প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় খুন, ধর্ষন আর অন্যায়-অবিচারের খবর পড়তে পড়তে আপনি কি ক্লান্ত? আপনার কি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে? খুব ইচ্ছে করে একটা পিস্তল হাতে রাস্তায় নেমে পড়ে নরপশুগুলোকে নিজ হাতে শাস্তি দিতে? তাহলে আপনিই এই গল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা। গল্পের প্রত্যেকটা লাইন আপনার মনের ইচ্ছের প্রতিফলন। আপনার মন যা চাইবে, গল্পে ঠিক তাই ঘটবে! আপনার কল্পনার জগত থেকে একে একে উঠে আসবে- আদিব, পারভিন, মজিদ গুন্ডা, মনির মিয়া, রুখসানা, করিম মোল্লা, শমসের মাতব্বর এর মতো চরিত্রগুলো। তবে একসময় কল্পনার জগত থেকে বাস্তবতা দূরে সরে যাবে! দেখবেন চরিত্রগুলো আর আপনার কথা শুনছে না, এগিয়ে যাচ্ছে নিজের মতো করে। একটা সময় পর আপনি বিরক্ত হয়ে এই অবাধ্য মানুষগুলোর যাত্রাপথে ইতি টেনে দেবেন! তারপর আপনি চাইলে গল্পটা আবার নতুন করে শুরু করতে পারেন। করবেন নাকি?
নাজিম উদ দৌলার জন্ম ১৯৯০ সালের ৪ নভেম্বর নানাবাড়ি কেরানীগঞ্জে। পৈত্রিক নিবাস যশোর জেলায় হলেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকার আলো বাতাসের মাঝে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করে বেশ কয়েক বছর বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি করেছেন।বর্তমানে দেশের প্রথম সারির প্রডাকশন হাউজ আলফা আই-এ ক্রিয়েটিভ ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। লেখালেখির চর্চা অনেক দিনের। দীর্ঘসময় ধরে লিখছেন ব্লগ, ফেসবুক সহ বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে। ২০১২ সালে প্রথম গল্প “কবি” প্রকাশিত হয় কালান্তর সাহিত্য সাময়িকীতে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫-তে প্রকাশিত হয় তার প্রথম থ্রিলার উপন্যাস “ইনকারনেশন”। একই বছর আগস্টে প্রকাশিত হিস্টোরিক্যাল থ্রিলার “ব্লাডস্টোন” তাকে এনে দেয় বিপুল পাঠকপ্রিয়তা। এ পর্যন্ত ৬টি থ্রিলার উপন্যাস ও ৩টি গল্পগ্রন্থ লিখেছেন তিনি। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লেখায় মনোনিবেশ করেছেন। সাম্প্রতিককালে তার চিত্রনাট্যে নির্মিত "সুড়ঙ্গ" সিনেমাটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। শান, অপারেশন সুন্দরবন, দামাল, বুকের মধ্যে আগুন, দ্যা সাইলেন্স, লটারি-এর মতো বেশি কিছু আলোচিত সিনেমা ও ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি। অবসর সময় কাটে বইপড়ে, মুভি দেখে আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। সদালাপী, হাসি খুশি আর মিশুক স্বভাবের এই মানুষটি স্বপ্ন দেখেন একটি সুন্দর বাংলাদেশের, যেখানে প্রত্যেকটি এক হয়ে মানুষ দেশ গড়ার কাজে মন দেবে।
ব্যাপক লাগল! মাঝে নায়ক ও নায়িকার প্রেমপর্বের আখ্যান ও প্রেমিকার ব্যাকস্টোরির জন্য গল্পের গতি শ্লথ হয়ে গেছিল। কিন্তু সেটুকু বাদ দিলে এই উপন্যাস আনপুটডাউনেবল। বাংলায় এইরকম 'রিয়্যালিটি' শো নিয়ে আগেও লেখাপত্র হয়েছে। অনীশ দেব লিখেছিলেন 'তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট' - যা বিদেশি গল্প আর সিনেমাগুলো দ্বারা বড়ো বেশি 'অনুপ্রাণিত' ছিল। 'মহাযাত্রা'-ও হয়তো অনুপ্রাণিত, কিন্তু ওই উপন্যাসটির তুলনায় অনেক পরিচ্ছন্ন ও গতিময়। সুযোগ পেলে অবশ্যই পড়ুন।
ঘোর লাগা একটা অবস্থায় আছি, শেষে যে এমন হবে তা ভাবতে পারিনি। অনেক আগ্রহ নিয়ে শুরু করেছিলাম বইটা। যেহেতু শুনেছিলাম দেশী সাইকো প্লাস সিরিয়াল কিলিং থ্রিলার[এই জনরার আপনাদের কিছু সাজেসন অনুবাদ থাকলে বলবেন]। আমি যতগুলো বই কিনেছি বেশির ভাগই এই ক্যাটাগরির মধ্যেই পড়ে। এই জনরার বইগুলোর গতী খানিকটা স্লথ হয় মাঝে মাঝে বাট শেষ মেস একটা প্লট টুইস্ট স্নায়ুতে চাপ ফেলতে সক্ষম হয়। এই ধরনের বইকে গতীশীল করা একটু কঠিন। বাট নাজিম উদ দৌলা ভাই ইজিলি তা করে দেখিয়েছেন।এক অজ্ঞাত ব্যাক্তি খুঁজে খুঁজে পলাতক অপরাধীদের বের করে খুন করে যাচ্ছে। প্রত্যেক ভিকটিমকে হত্যা করার আগে আয়োজন করে তাকে পত্রিকা থেকে তার অপরাধের খবর পাঠ করে শোনানো হয়। অনেকটা বলিউডের ফিল্মি টাচও পেয়েছি মেইন ক্যারেক্টার যখন নিজেদের পাস্ট স্টোরি শোনানো শুরু করে। আমার মতে গল্পের কোয়ালিটি টা একটু নিচে নামে সে সময়। সমস্যা নাই, পরে ক্লাইম্যাক্সে যখন লেখক তার লুকিয়ে রাখা কিছু কার্ড শো করা শুরু করে মনে হবে যেন কাহিনী আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সিক্রেট কিছু গোষ্ঠী আছে যারা কিনা মেইন ক্যারেক্টারের দ্বারা তার অনিচ্ছা সত্বেও খুন করায় নেয়। আমরা যদিও এমন হলিউড কিছু সিনেমা আগেও দেখেছি।তবে বলতে পারি দেশীয় পটভূমিতে এমন থ্রিলার কিছুটা হলেও উত্তেজনা বাড়াতে পারে আপনার।
“তবুও আঁধার শেষে/দেখা দেয় আলো অনেক সম্ভাবনার মাঝে/খেলা করে রোদ।”
অর্থহীন ব্যান্ডের “অসমাপ্ত-১”-এর লিরিক দিয়ে লেখকের সিগনেচার স্টাইলে শুরু করা এই বই, যেন কাহিনিরই প্রতিফলন।
“কিছু কথা”য় লেখক জানিয়েছেন এই বইয়ের কাহিনিকে অবাস্তব ভাবার কোনো কারণ নেই। আবার চারদেয়ালে বদ্ধ থেকে কল্পনা করেও লেখা নয় এটি। তাঁর শৈশব ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় কাটায় নিম্নবিত্তদের জীবন খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সেই উপলব্ধিকে করে অবলম্বন করেই তিনি লিখেছেন তাঁর পঞ্চম উপন্যাস “মহাযাত্রা”।
█▒কী নিয়ে এই উপন্যাস?▒█
এটা মূলত একটি ক্ষোভ প্রকাশকারী উপন্যাস। লেখক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের এক অস্থির ও অস্থিতিশীল সময়ের সমাজকে। লেখকের ভাষায়,
“প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় খুন, ধর্ষণ আর অন্যায়-অবিচারের খবর পড়তে পড়তে আপনি কি ক্লান্ত? আপনার কি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে? খুব ইচ্ছে করে একটা পিস্তল হাতে রাস্তায় নেমে পড়ে নরপশুগুলোকে নিজ হাতে শাস্তি দিতে?”
তিনি মনের এই সুপ্তবাসনাকেই পূরণ করেছেন এই বইয়ের পাতায় পাতায়। কিন্তু এর পেছনেও একটা কথা রয়ে গেছে। আসলেই কী শাস্তি দিতে নেমেছে এই বইয়ের নায়ক?
█▒যেভাবে এগিয়েছে কাহিনি▒█
উপক্রমণিকায় নিয়াজ নামের একজনের প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা; অধ্যায় এক-এ মাহতাবের সাথে ঘটা ঘটনা, দুইয়ে চা দোকানদার আজিজ মিয়ার সাথে ঘটা ঘটনা ও তিনে পারভিন ভিলায় এক অদ্ভুত যুবকের আগমনকে আপাতদৃষ্টিতে খাপছাড়া মনে হয়। একটু একটু করে এগুলেই ছেঁড়া সুতোগুলো যেন আপনাআপনি জুড়ে যেতে থাকে একসাথে। পাঠককে কেবল এগিয়ে যেতে হবে।
প্রথম প্রথম আদিবের কাজকর্মগুলোকে সমর্থন দিতে ইচ্ছা করে। লেখকও বলেছেন, “গল্পের প্রত্যেকটা লাইন আপনার মনের ইচ্ছের প্রতিফলন। আপনার মন যা চাইবে, গল্পে ঠিক তাই ঘটবে!” কিন্তু একটা সময় গান্ধীর একটা কথা হয়তো মনে পড়ে যাবে, “চোখের বদলে চোখ পুরো পৃথিবীকেই অন্ধ করে দেবে।”
আদিবের কি মনে হয়নি এই কথাটা? সে কি পেরেছিল নিজেকে থামাতে? আড়ালে চলা সময়ঘড়িটাকে কি থামাতে পেরেছিল? থেমেছিল কি এই “মহাযাত্রা”?
█▒লিখনশৈলী▒█
“মহাযাত্রা” লেখকের পঞ্চম মৌলিক উপন্যাস। তাই স্বাভাবিকভাবে সহজ-সাবলীলভাবেই কাহিনি এগিয়েছে। জড়তা নেই তেমন। আটকে যেতে হয় না বা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
█▒গঠনশৈলী▒█
উপক্রমণিকা ও পরিশিষ্ট মিলিয়ে ২৪টি অধ্যায় আছে এই বইয়ে। রয়েছে ৮টি ধর্ষণ ও ১৩টি খুনের বর্ণনা রয়েছে। মানে মোটামুটি অসহনীয় অবস্থা। এতগুলো ধর্ষণ আর খুনের বর্ণনা পাঠক-মগজ এফোঁড়ওফোঁড় করে দেওয়ার কথা। কিন্তু লেখক এই সমস্যা এড়াতেই তৃতীয় ব্যক্তির দৃষ্টিতে বর্ণনা করেছেন। এতে মোটামুটি সহনীয় হয়েছে কাহিনি।
অধ্যায়ভিত্তিক টুকরোটুকরো কাহিনির কারণে পাঠে ক্লান্তি আসে না। অধিকাংশ অধ্যায়ের শেষদিকে সাসপেন্স আর ক্লিফহ্যাঙার পরের অধ্যায়ে টেনে নিয়ে যাবে। নিয়মিত বিরতিতে টুইস্ট তো আছেই।
জীবনবোধের আধিক্যের কারণে তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের তুলনায় টানটান উত্তেজনাটার শূন্যতা আমার মতো অনুভব করতে পারেন। কারণ অধ্যায় দুইয়ে আজিজ মিয়ার কাহিনি পড়ার পর বাকিগুলোর পরিণাম সমন্ধে আগে থেকেই আঁচ করা যায়। তবে বেশকিছু টুইস্ট আছে, যেগুলোই মূলত এই বইয়ের প্রাণ। সেগুলোর জন্য বোরিং লাগবে না।
█▒চরিত্রায়ন▒█
প্রধান চরিত্র আদিব ও পারভিন। এছাড়ায় মজিদ গুন্ডা, মনির মিয়া, রুখসানা, করিম মোল্লা, শমসের মাতব্বর এর মতো চরিত্রগুলোরও সরব উপস্থিতি আছে। অল্প অল্প করে প্রত্যেকরই চরিত্রায়ন করা হয়েছে। কল্পনা করতে তেমন কষ্ট হবে না।
█▒প্রচ্ছদ, মেকআপ, প্রুফিং ও অন্যান্য দিক▒█
∆প্রচ্ছদ প্রচ্ছদ করেছেন শাহরিয়ার রাকিন।
ফ্রন্ট কভারে মূল চরিত্র তার নিজস্ব গেটআপে দাঁড়িয়ে, পেছনে মার খাচ্ছে কেউ (কে খাচ্ছে আর কেন খাচ্ছে বইয়ে পেয়ে যাবেন)। নীলাভ ক্যানভাসে বেশ লাগছে।
ব্যাককভারে পত্রিকার কাটিং দিয়ে সাজানোটা বুদ্ধিমত্তার কাজ হয়েছে।
ফ্রন্ট ফ্ল্যাপে দেওয়া কাহিনি সংক্ষেপের চেয়ে গুডরিডসে দেওয়া কাহিনি সংক্ষেপ কম স্পয়লার যুক্ত। পাঠকদের আগে না পড়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ব্যাক ফ্ল্যাপে লেখকের একটুখানি কাটা মাথাওয়ালা ছবির ব্যাপারটা বাদ দিলে চলনসই ছবি। লেখক এমনিতেই সুদর্শন দেখতে। আরো ভালো ছবি আশা করেছিলাম। আর লেখক পরিচিতিটাও যথেষ্ট তথ্যবহুল।
∆মেকআপ এ ব্যাপারটায় লেখকের দোষ তেমন একটা নেই। মেকআপ করেছে “ঈশিন কম্পিউটার”। রোদেলার বইয়ের মেকআপ মূলত এরাই করে। ১৩ ফন্ট সাইজে আর ঊর্মি ফন্টে অধ্যায়ের নাম দিয়ে করা মেকআপে সমস্যা কেবল একটাই—পেপার কাটিংগুলো চাইলেই দৈনিক পত্রিকার ফরম্যাটে করতে পারতো। করেনি।
∆প্রুফিং কে করেছে লেখা নেই। সাধারণত প্রকাশক রিয়াজ খান একবার দেখেন। লেখকও দেখেন। বানানে টুকটাক ভুল আছে। মাত্রাতিরিক্ত নেই। “কি/কী” এর মধ্যে তফাৎ আছে। নিয়মটা অনুসরণ করতে হতো। এছাড়াও উদ্ধরণ চিহ্ন বিরাম চিহ্নের পরে বসে। পুরো বইয়ে দাঁড়ির আগে উদ্ধরণ চিহ্ন ( ”।=>।”) চোখে লেগেছে। মাত্র একটি রিপ্লেস কমান্ডে ত্রুটিটা দূর করা যেত। এজন্য “ঈশিন কম্পিউটার”কেও দোষের ভাগীদার হতে হবে।
∆অন্যান্য দিক ছাপা হয়েছে ৮০ গ্রাম কাগজে। তাই ছাপাও হয়েছে দারুণ। এছাড়াও কাপড়ের পুট বাঁধাই আর ফিতা দেওয়াটাও দারুণ কাজ হয়েছে। ২০৮ পেজের এই দারুণ কাজটির দাম কোয়ালিটি অনুযায়ী ২৫০৳ হওয়ায় তাই বেশ সাশ্রয়ী মনে হয়েছে।
সবশেষে বলবো, আপনিও অংশ নিতে পারেন এই “মহাযাত্রা”য়। সময়টা ভালোই কাটবে। আর শেষের দিকের টুইস্টগুলো একটু হলেও চমকে দেবে।
আঁধারে চলছে সময় টিক টিক টিক, পথে শত সহস্র বিপদ জানা-অজানা নেমেছে ওরা মহাযাত্রায়, কে থামাবে ওদের, ওরা তো থামবে না।
লেখকের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
একনজরে বই পরিচিতি ═══════════════════════════ বই : মহাযাত্রা জনরা : সাইকো থ্রিলার, কন্সপিরেসি লেখক : নাজিম উদ দৌলা প্রথম প্রকাশ : এপ্রিল ২০১৮ প্রচ্ছদ : শাহরিয়ার রাকিন বাঁধাই : হার্ড কভার পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২০৮ অধ্যায় : ২৪ প্রকাশনী : রোদেলা প্রকাশনী মুদ্রিত মূল্য : ২৫০৳ মাত্র প্রাপ্তিস্থান : অনলাইন ও অফলাইন সকল লাইব্রেরিতে
“The worst form of injustice is pretended justice.” —Plato
কাহিনি সংক্ষেপঃ অখ্যাত এক বস্তিতে অদ্ভুত এক মানুষের আগমন ঘটলো। নম্র-ভদ্র ও শিক্ষিত এই মানুষটা বসবাস শুরু করলো বস্তিতে। ধীরে ধীরে নরম স্বভাব ও দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে বস্তিবাসীর সুখ-দুঃখের অংশীদারে পরিণত হলো সে। মানুষটার নাম আদিব। অদ্ভুত এক খেলার অধিনায়ক সে৷ যে খেলার নাম মহাযাত্রা। আর এই মহাযাত্রার খেলাটার সুচারু রূপদানের জন্যই আদিব ঘটিয়ে চলেছে একের পর এক ঘটনা।
রহস্যজনক ভাবে একের পর এক খুন হচ্ছে। যেন কোন মৃত্যুদূত তার মৃত্যুশীতল স্পর্শ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে খুন হওয়া মানুষগুলোর শরীরে। যারা খুন হচ্ছে, তাদের কারো অতীতই একেবারে পরিচ্ছন্ন না। এদের প্রত্যেকেই কোন না কোন ভয়াবহ অপরাধে অপরাধী। তবে কি কেউ একজন তাদের সবাইকে নিজেদের অপরাধের শাস্তি দিতেই খুন করে চলেছে! নাকি সবাই নিছক কোন সাজানো নাটকের চরিত্র!
বস্তি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়া রহস্যময় স্বভাবের আদিবের সাথে অতি সাধারণ পারভিন নামের এক মেয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠলো। আদিবকে ভালোবেসে ফেললো মেয়েটা। কিন্তু মাঝে মাঝে মানুষটা হুটহাট করে কোথায় উধাও হয়ে যায়, জানেনা সে। আর যখন জানলো তখন থেকেই পুরো ওলটপালট হয়ে গেলো পারভিনের দুনিয়া।
প্রায় সাত বছর আগে সর্বদা পর্দার আড়ালে থাকা ব্যক্তির হাত ধরে শুরু হয়েছিলো ভয়াবহ এক খেলা। যার নাম মহাযাত্রা। এই গল্পের প্রতিটা চরিত্রই এই খেলার কোন না কোন খেলোয়াড়। আর আদিব নামের মানুষটা তাদের অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত এই খেলার ফলাফল জানতে হলে খেলাটা চালু রাখতেই হবে।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ সম্পূর্ণ দেশীয় পটভূমিতে রচিত মৌলিক থ্রিলার 'মহাযাত্রা' প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এটা পড়ার প্রতি অন্যরকম একটা আগ্রহ বোধ করছিলাম। শেষ পর্যন্ত বইটা পড়তে পারলাম। নাজিম উদ দৌলা তাঁর এই উপন্যাসে ঢাকার ক্রাইম জোন হিসেবে পরিচিত এক বস্তিতে বসবাসকারী আদিব নামের এক যুবক ও তার সাথে সম্পর্কিত আরো কয়েকজন মানুষের অংশগ্রহণে সংঘটিত নানা রোমাঞ্চকর ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি এখানে যে থিম নিয়ে কাজ করেছেন তা সাধারণত আমেরিকান থ্রিলার উপন্যাস ও মুভিগুলোতে বেশি দেখা যায়। একটা ডেথ গেম। যার নাম মহাযাত্রা। আর এই মহাযাত্রাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে পুরো ব্যাপারটা। পুরোপুরি দেশীয় আবহে পাঠকের সামনে এই থ্রিলার উপন্যাসটাকে উপস্থিত করেছেন নাজিম উদ দৌলা।
এর আগে লেখকের 'ইনকারনেশন' ও 'ব্লাডস্টোন' নামের দুটো উপন্যাস পড়েছিলাম। বরাবরই বেশ সুন্দর তাঁর বর্ণনাভঙ্গি। সাবলীলতায় পরিপূর্ণ ছিলো 'মহাযাত্রা'-ও। তবে এই উপন্যাসটাকে দারুনভাবে সিনেম্যাটিক বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। উপন্যাসের মূল চরিত্র আদিব ও পারভিনের কিছু সংলাপে বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ছাপ ছিলো। যদিও ব্যাপারটা আমার কাছে খারাপ লাগেনি। 'মহাযাত্রা' উপন্যাসটার কাহিনিকে উপজীব্য করে দারুন কোন সিনেমা বানিয়ে ফেলা যায়।
প্রচুর ভুল বানানে পরিপূর্ণ ছিলো বইটা। এর নানা জায়গায় সাজ-কে লেখা হয়েছে সাঁজ, নিরস্ত করাকে লেখা হয়েছে নিরস্ত্র করা, ফুটো-কে লেখা হয়েছে ফুট, জিমে (Gymnasium) কাটানোকে লেখা হয়েছে জিমে কাঁটানো। এরকম আরো অনেক ভুল বানান চোখে পড়েছে। লেখকের চন্দ্রবিন্দু প্রীতি দেখে আসলেই কিছুটা অবাক হয়েছি। ভবিষ্যতে লেখককে বানানের প্রতি যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। সেই সাথে একজন দক্ষ প্রুফরিডারের সাহায্য নেয়াটাও জরুরি বই প্রকাশের পূর্বে।
শাহরিয়ার রাকিনের করা প্রচ্ছদটা চমৎকার লেগেছে। আমি মূলত প্রথমে 'মহাযাত্রা'-এর প্রচ্ছদ দেখেই এটার প্রতি আগ্রহী হই। পরে সিনোপ্সিস পড়ে আগ্রহটা আরো বেড়ে যায়।
প্রতিদিনকার খবরের কাগজগুলোতে কালো হরফে ছাপা কিছু খবরকে নিয়েই গড়ে উঠেছে মহাযাত্রা -র প্লট। মূল চরিত্রের চাইতে ট্যুইস্ট ছিল শেষ টার্গেটের আচরণে। মূল চরিত্রকেই বোকা বানিয়ে ছেড়েছে। তবে আশা করেছিলাম বইয়ের প্রথম ভিক্টিম সবকিছুর মূল হোতা কিন্তু তা হতে হতেও হয়নি। তবে আসলাম আর তৌহিদের ভাগ্যে কি ঘটেছিলো জানার ইচ্ছে ছিল কিন্তু লেখক আর এগোননি সেদিকে।
সিম্পল কিন্তু সুন্দর, সাবলীল লেখনী। বস্তিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের চিত্র দক্ষতার সাথে তুলিতে এঁকেছেন।
এদিকে মহাযাত্রার ক্যাপ্টেন দূঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। দক্ষতার সঙ্গে একের পর একটা হত্যা করে যাচ্ছেন। ভিক্টিম হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে এমন লোকদের যারা পূর্বে কোনো না কোনো ক্রাইমের সাথে জড়িত ছিলো। আইনের ফাঁক দিয়ে বেড়িয়ে আসতে পেরেছে। তাই তাদের শাস্তি দিতে শুরু হয়েছে নতুন এক খেলা নাম মহাযাত্রা। অন্যদিকে ঢাকার ক্রাইম জুন হিসেবে পরিচিত এক বস্তিতে আগমন ঘটে এক অচেনা পুরুষের। নাম তার আদিব। বস্তির মানুষের সাথে মিশে গিয়ে তাদ���র সমস্যা সমাধানের পথ বের করে দেয়। বস্তির বাচ্চাদের নতুন এক জীবনের স্বপ্ন দেখায়। বাড়ির মালিক পারভীনের স্বপ্নের পুরুষ হয়ে উঠে। কিন্তু সে কিছুদিন পরপর কোথাও নিখোঁজ হয়ে যায়। আবার ফিরেও আসে কিন্তু তার পরিচয় কেউ জানে না। এতো শিক্ষিত সুদর্শন মার্জিত ব্যবহারের একটা ছেলে কেন পড়ে আছে বস্তিতে? কিসের আশায়? মহাযাত্রা ক্যাপ্টেনের সাথে তার কি কোনো যোগসূত্র রয়েছে? মহাযাত্রার ক্যাপ্টেনই বা কেন জড়িয়ে পড়লো এই খেলায়? পুরোটা জানতে হলে পড়তে হবে থ্রিলার লেখক নাজিম উদ দৌলার লেখা থ্রিলার বই মহাযাত্রা।
পাঠ প্রতিক্রিয়া- রোদেলা প্রকাশনী থেকে বইটি হাতে নিতেই রহস্যের প্রতি একটি টান অনুভূত হয়; সেই সাথে নতুন কিছু সাসপেন্সের একটি উত্তেজনা তো আছেই। বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলাম, আর চরিত্রদের কাণ্ড সম্পর্কে জানছিলাম । রিয়েল লাইফ ইন্সিডেন্ট আর কল্পনা ভুবনের কাহিনী পড়তে পড়তে কখন যে বইয়ের মাঝে ডুবে গিয়েছি, খেয়ালই করিনি। একটার পর একটা পৃষ্টা পড়েছি, আর বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। নিরন্তর শুভ কামনা রইলো নাজিম উদ দৌলার জন্য। ভবিষ্যৎয়ে এরকম আরও অনেক লেখা তিনি আমাদের উপহার দেবেন, সে প্রত্যাশাই রইল। কিছু স্পেলিংয়ে ভ্রান্তি আছে, বিরাম চিহ্নের যথাযথ ব্যবহার হয়নি বেশ কয়েক জায়গায়। পরবর্তী মুদ্রণে সংশোধন করা হবে বলে আশা করি। যারা এখনো পড়েননি, পড়ে ফেলুন। আশা করি, নিরাশ হবেন না।
শেষ করলাম মহাযাত্রা। অনেক আগেই কিনেছিলাম বইটা কিন্তু অনেক বইয়ের ভিড়ে পড়া হয়ে ওঠেনি। লেখকের নতুন বই মিথ্যা তুমি ১০ পিঁপড়া পড়ে টুইস্ট এর উপর টুইস্ট খেয়ে মনে পড়লো আমার কাছে তার লেখা আরও একটা বই আছে। তাই চট করে হাতে নিয়ে এক বসায় পড়ে ফেললাম এই বইটাও।
এবার আসি মহাযাত্রার কথায়। কাহিনী নিয়ে কিছু বলতে চাই না। স্পয়লার এড়াতে পারবো না তাহলে। তবে এটা বলতে হবে, লেখক এক কথায় টুইস্ট মাস্টার। গল্পের মাঝামাঝি একটা পর্যায় কিছুটা ধীরগতি মনে হয়েছে। কিন্তু শেষে ছিল অসাধারন একটা চমক!
বই শেষ কড়ে এখন আমার মহাযাত্রার জগতে আরও কিছুক্ষন থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। লেখক কি এর সিকুয়াল বের করবেন?
সত্যি কথা বলতে কি, বইটা পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো সিনেমাই দেখছি চোখের সামনে। চিরায়ত বাংলা সিনেমার একটা ফ্লেভার পাচ্ছিলাম। লেখকের অন্যান্য বইয়ের তুলনায় এতে থ্রিলটা অনেক বেশি ছিলো। একটা করে খুন হচ্ছিলো আর টান টান উত্তেজনার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বইতে একটা জিনিস থাকলে আরও ভালো হতো- যদি একটা পুলিশ ক্যারেক্টার থাকতো, যে নায়ককে চেজ করছে। তবে শেষের টুইস্টটা একদম মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। লা জওয়াব ছোট নাজিম!
কাহিনী সংক্ষেপ পড়ে মনে হয়েছিলো সমাজের যত অন্যায় এর প্রতিবাদ নিয়ে কোণ গল্প হবে। কিন্তু আমি আসলেই সারপ্রাইজড গল্পটা পড়ে! এতো চমৎকার একটা কাহিনী ফেঁদেছেন এখানে লেখক যা আপনার চিন্তা জগতে সেইরকম একটা নাড়া দিবে। আসলেই যদি বাংলাদেশে মহাযাত্রার প্রচলন হয়ে যেত তাহলে কি ঘটে যেতে পারতো তা ভেবেি আমার গায়ের লোম দারিয়ে যাচ্ছে। আর শেষে টুইস্তটাও ছিল অসাধারন।
যারা থ্রিলার জনরার বই পছন্দ করেন তাদের কাছে বইটা খুব ভালো লাগবে।