অলৌকিক অতিলৌকিক ঘটনা সত্যিই কি ঘটে? না কি এসব অবচেতন মনের কারসাজি? বুদ্ধির অগম্য অভিজ্ঞতা কিন্তু থাকেই মানবজীবনের বাঁকে বাঁকে। মনে দোলাচলতা জন্মায়। একবার মনে হয়, এরকমটি অসম্ভব। পরক্ষণেই মনে হয়, ঘটনাটা সত্যি হতেও পারে। অলৌকিক রসের গল্পে বরাবরই মজেছে বাঙালি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে উঠে আসা অলৌকিক গল্পের স্বাদই আলাদা। তাঁর বিচিত্র ও সার্থক সাহিত্যজীবনের প্রথম গল্প ‘প্রেতপুরী’ একটি অলৌকিক কাহিনি। এই গল্পেই ভূতজ্ঞানী বরদার আবির্ভাব। অনেকগুলি ভূতের গল্পই বরদার কাহিনি। মুঙ্গের ও বিহারের গ্রামাঞ্চলের পটভূ্মিকায় বরদা ভূতের কাহিনি বলত চমকপ্রদ ঢঙে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অলৌকিক গল্পগুলি নিয়ে প্রকাশিত হল ‘অলৌকিক গল্পসমগ্র’। ভাষার সৌন্দর্যে, পরিবেশ রচনার মুনশিয়ানায় এবং অদ্ভুত রসের পরিবেশন-দক্ষতায় একত্রিশটি গল্পই অন্যমনস্ক হতে দেয় না একমুহূর্ত। অলৌকিকের মধ্যে মানবিক রস মিশে স্থায়ী অভিঘাত তৈরি করে হৃদয়ে। বহু-প্রতীক্ষিত এই সংকলন পাঠকের জন্য বিশেষ আনন্দ-উপহার।
Sharadindu Bandyopadhyay (Bengali: শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়; 30 March 1899 – 22 September 1970) was a well-known literary figure of Bengal. He was also actively involved with Bengali cinema as well as Bollywood. His most famous creation is the fictional detective Byomkesh Bakshi. He wrote different forms of prose: novels, short stories, plays and screenplays. However, his forte was short stories and novels. He wrote historical fiction like Kaler Mandira, GourMollar (initially named as Mouri Nodir Teere), Tumi Sandhyar Megh, Tungabhadrar Teere (all novels), Chuya-Chandan, Maru O Sangha (later made into a Hindi film named Trishangni) and stories of the unnatural with the recurring character Baroda. Besides, he wrote many songs and poems.
Awards: 'Rabindra Puraskar' in 1967 for the novel 'Tungabhadrar Tirey'. 'Sarat Smriti Purashkar' in 1967 by Calcutta University.
গৎবাঁধা ভূতের গল্প পড়তে খুব একটা ভালো লাগে না। কোনো ভূতের গল্পে ভয় বা চমক কোনদিক থেকে আসছে না জানা থাকলে পড়ে আনন্দ পাওয়া যায়। শরবিন্দু'র অলৌকিক গল্প পড়ে আশাতীত আনন্দ লাভ করলাম।গা ছমছমে ভৌতিক গল্প আছে, হা হা করে হাসার মতো গল্প আছে, আছে এমনকি রোমান্টিক ভূতের গল্পও।কিছু গল্প একেবারেই প্রথাগত, বেশকিছু গল্প দুর্দান্ত। ভৌতিক গল্পের পরিবেশ সৃষ্টিতে শরবিন্দু অনন্য না হলেও অনবদ্য। সূক্ষ্ম রসবোধ, ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গার মুগ্ধকর বর্ণনা, তৎকালীন মানুষের জীবনযাত্রার প্রাণবন্ত উপস্থাপন, বিস্ময়কর সব মোচড়, লেখকের মজলিশি গদ্য, ভূতজ্ঞানী বরদা - সব মিলিয়ে জম্পেশ একটা সংকলন।
বাংলা অলৌকিক কাহিনির জগতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় একমেবাদ্বিতীয়ম বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হবে না। ভয়াল রসের ক্ষেত্রে মোটামুটি যেক'টি ধারাকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি, তার মধ্যে একমাত্র 'কসমিক হরর' আর 'ক্রিয়েচার ফিচার' ছাড়া প্রায় সব নিয়েই তিনি গল্প লিখেছেন— একটি বা দু'টি করে। কিন্তু সেই সামান্য ক'টি লেখাই আমাদের মনে এমন ছাপ ফেলেছে যে পরবর্তী অর্ধশতক বা তারও বেশি ধরে যাবতীয় গল্পকারের প্রয়াস পরখ করার কষ্টিপাথর হয়ে উঠেছে তারা। শুধু আবহ-নির্মাণ, মনস্তত্ত্বের গূঢ় প্রয়োগ, বা চরিত্র-চিত্রণে নয়, শরদিন্দু বাংলা অলৌকিক সাহিত্যকে এমন দু'টি জিনিস দিয়েছেন, যা অতুলনীয় বললেও কম বলা হয়। তারা হল~ ১) ভাষা— যা সরসতা ও প্রজ্ঞার এক অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটিয়েছে; ২) ভূতান্বেষী বরদা— যাঁর মাধ্যমে বাঙালি আজও ছুটে চলেছে ভূতের অস্তিত্বের সন্ধানে। এই লেখাগুলো শরদিন্দু অমনিবাসের পঞ্চম খণ্ডে হাস্যরসাত্মক গল্পগুলোর সঙ্গে পড়তে পারেন। আবার আনন্দ-র সানন্দে শোষণ প্রকল্পে গ্রাহক হয়ে আলাদাভাবে একগাদা টাকা গচ্চা দিয়েও এই বইটা কিনতে পারেন। সেটা, নেহা ধুপিয়া স্টাইলে, আপনার চয়েজ। তবে গল্পগুলো পড়া কিন্তু অত্যাবশ্যক।
শুরু করার আগে ভেবিছিলাম শংকু সমগ্র-এর মতো রয়ে সয়ে পড়বো। তা আর হলো না। দুই দিনেই শেষ হয়ে গেলো। অধিকাংশ গল্পই কিছু রহস্য রেখে শেষ করা হয়েছে। সম্পাদকের ভাষায় ❝…কলা বৌয়ের ঘোমটার আবরণ সরাতে চাওয়াটা যেমন অযৌক্তিক এবং অশোভন তেমনি অলৌকিক অতিলৌকিক কাহিনীর সম্পূর্ণ বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা চাওয়াটা অযৌক্তিক ও অপরিণত মননের পরিচায়ক।❞ তাই আম্ব আর 'অমূল্য' এর মতো নিরস প্রশ্ন তুলিনি গল্পের শেষে। ব্রেনের লজিকাল পার্ট কে হাইবারনেশনে পাঠিয়ে গল্প পড়ার আনন্দেই গল্প পড়েছি। দুই একটি ছাড়া বিশেষ করে ভূতান্বেষী বরদার গল্পগুলো খুবই উপভোগ্য ছিল।
ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত সাহিত্যের প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয় ছোটোবেলায় সেবা প্রকাশনীর বই পড়ে। পর্যায়ক্রমে কিংবদন্তী সাহিত্যিক ও বাংলা অতিপ্রাকৃত সাহিত্যের পথিকৃৎ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতিপ্রাকৃত গল্পসমূহের সাথে পরিচয় যা এই জনরাতে আমার ভালো লাগা আরও বিস্তৃত করে। বেশ কিছু গল্প আগেই সানডে সাসপেন্সের উছিলায় শোনা হয়েছিল।
শরবিন্দুর লেখায় ভৌতিক পরিবেশ ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা অসাধারণ। এমনিতে ছোট ছোট গল্প। খুব একটা ভয় জাগানো কোন গল্প পাইনি। তবে কিছুটা থ্রিল ছিলো, উপভোগ্য ছিলো গল্পগুলো। সময় কাটানো যায় ভালো।
বাংলা সাহিত্যে ভৌতিক লেখনীতে আমি বিভূতিভূষণের পরপরই যাঁকে রাখি তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কিছু হরর আমি এমনভাবে আত্মস্থ করেছি যে আমৃত্যু স্মৃতিতে থাকবে। যেমন - ভূতান্বেষী বরদাকে কেন্দ্র করে লেখা 'প্রতিধ্বনি', 'বহুরূপী' এবং গ্রামবাংলার প্রচলিত ডাইনি/রক্তচোষাকে নিয়ে লেখা 'কামিনী'। লেখাগুলো আগেও পড়েছি, এবারও সাগ্রহে পড়লাম, ভবিষ্যতেও পড়ব।
মোট ৩১ টি ছোটগল্পের সমাহার। সবগুলো একই ধাঁচের না। একই ক্যাটাগরিরও না। শরদিন্দুর অদ্বিতীয় সৃষ্টি মুঙ্গেরের ক্লাবে চুনী, অমূল্যদের শ্রদ্ধাভাজন ভূতান্বেষী বরদাকে নিয়ে আছে মোট বারোটি গল্প। প্রথম গল্প প্রেতপুরী - শরদিন্দুর ষোল বছর বয়সে লেখা। এরপর রয়েছে রক্ত খদ্যোত, টিকটিকির ডিম, অশরীরী, মরণ ভোমরা, বহুরূপী, প্রতিধ্বনি, দেহান্তর, সবুজ চশমা, আকাশবাণী, নীল কুঠি ও মালকোষ। আগেই বলেছি বহুরূপী খুব প্রিয়। বরদার বাদবাকি গল্পগুলি গুল বলে চালানো গেলেও এই গল্পটিতে সরাসরি ভূতের আবির্ভাব ঘটিয়ে শরদিন্দু দেখিয়েছেন যাহা কিছু রটে তাহা কিছু বটে।
একই কথা খাটে প্রতিধ্বনির ক্ষেত্রে। রবিঠাকুরের ক্ষুধিত পাষাণের একটা ভাইভ আছে গল্পটিতে। প্যারানরমাল হরর।
তবে বরদার সব গল্পকে টক্কর দিয়েছে 'অশরীরী'। atmospheric horror, সাথে অপার্থিব অশরীরির উপস্থিতি। আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প। এন্ডিংটাও গায়ে কাঁটা দেয়ার মতই।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। মারাঠা, গুজরাট, রাজপুতনার ইতিহাস তাঁকে ভীষণভাবে টানতো। বিহারের পাশাপাশি পুনাতেও জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছেন। সেই ইতিহাসপ্রিয় মনোভাব ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লিখেছেন প্রত্নকেতকী, সতী, মধুমালতী ইত্যাদি।
এদিকে পুনর্জন্মের ওপরও ছিলো অগাধ বিশ্বাস। এই টপিকে লেখা হয়েছে - প্রত্নকেতকী (রাজস্থানের কোনো এক ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের অতীত ইতিহাস ধরা দেয় হাওয়া বদলাতে আসা একজোড়া স্বামীস্ত্রীর সামনে), গুহা (পরিত্যক্ত গুহায় আদিম যুগের দ্বন্দ্বযুদ্ধের পুনরাভিনয়), দেখা হবে (গা ছমছমে লেখায় স্বামী স্ত্রীর মৃত্যু পরবর্তী পুনর্মিলনের কাহিনী), মায়া কুরঙ্গী (ইলোরা গুহাচিত্রে নিযুক্ত এক কামাসক্ত ভিক্ষুর কাহিনী), চিরঞ্জীব (ঠিক পুনর্জন্ম নয়, তবে এমন একজনের কাহিনী যে যুগে যুগে অমর)। এদের মাঝে 'দেখা হবে' পড়লে সত্যিই গায়ে কাঁটা দেয়। বিশেষ করে মৃত্যু শিয়রে রেখে লেখকের বন্ধু-পত্নীর বলে যাওয়া সেই শেষ বাক্য - "একশিলা নগরে আবার দেখা হবে"!
'নিরুত্তর' বেশ ভালো একটি গল্প। রিটায়ার্ড পুলিশ কর্মকর্তার কাহিনী যে কিনা কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে প্রতিবার প্রাণে বেঁচে যায়। 'কামিনী'র কথা আগেই বলেছি। আরবান লিজেন্ডের ওপর বেস করে লেখা, গা শিউরে ওঠা গল্প। হালকা হরর হালকা রোমান্স আর হালকা ফ্যান্টাসি নিয়ে লেখা - শূন্য শুধু শূন্য নয়। সেই এইচ জি ওয়েলসের 'দি ইনভিসিবল ম্যান' এর পুরনো মদ শরদিন্দুর রোমান্টিক বোতলে!
ভূত-ভবিষ্যৎ যতটা না ভয়ের তার চেয়ে বেশি কমেডি। হাস্যরসের গল্প। এক হতোদ্যম দেনাগ্রস্থ লেখকের ভূতের পাল্লায় পড়া ও ভূতের অনুরোধ�� কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে উদ্ধার করা! গল্পটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মুভি হয়েছে।
সবমিলিয়ে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অলৌকিক গল্প সমগ্র'কে আমি দিবো ৪/৫। রিডার্স ব্লক কাটাতে দারুণ সাহায্য করেছে বইটা।
টোটাল ৩১টা অলৌকিক গল্পের সংকলন। কোনো সংকলনে যেটা হয়, সাধারণত গুটিকয়েক গল্প ভালো লাগে, বাকিগুলো খুব একটা ভালো লাগে না। কিন্তু এই সংকলনে ঘটেছে তার উল্টো। খুব একটা ভালো লাগেনি, এমন গল্পের সংখ্যা এই সংকলনে খুব কম।
প্রায় প্রত্যেকটা গল্পই খুব ভালো লেগেছে; অলৌকিক গল্পের যে বড় একটা বৈশিষ্ট্য, শেষে কী হলো, সে বিষয়ে পাঠককে দ্বিধায় ফেলে দেয়া, তা আছে। আমার কাছে সেরা গল্প 'শূন্য শুধু শূন্য নয়'। বাংলা ভাষার প্রথম সুপারহিরোর গল্পও বলা যায় কি এটিকে?
বইটাতে গল্পগুলো রচনাকাল হিসেবে বিন্যাস্ত মতা হয়েছে। ফলে ভৌতিক গল্পের লেখক হিসেবে শরদিন্দুর পরিবর্তনটা অনুভব করা যায়। মোট ৩১ টা গল্পের ৪০% গল্প ভালো লেগেছে, ৩০% খুব ভালো লেগেছে, ৩০৳ খারাপ লাগেনি। বইটার সাথে সময় খুব ভালো কাটলো। অন্য বইগুলোর মাঝে মাঝে পড়ব ভেবেছিলাম, কিন্তু লেখা এত সুন্দর যে ছেড়ে ওঠা যায় না। ফেলু মিত্তিরের ভাষায় 'আনপুটডাউনেবল'।
The effort writer had to put it on the book with some miraculous stories are appreciable. Doing this kinds of stuffs at the time of his period which is really challenging. Although Sharadindu Bandyopadhyay passed the task.
শরবিন্দুর লেখায় ভৌতিক পরিবেশ ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা অসাধারণ। এমনিতে ছোট ছোট গল্প। খুব একটা ভয় জাগানো কোন গল্প পাইনি। তবে কিছুটা থ্রিল ছিলো, উপভোগ্য ছিলো গল্পগুলো। সময় কাটানো যায় ভালো।