“লিখে টাকা নেই, সম্মান-স্বীকৃতিও নেই তেমন করে – এর জন্যই কি ভাটার টান কল্পবিজ্ঞান কাহিনি নির্মাণে?” না, এই প্রশ্নটা আমার নয়। ছোটোবেলায় সত্যিকারের বিজ্ঞান-আধারিত কল্পকাহিনি পড়ার সূত্রপাত যে পত্রিকার মাধ্যমে, সেই ‘কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞান’ পত্রিকায় এক সাহিত্যিক নিয়মিত লিখতেন। সেই কিন্নর রায় এই প্রশ্নটি তুলেছেন তাঁর কল্পবিজ্ঞান কাহিনির আলোচ্য সংকলনটির মুখবন্ধ ‘কথা-কল্পনা-কাহিনি’-তে। উত্তরটা এত সরল নয়, কারণ তাহলে মুষ্টিমেয় পেশাদারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ক’জনের বাইরে আর কারও লেখালেখি করার কথাই নয়। সর্বোপরি, এই উত্তর দিয়ে আজ ফেসবুকে রোজ পোস্ট হয়ে চলা অজস্র লেখা, যাদের ৯০% থিওডোর স্টার্জ্যনের ‘সূত্র’ মেনে রাবিশ হলেও বাকি ১০% ভালো, এমনকি খুব ভালো,-কে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাহলে কেন বাংলায় লেখা হয় না কল্পবিজ্ঞান? উত্তরটা কিছুটা লুকিয়ে আছে এই সংকলনের গল্পগুলোতেই। কেন? একেবারে সূচি ধরে-ধরে লিখি। ১] লাল নদ, নীল নদ: মঙ্গলের ‘পাথ ফাইন্ডার’ মিশন আর কাল্পনিক অতীতের মিশর মিশিয়ে লেখা এই গল্পটাতে ব্যাপক ইনফোডাম্পিং, প্রাচীন মিশর নিয়ে কিছু অবাস্তব রোমান্স, টুটানখামেনের হত্যা (?), রোবট, সব মিলিয়ে একটি বদখত খিচুড়ি হয়েছে এটি। গল্প হয়নি। ২] কালপুরুষের কুকুর: কিংবদন্তির কালপুরুষ, লুব্ধক, বৈতরণী, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশচেতনা, এইসব মিশিয়ে এই লেখাটি অনন্য। কিন্তু এটা কল্পবিজ্ঞান নয়। ৩] অমিতায়ু: সুদূর অতীতের এক উৎকৃষ্ট উপাখ্যান এটি, যাতে ইতিহাস, আয়ুর্বেদ, কল্পনা মিলে-মিশে একাকার হয়েছে ঠিকই। কিন্তু কল্পবিজ্ঞান কই এতে? ৪] জেলিফিশরা এসেছিল: জেলিফিশদের সহসা আয়তন ও সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে মাছ ধরা তো দূরের কথা, জলে নামাই অসম্ভব। কীভাবে এদের তাড়ানো যায়? ইতিহাস ও কল্পনার সাহায্য নিয়ে এই সমস্যার সমাধানটা ব্যাপক ছিল, কিন্তু লেখা এত বাজে...! ৫] জুরাসিক পার্ক: মাইকেল ক্রিকটনের উপন্যাসটি থেকে কপি-পেস্ট করা আইডিয়া নিয়ে একটি অতি রদ্দি লেখা এটি। ৬] পক্ষিপুরাণ: পরিবেশচেতনা ও সংরক্ষণ নিয়ে লেখা যেকোনো বইয়ে টেক্সট হিসেবে এই লেখার একাংশ ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু কল্পবিজ্ঞান? গল্প?? ৭] নবদিগন্তর বন্ধু: এই কাহিনিও আফ্রিকায় হাতি নিধন তথা চোরাশিকারের বিরুদ্ধে একটি দলিল। গল্প নয়। কল্পবিজ্ঞান তো নয়ই। ৮] কূর্মাবতার: আবার পরিবেশ দূষণ নিয়ে একটি নিবন্ধ, এবং তার মধ্যে রোবটিক ব্যাপার গুঁজে সেটাকে কল্পবিজ্ঞান বানানোর চেষ্টা। ৯] কঙ্কাল উপকূলের ‘কুইন’: পরিবেশ তথা লুপ্তপ্রায় প্রাণী সংরক্ষণের আরেকটি প্যামফ্লেট। ১০] স্পিলবার্গ, রায়, ও এলিয়েন: সত্যজিৎ রায়-এর গল্প ‘আপন’ করে স্পিলবার্গের সিনেমা বানানোর কাহিনি এখন মোটামুটি সবাই জানি। কিন্তু যখন খুব কম মানুষ এটা জানতেন, তখন এই কথাগুলো গল্পের আকারে, মাঝে ‘অ্যাং’ ধাঁচের একটি ভিনগ্রহী গুঁজে লেখা হয় এটি। স্রেফ এজন্যই যদি একে কল্পবিজ্ঞান বলে চালানো হয়...! ১১] করঞ্জাক্ষর কাজের লোক: অনীশ দেব সম্পাদিত ‘সেরা কিশোর কল্পবিজ্ঞান’ সংকলনে স্থান পাওয়া এই গল্পটা শীর্ষেন্দু-ঘেঁসা সুখপাঠ্য ফ্যান্টাসি মাত্র। ১২] স্ক্রিপ্টে ছিল না: গল্পটার আইডিয়া বেশ ভালো ছিল। ছোটোদের নিয়ে একটা সিনেমা বানানো হবে, যাতে থাকবে এই গ্রহে লুকিয়ে থাকা ভিনগ্রহীদের বেরিয়ে আসার কথা। যথারীতি, সেটাই হল। কিন্তু গল্পটাও সেখানেই থেমে গেল! ১৩] নগেনবাবু খগেনবাবু: রোবট, ক্লোন, এসব আনলেই যদি কল্পবিজ্ঞান হত... ভীষণ হতাশ হলাম। ১৪] চাঁদনি রাতে কাকের গান: আবার! আবার সেই কামানগর্জন, মানে হাইব্রিড রোবট আর গাঁজাখুরি আইডিয়া মিশিয়ে ফ্যান্টাসি। ১৫] ল্যাডলি লশকরের ল্যাজ: ‘পৈতৃক সম্পত্তি’ হওয়া সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায় নিজেও মাত্র একবার প্রফেসর হিজিবিজবিজ-কে এনেছিলেন পাঠকদের সামনে। সেখানে কিন্নর রায় গল্পের পর গল্পে সেই কনসেপ্ট ভাঙিয়ে চালিয়েছেন, সম্পূর্ণ অসম্ভাব্য জেনেও। ১৬] বৃক্ষ, তোমার নাম কী?: নাহ্! এমনকি পরিবেশ বিষয়ক পাঠ্যপুস্তকের অংশ হিসেবেও এটাকে নেওয়ার কথা ভাবা যাচ্ছে না। ১৭] মাংস: ব্যাপক ইনফোডাম্পিং, এবং গল্পের শেষে একটা বহু-ব্যবহারে ক্লিশে ‘চমক’(?), এই দিয়ে আরেকটি সাইফি বানানোর (অপ)চেষ্টা। ১৮] ভয়: বই না পড়ে, হলিউডি সিনেমা দেখে সাইফি লিখতে গেলে কী হয়, তার একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন এটি। ১৯] তাতুন, কসমস, আর ৯১২: আরেকটি সায়েন্স ফ্যান্টাসি। মাথামুণ্ডহীন। ২০] নেপচুনের মাটি: আবার একটি হলিউড-অনুপ্রাণিত আকাশকুসুম, যার চেয়ে সুপাঠ্য লেখা আমরা রোজ সোশ্যাল মিডিয়ায় পড়ি। ২১] অসম্ভবেরা: সায়েন্স ফ্যান্টাসি, যাতে গল্প-টল্প কিচ্ছু নেই। আছে শুধু পাতার-পর-পাতা কথা। ২২] বিরিক্ষি: গল্প নয়, এটি একটি আস্ত নভেল্লা। কিন্তু এতে নস্ট্যালজিয়ার রোমান্স আর কল্পনা থাকলেও কল্পবিজ্ঞান কই? তার চেয়েও বড়ো কথা, প্লট কই? শুধু তো দুই চরিত্রের কথা! ২৩] বাঘের যদি গজায় ডানা: পরিবেশচেতনা আর ভবিষ্যতের পণ্যায়িত বিপণন নিয়ে হাহাকারের সঙ্গে প্রচুর জ্ঞান, ইনফোডাম্পিং, এবং পাঠককে মুখে চুষিকাঠি গোঁজা শিশু ভাবার মিলিত ফল হল এই অখাদ্য জিনিসটি। ২৪] সবুজ সবুজ ওরা: পরিবেশচেতনা, দূষণ-বিরোধী প্রচার, ইনফোডাম্পিং, জ্ঞান দেওয়া… মানে ট্রেডমার্ক অপাঠ্য জিনিসকে কল্পবিজ্ঞান বলে চালানোর পুরোনো চাল আর কি। ২৫] ওরা এসে গেছে: পরিবেশচেতনা, ভাইরাসের ভয়, মাঝে দু’একটা ভিনগ্রহী এনে তাদের দিয়ে ক্যানভাসিং করানো... সেই ছক সমানে চলেছে। ২৬] বাতাস-কুঠুরির বায়স: কিছু কল্পনা। কিছু উদ্ভট কবিতা (মজা ইঞ্জেক্ট করার চেষ্টা?)। কিছু লীলা মজুমদারের অক্ষম অনুকরণ। এটা যদি গল্প হয়, তাও আবার সাইফি, তাহলে যেকোনো খবরের কাগজের সম্পাদকীয় অতি উৎকৃষ্ট থ্রিলার। ২৭] চন্দ্রাঘাত: স্বপ্নে ডাইনোসর দেখার ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা কী, তা আমি জানি না। তবে জুরাসিক পার্কের সিকুয়েল রিলিজের বছরে ডাইনোসরের ডিম ও তা ফুটে বেরোনো ডাইনোসরদের ওড়াউড়ি, তার সঙ্গে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মিশিয়ে লেখা এই কিম্ভূত জিনিসটি পড়ে আমি স্তম্ভিত হলাম। না, লেখার অভিনবত্বে নয়। বরং আমি এটাই ভাবলাম যে এই জিনিস কল্পবিজ্ঞান বলে ‘পেডলড’ হওয়ার পরেও লোকে সাইফি লেখকদের দূর থেকে ঢিল ছুড়ছে না কেন? ২৮] শুঁয়োপোকা: সিনেমার শ্যুটিং করতে গিয়ে শুঁয়োপোকা নিয়ে অবসেশন ও শেষে প্রজাপতি হবে, না মথ, এই নিয়ে ভাবনা... গল্পটা জঘন্য, কিন্তু লেখকের থরো কাউন্সেলিং করানো হয়েছিল কি? মনে তো হয় না। বরং বছরের-পর-বছর এইসব হাবিজাবি ছেপে ‘কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞান’ পত্রিকাটাই উঠে গেছিল।
বাংলায় কল্পবিজ্ঞান বেশি না থাকার কারণ এটাই। প্রেমেন্দ্র মিত্র, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, দিলীপ রায়চৌধুরী, অদ্রীশ বর্ধন, সঙ্কর্ষণ রায়, সমরজিৎ কর, সিদ্ধার্থ ঘোষ, অনীশ দেব, এবং নব্বইয়ের দশকে অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, এমন মুষ্টিমেয় সুলেখক ছাড়া যাঁরা এই ঘরানায় লেখালেখি করেছেন তাঁরা হয় অতি বাজে লেখক, নইলে কল্পবিজ্ঞান কীভাবে লিখতে হয় সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র পড়াশোনা না করে যা-ইচ্ছে-তাই লিখে সেটাই সাইফি হিসেবে চালিয়েছেন। এ আমাদের সৌভাগ্য যে এখনকার শিক্ষিত ও সচেতন সম্পাদকদের চেষ্টায় বাংলা কল্পবিজ্ঞান লেখার একটা ধারা তৈরি হয়েছে। টাকা, বা সম্মান-স্বীকৃতির তোয়াক্কা না করেই। এটাই ভরসা। ইতিমধ্যে, আপনি কিন্নর রায়-এর ভক্ত হলে উপরোক্ত চ্যাঁচামেচি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দে’জ থেকে প্রকাশিত সুমুদ্রিত বইটি পড়তে পারেন। শুভেচ্ছা রইল।