আকবর, রাজনীতি করে। পছন্দ করে একজনকে। যার জন্য কাউকে খুন করতেও দ্বিধা করবে না। আসিফ, ছাত্র। টিউশনি করে। চুপচাপ, অমিশুক। শাহেদ, হাসিখুশি মিশুক একজন। কিন্তু, এক রাতে সে বেরিয়ে পড়ে। নিজেকে খুঁজতে। কেন? নায়লা কেন ঠিক হাসিখুশি নয়? সে কি হতে যাচ্ছে কোন পরিস্থিতির শিকার? মনজুর, খুবই সাধারন ব্যবসায়ী। এক রাতে অপহৃত হলো? কেন? সে নিজেও জানে না! কার লোভের শিকার হতে যাচ্ছে ছোট একটা পরিবার? আকবর, শাহেদ, আসিফ, নায়লা, মনজুর ভিন্ন ভিন্ন সব চরিত্র। তারা সবাই কাছাকাছি, তবে, জনারন্যে থেকেও সবাই একা। এই সব চরিত্রের নানা জটিলতা, ষড়যন্ত্র, অপহরন আর আমাদের জীবনের কাছাকাছি গল্প নিয়ে শরীফুল হাসানের ভিন্নধর্মী উপন্যাস “জনারন্যে একা কয়েকজন।”
Shariful Hasan hails from Mymensingh, Bangladesh. He has spent his childhood by the banks of Brahmaputra river. He completed his Masters in Sociology from University of Dhaka and is currently working in a renowned private organization.
Shariful's first novel was published on 2012 titled Sambhala. With two other books, this captivating fantasy trilogy has received widespread acclimation both within and beyond the borders of Bangladesh. The Sambhala Trilogy was translated in English and published from India.
Although his inception consisted of fantasy and thriller, he has later worked on a variety of other genres. These works have been received fondly by the Bangladeshi reader community. Lot of his works have also been published from different publications in West Bengal.
Award- Kali O Kalam Puroshkar 2016 for 'অদ্ভুতুড়ে বইঘর'
-- গল্পটি নিজেকে খুজে পাওয়ার, গল্পটি বিষন্ন ভালোবাসার জীবনের গল্প
"অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে প্রথমে কিছু দেখা যায় না। তারপর আস্তে আস্তে সব অবয়ব পরিস্কার হয়ে আসে। জীবনটাও মনে হয় এরকম। গভীর মনোযোগে না তাকালে সবকিছু অস্পষ্ট লাগে।"
আমাদের সত্ত্বা গুলো বড্ড এলোমেলো। কখনো তারা এক সাথে একক ভাবে চলে, কখনো বা ছিন্ন হয়ে বহুমুখী হয়ে যায়। আমরা চাই সেটাকে বসে আনতে, স্থিতিশীল করতে। তার জন্য নিজেকে আগে খুজে পেতে হয়। নিজেকে খুজে পাওয়া আসলেও কি অনেক সহজ কাজ? নাকি আমরাই নিজেদের সত্ত্বা গুলোকে হারিয়ে যার যার পথে চলতে থাকি, আর ধরে নিই এইটাই আমার পথ ছিল?
শরিফুল হাসান এর বইগুলো আমাকে ছুয়ে যায়। তার লেখার ভেতর ছুয়ে যাবার প্রবণতা অনেক বেশি। হয়তো সে জন্যই সে অনেক প্রিয় একজন লেখক।
গল্পের প্রধান চরিত্র বা সাইড চরিত্র নিয়ে আমি কেন জানি ভাবতে পারছি না। প্রতিটা বার মনে হচ্ছে এরা সবাই মিলেই যেন আমাদের এক একটা অংশ। আমরা চাই কোনো ক্ষেত্রে আকবরের মত হতে, চাই আসিফের মত স্বপ্ন দেখতে কখনো বা শাহেদের মত সব কিছু ছেড়ে নিরুদ্দেশের পথে যেতে।
কিন্তু ভালোবাসার মানুষ গুলোর আকুতি, তাদের মায়া আমাদের ছেড়ে যেতে দেয় না, আমরা অতটা সাহসী না। তাই তৈরী করে নিই নিজেদের অসংখ্য সত্ত্বা।
আমি ঠিক কীসের আশায় এই বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম, সেটা খেয়াল নেই। বোধহয় রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাপূর্ন কোনো থ্রিলারের সন্ধানে ছিলাম আমি। বইটা অত্যন্ত গতিময়। লেখার মাঝপথে "এই বর্ণনা এখানে কেন?" টাইপের প্রশ্ন তোলার সু্যোগই পাইনি আমি। কোনো চরিত্রকে অগভীর মনে হয়নি। বরং স্মরণজিতের প্রথম দিককার লেখার মতো একটা অদ্ভুত মায়া ছড়িয়ে গেছে, জড়িয়ে গেছে চরিত্রগুলোর দিনরাত্রিতে। হয়তো সেজন্যই গল্পের শেষটা মানতে পারিনি। পারছি না। তাই একটি তারা খসালাম। ব্যস।
চমৎকার একটা জার্নি শেষ হলো। অসাধারন একটা সামাজিক থ্রিলার উপন্যাস। আশাকরি লেখকের এই জনরার আরো বই সামনে পাবো।কিন্তু দুঃখের বিষয় লেখকের এই জনরার বইগুলো সাম্ভালার মতো এতোটা আলোচিত হয়নি।
শেষের ১০-১৫ পেজ বাদে পুরাই লো এভারেজ বই! এতো ভাল ভাল রিভিউ সবার, মনে হচ্ছে আমি কি সেইম বই টাই পড়লাম! বন্ধুদের সব গুলো সিকুয়েন্স ই মনে হচ্ছিলো ফেসবুক গল্পের মতো।
কিছু কিছু বই থাকে সেগুলো পড়ার পর মনের মধ্যে হাহাকার তৈরি হয়।কিসের যেন শূন্যতা এস ভর করে। কিসের যেন আক্ষেপ।কিসের যেন না পাওয়া। সম্ভবত আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে মিলে গিয়ে এক হয়ে যায় বলেই বইয়ের সেই গল্পের মজাহ এত হাহাকার আর আক্ষেপ খুঁজে পাই। "জনারন্যে একা কয়েকজন" সেই রকমই একটা বই ।বইটা পড়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। বলা ভালো মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত এই মন খারাপটাই উপভোগ করছিলাম।আরেকটা বই পড়া শুরু করার আগ পর্যন্ত এই রেশ যাবে না। পৃথিবীর ৯০ ভাগ মানুষের আসলে চয়ায় পাওয়া খুব অল্প। কিন্তু বিধাতা কোন এক অজানা কারণে এই মানুষগুলোর চাওয়া পাওয়া গুলো অপূর্ণ রাখে। কিন্তু যে ১০ ভাগ মানুষের চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই বিধাতা তদের দুই হাত ভরে দেয়। যত চায় তত দেয়। আরো দেয়......... আরো দেয়। কয়েকজন অল্প চাওয়া মানুষকে নিয়ে রচিত হয়েছে "জনারন্যে একা কয়েকজন"।তাঁদের হয়তো খুব বেশি চাওয়ার নেই কিন্তু ভাগ্য দেবী যে তাঁদের প্রতি সদয় না। এর কারণ সম্ভবত বিশাল এই জনারন্যে আমরা প্রত্যেকটা মানুষই একা। আমাদের চাওয়ার যেমন কোন মিল নেই তেমনি আমাদের সেই অনুপাতে পাওয়ারও মিল নেই। প্রত্যেক আলদা মানুষ তাই দিন শেষে না পাওয়ার হাহাকারে ভোগে ।আর সে কারনেই দেখা যায় চারপাশে মানুষের ভীড়ের মাঝেও আমরা সবাই একা।
বইয়ের কাহিনী আসলে খুব সরল। কয়েকজন বন্ধু বান্ধব। তাঁদের পরিবার আর সেইসাথে তাঁদেরকে ঘিরে থাকা কিছু মানুষের। গল্পটা তাঁদের ভালোবাসার। তাঁদের চাওয়া পাওয়ার। আর দিনশেষে তাঁদের পাওয়া ,না পাওয়ার।
বইটা ভালো লাগার অন্যতম কারণ বইয়ের গল্প বলার ধরণ আর সেইসাথে শরীফুল ভাইয়ের লেখনী। সমকালীন থ্রিলার কে শরীফুল ভাই অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। যার শুরুটা হয়েছিল "মেঘ বিষাদের গল্প" দিয়ে। আশা করি ভাই এই জনরায় আরো লিখবেন।
"অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে প্রথমে কিছু দেখা যায় না। তারপর আস্তে আস্তে সব অবয়ব পরিস্কার হয়ে আসে। জীবনটাও মনে হয় এরকম। গভীর মনােযােগে না তাকালে সবকিছু অস্পষ্ট লাগে।"
বইটা নিয়ে যতটুকু প্রত্যাশা ছিল ঠিক ততটুকুই পূরণ করেছে লেখক। আসলে সত্যি বলতে বইটা আমার খুব মনে ধরেছে। বইটা লেখক উৎসর্গ করেছেন নিজেকেই। এ থেকে বোঝা যায় এই বইটা তাঁর বইগুলোর মধ্যে প্রিয় একটা বই। বইয়ের গল্পটা শুরু হয় একদম সাদামাটাভাবে, শেষও হয় সেরকম সাদামাটাভাবেই। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে এই বইয়ে। পুরো বই জুড়েই কেমন একধরনের হাহাকার আর বিষন্নতার ছাপ।
তারপর? "চারপাশে হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখে আসিফ। সবার অভিব্যক্তি আলাদা, সবার জীবন আলাদা। এরা সবাই একা। কেউ জানে, কেউ জানে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটতে থাকলো আসিফ। তারপর মিশে গেলো জনারন্যে। "
অনেকদিন পরে কোন বই পড়ে মনে হয়েছে, কেন পড়লাম? এমন না যে, বইটা খারাপ। খুবি ভালো লেখনি, খুব সাধারন একটা গল্প, কিন্তু এই সাধারনত্বই বইটাকে দিয়েছে অসাধারনত্ব।
খুব সাধারন একটা গল্প। সাধারন আর স্বাভাবিক। ঠিক আপনার আমার জীবনের মত। কিন্তু এই সাধারনেরই অসাধারন হয়ে ওঠার গল্প সাম্ভালা খ্যাত উপন্যাসিক শরীফুল হাসানের বিষন্নতায় ভরানো উপন্যাস জনারন্যে একা কয়েকজন।
আকবর, শাহেদ, আসিফ, নায়লা, মনজুর, এরা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সাধারন মানুষগুলোর মতই। এদের জীবনও আমাদের মত স্বাভাবিক সুন্দর, নিত্য নৈমিত্তিক কাজকর্মে ভরা। কিন্তু জীবনে তো চড়াই উৎরাই আসবেই। কখনো বাধ ভেঙ্গে বেনো জল, কখনো বা হঠাৎ করেই কালবোশেখির ঝড়। আর তার অভিশাপে তছনছ হয়ে যায় শান্ত সুন্দর পরিবারগুলো। জনারন্যে একা কয়েকজন তেমনি কতগুলো পরিবার তথা মানুষের গল্প যা আপনাকে ভাবাবে, হয়ত কাঁদাবেও। পড়ন্ত বিকেলে মনটা উদাস করে দিবে।।।
গত বইমেলায় শরীফুল হাসান তার মেঘ বিষাদের গল্প উপন্যাসে কিছু ভিন্ন জগতের হাতছানি দিয়েছিলেন। এই উপন্যাসটা তেমনি একটু সাধারনের মধ্যেও অসাধারন একটা উপন্যাস। গতকাল রাফিউজ্জামান সিফাতের সমকালীন উপন্যাস পদ্ম বলে, এসো পড়ার পর থেকেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে ছিল। আজ ভাবলাম মনটা হয়ত একটু ভাল হয়ে যাবে এই উপন্যাসটা পড়ার পর। কিন্তু না মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। মনটাকে উথালপাথাল করে দেয়া একটা লেখা। তবে কেন জানি আগে থেকেই পরিণতি সম্পর্কে একটা আভাস পাচ্ছিলাম। তবুও মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম, না ভুল বুঝছো তুমি, ভাল হবে, সবারই ভালো হবে। হয়ত হয়েছেও তাই। কি জানি? দিনশেষে তো আসলেই জনারন্যে সবাই-ই একা....
#রিভিউ জনারণ্যে একা কয়েকজন শরীফুল হাসান সামাজিক উপন্যাস বাতিঘর প্রকাশনী আসিফ ভার্সিটিতে পড়া এক ছাত্র। ভালোবাসে একজনকে । কখনো বলা হয়নি তাকে। সারাজীবন হয়তোবা এই না বলা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে, নাকি অন্য কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য???
আকবর রাজনীতি করে। বড় এক রাঘব বোয়ালের এসিস্ট্যান্ট সে। আসিফের বেস্ট ফ্রেন্ড। আকবরের বোনের বাসাতেই আসিফ আর আকবর একসাথে থাকে। আকবর এক চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থেকে একটা মেয়েকে দেখে বারান্দায় বসে থাকতে। একজনকে খুন করতে চায় সে। কাকে খুন করতে চায় সে , কি লেখা আছে তার কপালে??
মনজুর, আফরোজা। আকবরের বোন ও দুলাভাই । আসিফ,আকবর, আর ছোট সুমিকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। একদিন বিনা কারণে অপহরণ করা হলো মনজুরকে।কোন ঝড় ধেয়ে আসছে তাদের দিকে???
শাহেদ, আসিফের বন্ধু। একদিন সিদ্ধান্ত নিলো জনকোলাহল ছেড়ে চলে যাবে, নিজেকে খুঁজবে। সে কি নিজেকে খুঁজে পাবে, নাকি ফিরে আসবে।
এরকমই আমাদের আশপাশের পরিচিত চরিত্রদের মত কিছু মানুষ নিয়েই শরীফুল হাসানের উপন্যাস জনারণ্যে এক কয়েকজন। ২৩৮ পেজের এক সামাজিক উপন্যাস এটি। আর দশটা সামাজিক উপন্যাসের মতই। সাধারণভাবেই কাহিনীর বিল্ডআপ, প্যাচবিহীন, কয়েকটা ক্যারেক্টাররের প্রতিনিয়ত চলাফেরা, কাজকর্ম আর ক্রাইসিস সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। কিছু যায়গা হয়তো একঘেয়ে লাগতে পারে, তবে বেশ কিছু জায়গা অতুলনীয়। যেমন আসিফ আর নায়লার বৃষ্টির মধ্যে রিকশায় ঘুরার সময়টা, আকবরের অজানা রমণীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকাটা অথবা সাহেদের ট্রেনের গেটে বসে থাকাটা সাধারণ কিন্তু ঐ সময়ের ব্যাখ্যা লেখক দুর্দান্ত আবেগময় ভাবে দিয়েছেন। জীবনমুখী কিছু অসাধারন উক্তি খুঁজে পাবেন এ বইয়ে।...."পৃথিবীতে অনেক দাগ খাওয়া মানুষ আছে। আজ আরেকটা যোগ হলো😓.."
সবথেকে নিষ্ঠুরতা লেখক দেখিয়েছেন গল্পের শেষভাগে। ভাষা নাই আমার কোনো বলার মত। নিঃসন্দেহে এত সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য লেখকের। তবে মাঝে মাঝে চরিত্রে ঢুকে গেলে আপনার লেখনির চেয়ে চরিত্রের বাস্তবতা হতবাক করে দেয়। এখানে সেটাই ঘটেছে। প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ অনেক উপন্যাসে এরকম ট্র্যাজেডি উপহার দিয়েছেন। তুলনায় যাচ্ছি না ,তবে হুমায়ুন স্যারের মৃত্যুর পর শরিফুল হাসানের কিছু সামাজিক উপন্যাসে সেরকম ধাক্কা খুঁজে পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে একেকটা চরিত্রের পরিনতি খুব অসহায় আর মর্মান্তিক ছিলো। রীতিমত ধাক্কা খেয়েছি। আমি অতটা দুর্বল মানুষ না। তারপরেও বুকের ভেতরে যেয়ে লেগেছে কেন জানি। সবথেকে খারাপ লেগেছে প্রিয় চরিত্রের ট্র্যাজেডিতে। সে শুধু স্বপ্ন দেখেছিল সাধারণ একটা জীবনের, পরিবারের সুখের। সেটার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি সে। মানুষগুলি একা , অবশেষে জনারণ্যে থেকেও তারা একা। কথা আর না বাড়ায়। সামাজিক উপন্যাস প্রেমীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য , যুগোপযোগী একটা লেখা জনারণ্যে একা কয়েকজন।
" দাঁড়ান, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি। নার্স চলে গেলে শাহেদের পাশে দাড়ালো আসিফ। নিজেকে খুঁজতে বেরিয়ে হারিয়ে গেছে শাহেদ। নিজের মাঝেই। অন্য কোথাও হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যেতো, কিন্তু নিজের মাঝে হারিয়ে গেলে, সেটা কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায়!"
পাঠ অভিজ্ঞতা:
কথা বলছিলাম শরীফুল হাসানের লেখা "জনারন্যে একা কয়েকজন" বইটা নিয়ে। বইয়ের নামের সাথে চরিত্র গুলোও মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে যেনো। আসিফ, আকবর, শাহেদ, মনজুর, নায়লা, আফরোজা সবাই আলাদা আলাদা চরিত্রের হলেও জনারন্যের মাঝেও তাঁরা যেনো খুবই একা। যাদের প্রতিটি মুহূর্তই ছিলো কিঞ্চিৎ সুখ কিংবা বিষাদে ঘেরা একেকটি দিনগুলি। কারো প্রিয়জন হাঁরানো, কারো লোকালয় ছেড়ে একা হয়ে যাওয়া, কারো কাছের মানুষদের খুব করে চাওয়া কিংবা কারো একটু সুখের জন্য অনেক অপেক্ষার প্রহর গুনে একটু স্বস্তি হিসেবে অবসান চাওয়া। এসবগুলো নিয়েই সাজানো হয়েছিলো বইটার প্লট।
বইটা যখন পড়ছিলাম তখন মনটা একরকম বিষন্নতায় ছেয়ে গিয়েছিলো। গল্পের প্লট টা সাধারণ হলেও লেখকের কলমে অসাধারণ ফুটিয়ে তুলেছেন তা বলার অবকাশ নেই। যাঁরা শরীফুল হাসানের লেখার সাথে পরিচিত আছেন তাঁরা জানেন লেখক সাধারণ কিছুকে অসাধারণে রূপান্তর করতে ভালোই মুন্সিয়ানা দেখিয়ে ছাড়েন। শব্দশৈলী কিংবা চরিত্র বুননে কোনোরকমের খুঁত এসে চর্মচক্ষুতে লাগেনি। লেখকের অন্যান্য বইগুলোর তুলনায় এই বইয়ের আলোচনা খুব একটা নেই বললেই চলে। আমি হলফ করে বলতে পারবো যারা বইটা পড়েছেন একমাত্র তাঁরাই জানেন বইটা সেরাদের কাতারে অনায়াসে ঠাই পাওয়ার মতোন।
বাদবাকি:
প্রতিটি বইতে টুকটাক টাইপিং মিসটেক কিছু না কিছু থাকেই সে আঙ্গিকে এই বইতেও বেশ কিছু সমস্যা ছিলো; যেমন একটা কাহিনি তে নির্দিষ্ট চরিত্র তে অন্য একটা চরিত্রের নাম ব্যবহার করা হয়েছে যেমন: মনজুর এর জায়গায় আসিফ নাম টা অনেকবার এসেছে। এতে পড়ায় খুব একটা ব্যাঘাত হয় নি। এছাড়াও বানান ভুল ছিল কিছু। পরবর্তী এডিশনে বাতিঘর এইসব সমস্যার সমাধান করবে আশা রাখি।
এই বইটা পড়ার দীর্ঘ একটা সময় মন খারাপ করে বসে ছিলাম। গত বছর তার মেঘ বিষাদের গল্প পড়ার পরই মনে মনে চাচ্ছিলাম যাতে এরকম বই তিনি আরও লেখেন। বোধহয় মন খারাপ করা বই পড়ার মাঝেও আলাদা তৃপ্তি আছে।
ইমতিয়াজ মাহমুদের লেখা নিঃসঙ্গতার কিছু লাইন আমার প্রায়ই মনে পড়ে। মনটা যখন বিষন্ন হয়ে উঠে, তখন লাইনগুলো আওড়াই।
আন্দামান সাগরের এক একলা দ্বীপে এক সাধু যখন একটা পাখির কিচিরমিচিরে অতিষ্ঠ হয়ে ভাবছিল কীভাবে আরো একা হওয়া যায়, তখন জাকার্তার জনাকীর্ণ সড়কে হাজার হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে একটা লোক একা একা হেঁটে যাচ্ছিল।
এই লাইন আবারও মনে পড়ছে। শরিফুল হাসানের 'জনারণ্যে একা কয়েকজন' পড়ে মনে হয়েছে এই লাইনগুলোই যেন গল্প হয়ে ধরা দিয়েছে বইয়ের পাতায় কালো অক্ষরের এক গল্প হয়ে। যেখানে কিছু চরিত্র এমনই এক জনারণ্য শহরের অলিগলি থেকে দালানকোঠার জঙ্গলে একটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে একা একা পথ চলতে চলতে।
এই জীবনের প্রবাহমান সময়ে প্রকৃতি আর পৃথিবীর আচরণে বিস্মিত হতে নেই, জীবনের কাটিয়ে দেওয়া দীর্ঘ সময় অনেক কিছুই বদলে দেয়, অনেক কিছুই বদলাবেই। এখানে প্রতিটা মানুষ যতই একত্রে থাকার অভিনয় করুক সবাই এক আলাদা অভিব্যক্তি নিয়ে জীবন পথের পথিক হয়, বয়ে নিয়ে যায় প্রত্যেকে আলাদা আলাদা গল্প।
শহরের বুকের তেমনই কিছু মানুষের গল্প একে অপরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ভালোবেসে বিয়ে করা আফরোজা আর মনজুরের সংসারের গল্পে টাকার স্রোত ম্রিয়মাণ হলেও সুখের স্রোতের গতি ছাড়িয়ে গেছে অনেক দূর। ছোট্ট মেয়ে সুমি আর আফরোজার ভাই রাজনীতির সদ্য নেতা আকবরও সেই স্রোতে বয়ে চলা নৌকার যাত্রী। যে নৌকায় যাত্রী হয়েছে আকবরের বন্ধু ভাবুক আসিফও।
আকবর শহরে সদ্য গজিয়ে উঠা নেতা আরমান আলীর ডানহাত হয়ে রাজনীতির পাখা উড়াচ্ছে, পছন্দও করে একজনকে যার জন্য মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছে হয় একজনকে খুন করতে। একই বিছানায় থাকে অথচ আসিফের সাথে আকবরের কোনো মিলই নেই। আসিফ ছাত্র মানুষ, টিউশনি, বন্ধুরা আর গ্রামে রেখে আসা মাকে নিয়েই তার দিন চলে যায়। মাঝে মাঝেই শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোর মাঝ দিয়ে কিংবা তেহেরির দোকানের ভীড়ে একা একা ভাবুক হয়ে দিন কাটিয়ে দেয়। এমন দিনগুলো অতিক্রম করতে গিয়ে কখন যে আফরোজার সংসারের একজন হয়ে উঠেছে সে টেরই পাইনি।
আসিফের বন্ধু নায়লা, শাহেদ, সুমনা, পলি, কামাল এরা সবাই এই শহরের বাসিন্দা। প্রত্যেকেই এক একটা মুখোশের নিচে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের। আসিফ মাঝে মাঝে উদাস হয়ে নায়লার দিকে তাকিয়ে আকাশপাতাল ভাবনার অতলে হারিয়ে যায়। নায়লারও ভাবনার কোনো শেষ নেই। মৃত্যপথযাত্রী বোন শায়লা আর দুলাভাই হিরণের সংসারের গল্পের সাক্ষী হতে তার মাঝে মাঝে ভালো লাগলেও বোন শায়লাকে হারিয়ে ফেলার ভয় মাঝেমাঝেই কাবু করে ফেলে তাকে। মধ্যরাতের বিষন্ন মনে প্রায়ই যে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে সঙ্গী হয় দুলাভাই আর বোনের গল্পের আসরের কলকলিয়ে হেঁসে উঠা শব্দের।
এদের সবার মাঝে থেকেও এক ভিন্ন গল্পের নায়ক শাহেদ, যে গল্পে এই চঞ্চল হাসিখুশি ছেলেটা একদিন সবকিছু ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয় নিজেকে খুঁজে পেতে। আমারও মাঝে মাঝে শাহেদের মতো নিরুদ্দেশ হতে ইচ্ছে করে। সবাই একসাথে থেকে আলাদা আলাদা গল্প বলে যায়, যে গল্পে ঝড় আসছে, ভয়াবহ ঝড়। যে ঝড় অনেকের জীবন বদলে দিবে। তবুও পৃথিবীর এক প্রান্তের উথাল-পাতাল ঝড় অন্য প্রান্তের রৌদ্রজ্বল দিনে কী আর প্রভাব ফেলে! দিন শেষে যার যায়, সেই বুঝে জীবনের মানে। সবার গল্প কী আর সমান্তরাল হয়!
এ গল্পের চরিত্রের প্রতিটি মানুষই তার জীবনে এক সতন্ত্র গল্প নিয়ে জীবন বয়ে চলে। সেখানে সুখ দুঃখ উত্থান পতন দুটোই থাকে। জীবন কোনো সিনেমা নয়, এখানে কখন কার জীবনে সুখের বন্যা বয় আর কার সহজসরল নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে চলতে থাকা জীবন মুহূর্তেই তছনছ হয়ে যায় তা কেউ বলতে পারে না। তবুও কারো জীবনই থেমে থাকে না। গল্পের চরিত্রগুলোও সময়ের পরিক্রমায় জীবন স্রোতে এগিয়ে যায়।
শরীফুল হাসান সেই জীবনের গল্পই মলাটবন্দি করে নিয়েছেন কালো অক্ষরে, যেখানে প্রতিটা চরিত্র এক স্বতন্ত্র গল্প নিয়ে একে অপরের গল্পের মাঝ দিয়ে জীবন বয়ে নিয়ে যায় একা একা। জীবন কোনো সিনেমা নয়, সব মানুষই তার স্বপ্নের ন্যায় জীবন অতিক্রম করতে পারে না। সবার জীবনে সহজসরল ভাবে সবকিছু পাওয়া সম্ভব হয় না। জীবনের সুতো ক্ষণে ক্ষণে বদলে গিয়ে কখন কার গল্পে জুড়ে যায় তা ঐ সুতো হাতে বসে থাকা সৃষ্টিকর্তাই জানেন। লেখক তেমনই এক বিষন্ন করে দেওয়া গল্প বলেছেন।
যে গল্পের প্রতিটি চরিত্রই ভিন্ন ভিন্ন গল্প বলে। সবাই খুব কাছাকাছি জনারণ্যে থেকেও সবাই একা একা গল্প বয়ে চলে। তারা সবাই নানান জটিলতা, ষড়যন্ত্র, অপহরণ আর আমাদের জীবনেরই কোনো না কোনো গল্পের অংশ হয়েই যেন লেখক লিখেছেন 'জনারণ্যে একা কয়েকজন'।
এ গল্প মনকে বিষন্ন করে দেয়, গল্প শেষে কারো কারো বদলে যাওয়া জীবন চোখের কোণে অশ্রু জমা করে দেয়। বৃষ্টিস্নাত কোনো দিনে এমন এক বিষন্ন করে দেওয়া গল্প পড়তে চাইলে পাঠক নির্দ্বিধায় হাতে তুলে নেন শরীফুল হাসানের 'জনারণ্যে একা কয়েকজন' বইটি। যে বইটি শেষ করেও যার আবেশ রয়ে যাবে আরো অনেকক্ষণ। আর গল্প শেষে প্রচ্ছদের দিকে যখন ফিরে তাকাবেন তখন মনে হবে এই প্রচ্ছদ সেই গল্পেরই কথা বলছে।
চারপাশে হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখে আসিফ। সবার অভিব্যক্তি আলাদা, সবার জীবন আলাদা। এরা সবাই একা। কেউ জানে, কেউ জানে না । দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটতে থাকল আসিফ। তারপর মিশে গেল জনারন্যে ।
এক বিষাদময় আখ্যান বই। জনারন্যের মাঝে নিজেকে একা মনে করাটাই সব থেকে কষ্টের বোধহয়। সেই একা মানুষ খুঁজে বেড়ায় এমন এক সঙ্গীকে যার সাথে তার আনন্দ,দুঃখের কথা বলতে পারে, কেউ তা খুঁজে পায় আবার কেউ খুঁজে পায় না। আসিফ ও আকবর নামের দুই যুবকের সাথে গল্প আগায় দুই দিকে। আসিফ তার মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কথা গুলো বলার জন্য সাহস খুঁজে বেড়ায় অন্যদিকে আকবর তার বোনের জামাইকে খুঁজে বের করার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দৌড়ে যাচ্ছে। শায়লার জন্যও খারাপ লাগছে অনেক। খুবই সাদামাটা গল্প কিন্তু শরীফুল হাসানের দুর্দান্�� লেখনীতে সেই সাদামাটা গল্প আর চরিত্র গুলো পাঠকের মনে দাগ ফেলে যাবার জন্য যথেষ্ট। সমাপ্তিটাও মনমতো হয়েছে। শাহেদ চরিত্রটার ধোঁয়াশাটা রয়ে গেলো। তার অতীত নিয়ে কিছু পাই নি। কেনো সে রহস্যময় হয়ে থেকেছে তা বলা হয় নি। লেখকের এমন জনরার বই সামনে আরো আসবে আশা করি।
বইয়ের কিছু জায়গায় চরিত্রের নামে অনেক সমস্যা হয়েছে। আসিফের জায়গায় মনজুর আবার মনজুরের জায়গায় আসিফ চলে এসেছে।
এই ইট পাথরের নগরীর তিলোত্তমা শহরে, কত বিচিত্র মানুষের ভীড় ছড়িয়ে আছে সবখানে। কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে রঙিন চোখে, কেউ ছুটে চলে অবিরাম সাফল্যের দিকে। কেউ বা আছে বড় বিচিত্র, তাঁরা ঐশ্বর্য্যের চূড়ায় থেকেও নিজের মতো সব ছেড়��� ছুড়ে চলে যেতে চায় অজানা কোনো গন্তব্যে। যেখানে এই শহরের কোলাহল তাঁকে ছুঁতে পারবে না।
এই জনারণ্যে তবুও থাকে একা কয়েকজন। তাঁদের জীবনের গল্প কোথাও গিয়ে একসাথে মিলে যায়। এরা একাকী থেকে যায়, অনেক সময় নিজের কথা ভাবার এদের ফুসরত নেই। বাঁচতে হয় হয়তোবা অন্যের জন্য। কারণ এরা কৃতজ্ঞতার বোঝায় নুয়ে আছে। ভার হালকা করার আর সুযোগ নেই। এই শহুরে জনারণ্যে একা কয়েকজনের গল্প শোনা যাক তবে।
🪴 আসিফ 🪴
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটি পরিবার পরিজন ফেলে একলা ঢাকায় থাকে। মফস্বলে মা এবং বোন থাকে। বাবা মারা গিয়েছে বহুদিন। ঢাকায় একটি সাবলেটে উঠেছে। ভার্সিটিতে বন্ধুমহলে ছয়জনের একটি গ্রুপ নিয়ে চলে আসিফ। যদিও সবার মধ্যে সেই যেন কেমন একটু চুপচাপ। কারো সাথে কথা বলে না। ভাবুক অবস্থায় দিনযাপন করে। বন্ধু শাহেদের ভাষায় ভ্যান্দামারা। কিন্তু তবুও এই ছেলেটির মন ভালো। যেখানে সাবলেট থাকে সেই বাসার সবাইকে ভালোবাসে সে। একটা জায়গায় অনেকদিন থাকলে বোধহয় তাঁদের জন্য এমনিতেই মায়া জন্মে যায়।
🪴 নায়লা 🪴
নায়লা মেয়েটি আসিফের ক্লাসমেট এবং বন্ধু। ছয়জনের দলের একজন। আসিফ মনে মনে নায়লাকে পছন্দ করে। পছন্দ বলাও ভুল, এটা ভালোবাসা। তবে নায়লাকে সেটা বলতে পারে না। নায়লা অবশ্য একটু একটু বোঝে আসিফ তাঁর প্রতি দূর্বল। কিন্তু নায়লা এভাবে কারো সাথে নিজেকে জড়াতে চায় না। কারন তাঁর জীবন আর দশটা সাধারণ জীবন নয়।
মৃত্যুশয্যায়ী বোনকে কথা দিয়েছে তাঁর চলে যাবার পর নায়লা সব দেখেশুনে রাখবে। বোন শায়লার হাতে বেশি সময় নেই। দুলাভাই হিরণ এর মধ্যেই নায়লাকে নিজের আয়ত্তে নিতে শুরু করেছে। নায়লা দুলাভাইয়ের গাড়ি করে ভার্সিটি যায়। নায়লার বোধহয় এ জীবনে কাউকে আলাদা করে ভালোবাসা হবে না।
🪴 বাকি বন্ধুরা 🪴
শাহেদ, কামাল এবং আরো দুই মেয়ে বন্ধু আছে আসিফের সার্কেলে। এদের মধ্যে কামাল সিরিয়াস পড়ুয়া। মেয়েগুলো অবশ্য নিজেদের মধ্যে গল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবে সবচেয়ে যার কথা বেশি বলা দরকার সেটা হলো শাহেদ। এই ছেলেটি হলে থাকে। দেখলে মনে হবে মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান।
একদিন শাহেদ কাউকে কিছু না বলে চলে গেল নিরুদ্দেশ। একদম সত্যি কারো সাথে যোগাযোগ নেই। বলেছিল আসিফকে। আসিফ অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ ভাবেনি বিষয়টা। কিন্তু এই শাহেদের মা যখন শাহেদের খোঁজে ওদের গ্ৰুপের সাথে দেখা করতে এলো সবার চক্ষু চড়কগাছ। কিন্তু কেন? আর শাহেদ আসলে কোথায় গেল?
এবারের গল্পটা আসিফের সাবলেট ফ্ল্যাটের তিন মানুষের।
🪴 আকবর 🪴
আকবর রাজনীতি করে। আরমান আলীর ডান হাত সে। এভাবেই দিন কাটছে। আকবর বলে কাউকে সে খু ন করবে। সত্যিই কি কাউকে খু ন করবে? না কথার কথা? আকবর রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় হতে চায় বলেই আরমান আলীর দলে আছে। কিন্তু আরমান আলীর মেয়ে সুরভীর হাবভাব সন্দেহজনক। আকবরের কাছে কী চায় এই মেয়ে? আকবর তো পছন্দ করে লামিয়াকে। সুরভীর ঘনিষ্ঠ হলে আরমান আলীর রোষানলে পড়তে হবে আকবর তা জানে।
🪴 আফরোজা 🪴
আকবরের বোন আফরোজা মেয়ে হিসেবে ভালো। ছোটবেলার প্রেমিক মনজুরের হাত ধরে পালিয়ে এসে ঢাকায় সংসার শুরু করে। তারপর মেয়ে সুমির জন্ম। ছোট্ট সংসারটা আফরোজা আগলে রাখে।
ভাই আকবর এবং আসিফকেও ভালোবাসে মেয়েটা। যত্ন করে খাবার রেখে আসে দুজনের রুমে গিয়ে। এই মেয়েটার জীবনে নেমে এলো দুঃসময়। স্বামী মনজুরকে কারা ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোথায়? মনজুর কী করেছে? স্বামীকে কীভাবে ফিরে পাবে আফরোজা?
🪴 মনজুর 🪴
লোকটা প্রথমে গার্মেন্টসে কাজ করতো। সেখানে চাকরি চলে যাবার পর ধরলো কী যেন ব্যবসার কাজ। দুই রুমের অফিস নিয়ে সে এবং আরেকজন কাজ করে। কিন্তু হঠাৎ করেই বাসার প্রায় কাছ থেকে মাইক্রোবাস এসে তুলে নিয়ে গেল মনজুরকে।
মেয়ের জন্য কেনা আপেল কমলা রাস্তায় পড়ে রইলো। মনজুর নিখোঁজ। আদৌ কী আর খোঁজ মিলবে?
🪴 পাঠ প্রতিক্রিয়া 🪴
শরীফুল হাসান ভাইয়ের বই পড়তে হবে আর টুইস্ট থাকবে না সেটা কী হয়। সামাজিক জনরার উপন্যাস হলেও এখানে শেষের দিকে আপনি টুইস্ট খুঁজে পাবেন। অবশ্য সেটার জন্য লেখক ধীরে সুস্থে এগিয়েছেন। তাড়াহুড়ো দেখা যায়নি। আস্তে আস্তে গল্প এগিয়ে যাচ্ছিল পরিনতির দিকে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এইবার আমার আন্দাজ ঠিক ছিলো টুইস্ট ধরার ক্ষেত্রে। প্রতিবার গুলিয়ে যেত।
"জনারণ্যে একা কয়েকজন" বইটির শুরুতে গল্প এগিয়েছে মন্থর গতিতে। এবং একে একে যখন চরিত্রগুলো নিয়ে আসা হয় তখন আসলে নড়েচড়ে বসতে হবে কারণ গল্পের বেশ ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট শুরু হয়েছে মাঝপথে। তবে লেখকের বর্ণনা বরাবর আমার ভালো লাগে। ওয়ান কাইন্ড অফ আর্ট ফিল্ম দেখছিলাম যেন। খুব সিম্পেল গল্প অথচ কী সুন্দর এগিয়েছে বর্ণনায় বৈচিত্র্য থাকায়। চরিত্রগুলোকে একসাথে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন কাজ অবশ্যই।
এই ধরনের বইয়ের ক্ষেত্রে প্লট অনুযায়ী গল্পের গতি মন্থর হবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু শরীফুল ভাইয়ের লেখা দ্রুত এবং সাবলীল। তিনি যতটুকু টুইস্ট রাখতে চেয়েছেন আস্তে ধীরে গল্পে সেগুলো এসেছে। শরীফুল ভাইয়ের এই ঘরনার আরো কিছু বই আছে এবং এইজন্য অনেকে মনে করেন শরীফুল ভাইয়ের লেখা একই ধরনের। কিন্তু নাহ আমি অন্তত সেটা মনে করি না।
"জনারণ্যে একা কয়েকজন" হয়তো লেখকের সেরা কাজ নয়। কিন্তু খুব সফট গল্প এবং বেশ ভালো বর্ণনা করেছেন লেখক গল্পটা। এই গল্পটা এই জনারণ্যে ঘেরা নগরীর কিছু একা মানুষজনের। তাঁরা একা হয়েছে একেক কারণে এবং বন্ধুত্ব, পরিবার, ষড়যন্ত্র, রাজনীতি কিংবা কৃতজ্ঞতাবোধ এই বইয়ের চরিত্রগুলো শোনাবে জীবনের আলাদা আলাদা গল্প। যে গল্প হয়তো আপনার মনেও তৈরি করবে তাঁদের জন্য মায়া।
"অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে প্রথমে কিছু দেখা যায় না। তারপর আস্তে আস্তে সব অবয়ব পরিস্কার হয়ে আসে। জীবনটাও মনে হয় এরকম। গভীর মনােযােগে না তাকালে সবকিছু অস্পষ্ট লাগে।"
'জনারণ্যে একা কয়েকজন' বইটাতে কয়েকজন মানুষের গল্প বলা হয়েছে যারা জন অরণ্যে থেকেও বাস্তবিকই একা। আচ্ছা আপনাদের কারো কখনো এমন হয়েছে যে, হাজার মানুষের ভিরে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, সবাই আপনার পরিচিত, কিন্তু মনে হচ্ছে আসলে আপনি একা? জীবনের কোনো এক সময় প্রায় সব মানুষের জীবনেই এমন পরিস্থিতি আসে। কেউ একাকীত্ব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে, কেউ হয়তো টেরই পায় না। অনেকে হয়তো ডিপ্রেশনে আত্মহত্যাও করে। আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের কারো সাথে কোনো প্রেমের সম্পর্ক নেই, পড়ালেখায়ও ভালো, বাবা মায়ের টাকা পয়সারও অভাব নেই, কিন্তু হুট করে আত্মহত্যা করে বসে। আমরা বাইরে থেকে ভাবি ছেলেটা তো ছ্যাকা খায়নি, টাকা পয়সারও অভাব নেই, বাবা মায়েরও কোনো সমস্যা নেই, তারপরও কেন আত্মহত্যা করলো? নিশ্চয় কোনো কুকর্ম করেছে। একবারও ভাবি না ছেলেটা এত কিছুর ভিড়েও একা থাকতে পারে, একাকীত্ব তিলে তিলে শেষ করে দিতে পারে। না, এসব আমরা ভাবি না, এসব ভাবার সময় আমাদের নেই। আসলে আমরা নিজেদের বাইরে কাউকে নিয়ে ভাবতে পছন্দ করি না।
আসিফ ঢাকায় একটা বাসায় সাবলেট থাকে। আফরোজা এবং মঞ্জুরের ছোট্ট সংসার। সুমি নামের একটা ফ���টফুটে মেয়েও আছে তাদের। হুট করে চাকরি ছেড়ে দেয়ায় বাসা ভাড়া এবং সংসারের খরচ কমাতে আফরোজার ছোটভাইয়ের সাথে সাবলেট হিসেবে আসিফকে উঠায়। অল্প কয়দিনেই আকবরের বন্ধু হয়ে যায় আসিফ। আকবরের বোন দুলাভাইকেও নিজের বোন দুলাভাই মনে করে। আসিফ এমন একটা ছেলে যাকে দূর থেকে দেখে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের কথা মনে হয়। যে দ্বীপে কেউ বসবাস করে না। মাছ ধরা নৌকাও এড়িয়ে চলে।
আসিফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ভার্সিটিতে ওর বন্ধুবান্ধব একদম কম। যেকয়জন ক্লোজ তারা হয়তো ওকে ভালোভাবে চিনে বলেই ওর সাথে মেশে। তাদের মধ্যে নায়লা মেয়েটাকে মনে মনে পছন্দ করে আসিফ। হাবভাবে বোঝা যায় নায়লাও ওকে পছন্দ করে। সুমনা আর পলি সারাক্ষণ আছে পড়াশুনা আর হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে। কামাল তো পড়াশুনার বাইরে কথা বলতেও নারাজ। তাদের মধ্যে একজন ব্যতিক্রম, যার সাথে আসিফের ভালো জমে। সে হলো শাহেদ। মাস তিনেক পর পর আসিফ একদিন শাহদের হলে সার রাত থাকে, নিষিদ্ধ আনন্দ উপভোগ করে।
নায়লার বড়বোন শায়লা অসুস্থ, সারাদিন কাটে বিছানাতেই। একবার বোনম্যারো ট্রান্সফার করা হয়েছিল, কী এক জটিলতায় আবার নাকি অপারেশন করতে হবে। সারাদিন ভার্সিটিতে মেতে থাকার চেষ্টা করলেও বাসায় আসলেই বিষণ্ণতা চেপে বসে।
আর আকবর আছে রাজনীতি নিয়ে। ওর বিশ্বাস ভালো কোনো নেতার শেল্টার পেলে ও অনেক উপরে উঠতে পারবে। একজনকে পছন্দ করে, যার জন্য যে কাউকে খুন করতেও দ্বিধা নেই কোনো।
এইযে এখানে অনেকগুলো চরিত্রের কথা বললাম এদের কেউই এখানে মূখ্য নয় আবার কেউই গৌণ নয়। মনে হতে পারে গল্পটা আসিফের, আবার মনে হবে গল্পটা আসলে আকবরের, কিংবা শাহেদের কিংবা নায়লার। এমনকি কামাল কিংবা সুমনার। লেখক প্রত্যেকটা চরিত্র এমনভাবে গঠন করেছেন, কোনো চরিত্রকেই দুর্বল ভাবতে পারবেন না আপনি। এই গল্পে একক কোনো নায়ক নেই। প্রত্যেকেই তার নিজ গল্পের নায়ক।
গল্পটা শুরু থেকেই একদম সাদামাটাভাবে এগিয়েছে, শেষও হয়েছে সাদামাটাভাবেই। বইটা লেখক উৎসর্গ করেছেন নিজেকেই, এ থেকে বোঝা যায় এই বইটি তার বইগুলোর মধ্যে প্রিয় বই। কোনো এক কথা প্রসঙ্গে আমাকেও বলেছিলেন এই বইটা বিশেষ করে পড়ার জন্য। আমি যেহেতু থ্রিলার পড়ে অভ্যস্ত তাই কোনো একটা গুরুতর পরিস্থিতি না আসা পর্যন্ত ঠিক যুৎ পাচ্ছিলাম না। সেইদিক হিসেব করলে এই বইয়ে সেরকম পরিস্থিতি আসতে অনেক সময় লেগেছে এবং বইয়ে পুরোপুরিভাবে ঢুকে যেতে আমারও সময় লেগেছে। তবে একবার ঢুকে যাওয়ার পর শেষ না করে বের হওয়ার আর সুযোগ পাইনি।
শরীফুল হাসানের লেখার হাত যে কেমন সেটার প্রমাণ তো আপনারা সাম্ভালা, রাত্রি শেষের গান, আঁধারের যাত্রী যারা পড়েছেন তারা জানেনই। উনি যেমন দুর্দান্ত ফ্যান্টাসি থ্রিলার লিখতে পারেন তেমনি সামাজিক গল্পও লিখতে পারেন। সেসব গল্পে সমাজের বিভিন্ন অসংগতির সাথে সাথে থ্রিলারের উপাদান থাকে বলে অনেকেই সেটাকে সামাজিক থ্রিলারও বলে থাকেন। তবে এই বইটাতে অন্যান্য বইগুলোর মত থ্রিলারের উপাদান বলতে গেলে ছিলই না, সেক্ষেত্রে আমি এটাকে সামাজিক থ্রিলার না বলে বরং সমসাময়িক গল্প বলব।
এই বইটা আমার কাছে ভালো লেগেছে। কিন্তু লেখকের অন্যান্য বইয়ের তুলনায় দুর্বল লেগেছে অনেক। হতে পারে কোনো কারণে এটা লেখকের প্রিয় বই, কিন্তু আমি তার মত করে বইটাকে প্রিয় করতে পারিনি। আমার কাছে বরং ছায়া সময় কিংবা রাত্রী শেষের গান এর থেকে অনেক ভালো লেগেছে। আর সাম্ভালার সাথে তো তুলনাই চলে না।
বাতিঘরের অন্যান্য বইয়ের তুলনায় এই বইয়ের বাইন্ডিং খুবই দুর্বল। চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী বানান ভুল এবং টাইপিং মিস্টেক তো আছেই, এমনকি কয়েক জায়গায় চরিত্রের নামই বদলে গেছে। এটা বেশিরভাগ হয়েছে মঞ্জুরের ক্ষেত্রে। একবার তাকে সোহেল বলা হয়েছে আবার তাকে আসিফ বলা হয়েছে। আশা করব পরবর্তী সংস্করণে যেন এই বিষয়গুলো দেখা হয়।
আপনি যদি কখনো, এক মুহূর্তের জন্য এই জন অরণ্যে একা অনুভব করে থাকেন তবে এই বইটা আপনার জন্য। হ্যাপি রিডিং...
শরীফুল হাসান ভাইয়ের রিয়েলিস্টিক ফিকশনের মধ্যে আমার পড়া দ্বিতীয় বই এটা। প্রথম বইটা - "মেঘ বিষাদের গল্প" পড়ার পর এই বইটা থেকে প্রত্যাশা ছিল অনেক উঁচু আর শরীফুল ভাই চমৎকার ভাবে সেই প্রত্যাশা মিটিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক ঝাঁক উজ্জ্বল চোখের ছেলেমেয়ে কেমন একটা ঘোর লাগা সময় পার করছে। রাজনীতির মাঠের নতুন খেলোয়ার আকবরকে পিছু টেনে ধরে রেখেছে মায়ার বাঁধন। আর একটু ভালো একটা জীবনের স্বপ্ন দেখা ছোট ব্যাবসায়ী মনজুর কীভাবে যেন পা পিছলে তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দুনিয়ায়!
গল্পটা বেশ ছোট কিন্তু প্রতি মূহুর্তে এই গল্পে পাঠক নতুন কিছু খুঁজে পাবে। এই বইটাও প্রচলিত অর্থে থ্রিলার না, কিন্তু মানুষের জীবনটাই তো একটা নন-স্টপ থ্রিলার! জন-মানুষের এই অরণ্যের মাঝে থেকেও আমরা সবাই আসলে কতটুকু একা আর অসহায় আরো একবার সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন শরীফুল ভাই - শুভকামনা থাকল তাঁর জন্য। বইটা শেষ করে আপনার মনে হবে, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল - আমরা কি আসলেই খুব একা নই?
কাহিনি সংক্ষেপঃ আসিফ একজন ছাত্র। ঢাকায় থাকে বন্ধু আকবরের সাথে। টিউশনি করে নিজের খরচাদি চালায়। আসিফ একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের ছেলে। ক্যাম্পাসের বন্ধু শাহেদ, নায়লা, কামাল, সুমনা ও পলি ছাড়া কারো সাথে সেভাবে মিশতে পারেনা। গোপনে সে নায়লার ওপর অদ্ভুত এক টান অনুভব করে। কিন্তু তাকে বলতে গেলেই অদ্ভুত এক সঙ্কোচের অনুভূতি ঘিরে ধরে ওকে।
আকবর টুকটাক রাজনীতি করে। বড় বোন আফরোজা ও দুলাভাই মনজুরের সাথে তার বসবাস। লামিয়া নামের রহস্যময়ী এক রমণীকে ভালোবাসে সে। এমনকি তার জন্য খুন করতে হলেও কখনো পিছপা হবেনা আকবর। রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী আরমান আলীর ডানহাত হয়ে উঠলো সে ঘটনাক্রমে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার মন জুড়ে শুধু একটাই নাম - লামিয়া।
মনজুর একজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী। সাদাসিধে স্বভাবের এই মানুষটা নিজের ছোট্ট ব্যবসা আর পরিবার ছাড়া কিছুই বোঝেনা। কিন্তু কোন এক রাতে অজানা কারণে অজ্ঞাত কিছু দুর্বৃত্তের দ্বারা অপহৃত হলো সে। এর কারণ যেমন মনজুর জানেনা, তেমন জানেনা তার পরিবারও। এমনকি কেউ এটাও জানলোনা, আদৌ মানুষটা বেঁচে আছে কিনা।
বোহেমিয়ান স্বভাবের যুবক শাহেদ হঠাৎ করেই একদিন ঘর ছাড়লো। পাড়ি জমালো অজানার উদ্দেশ্যে। মানুষের এই অরণ্যের মাঝ থেকে যতোটা সম্ভব দূরে সরে যেতে চাইলো সে। এদিকে শাহেদের অপেক্ষায় নিজের অজান্তেই দিন গুনছে এক অভিমানী তরুণী৷ শাহেদ কি আসলেও কখনো ফিরবে চিরচেনা জনারণ্যে, নাকি চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে - জানেনা সেই তরুণী।
শামসুল আলম নামের দুর্বোধ্য স্বভাবের মানুষটার পেশা কি, কেউ জানেনা। অথচ পুরো গল্পটার সাথে এই মানুষটার রয়েছে অদ্ভুত এক যোগাযোগ। এই গল্পটা এগিয়ে গেছে আসিফ, শাহেদ, মনজুর, আফরোজা, নায়ল��র মতো শামসুল আলমের হাত ধরেও। গল্পটা যেমন জনারণ্যে শুরু হয়েছিলো, শেষও হলো সেই চিরায়ত জনারণ্যেই। এটাই যেন ভবিতব্য। এটাই যেন ধ্রুব সত্য।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ 'সাম্ভালা' ট্রিলোজি খ্যাত লেখক শরীফুল হাসানের ভিন্নধর্মী এক উপন্যাস 'জনারণ্যে একা কয়েকজন'। ২০১৭ সালের একুশে বইমেলায় তাঁর লেখা 'মেঘ বিষাদের গল্প' উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিলো। থ্রিলারের বাইরে একদম ভিন্ন ধরণের এই উপন্যাস পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি লিখলেন চিরচেনা সামাজিক প্রেক্ষাপট কেন্দ্রিক 'জনারণ্যে একা কয়েকজন'।
সাধারণ একটা পরিবারের কয়েকজন সদস্য ও তাদের সাথে সম্পর্কিত আরো কিছু মানুষকে লেখক এই উপন্যাসে এঁকেছেন দারুন এক আবেগ মাখিয়ে। পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, আরে! এই গল্পটা তো আমারো হতে পারতো! বাহুল্যহীন ভাষায় বেশ ঝরঝরে ভঙ্গিতে শরীফুল হাসান পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মানব মনের পরিচিত নানা আবেগের সাথে। যেখানে আছে প্রেম, বিভ্রান্তি, প্রতিহিংসা, দায়িত্ববোধ, লোভ আর বিশুদ্ধ বন্ধুত্বের মতো ব্যাপারের যুগপৎ আনাগোনা। মুগ্ধতার আবেশ এখানে ছড়িয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
ভিন্নধর্মী উপন্যাসের মতো শরীফুল হাসান তাঁর এই উপন্যাসের বর্ণনাতেও ভিন্নধর্মী (!) বানানরীতি ব্যবহার করেছেন। ই-কার ও ঈ-কারের ব্যাপারটা বাদ দিলেও বেশ কিছু বানান বেশ দৃষ্টিকটু লেগেছে। যেমনঃ লেখক 'শাড়ি পরা' কথাটার বদলে তিনি ব্যবহার করেছেন 'শাড়ি পড়া' কথাটা। পরিধান করা অর্থে কথাটা 'পরা'-ই হবে, 'পড়া' না। এসব বাদেও অনেক টাইপিং মিসটেক ছিলো পুরো বই জুড়ে। এই ব্যাপারটাও দারুন বিরক্তি উৎপাদন করেছে। এক চরিত্রের জায়গায় অন্য চরিত্রের নাম বেখেয়ালে ব্যবহার করার বিষয়টাও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যেমনঃ এক জায়গায় লেখক মনজুরের পরিবর্তে আসিফকে বসিয়ে দিয়েছেন। আরেক জায়গায় দেখলাম, হুট করেই আরিফ নামের এক ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে কোন পূর্বাভাস ছাড়াই।
এসব থেকে একটা ব্যাপার নিশ্চিত হয়েছি। সেটা হলো, 'জনারণ্যে একা কয়েকজন' প্রকাশ হওয়ার আগে প্রুফ রিডিংয়ের কোন বালাই-ই ছিলোনা। কথায় বলে, তাড়াহুড়ার কাজ কখনো ভালো হয়না। এই বইয়ের ক্ষেত্রে কথাটা দারুন ভাবে মিলে গেছে বলেই মনে হয়েছে আমার। অথচ অসাধারণ একটা প্লট মাথায় নিয়ে উপন্যাসটা লিখেছেন শরীফুল হাসান। 'সাম্ভালা' ট্রিলোজি, 'ঋভু', 'আঁধারের যাত্রী' ও 'মেঘ বিষাদের গল্প'-এর মতো কাহিনি যাঁর কাছ থেকে পাঠক পেয়েছে, তাঁর কাছে আশাটাও অবশ্যই বেশি থাকবে। একটা চমৎকার রচনার বারোটা বাজানোর জন্য প্রুফ রিডিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে উদাসীনতাই যথেষ্ট। আশা করি ভবিষ্যতে এই ব্যাপারগুলো কাটিয়ে উঠবেন লেখক। তাঁর জন্য শুভ কামনা।
তানিয়া সুলতানার দৃষ্টিনন্দন অঙ্কনে ডিলান সাহেবের করা প্রচ্ছদটা দারুন লেগেছে। যাদের 'মেঘ বিষাদের গল্প' ভালো লেগেছিলো, হয়তো তাদের কাছে ভালো লাগবে এই বইটাও। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
আশেপাশে অনেক মানুষের থাকলেও কখনো কখনো নিজেকে এক মনে হয়। ভিড়ের মধ্যে থেকেও নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চলে। কখনো পাওয়া যায়, কখনো না। প্রতিটি মানুষ মুখোশের আবরণে নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করে। নিজের মনে জমে থাকা কথাগুলো বলতে দ্বিধা করে। তাই হয়তো সেই কথাগুলো জমতে জমতে পাহাড়সম হয়ে যায়। আর এভাবেই একদিন বিশাল পাহাড়ের চাপে পিষ্ট হতে হয়।
এই গল্পে অনেকগুলো মানুষ আছে। সবার আগে আসিফের কথা বলা যাক। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে পরিবার পরিজন ফেলে একলা ঢাকায় থাকে। একটি সাবলেটে উঠেছে। যেখানে আকবর হয়ে ওঠেছে তার বন্ধু। আকবরের বোন আফরোজাকে সে নিজের বোনের মতোই সম্মান করে। আকবরের দুলাভাই মনজুর যেন নিজের ভাইয়ের চেয়েও বেশি। পরিবার না হয়েও কোনো কোনো কেউ কেউ নিজের পরিবারের চেয়েও বেশি হয়ে ওঠে। এ যেন তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। বন্ধুমহলে ছয়জনের একটি গ্রুপ নিয়ে চলে আসিফ। যদিও সবার মধ্যে সেই যেন কেমন একট। চুপচাপ, কারো সাথে কথা বলে না। ভাবুক অবস্থায় দিনযাপন করে। বন্ধুদের ভাষায় ভ্যান্দামারা। আসিফ হাসে, কিছু বলে না।
আসিফের এক বন্ধু নায়লা। মেয়েটা কেমন যেন। ঠিক হাসিখুশি নয়। আবার প্রানবন্ত। আসিফ বুঝতে পারে না। শুধু বুঝে, এই নায়লার প্রতি দিনদিন আসক্ত হয়ে পড়ছে। একেই কি ভালোবাসা বলে? নায়লা কি তাকে গ্রহণ করবে? আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, নায়লা কাউকে ভালোবাসে না তো? এই নায়লার বড়ো বোন শায়লা মৃ ত্যুর সাথে লড়াই করছে। সে জানে তার জীবনের শেষ সময় উপস্থিত। তবুও সবার মাঝে নিজেকে রেখে একটু বাঁচার চেষ্টা। কিন্তু এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে শায়লা কি পারবে সবার সাথে হাসিমুখে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে।
আকবর রাজনীতি করে। আরমান আলীর ডান হাত সে। এভাবেই দিন কাটছে। আকবর বলে কাউকে সে খু ন করবে। সত্যিই কি কাউকে খু ন করবে? না কথার কথা? কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আকবরের দুলাভাই মনজুরকে কেউ অ পহ রণ করে নিয়ে গেছে। এমন এক ঘটনা পুরো বদলে দিলো আকবরের পরিবার। রাজনীতির প্রভাব কাজে লাগিয়ে তোলপাড় করে ফেলা আকবর কি তার দুলাভাইকে খুঁজে পাবে? ফিরিয়ে আনতে পারবে তার বোনের কাছে? ঠিক কি কারণে মনজুরকে অ পহ রণ করা হয়েছে? কী দোষ তার? না-কি পরিস্থিতির শিকার?
শরীফুল হাসান ভাইয়ের বই পড়তে গিয়ে যদি আপনি প্রত্যাশা করেন, যা ঘটবে ভাবা হচ্ছে তা আদৌ হবে না; সব ভালোয় ভালোয় শেষ হবে, তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। লেখক তার আপন নিয়মে চলবে। এক বিষণ্ণ অদ্ভুত সুন্দর বইয়ের শেষটা আরও বিষণ্ণ করে তোলায় তার চেয়ে সেরা হয়তো কেউ নেই। আমি বরাবরই সামাজিক উপন্যাস জনরায় লেখকের লেখনীতে ভরসা করি। তিনি এবারও সেই ভরসা রেখেছেন।
"জনারণ্যে একা কয়েকজন" বইটির শুরু কিছুটা অগোছালো। অনেকগুলো চরিত্রের সাথে লেখক পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন। চরিত্রের মধ্য দিয়ে গল্প এগিয়ে গিয়েছে। দারুণ কিছু অনুভূতি দিয়ে গেছে। চরিত্রগুলো যেন একাকীত্বের ধারক। অনেক মানুষের ভিড়ে থেকেও কোথাও যেন একা। আমি লেখকের বর্ণনার খুব বড়ো ভক্ত। এত দারুণভাবে চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলা খুব সহজ নয়। যে চরিত্রগুলো আপন মনে হয়, প্রিয় মনে হয়। কঠিন পরিণতি হবে জেনেও চরিত্রগুলোর জন্য প্রার্থনা অচিরেই মন থেকে আসে।
উপন্যাসের সবচেয়ে ভালো লেগেছে ধীরে সুস্থে গল্পের রাশ একটু একটু ছেড়েছেন। কোনো না কোনো রহস্য সবসময় জীবন্ত রেখেছেন। গল্পের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন আকবর কাউকে খু ন করতে চায়। কিন্তু কাকে? সেই রহস্য খুব সহজে খোলাসা করেননি লেখক। আবার শায়লা বড়ো কোনো অসুখে মৃ ত্যু পথযাত্রী। কী হয়েছে শায়লার, এই রহস্য সমাধান করেছেন অনেক পরে। ততক্ষণে লেখকের লেখার গতি আর জানার আগ্রহে গল্প এগিয়েছে অনেকদূর। ভালো লেগেছে লেখকের এই প্রয়াশ। এছাড়া বন্ধুত্বকে এক দারুণ অনুভূতি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। বন্ধুদের মধ্যে খুনসুটি, ভালোবাসা, আবেগ সব যেন ছিল খাপেখাপ। এই অংশ মনে জায়গা করে নিয়েছে।
"জনারণ্যে একা কয়েকজন" হয়তো লেখকের সেরা কাজ নয়। কিন্তু আমার ভীষণ পছন্দের বই হয়ে থাকবে। বিশেষ করে বন্ধুত্বের গল্প, ভালোবাসার অনুভূতি, কিংবা পারিবারিক সম্পর্কের বাইরেও যে সম্পর্ক লেখক তুলে ধরেছেন!
জনারন্যে একা কয়েকজন এর অর্থ কি? জনঅরন্যে একা হয়ে থাকা কয়েকজন মানুষ? কিন্তু এও কি হয়?
হয় হয়তো, অন্তত শরীফুল হাসান তো তাই লেখেন। সামাজিক থ্রিলার বলে যে জন্রায় উনি লিখছেন, সেই জন্রা অন্যান্য থ্রিলার জন্রার চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে উঠছে দিন কে দিন। হলি গ্রেইল খোলার এডভেঞ্চারের চেয়ে আমার বরং ভালো লাগে সমাজের প্রাত্যহিক অপরাধ এর ঝড়ে এলোমেলো হওয়া পরিবারের গল্প পড়তে। ব্যাপারটা হয়তো প্যাথেটিক যে বইয়ের চরিত্রের চরম দুর্যোগকেই আমি উপভোগ করছি- আমি চরিত্রদের কাছে দুঃখিত।
আমি লেখকের লেখার মুন্সিয়ানায় অবাক হই, সম্পর্কের সহজপ্রকাশের সাথে মানবমনের জটিলতা, দুর্বার প্রেম থেকে অদ্ভুত নির্লিপ্ততা, সুন্দর দিনের সহজ স্বপ্নের পথে চড়াই উৎরাই আর বাস্তবতার আঘাত- ট্রেনের কোলাহলের মধ্যে পড়লেও সবকিছুই ভেসে উঠেছে সামনে।
সেরকম টুইস্ট না থেকেও প্রায় আড়াইশ পৃষ্ঠার বইটির কাহিনি গতিময়। সেই গতিতে পড়তে পড়তে শেষে এসে পরপর তিনটি হোঁচট খাই। সেই হোঁচটে ভেতরটা কেন জানি আর্দ্র হয়ে ওঠে, কার জন্য বুঝিনা। সম্ভবত আসিফের জন্যই বেশি। সম্ভবত আকবর আর মনজুরের জন্যও। সম্ভবত জনারন্যে থেকেও যারা একা হয়ে যান আপনজনের অভাবে, তাদের সবার জন্য।
অনেকটা লেখকের আগের বই "মেঘ বিষাদের গল্প"এর মতোই। এই ধাঁচে লেখা। পুরো বই জুড়ে কেমন যেন মন খারাপ করা দুঃখ এবং বিষাদের ছায়া। হ্যাপি এন্ডিং না হয়ে ট্রাজিক এন্ডিং। গল্পের অনেকখানিই প্রেডিক্টেড ছিল। তবে যেহেতু থ্রিলার না, উপন্যাস। তাই ইহাকে মেনে নেওয়া যায়।
মেঘ বিষাদের গল্প থেকে বেটার মনে হয়েছে। লেখা অনেক সাবলীল। লেখনী চমৎকার। তবে বইয়ে বেশ কিছু বানান ভুল এবং প্যারাগ্রাফিংয়ে ভুল দৃষ্টিকটু লেগেছে।
শরীফুল হাসানের বই এই প্রথম তিন স্টার দিচ্ছি । তিনি অসম্ভব সুন্দর লেখেন । বিগত সব গুলা বই তার প্রমাণ। এই বইয়ের বেলার একটু ব্যতিক্রম হয়েছে। কাহিনী ছোট্ট । মাত্র ২ ঘন্টা লেগেছে শেষ করতে । ছোট একটা ঘটনাকে তিনি তিনি বেশ বড় করে লিখেছেন। যদি ও লেখনী বর্ননা ছিল অসম্ভব সুন্দর।কাহিনী বিন্যাসের ধারবাহিকতা ছিল এবং সুক্ষ ভাবেই প্রতিটী ঘটনাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।