তাঁর জন্ম এবং বড় হওয়া হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর উপাধি অর্জনের পরে তিনি রাজ্য সরকারের অধীনে আধিকারিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ দুই-দশকের লেখক-জীবনে তিনি প্রাপ্তবয়স্ক এবং কিশোর-সাহিত্য, উভয় ধারাতেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তিনি যখন গল্প-উপন্যাস লেখেন, তখন ঘটনার বিবরণের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেন মানব-মনের আলোছায়াকে তুলে আনার বিষয়ে। লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। তাঁর বহু কাহিনি রেডিও-স্টোরি হিসেবে সামাজিক মাধ্যমে সমাদর পেয়েছে। সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন দীনেশচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার এবং নান্দনিক সাহিত্য সম্মান।
#কিসসাওয়ালা লেখক ~ সৈকত মুখোপাধ্যায় প্রকাশক ~ দ্য ক্যাফে টেবিল
লেখকের গল্প আগে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অল্পবিস্তর পড়া থাকলেও খুব ইচ্ছে ছিল একটা গল্প সংকলন পড়ে দেখার। ক্যাফে টেবিলের হাত ধরে সেই শখ পূর্ণ হল। এতে আছে ওঁর বারো বছরের লেখক জীবনে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত চল্লিশটা গল্প, যা তাঁর লেখা মূলধারার সামাজিক মনস্তাত্বিক কাহিনী।
একতা ভট্টাচার্যের আঁকা স্মার্ট প্রচ্ছদ বইকে একটা ইউনিক লুক দিয়েছে। ৩৬০ পাতার এই বইয়ের বাইন্ডিং দুর্দান্ত, ওজন মোটামুটি আর ফন্ট বেশ স্পষ্ট, পড়তে খুবই ভালো লাগবে।
বইটা শেষ করে আমার মনে হল চল্লিশটা গল্পের সবই যে মন ছুঁয়ে যাবে, এমন নয়। গল্পগুলো লেখক সাজিয়েছেন প্রকাশের ক্রমানুসারে। এতে পাঠক সহজেই বুঝতে পারবেন ওঁর লেখার স্টাইলের অভিযোজন সম্বন্ধে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে প্রথমদিকের বেশ কিছু গল্প ইন্টারেস্ট বাড়াতে পারল না। একটা সময়ে এমনও মনে হল যে শেষ করতে পারব না হয়তো বইটা। কিন্তু সাত নম্বর গল্প থেকে মোড় এমন ঘুরল যে বইটা রাখা মুশকিল হয়ে পড়ল। যেগুলো মনে ধরল, সেগুলো যেন "আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড"! হাঁ করে ভাবতে লাগলাম কীভাবে লেখক ভেবেছেন এমন সব দুর্দান্ত প্লট! প্রকাশের ক্রমানুসারে না সাজিয়ে প্রথমদিকেই ভালো ভালো কিছু গল্প থাকলে মনে হয় পাঠককে আরও তাড়াতাড়ি টেনে নেওয়া যেত।
"অ-ঘ্রাণ আলেখ্য" গল্পে তিনটে আলাদা দৃশ্যকোণের অদ্ভুত সুন্দর সংমিশ্রন করেছেন লেখক। বৃদ্ধ রাজিব গাঙ্গুলি থাকেন বনশ্রী হাউজিং কমপ্লেক্সে। একলা থাকেন বলে বাকি আবাসিকরাও খোঁজখবর নেন৷ কিন্তু রাজিব বাবুর স্মৃতিতে তাঁর জীবনের প্রথম কুড়ি বছর আর অবশিষ্ট নেই। অথচ সেই সময়কার বিভিন্ন গন্ধ আজও চিন্তায় ফেলে দেয় তাঁকে। যেমন, পরীক্ষার কথা উঠলেই উনি গঁদের আঠার গন্ধ পান, কিন্তু ভেবে পান না এর সম্পর্ক। পরে পাশের ফ্ল্যাটের ক্লাস এইটে পড়া অনুরাগের থেকে জানতে পারেন পরীক্ষার হলে সিট নাম্বারগুলো গঁদের আঠা দিয়ে আটকানো হয়। হয়তো সেই গন্ধই পান। কিন্তু দিদিভাইয়ের একটা অদ্ভুত কথার মানে খুঁজে পান না স্মৃতি হাতড়ে কিছুতেই। এদিকে অনুরাগ একদিন রাতে পাশের ফ্ল্যাট থেকে এক দৃশ্য দেখতে পায়। বাকিটা জানতে হলে পড়তে হবে গল্পটা।
"প্লাবনগাথা" গল্প গড়ে উঠেছে হঠাৎ আসা একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কেন্দ্র করে। অতনু আর কেয়া একে অপরের সান্নিধ্য পেতে চায়। কিন্তু দুটো আলাদা সংসারে থেকে সেই কুব্জচেতনা বাস্তবায়িত হতে পারে না। অবশেষে আসে সেই সুযোগ। কিন্তু সাথে নিয়ে আসে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা, যা এই গল্পটিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে চলে যায়। গল্পের শেষ লাইনে চরিত্রদ্বয়ের উপলব্ধি চিরকাল মনে থাকবে। আমার পড়া বেস্ট গল্প এই বইয়ের।
"স্বর্গবেশ্যার ছেলে" গল্পে প্রতিমার বিসর্জনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা ছেলেটার আসল লক্ষ্য, আর মূর্তির সাথে ওর কথোপকথন শুনে চমকে উঠবেন। জলে ভেসে চলা প্রতিমাকে সে জিজ্ঞেস করে, "মা তুই বেশ্যা হলি কেন?" প্লটের শেষ টুইস্টের জন্য কুর্ণিশ জানাই লেখককে। অসাধারণ লাগল গল্পটা।
এছাড়াও লুসিপাসের ললাটলিপি, বারাহী, বামন বিষাদময়ী কথা, কাঁকনের সংসার, দয়াল বাংলো, মেটাল - এই গল্পগুলো চিরকাল মনে থেকে যাবে। আশা করি পাঠকরা বুঝে গেছেন এই বই থেকে কী পেতে পারেন। প্রকাশকের কাছে অনুরোধ রইল সৈকত বাবুর আরও কিছু ভিন্নস্বাদের গল্প নিয়ে আসুক নতুন সংকলন।
বইয়ের ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন যে তার ‛কিসসাওয়ালা’ হওয়ার স্বপ্ন ছিল । ‛কিসসাওয়ালা’ যেমন হাটের এক কোণে বসে হাট-ফেরতা সব মানুষদের বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনায়, লেখকও তেমনই বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখে আমাদের শোনাতে চেয়েছেন । বলাই বাহুল্য, ‛কিসসাওয়ালা’ সৈকত মুখোপাধ্যায় সম্পূর্ণরূপে সফল । এই সংকলনটি বর্তমান বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্প-সংকলনগুলির মধ্যে খুবই উপরের দিকে থাকবে ।
এই সংকলনটি লেখকের (2006-2017) ১২ বছর ধরে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ছোটগল্পের সংকলন । প্রকাশকালের ক্রমানুসারে গল্পগুলি সাজানো হয়েছে, যাতে পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন লেখকের লেখনীর অভিযোজন সম্পর্কে ।
বইটির সবকটি গল্পই হৃদয় ছুঁয়ে যাবে এমন কিন্তু নয় । প্রথমদিকের বেশ কয়েকটি গল্প (2006-2007) বেশ আলগা গোছের, এগোতেই চায় না । এতে আমার মনে হয়েছিল হয়তো বইটা শেষ করে উঠতে পারবো না । কিন্তু 2007 এর শেষের দিক থেকে যে গল্পগুলি পেলাম, সেগুলি সম্পর্কে বলার ভাষা আমার নেই । পাতার পর পাতা উল্টে গেছি, গল্প শেষ হয়েছে, স্তম্ভিত হয়ে বসে থেকেছি, ভেবেছি এটা কি পড়লাম, তারপর সেই ঘোর কাটিয়ে উঠে চলে গেছি পরের গল্পে । কি অভূতপূর্ব লেখনী, আহা ।
এই সংকলনের ৪০টি গল্পের মধ্যে লেখক আমাদের জীবনদর্শনের নানা উপাদান নিয়ে আলোচনা করেছেন । প্রতিটি গল্পই প্রাপ্তমনস্ক পাঠকদের জন্য লেখা মূলধারার সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক কাহিনী । বিষয়বস্তু?? কি নেই ??? বন্ধুত্ব, প্রেম-অপ্রেম, পরকীয়া, হারিয়ে পাওয়া প্রেম, মনুষ্যত্ব, বেশ্যাদের কাহিনী । কখনো স্বপ্নপূরণ, কখনো হতাশা, কখনো নিত্যদিনের যাপন, আবার কখনো চরম হিংসার মোড়কে এক অদ্ভুত কিসসা । নিতান্ত সাদামাটা রোজনামচা দেখা গেলেও, তার আড়ালে ঘটে চলে অন্যরকম মনস্তাত্ত্বিক কাহিনী । লেখক সৈকত মুখোপাধ্যায় ‛কিসসাওয়ালা’ হতে চেয়ছেন, কিন্তু তিনি আসলে জাদুকর । সামান্যতম ফ্যান্টাসিও অসামান্য হয়ে উঠেছে লেখকের কলমের স্পর্শে ।
৩৬০ পাতার এই সংকলনটি চমৎকার । পাতার মান, ছাপার গুণমান, হার্ড বাইন্ডিং - সবকিছুই অসামান্য, এবং সেই তুলনায় দাম কিন্তু বেশ পকেট ফ্রেন্ডলি । প্রচ্ছদটি অত্যন্ত সুন্দর । মরুভূমির মাঝে চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে কিসসাওয়ালা’র তাবু । এই তাবুতে বসেই পাঠকদের গল্প শোনাচ্ছেন ‛কিসসাওয়ালা’ সৈকত মুখোপাধ্যায় ।
পাঠক, প্রবেশ করুন কিসসাওয়ালা’র ম্যাজিক-দুনিয়ায় ।
বছরের ১০ নম্বর বই, ৭ নম্বর গল্প সংকলন সৈকত মুখোপাধ্যায় এর লেখা ছোট গল্প সংকলন কিসসাওয়ালা।। বইয়ের ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন যে তার ‛কিসসাওয়ালা’ হওয়ার স্বপ্ন ছিল।। ‛কিসসাওয়ালা’ যেমন হাটের এক কোণে বসে হাট-ফেরতা সব মানুষদের বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনায়, লেখকও তেমনই বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখে আমাদের শোনাতে চেয়েছেন।। সৈকত বাবু লেখা শুরু করেছিলেন ২০০৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার মাধ্যমে।। আর এই বইয়ের মধ্যে আছে সেই ২০০৬ সালে প্রকাশিত গল্প থেকে ২০১৭ সাল অবধি প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্পগুলির একটি সংকলন।। এখানে মোট ৪০ টি গল্প আছে।। ৪০ টি গল্পের জনরা একদম পৃথক।। একে অপরের সাথে কোন জায়গাতেই তাদের মিল নেই।। বইটির প্রচ্ছদ অত্যন্ত সুন্দর এবং আকর্ষণীয়।। খুব ক্রিয়েটিভ ভাবনাচিন্তার মাধ্যমে এই কাজ করা হয়েছে।।
মোট ৪০ টি ছোট গল্পের সংকলন এই বইটি, আমি আমার পছন্দের কিছু গল্প সংক্ষেপে আলোচনা করে রাখলাম।।
🖤 আরোগ্��� কামনা - আত্মহত্যাপ্রবন, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা ত্বিষা, মনোবিদ বিতান কে বলেছে, আনন্দের গল্প, বেঁচে থাকার গল্প শোনাতে ত্বিষাকে।। বিতা��� শোনায় শ্রমোনা গ্রামের অভেরি জাতিদের গল্প।। যারা নিজেদের গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাতে জাতীয় সড়ক না তৈরি হয় সেই প্রচেষ্টায় গোটা একটা গ্রাম মৃত্যুর পথ বেছে নেয়।।
🖤 রক্তকস্তুরি - ওঙ্কার যোশী সুগন্ধ সন্ধানী, এডভেঞ্চার প্রিয় এক মানুষ।। তার নেশা আর পেশা হল, সুগন্ধ সন্ধ্যান করা।। এই গল্প তেমনি এক সুগন্ধীর গল্প।। এর সাথে আছে বৌদ্ধ তন্ত্র, এক প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা, এবং ইয়ংজং গুহা।।
🖤 বারাহী - একটা পরিবারের নৃশংস পরিণতি, অভাব অনটনের সংসারে বাবাহারা বাচ্চাদের পেটে খাবার তুলে না দিতে পারার যে গ্লানি, শিবানী তা রোজ অনুভব করে, শ্বশুরমশাই মারা যাওয়ার পর তো একমাত্র ভাশুর ও হাত তুলে নিয়েছে।। শিবানী, বুলা, খোকন, রাধি এরা তাহলে বাঁচবে কি করে।।
🖤 বামন বিষাদময়ী কথা - এই গল্পটি আদপে একটি প্রেমের গল্প।। প্রেম যে কত গভীর হতে পারে তার প্রমাণ দেয় এই গল্পের চৈতন্য এবং লবঙ্গ।।
🖤 বাদল আর জাদুকর সূর্যকুমার - বাদল ১৩ বছর বয়সী এক পথশিশু, মা মৃত, বাবার খোঁজ নেই।। বাদলের বেঁচে থাকার লড়াই, জাদুকরের সাথে তার বন্ধুত্ব এবং অন্তিম পরিণতি এই গল্পের উপজীব্য।।
🖤 চিরদুয়ার - এই এই গল্পটিও নিরন্তন প্রেমের গল্প সব প্রেম তো পূর্ণতা পায় না সেই রকমই এক অপূর্ণ কিন্তু আপাত পূর্ণতা পাওয়া এক প্রেমের কথা বলে এই লেখা।। অলকেশ এবং দিঠি, তাদের মাঝে একটি দরজা, একটি দুয়ার যা চিরকালীন দুয়ার হয়েই থেকে গেল।।
🖤 স্বর্গবেশ্যার ছেলে - ফেলারাম, রাতের অন্ধকারে ভাগীরথীর পারে বসে অপেক্ষা করছে মোহিতপল্লি বান্ধব দলের ঠাকুর বিসর্জনের।। সদাসতর্ক ও সুযোগসন্ধানী ফেলারাম, বিসর্জনের পর ওই প্রতিমার মুখ দেখে নিজের মায়ের কথা মনে পরে, আসলে ফেলারাম কিন্তু একটা কাজে এসেছে সেই কাজ এখন সে করছে, সেই কাজ তাকে দিয়েছে বিখ্যাত প্রতিমাশিল্পী শঙ্কর পাল।। এই গল্পটিও এই বইয়ের মধ্যে অসাধারণ একটি গল্প।।
🖤 প্রস্তুতিপর্ব - এই লেখাটি এক মধুমিতার কথা বলে যে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশেষ পরীক্ষার।। ভারতীয় রাগ রাগিনীর উপর এক গোছা বই নিয়েছে সারা জীবন ঘুরে বেড়ায় পথে পথে।।
🖤 ম্যাডাম কিউ - কিউ মানে বিরাট একটা প্রশ্ন চিহ্ন, কিউ মানে অপেক্ষমান নারীদের দীর্ঘ এক সারি।। কিউ মানে কুইন, কিউ মানে মর্গে শুয়ে থাকা রাজেন্দ্রানী।। এক ব্যর্থ কবি জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে ফোনে কথার মাধ্যমে যৌনসুখ দেওয়ার পন্থাকে।। এই বইয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি লেখা।।
🖤 মেটাল - মিঠাপানি গির্জার বাগানে একটা ঘণ্টা লাগানোর স্বপ্ন ফাদার জোসেফ হারাধন টুডুর।। ঘন্টা বসাতে খরচ ২৫ হাজার টাকা অথবা ত্রিশ কেজি মেটাল।। মিঠাপানি গ্রামের গরিব মানুষজন কি পারবে সেই ঘণ্টা বসাতে।।
🖤 বুকের পাথর - নিজের বউকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে কোম্পানির থেকে অর্ডার নেয় রনিত গুপ্ত।। নারীকে পণ্য করার ঘটনা মহাভারতের সময় থেকেই চলে আসছে আর এই গল্প আধুনিক সময়ে তাড়িয়ে তেমনি এক নিদর্শন।।
🖤 মাটির বেহালা - ভারত সরকারের উন্নয়ন মন্ত্রকের সর্বেসর্বা হীরালাল টুডু আর তার সর্বক্ষণের দেহরক্ষক মুসাফির।। দুজনের বার্তালাপ এই গল্পের উপজীব্য।। এই গল্পটিও এই বইয়ের মধ্যে অসাধারণ একটি গল্প।।
🖤 মৌনের মিনার - পার্শী সম্প্রদায়ের মানুষদের মৃতদেহ কিভাবে সৎকার করা হয় জানেন।। তারা মৃতদেহকে আগুনে পোড়ায় না বা মাটিতে কবর দেয় না, টাওয়ার অফ সাইলেন্স নামে একটি জায়গায় তারা মৃতদেহকে তুলে রাখে, তারপরে শকুন বিভিন্ন মাংস খেকো পাখিরা সেই মৃতদেহকে খুবলে খুবলে খায়।। আর এই গল্প তেমনি একটি নৃশংস নিষ্ঠুর গল্প।। পড়ুন ভালো লাগবে।।আরো বহু গল্প নিয়ে বলাই যায় কিন্তু এর পরে লিখতে গেলে আরো লেখাটি বড় হয়ে যাবে।। তাও এখানে বলে দিচ্ছি আরো যে কটি গল্প অত্যন্ত ভালো লেগেছে।।চান্দ্রায়ন ব্রতকথা, হাতছানি, কাঁকনের সংসার, দয়াল বাংলো, ভারসাম্য।।
🍁🍁পাঠ প্রতিক্রিয়া -
প্রতিটি গল্পই প্রাপ্তমনস্ক পাঠকদের জন্য লেখা মূলধারার সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক কাহিনী।। বিষয়বস্তু ?? কি নেই ??? বন্ধুত্ব, প্রেম-অপ্রেম, পরকীয়া, হারিয়ে পাওয়া প্রেম, মনুষ্যত্ব, বেশ্যাদের কাহিনী।। কখনো স্বপ্নপূরণ, কখনো হতাশা, কখনো নিত্যদিনের যাপন, আবার কখনো চরম হিংসার মোড়কে এক অদ্ভুত কিসসা।। নিতান্ত সাদামাটা রোজনামচা দেখা গেলেও, তার আড়ালে ঘটে চলে অন্যরকম মনস্তাত্ত্বিক কাহিনী।। আসলে সৈকত মুখোপাধ্যায় বাবুর উপন্যাস এর থেকে অনেক অনেক ভালো লেখেন এই গল্পগুলি, এই সংকলন এর প্রথম ৬ টি গল্প একটু আলাদা ধরনের, বোঝা যায় প্রথম সারির লেখা, তারপরের লেখা গুলো অনেক বেশি ডাইরেক্ট, অনেক পরিণত, বেশি নারেশন নেই, সুন্দর সাবলীল ভাষায় লেখা।। বেশ কয়েকটি লেখা পড়ে পাঠকের মনে হবে এর মধ্যে আর কি গল্প থাকতে পারে!! কিন্তু সমান্তরাল ভাবেই লেখক বুনে গেছেন দারুন দারুন সব প্লট।। আরেকটি বিশেষ দিক হল প্রত্যেকটি গল্পই বাস্তব জীবনের খুব কাছাকাছি।। বারাহী, স্বর্গবেশ্যার ছেলে, ম্যাডাম কিউ, মেটাল গল্পগুলি এতটাই ভালো লেগেছে যে এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছি আমি।। এই ধরনের লেখা আরো আশা করবো লেখকের থেকে আগামী দিনে।।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যাদের জন্ম,একবিংশ শতকের প্রথম দিকে শৈশব ছাড়িয়ে তারা কৈশোরের পথে পা বাড়িয়েছি।সেইসব সেপিয়া রঙের দিনগুলোয় ছাদে গিয়ে এন্টেনা ঘুরিয়ে ছবি ঠিক করে সাদা-কালো দূরদর্শনে শক্তিমান,জুনিয়র-জি,ক্যাপ্টেন ব্যোম ইত্যাদি গলাধঃকরণ করার পাশাপাশি বই নিয়েও চলত দাদা,বোনেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি।ছোটদের বই পড়ার সাথে সাথে লুকিয়ে বড়দের পত্রিকা পড়ার অভ্যাসও শুরু এর পরে পরেই।আনন্দমেলা,শুকতারা,সন্দেশ,কিশোর ভারতী,কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞান এর পাশাপাশি রুটিনে জায়গা করে নিচ্ছিল দেশ,বর্তমান,পত্রিকা,সানন্দা,নবকল্লোল।প্রথম বড়দের লেখা পড়ার নিষিদ্ধ আনন্দের স্বাদ পাঠকমাত্রেই জানেন।কিন্তু কয়েকজন হাতেগোনা লেখকের কিছু গল্প-উপন্যাস ছাড়া সেইভাবে বড়দের লেখা টানেনি কোনোদিনই।অর্থাৎ,ছোটদের লেখা যেমন নির্বিচারে পড়তে ভালো লাগে,উপন্যাস ছাড়া বড়দের লেখায় সেইভাবে মুগ্ধ হবার অবসর হয়নি। কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর অবসর সময়ে উপন্যাসের প্রতি চিরকালীন পক্ষপাতিত্ব থাকলেও গল্পের ব্যাপারে খুঁতখুঁতুনি রয়েই যায়।লেখক পছন্দের হলেও মনভরেনা অনেকসময়ই।আজকের দুর্বারগতির জীবনে ঝকঝকে জীবনযাত্রার মত গল্পেরাও ঝকঝকে,ভাষাও মেদহীন,তৎসম শব্দের প্রয়োগ তাতে উল্লেখযোগ্য ভাবে কম।উপন্যাসে,বিশেষ করে ঐতিহাসিক উপন্যাসে এখনও এর চল রয়েছে,কিন্তু গল্পের ক্ষেত্রে ব্যবহার নগণ্য।অন্তত,বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলিতে ছাপা বেশিরভাগ গল্পই আধুনিক শব্দেই রচিত।তৃষ্ণার্ত মন তাই ভাষার অলঙ্কারে সজ্জিত একেকখানি নিটোল গল্পের পথ চেয়ে থাকে।খুব কম সময়ই পাওয়া যায় সেই চোখের আরাম,মনের শান্তি। গল্প হবে এমনই,যা স্পর্শ করে যাবে হৃদয়ের অন্তরতম স্থলটি।সেই স্পর্শের মাধ্যম হতে পারে কখনও কোমল প্রেমানুভূতি,কখনও তীক্ষ্ণ শ্লেষ,কখনও বা নির্ভেজাল হাস্যরস,আবার প্রবল বিষাদসাগরে নিমজ্জিত হতে হলেও কোনো ক্ষতি নেই।মোদ্দা কথাটা হল,সাগরতীরের বালুকাবেলায় আঙুল দিয়ে কাটা ক্ষণস্থায়ী দাগের মত নয়,ভীমবেটকার গুহামানব যে অক্লান্ত পরিশ্রমে পাথরের গায়ে ক���লজয়ী দাগগুলো কেটেছিল,ঠিক সেইরকম হবে পাঠকমনে এর স্থায়ীত্ব।তাই পাঠকের প্রশ্ন হল,এইসময়ে দাঁড়িয়ে কার লেখায় এই বিবিধ ভান্ডার খুঁজে ফিরব?কার লেখায় পাব সেই স্বতঃস্ফুর্ত ভাষানির্মাণ যাতে সাধারণ চরিত্ররাও অপরূপ রূপে ধরা দেবে? যাঁরা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নিয়মিতভাবে গল্প লিখছেন,যাদের প্রায় প্রত্যেকটি গল্পই নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও গুণমান বজায় রেখে নির্মাণ করে চলেছে এক আশ্চর্য মায়াবী জগৎ,যার কলাকুশলীরা সকলে আমাদেরই চারপাশের চেনা-অচেনা চরিত্র,তাঁদের প্রথম কয়েকজনের একজন হলেন সৈকত মুখোপাধ্যায়।বারো বছরের লেখকজীবনের চল্লিশটি বাছাই করা মণিমুক্তো প্রকাশের ক্রমানুসারে সাজিয়ে পাঠকের কাছে তিনি পেশ করেছেন 'কিসসাওয়ালা' নামে।নিজেকে লেখকের তুলনায় 'কিসসাওয়ালা' বা গল্পবলিয়ে ভাবতেই যিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন,তাঁর গল্পসংকলনের এমনধারা নাম হওয়াই বাঞ্ছনীয় নয় কি? কোন এক অজানা গাঁয়ে হাটবারের সন্ধেতে মাথার ওপর চাঁদ উঠলে কিসসাওয়ালার আসর বসেছে।বেচাকেনা-ক্লান্ত হাটুরের দল উৎসাহভরে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে,না জানি কোন আশ্চর্য গল্প শুনিয়ে তাদের সারাদিনের শ্রান্তি ধুইয়ে দেবে সে।আসুন,গুটিগুটি পায়ে পেছনের সারিতে বসে পড়ি আমরাও,ঢুকে পড়ি কিসসাওয়ালার আজব কিসসার জগতে। লেখকজীবনের শুরুর দিকের গল্পগুলি মূলত বিষাদধর্মী এবং খানিক জটিলতা বয়ে চলতে ইচ্ছুক।তবে শল্কের পর শল্ক ছাড়িয়ে গভীরে গেলে দেখা হয়ে যায় 'অবলোকিতেশ' এর যৌনপ্রত্যাখ্যাত থেকে মৃতকামী হয়ে ওঠা বাসবী,বকুলগন্ধে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকা 'অ-ঘ্রাণ আলেখ্য'র গাঙ্গুলীদাদু,'আরোগ্য কামনা'র আত্মহত্যাকামী ত্বিষা বা 'চান্দ্রায়ণ ব্রতকথা'র রাজীবের মত দৈনন্দিন জীবন থেকেই উঠে আসা বর্ণময় চরিত্রের সঙ্গে।গল্পের চলন এবং তার ভাষাশরীর নির্মাণ দুইয়েই লেখকের প্রস্তুতিপর্বের পরিশ্রম পরিলক্ষিত হয়েছে।আবার আশ্চর্য প্রকৃতিপ্রেম ও রিপুসংবরণের উদাহরণ 'রক্তকস্তুরী',জাদুবাস্তবতার সার্থক প্রয়োগে 'সেরিবান যে পথটা খুঁজেছিল' দিয়ে তাঁর অন্যধারার গল্প লেখার শুরু।আলাদা করে বলতেই হয় 'বারাহী'র কথা।প্রাচীন বৌদ্ধদেবীর মূর্তিখোদিত নৌকার উল্লেখ এবং গভীর দুঃখজনক পরিণতি একে স্বতন্ত্র করেছে।'সন্ধ্যার গোয়েন্দা একজন'এ রহস্য গল্পচ্ছলে আলোকপাত করা হয়েছে এক যৌন-উপবাসী মেয়ের জটিল মনোবৃত্তে।মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে,প্রেমও তার কাছে কিছুই নয়,এই আপ্তবাক্যের উপলব্ধি 'বামন বিষাদময়ী কথা'য়।গত দশকের শেষ থেকে চলতি দশকের শুরুতে প্রকাশিত গল্পগুলিতে ফের গভীর দীর্ঘশ্বাস বিস্তৃত হয়েছে।বিশেষত,'বাদল আর জাদুকর সূর্যকুমার' সহজ লিনিয়ার ন্যারেটিভে বলে যাওয়া অথচ তীব্র অভিঘাতযুক্ত একটি উৎকৃষ্ট কাজ।আবার,'চিরদুয়ার' গল্পে দেখা মেলে সেই চিরন্তন নরনারীর,অবধারিত বিচ্ছেদ জেনেও যারা যুগযুগ ধরে বন্ধ দরজার দুদিকে অপেক্ষমান।মানুষের জীবনের বেশিরভাগ জায়গাটা জুড়ে আছে তীব্র দুঃখ-কষ্ট,হতাশা,সুখ সেখানে ডুমরের ফুলের মত বস্তু।আর কে না জানে,চিরকাল দাগ ফেলার ক্ষমতা দুঃখেরই বেশি। লেখক অক্ষরসেতু দিয়ে পাঠককে পার করাতে চেয়েছেন সেই অসীম বিষাদসিন্ধু,বা হয়তো পার করাতে নয়,টেনে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেয়েছেন সেই অন্ধকারতম সত্যের মুখোমুখি।তাই প্রায় প্রত্যেকটি গল্পেই আধিপত্য চরম কষ্টের।ঘুণধরা সমাজের প্রায় প্রতিটি কোণায় জড়সড় হয়ে থাকা অসহায়,লাঞ্ছিত,অপমানিত,সর্বহারা মানুষগুলোই প্রধান চরিত্ররূপে বারবার এসে দাঁড়িয়েছে গল্পের আঙিনায়।তারমধ্যে কাহিনীর অভিনবত্বেই হোক বা তার আশ্চর্য সমাপ্তিতেই হোক,'স্বর্গবেশ্যার ছেলে','কাঁকনের সংসার','দয়াল বাংলো','মেটাল','মেহেদিবাড়ির করাতকল','মাটির বেহালা','পিতৃমুখী','মৌনের মিনার' আলাদা জায়গার দাবি রাখে।আবার,সংকলনের শেষ গল্প 'টেকেন ফর গ্র্যান্টেড' তার সর্বজ্ঞ কথকের কারণে হয়ে উঠেছে অনন্য।লক্ষণীয় এই যে,বারো বছর ধরে গল্পের ভাষা ক্রমশঃ সহজ হয়ে এসেছে,রূপকের আড়াল ছেড়ে সোজাসুজি চরিত্রের মাধ্যমেই আঘাত হেনেছে পাঠকের বুকে।এই সরলীকরণের কারণ অজ্ঞাত,তাও প্রথমদিকের গল্পগুলির মধ্যে যে আবিষ্কারের আনন্দ রয়েছে,তাতে ভবিষ্যতে এধরণের গল্পের প্রত্যাশা থাকবেই।প্রত্যেকটি গল্পের শেষে প্রকাশকাল থাকায় লেখনীর বিবর্তনপথ বুঝতে বেশ সুবিধা হয়েছে,একথা অনস্বীকার্য। এ তো গেল গল্পের জগতের কথা।বইটির ভূমিকা 'স্বপ্নে স্বপ্নান্তরে'র কথা খানিক না বললে এ কীবোর্ড এর খটখটানি বৃথা।এই যে কিসসাওয়ালা হওয়ার অলীক স্বপ্ন,প্রতিটি গল্পেই একটি নিটোল গোলগল্প পাঠককে উপহার দেওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা,ফ্যান্টাসীর আড়ালে লুকিয়ে রাখা কষ্টের তাসটি ঠিকই চিনিয়ে দেওয়া,গল্পের বিভিন্ন আঙ্গিকে পরীক্ষানিরীক্ষা এবং সর্বোপরি মানুষের কথা লিখে চলার যে আকুল প্রার্থনা,এই সবই লেখক তাঁর অদ্ভুত সুন্দর ভাষার মাধ্যমে পাঠকের হাতে তুলে ধরেছেন এই ভূমিকার মধ্যে দিয়েই।তাই শুধুমাত্র এইটুকু পড়ার জন্যই আমি বইটি বারবার হাতে তুলে নিতে মুখিয়ে থাকব। অবশেষে,প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে বলি,কিসসাওয়ালার জন্য বেদুইন তাঁবুর চেয়ে বড় আশ্রয় আর কীই বা হতে পারে?আর,পাঠকের হাতে এই অমূল্য উপহার তুলে দেওয়ার জন্য 'দ্য কাফে টেবিল'এর অবশ্যপ্রাপ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।যাঁরা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে আমার এই অসীম ধৃষ্টতার নমুনা পড়েই ফেলেছেন,তাঁদের অনুরোধ,কিসসাওয়ালার আসরে একবার এসে বসেই পড়ুন।লোকটা বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে বটে,তা বলে সে কাউকে ঠকাবার ইচ্ছা রাখেনা,একথা নিশ্চিত বলতে পারি।
সৈকত তাঁর সংকলনের ভূমিকায় এই এক সরল, প্রায় শিশুসুলভ উচ্চারণে নিজের সাহিত্যিক আত্মপরিচয়ের ক্যানভাস আঁকেন। তবে এই উচ্চারণ মোটেই সরল রোমান্টিকতায় বাঁধা কোনও বয়ান নয়। এটি যেন এক অদৃশ্য বহতা ধ্বনি, যা প্রান্তিক মানুষের ঠোঁট থেকে উঠে আসে, বসে যায় হাটের ধুলোয়, মাটির হাঁড়িতে ফুটে ওঠে কিসসার জল, আর তার বাষ্পে আমরা দেখি আমাদের নিজের মুখ।
‘হাটের কোণে বসে গল্প বলা’—এই চিত্রকল্পটি আপাতভাবে নস্ট্যালজিক, কিন্তু একুশ শতকের বাঙালি পাঠকের চেতনায় এটি একটি পুনর্গঠিত বাস্তবতা। এটি যেন সেই লুপ্তপ্রায় মৌখিক ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ, যা ‘নকশাল’ যুগের তাণ্ডব পেরিয়ে, ‘কালো গল্প’-এর প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। সৈকত মুখোপাধ্যায় সেই বিস্মৃত ঘুঘু-ভাঙা গদ্যের উত্তরাধিকারী, যিনি গল্প বলেন—তবে তা মাটির গন্ধে ভেজা বাস্তবতা আর প্রান্তের নৈঃশব্দ্যের কোলাজে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।
সংকলনের ৪০টি গল্প মূলত ২০০৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে লেখা। লেখকের ভাষায়, এটি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গাঁথা গল্পচরিত্রের ‘তাবু’। প্রতিটি কাহিনিই আলাদা, কিন্তু সুরটিকে চিনে ফেলা যায়—এক নিঃশব্দ, ঠোঁটকাঁপা করুণ ধ্বনি, এককালের ফেলে আসা মনোবেদনার ঠিকুজি।
তবে কিসসা এখানে নিছক গালগল্প নয়, আবার শুধুই রিয়ালিস্টিক গদ্যও নয়। বরং এই গল্পগুলি ফাঁকফোকরে জমে থাকা সেইসব যন্ত্রণার রূপ, যাকে খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়—ঠিক যেমন রবি ঠাকুর লিখেছিলেন: “দুঃখকে যিনি রস করিতে জানেন, দুঃখ তাঁহারই রসসিক্ত হয়।” (সাধনা, ১৮৯৬)
এই বইয়ের একাধিক গল্প সেই দুঃখকেই রসে পরিণত করে। "স্বর্গবেশ্যার ছেলে", "মেটাল", "নির্ভয়া", কিংবা "বুকের পাথর"—প্রতিটি গল্প যেন বাস্তবতার মজ্জাগত চিৎকার, যার উচ্চারণ এত সংযত যে পাঠকের হৃদয়ে পেরেকের মতো বিঁধে যায়।
বিশদে:
১) ‘গল্প’ থেকে ‘গূঢ়তা’ - পাঠক অভিজ্ঞতার বিবর্তন: গল্পগুলি লেখক সাজিয়েছেন প্রকাশের ক্রমানুসারে। ফলে পাঠক একজন সহযাত্রী হয়ে ওঠেন—বুঝতে পারেন সৈকতের ভাষা কীভাবে সময়ের সঙ্গে বদলেছে, কীভাব��� আগুন থেকে ধোঁয়া ছড়িয়েছে, আর সেই ধোঁয়ার ভিতর দিয়েই ফুটে উঠেছে চরিত্রের ধূসর জটিলতা।
প্রথমদিকের গল্পগুলি কিছুটা কাঁচা হতে পারে, ঠিক যেন সদ্য-কাটা বাঁশের গন্ধ—তীক্ষ্ণ, কড়া, এখনও রোদে পোড়েনি। কিন্তু সপ্তম বা অষ্টম গল্প থেকে ভাষা তীক্ষ্ণ হতে শুরু করে, গল্পের পর গল্প টেনে নিয়ে যায় একরকম ব্যতিক্রমী আবেশে।
যেমন—"অ-ঘ্রাণ আলেখ্য"-তে লেখক তিনটি ভিন্ন ভিউপয়েন্টকে যেভাবে সংহত করেছেন, তা মনে করিয়ে দেয় কুরোসাওয়ার Rashomon ছবির কাঠামো, যেখানে সত্যই একাধিক। গন্ধ, স্মৃতি এবং শূন্যতা এখানে জটিল প্রতীক। রাজীব গাঙ্গুলি নামের চরিত্রটির মস্তিষ্কের ভাঁজে জমে থাকা গন্ধ যেন আধুনিক স্মৃতিচিহ্নের সেমিওটিক্স। পাঠকের চোখে জল এনে দেয় না, কিন্তু মস্তিষ্কে বাষ্প তোলে।
অন্যদিকে, "মেটাল"-এ যে বাক্যটি— “ওরা বুঝতে পেরেছে, পৃথিবীতে কোনো দিন খালি কার্তুজের অভাব হবে না”—
এটি কেবল সাহিত্য নয়, বরং শ্লেষে বাঁধানো রাজনৈতিক চাবুক। এখানে সৈকত যেন কাব্যিক অস্ত্রশস্ত্রে বলপূর্বক ঢুকে পড়ছেন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতায়। এটি যেন একটা সার্বভৌম সতর্কীকরণ: নিপীড়নের গন্ধ ছড়ায় ঈশ্বরের ঘরেও।
২) কথনশৈলীর কাঠামো ও বয়ান-প্রযুক্তি: সৈকত বাবুর লেখার একটি বড় শক্তি তাঁর বয়ানকৌশল। তিনি কখনও এক্সপোজিশনে যান না, বরং ছোট ছোট চিত্রকল্প, সংলাপ এবং ছেঁড়া বর্ণনাগুলিকে পিনের মতো গেঁথে দিয়ে গড়ে তোলেন চরিত্র এবং পরিপার্শ্ব। তাঁর ভাষা সরল, কিন্তু প্রতিটি বাক্যের নিচে চাপা থাকে একটি জলের স্রোত—যেটি হঠাৎ চরিত্রের চোখের কোণে লেগে থাকে।
তাঁর "ম্যাডাম কিউ", "চিরদুয়ার", কিংবা "রক্তকস্তুরি"-র মতো গল্পগুলি এমন, যেগুলি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে পড়ে না, অথচ সেখানে রক্তপাত ছাড়াই প্রতিদিন ঘটে যায় ট্র্যাজেডি।
“কিউ মানে কুইন, কিউ মানে অপেক্ষমান নারীদের দীর্ঘ এক সারি…”—
এই বাক্যটিকে আমরা পড়ি, কিন্তু একপলক থেমে বুঝি—এটি আসলে সেই অদৃশ্য ‘লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা’ সমস্ত নারীর আত্মকাহিনি।
বয়ানে বারবার আমরা দেখি এক ধরনের ট্রান্সজেনিক দৃষ্টিভঙ্গি—অর্থাৎ দৈনন্দিনের মধ্যে অদ্ভুতুড়ে, অলৌকিক, কখনও কখনও হিংস্র ফ্যান্টাসির প্রবেশ। এখানে রিয়ালিজম আছে, কিন্তু তার মধ্যে আছে ফাটল, যার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে স্বপ্ন, ভয়, কিংবা হঠাৎ জেগে ওঠা রাজনৈতিক চেতনা।
কিসসা, কল্পনা, এবং কাঁটা গলার মতো সত্য: সৈকতের গল্পের মধ্যে একধরনের বিষণ্ণ সৌন্দর্য আছে। তাঁর গল্পেরা ফিনিক্সের মতো, বারবার ভস্ম থেকে উঠে দাঁড়ায়। অনেক চরিত্র পরাজিত, ভাঙাচোরা, অথচ তারা নিজেদের কাহিনি বলতে চায়। ঠিক যেমন হেমিংওয়ের ‘The Old Man and the Sea’-এর সান্তিয়াগো বলেছিল— “A man can be destroyed but not defeated.”
এই সংকলনের গল্পগুলিও তাই—ধ্বংসপ্রায় কিন্তু পরাজিত নয়। “জন্মবিষ”, “বামন বিষাদময়ী কথা”, “বুকের পাথর”—প্রতিটি গল্পে যেন এই আত্মসম্মান খুঁজে পাওয়া যায়।
এই গল্পগুলিকে ‘ফিকশন’ বললে ভুল হবে। এগুলি বাস্তবের পেটে লুকোনো সেই কিসসা, যা কেউ বলে না, শুনতেও চায় না। সৈকত তাদের বলার সাহস দেখিয়েছেন।
৩) পাঠক হিসেবে যে প্রশ্ন থেকে যায়: সৈকতের গল্পপাঠ শেষে বারবার প্রশ্ন আসে—আমরা এই সমাজে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? লেখক আমাদের মনের আয়নায় যে প্রতিবিম্ব দেখান, তাতে নিজেদের রূপ অনেক সময় চিনে উঠতে পারি না।
“তুমি কি সত্যি নিজের মাকে চিনতে পারো?”—এই প্রশ্ন উঠে আসে "স্বর্গবেশ্যার ছেলে"-তে।
“তুমি নিজের কণ্ঠস্বর ভুলে গেছ?”—এটা যেন প্রতিটি নারীকেন্দ্রিক গল্পের মূলে।
আর সবচেয়ে বড় কথা, সৈকতের কলম আমাদের পাঠকত্বের সংজ্ঞাটাকেও চ্যালেঞ্জ জানায়। তিনি চায় না আমরা শুধু পাঠ করি—তিনি চান, আমরা কিসসার একেকজন অংশ হয়ে উঠি।
সৈকত মুখোপাধ্যায়ের ‘কিসসাওয়ালা’ কেবল একটি গল্পসংকলন নয়। এটি এক চেতনার দলিল, যেখানে গল্পের মধ্য দিয়ে সমাজকে আত্মসমীক্ষা করানো হয়। তাঁর কলম শুধুই নির্মাণ করে না—সে ধ্বংসও করে, চিরাচরিত কাঠামো ভেঙে দেয়। ঠিক যেমন অরুন্ধতী রায় লিখেছিলেন:
“There’s really no such thing as the ‘voiceless’. There are only the deliberately silenced, or the preferably unheard.” (The Cost of Living, 1999)
এই বইয়ে প্রতিটি কিসসা যেন সেই ‘preferably unheard’ কণ্ঠের গর্জন। আর পাঠক হিসেবে, এই গর্জনের সঙ্গে আত্মস্থ হওয়াই হয়ে ওঠে আমাদের সাহসিকতার দৃষ্টান্ত।
তাই ‘কিসসাওয়ালা’ শুধু একটি সংকলনের নাম নয়—এ এক আলোকবর্তিকা। অন্ধকারের ভিতর গল্পের আলো ধরিয়ে সৈকত মুখোপাধ্যায় যেন পাঠককে বলেন— "শোনো, এই কিসসা তোমারও..."
৪) গল্পের শরীর ও আত্মা: গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়, এগুলো যেন আলাদা আলাদা চরিত্র, কিন্তু আত্মার গভীরে তারা একে অপরের সহোদর। "অঘ্রাণ আলেখ্য", "রক্তকস্তুরি", "বারাহী", "স্বর্গবেশ্যার ছেলে", "মেটাল" কিংবা "ম্যাডাম কিউ"—প্রতিটি গল্পে আলাদা প্লট, আলাদা পরিস্থিতি, কিন্তু গল্পগুলির ভাষা, ছন্দ এবং বিষাদের যে অভিন্ন রেখা, তা একটি গল্পপাঠক জাতির মনস্তত্ত্বকে উসকে দেয়। যেমন টি.এস. এলিয়ট The Waste Land-এ লিখেছিলেন: "These fragments I have shored against my ruins." সৈকতের গল্পগুলি ঠিক সেভাবেই ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি, ক্ষত, কষ্ট, প্রেম, অপ্রাপ্তি এবং ভয়ঙ্করের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
৫) ফর্ম ও ফ্যান্টাসির সংলগ্নতা: সৈকত স্বয়ং স্বীকার করেছেন—তাঁর গল্পে রিয়ালিজম নেই বললেই চলে। বরং একটি টুকরো দৃশ্য থেকে কল্পনার এক অসমাপ্ত ক্যানভাস তৈরি করেন তিনি। এটি কিছুটা মার্কেসের ম্যাজিক রিয়ালিজম-এর ধাঁচে পড়ে, আবার কোথাও কোথাও বেলা বার্টোক বা মারিও ভার্গাস ইয়োসার মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রমের ছাপ স্পষ্ট।
যেমন ধরা যাক গল্প "রক্তকস্তুরি"। গল্পটির প্রোটাগনিস্ট ওঙ্কার যোশীর পেছনে ছুটে বেড়ানো সুগন্ধ—এ এক বৌদ্ধিক অথচ বস্তুজগতের অনুসন্ধান। এই গল্পের গায়ে লেগে থাকে রক্ত ও সুগন্ধের দ্বৈততা, যা পাঠককে অস্বস্তিকর অথচ মোহময় এক প্রান্তে নিয়ে দাঁড় করায়। এখানে যেন ড্যান্টের সেই লাইন ফিরে আসে: "Abandon all hope, ye who enter here." (Inferno, Dante Alighieri)
যতবার সৈকত রক্ত, নির্জনতা, দেহ, বা সময় নিয়ে খেলেন, ততবার যেন পাঠক নিজেকেই খুঁজে পান এক অন্ধকার গুহায়।
৬) নারী ও নগরের ক্রন্দন: নারীচরিত্র সৈকতের গল্পে নিছক ভিক্টিম নন। বরং তাঁরা বারবার গর্জে ওঠেন, প্রতিরোধ করেন, অথবা প্রশ্ন তোলেন। "স্বর্গবেশ্যার ছেলে"-তে যেমন এক বিসর্জিত প্রতিমাকে তার ছেলে প্রশ্ন করে: "মা, তুই বেশ্যা হলি কেন?"—এই প্রশ্নটি যেন আঘাত করে আমাদের সামাজিক কাঠামোকে, এবং স্মরণ করায় মহাভারতের দ্রৌপদীর নৈরাশ্য:
"নাহি কিঞ্চিত্ প্রিয়ং মম, সর্বং দুঃখময়ং জগৎ।" (আমার প্রিয় কিছুই নেই, এই জগত্ সম্পূর্ণ দুঃখময়।)
এই নির্লিপ্ত দুঃখবোধ সৈকতের গল্পে এক অবধারিত সত্য হয়ে আসে। মেয়েরা এখানে কাঁধে রক্ত নিয়ে হাঁটে, মুখে আছে প্রত্যয়ের ছায়া। "ম্যাডাম কিউ" এই দৃষ্টান্তে এক বিরল গল্প—যেখানে একটি কিউ শব্দের ভেতরেই লুকিয়ে আছে নারীর দীর্ঘশ্বাস, দেহনীতি, শিল্প এবং স্বপ্নের ধ্বংসাবশেষ।
৭) সমাজ, ভাষা ও ভাঙনের বয়ান: "মেটাল" গল্পে সৈকত লিখছেন— "ওরা বুঝে গেছে, পৃথিবীতে কোনো দিন খালি কার্তুজের অভাব হবে না।"
এই একটি বাক্যেই যেন সংঘাতজর্জর সমাজের মুখোশ ছিঁড়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে এক নির্মম, অথচ চেনা বাস্তব। এটি শুধু একটি গ্রামের গল্প নয়—এ এক জাতীয়, এমনকি বৈশ্বিক ট্র্যাজেডির প্রতীকময় উচ্চারণ। যেখানে অস্ত্রই ঈশ্বর, সন্দেহই ন্যায়, আর রাষ্ট্র নামক দেবতা কেবল রক্তেই স্নান করে।
এই বাক্যটি যেন প্রতিধ্বনিত করে জঁ বোদ্রিয়ার-এর সেই অন্তর্দৃষ্টিকে: "Power itself is no longer a political relation but a semiotic one." অর্থাৎ ক্ষমতা এখন আর কেবল প��রশাসনিক নয়, তা হয়ে উঠেছে প্রতীক-ভাষার খেলা। সৈকতের ‘মেটাল’ এই প্রতীকীকরণকে নাটকীয় নির্লিপ্ততায় প্রকাশ করে।
‘মেটাল’ শব্দটি এখানে শুধু ধাতব নয়, বরং মানবচরিত্রের কঠোরতা, সহানুভূতির মরুচিত্র, এবং বোধশক্তির মরচে পড়ে যাওয়ার প্রতীক। গল্পের আবহে যে নিরবতা ও সংশয় গড়ে ওঠে, তা পাঠকের মনে তীব্র অভিঘাত ফেলে—ঠিক যেন সেই সমাজে আমরা নিজেরাই বাস করি, যেখানে সত্যকে চাপা দিতে ব্যবহৃত হয় তথ্য নয়, ট্রিগার।
ভাষার ভাঙন ও বহুমুখিতা -- একটি বয়ানিক তত্ত্ব: রোলাঁ বার্ত বলেছিলেন: "Narrative is determined not by a desire to narrate but by a desire to exchange." (বার্ত, S/Z)
এই “আদান-প্রদানের ইচ্ছা” ঠিক কোন স্তরে কাজ করে সৈকতের লেখায়?—তা বোঝা যায় তাঁর ভাষা-নির্মাণের বহুবিধ রূপান্তরে।
সৈকতের ভাষা কখনও আর্কাইভিক—একদম পুরনো দিনের মতো গম্ভীর; আবার কখনও লোকমুখে শোনা বাচনিক ভঙ্গিতে ধরা দেয়—যেন বাজারের কোণায় দাঁড়িয়ে গল্প বলছেন এক পথচলতি লোক; আবার কখনও তা হয়ে ওঠে সংবাদপত্রের খসড়া ভাষ্য—তথ্যনিষ্ঠ, অথচ আবেগহীন; এমনকি কখনও বা তা মনস্তাত্ত্বিক চুপচাপি, আত্মার নিঃশব্দ বয়ান।
এই ভাষার বহুকেন্দ্রিকতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় Mikhail Bakhtin-এর “Heteroglossia”-র ধারণা, যেখানে বলা হয়েছে: “Every utterance is a struggle of voices.” সৈকতের প্রতিটি গল্পেই যেন একাধিক কণ্ঠস্বর মিশে যায়—লেখক, চরিত্র, পাঠক, সমাজ, ইতিহাস—সব মিলে এক
৮) আঙ্গিকের অভিযোজন ও গল্পের বিন্যাস -- ধারাবাহিকতায় বিবর্তনের রেখাচিত্র: ‘কিসসাওয়ালা’-র বিন্যাসে রয়েছে এক রকম গোপন নকশা—গল্পগুলি যেমন কালক্রম অনুযায়ী সাজানো, তেমনি এর ভেতরে পাঠকের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে এক অন্তর্লীন সাহিত্যিক অভিযাত্রা। এক অর্থে, এটি একটি bildungsroman—তবে লেখকের নয়, বরং লেখকের ভাষার, ভঙ্গির, ও বয়ানের পরিণতির কাহিনি। পাঠকের জন্য এটি যেন এক প্রত্নতাত্ত্বিক যাত্রা—যেখানে স্তরে স্তরে উন্মোচিত হয় লেখকের বয়ান-কৌশলের রূপান্তর ও শাণিত হয়ে ওঠা।
কিন্তু সপ্তম গল্প থেকে স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যায়। যেন সৈকত হঠাৎ করে নিজের ছায়া ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ান—নিজস্ব গ্রুভ, স্বর ও সুরে। এখান থেকে গল্পগুলি কেবল ঘটনার বিন্যাস নয়, বরং ভাষাগত অর্নামেন্টেশন, আঙ্গিক-সংলগ্ন ধাক্কা এবং থিমেটিক layering-এ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
"A style is a means of insisting on something." — Susan Sontag, Against Interpretation
সৈকতের স্টাইল পাঠকের মনন-তন্ত্রে কিছু "জোর" দিয়ে ঢোকে—সেই জোর আবেগের নয়, ভাষার অন্তর্গত বিন্যাসগত পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে জন্ম নেয়। ঠিক যেমন “প্লাবনগাথা” গল্পে ভাষা কখনও নদীর মতো বয়ে যায়, আবার কখনও রুদ্ধ স্রোতের মতো জমাট বেঁধে ওঠে।
বাস্তব ও প্রতীকের সুরম্য সন্নিবেশ: “দয়াল বাংলো”, “মাটির বেহালা”, “টেকেন ফর গ্র্যান্টেড”, “নির্ভয়া”—এই গল্পগুলো যেন বাস্তব ও প্রতীকের এমন এক সংমিশ্রণ তৈরি করে, যেখানে পাঠক অনুভব করেন:
একদিকে অন্তঃসারশূন্যতা ও সামাজিক নিষ্ঠুরতার নগ্ন রূপ, অন্যদিকে অপ্রকাশ্য বেদনা ও প্রতিরোধের প্রতীকী ভাষা।
এই দ্বৈততা একেবারে গল্পের নির্মাণগত পরতে পরতে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, “মাটির বেহালা” গল্পটিতে ‘মাটি’ এখানে কেবল ভূমি নয়, বরং প্রতীক—মানুষের সহজাত সংবেদনশীলতা, যার ওপরে জেগে ওঠে ছাঁদহীন যন্ত্রবন্দিত জীবনের ব্যর্থ সুর।
এই প্রতীকী রূপায়ণ T.S. Eliot এর উদ্ধৃতিকে মনে করায়: "Genuine poetry can communicate before it is understood." সৈকতের গদ্য কখনও কখনও এমনই—তা একসময়ে পাঠককে স্পর্শ করে, বুঝিয়ে দেয়ার আগেই সে কেঁদে ফেলে।
বয়ান-কৌশলের বহুমাত্রিক অভিযোজন: এই গল্পসংকলনে সৈকতের আঙ্গিকগত বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। কখনও তিনি ব্যবহার করেছেন প্রথম পুরুষ বক্তার সংলগ্ন মনোলগ, কখনও বা তৃতীয় পুরুষের চোখ দিয়ে নির্মাণ করেছেন দৃষ্টিভঙ্গির দ্বৈততা। ভাষা কখনও স্বতঃস্ফূর্ত, কখনও বা ইচ্ছাকৃত জটিল—কিন্তু প্রতিবারই তাঁর আঙ্গিক পাঠকের অভিজ্ঞতাকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে না, বরং disorient করে, recalibrate করে।
“নির্ভয়া” গল্পে ব্যবহার করা হয়েছে একটি প্রায় documentary realism-এর কাঠামো, যেখানে সংবাদ, স্মৃতি, রাষ্ট্র এবং নৈরাশ্যের কোলাজ একজোট হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই সৈকতের সাহিত্যিক কৌশল অন্য উচ্চতায় পৌঁছায়—কারণ পাঠকের কল্পনা না জাগিয়ে, এখানে তাকে ঠেলে দেওয়া হয় নির্মম বাস্তবের সামনে।
ধাক্কার বিন্যাস -- এক অভ্যন্তরীণ অর্কেস্ট্রেশন: গল্পের বিন্যাসে একরকম সংগীতশাস্ত্রীয় সুরধ্বনি কাজ করে—আস্তে শুরু, মাঝপথে উত্তরণ, তারপর একের পর এক ক্লাইম্যাক্স, যেন এক কাকতালীয় নয়, বরং সাবধানে গড়া লিটারারি অর্কেস্ট্রা।
“নির্ভয়া” গল্প শেষ করে এক আত্মবিস্মৃত শোকসংগীতের মতো।
এই অভ্যন্তরীণ সংগীত যেন Borges-এর সেই কথাকে মনে করিয়ে দেয়:
“Time is a river that sweeps me along, but I am the river; it is a tiger that devours me, but I am the tiger.”
সৈকতের কাহিনি-প্রবাহ পাঠককে গিলে খায়, কিন্তু পাঠক তাতেই নিজেকে খুঁজে পান।
৯) পাঠপ্রক্রিয়া ও পাঠকের মনস্তত্ত্ব: “পাঠ” এখানে একটি অনুভব, একটি অভিঘাত, একটি আত্মদর্শন।
কিসসাওয়ালা পড়া মানে কেবল কাহিনি গ্রহণ নয়—এ এক নিজস্ব মনোজাগতিক প্রতিক্রিয়ার রাসায়নিক সংযোগ। সৈকতের গল্পগুলিতে পাঠক নিজেই এক চরিত্রে রূপান্তরিত হন—যিনি কেবল বিচার করেন না, বরং আলো-আঁধারির ভিতর দাঁড়িয়ে নিজের অনুচ্চারিত অনুভবগুলির মুখোমুখি হন। এই গল্পগুলি যেন মনের আয়নাঘরে পাঠককে আটকে ফেলে। সেখানে প্রতিফলিত হয়—সমাজ, রাজনীতি, লিঙ্গ, যৌনতা, হিংসা ও ত্যাগের প্রতিচ্ছবি।
সৈকত নিজেই স্বীকার করেছেন: “আমার অভিজ্ঞতাকে আমি হুবহু লিখতে পারিনি, লিখলে আবেগ এসে কলম ফেলে দিত।”
এই বক্তব্য শুধু এক লেখকের আত্মস্বীকারোক্তি নয়—এ এক নৈতিক অবস্থান। এই দ্বিধা, এই দোলাচল—সেই আবেগ ও আত্মসংযমের মধ্যবর্তী লীলা—সেই তো শিল্পের স্ফুলিঙ্গ জন্ম দেয়। Barthes যেমন বলেছিলেন, “The birth of the reader must be at the cost of the death of the author.”—এখানে সৈকত বারংবার নিজেকে হত্যা করেছেন, যাতে পাঠকের জন্ম আরও গভীরতর হয়।
এই অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার আভাস যেন আমরা পাই মহাভারতের এই শ্লোকে: "शोचन्ति जिह्वया लोकाः, कर्मणा शुद्धिं आप्नुयात्।" (অর্থ: লোক মুখে শোক করে, কিন্তু কাজ দিয়েই পবিত্রতা লাভ করে।)
এই কাব্যিক অন্তর্দৃষ্টি সৈকতের বয়ানে কল্পনার শরীর পায়। তাঁর গল্পে শোক, অপরাধবোধ বা অনুতাপ কেবল রচনার উপজীব্য নয়—তারা নিজেই রচনার উপায়।
ছায়া, প্রতিচ্ছবি এবং অনুভূতির ডার্ক ম্যাটার: সৈকতের অনেক গল্প শেষ হয় না—তারা থেকে যায়। ফেলে দেওয়া পর্ব নয়, বরং এক টানাপোড়েনের হোমরান। সেই গল্পের শেষে পাঠক একা হয়ে পড়েন না—বরং ভেতরের এক মৌন প্রতিধ্বনির মুখোমুখি দাঁড়ান। কখনও তীব্র হাহাকার, কখনও বিদ্রূপ, কখনও নির্লিপ্তি—প্রতিটি অনুভবই যেন একেকটি রঙ, যা পাঠকের মানসপটে খেলা করে।
ব্লেক যেমন বলেছিলেন: "Without contraries is no progression." (The Marriage of Heaven and Hell)
এই ধারণাটি সৈকতের লেখার DNA-তে প্রবাহিত। তাঁর গল্পে আমরা এক অদ্ভুত দ্বৈততা দেখি—যেখানে মানবিক কোমলতা হঠাৎ এক নির্মম নৈরাজ্যে রূপ নেয়, আবার পিশাচের ভেতরেও একটা অদ্ভুত মনুষ্যত্ব জেগে ওঠে। ভালোবাসা ও ঘৃণা, কামনা ও নিষ্ঠা, হাসি ও শোক—সব একসঙ্গে বাস কর��� তাঁর প্যারাগ্রাফে।
পাঠক হিসেবে ‘আমি’, পাঠক হিসেবে ‘আমরা’: এই গল্পগুলি কোনও “একক” পাঠকের জন্য নয়—বরং ‘আমরা’—যারা নিজেদের খুঁজি ভাষার লুকানো সাঁতারে, এই বই তাদের জন্য। যখন একজন পাঠক “স্বর্গবেশ্যার ছেলে” পড়ে অভিমানে স্তব্ধ হয়ে যায়, বা “ম্যাডাম কিউ”-র শরীরী কণ্ঠে এক নিঃসঙ্গ মানবিকতা খুঁজে পায়, তখন সে আসলে নিজের ইতিহাসকে পুনঃপাঠ করে।
Paul Ricoeur-এর ন্যারেটিভ থিওরি অনুযায়ী, “to read a story is to enter time twice over.” একদিকে কাহিনির ভেতরের সময়, অন্যদিকে পাঠকের নিজের অভিজ্ঞতার সময়। সৈকতের গল্পগুলি ঠিক এই দ্বিত্ব সময়ের স্তরে পাঠকের মনে এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক সুর বেজে তোলে।
অনুভব ও অনুরণনের স্থায়িত্ব: সব গল্প একরকম অভিঘাত ফেলে না। কখনও কিছু গল্প মুহূর্তেই বিস্মৃত হয়, কিন্তু কয়েকটি গল্প—যেমন বারাহী, মেটাল, চিরদুয়ার, বুকের পাথর—পাঠকের মগজে যেন স্থায়ী স্থাপত্য নির্মাণ করে। যেগুলি সময়ের সীমানা পেরিয়ে একধরনের slow burn তৈরি করে—এক রকম নিঃশব্দ চেতনার বিস্ফোরণ।
Virginia Woolf বলেছিলেন: “A good story leaves its mark like a wound.” সৈকতের কিছু গল্প এইরকমই—মধুর আঘাতের মতো, যা সারেও না, ঘায়েলও করে না; শুধু মনে পড়ে যায়।
সমাপ্তি নয়, নতুন পাঠের উন্মেষ: এখানে পাঠ শেষ হয় না—বরং শুরু হয় পাঠকের এক নতুন অভিযাত্রা। ‘পাঠ’ এখানে একটি আত্মজিজ্ঞাসা, একটি দুর্মর অথচ অন্তরঙ্গ যাত্রা—যেখানে গল্পের ভেতরের চরিত্রের সঙ্গে পাঠক নিজের প্রতিচ্ছবিও দেখতে পান। সৈকতের ভাষা কখনও ছুরির মতো ধারালো, আবার কখনও জলপাই পাতার মত কোমল; ঠিক যেন Ovid-এর Metamorphoses—যেখানে প্রতিটি রূপান্তরই বাস্তব ও রূপকের দ্বৈত আলোড়নে আবর্তিত।
১০) উপসংহার -- কিসসাওয়ালার তাবুতে পাঠকের তৃষ্ণা, কল্পনার কাফেলা: এই সংকলনের প্রচ্ছদে মরুভূমির বুকে জ্বলজ্বলে চাঁদের আলোয় একটি তাবু, আর তার সামনে বসে থাকা এক কিসসাওয়ালা—এই দৃশ্য শুধু অলংকার নয়, বরং এক কাব্যিক আত্মজীবনচিত্র। এই কিসসাওয়ালা আসলে এক কাল্পনিক পথিক, যিনি সময়ের গর্ভে ধ্বনি ছড়ান, শব্দের শরীরে তুলে আনেন আমাদের অদৃশ্য ক্ষত। এই কিসসাওয়ালাই সৈকত মুখোপাধ্যায়, যাঁর প্রতিটি গল্প এক একটি নিরক্ষর ভ্রমণ—যেখানে বাস্তব আর মিথের সীমানা মিশে যায়।
এই কিসসাওয়ালার তাবুটা আসলে বাংলা সাহিত্যেরই প্রান্তিক এক মঞ্চ। পাঠক এসে বসেন, কেউ আবিষ্ট, কেউ অস্বস্তিতে, কেউ বা গোপনে অশ্রুসিক্ত। আর এই পাঠপ্রতিক্রিয়াই বোঝায় বইটি কতটা মূর্ত, কতটা রক্তমাংসের। সৈকতের কিসসাগুলি কেবল মনোরঞ্জন নয়; তারা আমাদের বিবেকের ঘুম ভাঙায়, প্রশ্ন তোলে, সংলাপ চায়।
“Storytelling reveals meaning without committing the error of defining it.” — Hannah Arendt, The Human Condition
সৈকতের গল্পগুলো যেন সেই ন্যারেটিভ, যা কোনও সত্যকে ঘোষণা করে না—বরং তাকে অনুভব করায়।
কিন্তু এই অনুভব, এই আবিষ্টতাও সরল নয়। কিসসাওয়ালার গল্পে আমরা পাই:
প্রিয় সত্য — যাকে আমরা আশ্রয় করতে পারি, যেমন প্রেম, সহানুভূতি, অনুকম্পা।
অপ্রিয় রূপক — যা আমাদের বিবেককে অস্বস্তিতে ফেলে, যেমন যৌনতা, নিপীড়ন, শ্রেণিচেতনা, মৃত্যুর গন্ধ।
এই দ্বৈত অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ যেন মেলে প্রাচীন শ্লোকে:
"सत्यं ब्रूयात् प्रियं ब्रूयात्, न ब्रूयात् सत्यम् अप्रियम्।" (সত্য বলো, প্রিয় বলো, কিন্তু এমন সত্য বলো না যাতে অপ্রীতি জন্মে।) সৈকতের গল্প ঠিক এই শ্লোকে আচ্ছাদিত দ্বিধাকে চ্যালেঞ্জ করে। তিনি অপ্রিয় সত্য বলতেও কুণ্ঠিত নন, তবে তার ভঙ্গি কখনও কুশ্রী নয়। এখানে কষ্টও শিল্প, অস্বস্তিও কাব্য।
এই কিসসা শুধু পঠনের জন্য নয়—আত্মস্থ করার জন্য: এই সংকলন আসলে একান্তভাবে পাঠকের ব্যক্তিগত ভ্রমণপথে অদৃশ্য সহচর। সৈকতের গল্প পড়া মানে কেবল একেকটা গল্পে ঢুকে পড়া নয়, বরং নিজের ভিতরকার অপঠিত গল্পগুলিকেও পড়া। একেকটা চরিত্র যেন আত্মপরিচয়ের আয়না। “স্বর্গবেশ্যার ছেলে”-র ফেলারাম, “মেটাল”-এর গ্রামের মানুষ, বা “ম্যাডাম কিউ”-র অভিশপ্ত কণ্ঠ—তাঁরা কেবল কাহিনির চরিত্র নন, তারা পাঠকের ভিতরে বাস করে।
যেমন টনি মরিসন বলেছিলেন: “If there's a book that you want to read, but it hasn't been written yet, then you must write it.”
সৈকতের ‘কিসসাওয়ালা’ যেন সেই অবলম্বনহীন পাঠকের হয়ে লেখা বই—যারা গল্প খোঁজে, কিন্তু পায় না; যাদের দুঃখকে কেউ গল্পে বাঁধে না।
শেষ কথা? না, এক অন্তহীন আহ্বান: এ বই শুধুমাত্র সংগ্রহে রাখার জন্য নয়—এটি ঘরে রাখতে হয়, কিন্তু মগজে চলতে হয়। কিসসাওয়ালা পাঠককে শুধু গল্প শোনায় না, তাকে প্রস্তুত করে গল্প বলতে শেখার জন্য। কারণ এই কিসসা, একবার শুনে ফেলার পর, মন থেকে মুছে যায় না। তার বর্ণনা, তার বর্ণ, তার বেদনাও ঘুরেফিরে আসতে চায়।
এটি এমন একটি সংকলন, যা পাঠ শেষে ফেলে রাখা যায় না। এর শব্দেরা ফেনিয়ে ওঠে, এর চরিত্রেরা পাঠকের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে।
তাই পাঠক, যিনি এখনও দ্বিধায় আছেন—এটি একটি বই কিনা, নাকি অভিজ্ঞতা—তাঁদের জন্য কেবল বলব: