বাংলার ইতিহাস কে ভিত্তি করে রচিত কিছু কাল্পনিক ও বাস্তব চরিত্রের আখ্যান। দুই প্রজন্মের বিভিন্ন মানুষ, তাদের জীবন এবং তার মাধ্যমে ইতিহাসের জীবন্ত বিবরণ।
Sharadindu Bandyopadhyay (Bengali: শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়; 30 March 1899 – 22 September 1970) was a well-known literary figure of Bengal. He was also actively involved with Bengali cinema as well as Bollywood. His most famous creation is the fictional detective Byomkesh Bakshi. He wrote different forms of prose: novels, short stories, plays and screenplays. However, his forte was short stories and novels. He wrote historical fiction like Kaler Mandira, GourMollar (initially named as Mouri Nodir Teere), Tumi Sandhyar Megh, Tungabhadrar Teere (all novels), Chuya-Chandan, Maru O Sangha (later made into a Hindi film named Trishangni) and stories of the unnatural with the recurring character Baroda. Besides, he wrote many songs and poems.
Awards: 'Rabindra Puraskar' in 1967 for the novel 'Tungabhadrar Tirey'. 'Sarat Smriti Purashkar' in 1967 by Calcutta University.
'গৌড়মল্লার' নিয়ে বিষদে আলোচনা করার পূর্বে, মনে রাখা উচিত যে উপন্যাসটি আদ্যোপান্ত সময়ের দাস। আধুনিক মাইক্রোস্কোপে এই জিনিসের মূল্যায়ন করলে, লেখাটির রোমান্টিক হৃদয়ের প্রতি অনাচার হয়। তবে এটাও ঠিক যে হালফিলের বাজারে ঐতিহাসিকের ধারা বদলেছে। যুগপোযোগী নিয়মে গল্পে এসেছে ম্যাচিউরিটি। আরো তথ্যবহুল, আরো উন্নত রিসার্চ সহযোগে লেখক-লেখিকারা একের পর এক ঐতিহাসিক লিখে চলেছেন আজ অনেক বছর ধরে।
এদের পাঠক আমি খোদ নিজে। ভালো খারাপের মাঝেই, এসব গল্পে দেখা পাই তৎসম প্রবাহ। দেখা পাই ভাষাগত সামঞ্জস্য বজায় রাখার সংযত প্রচেষ্টা। ক্লাসিক্যাল শব্দচয়নের পাশাপাশি আরো কমপ্লেক্স, আরো জটিল নির্মাণে নিজেদের গল্পগুলো বাঁধবার সাধু প্রয়াস। যাদের কলেবর যথার্থই বৃহৎ আর স্কোপ উচ্চাকাঙ্ক্ষী! যা অনেক ক্ষেত্রেই একটি মাত্র বইতে এঁটেও আঁটতে চায় না। (প্রি-বুক নাউ!)
তবুও কেন বারংবার শরদিন্দুতে ফিরতে চায় মন? কেন এই আবেগমিশ্রিত ঘোরে ভুগে মরে আমার সাধারণ পাঠক স্বত্বা?
উত্তরটা আপেক্ষিক। তবে আমার ক্ষেত্রে, লেখকের অপার্থিব গদ্য বর্ণনার বাইরেও, ওনার গল্পের মানবিক সরলতা ও লেখনীর সহজ স্পন্দিত হৃদয়, মনে করায় ঠিক একটাই কথা। মনে করায় সেই আমির কথা যে আত্মীয় পরিজনের হাজারটা বারণ সত্বেও স্কুল-কলেজে সাগ্রহে বেছে নিয়েছিলাম ইতিহাসের পাঠ। এবং আজও নিয়ে চলেছি প্রতিনিয়ত! পাঠ্য ইতিহাসের প্রাপ্তবয়স্ক ডিসকোর্সের বাইরেও স্বর্ণালী ভালোলাগার যেই রেশ আমাদের আত্মবিস্মৃতির বিরুদ্ধে সর্বদা চালিত করে, সেই সহজ আনন্দ থেকেই 'গৌড়মল্লার'কে আজ পাঁচ-পাঁচটি তারা দিতে বাঁধছে না আমার।
চিরায়ত উপন্যাসের চিরাচরিত গোলাপী চশমার বজ্রআঁটুনি সত্ত্বেও, লেখাটির অন্তর্নিহিত অন্ধকার প্রচুর। এতে উপন্যাসে আসে আশ্চর্য ডাইমেনশন। অবাক হই না। কারণ, পটভূমি হিসেবে বাংলার মাৎস্যন্যায়কেই বেছে নিয়েছেন লেখক। শশাঙ্ক পরবর্তী বাংলাদেশের যেই অবক্ষয়ী চিত্র আমাদের মনে বিরাজ করে, কতকটা তারই পুরাতন ও সরলীকৃত ছায়ায় গল্প সাজিয়েছেন তিনি। সাহায্য নিয়েছেন নীহাররঞ্জন, সুকুমার, সুনীতিকুমার, প্রভৃতির। নিটফল, একটি চমৎকার লেয়ার্ড উপন্যাস, যার গতিপ্রকৃতি ঠিক বিয়োগান্তক না হয়েও হ্যাপী-এন্ডিংয়ের চেনা ফর্মুলায় খাপ খায় না।
আপনি আবার ভাববেন না যেন আমার এই ক্ল্যাসিকাল প্রীতি 'হামারে জমানে পে...' গোছের কোনো ফোপোরদালালির হিসেব। আমি এই 'জমানার'ই মানুষ। হালফিলের সবকিছু খারাপ, পুরনোই বেস্ট - এহেন চিন্তাধারা বোকা বোকা ও অপ্রগতিশীল। তবে একান্ত অনুরোধ, আমার বেহিসেবী ঘ্যানঘ্যানানিকে স্রেফ বাচালতা বলে না দাগিয়ে দিয়ে, উপন্যাসটির প্রথম কটা পাতা উল্টে দেখুন গে। দেখবেন কেমন করে, সাহিত্যের সিঁড়ি বেয়ে অধুনা পৃথিবীর মৃতপ্রায় মন, টাইম ট্রাভেলে সেঁধিয়ে যায় পুরোনো বাংলার গ্রাম্য স্বপ্নে।
কি সুন্দর অমৃত ন্যায় প্রথমাংশটি! মৌরি নদীর তীরের ছোট্ট বেতসগ্রাম। যার কোমল কুঞ্জ কুটির ও সরল অভিভূত জীবনে, ঝড় তোলে মনকেমনের বাতাস। যার পলাশ বন, বাশের ঝাড় ও ইক্ষুজঙ্গল ঘেঁটে পাওয়া যায় ইউটোপিয়ার সুবাস। যেই গ্রামের অশ্বত্থতলায় একই সাথে ফুল-চন্দনে বন্দিত হন বিষ্ণু-বুদ্ধ মূর্তিদ্বয়। এহেন বেতসগ্রামের বাসিন্দা রঙ্গনা, বজ্রদেব, গুঞ্জা বা চাতক ঠাকুরেরা আমাদের সাধারণের প্রতিনিধি। লেখনীর লৌকিক হৃদস্পন্দন। যেকোনো সার্থক ঐতিহাসিকের সজীব মাপকাঠি।
উপন্যাসের এই পর্যায়টি রোমান্টিক। সুন্দর কোনো রূপকথা সম। চাতক ঠাকুরের অলৌকিক পূর্বাশঙ্কা। রঙ্গনা মানবদেবের শকুন্তলা প্রেম। বজ্রদেবের শৈশব, ভালোবাসা ও আত্মপরিচয়ের টান। সবটাই ভীষণ মিষ্টি। যেন অবন ঠাকুরের 'রাজকাহিনী' বা রবিমামার 'রাজর্ষি'র গান! তবে সবটাই স্রেফ ঐতিহাসিক রোমিওপনা নয়। মাৎস্যন্যায়ের প্রকৃতি অন্বেষণের পূর্বে লেখকের জরুরী তৎপরতায় এই সৌন্দর্য জাহির করাতে পাই আইরনির ছোয়া। যেন রুদ্ধ কন্ঠে চেঁচিয়ে বলছেন, দ্যাখ রে ভাই, কি ছিল আর কি হলো! দ্যাখ একবার!
হাহাকারই বটে। যা সবিস্তারে প্রকাশিত হয় উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্যায়ে, গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণে এসে। অনেকটা ধৈর্য নিয়ে, যথাসম্ভব খুঁটিয়ে লেখা এই অংশটিতে প্রাচীন বাংলার টালমাটাল নাগরিক জীবনের একটি সুচারু প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলেন লেখক।
তাই পতনশীল কাঁনসোনার বিপথগামী ঐশ্বর্যের প্রতি গ্রামছাড়া বজ্রের অস্থির মোহ, মন খারাপ করে। গুমোট আবেগে, বুঝে আসে চোখ। অন্ধকারের কাছে সমর্পণ করতে চায় মন। দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে নিউজ-রিলের মত কালান্তক ছবি সব। রাজধানীর গলিপথের পড়ন্ত অনাড়ম্বরতা। রাজদেওয়ালের অন্দরে নিকৃষ্ট অরাজকতা। ঐতিহ্যশালী রক্তমৃত্তিকার টিমটিমে প্রদীপ। বা বাংলার নৌঘাটে মৃতপ্রায় বাণিজ্য। কি এক গেল-গেল রবে আচ্ছন্ন রয় উপন্যাসের পাতা। এক এমন উদাসীনতা যা পাঠকের সাথে নায়ক বজ্রদেবকেও বেঁধে রাখে বজ্র শৃঙ্খলে!
বজ্রের এই সূক্ষ্ম আত্মসঙ্কট, তার চরিত্রের নিস্পৃহ দ্বৈততা, 'গৌড়মল্লার'কে স্রেফ একটি শুভ-বনাম-অশুভের গতানুগতিক গল্প থেকে একটা কৌতূহলী চরিত্র চিত্রণে রুপান্তরিত করে। কোন এক অমোঘ নাড়ির টানে বজ্র পড়ে রয় কর্নসুবর্ণতে। যেন খরস্রোতা নদীর বুকে আটক এক মাঝিহীন নৌকো। সে ব্যাথা পায়। ব্যাবহৃত হয়। উপন্যাসের এক ভীষণ অন্ধকার পর্বে, নিগৃহীত হয় যৌন রূপে! তবুও মাটি কামড়ে পড়ে থাকে সে কিসের আশায়। যেন কোনো দড়ি সঞ্চালিত মাটির পুত্তলিকা। তার কোনো সদিচ্ছা নেই। নেই কোনো ব্যক্তিগত এজেন্সি!
এমন এক চরিত্র যে এক মুহূর্তে "এ আমার যুদ্ধ নয়" বলেই অপর মুহূর্তে একই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বসে। ফলস্বরুপ, উপন্যাসের শেষটাও ক্লান্ত ও করুন। কতকটা হতাশামন্ডিত। তবুও সবটাই লাগসই। হয়তো বা বঙ্গদেশের হারানো সাঁঝে সমস্ত চরিত্রদের ফুটনোট হিসেবে রয়ে যাওয়াটাই কালচক্রের কটাক্ষ? ভগ্নোৎসাহ লেখক এই সত্যটা মেনে নিয়েছেন যেন। উপন্যাসের পাতায় আর বিরূপ করেননি তাই। কেবল তিক্তকন্ঠে একটি অব্যক্ত প্রশ্ন উপস্থাপিত করেছেন। আঁকারে ইঙ্গিতে জানতে চেয়েছেন, সব গেলেও সব হারায় কি?
কে জানে। কত প্রশ্নেরই তো আর সহজ উত্তর মেলে না। যেমন বইয়ের একটিমাত্র অধ্যায়ে চারুদত্ত নামক একজন পীড়িত নৌ-ব্যবসায়ীকে হাজির করেছেন শরদিন্দু। যার মুখে বাংলার নৌ-দুর্গতির খবর পায় বজ্র। এই একটিমাত্র দৃষ্টান্ত বাদে চরিত্রটিকে আর একবারও ফিরিয়ে আনেন না লেখক। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ কি স্রেফ সেই সময়ের নিরিখে লেখকের ইনফোডাম্পিংয়ের পন্থা? নাকি অন্য কিছু? আমি আবার চারুদত্ত নামটিতেই শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকার ছায়া খুঁজে পাই। যা উপন্যাসের অবিচল নিস্পৃহতার সাথে এক অদ্ভুত সমাপতনে মিলেমিশে যায়।
বাংলার ইতিহাসে রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুকে একটা "ওয়াটারশেড" মুহূর্ত হিসেবে ধরা হয়। কারণ, তারপরেই সমগ্র বঙ্গভূমি ডুবে গিয়েছিল এক দীর্ঘমেয়াদি অরাজকতার অন্ধকারে, যা মাৎস্যন্যায় নামে পরিচিত। এই অরাজকতা আবার দিকনির্দেশ করেছিল বাংলা ও বাঙালির ভবিষ্যত ইতিহাসকে। লেখকের নিজের ভাষাতেই, "আধুনিক বাঙালীর জন্ম এই সময়"। শশাঙ্কের মৃত্যুর অব্যবহিত পরের সেই ঘটনাবহুল কালখণ্ডই এই উপন্যাসের পটভূমি। ইতিহাসসম্মত বাস্তব উপাদানের সঙ্গে ���ল্পনার মিশেলে শরদিন্দু লিখেছেন উপন্যাসটি।
যদিও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় একজন চমৎকার গল্পবলিয়ে, তবু এই উপন্যাসের প্লট সামান্য নড়বড়ে মনে হলো। কাহিনিতে সমাপতনের বাহুল্য এবং কয়েকটি চরিত্রের পরিণতির অভাব প্লটকে দুর্বল করেছে। কিন্তু প্লটের দুর্বলতা ঢেকে দিয়েছে অসামান্য গদ্যসৌন্দর্য এবং পরিবেশ নির্মাণ। তৎসম শব্দের পর্যাপ্ত ব্যবহার সত্ত্বেও পড়ার গতি থমকে যায় না কিংবা বর্ণনা কৃত্রিম বলে মনে হয় না— এই অভাবনীয় ম্যাজিকটি করে দেখাতে শরদিন্দু সিদ্ধহস্ত। বাংলা ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাসে সচেতনভাবে তৎসম শব্দপ্রয়োগের এই রীতিটি পরবর্তী সময়ে অনেক সাহিত্যিক গ্রহণ করলেও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় অদ্বিতীয়।
ঐতিহাসিক সিরিজের দ্বিতীয় বই এটা। এই বইয়ের বিষয়বস্তু হিসেবে লেখক বেছে নিয়েছেন শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকে পালরা আসার পূর্ব পর্যন্ত বাংলায় চলা মাৎস্যন্যায়কে। তখনকার সেই বিশৃঙ্খল অবস্থাকে লেখক তুলে ধরেছেন বজ্র, জয়নাগ, ভাস্করভার্মা, কোকবর্মাদের বাংলার সিংহাসনের জন্য লড়াইয়ের মাধ্যমে।
প্রথম বইয়ের মতোই কাহিনী ততটা জোরালো না কিন্তু অপূর্ব ভাষা শৈলী আর অসাধারণভাবে তৎকালীন সমাজকে তুলে ধরার কারণে এটাও বেশ উপভোগ্য।
সত্যজিৎ আর শরদিন্দু, দুজনের মিল কোথায়? দুজনেই শিল্পী, আর দুজনেই সিনেমাপাড়া নিবাসী সাহিত্যিক। সুতরাং সিনেমা + সাহিত্য মিলে শরদিন্দু এমন সব আখ্যান রচনা করতে পারেন, যেখানে পরিমিত পরিমাণ জটিলতা, সাহিত্য আর উপভোগ্যতা, সবই থাকে।
যদিও এই গল্পের প্রথম অংশটুকু খুবই স্লো, কিন্তু ২য় অংশ পুষিয়ে দিয়েছে বেশ। ইতিহাসকে ব্যাকড্রপে রেখে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের ছবি আকঁতে শরদিন্দুর মত সিদ্ধহস্ত কেউ নেই। প্রতিটা উপন্যাস বা গল্প পড়ি আর মনে হয়, ইস!!এই কাহিনীগুলিকে নিয়ে কি জোস একএকটা সিনেমা বানানো যায়!!
এমন অডিও ভিজুয়াল ফিল খুব কম লেখকের লেখায় পাওয়া যায়। আর হ্যাঁ, মির্চির উপস্থাপনা দারুণ, এজ অলয়েজ!!
১৯৫০ থেকে ১৯৫২ - এই সময়কালে রচিত এবং ১৯৫৪ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল এই ঐতিহাসিক উপন্যাস। শশাঙ্ক-পরবর্তী বাংলা সম্বন্ধে তখন যা জানা ছিল, এখন অবস্থা কিছুটা বদলেছে। পাঠকের চিন্তাধারাও অনেক বদলে গেছে। কিন্তু লালসা ও ভালোবাসা, ক্ষমতার লোভ ও মাটির টানের দ্বৈত সংগ্রাম, আর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এক কিশোরের পুরুষ হয়ে ওঠা - এই উপাদানগুলোর আকর্ষণ চিরন্তন রয়ে গেছে। এদের সুষম বিন্যাসের পটভূমি হিসেবে ইতিহাসকে ব্যবহার করায় শরদিন্দু স্রেফ অতুলনীয় ছিলেন। হয়তো সেজন্যই, দলিল আর ফলকের নিষ্ঠুর প্রমাণ দিয়ে ইতিহাস লিখতে গিয়েও এযুগের ঐতিহাসিক শুনতে পান কালের যাত্রার সেই ধ্বনি, যা লেখা হয়েছিল এই উপন্যাসে। গৌড়মল্লার মোহিত করে রাখে আমাদের বরাবরের জন্য। না পড়ে থাকলে প্লিজ পড়ুন।
গৌড় কথাটার উৎপত্তি গুড় থেকে। আখের গুড়। আর মল্লার হইল রাগ; গানের রাগ। যে রাগের আবার বিশেষকাল আছে। রাত্রি দ্বিপ্রহরে এই রাগ গাওয়ার নিয়ম। তো, গৌড়মল্লার কথাটার অর্থ এখন অনুমেয়।
উপন্যাসখানি লেখকের ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্রের। দ্বিতীয় উপন্যাস। সময়কাল, সপ্তম শতক।
তার আগে বাংলায় ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্য। আনুমানিক ২৪০-৫৫০ পর্যন্ত সময়। শেষ গুপ্ত সম্রাট ছিলেন মহাসেনগুপ্ত। তারপরে অনেকেই সিংহাসনে বসার চেষ্টাচরিত করবে স্বাভাবিক।
তো, অনেকেই ধারণা করেন মহাসেনগুপ্তের অধীনেই কোনো এক এলাকা শশাঙ্কদেব দেখেটেখে থাকতেন অথবা সে হয়ত মহাসেনগুপ্তের বংশীয় কেউ। যাহাই হোক, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, সেইখানে রাজা হিসেবে আবির্ভূত হন শশাঙ্কদেব।
তিনি প্রায় ৩০ বছর গৌড় শাসন করেন। গৌড়ের সীমানা নির্ণয় কষ্টকর। তবে, মালদহ, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ অধুনা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত এর সীমানার মধ্যে ছিল বলা যায়৷ ধারণা করা হয় বঙ্গের এই বিস্তৃতি পুণ্ড্র, উড়িষ্যা পর্যন্তও বিস্তৃত থাকতে পারে।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের অংশ ছিল বিশাল। ধরতে গেলে উপমহাদেশই কন্ট্রোল করত তারা। প্রথমবারের মতো আইসা বঙ্গ অধুনা গৌড় জনপদের প্রথম স্বাধীন রাজা হিসেবে শশাঙ্করে দেখা হয়।
এই লোকই প্রথম বাংলা ক্যালেন্ডারের বন্দোবস্ত করেন। যদিও হিউয়েন সাংয়ের মতে তিনি ছিলেন বৌদ্ধধর্মের নিগ্রহকারী। সেই বর্ণনাও বইয়ে উপস্থিত। তাছাড়া নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ শীলভদ্রকেও দেখা যায়।
শশাঙ্কদেব রাজত্ব করছেন আনুমানিক ৬০৬-৬৩৮ পর্যন্ত। এরপর তার ছেলে মানবদেব হয় রাজা। যদিও তিনি থাকতে পারছেন মাত্র ৮মাস।
এইসময় কামরূপের রাজা ছিলেন ভাস্করবর্মন। রাজ্য বিস্তার নিয়া তার সাথে মানবের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মানব আহত হইয়া পলায়ন করে।
তিনি গিয়া উপস্থিত হইলেন বেতসগ্রামে। সেইখানে তিনি এক অনিন্দ্যসুন্দরীর দেখা পাইলেন। তাদের অভিসার হইল। রাজা যেমনি আসিয়াছিলেন, তেমনি চলিয়া যান। কিছুদিনপর সেই রমণীর একটা ছেলেসন্তান হইল। নাম রাখা হইল বজ্রদেব। শশাঙ্কের পৌত্র, মানবের পুত্র!
ইতিহাসআশ্রয়ী উপন্যাস হইলে প্রথমত, সেইসময়কার স্থান, কাল, পোশাক-পরিচ্ছদ, সমাজব্যবস্থা, প্রাকৃতিক অবস্থার বিষয় জানা জরুরি। লেখক সাহেব সেইদিকে কোনো কমতি রাখেন নাই। ঘটনাপ্রবাহ উনি যেভাবে ইচ্ছে মিলাইছেন। তা নিয়ে বিশেষ উচ্চ বাক্য থাকার কথা না। কারণ, বজ্রদেবের অস্তিত্ব নিয়া ইতিহাসবেত্তারা সন্দিহান।
বঙ্গদেশ নিয়া তার একটা লাইন লিখে শেষ করি, “আগামীকল্য হইতে রীতিমতো গুড় প্রস্তুতের কাজ আরম্ভ হইবে। ইক্ষুযন্ত্রের চারিপাশে সারি সারি আখা(চুলা) জ্বলিবে। আখার উপর অগভীর বৃহৎ কটাহে(কড়াই) মেয়েরা রস পাক করিবে। রস গাঢ় হইয়া শেষে সোনার বর্ণ ধারণ করিবে। ইহাই বাংলা দেশের খাঁটি সোনা।”
আরেকটা আলাপে শেষ করি— ৬৫০-৭৫০ সাল, এই সময়রে ইতিহাসে বলা হয় মাৎস্যন্যায়।
বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসিক হিসাবে পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন শরদিন্দু বাবু। এ গল্পের কাহিনী রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর আরো বিশ বছর পরের। কিভাবে শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে তার ছেলে মানব দেব তার সিংহাসন হারান ও পরবর্তীতে তার ছেলে বজ্র দেব সে সিংহাসন লাভ করার চেষ্টা করেন তা বর্ননা করা হয়েছে। সাথে রয়েছে প্রেম, ভালোবাসা, ষড়যন্ত্রের বর্ননা যা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর ঐতিহাসিক কাহিনী গুলোকে প্রাণ এনে দেয়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর অন্য ঐতিহাসিক উপন্যাস এর তুলনায় এর কাহিনী একটু দুর্বল মনে হয়েছে তাও উপভোগ্য।
Setting - বাংলায় মাৎস্যন্যায় শুরু হওয়ার দিকটায় এ গল্পের স্থান।স্বয়ং শশাঙ্ক দেবের পৌত্র স্থান পেয়েছে এই কাহিনিতে! এর ইতিহাস নির্ভরতা সম্পর্কে আমার কোনোধরনের ধারণা নেই!যদিও এতে সেসময়কার সমাজের একটা বিস্তর ছবি উঠে এসেছে! লিখনি সম্পর্কে তো আর বলার কিছু নেই।তবে,এটা অন্যগুলোর মতো তেমন একটা ভালো লাগল না আমার।!তবে যেখানে ইতিহাস উঠে এসেছে, এও আবার বাংলার! সেখানে সময় দেয়া লাভজনক।
এই উপন্যাসটিতে বর্ণিত গ্রাম্য জীবন আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত করেছে, কত মধুর কত স্বাভাবিক বলে মনে হয় এই জীবন, কিন্তু এখন সেই জগৎ যেন সুদূর স্বপ্নালোক। নির্বিবাদী স্নেহময় চাতক ঠাকুর, গুঞ্জা , দুঃখী রঙ্গনা সরল গ্রামীণ জীবনকে ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলেছে।