বিগত চল্লিশ বছরে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। প্রতাপশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। এক সময় পূর্ব ও পশ্চিম পশ্চিম জার্মানির বিভেদ রেখা হোয়ে দাড়িয়ে থাকা বার্লিন প্রাচীর তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে। সমাজতন্ত্রের মোড়কে ধনতন্ত্রের অনেক ধারণাকেই আপন করে নিয়েছে চিন। রাজনৈতিক দর্শনের এইসব পালাবদল বাংলাদেশকেও স্পর্শ করেছে। খুব দ্রুত গতিতে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু রাষ্ট্র যত দ্রুত এই পালাবদলকে গ্রহন করতে পারে, অনেক সময় ব্যক্তি তত দ্রুত তা গ্রহন করতে পারে না ।নিজের জীবন-যৌবন-সম্পদ সব কিছু সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার জন্য উৎসর্গ করে পরবর্তীকালে চাইলেই সে বিশ্বাস থেকে ফিরে আসা যায় না। আবার কেউ কেউ কখনো ফিরে আসার প্রয়োজন-ই অনুভব করেন না। যারা ফিরে আসার প্রয়োজন অনুভব করেনি এবং একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিপ্লব এর স্বপ্ন দেখে তাদের একজন- কমরেড আজফার হোসেন মুকুল। কেউ মনে করেন তিনি এখনো ঘুমিয়ে আছেন। কেউ জানে, তিনি নিখোঁজ। কেউ কেউ মনে করেন আদর্শ ধরে রাখতে গিয়ে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হোয়ে পড়া কমরেড মুকুল বর্তমানে রাজনীতির ময়দানে অচল। আর কমরেড আজফার হোসেন মুকুল মনে করেন, তার রাজনীতির ময়দান আলাদা। সেই ময়দানে সবাই খেলতে পারে না।আমাদের কাছে জেগে থাকার যা সংজ্ঞা- কমরেড আজফার হোসেন মুকুলের কাছে তারই নাম- ঘুমিয়ে থাকা। আমরা কেন ঘুমিয়ে আছি আর কমরেড আজফার হোসেন মুকুল কেন জেগে আছেন সেই রহস্য উন্মোচনের কাহিনি- লস্ট কমরেড।
মাসউদুল হকের জন্ম ১৯৭৪ সালে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও তাঁর আগ্রহের জায়গা মুলত কথাসাহিত্য। তবে কথাসাহিত্যের নির্দিষ্ট কোন গণ্ডিতে নিজেকে আটকে রাখতে চান না। ফলে তাঁর প্রতিটি গল্প বা উপন্যাসের বিষয়বস্তু হয় ভিন্ন। কথাসাহিত্যের প্রতিটি শাখায় কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি লেখালিখি করেন। প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন নতুন সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করানাে এবং সেই চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের চেষ্টাই মাসউদুল হকের সাহিত্য রচনার মূল প্রেরণা। পড়াশােনা করেছেন কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিভিল সার্ভিস কলেজে। একাডেমিক পড়াশােনার বিষয় সমাজকর্ম এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক। তবে আগ্রহের বিষয় দর্শন, ইতিহাস এবং রাজনীতি। প্রথম উপন্যাস ‘দীর্ঘশ্বাসেরা হাওরের জলে ভাসে’র জন্য ২০১২ সালে পেয়েছেন এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ কথাসাহিত্যিক পুরস্কার। তাঁর গল্প অবলম্বণে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘ঘ্রাণ’ দেশের বাইরে একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবের পাশাপাশি ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ স্বল্প দৈর্ঘ্য ছবির মর্যাদা পেয়েছে। মাসউদুল হক পেশায় সরকারি চাকুরে।
৩.৫/৫ মাসউদুল হকের লেখার একটি বিশেষ দিক হলো তাঁর চমৎকার বয়ানকৌশল। বরাবরের মতো এই উপন্যাসেও সেটি বজায় ছিল। আসলে উপন্যাসটি নিয়ে প্রত্যাশার পারদ একটু উঁচুতেই ছিল, সে তুলনায় পুরোপুরিভাবে প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলেও কমরেড আজফার হোসেন মুকুলের বৃত্তান্ত বয়ানে লেখকের অভিনবত্বের জন্যই মোটের উপর 'লস্ট কমরেড' বেশ ভালো একটি উপন্যাস হয়ে উঠেছে আমার কাছে।
গত চার দশকে অনেক কিছু বদলে গেছে।সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয়েছে।ইন্টারনেট,মোবাইল আরো কত শত প্রযুক্তি এসেছে।কিন্তু পরিবর্তন হয়নি শুধু কমরেড মুকুলের।সে আগের মত সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে,এখনো সে ঘুরে বেড়ায় গ্রামে গ্রামে,সমাজের বৈষম্য পরিবর্তন করার লক্ষ্যে।কিন্তু মুকুলের সমাজতান্ত্রিক দল 'জনমুক্তি পার্টি' থেকে সে কিভাবে হারিয়ে গেলো?কমল-রুহুল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ওরা তো বেশ আছে সরকারী দলের মন্ত্রী উপমন্ত্রী হয়ে।সমাজতন্ত্র রাজনীতি করে বলে আমরা ভেবে নিবো মুকুলের কোন পারিবারিক জীবন নেই।কমরেড মুকুলের জীবনে সংসার, প্রিয়তমা 'বিনু' এবং একটি কণ্যা সন্তান 'পঙক্তি' সবই ছিল।কিন্তু সমাজতন্ত্রের কঠিন বাস্তবতাকে কমরেড মুকুল মেনে নেয় আর ত্যাগ করে তার পারিবারিক মোহ।মুকুলের কি কখনো তার মেয়ে বড় হওয়ার পর মেয়ের সাথে দেখা হয়েছে? অনির্বাণকে মুকুল ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করে,অনির্বাণের ও মুকুলের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কোন কমতি ছিল না।তাহলে কেন অনির্বাণকেই বিয়ে করে বিনু?বিনু যখন পুরনো ফিদেল কাস্ট্রোর পোশাকের আদলে তৈরি পোশাক পরা মুকুলকে দেখেছে,তখন সে পুরনো দিনের স্মৃতি চারণে হারিয়ে যায় বারবার,কখনো নিজের শৈশব,কখনো নিজের কৈশোর।ফিদেল কাস্ট্রোর সাথে মুকুলের দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল,মুকুল কি পেরেছে তার আদর্শিক নেতার সাথে দেখা করতে? কিন্তু ফিদেল কাস্ট্রো মারা যাওয়ার পর তার উদ্দেশ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান ' লাল সালাম' এ কমরেড মুকুলকে সবাই লাইভে দেখে ভয় পেয়ে যায়,কেউ কেউ অবাক হয়,কারো কারো বিস্ময়প্রকাশের ভাষাও থাকে না।কেন সবাই কমরেড মুকুলের মত এমন ত্যাগী নেতাকে নিয়ে এত বিস্ময়প্রকাশ করছে?
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ মুকুল,বিনু, রুহুল,কমল,অনির্বাণ সহ প্রতিটি চরিত্রে লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দেখা পাওয়া যায়।কিন্তু স্বভাবতোই আমরা কল্পনাশ্রয়ী উপন্যাস পড়তে অভ্যস্ত না।কিন্তু পুরো উপন্যাসে কল্পনাকে কেন্দ্র করে বাস্তবিক জীবনকথা এত স্পষ্ট ছিল,পড়তে গিয়ে আমার পরিচিত মানুষদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছি। পঙক্তিকে এত কঠোর করে তুলে ধরাটা বাস্তবিক ছিল,তবে উপন্যাস পড়ে যে আবেগ তৈরি হয়েছে তার সাথে হঠাৎ করে ধাক্কা লাগে,মনে প্রশ্ন জাগে,এমন করেই কি বেঁচে থাকে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানরা। রুহুল-কমল ছিল আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। বিনু আর অনির্বাণরা সমাজের কঠিন শিকল ভেঙ্গে নিজেদের তৈরি করে নতুন সমাজের আশায়।কিন্তু মুকুল, মুকুলরা কি কল্পনাতে থাকে, তাদের সততা গুলো নিয়ে।বাস্তবিক জীবনে তারা ব্যর্থ বা লস্ট কমরেড কিন্তু তাদের জীবনে কখনো তারা পরিতাপ অনুভব করে কি?
উপন্যাসটা পড়ে সবচেয়ে যে বিষয়ে ভালো লেগেছে তা হলো উপন্যাসের শুরু আর শেষের পর্বে একই দৃশ্যপটের মিল রাখা,এটা একজন লেখকের জন্য কষ্টকর।লেখক তার কল্পনার সুন্দর উপস্থাপন করেছেন।
আশা করেছিলাম লস্ট কমরেড আজফার হোসেন মুকুলের গল্প বলতে বলতে লেখক কিছুটা হলেও সত্তর আর আশির দশকে বাংলাদেশের রাজনীতির নানান ঘটনাপ্রবাহ ও বাম রাজনীতির ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাস (অন্তত কমরেডের গল্পের সাথে যতটা প্রাসঙ্গিক) তুলে ধরবেন। সেটা নেই বলে কমরেডের গল্প কেমন জানি শূন্যে ভেসে ছিল। হতাশ হয়েছি।
দৃশ্যত নিখোঁজ একজন কমরেড। অথচ এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় তাঁর নিরাসক্ত, দৃঢ় চোয়াল সমৃদ্ধ উপস্থিতি। পরিবার পরিজনকে ভালোবাসা, বাঁধনে জড়ানো তাঁর কাছে খুবই তুচ্ছ ব্যপার। সমাজ ও পরিবারের কাছে তিনি একজন ব্যর্থ ও ভুল মানুষ। এক সময়ের বিপ্লবী সংগঠনের দিনরাত্রির সঙ্গীদের কেউ কেউ হয়ে গেছেন আপোষকামী, সুবিধাভোগী -, তাঁরা অস্বস্তির সাথে হারিয়ে যাওয়া কমরেডের ভুত দেখতে পান। নিখোঁজ কমরেড শেষবারের মতো জনসমক্ষে আসেন, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে তাঁর আলোচিত ও দীর্ঘ প্রস্তুতির সাক্ষাতের ব্যাপারে সারাজীবন মুখ না খুললেও টেলিভিশনের পর্দায় এক অনুষ্ঠানে সেই রহস্যময় ঘটনাটি বলে শ্রোতাদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটান। হারিয়ে যাওয়া কমরেডের হারিয়ে যাওয়া জীবনসঙ্গীর চোখে একটা ভিন্ন জগতের মুখোমুখি হবেন পাঠক।
মাসউদুল হকের নাম শুনেছি গত ফেব্রুয়ারিতে, বইমেলায় কি কি বই কিনবো সেই লিস্ট করতে গিয়ে। অপূর্ব লেখনী। বর্ণনা করার বেশ কিছু স্টাইল দেখেছি। এই লেখকের বলার ভঙ্গীটা সচরাচর চোখে পড়েনা এমন। একটা দৃশ্য, সেটিং বলে সেখান থেকে খুঁটে খুঁটে একেকটি অভিব্যক্তি, পোষাক, মানুুষ ধরে ধরে ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে গল্প বলার স্টাইল টা অসম্ভব ভালো লেগেছে। মুগ্ধ!