এলোমেলো ঠান্ডা একটা বাতাস শুরু হয়েছে। সামান্য কেঁপে ওঠে বিস্তৃকা, এখনও তাকিয়ে রয়েছে অন্ধকার দিগন্তের দিকটায়। মাঠটার ওপর কুয়াশা নামতে আরম্ভ করেছে। সত্যিই কি ক্রাচে ভর করে কেউ আসছে?
পৈত্রিক সূত্রে চট্টগ্রামের মানুষ। যদিও বান্দরবান, ঢাকা আর সিলেটেই থাকা হয়েছে জীবনের বেশির ভাগ সময়। বাবা মোঃ আয়ুব ও মা ফাহিমা পারভীন রিতা। একমাত্র বড় বোন শারমিন আক্তার শিমু। পড়াশোনা করেছি চট্টগ্রাম টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে। বিএসসি শেষ করে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছি চট্টগ্রাম এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। ছোটবেলা থেকেই আঁকা আঁকির সাথে ছিলাম। ঘটনাক্রমে লেখক হয়ে গেছি। দুটো শখ মানুষের কখনো থাকে না একসাথে। তবুও মাঝে মধ্যে নিজেকে আঁকিয়ে, কখনো বা লেখক হিসেবে পরিচয় দিতে আনন্দ পাই। নিজের সম্পর্কে এটুকুই।
তেপান্তর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বিস্তৃকা ও দীপ্ত। বিস্তৃকার বড় বোন মৃত্তিকা বইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। উপন্যাসের প্রথম অর্ধেক আবর্তিত হয়েছে মৃত্তিকাকে নিয়ে। মৃত্তিকার পড়াশোনা,বিয়ে,সংসার জীবন এবং সুইসাইড নিয়ে। মৃত্তিকার মৃত্যু আপনাকে ভাবাবে। পরিবার ও সমাজের মানসিক চাপ কীভাবে একজন মানুষকে তিলেতিলে ধ্বংস করে দেয় তা কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন।
উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ বিস্তৃকা আর দীপ্তের সম্পর্ক নিয়ে। বিস্তৃকা নামের কালো মেয়েটি যে সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত,যাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসে দীপ্ত,যাকে মজার ছলে বিষ্ঠাপা বলে ডাকতো। মাস্টার্সে শেষ করার আগে দীপ্ত ব্যাংকে চাকরি পেলে তাদের সম্পর্ক পূর্ণতা পেতে শুরু করে। দীপ্ত যে ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলেও, ডিবেটে চ্যাম্পিয়ন কিংবা কবিতা লিখে আবৃত্তি করে মঞ্চ কাঁপিয়ে দিলেও সমাজের চোখে সে পঙ্গু, কারণ সে ক্রাচে ভর দিয়ে হাটেঁ। সেই সমাজ কি বিস্তৃকা-দীপ্তের এই সম্পর্ক স্বাভাবিক চোখে দেখবে? বিস্তৃকা-দীপ্তের সম্পর্কের পরিণতি জানতে উপন্যাসটি পড়ুন। বিস্তৃকার হাহাকার,বিষণ্ণতা আপনিও অনুভব করবেন লেখকের লেখার গুনে।
অমিয়েন্দ্র,অমিয়েত্রা পড়েই আমি মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাবের লেখার ফ্যান। উনার বাকি বইগুলো খুব শীঘ্রই সংগ্রহ করবো।
ছোট্ট, সুন্দর, এক বসায় পড়ে শেষ করে ফেলার মত একটা বই। পড়তে কম সময় লাগলেও রেশ রয়ে যাবে অনেকক্ষণ। লেখকের গল্প বলে যাওয়ার মত করে লেখার ভক্ত আমি আগে থেকেই। এখানেও তিনি নিরাশ করেননি। থ্রিলার নয়, আধিভৌতিক নয়, পাতায় পাতায় রহস্য নেই, কিন্তু তবুও কোথাও থেমে যেতে হয় নি। এই গল্পটা মৃত্তিকা, বিস্তৃকা আর দীপ্তর। সাথে গল্পটা একরাশ বিষণ্নতার।
বইপোকা বন্ধুবান্ধবদের কাছে ফরহাদ চৌধুরী শিহাবের অনেক প্রশংসা শুনেছি। তবে, এর আগে তার লেখা কোনো বই পড়া হয় নি। তেপান্তর বইটা অনেকটা “ভালোই, খারাপ না” ক্যাটাগরিতে পড়ে। বইটা একটা সামজিক উপন্যাস। দুজন মানব মানবীর সম্পর্ক, আর তাদের পারিপার্শ্বিক নানা জটিলতা নিয়েই বইয়ের কাহিনী। বইটার ভালো দিক হচ্ছে এর লেখনী। ফরহাদ চৌধুরীর লেখার হাত বেশ ভালো, এবং স্টাইলটাও unique. জগতের এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যপারগুলোও এত সুন্দরভাবে উপলব্ধি করা যায়, এটা উনার লেখনী না পড়লে হয়ত বুঝতাম না। একটা মেয়ের নাকফুল পড়ার ব্যপারটাও যে এত সুন্দরভাবে উপলব্ধি করা যেতে পারে, ব্যপারটা আসলেই অসাধারণ! কিন্তু, কাহিনীটা খুবই এভারেজ। আর দশটা উপন্যাস থেকে এটাকে আলাদা করার উপায় নেই। সেই একই ধরণের বিষাদময় কাহিনী। তবে হ্যাঁ, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ ভালো লেগেছে পড়তে। কাহিনীর সাথে বেশ রিলেট করতে পেরেছি। আর বইটা পড়ার পর এখন “ভাল্লাগতেছে না কিছু” স্টেজে আছি। কাহিনীটা আরেকটু ভিন্ন কিছু হলে হয়ত আরও ভালো লাগতো। এই আরকি। ধন্যবাদ।
এ গল্প দুই মানব-মানবীর। এ সমাজের কোনো এক ঘুপচি গলিতে বাস করা অসম ভালোবাসাযুক্ত দুই মানুষের গল্প।
গল্পের নায়িকার নাম বিস্তৃকা। গল্প-উপন্যাসের নায়িকারা দুধেআলতা রঙা, দীঘল কালো চুল আর অসম্ভব সুন্দর মায়াময় হাসির অধিকারিণী হয়। কিন্তু এতো শুধু উপন্যাস নয়! উপন্যাসের মোড়কের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাস্তবতার প্রাচীর ঘেরা গল্প। যে গল্প আমরা শুনতে চাই না, দেখতে চাই না তবু জোর করে এর শেষটুকু দেখানো হয়। আমরা কাঠপুতলির মতো দেখে যাই, নির্বাক দর্শক হয়ে। শুনে যাই এর পরতে পরতে থাকা প্রতিটি হাহাকার মেশানো গল্পগুলো।
বলছিলাম বিস্তৃকার কথা। কালো রঙের মেয়েটির কথা; যে আহামরি সুন্দর না, সাধামাটা জীবনে সাধামাটা যাপনে অভ্যস্ত এক তরুণী।
এই উপন্যাসে বিস্তৃকার শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের কিছু খন্ডাংশ দেখা যাবে। শৈশব আর কৈশোরের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে উপন্যাসের কাহিনি এগিয়েছে মৃত্তিকার জীবনকথা নিয়ে।
মৃত্তিকা পরিবারের বড় সন্তান, সম্পর্কে বিস্তৃকার বড় বোন। বাবা মোশতাক আহাম্মেদের অনেক স্বপ্ন ছিল মৃত্তিকা বড় হয়ে ডাক্তার হবে। বোর্ডস্ট্যান্ড করা মৃত্তিকা ডাক্তারি পড়ার জন্য মেডিকেলে ভর্তিও হয়েছিল নিজের যোগ্যতাবলে। কিন্তু বাস্তবতার আঘাতে তাকে তার স্থানচ্যুত হতে হয়।
বাবা স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে বাসায় বিছানায় পড়ে থাকেন। পরিবারের চার ভাইবোনের মধ্যে মৃত্তিকা বড়। মৃত্তিকার মা রোকসানা খানম স্বামীর চাকরি পেয়ে নিজের মতো করে সংসারটা গুছিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু কিছুদিন পর স্বামীর অকস্মাৎ মৃত্যুতে খেই হারিয়ে ফেলেন। শতাব্দীধরে চলমান মজ্জাগত শিক্ষা তার আত্মবিশ্বাসকে দমিয়ে ফেলেছিলো। তাই মৃত্তিকার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করার জন্য বাধ্য করেন।
জীবনে চলার পথে কাউকে না কাউকে নিজের জীবন/ স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়। মৃত্তিকা তাই ডাক্তারির স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়।
বিয়ের পরও মৃত্তিকা ডাক্তারির পড়া চালিয়ে যেতে থাকে। স্বামী হিসেবে শওকত অনেক ভালো। সরকারি চাকরিতে বেশ ভালো একটা পদে আছে। কিন্তু ঝিনুকের জীবন নিয়ে যে জন্ম নিয়েছে তার জীবনে সুখ বেশিদিন সইলো না। বিয়ের বছরখানেক পর শুরু হয় মৃত্তিকাকে মানসিক চাপ দেওয়া। ঘরের বৌ ডাক্তারি পড়ে কী হবে? বাইরে ছেলেপেলের সাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ, যদি অন্য কোনো ছেলের হাত ধরে চলে যায়?
শ্বশুড় শাশুড়ির এধরণের কথায় ভয়াবহ মানসিক চাপে পড়ে মৃত্তিকা। কিন্তু স্বামী শওকতকেও অনেক ভালোবেসে ফেলে। স্বামীর সুখের কথা চিন্তা করে ভবিষ্যতের কথা না ভেবেই হুট করে বাচ্চা নিয়ে ফেলে সে। কিন্তু এতেও সমাজের মুখ বন্ধ হয় না। বাচ্চাটা আসলেই শওকতের তো? নাকি বাইরে যাদের সাথে ডাক্তারি পড়ে তাদের কারো? নইলে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের বছরখানেকের মধ্যে শিক্ষিত কেউ বাচ্চা নেয় নাকি?
মৃত্তিকা নিজেকে বঞ্চিত মনে করে। করবেই বা না কেনো? পরিবারের বড় সন্তান হওয়াতে নিজের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে বিয়ে করেছে আর সেখানেও দুদণ্ড শান্তি নেই। শওকত বাচ্চা হওয়ার পর কেমন যেন বদলে গেছে। কাছের মানুষগুলোকে আর আপন মনে হয় না। দিগন্তের সীমারেখার মতোই তাদের পর মনে হয়, ঠিক চেনা যায় না।
মৃত্তিকার জীবনের এরকম ���িছু গল্প শেষ হয় বিস্তৃকার কৈশোরে। এরপর চলতে থাকে জীবন তার দুর্বার গতিতে। সময় তো থেমে থাকে না। কিছু পুরনো স্মৃতি বিশেষ কিছু সময়ে জেগে উঠ��� মাত্র। এই জেগে উঠা স্মৃতি নিয়েই জীবন চলতে থাকে তার নিজস্ব ধারায়।
বিস্তৃকার মেজ বোন হৃত্বিকা আর মিশুকের ভূমিকা উপন্যাসে খুব নগণ্য ছিল। তবে মৃত্তিকার মৃত্যুর পর উপন্যাসের কাহিনি এগোতে থাকে বিস্তৃকার ছোটবেলার বন্ধু দীপ্ত আর বিস্তৃকার সম্পর্ক নিয়ে।
দীপ্ত বিস্তৃকার সমবয়সী বন্ধু। হিসেবে দুজন একই ক্লাসে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু নিউমোনিয়ার কারনে দীপ্ত একটা পা হারায় ছোট থাকতেই। তাই বিস্তৃকার এক ক্লাস নিচে ভর্তি হয় ছেলেটা।
দীপ্ত ছোটবেলা থেকেই বিস্তৃকাকে ভালোবাসতো। দুষ্টুমি করে বিস্তৃকাকে 'বিষ্ঠাপা' বলে ডাকতো। এতে বিস্তৃকাও ক্ষেপে গিয়ে দীপ্তকে মারতো অনেক। স্কুল কলেজে জুনিয়র হলেও ভার্সিটি ভর্তির সময় বিস্তৃকা দীপ্তর সাথেই পরীক্ষা দিয়ে একই বছরে একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। আলাদা ডিপার্টমেন্ট হলেও পাশাপাশি বাসা হওয়াতে দুজন একইসাথে যাওয়া আসা করতো। এভাবে দুজনের সম্পর্ক বেশ ভালোভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু দীপ্ত মাস্টার্সে থাকাকালীন চাকরি পাবার পর সম্পর্কের সমীকরণ পাল্টে যায়। এতোদিনের দুষ্টুমির ছলে বলা কথাগুলো পূর্ণতা পায়।
কিন্তু দীপ্তর প্রতিবন্ধকতার দায় সমাজ এড়াতে পারে না। দীপ্ত ডিবেটে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছেলে, অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল, কবিতা লিখে আবৃত্তি করে মঞ্চ কাঁপিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। তাতে কী? সমাজ চোখে আঙুল দিয়ে তার একটা পা আর ক্রাচ দুটো দেখিতে দেয়। এই সমাজ স্বাভাবিক মানুষের, এই সমাজ পঙ্গুত্বের ভার বয়ে চলা কারো না। দীপ্তর হাজারো গুণ থাকার পরেও তার পায়ের প্রতিবন্ধকতা তাকে সমাজের স্বাভাবিক জীবনযাপনের স্বীকৃতি দেয় না। বিস্তৃকা আর দীপ্তর সম্পর্কে তাই ছন্দপতন হয়। দীপ্ত জোর করে দূরে চলে যায় বিস্তৃকার কাছ থেকে।
বিস্তৃকা কী পারবে দীপ্তকে স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত করতে? তাদের সম্পর্কের পরিণতি কী? মৃত্তিকা কী টিকে থাকবে এই নিষ্ঠুর সমাজে? জানতে হলে পড়তে হবে 'তেপান্তর'।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
লেখকের এই বই দিয়েই তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছে। লেখনী নিয়ে কী বলবো, কোন ভাষায় ফুটিয়ে তুলবো বুঝে পাই না। অনেকদিন পর ভালো কোনো লেখা পড়েছি এতোটুকু বলতে পারি নিশ্চিতভাবে। প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘটেছে। এ সময়টা সন্ধ্যার ঠিক পূর্বমুহূর্তে আকাশ যখন গোলাপী-কমলা রঙের মিশেলে আলোকিত হয় সে সময়টাকে ইংগিত করে। এ মায়াবী আলোকে কনে দেখা আলো বলে। নামটা বেশ লেগেছে। পুরো বই একবসাতে না পড়ে একটু একটু করে পড়াতে আনন্দ লেগেছে বেশি। কারন কথাগুলো একেবারে গিলে ফেলার মতো ছিল না। কিছু অংশ পড়ে অনেকখানি ভাবার মতো ছিল লেখাগুলো। আমি বইটা মোট দুইবার পড়েছি। একবার পড়ে মন ভরেনি তাই আবার পড়েছি। কিছু অংশ বেশি পড়েছি। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখক যে কবিতাটা লিখেছেন সেটা এতো ভালো লেগেছে যে অন্তত দশবার আবৃত্তি করে ফেলেছি। এরচেয়ে বেশি আর কিছু বলতে পারছি না। দ্বিতীয়বার পড়ার পরও আমি কাহিনির প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছি। আমার লেখাতেও সে প্রভাব পড়েছে মনে হচ্ছে।
অমিয়েন্দ্র বইটি পরে লেখকের ফ্যান হয়েছিলাম,পরে একদিন বাংলাবাজারে ভূমি প্রকাশের শো রুমে গিয়ে দেখি এই বইটা এবং কোন চিন্তা না করেই কিনে ফেলি এবং পড়া শেষ করে বুঝলাম লেখক এইবার ও হতাশ করে নাই,ছোট্টো একটা বই কিন্তু শেষ করার পর তীব্র একটা হাহাকার আমাকে নাড়া দিয়ে যায়,যা ভালো বইয়ের অন্যতম একটা গুন