‘আমার ছেলেবেলা’, ‘আমার যৌবন’ ও ‘আমাদের কবিতাভবন’—বুদ্ধদেবের এই তিনটি আত্মস্মৃতিমূলক রচনা একত্র করে প্রকাশিত হয়েছে এ বইটি।
সংকলিত রচনা তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে। অপর রচনাটি শেষ করার আগেই বুদ্ধদেব মৃত্যুবরণ করেন, ফলে সেটি তাঁর আত্মজীবনীর অসমাপ্ত অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। সেই অসমাপ্ত অংশে নতুন কিছু কথা সংযোজন করেছেন বুদ্ধদেবের মেয়ে দময়ন্তী বসু সিং।
Buddhadeva Bose (also spelt Buddhadeb Bosu) (Bengali: বুদ্ধদেব বসু) was a major Bengali writer of the 20th century. Frequently referred to as a poet, he was a versatile writer who wrote novels, short stories, plays and essays in addition to poetry. He was an influential critic and editor of his time. He is recognized as one of the five poets who moved to introduce modernity into Bengali poetry. It has been said that since Tagore, perhaps, there has been no greater talent in Bengali literature. His wife Protiva Bose was also a writer.
Buddhadeva Bose received the Sahitya Akademi Award in 1967 for his verse play Tapaswi O Tarangini, received the Rabindra Puraskar in 1974 for Swagato Biday(poetry) and was honoured with a Padma Bhushan in 1970.
বেশ কিছুদিন ধরেই বুদ্ধদেবের আমার ছেলেবেলা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। ক’দিন আগে বাতিঘরে দেশ-সমাজ উদ্ধার করতে গিয়ে দেখি, ঝকঝকে প্রচ্ছদে ছাপা আত্মজীবনী—ভেতরে আমার ছেলেবেলা, আমার যৌবন, আমাদের কবিতাভবন—তিনটাই এক মলাটে বেঁধেছেঁদে বের করা হয়েছে, এই এপ্রিলেই!
বই তিনটার প্রেক্ষাপট আমি জানতাম না, জানলাম দময়ন্তী বসুর লেখা প্রাককথন থেকে। তাঁর ভাষ্যমতে, স্ত্রীর চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের জন্য জীবনের শেষ দিকে এসে বুদ্ধদেব দু হাতে কেবলই লিখে গেছেন। এমন সময় দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের অনুরোধে আত্মজীবনী লেখায় হাত দেন। ১৯৭২-এ বের হই প্রথম বইটা, পরের বছর দ্বিতীয়টা, এবং তারও পরের বছর হয়তো তৃতীয়টা বের হত, বুদ্ধদেব বেঁচে থাকলে।
আমার মতে, এ বইগুলো অসাধারণ একটা রেফারেন্স—বুদ্ধদেবের জীবনের চেয়েও—সে সময়টুকুর দলিল হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকের ছাত্র ছিলেন বুদ্ধদেব, এবং সে সময়ের বর্ণনা পড়লে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়! চা খেতে খেতে তিনি পরীক্ষার খাতায় লিখে যাচ্ছেন, মাঝে আবার খানিক বেরিয়ে একটু সিগারেটও টেনে আসছেন—কী সর্বনাশ!
কেবল ঢাকা, কলকাতা, দুই শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্ণনাময়তার জন্যেই না, বইটা ভালো লাগবে মানব-চরিত্রগুলোর জন্যেও। নজরুলের গান রচনার বিধ্বংসী বর্ণনা, দাঁত-ব্যথার অজুহাতে জীবনানন্দের প্রস্থান, প্রেমেন-অচিন্ত্য-বুদ্ধর কল্লোল ট্রায়ো, এবং অবশ্যই, বুদ্ধদেবকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি—সবকিছুই।
কিন্তু…এ বইটা ‘লেখক বুদ্ধদেবের’ আত্মজীবনী, কাজেই পারিবারিক জীবন বা অন্য কিছুই এখানে আসেনি। কেবল সাহিত্য-জীবনের যাত্রার কথা বলতে গিয়ে যেসব প্রসঙ্গ আনা দরকার ছিল—বুদ্ধদেব ওটুকুই এনেছেন। অবশ্য, ঢাকার বুদ্ধদেব বসু বইতে সৈয়দ আবুল মকসুদ দাবি করেছেন—বুদ্ধদেব ওটুকুও আনেননি। ঠিক মনে পড়ে না, ‘প্রগতি’ প্রকাশের সময়েই সম্ভবত, বুদ্ধদেব যখন অর্থকষ্টে পড়েন তখন তাঁর বাবা নাকি নিজে একটা বড় অংকের টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। সারা বইয়ে কোথাও এর উল্লেখ নেই। আবুল মকসুদের দাবি সত্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যদিও বুদ্ধদেবের এ আচরণের কারণ ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আমার নেই।
যেটা ব্যাখ্যা করতে পারি সেটা হল, কেন যেই বইটা শুরুতে এত অসাধারণ—সেটা শেষদিকে এসে এতখানি একঘেঁয়ে হয়ে গেল। দময়ন্তী বসুর বলেছেন, বুদ্ধদেবের খুব একটা ইচ্ছে ছিল না আত্মজীবনী লেখার, স্ত্রীর চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের জন্য বোধ করি তিনি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনেকখানি লিখতে শুরু করেছিলেন। আমাদের কবিতাভবন-এ এসে সেই লেখায় খাপছাড়া হয়ে গেছে, কেবল একের পর এক কিছু চরিত্রের নাম করে তাদের সম্পর্কে খানিকটা কথা বলা হয়েছে কেবল। কে জানে, হয়তো বেঁচে থাকলে বুদ্ধদেব সম্পাদনা করে লেখাটার কোনো গতি করতেন। প্রিয় লেখকের অসমাপ্ত লেখার সাথে ‘হয়তো’ আর ‘ইশ’ শব্দ দুটো চিরকালই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে।
দময়ন্তী বসুর সংযোজন করা অংশটুকুর প্রয়োজন ছিল বটে, কিন্তু তাঁর লেখনী বিশেষ ভালো লাগেনি। বাবার প্রতি ভালোবাসা সুন্দর হলেও, অন্ধ ভালোবাসা খুব একটা ভালো কিছু না। সুকুমার সমগ্রে সত্যজিৎ রায় যে ভূমিকা লিখেছিলেন—তা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম, কিন্তু এ বইতে এসে বুদ্ধদেব-বিরোধীদের প্রতি দময়ন্তী বসুর উষ্মা প্রকাশের ধরন দেখে হতাশ লাগলো। এভাবে অর্থহীন ফেসবুক-স্ট্যাটাস দেয়া যায়, বুদ্ধদেবের বইয়ে সংযোজন করা যায় না।
যাই হোক। আমার ছেলেবেলা এবং আমার যৌবন-কে আমি বুদ্ধদেবের শক্তিশালী সাহিত্যপ্রতিভার একটা উদাহরণ হিসেবে দেখছি। আমাদের কবিতাভবন-কে দেখছি অসমাপ্তের পাশাপাশি অসম্পাদিত এক লেখা হিসেবেই—কারণ এ বই সরাসরি বুদ্ধদেব ছাপিয়ে দিতেন—এটা আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না।
এবং অপ্রসঙ্গত, বাতিঘরের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বইটাকে চমৎকার চেহারা দিয়ে প্রকাশ করার জন্য। নীলক্ষেত-প্রিন্টে এ বইগুলো বের করার হলে সেটা হত বুদ্ধদেবের, এবং নিজেদেরও অপমান।
এ বইটা বাংলা ভাষায় একটা উজ্জ্বল সংযোজন, যেহেতু হাতখানা বুদ্ধবেদের আর নাক খানাও তারই! আর তাই অক্ষরে অক্ষরে হোঁচট খেতে খেতে মনে হতে থাকে বাংলা ভাষায় এতো সুন্দর সুন্দর শব্দ আছে, আমাদের জানাই হয় না। এক একটা বাক্য গঠিত হয়েছে বেশ অনেক গুলো শব্দ নিয়ে, অনেক গুলো কমা সেমিকোলন এর সমন্বয়ে যে সকল বাক্যের শেষে এসে আবার ইচ্ছে করে, এ ভ্রমণ পুনরায় হোক তবে! বহুদিন পরে, একটা বই এ মূক হতে পেরেছি, ভেবেছি, আর মুরগীর তরকারীর নিচে উচ্চ তাপে পরে পুড়ে গেছে যে মশলা, তার গন্ধ নাকে আসার পরে মনে হয়েছে, আহহ খেয়াল ছিলো না! তা আমাকে এতোটা বেখেয়ালী করেন যে কবি, তিনি কবিতার কথা শোনান, শোনান লেখক কবিদের কথা, আর তার নিজের কথার ফাকে ফাকে, যা কিছুতে আমার রাগ ধরে যায় তাইতে ইচ্ছে মতন আমি দু হাত নেবো ভেবে, পরের পাতাতে মগ্ন হই! *বই বৃত্তান্ত* বুদ্ধদেব বসু- আত্মজৈবনিক। প্রকাশক - বাতিঘর গায়ের মুল্য- ৪৫০ টাকা।
কবিরা সময় শিকারী, ঘাই খেয়ে খেয়ে তারা হুট করে কোন এক অতল জলে ডুবে, ভেসে আমাদেরও তাই দশা করিয়ে নিয়ে চলেন সেই অদুরে। এতো বড় দাঘা দিল গণিত যারে, আমরা গুটি গুটি পায়ে, কবির সাথে করে, তার ছেলে বেলা ঘুরে এসে, যৎসামান্য যা কিছু পাই, তা খাবার হলে অমৃত সমান, বস্তু হলে হীরে সমো! নোয়াখালী বিভাগ চাওয়ার আন্দোলের ঠিক আগের দশকের অবহেলীত নোয়াখালীর গল্প! ঢাকার সেই আবছায়া আধো আধো মায়া মায়া বিশ্বাস হতে না চাওয়া পথের, দ্বারের, গাছের, আর নানান গল্পের পিছনের গল্প নিয়ে কবি যখন হুট করে বলেন এই শেষ হলো ছেলেবেলা, তার কিছু কিছু আগে, একটা লাইন। "অমাবস্যা পূর্ণিমার পরিণয়ে আমি পুরোহীত।" কবি কন্ঠের স্বীকারুক্তিতে এই তার প্রথম কবিতার লাইন, যা কবিতা হয়ে উঠতে পেরেছে, কিন্তু তারও আগে, বহু আগে যখন কবি ৭ কিংবা তার থেকেও কম তখন থেকেই কাব্য প্রতিমা তার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়েছেন! কিন্তু এই ১৭/১৮ ছুবার পরেই তার মনে হয়েছে এই প্রথম লাইনে তিনি নিজেকে কবি বলে স্বীকার করাতে করতে পারেন! সুতরাং এই যে ৭২ পৃষ্টা আমরা পড়ে এসেছি তার আগে, তা হলো কবির ছেলে বেলা, সেখানে যা কিছু সকলই ছেলেখেলা! কিন্তু, "ইসাসনে শুষ্যত মে শরীরং" বলে মাত্র এক খানা লাইন, যে বালকের চোখে লেগে থাকে, যে অর্থ উদ্ধার করে এই সংস্কৃতের আর জেনেছে " এই আসনে এই শরীর শুষ্ক হবে, ধ্বংস হবে ত্বক, অস্তি, মাংস (যতদিন) বহুকল্প দুর্লভ জ্ঞান অপ্রাপ্ত থাকবে (ততদিন)। এই আসন থেকে এই দেহ সঞ্চালিত হবে না। বোধিবৃক্ষের তলায় তপস্যায় বসার পূর্বে এই শ্লোকটি বলেছিলেন শাক্য মুনী! মুনীবর তার জন্য তো বলে কাল পাড় করেই দিয়েছিলেন, কিন্তু বহুকাল পরে এই কথা আরেক বালকের বুকে গেঁথে গেলে তিনিও এই জ্ঞান সাধনে, কবিতা দেবীর পুজোতেই বাকি জীবন উৎসর্গ করে দিলেন। আমরা দেখি ইংরেজী সাহিত্য অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করেও কবি একেবারে সমাজের হাই ক্লাস চাকুরী, দশটা পাচটার জীবনকে বেশ কষে লাথি মেরে যাকে অতি আগ্রহে পুজো দেন সেই কবি, কবির কল্লোল, সেখানে নজরুল আসেন রবীন্দ্রনাথের কথা আসে, আর এই যে আমরা কাক হবো বলে অপেক্ষায় থাকি যার কথায় সেই জীবনানন্দ! অতি অল্প কথা জীবনানন্দকে নিয়ে, এই অতি অল্প কথাকেই পুঁজি করে যে কেউ না দেখা জীবনান্দের একটা স্কেচ ���রে ফেলতে পারবে অনায়াসে। অনবরত আমরা টের পাই এক বিদ্রোহ, হাল আমলে অনেককেই বলতে দেখি সে বিদ্রোহ ছিলো কবি গুরুর বিরুদ্ধে, কিন্তু তীব্র রকমের শ্রদ্ধা মনের মাঝে রেখে বুদ্ধদেব রবি ঠাকুরকে আরো আরো উঁচু দেখতে চেয়েছেন, চেয়েছেন রবির কোন কিছুতেই সামান্য একটু দাগ না লাগুক তার সতন্ত্রতার সাথে করে নতুন কিছু আসুক, নতুন কবিতা নির্মাণে যারা যারা কুশীলব হয়ে তখন এসেছেন, বিষ্ণু দে, অমীয় চক্রবর্তী এদের সকলের এক সুনীপন চালচিত্র অতি অল্প কথায় আমরা পাই। একেবারে শেষের অংশে এসে আমাদের কবিতা ভবনের কথা, কত কথা সেখানে। এক বৈঠকে এই বই পড়তে নিলে যে কারো বদহজম হয়ে যাবে। সুতরাং সেই যে পুড়েছে মুরগী প্রথমে, তা দিয়েই আপনি কোন রকমে আজকে রাত্রের খাবার খেয়ে নিয়ে আবার বসবেন, তীক্ষ চোখে আবার খোজবেন আর কেউ ? আর কারো ? রবি বুড়োর আর কোন চিঠি? আর কোন খুত, ছোট করে বুঝিবা আবার জীবনানন্দ! এইসব খোঁজতে খোঁজতে আপনার হাল আমলের ঘড়িতে হয়তোবা বারো বাজবে, ঢং ঢং, মা ডাকবেন, বউ বকবেন, আপনি ঘুমোতে যাবেন। কিন্তু এক সুখ সুখ ব্যাথা বুকের মাঝে নিয়ে ভাববেন আর কেউ এমন করে আগলে রাখতে আসেনি, আসবে না, আসছে না। আমাদের কবিতা দেবীও কাঁদছেন। যারা চলে যাবার তারা চলে গেছেন, কেউ কেউ থেকেছেন, ফিরে ফিরে আসবেন বলে।
রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে গিয়ে যে পাঁচজন সাহিত্যিক সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু অন্যতম। বর্ণিল সাহিত্যিক জীবনে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধসহ নানাবিধ রচনা উপহার দিয়েছেন পাঠককে। 'আত্মজৈবনিক' রচনায় লেখকের শৈশব, যৌবন এবং যৌবন পরবর্তী সাহিত্যচর্চার ফিরিস্তি প্রদান করেছেন। বইটিকে সহজ অর্থে আত্মজীবনী বলার চাইতে বাংলা সাহিত্যের কয়েক যুগের ইতিহাস বলা যেতে পারে।
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম কুমিল্লায়। পিতা ছিলেন উকিল এবং পৈতৃক নিবাস বিক্রমপুরে। জন্মের পরপরই ধনুষ্টংকার রোগে মা মারা যাওয়ায় পিতা গৃহত্যাগী হন। এরপর বুদ্ধদেব বসুর দায়িত্ব গিয়ে বর্তায় মাতামহের উপর। কুমিল্লা থেকে চলে যান নোয়াখালিতে। শৈশবের পুরো সময়টাই কাটে মেঘনা নদীর কোলে গড়ে উঠা শহরে। তবে লেখকের দৃষ্টিতে নোয়াখালির মেঘনা অন্যতম হতশ্রী নদী ছিল। মেঘনা নদীর ভাঙনে একসময় শহরের অনেক অংশই তলিয়ে যায়, যা অবলোকন করে ব্যথিত হয়েছেন লেখক। চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়ে প্রথম প্রেমে পড়া, দাদামশায়ের নিকট ইংরেজির পাঠ নেওয়া, সাহিত্যের সাথে পরিচিতি, কবিতা লেখা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের স্মৃতিচারণ উঠে এসেছে 'আমার ছেলেবেলা' অংশে।
ঢাকা কলিজিয়েট স্কুল থেকে পঞ্চম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আইএ পাস করার পর ১৯৩০ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স পড়তে। ততদিনে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা বের হয়ে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর সাহিত্য রচনার দ্বার যেন আরো ভালোভাবে উন্মোচিত হলো। বন্ধু-বান্ধবের সাথে সাহিত্য আড্ডা, সভা-সেমিনার, কাজী নজরুল ইসলামকে অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে কবিতা পাঠ করে সময় ভালোই কাটছিল। এমনকি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে জয়ীও হয়েছিলেন। লেখকের বর্ননায় ঢাকাকে যেন নতুন করে দেখতে পেলাম। কী অসাধারণ সব বর্ননার ভাষা! তবে একসময় ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় স্থায়ী হন বুদ্ধদেব বসু। সেখানেই বিয়ে করেন ঢাকার মেয়ে রাণু সোমকে। যার সাথে পরিচয় হয়েছিল গান রেকর্ডিং এর মাধ্যমে। অধ্যাপনার বিরাট একটা সময় কাটিয়েছেন রিপন কলেজে, পাশাপাশি ক্ষুরধার কলমও চলেছে। যৌবনের পাঠ চুকিয়ে প্রৌঢ়ত্বের স্বাদ যখন গ্রহণ করলেন তখন তিনি নন্দিত এবং নিন্দিত উভয়ই। অশ্লীলতার দায়ে যখন বই নিষিদ্ধ হলো, বই প্রকাশের জন্য প্রকাশক পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন নিজেই প্রকাশক হয়ে বই প্রকাশ করেছেন। তাতে জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকুও।
বইটির ভাষা একটু কঠিন মনে হতে পারে। কারণ ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ কিংবা যৌবনের বর্ননায় লেখক শুধু সাহিত্যকেই প্রাধান্য দিয়েছেন কঠিন শব্দচয়নে। তবুও বইটি অসাধারণ। মিশে গেছে এপার-ওপার বাংলার সাহিত্য দর্শন। নিছক আত্মজীবনী নয়, বরং একটি যুগের অসামান্য জীবন্ত ছবি। হ্যাপি রিডিং।
বছরের ৫২তম বই পড়ে শেষ করে উঠলাম মাত্র। পড়েছি বুদ্ধদেব বসুর আত্মজৈবনিক। এক মলাটের ভেতর তিন খন্ডের এই চমৎকার আত্মজীবনীমূলক বই। যদিও এই তিন খন্ডই আলাদা ভাবে প্রকাশ পেয়েছিলো ভারতে। কিন্তু বাংলাদেশে বাতিঘর তিন খন্ডই এক মলাটের ভেতর বন্দী করে বেশ কাজের কাজ করেছে।
লেখকের জীবদ্দশায় শেষের দিকের লেখা ছিলো। অসুস্থতার মাঝে লেখার কারণে লেখার পরিসর বেশ কম ছিলো। লেখাগুলো বিচ্ছিন্ন ছিলো। কিন্তু চমৎকার লেখনীশৈলীর কারনে সব মিলিয়ে পড়ে ভালো লেগেছে। এমনিও আত্মজীবনীমূলক লেখা সব সময়ই ভালো লাগে। আর সেটা পছন্দের লেখক হলে তো কথাই নেই।
বইয়ের প্রথম খন্ডে এসেছে লেখকের ছেলেবেলার কথন। লিখেছেন উনার শৈশব, পরিবার, কুমিল্লায় ছেলেবেলার স্মৃতি, ঢাকায় কৈশোরে চলে আসা, বই পড়ার গল্প, লেখালেখি শুরু করার গল্প ইত্যাদি।
দ্বিতীয় খন্ডে পেলাম লেখকের যৌবনকালের আখ্যান। লেখকের ঢাকার জীবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ের কথাগুলো পড়তে বেশি ভালো লেগেছে। কোলকাতা বাসের সময়গুলোর বিবরণও ছিলো বেশ।
তৃতীয় খন্ডের নাম 'আমাদের কবিতাভবন' রাখা হলেও আদতে শুধু কবিতার কথাই উঠে আসেনি। বরং যৌবনে উপনীত হবার পর লেখকের সামগ্রিক লেখার কথাই এসেছে। যদিও এই খন্ডে লেখার ব্যপ্তী আরো হতো। কিন্তু লেখকের অকাল প্রয়াণে লেখাটি অসমাপ্ত থেকে যায়। যদিও লেখকের কন্যা দময়ন্তী বসু সিং এর কিঞ্চিৎ সংযোজনে লেখার শেষাংশে বেশ প্রাণ পাওয়া যায়।
আফসোস লাগে বুদ্ধদেব বসু উনার আত্মজীবনী আগে কেন লিখতে বসলেন না! তাহলে আরো অনেক কিছু উঠে আসতে পারতো উনার আত্মজীবনীতে।
এক নজরে: বইয়ের নাম: আত্মজৈবনিক লেখক: বুদ্ধদেব বসু প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা প্রকাশনী: বাতিঘর চট্টগ্রাম মূদ্রিত মূল্য: ৫০০ টাকা
‘আমার ছেলেবেলা’, ‘আমার যৌবন’ ও ‘আমাদের কবিতাভবন’ বুদ্ধদেব বসুর এই তিনটি স্মৃতিচারণামূলক লেখা নিয়ে এই বইটি প্রকাশ করেছিল বাতিঘর। তবে লেখা তিনটিই বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন জীবনের শেষ দিকে দেশ পত্রিকায় এগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও ‘আমাদের কবিতাভবন’ লেখাটি তিনি সম্পূর্ণ লিখে যেতে পারেন নি। এটিই বুদ্ধদেব বসুর সর্বশেষ লেখা।
মূলত কবি হলেও বুদ্ধদেব বসুর পরিচয় শুধু এখানেই থেমে থাকে না। একই সাথে তিনি গল্পকার, উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক এবং প্রকাশক। রবীন্দ্রনাথের ধারার বাইরে যারা বাংলা কবিতার ভিন্ন একটি ধারার সূচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন বুদ্ধদেব বসু। কল্লোল গোষ্ঠীর তিনিও অন্যতম, অন্যদিকে নিজেও বের করেছিলেন অজিত দত্তের সাথে ঢাকা থেকে প্রগতি পত্রিকা। পত্রিকাটি প্রথমে ছিল হাতে লেখা, তবে বুদ্ধদেব বসু ইন্টারমিডিয়েট পরীক্��ায় দ্বিতীয় হবার পর যে স্কলারশীপ পেয়েছিলেন সেই টাকায় ছাপার কাগজে বের করা শুরু করেছিলেন তাদের পত্রিকাটি। সেই পত্রিকায় লিখেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং তৎকালীন সময়ে প্রবলভাবে সমালোচিত গন্ডার কবি নামে অভিহিত জীবনানন্দ দাশসহ অনেকেই। বুদ্ধদেব বসু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকের ছাত্র। ছাত্র জীবন শেষে পাড়ি দিয়েছিলেন তখনকার বাংলার এবং সাহিত্যেরও রাজধানী কলকাতায়। এক পর্যায়ে বের করেছিলেন শুধু কবিতা নিয়ে ম্যাগাজিন ‘কবিতা’ এবং এক পয়সায় একটি সিরিজ ও নানা ধরনের বই ও বার্ষিকী। তবে সেসব পরের কথা।
জন্ম তার কুমিল্লায়। জন্মের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই তার মা মারা যান। বুদ্ধদেব বসু বড় হয়েছেন তার মাতামহ আর মাতামহীর কাছে সন্তানবৎ স্নেহে। তার জন্মদাতা বাবা আবার বিয়ে করেছিলেন এবং সম্ভবত ঢাকাতেই থাকতেন যা বিস্তারিত কোথাও তিনি না লিখলেও উল্লেখ পাওয়া যায় বইটির কয়েকটি জায়গায়। নিরীহ দারোগা মাতামহ ও মাতামহীর অভিভাবকত্বেই তিনি বড় হয়েছেন নোয়াখালী শহরে। সেই শহরের বর্ণনা আছে ‘আমার ছেলেবেলা’ পর্বে। সেই শহরটিও অবশ্য ভৌগলিকভাবে আগের জায়গায় নেই। মেঘনার ভাঙন কেড়ে নিয়েছে সেই শহরটিকে। সেই শহরের একটি সাহিত্যপাগল তোতলা কিশোর কি করে ধীরে ধীরে একজন কবি হয়ে উঠলো সেই বর্ণনা রয়েছে এই পর্বটিতে। সাথে আছে বৃহত্তর ঢাকা জেলার গ্রামের বাড়ির এবং চট্টগ্রামের কিছু স্মৃতি। একজন কিশোর কবির দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে এবং তার পরিবারের সাথে পরিচিত হবার স্মৃতিও।
কলেজ জীবন থেকে অবশ্য শুরু ঢাকায় থাকা। এই পর্যায়েই বুদ্ধদেব বসুর মাতামহেরও মৃত্যু হয়। দিদিমা ও এক বৃদ্ধা আত্মীয়াকে নিয়ে পুরানা পল্টনে নিজেদের জায়গায় কোনমতে তৈরি করা বাসায় উঠে আসেন বুদ্ধদেব বসু। তখন পুরানা পল্টন ছিল ঢাকা শহরের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে। সদ্য লোকবসতি তৈরি হচ্ছে সেখানে, আগে সেখানে ছিল সেগুন বাগান, কিছু লোক তখনও তাকে সেই নামেই চেনে। এসব গত শতকের বিশের দশকের ঘটনা। বুদ্ধদেব বসু তখন পড়ছেন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। অজিত দত্তের সাথে হাতে লেখা পত্রিকা বের করছেন। পরিচিত হয়ে উঠছেন কবি হিসেবে, হয়ে উঠছেন কল্লোল গোষ্ঠীর একজন যারা তখন তুমুল আলোচিত এবং সমালোচিত। তারপর ঢাকা ইউনিভার্সিটির শুরুর দিকের ছাত্র হিসেবে ইংরেজি বিভাগে অধ্যয়নের সময়কালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা, সদরঘাট এবং ঢাকা শহরের নানা টুকরো এবং মনোজ্ঞ বর্ণনা আছে ‘আমার যৌবন’ অংশটিতে আর অবশ্যই আছে পুরানা পল্টনের কথা। এ স্মৃতিকথা বিশ শতকের বিশ দশকের মফস্বল শহর ঢাকার, যার একমাত্র ট্রাফিক কন্ট্রোল ছিল তখনের শহরের কেন্দ্রস্থল সদরঘাটে। বিকেলে গোটা শহরের মানুষ হাওয়া খেতে যেত সেখানে, রমনা তখন নির্জন সবুজ এক স্থান, পুরানা পল্টন তখনও বিদ্যুৎহীন। সেই ঢাকা শহরও এখন আর কোথাও খুঁজে যাওয়া যাবে না পুরোনো নামগুলোতে ছাড়া কোথাও। সেই ঢাকা ছাড়লেন বুদ্ধদেব বসু। কলকাতায় গিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া কল্লোল গোষ্ঠীর সাথে সাহিত্য রচনা আর টিউশনি সম্বল করেই জীবিকা নির্বাহ শুরু করলেন। তিন তিনবার চেষ্টা করে শিক্ষকতা জুটলো অবশেষে রিপন কলেজে। ততোদিনে বুদ্ধদেব বসু প্রেম এবং পরিণয় সুত্রে আবদ্ধ হয়েছেন ঢাকারই মেয়ে রাণু সোম এর সাথে, যার ভালো নাম প্রতিভা বিয়ের পরে প্রতিভা বসু। দুজনেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা মানুষ হলেও ভালোবাসা হলো কলকাতা শহরেই, পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে বারবার দেখা হতে হতে এবং ক্রমাগত পত্রালাপে। তারপর সংসার উঠে এলো একসময় ২০২ এর বাড়িতে এ যার নাম বুদ্ধদেব বসু দিয়েছিলেন কবিতা ভবন। কবিতা পত্রিকার জন্ম, কতো বইয়ের প্রকাশ, কত সাহিত্যের আড্ডা, কত নাটকের অভিনয় এবং মঞ্চায়ন এই ২০২ এ। প্রায় তিন দশক কাটানো এই ২০২ বা কবিতাভবন নিয়েই হয়তো বুদ্ধদেব তার জীবনীগ্রন্থের বা স্মৃতিচারণার বড় অংশটা লিখতেন, লিখতে শুরুও করেছিলেন কিন্তু তা আর শেষ হয়ে ওঠে নি তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে। কবির কণিষ্ঠা কন্যা দয়মন্তী বসু সিং স্থানে স্থানে সংযোজন ও টীকার ব্যবহার করে সেই লেখার ফাঁকটুকু ভরতে চেয়েছেন তবু তা আসলে হবার নয়। এই পর্যায়ের স্মৃতিচারণায় রবীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ, হুমায়ন কবীর, প্রমথ চৌধুরীসহ অনেকের কথাই এসেছে এবং নিশ্চয়ই আরও অনেকের কথাই বলার ছিল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সমকালীন রাজনীতি নিয়ে বুদ্ধদেব বসু কখনোই আগ্রহী ছিলেন না। তার লেখাতেও যতটা সাহিত্য, পত্রিকা ও প্রকাশনার কথার উল্লেখ আছে সমকালীন আর্ন্তজাতিক বা রাষ্ট্রীয় উল্লেখযাগ্য ঘটনার কথা সেভাবে নেই। হয়তো এসব নিয়ে তিনি লিখতে আগ্রহী ছিলেন না বলেই এমন ঘটনার উল্লেখ নেই, বা এসব নিয়ে তিনি ছিলেন উদাসীন। শেষটা পড়তে গিয়ে আক্ষেপ জাগে বুদ্ধদেব বসু তাঁর লেখা শেষ করে যেতে পারলেন না কেন। তবু যতটুকু লিখেছেন, লিখে গেছেন তার স্বভাবজাত স্বাদু গদ্যে তা উপভোগ্য এবং তথ্যবহুল। পুরোনো কথা যারা পড়তে ভালোবাসেন, বাংলা সাহিত্য নিয়ে যারা পড়তে আগ্রহী কিংবা বুদ্ধদেব বসুর লেখার যারা ভক্ত কিংবা ভক্ত নন তাদের সবারই ভালো লাগার কথা অম্লমধুর এই স্মৃতিচারণা সংগ্রহটি।
প্রথমটায় বুদ্ধদেব বসুর নোয়াখালী । বিংশ শতাব্দীর গোরার দিকটায় বাংলার এই অংশে কাটানো ছেলে বেলা । প্রকৃতি আর সমাজ সব দিকটার ছবি এঁকেছেন স্বভাব সুলভ মায়ায় । ছেলেবেলা থেকে বই, কবিতা, পত্রিকার প্রতি তার যে ভালবাসা তার পড়ে মনের ভেতরে এক অদ্ভুত ওম তৈরি করে । তারপর বুদ্ধদেবের পুরানা পল্টন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর উদ্যান শহর ঢাকা । সেই ঢাকারই এক ঠাস বুনট কংক্রিটের ঘরে বসে পড়তে পড়তে ভিন্ন এক কারণে বুকটা ভারি হয়ে আসে । কবিতার ভালবাসায় ধীরে ধীরে ডুবে যাওয়া এক যুবকের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে ঢাকা । তারপর কলকাতায় হিযরতের পর শুধু কবিতা আর কবিতা ভবন । বাংলা কবিতার বেড়ে ওঠা আর কালের সাক্ষী “আমাদের কবিতাভবন” । যদিও এই অংশের ব্যাপৃতি সুদীর্ঘ । কিন্তু তাকে অসম্পূর্ণ রেখেই চলে যেতে হয় বুদ্ধদেবকে । অনবদ্য লিখিত গদ্যে বিগত শতকের বুদ্ধদেবকে মনে হয় খুব কাছের কেউ ।
ঠিক ঠিক এক বছর আগে বুদ্ধদেব বসুর কালের পুতুল পড়ার মাধ্যমে সাহিত্যের এক ভিন্নধর্মী জনরার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। এক বছর পরে এসে বুদ্ধদেব বসুর দ্বিতীয় বইটা হাতে তুলে নিলাম। তাঁর লেখা আত্মজীবনী। আত্মজীবনী পড়তে বেশ লাগে। এর মাধ্যমে লেখকের চিন্তার জগৎ ঘুরে দেখার দুর্লভ সুযোগলাভ করা যায়। সেইসাথে অবশ্যম্ভাবীভাবে আরও কিছু কীর্তিমানের সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়ে যায়।
দেশ পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে লেখক আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেন। যদিও আত্মজীবনীর মত গুরুত্বপূর্ণ লেখা লেখক তাড়াহুড়ো করে লিখতে চাননি। কিন্তু সেই সময়ে তাঁর স্ত্রীর আকস্মিক শারীরিক বৈকল্যের দরুন চিকিৎসার জন্য আরও অর্থ প্রয়োজন। কাজেই লেখক কাউকে ফেরাতেন না। লিখতে শুরু করলেন আত্মজীবনীর প্রথম খন্ড 'আমার ছেলেবেলা'।
আমার ছেলেবেলায় বাংলাদেশের অনেকগুলো অঞ্চল বিশেষত কুমিল্লা, নোয়াখালীর কথা তুলে ধরেছেন। লেখকের জন্ম হয়েছিল কুমিল্লায়। জন্মেই মাতৃহারা হয়েছিলেন তিনি। আর এই শোকে তাঁর পিতা বছর খানেকের জন্য এক প্রকার সন্যাসী-ই হয়ে গিয়েছিলেন। কাজেই লেখক নানা-নানুর কাছেই মানুষ। লেখকের ছেলেবেলা কেটেছিল "ক্ষুদ্র এক মফস্বল শহর, নোয়াখালী"-তে। তখনকার সেই ক্ষুদ্র শহর এখন আস্ত এক জেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। তবে সাগরের এত কাছে থেকেও কেন জানি নোয়াখালী অতটা মর্যাদাও পায়নি- লেখকের এই মন্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত। এই নোয়াখালীর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে মেঘনা নদী- যে নদীকে নিয়েই ছোটবেলায় প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন তিনি।
যৌবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ইংরেজিতে অনার্সে। লেখকের স্মৃতিচারণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয���ের নানান দিক এবং সেইসাথে রমনা, পুরানা পল্টন, ওয়াড়ি ও এর আশেপাশের এলাকার কথা বারবারই এসেছে। এখানেই তিনি নজরুলকে প্রথমবার দেখেন। জীবনানন্দকেও লেখক ঢাকায় প্রথমবার দেখেন। জীবনানন্দের সাহিত্যজীবনের সাথে লেখক যে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন সে কথাও নানাভাবে ফুটে উঠেছে।
তারপর কলকাতায় আগমন এবং সাহিত্যে বিচরণের প্রসঙ্গ রয়েছে। মনমতো কবিতা ছাপাতে পারছিলেন না বলে নিজেই খুলে বসলেন আস্ত একটা প্রকাশনা সংস্থা। স্ত্রীর লেখা প্রকাশকের দপ্তর থেকে ফেরত এসেছিল বলে নিজেই একটা বার্ষিকী প্রকাশ শুরু করে দিলেন।
বইয়ের শেষাংশ অসমাপ্ত। লেখক 'আমাদের কবিতাভবন' পুরোটা লিখে যেতে পারেননি। অথচ এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লেখকতনয়া অবশ্য অনেক টিকা এবং শেষে একটা 'সংযোজন' দিয়েছেন। তবুও আরও জানার আগ্রহ থেকেই যায়!
রবীন্দ্র-নজরুল যখন মধ্যগগনে তখন আবির্ভাব হয় বুদ্ধদেব বসুর। কৈশোরে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম "আমরা তিনজন।" তৎকালীন পুরানো পল্টন একেবারে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। সেই থেকে পরিচয়, এরপর যতই বুদ্ধদেব বসুর লেখা পড়ি ততই মোহমুগ্ধ হই। আমার কাছে বাংলা ভাষায় প্রথম তিনজন শক্তিমান লেখকের মধ্যে থাকবেন বুদ্ধদেব। 'আত্মজৈবনিক' ছোট বই। আসলে একটি বই না, লেখকের শৈশব, যৌবন এবং জীবনের শেষ ভাগ নিয়ে লেখা তিনপর্বের আত্মজীবনী। অনেক অজানা তথ্য জানলাম - বুদ্ধদেবের জন্মের পর পরই ওনার মার মৃত্যু হয়, ওনার নোয়াখালীর শৈশব কাল, ঢাকা ও কলকাতায় যৌবনকাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে কলকাতার বনেদি সমাজের কাছে অপাংক্তেয় হওয়া, সংবাদপত্র গুলোর ওনার সাথে রবি ঠাকুরের ফাটল ধরানোর চেষ্টা, নিজের প্রতিষ্ঠিত যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ থেকে বিতাড়িত হওয়া, ইত্যাদি। "আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম" একটা ইল্যুশন, পিছন থেকে ছুরি মারা আমাদের আবহমান কালের ঐতিহ্য। আশ্চার্জজনক ভাবে দেশ বিভাগ সংক্রান্ত কোন কথা আত্মজীবনীতে নাই, হয়তো বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ভালোবাসতেন, অপ্রিয় প্রসঙ্গ ইচ্ছে করে এড়িয়ে গিয়েছেন। একটাই দুঃখ, বইটি শেষ করে যেতে পারেন নি। অকালে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল দুই বাংলার প্রিয় লেখককে।
কয়েকটা মনোরম ছবিও চোখে আছে আমার । গাছপালা অজস্র, যেখানে–সেখানে পুকুর, সারা শীত গৃহস্থের উঠোন আলো করে রেখেছে লাল আর হলদে রঙের গাঁদাফুল, ফুটে আছে পথের ধারে–ধারে পাতার ফাঁকে রক্ত–লাল জবা আর শ্বেতবর্ণের টগর, কোন–এক সরকারি আপিশের বাগানে রঙে–রঙ–মেশানো বিচিত্র সব পাতাবাহার, চৈত্রমাসে আগুন–লাল শিমুল ফেটে গিয়ে ছোটো–ছোটো তুলোর বল্ হাওয়ায় ভাসে । হলুদ আর টকটকে লাল শুকনো পাতার উপর দিয়ে ঘুরে বেড়ায় গোসাপ―মানুষের সঙ্গে দেখা হলে চকচকে চোখে তাকিয়ে থাকে । আছে রৌদ্রের জীব প্রজাপতি অনেক, অন্ধকারে ঝকঝকে সবুজ জোনাকির ঝাঁক । আছে আকাশ–জোড়া ঝিমঝিম জ্যোৎস্না, আর শীতের জ্যোৎস্নায় ঘন কুয়াশার আস্তরণ, যাতে চেনা জিনিশ রহস্যময় হয়ে ওঠে, হঠাৎ তাকালে মানুষ বা মানুষের মতো আকৃতি দেখা যায় । আর অবশ্য নদীও আছে―কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেটা মনোরম নয় ।
আমার ছেলেবেলা – বুদ্ধদেব বসু ।
আমার ছেলেবেলা, আমার যৌবন, আমাদের কবিতাভবন । তিনটি পৃথক রচনা এক মলাটে আত্মজৈবনিক নামে ছেপেছে বাতিঘর । গায়ে লেখা মূল্য ৪৫০ টাকা । পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১৬ ।
১৮ মার্চ বুদ্ধদেব বসুর প্রয়াণ দিবস ছিলো ,,এ কথা জেনে আমি বই টা পড়তে শুরু করিনি অবশ্য। রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে আসার সময় টা কেমন ছিলো এটা জানার ইচ্ছে থেকেই মূলত পড়া শুরু করেছিলাম। কিছু কিছু মানুষ আমৃত্যু কেমন একটা যুগের বিনির্মাণে নিজেকে সমর্পণ করতে পারে,, ভাবতেই অদ্ভুত লাগে। কল্লোল এর যুগে প্রগতি,এরপর কবিতা, কবিতাভবন সবই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে যদিও বিষ্ণু দে, প্রেমেন মিত্রের অবদান অনস্বীকার্য। জীবনানন্দ কে তাঁর সমকালীন পাঠক সমাজে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কৃতিত্বও বোধহয় বুদ্ধদেব বসুরই বেশী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এর তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ এর প্রতিষ্ঠাতা বুদ্ধদেব বসু পদত্যাগও করেন তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্বের জন্য।রিপন কলেজ থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকার প্রাচীন অলিগলি থেকে বিস্তীর্ন কোলকাতার এই জার্নি পড়ে মোটামুটি টাইম ট্রাভেল ই করেছি বলা যায়।
ইদানীং আত্মজীবনী পড়তে বেশ আগ্রহ হচ্ছে। লেখকদের, যাদের লেখা ভালোবাসি, তাদের জীবনযাপন, সময় যাপন, সমসাময়িক অন্যান্য লেখকদের সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়া, জানতে ভালো লাগে।
বুদ্ধদেব বসুর লেখা তেমন পড়া হয় নি, কিন্তু তিনি একেবারেই অপরিচিত নন, অজানা নয় বাংলা সাহিত্যে তার অবদান। রাত ভ'রে বৃষ্টি উপন্যাসটা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তবে তারচেয়ে বেশি মুগ্ধতা ছিল জীবনানন্দ দাশ সহ আরো অনেক কবিকে যেভাবে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, তা জানতে পেরে। মানুষটাকে জানার আগ্রহ কিছুটা হলেও মিটলো আত্মজৈবনিক পড়ে।
বুদ্ধদেব বসু দ্রুতই পড়বো আরও।
This entire review has been hidden because of spoilers.
আত্মজীবনী পাঠ করতে গেলে অদ্ভুত এক বিষাদ, ভীষণ এক হাহাকার আচ্ছন্ন করে। হারানো সবকিছুর জন্য হাহাকার। এটিও ব্যতিক্রম নয়। বাংলা সাহিত্য-ইতিহাসের মহাসড়ক ধরে আনন্দময় এক যাত্রার সুখ আর হারানোর হাহাকার এই দুই অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম পাঠান্তে।
This entire review has been hidden because of spoilers.