নিজেকে এবং পারিপার্শ্বিককে ঘিরে সমস্ত কিছুকেই চ্যাপলিন দেখেছেন ব্যক্তির সীমানা ডিঙিয়ে এক গভীরতর অনুভূতি দিয়ে। তাঁর বস্তি, পথঘাট, মানুষ, সবই সেই অনুভূতির প্রতীক। তাই তাঁর বেদনাবোধটি নিতান্ত ব্যক্তিগত হয়েও যেন ব্যক্তির উর্ধ্বে এক বৃহত্তর অনুভূতির রাজ্যে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।আর এই অনুভূতিই চ্যাপলিনের শিল্পসৃষ্টির উৎস। সৃষ্টির এই মূল উপাদানটি চ্যাপলিন কুড়িয়ে পেয়েছেন তাঁর ছেলেবেলাকার দুঃসহ জীবনযাত্রার মধ্যে। এখানেই তিনি চিনেছেন দুঃখকে, দারিদ্র্যকে; রূঢ় বাস্তবের সাথে তাঁর নিবিড় পরিচয় ঘটেছে। আবার এই কঠিন জীবনযাত্রার মধ্যে খাঁটি সোনার মতো সাচ্চা প্রাণেরও হদিস তিনি পেয়েছেন লাঞ্চিত মানুষের ভিতরেই। এই বইতে সেই অনাড়ম্বর, অথচ বর্ণাঢ্য চ্যাপলিন রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে উন্মোচন করেছেন আরেক বিশ্রুত পরিচালকের জাদুকলমে। এক পরিচালকের কলমে অন্য এক পরিচালকের এমন স্মরণীয় রূপায়ণ সাহিত্যের ইতিহাসে রোজকার ঘটনা নয়।
কানসাস সিটির স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছে ২৪ বছরের এক তরুণ। গন্তব্য ক্যালিফোর্নিয়া। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ফ্রেড কর্নোর থিয়েটারে কাজ করা সহকর্মীদের এবং কর্মকর্তাদের কোনরকম বিদায় না জানিয়ে চলে এসেছে স্টেশনে। ক্যারিয়ার নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। তবুও সে কাউকে জানায়নি, যদি শেষ মূহুর্তে তার দ্বিধান্তিত মন সিদ্ধান্ত রদ করে দেয়।
বিখ্যাত কীস্টোন কোম্পানির কর্ণধার এডামস কেসেল তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের। থিয়েটার অভ্যস্ত এই তরুণ ব্যাপারটা নিয়ে তখন তেমন মাথা ঘামায়নি। অতঃপর প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি হলো, তৎকালীন চলচ্চিত্রের প্রাণ পুরুষ ম্যাক সেনেটের নিকট থেকে। এবার তরুণ এই হাতছানিকে আর অগ্রাহ্য করতে পারলো না। অনেক ভেবে চিন্তে, সহকর্মীদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেই হলো। তবুও মন কিছু অশান্ত, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত এবং অনেকটা আশাবাদী। সে কি তার থিয়েটারি বিদ্যা নিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্রে মানিয়ে নিয়ে পারবে? জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে চলচ্চিত্রকে আদৌ কিছু দিতে পারবে?
ওদিকে ট্রেন এসে পৌছাল স্টেশন। তরুণ ভাবল আর পিছিয়ে যাবার কোন মানে হয় না। মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে সেই তরুণ চেপে বসলো ক্যালিফোর্নিয়াগামী ট্রেনে। ট্রেন ছুটতে শুরু করলো তার গন্তব্যের দিকে আর এই ট্রেনে চাকার ছন্দেই যেন ঘুরতে শুরু করে দিয়েছিল চলচ্চিত্রের গতি, প্রকৃতি এবং ভবিষ্যৎ। কারণ সেই তরুণ আর কেউ নন, স্যার চার্লস (চার্লি) স্পেন্সার চ্যাপলিন। চলচ্চিত্রের ইতিহাস চার্লির এই সিদ্ধান্ত আর যাত্রা ছিল সেরা ঘটনার একটি।
চার্লি চ্যাপলিনের ঘটনাবহুল জীবন আর তাঁর চলচ্চিত্র নিয়ে মৃণাল সেনে চমৎকার একটি কাজ এই বইটি। ১৯৭২ সালে মৃণাল সেন ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে গোটা দুই সপ্তাহ জুড়ে উপভোগ করেন চার্লির কাজগুলো। অভিভূত হন। ভাগ্য স্বপক্ষে থাকায় দেখাও পেয়ে যান ৮৪ বছর বয়সী এই কিংবদন্তীর। যদিও বইটি বইটি লেখা হয়েছে ১৯৫৩ সালে কিন্তু সেই লেখার কথাগুলো যেন পরিণতি পায় এই চলচ্চিত্র উৎসবে। তার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই কলকাতার Frontier পত্রিকার মৃণাল সেনের লেখা Venice Film Festival প্রবন্ধে। চার্লিকে নিয়ে যারা আগ্রহী বইটি মন্দ লাগবে না আশা করি।
পারসোনালিটিরও একটা ব্র্যান্ড ভ্যালু আছে। সেই ব্র্যান্ড ভ্যালুর তাগিদেই হোক বা ব্যক্তিটির অসামান্যতায় হোক - লিখতে জানে এমন কারো হাতে পড়লে সে লেখার চমক এমনিতেই বহুগুণে বেড়ে যেতে বাধ্য। চ্যাপলিনের ব্যক্তিত্ব এবং মৃণাল সেনের লেখনী - এ দুইয়ের চমৎকারিত্বে এবইটা তো ভালো হওয়ার কথা ছিলই এবং সত্যিই তাই -
ছোটবেলা যখন চার্লি চ্যাপলিনের নির্বাক চলচিত্রগুলো দেখতাম তখন হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত কিন্তু হাসানো ছাড়াওযে প্রতিটা চলচিত্রের আড়ালে এক গভীর জীবনবোধ আছে সেটা বুঝার বয়স তখনও হয়নি। যখন বয়স হল তখন আধুনিক চলচিত্রের স্বর্নযুগ চলছে -একশন,মিউজিক আর গ্লামারে ভরপুর সিনেমায় মঝে গেলাম, ভুলে গেলাম সেই নির্বাক চলচিত্রের শিল্পীর কথা।
তাই মৃণাল সেনের বইটি যখন পড়তে শুরু করলাম সত্যিকার অর্থে একটা ধাক্কা খেলাম।আইনস্টাইন চার্লির সাথে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন "লোকে বলে আপনি কমেডিয়ান এতো দেখি পুরোদস্তুর অর্থনীতিবিদ"। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে চ্যাপলিনের ছিল মাত্র দুই বছর একটি বস্তির স্কুলে পড়ার অভিজ্ঞতা।
নিছক পেটের দায়ে অভিনয় জীবনে প্রবেশ, অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সাধারণ জনগনের হৃদয় জয়করে নিলেন, হলেন তখনকার সময়ের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক প্রাপ্ত অভিনেতা।কিন্তু যে যোগ্যতা চার্লিকে একজন অভিনেতা থেকে মনীষীতে রুপান্তরিত করেছিল সেটা হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনকে বুঝার যোগ্যতা, এক গভীর জীবনবোধ।
বইটিতে লেখক অতি সাবলীলভাবে মনিষী চার্লির জীবনকে বিশ্লেষণ করেছেন।সংগত কারনেই ব্যাক্তি চার্লির দোষ-ত্রুটিগুলো অনেকটা স্কিপ করে গেছেন বলে আমার মনে হল।লেখক নিজে একজন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ায় চার্লির প্রতিটা ছবির গল্পে ফুটে ওঠা জীবনবোধ আর অভিনয়কে অতি দক্ষতার সাথে ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন।
আশাকরি বইটি পড়ে যারা আমার মত চার্লিকে শুধু দক্ষ আভিনেতা হিসেবে জানেন তারা এক নতুন চার্লিকে আবিষ্কার করবেন আর যারা এখনই চার্লিকে ভালভাবে জানেন তারা আরো গভীরভাবে চার্লির প্রতিটা সিনেমা সম্পর্কে জানবেন।
এক বিশ্বখ্যাত পরিচালকের আরেক কিংবদন্তি পরিচালক এবং অভিনেতাকে নিয়ে হৃদয়গ্রাহী, আবেগীয় এবং বিশ্লেষণমূলক লেখা। বইটির অসাধারণ ব্যাপার হচ্ছে মৃণাল সেনের চোখে চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে মূল্যবান মূল্যায়ন, যাতে করে চলচ্চিত্র, ভাবনা এবং ব্যক্তি চ্যাপলিন এক সুতোয় বাঁধা পড়েছেন। বইয়ের একদম শেষ লাইনটি এত চমৎকার! ইটালিয়ান এক সাংবাদিককে লেখক জিজ্ঞেস করছেন, আপনাদের জাতির জনক মুসোলিনিকে এত বিদ্রুপ করা হল ছবিতে (দ্য গ্রেট ডিক্টেটর) অথচ আপনারা সকলের সাথে তাল মিলিয়ে উপভোগ করলেন, ব্যাপারটা সত্যিই দারুণ। জবাবে সাংবাদিকটি বললেন, মুসোলিনিকে কেন ইটালিয়ানরা পছন্দ করে না জানেন? কারণ, মুসোলিনি হেরে গিয়েছিলেন! এই কথাটির মধ্যে এক বিরাট সত্য উন্মোচিত হয়ে আমাদের অন্তরাত্মাকে ধাক্কা দেয়। ভাষা সাবলীল, প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র কাহিনী এবং গুরুত্ব আলোচিত হয়েছে সুচারুরূপে। এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
চ্যাপলিনের সম্পর্কে মোটাদাগে একটা ধারণা পাওয়ার জন্য ভালো বই। এছাড়া খ্যাতনামা পরিচালক হিসেবে সিনেমাকে দেখার দৃষ্টিকোণ থেকেও চ্যাপলিনের সিনেমাগুলোর আলোচনা পেয়ে যাই। সেগুলো বেশ উপভোগ্য। তবে মৃণাল সেন পুরোটাই লিখেছেন চ্যাপলিনের প্রতি বায়াসড হয়ে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে কিংবা বিস্তারিত ধারণা চাইলে এই বই এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম সিদ্ধান্ত।
এই CGI এর যুগেও সাদা-কালো প্যান্টোমাইমের চ্যাপলিন ভীষণ চমৎকার। আর সেই চমৎকার চ্যাপলিন কে নিয়ে লিখছেন আরো একজন গুণী মানুষ বাংলা সিনেমার মহারথীদের একজন মৃণাল সেন_ বইয়ের নাম চার্লি চ্যাপলিন।
বইয়ের নামকরণে কোনো আতিশয্য বা বিশেষনের বাহুল্য নেই। সাদামাটা এবং স্পষ্ট _ চার্লি চ��যাপলিন। যে নামটা শুনলেই ঢেলা ট্রাউজার, আঁটসাট কোট, উল্টো করে পরা বেখাপ্পা একজোড়া বুট, টুথ ব্রাসের মতন গোফ, মাথাই টুপি আর হাতে বাশের ছড়িতে ���ক হাস্য উজ্জ্বল ভবঘুরের চেহারে ভেসে উঠে, যাকে দেখলে মনে হবে_ "A fallen aristocrat at grips with poverty "। যে নির্বাক সিনেমা জগতে বিপ্লব এনেছিল, নিছক বিনোদনের মলাট ছাড়িয়ে রিল কে করেছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার। তার স্বতন্ত্র অ্যাকশন ও ম্যানারিজম দিয়ে সৃষ্টি করেছিল এক মৌলিক ধারা, যা পরে Chaplinesque নামে বিশ্ব সমাদৃত হয়।
সেই সমাদরের একটি আখ্যান মৃণাল সেনের এই বই। গুণী এই পরিচালকের কলমে চ্যাপলিন আরো প্রাণবন্ত। যেন বইটি একটা সিনেমা_ লণ্ডনের কেনিংটন বস্তির ক্ষুদে শিশুটির একদিন বিশ্ব বিখ্যাত বনে যাওয়ার কল্পচিত্র। ❤️
চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে আগ্রহ ছোটবেলা তার সেই সাদাকালো নির্বাক চলচিত্র দেখার সময় থেকে। পরবর্তীতে বড় হয়ে আরো ভাল করে তাকে চিনেছি। তাকে নিয়ে সেমিনারেও গিয়েছিলাম একবার। সেই থেকেই বইটা সংগ্রহ করা। মৃণাল সেনের চলচিত্রগুলোর প্রতিও আলাদা ভাললাগা আছে। তো এক চলচিত্র পরিচালকের দৃষ্টি দিয়েই আরেক বিশ্বসেরা চলচিত্র পরিচালককে দেখার চেষ্টা করলাম। চেষ্টাটা সফল হয়েছে হিসেবেই বলবো। চার্লি চ্যাপলিনকে যেন শুন্য থেকে শুরু হতে দেখলাম। দেখলাম তার চলচিত্র জগতের পথচলা, হোঁচট খাওয়া, পরে যাওয়া আবার উঠে দারানোও। মৃণাল সেন যেন হাতে ধরিয়ে দেখালেন, বুঝালেন চ্যাপলিনকে, তার চলচিত্র গুলোকে। চার্লি চ্যাপলিনের প্রতি যে আগ্রহ আগে ছিল মোমবাতির জ্বলন্ত শিখা তা যেন এখন সম্পূর্ণ দাবানলে পরিনত হয়েছে।
চার্লি কে নতুন করে জানা গেলো। একজন ফিল্ম আর্টিস্ট আরেকজন ফিল্ম আর্টিস্ট সম্বন্ধে কেমন ধারনা রাখেন তা জানার জন্যই বইটি পিকআপ করেছিলাম। চার্লিকে আমরা মূক অভিনেতা হিসেবে পর্দায় যেমন দেখি সেই মানুষটার বাস্তব জীবনে যে কত রকম ত্যাগ, প্রচেষ্টা আর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা রয়েছে তা তার জীবনী না ঘাঁটলে বোঝা যায়না। চার্লির মানারিজম ও একশন জানা জরুরি। তাকে জানলে তার সময়কালের একটা বড় আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে জানা যায়। এছাড়া ফিল্ম জগতে সে এক নতুন যাত্রা শুরু করেছিল, সিনেমাখোর বাঙ্গালিদের সে কথা না জানলেই না। :)