আপনি কয়জন সিরিয়াল কিলারকে চেনেন? জগতের ইতিহাসে ভয়াবহতম খুনীর সাথে কি আপনার দেখা হয়েছে?
‘সানজাক-ই উসমান’ আপনাকে তার সাথে দেখা করিয়ে দিতে চলেছে। তাকে দেখতে হলে আমাদের উঁকি দিতে হবে আট শ বছর আগের পৃথিবীতে।
ত্রয়োদশ শতাব্দির শুরুতেই মঙ্গোলিয়ান স্তেপ থেকে যেন স্বয়ং আজরাঈল হয়ে নেমে এলেন চেঙ্গিজ খান এবং তার মোঙ্গল বাহিনী। মাত্র কুড়ি বছরের ভেতর যেন নরকে পরিণত হলো সারা পৃথিবী। প্রথমে চীন তারপর তুর্কিস্থান, খোরাসান হয়ে মোঙ্গল ঝড় ধেয়ে এল ককেশাস, আনাতোলিয়া দিয়ে রাশিয়া আর হিন্দুস্থানের দিকে। মরে সাফ হয়ে গেল কোটি কোটি মানুষ। মোঙ্গলদের হাত থেকে কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে ইরান-তুর্কিস্থান থেকে আনাতোলিয়ার দিকে রওনা দিল কিছু মানুষ।
তারপর কী হলো? কী করে তারা গড়ে তুলল বিশাল এক সালতানাত? মোঙ্গলদের হাত থেকে কারা বাঁচালো মক্কা-মদীনাকে?
এটা কোনো নিয়মিত ইতিহাসের বই বা কোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। এটা একই সাথে ইতিহাস, ফিকশন আর থ্রিলার। আজকের পৃথিবী কী করে নির্মাণ হলো, তা জানতে এই বই আপনাকে দারুণ সহযোগিতা করবে ইনশা আল্লাহ।
বড়ো কোনো বৃক্ষ জন্মায় না অথচ বিস্তীর্ণ ঘাসে ঢাকা সমতল ভূমিকে স্তেপ বলে। মঙ্গোলিয়ান স্তেপের ছোট্ট গোত্রধিপতি ইয়ুসুগেইয়ের এক ছেলে জন্মেছিল। যে মাত্র বিশ বছরের মধ্যে চীন, তুর্কিস্তান, খোরাসান, আনাতোলিয়া, রাশিয়া ও হিন্দুস্তানের কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছিল। যে একইসাথে ছিল দ্বিগ্বিজয়ী বীর ও আল্লাহর প্রেরিত গজব৷ এই মঙ্গোলিয়ান গজবকে কারা থামাল এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্থান শেষে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহের সময়কাল নিয়ে তরুণ লেখক প্রিন্স মুহাম্মদ সজলের 'সানজাক-ই-উসমান'।
ইতিহাসে অনাগ্রহী পাঠকের সবচেয়ে বড়ো হ্যাপা হলো সন-তারিখ। অনেকের কাছে এগুলো বিষতুল্য। তাই ইতিহাস পাঠের ইচ্ছে অঙ্কুরেই মরে যায়। দ্বিতীয়ত, আ্যকাডেমিক উদ্দেশ্য লিখিত গ্রন্থে গদ্যের সৌন্দর্য প্রায়শই থাকে না। তাতে নিতান্তই দায়ে না পড়লে সাধারণ মানুষ ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থ পড়তে চান না। এই দুই ক্ষেত্রে দারুণ সাফল্য অর্জন করেছেন তরুণ তুর্কী প্রিন্স মুহাম্মদ সজল। চেঙ্গিস খানের উত্থানের কাহিনিকে এমন অনবদ্যভাবে লিখেছেন যেন মনে হচ্ছিল কোনো গল্প পড়ছি। যে গল্পের পরতে পরতে ধ্বংসের নিঃশ্বাস, বীভৎস রস এবং একটি বিশৃঙ্খল জাতি মোঙ্গলের দুনিয়ায় সেরা সেনাবাহিনীতে রূপান্তরের আদ্যপান্ত।
আপাতদৃষ্টিতে ছোটো ঘটনা মাঝেমধ্যে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এই ওতরার রাজ্যের কথাই ধরুন না। চীন থেকে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করতে প্রথমে পড়বে ওতরার। এরপর বুখারা, সমরখন্দ ও খাওয়ারিজমের শাহের রাজধানী রাজধানী উরগঞ্জ।
চারশ' বণিকের একটি দলকে হত্যা করলেন ওতরার শাহের চাচা ইনালচিক খান। অভিযোগ তারা ছিল চেঙ্গিস খানের গুপ্তচর। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শাহের কাছে তার চাচা ইনালচিকের মাথা দাবি করে দূত পাঠালেন চেঙ্গিস খান। খানের প্রিয় দূত ইবনে কেফরেজকে হত্যা করলেন শাহ। আরও দুই মোঙ্গল সেনাপতির দাড়ি পুড়িয়ে ও মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢেলে চেঙ্গিস খানের কাছে ফেরত পাঠালেন খাওয়ারিজমের শাহ। ক্ষুব্ধ চেঙ্গিস ছোট্ট একটা চিঠি পাঠালেন শাহের কাছে। তাতে লেখা ছিল,
' সমরের সাধ ছিল। সে সাধ মেটাব। '
ওতরার জয় করার পর যা করলেন তা হলো - ইনালচিক খানকে চোখ, নাক ও মুখ দিয়ে গরম রূপা ঢেলে হত্যা করা হলো। রাজ্যের সকলকে হত্যা করে তাদের মাথা দিয়ে একুশটি পিরামিড তৈরি করেছিলেন চেঙ্গিস খান।
ত্রয়োদশ শতকের বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ শহর বুখারা ও সমরখন্দকে মাটির সাথে এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া হলো যেন এখানে কোনো শহরই ছিল না। হত্যা ও গণধর্ষণ করা হলো নির্বিচারে। বুখারা ধ্বংসের আগে চেঙ্গিস খান বলেছিলেন, ' I am the flail of god for sins you have done. If you were not so sinful, god didn’t sent such a punishment like me to you. '
এটি একটি ঐতিহাসিক উক্তি। আরও অনেকের বইতে চেঙ্গিস খানের এই অমোঘ উক্তি পড়েছি। কিন্তু কৌতূহলী মন জানতে চায়, বুখারা ধ্বংসের আগে চেঙ্গিসের পোষা লেখকগণ কী অপেক্ষা করছিলেন বসের বাণী চিরন্তনির জন্য?
বুখারা ও সমরখন্দের মুসলমানরা ছিল ভীরু। তারা মোঙ্গলদের প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করেনি। কিন্তু শাহের উরগঞ্জ বাধা দিতে চায়। পারেনি৷ উরগঞ্জকে এমনভাবে ধ্বংস করেছিলেন চেঙ্গিস যে পৃথিবীর ইতিহাসে উরগঞ্জ নামে যেন কোনো স্থান না থাকে৷ শাহের মা সত্তর বছর বয়সী তুর্কান খাতুনকে ছেড়ে দেওয়া হলো বর্বর মোঙ্গলদের হাতে। তারা প্রকাশ্যে গণধর্ষণ করল এই নারীকে। শেষ বয়সে তুর্কান খাতুন চেঙ্গিস খানের তাবুর কাছে বিলাপ করতে করতে মারা যান।
এই মানবসভ্যতা বিধ্বংসী মোঙ্গলের জয়রথ থামিয়ে দেওয় আইন-আল-জালুতের যুদ্ধ। সাইফউদ্দিন কুতুজ ও রোকনউদ্দিন বাইবার্সের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় মোঙ্গলরা। এরপর সেভাবে আগাতে পারেনি তারা।
ইতিহাসের আরও একটি ছোটো ঘটনা বড়ো হয়ে দাঁড়ায়। সুলতান বায়েজিদ ততদিনে বিরাট বীর। তিনি যোদ্ধা যত, তত দূরদর্শী নন। ঘটনাচক্রে পৃথিবীর আরেক বীরযোদ্ধাকে চিঠি পাঠিয়ে লিখেছিলেন, তোমাকে যদি যুদ্ধে হারাই তাহলে তোমার স্ত্রীদের নগ্ন করে নাচের আসর বসাব। আর আমি শরাব পান করব।
এই পত্র পাঠ করে সত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধ রেগে গেলেন। পুরো এশিয়া জুড়ে শাসন করার তার সকল আত্মীয়কে তৈরি হতে বললেন। এবার বায়েজিদকে তিনি শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন। যুদ্ধে বায়েজিদ পরাজিত হন এবং বন্দি হয়েছিলেন সেই সত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধের কাছে৷ সেই বৃদ্ধ তাকে হত্যা করেনি। তার রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিল কোনোএক নাচের আসরে। যে নাচের আসরে নগ্ন করে হাজির করা হয়েছিল সুলতান বায়েজিদের স্ত্রীদের। এই দৃশ্য সহ্য করতে পারেননি বায়েজিদ। স্ট্রোক করে মারা যান। যে বৃদ্ধের কাছে বায়েজিদ পরাজিত হয়েছিলেন তার নাম তৈমুর লঙ!
ওসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্থানের চমকপ্রদ কাহিনি লেখক লিখেছেন। তা পড়ে নেবেন। বেশ ভালো লাগবে পড়তে।
এই বই অনেকের ভালো লেগেছে। আমিও পড়ে আনন্দ পেয়েছি। নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে ওসমানীয় সাম্রাজ্য নিয়ে। তাই একটা ধন্যবাদ লেখক প্রিন্স মুহাম্মদ সজল পেতে পারেন। কিন্তু তিন তারকার বেশি দিতে পারব না। কারণ-
১. এই বইটি সুলিখিত। কিন্তু লেখকের টার্গেট পাঠক শুধু মুসলমান পাঠক। বারবার ধর্মের প্রসঙ্গ এমনভাবে এসেছে যাতে কোনো অমুসলিম পাঠক অস্বস্তিবোধ করতে পারেন।
২. বইয়ের পৃষ্ঠা ১২৭-১২৮ এ মোঙ্গলদের সেক্যুলার হিসেবে অভিহিত করেছেন। আরও লিখেছেন তাদের রাজধানীতে সকল ধর্মের উৎসব পালন করা হতো এবং হত্যার সময় ধর্মের বাচবিচার করা হতো না। এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে লেখক ধর্মনিরপেক্ষতার অনুষঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একজন সত্যিকারের উদার লেখক শুধু নিজের মতাদর্শকেই সম্মান করেন না, পাশাপাশি শ্রদ্ধা করেন অপরের মতবাদকেও। কিন্তু লেখকের ধর্মনিরপেক্ষতা বিদ্বেষ অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ও সংকীর্ণ মনের পরিচায়ক।
৩. রাহোভা শহর দখলের পর সেখানকার নারীদের নির্যাতন করে খ্রিষ্টান বাহিনী। নিকোপলিসের যুদ্ধে পরাজিত খ্রিষ্টান বাহিনীর সঙ্গী নারীদের সঙ্গে বায়েজিদের বাহিনী কেমন আচরণ করে তা লেখক উল্লেখ করেননি। কেন করেননি?
৪. L P Peirce রচিত 'The Imperial Harem' গ্রন্থকে তথ্যসূত্র ব্যবহার করে হেরেমের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক যেসব কথা লিখেছেন তা নিন্দনীয়। নারীবিদ্বেষী মনভাবকে চিহ্নিত করে।
৫. বইয়ের নাম 'সানজাক-ই-উসমান'। ওসমানীয় সাম্রাজ্য নিয়ে আলোচনা নামের সাথে মানানসই। কোথা থেকে কলোনিয়ালিম, গ্লোবালাইজেশন ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু চলে এলো তা বোধগম্য নয়।
৬. 'শেষমেশ নেটিভ আমেরিকান থেকে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, কাউকেই ছাড়েনি সিফিলিস। ' - কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ কোন দিক থেকে প্রাসঙ্গিক হলেন? সজল সাহেব লেখক হিসেবে ভীষণ বিদ্বেষপরায়ণ। এমন বিশ্রী মনের মানুষ লেখক হিসেবে উঁচু দরের হতে পারেন না। কোনোভাবেই না।
লেখার গতির কারণে পড়ে আনন্দ পাবেন। সময় ভালো কাটবে। লেখক তথ্যসূত্র ব্যবহার করেছেন। যা বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। তবু খুশি হতে পারলাম না। দুঃখিত!
যুদ্ধ গড়ে দিয়েছে অনেক সাম্রাজ্য, আবার ধ্বংস করে দিয়েছে তারচেয়েও বেশি জনপদ। যুদ্ধের বিপরীত শব্দ-টাইপ কিছু কাগজেকলমে থাকলেও সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তার দেখা মেলেনি। ফলে যুগে যুগে এসেছে অত্যাচারীরা ও তাদের দমনকারীরা।
ইতিহাস নিয়ে একসময় আগ্রহ থাকলেও পরে এই বিষয় অত ভালো লাগত না। কারণ যে বিষয়ে জানতে চাই, তার ঠিক ঠিক নিরপেক্ষ লেখা কখনোই লেখা হয় না। অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে জনপ্রিয় হওয়া ধারাবাহিকগুলোও দেখতে ইচ্ছে হয়নি অতিরঞ্জনের কারণে। তারচে বরং ইতিহাস স্রেফ গল্পের মতো পড়ে যাই, সত্যাসত্য নিয়ে তাতে অন্তত আর খোঁচাখুঁচি করতে পারি না। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও সেটাই বলব। ফিকশন হিসেবে পড়েছি এবং সেভাবে ভালো লেগেছে।
▪️▪️▪️
চেঙ্গিজ খানের জন্ম থেকে যাযাবরদের নেতা বনে যাওয়ার পুরো ঘটনাবলি অনবদ্য। মোঙ্গল–যাদের একসময় তুর্কি, হান, জিন ইত্যাদি জাতি দাবিয়ে রেখেছে; তাদেরই এক শিশু নিষ্ঠুর শৈশবের মধ্য হতে এসে পুরো পৃথিবীকে দাবিয়ে তো রাখলই, অকথ্য গণহত্যার সাথে পরিচিত করাল। চেঙ্গিজ খানের নির্দয়তা তার একটি উক্তির মাধ্যমে শেষ করব: ‘A man's greatest happiness is to break his enemies, to drive them before him, to take from them all the things that have been theirs, to hear the weeping of those who cherished them, to take their horses between his knees and to press in his arms the most desirable of their women.’
আরো একজন কুখ্যাত সাইকোর সাথে পরিচয় হওয়াটা অবাক করবার মতো ছিল–ড্রাকুলা ভ্লাদ। এর নাম আমি আগে কখনও শুনিনি; তার কাজকর্ম পড়ে বমি পেয়ে গিয়েছিল।
লেখক যদি উসমানীয় সাম্রাজ্যের কথা বলতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক কাহিনি বিস্তৃত করতে পারেন, তবে পড়ার সময় আমার চিন্তা বিস্তৃত (অন্য পথে যাওয়াও) হতে পারবে না কেন? সেখান থেকেই মনে হলো, পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ তো তখন থেকেই। তখন এবং এখন পর্যন্ত যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিল তা হলো, মুসলিমদের মধ্যে সংবদ্ধতার অভাব। বিভিন্ন সময় নিজেদেরই কোন্দলে অমুসলিমদের সুযোগ করে দেওয়া, ডেকে আনা, প্রতিরোধ গড়ে না তোলা–জিনিসগুলো খুবই কষ্ট দিল। চেঙ্গিজের একটি বিখ্যাত উক্তি–I am the flail of God for sins you have done. If you were not so sinful, God didn't send such a punishment like me on you. খুবই নিষ্ঠুর কথা, তবে সঠিক কথা। আজকের দুনিয়ায় এই ঐক্যবদ্ধতার অভাবেই আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইয়েরা, শিশুরা ধুঁকে ধুঁকে মরছে। পুরো একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, অথচ আমরা চুপ। উক্তিটি পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল, ইসরায়েলও হয়তো এটাই বলছে! (ভাবতে পারেন, পড়তে গিয়ে আমি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারিনি বলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পাশবিকতার হাইলাইট করছি বেশি। তা না... খুনোখুনি সবাইই করেছে, কোনো ধর্মের কাউকেই সেরা বলার কিছু নেই। তবে খারাপ লাগল.. মুসলিমদের প্রকট অন্তর্দ্বন্দ্ব।)
যা হোক, যা দেখে পড়তে নিলাম মানে 'অটোমানদের দুনিয়া', তাদের দুনিয়া নিয়েই জানা হলো সবচে কম। উত্থান এবং সুলতান মেহমেদের জীবনী ছাড়া অন্যসব ততটা চমকপ্রদ করে লেখা হয়নি। লেখা ভালো, গতি ভালো। এর রেটিংও দেখছি খুবই ভালো। তবু ওভাররেটেড মনে হলো।
দুর্ধর্ষ, ভয়ংকর চেঙ্গিজ খান থেকে শুরু করে অটোম্যান পরবর্তী ও ইতিহাসের আরও অনেক খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরেছেন লেখক। এতোটা বিশদভাবে ইতিহাস, স্পেশালি অনেকখানি অংশে মুসলিম ইতিহাস জানার জন্য বেস্ট! আমার মতো এই বিষয়ে কাঁচা মানুষজন এই বইটা পড়ে দেখতে পারেন। ইতিহাসের নন ফিকশন লেখায় আরেকটা সমস্যা আছে, শুধু ইতিহাস কেন? যে কোন নন-ফিকশন বই উপস্থাপন ভালো না হলে, লেখনীর জোর না থাকলে কন্টেন্ট যতোই ভালো হোক না কেন, বইটা উৎরাতে পারে না। এখানে সানজাক-ই উসমান বইটা পুরোপুরি সফল। ৪৩২ পৃষ্ঠার মোটামুটি বৃহৎ এই বইটা পুরাই আগুন! 💥💥
বইয়ের নাম ‘সানজাক-ই উসমান: অটোমানদের দুনিয়ায়’। নামেই বুঝা যাচ্ছে তুরস্কের উসমানী খিলাফত নিয়েই এই বই।কিন্তু বইয়ের প্রথম এক তৃতীয়াংশে যে কেবলি চেংগিস খান ও তার সৈন্যবাহিনীর খুরের আওয়াজ,অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং তাণ্ডবলীলার বর্ণনা। তাহলে উসমানীরা কোথায়? আসলে উসমানীদের উত্থান বুঝতে হলে আগে বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের সময়টা এবং মোংগলদের দুর্ধর্ষতার দিকে নজর দিতে হবে। এক অনুর্বর পাথুরে জমির যাযাবর জাতি ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে কিভাবে সমৃদ্ধশালী মুসলিম সাম্রাজ্যকে ধসিয়ে দিল তার ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়েছেন লেখক প্রিন্স মুহাম্মাদ সজল। মুসলিমদের সম্পদ-সমৃদ্ধি আর ঘাড়ের উপর চেপে বসা স্বৈরাচারী ধুরন্ধর শাসকরাই যেন তাদের কাল হয়ে দাঁড়াল। মাত্র ১০০ বছরে অর্ধ পৃথিবী দখলে নেওয়া আরবদের উত্তরসূরিরা তখন ভোগবিলাসে মত্ত।শাসকরা জনগণকে শাসন করছেন ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসিতে।অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বিভক্ত রেখেছেন জনগণকে। বুদ্ধিজীবীরা দলিলদস্তাবেজ দিয়ে তর্ক করছেন কোন ধাতুর তৈরি পাত্রে মদ খেলে বেশী নেশা হয়? সোনা না রুপার? সন্ধ্যা হলেই দিকে দিকে নুপুরের নিক্কণ আর সংগীতের জলসা। এমন সময়েই যেন মাথায় বাজ পড়ার মত আবির্ভূত হলো মংগলরা। মংগলদের আগমন যে একেবারে আকস্মিক ছিল তাও না। মংগলদের আগমনের খবর অনেকদিন আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল।এমনকি যেসব ছোট ছোট আমিরাত মংগলদের অভিযানের শিকার হওয়ার জন্য সবচাইতে ঝুঁকিতে ছিল, তাদের সহযোগিতার আহবানও রাজনৈতিক গুটিবাজির জায়গা থেকেই প্রত্যাখান করলেন।চিন্তার জায়গাটা এমনভাবে শুণ্য হয়ে গেছিল যে,শাসকশ্রেণী অনাগত বিপদ সম্পর্কে কোন ধরনের হোমওয়ার্ক করার দরকার মনে করেনি। ফলস্বরুপ, মংগলরা যখন দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছাল,ততদিনে প্রস্তুতি নিয়ে লড়াই করার সামর্থ্য আর নাই।ক্ষমতার সুফলভোগী উচুঁতলার মানুষরা নিজেদের পিঠ বাঁচাতে নূন্যতম লড়াইয়ের বদলে একপ্রকার মনুষ্যত্বহীন এই গোষ্ঠীর সামনে অসহায় আত্মসমর্পন করতে চাইলো। অথচ এই জাতিরই ছিল অল্প কিছুকাল আগে রক্তক্ষয়ী ক্রুসেড জয়ের অভিজ্ঞতা। যৎসামান্য প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন এক সুলতান জালাল উদ-দীন।কিন্তু বড় অসময়ে জন্ম এই বীরের। অপ্রতিরোধ্য মংগলদের রুখে দেওয়ার জন্য সামর্থ্যের সবটা ঢেলে দিয়েছিলেন।কিন্তু সমসাময়িক মুসলিম শাসকদের কাপুরুষচিত আচরণের কারণে সফল হননি।এদিকে জনপদের পর জনপদে রটে গেছে,এ মংগলরা শেষ সময়ের ইয়াজুজ-মাজুজ ছাড়া আর কেউ নয়। ভীতি আর আতংক যেন আরো চেপে বসলো মুসলিমদের উপর।অথচ মংগলদের রুখে দেওয়ার জন্য বুকের সাহস আর হাতের কাছের সামর্থ্য একত্র করতে পারলে ইতিহাস হয়ত অন্যরকম হলেও হতে পারতো।
মংগলদের যে চাইলে রুখে দেওয়া যায়,সেটা প্রথম হাতেকলমে দেখালেন সুলতান সাইফ উদ দীন কুতজ ও সুলতান বাইবার্স। এই দুইজন একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন,এই মহাদুর্যোগ রুখতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোন বিকল্প নেই। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, কুতজ এবং বাইবার্সের মধ্যে কিন্তু তখন চরম বৈরী সম্পর্ক! তাঁরা হয়তবা জানতেন,ঐক্য হয় দুই কারণে। ১. অভিন্ন লক্ষ্য ও ২.অভিন্ন ঝুঁকি থেকে। তাঁরা জানতেন, মংগলদের না রুখলে মুসলিমদের নাম-নিশানা পৃথিবীর বুক থেকে বিলীন হয়ে যাবে। তাঁদের নিয়তকে আল্লাহ কবুল করেছিলেন।মংগলদের অগ্রযাত্রাকে তাঁরা সত্যিই ঠেকাতে পেরেছিলেন।
কিন্তু এখানে ইতিহাসের চাকা ঘুরতে অন্য দুইটা ফ্যাক্টরও প্রভাবকের কাজ করেছে। প্রথমটি হচ্ছে,কোন ধরনের আদর্শিক ভিত্তি না থাকলে সে সাম্রাজ্য টিকে না।মংগলরা স্রেফ লুটতরাজ আর রক্তের নেশা থেকেই সাম্রাজ্যের বিস্তার করে যাচ্ছিল।তাদের সামনে আদর্শিক লক্ষ্য ছিল না।মোংগলদের দ্রুত বিস্তৃত সাম্রাজ্যও একটা সময় থমকে গেছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নারীর শক্তি। মংগলরা যখন একের পর এক মুসলিম ভূমি দখলে নিচ্ছিল,তখন পুরুষদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করেছে আর নারীদেরকে দাসী হিসেবে বন্দী করেছে। এই নারীরা এক অসম্মানের বেড়াজালে জড়িয়ে গেলেও নিজেদের ধর্ম-ঐতিহ্যকে ভুলেননি। চরম লাঞ্ছনা আর অপমানের মধ্যেও ইসলামকে লালন করে গেছেন।ফলে মংগলদের মধ্যে যখন ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা বাড়লো,তখন দেখা গেল মোংগল অন্তঃপুরে ইসলাম আরো আগেই উপস্���িত হয়ে আছে। ইতিহাসে এমন নজির অভূতপূর্ব। বিজয়ীরা গ্রহণ করছে বিজিতদের আদর্শ!
মংগলরা যখন ইসলাম গ্রহণ আর অন্তর্কোন্দলে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে,তখন আস্তে আস্তে ডানা মেলছে উসমান নামের এক তুর্কী ঈগলের নেতৃত্বে খিলাফতের নতুন দিগন্ত। তাঁরই উত্তরসূরি খলিফা মুহাম্মদ আল ফাতিহ রাসুল সাঃ করা কনস্ট্যান্টিপল বিজয়ের ভবিষৎবাণীকে সত্যে পরিণত করেন।সুসংহত করেন ইসলামী সাম্রাজ্যকে। বইয়ের শ���ষ এক তৃতীয়াংশর অনেকটা জুড়েই আছেন এই ‘মেহমেত দি কনক্যুরার’।লেখক তাঁর জীবন্ত আর সুনিপুণ লেখনীতে এই ক্ষণজন্মার কনস্ট্যান্টিপল বিজয় ও মৃত্যুর ক্ষণকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠে।
সানজাক-ই উসমান ইতিহাস গ্রন্থ হলেও লেখক চেষ্টা করেছেন এক সহজবোধ্য প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করতে। বইয়ের বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে সমরকৌশল আর জিওপলিটিক্সের বর্ণনা। তাই থ্রিলারের গড়নে লেখা এই বই যে কোন বিগিনারের কাছে দুরুহ মনে হলেও হতে পারে। তবে উসমানী খিলাফতের সামাজিক চিত্র,প্রশাসন ব্যবস্থা এবং হেরেম সংক্রান্ত মিথের খণ্ডন যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। এইসব উত্থান-পতনের সমান্তরালে কখনো কখনো হাজির করেছেন মাওলানা রুমিকে,ক্ষীয়মাণ আন্দালুসকে আবার কোথাও কোথাও ইউরোপের ডেমোগ্রাফিতে বিরাট পরিবর্তন আনা ব্ল্যাক ফিভারকে।
বইয়ের বড় দুর্বলতা মনে হয়েছে, মানচিত্রের অপ্রতুলতা এবং অস্পষ্টতাকে।বইয়ে কিছু মানচিত্র থাকলেও অনেক জায়গাতে প্রবল অভাব অনুভূত হয়েছে। সমরকৌশল গুলো চিত্রাকারে দেখাতে পারলে বুঝতে সুবিধা হত।রণকৌশল সংক্রান্ত অনেক টার্ম সাধারণ পাঠকের কাছে একেবারে অচেনা ঠেকাটা অস্বাভাবিক না। শুরুতে পরিভাষার আইডিয়াটা ভালো।কিন্তু যেসব টার্ম অল্প কয়েকবার ব্যবহৃত হয়েছে,সেগুলো ফুটনোট আকারে আসলেই ভালো হত। বাংলা বইয়ে ইন্ডেক্স বা নির্ঘণ্ট ততটা প্রচলিত নয়।কিন্তু এই বইয়ে যে বিপুল পরিমাণ চরিত্র ও স্থানের সম্মিলন ঘটেছে,তাতে করে একটা নির্ঘণ্ট দাবী করাই যায়।মংগল বা উসমানীদের একটা বংশলতিকা থাকলে মন্দ হত না। বইয়ের ছাপার মান,কাগজ, কাভার ও বাঁধাই বেশ প্রশংসনীয়।সেই অনুসারে বইয়ের দাম একেবারেই হাতের নাগালে। প্রিন্টিং মিস্টেক চোখে পড়েনি বললেই চলে। প্রকাশকের প্রফেশনালিজমের তারিফ করতে হয়।
মোরশেদ শফিউল হাসান লিখেছিলেন, ” “আমরা যাকে ইতিহাস বলে জানি তার অনেকটাই আসলে ইতিহাসের গল্প। এক কিংবদন্তিকে আমরা সাধারণত অন্য কিংবদন্তি দিয়ে, এক সংস্কারকে অন্য সংস্কার দিয়ে পুনর্বাসিত করি।” লেখক প্রিন্স মুহাম্মাদ সজল তাঁর সাবলীল ভাষায় এবং বিপুল পরিমাণ বই-প্রবন্ধের রেফারেন্স ব্যবহার করে পাঠককে কনভিন্স করতে পেরেছেন যে, তিনি ঈগলের চোখ দিয়ে যে ইতিহাসটা তুলে ধরতে চেয়েছেন,সেটাই সত্য। প্রথম বইয়ের লেখক হিসেবে এই অর্জন অবশ্যই অভিনন্দনের দাবী রাখে।মুসলিম উম্মাহর এই দুঃসময়ে এমন বই পাঠককে হয়ত নতুন করে ভাবাবে।
ইতিহাস নিয়ে যিনি লিখবেন, তিনি অ্যাকাডেমিশিয়ান হোন আর শৌখিন, তার একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকবেই। মনকে সাধকের মত নিস্পৃহ করে ইতিহাস লিখতে পারেন এমন ঐতিহাসিক খুব কমই আছেন, আর যেসব সূত্র তিনি ব্যবহার করেন সেগুলোও খুব কমই নিরপেক্ষ হয়। যিনি লিখছেন তার নিজের ফিল্টার এবং বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করেই ন্যারেটিভটা তৈরি হয়। সেটা নিরপেক্ষ না হলেও সেটার চেষ্টা থাকবে ভাল ঐতিহাসিকের লেখায়। আবার পক্ষপাত থাকলেও সেটা যাতে কোন আদর্শের গুনগান না হয় সেটা খেয়াল রাখলে ডকুমেন্টটার গুরুত্ব বাড়ে। পক্ষপাতদুষ্টতার পরের ধাপে সেটা ফ্যানাটিসিজমের পর্যায়ে চলে যায়, তখন ঐ লেখার উপর ভরসা করাই উচিত নয়। সানজাক-ই-উসমান বইটা লেখক একটা আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন, সেটা নিয়ে আমার আপত্তি থাকলেও অভিযোগ নেই; বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত, এমনকি এখনকার দিনেও পশ্চিমা অনেক ঐতিহাসিকের ইতিহাসচর্চাই পক্ষপাতদুষ্ট, কিন্তু এই বইটা লেখকের নিজস্ব বিশ্বাসের ফিল্টারের কারণে পক্ষপাত আর ফ্যানাটিসিজমের বর্ডারলাইনে চলে গেছে।
বইটার ভাল দিক নিয়ে আগে বলি। লেখক প্রচুর পড়েছেন, এবং অল্প জায়গার মাঝে বিশাল একটা টাইমলাইন এবং ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঘটনাকে বেশ সাজিয়ে উপস্থাপন করেছেন, কাজেই ইতিহাসের উত্থান-পতনের ক্রম বুঝতে সমস্যা হয় না। তবে যেহেতু লক্ষ্য ছিল অটোমান সাম্রাজ্য, সেখানে ৪০০ পৃষ্ঠার বইয়ের ১০০ পৃষ্ঠার বেশি চেঙ্গিজ খানের পেছনে খরচ করার কোন মানে ছিল না। বাকি ১০০ পৃষ্ঠার বেশি গেছে সুলতান মুহাম্মদ বা মেহমেদের পেছনে। কাজেই বইয়ের নাম 'চেঙ্গিজে বিধ্বস্ত সাম্রাজ্য উদ্ধারে সুলতান মুহাম্মদের অবদান' জাতীয় কিছু হলে বেশি মানাতো। কোন সাম্রাজ্য নিয়েই আমার বিশেষ একটা ভক্তি নেই; মানবজাতিকে লাইনে রাখার জন্য সম্ভবত রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকের প্রয়োজন আছে, তাদের প্যাঁচঘোচ আর যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস শুনতেও থ্রিলার দেখার উত্তেজনা পাওয়া যায়, কিন্তু এদের নিয়ে আমার কোন রোমান্টিসিজম বা ভক্তি নেই। ইতিহাসের শতভাগ শাসকই নানা অজুহাতে নিজেদের সকল কুকর্ম জায়েজ করেছে এবং কখনো আদর্শ, কখনো ধর্মকে সে কাজে ব্যবহার করেছে। যত বড় শাসক, তত বড় খুনী। এদের মাঝে কেউ খুন করতে করতে থেমেছে, কেউ থামার আগেই মরেছে, মোটামুটি এই হলো সারমর্ম। কাজেই কোন শাসক বা শাসকগোষ্ঠী নিয়ে ভক্তিরসে আপ্লুত লেখা দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
এই বইটা শতভাগ এ দোষে দুষ্ট। পড়লে মনে হবে, নতুন খেলাফত আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো পড়ছি, যাতে অটোমানদের গৌরবগাঁথা পড়ে আমাদেরও লাইনে চলে আসতে হবে। তুর্কি হারেমের গুণগানও বেশ চোখে লাগে। সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধে মারা যাওয়া সকল অটোমান যোদ্ধা কিভাবে 'শহীদ' হয়, সেটাও আমার বোধগম্য নয়। অটোমানরা কিভাবে ইসলামের সিপাহী হয়, সেটাও বুঝতে আমি অক্ষম। সকল রাজা-বাদশাহই নানা রকম খুনোখুনি আর অপকর্ম করেছে, ক্রুসেড শুরু হওয়ার সময় থেকে ইউরোপের নাইট-পোপ আর খ্রিস্টান রাজাদের ধূর্তামি আর গণহত্যার ব্যাপারগুলোও আজকাল ঐতিহাসিক সত্য, কিন্তু সেই সাথে অটোমানদের অকাজ আর খুনোখুনিগুলোও সুকৌশলে অল্প কথায় সেরে দেয়াটা চোখে লাগে। মোদী পার্টি যদি মুসলমান আগমনের আগে ভারতের মহানতার জয়গান লিখে কোন বই লিখে, সেটা সম্ভবত এরকম কোন ফরম্যাটেই হবে।
প্রচুর বইপত্র পড়ার জন্য লেখককে ২ দেয়া গেল। তবে বইটা পড়তে চাইলে নিজের অ্যালার্ট ফিল্টার অন করে নেয়ার অনুরোধ থাকলো। একটা লোক গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে, একটা লোককে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে, আর একটা লোক দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে, এই তিনটা বাক্যই একই সত্য ঘটনাকে উপস্থাপন করলেও, তিনটা বাক্যে কিন্তু আপনি ৩ রকম অর্থ খুঁজে পাবেন। কাজেই, সাধু সাবধান।
আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগে মঙ্গোলিয়ান স্তেপ থেকে ভয়ংকর এক নেতার আবির্ভাব হয় যে তার একদল বর্বর কিন্তু শৃঙ্খল সৈন্যবাহিনী নিয়ে পৃথিবী জয় করতে বের হয়েছিলো। লোকটার নাম তেমুজিন একেএ গ্রেট চেঙ্গিজ খান । চেঙ্গিজ খানের বাহিনীর সৈন্যরা ছিলো ইতিহাসের সবচেয়ে অশান্ত , ধুরন্ধর , যুদ্ধপ্রিয় ,চতুর , দক্ষ এবং ভয়ানক কূটবুদ্ধির অধিকারী । চেঙ্গিজ খান নিজস্ব কিছু পদ্ধতিতে এদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেন যে এরা যুদ্ধের ময়দানে হয়ে উঠে বন্যপ্রাণীর মতো ভয়ংকর এবং দয়ামায়া শূন্য । তাছাড়া মঙ্গলরা বেশকিছু টেকটিক্সের জন্য বিখ্যাত ছিলো ( পার্থিয়ান শট – ভয় পাইছি ভং ধইরা পলায়নের অভিনয় এবং শত্রু যখন ভাবতেছে ভয় পাইছে তখন পাল্টা আক্রমণ ) মোকাবেলার ব্যাপারে তাদের মূল টার্গেট থাকতো শত্রুকে গায়ের জোরে নয় বুদ্ধির জোরে হারিয়ে দেওয়া । সেই সময়��� সত্যিই তারা সেই ব্যাপারে ছিলো অতুলনীয় । মঙ্গলরা প্রতিটি নগর দখল করার পর সেই নগরের নাগরিকদের মাথা দিয়ে নগরের মূল ফটকের সামনে পিরামিড বানিয়ে রাখতো , শত্রু যদি আত্মসমর্পণ ও করতো তাও তাদের খুব নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতো । চেঙ্গিজ খানের নরকীয় হত্যাকাণ্ড এবং কলাকৌশলের জন্যই আস্তে আস্তে তার কুখ্যাতি এমন পর্যায়ে চলে গেলো যে কখনো কখনো কোন প্রকার যুদ্ধ ছাড়াই সে দখল করতে লাগলো কাঙ্ক্ষিত রাজ্য । চেঙ্গিজ খানের মুসলমানদের উপর বিদ্বেষ লক্ষ্য করা যায় … আসলে শুধু মুসলমান না , চেঙ্গিজ খানের দুনিয়ার সবার উপরেই বিদ্বেষ লক্ষ্য করা যায় । এই লোক মনে করতো যুদ্ধই সব যুদ্ধের কোন বিকল্প নেই। বইটিতে চেঙ্গিজ খান কে নিয়ে খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা করা হয়েছে । একমাত্র চেঙ্গিজ খান ই বিশাল মোঙ্গল সম্রাজ্য তৈরি করে রেখে যান কিন্তু তার কোন বংশধরেরা সেটা খুব বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন নি । চেঙ্গিজের মৃত্যুর পরে তার ওয়ারিশদের খাকান হওয়া নিয়ে রেষারেষির কারনে কেউ ই এই সম্রাজ্য আর চেঙ্গিজ খান যেমন চেয়েছিলো সেভাবে বাড়াতে পারে নি । এরপর আলোচনা শুরু হয় উসমানী সম্রাজ্য নিয়ে । তখনকার সময়ে খ্রিষ্টান রা কিভাবে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলো এবং মুসলমান রা কিভাবে তার উচিৎ জবাব দিয়ে নিজেরাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় । যুদ্ধের কলাকৌশল , বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি , সুলতানদের আচরণ , প্লেগের উৎপত্তি , ড্রাকুলা , হারেম ……… কি নেই বইতে ? সানজাক-ই উসমানে ইতিহাসের একটা বিশাল অংশ একেবারে খুঁটিনাটি সহ গল্পের মতো করে বলা হয়েছে । ইংরেজি বই গুলোর পেছনে বিখ্যাত বিখ্যাত লোকদের বই সম্পর্কে ব্যক্তিগত মতামত লেখা থাকে দেখেছি । আমাকে বললে আমি লেখতাম- এই বইটি একটা গরম তাওয়ার মতো । ধরার আগে হাতে ন্যাকড়া দিয়ে পেচিয়ে নেওয়া ভালো । সব কথার এক কথা বেঁচে গেছি ; দেড়শো পর্বের ‘’সুলতান সুলেমান’’ দেখার ঝামেলা থেকে বড় বাঁচা বেঁচে গেছি । খোদার দরবারে হাজার শুকরিয়া
অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে যাদের কৌতূহল আছে, তাদের জন্য 'সানজাক-ই উসমান' বইটা ইতিহাসের অন্য রকম এক ভুবন হিসেবে কাজ। বইয়ের নাম দেখে শুধু উসমানীয়দের গল্প মনে হলেও এখানে রয়েছে তাদের উত্থানের পেছনে কয়েকশ বছর ধরে জমে থাকা বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, নৃশংস যুদ্ধ, শক্তি সংগ্রাম, বিজ্ঞান, বিশ্বাস, সভ্যতার উত্থান ও পতনের এক আসাধারণ চিত্র।
“I am the punishment of God. If you had not committed great sins, God would not have sent a punishment like me upon you.”
— Genghis Khan
চেঙ্গিস খানের নাম বহুবার শুনেছি, তাঁর নামে খান আছে দেখে ভাবতাম হয়তো মুসলিম শাসক, পরে জানলাম উনি একজন মঙ্গোলিয়ান। খান শব্দটা সাধারণত সম্রাট বা নেতার সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতার প্রধান পরিচয় ছিল এই উপাধি।
তো বইটা শুরুই হয় চেঙ্গিস খানের ভয়াবহ অধ্যায় দিয়ে। এখানে আসে কিভাবে তিনি তেমুজিন থেকে বিখ্যাত চেঙ্গিস খান হয়ে ওঠেন। তাঁর জন্ম, শৈশব, দুর্দশা, সংগ্রাম, এরপর কিভাবে সামান্য এক যাযাবর গোষ্ঠীর নেতা থেকে তিনি দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর সম্রাট হয়ে ওঠেন সেই কাহিনী রীতিমতো কাঁপিয়ে দেয়। ইতিহাসে তাঁর সেনাবাহিনীর নির্মমতা যেমন পাঠকে শিহরিত করে, তেমনি বিস্ময়েও ফেলে। কোন শহরকে তারা কিভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিত, মানুষের মাথার খুলি দিয়ে পিরামিড বানাতো, লক্ষ লক্ষ মানুষ কিভাবে মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত – বইটি যেন সেই ঘটনার সরাসরি সাক্ষী বানিয়ে দেয় পাঠককে।
চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোল বাহিনী মধ্য এশিয়া, চীন, পারস্য এবং ইউরেশিয়ার বিশাল অংশ দখল করে। তাঁর সামরিক কৌশল ছিল অত্যন্ত নৃশংস, দ্রুত গতিসম্পন্ন এবং সংগঠিত। তাঁর আসল শক্তি ছিল মনস্তাত্ত্বিক ও কৌশলী যুদ্ধশৈলীতে। যুদ্ধ, কূটনীতি ও প্রশাসনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি বিশ্বের বৃহত্তম স্থল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল চীনের "জিন" রাজবংশের বিরুদ্ধে, যা ১২১১ থেকে ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। এই যুদ্ধে চেঙ্গিস খান ও তাঁর উত্তরসূরিরা উত্তর চীনের বিশাল অংশ দখল করেন। . . চেঙ্গিস খানের অধ্যায় শেষ হওয়ার পর আসে তাঁর উত্তরাধিকারীদের দাপট। হালাকু খান যখন বাগদাদ আক্রমণ করে, তখন মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি কেমন করে সেই দুর্যোগকে ডেকে আনল, আর কী ভয়াবহ ক্ষতি হলো সেই আঘাতে, লেখক তা অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। জ্ঞানের শহর বাগদাদের গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানীদের কাজ, হাজার বছরের ইতিহাস যথারীতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেই ধ্বংসের মাঝে ডুবে আছে মানব সভ্যতার বড় এক ট্র্যাজেডি। . . বইয়ের এক পর্যায়ে পাঠক মুখোমুখি হয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত নানা সামরিক শক্তির। কখনো মামলুকদের বীরত্ব, যারা আইনজালুত প্রান্তরে মোঙ্গলদের পরাজিত করে ইতিহাস বদলে দেয়। আবার কখনো উঠে আসে তুর্কি উপজাতিদের ধৈর্য, স্বাধীনতা আর বুদ্ধির গল্প, যারা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে একদিন প্রতিষ্ঠা করে অটোমান সাম্রাজ্য। . . আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ড্রাকুলার অধ্যায়। ইতিহাসে ড্রাকুলা বলতে আসলে কাউন্ট ড্রাকুলা না, বরং ভ্লাদ তৃতীয় বা ভ্লাদ দ্য ইমপেলার নামের এক বাস্তব ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। তিনিই পরবর্তীতে ড্রাকুলা চরিত্রের অনুপ্রেরণা হন। লেখক সেই নরপিশাচের নৃশংসতা বর্ণনা করেছেন এমন এক ঢঙে, যা ভয়ের সাথে সাথে পাঠককে বুঝতে সাহায্য করে সেই সময়ের রাজনৈতিক রূপ। ড্রাকুলার প্রতারণা, উসমানীয়দের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, আর তার শেষ পরিণতির গল্পটি বইয়ের অন্যতম নাটকীয় অংশ। . . বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধ্যায় নিঃসন্দেহে সুলতান ফাতিহের যুগ। তার শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল এতটাই আধুনিক যে আজকের যুগেও তা বিস্ময় জাগায়। তিনি এমন এক প্রজন্ম তৈরি করেছিলেন যারা বিজ্ঞান, ন্যায়, সামরিক দক্ষতা ও নৈতিকতায় ছিল অনন্য। তাঁর শাসনামলে পড়াশোনার স্বাধীনতা, গবেষণা, দায়িত্বশীলতা ও সততা দেখে বোঝা যায় কেন তিনি মাত্র একুশ বছর বয়সেই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নগরী কন্সট্যান্টিনোপল জয় করতে পেরেছিলেন। . . বইয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে ক্রুসেড। ক্রুসেড বলতে বোঝানো হয় একাদশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের দ্বারা পরিচালিত একটি বৃহৎ ধর্মীয় ও সামরিক অভিযান, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল পবিত্র ভূমি (বিশেষত জেরুসালেম) মুসলমানদের হাত থেকে মুক্ত করা এবং খ্রিস্টান শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
আর কনস্ট্যান্টিনোপল ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী, বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুল। এটি ইউরোপ ও এশিয়ার মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় বাণিজ্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং সামরিক কৌশলের দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি খ্রিস্টান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ধনী নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল।
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যই প্রথমে পোপের কাছে সাহায্য চেয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতেই প্রথম ক্রুসেড শুরু হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রুসেডাররা বাইজেন্টাইনদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। চতুর্থ ক্রুসেড ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত একটি ঘটনা। মূল লক্ষ্য ছিল জেরুজালেম, কিন্তু ক্রুসেডাররা পথ পরিবর্তন করে নিজেদের স্বার্থে কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণ করে।
এই ঘটনাকে ইতিহাসে খ্রিস্টানদের দ্বারা খ্রিস্টানদের উপর সবচেয়ে বড় আঘাতগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়।
সুলতান মেহমেদ কন্সট্যান্টিনোপল বিজয় বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নবীজী (স.) এর ভবিষ্যৎবাণী পূরণ করার জন্য মুসলিম সেনাবাহিনী শত শত বছর ধরে যে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল, সেটি কীভাবে সফল হলো, শহরের দুর্ভেদ্য প্রাচীর কীভাবে ভাঙল, সেই অধ্যায় যেন এক মহাকাব্য।
এটা শুধু একটি শহরের পতন ছিল না, বরং মধ্যযুগের সমাপ্তির প্রতীক। এর ফলে ইউরোপ থেকে বাণিজ্যপথ সরে যায়, রেনেসাঁর ধারায় তুর্কী ও আরব জ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েএবং অটোমান সাম্রাজ্য উঠে আসে বিশ্বশক্তি হিসেবে। . . বইটিতে অসংখ্য সংস্কৃতি, সভ্যতা, যুদ্ধ, ধর্মীয় সংঘাত, বিশ্বাসঘাতকতা, নৃশংসতা আর বীরত্বের গল্প আছে। মোঙ্গল উপত্যকা থেকে আব্বাসীয় খিলাফত, মামলুক যুগ থেকে তিমুরীয় সাম্রাজ্য, আরব-চীন-ইউরোপের রাজনীতির টানাপোড়েন, ক্রুসেডের চাপ, আল আন্দালুসের পতন, মশলার জন্য অভিযাত্রা, কলম্বাসের আগমন সবকিছু এমনভাবে লেখা হয়েছে যে একে একমুহূর্তের জন্যও বিরক্তিকর মনে হয় না। বরং মনে হয় একটা থ্রিলার উপন্যাস পড়ছি, যেখানে প্রতিটি পাতার পর নতুন উত্তেজনা অপেক্ষা করছে। . . সব মিলিয়ে 'সানজাক-ই উসমান' বইটা ভালোই লেগেছে। লেখকের লেখার ধরন ভালো এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বইটা বেশ ইসলাম ঘেষা। মানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের এইটা পড়তে ভালো নাও লাগতে পারে। কিছু কিছু জায়গা অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে৷
একটানা পড়লে একঘেয়ে লাগতে পারে। একটু একটু করেই পড়া উচিত।
যারা অটোমান সভ্যতার বিস্তৃত গল্প জানতে চান, কিংবা যারা শুধু চমৎকারভাবে লেখা একটি বই খুঁজছেন, তাদের জন্য সানজাক ই উসমান নিঃসন্দেহে একটি সুখপাঠ্য।
খুবই চমৎকার উপস্থাপনা বইটার মধ্যে! কিছু জায়গায় তথ্যগর দুর্বলতা থাকতে পারে, যেহেতু লেখকের প্রথম বই, হয়ত রেফারেন্সিং এর বিষয়টা ঠিকমত বুঝেন নাই। কিন্তু সব দিক বিবেচনায় সেরা একটা বই বাংলায়।
ইতিহাস গ্রন্থ যে এতটা উপদেয় হতে পারে, অটোমানদের দুনিয়ায় পা না রাখলে জানা হতো না। প্রচন্ড উত্তেজনা নিয়ে রূদ্ধশ্বাসে পড়ার মত একটা বই৷ সানজাক-ই উসমান।
যদিও বইটা উসমানীয় সাম্রাজ্য নিয়ে, কিন্তু এর বিস্তার আরও ব্যাপক, বিস্তৃত। আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বইয়ে উসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্থানের পাশাপাশি মোঙ্গল শক্তির উত্থান আর পতন, আব্বাসীয় আর মামলুক সালতানাতের ইতিহাস, রোমান সাম্রাজ্য, ক্রুসেড থেকে শুরু করে ইউরোপের রেনেসাঁস ও কলোনিয়ালিজমের উত্থান... কোন কিছুই বাদ যায় নি। বিভিন্ন পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যের উত্থান আর পতনের আশ্চর্যজনক পরিক্রমা সানজাক ই উসমান। চেঙ্গিস, তৈমুর, হালাকু, সুলেমান, মুহাম্মদ দা কনকারার সহ সব দিগ্বিজয়ী বীরেরা কীভাবে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ৪০০ বছর ধরে দুনিয়ার বুকে, পালটে দিয়েছেন সমাজ, ইতিহাস আর সভ্যতার গতিপ্রকৃতি, এ বই তার এক চমৎকার বিবরণী।
বইটার সবচেয়ে পজেটিভ দিক হচ্ছে এর বর্ননাভঙ্গি। পড়ার সময় একবারও মনে হয় নি বই পড়ছি, বরং মনে হচ্ছিল দেখছি বিবিসি বা নেটফ্লিক্সের কোন ঐতিহাসিক ডকুমেন্টারি। আরেকটা জিনিস স্বীকার করতে কিছুটা লজ্জাই লাগছে, মুসলিম লেখকদের ঐতিহাসিক বিবরণে ধর্মীয় আর জাতিবাদের একটা বাড়াবাড়ি দেখা যায়। যে কারনে আমি সাধারণত তাদের লেখা এড়িয়ে যাই। সানজাক-ই উসমানে পড়তে গিয়ে এমন কোন বিষয়ের সম্মুখীন হই-ই নি বলতে গেলে।
সুলতান মুহাম্মাদের উপরে নেটফ্লিক্সের একটা চমৎকার ডকুমেন্টারি দেখা হয়েছিল, রাইজ অব দ্যা অটোমান নামে। বই এবং ডকুমেন্টারি, কোনটার মধ্যেই বর্ণনার তেমন অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে নি। বরং ডকুমেন্টারিতে ইস্তাম্বুল পতনের দিন চার্চের চূড়ায় অতিপ্রাকৃত এক আলোর উপস্থিতি, ইস্তাম্বুল কুয়াশায় ঢেকে যাওয়ার মত কিছু ব্যাখ্যাহীন ঘটনা দেখানো হয়েছিল, যা আমি অতিরঞ্জন বলেই ধরে নিয়েছিলাম। বইতেও রেফারেন্স সহ এর উল্লেখ দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছি।
উসমানীয় খিলাফত সম্পর্কে আমার জ্ঞান শূন্যের কোঠায় ছিল। সাথে তৈমুর, চেঙ্গিস, ব্ল্যাক ডেথ, রেনেসাঁস বা ইউরোপের ঘুরে দাঁড়ানো, কলোনিয়ালিজম... এসব সম্পর্কে ধারণা ছিল ভাসাভাসা। সানজাক-ই উসমান বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে জানতে, তার পেছনকার কার্যকরণ বুঝতে এবং ঐসব ঘটনার প্রভাব সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি বা অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলেছে, এখনো ফেলে যাচ্ছে, তা বুঝতে অতুলনীয় সাহায্য করেছে।
Are you a history lover? Have you developed an interest on history lately but new in the vast sea?? Famous authors' boring books making you sick??? Then you've found the right book.
আমার পড়া সেরার সেরা বই এটা।
বইয়ের রিভিউ, প্রিভিউ কোথাও কোনো রঙ চড়ানো হয় নি। লেখক সত্যিই বলেছেন এটা প্রচলিত ধারার ইতিহাস বই না। এটা থ্রিলার, এডভেঞ্চার একই সাথে ফ্যাক্ট। নাম দেখে হয়তো মনে হতে পারে এটা শুধুমাত্র অটোমান এম্পায়ারের উপর লেখা কোনো বই। তাহলে ভুল ভাবছেন। বইটিতে সাতটি অধ্যায়ে ৬৭ টি শিরোনামে (৩য় সংস্করণ) আলোচনায় এসেছে মোঙ্গলদের উত্থান, সাম্রাজ্য বিস্তার থেকে শুরু করে দুটো বৃহত্তর মহাসভ্যতার বিলীন হওয়া থেকে মধ্যযুগীয় ইউরোপ পর্যন্ত।
Synopsis: আজ থেকে আটশো বছর আগে পৃথিবীর বুকে কিয়ামতের আগেই মোঙ্গলদের দ্বারা নেমে এসেছিল আরেক কিয়ামত। সভ্য জগত থেকে অনেক দূরের মঙ্গোলিয়ান স্তেপ থেকে বর্বর এক বাহিনী নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন ইতিহাসের ভয়ংকরতম খুনি চেঙ্গিজ খান । আর এভাবেই মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে মোঙ্গলদের তলোয়ারের নিচে পড়ে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল সাইবেরিয়া, চীন, মধ্য এশিয়া, খোরাসান, আফগানিস্তান আর ইরানের চার কোটি মানুষ। একসাথে এত লাশ পৃথিবী আর কখনো দেখেনি!
চেঙ্গিজ খানের মৃত্যুর পরও এই মোঙ্গল ঝড় থামেনি, এই ঝড় অপ্রতিরোধ্যভাবে আছড়ে পড়েছিল রাশিয়া, ইউক্রেন, হাঙ্গেরি, আনাতোলিয়া আর আব্বাসীয় খিলাফতের প্রাণকেন্দ্র ঐতিহাসিক বাগদাদে। নেতৃত্ব আর ঐক্যের অভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিলীন হয়ে গেল পাঁচশো বছরে গড়ে উঠা ইসলামী সভ্যতা। ১২৫৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাগদাদে হালাকু খানের দ্বারা সংঘটিত হলো ইতিহাসের ভয়ংকরতম গণহত্যা! ফোরাত (ইউফ্রেটিস) নদীর পানি প্রথমে মানুষের রক্তে লাল হলো, এরপর কালো হয়ে গেল প্রাচীন ও মধ্যযুগের সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানের সংগ্রহশালা বাইতুল হিকমার পুড়ে যাওয়া বইয়ের ছাইয়ে! সাতদুন ধরে লুট করার পর লাশের গন্ধে টিকতে না পেরে হালাকু খান বাগদাদ ছেড়ে চলে যান।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে এভাবেই ছিল পৃথিবীর দিকে দিকে মোঙ্গলদের ত্রাসের রাজত্ব। হিটলারের হলোকাস্ট বা রুজভেল্টের হিরোশিমা নাগাসাকি অথবা স্ট্যালিনের হলোডোমোর চেঙ্গিজ খানের মোঙ্গল বাহিনীর ধংসযজ্ঞের কাছে কিছুই না।
এই সর্বগ্রাসী মোঙ্গলদের হাত থেকে কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে ইরান, তুর্কিস্তান থেকে কিছু মানুষ আনাতোলিয়ার দিকে রওনা দিল।
তারপর কি হলো? কী করে তারা গড়ে তুলল এক বিশাল সালতানাত? মোঙ্গলদের হাত থেকে কারা বাঁচালো অবশিষ্ট পৃথিবীকে?
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে আনাতোলিয়ার ছোট্ট এক আমিরাতের সুলতান কিভাবে জন্ম দিলেন প্রাক-আধুনিক যুগের ইতিহাসে পৃথিবীর বৃহত্তম রাজশক্তির যা টিকে ছিল ছয়শো বছরেরও বেশি সময় যেখানে সাম্রাজ্যতত্ত্ববিদদের মতে একটি সাম্রাজ্যের সাধারণ গড় স্থায়িত্বকাল একশো বছর? মোঙ্গল আক্রমণে ধুলিসাৎ হয়ে যাওয়া মুসলিম সভ্যতা কিভাবে আবার মাথা উঁচিয়ে দাড়াল? . চৌদ্দশ বছর আগে মহা���বী (স) ম���সলমান কর্তৃক কনস্ট্যান্টিনোপোল জয়ের যে ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন তা-ই কিভাবে পূর্ণ হলো? শেষে কিনা একহাজার বছর ধরে অপরাজেয় থিওডসিয়ান ওয়ালও তার শেষ রক্ষা করতে পারে নি।
অটোমান সালতানাত এখানে কেন্দ্রীয় উপাদান হলেও মধ্যযুগীয় ইউরোপকেও এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ক্রুসেড, পোপের সঙ্গে সম্রাটদের বিবাদ, ব্ল্যাক ডেথ আর মসলার প্রতিযোগিতা সবই বইটিতে স্থান পেয়েছে। বাদ পড়েনি চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ দিকে এশিয়াকে কবরস্থানে পরিণত করা তাইমুর লং বা ইতিহাস কুখ্যাত নরপিশাচ ড্রাকুলার কথাও।
১১৬২ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়া প্রায় প্রতিটি ঘটনাই বইটিতে স্থান করে নিয়েছে।
তরুণ লেখক বিধায় তার বর্ণনাও ছিল সোজাসাপ্টা। কোনো রূপক বা উপমা ছিল না। কিন্তু কোথায় কোন মন্তব্য করতে হবে লেখক এব্যাপারে বেশ দক্ষতা দেখিয়েছেন যা বইটিকে আরো জীবন্ত করে দিয়েছে। ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে আছে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, নিষ্ঠুরতা। ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটা বই। . . বইটির আকর্ষণীয় দিক ছিলো তার রাজকীয় কভার আর বাইন্ডিং। সাথে ক্রিম পেপার। বুকমার্কও ছিল!😀 . . সায়েন্স এর স্টুডেন্ট বিধায় ইতিহাস আর ভূগোল জানার সুযোগ না হলেও আগ্রহ ছিল সবসময়। তাই এসএসসি দিয়েই ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে দিলাম। বইটা আমার জন্য ছিল head start । শুধু যে ইতিহাস তা নয় ছিল ভূগোলেরও পাঠ। তাই বইটা শুরু করার আগে ওয়ার্ল্ড ম্যাপটা ভালোভাবে দেখে নিলে ভালো। শুধু গৎবাঁধা বিবরণ না দিয়ে লেখক মানবিক একটা বর্ণনা দিয়েছেন। এককালের মহাশক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর কিভাবে কেন পতন হলো তা নিয়ে ছিল বিশ্লেষণী আলোচনা। প্রথম দিকে বোরড্ হয়ে গেলেও শেষের দিকে মনে হয়েছে থ্রিলার পড়ছি। লেখক একটুও মিথ্যা বলেননি যে বইটি আমাদের টাইম ট্রাভেল করিয়ে আনতে যাচ্ছে...
(তবে হ্যা, প্রথমদিকে ওয়ার নভেল টাইপ মনে হয়েছিল তাই বোরড হয়ে যাই। তবে শেষ পর্যন্ত মুগ্ধকর ❤)
পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিলো যেন কোনো থ্রিলার পড়ছি। অবশ্য লেখক সেটা আগেই নিশ্চিত করেছেন যে এই বই পড়ার অভিজ্ঞতা অন্য আর দশটা ইতিহাসের বই পড়ার মত হবে না এবং লেখক তার কথা পুরোপুরিভাবেই রেখেছেন। এত চমৎকার, সাবলীল আর আনন্দদায়ক ভ্রমণে ইতিহাসের বাঁকে ঘুরিয়ে এনেছেন যে তার জন্য তিনি অবশ্যই একটা ধন্যবাদ পাওনা। এরকম সহজ সাবলীল উপস্থাপনায় ইতিহাসে পরিভ্রমণের জন্য লেখকের কাছে আরও অনেক অনেক বইয়ের দাবী রইলো।
উসমানীয় সাম্রাজ্য। যা গ্রিক ভাষায় অটোমান সাম্রাজ্য। এই নামেই পুরো বিশ্বে পরিচিতি পায় উসমানীয় সাম্রাজ্য। সেলজুকদের অধীনে ছোট একটি আমিরাত থেকে আস্তে আস্তে এশিয়া-ইউরোপের বিরাট এক অঞ্চলের শাসক হয়ে উঠে উসমানীয়রা।
বইটিকে অটোমানদের ইতিহাস বললেও মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগে চেঙ্গিস খানের উত্থান ও এশিয়াজুড়ে মোঙ্গল বর্বরদের ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। দ্বিতীয়ভাগে অটোমানদের উত্থান, ইউরোপে তাদের ক্ষমতার খুঁটি স্থাপন এবং সাম্রাজ্যের বিস্তারকে তুলে ধরেছেন। তৃতীয় ও শেষভাগে লেখক কিছু ভিন্ন সময়ের ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করেছেন। ইতিহাসের বই পাঠের সবচেয়ে বড় সমস্যা সাল-তারিখ। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে লেখক বইটিতে তারিখের ব্যবহার খুব কম করেছেন, যাতে করে সাধারণ পাঠক বইটিকে সাদরে গ্রহণ করতে পারে।
তেরো শতকের প্রথমদিকে মঙ্গোলিয়ার যাযাবর উপজাতিদের নিয়ে চেঙ্গিস খান যে সাম্রাজ্যের সূচনা করেন তা টিকে ছিল তার মৃত্যুর পরেও। মোঙ্গলরা পুরো মধ্য এশিয়াজুড়ে এক মূর্তিমান কিয়ামতে রূপ নিয়ে ধ্বংস করেছিল একের পর এক শহর। মাটির সাথে শহরগুলোকে মিশিয়ে দিয়েছে, সাথে হত্যা করেছে কোটি মানুষকে। আত্মসমর্পণ করেও রেহাই পায়নি শহরের বাসিন্দারা। হত্যা করে লাশের পরে পিরামিড বানিয়ে রাখতো শহরের প্রবেশদ্বারে। এই মোঙ্গল বাহিনীর জয়রথ থেমে গিয়েছিল আইন জালুতের যুদ্ধে।
মোঙ্গল বাহিনীর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া তুর্কি মুসলিমরা আনাতোলিয়াতে (বর্তমান তুরস্কের অঞ্চল) গড়ে তুলতে থাকে নতুন সাম্রাজ্য। এমনই একজন ছিলেন আরতুরুল বের ছেলে উসমান। যার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় উসমানীয় তথা অটোমান সাম্রাজ্য। আনাতোলিয়াতে উসমানীয়রা এমন এক সাম্রাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন, যা ছিল তৎকালীন ইউরোপীয়দের থেকে অনেক উন্নত। অমুসলিমরা এই সাম্রাজ্যেই বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন সুশাসনে আকৃষ্ট হয়ে। সপ্তম অটোমান সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহর শাসনামলে সবচেয়ে বেশি বিস্তার পায় উসমানীয় সাম্রাজ্য। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ডেকে আনেন তিনি, পাশাপাশি ইউরোপে অটোমানদের শাসন সুসংহত করেন। অটোমান সুলতান বায়েজিদ মধ্য এশিয়ার আরেক দিগ্বিজয়ী বীরকে চিঠিতে তার স্ত্রীদের অসম্মান করেছিলেন। সেই সত্তর বছর বয়সী বীর যুদ্ধে বায়েজিদকে হারিয়ে উলটো তারই স্ত্রীদের সম্মানহানি করে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। সেই বীর হলেন বিশ্ববিখ্যাত তৈমুর লং।
বইটির শেষ ভাগে উসমানীয় সাম্রাজ্যের মুহাম্মদ আল ফাতিহর মৃত্যুর পর স্পেন অঞ্চলে মুসলিমদের শাসন হাতছাড়া হওয়া এবং আফ্রিকা আমেরিকার আবিষ্কারের গল্প তুলে এনেছেন লেখক।
বইটির নামের সাথে বইয়ের ভেতরের জিনিসের মিল পুরোপুরি নাই। কারণ অটোমানদের গল্প বলতে পুরো ১০০ পৃষ্ঠার মোঙ্গলদের ইতিহাসের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আবার বইয়ের শেষদিকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কলোনিয়াল, গ্লোবালাইজেশন ইত্যাদি বিষয়কে এনেছেন। এসবের আদৌ কোনো দরকার ছিল? তিনি অটোমান সাম্রাজ্যকে মুহাম্মদ আল ফাতিহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ করেছেন, ইচ্ছা করলে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে পরবর্তী সময়কেও লিপিবদ্ধ করতে পারতেন
ঘরের খবর ঘরের মানুষই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে। পুরো বইটি লিখতে তিনি শুধুই ইউরোপিয়ান লেখকদের তথ্য ব্যবহার করেছেন, যা অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। আর যুদ্ধক্ষেত্রের এত খুঁটিনাটি বিবরণ সন্দেহের অবকাশ রাখে। এতটা স্পেসিফিক বর্ননা আসলেই সম্ভব?
বইটি পড়ে আসলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবেনা। এখানে লেখকের বর্ননাভঙ্গি আমার ভালো লাগেনি। শুধু মনে হয়েছে এক পক্ষকে হিরো বানানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।
বইটি আরো কম পৃষ্ঠায় শেষ করা যেত। ছোট ছোট লাইন করে পৃষ্ঠা ভরা হয়েছে। বানান ভুল নেই বললেই চলে। সাবলীল লেখা। নতুন পাঠকও চাইলে বইটি পড়তে পারবে। হ্যাপি রিডিং।
১। মুসলমানের প্রতি সুধারণা পোষণ করা হাদিসের নির্দেশ। ২। ক্রুসেডে সুবিধা করতে না পেরে খ্রিস্টান দুনিয়া বহু ওরিয়েন্টালিস্টের জন্ম দেয়। যারা ইসলামী ইতিহাসের ক্ষেত্রে অন্যায্য আচরণ করে এসেছে বরাবরই। রাসূলের সীরাতে পর্যন্ত জাল বর্ণ্না ঢুকিয়েছে।
আমরা ���ংরেজি ভাষার চক্করে পড়ে তাদের অখাদ্য গিলছি গোগ্রাসে। তাদের কৃত কুরআনের ইংলিশ অনুবাদ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি হরহামেশা। অথচ, তারা কুরআনের অনুবাদেও সততা রক্ষা করেনি-এটা প্রমাণিত সত্য।
'সানজাক' বইটির লেখকও প্রমাণ করেছেন তিনি আলাদা কিছু নন। ইউরোপ কৃত অটমানদের ইতিহাস তিনি অন্ধের মত বয়ান করেছেন। সম্ভবত মুহাম্মাদ আল ফাতিহ'র আলোচনায় তার প্রমাণ বিদ্যমান।
আমার মনে হয়, অনুসন্ধানী পাঠকের জন্য বইটি 'অনিরাপদ।'
একসময় সারা পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতিয়াংশ মুসলিক শাসনের অধীনে ছিলো। মুসলিম শাসনের সেই সময়কালের একটা বড় সময় ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিলো অটোমান সাম্রাজ্য। “সুলতান সুলেমান” নামের যে টিভি সিরিয়ালটি আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো তা এই অটোমান সাম্রাজ্যেরই সবচেয়ে বেশি সময় শাসনভারে থাকা সুলতান সুলাইমানের জীবনির উপর নির্মিত।
বইটির মূল উপজীব্য অটোমান সাম্রাজ্য হলেও অটোমান সালতানাত গড়ে উঠবার আগে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপজুড়ে নিষ্ঠুর ও পরাক্রমশালী মোঙ্গল নেতা তেমুজিনের উপাখ্যান দিয়ে শুরু হয়েছে। ইতিহাসে এই হানাদার মোঙ্গল সম্রাট চেঙ্গিস খান নামে পরিচিত। পুবে চীন থেকে পশ্চিমে সার্বিয়া পর্যন্ত বিশাল এক ভুখন্ড দখল করেছিলো এই চেঙ্গিস খান, একাই হত্যা করেছিলো প্রায় ৪ কোটি মানুষকে। সেইসময় পুরো পৃথিবীর জনসংখ্যাই ছিলো ৪০ কোটির কাছাকাছি। চেঙ্গিস খানের উথান ও তার মৃত্যুর পর ক্রমান্বয়ে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি পুরোটাই বেশ সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। মোঙ্গলদের ক্রুরতা ও তাদের বিভিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ননা গল্পের মত তুলে ধরেছেন লেখক। পড়তে গেলে একদম নবীশ পাঠকদেরও কোন বিরক্তি লাগবে না।
বইটিতে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম সুলতান ওসমান থেকে শুরু করে সুলতান দ্বিতীয় বায়োজিদ পর্যন্ত মোট আটজন সুলতানের শাসনামল ও তাদের সময়কালের বিবরন দেয়া হয়েছে। রোমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে অটোমানদের প্রায়শই ঘটে যাওয়া যুদ্ধগুলোর বর্ননা লেখক এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে সেগুলোকে কল্পনা করতে মোটেও কষ্ট হয় না। মনে হয় যেনো চোখের সামনেই ঘটে চলেছে ঘটনাগুলো। অটোমান সুলতানদের সাহসিকতা, তাদের প্রজ্ঞা, সাম্রাজ্য পরিচালনা ও জনগনের কল্যানে নেয়া পদক্ষেপ গুলো নিয়ে লেখক সুনিপুনভাবে তুলে ধরেছেন। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে অটোমানদের প্রশাসনিক গঠনতন্ত্র ও তাদের শিক্ষাব্যাবস্থার বর্ননাগুলো। পড়ার সময় বার বার মনে হয়েছে এইরকম শিক্ষাব্যাবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামো যদি আমাদের দেশে থাকতো তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র বহুদুর এগিয়ে যেতো। পুরো ইউরোপ যখন অজ্ঞানতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও শাসকশ্রেনীর যাতাকলে পড়ে নিষ্পেষিত হচ্ছিলো মুসলিম বিশ্ব তখন এই অটোমানদের সংগঠিত ব্যাবস্থাপনায় অপ্রতিরোধ্য এক জাতিতে পরিনত হয়েছিলো।
বইটি রচনায় লেখক যথেষ্ট গবেষনা ও পরিশ্রম করেছেন। তার চমৎকার লেখনশৈলিতে ইতিহাসের একটা গুরুত্বপুর্ন অধ্যায় সুন্দর ও সহজভাবে ফুটে উঠেছে বইটিতে। মাহমুদুর রহমানের লেখা মোগলানামার পর ইতিহাস নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা আরো একটা প্রাঞ্জল বই পড়লাম। ইতিহাসে আগ্রহী পাঠকদের রেকমেন্ড করার মত একটা বই এটি।
বইটা মূলত মধ্যযুগের মুসলিমদের ইতিহাস নিয়ে লেখা, আরও ভালো করে বললে বলতে হয় অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে লেখা। কিন্তু বইটাতে স্থান পেয়েছে আরও অনেক কিছু। যেমন প্রথম ১৫০ পৃষ্ঠার মতো ছিলো চেঙ্গিস খান এবং তার বংশধরদের ইতিহাস, কিভাবে চেঙ্গিস খান পুরো মুসলিম বিশ্বে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলো যে তারা ইয়াজুজ-মাজুজের বংশধর, কি করে সে এক এক করে মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোতে ধ্বংস ডেকে আনে। তার বংশধররা বাগদাদের মতো একটা সমৃদ্ধশালী শহরকে কিভাবে নরকে পরিণত করে তারও বর্ণনা রয়েছে। তারপর মোঙ্গলদের ঘন্টা বেজে যায় চেঙ্গিসের মৃত্যুর পর তার বংশধরদের ভিতরের গৃহযুদ্ধে। . এছাড়াও মামলুকদের এবং সেলজুকদের কাহিনিগুলোও বেশ চমৎকার ছিলো। অতঃপর উসমানের হাত ধরে তৈরি হয় অটোমান সাম্রাজ্য এবং তারই রক্তধারায় তৈরি হয় একটা বৃহৎ সাম্রাজ্য ব্যবস্থা যা আগে কখনো পৃথিবীর মানুষ দেখেনি। এখানে অটোমানদের বিখ্যাত সুলতান উসমান, ওরহান, মুরাদ I , বায়েজিদ, মুহাম্মদ I, মুরাদ II, মুহাম্মদ II, বায়েজিদ II এর কাহিনি বর্ণিত আছে। কখনো তারা লড়াই করে ইউরোপের ক্রুসেডারদের সাথে, কখনো ড্রাকুলা ( ভ্লাদ ) বা কখনো তৈমুর লং এর সাথে। এখানে দেখানো হয়েছে কি করে অটোমানরা কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে তাকে নাম দেয় ইসলামবুল। এছাড়াও স্থান পেয়েছে স্পেন এবং পর্তুগালে কি করে মুসলিমদের পতন হয়। আরও এমন অনেক ইতিহাস রয়েছে বইটিতে। . বইটা পড়ার সময় আপনার ইতিহাসের এই সময়টাকে অনেক নিষ্ঠুর মনে হবে, সাম্রাজ্য বনাম সাম্রাজ্য যুদ্ধ লেগেই থাকতো যার কারনে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা পড়তো।
৪.৫/৫ তারকা। ইতিহাসের প্রতি আমার মতো অনেকেই আগ্রহ পান না। বিভিন্ন ব্যাক্তিদের নাম,সন-তারিখ ইত্যাদি মনে রাখা অনেক কষ্টকর। সেই হিসেবে এই বইটা যথেষ্ট সুখপাঠ্য। এক বসায় পড়ে ফেলার মতো একটা বই। লেখক মাঝে মধ্যে টুইষ্ট,থ্রিল দিয়ে আরো মজাদার করে তুলেছেন। নাম মনে রাখার জন্য শেষে চেঙ্গিস খান আর উসমানের বংশধরদের একটা তালিকা দিছেন।সেটা অনেক উপকারে আসছে। ০.৫ তারকা কেটে নিলাম শেষের ২/১ টা অধ্যায় বিষয়বস্তুর সাথে মিল না থাকায়।
সব মানুষের সম্রাট চেঙ্গিজ খান। এখন হয়তো খুব কম মানুষই আছে যারা তার নাম জানে না। যার দলবল আজ থেকে প্রায় ৮ শ' বছর পৃথিবীর বুকে নামিয়ে এনেছিল এক ভয়াবহ কেয়ামত। চেঙ্গিজ খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলিয়ান স্তেপ থেকে এক বর্বর বাহিনী মাত্র বিশ বছরের ব্যবধানের পাল্টে দিয়েছিল পৃথিবীর ক্ষমতা কাঠামো। মোঙ্গলদের তলোয়ারের নিচে পড়ে খড়কুটোর মত উড়ে গেল সাইবেরিয়া, চীন, মধ্য এশিয়া, খোরাসান, আফগানিস্তান ও ইরানের চার কোটি মানুষ। একসাথে এত লাশ পৃথিবী আর কখনো দেখে নি!
এই অপ্রতিরোধ্য মোঙ্গল বাহিনীর জেনারেল চেঙ্গিজ খানের নাতি হালাকু খানের তোপ���র মুখে পড়ে বিলীন হয়ে গেল বাগদাদ নগরী।অর্থাৎ আব্বাসীয় খিলাফতের কফিনে সর্বশেষ পেরেকটি মেরেছিল মোঙ্গলরাই। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পুরোটা জুড়েই ছিল পৃথিবীর দিকে দিকে মোঙ্গলদের ত্রাসের রাজত্ব। কিন্তু এর মাঝে নতুন এক শক্তির উত্থান ঘটে মিশরে। মামলুকরা জীবন বাজি রেখে সিরিয়া, মিশর ও মক্কা-মদিনা রক্ষা করে। আইন জালুত আর হোমসের যুদ্ধের পর পাল্টে যেতে যেতে শুরু করে ইতিহাসের স্রোতধারা। তবে এর মধ্যে অবাক করা বিষয় হলো রাইজিং সুপার পাওয়ার মঙ্গোলিয়ান বাহিনী সর্বপ্রথম পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছিল তরুণ সুলতান জালালুদ্দিনের কাছ থেকে। কিন্তু সময়মত ক্ষমতা হস্তান্তর না করার দরুন জালালুদ্দিন মোঙ্গলদের কফিন রচিত করতে পারেন নি। তবুও আমার মতে মঙ্গোলীয় কফিনের প্রথম পেরেকটি ছিল তারই। জালালুদ্দিনের ব্যাপারে চেঙ্গিজ খান বিস্মিত হয়ে বলে, "ধন্য সেই মা, যে এমন ছেলে পেটে ধরেছে। বাপের তো চাই এমনই এক ব্যাটা! আহ, আমার যদি এমন একটা ছেলে থাকত!
মোঙ্গলদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া তুর্কি মুসলিমরা আনাতোলিয়াতে গড়ে তুলতে থাকে নতুন সভ্যতা এদের মধ্যেই একজন ছিল আর্তুগ্রুল বে'র ছেলে উসমান। আর্তুগ্রুল তার জীবদ্দশায় সালতানাতের বীজ রোপণ গিয়েছিলেন। সেই সালতানাত আলোর মুখ দেখে উসমানের হাতে। তা স্থায়ীত্ব পায় ছয় শো বছরের অধিক সময়কাল। এই উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতানই রাসুল স. কনস্টান্টিনোপল জয়ের ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবায়ন করে। তারাই ইউরোপের উপর বীরদর্পে পদচারণা করেন। উসমানীয়দের নানা উত্থান-পতনের কাহিনী থাকলেও বক্ষ্যমান গ্রন্থ থেমে গেছে সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহর নিকট এসে।
কথা বলছিলাম 'সানজাক-ই উসমান' নিয়ে। সাল, তারিখ বা বিস্তৃত ইতিহাসের প্রতি যাদের তীব্র অনীহা তারা মোঙ্গলদের উত্থান-পতন, মামলুকদের শাসন, উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল জয় ও ইউরোপের মানুষরূপী পিশাচ কাউন্ট ড্রাকুলার নিধনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস একনজরে এখানে পড়তে। বইটি অনেকটা উপন্যাসের ধাঁচে লিখা। তবে উপন্যাসের মত কোনো কাল্পনিক চরিত্রে চিত্রায়িত নয়। বইটির নির্দেশিকায় ভৌগোলিক ও নৃগোষ্ঠীর অনেক পরিভাষা ব্যাখ্যা করা হয়েছে যা প্রথম দিকের ইতিহাসে পাঠকের জন্য ভালো উপকারে আসবে। যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ বোঝার জন্য অনেক জায়গায় মানচিত্র সংযুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে দুর্বোধ্য অভিযানগুলো খুব সহজেই মাথায় এসে যায়। তবে বইটিতে ঘটনা প্রবাহ বর্ণনার সময় লেখক পশ্চিমা ইতিহাসবিদদের বই অনুসরণ করেছে। আবার যারা সামরিক পরিভাষায় একবারে অজ্ঞ তাদের বইটির যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ বুঝতে ভালো বেগ পেতে হবে। আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো যে, ইতিহাসের নিয়মিত পাঠকদের জন্য বইটি ফলদায়ক নয়। পরিশেষে বলা যায়, এক নজরে ইতিহাসের পাতায় রোমাঞ্চ অনুভব করা জন্য বইটি বেশ ভালো।
পরিবর্তনই ইতিহাসের ধর্ম। মানব জাতি তার ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের মাধ্যমে আজকের এই সভ্যতায় পদার্পন করেছে। মানুষ স্থির হয়ে থাকার মতো কোন প্রাণী না। পৃথিবীর বুকে পা রাখার পর থেকেই সে ঘুরে বেড়িয়েছে। চিনতে চেয়েছে অজানাকে। ইতিহাস এটাও স্বীকার করে "যেখানে শেষ, সেখান থেকেই শুরু"।
মুহাম্মদ (দঃ) যে রাষ্ট্র এবং ধর্ম ব্যবস্থা রেখে গিয়েছিলেন তা তার পরবর্তী উম্মতগণ শুধু মজবুতই করেননি বরং তা বিশ্বের দরবারে আরও করেছেন শক্তিশালী এবং ভুমি করেছেন বিস্তৃত। অর্থাৎ ইসলাম যে বাণী নিয়ে ৬১০ সালে আরবে হাজির হয়েছিল। মাত্র এক শতাব্দীর মধ্যেই তা সেসময় মানবসভ্যতার তিনভাগের দুই ভাগে পৌছে দিয়েছিলো আরব মুসলিমরা।
আবুবকর এর মাধ্যমে খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের শুরু হলেও মুলত তা বেশি বছর টিকে থাকতে পারেনি। বরং মুয়াবিয়া নতুন করে রাজ্যব্যবস্থার প্রবর্তন করে রাজতন্ত্র চালু করলেন। উমাইয়া, আব্বাসীয়, মামলুক, ফাতেমীয়, উসমানীয় শাসন ছড়িয়ে পড়েছে এপ্রান্ত থেকে ওপান্ত পর্যন্ত। ইসলামের স্বর্ণযুগ মুলত ছিলো উমাইয়া যুগে। যারা ইউরোপ, আফ্রিকা, ভারতবর্ষের দিকে ইসলামের ঝান্ডা উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
সানজাক-ই উসমান এর আলোচনার বিষয় হলো, কিভাবে মঙ্গোলদের হাত থেকে ইসলামী সালতানাত রক্ষা, এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মুল বিষয়টি হচ্ছে উসমানীয় খিলাফত। তবে তার আগে অবশ্যই আপনাকে অধ্যায়ন করতে হবে মঙ্গোলদের উত্থান, আব্বাসীয়দের পতন, মামলুক শাসন, তারপরে উসমানীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা। এছাড়া সেলজুক শাসনামল, ক্রুসেড সহ সেসময়ের নানান ঘটনা তো রয়েছেই।
বইটি শুরু হয়েছে চেঙ্গিস খানের জন্ম পরিচয়ের মাধ্যমে। আজ থেকে আটশ বছর আগে পৃথিবীতে কেয়ামতের আগেই কেয়ামত শুরু করে দিয়েছিলেন চেঙ্গিস ও তার বংশধররা। তার মৃত্যুর পরেও এই ঝড় থামেনি। বলা যায় পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সিরিয়াল কিলার ছিলেন চেঙ্গিস খান। যার নেতৃত্বে কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
তিনি এমন কোন যুদ্ধে জড়াতেন না, যে যুদ্ধে জিততে পারবেননা। মুলত এই কারনে বাগদাদ আক্রমনের ইচ্ছে থাকলেও বিশ্বমুসলিমদের ভয়ে তার সময়ে আক্রমন করেননি। যা পরবর্তীতে করেছিলো তার নাতি হালাকু খান। চেঙ্গিস খান যুদ্ধের পর সবাইকে গনহারে হত্যার নির্দেশ দিতেন। আর মাথাগুলো দিয়ে বানাতেন পিরামিড। যার একেকটা পিরামিডে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মাথা থাকতো।
চেঙ্গিস খানের জীবনে তার বাহিনী একবারই পরাজিত হয়েছিলেন। তা হলো পারওয়ানের পরাজয়। যেটার বিপক্ষে ছিলেন জালাল উদ্দিন। তার বিরত্বে চেঙ্গিস খান আফসোস করে বলেছিলেন - ধন্য সেই মা যার এমন একটি সন্তান রয়েছে। আমার যদি এরকম একটি সন্তান থাকতো!
চেঙ্গিসখান মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে পৃথিবীর ক্ষমতা কাঠামোই পাল্টে দেন। মোঙ্গলদের তলোয়ারের নিচে চার কোটি মানুষ জীবন দিলো। এত লাশ পৃথিবী আগে কোনদিন দেখেনি। চেঙ্গিসখানের মৃত্যুর পরেও এই মৃত্যুর ঝড় থামেনি। ৫০০ বছরের গড়ে উঠা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটি মুসলিম সভ্যতার পতন হয় মোঙ্গলদের হাতে। মুসলমানরা হয় ভাগ্যবিড়ম্বিত, অসহায় জাতিতে।
কিন্তু মোঙ্গলদের এই ঝড় বাধা প্রাপ্ত হয় মামলুক বংশের শক্তিশালী মুসলমানদের হাতে। মুলত মামলুকদের হাতেই প্রচন্ড মার খেয়ে দিকভ্রান্থ হয়ে পড়ে মোঙ্গলরা। পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে বিশাল মোঙ্গল জনগোষ্ঠী র একটি অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
মঙ্গোল দের আক্রমন, গুপ্তঘাতকদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে যেসব লোক আনাতোলিয়ায় জড়ো হয়েছিলেন। সেখান থেকেই উসমানের নেতৃত্বে উসমানীয় খিলাফতের সূচনা হয়। পৃথিবীতে যার পরিচয় হলো গ্রেট অটোমান সা���্রাজ্য নামে।
অটোমানদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন বায়েজিদ। তাকে বলা হতো ইয়িলদিরিম (বজ্রপাত)। মুলত তিনি ছিলেন শত্রুর কাছে বজ্রপাতের মতোই। এই বজ্রপাতের আঘাতে ইউরোপের সামরিক মেরুদন্ড একেবারেই ভেঙ্গে যায়। অটোমান সাম্রাজ্য বিস্তৃত্ব হতে থাকে। কিন্তু আঙ্কারার যুদ্ধে তৈমুর লং এর সাথে পরাজিত হলে অটোমান সাম্রাজ্য পতনের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। তারপরেও অটোমান সাম্রাজ্য ৫০০ বছর ইউরোপ শাসন করেছিল!
সত্যে পরিণত করেছিল মুহাম্মদ (দঃ) এর বাণী। কনস্টান্টিনোপল জয় করবে একদিন মুসলমানরা! কিভাবে সম্ভব হয়েছিলো শতশত বছর ধরে পর্বতের মতো অটোল সেই কনস্টান্টিনোপল এর দেয়াল ভেঙে তা জয় করা! যে কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করতে গিয়ে আড়াইলাখ যোদ্ধা হারায় উমাইয়া খিলাফত। আজ থেকে তেরো শ বছর আগে আড়াই লাখ যোদ্ধা। যে সে কথা নয়, যখন পৃথিবীর জনসংখ্যাই ছিলো দুই কোটির মত। কিভাবে তৈমুর লং এর ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য থেকে ঘুরে দাঁড়ালো অটোমান সাম্রাজ্য?
ইউরোপের ইতাহাসবিদরা উসমানীয় সাম্রাজ্যকে অটোমান সাম্রাজ্য বলে থাকেন। অটোমান হলো গ্রীক শব্দ। অটোমানদের সেসব রোমাঞ্চকর কাহিনী জানতে হলে এই বইটি আপনাকে পড়তে হবে। প্রতিটি পৃষ্ঠাতে পাবেন শিহরণ জাগানো জাগানিয়া সব ঘটনা। দেখা হয়ে যাবে ইতিহাসের সেসব সিরিয়াল কিলারদের সাথে। আর হ্যাঁ এটা কোন উপন্যাসের বই নয়, এটা ইতিহাস, উত্থানের ইতিহাস, সভ্যতার পতনের ইতিহাস, ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস, ঈমানের ইতিহাস। ইতিহাস কলঙ্কের। ইতিহাস ধ্বংসযজ্ঞের। ঘুরে আসুন সেসব দিনগুলোতে, কেমন ছিলো তারা! কেমন ছিলো সেসব মানুষের জীবন!
এই বইটি পড়ে আপনি বুঝতে পারবেন - একজন শাসকের কোন বন্ধু থাকেনা, ভাই থাকেনা, পুত্র থাকেনা, পিতা থাকেনা, তাদের থাকে শুধু তলোয়ার। যতদিন তলোয়ার দিয়ে শাসন করার ক্ষমতা থাকে, ততদিন শাসক টিকে থাকেন। যখন ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। তাকে নেমে যেতে হয়। কারোর জন্য অপেক্ষা করে করুণ পরিনতি।
♦বইটির বাধাই, পৃষ্ঠা, কভার, সবকিছুই অত্যান্ত চমৎকার। বানান ভুল চোখে পড়েনি। আর লেখকের প্রতি ভালোবাসা রইলো - ইতিহাসের এমন এক চমৎকার বই পাঠকদের কাছে তুলে ধরার জন্য।
উসমানী খেলাফত সম্পর্কে জানতে বইটা পড়া দরকার।একবারে প্রাথমিক লেবেলের বই উসমানী খেলাফত সম্পর্কে, এক মলাটে সব বলা যায়। এই বই পোড়ে উসমানী খেলাফত সম্পর্কে আরো আগ্রহী হয়ে উঠেছি।
খুব ছোটবেলা ইতিহাস বলতে আমরা যা শিখি বা জানি তা হল বাবর,হুয়ায়ুন মোগলদের সম্পর্কে। নিদেনপক্ষে দিল্লি সালতানাত এর খোঁজ খবর পর্যন্তই আমাদের দৌড়। অবশ্য এর কারণও আছে।ভৌগলিকভাবে আমাদের এসব জানা সহজ যেহেতু মোঘলরাই দিল্লির সিংহাসনে বসে ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছে।
যেই সময় দিল্লির সিংহাসনে মোগলরা বসে আছে কিংবা মামলুক, খিলজি,তুঘলক কিংবা লোদিরা ঠিক সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের কিছু অংশজুড়ে দুর্বার গতিতে শাসন করে গিয়েছে অটোমান বা উসমানী সালতানাতের সম্রাটরা। আমরা সাবকন্টিনেটাল হওয়াতে মোঘল নিয়ে যেই পরিমান বই বাজারে আছে এবং আমাদের মধ্যে যেই পরিমানে আলোচনা হয় তার ১% ভাগও আলোচনা হয় না অটোমানদের নিয়ে। কিন্তু শক্তির দিক দিয়ে এবং শৌর্যের দিক দিয়ে তারা ছিলো দিল্লি সালতানাতেরও অনেক অনেক উপরে।
"সানজাক-ই উসমান" বইটি নিঃসন্দেহে অটোমানদের সেই সোনালী অতীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য আদর্শ একটা বই।
অটোমান সুলতান নাম শুনতে আমাদের মনে যার নাম সবার আগে আসে তিনি হলে সুলতান সুলেমান। কিন্তু সুলতান সুলেমানের রাজত্বকাল ছিল ১৫২০ সাল থেকে ১৫৬৬ সাল পর্যন্ত। কিন্তু বস্তুত সুলতান সুলেমান সুবিশাল অটোমান সাম্রাজ্য পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে।অথচ সুবিশাল অটোমান সাম্রাজ্য অটোমান সম্রাটরা কয়েক শতাব্দী ধরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। যার কোনটাই উড়ে এস জুড়ে বসেনি।
"সানজাক-ই উসমান"বইটাতে অটোমানদের গোড়াপত্ততনের শুরু থেকে মুহাম্মদ আল ফাতিহ (Mehmed the conqurer)/ দ্য ঈগল এর মৃত্যু পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী কয়েকটি শতাব্দীর ইতিহাস বর্ননা করা হয়েছে।
উঠে এসেছে চেঙ্গিস খান এর বিশ্ব বিজয়ের কাহিনী। যিনি বিশ্বজুড়ে হত্যা করেছিলেন কয়েক কোটি মানুষ। যার পথে পড়ে কেউ বাঁচতে পারেনি। উঠে এসেছে তৎকালীন সময়ে আরাম আয়েশে মজে থাকা মুসলিমদের কথা।যারা নিজেদের আকিদা ছেড়ে মৌজে মজে ছিলো। যাদের উদ্দেশ্য করে চেঙ্গিস খান বলেছিলো - “I am the punishment of God...If you had not committed great sins, God would not have sent a punishment like me upon you.”
উঠে এসছে মামলুকদের কথা যারা জীবন বাজি রেখে রক্ষা করেছিলো মক্কা ও মদিনা। উঠে এসেছে মঙ্গলদের থেকে পালিয়ে আসা একটি পরিবার কি করে আনাতোলিয়ায় বাস করে একটা সালতানাতের জন্ম দিলো। যা কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শাসন করেছিলো প্রায় অর্ধে পৃথিবী।
বইতে উঠে এসেছে মুসলিমদের সাথে খ্রিষ্টানদের ক্রুসেডে অটোমানদের নেতৃত্বের নেপথ্যে কথা। নানা ঘাত প্রতিঘাতে টিকে থাকা অটোমানদের জয় পরাজয়ের কথা। উঠে এসেছে ইসলামদের সোনালী গৌরবের কথা। উঠে এসেছে কিভাবে নিজেদের কর্তব্য ভুলে এবং নিজদের পথ ভুলে বিপথে গিয়ে ধ্বংস ডেকে আনা মুসলিম জাহানের কথা।
ইতিহাস ভিত্তিক বই হিসাবে দারুন জম্পেস একটা বই। যারা ইতিহাস জানতে আগ্রহী তাদের তো অবশ্য পাঠ্য একটা বই। ৪৩২ পৃষ্ঠার বইটি পড়তে একটুও বিরক্তি আসবে না।
তেমুজিনের পিতা ইউসুগেইয়ের মৃত্যুর পরপরই তেমুজিন ও তার পরিবারকে পাঠানো হয় নির্বাসনে। তিনভাই, দুই সৎভাই আর এক বোন ও মাকে নিয়ে জঙ্গলে নেকড়ের খাওয়া মরা ষাঁড়ের মাংস খেয়ে টিকে থাকা ছিলো অত্যন্ত কষ্টের। এই কষ্টের মধ্যেও যখন তেমুজিনের সৎভাই জোরপূর্বক মা হুয়েলোনকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন, তেমুজিনের ষোল বছরের তাগড়া জোয়ান শরীর তা সহ্য করেনি। তেমুজিন ও তার সহোদর খাসার মিলে হত্যা করে সৎভাই বারাগাতকে। তৈয়ুচিদ গোত্রের দস্যুদের হাতে বন্দী হয়ে তাদের দাসে পরিণত হতে হয় তেমুজিনকে। সেখান থেকে পালিয়ে যেয়ে পরবর্তী বিশ্বে নিজের অবস্থানের জানান দেয় তেমুজিন। যাকে আমরা চেঙ্গিজ খান নামে চিনি। . শুরু হলো মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তিধর শাসক তেমুজিন ওরপে চেঙ্গিজ খানের সময়কাল ও প্রভাব বিস্তারের গল্প.... . কথিত আছে তেমুজিন জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে যে বাহিনী গঠন করেছিলো তা হিটলারের নাজিদেরও হার মানায়। যারা ছিলো, আনুগত্য বিশ্বস্ততা ও দক্ষতায় সেরা৷ তেমুজিনের অবাধ্যতার শাস্তি ছিলো একটাই, মৃত্যু। . মাত্র তিনবছর বয়সে মোঙ্গল শিশুদের ঘোড়ার পিঠে বেঁধে ছেড়ে দেয়া হতো। তারপর ঘোড়াকে ছোটানো হত পূর্ন গতিতে। ছ'বছর বয়সে শিশুরা নিজেরাই হয়ে যেত পুরদস্তুর সওয়ার। দশ বছর বয়সে শিখে যেত তিরন্দাজি। যে পুরুষ ঘোড়ায় চড়তে জানত না, তির চালাতে জানত না মোঙ্গলদের সমাজে বেঁচে থাকা ছিলো অসম্ভব। মেয়েরাও সমান তালে ঘোড়া চালাতে জানত, জানত তির চালাতে। 'প্রতিটি মোঙ্গল পুরুষ তার জন���মানোর দিন থেকেই যোদ্ধা, আর মেয়েরা যুদ্ধের সহযোগী।' . মোঙ্গলদের ছিলো মোঙ্গল ঘোড়া, যারা ছিলো অল ওয়েদার ভেহিকলের মত। মাইনাস ফোর্টি ফাইভ ডিগ্রী থেকে প্লাস ফর্টি ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় অনায়াসেই চলতে পারতো এ ঘোড়াগুলো। এই জাদুকরী বাহনই মোঙ্গল সাম্রাজ্যকে নিয়ে গেছে এক অনন্য অবস্থানে। খুনোখুনি না করলে মোঙ্গলদের পেটের ভাত হজম হতো না। কোনো অভিযানে না থাকলে তারা নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনিতে লেগে যেতো৷ তাই চেঙ্গিজ খান কদিন পরপরই তার বাহিনীকে এদিক ওদিক অভিযানে পাঠিয়ে দিতেন। জিন সাম্রাজ্য জয়ের মাধ্যমেই মধ্য এশিয়াতে মোঙ্গলদের প্রবেশের শুরু হয়। . মুসলিম খলিফাদের শক্তিশালী নেতৃত্ব ছিলো প্রথম তিন শতাব্দী জুড়ে৷ আল মুতাসিমের মৃত্যুর পর তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একাদশ শতাব্দীতে এসে শিয়া সুন্নী সাম্রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায় মুসলিম উম্মাহ। পশ্চিমে মিসরভিত্তিক ফাতেমি খিলাফত ও পূর্বের ইরানভিত্তিক সেলজুক সালতানাত। দুই সাম্রাজ্যের বিরোধের জের ধরেই প্রথম ক্রুসেডে সফল হয়েছিলো খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা। ১১৮৭ সালে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি উদ্ধার করেন জেরুজালেম। তৃতীয় ক্রুসেডে লড়ার কদিন বাদেই সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রেখে যান একটি অগোছালো আইয়ুবি সালতানাত। তার ভাইয়েরা উত্তরসুরী হিসেবে তার কাছাকাছিও ছিলো না। আইয়ুবি সালতানাতের অন্তর্কোন্দলের মধ্যেই তৎকালীন পোপ আর হোলি রোমান ডাক দেয় পঞ্চম ক্রুসেডের৷ ১২১৬ সালে খলিফা আন নাসির সাহায্য চান অমুসলিম শাসকদের কাছে। যা পরবর্তী দশকগুলোতে কবরস্থান বানিয়ে ফেলেছিলো পুরো এশিয়াকে৷ সে ঝড়ের নাম তেংরি দেবতার পুজারী চেঙ্গিজ খান৷ চেঙ্গিজ খান তার জীবদ্দশায় যত মানুষ মেরেছেন তা ইতিহাসে আর কেউ করেছে বলে জানা যায় না৷ বুখারায় একটি জামে মসজিদে তৎকালীন সেরা সুন্দরীদের নিয়ে নাচ গানের আসর বসিয়েছিলেন চেঙ্গিজ খান। . বুখারার প্রতিটা মানুষকে প্রতারণার ভেলকি দিয়ে মাথা কামিয়ে জবাই করে ধ্বংস করে দেয়া হয়। কিছু কিছু অঞ্চলে বিদ্রোহ হবার সম্ভাবণা দেখা দিলে, সেখানে ইঁদুর বিড়াল সহ মেরে ফেলা হয়েছিলো চেঙ্গিজ খানের নেতৃত্বে। . চেঙ্গিজ খানের জীবনে একমাত্র পরাজয় ঘটে পারওয়ানে দুর্ধর্ষ মুসলিম যোদ্ধা জালাল উদ্দীনের কাছে। অথচ জালাল উদ্দীনের বাহিনীও টেকেনি অন্তর্কোন্দলে পড়ে। . ফারসি সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অমূল্য রত্ন বালখের পাঁচ লাখ অধিবাসীর প্রায় সব মানুষকেই মেরে ফেলেছিলেন চেঙ্গিজ খান। ধারণা করা হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বৃহত্তম শহর ছিলো, মার্ভ। যাকে বলা হতো দুনিয়ার বুকে বেহেশতের টুকরো। পৃথিবীর ইতিহাসে হওয়া ভয়ংকরতম গনহত্যাগুলোর একটার শিকার হয়েছিলো মার্ভ। . চেঙ্গিজ খানের বংশধরদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন, বারকি খান। যেখান থেকে শুরু হয় মোঙ্গল সাম্রাজ্যের মুসলমান শাসকদের বিস্তার। . এরপর আসে শিল্পী ও শিল্পের শহর নিশাপুর,দামেশক, ইরান প্রভৃতি অঞ্চলের ঘটনাবলী। যেখানে বেড়ে উঠছিলেন বিখ্যাত কবি জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ রুমি। রুমিকে বলা হয় ভালোবাসার কবি। তার একটা বিখ্যাত উদ্ধৃতি হচ্ছে - "There are many ways to find Allah. Amongst them, I have chosen love." আজ আটশো বছর পরেও রুমির কবিতা পড়া হয় ফারসি, তুর্কি,আরবি, উর্দু, স্প্যানিশ, জার্মান,ফ্রেঞ্চ ইংরেজি, রুশসহ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জনবহুল ভাষায়৷ ইউএস বিলবোর্ড টপচার্টের অলটাইম টপ টুয়েন্টিতে আছেন রুমি। গত বিশ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক পঠিত কবির নাম মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমি। তাঁর কথায়, 'If your thought is a rose, you are a rose garden,. If your thought is a thorn, you are fuel for the fire.' . বলা হয়, হলোকাস্টে ষাট লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিলো, অথচ কেবল নিশাপুর,হিরাত,বামিয়ান, মার্ভ, তিরমিজ আর বালখেই ষাট লাখের বেশি মুসলিমকে হত্যা করে চেঙ্গিজ খান। গোটা পৃথিবীর ০.৫% কে চেঙ্গিজ খানের বংশধর হিসেবে ধরা হয়। চেঙ্গিজ খানের উত্তরসুরী হালাকু খানের আমলে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক মুসলিম খলিফা আল মুস্তাসিমেকে হত্যা করা হয় বিপুল অর্থসম্পদসহ সোনার খাঁচায় বন্দী করে,যা মার্কোপোলো লিখেছিলেন। . বাগদাদ দখলের তিনদিনের মাথায় সোনার খাঁচায় ভরে রাখা খলিফাকে হালাকু খান জিজ্ঞেস করলেন, 'কি, ক্ষুধা পেয়েছে? ' খলিফা বললেন, 'হ্যাঁ, পেয়েছে ' হালাকু বললেন, তাহলে খাও। খলিফা বললেন, এখানে তো কোনো খাবার নেই। হালাকু বললেন, বছরের পর বছর যে সম্পদ জমিয়েছ তা খাও। তারপর গালিচায় মুড়িয়ে ঘোড়ার পায়ের নিচে পিষ্ট করে তাকে মারা হয়। . এরপরেই ধারাবাহিকভাবে উত্থান হতে থাকে মুসলিম বীর যোদ্ধাদের। পৃথিবীতে একটি ছোটো আমিরাত থেকে উঠে আসে একটি সালতানাত, অটোমান বা উসমানি সালতানাত। উসমান নামের গ্রিক উচ্চারণই অটোমান। . আমেরিকা আবিষ্কারের যে গল্প আমাদের শোনানো হয় তা মূলত আমেরিকা আবিষ্কারের প্রথম গল্প না৷ কলম্বাসের আগেও বহুবার দুঃসাহসী মানুষেরা আমেরিকায় গেছেন৷ নতুন পৃথিবী আবিষ্কারের এই রেসে সম্ভবত চাইনিজরাই এগিয়ে। ঝেং হো নামের একজন মুসলিমের কথা চাইনিজরা বলে থাকে, যদিও এর সরাসরি কোনো প্রমাণ মেলেনি। ৮৮৯ সালে মাসউদী লিখেছেন খাসখাস ইবনে সাইদ ইবনে আসওয়াদ সম্পর্কে, যিনি অসীম আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এনেছিলেন প্রচুর ধনসম্পদ৷ মালি সাম্রাজ্যের কথা অনেকেই পড়েছি। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সাম্রাজ্য ছিলো মালি সাম্রাজ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি বলা হয় মালি সাম্রাজ্যের সম্রাট মানসা মুসাকে। এরপরে অনেক মুসলিমই আমেরিকায় প্রবেশ করেন, কিন্তু সঠিক কোনো ম্যাপ প্রকাশ করে না যাওয়ায়, কলম্বাসের ঝুলিতেই জমা পড়ে আমেরিকা আবিষ্কারের কাহিনী।. গ্লোবালাইজেশনের যুগে এসে আবার অটোমান সালতানাতের পিছিয়ে পড়ার গল্প রয়েছে এখানে৷ . এখানে স্কিপ করা হয়েছে অটোমান সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ ঘটনা, যা এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তু। আর এই বিষয়বস্তুকে ঘাঁটতে যেয়েই লেখক প্রিন্স মুহাম্মদ সজল উপহার দিয়েছেন অনন্য এই বই। যার প্রথমাংশ ও শেষাংশের সামান্যতম অংশ আমি উল্লেখ করেছি। ইতিহাস সত্য৷ এসব ইতিহাসের অসংখ্য প্রমাণাদি রয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত সব জাদুঘরে। সুলতান উসমান থেকে শুরু করে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ অবধি গৌরবময় সময়ের যে উত্তেজনা, তা নিমিষেই ইতিহাসে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে দৃশ্যমান কোনো টাইম ট্রাভেলে করে৷ এই বইয়ের রেটিং দেয়ার দুঃসাহস আমার নেই৷ অত্যন্ত সংক্ষেপিত ইতিহাসের বইটাতে পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪৪০। আরো মোটা হতে পারতো বইটা। বোরিং সাল, নামধামে ভরা ইতিহাসের মত করে না লিখে ইতিহাসটাকে গল্পের মতই তুলে ধরেছেন লেখক। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা আরো দুশো কিংবা আরও চারশো হলেও বিরক্তি আসতো না একবারের জন্যেও। . আমি রিকমেন্ড করবো, এ টু জেড সকল পাঠকই এই বই পড়ে মজা পাবেন। ইতিহাস যখন গল্পের মত পাঁচমিশালী ছন্দে ভরপুর হয়, তখন এরমত সুখপাঠ্য আর কিছু হয় না... . রেটিংঃ ১০/১০। বইঃ সানজাক-ই-উসমান লেখকঃ প্রিন্স মুহাম্মদ সজল হার্ডকভার মলাটমূল্যঃ৫০০ পেপারব্যাক মলাটমূল্যঃ৪৪০ প্রকাশনীঃগার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স।
আল্লাহ পৃথিবীতে যখন মানুষ পাঠাতে চাইলেন তখন তিনি ফেরেশতাদের নিয়ে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করেছিলেন। তিনি ফেরেশতাদের বলেছিলেন আমি পৃথিবীতে ���ানুষ পাঠাতে চাই। তখন ফেরেশতারা আল্লাহকে বলেছিল, আপনি পৃথিবীতে এমন এক সম্প্রদায়কে পাঠাবেন যারা সব সময় রক্তপাতে লিপ্ত থাকবে? ফেরেশতারা মানব জাতি সম্পর্কে মাত্র একটি মন্তব্য-ই করেছিল তাহলো এরা এমন জাতি যারা সবসময় রক্তপারে লীপ্ত থাকে।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি পরতে পরতে তার প্রমাণ মেলে। পৃথিবী কখনো শান্ত থাকেনি। কালে কালে এসেছে কিছু রক্ত পীপাসু, ঘটিয়েছে ধ্বংসজঞ্জ, দুনিয়ার মানচিত্র নতুন করে আবার একেছে রক্তের দাগ দিয়ে। ক্ষমতার লড়াইয়ে কেউ কাউকে ছাড় দেয়নি। রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতা। মানব জাতি যেমন ভাংতে জানে তেমন গড়তে ও জানে, এই একমাত্র আশার বাণী।
পৃথিবীর অজানা অবহেলিত একপ্রান্তে মঙ্গোলিয়ার ক্ষুদ্র এক গোত্রে জন্মেছিল এক শিশু, নাম তার তেমুজিন (চেঙ্গিস খান)। কে জানত সেই ছোট্ট শিশুটি একদিন পৃথিবীর বুকে রক্তের বন্যা বইয়ে দিবে? পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে দিবে? সাজানো গোছানো কত শত শহর নগর ধূলোয় ধূসরিত করবে? অর্ধ পৃথিবী তার শ্বাসনভারে কাঁপবে?
কাহিনীর এখানেই শেষ নয় বরং কেবল শুরুর শেষ। এরপর এশিয়ার ক্ষুদ্র একটুকরো ভূখন্ড আনাতোলীয়া থেকে জন্ম নিবে পরবর্তী পৃথিবীর রাজাধীরাজদের সাম্রাজ্য, ওটোমান সাম্রাজ্য। চারপাশের ক্রিস্টান সাম্রাজ্যের কত শত কূট কৌশলকে ব্যার্থ প্রতিপন্ন করে তারা অর্ধ পৃথিবীতে চাঁদ তারা খচিত পতাকা উড়াবেই উড়াবে।
বইটি প্রচন্ড রকমের সুখ পাঠ্য। লেখকের প্রথম বই হিসেবে তা অবশ্যই চরম প্রশংসার দাবীদার। ইতিহাস প্রেমীদের তৃপ্তী মেটাতে বইটির কোন জুড়ী নেই।
বাংলা ভাষায় আমার পড়া অন্যতম সেরা একটি ইতিহাসের বই এটি। লেখক চিরাচরিত ইতিহাসের বই এর বাইরে গিয়ে ঔপন্যাসিক দৃস্টিভঙ্গিতে ইতিহাস কে এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যেন মনে হয় ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনেই ঘটে চলেছে। প্রত্যেকটি ঘটনার রেফারেন্স থেকে নিজের মতো করে সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করেছি এবং বারবারই মুগ্ধ হয়ে গেছি ঘটনাগুলোর ঐতিহাসিক তাৎপর্য দেখে। বইটিতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত আলোচনা করা হয়েছে। বইটির প্রথম ১০০-১৫০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মোঙ্গল দের বিস্তারিত ইতিহাস দেখে অনেকেই হতাশ হতে পারেন তবে এই অংশটুকু বইটির বাদবাকি অংশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কাজটা করে দিয়েছে। বইটিতে ফাতিহ সুলতান ২য় মোহাম্মদ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে যা সবসময়ই ইতিহাস প্রিয় পাঠকদের বিশেষ করে ইসলামিক ইতিহাস নিয়ে যাদের আগ্রহ রয়েছে তাদের জন্য একটি রত্নভান্ডার বলা যায়। এছাড়াও মোঙ্গল দের বিরুদ্ধে জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ এর প্রতিরোধ, মামলুক সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজ, রুকনুদ্দিন বাইবার্স, মানসুর কালাউন দের বিজয়ের ইতিহাস আপনাকে যেমন মুগ্ধ করবে তেমনি ভাবে বাগদাদ এ খিলাফতে আব্বাসিয়ার পতন, স্পেনের মুসলিম খিলাফত আল - আন্দালুস এর পতন ও রিকনকুইস্তার ঘটনাগুলো মনকে বিষাদে ভরিয়ে তুলবে।বইটিতে অনেক চিন্তার খোরাক পেয়েছি লেখক এর পরবর্তী বই গুলোর ব্যপারে আগ্রহী হয়ে অপেক্ষায় রইলাম। বইটি আপনাকে মুসলমান জাতির ইতিহাস নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করবে এতটুকু আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি। পরিশেষে সমস্ত প্রশংসা মহান রব্বুল আলামিনের যিনি আমাকে নতুন নতুন বিষয়ে অবগত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
অসাধারণ একটি বই শেষ করলাম। মোঙ্গলদের ভয়াবহ নৃশংসতা (যা গা শিউরে উঠার মতো) থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে উসমানি সালতানাতের দিকে নদীর জল গড়িয়ে গেছে। অটোমান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে ক্রুসেডসহ অন্যান্য যুদ্ধে তাদের সাহসীকতার পরিচয় সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পড়ার সময় লেখকের কথার সত্যতা টের পেয়েছি। তাই বলতেই হচ্ছে, 'এই টাইম ট্রাভেলে আপনি একই সাথে ইতিহাস, ফিকশন আর থ্রিলারের স্বাদ পানেন।' লেখায় যে একেবারে কোনো জড়তা ছিল না, তা বলব না। তবে তা যথেষ্টই ম্লান মনে হয়েছে আমার কাছে। আপনাকেও স্বাগতম এই চমৎকার টাইম ট্রাভেলে ;)
অটোমানদেরকে আমার গার্ডিয়ান অফ মুসলিম উম্মাহ (আফটার প্রফেট (স:)) বলেই মনে হয়। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সঃ) যাদেরকে নিয়ে ভবিষ্যৎবানী করে গেছেন : “মুসলিমরা একদা কনস্টানটিনোপল বিজয় করবে। তাদের সেই বিজয়ী কমান্ডার কতই না সৌভাগ্যবান। সেই বিজয়ী সেনাদল কতই বরকতময়।” তাঁদের নিয়ে প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা আমি দেখিনা।
আপনার যদি মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পড়েন, এটা একটা চমৎকার বই৷
কিন্ত নিরপেক্ষভাবে পড়তে গেলে বিরক্ত লাগতেই পারে। মুসলিম হিসাবে আমাদের দৃষ্টিতে যিনি বীর যোদ্ধা কিংবা শহিদ, অন্য দৃষ্টিতে তাকে আর দশজনের মতই ধরা হবে, স্বাভাবিক।