Jump to ratings and reviews
Rate this book

চৌথুপীর চর্যাপদ

Rate this book

444 pages, Paperback

Published December 25, 2017

10 people are currently reading
354 people want to read

About the author

Pritam Basu

11 books75 followers

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
106 (42%)
4 stars
84 (33%)
3 stars
43 (17%)
2 stars
14 (5%)
1 star
1 (<1%)
Displaying 1 - 30 of 52 reviews
Profile Image for Kaushik Majumdar.
Author 37 books597 followers
July 21, 2018
এক ওভার হাইপড উইকি
*********************************
প্রথমেই বলে রাখি আপনি যদি চৌথুপীর চর্যাপদের একনিষ্ঠ ভক্ত হন, তবে এই লেখা আপনার ভাল নাও লাগতে পারে। প্রীতম বসুর লেখা পাঁচমুড়োর রিভিউ দেবার পরে অনেকে বলেছিলেন এটা পড়লে নাকি ছিটকে যাব।

দুঃখিত। গেলাম না। বরং পাঁচমুড়োতে গল্পের গতি বলে একটা জিনিস ছিল, যা এখানে অনুপস্থিত। চরিত্র চিত্রণ দুর্বলতর, কাহিনীর গতি দিশেহারা। বইয়ের শেষে বিশাল বইয়ের লিস্টি জানাচ্ছে এই বই লিখতে লেখককে অনেক বই পড়তে হয়েছে। সেটা ভাল, কিন্তু যা যা পড়েছি, সব সঅব আমার উপন্যাসে ঢুকাবো, এমন ভাবলে যে জিনিসের অভাব স্পষ্ট হয়, তা পরিমিতি বোধের। এই এই অভাব পদে পদে এই বইতে পাওয়া গেছে। সেই সময় বা প্রথম আলোর মত বইগুলোতে এর থেকে অনেক বেশি বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোথাও এ ভাবে শিশুকে জোর করে দুধ গেলানোর মত তথ্য গেলানো হয়নি। লেখক যেন ধরেই নিয়েছেন, কেউ কিচ্ছু পড়েনি, ফলে সব জানানোর দায় তাঁর। ফলে উপন্যাসের চরিত্রদের প্রত্যেকে এক এক সিধু দাদু (শুধু জ্যাঠায় এত হয় না)... যে যখন পারছে, যাকে পারছে কারণে অকারণে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে। ধরুন আপনি নৌকায় উঠলেন, মাঝিকে জিজ্ঞেস করলেন " আচ্ছা এটা কি নৌকো? (কেন করলেন জানি না), আর মাঝি আপনাকে প্রাচীন বঙ্গে কর প্রকার নৌকা আছে, ছিল, তাঁদের গঠন নিয়ে দু পাতা জ্ঞান দিয়ে দিল। কাহিনীর নায়িকা যোজনগন্ধা ক্যান্সারের অ্যাডভান্সড স্টেজ নিয়ে যা যা করল, তা কোন সুস্থ মানুষ পারে কিনা সন্দেহ। হাফই হাবিলদার চরিত্রটি কমেডি রিলিফ, আর ঠিক এরকম একটা চরিত্র ছিল পাঁচমুড়োতে, সে ব্যাটা ছিল চোর। যোজনগন্ধার মত এক চরিত্র ছিল বদন। ভিলেন এখানে ছেত্রী, ওখানে শেখ....দুজনেই আর মাত্র সাতদিন বলে ডেডলাইন দেয়, কিন্তু একজনেরও ডেডলাইন মেইন্টেন করার ইচ্ছা বা তাগিদ দেখি না। তাগিদ বরং লেখকের প্রচুর। প্রতি অধ্যায় শেষে, " আর মাত্র..... দিন" বলে শেষ করছেন ( .... এর দিন ক্রমাগতঃ কমছে) কিন্তু সে দিন পেরিয়ে গেলেও তেমন কিছু হচ্ছে না। কিছুক্ষণ বাদেই পাঠক বোঝে যে মূল চরিত্ররা অজর অমর অক্ষয়, লোকনাথ বাবা এদের রণে বনে জলে জংগলে রক্ষা করবেন শিওর। মামাজী বলে এক উগ্রপন্থী আছে। এত গাম্বাট উগ্রপন্থী আমি লাইফে কোথাও আছে বলে জানি না। তাঁর কোন ট্যাক্টিস বলে কিছু নেই। দুমদাম আসছে, হুমহাম চেল্লাচ্ছে আর অকারণে একে ওকে মারছে। সবাই বলছে " মামাজী খুব হিংস্র"। আমার একে বরং ভাল লেগেছে। একমাত্র এই চরিত্রটি কোন জ্ঞান দেয়নি, শুধু উল্টোপাল্টা অ্যাকশান করে গেছে। কাহিনীর মধ্যে কাহিনীর মত, প্রাচীন বাংলার ইতিহাস আর বৌদ্ধদের কথা আছে। বাংলার ইতিহাস যার ন্যুণতম পড়া তাঁর কাছে বেশিরভাগ জানা, তবু লেখক জানেন যে আপনি জানেন না। তাই তিনি জানিয়েই ছাড়বেন। মানুষের data memory কম হয় জানতাম। এ বই সে ভুল ভেঙ্গে দিল। হাজারে হাজারে ডাটা লোকে কপচাচ্ছে। মানুষ নিজেদের কথায় এত উচ্চমার্গের আলোচনা করে জানতাম না। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর হয় যোজনগন্ধার জ্বর আসছে, নয় পুলিশে তাড়া করছে, নয় কয়েকশো বছর আগে তুর্কিরা তেড়ে আসছে। পালাতে পালাতেও জ্ঞান বন্ধ হচ্ছে না..... নিজে বাঁচলে বাপের নাম জানতাম, এ দেখি আগে লেকচার দেয়, পরে পালায়। জংগলে পালাতে পালাতে একজন জিজ্ঞেস করে এটা কি প্রজাপতি? অন্যজন তাঁর বৈজ্ঞানিক নাম, জেনাস, স্পিসিস সহ গোটা মগজাস্ত্র (৩০০ শব্দে) নামিয়ে দিচ্ছে.... মহাভারত যার একটুও পড়া আছে তিনিই জানেন সত্যবতীর আসল নাম কালী, যিনি পরাশরের কৃপায় যোজনগন্ধা হন। এটা নিয়েও যা সাসপেন্স দেখলাম, তাতে সাস্পেন্সের উপর আমার ভক্তি চটে গেল। টুইস্ট এমন যা প্রথমেই বোঝা যায়। যাকে আপনার সবচেয়ে কম সন্দেহ হবে সেই আসল পালের গোদা.... এতো আগাথা ক্রিস্টি কবে লিখে গেছেন! তবুও বই ৪০০ পাতা অবধি টেনে নিতে হবে। লাগাও শরৎ দাস। তাঁর বই থেকে হুবহু প্যারা বাই প্যারা নেমে গেল। কাহিনি চলল তিব্বতে।

এটা থ্রিলার!!!! তাহলে স্টিফেন কিং, লি চাইল্ড, ব্যারি আন্সোয়ার্থ, একো -র লেখা যা যা এতদিন পড়লাম সেগুলো কি? তাহলে এই বই পড়বেন কেন? প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধধর্ম নিয়ে যদি আপনি আগে কিচ্ছু না পড়ে থাকেন, অথবা আকর গ্রন্থগুলো পড়ার ইচ্ছে বা সময় আপনার না থাকে তাহলে এই বই একেবারে মেড ইজি করে জলে গুলে, মধু মেড়ে খলে করে আপনাকে খাইয়ে দেবে, আর আপনিও আহা কি জানিলাম ভাবতে ভাবতে এটা ভুলে যাবেন যে তথ্যের চাপে উপন্যাস ত্রিস্রোতা ( মানে তিস্তা আর কি) র জলে ডুবে অনেক আগে মরে গেছে.....
Profile Image for Riju Ganguly.
Author 37 books1,863 followers
November 22, 2020
প্রীতম বসু'র নতুন উপন্যাস আসছে। হঠাৎ খেয়াল হল, পাঁচমুড়ো পড়ে স্রেফ প্লাবিত হওয়ার অনুভূতি নানা জায়গায় লিখলেও সেই ধারার দ্বিতীয় বইটিকে নিয়ে কিচ্ছু লিখিনি! অতঃপর এই বিলম্বিত রিভিউ।
আগেই লেখা যাক, থ্রিলার হিসেবে এই বই না পড়াই ভালো।
কেন? সেটাই লিখছি।
পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল'-এর মতো এতেও দু'টি সমান্তরাল ঘটনাক্রম তথা ন্যারেটিভ আছে। তার একটিতে যোজনগন্ধা তাঁর গবেষক বাবা, তথা তাঁর সারা জীবনের সাধনার ফলাফল খুঁজতে ও বুঝতে চাইছেন। অন্যদিকে তুর্কি আক্রমণের বাহ্যিক ও সামাজিক বিধিনিষেধের অভ্যন্তরীণ আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে বাঙালির ইতিহাস। ডি.এন.এ-র ডাবল হেলিক্সের মতো করে দুটো সুতো বারবার কাছে এসেছে, একে-অপরকে ছুঁয়েছে, আবার দূরে সরে গেছে। মুশকিল হল, এর একটা সুতো যত বলিষ্ঠ, বর্ণময় ও তেজোদৃপ্ত, অন্যটা ততই ধূসর ও আরোপিত।
ইতিহাসের অংশটা, বিশেষত তার বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন সম্ভাব্যতার প্রোজেকশন, অনন্য। এই অংশটির মাধ্যমে প্রীতম বসু আমাদের হারিয়ে যাওয়া, ভুলিয়ে দেওয়া ইতিহাসকে ফিরিয়ে এনেছেন। এ-জন্য তাঁকে বাঙালির গর্ব বলা হলে বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হবে না।
কিন্তু থ্রিলার অংশটা অসম্ভাব্যতার যাবতীয় রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে! এর শেষে সেই ইমোশনাল পাঞ্চটিও পাইনি যা ছিল পাঁচমুড়োর শেষে।
তাই আবারও বলব, থ্রিলার হিসেবে এটিকে দয়া করে পড়বেন না। হাস্যকর ভিলেইন, বিরক্তিকর প্রোটাগনিস্ট, গাঁজাখুরি খুনখারাপি— এগুলো স্রেফ টপকে যাবেন। তাহলেই দেখবেন, কালসমুদ্রের কল্লোলে বাহিত হয়ে আপনার কাছে ভেসে আসছে ইতিহাস!
ধর্ম, অর্থ, কাম এবং শেষে মোক্ষ— এই চার স্তম্ভ দিয়ে গড়া এ চৌথুপিতে ইতিহাসের সাক্ষী হোন।
Profile Image for Shotabdi.
818 reviews194 followers
September 22, 2020
থ্রিলারে থ্রিল না থাকলে সেটা থ্রিলার নাম দিলে চলে না। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা তাও নজর কেড়েছিল। কিন্তু ৪৪৩ পৃষ্ঠা টানার কোন দরকার ছিল না বইটা।
মেলোড্রামায় ভরা, ইতিহাসের অনেক অনেক জ্ঞান। এমনিতে ইতিহাস আমার ভালো লাগে। তবে সবাই এত জ্ঞানী, ব্যাপারটা একটু অবাস্তব।
আর মেইন চরিত্র যোজনগন্ধা, যে কিনা ফাইনাল স্টেজ ক্যান্সারের রোগী, সে এত বড় একটা অ্যাডভেঞ্চার কোন ঔষধ ঠিকমত খাওয়া ছাড়াই করে ফেলল!
হাফি হাবিলদার তাও ভালো আছে। ভিলেনগুলো চরম পানসে। একই সাথে তুর্কি আক্রমণ আর বৌদ্ধদের ইতিহাস নিয়ে এগিয়েছে কাহিনী। পাঁচমুড়োটাতেও অনেক ইতিহাস ছিল, কিন্তু সেগুলোতে থ্রিল ছিল আর গল্পের কলেবর ছোট হওয়ায় জমে গেছে। এটাকে মনে হয়েছে অযথা টেনে লম্বা করা।
Profile Image for Farhan.
725 reviews12 followers
May 24, 2020
বইটার নাম হতে পারতো 'সহজ ভাষায় বৌদ্ধপাঠ' কিংবা 'বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের অবসান'। কারণ সব মিলিয়ে এটা থ্রিলার হয়নি, হয়েছে লেকচার বুক। আর প্রটাগনিস্টের নাম যোজনগন্ধা না হয়ে হওয়া উচিত ছিল যোজনবক্তা, কারণ শয়নে-স্বপনে-জাগরণে-পলায়নে-জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে তিনি শুধু যোজন যোজন দৈর্ঘ্যের লেকচার ঝাড়েন, ঝাড়তেই থাকেন। মাস্টারমশাই বা দিদিমণিদের এট্টু লেকচার দেয়ার প্রবণতা থাকে সেটা সত্যি, কিন্তু এমন নন-স্টপ চ্যাটার বক্স ভূ-ভারতে আছে বলে মনে হয় না। ইদানিং বেশ কিছু ঐতিহাসিক থ্রিলার টাইপের বই পড়ছি (যেমন 'বিন্দুবিসর্গ' বা 'চন্দ্রহাস') যাদের প্রত্যেকটির লেখকের একই সমস্যা; তারা কতটা পড়াশোনা করেছেন বিষয়টার উপর সেটাই পাঠককে দেখাতে ব্যস্ত থাকেন, ফলে গল্পটা আর বলা হয়ে ওঠেনা। এই বইখানাও তাই। তাও ভাল যে, ২৫০ পৃষ্ঠা লেকচারের বন্যা বইয়ে তারপর তিনি কিছু গল্প বলেছেন। এরপরেও লেকচার আছে, তবে শুরুর মত মুষলধারে নয়, ইলশেগুঁড়ি। এন্ডিংয়ে কিছু জোর করা টুইস্ট আছে, কিছু অবিশ্বাস্য একশন আছে, তারপরও এন্ডিংটাই ভাল লেগেছে। সেজন্য ২ দিলাম, নয়তো উপন্যাসের নাম দিয়ে বাংলা পরীক্ষার পাঞ্জেরী গাইডবই পড়ানোর জন্য ১ দিতাম।
Profile Image for Saima  Taher  Shovon.
521 reviews190 followers
April 4, 2023
এই বই আমি সকাল ৮টা থেকে শুরু করে বিকেল ৫টায় শেষ করেছি। এ থেকেই বুঝে নাও কতো আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
Profile Image for Akash Saha.
156 reviews26 followers
October 13, 2025
"আজ গন্ধকালী আগুনপাখি হলো! "

প্রীতম বসুর "চৌথুপীর চর্যাপদ" থ্রিলার হিসেবে কতটুকু সফল, তা যথেষ্ট যুক্তিতর্ক সাপেক্ষ হলেও, ইতিহাসের জানালা দিয়ে দেখলে যথেষ্ট কৌতুহল জাগানিয়া। গন্ধকালীর উপাখ্যান কতটা সত্য, কতটা কল্পনা আশ্রয় করে লেখা- তার বিচার করতে আরও ঘাটাঘাটি করতে হবে ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু লেখক নতুন একটা বিষয়ে আগ্রহের দ্বার খুলে দিয়েছেন- তাই বা কম কি? উপন্যাসের অতীতের অংশটি বেশি ভালো লেগেছে, বর্তমানের যোজনগন্ধার গল্পের প্লট যথেষ্ট দূর্বল। গন্ধকালীর উপাখ্যানের জন্যই উপন্যাসটিকে পঁাচে সাড়ে চার দেয়া যেতে পারে। লেখকের অন্য বইগুলো পড়ে দেখার ইচ্ছা রইল অদূর ভবিষ্যতে।
Profile Image for Little Blezz.
70 reviews21 followers
February 7, 2018
রিভিউ লেখার ক্ষেত্রে নিন্দুক বলে আমার কিছু বদনাম আছে। বাঙালি হিসেবে কারো ব্যাপারে ভালো কিছু বলতে পারিনা এই বাহানায় লোকজন সুযোগ পেলেই এক হাত নিয়ে নেয়। যত বলি, আমি রিভিউ দিই না, যেটা দি সেটাকে প্রতিক্রিয়া বলে। সেই যে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে ছোটবেলায় নিউটন সাহেবের তৃতীয় সূত্র পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল না? সেই প্রতিক্রিয়া। একটা লেখা পড়লাম। ফলতঃ কেঁপে গেলাম কি ভাবসমাধিতে চলে গেলাম কি বমন ক্রিয়া করতে দৌড় দিলাম, এই টুকুই ধরা থাকে আমার লেখায়। কিন্তু বাঙালির তাও সহ্য হয় না। বাথরুমে হার্পিক দিলাম না পতঞ্জলি, স্কচ-ব্রাইট এ ঘোসলাম না মুড়োঝাঁটায় এটা নিয়েও কৈফিয়ৎ চায়। সবেতেই নাকি 'কাঠি' খুঁজে পায় তারা। যাই হোক, এখানে ফ্রাস্ট্রেশন নাই বা ঝাড়লাম। ডাইরেক্ট বক্তব্যে ঢুকি। এরপরেও যদি কি লিখলাম পড়ে দেখতে চায়, বস নিজের দায়িত্বে... কাউকে মাথার দিব্যি দিই নি আমার প্রতিক্রিয়া নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে; একান্তই ইসে পেলে নিজের বাথরুমে যেতে পারো।

আমাদের ঘন্টারাম লেখকের ধ্বজাধারী; প্রথম বইটি পড়ানোর সময় বিশাল লম্বা-চওড়া বাক্যি খসিয়েছিল। মিথ্যে বলবো না, পড়ে ভালোই লেগেছিল। কিন্তু আজকাল ওটার ওপর খুব একটা ভরসা নেই। পাতি কারন, যে হেরুক পড়ে রাতে বাথরুমে যেতে ভয় পায়... তাকে আর যাই হোক ভরসা করা যায় না। কিন্তু লেখকের 'পরে কিছুটা ভরসা আছে। তাই নির্দ্বিধায় ওর থেকে বইটা এনেই পড়া শুরু করে দিলাম। এক্ষেত্রে পাঠকের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, আমি ঐতিহাসিক উপন্যাস হাতে পেলেই কিরকম একটা যেন হয়ে যাই; নিজেকে জাতিস্মর গোছের কিছু একটা লাগে, যেন আমিও (থাউক বাছা, অন্যের মগজে ঢোকার চেষ্টা ক'রে না)... ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে সঙ্গে সঙ্গে পড়ি না পড়ি, আগে জমিয়ে রেখে দি। প্রীতম বাবুর ভাগ্য ভালো, বইটি গুপি করেই পড়তে বসে যাই কারন পাঁচমুড়ো পড়ার পর ওনার লেখার ওপর অনেকটা বিশ্বাস জন্মে গেছে; আর যাই হোক ভদ্রলোক রিসার্চ করে তারপর লেখেন, বাকী অনেক ভুঁইফোর অথচ নামি-দামি লেখক-লেখিকার থেকে সহস্রগুণে ভালো। আর এবারের বিষয়টাই এত প্রিয়, ফেলে রাখার প্রশ্নই ওঠেনি।

আজকাল অতীত ও বর্তমানকে সমান্তরাল ভাবে নিয়ে গল্প বলার হিড়িক একটু বেশীই চোখে পড়ে। সেই কোন কালে উমবার্তো একো একটা ঘড়ানা চালু করে গেছেন, এদ্দিনবাদে এদেশে সেই প্রথা চালু হয়েছে। লাভবান আমার মত পাঠক অবশ্যই। যাই হোক, এই বই একই খাতে বয়ে চলেছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বইটা পরীক্ষার পর পরই মধ্যাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে কুলুঙ্গিতে তুলে রেখেছিলাম, তাকে আজ বড় মনে পড়ছে। চর্যা (এবং তৎপরবর্তী বাংলাভাষার সৌন্দর্য) যে কি, কখনো মনে হয়নি ফিরে দেখি; লেখক ভদ্রলোক এই উপকারটাও করে দিলেন আমার। বাঙালীর ইতিহাসকে আরও একবার ঘুড়ে দেখে এলাম বইটিকে সঙ্গে করে। বইয়ের গল্পটা কি এই নিয়ে কিছু পাঠক ছোট-বড়-মাঝারি বেশ কিছু রিভিউ দিয়েছে দেখেছি। সেগুলো পড়তে চাইলে ফেসবুকের সার্চ অপশনে বইয়ের নাম লিখে সার্চ দিলেই হবে। যারা সেটুকু কষ্টও করতে চাইবে না তাদের জন্য নীচে কিছুটা ঝেপে দেওয়া গেল...

[দুটো কাহিনী সমান্তরালে চলে ; একটা ২০১৬ সালে , অন্যটা সেন আমলের অব্যবহিত পরেই তুর্কী আগ্রাসনের । আর একটি কাহিনি তৈরী হয় তিব্বতে , মিশে যায় দ্বিতীয় কাহিনীটিতে , একে উপকাহিনী বলাই ভাল ।
প্রথম কাহিনীর নায়িকা , প্রত্নতত্ববিদ যোজনগন্ধা , দ্বিতীয়টির গন্ধকালী (মহাভারতে এই গন্ধকালী আবার যোজনগন্ধা নামে অভিহিতা) ।
প্রথমজন এক মূর্তির ছবি আর তার পিছনে সিদ্ধম বা সিদ্ধমাত্রিকা লিপিতে লেখা একটি কবিতা পড়ে উত্তেজিতা । চিন্তায় বারবার আভাস দিয়ে যায় এই মূর্তি .... কোথায়? কোথায় দেখেছে সে । কবিতাটা বাড়িয়ে দেয় আড্রিনালিনের ক্ষরণ.... চর্যাপদ । তার হারিয়ে যাওয়া প্রত্নতাত্বিক বাবা আর চৌথুপী.....তারপর চলে আসা চৌথুপীর সংগ্রহশালায় । একে একে উপস্থিত হতে থাকে অন্যান্য পার্শ্বচরিত্রেরা .... নলিনী রক্ষিত , হাবিলদার হাফিজুর , থানার বড়বাবু , স্থানীয় সাংবাদিক বনমালী সাহা , পাল- সেন যুগের মূর্তি । চলে আসে পাহাড়ের মাফিয়া ডন ছেত্রী । রক্ষিতের কাছে যোজনগন্ধা দেখে গন্ধকালী ডাকিনীর লেখা গুহ্যচর্যা পুঁথি । যার খোঁজে বাবা নিখোঁজ । ঘটনা এগিয়ে চলে । একটা আধুনিক কিশোরপাঠ্য ক্রাইম থ্রিলারের সব উপাদান আছে । অপহরন, ড্রাগ, গোলাগুলি , মাঝে মাঝে হাফি হাবিলদারের কমিক রিলিফ । এসে পরে লামা চোগিয়াল । অত্যন্ত খাজা সিনেমার ঢঙে সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ড্রাগ পাচার। এরপর আর বলবনা .... বই পড়ে দেখবেন ।
দ্বিতীয় কাহিনীর নায়িকা গন্ধকালী । কালের খেলায় সেই হয়ে ওঠে ভিক্ষুণী সঞ্জীবনী । এখান পার্শ্বচরিত্ররা কেউ তার বাবা চন্দন , কেউ প্রথম গুরু শ্রীধর , কেউ দিবাকর , কেউ শান্তভদ্র । তার সময়কাল বাংলার ইতিহাসের এক জটিল পর্যায় ... তুর্কী আক্রমনকাল । এক নগণ্য গ্রামবালিকা থেকে চৌথুপী মহাবিহারের জ্যোতির্বিদ্যা ও মানমন্দিরের সেরা অধ্যাপিকা , আদতে মহাবিহারের সেরা অধ্যাপিকা ।
উপকাহিনীর নায়ক খাম��বা রাজ্যের রাজপুত্র খু-স্তোন । তিব্বত থেকে ভারতে আসা চিকিৎসার কারনে , কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় জড়িয়ে পরে মহাবিহারের এক সংকটমুহূর্তে ।
দ্বিতীয় কাহিনি আর তার উপকাহিনিও বেশ উপভোগ্য । তরতর করে এগিয়ে চলে , কিছু সময়ে বোঝা যায় পরেরটা কি হতে পারে , কিন্তু ভাল ।
......সংগৃহীত]

কিন্তু মোক্ষম প্রশ্নটা এরপর আসে, আমি কি পেলাম! আগেই বলেছি, এই লেখা শুধু প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্যই লেখা। অনেকা��শে গাঁজাখুরি থ্রিলারটুকু বাদ দিলে তথ্যগতভাবেও এ বই সাধারন পাঠকদের জন্য যথেষ্ট রসদ মজুত করে রেখেছে। প্রধানতঃ বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস যাতে তৎকালীন ধর্ম, আচার, সমাজ, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বেশ সুন্দর পরিবেশিত হয়েছে। অন্ধের মত ভালো বলতে পারছি না। হাজার হোক হাবিলদারের কাছে নিজের গাড়ি বা রিভলভার থাকে না। ক্যান্সারের রোগী জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে পাহাড়ের বুকে ওভাবে টিকে থাকতে পারে না, যার কিনা ১৫ দিনের মাথায় অপারেশন না করাতে পারলে বাঁচার সম্ভাবনাই নেই। ভিলেনরা যতটা না দুর্ধর্ষ, তার চেয়ে বেশী মজাদার। লামারাও কি লাল চীবর পড়ে একটা মেয়ের হাত মুঠোয় ধরে জনসমক্ষে বসে প্রতিযোগীতা দেখতে পারে? আমার ধারণা নেই। মহাভারতের যুদ্ধের সময়কাল নিয়ে যে দুর্দান্ত জায়গাটা আছে, তার শেষটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার সাধ্যে কুলোয়নি। কিন্তু এ সমস্ত বাদ। এ'বই নিজের ইতিহাসের সন্ধানে মাথা কুটে মরে হাজার বছর ধরে জমে থাকা চৌথুপীর ঘোলা অন্ধকারে!
Profile Image for Kripasindhu  Joy.
543 reviews
April 28, 2025
প্রীতম বসু ভাল প্লট পেলেও সেটাকে কেন যেন কাজে লাগাতে পারেন না। এটা তার ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’-এর ক্ষেত্রেও দেখেছিলাম, এবারও পুনরাবৃত্তি ঘটলো।

প্লট যদি আকর্ষণীয় হয় আর লেখক যদি সেটার সঠিক ব্যবহার করতে না পারেন, তবে, খারাপ লাগে। এই উপন্যাস পড়তে গিয়ে এটা মনে হলো।

৪৪৩ পাতার এই বিশাল বইটিকে থ্রিলার বানাতে পারেননি। শুরুটা সুন্দর হলেও শেষ পর্যন্ত জোর করে তথ্য গেলানো ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
Profile Image for Jheelam Nodie.
314 reviews12 followers
April 14, 2022
অনেক তথ্যবহুল, অনেক অজানা জিনিস জানলাম। গন্ধকালীর গল্পটা যতটাই শক্তিশালি, ততটাই দূর্বল যোজনগন্ধার কাহিনি। সত্যি বলতে এক পর্যায়ে আমি বর্তমান টাইললাইন স্কিপ করে প্রাচীন অংশটাই পড়েছি। থ্রিলার না হয়ে শুধু ঐতিহাসিক উপন্যাস হলে ৫ তারা দেয়া যেত।
Profile Image for Arnab Pal.
51 reviews9 followers
April 19, 2018
কোড়ি দেখই সাপ বিস একু হেরে মণি॥

আমরা যারা থ্রিলার ভালোবাসি তারা যা পড়ি তার ম্যাক্সিমামই চিপ আর ফালতু। হাতে গোনা একটা কি দুটো মনে রাখার মত। বাংলায় সে জিনিষ কোটিতে এক। যেমন প্রীতম বসুর সেল্ফ পাবলিশড এই বই - চৌথুপীর চর্যাপদ (৪০০/-)। ধন্যবাদ এক গুপ্তারুন্ধতীকে।



চর্যাপদ এককালে আমাদের চড় যা খাইয়েছিল তা ভোলবার নয়। ইশ, কম নাকানিচোবানি খাইয়েছে ইস্কুলে? তবে এই গপ্পো আপনাদের নাকানিচোবানি খাওয়ার সুযোগ দেবেনা। অত বোঝবার আগেই আপনাকে অতলে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। সে এমনি এক জায়গা যেখানে আলো-আঁধারী ভরা অথচ উজ্জ্বল বাংলার গৌরবের দীপটি। পদে পদে বিস্ময়। মনে হতেই পারে সেখানেই থেকে যেতে। কিন্তু তাও থাকতে পারবেন না। এই ব-দ্বীপ থেকে টেনে আপনাকে এমন এক অভিযানে নিয়ে যাবে যেখানে আপনি কোনোদিনও যাননি। অন্তত নতুন বাংলা সাহিত্য যাবার সাহস দেখায়নি।

ইংরেজিতে গপ্পো লেখা সহজ, ব্যবসা করা আরও সহজ। বস্তাপচা ভূসি মাল (পড়ুন - চেতন ভগত, রভিন্দর সিং) হোক আর অসাধারণ রিসার্চ করে লেখা কালজয়ী উপন্যাস (পড়ুন - মাইকেল ক্রিকটন বা ড্যান ব্রাউন) হোক, খুব সহজিয়া পদ্ধতিতে বেস্টসেলার হয়ে লক্ষ্যভেদ করে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে আসে। কারণ ইংরেজিতে গপ্পো পড়ার লোক অনেক (পাইরেসি হলেও)। এই আমরাই তো আছি।

বাংলা বলতে কি লজ্জা। বাংলা বই? রামোঃ।
বাংলায় বই পড়া মানে, অনেক নিচে নামো॥
(হ্যাঁ, জানি, আমার মধ্যে একটা গুহ্য চারণকবিনেস আছে।)

এহেন প্রতিকূলতার মধ্যে লেখক যেভাবে প্রতি পাতায় খুব কুললি নিজের অসাধারণ রিসার্চ তুলে ধরে লতার মধ্যে জড়িয়ে দিয়েছেন, তার সুবাস পাহাড়-নদী পেরিয়ে বহু যোজন দূরে ছড়িয়ে পড়ুক। হীনজনে বুঝবে না, মহাজন সুদে আসলে বুঝে নেবে। ব্জ্রাঘাতের মত লাগবে এ অভিযান। লেখকের কার্যম সিদ্ধম। পঙ্কজ এক গোলাপি পদ্মের ন্যায় এরকম রত্ন যে লেখা সম্ভব, সেই সাহস দেখানোর জন্য ধন্যবাদ প্রীতমবাবুকে। প্রীত হলাম। আপনিও হবেন। আকাশগঙ্গার উজ্জ্বল তারা এটি। শুধু ৩টি অনুরোধ।
১ - বইটি কিনে পড়বেন। অর্থ এই পরিণত আগুনপাখিকে আবার ডানা মেলতে সাহায্য করবেই। তাছাড়াও কিছু বই থাকে যেগুলো কিনে রাখার মত। ছাপার কালির গন্ধে এ বই আরও তার শব্দকামরূপ বিকশিত করতে পারবে। বাঙালীর ইতিহাস যে কতটা সুবৃহৎ ও শ্রীধর তা বইটা না পড়লে বুঝবেন না।
২ - পড়া শেষ হলে লেখককে অবশ্যই অনুপ্রাণিত করবেন। দরকার আছে। 'ওনার' ওইসব মহাজাগতিক অনুপ্রেরণার থেকে আমাদেরটা অনেক বেশী দামী। লেখকের মনে আমাদের ভালোবাসার ভোট পড়া খুব দরকার যাতে এরকম রিসার্চ আরো করেন উনি। আমরা ব্রাউনের পিছনে ছুটব না। ব্রাউন তার পেছন ইয়োলো করে ফেলুক। আমরা বাঙালী। আমাদের ইতিহাস, আমাদের গৌরব সারা পৃথিবীতে অবলোকিত হোক।
৩ - বইটা পড়া শেষ করে আমার এই লেখাটা আর একবার পড়বেন, দয়া করে। কেন বলছি, তখন বুঝতে পারবেন।
Profile Image for Anik Chowdhury.
175 reviews36 followers
May 12, 2022
লেখক প্রীতম বসুর লেখা পড়ে উপভোগ করার কারণ উনার নিজের তৈরি আলাদা প্রাচীন কাল্পনিক জগৎটার জন্য। চৌথুপির চর্যাপদ বইয়েও লেখক সেই প্রাচীন এক খন্ড ভারতীয় উপমহাদেশকে তুলে এনেছেন সাথে করে নিজের সৃষ্ট সন্ধ্যাভাষায় তৈরি চর্যাগীতির সাথে। আমি নিজে পুরাণকে কেন্দ্র করে তৈরি উপন্যাস কিংবা বলা যায় এইরকম পৌরাণিক রহস্য উপন্যাস পড়ে মজা পাই কারণ পৌরাণিক বিষয়গুলো খুব পছন্দের। চৌথুপির চর্যাপদ বইটি দুইটি সময়কে কেন্দ্র করে এগিয়েছে, যার একটি হলো বর্তমান কাল আর অন্যটি সুদূর অতীত। আমার কেন যেন মনে হয়েছে লেখক অতীত সময়কে কেন্দ্র করে যেই কাহিনী উনি সৃষ্টি করেন সেটাকে খুব গুরুত্ব দেন কিন্তু বর্তমান সময়টাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেন না। যেন অতীতের গল্পের তরে বর্তমানের গল্পকে টেনে বৃথা লম্বা করা! অর্থাৎ লেখক অতীতকে বলার জন্য বর্তমানকে বৃদ্ধি করেছেন বলে মনে হলো।
তবুও চৌথুপির চর্যাপদ আমার খুব ভালো লেগেছে অতীত সময়ের জন্য। লেখকের জ্ঞানের গভীরতারও তারিফ করতে হয়। পাচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের মতো এটাও পছন্দের হয়ে রইলো।
Profile Image for Syeda Banu.
99 reviews52 followers
April 11, 2022
অইসনী চর্যা কুক্কুরী পাএ গাইল।

কোড়ি মার্ঝে একু হি অহি সমাইল ॥


বাংলার প্রাচীনতম ভাষায় রচিত সাহিত্য নিদর্শন চর্যাপদ। লেখা হয়েছিল সন্ধ্যা ভাষায়, এর প্রতি পঙক্তিতে সন্ধ্যার আলো আঁধারির রহস্য। চর্যাপদ নেপালের রাজপ্রাসাদের লাইব্রেরিতে খুঁজে পান হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। সেটা অবশ্য মূল চর্যাপদের নকল, আর পাতা কিছু ছেঁড়া। যে চর্যাপদটি পাওয়া গিয়েছিল সেটা মূলতঃ বৌদ্ধদের ধর্মসঙ্গীত। কিন্তু এর পদে পদে আছে অন্তর্নিহিত অর্থ, যেমন হরিনের উল্লেখ মানে চঞ্চল, তেঁতুল অর্থ চিত্ত। চর্যাপদের এই রহস্য বুঝতে পারে কোটিতে একজন। 


তেমনি একজন আর্কিওলজিস্ট যোজনগন্ধা। যে শুধু সন্ধ্যা ভাষার বিশেষজ্ঞই নয়, বৌদ��ধ তান্ত্রিকদের সাংকেতিক লিপি সিদ্ধম পড়তেও পারদর্শী। তার বাবা ডক্টর বুধাদিত্য চ্যাটার্জিও ছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ। চৌথুপীতে কাজের সময় প্রাণ হারান তিনি।


উত্তরবঙ্গের চৌথুপী বৌদ্ধ বিহারের বিখ্যাত নিদর্শন। সেখানে পাওয়া গেছে বুদ্ধের শিষ্য অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি। পাশে সিদ্ধম লিপিতে লেখা এক পদ --

গঅণ পদুমা রঅণ আঠাশ পাখুরী

দিবসই ন দিঠঠে অচ্ছই অন্ধারি।

নিসিঅ উদ্ধমেরুত ণিচল পেখই

পরিমানহ থাব গন্ধকালী ভণই।।


গন্ধকালী! যার অস্তিত্বের সত্যতা খুঁজে বেড়াচ্ছে যোজনগন্ধা জীবনভর। সেই টানে নিজের শরীরে বাস করা মারণব্যাধির ছোবল উপেক্ষা করে চৌথুপী ছুটে আসে যোজনগন্ধা। মিউজিয়ামের এ.এস নলিনী রক্ষিত তার হাতে তুলে দিল লাল শালুতে মোড়ানো সিদ্ধমে লেখা পুঁথি - 'গুহ্যচর্য্যা ~ গন্ধকালী জ্ঞান ডাকিনী'। পুঁথির পুরোপুরি পাঠোদ্ধারের আগেই যোজনগন্ধা আর তার নিরাপত্তায় থাকা হাফি হাবিলদার অপহৃত হয় 'মামাজী' নামের টেরোরিস্টের হাতে। সাথে যোগ দেয় ভেষজ বিদ্যা ও সিদ্ধম পঠনে পারঙ্গম তিব্বতি লামা লবসাঙ চ্যোগিয়্যাল। নেপালের পাহাড়ে বন্দি যোজনগন্ধা মিশে যেতে থাকে গন্ধকালীর জীবন বর্ণনায়।


কৈবর্ত কন্যা গন্ধকালী। বঙ্গের গ্রামগুলো তখন তুর্কীদের আক্রমণ ভয়ে কাঁপছে। বখতিয়ার খলজির নেতৃত্বে বৌদ্ধ মহাবিহারগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। জ্যোতিষ শাস্ত্রের মহাপন্ডিত, বিক্রমশীল মহাবিহারের প্রাক্তন শিক্ষক, শিলাদিত্য সঙ্ঘারামের অধ্যক্ষ শ্রীধর আচার্য প্রাণ বাঁচাতে এসে পৌঁছুলেন তাদের গ্রামে। আশ্চর্য স্মৃতিশক্তিধর ও বিদ্যানুরাগী গন্ধকালী হয়ে গেল আচার্যের প্রিয় শিষ্য। একসময় ভাগ্যের ফেরে পিতা ও গুরুকে হারিয়ে গন্ধকালী উপস্থিত হয় চৌথুপীর  বিহারে। চিকিৎসাশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যায় অসাধারণ জ্ঞানে ক্রমশ গন্ধকালী পরিচিতি পায় থেরি সঞ্জীবনী হিসেবে।


একই সময়ে তিব্বত থেকে ভারতে আসে রাজপুত্র খু-স্তোন। রাজা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত, গোটা তিব্বতেই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। কুষ্ঠের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিচ্ছে রাজপুত্রের শরীরেও। চিকিৎসার খোঁজে ভারতে বিক্রমশীল মহাবিহারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল খু-স্তোন। ভারতে পা দেওয়ার আগেই জানল সিংহাসন দখল করে নিয়েছে রাজার ভাই। চিকিৎসা ও শক্তি সঞ্চয় না করে তিব্বতে ফিরবে না - সংকল্প দৃঢ় হয় রাজকুমারের। 


২০১৬ সালে যোজনগন্ধা ও অতীতে ১২০৫ অব্দে গন্ধকালী - দুটি চরিত্রের গল্প সমান্তরাল বর্ণনায় এগিয়েছে উপন্যাসটি। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, থ্রিলার হিসেবে পড়লে পাঠকমাত্র হতাশ হবেন। এতে ইতিহাস আশ্রিত ফিকশনটাই বেশি, থ্রিলগুলো বরং খাপছাড়া ও অবাস্তব। বর্তমান যুগের অংশটি গল্পে অতটাই নিস্প্রভ, যতটা উজ্জ্বল গন্ধকালীর সময়কাল। বরং এভাবে দেখা যায়, গন্ধকালীর জীবনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যাখ্যা প্রয়োজন হলে লেখক যোজনগন্ধার বয়ানের আশ্রয় নিয়েছেন। সেটা আরো দক্ষতার সাথে করা সম্ভব ছিল মনে করি। 


থ্রিলারের মোড়কটি সরিয়ে রাখলে, বাংলা ভাষার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস, বৌদ্ধদের গৌরবময় সময়কালটা, পুঁথির ভাষার ব্যাখ্যা ও ইতিহাসের বিশ্লেষণ করার জন্য উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে একটি মনে রাখার মত কাজ। বাংলার চর্যাপদ কী করে নেপালে গেল; চর্যাপদের প্রতিটি পদ যেখানে দুটো অর্থবহন করে, সেখানে বৌদ্ধ পন্ডিতদের জ্ঞানের অসামান্য প্রতিফলন কীভাবে লুকিয়ে থাকতে পারে এর পাতায় পাতায় অথবা মহাভারতের যুদ্ধের সময়কাল - ইতিহাস ও কল্পনাকে মিলিয়ে বেশ কিছু থিওরি যুক্তিযুক্তভাবেই উপস্থাপন করেছেন লেখক। ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন সম্পদ আয়ুর্বেদও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এসেছে উপন্যাসে।


ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মের বিস্মৃত ইতিহাস ও তাদের পতন দুই-ই বিস্তারিত জানা যায় উপন্যাসে। চৌথুপীর বিহারটি কাল্পনিক হলেও, বিক্রমশীলা, সোমপুর, তক্ষশীলা, নালন্দার মত মহাবিহারগুলোর খ্যাতি সত্যিই ছড়িয়েছিল পৃথিবী জুড়ে। বৌদ্ধরা শিক্ষা ও বিদ্যায় যে উচ্চতায় উঠেছিল, তার অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় বৌদ্ধদের মধ্যকার বিভক্তি। মুসলমানরা যেমন ভাগ হয়েছে শিয়া ও সুন্নিতে, বৌদ্ধরা নিজেদের দূর্বল করেছিল হীনযানী ও মহাযানীদের দলাদলিতে। আর সেই কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মত হাজির হয় তুরস্ক থেকে বখতিয়ার খলজি ও তার সৈন্যদল। 


উপন্যাসে লেখক বৌদ্ধদের পতনের একক খলনায়ক হিসেবে মুসলিম তুর্কিদের উপস্থাপন করাটা কিছুটা আরোপিত অপবাদ বলেই মনে হল। তুর্কিদের হাতে বৌদ্ধ বিহারগুলো ধ্বংসের ভয়ংকর বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বাংলার ইতিহাস' পড়লে জানা যায়, প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বিহারের পাশে গড়ে উঠা মুসলিম জনপদ প্রমাণ করে তুর্কিদের তান্ডব। মিনহাজ ই সিরাজের 'তবকাত-ই-নাসিরী'তেও বখতিয়ার খলজির ওদন্তপুরী বৌদ্ধবিহার আক্রমণ, ব্রাহ্মণ ভেবে সকল ভিক্ষুদের হত্যা করার সত্যতা পাওয়া যায়।  কিন্তু খলজি যখন জানতে পারেন বিহারটি কোনো দূর্গ নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর অন্য কোনো বিহার আক্রমণের উল্লেখ সেখানে নেই। তাছাড়া তুর্কিরা বাংলায় আগমণের আগেই যে বৌদ্ধ জাতির অস্তিত্ব কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ বৌদ্ধদের দলে দলে ইসলাম গ্রহণের পেছনে, সেন বংশীয় রাজাদের হিন্দু পৃষ্ঠপোষকতা ও হিন্দু ব্রাহ্মণদের অত্যাচার প্রত্যক্ষ কারণ ছিল যা লেখক সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছেন। তুর্কিরা পথে ঘাটে নির্বিচারে বৌদ্ধদের হত্যা করছে, ইতিহাসে এর উল্লেখ কই? আর এই দাবি প্রমাণ করতে না পারলে খু-স্তোন ও গন্ধকালীর পালিয়ে বেড়ানোর পুরো প্লটটাই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। বখতিয়ার খলজিকে একপেশে হয়ে 'স্বৈরাচার' আখ্যা দেওয়াটাও কিছুটা ভ্রুকুটির জন্ম দিল। সুশাসক ও প্রজাদরদী হিসেবে যার সুনাম ছিল, তিনিই সৈন্যদের মৃত্যুর গ্লানিতে পর্যুদস্ত হয়ে যেতে পারেন।


উপন্যাসের বর্তমান অংশটিতে চরিত্রগুলো একেবারেই যাচ্ছেতাই। খল চরিত্রে মামাজী বা ছেত্রীকে অতি ড্রামাটিক মনে হয়েছে। হাফি হাবিলদার জোকারি করে পাঠকের মনোরঞ্জন করতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু জমেনি। যোজনগন্ধা প্রবল জ্বর নিয়েও ঘন্টার পর ঘন্টার পুরো গুহ্যচর্য্যাটি শুনিয়ে গেল সঙ্গীদের। চরিত্র হিসেবে সে একেবারেই খাপছাড়া। তবে গন্ধকালী ও যোজনগন্ধার মধ্যে লেখক যে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন তা চিত্তাকর্ষক। মহাভারতের সত্যবতীর দু'টি নাম থেকেই চরিত্র দু'টির নামকরণ করেছেন তিনি। একাধিক সূত্রের মাধ্যমে লেখক সরাসরি কবুল না করেও জানিয়েছেন গন্ধকালীই যোজনগন্ধা। গন্ধকালীর পূর্নজন্মকে যোজনগন্ধার আইডেন্টিটি ডিসওর্ডার যতই বলুক না বিজ্ঞান, অরুন্ধতী যে গন্ধকালীর প্রার্থনা শুনেছে তা নিশ্চিত। তাই কখনো খু-স্তোন বা কখনো চ্যোগিয়্যাল - গন্ধকালী তার তিব্বতি রাজপুত্রকে প্রতি জনমে পাশে পেয়েছে।



বই: চৌথুপীর চর্যাপদ 
লেখক: প্রীতম বসু
ভারতীয় মূল্য: ৪০০ রুপি
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৪৪২
Profile Image for পর্ব.
24 reviews14 followers
April 30, 2024
হুদাই বকবক করল ১০০/১৫০ পাতা
Profile Image for Dev D..
171 reviews26 followers
February 27, 2022
প্রীতম বসুর এ নিয়ে আমার পড়া দ্বিতীয় বই এটি। কি বলা যায় একে? থ্রিলারের মোড়কে ইতিহাস? অনেকটা তাই। সেন রাজাদের আমলে তুর্কী বাহিনীর আক্রমণের সময়টা নিয়ে এর আগে পড়েছিলাম শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন। এই বইয়ে সেন আমল, পাল আমল, তৎকালীন তান্ত্রিক বৌদ্ধমত এসব নিয়ে বিস্তর তথ্য আছে, আছে সেই সময়ের তিব্বত ও বাংলা ও মগধকে দেখার চেষ্টাও। আর চর্যাপদকে নিয়ে বিস্তর তথ্যও তো আছেই। চৌথুপী নামে সত্যিকারের কোন বৌদ্ধ বিহার ছিল কিনা জানিনা, ত্রিথুপী নামে একটি বিহার বোধহয় ছিল পড়েছিলাম।

দুটো টাইমলাইনে লেখা এই বইয়ের মূল দুটো চরিত্র যোজনগন্ধা ও গন্ধকালী কি জন্মান্তরের একই মানুষ কিনা তার আভাস দিয়ে দিয়েও লেখক নিশ্চিত করেন নি। অন্য চরিত্রগুলোও এসেছে প্রয়োজনে এবং অনেকটা ব��যালেন্স করতে গিয়েও সময়ে সময়ে। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, সহজযান বা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস বিশেষত বঙ্গভূমিতে জানার জন্য এই বই ইতিহাস পাঠের কাজ করতে পারে যাদের একেবারেই ধারণা নেই। এমনকি মহাভারত, খনা এমন অনেক কিছু সম্পর্কে লেখক তার বইয়ে বিস্তর তথ্যও দিয়েছেন। তবে থ্রিলার হিসেবে বিবেচনা করলে এটা বোধহয় দারুণ কিছু নয়। তবে বইটি আকর্ষণ ধরে রাখে, শেষ না করে ছাড়া যায় নি এটাও সত্যি। নারীকেন্দ্রিক এই উপন্যাসটি প্রীতম বসুর বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি যেমন প্রকাশ করে তেমনি তার আরও বই পড়ার আগ্রহও তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে দুর্দান্ত না হলেও ফেলে দেবার মতো অবশ্যই নয়। বেশ ভালোই লেগেছে মোটের উপর এটুকু বলাই যায়।
Profile Image for Swatilekha Bhattacharya.
1 review3 followers
February 18, 2024
চর্যাপদ কথাটা শুনলেই মন ও মাথা কেমন অসাড় হয়ে পড়ে।কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন একেবারেই সুখপাঠ্য ছিলনা এই আলো-আঁধারি ভাষায় লেখা গানগুলি..(আমার ক্ষেত্রে 'अंधेरा' পুরোমাত্রায় कायम ছিল।)
তো যাই হোক,এসব বহু প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে পড়া শুরু করলাম প্রীতম বসুর " চৌথুপীর চর্যাপদ"।
উপন্যাসে অতীত ও বর্তমানের দুটি কাহিনী সমান্তরালে চলতে থাকে- একটি কাহিনী, আর্কিওলজিস্ট যোজনগন্ধার;অপরটি বৌদ্ধ থেরী গন্ধকালী ওরফে সঞ্জীবনীর।
উপন্যাসের কাহিনী বলা আমার উদ্দেশ্য নয়,শুধুমাত্র বইটি পড়ে আমার কী মনে হয়েছে;তা-ই তুলে ধরতে চাই।
প্রথমেই বলে রাখি লেখক নিছকই খাতা-কলম নিয়ে লিখতে বসে পড়েননি;উপন্যাসের প্লট নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিস্তর পড়াশুনো করেছেন-বইয়ের শেষের দু'পাতার গ্রন্থপঞ্জী তার প্রমাণ দেয়।তাঁর এই গবেষণার একটা ভালো দিক ও আরেকটা খারাপ দিক আছে।
ভালো দিকটি হল,খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত এই চর্যাগানগুলি বাংলায় ত্রয়োদশ শতাব্দীর তুর্কি আক্রমনের যে অস্থির সামাজিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রক্ষিত হয়েছে ..গন্ধকালী,খু স্তোন,তোন পা,শান্ত ভদ্র প্রমুখেরা নিজেদের প্রাণ বিপণ্ণ করে কীভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আঁতুড়ঘরকে রক্ষা করেছিলেন -তারই সাক্ষ্যবহন করে এই উপন্যাস।বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ধর্মাচরণ-হীনযান,মহাযান,বজ্র্যযান ও সহজযানের মধ্যেকার মৌলিক পার্থক্য,পারস্পরিক বিভেদ - কাহিনীর খাঁজে খাঁজে উঠে আসে। অবলোকিতেশ্বর,ষড়ক্ষরী,তারা,মঞ্জুশ্রী,মরীচী প্রভৃতি বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবদেবীদের বিষয়ে জ্ঞাত হই।গন্ধকালীর জীবন সংগ্রামের আলেখ্যে উঠে আসে বর্ণপ্রথা,জাতিবৈষম্য,তুরস্ক বাহিনীর পাশবিক অত্যাচার,বৌদ্ধ বিহার-মঠ-মন্দির ধ্বংসের হিংস্র করাল রূপ এবং ইসলাম ধর্মান্তরকরণের নির্মম প্রয়াস।
উপন্যাসে চরিত্রদের কথোপকথনে উঠে এসেছে বাঙালি জাতির পদবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।যেমন:-
বন্দ্যঘটি গ্রাম থেকে বন্দোপাধ্যায়
গাঙ্গুল ,, গাঙ্গুলী
বড়া ,, বড়াল বা বটব্যাল
মুখটি। ,, মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি।
ভারতের প্রাচীন জ্যোর্তিবিদ্যা ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং বর্তমান বাজারে এই সকল বনৌষধি(কীরা জরি,সর্পগন্ধা,ঘৃতগন্ধা প্রভৃতি) কতকখানি দুর্মূল্য তা লেখক কাহিনীর প্রেক্ষাপটে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।
আর এখানেই গল্পের গরু গাছে উঠেছে! লেখক এত বেশি ডিটেলিং -এ মন দিতে গিয়ে পরিমিতিবোধ হারিয়ে ফেলেছেন।আর এতেই বর্তমানে -চলা কাহিনীটি যাকে তিনি টান্ টান থ্রিলারের রূপ দিতে চেয়েছেন তা তথ্যের ভারে ও কিংকর্তব্যবিমুঢ় চরিত্রদের দিশাহীনতায় ঘেঁটে ঘ হয়েছে।উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র আর্কিওলজিস্ট যোজনগন্ধা ক্যানসারের অ্যাডভান্স স্টেজে থেকেও বিনা ওষুধে শুধুমাত্র সার্ভাইভ করেনা ..যে রকমের স্টান্ট দেখায় তাতে আমি অন্তত স্টান্ট হয়ে গেছি! মামাজী,ছেত্রী ..এইসব ভিলেন চরিত্রগুলিও অত্যন্ত মোটাদাগের এবং এদের কার্যকলাপ হিন্দি সিনেমার ভিলেনদের থেকেও উদ্ভটতর।কেবলমাত্র হাবিলদার হাফিজুর চরিত্রটি যেন মরুভূমিতে ওয়েসিস- বিশুদ্ধ কমিক রিলিফ!
লেখক যোজনগন্ধা ও গন্ধকালী চরিত্রদুটিকে এক সুতোয় গাঁথতে গিয়েই গিঁটটা পাকিয়েছেন!গন্ধকালী যেন যোজনগন্ধার অল্টার ইগো। গন্ধকালী যেমন তোন পা,খু স্তোন,শান্তভদ্রের সাহায্যে তুরস্কবাহিনীর হাত থেকে দুষ্প্রাপ্য পুঁথিগুলি উদ্ধার করেন, ঠিকয যেন তেমনি যোজনগন্ধাও হাফি হাবিলদার,লামা লবসাং ,বিমলাদের সাহায্যে গন্ধকালীর পুঁথি ও অবলোকিতেশ্বরের মূর্তিটি অজাতশত্রু ছেত্রী,নলিনী রক্ষিত,মামাজী দের হাত থেকে রক্ষা করেছে।আর এই সমকক্ষ করে তোলার প্রতিযোগীতাতেই লেখক যোজনগন্ধা চরিত্রটিকে কারণে-অকারণে বক্তৃতাদানকারী সুপার ওম্যান এ পর্যবসিত করেছে!
পরিশেষে একথা বলতে পারি,থ্রিলার হিসেবে উপন্যাসটি মুখ থুবড়ে পড়লেও তৎকালীন সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে জানতে এই গ্রন্থ বিশিষ্টতার দাবি রাখে।
Profile Image for Tahjiba Adrita.
103 reviews34 followers
November 23, 2022
ইতিহাসভিত্তিক থ্রিলার কে পুজি করে অতীত জ্ঞান-বিজ্ঞান,চিকিৎসার শাস্ত্র,জ্যোতির্বিদ্যার এক দ্বার উন্মোচন করেছেন লেখক।যা নিঃসন্দেহে আমাদের কে আমাদের শিকড় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে তোলে।গন্ধকালী খুব শক্তিশালী একটা চরিত্র,এমন চরিত্র অনুপ্রেরণা যোগায়।অরুন্ধতী গন্ধকালীর প্রার্থনা পূর্ণ করেছিল, প্রতি জন্মেই যেনো গন্ধকালী তার খু-স্তোন কে পাশে পায়।যোজনগন্ধ্যা আর হাফি হাবিলদার কি তাহলে এই জন্মের গন্ধকালী আর খু-স্তোন?

উপন্যাস জুড়ে পরতে পরতে ইতিহাস কে পেলেও থ্রিলিং বা এডভেঞ্চার কিছু পাইনি বললেই চলে শুধু শেষের টুইস্ট টুকু ছাড়া।অনেক জায়গা স্কিপ করে গিয়েছি অহেতুক, অপ্রয়োজণীয় মনে হয়েছে তাই।অনেক আশা নিয়ে পড়তে গেলে একটু নিরাশ হতে হবে।তবে ইতিহাসপ্রেমী হলে নিঃসন্দেহে বই টি সুপাঠ্য।
Profile Image for Farzana Raisa.
530 reviews237 followers
May 13, 2020
খুব সাদামাটাভাবে শুরু হওয়া সকালটা হুট করেই অন্যরকম হয়ে যায় যোজনগন্ধার। পত্রিকায় খবর আসে একটা মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাচীন ঐ বৌদ্ধ মূর্তির পাশে আবার পাওয়া গেছে একটা লাশ। অত্যন্ত নৃশংস এক ডন ছেত্রীর ছেলেই হলো ওই লাশটি। প্রাচীন ভাষা ও লিপি বিশেষজ্ঞ যোজনগন্ধা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সেখানে যাবার। ও হ্যা, বলা হয়নি, যোজনগন্ধা ক্যান্সারের সাথে লড়ছে, বেশ ক্রিটিক্যাল অবস্থাই বলা চলে। ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করার আগে ক'টা দিন ফাঁকা... সেই ফাঁকেই ভোঁ দৌড় সেই প্রাচীন বৌদ্ধমুর্তি অবলোকিতেশ্বরের গায়ে সিদ্ধম ভাষায় লেখাটির পাঠোদ্ধার করতে।
ভালোয় ভালোয় তা আর হবে কেন? আর যদি তা হতোই গল্প আর এগুবে কি করে? কাজেই লেখক প্রীতম বসু লেলিয়ে দিলেন নিষ্ঠুর ছেত্রীকে, চলে আসলো আরেক ভিলেন মামাজী। সংগে আছে প্রাচীন একটা পুঁথি, যেটার লেখিকা স্বয়ং জ্ঞানডাকিনী গন্ধকালী । এই গন্ধকালীকে খুঁজতে খুঁজতেই চৌথুপীতে প্রাণ দিয়েছিলেন যোজনগন্ধার বাবা। সেই গন্ধকালীর পুঁথিতে লুকিয়ে আছে সব প্রশ্নের উত্তর। অনিচ্ছাকৃতভাবে সঙ্গী হিসেবে হাফি হাবিলদারকে সাথে নিয়ে যোজনগন্ধার অদ্ভুত এক অ্যাডভেঞ্চার।

চৌথুপীর চর্যাপদ বই হিসেবে কতো ভালো সে প্রশ্নে না-ই বা গেলাম। স্টোরি ভালোই কি���্তু বইয়ের শুরুতেই প্রায় প্রতিটা চরিত্রের একটু বেশি 'জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা' করায় কিছুটা বিরক্ত লেগেছে। (আমার অবস্থা হয়েছিল কিছুটা ঐ হাফি হাবিলদারের মতো) খানিক বাদে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর অবশ্য খারাপ লাগেনি, ঐ 'জ্ঞানগুলো' যথেষ্ট আনন্দ নিয়ে পড়েছি তাই ভালো লেগেছে। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে জ্ঞানডাকিনী, বৌদ্ধ ভিক্ষুনী গন্ধকালীর চরিত্রটি। যাস্ট অ্যামেজিং!

মজার কথা হলো, সেই স্কুল-কলেজে থাকতে বাংলা বইয়ের যে অংশগুলো পড়তে অসম্ভব বিরক্ত লাগতো এই লেখকের বইগুলো পড়ে (পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল, চৌথুপীর চর্যাপদ) ঠিক সেই সব বিষয়গুলোকেই ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। প্রাচীন বাংলা, প্রাচীন বাংলা ভাষার লিপি, তখনকার বৌদ্ধতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, চর্যাপদ বা সে সব বিষয় ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রাচীন বাংলার লিপি, ভাষা, ইতিহাস এসব নিয়েও যে এত সুন্দর সুন্দর বই লিখে ফেলা যায় সেটা ভেবেই মুগ্ধ ছিলাম বেশ খানিক্ষণ। ইদানিং এমনিতেই গৌতম বুদ্ধ, বৌদ্ধ ধর্ম-এসবের উপর খুঁজে খুঁজে বই পড়ছিলাম এখন সাথে যুক্ত হয়েছে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস। লেখকের উদ্দেশ্য বোধহয় সার্থক :v

বই-চৌথুপীর চর্যাপদ
লেখক-প্রীতম বসু


#Happy_reading
#বই_হোক_অক্সিজেন
18 reviews1 follower
July 29, 2021
গ্রন্থ – চৌথুপীর চর্যাপদ
লেখক – প্রীতম বসু
প্রকাশক – প্রীতম বসু
মুদ্রিত মূল্য- ৪০০



গ্রন্থারম্ভেই লেখকের নিবেদনে ছিলো যে - গ্রন্থের সকল ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক তার পরেও প্রতিটা ঘটনা প্রতিটা চরিত্র এতটাই জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে লেখকের কলমে যে বিশ্বাস করতেই পারছি না এগুলি কেবলই লেখকের কল্পনাপ্রসূত। গ্রন্থটিকে কোন পর্যায়ে রাখা যায় এই নিয়ে বেশ দ্বন্দ্বে আছি। একাধারে ঐতিহাসিক সময়পটে লেখা, দ্বিতীয়ত বর্তমান সময়ের সাথে জড়িত, তৃতীয়ত রহস্যের গন্ধ সব মিলিয়ে বলা যায় ঐতিহাসিক রহস্য উপন্যাস বলা চলে কিনা সেটা পাঠকের ওপরই ছেড়ে দেওয়া ভালো। অনেকে এটাকে থ্রিলার উপন্যাসও বলেছেন, তবে থ্রিলারের নামে যা আছে এখানে তাতে আর যাই হোক থ্রিলার বলা চলে না।
এবারে প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে আছে কি এই বইয়ে-
এর উত্তর বেশ দীর্ঘায়িত হতে পারে। আমি থ্রিলার হিসাবে এটাকে দেখছিই না, আমি যেভাবে দেখেছি সেগুলিই বলব-
১. বাংলার বুকে দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতকের একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক।
২. বাংলার বুকে বৌদ্ধধর্মের বিপুল প্রভাব সবিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে প্রতি পত্রে পত্রে।
৩. বৌদ্ধধর্মের সামান্য পরিচায়ক হয়ে উঠতেই পারে এই গ্রন্থ।
৪. বৌদ্ধধর্ম নিয়ে উত্সুকতা জন্মাতে বাধ্য করবে এই গ্রন্থ।
৫. বৌদ্ধধর্মে হীনযান মহাযান সহজযান বজ্রযান এসব সংক্রান্ত সামান্য পরিচয় নিয়ে ফিরতে পারেন এই গ্রন্থ থেকে।
৬. বৌদ্ধ দেবদেবীদের নিয়ে বিস্তারিত তথ্যে ডুবে যাবেন এখানে।

এখানেই যত সমস্যা আরে পড়ছি তো গল্পের বই, সেখানে এই জ্ঞানের কপচাকপচি কাহাতক মেন নেওয়া যায়। তাই আমার মনে হয়েছে এই বই সবার জন্য না। এ বই তাদের জন্য যারা গল্পের ছলে ইতিহাসকে জানার চেষ্টা করে তাদের জন্য। সববিষয়ে জ্ঞানের কপচাকপচি বই জুড়ে পাওয়া যাবে একথা শতাংশ সত্য তার পরেও এ বই ভীষণ সুখপাঠ্য। বাংলার তত্কালীন পরিস্থিতি বর্ণনায় এ গ্রন্থ অতুলনীয়।

মূলস্রোতে ফিরি এবারে, গল্পের বিষয়বস্তু নিয়েও দুচার কথা বলি- গ্রন্থের নামেই বোঝা যাচ্ছে চর্যাপদ নিয়ে কিছু একটা কেস হবে। তা এই চর্যাপদ কী জিনিস। আমাদের জ্ঞান যতদূর তাতে বলতে পারি ঐ তো নেপালের লাইব্রেরী নাকি কোন রাজার গোয়ালঘর থেকে ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এক পুঁথি উদ্ধার করেন তাই নাকি চর্যাপদ, আরও যদি কারও মনে থাকে সে বড়জোর বলতে পারে যে এই চর্যাপদই নাকি আধুনিক বাংলার প্রাচীন নিদর্শন। এবারেই প্রশ্ন আসে আচ্ছা যদি প্রাচীন বাংলার নিদর্শনই হয়ে থাকে তাহলে বাংলার কোথাও এ পুঁথি না পাওয়া গিয়ে সুদূর নেপালে কীভাবে পাওয়া গেল। আরে সত্যিই তো নেহাত বাংলায় না পাওয়া গেলেও ভারতের কোথাও তো পাওয়া উচিত ছিলো, তা না একেবারে নেপালে গিয়ে বসে আছে। ব্যাপারটা কী। এখানেই এই গ্রন্থ আপনার সংশয় মেটাতে সক্ষম হবে। বাংলায় পালরাজাদের বদন্যতায় বৌদ্ধধর্মের বেশ ভালোই রমরমা, ইতি উতি গজিয়ে উঠছে বৌদ্ধবিহার, স্তুূপ, সংঘারাম পঠনপাঠন ক্ষেত্র। বাংলায় এরকমই এক স্তুপ ছিলো চৌথুপীতে। চার স্তূপ থেকেই চৌথুপী নামকরণ। দ্বাদশ শতকের দিকে এই চৌথুপী নালন্দা বা বিক্রমশীল মহাবিহারের থেকে কোনও অংশে কম ছিলো না। ঠিক এরকমই একটা সময়ে এই সংঘারামে ঘনিয়ে এলো বিপদের ঝঞ্ঝাবাত। বাংলায় ঘটলো তুর্কি আক্রমণ। তুর্কিদের প্রবল পরাক্রমে একে একে রাজ্যের সূর্য তখন অস্তগামী। তুর্কিরা ছিল অন্য আর পাঁচটা আক্রমণকারীদের থেকে আলাদা গোত্রের। এরা কেবলই ধনসম্পদ লুঠ করে ক্ষান্ত ছিলো না। এদের নজরে এসেছিল ধর্ম ও সংস্কৃতি। যথা সাধ্য চেষ্টা করে বলপূর্বক মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল সেই সময়ে। বাংলায় তখন আরোই অরাজকতা, ন ছিলো কোনও বড়ো সাম্রাজ্য না ছিলো তুর্কিদের প্রতিহত করার মতো কোনও শাসক, বাংলা শয়ে শয়ে সামন্ত জমিদারদের মধ্যে বিভক্ত, কোনও একতা নেই যার ফলে আরোও সুবিধাই হলো তুর্কিদের বিনা প্রতিরোধে একের পর এক মন্দির বৌদ্ধবিহার, সংঘারাম ধ্বংস করতে করতে বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে। যদি লক্ষ্য করেন দেখবেন এই তুর্কি আক্রমণের সময়কালের কোনও সাহিত্যিক নিদর্শন কিন্তু আজও পাওয়া যায় না। এতটাই নৃসংশতার সাথে চলেছিল এই ধ্বংসলীলা। এরপর এই ঝঞ্ঝাবাত যখন চৌথুপীতে আছড়ে পড়ল তখন সেখানে রয়েছে হাজার হাজার প্রাচীন পুঁথি। সেগুলোকে রক্ষা করার জন্য অবতারিত হলেন সংঘারামের প্রধান আচার্যরা ও নেপালের রাজকুমার, যিনি এসেছিলেন নিজের কুষ্ঠ রোগ সারাতে, কারণ তখন বৌদ্ধ আচার্যদের আয়ুর্বেদ পারদর্শিতা সর্বজনবিদিত। যাই হোক এই তুর্কি আক্রমণের মধ্যেও পুঁথিগুলির তিব্বত গমন বিস্তারিত বর্ণিত গ্রন্থে। এই সময়েই বাংলার প্রাচীন সম্পদ বাংলা ছেড়ে নেপাল তিব্বতের মতো দেশে পৌঁছে যায়। এই হচ্ছে গল্পের ঐতিহাসিক দিক। এর পরেও একটা অংশ রয়ে যায় থ্রিলার অংশ সেটা সামান্য বলে শেষ করতে চাই-
২০১৬ সালে যোজনগন্ধা নামের এক ভাষাবিশারদ মহিলার চোখে পড়ে এমনই একটা খবর, যার ফলে তিনি ক্যান্সারের পেশেন্ট হওয়া সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়েন উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে কালক্রমে হাতে আসে এক চর্যাপদরে প্রাচীন পুঁথি ও অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি। ঘটনাক্রমে জড়িয়ে পরে এন্টিক মূর্তির ডিলার ছেত্রী, তারপর যোজনগন্ধার কিডন্যাপিং, সেই অবস্থা থেকে ঘটনা নানান প্রবাহে বইতে থাকে। সেই চর্যাপদের গ্রন্থ থেকেই উঠে আসে দ্বাদশশতকের বাংলা। গ্রন্থে চর্যাপদের উল্লেখ বহুত্র করা হয়েছে, যারা এই নিয়ে আগ্রহী তাদের তো নিশ্চই ভালো লাগবে এই গ্রন্থ।

তাহলে কি শুধুই ভালো ভালো জিনিসিই আছে, তা কিন্তু মোটেই নয়,
গ্রন্থের থ্রিলার অংশটী বড়ই অযৌক্তিক। কোথাও যেন জোর করে থ্রিল আনার তাগিদ লক্ষ্য করছিলাম। তবে এর জন্য লেখকের কিছুই যায় আসে না, আমার মনে হয় উনি ইতিহাসটাকেই বলতে চেয়েছেন এবং সেক্ষেত্রে উনি রীতিমতো সফল, থ্রিলারটা কেবলই অতিরিক্ত সংযোজন আর কি। তাই থ্রিলার অংশ বাদ দিয়ে গল্পের ছলে ইতিহাস জানতে চাইলে এ গ্রন্থ অত্যন্ত উপাদেয় এটুকু নিশ্চিত।
সবটা গুছিয়ে বলতে পারলাম না, এবারে আপনিও পড়ুন, পড়ে নিজের মতো করে লিখে রাখুন কেমন লাগলো।
16 reviews3 followers
October 21, 2019
অসাধারণ একটা লেখা। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাস নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন এই ভদ্রলোক। প্রত্যেকটি চরিত্রের উত্থান লক্ষণীয়। শুধুমাত্র ইতিহাসই নয়, অনেকগুলো বিষয় গল্পের মধ্যে স্পর্শ করেছেন লেখক। প্রেম, বাৎসল্য, corruption, অসম বয়সী বন্ধুত্ব, অপহরণ, বিপথে চালিত কিশোর-কিশোরী ,- এরকম অনেক কিছু। কিন্তু গল্পের বাঁধনে কোনকিছুই খাপছাড়া লাগেনা। শুধু থ্রিলার বললে এই গল্পটাকে একপেশে করে দেয়া হবে। যাই হোক, আমার মনে হয় এরকম লেখা অনেকদিন পরে বাংলায় হয়েছে।
Profile Image for B. M.  Parvej  Rana.
20 reviews10 followers
Read
April 8, 2022
পৃথিবীতে যদি জাতির পরিচয়ে মানুষকে ভাগ করা হয় তবে সর্ব প্রথম আমরা বাঙালি জাতির কাতারে গিয়ে পড়বো। জাত, কাল, ভাদ্র মিলিয়ে পৃথিবীর ত্রিশ কোটি বাঙালি আমরা। যার আদি গোষ্ঠীর বাসস্থান থেকে শুরু করে আজ অব্দি এই এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে বসবাস। সেই কলিযুগের আগে থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালির পদচারণা রয়েছে পুরো পৃথিবী জুড়ে। তবু বাঙালির জন্মস্থান এই দক্ষিণ এশিয়ায়। তবে বাঙালির আদিকাল সম্পর্কে পৃথিবীর অন্য জাতি দূরে থাক খোদ বাঙালি কতটুকু জানে তা কি কখনো পরখ করেছি আমরা?
চার হাজার বছর পূর্বে বাংলাকে গঙ্গারিডি বলেই জানতো রোম, গ্রিকের সম্রাট তথা মানুষেরা। এরপর বৈদিক যুগ, গুপ্ত, মৌর্য ইত্যাদি সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে শাসন করে গেছে যার দরুন বাংলাতেও এদের শাসনের আধিপত্য বিস্তারের দাগ রয়ে গেছে পরতে পরতে। এরপরে আসে পাল বংশ। বইয়ের পাতা থেকে হোক অথবা বাঙলা ভাষা থেকে হোক পাল বংশকে ইতিহাসের শুরু থেকেই বহু বাঙালি চেনে। কিন্তু কেন চেনে? শুধু চারশো বছর অথবা বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শাসন করেছিল বলেই কি পালরা ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষর ছাড়াও মানুষের মনে গেঁথে আছে? না কি এর পেছনে রয়েছে আরও গূঢ় কিছু বাঙালিয়ানা?
প্রশ্নের সমাগম চলতে থাকলে চৌথুপীতে হয়তো আরেকটা সঙ্ঘরাম ধ্বংস হয়ে যাবে তবুও প্রশ্নের বান শেষ হবে না।

ধর্ম, মানুষের এক দুর্বল দিক৷ তাকে রক্ষা করার জন্য মানুষ নিজের জীবনও বলি দিতে পিছুপা হয় না। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করেও অনেক অপকর্ম হয়৷ কোনো ধর্মই এটা অস্বীকার করতে পারে না। সব গুচ্ছ বিষয় যখন এলোমেলো হয়ে আবার একগুচ্ছে পরিণত হয় তখন এলোমেলো করে দেওয়া মানবমনে এক দ্রোহের জন্ম নেয়। সে দ্রোহে হয়তো জ্বলে কলিযুগের কয়েকশো কোটি মানুষ।

গুরুগম্ভীর কথা আরও অনেক বলা যাবে। যে বই পড়ে শেষ করেছি তা দৈর্ঘ্যে ততটা বড়ো না হলেও ইতিহাসে এর বিস্তর প্রভাব রয়েছে বলেই মনে করি। সেই বুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমান আবার মহাভারত থেকে শুরু করে পাল বংশ এত এত টাইমলাইন থেকে উঠে আসা এই বইকে একখানা চর্যার গীতি বলে আখ্যা দিলে লোকে নাকচ করার সাহস রাখবে বলে মনে হয় না।
কী সেই চর্যা যা নিয়ে ১৯০৭ সালে তিব্বত থেকে আবিষ্কারের পর মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মতো জ্ঞানীগণ দীর্ঘ নয় বছর বিশ্লেষণ করে ১৯১৬ সালে তা বাংলার কবিতা বলে স্বীকৃতি দেন? যদি বাংলায়ই তা রচিত হলো তবে কেন নেপালের রাজদরবারে তার সন্ধান মিলল? এই সব সূত্র একজায়গায় এসে চৌথুপীর চর্যাপদ বইতে মিলিয়েছেন লেখক প্রীতম বসু।

সুবিন্যস্ত আলোচনা করার আগে আখ্যান থেকে ঘুরে আসি চলুন।

★ আখ্যানঃ

আর্কিওলজিস্ট যোজনগন্ধা চ্যাটার্জি খবরের কাগজে একটা খবর দেখে চমকে ওঠেন। চৌথুপীতে বৌদ্ধ ধর্মের সবথেকে বেশি পূজিত মূর্তি অবলোকিতেশ্বরের পাশে একটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে একটা খবর প্রকাশিত হয় পত্রিকায়। এবং তার পাশে সিদ্ধং লিপিতে লেখা আছে অবোধ্য এক ভাষা। কিন্তু আর্কিওলজিস্ট যোজনগন্ধার কাছে তা অবোধ্য রইলো না। তিনি সেই ভাষা ডিকোড করে বুঝতে পারলেন ইতিহাসের পাতায় লেপ্টে থাকা কোনো এক গুণীর বিবরণ দেওয়া আছে ওতে। এবং মূর্তিটি যে জায়গায় পাওয়া গেছে সেখানে ইতিহাসের একসময় তার বিচরণ ছিল৷ লোকে তাকে অসত্য বলে মানতো এতদিন। কিন্তু তিনি মূর্তির পেছনে সেই ভাষায় লেখা বাক্যের অর্থ বুঝতে পেরে ক্যান্সারের সার্জারি বাদ দিয়ে রহস্যের গন্ধে চলে যান সেই চৌথুপীতে। যেখানে তার বাবাও একই রহস্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন।
ঘটনাক্রমে চৌথুপীর মিউজিয়ামে থাকা আরেক আর্কিওলজিস্ট নলিনী রক্ষিতের সাথে আলাপের পরে জানতে পারেন তার বাবা একটা পুরোনো পুঁথি পেয়েছিল মারা যাওয়ার আগে যা এতদিন নলিনী রক্ষিত কাকে দেবে তা ভেবে পাচ্ছিল না। হঠাৎ যোজনগন্ধার উদয়নে তিনি সেই পুঁথি তাকে দেন। এই পুঁথিতেই লুকিয়ে আছে সেই গুণীর ইতিহাস। কিন্তু তা বর্ণনা করা আছে সন্ধ্যা ভাষা এবং সিদ্ধং লিপিতে এবং তা ডিকোড করতে পারে অল্প কিছু মানুষ। তার মধ্যে যোজনগন্ধা একজন। তিনি সাথে করে নিয়ে যান সেই পুঁথি যাতে করে তিনি ডিকোড করতে পারেন তার ভেতরের ইতিহাস। এটা ডিকোড করার আরও কিছু কারণ ছিল। সেই গুণী কায়দা করে পুঁথির ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন এক তথ্য। কয়েক হাজার গুপ্তপুঁথির তথ্য।
এ সকল বিষয় যখন উদ্ধার করার সিদ্ধান্ত নেন যোজনগন্ধা ঠিক সেসময়ে তিনি এবং পুলিশের এক কর্মচারী টেরোরিস্টের হাতে কিডন্যাপড হন।
ব্যস এরপর শুরু হয় মৃত্যুখেলা এবং ইতিহাসের যারপরনাই বিচরণ৷ তারা কী পেরেছিল বের করতে সেই গুণীর ইতিহাস এবং গুপ্তপুঁথির সন্ধান? যদি বেরই করে তবে কী ছিল সে গুণীর ইতিহাস?
উত্তর খুঁজতে হলে পড়তে হবে বই।

★ মূল রিভিউঃ

আখ্যানে অনেক কিছু স্পষ্ট হলেও হয়নি এর কারুকার্যতা।
প্রথমে যা দিয়ে শুরু করবো তা হলো চর্যাপদ। সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষায় রচিত হওয়া কিছু পাদ বা সংকলনকে বলা হয় চর্যাপদ। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মূল চর্যাপদ আবিষ্কার করার পরেও অনেক চর্যাপদ আবিষ্কৃত হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শশিভূষণ দাসগুপ্ত ১৯৬৩ সালে নেপাল এবং তআই অঞ্চল থেকে অজস্র চর্যাপদ আবিষ্কার করেছিলেন যা পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে নব চর্যাপদ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ১২০০ সাল অব্দি চর্যার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু আসলে এর পরেও গোপনে চর্যার সংকলন চলমান ছিল। প্রায় তিনশো সাল পর্যন্ত চলেছিল৷ ঠিক এই সময়কেই প্লট ধরে নিয়ে লেখক প্রীতম বসু তার বই রচনা করেছেন।
অর্থাৎ ১২০৫ সালের দিকে বাংলায় তুরস্কের আক্রমণের সময় একজন জ্ঞান ডাকিনী গন্ধকালীকে নিয়ে গল্প এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

চৌথুপীর চর্যাপদ বইটিতে লেখক দুটো টাইনলাইন ব্যবহার করেছেন। প্রথমটা ২০১৬ সাল এবং দ্বিতীয়টা ১২০৫ সাল। গল্পের আকারে তুলে ধরেছেন সে সময়কার বাংলার রীতি। হিন্দু বা বৌদ্ধদের আচার আচরণ। প্রসঙ্গ আসে হিন্দু আর বৌদ্ধ কি একই সমাদরে গাঁথা কি না?
স্বামী বিবেকানন্দ তার এক বক্তিতায় বলেন হিন্দু ধর্মের পূর্ণ প্রকাশ হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। এছাড়াও সনাতন ধর্মের বিশ্বাস বুদ্ধ বিষ্ণুর দশাবতারের একটি।

সেদিকে পরে যাবো আগে আসি বইয়ে কীরূপ আকারে ধর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা প্রীতম বসু দিয়েছেন সেদিকে। দুটো টাইমলাইনেই বইটির প্রধান চরিত্র ছিল একজন মেয়ে। একাধারে ১২০৫ সালে একজন কেবট্ট (কৈর্বত্য- হিন্দুদের শূদ্র জাতের একটা অংশ) নারীর সাথে সমাজের কী হেরফের অন্যদিকে ২০১৬ সাল�� টেররিস্টদের হাতে বন্দী হওয়া এক ক্যান্সার রোগী নারীর ইতিহাস উদ্ধার করার গল্প নিয়েই তৈরী হয়েছে এই বই৷

প্রথম টাইমলাইন তিনি সরাসরি বর্ণনা করেননি। সেই পুঁথির মাধ্যমে যোজনগন্ধাকে দিয়ে ডিকোড করিয়েছেন। অর্থাৎ ইতিহাস পড়ার মতো করে করেছেন লেখক। বাংলায় সে সময়ে জাতের মাধ্যমে কীরূপ ভেদাভেদ তৈরি করা হতো তার নিদারুণ দৃশ্য লেখক প্রীতম বসু এই বইতে তুলে ধরেছেন। অবশ্য হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী অনেকক্ষেত্রে এসব এখনও মানা হয়। ব্রাহ্মণরা এখনও কোনো নিচু জাতের খাবার স্পর্শ করলে তাদের জাত যায় বলে চলমান আছে। এমনকি সে সময়ে নিচু জাতের কারও জ্ঞান আহরণেও কত বড়ো বাঁধা আসতে পারে তা এই বই না পড়লে আমি জানতাম না।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বা বিক্রমশীল মহাবিহার সে সময়ের প্রধান বিদ্যাপীঠ ছিল বলেই মনে করেন অনেক ঐতিহাসিকরা। বইতে সেরকম বিদ্যাপীঠের মতো একটা বিদ্যাপীঠ তৈরি করে প্রীতম বসু তার গল্পে। নাম দেন চৌথুপী সঙ্ঘারাম। যেখানে বৌদ্ধ আচার্যগণ তাদের অনুচরদের রীতিনীতি শেখাতেন। এই চৌথুপী নিয়ে পুরো কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। চারটি স্তুপ থেকে চৌথুপী নামকরণ করা হয়।

সে সময়ের সমাজের হাল স্বরূপ এবং গুরুদের ভক্তি কতখানি বিন্যস্ত ছিল তার বিস্তর আলাপ লেখক করেছেন বইতে। বজ্রযানীদের কারুকার্য থেকে শুরু করে হীনযানী, মহাযানীদের মধ্যকার যে সংঘর্ষ বা দলাদলি তার বিপুল সংমিশ্রণ বইতে রয়েছে। এবং তার অধকাংশই সত্য।
আশ্রিত থ্রিলার আশ্রয় যখন সত্য বলে বিবেচিত হয় তখন এর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। তুরস্কের বর্বরতার কথাও উল্লেখিত হয়েছে বইতে। তবে তার অধিকাংশই বানোয়াট। সমালোচনা অংশে এর বিস্তারিত আলাপ করবো।
সে সময়ের জ্ঞান গাম্ভীর্যের যে তর্কাতর্কি কতটা উচু স্থানের অধিকার পেতে পারে তারও বর্ণনা রেখেছেন লেখক।
জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে শুরু করে ঔষধিবিদ্যা। নীতি থেকে রীতি সে সময়ের কিছুই লেখক বাদ দেন নাই।

লেখকের প্লট নির্বাচন দারুণ বলবো। অর্থাৎ ইতিহাসের একটা হারানো নক্ষত্রকে অবলোকন করে লেখক সেটাকে আবার হারিয়ে ফেলে একটা সন্ধ্যা ভাষার পদ দিয়ে উদ্ধার করার ভার ছেড়ে দিয়েছেন বর্তমানের ঐতিহাসিক এবং আর্কিওলজিস্ট যোজনগন্ধার হাতে। এরকম বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে প্লট নির্বাচন করা চাট্টিখানি কথা না। এর জন্য লেখককে প্রায় পঞ্চাশটা বইয়ের টীকা বা সাহায্য নিতে হয়েছিল যা বইয়ের শেষে উল্লেখ করা ছিল।

এছাড়াও বর্তমানের টাইমলাইনে তিনি রেখেছেন এক বিশাল ভূমিকা। যেখানে ইতিহাস উদ্ধার ছাড়াও ছিল অনেক প্রগাঢ় বিষয়। ভালোবাসার বন্ধন, টাকার খেলা, জোচ্চুরির কারসাজি, টেরোরিস্টদের আক্রমণ, ডাকাতদের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।

★ পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ

ইতিহাস বা মিথলিজি আশ্রিত থ্রিলার মূলত চমকের শেষ রাখে না বলেই মনে করি৷ এটাও ব্যতিক্রম কিছু করেনি।
যেমনটা পীড়িত হচ্ছিলাম সে সময়ের সমাজের কলুষিত দিক দেখে আবার ঠিক ততটাই চমকপ্রদ হচ্ছিলাম ইতিহাসকে বর্ণনা করার ভঙ্গি দেখে।
নিঃসন্দেহে এই বই আমার পড়া বেস্ট বইয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে তবে একটু খোরাক যেন থেকেই যায়। তা নিম্নে তুলে ধরবো। বইটি আমি দুই চারদিনে শেষ করেছি।
উপভোগ করেছি এর নব্বই ভাগের ওপরে।
১২০৫ সালে একজন আঠেরো বছর বয়সী শূদ্র জাতের মেয়ে বিশাল জ্ঞানী ব্রাহ্মণদের তর্ক যুদ্ধে হারায় তা দেখে বুকের ভেতরে উচ্ছ্বসিত হয়েছিল বারংবার। মূলত তার প্লটের প্রথম টাইমলাইনই ছিল আমার কাছে আগ্রহের শীর্ষে।
জ্ঞানের কাছে জাত যে মাথা নত করে তার ঢের উদাহরণ মহাভারতে থাকলেও সমাজে ছিল না। অন্তত বৈদিক যুগের পর তো না-ই। সেখানে এরকম ফিকশনাল ক্যারেক্টারের বাচন ভঙ্গি বলার মহিমা মুগ্ধ করেছে আমাকে।
এছাড়াও মহাভারতে বর্ণিত যুদ্ধ কত সালে হয়েছিল তা নির্ণয় করা, বিভিন্ন ঔষধের বিবরণ দেওয়া ইত্যাদি জ্ঞান গাম্ভীর্য বিষয় ছিল অত্যন্ত লোভনীয় মাত্রার।

সন্ধ্যা ভাষার চর্যাগুলো লেখক নিজে সাজিয়েছেন দেখে চমকে উঠেছিলাম। আসলেই লেখক বেশ খেটেছেন বইটির জন্য।
বর্তমানের টাইমলাইনও সাজিয়েছেন সুন্দর করে। এতটুকু ফাঁক রাখেননি লেখক সেক্ষেত্রে।

★ সমালোচনাঃ

সমালোচনার দিক বইতে না থাকলেও যতটুকু রয়েছে ততটুকুতে যে কারোই বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে অনেক। ইতিহাস আশ্রিত থ্রিলারে ইতিহাস বিকৃত নতুন কিছু না। তবে সেই ইতিহাস যদি কোনো ধর্মের পরিপ্রেক্ষিতে গিয়ে দাঁড়ায় তবে তা অন্যায্য বলে বিবেচিত হয় বলে মনে করি।
বইয়ে তুরুস্কের বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে আক্রমণ এতটাই অমানবীয় ভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গিয়েছিলাম। লেখক বর্ণনা করেছেন যে তুর্কিরা বৌদ্ধ বা হিন্দুদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। বিহার গুড়িয়ে দেয় এবং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য বিহার গুড়িয়ে দিয়েছিল। এবং তাতে মসজিদ বা মক্তব তৈরি করেছিল।
মূলত ইতিহাস ঘাটলে এটা একটা বানোয়াট কাহিনি বলেই মনে হবে। তুর্কিরা কখনোই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য কোনো বিহার আক্রমণ করেনি। অথবা নির্বিচারে বৌদ্ধ হত্যা করেনি। এর যথেষ্ট প্রমাণ ও ভিত্তি রয়েছে।
তুর্কিরা মূলত ওদান্তপুর বিহারে আক্রমণ করেছিল। নালন্দা বা অন্যান্য কোনো বিহারেই আক্রমণের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

এক্ষেত্রে বলা যায় সাতশো শতাব্দিতে পাল বংশের আগমনের আগে বৌদ্ধদের প্রধান শত্রু ছিল রাজা শশাঙ্ক। তিনি নির্বিচারে বৌদ্ধ নিধন করেছিলেন। তারপর পাল বংশ এসে আবার বৌদ্ধ বিস্তার লাভ করে। এর প্রধান কারণ ছিল সহজিয়া বৌদ্ধদের ভূমিকা। যদিও হীনযানী বৌদ্ধরা সদ্ধর্মীদের দুচোখেও দেখতে পারতো না।
এরপরে পাল বংশের পতনের পর সেন রাজারা আবার নির্যাতন চালায় বৌদ্ধদের ওপরে।
বরঞ্চ তুর্কি আগমনে বাংলার বৌদ্ধরা হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল বলা যায়। তখনকার ব্রাহ্মদের দ্বারা পরিচালিত সমাজে নিচু জাতদের বৌদ্ধ বা হিন্দুদের অবস্থা ছিল শোচনীয়।

মূলত একজন ত্রাণকর্তার অপেক্ষায় ছিল সবাই। সেই সময়ে বখতিয়ার খলজির আগমন ঘটে বাংলায়। তিব্বতী বুদ্ধ ঐতিহাসিক কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রীর বিবরনী থেকে জানা যায় মগধ থেকে এক দল ভিক্ষু মির্জাপুরে গিয়ে বখতিয়ারের সঙে দেখা করে তাকে মগধকে মুক্ত করতে আবেদন করেন (Journal of the Varendra Research Society, Rajshahi, 1940)। তাঁর আগমনে ব্রাহ্মণ্য শাসনের অবসান ঘটে। বৌদ্ধরা মুসলিম শাসনকে স্বাগত জানায়। দীনেশ চন্দ্র সেন তার পর্যবেক্ষণে বলেন, "বৌদ্ধগণ এতটা উৎপীড়িত হইয়াছিল যে তাহারা মুসলমানদের পূর্বকৃত শত অত্যাচার ভুলিয়া বিজয়ীগণ কর্তৃক ব্রাহ্মণ দলন এবং মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয় ভগবানের দানস্বরূপ মনে করিয়াছিল। শূন্যপুরাণের ‘নিরঞ্জনের উষ্মা’ নামক অধ্যায়ে দেখা যায়-তাহারা (বৌদ্ধরা) মুসলমানদিগকে ভগবানের ও নানা দেবদেবীর অবতার মনে করিয়া তাহাদের কর্তৃক ব্রাহ্মণ দলনে নিতান্ত আনন্দিত হইয়াছিল। ইতিহাসে কোথাও একথা নাই যে সেনরাজত্বের ধ্বংসের প্রাক্কালে মুসলমানদিগের সঙ্গে বাঙালি জাতির রীতিমত কোনো যুদ্ধবিগ্রহ হইয়াছে। পরন্তু দেখা যায় যে বঙ্গবিজয়ের পরে বিশেষ করিয়া উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সহস্র বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণীর হিন্দু, নব ব্রাহ্মণদিগের ঘোর অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণপূর্বক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়াছে। (ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা-৫২৮)

এছাড়াও বইয়ে বর্ণিত আছে যে তুর্কিরা বর্বরতার মধ্য দিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিল। এটাও ভুল। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি আসার পূর্বেই বাংলায় ইসলাম ধর্ম ঢুকে গিয়েছিল। মূলত বৌদ্ধ বা হিন্দ��দের ধর্ম পরিবর্তন করার মূলে ছিল ব্রাহ্মণ্য সমাজ এবং তাদের কট্টর হিন্দুয়ানী রীতি৷ যেখানে জাত ভেদে সবাইকে পরিমাপ করা হয়। নৃশংসতা হয়নি এমন না। তবে তা কোনো সিভিলিয়ানদের ওপর হয়নি।

হিন্দু বা বৌদ্ধদের মুসলিম হওয়ার পেছনে আরেকটা কারণ যেটা ছিল তা হলো সতীদাহ প্রথা। পাল রাজাদের আমলেও এর বিচরণ যে ছিল তা চৌথুপীর চর্যাপদ বইতেও পাওয়া যায়। এই প্রথার ভয়ে বহু হিন্দু বা বৌদ্ধ এমনকি ব্রাহ্মণরাও দলে দলে মুসলিমদের কাতারে ভীড় করেছিল।

এছাড়াও বইতে উল্লিখিত এক চরিত্র চাণক্য কবিরাজের ব্যবহৃত মুসলিমদের যুদ্ধনীতি সম্পর্কে ভুল বর্ণনা করেছেন লেখক। মুসলিমদের যুদ্ধ নীতি সম্পর্কে ধারণা থাকলে তিনি তা বলতেন না বোধহয়। হাফি হাবিলদারকে মাগরিবের নামার পড়ানোর জায়গায় মাঘ্রিব বলাটাও কেমন যেন অশোচনীয় লেগেছে। একটা ধর্মকে কেন্দ্র করে আরেকটা ধর্মকে নিচু করা অনুচিত কাজ যদিও তা ফিকশন হয়।
সিদ্ধং লিপিকে সিদ্ধম বলে কেন টানলো তাও বুঝিনি। সংস্কৃতর ব্যবহার রোধ করতে করেছেন মনে হয়।

★ চরিত্রায়নঃ

চরিত্রায়ন ছিল অমায়িক। যে চরিত্রের যতটুকু বিশ্লেষণ দরকার ঠিক ততটুকুই লেখক করেছেন। প্রধান দুই চরিত্র গন্ধকালী এবং যোজনগন্ধার নামের মধ্যে যে মিল তিনি রেখেছেন তা বই না পড়লে বোঝা যাবে না।
সবচেয়ে মজাদার চরিত্র ছিল হাফি হাবিলদারের চরিত্র। শেষের দিকে তার নামের হাফ-হাফ বিষয়টা দারুণ লেগেছে। এছাড়াও পুরো উপন্যাসে তার কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য উপন্যাসটি নির্দ্বিধায় পড়তে সাহায্য করেছে। কিছু জায়গায় আপন মনে হেসে উঠেছিলাম।
মামাজী চরিত্রটা আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করা যেত যদিও প্রেক্ষাপট ছিল না তেমন।
বিমলা, অর্জুন, ভাণু চরিত্রগুলো আসলেই আমাদের অপরাধ জগতের একটা করুণ দিক ফুটিয়ে তুলেছিল।
আর সবচেয়ে আশ্চর্যান্বিত চরিত্র ছিল লামা। তার জ্ঞানময় কথা যেন সবাইকে বিমুগ্ধ করেছিল বইতে।
পাশাপাশি গন্ধকালীর টাইনলাইনে খু-স্তোন, শ্রীধর আচার্য, বাগছী, আচার্য শান্তভদ্র, গোপা, দিবাকর, মুনিয়া ইত্যাদি চরিত্র ছিল মনে রাখার মতো।
এদের বিবরণ, বাচনভঙ্গি নিখুঁত ছিল।

★ লেখনশৈলীঃ

লেখকের লেখনশৈলী দারুণ। এত দারুণ ভাবে জ্ঞানের কথা বলা যায় তা এঁনার বই পড়েই বুঝেছি। যদিও ইতোপূর্বে বহু ইতিহাসের বই অধ্যয়ন করা হয়েছে তবে এমন বিষয়ের উপর উপন্যাস পড়া আসলেই সৌভাগ্যের বিষয়।
সে সময় বহু চর্যাচর্য হারিয়ে গিয়েছিল। সেইরকম এক চর্যাকে কেন্দ্র করে এরকম উপন্যাস তিনি বর্ণনা করেছেন তা প্রশংসার যোগ্য নিঃসন্দেহে।
তবে কিছু জায়গায় আরেকটু হাত বুলানোর দরকার ছিল বলে মনে করি। লিখতে লিখতে কিছু কিছু জায়গায় 'ল' বর্গের ছন্দ চলে এসেছিল যা দৃষ্টিকটু লেগেছিল।
বানান ভুল ছিল না কোনো। একরকম একটাও চোখে পড়েনি। তবে প্রমিত বানান ভুল ছিল। যদিও বইটি কলকাতার তাই সমস্যা মনে করিনি।

★ উপসংহারঃ

একসাথে জ্যোতির্বিদ্যা, মূর্তি তত্ত্ব, বৌদ্ধ ধর্মের রীতি, ইতিহাস, মহাভারতের যুদ্ধ, শ্লোকের তর্ক, মেডিসিন, আর্কিওলজি, বজ্রযান, বজ্রসাধনা, কাহ্নপা-লুইপাদের চর্যাগীতির উদাহরণ, জাত ভেদে বর্ণনা এত কিছু পাওয়া অসম্ভব সেখানে পেয়ে গেছি সুতরাং ভালো লাগার বিষয় প্রগাঢ়। নিশ্চয়ই এই বই সংগ্রহে রাখার অবকাশ রাখে।
ইতিহাসের সাথে আশ্রিত এত সুন্দর একটি আখ্যান যার শেষে রয়েছে প্রণয়ের উদাহরণ তা অবশ্যই পাঠের যোগ্য।

নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অ্যাডভেঞ্চারে ছিলাম এ কয়দিন। মনে হয়েছিল মৃত্যু বুঝি সাথে সাথে চলছে। এই বুঝি যোজনগন্ধার সাথে আমিও পাহাড়ারে চূড়ায় উঠেছিলাম মৃত্যু থেকে পলায়ন করতে আবার এই মুহূর্তে ফিরে গিয়েছিলাম সেই তেপান্তরে যেখানে বজ্রযানীরা তাদের মধ্যরজনীতে মৈথুনের ধ্যান করছে।
নারী পুরুষের সেই মিলন যা যোজনগন্ধাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল তর্কে। যা না হলে হয়তো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যেত গন্ধকালী ওরফে সঞ্জীবনী। অর্থাৎ যে মরে না।
কেন মরে না এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে বইতে। মহাভারতে হনুমান যখন পুরো পাহাড় তুলে নিয়ে এসেছিল লক্ষ্মণকে বাঁচাতে একটা গাছ খুঁজে না পেয়ে সেই গাছের নাম জানতে হলেও পড়া উচিত বইটি। এবং তার সাথে আজকের পৃথিবীর কী সম্পর্ক রয়েছে তারও বিবরণ দেওয়া আছে বইতে।

বইঃ চৌথুপীর চর্যাপদ
লেখকঃ প্রীতম বসু
প্রকাশনীঃ বাতিঘর
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ২০২২
Profile Image for Ariyan Shuvo.
77 reviews1 follower
July 29, 2022
বই : চৌথুপীর চর্যাপদ
লেখক : প্রীতম বসু
প্রচ্ছদ: দেবাশিষ রায়
প্রকাশনী : বাতিঘর প্রকাশনী
পৃষ্ঠা: ৪৪৮
মূদ্রিত মূল্য: ৫০০ টাকা

এক বাক্যে রিভিউ : এই বছরে এখনও অবধি আমার পড়া সেরা বই ।


কাহিনী সংক্ষেপ
----------------------------

যোজনগন্ধার দিনটা সাধারণভাবে শুরু হলেও হঠাৎ করেই গতিপথ পাল্টে গেল পত্রিকায় ছাপা একটা ছোট খবরে। একটা মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাচীন ঐ বৌদ্ধ মূর্তির পাশে পাওয়া গেছে একটা লাশ। নিহত ব্যক্তি আর কেউ না, নৃশংস সন্ত্রাসী ডন ছেত্রীর ছেলে। প্রাচীন ভাষা ও লিপি বিশেষজ্ঞ যোজনগন্ধা তাৎক্ষণিক ছুটে যায় সেখানে। এদিকে যোজনগন্ধা ক্যান্সারের সাথে লড়ছে, পরিস্থিতি সুবিধার না। তবুও কৌতূহল বলে কথা। সেই প্রাচীন বৌদ্ধমুর্তি অবলোকিতেশ্বরের গায়ে সিদ্ধম ভাষায় লেখাটির পাঠোদ্ধার করাতেই যেন তার জীবনের সফলতা। তবে চাইলেই কী সব সহজে ঘটে? প্রেক্ষাপটে হাজির নিষ্ঠুর ছেত্রী, চলে আসলো আরেক ভিলেন মামাজী। সাথে আছে প্রাচীন একটা পুঁথি, যেটার লেখিকা গন্ধকালী। এই গন্ধকালীকে খুঁজতে চৌথুপীতে অতীতেও রক্ত বন্যা বয়েছে। কেন? কে এই গন্ধকালী? পুঁথিতে লুকিয়ে আছে সব প্রশ্নের উত্তর।
*
তুরস্ক বাহিনীর হামলায় পর্যুদস্ত চারিদিক । চৌথুপী সঙ্ঘারাম ধ্বংস করতে এগিয়ে আসছে তারা । মাঝে হাতে সময় আছে কেবলমাত্র একদিন । সঙ্ঘারামের সকল ভিক্ষু প্রাণ রক্ষার্থে পালিয়ে যাচ্ছে । শুধু রয়ে গেছেন একজন । গন্ধকালী । সঙ্ঘারামের এত এত পুঁথি, ভিক্ষুদের সারাজীবনের গবেষণা লিপিবদ্ধ আছে এই পুঁথিগুলোতে । এগুলো তুরস্কদের হাতে পড়লে আগুনে পুড়িয়ে দেবে তারা । মুহূর্তেই ছাই হয়ে যাবে হাজারো গবেষণার দলিল । গন্ধকালী তা কিছুতেই হতে দেবে না । প্রাণের চেয়ে পুঁথি দামী তার কাছে । কিন্তু এত এত পুঁথি সে কীভাবে রক্ষা করবে?
*
অনিচ্ছাকৃতভাবে সঙ্গী হিসেবে হাফি হাবিলদারকে সাথে নিয়ে শুরু হলো যোজনগন্ধার অদ্ভুত এক অ্যাডভেঞ্চার। প্রাচীন বাংলা, প্রাচীন বাংলা ভাষার লিপি, তখনকার বৌদ্ধতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, সেই সাথে প্রাচীন বাংলার লিপি, ইতিহাস, ভাষা এবং সেইসাথে ‘চর্যাপদ’-কীভাবে হবে এসব রহস্যের সমাধান?

দুইটি টাইমলাইন । অতীতকালের গন্ধকালী, বর্তমানের যোজনগন্ধা । দুই মহীয়সী নারীর জীবনের গল্প পুঁথির কালো হরফের ন্যায় দুই মলাটে তুলে ধরেছেন লেখক । বর্তমান সময়ের অন্যতম থ্রিলার লেখক প্রীতম বসুর অত্যাশ্চর্য উপন্যাস 'চৌথুপীর চর্যাপদ' পাঠককে তার নিজের প্রাচীন গৌরবের উজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। 


পাঠ প্রতিক্রিয়া
-------------------------
সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার সুবিশাল এই বইটি নিয়ে আমার বহুকাল আগে থেকেই একরকম অবসেশন কাজ করতো । বইটি সরাসরি ভারত থেকে কেনার ইচ্ছে ছিল । অবশেষে দীর্ঘ একমাস সময় নিয়ে বইটা খুটিয়ে খুটিয়ে যত্নসহকারে পড়লাম । লেখক প্রীতম বসুর লেখার সাথে পরিচয় তার 'পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল' বইটি পড়ে । কী অসাধারণ এক বই 'পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল' । কত প্রাচীন ইতিহাস যে জানতে পেরেছিলাম বইটি পড়ে । পঞ্চাননমঙ্গলে কেন আমাদের পূর্বপুরুষের অঙ্কের নানা সূত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন তার এক বিস্ময়কর আখ্যান ছিল 'পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল ।'
এবার পড়লাম 'চৌথুপীর চর্যাপদ' । চৌথুপীর চর্যাপদ যেন আরো এক ধাপ উপরে । যাহোক রিভিউতে ফিরি ।

▪️প্লট ও স্টোরিটেলিং

ইতিহাস আমার ভীষণ পছন্দের বিষয় । বিশেষত বাংলার পুরোনো ভাষা, জ্যোতির্বিদ্যা, কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আমার অনেক পছন্দ । চৌথুপীর চর্যাপদের প্লট বেশ ইন্টারেস্টিং । দুইটি টাইমলাইনে প্যারালাল প্লট । অতীত ও বর্তমানকাল - এই দুই টাইমলাইনে গল্প এগিয়েছে । অতীতের গন্ধকালী ও বর্তমানের যোজনগন্ধা । একজন প্রাণপণ চেষ্টা করছে প্রাচীন পুঁথি লুকাতে, অন্যজন চেষ্টা করছে পুঁথি উদ্ধারে । দুইটি ভিন্ন ভিন্ন সুতা শেষমেষ যখন এক হয়ে ধরা দেবে তখন পাঠক অচিরেই বলে উঠবেন 'চমৎকার! এর জবাব নেই ।'

▪️ ভাষাশৈলী ও বর্ণনাভঙ্গী

ভাষাটা সামান্য একটু কাটখোট্টা হলেও প্রীতম বসুর বর্ণনাভঙ্গী অনেক ভালো । প্রতিটা ঘটনার ডিটেইল আলোচনা করেছেন তিনি । আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি ইনফো ডাম্পে ভারতীয় লেখকের ধারেকাছেও নেই বাংলাদেশের লেখকেরা । সাড়ে চারশো পেজের বই, স্বভাবতই পুরোটাই উপন্যাস ভাবা বোকামি । এই বইতে উঠে এসেছে প্রচুর তথ্য ও ইতিহাস । লেখক পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গল্প থেকে সরে এসে জ্ঞানগর্ভ আলাপ করেছেন, প্রচুর ইতিহাস তুলে ধরেছেন । তবে আমার একটুও বিরক্ত লাগেনি এটা । এখানেই বাংলাদেশের থ্রিলার লেখকদের কমতি পাই আমি । তারা দুই পেজ ইনফো ডাম্প করলেই পড়তে বিরক্ত লাগে, মনে হয় যেন গল্প তার স্বাভাবিক গতি হারাচ্ছে । এর কারণ একটাই । বেশিরভাগ বাংলাদেশী লেখকের এই ইনফো ডাম্পিংটা পাঠ্যবইয়ের মত হয়ে যায় । অনেকটা কপি পেস্টের মত লাগে । গৎবাঁধা থিওরি কপচালে পাঠক বিরক্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু ভারতীয় থ্রিলার লেখকদের বেলায় আমি দেখেছি তারা এত সুন্দর করে এই জ্ঞানগর্ভ আলাপগুলো বইতে করেন যে পড়লে একটুও বিরক্ত লাগেনা । বিষয়টা আসলে উপস্থাপনা কৌশলের উপর নির্ভর করে আরকি । যেটা বাংলাদেশের থ্রিলার লেখকদের মধ্যে ভালোরকমের কমতি আছে । 
রিভিউ তে ফিরি । মোটকথা প্রীতম বসু যেখানে গল্প বলেছেন আমি সেই গল্প এনজয় করেছি, উনি যেখানে ইইহাস কপচেছেন আমি সেটাও নিখাদ আনন্দের সাথে উপভোগ করেছি ।

▪️ চরিত্রায়ন

ঢাউস সাইজের এই বইটিতে মুখ্য চরিত্রের পাশেও এসেছে অসংখ্য চরিত্র । এই লেখকের 'পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল' বইটি পড়ে আমার রিয়্যাকশন ছিল এমন : "মাভৈঃ মাভৈঃ, চোরেরও যে এত জ্ঞান আর বিদ্যাবুদ্ধি থাকতে পারে তা আমি এই প্রথম দেখলাম ।" হাহা । যাহোক এই বইটিতে অমন ত্রুটি নেই । ঢালাওভাবে নিজের জ্ঞান জাহির করার চেষ্টা কোনো চরিত্র ই এখানে করেনি । চরিত্রগুলো যে যার রোল টা ঠিক মত প্লে করে গেছে । ফলপ্রসু সোনায় সোহাগা একটা বই পড়তে পেরেছি ।
ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট যথেষ্ট ভালো । গন্ধকালীর জীবনের পুরো ups and downs লেখক তুলে ধরেছেন দেখে ভালো লাগলো । বিশেষত তার পাস্ট স্টোরি । মোটকথা অতীতকালের গন্ধকালীকে আমি দশে দশ দেবো । তার কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা, প্রজ্ঞা, ডিসিশন মেকিং, জীবনদর্শন - সবকিছু লেখক চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন । প্রতিটা দৃশ্যেই গন্ধকালীকে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম । একই কথা খু-স্তোনের বেলায় ও । তাকেও অলাপ সময়ে বেশ ভালোভাবে ডেভেলপ করেছেন লেখক । মোট কথা চরিত্রায়নে অভিযোগের জায়গা পাইনি আমি ।
এবার আসা যাক বর্তমানের যোজনগন্ধা চরিত্রে । ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন নারী যার বাবা মারা গেছে চৌথুপীতে কোনো এক মূর্তির সন্ধান করতে করতে । এই চরিত্রটির স্ক্রিনটাইম ছিল সবথেকে বেশি । লেখক এই চরিত্রটিও বেশ ভালোভাবেই ডেভেলপ করতে পেরেছেন । তবে কোনো কোনো জায়গায় একটু খাপছাড়া লাগলো । যেমন ধরুন ক্যান্সারের ফাইনাল স্টেজে থাকা যোজনগন্ধা কীভাবে মেডিসিন ছাড়া এত বড় একটা এডভেঞ্চার পাড় করলো - এটা একটা ভাবনার বিষয় ই বটে । যাহোক অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে হাফিজুর হাবিলদারকে আমার বেশ ভালো লেগেছে । সহজ সরল, জেদী একজন মানুষ সে । ঘটনাক্রমে আটকে গেছে যোজনগন্ধার সাথে । তার সাবলীল কথাবার্তা, হিউমার আমি উপভোগ করেছি । তবে আমি হলে এই চরিত্রটি নিয়ে একদম বইয়ের এন্ডিং এ গিয়ে আরেকটু এক্সপেরিমেন্ট করতাম । হাহা । এছাড়া ভিলেন চরিত্রে মূল ভিলেন ছেত্রীর চেয়েও মামাজীকে বেশি ভালো লেগেছে । সচরাচর বইতে আমার নায়কের চেয়ে ভিলেন বেশি পছন্দ । এই বইতে ভিলেনদের মধ্যে কেউ ই মনে দাগ কাটার মত অতটা বুদ্ধিদীপ্ত ছিল না । মানে পড়লাম আর ভুলে গেলাম টাইপের ভিলেন । সব আলোকবিন্দু ছিল যোজনগন্ধা ও গন্ধকালীর দিকেই । এবং লেখক আশ্চর্যভাবে এই দুই চরিত্র দিয়েই বাজিমাত করে দেখিয়েছেন ।

▪️ এক্সিকিউশন ও এন্ডিং

লেখক বেশ সুন্দরভাবে পুরো গল্পটার পরিণতি দিয়েছেন । এন্ডিংটা আরেকটু ডিটেইলসে আশা করেছিলাম । আরেকটা ব্যাপার আগাগোড়া সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার থ্রিলার হিসেবে এই বই পড়লে আপনার মোটেই ভালো লাগবে না । থ্রিল যে একদম ই নেই তা নয় । তবে খুব বেশি সাসপেন্সের বই এটি নয় । ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস বলা চলে বইটিকে । হ্যাঁ এই বইতে এডভেঞ্চার আছে, সাসপেন্স আছে, chasing scene, action scene
সবই আছে । তাও বলবো থ্রিলারের মত সুপার ফাস্ট পেসের মনোভাব নিয়ে এই বই পড়লে কিছুই বুঝবেন না । সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে বুঝে বুঝে পড়তে হবে । আমি নিজেই এই বইটা পড়তে একমাস সময় নিয়েছি । তাই এই বইটি ধীরেসুস্থে পড়ার পরামর্শ রইলো ।

▪️ প্রোডাকশন ও অন্যান্য

বইটি বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছে বাতিঘর প্রকাশনীর হাত ধরে । বইটির প্রোডাকশন কোয়ালিটি বেশ ভালো । পৃষ্ঠা ও বাঁধাই এর মান ভালো । বানান ভুলের সংখ্যা তেমন নেই বললেই চলে ।

▪️ শেষের কথা

বলা হয়ে থাকে - একটা ভালো বই একটা বন্ধুর সমান । এই বইটা আমি এত বেশি এনজয় করেছি যে শেষের দিকে মনে হচ্ছিল এই বুঝি বইটা পড়া শেষ হয়ে যাবে আর এত সুন্দর জার্নিটা শেষ হয়ে যাবে । এজন্যই মূলত একমাস সময় লেগেছে বইটা পড়তে আমার । সচরাচর এত সময় লাগেনা বই পড়তে আমার । প্রতিটা পৃষ্ঠা অনেক মনোযোগের সাথে যত্ন করে পড়েছি ।
আমি হলে এই বইয়ের নাম রাখতাম 'আগুনপাখি' । এর কারণ বইটা পড়লে নিজেরাই বুঝতে পারবেন । যারা ইতিহাস ভালোবাসেন, সত্যকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন বাংলা ও বাংলার ভাষাকে, অতলে হারিয়ে যাওয়া আশ্চর্য জ্ঞানের সম্ভার নিয়ে জানতে যারা আগ্রহী - তাদের জন্য এই বইটা পড়ার পরামর্শ থাকবে ।


ব্যক্তিগত রেটিং : ১০/১০
Profile Image for Rehnuma.
444 reviews21 followers
Read
June 14, 2023
নেপালের রাজপ্রাসাদে চর্যাপদের হদিস পান হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। এরপর ধীরে ধীরে চর্যাপদের কথা ছড়িয়ে পরে। চর্যাপদগুলো প্রাচীন ইতিহাস বহন করে। বহন করে এককালে আমাদের গৌরবময় অতীতের কথা। চর্যাপদগুলো বোঝা সোজা কথা নয়। এর আছে অন্তর্নিহিত অর্থ। একই কথার আছে ভিন্ন মানে।

গঅণ পদুমা রঅণ আঠাশ পাখুরী
দিবসই ন দিঠঠে অচ্ছই অন্ধারি।
নিসিঅ উদ্ধমেরুত ণিচল পেখই
পরিমানহ থাব গন্ধকালী ভণই।।

চৌথুপীর বিখ্যাত এক বৌদ্ধবিহার থেকে পাওয়া গাছে অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি। মূর্তির পাশে সিদ্ধম লিপিতে লেখা এই পদ। সাথে একটা লা শও মিলেছে। জানা গেছে লা শটা মাফিয়া ছেত্রীর পুত্রের। চৌথুপীর অবস্থা বেশ গরম।

পত্রিকায় চৌথুপীর খবর পেয়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে আর্কিওলজিস্ট যোজনগন্ধার মন। শরীরে বেড়ে ওঠা মর ণঘাতী রোগকেও পরো��়া না করে ছুটে চলে চৌথুপীতে। অবলোকিতেশ্বরের মূর্তিটা যেন যোজনের অনেকদিনের চেনা! আর গন্ধকালী! সেই জ্ঞান-পিপাসু নারী। যার অস্তিত্বের পিছে ছুটে চলেছিল যোজনের বাবা বুধাদিত্য চ্যাটার্জিও। তবে লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই প্রাণ হারান তিনি। তারই পথ অনুসরণ করে যোজনগন্ধা ছুটেছে চৌথুপীতে।
চৌথুপীতে যোজনগন্ধার দেখা হয় মিউজিয়ামের এ.এস নলিনী রক্ষিতের সাথে। রক্ষিত যোজনের হাতে তুলে দেয় শালুতে মোড়া এক পুঁথি। সিদ্ধমে লেখা পুঁথির নাম, ❛গুহ্যচর্য্যা - গন্ধকালী জ্ঞান ডাকিনী❜। পুঁথির সঠিক মানে বুঝতে পারে এমন লোক খুব কম-ই আছে। বলা যায় কোটিতে একজন! সেই একজন-ই কি যোজনগন্ধা?
পুঁথি নিয়ে কাজ শুরুর আগেই যোজনগন্ধা এবং হাবিলদার হাফিজুর আলী ছেত্রীর লোকের অপহরণের শিকার হয়। ছেত্রীর পুত্রের হ ত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে সাতদিনের সময় দেয়া হয় হাফিকে। পথের মাঝেই দ্বিতীয়বার অপহরণের শিকার হয় তারা। এবার অপহরণকারী টে রোরিস্ট ❛মামাজী❜। বন্দী অবস্থায় থেকেও যোজনগন্ধা পুঁথির পাঠোদ্ধার করতে কাজ করে যায়। ঘটনাক্রমে হাফি আর যোজনের সাথে যোগ হয় তিব্বতি লামা লবসাঙ। চলতে থাকে গুহ্যচর্য্যার অন্তর্নিহিত মানে বের করার কাজ।

গন্ধকালী। জাতে কৈবর্ত। অসাধারণ মেধা আর স্মৃতিশক্তির অধিকারিণী সে। তুর্কি সেনার তান্ডবে যখন বাঙলার গ্রামগুলো গুড়িয়ে যাচ্ছে সে সময় প্রাণ বাঁচাতে শ্রীধর আচার্য এলেন গন্ধকালীর গ্রামে। তার শিষ্যা করে নিলেন গন্ধকালীকে। তবে ভাগ্যের খেলে গন্ধকালী তার গুরু এবং পিতা থেকে দূরে চলে যায়। গুরুদক্ষিণা পূরণ করতে চৌথুপীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। একসময় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে চৌথুপী সঙ্ঘারামের থেরি সঞ্জীবনী রূপে। চিকিৎসা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে অসাধারণ দক্ষতা তার।
আগুনপাখি খ্যাত গন্ধকালী ওরফে সঞ্জীবনীর জীবনে থিতু হওয়া বলে যেন কিছু নেই। কারণ এগিয়ে আসছে তুর্কি সেনারা।

খু-স্তোন। তিব্বতি রাজকুমার। বেরিয়েছে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার খোঁজে। আক্রান্ত বাবা এবং তিব্বতি জনগণ। পথে আক্রমণের শিকার হয় রাজকুমার। লাই-দো-লাই নিজের প্রাণের বিনিময়েও কুমারকে রক্ষা করে যায়। জানতে পায় রাজার ভ্রাতা সিংহাসন দখল করে নিয়েছে। খু-স্তোন প্রতিজ্ঞা করে রোগের প্রতিকার নিয়ে ফিরবে এবং রাজ্য ফিরিয়ে আনবে। যাত্রাপথে কুমারের দেখা হয় চাণক্য কবিরাজের সাথে। তার থেকেই সে খোঁজ পায় থেরি সঞ্জীবনীর এবং নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে দেখা হয় তার সাথে।
তুর্কি সেনারা চৌথুপীর বিহারেও আ ক্রমণ করলে কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালাতে সমর্থ হয় সঞ্জীবনী এবং খু-স্তোন। সাথে সিন্ধুক ঠাসা পুঁথি। যা বহন করছে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, জ্ঞান, শাস্ত্র। দুজনে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পুঁথিগুলোকে আগলে রাখে। শেষমেষ সঞ্জীবনী আর খু কি পেরেছিল পুঁথির রক্ষা করতে আর নিজ রাজ্য পুনঃঅধিকার করতে? বিপদের সময় অরুন্ধতীর কাছে গন্ধকালীর করা প্রার্থনা কি পূরণ হয়েছিল?

২০১৬ তে বসে যোজনগন্ধা, হাফি আর লবসাঙ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অতীতের ঘটনার শেষ জানতে। চারদিকে বিপদ তবুও ইতিহাস উদ্ধার চাই। পারবে কি?


পাঠ প্রতিক্রিয়া:

ঐতিহাসিক ঘটনাকে উপজীব্য করে ফিকশন পড়তে গেলে আসল ইতিহাস বা সঠিক ইতিহাসের সম্পর্কে জানা না থাকলে মাঝেমধ্যে সত্য নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। যেহেতু ফিকশন তাই লেখকের এখতিয়ার আছে মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখার। কারণ সব লেখকের কল্পনাপ্রসূত এবং বাস্তবের সাথে মিলে গেলে তা কাকতালীয়। এখানে ঘটনা বিকৃত হলেও তা কাল্পনিক।
❛চৌথুপীর চর্যাপদ❜ ইতিহাস আশ্রিত ফিকশন বই। বইয়ের প্লট সত্যিই দারুণ। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, দর্শন, শাস্ত্রচর্চার দারুণ সব ঘটনা উঠে এসেছে বইতে। ইতিহাস উপজীব্য ফিকশনে থ্রিল খুবই কম থাকে। কী হয় কী হয় এই ভাব থেকে মূলত লক্ষ্য থাকে কী হয়েছিল সেটা জানার। ইতিহাসের প্রচুর বর্ণনা থাকে। ইতিহাস পছন্দ না হলে অধিক বর্ণনা ভালো নাও লাগতে পারে।
দুটো সময়ের বর্ণনা লেখক করেছেন। একটা যোজনগন্ধার সময় এবং আরেকটা গন্ধকালীর সময়। গন্ধকালীর সময়ের বর্ণনাগুলো যোজনগন্ধার পুঁথি পাঠের মাধ্যমে উঠে এসেছে। বর্তমান আর অতীতের সমান্তরাল ধারা ছিল।
তবে আমার কাছে বর্তমান থেকে অতীতের বর্ণনাগুলো মনে ধরেছে বেশ। গন্ধকালীর উত্থান এবং ইতিহাস সত্যিই দারুণ লেগেছে। এরপর খু-স্তোনের আগমনের পরের ঘটনাগুলোও দারুণ ছিল। ভাষার কাঠিন্য ছিল অতীতের বর্ণনায় তবে পড়তে পড়তে একসময় সয়ে গেছে।
অতীত ইতিহাস পাঠের সময়ের ভালো লাগাটা বর্তমানে মিইয়ে গিয়েছিল অনেকটা। গন্ধকালীর বিপরীতে যোজনগন্ধাকে অনেকটাই নিষ্প্রভ মনে হয়েছিল। কঠিন ব্যাধী নিয়ে এত প্রতিকূল পরিবেশে চলার ব্যাপারগুলো অবাস্তব ঠেকেছে। জোর করে গেলানো হচ্ছে এমন। লামা, বিমলা, ভানু, অর্জুন চরিত্রগুলো ঠিক ছিল। হাফিজুর ওরফে হাফি হাবিলদারের চরিত্র রসবোধ মোটামুটি ধরনের ছিল। তবে শেষদিকে হাফির পরিবর্তন আমার দারুণ লেগেছে।

ইতিহাস আশ্রিত বইগুলোতে আগেই বলেছি সত্য মিথ্যা আর কল্পনার একটা সমাবেশ থাকে। তবে ফিকশনের এক পাক্ষিক বর্ণনাগুলো ফিকশন হিসেবেও যেন পড়তে গেলে ঠিক হজম হয়না। বিশেষ করে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। ধর্ম আদতেই স্পর্শকাতর এক বিষয়। এসব নিয়ে বর্ণনার ক্ষেত্রে যেকোন ধর্মাবলম্বী লেখকের-ই উচিত যথাসম্ভব সত্যের আশ্রয় নেয়া এবং কল্পনাকে একটু কম বাড়তে দেয়া। বাংলায় তুর্কির আক্র মণ এবং বৌদ্ধদের ওপর তান্ডবের যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন সেটা নিতান্তই একপাক্ষিক এবং মনগড়া। অতীতের চরিত্রদের মুখে লেখক বারংবার বলিয়েছেন ❛মুখখু তুরুষ্কু সেনা তারা এত দামী পুঁথির মূল্য কী বুঝবে❜, ❛বখতিয়ার খলজি স্বৈ রশাসক❜ ইত্যাদি। এমনকি তুর্কিদের বৌদ্ধ নিধনের বর্ণনা বেশ রসিয়ে, আবেগ দিয়ে, যথাসম্ভব নি ষ্ঠুরভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। এমনকি গো-মাংস ভক্ষণ এবং পরে শুদ্ধি হওয়ার যে বর্ণনা দিয়েছেন!
তবে আমার স্বল্পজ্ঞানে যেটুক জানি, পড়ার সূত্রে যা জেনেছি বখতিয়ার খলজি জানতেন না এগুলো বিদ্যালয় ছিল। বরং দূর্গ ভেবেই তিনি আ ক্রমণ করেছিলেন। যখন জানতে পেরেছিলেন এরপর আক্র মণের ইতিহাস আর নেই। এছাড়াও খলজিকে স্বৈরাচারী হিসেবে উপাধি দেয়াটাও অবাক লেগেছে। তিব্বতে সৈন্য হারিয়ে যে নেতা নিজেকে একা বন্দী করে ফেললেন সে কী করে স্বৈরা চারী হতে পারে? প্রাচীন ভারতে সেসময় তুর্কি প্রবেশের আগেই বৌদ্ধ ধর্ম হুমকীর মুখে ছিল। হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং রাজাদের অ ত্যাচারে তখনকার বৌদ্ধরা এমনিতেই কোণঠাসা ছিল। এবং দলে দলে ধর্মত্যাগ করছিল। কিন্তু লেখক এই ব্যাপারগুলো নিদারুণ সূক্ষভাবে চেপে গেছেন। বৌদ্ধধর্মের পতনের জন্য যেমন তারা দায়ী ছিল অর্থাৎ তাদের দু দলে ভাগ হয়ে যাওয়া তেমনি সেসময়ের রাজাদের অত্যাচারও দায়ী ছিল। শুধুমাত্র বৌদ্ধদের উপর তুর্কির আক্র শ ছিল এমনটা কখনো শুনিনি। পথে-ঘাটে-রাস্তায় বৌদ্ধদের হ ত্যা করেছে সেনারা এটাও নিতান্ত বানোয়াট। এক পাক্ষিক দোষারোপ কিংবা মনগড়া এসব কাহিনির জন্য পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যে খুব বিরক্ত হয়েছি। এই অংশটুক বাদ দিলে বইটি অবশ্যই উপভোগ্য। চর্যাপদের শ্লোকগুলোর দারুণ খেল দেখিয়েছেন সাথে ভারতের ইতিহাস এবং আয়ুর্বেদের যে বর্ণনা ছিল তা সত্যিই পড়তে ভালো লেগেছে।
যোজনগন্ধা-ই যে অতীতের গন্ধকালী সেটা শেষটুক আসার অনেক আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছি। শেষে বৈজ্ঞানিক যে বর্ণনাই থাকুক মাঝের ঘটনাগুলো তাই নির্দেশ করে। খু-স্তোনের সাথে বর্তমানের যাকে রিলেট করেছেন সেটাও ভালো লেগেছে।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, পুঁথি নিয়ে ❛চৌথুপীর চর্যাপদ❜ উপভোগ্য এক বই।
Profile Image for Diptajit Misra.
47 reviews27 followers
February 5, 2019
#পাঠ_প্রতিক্রিয়া
বইয়ের নাম: চৌথুপীর চর্যাপদ
লেখক: প্রীতম বসু
প্রকাশনা: self publishing
মূল্য: ৪০০₹

'ছিরিছাঁদ' আর 'পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল' পড়ে প্রীতমবাবুর অসামান্য লেখনী ও জ্ঞানের আধার সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় এই বইটা পড়ার অনেকদিন ধরেই ইচ্ছা ছিল। হাতে আসতে প্রায় ৪৫০ পাতার বইটা গোগ্রাসে শেষ করলাম তিন রাতে। যথারীতি লেখক তাঁর অসম্ভব জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন চর্যাগীতির অংশগুলো লিখতে। একেবারে নিখুঁত সন্ধ্যাভাষা। কিন্তু, বড়ই হতাশ করল চৌথুপী। থ্রিলারের থ্রিলটা নেই বললেই চলে। চর্যাগানে গন্ধকালীর জীবন বর্ণনা করতে গিয়ে যোজনগন্ধার ও তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া মানুষগুলোর জীবনে এতগুলো ক্রাইসিস এসে গেছে, বড্ড সব জড়িয়ে যাচ্ছিল। হাফিজুরও যদি কোনো চর্যাগানের চরিত্রের রিইনকারনেশন হত, মজা লাগত। বইয়ের সবচেয়ে হতাশার অংশ হল এত তথ্য। এত রকমের তথ্য গোটা বই জুড়ে আছে, একটা অংশ মাথায় রেজিস্টার করতে গেলে অন্য তথ্য ভুলে যাচ্ছি। আবার সেসব দিকে মন দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে খেই হারাচ্ছে যোজনগন্ধার ঘটনাগুলোর। তবে অনেক অজানা তথ্য পেলাম। হীনযান, বজ্রযান সম্পর্কে ধারণাটা আরও ক্লিয়ার হল। ক্লাস ইলেভেনে(বা টুয়েলভে) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাগীতির কথা পড়েছিলাম। সেই বিষয়টাকে আরও কাছ থেকে জানলাম। মোটামুটি কমন শব্দগুলো দেখলে এখন থেকে চিনতেও পারব আশা করি। মোটের ওপর ভালো বই।

পাঠ শুভ হোক। বইবাসা রইল।
Profile Image for Somen Sarkar.
60 reviews2 followers
December 27, 2024
অনেক দিন আগে পড়া হওয়া সত্ত্বেও রিভিউ শুধুমাত্র লেখা হয়নি, বইটা পড়ে আমি হতাশ। আর গুছিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা নেই। লেখকের অন্য বই পড়ে যতটা উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম তার বিন্দুমাত্র হতে পারলাম না। আশা রাখছি আগত বইগুলো আরও ভালো হবে।
Profile Image for Debolina Chakraborty.
33 reviews16 followers
July 11, 2023
বই - চৌথুপীর চর্যাপদ
লেখক - প্রীতম বসু
পৃষ্ঠা - ৪৪৪
মূল্য - ৪০০ টাকা

"কোড়ি দেখই সাপ বিস একু হেরে মণি॥"

আমরা যারা থ্রিলার ভালোবাসি তারা যা পড়ি তার ম্যাক্সিমামই চিপ আর ফালতু। হাতে গোনা একটা কি দুটো মনে রাখার মত। বাংলায় সে জিনিষ কোটিতে এক। যেমন প্রীতম বসুর সেল্ফ পাবলিশড এই বই - চৌথুপীর চর্যাপদ...

চর্যাপদ এককালে আমাদের চড় যা খাইয়েছিল তা ভোলবার নয়। ইশ, কম নাকানিচোবানি খাইয়েছে ইস্কুলে? তবে এই গপ্পো আপনাদের নাকানিচোবানি খাওয়ার সুযোগ দেবেনা। অত বোঝবার আগেই আপনাকে অতলে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। সে এমনি এক জায়গা যেখানে আলো-আঁধারী ভরা অথচ উজ্জ্বল বাংলার গৌরবের দীপটি। পদে পদে বিস্ময়। মনে হতেই পারে সেখানেই থেকে যেতে। কিন্তু তাও থাকতে পারবেন না। এই ব-দ্বীপ থেকে টেনে আপনাকে এমন এক অভিযানে নিয়ে যাবে যেখানে আপনি কোনোদিনও যাননি। অন্তত নতুন বাংলা সাহিত্য যাবার সাহস দেখায়নি।
ইংরেজিতে গপ্পো লেখা সহজ, ব্যবসা করা আরও সহজ। বস্তাপচা ভূসি মাল (পড়ুন - চেতন ভগত, রভিন্দর সিং) হোক আর অসাধারণ রিসার্চ করে লেখা কালজয়ী উপন্যাস (পড়ুন - মাইকেল ক্রিকটন বা ড্যান ব্রাউন) হোক, খুব সহজিয়া পদ্ধতিতে বেস্টসেলার হয়ে লক্ষ্যভেদ করে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে আসে। কারণ ইংরেজিতে গপ্পো পড়ার লোক অনেক (পাইরেসি হলেও)। এই আমরাই তো আছি।

বাংলা বলতে কি লজ্জা। বাংলা বই? রামোঃ।
বাংলায় বই পড়া মানে, অনেক রিচ কমে গেলো॥
(আমি জানি আমি একটু gen-z বিদ্রোহী আছি... বলতে হবে না 🥱)
এহেন প্রতিকূলতার মধ্যে লেখক যেভাবে প্রতি পাতায় খুব ঠান্ডা মাথায় নিজের অসাধারণ রিসার্চ তুলে ধরে লতার মধ্যে জড়িয়ে দিয়েছেন, তার সুবাস পাহাড়-নদী পেরিয়ে বহু যোজন দূরে ছড়িয়ে পড়ুক। হীনজনে বুঝবে না, মহাজন সুদে আসলে বুঝে নেবে। ব্জ্রাঘাতের মত লাগবে এ অভিযান। লেখকের কার্যম সিদ্ধম। পঙ্কজ এক গোলাপি পদ্মের ন্যায় এরকম রত্ন যে লেখা সম্ভব, সেই সাহস দেখানোর জন্য ধন্যবাদ প্রীতমবাবুকে। প্রীত হলাম। আপনিও হবেন। আকাশগঙ্গার উজ্জ্বল তারা এটি। শুধু ৩টি অনুরোধ. . . .
১ - বইটি কিনে পড়বেন। অর্থ এই পরিণত আগুনপাখিকে আবার ডানা মেলতে সাহায্য করবেই। তাছাড়াও কিছু বই থাকে যেগুলো কিনে রাখার মত। ছাপার কালির গন্ধে এ বই আরও তার শব্দকামরূপ বিকশিত করতে পারবে। বাঙালীর ইতিহাস যে কতটা সুবৃহৎ ও শ্রীধর তা বইটা না পড়লে বুঝবেন না।
২ - পড়া শেষ হলে লেখককে অবশ্যই অনুপ্রাণিত করবেন। দরকার আছে। 'ওনার' ওইসব মহাজাগতিক অনুপ্রেরণা আমাদের কাছে অনেক বেশী দামী। লেখকের মনে আমাদের ভালোবাসার ভোট পড়া খুব দরকার যাতে এরকম রিসার্চ আরো করেন উনি। আমাদের ইতিহাস, আমাদের গৌরব সারা পৃথিবীতে অবলোকিত হোক।
৩ - চর্যাপদ মানেই "উঁচা উঁচা পাবত্" নয়... সব জায়গায় নর নরৌ নরা করলে হয়না মশাই... একটু বুঝুন...
Profile Image for Arfaz Uddin.
91 reviews7 followers
May 21, 2022
বেশ আগ্রহের সাথে শুরু করলাম চৌথুপির চর্যাপদ। বাঙলার এক প্রাচীন ইতিহাস চর্যাপদ নিয়ে লেখক সুনিপুন ভাবে তার কলম চালিয়ে গিয়েছেন আর চর্যাগীতিকে তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। যার জন্য আমার কাছে লেখক কে নিসঃন্দেহে ইউনিক মনে হয়েছে।

এই বইয়ের প্লট বেস টা ছিলো বেশ কঠিন, চর্যাপদ আর তার একটা স্পেসিফিক ক্যারেকটার গন্ধকালীকে নিয়ে। এই গন্ধকালী যেনো প্রজাপতির মত মথ থেকে কোকুনে রূপান্তর হন থোরি সঞ্জিবনীতে৷ এছাড়া যোজনগন্ধা যে কিনা তার ই আরেক জন্ম। চৌথুপি এসে যুক্ত হয়ে যান এক অসম্ভব উত্তেজনা মূলক অভিযানে। যা তাকে নিয়ে যায় গন্ধকালীর জীবনযুদ্ধে।

আমার কাছে এই দুই টাইমলাইনের মধ্যে সবথেকে বেশি পছন্দ হয়েছে প্রাচীন টাইমলাইন টা কেননা সেখানে গন্ধকালীকে দেখানো হয়েছে, আর এই ক্যারেক্টারকে আস্তে আস্তে চমৎকার ভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। যদিও সান্ধ্য ভাষায় প্রয়োগ আর বেশ কিছু কঠিন বাংলা শব্দে বারংবার পড়ার ক্ষেত্রে হোচট খেতে হয়েছে। তবে সর্বদিক দিয়ে গন্ধকালী আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।

বর্তমান টাইমলাইন নিয়ে কথা বলতে গেলে আলোচোনার চেয়ে সমালোচোনাই বেশি হয়ে যাবে। কেননা এই কাহিনীতে লেখক বেশ দুর্বলতা দেখিয়েছে যা আমার কাছে বেশ হতাশাজনক মনে হয়েছে। যা আসলে থ্রিলার গল্পের থ্রিলার উপজিব্য কে ধরে রাখতে গিয়েও পারেনি। এ দিক দিয়ে গল্পটা যেনো বেশ ভেঙে পড়ে।

লেখকের লেখনী এক কথায় অসাধারন। তার লেখা প্রথম বই যা আমি পড়লাম আর তার লেখার স্টাইলে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এছাড়া সব মিলিয়ে ইতিহাসকে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। আর লেখক যেভাবে প্রতিটা ব্যাক্ষা দিয়েছেন তা আসলে প্রশংসাযোগ্য।

সর্বশেষে, ইতিহাসের পাল্লাটা বেশি হলেও ইতিহাস খুজতে গেলে আপনার জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য চৌথুপীর চর্যাপদ উপযুক্ত বই। তবে একটা থ্রিলার বই বলতে গেলে এই বইটি বেশ দুর্বল৷ সব মিলিয়ে উপভোগ্য। টক মিষ্টি যেনো!
Profile Image for Md Abdul Kayem.
177 reviews3 followers
June 14, 2022
'চৌথুপীর চর্যাপদ' বইটা পড়ে ভালো লাগলো। বিশেষ করে অতীতের গন্ধকালী ও খু-স্থানের আখ্যান পড়ে।  অতীতের গল্পে প্রথমদিকের বর্ণনাগুলো অপেক্ষাকৃত কঠিন মনে হলেও পরবর্তীতে কাহিনির প্রতি আগ্রহের কারণে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতাটা কেটে গিয়েছিলো। লেখকের চর্যাপদ নিয়ে খেলাটা চমৎকার উপভোগ করেছি।  আগুনপাখি গন্ধকালীর জার্নিটা একদম মাথায় গেঁথে গেছে বলা যায় সাথে অতীতের অন্যান্য চরিত্রগুলোও।

বইটিতে গন্ধকালীর জার্নিটা আমার কাছে ভালো লাগলেও বর্তমান কাহিনিটা অনেকটা খাপছাড়া লেগেছে,  বর্তমানে এসে লেখক যে চরিত্র গুলো এনেছেন ছেত্রী, যোজনগন্ধা, লামা, হাফি হাবিলদার, ভানু, বিমলা... এদের বর্ণনাগুলো অতটা স্ট্রং লাগেনি আমার কাছে, বরং কিছুটা অতিনাটকীয় মনে হয়েছে। বিশেষ করে মামাজী কারেক্টারটাই বেশি খাপছাড়া মনে হয়েছে। এই কারেক্টার নিয়ে আরেকটা বিশদ গল্প হলে সম্ভবত এমনটা হতো না।

আরেকটা বিষয় খারাপ লেগেছে তা হলো লেখক ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিকৃত বা পক্ষপাত তুষ্ট ভাবে ইতিহাসকে উপস্থাপন করেছেন। তবে অন্যান্য বিষয় বিশেষ করে চর্যাপদ, জ্যোতিবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয় লেখক চমৎকার ভাবে তুলে এনেছেন, এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মের রীতিনীতি নিয়ে এই বইটি পড়ার আগ পর্যন্ত অনেককিছুই জানা ছিলো না।

বইটির  শেষে এসে হাফি হাবিলদারকে যে পার্সোনালিটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আগের হাফির সাথে ঠিক মিলাতে পারিনি। তবে তার মাঝেমধ্যে বলা জোক্স গুলো হাসির খোরাক জোগিয়েছিলো। যোজনগন্ধা কারেক্টারটাও ভালো লেগেছে কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার বর্ণনা গুলো অতিনাটকীয় মনে হয়েছে তবে তার সাথে অতীতের সাথে কানেক্টেড করে দেওয়াটা ভালো লেগেছে।
Profile Image for Soumya.
8 reviews1 follower
April 25, 2022
এক পরিচিতের মুখে থ্রিলার genre শুনে বইটি কেনা এবং পড়তে শুরু করা। কিন্তু বস্তুতই এই বই থ্রিলারের অপমান। সমান্তরাল একাধিক গল্পের সমাপতন ঘটলেও বাঁধন যেন খুবই আলগা।

গন্ধকালী কিংবা খু-স্তোনের গল্প গুলো আকর্ষণীয় হলেও বর্তমান সময়ের গল্পটা একেবারেই বর্ণহীন। গল্পের শুরুতে গতি থ্রিলার উপযুক্ত এবং আকর্ষণীয় হলেও, শেষের দিকে এসে যেন জোর করে দায়সারা ভাবে গল্প শেষ করার চেষ্টা। বস্তুত লেখা পড়ে মনে হয় লেখক নিজেই হয়তো উপন্যাসের শেষের দিকে গিয়ে নিজের উপন্যাসের ওপর নিজেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন।

তবে এই বইয়ের জন্য দেওয়া আমার থ্রি স্টার অন্য কারণে। এমন বিস্তৃত রিসার্চ বাংলা বইয়ে আমি খুব কমই দেখেছি। ভাষার গঠন প্রণালী, তার বিবর্তন, তার ইতিহাস এবং একই সাথে বৌদ্ধ ধর্মকে জড়িয়ে আমাদের প্রাচীন বাংলার ইতিহাস এমন সুন্দর তথ্য সমৃদ্ধ ভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য আমি লেখকের কাছে কৃতজ্ঞ।

অনেকেই এই বইয়ের রিভিউ হিসেবে মন্তব্য করেছেন যে এই বই নাকি তথ্যবহুল হতে গিয়ে গতিহীন, বিরক্তিকর এবং 'জ্ঞান দেওয়া' বই হয়ে গিয়েছে। তাদের মতামতকে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি, বইটির বিস্তার এবং প্রচেষ্টাকে আমার কুর্নিশ। গল্পের মোড়কে এমন ঝরঝরে ভেবে ইতিহাস তথা প্রাচীন বাংলার ব্যাকরণ ও বিবর্তনকে তুলে আনার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
Profile Image for Shreyashi Bhattacharjee Dutta.
81 reviews9 followers
May 17, 2023
আমেরিকা ফেরৎ গবেষক যোজনগন্ধা চৌথুপীতে পাওয়া একটি মূর্তির ছবি দেখে চমকে যায়। তার মনে হয় সে এই মূর্তি আগেও দেখেছে। কিন্তু কোথায়?
অনুসন্ধান করতে, ক্যান্সারের মত রোগকে তুচ্ছ করে সে পৌঁছে যায় চৌথুপীতে। সেখানে তাঁর হাতে আসে একটি চর্যাপদ। সেটা ছিল এক বৌদ্ধ ভিক্ষুনী গন্ধকালীর জীবনী। বিধি বাম। যোজনগন্ধা তাঁর এই প্রাচীন ভাষা ও চর্যাপদ পড়তে জানার কারণে জড়িয়ে পড়ে গভীর চক্রান্তে। তার সাথে জড়িয়ে পড়ে হাফি হাবিলদার, লামা, বিমলা ও অর্জুনের মত কিছু মানুষ।

একদিকে এগিয়ে চলে বন্ধিনি যোজনগন্ধার কাহিনী, আরেকদিকে বহু যুগ আগের এক বৌদ্ধ থেরী গন্ধকালীর জীবনসংগ্রাম। পাঠকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রাচীনকালের বৌদ্ধ বাঙালিদের ঘিরে বীরত্ব ও পাণ্ডিত্যের আখ্যান।
---
এখানে বর্তমান সময়ের যোজনগন্ধার গল্প থেকেও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে প্রাচীন যুগের গন্ধকালীর গল্পটি। সেই সময়ে হিন্দু ধর্মের বর্ণবৈষম্য, তুরস্কদের অত্যাচারে সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন মহাবিহারের ভিক্ষুদের তাঁদের অমূল্য পুঁথি বানানোর আপ্রাণ চেষ্টার কাহিনী সত্য হোক বা কাল্পনিক, বইটি কিন্তু এক শ্বাসে পড়ে না ফেলে শান্তি হবে না। পড়ার যাত্রাটি অতি মনোমুগ্ধকর।

এটা পঞ্চানন মঙ্গলথেকেও বহুগুণ বেশি ভালো লেগেছে। যারা পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল পড়েছেন ও ভালোবেসেছেন, তাঁদের বলবো এই বইটিও পড়ুন।
Displaying 1 - 30 of 52 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.