ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসকে বলা হয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির লীলাভূমি। গুণদা প্যারিস ভ্রমণ করে এসে লেখায় হাত দিলেন। সাহিত্যের নানা দিক উঠে এসেছে তাঁর এবং প্যারিস শীর্ষক ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনীটিতে। নিছক ভ্রমণকাহিনী নয়, অতীত থেকে বর্তমান অবধি নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্যারিসের মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, স্থাপত্য প্রভৃতি বিষয়ের সাবলীল বর্ণনা প্রকাশিত হয় তাঁর এই অনবদ্য রচনাটিতে।
Nirmalendu Goon (Bengali: নির্মলেন্দু গুন) is one of the most popular Bangladeshi poets known for his accessible verse. He was born in Kashbon in Barhatta in Netrokona, Bangladesh.
His first book of poetry was published in 1970. Since then he has published forty five collections of poetry and twenty collections of prose. Part of the generation of poets of 1960s, Goon's poetry contains stinging criticism of the nouveau riche and a touching description of the contrasting fate of the masses. A love of freedom and faith in the human spirit also permeates many of his poems. An avowed Marxist, Goon has also written poems urging an upheaval of the poor against the rich. He also has written a number of poems on important personalities, including Rabindranath, Sheikh Mujib, Lenin, Shakti Chattopadhyay and others.
ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছে কুমিল্লার কোটবাড়িতে। জায়গাটাকে নিজের ঘরবাড়ি ঘরবাড়ি বলেই মনে হয়। মিউজিয়ামে ঢুকলেই বেশ বড় একটা বুদ্ধ মূর্তি চোখে পড়তো। জানি না কেন, এই মূর্তিটার উপর ছিল আমার প্রবল আকর্ষণ.. (ছোট ছিলাম, বাট্টু টাইপও ছিলাম, ধ্যানী বুদ্ধকে মনে হতো আমার চেয়েও বড়। একটা শান্ত দীঘির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে যে ফিল পাওয়া যায় অনেকটা সেরকম লাগত।) মিউজিয়ামে গেলেই সম্মোহিতের মত থাকিয়ে থাকতাম সেই ধ্যানী বুদ্ধের দিকে। অনেকদিন পর একবার যেয়ে দেখি আমার বুদ্ধ নাই, আমি তো দু:খে শেষ। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ফ্রান্সে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের একটা প্রদর্শন হবে তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন জাদুঘর থেকে বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার মাথায় রীতিমতো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! আস্তা মিউজিয়ামে এতো কিছু থাকতে আমার বুদ্ধ চলে গেলো!! পরে আবার টিভিতে-পত্রিকায় দেখি কতো শ'তো ঘটনা.. ফ্রান্সে যেয়ে যদি সব নিদর্শন ফেরত না আসে বা নিদর্শনগুলোর কিছু ঘটে? এই নিয়ে মহা হৈ চৈ। আমি ভিতরে ভিতরে দারুণ মনখারাপ নিয়ে ঘুরি.. আমার বুদ্ধার যদি কিছু হয়? এর উপর আবার শোনা গেল রাতের আঁধারে পাচার (আমি পাচার শব্দটাই ইউজ করব এখানে) হয়ে গেছে এক লট নিদর্শন.. আবার বেশ কিছু দিন পর একটা নিদর্শনের (এখন বইয়ে পড়ে মনে পড়ল, একটা বিষ্ণু মূর্তি) খন্ডিত টুকরা উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর বহুদিন মিউজিয়ামে যাওয়া হয়নি। তারও অনেক পড়ে একদিন মিউজিয়ামে যেয়ে রক্ত ছলাৎ করে উঠল! ঘরের বুদ্ধ, ঘরে ফিরে এসেছে।
এখন কথা হচ্ছে এই হা বিতং করে এত কথা বলার উদ্দেশ্য কি? কাহিনি হচ্ছে.. নির্মলেন্দু গুণের ভ্রমণ কাহিনি 'এবং প্যারিস' বইটি। বইয়ের শুরুই হয়েছে সেই বিখ্যাত ঘটনা নিয়ে। সঙ্গে আছে কবির প্যারিস ভ্রমণ। যতোটা না প্যারিস নিয়ে লেখা তার চেয়ে বেশি লেখা প্যারিস ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। কবি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কঠিন ভক্ত ছিলেন তা বুঝাই যায়। কবির সেই গিমে মিউজিয়ামের সাথে বাংলাদেশের সেই টানাপোড়ন নিয়ে ব্যয় করেছেন বইয়ের অনেকাংশই। আমার নিজেরও মনে পড়ে গেল সেই স্মৃতি.. কবির প্যারিস স্মৃতিতে উঠে এসেছে আরও বড় বড় মানুষের নাম, স্মৃতিচারণ কিন্তু বারে বারে ঘুরে ফিরে এসেছে সেই একটা নামই.. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ও হ্যা! কবি কন্যা মৃত্তিকা গুণও কিন্তু দারুণ লেখেন। হয়ত সেই গুণটি পিতৃসূত্রে পাওয়া। কবি তার ভ্রমণ কাহিনী শেষ করেছেন বিখ্যাত কবি শার্ল বোদেলিয়ারের কবরের সামনে কবিতা আবৃত্তি করে। কবিতাটা যথার্থই প্রাসঙ্গিক। আমিও মোটামুটি অনেক দিন যাবত কবির সঙ্গে ঘুরছিলাম প্যারিসে। আমারও ভ্রমণ সাঙ্গ হইল 😌
আমি সবসময়ই দেখেছি, কবিরা যখন গদ্য লেখেন তার ভাষাটা একটু বেশিই যেন মিষ্টি হয়। এই বইটি পড়তে গিয়েও আমার এরকমই অনুভূতি হল। বইটি লেখকের প্যারিস ভ্রমণকাহিনী নিয়ে। যদিও কেবল ভ্রমণ নয়, এতে আলোচিত হয়েছেন বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু দিগগজ। গুণের নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং ভ্রমণপুরাণের পাশাপাশি তিনি প্রায় একটি গবেষণাগ্রন্থের মতোই তুলে ধরেছেন মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, শামসুর রাহমান প্রমুখদের পারী সংক্রান্ত ভাবনার বয়ান। এই ব্যাপারটিই বইটিকে একটি গতানুগতিক ভ্রমণকাহিনী থেকে অনেকখানি আলাদা করে দিয়েছে। মধুসূদনের ভার্সাই নগরী, রামমোহন রায় কিংবা প্রিন্স দ্বারকানাথের স্মৃতি বিজড়িত প্যারিস কবির চোখে তাই আরো বেশি মোহনীয় হয়ে উঠেছে৷ তবে অধিকাংশ জায়গা জুড়েই রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। গিমে জাদুঘরে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি, শর্মিলা রায়ের রবীন্দ্রসংগীত, লুভরে কবিগুরুর স্মৃতি লেখক একেবারে বই, পৃষ্ঠাসংখ্যা সহ উল্লেখ করে দিয়েছেন৷ ফলে এই বইটি আরো অনেক মূল্যবান বইয়ের সন্ধান দিয়েছে৷ তাছাড়াও অবধারিতভাবে এসেছে সুনীলের 'ছবির দেশে কবিতার দেশে' বইটির প্রসঙ্গ, বুদ্ধদেবের অনুবাদে শার্ল বোদলেয়ার। লেখকের ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে ছিলেন কন্যা মৃত্তিকা গুণ এবং চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন। ছোট্ট একটা সংযুক্তিতে গুণকন্যার লেখনীও কতটা শক্তিশালী তা বেশ বোঝা গেছে। খুব সরস একটি ভ্রমণকাহিনী পড়বো ভেবে বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম, অথচ পেয়ে গেলাম আরো অনেক কিছু। বেশ স্মরণীয় পাঠ হয়ে থাকবে বইটি।
পুরো বইটি নির্মলেন্দু গুণের লেখা নয়। কিছু অংশ লিখেছেন তার কন্যা মৃত্তিকা গুণ। খাঁটি ভ্রমণকাহিনি বলতে আমরা যা বুঝি একে ঠিক সেই ছকেও ফেলা যাবে না। মোটকথা, আমার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
[এবং প্যারিস লেখক : নির্মলেন্দু গুণ পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৯২ ধরন : ভ্রমণকাহিনী রেটিং: ৩.৫/৫]
“এবং প্যারিস” কে ভ্রমণকাহিনী থেকে বরং প্রবন্ধ সংকলন বলাটা যথার্থ হবে। লেখক, কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ফ্রান্স ভ্রমণকে উপজীব্য করে রচনা করেন তথ্যসমৃদ্ধ এই গ্রন্থটি। মোট রচনার সম্ভবত ২০ শতাংশ লেখা লেখকের নিজের নয়; বিভিন্ন রেফারেন্স, কবিতা, ইমেইল/চিঠি এবং তার সহযাত্রী/কন্যা মৃত্তিকা গুণের একাধিক প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে এখানে। গুণ সাহেব রবীন্দ্রনাথের একাধিকবার ফ্রান্সে অবস্থানকালের ঘটনা সমূহ সম্পর্কে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছেন, বিভিন্ন নথিপত্র, লেখা, আত্মজীবনী ও নিজের কল্পনাশক্তির যাথাযত ব্যবহার করে উদ্ধার করতে চেয়েছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। এছাড়াও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ফ্রান্স ট্র্যাজেডি, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের য়ুরোপ ভ্রমণ ও সমাধি, রাজা রামমোহন রায়ের ফ্রান্স যাত্রাসহ বাঙালি মহান ব্যক্তি সমূহের উক্ত দেশে পদচারণা অনুসরণ করতে চেয়েছেন কৌতূহলী হয়ে।
বইয়ের একটি নেতিবাচক দিক উল্লেখ করতে হলে অবশ্যই এর অতিরিক্ত তথ্যবহুলতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমার এই অভিযোগটা থাকতো না যদি এটাকে ভ্রমণকাহিনী না বলা হতো। কিছু রচনা মনে হয়েছে পৃষ্ঠা-সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য রাখা হয়েছে।
• সকল শিল্পীদের দ্বিতীয় মাতৃভূমি যে ফ্রান্স, সুনীলের সাথে সুর মিলিয়ে সেটাই বলতে চেয়েছেন তিনি, এবং এটা অবশ্যই একটা সর্বজন স্বীকৃত মতবাদ। ফ্রান্স যেন এক বিরাট শিল্পের হাট, আর সর্বক্ষণ শিল্পীদের পদচারণায় মুখরিত এর প্রতিটি কোণ। তাছাড়া বিপ্লবীদের তীর্থ স্থানও এই ফরাসভূমি। ১৮৭১ এর প্যারি কমিউন, বিশ্বের প্রথম শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা, যে সংগ্রাম চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলো তার ১০০ বছর পর বাঙালিরাও বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। ফরাসি বিপ্লব আজও বহন করে তার মহাজাগতিক বৈপ্লবিক আবেদন।
এই বইয়ে লুভ্যর জাদুঘর, আইফেল টাওয়ার, ভার্সাই প্রাসাদ ও ইত্যাদি স্থান ভ্রমণের বর্ণনা যতোটা ছিলো তার চেয়েও বেশি ছিলো অতীতের স্মৃতি রোমন্থন। একটি ভ্রমণ কাহিনীতে কী কী থাকা উচিত নয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে আমি “এবং প্যারিস” এর নামোল্লেখ করবো।
কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা আমার খুব বেশি পড়ার সৌভাগ্য হয়নি, কবিতা-ফোবিয়ায় আক্রান্ত আমি। তার গদ্য সম্পর্কে বিশেষ করে উল্লেখ করার মতন কিছু নেই, তবে পড়তে হোঁচট খেতে হয়না। বাক্য গঠনে সরলতা আশ্রয় নেন তিনি, সহায়ক হিসেবে ছিলো তার হালকা রসবোধ। যদিও পুরোটা পড়তে আমার বেশ লম্বা-চওড়া সময় লেগেছে তবে খারাপ লাগেনি।