৩.৫/৫ "অন্যচোখে" উপন্যাস হিসেবে অভিনব। প্রতিটি আলাদা অধ্যায় একেকটা গল্প, সবগুলো গল্প মিলিয়ে আবার একটা অখণ্ড কাহিনি।বিষয় - মুক্তিযুদ্ধ। লেখক সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ঘটনা এক ক্যানভাসে আনতে চেয়েছেন। এর জন্য তিনি সাহায্য নিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন কথকের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির। ২৫ শে মার্চের কালরাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে গল্প। পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, রাজাকার, ধর্ষণ, প্রাণভয়ে পলায়নরত মানুষ, মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম, ক্যাম্পের পৈশাচিক নির্যাতন, বুদ্ধিজীবী হত্যা, সার্বক্ষণিক চাপা ভয়, মানুষের গিরগিটির মতো রঙ বদলানো, নিজেদের দ্বিধা ও জড়তাসহ অনেক বিষয় কাহিনিতে এসেছে। বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে পাকিস্তানীদের চোখে দেখা একাত্তরের বর্ণনা (এক সৈনিক ও তার পরিবারকে তার নিজের করা হত্যা ও নির্যাতন কীভাবে প্রভাবিত করেছে তার অসাধারণ বর্ণনা আছে।) কিন্তু লেখক স্বল্প পরিসরে বিশাল ঘটনাপ্রবাহ ছুঁতে চাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার ভয়াবহতা বা রেশ মনে জাগতে না জাগতেই সেই অংশের বর্ণনা শেষ হয়ে গেছে। যে কারণে পাঠক পুরোপুরি একাত্ম হওয়ার সুযোগ পায় না সবসময়। তারপরও আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে "অন্যচোখে" উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
অন্যচোখে উপন্যাস নিয়ে আশান উজ জামানের উপস্থিতি সূর্যের মতো। প্রথম চ্যাপ্টারটা পড়ার পরই আমি যারপর নাই অবাক হইছিলাম। আমার নিজেরও ভাবনা ছিল পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে 1971 সালের যুদ্ধটাকে দেখা দেখতে চাওয়া। জানতে এবং জানাতে ইচ্ছা ছিল কেউ না কেউ তো ছিলই যে বা যারা চাইতো না যুদ্ধ। সেইখান থেকে আশান উজ জামান আমার সামনে না চাইতেও বৃষ্টি হয়ে উপস্থিত হয়। ফলে আমার জন্য অবিস্মরণীয় এক উপন্যাস হয়ে ওঠে অন্যচোখে। ভাষার গাঁথুনিতে আশান উজ জামান যে মুনশিয়ানা দেখাইছেন, এবং দেখিয়ে যাচ্ছেন, তাতে করে আমি এবং আমাদের মতো অনেকেই যারা লিখি, লিখতে চাই তাদের জন্য বিরাট এক সবক বিরাট এক উদাহরণ। ফলে নিজের লেখার দিকে তাকিয়ে কিছুটা লজ্জাও বোধ হয়। আরো কত সচেতন হওয়া যায়, আরো কত সুন্দর করা যায়, বুঝতে পারি। আশান উজ জামান আমাদের জন্য, বাংলা ভাষার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন। আমরা তাকে অভিবাদন জানাই। হৃদয় থেকে ভালোবাসা জানাই।
পড়া শেষে মনে খানিক অতৃপ্তি থাইকা গেলেও, বলতেই হইবো বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ নিয়া এমন বই আর একখানও মনে হয় পড়িনাই। অনেকগুলোন ছোটগল্প গাঁইথা লেখা উপন্যাস, তাও আবার সব মিলায়া একখান বড় সাইজের ছোটগল্পের মতোনই। আইডিয়াডা দুর্দান্তই বলব, অভিনব তো ফর শিওর। তবে গল্পগুলোর মধ্যে যোগসূত্রগুলোন আরেকটু জোরদার হইতো যদি, কিম্বা ধরেন, আরো খোলাসা হইতো, বইটারে সবাই মাথায় তুইলা রাখত। আমার মনে হয় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ব্যাপার যা আসছে এইটায় তা সব পাঠক ঠিক বুইঝা উঠবার পারে নাই। তাও আমার ভাল্লাগছে খুব, বিশেষ কইরা সংক্রান্তি, মুক্তি, যুদ্ধ, বিজয়, আর শরণ অধ্যায়গুলোন মাইন্ডব্লোইং টাইপ। শেষের পতাকা অংশটাও। আমার কাছে প্রায় মাস্টারপিস। মানে ছোটখাটো খামতি খুমতিগুলোন না থাকলে মাস্টারপিসই বলতাম এরে। মুক্তিযুদ্ধের বই যারা পড়তে চান, তাগো লাইগা মাস্টরিড বই একখান। রেটিং ৪.৫/৫
অন্যচোখে যতটা না মুক্তিযুদ্ধের গল্প, তারচেয়ে বেশি জীবন আর মৃত্যুর গল্প; মৃত্যুর পাহাড়ের মাঝে জীবনের আশায় বুক বাঁধা মানুষের গল্প। ঐ অদ্ভুত অশান্ত সময়টাতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের চিন্তা- ভাবনাগুলো প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন লেখক। রাজাকারদের হাতে ধরা পড়া একজন মুক্তিযোদ্ধার মানসিক অবস্থার পাশাপাশি পঁচিশে মার্চ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালানো এক পাকসেনার ভাবনা কিংবা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের এক সাধারণ তরুণের ধারণা কেমন ছিল- সে সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে চেয়েছেন তিনি।
বইটা উপন্যাস হিসেবে কেন প্রকাশিত হয়েছে সেটা আমার কাছে পরিষ্কার না- গল্প সংকলন হলেই মানাত ভালো। বইয়ের কাঠামোটাও সেরকমই, এবং দু-একটা চরিত্রকে একাধিক গল্পে দেখা গেলেও প্রতিটা অধ্যায়ই স্বয়ংসম্পূর্ণ।
আরেকটা কথা- এই বইমেলার যতগুলো মৌলিক বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টোনোর সুযোগ হয়েছে আমার, তার মধ্যে একমাত্র নন-হুমায়ূনীয় বই এটা। বলছি না হুমায়ূন আহমেদকে অনুসরণ করা খারাপ, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে সাহিত্যে বৈচিত্র্য দরকার- সেটাও কেউ অস্বীকার করবেন বলে মনে হয় না। হুমায়ূন আহমেদের- এবং তাঁর অনুসারীদের- লেখার স্টাইল অনেকটা সোজাসাপ্টা, বর্ণনামূলক- তাতে অলঙ্কারের ব্যবহার কম। এই ধরনের লেখা পড়ে মজা আছে, কিন্তু একই ধরনের প্লট ও ধাঁচের বই পরপর আর কত পড়া যায়? সেখানে "অন্যচোখে" বইটায় জহির রায়হান, শওকত ওসমান বা হাসান আজিজুল হকের লেখার ক্ষীণ ফ্লেভার পেয়েছি। তবে তার চেয়েও বড় কথা, লেখক নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত সেই স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছেন। পরবর্তী বইয়ের জন্য অপেক্ষায় আছি।
অাসুন একটু দৃষ্টি বদল করি। একই জিনিসকে একটু ভিন্ন অাঙ্গিকে দেখি। সহজ উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হয়, শেখ মুজিবকে বাঙালী যতই স্বাধীন দেশের রূপকার বলুক পাকিস্তানি মাত্রই বলবে দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক। অাসুন এবার মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলোকে একটু দৃষ্টি বদল করে দেখি। কি? দেখতে সমস্যা হচ্ছে? অামার কাছে সহজ উপায় অাছে। নতুন কথাসাহিত্যিক উজ জামানকে চেনা অাছে? ওনার অন্যচোখে খুলে বসুন। প্রথম কয়েক পাতায় বর্ণনা করা অাছে পঁচিশে মার্চের কালো রাতের কথা। কিন্তু বাঙালির চোখে নয়, একজন পাকিস্তানি সৈন্যের চোখে। একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে ইতিহাসকে দেখি। গল্পগুলো একই রকম, শুধু অনুভূতি গুলো অজানা। সেই ভিন্ন অনুভূতির অাবহাওয়া পেতে পড়তে হবে এই অন্যচোখে।
অামি সাধারণত একটু দেখেশুনে বই পড়ি। বইয়ের শেষে একগাদা বইয়ের রেফারেন্স দেখে মনে হল পড়া যেতে পারে। তো পড়তে শুরু করলাম। লেখার অাভাসে বোঝা যাচ্ছে খুব খেটেখুটে লেখা। অনেক তথ্য অাছে, জ্ঞান অাছে, অার অনুধাবনের একটা বিষয় অাছে। অনেকটা সৃজনশীল প্রশ্ন এবং উত���তরের মতো। ছোটছোট কথায় অসাধারণ অভিব্যক্তি। লেখকের এই জিনিসটা মন কেড়েছে খুব। প্রতিটি লাইনের অাবার এক লাইন করে উপমা। অাহা!
উপন্যাসের শুরু, থুক্কু গল্পের শুরু,, থুক্কু, বইটিকে গল্প বলবো নাকি উপন্যাস এটা নিয়ে অাবার বেশ খটকা অাছে। সে যাই হোক, উপন্যাস যখন উপন্যাসই বলি। উপন্যাসের শুরুতে ভিন্ন চোখে দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকে। প্রতিটি গল্পই খুবই সাধারণ কিন্তু ভিন্নচোখে দেখানো হয়েছে প্রেক্ষাপট। একজন শিশু, একজন নারী, একজন ছাত্র, একজন সাধারণ মানুষের চোখে মুক্তিযুদ্ধের সাধারণ চিত্র চিত্রিত হয়েছে এখানে। অারেকটু সহজ করে বলি, এখানে বারোটি ভিন্ন-ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন-ভিন্ন গল্পকে ভিন্নচোখে দেখানো হয়েছে। একজন পাকিস্তানি সৈনিক অপারেশন করছে তখন তার অনুভূতি কেমন, একজন ছাত্র যখন দূর থেকে দেখছে হত্যাযোঞ্জ তখন অনুভূতি কেমন? একজন ছোট বাচ্চা সে তখন কি ভাবছিলো, একজন সাধারণ নারী, একজন সাধারণ মানুষের অনুভূতি কেমন ছিলো রাজাকারের বিরুদ্ধে? গল্পগুলো ভিন্ন কিন্তু একই সুতোয় বাঁধা।
অামি বইয়ের কাহিনী কিংবা সারসংক্ষেপ নিয়ে অালোচনা অাগাবো না। কারণ তা পড়লে পাওয়া যাবে, অার বলতে গেলে একটা উপন্যাসের নয় বারোটা গল্প নিয়ে অালোচনা করতে হবে। তবে মোটামুটি কি ধরনের লেখা অাছে তার একটা স্পষ্ট ধারণা দিয়েছি। তবে বইয়ের শুরু এবং শেষটা মারাত্মক সুন্দর। অার মধ্যের অংশ ম্যাড়মেড়ে সুন্দর।
অামি একজন ভাল লেবেলের নিন্দুর। নিজের প্রবৃত্তি দমন রাখা দুষ্কর। পরিশেষে একটু নিন্দে করে যাই, লেখক মহাশয় গল্প লিখেছেন নাকি উপন্যাস লিখেছেন সেটা অামি বুঝে উঠতে পারিনি। হয়তো অাপনিও পারবেন না। ঠিক গল্প নয়, অাবার উপন্যাসও নয়। গল্পে কোন টুয়িষ্ট নেই, উপন্যাসের মতো জীবনের কথাও বলে না। তবে বারোটি গল্পকে যদি একই ধারাবাহিকে মেলানো যেত তবে বইটা মারাত্মক লেবেলের সুন্দর হতো। লেখক এখানে এমনি চেয়েছেন নাকি কম খেটেছেন বোঝা মুসকিল। তবে লেখার মধ্য যে একটা শক্তি অাছে তা নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে বাধ্য হবে প্রতিটি পাঠক।