আমরা অনেকেই হয়ত একটি কথা শুনেছি। মুক্তচিন্তার চর্চাকারী এ দেশের একজন জনপ্রিয় সাহিত্যিক ও পদার্থবিদও সেই কথাটি তাঁর কলমে তুলে ধরেন, ‘ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস, কাজেই ধর্মগ্রন্থে যা লেখা থাকে সেটাকে কেউ কখনো প্রশ্ন করে না, গভীর বিশ্বাসে গ্রহণ করে নেয়। বিজ্ঞানে বিশ্বাসের কোন স্থান নেই।’
আসলেই কি তাই? স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস কি শুধুই কুহেলিকা? এই বিশ্বাস কি প্রমাণহীন অন্ধ বিশ্বাসের ন্যায়? কেবলই শৈশবে পিতামাতা কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া কোন বোঝা?
আর অপরদিকে বিজ্ঞান কি কেবলই তথ্যপ্রমাণ নির্ভর? এখানে কি কোন বিশ্বাসের স্থান নেই? সত্যিই কি আমরা বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি? বিবর্তনবাদ কি সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের মতোই নিশ্চিত কোন বিষয়?
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, মানব মন মাত্রই বিশ্বাস। জীবনের শুরু থেকেই সে কোনো না কোনো বিশ্বাস নিয়েই জন্মে। হয় সে বিশ্বাস থাকে, না হয় livings and surroundings দ্বারা পরিবর্তিত হয়। বিশ্বাসের অনেক ধরণ রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে সবথেকে আদি বা মূল হলো basic belief, যা মানুষ মনের অজান্তে কোনো প্রমাণ ছাড়াই নিজের মধ্যে স্থাপন করে। কারণ সেটা axiomatic (স্বপ্রমাণিত), প্রমাণ করার কথা কেউ চিন্তাও করেনি। অবজ্ঞার ভাষায় একগোষ্ঠী যাকে বলে "অন্ধ বিশ্বাস"। স্রষ্টায় বিশ্বাস হলো এমনই এক মৌলিক বিশ্বাস। যাকে প্রমাণ করার প্রয়োজন পড়ে না।
কিন্তু যারা আজকে নিজেকে অত্যাধিক পরিমাণ "বিজ্ঞানমনষ্ক" ভাবছে, যারা এই মৌলিক বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ছে, আমাদের "অন্ধবিশ্বাসী" আর poor ভাবছে বা বলছে, তারা নিজেরাও জানেনা যে তারা নিজেরাও অন্ধবিশ্বাসে আবদ্ধ। সেটা হলো নিজের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস। কখনো এই অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়েনি। ছোট থেকেই যা দেখে আসছে বিশ্বাস করে আসছে। প্রমাণ করার প্রয়োজন মনে করেনি। কিংবা প্রয়োজন মনে করলেও কোনো প্রমাণ মিলাতে পারেনি।
আমরা কি পৃথিবীতে আসলেই exist করছি? নাকি আমাদের ব্রেইনকে avatar, matrix, source code মুভির মতো অন্য কোথাও রেখে computer simulated করানো হচ্ছে? মৃত্যু কি জাস্ট সিমুলেশন বা ম্যাট্রিক্স থেকে বিচ্ছিন্ন করার পদ্ধতি, যার পর আমরা ফিরে যাবো আমাদের আসল ওয়ার্ল্ডে?
আশ্চর্য হলেও সত্য এতকিছু বের করতে পারলেও এখনো কেউ এটাই প্রমাণ করতে পারেনি যে, yes, we do exist. we are not in a matrix or in a super-simulated world. কিন্তু প্রমাণ মেলেনি বলে কি তারা নিজেরা অস্তিত্বহীনতায় ভুগেছে কেউ? ভুগেনি। আর ভুগবেও না। তাহলে স্রষ্টাকে নিয়ে কেন এত প্রশ্ন? এত বিতর্ক?
বইটা ইতোমধ্যে তিনবার পড়ে ফেলেছি। যতবারই পড়ছি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। চিন্তার অতল গহবরে পড়ে যাচ্ছি। যে বিজ্ঞানের পরিধি মাত্র ৪ (চার)%, যে বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল, সসীম, যে বিজ্ঞান এখনো আমাদের অস্তিত্বই প্রমাণ করতে পারে না, সেই বিজ্ঞানকে প্লাটফর্ম বানিয়ে কি করে আমরা স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিকূল নিয়ে প্রশ্ন তুলছি! বিতর্ক জমাচ্ছি!
বইয়ের যত রেফারেন্স আছে সবগুলো পড়ার চেষ্টা চলছে। ইনশাআল্লাহ আরো জানবো।
এই বইটা নিয়ে বিস্তারিত একটু না বললেই হচ্ছেনা। আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে লেখকের ‘অ্যাপ্রোচ’ টা। এর তিনটি দিক আমার অসাধারণ লেগেছে – ১) লেখক শুরু করেছেন ওনার ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়ে। আমার মতে এটা খুবই জরুরী। অনেক সময়েই পাঠকরা যেকোনো লেখাকে face value তে বিচার করেই গ্রহন করে নেয়; লেখকের perspective টা লক্ষ্য করেনা। এতে দুটো গুরুতর ক্ষতি হয়- প্রথমত, অনেক বক্তব্যের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত বোঝা যায়না দ্বিতীয়ত, লেখনীর প্রভাব টা তার উপর ঠিকই পড়ে সেটা সচেতন / অবচেতন যেভাবেই হোক না কেন যদিও পাঠক তা ধরতে পারেনা। এছাড়া, লেখক অনেক বিজ্ঞানীকে উদ্ধৃত করবার সময় তাদের নামের পাশে বন্ধনীতে তাদের বিশ্বাস/ জীবনদর্শন উল্লেখ করেছেন। আমি এটাকে বক্তব্যের দাবী প্রমাণে খুবই প্রয়োজনীয় একটা কাজ বলেই মনে করি।
২) লেখক পাঠককে আর্গুমেন্টটা পেশ করেছেন সহজবোধ্য ‘বেসিক বিলিফ’ আর ‘ফাংশনাল রিজনিং’ দিয়ে গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে । আর এর কারণটাও উনি উল্লেখ করেছেন খুব সুন্দর করে – “সত্য এমন হওয়া প্রয়োজন যা সকলেই বুঝতে পারে”। এই ব্যাপারটা আমিও ভাবতাম। আপনাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি, যখন আমি ‘স্রষ্টা’-র অস্তিত্ব অস্বীকার করা শুরু করেছিলাম, তখন আমি অযথা কমপ্লিকেট চিন্তাভাবনা করে বাস্তবতা এড়িয়ে গিয়ে জ্ঞানীর ভান করছিলাম। নিজের মনে ‘ভান’ টা টের পেলেও বাস্তবতা এড়ানোটা টের পেয়েছিলাম আরও পরে। আরেকটা ব্যাপার আমার মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করত- ‘সত্য’ কেন এমন হবে যে কিছু বিশেষ শ্রেণীর মানুষ না হলে তা বুঝা যাবেনা। কেন পৃথিবীর মহাসত্য কেবল কিছু মানুষ অনুধাবন করবে আর বাকিরা এই জায়গায় এসে নগন্য অবুঝ হয়ে যাবে। সেই ভাবনার ব্যক্তিগত সমাধান আমি পেয়েছিলাম ‘the God question’ -এর উত্তরে। বইটি পড়ে তাই আরও আশ্বস্ত হলাম। এরপর, ডিডাকটিভ রিজনিং/ সিলজিসম আমাদের মাঝে যারা বুঝবেনা, ‘অস্তিত্বের সত্যতা’ যে কোনরকম পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন ছাড়াই একদম মৌলিক সহজ একটা সত্য- এটা তাদের কাছে কিভাবে তুলে আনা যেতে পারে- এই ব্যাপারে আমার প্রশ্ন ছিল। এই বইয়ের ‘ফাংশনাল রিজনিং’ অধ্যায়ে এসে আমি উত্তরটা পেলাম পাশাপাশি এই স্বতঃস্ফূর্ত সত্যগুলো কেমন ধরণের বিশ্বাস এবং এগুলোর একাডেমিক সঙ্গায়নের ব্যাপারেও স্পষ্ট ধারণা পেলাম।
৩) তাছাড়া লেখক সবচেয়ে বেশি ফোকাস রেখেছেন- ‘স্রষ্টায় বিশ্বাস মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য এবং এটা খুবই যৌক্তিক' এই দাবির উপর। ফোকাস স্থির রেখেই লেখক এই দাবিকে কেন্দ্র করে প্রচলিত science আর scientism এর ব্যবধান তুলে ধরেছেন। একইসাথে উনি বিজ্ঞানের প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতার উপরও মোটামুটি আলোকপাত করেছেন। আর প্রাসঙ্গিকভাবে বিবর্তনের ব্যাপারে scientism -এ আক্রান্ত অপপ্রচারকারিদের ইচ্ছাকৃত লুকোছাপাগুলো -ও তুলে ধরেছেন। সত্যিই scienceএর জগতে সত্য এক রকম, আর প্রচলিত সাধারণ বিশ্বাস সর্বগ্রাসী মিডিয়া প্রচারণায় দুম্ড়ে-মুচড়ে scientism এর জগতে এনে সেটাকে কতটা বিকৃত আর ক্ষতিকর করে তুলে, তা অবাক করার মত। আর পুরো কাজটি লেখক যেসব বিজ্ঞানীদের উদ্ধৃত করে করেছেন, তাদের বক্তব্যগুলোই এদেশের তথাকথিত 'বিজ্ঞানমনস্ক/ মুক্তমনা/ মুক্তচিন্তা' ট্যাগ নিয়ে চলা scientism আক্রান্ত intellectually dishonest লোকেদের চিন্তার পক্ষপাতিত্ব, বিজ্ঞানীদের বক্তব্যকে আংশিক করে তুলে এনে ভুলভাবে উপস্থাপন করা এবং বিজ্ঞানের কর্মপ্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে যাওয়ার যে অসৎ প্রবণতা- সেই মিথ্যাশ্রয়ী বিবেককে সত্য দিয়ে চপেটাঘাত করার জন্য যথেষ্ট। আর দিনশেষে যদি তবুও কারো ভাবনার উদ্রেক না হয়, তাহলে এই বইয়ের 'ফিরে দেখা' অধ্যায়ের শেষ লাইনটির মতই লেখকের সুরে বলতে হয়- ''আপনি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে বোকা বানাচ্ছেন না''
আমার কাছে বইটা সত্যিই অনেক ভালো লেগেছে। আশা করছি লেখক philosophy of natural science, limitations of science এবং scientism – এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও সুন্দর কিছু লেখা উপহার দিবেন।
যারা সততার সাথে সত্যিসত্যি ‘সত্য’ কে খুঁজে পেতে চায়, এই পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব আর বিশ্ব-মহাবিশ্বের সুনিপুণ বিশালতার মাঝে জীবনের উদ্দেশ্যের সমীকরণ খুঁজতে চায়, তাদের সেই অনুসন্ধানের পথে এই দারুণ বইটি একটা মাইলফলক হবে।
"আমরা স্রষ্টায় এ কারণে বিশ্বাস করি না যে আমরা যুক্তি খাটিয়ে তা বের করতে পারি। যোক্তিক চিন্তা করার ক্ষমতার কাজ হল, ফিতরাহ্কে জাগিয়ে তোলা। যাদের এই প্রকৃতি ঘোলাটে বা বিক্ষপ্ত হয়ে গেছে, তাদের মাঝে বিদ্যমান সহজাত এই প্রকৃতিকে আবারও প্রজ্জ্বলিত করা" - বিশ্বাসের যৌক্তিকতা, পৃ- ২৭
মাস্টারপিস এক বই। নাস্তিক বা সংষয়বাদীদের জন্যে চিন্তার অনেক খোরাক রয়েছে ছোট্ট এই বইটিতে। আর বিশ্বাসীদের জন্যে রয়েছে নিজের ঈমানকে মজবুত করার মত অনেক সম্পদ।
আস্তিকতা- নাস্তিকতা- ধর্ম এবং বিজ্ঞান নিয়ে অনলাইনে রাফান আহমেদের কিছু লেখাজোখা পড়া হলেও তার গোটা একটা বই কখনো পড়া হয় নাই। অনলাইনে তার লেখনি, যুক্তি বেশ প্রমিজিং মনে হয়েছে পড়ে। সে অনুযায়ী বেশ এক্সপেক্টেশন নিয়ে শুরু করেছিলাম বইটা। আস্তিকতা কিভাবে বিজ্ঞানসহ সবদিক থেকে যৌক্তিক তা নিয়ে লেখা বই। পড়া শেষে বলা যায়, সম্পূর্নভাবে হতাশ হয়েছি।
মিডিওকোর লেখনি, দুর্বল লজিক আর অগভীর আলোচনায় এটা কোন বই ই হয়নি। একেকটা চ্যাপ্টার এক পৃষ্ঠা- দু পৃষ্ঠা করে। একটা টপিকে যে রয়ে সয়ে বিস্তরভাবে-বড় কলেবরে ইন ডেপথ আলোচনা হবে এমনটা কোথাও ছিলো না। কোন টপিকেই আলোচনা পূর্নতা পায়নি। এই ইস্যুতে দু লাইন না বলতেই অন্য ইস্যুতে দুই লাইন... এভাবে করে আধখ্যাচড়া একটা লেখায় দাড়িয়েছে বইটা। আর হবেই বা কি করে। আস্ত বইটা মোটে আশি পৃষ্ঠা। আবার এই আশি পৃষ্ঠার এক তৃতীয়াংশই চলে গেছে বিভিন্ন বই, ওয়েবসাইটের রেফারেন্সের নির্ঘন্ট দিতে গিয়ে। ফেসবুকের লুতুপুতু রোমান্টিক কয়েকটা বড় গল্প যোগ করে দিলে এই বইয়ের সাইজে দাড়ায় যাবে।
বইয়ের পজেটিভ দিক বলতে পুরো বইয়ে মাত্র দু একটা লজিক গ্রহনযোগ্য লেগেছে। বলার মতো ইতিবাচক আর কিছু খুজে পাচ্ছিনা।
নেতিবাচক দিক বললে প্রথমে যেটা চোখে পড়েছে- আস্তিকতার পক্ষে লেখক তার ভাষ্য পোক্ত করতে বইজুড়ে অসংখ্য বিখ্যাত নাস্তিক এবং সংশয়বাদীদের কোট তুলে দিয়েছেন। কোটেশনগুলো পড়লে দেখা যায় নাস্তিকরা নাস্তিক হয়েও নাস্তিকতার বিরুদ্ধে বলছেন(!), কেউ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে কোন শক্তি নিশ্চিতভাবেই আছে বলছেন, কেউ সখেদে বলছেন বিবর্তনবাদে খুত আছে, বিষ্ময় প্রকাশ করছেন কি করে জড় পরমানু থেকে তৈরী দেহে আপনাআপনি চেতনা(আত্মা) চলে আসলো, কেউ বলছেন বিজ্ঞান অমুকের উত্তর দিতে পারে না, তমুকের উত্তর দিতে পারেনা...ইত্যাদি ইত্যাদি। ইভেন আস্তিকতার পক্ষে খোদ রিচার্ড ডকিন্সের একটা কোটও পেয়েছি বইয়ে!
এসব কোটেশন আলোচনায় সুংযুক্ত করার উদ্দেশ্য হলো লেখক নাস্তিক/সংশয়বাদী পাঠকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন 'এইযে দেখো, তোমাদের গুরুরাই বিশ্বাসের মাঝে যৌক্তিকতা খুজে পেয়েছেন, আস্তিকতার পক্ষেই কথা বলেছেন'।
লেখকের এই কৌশলটা আমার কাছে খুবই দুর্বল এবং কিছুটা হাস্যকর লেগেছে। ধরুন, আমি একটা চাকরি করি। নয়টা পাচটা ব্যস্ত সময় কাটে আমার, দম ফেলবার ফুসরত পাইনা, ফ্যামিলিকে সময় দিতে পারিনা। তো বন্ধুদের সাথে দেখা হলে আমি ক্লান্ত গলায় বলতেই পারি "ভাইরে চাকরি মানুষে করে না। এইটা কোন মানুষের জীবন না।" এখানে এই কথা দিয়ে কি মীন করছি আমি? আক্ষরিকভাবেই আমি চাকরি করতে অনিচ্ছুক? আসলেই আমি অসুখী চাকরি করে?
বিভিন্ন নাস্তিক তাদের বিভিন্ন বইয়ে এরকম ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট টাইপ কিছু কথা বলেছেন যেগুলা ইভেন ডিরেক্টলি নাস্তিকতাকে নাকচও করে দেয় না, তেমন কিছু বক্তব্য লেখক বইয়ে এনে জুড়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় ফাকটা যেটা তিনি ধরতে পারেন নি তা হলো যাদের বক্তব্য কোট করেছেন তারা যদি আস্তিকতার যৌক্তিকতায় সম্পুর্নরূপে আসলেই বিশ্বাস করতো তাহলে এখনো কেনো নাস্তিকই রয়ে গেলেন!
রিভিউএর এতোটুকু পড়ে মনে হতে পারে আমি বোধয় ঘোরতর নাস্তিক। না ভাই। আস্তিক এবং যৌক্তিক রুচির একজন পাঠক হিসেবে আমি চাই ধর্মকে যারা যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করবে, সেটা যেনো শক্তিশালী যুক্তির মাধ্যমেই করে। দুর্বল লজিকের লেখাজোখা যদি নাস্তিক সার্কেলে হাস্যরসের সৃষ্টি করে তাহলে ওরকম লেখার সমালোচনা বিশ্বাসীদের মধ্যে থেকেই আগে হওয়া উচিত আমি মনে করি।
যাহোক, পড়তে পড়তেই সন্দেহ হলো এটা লেখকের শুরু দিককার লেখা কিনা। কারন অনলাইনে পড়া তার লেখা আরো পরিনত ছিলো। ঘেটে দেখলাম সত্যিই তাই। এটা লেখকের প্রথম বই। দুই সময়ের লেখা তুলনা করে নিসঃন্দেহে বলা যায় তার লেখনি এবং ভাবনার গভীরতায় আরো উন্নতি হয়েছে। সেজন্য 'রাফান আহমেদ বাজে লেখক' এটা বলার অবকাশ পাচ্ছিনা। শুরুর দিকের অপরিপক্কতা হিসেবে এটা মেনে নেয়া যায়। তার পরের বইগুলা নিশ্চই সবদিক থেকে আরো গ্রহনযোগ্য হবে। তার অবিশ্বাসীর কাঠগড়ায় বইটা শিঘ্রি পড়বো।
যেহেতু বইটা পড়ে আমি নিজেই সন্তুষ্ট না, তাই কাউকে রিকমেন্ড করছিনা। সেক্ষেত্রে অন্য আরেকটা বইয়ের কথা বলে যাই সংক্ষেপে। রাফান আহমেদদের সার্কেলেরই আরেক লেখক আছে, আসিফ আদনান। তার লেখা বই 'চিন্তাপরাধ' একটা অসম্ভব অসম্ভব ভালো বই। এতো অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত যৌক্তিক আলোচনা আমি খুব কম বইয়েই পড়েছি। জীবনে অসংখ্য বই পড়া হয়েছে, তার মধ্যে খুব নগন্য সংখ্যক বই-ই আছে যেগুলো আমার দৃষ্টিভঙ্গী আর চিন্তা করার ধরনে পরিবর্তন আনতে পেরেছে। চিন্তাপরাধ সেই লিস্টের একদম উপরের দিকে থাকবে। LGBTQ, হোয়াইট টেরোরিজম, কলোনিয়াল এফেক্ট, নারী স্বাধীনতা, নৈতিকতার মানদন্ড... এসবকে ভিন্নভাবে ভাবতে শেখাবে বইটা। সবাইকে হাইলি রিমমেন্ডেড।
রাফান আহমেদ ভাইয়ের বিশ্বাসের যৌক্তিকতা বইটি আজ শেষ করলাম। যদি এক কথায় বলতে হয় তাহলে বলব বইটি নাস্তিকদের করা অভিযোগের একটি দাঁতভাঙ্গা জবাব।মানুষ জন্মগত অর্থ্যাৎ প্রকৃতিক ভাবে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসী।সৃষ্টিকর্তারপ্রতি মানুষের বিশ্বাস সহজাত।আজ যারা নাস্তিক তারাও একসময় স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু তাদের বেড়ে উঠার পরিবেশ,দৃষ্টিভঙ্গি,ভ্রান্ত মতবাদ,কুযুক্তি,অযুক্তি তাদের এই বিশ্বাসকে আস্তে আস্তে দুর্বল করে নাস্তিকে রুপান্তর করেছে।
নাস্তিকদের এই কুযুক্তি, অযুক্তির বিপরীতে সুযুক্তি দিয়ে রাফান ভাই নাস্তিকদের ঘোমটা খুলে দিয়েছেন।
বিজ্ঞান আর অপ বিজ্ঞানের দ্বন্ধটা, আসলেই যারা বিজ্ঞানী তাঁদের আর আমাদের তথাকথিত বিজ্ঞানবাজ ভন্ডদের দাবির মাঝখানে যে আলোকবর্ষ গ্যাপ,তা বুঝার জন্য বিশ্বাসের যৌক্তিকতা বইটি অনবদ্য। এই বইটির যেটা সবচেয়ে আকর্ষিত তা হল রেফারেন্স। তথাকথিত মুক্তচিন্তকরা যদি শুধু এই রেফারেন্সগুলো ধরে সত্যিকারের মুক্তচিন্তা করে তাহলে তাদের সকল চেতনা ধুয়েমুছে যাবে, তারা সত্যের সন্ধান পেয়ে যাবে।
বইটির শেষের পরিশিষ্টে বিবর্তনবাদ নিয়ে লেখাটি বিবর্তনবাদীদের একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছেন।বিবর্তনবাদীদের অসারতাগুলো রেফারেন্স সহ ভেঙ্গে ভেঙ্গে বুঝিয়ে দিয়েছেন।বিবর্তনবাদ যে সেক্যুলারদ���র আবিষ্কৃত আরেকটি ধর্ম সেটা তুলে ধরেছেন।
আসা করব আমাদের মুক্তচিন্তকরা মুক্তমন নিয়ে বইটি পড়বে।
আর বইটি বিশ্বাসীদের ফিতরাহকে, বিশ্বাসীদের বিশ্বাসকে আরো প্রজ্জ্বলিত করবে, আরো শাণীত করবে।
"স্রষ্টা যদি সবকিছু সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করেছে?" 'স্রষ্টাকে কেউ না কেউ অবশ্যই সৃষ্টি করতে হবে', এই যাদের মোক্ষম যুক্তি, সেই নাস্তিকরাই 'এই মহাবিশ্বের কোনো স্রষ্টা থাকা সম্ভব না' বিশ্বাস করাকেই যৌক্তিক মনে করে। স্রষ্টা যে এই তুচ্ছ সৃষ্টি প্রক্রিয়ার উর্ধে এটা মানতে তাঁদের অহমিকায় আঘাত লাগে। 'গড অব দ্য গ্যাপ্স' তাঁদের কাছে হাস্যকর মনে হয়, অথচ 'শূন্য' থেকে এই তাবৎ মহাবিশ্বের সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে এবং সুচারুরূপে অসংখ্য নিয়মের ভারসাম্য রক্ষা করে টিকে আছে সেটাই কিনা তাঁদের বিশ্বাসের ভিত্তি। যেই বিজ্ঞানের মোলিক বিধানই হচ্ছে যে, 'বিজ্ঞান কোনো কিছুকে পরম সত্য বলে না, বলতে পারে না', বিজ্ঞানের সূত্রগুলো কোথা থেকে কীভাবে আসলো সেটা ব্যাখ্যা করা বিজ্ঞানের জন্য অসম্ভব- সেই বিজ্ঞানের বাটখারায় স্রষ্টার অস্তিত্ব মেপে নিজেদের জ্ঞান জাহির করা যে একেবারেই মূর্খতা সেটা বোঝার মত জ্ঞান কি এই নাস্তিকদের আদৌ হবে না? যুক্তি আর বিজ্ঞানকে যারা নিজেদের ধর্ম বানিয়ে স্রষ্টার আসনে বসিয়েছে এই বই তাঁদের জন্য এক মোক্ষম জবাব। বিজ্ঞানের বুলি আউড়ে আর সস্তা যুক্তি বেঁচে খাওয়া নাস্তিকদের কথায় যারা মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হন, তাঁদের জন্যও এই বই পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ন।
প্রায় প্রতি পূর্ণিমারাতে আমরা দুই বন্ধু হ্যাংআউটে বের হই। আমি সংশয়ের দোলাচলে দুলছি স্রষ্টা, ঈশ্বর, আল্লাহ এসব নিয়ে। আদৌ কি এই পৃথিবীর স্রষ্টা আছেন? আছেন কোনো নিখুঁত ডিজাইনার? আমার পরিবারে একটা কথা প্রচলিত আছে। কেউ যখন প্রত্যাবর্তন করে সত্যের দিকে, তখন সে বেশ কঠিনভাবে সত্যকে আঁকড়ে ধরে। মাঝেমধ্যে ভয় পেয়ে যাই এসব কথা শুনে। আমার বিশ্বাস কি আদৌ সত্য? নাকি অন্যদের স্রষ্টাতত্ত্ব সত্য?
চাঁদটা আজ বেশ উজ্জ্বল। কৃত্রিম আলোর যে কোনো প্রয়োজন নেই, তা বেশ ভালোভাবেই জানান দিচ্ছে। বসে আছি বাড়ির ধারের মাঠের এক কোণে। সাথে আমার বন্ধু শরীফ। হ্ঠাৎ করেই ওকে প্রশ্ন করা শুরু করলাম।
- "আচ্ছা শরীফ! আমার কয়েকটি প্রশ্ন। আমাদের স্রষ্টা বলতে আদৌ কি কেউ আছেন? যেখানে আমরা শূন্য থেকে এসেছি, সেখানে স্রষ্টাতত্ত্বটা কি মেনে নেয়া যায়? ম্যাট্রিক্স থিওরি তাহলে কি? আমরা যে পরাবাস্তব জগতে নেই, তার শক্ত প্রমাণ কী?
বিজ্ঞান তো সবই আবিষ্কার করে ফেলেছে। বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে গিয়েছে যে, একসময় স্রষ্টাকে আবিষ্কারের পর্যায়ে চলে যাবে। তাহলে বিজ্ঞান বাদ দিয়ে অন্যদিকে যাবো কেনো? 'আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়...' এটাতো জানি। তাহলে শুধু শুধু অদেখা বিষয়ে বিশ্বাস করবো কেনো? যা দেখিনা, তা বিশ্বাস করা অযৌক্তিক। একজন মানুষ হিসেবে অযৌক্তিকতা মানায় না।" এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলাম।
- তোর কথা শেষ হইছে? হয়ে থাকলে এবার আমার কথা শোন। হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস।বাংলাদেশের মুক্তমনা দুইজন লেখক বইয়ে লিখেছেন "...আধুনিক বিজ্ঞান এখন যে জায়গায় পৌঁছে গেছে ঈশ্বর বলে কিছু থেকে থাকলে কোনো না কোনভাবে বিজ্ঞানের চোখে তা ধরা পড়ার কথা ছিলো...'' (অবিশ্বাসের দর্শন, পৃষ্ঠা:১২, ঢাকা, শুদ্ধস্বর প্রকাশন)। কিন্তু ডার্ক এনার্জির ধারণা আবিষ্কারের জন্য ২০১১ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া দলের একজন, প্রফেসর অ্যালেক্সে ফিলিপ্পেনকো এক সাক্ষাতকারে বলেন, "...আমি মহাবিশ্বকে একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করতে চাই ... কোন অতিমানবিক বা স্বকীয় স্রষ্টা আছেন কিনা বা এই মহাবিশ্বের কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা সে বিষয়ে আমি কিছু বলব না- এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বিজ্ঞানীরা দিতে পারেনা...।" (https:/www.rt.com/news/univers-physics-laws-...) - আরেকটা জিনিষ জানিস? ডক্টর জাফর ইকবাল স্যার কিন্তু উনার বইয়ে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন এই প্রকৃতির সব কিছুই বিজ্ঞান কখনোই জানতে পারবে না। - 'বিজ্ঞানীরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছেন যে, প্রকৃতি আসলে কখনোই সবকিছু জানতে দেবে না, সে তার ভেতরের কিছু-কিছু জিনিষ মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। মানুষ কখনওই সেটা জানতে পারবেনা- সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে এটা কিন্তু বিজ্ঞানের অক্ষমতা বা অসম্পূর্ণতা নয়। এড়াই হচ্ছে বিজ্ঞান। (কোয়ান্টাম মেকানিক্স, ড. জাফর ইকবাল, পৃষ্ঠা: ১০, ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স) - আচ্ছা! মানলাম তোর কথা, বিজ্ঞান সবকিছু আবিষ্কার করতে পারেনা। এবার তবে বল, স্রষ্টার প্রতি ভীতি কি পরিবার জোর করে ঢুকিয়ে দেয় না? এটা কি ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়? - ও এই কথা! এটা হচ্ছে একটা মৌলিক বিশ্বাস। যেহেতু মুসলিম পরিবারে জন্মেছিস, ইসলামিক পরিভাষা কিছু হলেও জানিস। 'ফিতরাহ' বা বুনিয়াদি বিশ্বাস সম্পর্কে জানিস? স্রষ্টার প্রতি ভয় কিন্তু প্রতিটি শিশুর জন্মগত বৈশিষ্ট্য। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিস কেনো? - অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজিস্ট ড. জাস্টিন এল. ব্যারেট শিশুদের উপর গবেষণা করেন। এ ব্যাপারে বেশকিছু বইও লিখেছেন তিনি। বইগুলোর মধ্যে একটি হলো "বর্ন বিলিভার্স"। যেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, "... শিশুরা জন্মগতভাবে বিশ্বাসী, যাকে আমি বলি 'সহজাত ধর্ম'..." (Dr. Justine L. Barrett, Born Believers: The Science of Children's Religious Belief; Page: 136, Simon and Schuster, Mar 20, 2012) - অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের (নাস্তিক) মনোবিজ্ঞানী ড. অলিভেরা প্যাট্রোভিচ Peer Reviewd জার্নালে তাঁর গবেষণার ফল জানান, "কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস যে সার্বজনীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে (যেমন কোন বিমূর্ত সত্তাকে বিশ্বজগতের স্রষ্টা হিসেবে মৌলিক বিশ্বাস), এর (স্বপক্ষে) শক্তিশালী প্রমাণ ধর্মগ্রন্থের বাণীর চেয়ে বরং (বৈজ্ঞানিক) গবেষণা থেকেই বেশি বেরিয়ে আসছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।" (https://doi.org/10.2298/PSI0703351P) -
দেখলি তো এবার? বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মানুষ সহজাত ও স্বত:স্ফূর্তভাবে অদ্বিতীয় সর্বোচ্চ এক বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বাস গড়ে তোলে। আরো নিবি উদাহরণ? আচ্ছা বল। ভালো জ্ঞান নিতে তো আপত্তি নেই।
তাহলে শোন। ইয়েল ইউনিভার্সিটির আরেক নাস্তিক গবেষক পল ব্লুম তাঁর Peer Reviewd জার্নালে দেখিয়েছেন ঐশ্বরিক সত্ত্বার পাশাপাশি মানুষের যে মন বলে কিছুর অস্তিত্ব আছে, এ ধারণাও সহজাতভাবেই শিশুদের মাঝে উদ্ভূত হয়। (Paul Bloom, Religion is natural (2007), Journal of Development Science 10:1, Page: 147-151. DOI: 10.1111/j.1467-7687.2007.00577.x)
আজ তাহলে এ পর্যন্ত থাক। আরেকদিন কথা বলবো ম্যাট্রিক্স, পরাবাস্তব জগত, মৌলিক বিশ্বাস, বিজ্ঞান ও বস্তুবাদ, বিবর্তন এসবকিছু নিয়ে!
শরীফ যেনো আমার এতদিনের বিশ্বাসে প্রচণ্ড এক নাড়া দিয়ে গেলো। এখন আমাকে সন্ধান করতে হবে, কোন সে মহামহিম সত্তা? যার কল্যাণে এই চাঁদনিরাতে বসে বসে মুখর পরিবেশে করতে পারছি মনোমুগ্ধকর সব আলাপ। যে স্রষ্টার ডিজাইনে নেই কোনো ত্রুটি। কোন সে "এক" তুমি? তোমার সন্ধানে তবে শুরু হোক পবিত্র এক যাত্রা!
আমি নাহয় শরীফের কাছ থেকে বাকি বিষয়গুলো জেনে নিবো। কিন্তু আপনি? যদি এমন সংশয়ের দোলাচলে থেকে থাকেন, তাহলে পড়ে ফেলুন সংশয়বাদের কালো থাবা থেকে বেরিয়ে এসে আলোর পথে হেঁটে চলা এক পথিক, ডাক্তার রাফান আহমেদ ভাইয়ের "বিশ্বাসের যৌক্তিকতা" বইটি।
সবশেষে বইটি সম্পর্কে ডাক্তার শামসুল আরেফিন শক্তি ভাইয়ের অভিমতটি হুবহু তুলে ধরছি: "বিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের দ্বন্দ্বটা, আসলেই যারা বিজ্ঞানী তাঁদের আর আমাদের বিজ্ঞানবাজ বন্ধুদের দাবির মাঝে আলোকবর্ষের যে গ্যাপটা, তা বুঝার জন্য রেফারেন্সসহ এমন একটা বইয়ের বড্ড প্রয়োজন ছিলো। দু:খের বিষয় হলো, ওনারা আমাদের বই পড়েন না বা মন দিয়ে পড়েন না। অন্তত এই একটা পাতলা বই মন দিয়ে পড়ার আহ্বান। আসুন দেখি মনটা আসলেই কতটুকু মুক্ত। আর খণ্ডনের অপেক্ষায় তো সাজিদের আমল থেকেই আছি। (সুদীর্ঘশ্বাস)" - ডাক্তার শামসুল আরেফিন, এমবিবিএস (ঢাকা), বিসিএস (স্বাস্থ্য), লেখক- ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, কষ্টিপাথর; সহলেখক- প্রত্যাবর্তন।
''ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, কি নেই সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকারকারীদের মাঝে একদল তাদের বিশ্বাস অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। আবার অবিশ্বাসকারীদের একদলও তাদের বিশ্বাস চাপিয়ে দিতে চায় অন্যদের উপর। এই দুই দলই সমান ক্ষতিকর।"
'বিশ্বাসের যৌক্তিকতা' বইতে রাফান আহমেদ কিছু তথ্যপ্রমাণ উপাস্থাপন করেছেন আল্লাহর অস্তিত্ব প্রামাণে। লেখক বেশ কিছু যুক্তি দিয়েছেন, নানা তথ্য উপস্থাপন করেছেন। ছোট্ট এই বইটাতে তথ্যের চেয়ে আসলে তথ্যের সোর্স (ফুট নোট) বেশি। বাঁশের চেয়ে কুঞ্চি বড় ধরনের। তবে, লেখক বিভিন্ন সোর্স থেকে নানান রেফারেন্স একত্র করেছেন এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই পরিশ্রমের জন্যই লেখক কিছুটা প্রশংসার দাবীদার।
এবার আসি অন্য দিকে, এই বইটা পড়ার আগে মনে রাখতে হবে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা ইসলামের মূল ভিত্তি। এটি নিয়ে প্রশ্ন করা বা প্রমাণ চাওয়ার স্বাধীনতা ইসলাম আমাদের দেয় না। এটা মাথায় রেখে বইটি রচিত।
আবার মনে করেন, পৃথিবী যে সমতল (ফ্ল্যাট) এর পক্ষে আপনি লাখ লাখ প্রমাণ পাবেন। ঠিক তেমনটাই মনে হয়েছে এই বইটা। আর, বিবর্তনরে অধ্যায়টা তো পুরাই যা তা একদম।
বিবর্তনের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা তর্ক বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি বিবর্তন বলতে কেবল ডারউইর এর মতবাদ নিয়ে কচলাকচলি করে তার কাছে হয়ত বিবর্তন মানে 'বান্দর থেকে মানুষ হইছে'!
আরেকটা দৃষ্টিকটু বিষয় হচ্ছে, লেখক কিছু 'নাস্তিক' ব্যক্তির মতামত বা বক্তব্য কোট করেছে। তাদের নামের পাশে 'নাস্তিক' শব্দটা লেখক লিখে দেছেন। কিন্তু যারা আস্তিক, তাদের ক্ষেত্রে উনি এমনটা করেন নি। সাইকোলজিক্যাল এমন অনেক গেম লেখক খেলেছেন।
ওহ্, এই বইটার কিন্তু বাঁশের চে কুঞ্চি বড়। মোট পেজ ৮০, যার প্রথম ১৬ পেজ ভূমিকা, এর মতামত ওর মতামত। শেষ ১০ পেজ পরিশিষ্ট, নির্ঘণ্ট, প্রন্থপঞ্জী নাম।
আর গড়ে প্রতি পেজের এক তৃতীয়াংশ কেবল বিভিন্ন ফুটনোট।
পরিশেষে বলব, বইটা পড়তে চাইলে সময় নিয়ে বসবেন। লেখক কি বোঝাতে চেয়েছেন, তা ৪/৫ বার না পড়লে বুঝবেন না।
বইটি অত্যন্ত ছোট পরিসরের হওয়া সত্ত্বেও এতে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ কিছু আলোচনা করা হয়েছে। স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস যে কেবল কোনো অন্ধবিশ্বাস নয় কিংবা শৈশবের ইনডক্ট্রিনেশনের ফল নয়, এর সপক্ষে বিভিন্ন পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের মতামত, বইয়ের উদ্ধৃতি ইত্যাদি উপস্থাপন করে বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দারুণ একটা কাজ করেছেন লেখক রাফান আহমেদ। বইয়ের লেখাগুলো অধুনা বিজ্ঞানভক্ত মানুষজনের কাছে অত্যন্ত চমকপ্রদ হয়ে ধরা দেবে। এ ধরনের বই-ই বাংলাদেশে বইয়ের জগতে একটা বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছে সাম্প্রতিককালে, এই পরিবর্তন অব্যাহত থাকুক। এখানে লেখক ডেলিবারেটলি বইয়ের পরিসর ছোট রেখেছেন কি না জানি না। তবে তিনি যেসব গবেষণার ফলাফল উদ্ধৃত করেছেন, বিশেষ করে ফিতরাহ সম্পর্কিত অধ্যায়ে, সেসবের খানিকটা বিস্তারিত বর্ণনা করলে আরও ভালো হত। একারণেই তিন তারা।
বিশ্বাসের যৌক্তিকতা বইটি আমি ভেবেছিলাম মনে হয় এক ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের যৌক্তিক কিছু ব্যাখ্যা। কিন্তু বইটি মূলত আমাদের এই চিন্তা খন্ডন করার চেষ্টা করেছে যে বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা "এটা সম্পূর্ণ যুক্তির ভিত্তিতে গঠিত এবং এর কখনও ভুল হতে পারে না"। বিভিন্ন পপুলার সায়েন্সের বিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাসের যে পার্থক্য সেটা বেশ ভালো করে বোঝা যায় বইটি পড়লে। তবে আমার কিছু দুর্বলতা মনে হয়েছে বইটি নিয়ে সেটা হলো কোনো যুক্তি উপস্থাপন এর জন্য লেখক নাস্তিক বিজ্ঞানী বা দার্শনিকদের বিভিন্ন উক্তি প্রমাণ হিসেবে রেখেছেন। আমি বইটি নাস্তিক্যবাদ আর বিশ্বাসীদের চিন্তা ভাবনার কিছু পার্থক্য বোঝার জন্য পড়েছিলাম এবং এই জন্য বইটি ভালো হতে পারে।
"তারা কি আপনা-আপনিই সৃজিত হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা ? না তারা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছে? আদতে তো তারা নিশ্চিত নয়।"
- (সূরা তূর ৫২:৩৫-৩৬)
স্রষ্টা বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় নয়। বিজ্ঞানের সংজ্ঞাই আমাদের বলছে বিজ্ঞান স্রষ্টার ব্যাপারে নিরব থাকে । প্রকৃতি, মহাবিশ্ব এদের চালচলন, ধরণ, বৈশিষ্ট্য, অস্তিত্ব, এসব নিয়েই বিজ্ঞানের পথচলা।
তবে এই প্রকৃতি ও মহাবিশ্ব তো স্রষ্টারই সৃষ্টি। তাই প্রকৃতির ও মহাবিশ্বের কোন কিছুই স্রষ্টার বিপরীতে যেতে পারে না। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মাঝে কোনো সংঘাত নেই বরং আছে সহাবস্থান। কিন্তু বস্তুবাদীদের পক্ষে বিষয়টি মেনে নেওয়া কষ্টকর।
বেস্টসেলার লেখক রাফান আহমেদের লেখা 'বিশ্বাসের যৌক্তিকতা' বইয়ে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য, জোর করে চাপিয়ে দেয়া কোনো বোঝা নয়। বইটিতে ব্যাপক তথ্যের সমাহার রয়েছে। লেখকের উপস্থাপন ভঙ্গিও প্রশংসনীয়। আগ্রহী পাঠকদের অবশ্যই উচিত বইটি পড়ে দেখা। উপকৃত হবেন বলে আশা করছি ।
১। স্রষ্টা কে অকুণ্ঠ ভাবে বিশ্বাস করতে যদি এখনো কিছুটা সংশয় থেকে থাকে তবে একবার হলেও পড়ে দেখুন বইটি। ২। স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস কে আরও যুক্তিযুক্ত করে নিজের ও কাছের মানুষদের কাছে তুলে ধরতে চান, তবে পড়ে দেখুন এই বইটি। ৩। সর্বোপরি আপনার আশে পাশে ঘুরে বেড়ানো নব্য নাস্তিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে বার্থ বা আপনার কাছের কোন পরিচিত নাস্তিক কে বুঝানোর জন্য ভালো একটি যুক্তি, বিজ্ঞান ও দর্শন সম্পূর্ণ তথ্যবহুল বই খুঁজছেন, তাহলে এই বইটি পড়ে দেখুন।
বেশ ভালো লেগেছে বইটি। এর একটা পজিটিভ দিক হলো, দর্শন বা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সিদ্ধান্তগুলোকে সংক্্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে। পৃষ্ঠা বিন্যাসও ভালো লেগেছে। বইয়ের শেষে ইনডেক্সটা দেওয়া পুরো ভিন্ন একটা সংযোজন। গবেষণামূলক বিদেশী বইগুলোতে এমন থাকে। মোট কথা, হ্যাপি রিডিং।