চলচ্চিত্র বিষয়ে অধ্যাপনা, তথ্যচিত্র নির্মাণ, ফিল্ম, টেলিভিশন ধারাবাহিক ও ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্য রচনা এবং তার ফাঁকে ফাঁকে নিজের ব্লগে নানা স্বাদের লেখালেখি-এইসব নিয়েই কল্লোল লাহিড়ী। প্রকাশিত উপন্যাস গোরা নকশাল (২০১৭)। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল(২০২০)। নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি (২০২২)। ঘুমিয়ে পড়ার আগে (২০২৪)। স্মৃতিগদ্য গ্রন্থ বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা (২০২১)। লেখক গোরা নকশাল এবং ইন্দুবালা ভাতের হোটেল উপন্যাস দুটির জন্য দুহাজার একুশ সালে ভূমধ্যসাগর পত্রিকার 'শ্রীমতী সাধনা সেন সম্মান'-এ সম্মানিত।
একটি ৬৪ পাতার বই, সত্তর দশকের কতই না বলা গল্প বলেছেন লেখক এই ছোট্ট বইটিতে। গুরুচন্ডালি প্রকাশনীর বাংলা চটি সিরিজ এর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ন বই গোরা নকশাল। সায়ন কর ভৌমিকের প্রচ্ছদ বইটিকে একটি আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে, এই প্রচ্ছদ পাঠক কে ভাবাতে বাধ্য। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং আন্দোলনের এক অদ্ভুত মিশেল তৈরি করেছেন প্রচ্ছদে।
পটভূমি -
না এই বই নকশাল আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে না। বইটি আদপে নকশাল এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বেঁচে থাকা এক কাল্পনিক চরিত্রের কথা জানায় যার নাম গোরা। হ্যাঁ গোরা নকশাল আদপে একটি ফিকশন। এই গল্পটা গোরা নকশালের, যে দিন বদলের স্বপ্ন দেখতো, আর এই কারণেই রাষ্ট্র তাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। জীবনের আট বছর আর একটি ল্যাংড়া পা নিয়ে সে যখন ফিরে আসে তখন রাজ্যে লাল পতাকার শাসন, সে ভেবেছিল এবার তাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। এই গল্পটা রিফিউজি কলোনি তে বেড়ে ওঠা টুকনুর, ছোটবেলায় সবার জীবনেই একজন পাড়াতুত দাদা থাকে যাকে আমরা আইডল ভাবী, টুকনুর জীবনে সেই দাদা গোরা নকশাল। আসলে সে নকশাল এর মানে জানতো না, সে জানতো "যারা উড়তে পারে তারাই নকশাল"। তার কাকার একটা পায়রা ছিল যার নাম ছিল নকশাল। এই গল্পটির কথক টুকনু। সে গোরা নকশাল এর চোখ দিয়ে যা দেখেছে তাই সেটাই বর্ননা করেছে সঙ্গে যোগ হয়েছে নিজের আবেগ এবং উপলব্ধিগুলো। এই গল্পটা প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়া এক মেধাবী ছাত্র সুশান্তর, যে চশমা ছাড়া ভালো দেখতে পায়না। মজদুর ইউনিয়ন এর ডাকা ধর্মঘট সফল করার জন্য, পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় মারধর করে তখন এই টুকনুই গিয়ে রাস্তায় পরে থাকা চশমাটা সুশান্তর হাতে দিয়ে আসে। সেই সুশান্ত আর ঘরে ফেরেনি, ফিরেছে তার পচা গলা কন্ঠনালী কাটা মৃতদেহ পাওয়া যায় গঙ্গার বুকে। গোরা নকশাল বুঝতে পারে সমাজ দিন বদলের স্বপ্ন গুলো অধরাই থেকে গেছে। "মনে রাখিস টুকনু, যারা প্রতিবাদের কথা বলে, যারা প্রাপ্য চাহিদার কথা বলে, যারা বলে ফিরিয়ে দাও আমাদের অধিকার,আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের দু বেলার দু মুঠো অন্নের অধিকার,তাদের প্রতিবার, প্রতি জনসমুদ্রে এইভাবে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এইভাবেই বার বার কণ্ঠনালী কেটে রক্তের গঙ্গায় বিসর্জন দেয়া হয়।"
পাঠ প্রতিক্রিয়া -
৬৪ পাতায় লেখক তুলে ধরেছেন এক অদ্ভুত সময়ের কথা, ১৯৭০ ১৯৮০ এর দশক সম্পর্কে আমিও শুধু বইয়ের পাতায় পড়েছি আর বাবা কাকার মুখে শুনেছি, এমনি একটি গল্প বলেছেন কল্লোল বাবু। বইটা সত্যি বলতে খুব যে সুখপাঠ্য হয়েছে তা না, বরঞ্চ কিছু কিছু জায়গায় গলার কাছে একটা গিঠ এর মত উপলব্ধি হয়েছে যা গেলা যাচ্ছে না ফেলা যাচ্ছে না। বইটা পাঠকদের নিয়ে যাবে সেই ছোটবেলা গুলোতে যেখানে মা এর বকুনি, মাঠে খেলতে যাওয়া, কারখানার ভেঁপু, মিটিং মিছিল ছিল। ঘটনার ঘনঘটা, তৎকালীন পরিস্হিতি, কিছু মানুষের হার না মানা জেদ, অদম্য সহ্যশক্তি আর দিন বদলের স্বপ্ন এই নিয়ে লেখক এক অনবদ্য সাহিত্য কর্ম সৃষ্টি করেছেন, যা একবার হলেও পাঠকের সত্তা কে আন্দোলিত করবে। যারা পড়েননি তাদের অনুরোধ করবো এই বইটি পড়ার জন্য। অসাধারণ বলিষ্ঠ লেখনীর গুনে এই ছোট্ট বইটি একখানি খাঁটি মুক্ত।
বিপ্লব, লড়াই, বদল। একটা সমগ্র শতকের তরুণ গর্জন। কিন্তু শেষ বড়ই কষ্টের, শেষ ব্যর্থতার। কোথাও গিয়ে সংশয়, এই যে এত আত্মবলিদান এগুলো কি আদৌ দরকার ছিল? আদৌ কি প্রত্যেকটা পা ভেবে চিন্তে ফেলা হয়েছিল? নাকি কেবলমাত্র ফুটন্ত রক্ত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বলেই ঝাঁপিয়ে পড়া? গোরা নকশাল ভাবে, শেষটা এভাবে হুড়মুড়িয়ে ধ্বসে গেল কেন? তার কারণ কি দূরদৃষ্টিহীন শুরু নয়? কিন্তু এই ভাবনা তার কাছে আসে যখন সব শেষ, সূর্যের শেষ কিরণটুকুও স্তিমিত হয়েছে। তার গাছের শেষ ফুলটুকুও যখন গাছ মরে গেছে বলে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে তখন। ঠিক তখন গোরা নকশাল হিসেব মেলাতে বসেন, কোথাও কি বিশাল একটা ফাঁক থেকে গেল? কেন অসহায় পার্থকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, ধর্মের দোহাই দিয়ে কুরুক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছেন কৃষ্ণ? সে তো লড়তে চায়নি। গোরা নকশাল, প্রিয়াংশু, সুশান্ত....এরা কেউ কি লড়তে চেয়েছিল? কেন এত কোটি জনসংখ্যার প্রতিবাদের কান্ডারী তারাই হল? তার প্রত্যুত্তরে কি পেল তারা? সারাজীবনের মতো প্রায় পঙ্গু পা, সারা গায়ের অজস্র জায়গা থেকে খোবলানো মাংস, গলার নলি কাটা অবস্থায় গঙ্গায় চির ঘুম অথবা নিজের একরত্তি সন্তানকে একবারও না দেখার আগেই মুণ্ডুপাত,এগুলোই কি ছিল তাদের প্রাপ্য? হাজার হাজার মৃতদেহ, হাজার হাজার সন্তানহীনা মা-বাবা, হাজার হাজার বাবা মা হীন সন্তান আর একটা সম্ভাব্য বদলের শতকের ভাবনা।
অন্য আরো অনেকের মতো চিতাকাঠে বা গঙ্গায় মৃতদেহ হয়ে নয়, গোরা নকশাল ফিরে আসে জীবন্ত। পঙ্গু পা ও শরীরের অনেক জায়গায় মাংস হারিয়ে, ছোট্ট টুকনুর কাছে ফিরে আসে সে। ছোট্ট টুকনুর বুকের ক্ষীণ মাদল দ্রিম দ্রিম তাকে ভবিষ্যতের পাল্টা হাওয়ার আশা দেখায় এখনও। কোথাও গিয়ে ছোট্ট টুকনুকেও নিজের আদলে গড়ে নেওয়ার ইচ্ছে উঁকি মারে তার বুকে। যদিও সে আশা ক্ষণস্থায়ী হয় টুকনুর বড় হওয়ার দিকে তাকিয়ে। গোরা নকশালের চোখের সামনে এক এক করে লুটিয়ে পড়তে থাকে তারই মতো একই আদর্শে বিশ্বাসী ফুলের কুঁড়িরা, তবু সে গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চায়। এই দাঁড়িয়ে থাকা তার অসহনীয় লাগে কিন্তু তাও সে থাকে। কোনো ফুলের উত্থান তাকে গর্বিত করে আবার সেই ফুলেরই নৃশংস মৃত্যু তাকে নিজের আদর্শকেই প্রশ্ন করতে বাধ্য করে। তবু গোরা নকশাল নিজের শেষ শ্বাস অবধি উড়তে চায়, বদল আনতে চায়। আর ছোট্ট টুকনু নিজের সর্বস্ব দিয়ে গোরা নকশালকে রেখে দিতে চায়, খুব ভয় করলেও চায়। যে টুকনু একদিন এই গোরা নকশালকে দেখেই ভয় পেয়েছিল, মুখ দিয়ে তার বেরিয়ে এসেছিল রাগ, সেই টুকনু গোরা নকশালের শেষ সময়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে "আজ কেন এত ঘুমোচ্ছে মানুষটা?" বড় হয়ে সেই টুকনুই বুঝতে পারে ভয় আদতে কি বিষম রোগ। এই ভয় থেকেই সে চিরকাল চেয়েছে তাদের পায়রা 'নকশাল' কে যেন খেয়ে নেয় পাশের বাড়ির হুলো। ওই একই ভয় থেকে পুরো একটা শতক ভরে গিয়েছিল রক্তে। ক্ষমতাধারীরা ভয় পেয়েছিল, তরুণ প্রজন্মের হুঙ্কারে তারা ভীষণ ভয় পেয়েছিল। এই ভয় ছিল বলেই শত ব্যর্থতা নিয়েও চশমা ছাড়া জিতে যায় সুশান্ত, একরত্তিকে না দেখা মুন্ডহীন প্রিয়াংশুও জিতে যায় তার বলিদানে আবার গোরা নকশালও এগিয়ে চলার আহ্বান জানিয়ে জিতে যায় সময়ের হাতে। বদল হয়নি ঠিকই কিন্তু ভয় এসেছিল, গোটা তরুণ সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়লে কি হয় বুঝে গিয়েছিল শাসক। এটা কি কোথাও গিয়ে জিতে যাওয়া নয়? নাকি এটাও এক ধরণের সান্ত্বনা? কিংবা টুকনুর মতো লেখকের দারুণ একটা ওয়েব সিরিজের প্লট?
শেষে বলি, এই উপন্যাস আদতে গোরা নকশাল আর ছোট্ট টুকনুর। এই উপন্যাস সেইসব মানুষজনের যাদের আর কোনোদিন ফেরা হয়ে ওঠেনি বাড়িতে। এই উপন্যাস তাদেরও যারা কেবল দেশ বদলের আশায় ঝাঁপিয়ে পড়তে দু'বার ভাবেনি। এই উপন্যাস তাদের যাদের উদ্দেশ্য দেশভাগ ছিল না, এক সাথে এক অধিকারে বাঁচা ছিল, কিন্তু ক্ষমতাধারীর নৃশংসতার কাছে যাদের সবকিছু গুঁড়িয়ে গিয়েছিল এক লহমায়। মাত্র ৬৪টা প���ষ্ঠা এভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যেতে সক্ষম হবে এই বইটা না পড়লে সত্যিই জানতাম না। লেখকের লেখা এর আগে পড়িনি। এটাই প্রথম বই। খুব ইচ্ছা রইল বাকিগুলোও পড়ে দেখার। বইয়ের প্রচ্ছদ, বাঁধাই, পৃষ্ঠার কোয়ালিটি অনবদ্য। লেখার ফন্টে একটি লাইনের সাথে অপর লাইনের গ্যাপিং খুবই কম, যদিও আমার এতে কোনো অসুবিধা হয়নি কিন্তু বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকম চোখের অবস্থা ভেবে বলছি, হয়তো অনেকের অসুবিধা হতে পারে। শেষে বলি, অনেক দামী মোটা বইয়ের তুলনায়, কম দামী ছোট্ট এই বইটা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি প্রশংসার ও পাঠকের দাবী রাখে।
বই - গোরা নকশাল লেখক - কল্লোল লাহিড়ী প্রকাশনা - গুরুচন্ডালি মুদ্রিত মূল্য - ৯০ টাকা
"একজন কিশোর ছিল, একেবারে একা আরো একজন ক্রমে বন্ধু হল তার। দুয়ে মিলে একদিন গেল কারাগারে; গিয়ে দেখে তারাই তো কয়েক হাজার!" ('জেলখানার কবিতা'- বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
'গুরুর সস্তা কাগজের সুলভ ও পুষ্টিকর চটি বই', কল্লোল লাহিড়ীর 'গোরা নকশাল' এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে আমার সাম্প্রতিক পাঠ। গুরুর বাংলা চটি সিরিজের 'কামানবেবি', 'মজুররত্ন', 'পাড়াতুতো চাঁদ', 'কাঠপাতার ঘর আগান কথা-বাগান কথা'-র পর আমার মত এক নগণ্য পাঠকের কাছে 'গোরা নকশাল' এক পরিতৃপ্ত পাঠ-অভিজ্ঞতা।
উপন্যাসের কাহিনি অতি অল্প এবং সরল, সময়কে পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন, দিনবদলের বাসনা, শ্রেণীহীন সমাজ নির্মাণের প্রত্যয়ের ধারক হিসাবে কাহিনির কেন্দ্রীয়চরিত্র পুলিশের মারে ভাঙা পায়ের গোরা নকশাল, ছোট্টো টুকুনের প্রিয় গোরা নকশাল, যে স্বপ্ন দেখে এক অসম্ভব উড়ানের, তাকে এবং টুকুনকে ঘিরেই আবর্তিত হয় এই কাহিনি। ছোট, সরল গল্প হলেও 'গোরা নকশাল'-এর সার্থকতা তাহলে কোথায়? ভূমিকা বাদ দিয়ে ৫৪ পাতার কাহিনিতে পাঠকের প্রাপ্তির ভান্ডারের একটু হিসেবনিকেশ করলে যা উঠে আসে —
লেখকের অসম্ভব নির্ভার গদ্য এবং অনবদ্য লেখার স্টাইল। কাহিনি ছোট হলেও নিঁখুত ডিটেলিং প্রতিটি চরিত্রের, মফস্বলের আটের দশকে একটি কারখানা বন্ধ এবং শ্রমিকদের আন্দোলনের পটভূমিতে কিশোর টুকনু এবং তার 'গোরা নকশাল'কে নিয়ে এগিয়ে চলে এই কাহিনি । এক শিশুর চোখে দিনবদলের স্বপ্ন এবং 'নকশাল' শব্দটির সংজ্ঞা বাড়ির একটি পোষা পায়রার রূপক দিয়ে অদ্ভুত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন লেখক, "আসলে ওটা পায়রাদের টাইটেল। যারা ভালো উড়তে পারে তাদের নকশাল বলে।" অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি - ঠুলি, সুশান্ত, প্রিয়াংশু লেখকের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে পরম মমতায়। কল্লোল জানেন পাঠকমনের তন্ত্রী, উপযুক্ত স্থানে তিনি তার ন্যারেটিভে মিশিয়ে দিয়েছেন স্মার্ট রেফারেন্স এবং উপযুক্ত মায়া এবং অনুভব। প্রতিটি অধ্যায়ের সূচনা ঘটে দুই-চার পংক্তির কবিতার মাধ্যমে। দুটি সমান্তরাল সময়সরণী ধরে এগিয়েছে কল্লোলের কাহিনি, অবাক করে এত স্বল্প পরিসরে তিনি দুটি সময়কে নিয়ে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। নির্ভার গদ্য, সাদামাটা কাহিনি হওয়া সত্ত্বেও ৫৪ পাতার কাহিনি পাঠককে শেষ করতে গিয়ে বেশ কিছুবার হলেও অন্ততঃ থমকে দাঁড়াতে হয়, প্রতিটি চরিত্র পাঠককে ভাবায়, মন ভার করে তোলে অজান্তেই।
বইটি সর্বাঙ্গসুন্দর হওয়ার পথে পাঠক হিসাবে যা বিশেষ অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে, তা হল দুর্বল প্রুফচেকিং। বেশ কিছু বানান ভুল, স্পেসিং সমস্যা যা গুরুর আগের কোন বইতে আমি সেইভাবে পাইনি, দ্বিতীয় সংস্করণে একটি উপন্যাসিকার ক্ষেত্রে এই ত্রুটি সংশোধন করা যেত বলে আমার বিশ্বাস। পুরো উপন্যাসটি খুঁটিয়ে না দেখলেও যতটুকু যা পড়ার সময়ে চোখে পড়েছে:
* পৃষ্ঠা ১২ - কখোনো সখনো * পৃষ্ঠা ১৪ - হাত গুলো * পৃষ্ঠা ১৬ - ধপধপে * পৃষ্ঠা ৪১ - প্রান * পৃষ্ঠা ৪৬ - কালি বাড়ি
▪️(আমার তরফ থেকেও কিছু ভুল হলে জানাবেন।)
নিঃসন্দেহে 'গোরা নকশাল' বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যেচর্চার ক্ষেত্রে এক ফিনিক্স পাখি যার অপ্রত্যাশিত উত্থান আগুনের মধ্যে থেকে। 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল'-এর অভূতপূর্ব পাঠকপ্রিয়তার মাধ্যমে অধিকাংশ পাঠক কল্লোল লাহিড়ীকে চিনলেও তাকে মনে রাখা উচিত ফিনিক্স 'গোরা নকশাল'-এর জন্য, ২০১৭-তে প্রকাশের পর ২০২১-এ এই কাহিনির পুনর্জন্ম যেন। পাঠান্তে চোখে পড়ে, 'গোরা নকশাল সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এই আখ্যানে বর্ণিত কোন মানুষ, মানুষের জীবন, জীবনের ওঠা পড়া দুঃখ দুর্দশার সাথে জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তির সাদৃশ্য থাকলে তা নেহাতই কাকতালীয়।' অজান্তেই পাঠকমন প্রশ্ন করে অবচেতনে, প্রত্যেক সাধারণ মানুষের মধ্যেই কি এক গোরা নকশাল আর এক ছোট্ট টুকুন নেই? — একজন স্বপ্ন দেখিয়েছিল সমাজ বদলের আর একজন তার কিশোর চোখে সেই স্বপ্ন বুনেছিল,'ভালো উড়তে পারার জন্য', সমাজকে বদলে দেওয়ার জন্য।
কিছুটা থাক আলগোছেতে কিছুটা থাক কাছে ---কিছু কথা ছড়িয়ে পড়ুক চেনা আলোর মাঝে' - চেনা আলোয় ছড়িয়ে পড়া কথাগুলো জড়ো করার গভীর মনোযোগ আর গল্পের মুখগুলো চিনে নেবার একবুক তাগিদ নিয়ে পাঠক শুরু করেন গোরা নকশাল। পূর্ব বাংলা থেকে আগত এক পরিবার, বলা ভালো উদ্বাস্তু তকমা এঁটে যাওয়া এক পরিবার, যাদের ঠাঁই পশ্চিম বাংলার উত্তর পাড়ার বালি এলাকায়। সেই তাদের নিয়েই শীতের একটা সকালের বর্ণনার মাধ্যমে গল্পের উড়ান। উত্তম পুরুষে লেখা এই আখ্যানের কথক ছোট্ট টুকুনের দেখা পাবেন পাঠক প্রথম অধ্যায়েই। সে পরিবারের কনিষ্ঠ জন। ভীষণ ঘুম কাতুরে, নানান ফন্দিতে পড়াশোনায় ফাঁকি দেয়া, ঠাম্মার খাবারে ভাগ বসানো, আর ঠাম্মা, মণির মুখে শোনা মজাদার খাবারের জন্য ছোঁক ছোঁক করাই যার প্রধানতম কাজ। ও হ্যাঁ, আরো একটা কাজ সে বিশেষভাবেই করে যায়, মনে মনে নকশাল নামের ছোটকা হাঁদা'র পোষা পায়রাটিকে কিভাবে জব্দ করা যায় সে ভাবনায় ডুবে থাকে। এহেন ছোট্ট টুকুনের পরবর্তী জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবার জন্যই যেন তার জেল ফেরত জ্যেঠাতো কাকা গোরা নকশালের আর্বিভাব ঘটে। যাঁর পুঁতে দেয়া বীজমন্ত্রের অনুরণন পাঠক শুনতে পান বড় হয়ে ওঠা কল্লোল লাহিড়ীর বয়ানে। 'গোরা নকশাল'এর গল্পটা একটা কোলাজ। সময়ের একাল- সেকালের ফোঁড় দিতে দিতে এগিয়েছে।
টুকুনের পরিবার আর্থিক ভাবে প্রায় নিঃস হলেও, আত্মিকভাবে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। পরিবারটি পাঠপ্রিয়। বিষাক্ত রাজনীতির ছোবল তাদের পূর্ব বাংলার ভেটেমাটি ছাড়া করলেও রুচিশীল সংস্কারগুলো কেড়ে নিতে পারেনি। তাই সঙ্গত কারণেই 'গোরো কিনা কালো কি'র মত সস্তা চটুল গান এ পরিবারে ব্রাত্য। ঠুলির মত খিস্তিবাজ ছেলের বন্ধুত্ব গ্রহণ করা বারণ। কানের পাশে চুল গুঁজে রাখা শেখায় রুচিবোধ। যেখানে পরিবারের কর্তা স্কুল শিক্ষক বাবা স্কুলের বই ফেরত দেবার আগে ভালো ভালো কিছু বই আরো একবারটি করে পড়ে নিতে চান। ঘুমে ঢুলতে থাকা ছোট্ট টুকুনের বুকে সেঁধিয়ে যায় বাবার পাঠরত কিছু খুচরো লাইন ''আমলকি বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরু দুরু/ পেয়েছে খবর পাতা ঝরার সময় হয়েছে শুরু।'' লাইব্রেরি থেকে আনা বইগুলো পড়ে নেবার ব্যাকুলতায় চোখের ছানি যত দ্রুত সম্ভব কাটানোর তাগিদ দেখি বয়স্ক ঠাম্মার মধ্যে।
যে ভরপুর জীবন আমাদের দেখা হয়নি কোনোদিন, কেবলি গল্প হয়ে ঘুরে ফিরে কাছে আসে, সেজীবনের প্রতি একটা বিস্ময়মাখা আগ্রহ জেগে থাকে যেন। ঠাম্মার মুখে শোনা পরিবারের টইটম্বুর দিনের গল্পেরা তাই কথকের টুকুন মনে লেপ্টে থাকে। আস্তে আস্তে গোরা নকশাল টুকুনের অবচেতনে তার বুকের ভেতর বুঁনে যেতে থাকেন ভবিষ্যতের ইস্তেহার। যা টুকুন কল্লোল লাহিড়ী হয়ে বুঝে নেবেন একদিন। এই বুনে যাওয়া আর বুঝে নেয়ার রথযাত্রায় লেখকের সাথে সাথে পাঠক একবার অতীত আবার বর্তমানের ভ্রমণের সঙ্গী হয়ে ওঠেন ��্বাচ্ছন্দ্যে। 'এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া'র আকুলতায় সে রথের চাকা বার বার যেখানে গিয়ে থামে 'সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়'। তারপরও টুকুন এক মায়াবী লাবন্য খুঁজে পায় পুলিশের নিষ্ঠুর অত্যাচারে পঙ্গু , আশ্চর্য সুন্দর হাসতে জানা একজনের মুখে, বুকে। যিনি একটি আন্দোলন, রাষ্ট্র কর্তৃক ধামাচাপা দিতে চাওয়া এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের সাক্ষী। 'গোরা নকশাল' আমাদের সেই আন্দোলনের কাছে নিয়ে যায়, পাঁজর খুলে দেখাতে চায় ক্ষতের বিভৎসতা।
যে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবালন হয়ে ওঠার উৎসাহ দিয়েছিল হাজার তরুণ যুবাকে। স্বপ্ন দেখতে আর দেখাতে তাড়না যুগিয়েছিল দিন বদলের। ইতিহাসের সেই সময়কে কল্লোল এক অবাক মোহময় ঘোর নিয়ে পাঠকের কাছে বয়ান করে যান। সে বয়ানে পাশাপাশি ঢুকে যায় কথকের উত্তর কলকাতার প্রায় মফস্বল শহরের বাড়ির কাছাকাছি চটকলের ধর্মঘটী শ্রমিকদের কথা। সুশান্ত নামের এক তুখোড় ছাত্র যে কিনা প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়েছিল, ভবিষত্যে সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে যার পড়ার ইচ্ছে, তাদের বাড়িতে তার আগমন এবং পরে পুলিশের তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া। কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে অসৎ হরিমিত্রের ভোটে নামা। হাঁদার দোকান চটকল বন্ধের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা কিংবা সুশান্তের খুন হয়ে যাওয়া, গঙ্গায় তার ভেসে যাওয়া লাশ টেনে আনার জন্য ঠুলি নামের অনাথ ছেলের ভরাকোটালকে উপেক্ষা করে ঝাপিয়ে পড়া। কিংবা ক্ষমতার পালাবদলে গরীবের বন্ধু সরকারের মুখপাত্রের ভাষণ শোনায় মন না দিয়ে শিবু দোকানির কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক ভাবনায় ডুবে যাওয়া। বন্ধু সরকার ক্ষমতায় এলেও যে গরীবের ভাগ্যের খুব একটা হেরফের হয়না, হাঁদার 'গরীবের সরকার, গরীবের উপর লাঠি চালায় কী করে? জাতীয় অবোধ প্রশ্নগুলো পাঠকের মনে ইতিহাসের সেই সময়কে জানার একটা আগ্রহ তৈরি করে এগোতে থাকে। অনুসন্ধিৎসু পাঠক, লেখকের সেসব বয়ানে নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হন। গভীর মনোযোগ কেড়ে নেয় লেখকের বয়ানের মুন্সিয়ানা। যাদের ঘরে ফেরার কথা ছিল; যারা স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশহারা মানুষেরা দেশ পাবে, অন্নহীনের থালায় ভাত উঠবে, কেন তাদের ঘরে ফেরাটা নিশ্চিত করা গেলো না। কিংবা কেন তাদের 'রোজ চেটে খেতে হলো লজ্জা ও ঘৃণা', বাস্তবে সত্যিই তাদের কোনো দেশ আছে কিনা প্রশ্নের গোলক ধাঁধায় পড়ে 'আমি একা, ভারতের মত স্বাধীন। দুই চোখে দেখিনি তো দেশ কোনোদিন!' এমন এক উদ্বাস্তু আক্ষেপে ডুবে যেতে হলো। ফুল শুঁকিয়ে রাষ্ট্রীয় ছেলেধরারা হাজার হাজার তাজা প্রাণ যেসব তরুণ-যুবাকে ধরে নিয়ে গেলো কিংবা লোপাট করে দিলো, তার সঠিক হিসাবই বা কত? ইত্যাদির সবটাই হয়ত এই আখ্যানে ওঠে আসেনা। সে দায় লেখকের উপর চাপানোটাও অন্যায়, কারণ এই গল্পের স্পটলাইটটা কল্লোল ফেলেছেন একজনেরই উপর। গোরা নকশালকে কেন্দ্রে রেখেই তিনি নানান 'রেফারেন্স, কাউন্টার রেফারেন্স, অন্তর্ঘাতের বয়ান' দিয়ে গেছেন। এদত সংক্রান্ত বিষয়ে ঋদ্ধ পাঠকমাত্রই সেসব বুঝে নেবেন চটজলদি। সেরকম পড়াশোনার অভাবজনিত কারণে আমার পক্ষে তার সবটা বুঝে নেয়া খানিক মুশকিল হলেও উপন্যাসের টোন ধরে এগোতে খুব বেগ পেতে হয়নি।
অভিমন্যুর মত চক্রব্যুহ থেকে বের হবার মন্ত্র না জেনেই সেখানে প্রবেশের ঝুঁকি মানুষ ঠিক কখন নিতে পারে তার বিস্তারিত সুলুকসন্ধানে কল্লোল লাহিড়ীর গোরা নকশাল আমাকে আগ্রহী করেছে। ছোট্ট টুকুনের বিশ্বাস যারা উড়তে পারে তারাই নকশাল। গোরা নকশাল স্বপ্ন নিয়ে তাকে সেই উড়ানের বিদ্যােটাই শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। এই উড়ানের সীমারেখায় কোনো রাষ্ট্রীয়শক্তিই যেন লক্ষণরেখা টেনে দেবার দীনতা না দেখায়। রাজনীতির নামে, স্বাধীনতার নামে কারো পিঠে 'কাটা তারের দাগ' এর ছাপটা কলংক বয়ে বেড়ানোর মত মর্মঘাতী বেদনা না ছড়ায়। এটাই আন্তরিক চাওয়া।
প্রথম পাতা থেকে গুনলে(গল্প শুরুর আগে) এই বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪। ৯-১০ পাতার বিস্তীর্ণ সাদাটে অংশের শূন্যতা বেশ চোখে লাগে। পাতার সংখ্যা বিচারে এটা ছোটোখাটো উপন্যাস, বলাইবাহূল্য। কিন্তু ছোটো বলেই এটি একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মত বই নয় বলেই মনে হয়েছে আমার। এর গভীরতা ব্যাপক, সেটা পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন। প্রতিটা অধ্যায়ের শুরুতে উদৃত পংক্তিগুলো খানিকটা সূত্রধরের মত ভেতরের গল্পকে পাঠকের সামনে হাজির করেছে। এটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। জীবনকে আতশকাঁচের নীচে ফেলে দেখবার আর দেখাবার ক্ষমতা, এবং গল্পের ভাষা, কল্লোল লাহিড়ীর সবচে' বড় অস্ত্র। সে অস্ত্রের নানামুখী ঘায়ে পাঠক কখনও কাঁদবেন, নকশালদের উপর পুলিশি অত্যাচারের নির্মম বর্ণনায় শিউরে উঠতে উঠতে হয়ত ভাববেন(তাঁকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন), 'ওরকম একজন নরম সরম মানুষের পক্ষে এভাবে বর্ণনা করা কিভাবে সম্ভব!' আবার নিজের শৈশবের নানান ফন্দি ফিকিরের বয়ানে পাঠক ফিক করে হেসেও উঠবেন। গোরা নকশাল কল্লোল লাহিড়ীর প্রথম ছাপার অক্ষরের উপন্যাস। নকশাল নামের যে পায়রাটিকে তিনি পাশের বাড়ির হুলোর পেটে চালানের নানান চিন্তায় ডুবে ছিলেন শৈশবের অনেকটা সময়। একদিন সত্যি সত্যিই পায়রাটাকে হুলোটা ঘাড় মুটকে নিয়ে গেলে তার মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেকেই দায়ী করেন। মণির মামদোর চেয়েও ভয়ংকর ভাবে আজীবন কাঁধে(নাকি বুকে?)চেপে বসা গোরা নকশালের টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুতেও তিনি নিজের অক্ষমতাকে দায়ী করে ভেঙে পড়েন গভীর এক বেদনায়। হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে গোরাও নিশ্চিত বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন! কিন্তু পারেননি। তাঁদের সবার না ফেরার বেদনা ভুলতেই এই অসাধারণ লেখাটা গোরা নকশালসহ আরো যেসব স্বপ্নবাজ মানুষের বাড়ি ফেরা হয়নি, তাঁদের প্রতি লেখকের ব্যক্তিগত ট্রিবিউট। এরচে' সুন্দর, আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি আর কী হতে পারে! এ বইটির ভূমিকা যিনি লিখেছেন তাঁর পরিচয় জানার পর মনে কেমন একটা শিহরণ জাগে। তিনি বাস্তবের নকশাল আন্দোলনে জড়িত মানুষ, কল্লোল দাশগুপ্ত! এটিকে আমি কল্লোলের সৌভাগ্যই বলবো। সায়ন কর ভৌমিকের করা গোরা নকশালের প্রচ্ছদটাও উপযুক্ত বটে। রক্তাক্ত প্রান্তর, নানান জটজঞ্জাল পেছনে ফেলে শুভ্র-সুন্দর-কল্যাণকে বুকে নিয়ে সাদা এক পায়রার উড়ান! চমৎকার!! বাংলা চটি সিরিজের বই হিসেবে একটি গুরু চণ্ডা৯ প্রকাশনা থেকে বইটা প্রকাশিত। এর মূল্য:৬০টাকা(ভারতীয়)। লেখক হিসেবে কল্লোল লাহিড়ীর সৌভাগ্যের মুকুটে সাফল্যের নতুন নতুন পালক জুড়ে বসুক। সাহিত্যের জগতে এই বইটা নিজের ন্যায্য আসন পাক, সেই শুভকামনা।
✍️প্রাক কথন: লেখকের পরিচিতি আমার কাছে "ইন্দুবালা ভাতের হোটেল" বইটির মাধ্যমে। সেখানের দুই বাংলার এমন এক উপাখ্যান লেখক লিপিবদ্ধ করেছেন যা অনেকের মনকেই এমনকি আমাকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। এই বইটি সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না, এই বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনাও কোথাও শুনিনি। কিন্তু লেখকের আর কি লেখা আছে সেটা খোঁজ করতেই আত্মপ্রকাশ করল এই বইয়ের নাম। আমার ব্যাক্তিগত মত এই বইটি লেখকের বহুল সমাদৃত বই "ইন্দুবালা ভাতের হোটেল" এর থেকে কোনো অংশে কম নয়।
✍️মূল চরিত্র: মূল চরিত্র তকমা আমি এখানে একটি বাচ্চা ছেলেকেই দিতে চাই, যার নাম "টুকনু" যে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, যার হাত ধরেই গল্পের সূত্রপাত, বাবা, মা, এক চোখে ঠিক দেখতে না পাওয়া ঠাম্মা, মেধাবী দাদা, আরও অনেককে সঙ্গে করে যার প্রতিটি সকাল শুরু হয় রিফিউজি ক্যাম্পে।
ত���র জীবনের রূপরেখার বদল করতে যার আগমন হয় সেই "গোরা নকশাল"। যে দিন বদলের স্বপ্ন দেখে, এখানে গোরা নকশাল কেউ প্রধান চরিত্র বললে কোনো অত্যুক্তি হবে না । এছাড়াও রয়েছে সুশান্ত, প্রেসিডেন্সি কলেজের মেধাবী ছাত্র ও তার করুন পরিণতি।
✍️ পটভূমি/ প্রেক্ষাপট: বইয়ের নামকরণ থেকেই এটা সহজেই অনুমেয় যে বইটি নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা একটি সাহিত্য কর্ম, যদিও লেখক বইয়ের শেষে তার এই বইকে সম্পূর্ণ কাল্পনিক রচনা হিসেবেই ঠাই দিয়েছেন।
✍️ পাঠ অভিজ্ঞতা: লেখক বইটি লেখার ক্ষেত্রে কল্পনার আশ্রয় নিলেও যে লেখক বইটির মাধ্যমে আমাদের ভাবনা সত্তা কে পুরোমাত্রায় আন্দোলিত করতে সমর্থ হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঘটনার ঘনঘটা, তৎকালীন পরিস্হিতি, হার না মানা জেদ, অদম্য সহ্য শক্তি সব কিছু দিয়ে এক অপূর্ব সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন লেখক।
✍️ শ্রেষ্ঠ উক্তি আমার কাছে: "মনে রাখিস টুকনু, যারা প্রতিবাদের কথা বলে, যারা প্রাপ্য চাহিদার কথা বলে, যারা বলে ফিরিয়ে দাও আমাদের অধিকার,আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের দু বেলার দু মুঠো অন্নের অধিকার,তাদের প্রতিবার, প্রতি জনসমুদ্রে এইভাবে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এইভাবেই বার বার কণ্ঠনালী কেটে রক্তের গঙ্গায় বিসর্জন দেয়া হয়।"
"একজন কিশোর ছিল , একেবারে একা আরও একজন ক্রমে বন্ধু হল তার । দুয়ে মিলে একদিন গেল কারাগারে; গিয়ে দেখে তারাই তো কয়েক হাজার !" - জেলখানার কবিতা, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বইয়ের নামঃ গোরা নকশাল লেখকঃ কল্লোল লাহিরি প্রকাশকঃ গুরুচন্ডা৯ পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৬৪ মুদ্রিত মূল্যঃ ৬০ রুপি পার্সোনাল রেটিংঃ কিছু বই রেটিং দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না।
কাহিনী সংক্ষেপঃ (সংগৃহীত) শীতের কুয়াশা ঘেরা সকালে বাড়িতে হঠাৎ যে মানুষটা ফিরে এলাে তাকে এর আগে দেখেনি বছর পাঁচেকের টুক। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটা, গাল ভর্তি কোঁচকানাে দাড়ির নীচে ছড়িয়ে আছে অমলিন হাসি। আর চোখ দুটোর মধ্যে তখনও ভেসে বেড়াচ্ছে দিন বদলের স্বপ্ন। লােকটাকে সবাই চেনে গােরা নকশাল বলে। নকশাল? সেটা আবার কী? টুকনুর বাড়িতে পােষা পায়রাটাকে সবাই নকশাল বলে ডাকে। টুকনু এতােদিন জেনে এসেছে ওটা পায়রাদের টাইটেল। যারা উড়তে পারে তারাই নকশাল। কিন্তু সত্যিই কি তাই? সময়টাও কি ছিল না উড়ন্ত? টুকনুর শৈশব ধরে এমন একজন মানুষের হাত যিনি দেখেছিলেন একদিন সূর্যের ভাের গােরা নকশালের স্বপ্নের নক্সী কাঁথা বােনা চলে টুনুর মনে। সব মেনে চলা ছােট্ট জনপদটা আর ছােট্ট থাকে না। দেশ কাল সীমার গন্ডি পেরিয়ে এক আখ্যানের ভূমি হয়ে দাঁড়ায় যে পটভূমিতে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক বন্দী জীবন কাটিয়ে একটা মানুষ খুঁজে ফেরে তার বাড়ি, তার ঘর। তার দিন বদলের স্বপ্ন গুলাে গােরা নকশাল।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ অসাধারণ একটি বই। মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার বই কিন্তু কি শক্তিশালী লেখা। আমার পড়া শ্রেষ্ঠ বইগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে থাকবে বইটি। ভারতের নকশালবাড়ি আন্দোলন সম্পর্কে হালকা ধারণা ছিল বেশকিছু বই এবং মুভি দেখে। কিন্তু এই বইটিতে নক্সালপন্থীদের সকল সংগ্রাম, তাদের চাওয়া এবং তাদের উপর দিয়ে যাওয়া অমানুষিক অত্যাচার খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। লেখকের বর্ণণশৈলী চুম্বকের মত আটকে রেখেছিল সারাক্ষণ। বইটি পড়ার সময় গায়ে বেশ কয়েকবার কাটা দিয়ে উঠেছিল। বর্ণনাগুলো পড়ছিলাম আর বার বার পরিস্থিতিটা ইমাজিন করার চেষ্টা করছিলাম। বইতে থাকা কবিতার লাইনগুলোও বেস্ট। এক কথায় বলতে বইটি একটি অনবদ্য সৃষ্টি।
১." হাদার নকশাল নামে একটা পায়রা আছে। সেই রকম নকশাল? দাদা ঘাড় নাড়ে, না। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, নকশাল হলো তারা, যারা মনে করত একদিন সবকিছু পালটে দেবে।"
২."দাদা কিচ্ছু জানে না। এটা আসলে পায়রাদের টাইটেল। যারা ভালো উড়তে পারে তাদের নকশাল বলে।"
এমন অনেক সুন্দর সুন্দর সংলাপ এবং পাশাপাশি অনেক এলেগরির সমাহার বইটি। কমরেড গোরা নকশাল লাল সেলাম।
গোরা নকশাল লেখক- কল্লোল লাহিড়ী প্রকাশক - গুরুচন্ডালি মূল্য - ৬০ চোখ বন্ধ করে নিজের ছোটবেলা তে ফিরে গিয়ে বিস্মৃতির অতল থেকে খুঁজে আনা এক চরিত্রের গল্প। অসাধারণ লেখনীর গুণে এই ছোট্ট বইটি একেবারে খাঁটি মুক্ত।
একটি ৬৪ পাতার বই, সত্তর দশকের কতই না বলা গল্প বলেছেন লেখক এই ছোট্ট বইটিতে। গুরুচন্ডালি প্রকাশনীর বাংলা চটি সিরিজ এর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ন বই গোরা নকশাল। সায়ন কর ভৌমিকের প্রচ্ছদ বইটিকে একটি আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে, এই প্রচ্ছদ পাঠক কে ভাবাতে বাধ্য। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং আন্দোলনের এক অদ্ভুত মিশেল তৈরি করেছেন প্রচ্ছদে।
পটভূমি -
না এই বই নকশাল আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে না। বইটি আদপে নকশাল এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বেঁচে থাকা এক কাল্পনিক চরিত্রের কথা জানায় যার নাম গোরা। হ্যাঁ গোরা নকশাল আদপে একটি ফিকশন। এই গল্পটা গোরা নকশালের, যে দিন বদলের স্বপ্ন দেখতো, আর এই কারণেই রাষ্ট্র তাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। জীবনের আট বছর আর একটি ল্যাংড়া পা নিয়ে সে যখন ফিরে আসে তখন রাজ্যে লাল পতাকার শাসন, সে ভেবেছিল এবার তাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। এই গল্পটা রিফিউজি কলোনি তে বেড়ে ওঠা টুকনুর, ছোটবেলায় সবার জীবনেই একজন পাড়াতুত দাদা থাকে যাকে আমরা আইডল ভাবী, টুকনুর জীবনে সেই দাদা গোরা নকশাল। আসলে সে নকশাল এর মানে জানতো না, সে জানতো "যারা উড়তে পারে তারাই নকশাল"। তার কাকার একটা পায়রা ছিল যার নাম ছিল নকশাল। এই গল্পটির কথক টুকনু। সে গোরা নকশাল এর চোখ দিয়ে যা দেখেছে তাই সেটাই বর্ননা করেছে সঙ্গে যোগ হয়েছে নিজের আবেগ এবং উপলব্ধিগুলো। এই গল্পটা প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়া এক মেধাবী ছাত্র সুশান্তর, যে চশমা ছাড়া ভালো দেখতে পায়না। মজদুর ইউনিয়ন এর ডাকা ধর্মঘট সফল করার জন্য, পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় মারধর করে তখন এই টুকনুই গিয়ে রাস্তায় পরে থাকা ���শমাটা সুশান্তর হাতে দিয়ে আসে। সেই সুশান্ত আর ঘরে ফেরেনি, ফিরেছে তার পচা গলা কন্ঠনালী কাটা মৃতদেহ পাওয়া যায় গঙ্গার বুকে। গোরা নকশাল বুঝতে পারে সমাজ দিন বদলের স্বপ্ন গুলো অধরাই থেকে গেছে। "মনে রাখিস টুকনু, যারা প্রতিবাদের কথা বলে, যারা প্রাপ্য চাহিদার কথা বলে, যারা বলে ফিরিয়ে দাও আমাদের অধিকার,আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের দু বেলার দু মুঠো অন্নের অধিকার,তাদের প্রতিবার, প্রতি জনসমুদ্রে এইভাবে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এইভাবেই বার বার কণ্ঠনালী কেটে রক্তের গঙ্গায় বিসর্জন দেয়া হয়।"
পাঠ প্রতিক্রিয়া -
৬৪ পাতায় লেখক তুলে ধরেছেন এক অদ্ভুত সময়ের কথা, ১৯৭০ ১৯৮০ এর দশক সম্পর্কে আমিও শুধু বইয়ের পাতায় পড়েছি আর বাবা কাকার মুখে শুনেছি, এমনি একটি গল্প বলেছেন কল্লোল বাবু। বইটা সত্যি বলতে খুব যে সুখপাঠ্য হয়েছে তা না, বরঞ্চ কিছু কিছু জায়গায় গলার কাছে একটা গিঠ এর মত উপলব্ধি হয়েছে যা গেলা যাচ্ছে না ফেলা যাচ্ছে না। বইটা পাঠকদের নিয়ে যাবে সেই ছোটবেলা গুলোতে যেখানে মা এর বকুনি, মাঠে খেলতে যাওয়া, কারখানার ভেঁপু, মিটিং মিছিল ছিল। ঘটনার ঘনঘটা, তৎকালীন পরিস্হিতি, কিছু মানুষের হার না মানা জেদ, অদম্য সহ্যশক্তি আর দিন বদলের স্বপ্ন এই নিয়ে লেখক এক অনবদ্য সাহিত্য কর্ম সৃষ্টি করেছেন, যা একবার হলেও পাঠকের সত্তা কে আন্দোলিত করবে। যারা পড়েননি তাদের অনুরোধ করবো এই বইটি পড়ার জন্য। অসাধারণ বলিষ্ঠ লেখনীর গুনে এই ছোট্ট বইটি একখানি খাঁটি মুক্ত।