পার্টিশনের ঠিক পনেরো বছর বাদে অরুণ চন্দনপুর ফিরে এলো। নাকি সে পিছিয়ে এলো পনেরোটা বছর?
পূর্ববঙ্গের এই ছায়াঘেরা যমুনার কোল, রামকৃষ্ণবাবুদের আমবাগান, মধ্য দুপুরের খাঁ খাঁ করা হাটখোলা, আর পারমিতার অষ্পষ্ট স্মৃতি বুকে নিয়ে জহির এতদিন বসে ছিল, এই চন্দনপুরে। সে জানতো--দৃশ্যমান এই জগতে হারিয়ে যাওয়া কোনো স্থায়ী চিত্র নয়। অরুণ একদিন ঠিকই ফিরবে। সেই এক অমোঘ সত্যটা যে তাকে বড্ড পোড়ায়। অরুণ এসে সেই আগুন নেভাবে না?
প্রভাতী, সমসাময়িক এক আধুনিকার নাম। প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক, একগুঁয়ে, উড়নচণ্ডী মেয়েটা মাত্র কিছুকাল আগে আবিষ্কার করেছ--জহির তার বুকের মধ্যেকার সেই অপেক্ষা, যা তার বেঁচে থাকার প্রকৃত অর্থ বহন করে। অতীতের সেই উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলা, গৎবাঁধা দিন, আর জীবনের সাথে একলা যুদ্ধ করার কোনো মানে নেই। বাবা রাজেন সরকারের রাজনৈতিক আদর্শের সাথে নিজেকে মিলেমিশে তৈরি করা মেয়েটার হঠাৎই এ কোন বোধোদয় ঘটলো?
নাকি নূরজাহান, রেহানার মতো সেও এক চিরন্তন অপেক্ষা পুষে রেখেছে? বুকের গভীরে...
বছরের প্রথম বই হিসেবে পড়া হইলো শিহানুল ইসলামের ‘এপারে কেউ নেই’ বইটা। পুরো রিভিউতে বাংলাদেশকে ‘এপার’ আর কলকাতাকে ‘ওপার’ বলবো, ঠিক আছে?
গল্পের প্রেক্ষাপট ‘৪৭ এর দেশভাগকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে। গল্পটা শুরু হয় অরুণের চন্দনপুর অর্থাৎ এপারে আসার মধ্য দিয়ে। শেষবার যখন চন্দনপুরের মাটি ওর পায়ে লেগেছিল তখন ওর বয়েস ছিল ১৭। আজ দীর্ঘ ১৫ বছর পরে এপারে পা রেখে অরুণ ভাবছে সে কি ফিরে এলো, নাকি পিছিয়ে এলো পনেরোটা বছর? সে কি সত্যিই তাহলে আবার চন্দনপুরে পা দিলো? অরুণ বিস্মিত হলেও বিস্মিত হয় না অরুণের সেই সময়ের প্রাণের বন্ধু জহির। সে জানতো অরুণ আসবে, একদিন ঠিকই আসবে। আর তাইতো পূর্ববঙ্গের এই ছায়াঘেরা যমুনার কোল, রামকৃষ্ণবাবুদের আমবাগান, মধ্য দুপুরের খাঁ খাঁ করা হাটখোলা, আর পারমিতার অষ্পষ্ট স্মৃতি বুকে নিয়ে জহির এতদিন বসে ছিল, এই চন্দনপুরে। যে সত্যিটার মুখোমুখি হয়েছিল অরুণ সেই এক অমোঘ সত্যটা যে তাকে বড্ড পোড়ায়। অরুণ এসে সেই আগুন নেভাবে না?
সময়রেখা ৬০ এর দশকের বিভক্ত বাংলা হলেও গল্পে এসেছে অবিভক্ত বাংলার সময়কার কথা, স্মৃতি হিসেবে। তবে গল্পটির প্রেক্ষাপট দেশভাগ হলেও শুধু দেশভাগের গল্প নয় এটা। এখানে উঠে এসেছে কৈশোর, বন্ধুত্ব, প্রেম, সম্পর্ক, রাজনীতি, মাটির টান, আক্ষেপ, অভিমান, অপেক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশ্বাস করেন হুদাই পোস্টের ভাব বাড়াইতে এত শব্দ ব্যবহার করি নাই। আসলেই সবগুলা জিনিস ১৭৬ পেজের এ বইটাতেই পাবেন। শুধু এইগুলা না, আরো বহুত কিছু আছে। পড়লে ছুঁইতে পারবেন।
বইটারে কোন জনরায় ফেলা যায় সেইটা নিয়ে একটা কনফিউশন কাজ করছে আমার মাঝে। মানে মোটাদাগে এইটা তো অবশ্যই সমকালীন তবে তার চাইতেও প্রকট হইয়্যা উঠছে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটা। প্রতিটা চরিত্র সুন্দরভাবে চিত্রিত হইছে বইতে, বিশেষ করে কিশোর বয়সের অরুণ, জহির আর পারমিতাদি। পারমিতাদির চরিত্রটা লেখক অসম্ভব যত্ন নিয়ে তৈরি করছেন। তাকে বইতে আরো ভালোভাবে দেখার জন্য পাঠকের মন আকুপাকু করবে নিশ্চিতভাবে। মিল দেখাইতেছি না, তবে এইরকম ভাবে দেখার ইচ্ছা জাগছিল হেইরি রাইডার হ্যাগার্ডের শী’কে। থ্রিলার না হইলেও বইয়ের শুরুর দিকে, মাঝে দিকে যে সুতাগুলা ছাড়ছেন লেখক সেগুলো সুন্দরভাবে মেলানো হইছে সমাপ্তিতে। আর লেখকের লিখনশৈলী অসম্ভব সুন্দর। চমৎকার এক্সিউকিউশনের কারণে কোথাও গোত্তা খেয়ে পড়ে নাই বই। আর বইয়ের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে ৫টা চিঠি। আবেগের একদম মাপা ব্যবহার চিঠি তথা বইকে একদম অনন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। সেই সাথে বইতে থাকা রাজনীতি খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে এসে বইটাকে প্রায় পারফেক্ট একটা বই হিসেবে প্রমাণ করেছে।
পুরো বইতে অপ্রাপ্তি স্রেফ একটা (ওঠা প্রতিবার উঠা হয়ে গেছে, সেইটাকে আমি অপ্রাপ্তি না ধইরা তার দায় আমি প্রুফ রিডিং এর কাঁধে দিলাম)। সেটা হচ্ছে গত শতাব্দীর ৬০ এর দশক হিসেবে গ্রাম (বা বড়জোর মফস্বল) হিসেবে কুশীলবদের মুখের ভাষা মানানসই লাগেনি। বড্ড বেশি আধুনিক মনে হচ্ছিল। আর চরিত্রগুলোর আচার আচরণে আধুনিকতা কেমন যেন গ্রাম/মফস্বল হিসেবে মানাচ্ছিল না। তবে এ ব্যাপারে ঠিক জোরালোভাবে কিছু বলতে পারছি না কারণ ঐ সময়কালের এই বইয়ের সেটাপে খুব বেশি বই আমার পড়া নেই। হতে পারে এটা আমারই ভুল।
বইটা নিয়ে একটা আফসোস আছে। নতুন লেখক ২০১৮ সালে এ বইটা দিয়ে সাহিত্যে পদার্পন করছেন অথচ এই বইটা নিয়ে আজ এত বছর বাদেও তেমন আলাপ শুনিনা কোথাও। এই বইটা সকল দিক থেকে আলোচনার দাবীদার। আপনারা পইড়া দেখেন। লেখকের নাম যে বর্তমান সময়ের বড় বড় কথাসাহিত্যিকদের পাশে উচ্চারিত হবার দাবীদার সেইটা আপনারাও মানবেন বলে আমার বিশ্বাস।
বইটিতে মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা ও দ্বন্দ্ব নিয়ে দারুণ কাজের দেখা পেয়েছি। চরিত্রের পরিস্ফুটনও চমৎকার। অত্যন্ত সাবলীল লেখনী হলেও বইটি চিন্তা করতে বাধ্য করবে। দেশভাগ, চরিত্রের মধ্যকার অন্তঃস্থিত দ্বন্দ্ব ছাড়াও পাঠককে তার ব্যাক্তিগত দ্বন্দ্ব নিয়েও ভাবাবে। লেখকের প্রথম উপন্যাস হিসেবে এটি সিগনিফিক্যান্ট এক মাইলফলক অতিক্রম করেছে বলে আমার বিশ্বাস।
ধীর গতির গল্পের বই পছন্দ নয়?? আমারো তেমনটা ঠিক পছন্দ নয়। গল্পে টানটান উত্তেজনা, থ্রিল, টুইস্ট থাকলে তবেই না মজা!!
তবে কিছু বই ভিন্ন দৃস্টিতে ভাবতে শেখায়। "এপারে কেউ নেই" বইটি ধীরগতির। তবে পুরো গল্প জুড়ে মনে হয়েছে - এটাই যথার্থ। লেখক ধীরে ধীরে নাটাই থেকে গল্পের সুতো ছেড়েছেন। আর বইয়ের গল্পগুলো ঘুড়ির মত আকাশে উড়েছে।
লেখকের বর্ণনাভঙ্গি, লেখনী মুগ্ধ করেছে আমাকে। গল্পের প্লট, চরিত্র সবকিছুই মনোমুগ্ধকর।
ধীরগতির গল্প তাড়াহুড়ো করে শেষ করার বোকামি না করলে - এই বই মুগ্ধ করার মত।
This is not a 'Page Turner' type of book. Rather it is a 'Line Stopper'. You have to take a pause after some lines and have to think twice.
বইয়ের লেখক এবং ভূমিপ্রকাশ কে অসংখ্য ধন্যবাদ, এই দুর্যোগের সময়ে বইটি অনলাইনে পাঠ উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য ❤
থ্রিলার জনরার বাইরের বইগুলিও যাদের টানে - তাদের জন্য হাইলি রেকোমেন্ডেড।
মানুষের জীবনে অপূর্ণতা নেহাত কম না, সেগুলো অনবরত মানুষকে তাদের অস্তিত্ব মনে করিয়ে দিতে ভোলে না। তবে আমার ধারণা এরপরেও মানুষ দুঃখ পেতে ভালোবাসে। কারন, না হলে যে বইয়ের নাম, প্রথম পৃষ্ঠায় এত হাহাকার সে বই মানুষ কেন পড়বে।পড়ে আবার বলছেও যে বইটা তাদের ভালো লেগেছে, বলবে নাই বা কেন? কষ্ট পাওয়ার পরও এবইগুলো মনে যতটা দাগ কাটতে পারে, তার সাধ্য বোধ করি আর কোন বইয়ের নেই। শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট, ভিক্টোর হুগোর লে মিজারেবল কিংবা শরৎবাবুর দেবদাস তো বেঁচেই আছেই পাঠকের অশ্রুতে।
পাঁচটা চিঠি, কি অসাধারণ পাচটা চিঠি! কি প্রচন্ড অতৃপ্তির ছোঁয়া প্রতিটা বাক্যে, প্রতিটা শব্দে। বইটার নাম আর প্রচ্ছদ দেখেই কেন যেন মনে হয়েছিল বইটা অনেক ভালো লাগবে, অনেকদিন থাকবে আমার সাথে সৃতি হয়ে, কিন্তু কে জানত সেই স্মৃতি মোড়ানো থাকবে একবুক শূণ্যতা এবং হাহাকারে। আমি সাধারণত ধীরগতির বই পড়ে খুব একটা অভ্যস্ত নই। একেবারেই পড়ি না, তা নয়, তবে তুলনামূলকভাবে কম। এবইটা ধীরগতির, অন্তত আমার কাছে। কিছু কিছু লাইন পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থেকেছি অনেকটা সময়, কথোপকথনগুলো পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, যেটা আমার ক্ষেত্রে খুব একটা হয় না। তারপরও ২৪ ঘন্টার মধ্যেই শেষ করেছি। শুরু করেছিলাম, কালকে বিকেলে, শেষ হলো এইমাত্র।
পার্টিশন, বিশেষত ইন্ডিয়া-পাকিস্তান পার্টিশন নিয়ে আমার পড়া তৃতীয় ফিকশন এটা। কাকতালীয় কীনা জানি না, তিনটাই বেশ ভালো লেগেছে আমার। মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও স্থায়ী হওয়া, নিজের শিকর ফেলে অচেনা কোথাও উদ্বাস্তু হয়ে থাকার দহন যেন আমাকেউ সমানভাবে পোড়ায়। ২০১৮ সালের স্বাধীন বাংলাদেশে বসে ‘৪৭ এবং ‘৬২র সেই পরাধীন, অস্তিতিশীল বাংলাকে তুলে ধরা মোটেই সহজ কোন কাজ নয়। লেখক করে দেখিয়েছেন সেটা, বেশ ভাল��ভাবেই করেছেন।
মানুষের মনস্তত্বকে অনেক ভালোভাবে এঁকেছেন লেখক। মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যাগুলো বইয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় অংশ। লেখকের জীবনবোধ অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের। কথপকথন গুলো পড়ার পর অনেকক্ষন আবেশ রয়ে যায় তার। গল্পনিয়ে কথা বলতে চাই না, এই বইয়ের একটুখানি স্পয়লার দিয়ে দিলেও নিজেকে তার জন্য ক্ষমা করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। তাই, এখানেই থামছি আপাতত। তবে সামনে অনেক বই নিয়ে কথা বলতে গেছে ঘটনাক্রমে এই বইটা চলে আসবে হয়ত, কারন কিছু বই আছে যেগুলো স্মৃতিপটে অক্ষত থাকে অনেকদিন, কখনো বা অনন্তকাল!
. “সময় খুব নিষ্ঠুর একটা ঔষধ, যা ভুলতে চাই না, তা সুন্দর করে ধুলোর আস্তরণ মেখে ভুলিয়ে দেয়। আর যা ভুলতে চাই, তা স্তরে স্তরে গুছিয়ে রাখে বুকের মধ্যে।” . “দীর্ঘ এক জরাজীর্ণ পথ পেরিয়ে সুখের মুখ দেখা মানুষগুলো চাইলেই নিজের অতীত উপেক্ষা করতে পারে না। অতীতের ধরণই এমন যে-তা প্রিয় কিংবা অপ্রিয়, দুই অবস্থাতেই বুকের ভেতর গেঁথে থাকে।”
পার্টিশনের পনেরো বছর পর চন্দনপুরে এলো অরুণ। পার্টিশনের সেই উত্তাল সময়ে এদেশ ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমাতে হয়েছিল। কিন্তু কীসের টানে ফিরে এলো সে? যমুনার ঘোলা জল, রামকৃষ্ণবাবুদের আমবাগান, মধ্য দুপুরের খাঁ খাঁ করা হাটখোলা, বন্ধু জহির নাকি পারমিতাদির টানে? নাকি শুধুই শেকড়ের টানে? জহির অবশ্য জানতো - অরুণ একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। তাকে যে ফিরে আসতেই হবে। কিন্তু এক অমোঘ সত্যের টানাপোড়েনে অরুণের মুখোমুখি হতে পারে না সে। সেই সত্যটা যে তাকে পোড়ায় খুব! গল্পটা পারমিতাদির, যে এমন এক অনুভূতির নাম যা বুকের মধ্যে প্রতিনিয়ত উৎপন্ন হলেও ধরার উপায় নেই। গল্পটা প্রভাতীরও, কারও জন্য যে বুকের মাঝে অপেক্ষা পুষে রাখে। গল্পটা আর কিছু প্রশ্নের। ওপারের সব কেমন আছে? এপার মিশে যায় বুকের মাঝে? এমন অধীর হয়ে আছে ওপারও? বুকটা পোড়ে না?
পাঠ পর্যালোচনা : লেখক একধরনের মায়া তৈরি করেছেন বইটাতে। তাই চটজলদি করে বইটা পড়ে ফেললেই চলে না। পড়ার সময় মিশে যেতে হয় লেখার বর্ণনাতে, চরিত্রগুলোর টানাপোড়েনে। কথোপকথনের মাঝে মানবমনের গতিপ্রকৃতির গভীরতায় ডুব দিতে হয়। পাঁচটি চিঠির পসরা দিয়ে বইটি সাজিয়েছেন লেখক। প্রতিটি চিঠিতেই যেন লুকিয়ে আছে টুকরো টুকরো গল্প। ফুটে উঠেছে হাহাকার, বেদনা আর অমোঘ সত্যের টানাপোড়েন।
গল্পটা অরুণের। দেশ ছেড়ে যাওয়ার এক যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পর যে ফিরে এসেছে নাড়ির টানে। পার্টিশনের পর যাকে প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল ওপারে।
গল্পটা জহিরের। উত্তাল সেই সময়ে যে প্রিয় বন্ধুকে নিজের বাড়িতে জায়গা দিতে পারেনি। যার অনুশোচনা পনেরো বছর ধরে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। পারমিতার অষ্পষ্ট স্মৃতি বুকে নিয়ে জহির অপেক্ষা করছিল। সে জানতো- অরুণ একদিন ঠিকই ফিরবে৷ সেই এক অমোঘ সত্যটা যে তাকে বড্ড পোড়ায়৷ তার বিশ্বাস, অরুণ এসে সেই আগুন নেভাবে। সত্যিই কি অরুণ জহিরের বুকের মধ্যকার আগুন নেভাতে পেরেছে?
গল্পটা প্রভাতীর। প্রচন্ড আত্মকেন্দ্রিক, একগুঁয়ে, উড়নচন্ডী মেয়েটা মাত্র কিছুকাল আগে আবিষ্কার করেছে- জহির তার বুকের মধ্যেকার সেই অপেক্ষা, যা তার বেঁচে থাকার প্রকৃত অর্থ। মেয়েটা জীবনের সাথে একলা যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। তাই সে জহিরকেই আঁকড়ে ধরতে চায়।
গল্পটা নূরজাহানের, সেও বুকের গভীরে এক চিরন্তন অপেক্ষা পুষে রেখেছে। অপরিচিত শহরের প্রতি যার অদ্ভুত ভালোবাসা …
গল্পটা রাজেন সরকারের। যিনি রাজনৈতিক আদর্শের সাথে নিজেকে একাকার করে দিয়েছেন। এবং গল্পটা অবশ্যই পারমিতার। যে বইয়ে নেই, কিন্তু পুরো বই জুড়ে যার আবেশ ছড়িয়ে আছে।
গল্পটা সাতচল্লিশের উত্তাল সময়ের মুখোমুখি হওয়া মানুষগুলো মনস্তত্ত্ব নিয়ে …
পাঠ প্রতিক্রিয়া
সাধারণত থ্রিলার হাইভোল্টেজ বইগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, একবার বই হাতে নিলে শেষ না করে রাখা যায় না। এসবক্ষেত্রে জীবনধর্মী বইয়ে অত স্পিডে না পড়লেও চলে। আমি চেয়েছিলাম এই বইটি তারিয়ে তারিয়ে পড়ব। একটু একটু করে পড়বো যাতে শেষ না হয়ে যায়। কিন্তু আমি আমার ইচ্ছেটাকে বহাল রাখতে পারিনি। বইটা পড়তে শুরু করার পর অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতায় ডুবে গিয়েছি। মনে হচ্ছিল একটা অস্ফুট হাহাকার বুকের মধ্যে আটকে আছে। তাই টানা পড়ে যাচ্ছিলাম, যদি এই হাহাকারের আবেশ থেকে বেরুতে পারি … শেষ পর্যন্ত বেরুতে পেরেছিলাম কি না, বলবো না। সেটা আপনারা নিজেরা যাচাই করবেন।
প্রভাতীর চরিত্রটার মধ্যে যেন নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমার কেন যেন মনে হয়, এই বইয়ের কোনো না কোনো চরিত্রে মেয়েরা নিজেকে খুঁজে পাবেই। চরিত্রগুলো যেন তৈরিই করা হয়েছে সেভাবে।
পুরো বইটা যেন একটা চিঠির পশরা। মোট পাঁচটি চিঠি বইয়ে। চিঠিগুলো যেন একেকটা গল্প। নিজের ভিতরের স্বত্ত্বার প্রকাশ, পারিপার্শ্বিকতা, আবেগ, জীবনবোধে টইটম্বুর। বইয়ে চিঠির ফ্রন্টটাও দারুণ। হাতে লেখা চিঠির ফ্লেভার পাচ্ছিলাম।
বইয়ের কিছু কিছু জায়গা পড়ে কেমন ধাক্কার মতো লাগে।
"শুধু কাছে থাকলেই ছোঁয়া যায়? তুই পারছিস অরুণ আমায় ছুঁতে?" এই লাইন পড়ে তীব্রভাবে কেঁপে উঠেছিলাম। সত্যিই তো। পাশাপাশি বসে থেকেও যেন অরুণ আর তার বন্ধুকে ছুঁতে পারছিল না।
বর্ণনাভঙ্গির কথা একদম না বললেই নয়। প্রকৃতির এরকম উপমারহিত সৌন্দর্য আর পড়িনি। বই থেকে কয়েকটা লাইন তুলে দিই। " চন্দনপুরের ভোর মানে এক পাল ঠান্ডা বাতাসের পরশ৷ মনে হয়- কাছেই কোথাও খুব জোরে ঢল নেমেছে৷ অথচ তা নয়, হাজার মাইল পেরিয়ে এইখানে এসে বাতাসেরা একটু জিরিয়ে নেয়৷ যমুনার ঘোলা জলের ওপর আলতো করে শুয়ে থাকে, গা ধোয়৷ তারপর ভেজা শরীর নিয়ে বয়ে চলে যায় পশ্চিমের কোন মরুভূমিতে … "
কিংবা
" … যমুনার বিশালতার মধ্যে বুঁদ হয়ে রইল খানিক্ষণ৷ এরপর আমায় পেছনে ফেলে পাড় ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে লাগল৷ স্রোতের উল্টোদিকে৷ আমি বেশ জোর গলায় বললাম, 'তোর একটা চিঠি আছে আমার কাছে৷ পারমিতা'দির লেখা৷ এতদিন ঠিকানা ছিল না বলে পোস্ট করা হয়নি৷' অরুণের কোন সাড়া শব্দ নেই৷ তাকিয়ে দেখি- অনেকটা দূরে চলে গেছে৷ আমার নাগালের বাইরে৷ এই দূরত্ব ঘোচায়, কার সাধ্য?"
কথোপকথনগুলো মোটেও সাধারণ নয়। ডায়লগগুলোর মধ্যে যে কী গভীর মনস্তত্ত্ব! আমি শিওর এই লোক তার বৌকে এরকম বাক্যবাণ দিয়েই কাবু করবে!
কেবল প্রশংসাই করে গেলাম। একটা বইয়ে কোনো খুঁত থাকবে না, তা তো হয় না। খুঁত আছে। তা হলো, লেখনীতে ওপার বাংলার একটা টান আসে। ঠিক নির্দিষ্ট কোনো লেখকের মতো নয়। ওপারের লেখকেরা কিছু বিশেষ শব্দ ব্যবহার করেন নিজেদের লেখায়। সেসব শব্দের কিছু এই বইয়েও আছে। তবে লেখনীতে ডুবে গেলে এটা খুব একটা সমস্যা করে না।
বইয়ের প্রচ্ছদ একদম পারফেক্ট হয়েছে টপিকের সাথে। বাঁধাইও বেশ ভালো। নতুন প্রকাশনী হিসেবে ভূমি ভালো কাজ দেখাচ্ছে।
খুব করে আবেশিত হতে চাইলে, বইয়ের পাতায় পাতায় বুঁধ হয়ে থাকতে চাইলে "এপারে কেউ নেই" বইটি আমার পক্ষ থেকে হাইলি রেকমেন্ডেন্ট।
বই- এপারে কেউ নেই (মনস্তাত্ত্বিক সামাজিক উপন্যাস) লেখক- শিহানুল ইসলাম প্রচ্ছদ- সজল চৌধুরী প্রকাশনা- ভূমি প্রকাশ মলাট মূল্য- ২১০ প্রকাশকাল - বইমেলা ২০১৮
বইয়ের নাম: এপারে কেউ নেই লেখকের নাম: শিহানুল ইসলাম ধরণ: মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস প্রকাশনী: ভূমিপ্রকাশ প্রথম প্রকাশ: ২০১৮ প্রচ্ছদকার: সজল চৌধুরী পৃষ্ঠা: ১৭৬ মুদ্রিত মূল্য: ২১০ টাকা
ফ্ল্যাপের লেখা:
পার্টিশনের ঠিক পনেরো বছর বাদে অরুণ চন্দনপুর ফিরে এলো। নাকি সে পিছিয়ে এলো পনেরোটা বছর?
পূর্ববঙ্গের এই ছায়াঘেরা যমুনার কোল, রামকৃষ্ণবাবুদের আমবাগান, মধ্য দুপুরের খাঁ খাঁ করা হাটখোলা, আর পারমিতার অষ্পষ্ট স্মৃতি বুকে নিয়ে জহির এতদিন বসে ছিল, এই চন্দনপুরে৷ সে জানতো— দৃশ্যমান এই জগতে হারিয়ে যাওয়া কোনো স্থায়ী চিত্র নয়। অরুণ একদিন ঠিকই ফিরবে। সেই এক অমোঘ সত্যটা যে তাকে বড্ড পোড়ায়। অরুণ এসে সেই আগুণ নেভাবে না?
প্রভাতী, সমসাময়িক এক আধুনিকতার নাম। প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক, একগুঁয়ে, উড়নচণ্ডী মেয়েটা মাত্র কিছুকাল আগে আবিষ্কার করেছে— জহির তার বুকের মধ্যেকার সেই অপেক্ষা, যা তার বেঁচে থাকার প্রকৃত অর্থ বহন করে। অতীতের সেই উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলা, গৎবাঁধা দিন, আর জীবনের সাথে একলা যুদ্ধ করার কোনো মানে নেই। বাবা রাজেন সরকারের রাজনৈতিক আদর্শের সাথে নিজেকে মিলেমিশে তৈরি করা মেয়েটার হঠাৎই এ কোন বোধোদয় ঘটলো?
নাকি নূরজাহান, রেহানার মতো সেও এক চিরন্তন অপেক্ষা পুষে রেখেছে? বুকের গভীরে...
মূল রিভিউ:
ফ্ল্যাপের লেখা পড়লেই বুঝা যায় যে অরুণ, জহির এ দু'জন উপন্যাসের নায়ক, আর তাদের বেশিরভাগ কথা পারমিতাকে ঘিরে, পারমিতাদির স্মৃতিচারণ। তাই পারমিতাকে নায়িকা বললে ভুল বলা হবে না। আবার পুরো বইতে জহিরের প্রভাতীকে উদ্দেশ্য করে লেখা বড় বড় চিঠিগুলো তাকেও নায়িকার আসনে বসাবে। একটা উপন্যাসে একটাই নায়ক, নায়িকা হবে এমন কোনো কথা নেই। কে মূল চরিত্র, কে পার্শ্বচরিত্র এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময়ই পাবেন না, যদি কাহিনির গভীরে অবগাহন করতে পারেন।
কথাগুলো কি খুব হেয়ালী মনে হচ্ছে? এ উপন্যাস পড়ার পর মনে হলো কোনো গতানুগতিক রিভিউ দিব না। গল্পচ্ছলে কিছু ব্যাপার তুলে ধরি। তাহলে হয়তো বইটির ব্যাপারে আপনাদের আগ্রহ আরো বাড়তে পারে!
জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত আসে, যখন আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। এমন অনেক ঘটনা ঘটে যখন আমাদের অবশ্যই কিছু করা উচিৎ, কিন্তু কিছুই করার থাকে না৷ কোনো এক অদৃশ্য শেকলে হাত-পা বাঁধা থাকে। আপন মানুষকে না চাইতেও দূরে ঠেলে দিতে হয়, তা সে যত আপনই হোক। এমনই ঘটনা ঘটেছিল পার্টিশনের সময়। জহির আর অরুণের ভাগ্য যখন নির্ধারিত করেছিল দেশভাগের কাঁটাতারের সীমানা। বয়ঃসন্ধিকালের অসহ্য সময়ে যখন আশেপাশের পরিস্থিতিও অসহ্য হয়ে উঠেছিল। যে ভূখণ্ডে জন্মে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সেখান থেকে সরে যেতে হয়েছিল অরুণদের৷ হ্যাঁ, ৪৭ এর দেশভাগের সময়ের গল্প এটা৷ অরুণ আর জহিরের মনে হাজারখানেক প্রশ্ন জন্ম দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আলাদা করে দেবার গল্প এটা।
অরুণ, জহির। একজন হিন্দু, একজন মুসলিম। পাশাপাশি বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই যাদের সম্পর্ক বন্ধুর চেয়েও ভ্রাতৃত্বের, ভালোবাসার চেয়েও মায়ার। এ দুজনের বয়ঃসন্ধিকালের ভালোবাসা, প্রথম প্রেম একজন— পারমিতাদি। যে খুব সাদামাটা হয়েও আর দশটা মেয়ের থেকে আলাদা, নিজের মতো। যাকে ঘিরে অরুণ আর জহিরের শৈশব, কৈশোর কেটেছে, সেই পারমিতাদির জন্য ভালোবাসা তাদের মধ্যে কিছুটা মান-অভিমানের জন্ম দিয়েছে। তবু, মানুষ তো! এজন্মে সবকিছু পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবু, একটা আক্ষেপ তো থেকেই যায়!
পার্টিশনের দীর্ঘ পনেরো বছর পর অরুণ ফিরে এলো— না, ফিরে এলো না বলে বেড়াতে এলো বলি, কেমন? অরুণ বেড়াতে এলো, জহিরদের বাড়িতে৷ সেই পুরনো জানালার গরাদের ফাঁকে মাথা গলিয়ে গালে ঠান্ডা কোমল স্পর্শ পাওয়া। আহ, এমন সুখ আর কোথাও কি পাওয়া যায়? কোলকাতার সেই ঘিঞ্জি জীবনে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যস্ততায় কবে পাওয়া গেছে এমন ঠাণ্ডা কোমল স্পর্শ?
যমুনাকে দেখে বড্ড মন খারাপ হয়৷ এক দেড় মাইল কাছে এগিয়ে এসেছে সর্বনাশা স্রোতের সাথে। পারমিতাদির বাড়ি কবে কোথায় হারিয়ে গেলো? তবে কি সে অনেক দেরী করে ফেলেছে? আর কি পাবে না পারমিতাদির খোঁজ? কোথায় আছে, কেমন আছে সে?
জহিরের বাড়িতে সবকিছুই পাওয়া যায়। তবে সন্ধ্যার আগে জহিরকে পাওয়া মুশকিল। অফিসে যেয়ে এক দেড় ঘণ্টা অনর্থক বসে থাকে। অরুণের মুখোমুখি হতে বিবেকে বাঁধে৷ অরুণরা চলে যাবার দিন যদি সে অমন না করতো, হয়তো আজ তাদের জীবন অন্যরকম হতো!
মনের বোঝা কমাতে প্রভাতীকে লেখা চিঠি। বড় বড় সব চিঠিতে ভাবের সাথে মনেরও আদান প্রদান চলে হয়তো। জীবনের এ প্রান্তে এসে এই একজনকেই সে সবকিছু বলে নির্ভার হতে চায়৷ প্রভাতী, যে থাকে যমুনার অপর পাড়ে। প্রভাতী, যে কুমারী থাকার সিদ্ধান্তে অনড়, তবুও জহিরের কথা শুনলে যার ভেতরে সব ওলোটপালোট হয়ে যায়।
ব্যক্তিগত মতামত:
আমার কাছে কোনো বই ভালোলাগার পূর্বশর্ত একটাই— বইয়ের কাহিনি টানতে হবে৷ কাহিনি টেনেছে গভীরে, হারিয়েছি অতলে। রিভিউ লেখার সময়েও মনে হচ্ছে কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। কী বলবো, কীভাবে বর্ণনা করবো, আজ বড্ড বিশেষণহীনতায় ভুগছি। লেখকের প্রথম বই পড়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবার বইমেলায় প্রকাশিত "সন্ধ্যে নামার আগে" বইটি সংগ্রহ করবো৷ সংগ্রহ করেছি। পড়ে অতিসত্ত্বর রিভিউও দিব। একজন লেখকের দায়িত্ব যদি হয় ভালোমানের বই পাঠকদের উপহার দেওয়া, আমার মনে হয় একজন পাঠক হিসেবে নিজের ভালোলাগা, মন্দলাগা লেখককে জানানোও কর্তব্য। আমি আশা করছি আমার কর্তব্য আমি যথার্থভাবে পালন করেছি।
এই বইয়ের অনেক প্রিয় সংলাপ আছে। পুরো বইতেই অনেক সুন্দর সুন্দর ভাবনার খোরাক জাগায় এমন সুন্দর লাইন আছে। তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় লাইন এটি— "বয়স হলে তো মানুষ একেকজন একেকটা দ্বীপ হয়ে যায়। কারুর নাগাল আর কেউ পায় না।"
বইঃ এপারে কেউ নেই লেখকঃ শিহানুল ইসলাম প্রচ্ছদঃ সজল চৌধুরী প্রকাশনাঃ ভূমি প্রকাশ প্রকাশকালঃ ২০১৮ মুদ্রিত মূল্যঃ ২১০
পার্টিশনের ঠিক পনেরো বছর বাদে অরুণ চন্দনপুর ফিরে এলো। নাকি সে পিছিয়ে এলো পনেরোটা বছর?
পূর্ববঙ্গের এই ছায়াঘেরা যমুনার কোল, রামকৃষ্ণবাবুদের আমবাগান, মধ্য দুপুরের খাঁ খাঁ করা হাটখোলা, আর পারমিতার অষ্পষ্ট স্মৃতি বুকে নিয়ে জহির এতদিন বসে ছিল, এই চন্দনপুরে। সে জানতো--দৃশ্যমান এই জগতে হারিয়ে যাওয়া কোনো স্থায়ী চিত্র নয়। অরুণ একদিন ঠিকই ফিরবে। সেই এক অমোঘ সত্যটা যে তাকে বড্ড পোড়ায়। অরুণ এসে সেই আগুন নেভাবে না?
প্রভাতী, সমসাময়িক এক আধুনিকার নাম। প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক, একগুঁয়ে, উড়নচণ্ডী মেয়েটা মাত্র কিছুকাল আগে আবিষ্কার করেছে জহির তার বুকের মধ্যেকার সেই অপেক্ষা, যা তার বেঁচে থাকার প্রকৃত অর্থ বহন করে। অতীতের সেই উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলা, গৎবাঁধা দিন, আর জীবনের সাথে একলা যুদ্ধ করার কোনো মানে নেই। বাবা রাজেন সরকারের রাজনৈতিক আদর্শের সাথে নিজেকে মিলেমিশে তৈরি করা মেয়েটার হঠাৎই এ কোন বোধোদয় ঘটলো?
নাকি নূরজাহান, রেহানার মতো সেও এক চিরন্তন অপেক্ষা পুষে রেখেছে? বুকের গভীরে...
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ প্রচলিত একটা কথা আছে, Slow and steady wins the race. সেই কথার সুর ধরে বলতে গেলে বইটি স্বার্থক। বইটার শুরুটা অনেক ধীরগতিতে এগিয়েছে, সত্যি বলতে আগ্রহ জন্মাচ্ছিলোনা, বিরক্ত হচ্ছিলাম, তাও আরেকটু পড়ি আরেকটু জানি করতে করতে লেখক আস��তে আস্তে গল্পের সুঁতো ছাড়তে শুরু করেছেন, এবার আগ্রহ জন্মাতে শুরু করলো এটার পেছনের যুক্তি কি, এটা কেন? এটার রহস্য কি। তখন আর গল্পটা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। বইটা এমন একটা বই কিছু কিছু পৃষ্ঠা পড়ে ফেলে অন্য পৃষ্ঠায় যাওয়ার আগে আপনাকে ভাবাবে পরিস্থিতি সম্পর্কে। গল্পটা মূলত পার্টিশন এর সময়কার আশেপাশের কিছু সাধারণ চরিত্র নিয়ে। দেশ ভাগের সময় কি ঘটেছিল, কিভাবে মানুষজন ভিটেমাটি, আত্বীয়স্বজন, সম্ভ্রম হারিয়ে দেশ ছেড়েছেন এসব ৷ গল্পটা একটানা বসে পড়তে পারা কষ্টকর,গল্পের ধীর গতির কারণে, লেখক অনেক সময় দিয়েছেন একেকটা চরিত্রের পেছনে যার জন্য চরিত্র গুলোর বিল্ড আপ ও শক্তপোক্ত ছিল। বর্ণনাভঙ্গী ছিল অত্যন্ত অসাধারণ। প্রতিটি লাইনে লেখকের বাক্যগঠন, দৃশ্য উপস্থাপনের মুনশিয়ানা বেশ ভালো লেগেছে৷ তবে কিছু কিছু সংলাপ মনে হয়েছে অপ্রোয়জনীয়। আবার কিছু কিছু সংলাপ বারবার উঠে আসছিলো, চরিত্রের খাতিরে হিসেব করলে এক দিক দিয়ে ঠিক মনে হবে। সবগুলো চরিত্রের প্রতি পূর্ণ জাস্টিস হয়েছে বলা চলে, কোনোটা থেকে কোনোটা কম না৷ কে গল্পের নায়ক কে নায়িকা এই বিচারকার্যে নিজেকে বসালে উত্তর পেতে বেশ বেগ পেতে হবে। ধীর গতির বই হলেও লেখক সংলাপ এর মাঝে একটা করে সাসপেন্স রেখে দেন যার ফলে এটার সমাধান এর জন্য হলেও সামনের দিকে এগোতে হবে। প্রেম, সাসপেন্স, ইতিহাস, প্রতিহিংসা, স্বার্থপরায়ণতা সব কিছুই বেশ সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন৷ গল্পে পাঁচটা চিঠির উল্লেখ আছে যেই চিঠিগুলোর মধ্যেই হয়ত পুরো গল্পের রহস্য লুকায়িত। শুরুটা যেমন স্লো ছিল, শেষটা ততটা ধীরে হয়নি। বইটা শেষ করে হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসেছিলাম। বেশ ভালো স্টোরিটেলিং, খুব সুন্দর লেখনী। সব মিলিয়ে অনেক ভালো সময় কেটেছে বইটার সাথে। যদি ধৈর্য্য ধরে রেখে পড়তে পারেন তাহলে অসাধারণ একটা বই এর স্বাদ গ্রহণ করতে চলেছেন। গল্পের সংলাপগুলোতে দর্শনের ভালো মাত্রা পরিলক্ষিত হয়েছে। বেশ কিছু পছন্দের সংলাপের মধ্যে অন্যতম-
★ সময় খুব নিষ্ঠুর একটা ঔষধ। যা ভুলতে চাই না, তা সুন্দর করে ধুলাের আস্তরণ মেখে ভুলিয়ে দেয়। আর যা ভুলতে চাই, তা স্তরে স্তরে গুছিয়ে রাখে বুকের মধ্যে।
★ বয়স হলে তাে মানুষ একেকজন একেকটা দ্বীপ হয়ে যায়। কারোর নাগাল আর কেউ পায় না।
"ওপারের সব কেমন আছে? এপার মিশে যায় বুকের মাঝে? এমন অধীর হয়ে আছে ওপারও? বুকটা পোড়ে না?"
"আমাদের কোন দেশ নেই জেঠিমা। আমরা এপার থেকে বিতাড়িত, ওপারেও যথাযথ সম্মান পাই না। রিফিউজি তকমাটা সহজে ঘুচবে না আমাদের।" অরুণের এই কথাটায় যে হাহাকার তা দেশভাগ সম্পর্কে জানা প্রতিটা লোকই অনুভব করতে পারবেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে বর্তমানে প্রায় অনুপস্থিত একটা টপিক হল দেশভাগ। ইংরেজরা চলে যাবার পর যখন দেশভাগ হল তখন দেশের সাথে যে কত পরিবার কত সম্পর্কও ভাগ হয়ে গেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমার দাদার বড় বোন যিনি দেশভাগের পর ভারতে চলে গিয়েছিলেন, তার সাথে আক্ষরিক অর্থেই আমার দাদার আর কখনও দেখা হয়নি। অসংখ্য পরিবার অসংখ্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক হারিয়ে গেছে এই সীমানার দুপাশে। এমনই কিছু সম্পর্কের গল্প রয়েছে শিহানুল ইসলামের এপারে কেউ নেই উপন্যাসে। আমার ছোটবেলা কেটেছে উত্তরবঙ্গে। বছরখানেক আগে আমি কাজের সুবাদে একবার গিয়েছিলাম। যে গলিতে আমার শৈশব আর কৈশোরের শুরুটা কেটেছে সেই গলিতে গিয়ে দেখলাম অনেক কিছুই চিনতে পারছি না। প্রায় অচেনা সেই মফস্বলে ফেলে আসা সম্পর্কগুলো সেদিন আমি আর খুঁজে পাইনি। পাবার কথাও না। শিহানের উপন্যাসের শুরুর অরুণের সাথে সেদিনকার আমার পার্থক্যটাও এখানে। অরুণ ফেলে আসা সম্পর্কগুলো খুঁজে পেয়েছিল। জহিরের মাঝেও নিজেকে খুজে পাওয়া যায়। পারমিতা আর প্রভাকে খুঁজে না পাওয়ার কষ্টটার সাথে প্রত্যেকেই নিজেকে সহজে একাত্ব করতে পারে। উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণের স্বার্থকতাই এখানে। চরিত্রগুলোর মধ্যে নিজেকে খুঁজে না পেলে। সেই চরিত্রটি স্বার্থক হয় না। সেক্ষেত্রে চরিত্রায়নের দিক থেকে শিহানুল ইসলাম স্বার্থক। এপারে কেউ নেই পড়ে মনেই হবে না এটা শিহানের প্রথম উপন্যাস। চরিত্র চিত্রায়ন, বর্ণনা, ডেভলপমেন্ট, প্লট এবং চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্ব ফুটিয়ে তোলার মধ্যে যে মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় তা সত্যিই আশাতীত। কিছু কিছু জায়গায় আমার একটু বাধোবাধো ঠেকেছে, এডিটিং আর প্রুফ রিডিংয়ের ক্ষেত্রে লেখককে আরেকটু যত্নবান হওয়া উচিত। উপন্যাসটির চরিত্র আর ডায়লগের মধ্যে যে কাব্যভাব তা আমার কাছে একটু বেশি মনে হয়েছে। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। আমি একটু হিউমার দেওয়া বা কাঠখোট্টা বর্ণনা পছন্দ করি বলেই হয়ত। এপারে কেউ নেই দেশভাগের গল্প না, গল্পটা সম্পর্কের, হারানো শেকড়ের। একবার পড়লে যেকারো ভালো লাগবেই। শিহানুল ইসলাম এই উপন্যাসে নিজের স্বকীয়তা দেখাতে সফল। আমি এপারে কেউ নেই, এর সিক্যুয়েল আর লেখকের সাফল্য কামনা করি।
ভুমিপ্রকাশ এর সাপ্তাহিক গিভঅ্যাওয়ে থেকে বইটা পাই। এর সাথে "দ্য থিফ" বইটাও নিয়ে নেই।
এই বই পাওয়ার আগে এই বই কেনো, লেখক সম্পর্কেও জানা ছিলো না আমার।
আমার কাছে একদম নতুন লেখক হিসেবে গল্প, লেখকের লেখনী দুইটাই ভালো লেগেছে।
গল্পের প্রেক্ষাপট ৬০এর দশকের সময়ের। অরুণ প্রায় ১৫ বছর পর চন্দনপুর ফিরে আসে, যেখানে সে এক সময় থাকত। অনেকটা স্মৃতির তাড়নায়,আবার বলা যায় জন্মস্থানের শিকড়ের টানে। যেখানে একসময় সে, জহির, পারমিতাদি একসাথে ঘুরে বেড়তা। প্রায় পনেরো বছর আগেই হঠাত করেই পারমিতাদির বিয়ে হয়ে অন্যত্র চলে গেলেও জহির তখনো সেখানেই থাকে। বহু দিন পর এসে দেখে আগের থেকে প্রায় অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। পুরনো জায়গায় আসতে পেরে ভালো লাগলেও পুরনো কিছু স্মৃতি যা আক্ষেপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিছুটা স্মৃতিচারণার পাশাপাশি ৬০ এর দশকের বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থাও পরিলক্ষিত হয়। তবে এটা মুল বিষয় নয় বইটির। মূলত বন্ধুত্ব, প্রেম, নাড়ির টান এগুলো মুখ্য বিষয়, যা লেখক খুবই সুন্দর ধীরস্থিরভাবে এগুলো একের পর এক গল্প বুনে গেছেন।
চরিত্রায়ন বেশ ভালো ছিলো। আর উল্লেখযোগ্যভাবে পারমিতাদির কথা বলতেই হয়।
বইটা পড়ার সময় আমি নিজের সাথে দুই একটা বিষয় নিয়ে রিলেট করতে পারতেছিলাম।
তবে একটা জিনিস ভালো লাগে নাই। গল্পের প্রেক্ষাপটের সময়ের গ্রাম্য ভাষা তুলনামূলক বেশি শহুরে কথ্য, আধুনিক ভাষা মনে হইছে। সচরাচর এইভাবে গ্রামে কেউ তেমন একটা কথা বলে না।
সবমিলিয়ে বেশ ভালো একটা বই বলা যায়। যদি স্লো বার্ন বই ভালো লাগে, তাহলে এটা পড়ে দেখতে পারেন। আশা করি ভালো লাগবে।
দেশভাগ নিয়ে লেখা বইগুলো আমার কখনো ঠান্ডা মস্তিষ্কে পড়া হয়না। উত্তপ্ত মস্তিষ্কে স্রেফ গো গ্রাসে গিলতে থাকি।
অরুন, জহির, প্রভাতী সহ আরো অনেকের কাহিনী। যাদের বেশিরভাগ দেশভাগের সময় হারিয়েছে ভিটেমাটি, হারিয়েছে আত্মীয় পরিজন, হারিয়েছে সম্ভ্রম , হয়েছে দেশছাড়া। অরুণ, দেশভাগের সতেরো বছর পরে ফিরে এসেছে পূর্ব বাংলায়। এখানেই তার শেকড় আবার দেশভাগের ফলে এখানেই সে সবকিছু হারিয়েছে। জহির, যদিও ভিটেমাটি ছাড়তে হয়নি, তবুও দেশভাগ তার অনেককিছুই কেড়ে নিয়েছে। প্রভা, দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলা না ছেড়ে যাওয়া কিছু হিন্দুদের একজন। কিন্তু তারো আছে নির্মম ইতিহাস। নুরজাহান, ওপার বাংলা ছেড়ে আসতে হয়েছে। পিছনে রেখে আসতে হয়েছে আদরের ছোট বোন আর প্রিয় মানুষটি। পারমিতা, কৈশোর পেরুনো এক উচ্ছল মেয়ে। অস্থির সময়ের অস্থির কিছু ঘটনার সাক্ষী।
অসাধারণ একটা কাহিনী, অসাধারণ লেখনী। বইটা পড়তে গিয়ে বিন্দুমাত্র মনে হয়নি নতুন লেখকের বই পড়ছি। পরিশীলিত বাংলায় লেখা বইটি এক বসায় মুগ্ধ হয়ে পড়ার মতো।
"অথচ সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো সেই মানুষগুলোরই, যারা জানে না - পার্টিশন কী, মাইগ্রেশন কী । মুহুরমুহ দাঙ্গায় দশ লক্ষের ওপরে মানুষ নৃশংসভাবে খুন হলো। দেড় কোটি মানুষ হলো দেশান্তরি। লক্ষ লক্ষ মুসলমান চলে গেল পাকিস্তানে, লক্ষ লক্ষ হিন্দু ফিরে গেল হিন্দুস্তানে। এক লাইনে প্রায় চার লক্ষ মানুষ পাকিস্তান থেকে এসেছিলো হিন্দুস্তানে! বিশ্বাস হয়? রাতারাতি গোটা জাতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে বুকের ওপর তাড়কাটার বেড়া ঝুলিয়ে দিল। "
কাহিনী সংক্ষেপঃ পার্টিশনের ঠিক পনেরো বছর বাদে অরুণ চন্দনপুর ফিরে এলো। নাকি সে পিছিয়ে এলো পনেরোটা বছর?
পূর্ববঙ্গের এই ছায়াঘেরা যমুনার কোল, রামকৃষ্ণবাবুদের আমবাগান, মধ্য দুপুরের খাঁ খাঁ করা হাটখোলা, আর পারমিতার অষ্পষ্ট স্মৃতি বুকে নিয়ে জহির এতদিন বসে ছিল, এই চন্দনপুরে। সে জানতো--দৃশ্যমান এই জগতে হারিয়ে যাওয়া কোনো স্থায়ী চিত্র নয়। অরুণ একদিন ঠিকই ফিরবে। সেই এক অমোঘ সত্যটা যে তাকে বড্ড পোড়ায়। অরুণ এসে সেই আগুন নেভাবে না?
প্রভাতী, সমসাময়িক এক আধুনিকার নাম। প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক, একগুঁয়ে, উড়নচণ্ডী মেয়েটা মাত্র কিছুকাল আগে আবিষ্কার করেছ--জহির তার বুকের মধ্যেকার সেই অপেক্ষা, যা তার বেঁচে থাকার প্রকৃত অর্থ বহন করে। অতীতের সেই উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলা, গৎবাঁধা দিন, আর জীবনের সাথে একলা যুদ্ধ করার কোনো মানে নেই। বাবা রাজেন সরকারের রাজনৈতিক আদর্শের সাথে নিজেকে মিলেমিশে তৈরি করা মেয়েটার হঠাৎই এ কোন বোধোদয় ঘটলো?
নাকি নূরজাহান, রেহানার মতো সেও এক চিরন্তন অপেক্ষা পুষে রেখেছে? বুকের গভীরে...
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ নবীন লেখক শিহানুল ইসলামের লেখা প্রথম বই - এপারে কেউ নেই। ৫-৬ দিন সময় নিয়ে বইটা পড়েছি। তা যতটা না ব্যস্ততার কারণে তার চেয়েও বেশি হলো বইটির গতির কারণে। ধীরলয় গতিতে বইটি এগিয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে আমি অভিযোগ করছিনা বরং বইটীর গতি আমার কাছে যথার্থ মনে হয়েছে। মনে হয়েছে লেখক প্রতিটি চরিত্রকে সঠিকভাবে সময় দিয়েছেন, তাদের জীবন্ত করে তুলেছেন। ধীর গতির এই বইটি আমি রয়ে - সয়ে রস আস্বাদন করে পড়েছি এবং মনে হয়েছে এভবে পড়েই যেন সম্পূর্ণরুপে বইটি উপভোগ করতে সক্ষম হয়েছি।
"ওপারের সব কেমন আছে? এপার মিশে যায় বুকের মাঝে? এমন অধীর হয়ে আছে ওপারও? বুকটা পোড়ে না?"
প্রথমেই বলি বইটির কাহিনী নিয়ে। উপরে দেওয়া কাহিনী সংক্ষেপ থেকেই হয়তো বুঝতে পারছেন গল্পটি কি নিয়ে। দেশভাগ , দেশভাগের সেই অস্বস্তিকর সময় , মানুষের জীবনে দেশভাগের প্রভাব , পরিণাম, রাজনৈতিক অসস্তি এগুলো তো গল্পে আছেই । কিন্তু এগুলো ছাপিয়েও গল্পটি সম্পর্কের , গল্পটি ভালোবাসার , গল্পটি বন্ধুত্বের, গল্পটি শেকড়ের প্রতি প্রতিটি মানুষের অগাধ টানের , গল্পটি অপেক্ষার , আক্ষেপের, বিচ্ছেদের , অভিমানের । গল্পটি অরুনের , জহিরের , পারমিতার ও প্রভাতির। গল্পটি কিছুটা হয়তো বুকের মধ্যে চিরন্তন অপেক্ষা জমে রাখা নুরজাহানের, কিছুটা রাজেন সরকারেরও। প্রথম বইয়েই লেখক শিহানুল ইসলাম এমন একটি বিষয়কে ঘিরে গল্প সাজিয়েছেন যা নিয়ে আমার আগে খুব বেশি পড়া হয়নি এবং এরকম একটি গল্প দিয়ে তিনি লেখালেখির জগতে পা রেখেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার । লেখক গল্পটি সাজিয়েছেনও সুন্দরভাবে। এক টাইমলাইন থেকে আরেক টাইমলাইনে খুবই সাবলীলতার সাথে সুইচ করেছেন। সেইসময়কার রাজনৈতিক অবস্থার যেটুকু বিবরণই দিয়েছেন সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। দেশভাগের এই উত্তাল সময়কে সাহিত্যে এক্সপ্লোর করার যে অনেক সুযোগ আছে তা আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বইটি শেষ করার পড়েই উপলব্ধি করছি। বাঙ্গালির জীবনে ঘটে যাওয়া এই মহাসংকটময় সময় নিয়ে সাহিত্যে আরও কাজ হওয়ার সুযোগ ও দরকার আছে বলেই আমি মনে করি।
শিহানুল ইসলামের বর্ণনাভঙ্গি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। প্রথমেই বলেছি উপন্যাসটা ধীরগতির এবং তাই আমার যথার্থ মনে হয়েছে। ধীরগতিতে গল্প এগোলেও এক মুহূর্তের জন্যও বিরক্ত হয়নি। প্রথম বই হলেও বর্ণনাভঙ্গিতে একদমই আড়ষ্টতা ছিল না। লেখক তার লেখনশৈলীর স্বকীয়তার ছাপ প্রথম বইতেই স্পষ্টভাবে রেখে গেছেন। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনাগুলি অসাধারণ ছিল। অনেকবারই এরকম দৃশ্যের বর্ণনা থাকলেও তা একঘেয়েমিতা সৃষ্টি করেনি কখনো। লেখক পাতায় পাতায় খুব মুনশিয়ানার সাথে বিষণ্ণতা রেখে দিয়েছেন পাঠকের জন্য। বইটি এমনই যে আপনি কিছুদূর পড়ার পরই মনে অন্যরকম একটা বিষণ্ণতা আপনাকে ঘিরে ধরবে। সংলাপগুলিতে দার্শনিকভাবটা অতিরিক্ত মনে হতে পারে , কিন্তু এই চরিত্র এমনটা বলতে পারে এটা লেখক আমাকে বিশ্বাস করাতে সফল ছিলেন। কিন্তু সব চরিত্রের বেলায় তা ঘটেনি। দুই একটা চরিত্রের সংলাপও কিছু জায়গায় মানানসই মনে হয়নি। এমনকি বইয়ের শেষ ৭০-৮০ পৃষ্ঠায় সংলাপগুলি একটু বেশি ভারী , কাব্যিক ঠেকছিল আমার কাছে।
গল্পের চরিত্রগুলিকে নিয়ে আলাদাভাবে না বললে অন্যায় হবে। চরিত্রায়ন দুর্দান্ত ছিল। কাহিনীর অগ্রগতির সঙ্গে অরুণ , জহির, পারমিতা , প্রভাতি সবার মনস্তত্ত্ব এক্সপ্লোর করেছেন লেখক। প্রতিটি চরিত্রের যে নিজস্ব জগত আছেসেখানে লেখক পাঠকদের বিচরণ করাতে সক্ষম হয়েছেন। পারমিতার নিজস্ব জগতটা যদিও তেমনভাবে লেখক তুলে ধরেননি কিন্তু তা গল্পের প্রয়োজনে বলেই মনে করি। চরিত্রদের মধ্যকার ডাইন্যমিকও সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে লেখকের কলমে। চরিত্রগুলি এতটাই জীবন্ত হয়ে গিয়েছিল যে তাদের আক্ষেপ , হতাশা, অনুশোচনা, অভিমান আমাকেও ছুয়ে যাচ্ছিল, আমিও তাদের অপেক্ষার বেদনাটা টের পাচ্ছিলাম।
কিছু কিছু বিষয় নিয়ে লেখক একটা চাঁপা সাস্পেন্সও তৈরি করেছিলেন। কিছু ঘটনা পুরোপুরিভাবে খোলাসা হওয়ার জন্য পাঠককে অপেক্ষা করিয়েছেন। ব্যপারটা উপভোগ্য ছিল এবং যেহেতু বইয়ের গতি একটু কম সে হিসেবে এগুলোর দরকার ছিল বলেও মনে করি।
শেষে এসে লেখক শিহানুল ইসলাম ও ভুমিপ্রকাশকে ধন্যবাদ দিতে চাই এই দুঃসময়ে সুন্দর এই বইটি পাঠকদের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য। সত্যি বলতে ব্যপারটা খুবই দুঃখজনক এই বই নিয়ে এত কম আলোচনা হয়েছে। এপারে কেউ নেই অবশ্যই আন্ডাররেটেড একটা বই এবং আরও বেশি এটেনশন আরও বেশি ফোকাস ডিজারভ করে বইটি। অভারওল বইটি আমার অনেক ভালো লেগছে এবং এই বইটি সহ লেখকের প্রকাশিত অন্য বইটি আমি শীঘ্রই হার্ডকপি কিনব। লেখকের জন্য অনেক শুভ কামনা।
এক নজরেঃ এপারে কেউ নেই শিহানুল ইসলাম প্রকাশনীঃ ভূমিপ্রকাশ পৃষ্ঠা সংখ্যা- ১৭৬ মুদ্রিত মূল্য - ২১০ টাকা
১৯৬২ সালের বিভক্ত বাংলা। স্বাধীন বাংলা। কাগজে কলমে স্বাধীন হলেও আসলে কি স্বাধীন? দুই বাংলাই কি অন্যের ছড়ি ঘোরানোতে অতিষ্ঠ নয়? বুকের ওপর দিয়ে কাঁটা তার বয়ে যাবার পরে সবাই কি খুশী? কেউ কেউ কি ভিটে মাটি ছেড়ে থাকতে কষ্ট পাচ্ছে না? পার্টিশনের ১৫ বছর পড় নিজের গ্রামে ফিরে আসলো অরুণ। বুকের ভেতর সূক্ষ্ম একটা ব্যথা অনুভূত তো হচ্ছেই। মনে পরে যাচ্ছে শৈশব কৈশোর এর দিনগুলোর কথা। কলকাতার রিফিউজি অরুণের কাছে নিজের মাতৃভূমিটাও আর নিজের নেই। এই দেশ তার না। এই গ্রাম কি এখনো তার? বন্ধু জহির ও আর সকলের সাথে কয়টা দিন কাটানোর জন্য এখানে ফেরত এসেছে সে। জহির কি আজও প্রভাতিকে ভুলতে পেরেছে? দুজন দুজনের এত কাছে তবুও কেন এত দূরে তারা। এত কাছাকাছি থেকেও কেন তারা এক অপরের হতে পারছে না? পারমিতা কি শুধুই এক স্বপ্নের নাম? অবিভক্ত বাংলার চন্দনপুর আর পূর্ব পাকিস্তানের চন্দনপুর কি আসলে এক?
পাঠ পতিক্রিয়া- আমার বেশীরভাগ সময় মারমার কাটকাট থ্রি;আর ফ্যান। ওই জনরার বই বেশী পড়া হয়, তবে এখন ভিন্ন জনরা বই নিয়ে কিছুটা নাড়াচাড়া শুরু করেছি। এই ধরণের স্পর্শকাতর বিষয়ের বই বআগে তেমন পড়া হয়নি। মন খারাপটা হয়েই ফেল। লেখকের লেখনীতে আমি মুগ্ধ।