মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠল রানা। ঠিক যেন লুবনা... লুবনা আভান্তি! ইটালিয়ান সেই মিষ্টি কিশোরী, যে রানার মন জয় করে নিয়েছিল... যে ওকে একটা গান উপহার দিয়েছিল... যাকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েও ব্যর্থ হয়েছিল রানা। সেই কষ্ট আজও তাড়া করে ফেরে ওকে।
কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম 'নবাব'। তাঁর পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন। কাজী আনোয়ার হোসেন সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসাবে ষাটের দশকের মধ্যভাগে মাসুদ রানা নামক গুপ্তচর চরিত্রকে সৃষ্টি করেন। এর কিছু আগে কুয়াশা নামক আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র তার হাতেই জন্ম নিয়েছিলো। কাজী আনোয়ার হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে বিদ্যুৎ মিত্র নাম ব্যবহার করে থাকেন।
অনেকদিন পরে মাসুদ রানা নিয়ে বসেছিলাম আর একদিনেই শেষও করে ফেললাম! তবে কি আমার রিডার্সব্লক বিদায় নিচ্ছে? আশাবাদী লাগছে নিজেকে। ভালো লেগেছে বইয়ের প্লট এবং গতি। বাচ্চাদের সাথে রানার বন্ডিং আমার ভালোলাগার আলাদা একটা জনরাই বলা যায়। 😍
একটা বিপজ্জনক মিশন শেষ করে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে কাটিয়ে এখন মোটামুটি সুস্থ বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স (বিসিআই)-এর টপ এজেন্ট মাসুদ রানা। ডাক্তারের পরামর্শে কিছুদিন বিশ্রাম করার জন্য ও উঠলো ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট্ট শহর এল সেডেরোর এক রিসোর্টে। এক ভোররাতে রানা যখন জগিং করছিলো, ঠিক সেই সময় একদম ওর বুকের ওপর এসে আছড়ে পড়লো এক কিশোরী মেয়ে, যার নাম অ্যালিসন মিচেল। একদল হিংস্র লোক তাড়া করে বেড়াচ্ছে মেয়েটাকে। তাকে দেখেই রানা স্তব্ধ হয়ে গেলো। একদম যেন লুবনা আভান্তির ('অগ্নিপুরুষ' দ্রষ্টব্য) মতো দেখতে মেয়েটা! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব! মাসুদ রানা সিদ্ধান্ত নিলো, যেভাবেই হোক অ্যালিকে রক্ষা করবে সে।
আমেরিকার এক ক্ষমতাশালী ডিফেন্স কনট্রাক্টর অ্যালেক্স লিয়ারি। যে কোন ভাবেই হোক না কেন অ্যালিকে খুন করতে চায় সে। এই কারণেই মেয়েটার পেছনে লিয়ারি লেলিয়ে দিয়েছে একদল নিষ্ঠুর খুনীকে। এমনকি তাকে খুঁজে বের করতে সে সাহায্য নিচ্ছে আমেরিকার অত্যাধুনিক মিরান্ডা স্যাটেলাইটেরও। আপাত দৃষ্টিতে একটা অত্যন্ত সাধারণ কিশোরীকে সরিয়ে ফেলার জন্য কেন এতো আয়োজন লিয়ারি'র?
বেশ কয়েক বছর ধরে থেকে গোপনে আমেরিকা একটা প্রজেক্ট চালাচ্ছিলো।এই প্রজেক্টে তারা তৈরি করার চেষ্টা করছিলো মাইন্ডরিডার। মানব মাইন্ডরিডার। যারা সরাসরি যেকোন মানুষের মনের ভেতরে উঁকি দিয়ে সবটা দেখে নিতে পারে। এসবের সাথে অ্যালিসন মিচেলের সম্পর্ক কি? আর মাসুদ রানা যখন না চাইতেও এসবের সাথে জড়িয়েই গেছে, পিছু হটার আর কোন সুযোগ নেই তার। কারণ, অ্যালিকে বাঁচাতে রানা নিজের সর্বোচ্চ সীমাও ছাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
ইউটাহ'র মরুভূমিতে একাকী দাঁড়িয়ে আছে একটা টাওয়ার। সেখান থেকে আসলে কোন সিগনার ট্রান্সমিট হচ্ছে? কেন একের পর এক শান্তিপ্রিয় মানুষ হিংস্র হয়ে উঠছে রক্তের নেশায়? কোনভাবেই যেন দমানো যাচ্ছে না অ্যালেক্স লিয়ারিকে। আর এই সমস্ত সমস্যার বিপরীতে শুধু একজন মাত্র মানুষ অকুতোভয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সে হচ্ছে আমাদের মাসুদ রানা। অ্যালির নিরাপত্তা বিধান করার জন্য যে নিজের জীবনও দিতে প্রস্তুত!
অনেক অনেক অনেকদিন পর মাসুদ রানা পড়লাম। এক্স্যাক্টলি মনেও নেই কতোদিন পর৷ তাও তো বছর চারেক হবেই। আর এবার 'অন্তর্যামী' শুরু করার পরেই যেন ফিরে এলো আগের সেই রানা কাহিনি পড়ার সময়কার অনুভূতিটা। কোমলে-কঠোরে মেশানো প্রিয় এই বাঙ্গালী এসপিওনাজ এজেন্টকে যে কতোটা মিস করেছি এতোদিন, তাও বুঝতে পারলাম। একটা সময় নিয়মিত মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলো কেনা ও পড়া হতো। এরপর দীর্ঘ একটা গ্যাপ পড়ে গেলো। 'অন্তর্যামী'-এর মাধ্যমে সেই গ্যাপটা কাটাতে পেরে ভালো লেগেছে।
আমেরিকান লেখক প্যাট্রিক লি'র স্যাম ড্রাইডেন সিরিজের প্রথম উপন্যাস 'রানার' অবলম্বনে রচিত হয়েছে মাসুদ রানা সিরিজের ৪৫৯ তম বই 'অন্তর্যামী'। মাইন্ডরিডিং আর মাইন্ড কন্ট্রোলের মতো বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা এই বইটা একটা চমৎকার টেকনো থ্রিলারের আবহ সৃষ্টি করেছে। অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে রানা'র সব দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড আর একের পর এক বিপদের ঘনঘটা আমাকে একরকম আটকেই রেখেছিলো বইয়ের সাথে। আর কিশোরী অ্যালিসন মিচেলের সাথে মাসুদ রানা'র ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট কাহিনিতে যোগ করেছে আলাদা একটা মাত্রা। কিন্তু 'অন্তর্যামী'-কে 'অগ্নিপুরুষ'-এর সাথে মেলানোর চেষ্টা করলে হতাশ হতে হবে। নিজের জায়গা থেকে ওটা মাসুদ রানা সিরিজের একটা অন্যতম মাস্টারপিস। 'অন্তর্যামী' তেমন না হলেও বেশ উপভোগ্য একটা বই।
এই বইতে অল্প সময়ের জন্য কিছু পুরোনো চরিত্রের আগমন ঘটেছে। যেমন নুমা'র ডিরেক্টর অ্যাডমিরাল হ্যামিল্টন আর রানা'র খুব কাছের বন্ধু ববি মুরল্যান্ড। অনেকদিন পর এই চরিত্রগুলোকে পেয়ে ভালো লেগেছে। হোক সেটা অল্প সময়ের জন্য। 'অন্তর্যামী'-এর সমাপ্তিটাও বেশ ভালো লেগেছে আমার কাছে। মাসুদ রানা সিরিজের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের কাহিনি সিলেকশনে সেবা'র আরেক সুলেখক ইসমাইল আরমান 'অন্তর্যামী'-তে চমৎকার কাজ দেখিয়েছেন।
রিভিউটা এতো বড় লেখার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু হয়ে গেলো। যাই হোক, প্রচ্ছদটা মোটামুটি ভালোই লেগেছে। মাসুদ রানা সিরিজের নিয়মিত পাঠকরা হয়তো বইটা পড়ে ফেলেছেন। আর যারা পড়েননি, চাইলে পড়ে ফেলতে পারেন 'অন্তর্যামী'।
বইটা পড়ে খারাপ লেগেছে বলব না। ভালো লেগেছে তাও বলা যাবে না। বলা যেত এটা মাসুদ রানা সিরিজের বই না হলে। স্ট্যান্ড-অ্যালোন কোন বই হলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু মাসুদ রানায় এ ঘরানার কাহিনী মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। যে কারণে মোটামুটি উপভোগ করার পরেও ২ রেটিং দিলাম।
ছোট্ট মেয়েটাকে খুন করার জন্য মাঠে নেমে পড়েছে বেশ কয়েকটা এলিট কমাণ্ডো টিম। কিন্তু মেয়েটা এখন মাসুদ রানার কাছে। তবে রানা মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবে কি না তা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী স্যাটেলাইট দিয়ে মনিটর করা হচ্ছে রানা আর ঐ মেয়ের গতিবিধি।
কিন্তু পুরো ব্যাপারটার সাথে আমেরিকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, মাইণ্ডরিডিং, মানসিক বশ্যতা কিংবা মস্তিষ্ককে পোষ মানানোর সম্পর্ক কী?
মাসুদ রানা সিরিজের আরও একটি দুর্ধর্ষ, হাই অকটেন থ্রিলার। ৮৩ তলা থেকে ঝাঁপ দেয়া, প্যারাট্রুপারের সাথে উড়ন্ত অবস্থায় মারামারি, সুপার কম্পিউটারের মত স্যাটেলাইটের চোখ ফাঁকি দেয়া, শ্বাসরুদ্ধকর সব কার চেসিং সিন, ভিন্ন কনসেপ্ট আর একের পর এক টুইস্ট। সব মিলিয়ে কমপ্লিট প্যাকেজ। শেষটা প্রেডিকটেবল হলেও যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক।