কল্পনার গোয়েন্দাকাহিনির ফেলু-ব্যোমকেশদের সঙ্গে বাস্তবের সত্যান্বেষীদের ফারাক বিস্তর। বাস্তবের অপরাধ-তদন্তে রোমাঞ্চ-উত্তেজনা ততটা নেই, যতটা রয়েছে পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়। নির্মাণের জগত্ মূলত, সৃষ্টির ততটা নয়। অপরাধীকে চিহ্নিত করার মধ্যেই কাল্পনিক গোয়েন্দার কাজ শেষ। বাস্তবের গোয়েন্দাদের দায় শুধু অপরাধের কিনারাতেই শেষ নয়, নিখুঁত তদন্তে দোষীর শাস্তিবিধান পর্যন্ত অবকাশ নেই বিশ্রামের। অভিজ্ঞ আই পি এস অফিসার সুপ্রতিম সরকারের এই বইটিতে ধরা আছে কলকাতার বারোটি চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার রুদ্ধশ্বাস নেপথ্যকথা, রক্তমাংসের গোয়েন্দাদের কীর্তি, তদন্তের কী-কেন-কখন। গোয়েন্দাপীঠ লালবাজারের সঙ্গে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তুলনা যে সঙ্গত কারণেই হত, কাহিনিগুলি তার প্রামাণ্য দলিল। রহস্যপিপাসু পাঠকের রসনাতৃপ্তির রসদ ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়। নিছক অপরাধের ঘটনাপ্রবাহ নয়, স্বাদু লেখনী আর টানটান বিন্যাসে এ বইয়ের অনায়াস উত্তরণ অপরাধ-সাহিত্যের নতুন ধারায়।
সুপ্রতিম সরকারের জন্ম কলকাতায়, ৩০ মে ১৯৭১। আশৈশব কৃতী ছাত্র। ছাত্রজীবন কেটেছে সেন্ট লরেন্স হাই স্কুলে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণির স্নাতক। আনন্দবাজার পত্রিকায় স্বল্প দিনের সাংবাদিকতার পর ১৯৯৭ সালে যোগ দেন ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে। কর্মজীবনে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় এবং কলকাতায় নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলেছেন। বর্তমানে কলকাতা পুলিশে অতিরিক্ত কমিশনার পদে কর্মরত। কর্মক্ষেত্রে প্রশংসনীয় দক্ষতার জন্য ২০১৫-য় সম্মানিত হয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত ‘ইন্ডিয়ান পুলিশ মেডেল’-এ, ২০১৭-য় ভূষিত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রদত্ত বিশেষ সম্মানপদকে।পেশায় আই পি এস অফিসার, নেশায় আপাদমস্তক ক্রিকেটানুরাগী। লেখকের প্রথম প্রকাশিত বই ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’।
বইটা নিয়ে বেশ সাড়া উঠেছিল। বাতিঘরে চোখে পড়ামাত্র কিনে ফেললাম। উচ্চপদস্থ একজন পুলিশ কর্মকর্তার লেখা বই, অথচ কী চমৎকার ঝরঝরে বর্ণনাভঙ্গি। বাস্তবজীবনের ভয়ঙ্কর সব উপাখ্যান, দুর্দান্ত থ্রিলার ফিকশনেও হার মানিয়ে দেয় সদম্ভে! Truth is stranger than fiction - আক্ষরিক অর্থেই কথাটা মনে পড়ল বারবার।
লেখক বলেনঃ
"সত্যিটা স্বীকার করা যাক, গল্পের ফেলুদা-ব্যোমকেশ-এরকুল পোয়ারো-শার্লক হোমসের রহস্যভেদের রোমাঞ্চ বা রোমান্স বাস্তবের তদন্তে থাকে কদাচিৎ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থলে আধপোড়া সিগারেটের টুকরো থাকে না, থাকে না বাগানের ঝোপঝাড়ের কাদায় পায়ের ছাপ, থাকে না হুমকি চিরকুট বা সমগোত্রীয় কিছু। কল্পনার গোয়েন্দা গল্প খুবই উপভোগ্য, গোগ্রাসে গেলার মতো। বাস্তবের তদন্ত কিন্তু ভিন্ন, অন্তত নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে। প্রতি পদে উত্তেজনায় আচ পোহানো নেই, নির্মোহ পরিশ্রম আছে। রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ নেই, আপ্রাণ অধ্যবসায় আছে। আপন মনের মাধুরী নেই, মরিয়া একাগ্রতা আছে। নির্মাণের জগত মূলত, সৃষ্টির নয় ততটা।"
এক ডজন সত্যিকারের তদন্তের ঘটনা নিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। কল্পনার রঙ চড়ানো রোমাঞ্চ নয়, যেখানে বাস্তবতার ভয়াল রূপ দেখে শিউরে উঠতে হয় পাঠককে। লোভ, প্রতিশোধ, আবেগ, ক্ষোভ অথবা নিছক কোন তুচ্ছ ঘটনা থেকে জন্ম এসব অপরাধ কর্মকান্ডের; অথচ কতোই না ভয়াবহ তার শেষ পরিণতি!
উপমহাদেশে 'বায়োলজিক্যাল উইপন' ব্যবহার করে খুন, লাশ কেটে আলাদা আলাদা কাগজের মোড়কে পেচিয়ে ছড়িয়ে দেয়া, ট্রেনের বগিতে বিদ্ধ ট্রাংকের ভেতর নয় বছরের বালকের লাশ উদ্ধার, সিমেন্টের বেদীর ভেতর পুতে রাখা ভাইয়ের লাশ, কঠোর নিরাপত্তা ঘেরা এম এল এ হোস্টেলের ভেতর রাতারাতি খুন - মাথার ভেতরটা তোলপাড় করে দেয়!
কেসের সাথে প্রয়োজন অনুসারে সংযুক্ত করা হয়েছে খবরের কাগজের হেডলাইন, ফরেনসিক রিপোর্ট, লাশের কিংবা ক্রাইমসিনের ছবি। তদন্তের প্রক্রিয়াকেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে। লেখক পুলিশ, আই পি এস অফিসার। পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণ্না আর সাহিত্যিক উপমা প্রয়োগ করে এমনভাবে গল্পের ছলে লেখা হয়েছে যেন ঘটনাগুলো একদম চোখের সামনে ঘটা!
পড়ে শেষ করলাম ইদানিংকালের সাড়াজাগানো বই গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার। বইটি বাতিঘর থেকে কিনা। কিনার ইচ্ছা ছিল না আসলে। অন্য বই কিনতে গিয়েছিলাম কিন্তু পাইনি। শেষমেশ এটা কিনে ফেললাম। কিনে ঠকিনি অবশ্যই। বাস্তব যে মাঝে মাঝে বইয়ের পাতার থ্রিলারকেও হার মানাতে পারে এই বই তার জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত। বইটি পড়ে যেমন মানুষের লোভ, লালসা, নির্মমতার প্রতি জন্মে তীব্র ঘৃণা, তেমনি বাস্তবের গোয়েন্দাদের জন্য মনে জাগে সম্মান আর বিস্ময়। লেখকের লেখার হাত অসাধারণ। উনি পেশাদার পুলিশ এবং লেখক নন এটা তো মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে। পুলিশ বলতেই মনে ভেসে উঠে কাঠখোট্টা, বেরসিক কেউ। এত সুন্দর করে বই-টই লিখবে এমন ভাবনা তো কোনদিন মনে আসে না। লেখক মাল্টিট্যালেন্টেড। আবার তার পড়াশুনাও অনেক মনে হল। প্রতিটি কাহিনির শেষে বা শুরুতে আছে অন্য কোন গল্পের বা কবিতার অংশ যা লেখনীকে করে তুলে আরও আকর্ষণীয়। পরিশেষে যারা থ্রিলার ভালোবাসেন বা বাসেন না, সবাই পড়তে পারেন। কারণ বইটি শুধু মানুষের নির্মমতার দৃষ্টান্ত নয়, একইসাথে কলকাতার গোয়েন্দা পুলিশের বীরত্ব এবং অধ্যবসায়ের কাহিনীও বটে।
এই উপমহাদেশের প্রথম বায়োলজিকাল ওয়েপন ইউজড মার্ডার হয়েছিলো ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে, খোদ কোলকাতায়। ভিক্টিমের শরীরে রীতিমতো প্লেগের ভাইরাস ইনজেক্ট করা হয়েছিলো হাওড়া ট্রেন স্টেশনে, হাজারো লোকের হাঁসফাঁস করা ভীড়ে। খুনি যে স্বয়ং নিহতেরই সহোদর, সেই চাঞ্চল্যকর রহস্যভেদ হয়েছিলো কলকাতা পুলিশের হাতেই। বর্তমানের ফেস রিকগনিশন প্রোগ্রামের হাতেকলম অ্যানালগ ভার্সন 'ফটোগ্রাফিক সুপারইম্পোজিশন'ও প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়েছিলো কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাবিভাগেই, আদালতে বিকৃত কঙ্কাল যে খুন হওয়া পঞ্চম শুক্লার, তা প্রমাণের জন্য। সে ঘটনা আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগের, ১৯৬০ এর। আবার ১৯৫৪ সালে যখন কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছিলো খবরের কাগজে মোড়ানো মানুষের কাটা মাথা, হাত, বুক, পা - সে রহস্যের কিনারা হয়েছিলো কলকাতা পুলিশের সেই গোয়েন্দাবিভাগেই, যাকে লালবাজার নামে একনামে চেনে সবাই।
রহস্যোপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা গল্প বলে ভ্রম হওয়ার মতো উপরের ঘটনার সবগুলোই সাক্ষ্য দেয় একসময় কলকাতার লালবাজারকে যে লন্ডনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাথে তুলনা করা হতো, তা নিছক গালগল্প নয়। গল্পের ফেলুদা-ব্যোমকেশদের সাথে রক্তমাংসের পুলিশ আর গোয়েন্দার ফাঁরাক বিস্তর, বাস্তবের অপরাধ রহস্য তদন্তে রোমাঞ্চ-উত্তেজনার চেয়ে একাগ্রতা আর পরিশ্রমের চিহ্ন অনেক বেশি। কিছু তদন্তে অপরাধীকে চিহ্নিত করাতে রহস্যের কিছু নেই, কিন্তু আদালতে তার উপযুক্ত শাস্তির জন্য অপরাধ প্রমাণ করা নিয়েই সৃষ্টি হয়ে টানটান রুদ্ধশ্বাস ঘটনার। আবার মাঝে মাঝে কিছু কেস হার মানিয়ে যায় ফেলু মিত্তিরদেরও। গত একশ' বছরে কলকাতায় ঘটে যাওয়া ১২টি চাঞ্চল্যকর হত্যামামলার আদ্যোপান্ত কাহিনী, নেপথ্যকথা, আর খুঁটিনাটি নিয়েই লেখক সুপ্রতিম সরকারের বই "গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার"।
লেখক স্বয়ং পুলিশ কর্মকর্তা, আই পি এস অফিসার। অত্যন্ত উপভোগ্য আর রসালো লেখনী, রীতিমতো সুখপাঠ্য। বিভিন্ন উপমা, কবিতাংশ, নানান গোয়েন্দা গল্পের যুৎসই রেফারেন্সের সাথে তার স্বাদু লেখনীর পার্টনারশিপ চমৎকার। মোট বারোটি শহর কাঁপিয়ে বেড়ানো মামলার প্রথমটা ১৯৩৪ সালের, আর শেষটা মাত্র দশ বছর আগে, ২০০৭ এর। সবগুলো মামলাই খুনের, কয়েকটার বিচিত্রতা অন্যগুলোকে ছাড়িয়ে যায়। প্রত্যেকটা মামলার সাথে আছে বিভিন্ন দরকারি নথিপত্র, কেস ফাইলের ছবি, খুন, মৃতদেহ, খুন হওয়ার জায়গার সাদাকালো ছবি। ৫০/৬০ বছর আগের সেই সাদাকালো গ্রেইন ভরা ছিঁড়েফেটে যাওয়া ছবিগুলো বিষণ্ণতা আর নৃশংসতার সাক্ষ্যদেয়, দুই একটা ছবি রীতিমতো গা শিউড়ে ওঠায়। এছাড়াও প্রত্যেকটা মামলার কাহিনীর আগ্রহোদ্দীপক ও বুদ্ধিমান নামকরণের জন্যেও লেখকের একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য থাকবে।
সুপ্রতিম সরকার এর 'গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার - এক ডজন খুনের রুদ্ধশ্বাস নেপথ্যকথা' চমৎকার বিন্যাসে লেখা একটি ননফিকশন, যা তার রোমাঞ্চকর ঘটনা আর ক্ষমতাধর লেখনীর জন্য পাঠকের কাছে বার বার ফিকশনের রূপ ধরে ফাঁকি দিতে সক্ষম।
Uh, Ok !! This book is not a regular thriller book if you accept it to be. It brings out the reality of crimes and the minds behind them. This book is plain and simple with very few suspense in it. It’s sort of a documentary kind of book where the writer tells us about how the crimes happens and how in actual world it is solved and what are the difficulties faced by the police to get the criminals convicted in front of laws. Some brutal and disturbing stories awaits you in this book.
বাংলায় ট্রু ক্রাইম নিয়ে তন্নিষ্ঠ বইপত্রের সংখ্যা বড়োই কম। আজও ডক্টর পঞ্চানন ঘোষালের লেখা বইগুলো পড়ার পরামর্শ দেন বিদ্বজ্জনেরা। সাম্প্রতিককালে আন্তর্জালে উপলব্ধ নানা তথ্য ও তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন বই বেরিয়েছে বটে। কিন্তু আমাদের কাছে বড়ো প্রশ্ন হয়ে ওঠে অন্য একটা বিষয়। কলকাতা পুলিশ, যাকে একসময় অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হত, তো কত-কত কেসের সমাধান করেছে। সেগুলো নিয়ে জানতে হলে কি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে পুরোনো কাগজ হাতড়ানো ছাড়া কোনোই উপায় নেই? সংবাদপত্রের কিঞ্চিৎ হলদেটে চশমার মধ্য দিয়ে ছাড়া কি কোনোমতেই জানা যাবে না সেই সত্যিকারের তদন্তের নানা কথা? তারপর এল ফেসবুকে কলকাতা পুলিশ-এর নিজস্ব পেজ। বেংগলুরু পুলিশ তাদের পেজে নানা মিম দেয়। মুম্বই পুলিশ উপহার দেয় শুষ্ক পরিহাসের নানা নিদর্শন। কলকাতা পুলিশ কিন্তু তাদের ছাপিয়ে গেল সাহিত্যগুণে। আর তার জন্য দায়ী ছিলেন সুপ্রতিম সরকার! সেই পেজে বহুলপঠিত, চর্চিত, নির্মম সত্যের পরিবেশনের জন্য সুকুমারমতি পাঠকদের দ্বারা নিন্দিত এবং অন্য সবার দ্বারা নন্দিত হয়েছিল এক ডজন খুনখারাপির বিবরণ। তারপর এল কলকাতা বইমেলা। সহজ, অনাড়ম্বর, তথ্যনিষ্ঠ অথচ প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য-পদবাচ্য এই লেখারা বই হয়ে এল তখনই। তাদের কথাই লিখি আগে। সূচিপত্র থেকে আন্দাজ পাবেন যে এদের রচয়িতার সাহিত্যপাঠ কতটা বিস্তৃত~ ১) এভাবেও মেরে ফেলা যায়! (পাকুড় হত্যা— অমরেন্দ্র পাণ্ডে) ২) মানুষ বড়ো শস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারত (বেলারানি দত্ত-কে হত্যা) ৩) অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো (পঞ্চম শুক্লা-কে হত্যা) ৪) বণিকবাড়ির অন্তরমহলে (দেবযানী বণিক-এর হত্যা) ৫) লাশই নেই, খুন কীসের? (অনুরাগ আগরওয়াল-কে অপহরণ ও হত্যা) ৬) করুণাধারায় এসো (নওলাখা দম্পতি-কে লুণ্ঠন ও হত্যা) ৭) মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে (বিশ্বনাথ দত্ত'র হত্যা) ৮) কী বিচিত্র এই দ্বেষ! (হারুন রশিদ-এর হত্যা) ৯) মধ্যরাতের কিড স্ট্রিটে (ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক রমজান আলি'র হত্যা) ১০) বয়স হয়েছিল পঁয়ত্রিশ (সার্জেন্ট বাপি সেন-এর হত্যা) ১১) দ্য বিলিয়ন ডলার কেস (তপন দাস-এর হত্যা) ১২) অতি পুরাতন ভৃত্য (রবিন্দর কাউর লুথরা-র হত্যা) অত্যন্ত যত্ন নিয়ে বেছে নেওয়া হয়েছিল এই কেসগুলোকে। সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তর তো বটেই, এমনকি রাজনীতি ও অর্থনীতির আলো-ছায়া যেভাবে প্রভাবিত করে ক্রাইম ও পানিশমেন্টকে, তারও যথাযথ প্রতিফলন যাতে ঘটে এই গোয়েন্দাপীঠের আখ্যানমালায়, সেই চেষ্টা করেছিলেন লেখক। কীভাবে অপরাধ নজরে এল, তারপর ধাপে-ধাপে এগোনো তদন্তের পদ্ধতি এবং শেষে প্রসিকিউশনের বিবরণ আমরা ফেসবুকেই পড়েছিলাম। এই বইয়ে সংযোজিত হয়েছিল বিভিন্ন মামলার নথি। যে লেখা ফেসবুকে পড়া যায় বিনামূল্যে, সে-জিনিস যে এমন মেগাহিট হবে— এ বোধহয় কেউ ভাবতে পারেনি। তবে এই বইয়ের আসল প্রভাব ছিল ফিকশনের আঙিনায়। মিডিয়া থেকে সাধারণ মানুষ— সবার গালাগালি খেয়ে, পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে, অজস্র সীমাবদ্ধতার মধ্যে যে মানুষগুলো অক্লান্ত শ্রমে অপরাধীকে আইনের সামনে পেশ করেন সেই পুলিশকে আমরা অনেকেই নতুন চোখে দেখতে শুরু করি। ফিকশনে ব্যোমকেশ বা ফেলুদা'র কথা আলাদা, তবে অন্য যে-সব গোয়েন্দার স্রষ্টারা পুলিশকে ভাঁড়ের স্তরে নামিয়ে আনেন, তাঁদের পালের হাওয়া হু-হু করে কমে যায় এই বই প্রকাশের পরেই। বরং এই বইয়ের পরিশিষ্টে লিপিবদ্ধ সেই নীরব অফিসারদের উদ্দেশে আমাদের সবার স্যালুট জমা হয় মনে, যাঁরা এই রহস্যগুলোর সমাধান করেছিলেন। লেখাগুলো অত্যন্ত সুখপাঠ্য হলেও পড়তে কষ্ট হবে কনটেন্টের জন্য। ষড়রিপুর এই প্রদর্শনী সহজপাচ্য নয়। তবু বলব, কাল্পনিক গোয়েন্দা গল্প তো অনেক পড়লেন। কলকাতা শহরের ভেতরের এই সাড়াজাগানো বারোটি ট্রু ক্রাইমের খতিয়ান থেকেই বা নিজেকে বঞ্চিত করবেন কেন? কলকাতা পুলিশকে নীরব নমস্কার জানালাম এই সামান্য লেখার মধ্য দিয়েই।
মানুষের মনের ভেতরকার রহস্য বোঝা শুধু কঠিনই নয়, অনেকাংশে অসম্ভবও। লালবাজারের বিচিত্রসব কেসগুলো নিয়ে পড়তে গিয়ে খানিকটা হোঁচট খেয়েছি অস্বীকার করব না। এমএলএ রহমত আলি খুনের ঘটনার টুইস্ট মাথা খারাপ করে দেওয়ার যোগাড় করেছিল, পুরাতন গৃহভৃত্যের কান্ড আর নৃশংসভাবে খুন করেও ঠান্ডা মাথায় ছক কষে রেহাই পাওয়ার ক্রিমিনাল মাইন্ডের তারিফ না করে পারা যায় না।
বইটা পড়ে একটা বিষয় বুঝেছি গল্প-উপন্যাসের খুনীদের চে' বাস্তবের খুনের কিনারা করা ঢের শক্ত এবং বাস্তবের অপরাধ এমনভাবে সংগঠিত হয় তেমনটি হয়তো বাঘা বাঘা লিখিয়ের ভাবনা জগতের দূরতম সীমানাতেও নেই।
থ্রিলার খুঁজছেন? "গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার" থ্রিলারকেও হার মানাবে৷
২০১৮-১৯ এর বেশ সাড়া জাগানো একটা বই। বাস্তব এবং গল্পের খুনের রহস্যের ফারাক এই বইটি পড়লে বুঝা যায়। যাইহোক বেশ ভাল একটা বই, যথেষ্ট উপভোগ্য। ২০১৮ তে কেনা হলেও দীর্ঘদিন পর পড়ার সুযোগ হল, বাস্তব হলেও লেখক অনেক সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন যে কারনে পড়তে ভাল লেগেছে। যা ননফিকশন এবং বাস্তব ঘটনার আদলে হলেও রহস্যের রোমাঞ্চের কোন কমতি ছিলনা।
সুপ্রতিম সরকার এর একটা ইন্টারভিউ দেখেছিলাম বছর দুয়েক আগে মনে হয় ইউটিউবে। পুলিশ হিসেবে এত স্মার্ট ভাবে কেউ কথা বলবে আশা ছিল না। তাই একটু গুগল করতেই এই বইয়ের সন্ধান পেয়েছিলাম। তখন থেকে বইটা পড়ার ইচ্ছে ছিল। তার কিছুদিন পরেই কলকাতা গিয়েছিলাম ভ্রমণে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ঘুরতে গিয়ে দেখি ছোট একটা বই মেলা হচ্ছে। মেলায় পেয়েও গেলাম বইটা। কিন্তু পাশেই তপন রায় চৌধুরীর "বাঙালনামা" দেখে এটা রেখে দিয়ে বাঙালনামা বগলদাবা করে ফিরেছিলাম কারণ পকেটের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না।
সেদিন হঠাৎ হাতে চলে আসে বইটা। এবার আর মিস করিনি। সুপ্রতিম বাবু আইপিএস অফিসার হওয়ার আগে সাংবাদিক ছিলেন। সেই সাথে ভয়ংকর রকমের সাহিত্যানুরাগী ও ক্রিকেটপ্রেমী সেটা বোঝা যাচ্ছিলো বইয়ের পাতায় পাতায়। দারুন সাবলীল লেখনী।
আমরা যারা গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে বড় হয়েছি তাদের জন্য এই বইটা দারুন একটা অভিজ্ঞতা হিসেবে যোগ হবে নিঃসন্দেহে। ফিকশন আর নন ফিকশনের মধ্যে একটা কল্পিত ঝুলন্ত সেতুতে ভারসাম্যহীন ভাবে ঝুলতে হবে বইটা পড়লে। ফেলু মিত্তির বা ব্যোমকেশ বাবুর মতো সহজ না লাল বাজারের গোয়েন্দাদের গোয়েন্দাগিরি। তাদের মতো খালি অপরাধী খুঁজে দিলেই হয় না এদের, সেই সাথে নিখুঁত ভাবে তৈরি করতে হয় চার্জশিট। নাহলে উকিলের মারপ্যাঁচে আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে আসামি। সিআইডির দয়া এক রাম থাপ্পড় দিলো আর আসামি স্বীকার করে ���িলো হ্যা স্যার আমিই খুন করেছি গল্প এখানেই শেষ না। সেটাই ফুটে উঠেছে এই বইয়ে।
হিংসা, লোভ, লালসা, কামনা মানুষকে মুহূর্তে পশুতে পরিণত করে দেয়। এরকম নানা কাহিনী প্রতিনিয়ত দৈনিক পত্রিকার কাটতি বাড়ায়, টিভি চ্যানেলের টিআরপি বাড়ায়। কিন্তু সেগুলোর আদ্যোপান্ত জানা হয়না সাধারণত। কলকাতা পুলিশের এরকম কিছু কেসের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন সুপ্রতিম সরকার। বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না, স্পয়লার হয়ে যাবে। থ্রিলার বা গোয়েন্দাকাহিনী যারা ভালোবাসে এই বইটা তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে আমি মনে করি।
নিপুণ নিধনকান্ডে নরাধমদের নির্বিচারে নিঃশব্দে নিখোঁজ হবার আগেই যুক্তি তর্ক গাল গপ্পোর অসারতার ���খ্যান অক্লেশে নিরলস অন্তর্ভেদী অনুসন্ধানে জনসমক্ষে এনে সুবিচারের সৌষ্ঠব সুদূর অতীত থেকে বর্তমানেও তুলে ধরা এক আস্থাভাজন আশ্রয়ের নাম আবালবৃদ্ধবনিতাদের জন্য।
প্রযুক্তির প্রচার প্রসারের এই ব্যাপকতার যুগে অপরাধীদের প্রচলিত আইনে নিয়মকানুনের জালে জড়িয়ে ফেলা বেশ সহজসাধ্য ই হয়ে গেছে, কিন্তু আজ থেকে আরো বছর ত্রিশেক আগে সদ্য ফরেন্সিকের বিস্তারের সাথে নানাবিধ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শুধু মাত্র নিষ্ঠা সততা সম্বলিত তীক্ষ্মধী সম্পন্ন সেইসব সুপার হিউম্যানরা ছিলেন বলেই পাপ বাপকে ছাড়লেও পাপীকে ছাড়েনি মোটেও।
শ্বাসরুদ্ধকর সব কেস অবস্থা জালে ফেঁসে যে যায়নি তা মোটেও নয় কিন্তু ফিকশনের চেয়ে বাস্তবের অ্যাকশন বড়ো বিচিত্র।বন্ধুর যে পথে কল্পনার ফেলুদা ব্যোমকেশ কিরীটি একেনবাবুরা সমাধানের অভাবনীয় পথ খুঁজে পেলেও লালবাজারের হোমিসাইডের ডাকসাইটে গোয়েন্দাদের খাটতে হয়েছে প্রচুর।
ব্যক্তিগত ভাবে এইসব নৃশংস হত্যাকান্ডের প্যাটার্ণ জ্ঞাত হলেও অজ্ঞাতসারে বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে দীর্ঘ শ্বাস বাইশ বছরের ফুটফুটে গৃহবধূ দেবযানী আর সন্তানসম্ভবা বেলারানী অকাল বোধনে।কিশোর অনুরাগ আগরওয়াল কিংবা শিশু হারুন হত্যায় মনে পড়ে যায়;
মানুষ বড় শস্তা,কেটে, ছড়িয়ে দিলেও পারত অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো অপরাধীদের মুখখানা বিজ্ঞাপনের আগেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেই অনাচার সমাজ থেকে ছাড়ত।
সুপ্রতিম সরকারের সত্যসন্ধানে এই অপ্রতীম চেষ্টা কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ করার জন্য রইলো শুভেচ্ছান্তে ধন্যবাদ।
"পথের কথা পথই জানে, মনের কথা মত্ত- মানুষ বড় সস্তা- কেটে ছড়িয়ে দিলেই পারতো!"
আশেপাশে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, "পুলিশ চাইলে যেকোনো অপরাধীকেই ধরতে পারে, শুধু হয়তো সদিচ্ছার অভাব থাকে কোথাও না কোথাও!" এই বইয়ের লেখক সুপ্রতিম সরকার, একজন আইপিএস অফিসার। কোলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেইজে প্রায়ই হৈ চৈ ফেলে দেয়া কেইসগুলো লেখবার অনুরোধ আসে, সেই থেকেই এই বইটার জন্ম। মোটমাট বারোটি গল্প স্থান পেয়েছে এই বইটিতে। গল্প বলছি কেন, এতো সত্যি। কোলকাতার সাড়া জাগানো কতোগুলো কেস, যেখানে প্রথমটা ১৯৩৪ এর দিকে- যখন সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, নেই ডিএনএ টেস্টের সুবিধা, সেইরকম সময়ে প্রথমবারের মতোন বায়োলজিকাল মার্ডার উইপন- মানে রীতিমতো সুঁইয়ে একবার টিটেনাস আরেকবার প্লেগের ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ছোটো ভাইকে হত্যার চেষ্টা। আজ থেকে অলমোস্ট একশ' বছর আগে, যখন সায়েন্টিফিক্যালি সব কিছু প্রমান করা ছিলো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য সেইসময় শুধুমাত্র পুলিশের আন্তরিক চেষ্টায় আদালতে beyond any reasonable doubt এমন কঠিন একটা মামলা প্রমাণ করা গিয়েছিলো।
বারোটি গল্প। বারোটিই খুনের গল্প। ভিকটিম প্রাণ দিয়েছে কখনো মাদকাসক্ত ছোট ভাই এর হাতে, কখনো আমুদে বড় ভাই এর হাতে। কখনোবা স্ত্রীর পরকীয়া ধরে ফেলায় স্বামীকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে, কখনোবা স্বামীর অন্য স্ত্রীর কথা প্রথম স্ত্রী জানবে- এই ভয়ে প্রথম স্ত্রীর শরীর টুকরো করে, তিন ভাগে ভাগ করে কোলকাতার তিন জায়গায় ফেলে আসা হলো। ডেডবডির পরিচয় যাতে জানা না যায় সেকারণে মুখের চামড়া তুলে ফেলা হলো- যাতে করে লাশ কেউ শনাক্ত করতে না পারে। তাছাড়া ডিএনএ টেস্ট বলেও তখন কিছু নেই। মোবাইল ফোনের যুগ না বলে যাকে অপরাধী বলে সন্দেহ তার ট্রেস ও পাওয়া যাচ্ছে না। দুইটা ছোট্ট বাচ্চার মৃত্যুর ঘটনা স্থান পেয়েছে এই বইতে। একটা খুন টাকার জন্যে। আরেকটা খুন করেছিলো সেই বাচ্চাটির সবচেয়ে পছন্দের এক লোক- যাকে তার বাবাই কোনো একদিন চাকরি দিয়েছিলেন। সেই চাকরি তাদের খামখেয়ালিতেই চলে গেলো- তবুও সেই দ্বেষে উপকারীর ছেলেকে একদম খুন করে বাক্সে ভরে ট্রেনে তুলে অন্য রাজ্যে পাঠানো হলো। হত্যাকারীরা শেষ অব্দি শোকাভিভূত বাবার পাশে বন্ধুর মতোন বসে ছিলেন, ধরা খাওয়ার আগ পর্যন্ত। মামলার জট খুলতে সবচেয়ে বড় ক্লু দিলো বাচ্চাটির বন্ধু। বইতে ব্যবহৃত একটা কথাই যোগ করি বরং। All motives for murders are covered by four L's. Love, Lust, Lucre and Loathing. - P.D. James, The Murder Room এতো বিচিত্র কারণে খুন গুলো হয়েছে... শুনলে বিশ্বাস হতে চায় না।
যা নিয়ে কথা বললেই না- সেটা হলো- লেখকের লেখনী। আজকালকার লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা মনে হয়, মনে হয় যে তারা পড়েন না। এই লেখকের ক্ষেত্রে তা মনে হবার কারণ নেই। ভদ্রলোকের খুব গল্প-উপন্যাস পড়াশোনার ধাত আছে, কাহিনির ভাষা থেকে উপস্থাপন- সবটাই ঝরঝরে। চমৎকার। মাঝখানে মাঝখানে এতো সুন্দর উদ্ধৃতির ব্যবহার, কথায় কথায়- ফেলুদা, ব্যোমকেশ কিংবা কাকাবাবুর কথা উঠে আসছিলো বারংবার। কাহিনিগুলোর নাম ও দেয়া হয়েছে চমৎকার।
পুলিশের কাজ শুধু অপরাধী ধরা তো না। অপরাধী পুলিশের কাছে একবার স্বীকার করে সেই অপরাধ আর কোর্টে স্বীকার করে না। এদিকে beyond any reasonable doubt সেটা প্রমাণ করার জন্য এমন একটা চার্জশীট পুলিশকে সাজাতে হয়, যেখানে এক ফোটা ফাক ফোকর থাকা যাবে না। থাকলেই শেষ। অপরাধী বেরিয়ে যাবে হনহন করে। খুনের দুইমাস পর যদি মৃতদেহ উদ্ধার, সেক্ষেত্রে দেহাবশেষ যে সেই ভিকটিমেরই এই প্রমাণ করতেই একশ' বছর আগে কোন প্যারার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তার কিছুটা এই সংক্ষিপ্ত লেখার মধ্যে উঠে এসেছে। শুধুমাত্র তদন্তকারী পুলিশের অধ্যবসায়টুকুর জন্যই এও কেইসগুলো সলভ করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে এই ধরণের কোনো বই লেখা হয়েছে কি না জানা নেই। গল্পগুলো পড়তে আজকে বেশ ভালো লাগলো, পাশের দেশ না হয়ে আমার দেশ হলে ভালো লাগতো আরেকটু। এদেশেও নিশ্চয়ই সৎ পুলিশ অফিসাররা আছেন, আমি নিজেই বিভিন্ন সময় তাদের আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি বার দুয়েক। কিন্তু তার সাথেও গতো একবছরে এক এসআই আমাদের ফ্যামিলিকে এতো হেনস্তা করার চেষ্টা করেছে, যে সেটা নিয়ে লিখলে এই বইটার মতোন একটা গল্প হয়ে যাবে, পুলিশের বিরুদ্ধে জায়গামতোন কম্পলেইন দেয়ার আর সেটা নিজেরা হ্যান্ডেল করার ব্যবস্থা থাকলে ওই শয়তানটার চাকরি চলে যাইতো, কতো মানুষের পিছনে যে লাগতেসে এখন আল্লাহ জানে। এতো শেইমলেস লোকের গায়ে ইউনিফর্ম ওঠে ব্যাপারটা খুবই লজ্জাজনক। অবশ্যি এই বইতেও চারজন কন্সটেবলের হাতে একজনের খুনের একটা কাহিনি ছিলো- বাকি এগারোটা কেসে যা হয়নি, এই কেসটাতে তাই হয়েছিলো- ফরেনসিক রিপোর্ট ফলস দেয়া হয়েছিলো। তাই মানুষের মুখে মুখে যে এসআই দের চক্করে পড়ে জীবন ত্যানা ত্যানা হওয়ার গল্প শোনা যায়, বা রাস্তা ঘাটে ট্রাফিক সার্জেন্টদেরকে অহরহ ঘুষ নিতে দেখার যে চেহারাটা দেখি, তার বাহিরে গিয়ে এমন একটা বই- খুবই অন্যরকম লাগলো পড়তে। আসলে- তদন্তকারীদের সদিচ্ছা থাকলে কতো কিছুই তো হয়! সাগর রুনি হত্যাকান্ডের কথা, ত্বকী হত্যাকান্ডের কথা কিংবা তনুর হত্যাকান্ডের কথা একের পর এক মাথায় ঘুরতেসিলো। তবে এগুলো অনেকাংশেই হয়তো পলিটিক্যাল কেইস, পুলিশের সদিচ্ছায়ও বেশি কিছু হতোনা হয়তো। এই বইতে একটাও পলিটিক্যাল কেইস ছিলো না। আমাদের দেশে তো আবরার হত্যাকান্ডের বিচারটাও বেশ দ্রুতই হয়েছিলো।
Robert Louis Stevenson এর একটা কথা বইতে উঠে এসেছে- "I've seen wicked men and fool, a great many of both, I believe they both get paid in the end; but fools first."
কাল্পনিক গোয়েন্দা গল্প পড়লে কখনো মনখারাপ হয় না। কেবল একটা থ্রিলিং অনুভূতি হয়। অপরাধী কে আর অপরাধের কারণ জানার আগ্রহই বেশী থাকে। গোয়েন্দার সাথে সাথে রহস্যের অলিগ���িতে বিচরণ করতে মন্দ লাগে না। কখনো কখনো নিজের মাথা খাটানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করা। তারপর রহস্যের সমাধান হয়ে গেলে উত্তেজনাও শেষ। মনে হয় কত সহজ আর আমি ধরতে পারলাম না। কিন্তু সেই অপরাধের যারা স্বীকার হয় তাদের নিয়ে কখনো সেভাবে ফিল করিনি, অন্তত গোয়েন্দা গল্প পড়ার সময় তো কখনোই না। কারণ হয়ত এটাই যে অবচেতন মনে আমি জানি এগুলি কাল্পনিক। বিশ্বাস করার কারণ নেই।
তবে বাস্তবের অপরাধ জগতের গল্প যখন মিডিয়ার কল্যাণে কানে আসে, যখন ফেসবুকে তোলপাড় হয় কোনো একটা বিশেষ ঘটনা নিয়ে তখন স্বাভাবিকভাবেই ভিকটিমদের জন্য খারাপ লাগে। প্রায়ই ভাবি, মানুষ কেন অপরাধ করে। কেন অন্যের ক্ষতি করে। এসব করে কি কখনো সত্যিকারে কারো ভালো হয়? অনেকদিন ধরেই বইটা পড়ার লিস্টে ছিল। পান্ডব গোয়েন্দার গাঁজাখুরি জোড়াতালিমার্কা গল্প পড়তে গিয়ে মাথা যখন বেশ গরম তখন তুলে নিলাম এই বইটা। শুরুর ঘটনাটাই ভীষণ পরিচিত আমার। ফেসবুকেই একবার কোনো এক গ্রুপে এই কেসটা সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা পড়েছিলাম। তারপর এক এক করে বাকি ঘটনাগুলিও পড়ে ফেললাম। সত্যিই রুদ্ধশ্বাস বটে... বিশেষ করে "বণিকবাড়ির অন্দরমহলে" আর "বয়স হয়েছিল পঁয়ত্রিশ" এই দুইটা ঘটনা আমাকে একদম নাড়িয়ে দিয়েছে ভিতর থেকে। "বণিকবাড়ির অন্দরমহলে" পড়ে খানিকটা আশ্চর্য হয়েছি। না এই ভেবে নয় যে এমন অপরাধ কি করে করলো। এই ভেবে যে মেয়েদের অবস্থান ওই আশির দশকে যা ছিল আজও একই আছে এটা ভেবে। পড়তে পড়তে মনে হলো কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ফেসবুকে আলোড়ন তোলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর ঘটনাটাই যেন পড়ছি। মিডিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী যে কিনা শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের স্বীকার এবং তাদের হাতেই নিহত যা কিনা পরবর্তীতে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়। এই অত্যাচারের কথা মেয়ের বাবার বাড়ির মানুষের থেকেই জানা যায়। তার মানে হলো অত্যাচারের কথা জেনেও মেয়েটাকে কেউ রক্ষা করেনি সময় থাকতে। যেমনটা হয়েছিল বণিকবাড়ির বড় বউয়ের বেলায়। বণিকবাড়ির বড় বউ, নাম দেবযানী বণিক - শিক্ষিত ছিল না। বিয়েও হয়েছিল কম বয়সে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদের কথা মেয়েরা তখন ভাবতো না। মা বাবার কথা শুনে মানিয়ে নেয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই নিজের কর্তব্য বলে ভাবতো। আর তখনকার সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় মেয়ের মা বাবার দ্বিধার কারণও ছিল স্পষ্ট। কিন্তু এই যুগে এই ২০২০ সালে এসেও কেন মা বাবারা দ্বিধা করেন? কেন একটা মেয়ে শিক্ষিত হয়েও, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করেও সেই একই অত্যাচার সয়ে যায়? কেন ফাইট ব্যাক করতে পারে না? উত্তরের কথা ভাবলে একটাই কথা মনে হয়৷ তা হলো এই সমাজ...মেয়েদের বেলায় সমাজের নিয়মকানুন কখনো বদলায় না। মা বাবারাও সমাজের কাছে নতি স্বীকার করেন। বাধ্য করেন নিজের মেয়েকেও মাথা নত করে থাকতে। সেই মেয়ে যাকে হয়ত তারা প্রিন্সেস বলে ডাকতেন। সেই মেয়ে যাকে তারা ভীষণ আগলে রাখতেন। সেই মেয়ে যার কতশত আবদার তারা হাসিমুখে পূরণ করতেন। তারপর আদরের মেয়েকে বিয়ে দেন...বাপের বাড়িকে বিদায় জানিয়ে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়...আর এই বিদায় কখনো কখনো চিরবিদায় হয়ে দাঁড়ায়। দেবযানী থেকে সুমাইয়া, ভিন্ন নাম, ভিন্ন জায়গা, কিন্তু নিয়তি তাদের একসূত্রে গাঁথা...যুগ যুগ ধরে শুধু এই নামগুলোরই বদল হয়। সময়ের বদল হয়। জায়গার বদল হয়। বদল হয় না শুধু সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির। এই ঘটনাটা পড়তে গিয়ে আমি আসলেই ভীষণ শিউরে উঠেছি। কতখানি নির্মম হতে পারে মানুষ?
অনেক বেশী আবেগী কথা হয়ত লিখে ফেলেছি। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই এই বইটা আমাকে ভাবিয়েছে।
আর "বয়স হয়েছিল পঁয়ত্রিশ" - এই ঘটনার নির্মমতা নিয়েও কিছু বলার নেই। এই ঘটনার মূলেও আছে একটি নির্যাতিতা মেয়ে। কিন্তু অন্য রূপে, অন্য প্রভাবক হিসেবে। বইটা পড়লেই বুঝতে পারবেন।
এই লেখাটাকে বইয়ের রিভিউ বলা যায় না। শুধু মনের অবস্থা বুঝাতেই এতগুলো কথা লেখা। বইটা পড়তে পারেন। এই সমাজের অসংগতিগুলো নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।
বাস্তবের অপরাধ এর তদন্ত ওয়ান ডে নয়, কুড়ির ক্রিকেটের জগঝম্প তো নয়ই এ হল আদ্যপান্ত টেস্ট ম্যাচ। যেখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হয়, বারবার নিরলস ভাবে একই প্রশ্ন করে যেতে হয়, যেতেই হয়। তদন্ত কোথাও এসে থমকে গেলে আবার শুরু শূন্য থেকে ।এত কিছুর পর হয়তো মস্তিষ্কের কোষের ভেতর ক্ষণিকের স্ফুলিঙ্গ বা নেহাতই কাকতালীয় ভাবে যদি বা হাতে এসে যায় কোন যোগসূত্র বা সটান অপরাধীই সেখানেই বাস্তবের গোয়েন্দার কাজ শেষ হয় না। অপরাধী শনাক্ত করা যেন ট্রেলার, এই বই এর পাতায় যে কেসগুলি উঠে এসেছে তাতে মনে হবে আসল সাধনা শুরু হয়েছে চার্জ শিট তৈরি করার সময়। বজ্র আঁটুনিতে এতটুকু ফোসকা গেরো থাকলেই যে গলে পার পেয়ে যাবে ধুরন্ধর শয়তানরা । উন্নত প্রযুক্তির বিলাসিতা ছিলো না অধিকাংশ কেসগুলিতে তাই শুধু সার্কামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সের নিশ্চিদ্র প্রাসাদ তৈরিতে নিরলস সাধনা করতে হয়েছে তদন্তকারীকে।টানটান এই এক ডজন সত্য ঘটনা নিয়ে বেশি কিছু বলা সমীচীন হবে না।লেখকের লেখনীর গুণে ঘটনাগুলি যে বড্ড বেশি জীবন্ত।তাই রিভিউ থেকে স্পয়লার না নিয়ে সরাসরি পড়ে ফেলাই শ্রেয়। শুধু এইটুকু বলতে পারি একই টাইপের কেস খুব একটা আসেনি এই বইতে সবগুলো কেসেই অভিনবত্ব আছে তা সে অপরাধ প্রক্রিয়াতেই হোক বা তদন্ত প্রণালীতে। লেখক ভালো করেই জানেন তাঁর বইয়ের অধিকাংশ পাঠক/পাঠিকাই বাস্তবের তদন্তের পদ্ধতির সাথে ওয়াকিবহাল নন। তাই যেখানেই তদন্ত সংক্রান্ত বহুল ব্যবহৃত কোনো টার্ম এসেছে সাথে সাথেই তার সহজ ভাষায় ব্যাখাও এসেছে। আবার লেখকের লেখনীর গুণে মনে হয় না যে কোথাও সবজান্তা শেয়াল পণ্ডিত নির্বোধ ভেড়ার দলকে জ্ঞান দিচ্ছেন।পাঠকের বিচার বুদ্ধির উপর ভরসা রেখে পরিমিত জ্ঞান এই বইকে করেছে আরও বেশি প্রাঞ্জল ও পাঠকের আরও বেশি কাছের। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে পুলিশ মাত্রেই বেরসিক । উচ্চপদস্থ পুলিশকর্মী লেখক বোধ হয় সচেনতন ভাবে এই ধারণা ভাঙতে চেয়েছেন।অনেক জায়গাতেই তাই বেশি রসের ব্যবহার একটু চোখে লাগে, লেখনী ঝরঝরে হলেও নির্মেদ নয়। এত ভালোর মাঝে খচখচানি বলতে শুধু এটুকুই।আরেকটু পরিমিত নাটকীয়তা হলে হয়তো আমার ব্যক্তিগত রুচি আরও বেশি সম্মতি দিত। সরাসরি বীভৎস লাশের ছবির প্রয়োগও পাতা উল্টানোর সাথে সাথে হামলে পড়ে আক্রমণ করেছে স্নায়ুতে । তাই লেখকের কাছে এই বিনীত অনুযোগ নিয়েই একটি তারা কম দিলাম। সত্যিকারের তদন্ত কেমন হয়, বা পুলিশের ভাষাতেই পুলিশের কাছে জটিল কেস কোনগুলি মনে হয় সে নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকলে এ বই অবশ্যপাঠ্য। পুনশ্চ - কোথাও মনে হতে পারে যে বাস্তবের অপরাধের তদন্তকারীদের নিরলস অধ্যবসায় কে বাহবা দিতে লেখক একটু বেশি নিন্দা করেছেন আমাদের প্রিয় ফিকশন গল্পের সখের গোয়েন্দা বা সত্যান্বেষীদের। মনে রাখা ভালো যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবের অপরাধীদের আধ খাওয়া সিগারেট যেমন পাওয়া যায় না অকুস্থলে তেমন এই সখের গোয়েন্দারাও কিন্তু মোতায়েন করতে পারেন না বিশাল পুলিশ বাহিনী বা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ। সখের গোয়েন্দাদের কাছে থাকে না অপরাধের অন্ধকার গলিতে নিত্য যাতায়াকারী সোর্স নিযুক্ত করার বিলাসিতা। তাই যে যার শক্তিকাজে লাগিয়ে চেষ্টা করে চলেন অপরাধের মীমাংসা করার, পাঠক হিসেবে আমরা খুশি মস্তিষ্কের একটু খোরাকের পর অপরাধী ধরা পড়লে। পরি��েষে আবার কুর্নিশ জানাই বাস্তবের সেই সকল রক্ত মাংসের গোয়েন্দাদের যারা সিস্টেমের উপর ভরসা আদায় করেছেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে।
এটা পড়তে যেমন উপভোগ্য ছিল তেমনি ছিল ভয়ে শিহরে উঠার মতো কেস। আমরা যেসব মার্ডার ক��স বইয়ে গল্পে পড়ি এসব যে আসলে হয়, তাও আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে এসবের সূত্রপাত তা ভাবতেই কেমন লাগে!
বইয়ের নামেই আগ্রহ জন্মেছিল পড়ার। পশ্চিমবঙ্গের ১২টি পুলিশ কেস তদন্তের দুর্দান্ত কাহিনী নিয়ে লেখা। শুধু তদন্তই নয় সাথে অপরাধীর শাস্তি কি হয়েছিল সেটাও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটাই কেসই ছিল বিষাদময় আর বেদনাদায়ক। তবে “বিলিয়ন ডলার নোট” কেসটি ছিল আদতেই বিষে বিষক্ষয়।
বিস্তারিত আর না বলি। যারা পড়েননি দ্রুত সংগ্রহ করে পড়ে ফেলুন।
ফেলুদা কিংবা কিরীটি-ব্যোমকেশের মতো গোয়েন্দারা কেবল বইয়ের দুই মলাটের ভেতরেই নয়, বাইরেও থাকেন। মগজাস্ত্র ব্যবহার করে তারাও জটিল থেকে জটিলতর কেস ক্র্যাক করেন, দিনের পর দিন কেস সলভ না হওয়া পর্যন্তই সেটা নিয়ে লেগে থাকেন। এই বইটা গত ১০০ বছরে ঘটে যাওয়া এক ডজন খুনের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি নিয়ে লেখা। লিখেছেন কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার সুপ্রতিম সরকার। বইয়ে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস চোখে পড়ার মতো। বইয়ের নামকরণের এমন কারণ হলো কলকাতা পুলিশের হেডকোয়ার্টার বা সদর দফতরের গোয়েন্দা বিভাগ লালবাজার নামেই পরিচিত।
কয়েক দশক আগেও কীসব তুচ্ছ কারণে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করা হতো আর কিভাবে আজকালকার প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই সেসব কেস সলভ করা হতো তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এই যেমন ১৯৩৪ সালে কী করে ভিক্টিমের গায়ে প্লেগের ভাইরাস ইনজেক্ট করর মারা হয়, কিভাবে বিকৃত কঙ্কাল কার তা কোনোধরনের ফেস রিকগনিশন প্রোগ্রাম ছাড়াই বের করা হয়েছে বা কিভাবে ক্লাস ওয়ানের বাচ্চাকে খুন করে স্যুটকেসে ভরে ফেলে দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি। সবগুলো খুনের মামলাই একটা আরেকটাকে ছাড়িয়ে যায়। কিছু কিছু বর্ণনা পড়লে তো গা শিউরে ওঠে৷
বইয়ের প্রত্যেকটা কেসের সাথে প্রয়োজন অনুসারে খবরের কাগজের হেডলাইন, ফরেনসিক রিপোর্ট, লাশের ও ক্রাইমসিনের ছবি, কোর্টের আদেশের কাগজ অ্যাটাচ করা আছে। এছাড়াও কিভাবে তদন্ত করা হয়েছে সেই প্রক্রিয়াও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এখানে বর্ণনা করা৷ একজন পুলিশ অফিসার এত দারুণ লিখতে পারেন, ভাবতেই অবাক লাগে! এটা কোনো অংশেই ক্রাইম থ্রিলার ফিকশনগুলোর কম না।
মহামারির আগ দিয়ে প্রচলিত বইয়ের পাশাপাশি ননফিকশন পড়ার একটা চল এসেছে। বিশেষত খাবারদাবার দিয়ে। আবার বিভিন্ন বিষয়ের ননফিকশনও আছে। গুডরিডস আর সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক স্তুতিবাক্য দেখে চিরায়ত স্বভাব অনুযায়ী একটু সন্দেহ হয়নি যে তা না। আসলেই কি এত ভাল? জীবনে তো কম পুলিসের কাহিনী শুনলাম না, এ আর এমন কি হবে ভাব।
বাতিঘরে বসেই বইটা একটু পড়া শুরু করলাম। ঝরঝরে লেখা। কোথাও কোন মেদ নেই। হালকা প্রতিষ্ঠান স্তুতি আছে কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই লেখকের চাকুরিসূত্রে। ভাল লাগার মত এমন কি ঘটনা আছে বইটাতে? মানুষের জঘন্য রূপগুলোই প্রকাশ পেয়েছে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মনে হয় ষড়রিপু ছাড়া তেমন কোন পার্থক্য নেই। সৃষ্টির সেরা জীব বলে এত অহম কেন করে মাথায় আসে না। বইটি প্রায় গত একশো বছরে কলকাতার কিছু নশৃংস হত্যার আদ্যোপান্ত৷ মার্ডার-মিস্ট্রি-থ্রিলার ফিকশন পড়ার আগ্রহ থাকলে এটাও পড়ে দেখতে পারেন, খারাপ লাগবেনা।
(ব্যক্তিজীবনে আমার বাবা একজন পুলিস। আরো স্পষ্ট করে বললে গোয়েন্দা পুলিস বলতে হয়। একটু বয়স বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই বাবার কাছে তার চাকরি জীবনের কমবেশি কাহিনী শুনেছি। বাংলাদেশ পুলিসের অনেক বাসরুদ্ধকর কাহিনী আছে, দুঃখের বিষয় পুলিশ বিভাগে সুপ্রতিম সরকার লেখক নেই। আর থাকলেও লেখালেখির পরিবেশ নেই।)
এ কোনো কল্পনা জগতের ফেলুদা,ব্যোমকেশের রহস্যকাহিনি নয়।এই বইএর কাহিনি, চরিত্র, গোয়েন্দারা সবই বাস্তবের। শুরুতেই লেখক বলেছেন, "এই বই কোনও পূর্বপরিকল্পনার পরিণতি নয়।কলকাতা পুলিশের জনপ্রিয় ফেসবুক পেজে পাঠক পাঠিকাদের অনেক অনুরোধ করেছিলেন,পুরনো কিছু মামলা নিয়ে লিখতে,যার কিনারায় সাফল্য পেয়েছিল পুলিশ।" - আর এ কাহিনিগুলো যে সত্যিই বাস্তবের তার প্রমাণস্বরূপ বইয়ে নানার তথ্য যেমন - মার্ডার স্পটের ছবি,লাশের ছবি,বিচার সির্ধান্তের অংশ বিশেষ এসব দেওয়া হয়েছে।
বইটিতে মোট ১২ টি গুরুত্বপূর্ণ কেসের কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলি হলো - ১) পাকুড় হত্যামামলা ২) বেলারানী হত্যামামলা ৩)পঞ্চম শুক্লা হত্যামামলা ৪)দেবযানী বণিক হত্যামামলা ৫)অনুরাগ আগরওয়াল হত্যামামলা ৬) নওলাখা হত্যামামলা ৭)বিশ্বনাথ দত্ত হত্যামামলা ৮)হারুন হত্যামামলা ৯)রমজান আলি হত্যামামলা ১০) বাপি সেন হত্যামামলা ১১)হোটেল পেঙ্গুইন হত্যামামলা ১২) লুথরা হত্যামামলা বেলারানী হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা পড়ে তো শিউরে উঠেছিলাম।ভাবতে পারছিলাম না যে,এরকম নৃশংস ভাবেও খুন করা যায়!! তাও আবার এককালে ভালোবেসে বিয়ে করা নিজের স্ত্রীকে!!!
পড়ার সময় যেমন একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম,তেমনি কোথাও একটা খারাপও লাগছিল। ভাবছিলাম যাদের পরিবারের সাথে ঘটেছে তাদের কি অবস্থা হয়েছে। এতো তুচ্ছ কারণে মানুষ মানুষকে কি করে খুন করতে পারে !!
Book is a Page turner. It chronicles 12 murder cases starting from 1933 to 2007 happened in the city Kolkata erstwhile Calcutta and solved by Calcutta police.
In the starting itself The author has categorically stated that its not a detective novel of whodunnit and lacks that adrenaline which comes while reading detective crime fiction. Rightly so the killer is told in the starting of every story and then most of the pages are dedicated to the investigation and the chargesheet filed after the killer is nabbed.
Some of the cases can be googled also specially the later ones. though after reading such cases and their high court judgements in kanoon.org, it seems that Mr Sarkar has taken some liberty in narrating the cases specially the Luthia's murder case just to entice more excitement in the viewers which in a way make it non-fictional opposite to what the writer has stated in the starting hence giving only 4 stars. Other than this shortcoming book is really unputdownable. Shortly be starting his second book. Hope it will also be as good as this one.
ফুটপাতে পড়ে আছে একটা লাশ। ছিন্নমূল এক নিম্নবিত্তের, ঘুমের ঘোরেই হয়তো বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে। খুনের অস্ত্র পড়ে আছে পাশেই, ভারি একটা পাথর দিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে মাথা। কদিন পরেই ঠিক একইভাবে পাওয়া গেল আরেকটা লাশ, ঠিক একইরকমভাবে পাথর দিয়ে করা হয়েছে খুন। কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবার আরেকটি। ঘুম হারাম হয়ে গেল কলকাতা পুলিশের, লালবাজার তোলপাড়। কে বা কারা খুন করছে এভাবে? অজ্ঞাত আততায়ীর নাম হয়ে গেল স্টোনম্যান।
এরকম বাস্তব জীবনের লালবাজারের কিছু কেস হিস্ট্রি নিয়ে সাজানো তিন খন্ডের এই বই। লেখক নিজেই একজন পুলিশ কর্তা, তাই টেকনিক্যাল বিষয়গুলো এসেছে বিস্তারিত। ��নেকগুলো কেস আছে। কিছু কিছু দারুণ, আবার কিছু সাদামাটা। তবে লেখকের ভাষা রীতিমতো সুখপাঠ্য, সেজন্যই পড়া শুরু করলে ছাড়া যায়না। ক্রাইম থ্রিলার যারা ভালোবাসেন, তাদের জন্য বলব মাস্ট রিড। ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন, কথাটা এই বই পড়লে আরেকবার উপলব্ধি করা যায়
স্বভাব অনুযায়ী, ট্রেন্ডের ঝড় একটু স্তিমিত হওয়ার পরেই বইটি পড়লাম। বলা ভালো, গোগ্রাসে গিললাম। গোয়েন্দা গল্পের থেকে আলাদা যে একেবারেই, তা বলা বাহুল্য। কারণ, এ সত্যি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। তাই, রোমাঞ্চকর অনুভূতির থেকে প্রায় বিপরীত মেরুর ভাবাবেগ আবিষ্ট করেছে মনকে। ভয়-ভীতি, উদ্বেগ, শান্তি, শ্রদ্ধা সবই মিলেমিশে একাকার। ক্রাইম সিনের গতিপ্রকৃতি বর্ণনায় কোনো খুঁত রাখেননি লেখক। কল্পনার জগতের সাথে তার যে কত বিস্তর ফারাক, তা ফুটে উঠেছে অতি সহজেই। সঙ্গে জুড়েছেন, বিভিন্ন বহুল প্রচলিত গল্প-কবিতার নানা উদ্ধৃতি। যা পাঠকের একঘেয়েমি কাটাতে ভীষণ রকম ভাবে সাহায্য করেছে। এছাড়াও, বারোটি গল্পের থুড়ি সত্য ঘটনার নাম-করণ রীতিমতো প্রশংসনীয়। সর্বোপরি, এরকম লোভনীয় সিরিজ মিস করার কোনো মানেই হয়না।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে অথবা বলা যায় সত্য ঘটনার সূত্র গুলো একে একে সাজিয়ে লেখক যে লোমহর্ষক কাহিনী শুনিয়েছেন তা গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে পছন্দ করে এমন পাঠকের কাছে রত্ন হয়ে থাকবে।
বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে একুশ শতকের শুরু পর্যন্ত কোলকাতা জুড়ে যেসব উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। যা একই সাথে লোমহর্ষক ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় বহন করেছে তেমন এক ডজন কাহিনী নিয়ে এই বই।
গোয়েন্দা কাহিনী কম বেশি আমরা সবাই পড়েছি। যেখানে সম্ভব অসম্ভব অনেক কিছুই ঘটে থাকে। যা পাঠককে যেমন রোমাঞ্চিত করে, তেমনিভাবে পাঠকের মনে একটা সময় পর্যন্ত উজ্জ্বল স্মৃতির মতো থেকে যায়। কথায় আছে সত্য কল্পনার চেয়েও নাটকীয়, ঘটনাবহুল। এই কথাটার চাক্ষুষ প্রমাণ যেন এই বইয়ের প্রতিটা কাহিনীতে পেলাম। কোলকাতা জুড়ে গত ৭০ বছর ধরে ঘটে যাওয়া যেসব হত্যাকাণ্ড সমসাময়ীক পুরো কোলকাতাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। পুলিশ বিভাগের, গোয়েন্দা বিভাগ থেকে শুরু করে জনমানুষের মনে যেগুলো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে সেসব যে কতটা চমকে দেয়ার মতো, পাঠকের মনে কতটা গভীর রেখাপাত করার মতো ঘটনা। সেটা যদি এই বইয়ের মতো গল্প আকারে সবার সামনে না আসতো তাহলে হয়তো এসব কাহিনী আজীবনই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যেতো। বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু কিছু হত্যাকাণ্ড গোয়েন্দা কাহিনীর চেয়ে কম না, বরঞ্চ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা কাহিনীর কাল্পনিকতার গণ্ডিকেও ছাড়িয়ে অনেকদূর পর্যন্ত যায়।
গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে পছন্দ করেন যারা। তারা সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত এই বইটা পড়তে পারেন। যার পরবর্তী আরো দুটো খণ্ড ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং সমানভাবে পাঠকমহলে সমাদৃত হ'য়ে ইতিমধ্যে। পড়ার পর আমি উপলব্ধি করলাম, এই বই পড়ে খারাপ লাগার চান্স নেই বললেই চলে।
সংক্ষিপ্ত কাহিনীঃ মার্ক টোয়েনের একটা কথা আছে, "Truth is stranger than fiction"- বাস্তব কল্পনাকেও হার মানায়। আমরা সবাই ই কমবেশি ফেলুদা-ব্যোমকেশ-কাকাবাবু-মিতিন মাসী থেকে শুরু করে এরকুল পোয়েঁরো-শার্লক হোমস বা মিস মার্পলের গোয়েন্দাকাহিনী গুলো পড়েছি। কিন্তু বাস্তবজীবনে কি আসলেই এমন ঘটে? ঘটে, বরং বলা যায় যা ঘটে তা আমাদের কল্পনাতীত। কলকাতা পুলিশের অভিজ্ঞ অফিসার, বর্তমান অতিরিক্ত কমিশনার সুপ্রতীম সরকার এমনই কিছু কাহিনীকে দুই মলাটের মধ্যে আবদ্ধ করেছেন, যেসব কেইসের সময়কাল ব্যপ্তী ১৯৩৩ থেকে ২০০৯ সাল। প্রতিটি কেইস ই এত ইউনিক, প্রত্যেকটিই এত ভয়ংকর যে আপনাকে প্রতিবারই বইটি মনে করিয়ে দেবে- মানুষ যখন নীচে নামে, তখন তার অসাধ্য কিছুই নেই
ব্যক্তিগত মতামতঃ আমি ছোটবেলা থেকেই থ্রিলার ভক্ত। এম বি বি এস থার্ড ইয়ারে ফরেন্সিক মেডিসিন পড়ার সময় বেশকিছু কেইস স্টাডি আমাদের পড়তে হতো। সেখান থেকেই মূলত এইধরনের কাহিনীর প্রতি আসক্তি। এরমধ্যে বারবারই এই বইয়ে "The Jigsaw Puzzle Case" যা "Ruxton Murders" নামে পরিচিত৷ তার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। বইটি আমার কাছে বেশ উপভোগ্যই লেগেছে। যারা রিয়েল লাইফ মার্ডার মিস্ট্রি বা পুলিশ থ্রিলার পছন্দ করেন, তাদের জন্য বইটা মাস্ট রীড!
পুনশ্চঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন নামের কাগজে বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের দেশের ঘটে যাওয়া বেশকিছু চাঞ্চল্যকর মামলার বিবরণ ও তদন্তপ্রক্রিয়া সিরিজ আকারে ছাপা হয়েছিল। আমার বেশ আফসোস হয়েছিল বইটা পড়ার পরে, যদি আমাদের দেশের কেইসগুলোকেও এমন দুই মলাটে আবদ্ধ করা যেতো!
সুপ্রতিম সরকারের লেখা গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার নিছক একটি বই নয় — এ যেন বাংলা ট্রু‑ক্রাইম সাহিত্যের ভূচিত্রে এক উল্লেখযোগ্য বাঁক, এক সাহসী ‘turnkey’ মুহূর্ত।
এই বই রহস্য গল্পের চেনা ছকে ক্লাইম্যাক্স বা অপরাধী ধরার নাটকীয় আখ্যান নয়, বরং সেই সমস্ত জটিল, ধৈর্য-নির্ভর ও প্রায়শই অবিশ্বাস্য বাস্তবতা, যা সাধারণত পর্দার আড়ালেই রয়ে যায়। তদন্তের দৃঢ়তা, প্রমাণের কারিগরি সংগ্রহ, সাক্ষীর ভঙ্গুর মনস্তত্ত্ব সামলানো, আদালতের দরজায় চার্জশিট পৌঁছানো—এইসব অনবরত ব্যুরোক্রাটিক, অথচ আবেগমথিত কসরতের মাঝেই গড়ে ওঠে এক অনন্য পাঠ-অভিজ্ঞতা।
এই বইয়ের প্রতিটি পাতা তুলে ধরে আধুনিক ফরেনসিক, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, এবং তদন্তকারী দলের পারস্পরিক নির্ভরতাকে — যেখানে দারোগার হাতের লাঠি নয়, বরং মস্তিষ্কের কৌশল, চোখের সতর্কতা, আর হৃদয়ের গভীর মানবিক সহমর্মিতাহয়ে ওঠে মূল প্রতিপাদ্য। সুপ্রতিম সরকার একাধারে তদন্তকারী, প্রত্যক্ষদর্শী, এবং বর্ণনাকারী—আর তাঁর লেখা সেইজন্যই কেবল তথ্যনিষ্ঠ নয়, বরং নিঃশব্দ সাহসিকতার দলিল।
বইটি একত্রিত করেছে ১৯৩৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে কলকাতায় ঘটে যাওয়া ১২টি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা। প্রতিটি ঘটনা অতি যত্নে তুলে আনা হয়েছে। পাঠক জানেন কে খুন করেছে, কিন্তু জানেন না কীভাবে পুলিশ প্রমাণ সংগ্রহ করেছে, কোন খাতে তদন্ত এগিয়েছে। পাঠক আরও বোঝেন যে অভিযুক্তকে ফাঁসানো নয়, বরং আইনত সাজা দেওয়ার উপযুক্ত করে তোলা কতখানি কঠিন। গোয়েন্দার এই ‘পরের কাজ’ নিয়েই লেখকের মূল আগ্রহ।
সুপ্রতিম সরকারের পেশাগত অভিজ্ঞতা বইটির সবচেয়ে বড় সম্পদ। তিনি শুধু পুলিশের উচ্চপদে থেকেছেন বলেই নয়, সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা, মনস্তাত্ত্বিক চাপ এবং মানবিক দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে গেছেন, সেগুলিকে তিনি নির্মোহ অথচ সংবেদনশীল ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।
তাঁর ভাষা ঝরঝরে, বিন্যা���ে শৃঙ্খলা আছে, আবার তা ক্লান্তিকর তথ্যচর্চা হয়ে ওঠেনি। তাঁর কথনে রয়েছে investigative non-fiction এর মতোই একটা cinematic টান। প্রত্যেকটি narrative শুরু হয়েছে সামাজিক প্রেক্ষাপট দিয়ে, তারপর এসেছে ঘটনার ঘনঘটা, তদন্তের বাঁক, পুলিশের দলগত রণনীতি, এবং সবশেষে আদালতের মুখোমুখি দাঁড়ানো।
তুলনামূলকভাবে, যদি প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের দারোগার দপ্তর এর সঙ্গে compare করা যায়, স্পষ্ট ফারাক বোঝা যাবে। প্রিয়নাথের কাহিনিগুলি ঐতিহাসিকভাবে অমূল্য, তবে তাঁর বয়ানে আধুনিক মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ বা আজকের প্রক্রিয়ার ফাইন টিউনিং অনুপস্থিত। প্রিয়নাথ ছিলেন উনিশ শতকের লালবাজারের মানুষ — তিনি ঘটনার সারসংক্ষেপ দিতেন, আবেগ বা কৌশল বা মনস্তত্ত্ব নিয়ে বেশি চিন্তা করতেন না। গোয়েন্দা চরিত্রকে প্রধান করে তোলার ধারাও তাঁর লেখায় অনুপস্থিত। ঠিক উল্টোদিকে গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার আধুনিক ট্রু‑ক্রাইম সাহিত্যের স্পেসে দাঁড়িয়ে। এখানে খুন যেমন রোমহর্ষক, তদন্ত তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত এবং মানবিকভাবে জটিল।
এই বই তুলনায় অন্যান্য বাংলা ট্রু‑ক্রাইম বা পুলিশি ধারার বইগুলোর থেকে আলাদা। সেকালের গোয়েন্দা কাহিনী ফিকশনধর্মী—নস্টালজিক এবং অ্যাডাপ্টেড গোয়েন্দা আখ্যানের সমাহার, যার মধ্যে সত্য ঘটনা নয় বরং গল্প বলার রোমাঞ্চটাই মুখ্য। মিয়াজান দারোগার একরারনামা বা বাঁকাউল্লার দপ্তর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝলক দেয়, তবে সেগুলো বিশ্লেষণাত্মক বা প্রসিডিওরাল নয়। অন্যদিকে, সাদা আমি কালো আমি বা অপরাধ বিজ্ঞান গভীর রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক পাঠ উপস্থাপন করে, যা তথ্যপূর্ণ কিন্তু সাহিত্যের গদ্য রসে তেমন রসদ জোগায় না।
তুলনামূলক টেবিলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার সময়ের নিরিখে আধুনিক, লেখনীর দিক দিয়ে টানটান ও বর্তমান প্রজন্মের পাঠকদের উপযোগী, এবং লেখক নিজে যে পেশার অন্তর্গত —সেই firsthand অভিজ্ঞতা তাঁকে এক আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। ,সে দিক দিয়ে প্রিয়নাথের কাজ আর্কাইভাল ও প্রামাণ্য হলেও, সুপ্রতিমের কাজ বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জিং বাস্তবতায় নিখুঁত টেক্সট।
তমোঘ্ন নস্কর, উপেন বিশ্বাস, দীপ্তজিৎ মিশ্র প্রমুখের যেসব ট্রু‑ক্রাইম লেখা আমরা পড়েছি, সেগুলো সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট বিষয়—যেমন চিকিৎসা-সংক্রান্ত অপরাধ, রাজনৈতিক দুর্নীতি বা সমাজতাত্ত্বিক পটভূমিতে লেখা — এই গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেইসব বইয়ে ঘটনার তীব্রতা থাকলেও তদন্তের জটিল স্তরগুলি, প্রসিডিওরাল বুনোট, বা পুলিশের দলগত চিন্তাভাবনার কাঠামো প্রায়শই একপাক্ষিক বা সংক্ষিপ্ত থাকে। অনেক সময় লেখক নিজে তদন্তের অংশ না হয়ে, পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় থাকেন—ফলে টেক্সচারে আসে একধরনের দূরত্ব।
গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার এই জায়গাটাই পুরো বদলে দিয়েছে। লেখক নিজে পুলিশের শীর্ষপদে থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তার স্পষ্ট ছাপ পড়েতাঁর বর্ণনায়। তাই এখানে তদন্ত প্রক্রিয়া কেবল চিত্রায়ন নয়, একপ্রকার অনুশীলন। এই বই পড়তে পড়তে পাঠক আপনার মনে হতে বাধ্য যে আপনি নিজেই পুলিশের ব্রিফিংরুমে বসে আছেন, নিজের চোখে ফাইল ঘাঁটছেন, আর অনুভব করছেন অপরাধীদের মানসিক প্রক্রিয়া, জেরা কৌশল, ফরেনসিক সমীক্ষা, এবং বিচার-প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব।
এমনকি যদি Mindhunter‑এর জন ডগলাস বা Helter Skelter‑এর ভিনসেন্ট বুগলিয়োসির মতো বইগুলোর কথা ভাবি—যেগুলো পশ্চিমের ট্রু‑ক্রাইম ক্ল্যাসিক, তাদের সঙ্গেও গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার একটি আত্মবিশ্বাসী তুলনার দাবি রাখে। কারণ এখানেও রয়েছে firsthand অভিজ্ঞতার নির্যাস, তদন্তের স্তরভিত্তিক বিবরণ, আর অপরাধের গভীরে পৌঁছানোর সেই ধৈর্য-ভিত্তিক এক্সপ্লোরেশন। শুধু ভাষার পার্থক্য নয়, সংস্কৃতিগত পার্থক্যের মধ্যেও লালবাজার তৈরি করে এক ঘরোয়া অথচ বিশ্বজনীন আবেদন।
সবশেষে, গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার নিছক একটা বই নয়—এ এক নীরব শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, সেই সব পুলিশ অফিসারদের প্রতি যাঁরা মিডিয়ার প্রচারের বাইরে থেকেও প্রতিদিন অপরাধ মোকাবিলা করেন, বিচারের পথে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যান।
যারা ট্রু‑ক্রাইমকে শুধু থ্রিলের উৎস হিসেবে নয়, বরং রাষ্ট্র, আইন ও মানবিক মননের আন্তঃসম্পর্কের জটিল ম্যাপ হিসেবে পড়তে চান—তাদের জন্য এই বই নিঃসন্দেহে এক অনন্য ক্লাসরুম।
কাহিনি সংক্ষেপঃ কলকাতা'র লালবাজারকে বলা হয় কলকাতার গোয়েন্দাদের তীর্থস্থান। কলকাতা পুলিশের অনেক কেসেরই সমাধান এসেছে লালবাজারের গোয়েন্দা পুলিশদের হাত ধরে। আবার অনেক কেসই রয়ে গেছে অমীমাংসিত। কলকাতা পুলিশের হাত ধরে সমাধান হওয়া নানা সময়ের মোট বারোটা হত্যা রহস্য নিয়ে সুপ্রতিম সরকার লিখেছেন 'গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার'। প্রত্যেকটা হত্যা মামলাই দারুন আলোচিত ছিলো। নিচে একটু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করলাম।
পাকুড় হত্যা মামলাঃ ১৯৩৪ সালের তুমুল আলোচিত পাকুড় হত্যা মামলা। ছোট কুমার অমরেন্দ্র পান্ডেকে বেশ অভিনব উপায়ে হত্যা করা হয় মানুষজনে ভরা স্টেশন চত্ত্বরে। অনেক জলঘোলা হওয়ার পর শেষমেষ এই মামলার কিনারা হয়। সেই ১৯৩৪ সালের দিকেও যে মানুষকে এভাবে হত্যা করা যায়, তা এই উপাখ্যান না পড়লে আসলেও বিশ্বাস হতোনা।
বেলা রানী দত্ত হত্যা মামলাঃ কলকাতা শহরে একের পর এক পাওয়া যাচ্ছে খবরের কাগজে মোড়ানো লাশের খণ্ডাংশ। খণ্ডিত অংশগুলো সব এক লাশেরই। একজন মহিলা। ১৯৫৪ সালের এই নৃশংস ঘটনার সমাধানও আসে লালবাজারের গোয়েন্দাদের হাত ধরেই। সেই সাথে উন্মোচিত হয় এক ভয়াবহ অন্ধকার ইতিহাস।
পঞ্চম শুক্লা হত্যা মামলাঃ ১৯৬০ সালে নির্জন এক ঝিলের মাঝে পুঁতে রাখা একটা কঙ্কাল আবিস্কার করে পুলিশ। কঙ্কালটা খিদিরপুর ডকের সিকিউরিটি গার্ড পঞ্চম শুক্লার। ৫০০ রুপির (সেই সময়ে ৫০০ রুপি মানে অনেক) জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছিলো। এই কেসটারও সমাধান হয় দারুন রোমাঞ্চকর ভাবে। এই কেসেই সর্বপ্রথম 'ফোটোগ্রাফিক সুপারইম্পোজিশন' সিস্টেম ব্যবহার করে লাশ শনাক্ত করা হয় যা ভারতে প্রথম ছিলো।
দেবযানী বণিক হত্যা মামলাঃ গড়িয়াহাট থানায় দায়ের হওয়া গৃহবধূ দেবযানী বণিক হত্যা মামলা একইসাথে যেমন চাঞ্চল্যকর, তেমনি হৃদয়বিদারক। ১৯৮৩ সালে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নৃশংসভাবে বাড়ির বউ দেবযানীকে হত্যা করে তার লাশ বাড়ির ভেতরেই লুকিয়ে রাখে। পরবর্তীতে পুলিশি হস্তক্ষেপে পুরো ব্যাপারটা আলোর মুখ দেখে।
অনুরাগ আগরওয়াল অপহরণ ও হত্যা মামলাঃ স্কুলছাত্র অনুরাগ আগরওয়ালের স্বপ্ন ছিলো টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করার। আর সেই স্বপ্নই তার কাল হয়ে দাঁড়ালো। অপহরণ করে হত্যা করা হলো তাকে। ১৯৮৮ সালের এই হত্যার ঘটনাটাও যথেষ্ট হৃদয়বিদারক।
বিশ্বনাথ দত্ত হত্যা মামলাঃ অন্তর্মুখী ও পড়ুয়া স্বভাবের নিপাট ভালো মানুষ বিশ্বনাথ দত্তকে হত্যা করা হলো সম্পত্তি দখলের জন্য৷ শুধু তাই না, তার লাশ লুকিয়ে ফেলা হলো অভাবনীয় এক স্থানে। ১৯৯৪ সালের এই ঘটনা খোদ কলকাতায় তো বটেই, সাড়া ফেলেছিলো সমগ্র ভারতে।
সার্জেন্ট বাপি সেন হত্যা মামলাঃ থার্টি ফার্স্ট নাইটে একদল মদ্যপ যুবক এলোপাথাড়ি লাথি ঘুষি মেরে হত্যা করলো তরুণ সার্জেন্ট বাপি সেনকে। হতভাগ্য বাপি'র দোষ ছিলো অচেনা এক তরুণীর সম্ভ্রম বাঁচাতে চাওয়াটাই। নড়েচড়ে বসলো পুরো কলকাতা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। ২০০৩ সালে সারা দেশে হইচই ফেলে দিয়েছিলো এই কেসটা।
এরকম আরো বেশ কয়েকটা হত্যা মামলা স্থান পেয়েছে 'গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার' বইয়ে। যেমনঃ হারুন রশিদ হত্যা মামলা, নওলাখা দম্পতি হত্যা মামলা, রবীন্দর কউর লুথরা হত্যা মামলা, রমজান আলি হত্যা মামলা ও হোটেল পেঙ্গুইন হত্যা মামলা। প্রত্যেকটা কেসই কমবেশি চাঞ্চল্যকর ও রহস্যে ভরপুর। এগুলোর মধ্যে একটা মিল খুবই লক্ষনীয়। আর তা হলো সবগুলো কেসেরই কিনারা করতে পেরেছিলেন লালবাজারের গোয়েন্দা পুলিশেরা।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ বর্তমানে কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে কর্মরত সুপ্রতিম সরকার তাঁর 'গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার' বইটা লিখতে গিয়ে যে রীতিমতো নানারকম গবেষণার মধ্যে দিয়ে গেছেন, তা সহজের বোঝা যায়। পুরোনো সব হত্যা মামলার রেকর্ড ঘেঁটে নানারকম অ্যানালাইজেশনের পর তিনি বেছে নিয়েছেন লালবাজারের গোয়েন্দা পুলিশের সমাধান করা বারোটা হত্যা রহস্য। দারুন উপভোগ্য এক গল্প বলার ঢঙে সুপ্রতিম সরকার তাঁর পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন এই বারোটা হত্যা মামলার নানা খুঁটিনাটি।
প্রয়োজনে তিনি মামলাগুলোর সাথে সম্পর্কিত নানা ছবি, ডকুমেন্ট ও পেপারকাটিং সংযুক্ত করে দিতেও কোন কার্পণ্য করেননি। এই ব্যাপারটা আমার কাছে দারুন লেগেছে। একেবারে প্রামাণ্য ভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন হত্যা রহস্যগুলোর সমাধানের পুঙ্খানুপুঙ্খ পদ্ধতিও। সুপ্রতিম সরকারের লেখনীও ছিলো যথেষ্ট সুখপাঠ্য। বাস্তবে ঘটে যাওয়া এসব নৃশংস হত্যা কাহিনি গুলো পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিলো কোন বিখ্যাত লেখকের রহস্য কাহিনি পড়ছি। বাস্তবের গোয়েন্দারা কিভাবে রহস্যের সমাধান করেন, সেটা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা দেয়ার জন্য 'গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার' যথেষ্ট।
এই সত্য খুনের উপাখ্যানটা পড়া শেষ হয়েছে বেশ দ্রুতগতিতে। ভালো লেগেছে প্রত্যেকটা মামলায় সুপ্রতিম সরকার ব্যবহৃত কাব্যিক শিরোনামগুলো। প্রচ্ছদটাও চমৎকার লেগেছে। সত্য অপরাধ কাহিনি প্রেমীরা চাইলে পড়ে ফেলতে পারেন 'গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার'। আশা করি হতাশ হবেননা।
বই এর কথায় পরে আসছি। আচ্ছা... আপনার কখনো খুন করতে ইচ্ছা করেছে? মানে, এই ধরুন, গলা টিপে মেরে ফেলা বা বুকে ছুরি বসিয়ে দেওয়ার মতন কিছু? উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয় তাহলে ভয়ের কিছু নেই, আমিও আপনার দলে পড়ি! আসলে সব মানুষের মধ্যেই কম বেশি অপরাধের মানসিকতা লুকিয়ে থাকে মস্তিষ্কের জটিল কোষ গুলোতে। আর যে বা যারা এই অপরাধ প্রবণতা কে প্রশ্রয় দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘটিয়েই ফেলেন ঘটনাটা তাদের একাংশের কথা নিয়েই এই বই দুটির সূত্রপাত। মানুষের লোভ, লালসা, নির্মমতা, ঘৃণা, প্রতিশোধ, আবেগ, ক্ষোভ অথবা নিছক কোন তুচ্ছ ঘটনা থেকে জন্ম এসব অপরাধের, কিন্তু এই সামান্য বীজ থেকে অসামান্য ও ভয়াল বাস্তবের শেষ পরিণতি দেখে শিউরে উঠতে হয় বইএর প্রতি পাতায়।
এবার আসি আমাদের "স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড" লালবাজারের কর্ম তৎপরতা ও তার কর্মী দের ভূমিকায়। আজকাল মিডিয়ার দৌলতে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, "পুলিশ কি করছে?" "তদন্ত কতদূর এগোলো?" "অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে আছে কিভাবে?" মশাই বলি কি গল্পের ফেলুদা-ব্যোমকেশদের সাথে রক্তমাংসের পুলিশ আর গোয়েন্দার ফারাক বিস্তর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থলে আধপোড়া সিগারেটের টুকরো থাকে না, থাকে না বাগানের ঝোপঝাড়ের কাদায় পায়ের ছাপ, থাকে না হুমকি চিরকুট বা সমগোত্রীয় কিছু। যে কোনো অপরাধের তদন্তের থাকে বেশ কয়েকটি স্তর— অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, সংগৃহীত তথ্যের মধ্যে থেকে ছাঁটাই করে প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু ছেঁকে নেওয়া, সেই ইনফরমেশনের উপর নির্ভর করে অপরাধীদের সনাক্তকরণ, যথোপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের ধরার জন্য ওঁৎ পেতে অপেক্ষা এবং পরিশেষে এইসব দোষীদের বিচার ও সঠিক আইনের অধীনে শাস্তি নিশ্চিত করা। যারা ভাবেন পুলিশ বা গোয়েন্দাদের কাজ খালি আসামীকে ধরতে পারলেই শেষ তাদের বলি, এই তদন্ত ব্যাপারটা অনেক টা রিসার্চ ওয়ার্ক এর মত; গবেষণা করে ফল পেলেই হবে না সেটা পুরোটা থিসিসে ঢেলে দিতে হবে যাতে পেপার রিজেক্ট না হয়ে যায় কোনোভাবেই। সেরকমই অপরাধী ধরলেই হলো না, নিখুঁত ভাবে তৈরি করতে হয় চার্জশিট। নাহলে উকিলের মারপ্যাঁচে আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে আসামী। সিআইডির দয়া এক রাম থাপ্পড় দিলো আর আসামী স্বীকার করে দিলো হ্যাঁ স্যার আমিই খুন করেছি ওসব নাটকের স্ক্রিপ্টে ই হয়। বাস্তবে এই পুরো প্রক্রিয়াতে নেই কোনো কল্পনা বা টিআরপি বাড়ানো রোমাঞ্চ আছে কেবল আপ্রাণ অধ্যবসায় আর কঠোর একাগ্রতা। সেই ছবিই তুলে ধরেছেন লেখক।
এবার যাঁর কথা না উল্লেখ করলে অসম্মান হয় তিনি স্বয়ং কলকাতা পুলিশের অ্যাডিশনাল কমিশনার এবং এই বই এর লেখক সুপ্রতিম সরকার। সুপ্রতিম বাবুর সাবলীল লেখনীতে বুঝে উঠতে পারছিলাম না কোনো এ ক্লাস সাহিত্যিকের লেখা পড়ছি নাকি এক দুঁদে আইপিএস অফিসারের বিবরণ! কেসের সাথে প্রয়োজন অনুসারে রয়েছে প্রয়োজনীয় খবরের কাগজের হেডলাইন, ফরেনসিক রিপোর্ট, লাশের কিংবা ক্রাইমসিনের ছবি। তদন্তের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা হোক বা কাব্যিক শিরোনাম লেখকের দক্ষতা ফুটে উঠেছে লেখনশৈলির পড়তে পড়তে।
সবশেষে বলি এই মাস্ট রিড থ্রিলার পড়তে পড়তে একটা কথাই মনে হবে— Truth is stranger than fiction.
সুপ্রতিম সরকার গুছিয়ে লেখেন। লিখিত বাংলা ভাষার ওপরও তাঁর দখল ভালো। কয়েক দশক ধরে ব্রিটিশ ভারত ও স্বাধীন ভারতে কলকাতা নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে এসে পড়া নানা খুনের ঘটনার রহস্যভেদের বিবরণ তিনি এ বইটিতে তুলে ধরেছেন। তাঁর কলমটি অনেকখানি সাংবাদিকের, কিন্তু তার ভেতরে যা আছে, তা যেন গোয়েন্দাকর্তার চোখের নিচে জমা হওয়া কালিটুকুই। খুনের ঘটনাগুলো অস্বস্তিকর, মোলায়েম প্রলেপ ছাড়াই তিনি সেসব বর্ণেছেন। গল্পের গোয়েন্দা থেকে বাস্তবের গোয়েন্দা কতখানি ভিন্ন, তা পাঠকের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি সময়ের সাথে কলকাতা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ব্যবহৃত নানা কৌশল ও পদ্ধতির বিবর্তনের ইতিহাসও তিনি আলগোছে মেলে ধরেছেন। তাঁর লেখা অন্য বইগুলো পড়ার আগ্রহ পেয়েছি।
যে ব্যাপারটা ভালো লাগেনি, সেটা হচ্ছে সাদা কাপড়ে চায়ের দাগের মতো লেগে থাকা বইয়ের এখানে-সেখানে সায়েবভক্তির একটা ক্ষীণ ছোপ। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাথে তুলনা করা হতো বা হয়, এ নিয়ে লেখক একাধিকবার গর্ব প্রকাশ করেছেন। সায়েবদের এক অবর কালা-আদমি সংস্করণ হিসেবে নিজেকে দেখতে পেয়ে আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন কোনো মানুষ কি গর্বিত হতে পারেন?
গল্পে উপন্যাসে পড়া কাল্পনিক খুনখারাপি নয়, বইটিতে উঠে এসেছে বাস্তবের ১২ টি খুনের আখ্যাননামা। পড়তে পড়তেই গা শিউরে ওঠে। ফিকশানের চাইতেও যে বাস্তবের খুনিরা এত নৃশংস হয়, সামান্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে যে মানুষ মানুষ কে এভাবে ঠাণ্ডা মাথায় মেরে ফেলতে পারে, তা বইটি না পড়লে হয়তো ভালোভাবে জানাই হতো না। একই ভাবে অজানা থেকে যেত পুলিশি কর্মকাণ্ডও। অপরাধীকে ধরার পরও তার শাস্তিবিধানের জন্য তাঁরা যে কঠোর পরিশ্রম করেন, তার মূল্যও অপরিসীম। আইপিএস অফিসার সুপ্রতিম সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এবং তাঁর অপূর্ব লেখনীশৈলীর মাধ্যমে, লালবাজারের একশ বছরের ইতিহাসের অগুনতি কেসের মধ্যে থেকে বারোটি কেসের বিবরণী সাজিয়েছেন। প্রতিটা কেসই কোনো না কোনভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিজেরাই পড়ে দেখুন, অবাক হওয়ার মতো অনেক বিষয়ই পাবেন। An absolutely must read for every thriller-lover.
রিভিউ ঠিক কি দৃষ্টিভংগি থেকে দেব বুঝতে পারছি না। পশ্চিম বাংলার সত্যিকার হত্যারহস্য সমাধানের কাহিনীগুলো লেখার গুনে অনবদ্য হয়ে উঠেছে। কাহিনীগুলো বাস্তব না হয়ে অবাস্তব হলে ভাল হত। ঘটনা সত্য হওয়াতে পড়া শেষে মন খারাপ হয়ে যায়। তবে লেখক বেশ দক্ষ, এটুকু বলা যায়। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে তার কাছ থেকে একেবারে ফিকশনধর্মী রহস্য গল্প বই আকারে পাব।