Jump to ratings and reviews
Rate this book

পদতলে চমকায় মাটি

Rate this book
একবিংশ শতাব্দীর ঘুণে ধরা কিছু যুবক।
ইতিহাসের ক্রমাগত ট্যাকলের বিপরীতে খেলে যাওয়া তরুণ এক ফুটবলার।
ক্ষ্যাপাটে এক ফুটবল কোচ।
একটি পাহাড়ঘেরা জনপদ,পরাবাস্তবের চেয়েও নাটকীয়তায় পূর্ণ যার ইতিহাস এবং বর্তমান।

উপন্যাস ‘পদতলে চমকায় মাটি ’ ধরতে চেয়েছে এই চতুষ্কোণ।

375 pages, Hardcover

First published February 3, 2019

40 people are currently reading
639 people want to read

About the author

Shuhan Rizwan

7 books1,107 followers
Shuhan Rizwan is from Bangladesh. His debut novel, a historical fiction named 'সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ (Knight in the Oblivion)' was published in 2015; since then, he published 3 more full-fledged novels. His novels often centered around the geo-political nuances and predicaments of life in contemporary Dhaka.

Apart that, Shuhan is a screenwriter too, and the recipient of Chorki Best Screenplay Award-2022.

Being a Mechanical Engineering Graduate, Shuhan choose to be a fulltime writer since 2020. Now when he is not writing in his muddled studio, he spends most of his time reading, traveling with his wife and watching sports events.

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
96 (41%)
4 stars
102 (43%)
3 stars
27 (11%)
2 stars
6 (2%)
1 star
1 (<1%)
Displaying 1 - 30 of 81 reviews
Profile Image for Israt Zaman Disha.
194 reviews622 followers
February 25, 2019
বইটা গতকাল যখন শেষ করি রাত তখন দুইটা। এরপর থেকে নানাভাবে বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো গুছানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু হয়ে উঠছে না। বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলোও হারিয়ে যাবে এই ভাবনায় তাই আবোলতাবোল লিখতে বসলাম।

প্রথমেই পড়তে গিয়ে একটু কেমন কেমন লেগেছে। সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণের পর লেখকের প্রতি এক্সপেকটেশন কিছু বেশি থাকাই স্বাভাবিক। প্রথম থেকে তাই সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণের ভাবাবেগটা না পেয়ে একটু মুষড়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কাহিনী যত এগোয় ভুলটা তত ভাঙে। আসলে দুইটা বই সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে লেখা। তাই এই দুইটা বইকে একই মাপকাঠিতে বিচার করাটাই ভুল।

লেখনীতে পেয়েছি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর শহীদুল জহিরের ছায়া। শহীদুল জহিরের বই পড়তে পড়তে যেমন একটা বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে, ফুটবল পায়ে সমরের অতীতে ঘুরতে ঘুরতেও কেমন একটা ছায়া ছায়া বিষণ্ণতা আঁকড়ে ধরে। বইটা তাই মনে হয় একটু ধীরে ধীরে পড়ার মত।

বইয়ের আরও একটা ভালো লাগার দিক হল, তরুণ সমাজের প্রতিনিধি আরিফ আর হিমেলের সাথে নিজেকে আর আশেপাশের বন্ধু বান্ধব, সহপাঠীদের রিলেট করতে পারা। সত্যি আমরা এমনই। কেউ দেশের ভিতরে কি হচ্ছে তাই জানি না, একধরনের নির্লিপ্ততার মধ্যে থাকি। আবার কেউ কেউ সব খবরই রাখি, সোশ্যাল মিডিয়াতে সবকিছু নিয়েই সোচ্চার। কিন্তু যখন কিছু একটা করার সময় হয় তখন রাস্তা খুঁজে পাওয়াটাই হয় মুশকিল। সাথে থাকে বাস্তব জীবনের নানা ব্যস্ততা।

পদতলে চমকায় মাটি পড়তে পড়তে আরও একটা খুব সুন্দর ব্যাপার মনে হল। সুহান ভাই আসলে উপন্যাসের ছলে ইতিহাসের সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিতে চান না, উনি শুধু পাঠকের মনে জানার একটু আগ্রহ উস্কে দিতে চান। বাকিটা পাঠক যতটুকু ইচ্ছা নিজ দায়িত্বে জেনে নিবে। সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণেও লেখক ঠিক এইটাই করেছেন, এই বইতেও এটা করার প্রয়াস লক্ষ করেছি। এই ব্যাপারটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।

অনেক ভালো ভালো কথার মাঝে এবার আসি একটু অতৃপ্তির জায়গায়। বইয়ের শেষটা হয়েছে ছোটগল্পের মত। "শেষ হইয়াও হইল না শেষ "। খুব নাটুকে ভাবে শেষ না করে লেখক বইয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখেছেন ঠিক। কিন্তু পাঠক হিসাবে আমি তৃপ্ত হতে পারলাম না। তাই রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নের মধ্যে নিজের মত করে এন্ডিং টেনে দিলাম। :P

সবশেষে সুহান ভাই, আপনাকে আমি যতই ধন্যবাদ দেই ততই কম হবে। এমন সব বিষয়ে আপনি আমার আগ্রহ উস্কে দিয়েছেন যা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এতদিন আমার হাইলাইটে আসেনি। পাঠক হিসাবে এটা আমার অনেক বড় পাওনা।
Profile Image for Farhana.
325 reviews202 followers
April 22, 2021
আমার পিংক ফ্লয়েডের Us and Them গানের কথা মনে পড়ে! এই বাইনারি ডিভাইডের কনসেপ্টটা বেশ পাওয়ারফুল। জাত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র যে কোন ক্রাইটেরিয়ায় এই Otherness এর ধারণা টা কোনভাবে মানুষের মনে গেঁথে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে! আর পাহাড়ের মত জায়গায় যেখানে কমপ্লেক্স মাইক্রোকোযম আর ডাইভার্স পলিটিক্যাল এবং ইকোনমিক ইকোসিস্টেম বিদ্যমান, সেখানে তো ---
"And who knows which is which and who is who
And in the end it's only round 'n round"

কমপ্লেক্স পাওয়ার ডাইনামিক্সে কাকে কখন ভিক্টিম বানানো হবে আর কে কখন এক্সপ্লয়েট করার সুযোগ পাবে এইসব তো টেবিলের পাশ বদলানোর খেলা + খেলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দানও বটে!

বছরের শুরুতে ফেব্রুয়ারির দিকে চিম্বুক পাহাড়ে ম্রো দের সরিয়ে ট্যুরিজমের জন্য হোটেল বানানোর হাতে গোণা কয়েকটা স্ট্যাটাস চোখে পড়েছিল! ফেসবুকে স্যাড ইমো দিয়ে কর্তব্য সেরেছিলাম। এরপর আর কোন আপডেট চোখে পড়েনি। ফ্রি মার্কেট আর ক্যাপিটালিজম যেখানে ইতোমধ্যে নিজেদের উপযোগিতা কয়েক হাজার বার প্রমাণ করে ফেলেছে, সেখানে ডেভেলপমেন্টের হিউম্যান cost ক নাকি খ দিচ্ছে এই ডিটেইলস গুলো বোধহয় মাইনরিটি রিপোর্ট ছাড়া আর কোথাও জায়গা পায় না!

এই বইটার সবথেকে শক্তিশালী দিক হল খুবই contemporary আর well-researched! ঢাকা শহরের পরিচিত জায়গাগুলোকে ঘিরে একটা গল্প ধীরে ধীরে তার জায়গা করে নিল - এর মধ্যেই একটা আলাদা ভালো লাগা কাজ করে। পড়ে আমার মনে হয়েছে গল্পের মূল চরিত্র কিংবা প্রোট্যাগনিস্ট হল আসলে পার্বত্য চট্টগ্রাম, এর মানুষ, এবং রাজনৈতিক পটভূমি। সমর, আরিফ, হিমেল, আজাদ এদের সবার মধ্য দিয়েই যেন সে হিচ-হাইকিং করে করে চলল। আবার পার্বত্য চট্টগ্রামের ছেলে সমরকে ঢাকায় নিয়ে আসা এবং ঢাকার ছেলে আরিফ-হিমেল কে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা গল্পের এই মিউচুয়াল এক্সচেঞ্জটাও লক্ষণীয়! আর মাঝে যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-মিহির সেনগুপ্তের কথোপকথন অথবা নূর হোসেনের প্রেক্ষাপটে কাহিনী চিত্রণ এই ছোট্ট সংযোজন গুলো মিলান কুন্দেরার লেখার কথা মনে করিয়ে দেয়!

এখন কথা হচ্ছে এরকম একটা বিষয় নির্বাচনে লেখকের উদ্দেশ্য কী হতে পারে? মানুষ কে সচেতন করা/ ভাবানো/ comfortably numb হয়ে বেড়ে উঠা মধ্য-মেধা আর মধ্য-বিত্তের মননে একটু ঘা দেওয়া? কিন্তু সেটাও যে ফেসবুকে স্যাড অথবা এংরি ইমো দিয়ে স্ক্রল করে যাওয়া ব্যাপারটার থেকে দীর্ঘায়িত হবে তার কি কোন গ্যারান্টি আছে? যাই হোক উপযোগিতা আর আউটকামের কথা বাদ দিলেও এই কনভারসেশন টা টাইমলি ছিল এবং এই ন্যারেটিভ টা ক্রিয়েট হওয়া টা দরকার ছিল। অবশ্য এই কথাটা আমি টুইটারে ডাটা এথিক্স নিয়ে কথা বলা লোকজন থেকে শিখেছি। দিনশেষে আমাদের এইসব কথা নিরর্থক মনে হতে পারে অথবা এদের উপযোগিতা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কিন্তু এই কনভারসেশন হওয়া টা জরুরি!

আমার মনে হয় words can be either futile or political. এবং কথার কোন নির্দিষ্ট ভাগ্য নেই। আজ যেই কথাটা পলিটিক্যাল উইপন কাল সেটা নিস্ক্রিয় বোমের মত নিরর্থকও হয়ে যেতে পারে! পার্বত্য চট্টগ্রাম কে ক্যাপিটালিজম যেভাবে আমাদের ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে দেখতে চিনিয়েছে এর বাহিরে সত্যিই আর কিছু জানতাম না। সেইদিক বিচারে বইটা এক অর্থে আমাকে শিক্ষিত করেছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের ঝামেলা এড়িয়ে ব্যক্তিগত উন্নয়নের চিন্তায় বহু বছর ধরে ট্রেইনড এই মাইন্ড সহসা এই নতুন শিক্ষার কোন ফলপ্রসূ দাম দিতে পারবে কিনা বা সময় আসলে দিতে পারবে / চাইবে কি না সেটা হল প্রশ্ন!

লেখার যেই ব্যাপারটা ভাল লাগে নি সেটা হল উপমাধিক্য। একটু বেশি আরোপিত মনে হয়েছে। এইটুকু বাদ দিলে বেশ স্বতন্ত্র একটা লেখা। চিন্তার খোরাক জোগায় এমন আরও নতুন লেখা লেখকের থেকে পাবার প্রত্যাশায় আজকের সকালে এখানেই ইতি টানছি।
Profile Image for সালমান হক.
Author 66 books1,956 followers
July 31, 2020
লেখকের কাজ যদি পাঠক মনে অস্বস্তির উদ্রেক ঘটানো হয়ে থাকে, তবে রিজওয়ান ভাই সেই কাজে ভীষণভাবে সফল হয়েছেন। অত্যন্ত সুখপাঠ্য গদ্যও যে অস্বস্তিদায়ক হতে পারে, তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বইয়ের শুরুতে অন্যতম মূল চরিত্র সমর এবং তার প্রিয় শান্তি প্রিয়ার মাধ্যমেই আমরা যেন আভাস পাই, তলস্তয়ের 'ওয়ার অ্যান্ড পিসের' মতন সমর ও শান্তির আখ্যানও একটি এপিকের জন্ম দিতে যাচ্ছে। হলোও তাই। পাহাড়ী অঞ্চল নিয়ে যে অংশটুকু আছে বইয়ে, তা আমার মত গা বাঁচিয়ে চলা, সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তের পেট বরাবর জুতসই এক আঘাত। চোখ থাকতেও কি ভীষণ অন্ধ আমি! মাঝে মাঝে মনে হয়েছে লেখক বুঝি এখনকার তরুণ সমাজের 'মেন্টালিটি' একদম গুলে খেয়েছেন। রূঢ় কিন্তু ভীষণ বাস্তব বিষয়গুলো নিয়ে যেভাবে বয���ান দিলেন, অনবদ্য।
Profile Image for Daina Chakma.
440 reviews772 followers
February 27, 2019
"You can't handle the truth! Son, we live in a world that has walls, and those walls have to be guarded by men with guns. Who's gonna do it? You?"


You can't handle the truth! You can't handle the truth!

মেঘ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন নিয়ে আর বুক ভরে বিশুদ্ধ অক্সিজেনে শ্বাস নেবে বলে ইটের দেয়াল পেছনে ফেলে প্রতিদিন নীলগিরি ছুটছে তরুণ অভিযাত্রীদল। সেলফি আর হ্যাশট্যাগ কনজিউমারিজের যাদুচক্রে পড়ে সাজেকও দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে "প্লেসেস মাস্ট টু ভিজিট বিফোর ইউ টার্ন থার্টি" লিস্টে। অথচ এইসব পাহাড়ের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে উচ্ছেদ হওয়া অসংখ্য অসহায় পাহাড়ির কান্না। যে ম্রো জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করে নীলগিরি দেশের শীর্ষস্থানীয় টুর‍্যিস্ট স্পটে পরিণত হয়েছে কিংবা যেসব ত্রিপুরা-পাংখোয়া নিজেদের বাসভূম থেকে বিতারিত হওয়ার সুবাদে আজকের সাজেক বিলাস যাপন রিসোর্ট হিসেবে গড়ে উঠেছে তাদের কান্নার অভিশাপ এই দেশ সইতে পারবে তো?!

লেখক Shuhan Rizwan কিন্তু শুরুতেই বলে দিয়েছেন, You can't handle the truth!

সত্যের প্রেক্ষিতে লেখা এই গল্পের পরিসর অনেক বিস্তৃত। আপাত দৃষ্টিতে স্বাস্থ্যবান মনে হলেও ঠেসে ঢুকানো বিশদ ক্যানভাসের বিচারে এই বইকে বরং ক্ষীণকায় বলা চলে। এখানে হিল ট্রাক্টের কদর্য কনফ্লিক্ট যেমন নির্ভয়ে ফুটে উঠেছে তেমনি ঘরোয়া ফুটবল ক্লাবের নোংরা রাজনীতিও উঁকি মেরে গেছে ক্ষণে ক্ষণে। আবার আরিফ-হিমেলের বৈচিত্র্যময় কথোপকথন আর স্মৃতিচারণে ডাকসু নির্বাচন থেকে শুরু করে, শাহবাগ গণজাগরণ, স্বৈরাচার শাসন বিরোধী আন্দোলন, সুন্দরবনে কারখানা বানানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অভিজিৎ রায় হত্যাও স্থান পেয়েছে অল্প পরিসরে। খানিকটা ধোঁয়াশার জালে বিষয়গুলো লেখক এমনভাবে টাচ করে গেছেন যে জানার পরিধি বিস্তৃত করার তীব্র আগ্রহ সৃষ্টি হবে পাঠকের মনে।

শুরু করতে হবে একদম একাত্তরের আগে থেকে। ১৯৬২'তে কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টির ফলস্রুতিতে ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল সবুজ পাহাড়ের মানুষগুলো। সেদিনের সেই বেঁচে থাকার সংগ্রাম আজকের ফোর-জি যুগের একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শেষ হয়নি! এরপর তো বঙ্গবন্ধু উপজাতিদের বাঙালি হয়ে যেতে বললেন কেনো -এই প্রতিবাদে প্রচন্ড ক্ষোভে সংসদের অধিবেশন থেকে মানবেন্দ্র লারমা ওয়াক-আউট করলেন! শব্দটা তখনও উপজাতি ছিল। ঝামেলাটা বাঁধলো জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে। আদিবাসী শব্দের মিনিং চেঞ্জ হয়ে যাওয়ায় তৈরি হয় সম্বোধনের ঝামেলা। বই পড়ুয়া তার্কিক হিমেল খুব চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছে ব্যাপারটার- " ...উইথ আদিবাসী টার্ম, কামস গ্রেট রেসপন্সিবিলিটি। আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এগুলার অধিকার দিতে হবে। তারপর মনে কর জমি দখল করা যাবে না আর। স্বায়ত্তশাসন দিতে হতে পারে। মোদ্দাকথা, তাদের রাইটস নিশ্চিত করা লাগবে। এগুলার কনসিকোয়েন্সও তো আছে। সেটেলারদের সরে যাওয়া লাগবে, অথবা সেই জন্য স্হানীয়দের কমপেনসেশন দেয়া লাগবে। গভমেন্টের জন্য ব্যাপারগুলা খুব কঠিন। সব প্রবলেমগুলার মাঝে ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছে আসলে ভূমি সমস্যাটাই..."

জিয়াউর রহমান ট্রাকের পর ট্রাক সেটেলার পাঠিয়ে যে ভূমি সমস্যা সূত্রপাত করেছেন তার শেকড় কিন্তু অনেক ভেতর পর্যন্ত ছড়িয়ে জাতিগত দ্বন্দ্বে গিয়ে রূপ নিয়েছে। এখানে একটু আমার চেনা ছোট্ট একটা মেয়ের গল্প বলবো। মেয়েটার শৈশব কেটেছে গ্রামে। তখনকার গ্রাম কিন্তু আধুনিক শহুরে গ্রামের মতো ইলেকট্রিসিটি কিংবা মোবাইল নেটওয়ার্কে স্বয়ংসম্পুর্ণ না। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব হিসেব করতে হতো কিলোমিটারের অংকে আর ঘন্টার কাটায়। স্কুলের দেয়ালে খসে পড়া প্লাস্টার আর ভাঙ্গা বেঞ্চে জীর্ণতার স্পষ্ট ছাপ। একটু একটু করে স্কুল ভালোবাসতে শেখা মেয়েটাকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাদু শিখিয়েছিল "বাঙালি"কে ভয় করতে হবে! একদিন রাঙামাটি ঘুরতে এসে লেকার্স স্কুলের চকচকে ইউনিফর্মের প্রতি মুগ্ধ হয়ে সেই ছোট্ট মেয়েটা কিভাবে বাবার কাছে এই কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়বে বলে জেদ ধরেছিলো আর অপাঠ্য বইয়ের সাথে সখ্যতা করে কিভাবে বৈচিত্র‍্যের সৌন্দর্যে বিশ্বাস করতে শিখেছিলো সেই গল্প অন্য। কিন্তু সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটার মতো কতো নির্মল মনে আজও এই ভয়ের বীজও বুনে দেয়া হচ্ছে সে পরিসংখ্যান কে কষতে যাবে!

১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হলেও চুক্তির মূল ধারাগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার দরুন আদর্শ আর বিশ্বাসের জায়গার অমিল থেকে ফাটল ধরেছে পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলোর। ওরাও এখন নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। জুম চাষ করে বাঁচতে শেখা মানুষগুলো এখন অন্ন জোগাতে হিমশিম খায়। যথেষ্ট জমি নেই তো! যা পাচ্ছে তা থেকে আবার চাঁদা জুগিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। এসবের বিচার চাইবে কার কাছে! ঈশ্বর যদি সত্যি মুখ তুলে চাইতেন তবে সমরের প্রেয়সী শান্তিপ্রিয়া, যে কিনা সকাল সন্ধ্যা দুই বেলা ঈশ্বরের কাছে করুণা প্রার্থনা করে, সেই মেয়েকে তো আর ধর্ষণের স্বীকার হতে হতোনা! শান্তিপ্রিয়া ধর্ষণ মনে করিয়ে দেয় পাহাড়ে ঘটে যাওয়া অজস্র সেক্সুয়াল এসল্টের ঘটনাকে। মারমা এথনিক মাইনরিটি গ্রুপের দুটি মেয়ের ধর্ষণের কথাও মনে থাকার কথা পাঠকের। ওদের পাশে দাড়াতে গিয়ে লাঞ্চিত হয়েছিলেন চাকমা সার্কেলের রাণী পর্যন্ত।

বাংলাদেশের ইতিহাসে পঁচিশে মার্চ একটি কালো অধ্যায়। হোক সেটা একাত্তর কিংবা আশি! এজন্যই কলমপতি জেনোসাইড রূপে পোয়াপাড়া, মুখপাড়া এলাকায় এই দিনের পুনরাবৃত্তি ঘটে। এসব ইতিহাস, কিন্তু এই সেদিনও লংগদুতে একজন বাঙালির খুনকে কেন্দ্র করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ২০০ পাহাড়ির ঘরবাড়ি। এদের বেদনা কাপ্তাই বাঁধের নিচে ডুবে যাওয়া ঘরহারা মানুষগুলোর চাইতে কম কিসে!

একতরফাভাবে লেখক কেবল পাহাড়িদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের মোড়কই উন্মুক্ত করেননি। কিভাবে শান্তিবাহিনীর পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হয়ে মেজর মহসিন রেজা সহ ২২ জন সেনাসদস্যের মৃত্যু হয়েছিল তাও কালো অক্ষরের বুননে তুলে এনেছেন দক্ষ শিল্পীর মতো। নির্মোহভাবে বর্ণনা করে গেছেন দাবা ঘুটির মতো ব্যবহৃত আদিবাসী আর সেটেলারদের দুর্দশাচিত্র।

ব্যাপক রিসার্চের ফসল হিসেবে অর্জিত তথ্য কেবল যথাস্থানে বসিয়ে লেখক থেমে থাকেননি। খেলা করেছেন পাঠকের ইমোশন নিয়েও। বড় দাদা মানবেন্দ্র লারমার সাদা কাপড়ে মোড়া লাশের উপর চোখ বুলিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা যখন নিজের কাঁধের উপর অর্পিত দায়িত্বের বোঝা নিয়ে দাদার উপর অভিমান করতে গিয়েও করতে পারেনা তার কষ্টের ভাগ কিছুটা পাঠকও ভাগাভাগি করে নেয়। নবীন সাংবাদিক কল্পনা চাকমার ডায়রি পড়তে গিয়ে যে ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধায় "কল্পনা ফিরে এসে রাগও তো করতে পারে?" শিশুতোষ চিন্তায় মগ্ন হয় তখন পাঠকের মনও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনার প্রতি শ্রদ্ধায় আদ্র হয়ে উঠে!

এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো নিয়েও লেখক ইচ্ছেমতো খেলেছেন। তাদের এনে ফেলেছেন কমফোর্ট জোনের বাইরে। চিরচেনা বাসভূম ফেলে সমর চাকমা এখন উঁচু উঁচু বিল্ডিং ঘেরা রাজধানীতে ব্যস্ত নিজের স্বপ্নকে সত্যি করার প্রত্যয়ে। আদিবাসী কাউকে দেখলে চ্যাংচুং শব্দবান ছুড়ে দিয়ে কিংবা সাপব্যাঙ খেকো বলে তাচ্ছিল্য করে অযথায় শহুরে লোকেরা মজা নিতে ছাড়েনা সেটি উল্লেখ করতেও ভোলেননি লেখক। আবার দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়ন, ক্যারিয়ার চিন্তা ভুলে আরিফ-হিমেল চলে গেছে পাহাড়ের কোলে, রিসার্চ ডাটা ��ালেক্ট করার কাজে যেখানে নাকি প্রতি পদেপদে গুম হওয়ার ভয়! সেখানে ওদের পরিচয় হয় বিজয় দেওয়ান নামক টগবগে এক তরুণের সাথে যে নিজের অধিকারের জন্য যৌক্তিকভাবে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত জেলবাসী হয়। রাজধানীভিত্তিক নেটওয়ার্ক পাহাড়ে অচল বলে বহু হোমরাচোমরা ব্যক্তির সাথে সুসম্পর্ক থাকা স্বত্তেও আরিফ-হিমেল পারেনা বিজয়ের কারামুক্তির ব্যবস্থা করতে।

এই বই পড়তে গিয়ে সবচেয়ে বেশী মিস করেছি লেখকের সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ উপন্যাসের স্বপ্নালু টোনটা। তব��� সেটা সুহান রিজওয়ান পুষিয়ে দিয়েছেন পরিপক্ক চিটাইঙ্গা আর চাকমা ডায়ালেক্টের মাধ্যমে। আর অসমতল ফুটবল মাঠে খেলার ধারাবর্ণনা দিয়েছেন এমনভাবে যেন স্ক্রিনপ্লের মতো সব পাঠকের চোখের সামনে চলে আসে!

এই বইয়ের সবচেয়ে সুন্দর অংশ শেষের অধ্যায়। অসাধারণ দক্ষতায় লেখক খানিকটা ধোঁয়াশা রেখে বাস্তবতার নিরিখে সমাপ্তি টেনেছেন! এরচেয়ে ভালো কোনো পরিশেষ আমি কল্পনাও করতে পারিনা!

সবশেষে বইয়ের কাভারের কথা আলাদাভাবে না বললেই নয়। প্রথম দর্শনে বুঝতে পারিনি চারকোনে চারটে প্যারাবোলা আর মাঝের মোটা দাগের দুইপাশে খালি পা আর বুটজোড়া দিয়ে ইলাস্ট্রেটর কি বুঝাতে চেয়েছেন। আরেকটু মনযোগ প্রয়োগ করে বুঝতে পারি পুরো প্রচ্ছদটা আসলে একটা ফুটবল মাঠ! এতো চমৎকার আইডিয়া অংকনের জন্য প্রচ্ছদশিল্পী ইশতিয়াক আহমেদ অর্ণবকে ধন্যবাদ দিতে হয়!

সুহান রিজওয়ানকে নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলার নাই। সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ উপন্যাসের মাধ্যমে ইতিহাসের আনসাং হিরোকে তুলে এনে ইতোমধ্যে যথেষ্ট ধন্যবাদ কুড়িয়েছেন। পদতলে চমকায় মাটি উপন্যাসে সময়ের দাবী মেনে এমন একটি সেন্সেটিভ ইস্যুকে তুলে এনেছেন যার জন্য শুধুমাত্র ধন্যবাদ দিলেও কম হয়। হি ডিজার্ভস অ্যা স্ট্যান্ডিং ওভেশন ফর দিজ মাস্টারপিস!

Profile Image for Amit Das.
179 reviews117 followers
April 5, 2021
তিনশ পঁচাত্তর পৃষ্ঠার অনবদ্য এক উপন্যাস।
গল্পের বুনন কিংবা ভাষার ব্যবহারে সুহান রিজওয়ান কতটা পরিশীলিত, তা তার লেখার যেকোনো অংশ পড়লেই আন্দাজ করা যায়। গত বছর লেখকের প্রথম উপন্যাস 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ' এর এক-তৃতীয়াংশ পড়া যখন শেষ করি, তখনই তার দ্বিতীয় এই উপন্যাস পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, এবং সেটি যে কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল তা উপন্যাসটি শেষ করার পর আবারও বুঝতে পারলাম।
শেষমেষ বলতে চাই- ক্ষ্যাপাটে এক ফুটবল কোচ, তরুণ এক ফুটবলার, একবিংশ শতাব্দীর ঘুণে ধরা কিছু যুবক এবং পাহাড়ঘেরা এক জনপদকে নিয়ে সুহান রিজওয়ান যে চতুষ্কোণ এঁকেছেন, তার প্রশংসা করতে একটা উপমাই ব্যবহার করতে হয়- অনবদ্য!
Profile Image for Amlan Hossain.
Author 1 book67 followers
February 22, 2019
আগেই বলে রাখছি এটা ঠিক কোনো প্রথাগত রিভিউ নয়, বরং তাৎক্ষণিক পাঠপ্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে।

প্রচলিত ধারণা সম্ভবত এটা, একজন লেখকের জন্য প্রথম বই লেখাটা সবচেয়ে কঠিন। তবে আমার কাছে মনে হয়, দ্বিতীয় বইটাই তার জন্য সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। বই অনেকেই লেখেন, হৃদয়ের কথা বলতেও কমবেশি সবাই ব্যাকুল থাকেন। প্রথম বইয়ে সেসবই বলে ফেলা যায় নিঃসংকোচে। তবে দ্বিতীয় বইয়ে সেই বলাতে ভর করতে পারে একটু দ্বিধা, লেখক হয়ে ওঠার পাথুরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের কথা বলাটাই তখন ভীষণ দুরুহ একটা কাজ।

প্রথম বই হিসেবে সাক্ষী ছিল শিরোস্ত্রাণ কেমন পাঠকপ্রিয়তা হয়েছে, সেটা বলার বোধ হয় অপেক্ষা রাখে না। তবে দ্বিতীয় বইতে আমরা আবিষ্কার করি অন্য এক লেখককে। প্রেক্ষাপটের কারণে এই উপন্যাসে আবেগের তারে টোকা দেওয়ার কাজটা ঠিক সহজ নয়। আগের বইতে তাজউদ্দিন আহমেদের সেই আখ্যানে বঙ্গবন্ধু, শহীদ জননী থেকে শুরু করে আমাদের সব পূজনীয় ব্যক্তিরা ছিলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের নিস্তরঙ্গ নদীতে সেই বই পড়লে একটা আবেগের ঢেউ উঠবেই। লেখকের ভাষাও ছিল সেই আবেগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কিছুটা তরল। তবে ‘পদতলে চমকায় মাটিতে’ বাঙালি হিসেবে নিজেদের নিয়ে শ্লাঘা বোধ করার মতো এমন কিছু নেই। একজন পাহাড়ি ফুটবলার-লাল পাহাড় থেকে সবুজ মাঠে আসতে যাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে রক্তমাখা পথ, অস্তিত্ববাদের সংকটে ভোগা একজন ভার্সিটিতে পড়ুয়া হীনমন্য যুবক, একজন খ্যাপাটে স্বপ্নবাজ ফুটবল কোচ, আর তাদের ঘিরে কিছু পলায়নপর লোক- ব্যস, এই তো! আগের উপন্যাসের মতো এবার মহৎ বা কীর্তিমান কোনো প্রধান চরিত্র নেই।

তাহলে এই উপন্যাসের ভেতর কী আছে? প্রথম লাইন থেকেই আছে প্রবলরকম একটা অস্বস্তি। ‘কমফোর্ট জোনের’ বাইরে গিয়ে রঙিন চশমাটা খুলে ফেলে অন্য একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। সেজন্য এই বইটা ঠিক চট করে তারিয়ে তারিয়ে পড়ার মতো নয়। সমর কুমার চাকমা, আরিফ, হিমেল , বিজন দেওয়ান বা শামীম আজাদরা প্রতিটা মুহূর্তেই পাঠকের উরুসন্ধি বরাবর কেমন যেন একটা খোঁচা দিয়ে যান। তবে চিন্তাশীল পাঠক সেই অস্বস্তির কাঁটা নিয়েই পড়ে যাবেন, সেটি নিশ্চিত।

খানিকটা পড়তে পড়তেই উন্মার্গিক ঢাকা শহর থেকে সেই যাত্রায় চলে যেতে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে। পর্যটকদের কাছে এই জায়গার এখন অনেক কদর, সাইড়ু, সাজেকের সুবাদে সেখানে এখন চেকিনগুনিয়ার দাপটও কম নয়। এসব বাদ দিয়ে পাহাড়ের ভেতর ট্রেকিং করতে গিয়ে একদম গহীনেও গেছেন অনেকে। নিজেরও কয়েকবার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটির সুবাদে পাহাড়ের মানুষদের সঙ্গে অল্প বিস্তর সুখ দুঃখের কথা বলেছি। এই উপন্যাসের বেশ কিছু অংশের সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে তাই সমস্যা হয় না। শান্ত সমাহিত জনপদের বাইরেও মরমে মরে যাওয়া যে অন্যতর পাহাড়, সবুজের আড়ালে রক্তে লাল হয়ে যাওয়া পাহাড়ের খবর আসলে আমরা কয়জন জানি? বা জানলেও সেটা আমরা গা করি কজন? ওই তো একুশে ফেব্রুয়ারি এলে হয়তো ওদের মাতৃভাষা নিয়ে এক দুইটা ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করি, এক দুইটা রেপ হলে হয়তো এক দুইটা হ্যাশট্যাগ দিই, লংগদুতে ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলে হয়তো কিছু স্যাড রিঅ্যাকশন দিয়ে আসি- এই তো। তাও তো ফেসবুক-ইউটিউব এসে কিছু জানতে পারছে অনেকে, আগে তো এসব চাপা পড়ে যেত জলপাই বর্মের আড়ালে।

দুই মলাটে সমর, বিজয় দেওয়ানদের গল্প পড়তে গিয়ে তাই প্রবল একটা ঝাঁকি খাই। এর মধ্যে ফুটবল এসে দুদন্ড শান্তি দেবে বলে মনে হয়, লেখকের বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাসও হয়ে ওঠে বাঙময়। তবে দলাদলি, নোংরামি এখানেও আছে, তার ভেতরেই লড়ে যেতে হয় সমর আর শামীমদের। এখানে যেন কিছুটা মতি নন্দীর সেই ফ্লেবারটা পাওয়া যায়। তবে সন্তর্পণে বুঝে যেতে হয়, ফুটবলটা এখানে নিছকই একটা ক্যামোফ্লাজ।

খানিক পড়েই তাই শান্তিপ্রিয়ার জন্য মনটা উতলা হতে থাকে, জানতে ইচ্ছে করে বিজয় দেওয়ানদের জামিনে ছেড়ে দেওয়া হলেও জানে বাঁচতে দেওয়া হবে তো? আনসার আলীদের মতো পাহাড়ে পাকিপনা করনেওয়ালা অনেকে আছেন, তারা কি জুমঘরে আগুন লাগিয়েই যাবেন? এমন অস্বস্তি, চাপা আতঙ্ক আর উদ্বেগের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে পদতলে চমকায় মাটি।

এর মধ্যেই উঁকি দিয়ে যান হারিয়ে যাওয়া সেই কল্পনা চাকমা, বন্দুকযুদ্ধে নিহত রক্তাক্ত মানবেন্দ্র লারমার লাশ। ও হ্যাঁ, এক ফাঁকে দেখা দিয়ে যান পাইপ টানা মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নামের লোকটাও। পাহাড়ের জন্য যাঁর মমতা ছিল অসীম, লোগাং গণহত্যার ঠিক পরে যিনি নিজেই ছিলেন পাহাড়ে। লেখকের করোটিতে ইলিয়াস বেঁচে থাকেন আশ্চর্য সজীব হয়ে। মনোরম মনোটোনাস ঢাকা শহরের বর্ণনায় ইলিয়াসের সেই ছায়া আরও ভালোভাবে টের পাওয়া যায়, চিলেকোঠার সেপাই বা খোয়াবনামার মতোই যেন চাবুক মারতে থাকে পদতলে চমকায় মাটি; আমাদের ভীষণ অস্বস্তিকে সঙ্গী করে, আমাদের চেনা জগতের আরও সব ভণ্ডামির মুখোশ খুলতে খুলতে। এই মানদণ্ডে অন্তত, পদতলে চমকায় মাটিকে তাই উপেক্ষা করা যায় না। কমফোর্ট জোনের বাইরে বেরিয়ে আসার এই চেষ্টা এই সেলফিসর্বস্ব যুগেই বা কম কী?
Profile Image for Rifat.
501 reviews329 followers
August 25, 2022
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ডিসেম্বরের ২ তারিখে, ১৯৯৭ সালে- এই লাইনটা আমি হাউকাউ করে মুখস্থ করেছিলাম মাত্র (!) ১১ বছরে আগে, ২০১১ সালে। এইসব শান্তির চুক্তি ঠিক কতটা শান্তি ফলাচ্ছে তা আমার ধারণার বাইরে (কেননা আমি একেবারেই অতিরিক্ত নির্ভেজাল মানুষ, সকালে খাওয়ার পর দুপুরে কী খাবো সেটাই হচ্ছে আমার গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার একটা) বইটির শুরুতে সমর বাসে করে শান্তিপ্রিয়ার সাথে সফর শুরু করে, একই সাথে পাঠকরাও সঙ্গী হয় এই ধীরগতির লোকাল বাসের! কখনও টিএসসি, কখনও শাহবাগ, কখনও বলের সাথে গড়িয়ে যাওয়া ফুটবলের মাঠ কিংবা কখনও বা চট্টলার পাহাড়ি রাস্তা: বাস লোকাল না হয়ে আর যাবে কই!?

ফ্ল্যাপ বলছে -
''একবিংশ শতাব্দীর ঘুণে ধরা কিছু যুবক।
ইতিহাসের ক্রমাগত ট্যাকলের বিপরীতে খেলে যাওয়া তরুণ এক ফুটবলার।
ক্ষ্যাপাটে এক ফুটবল কোচ।
একটি পাহাড়ঘেরা জনপদ,পরাবাস্তবের চেয়েও নাটকীয়তায় পূর্ণ যার ইতিহাস এবং বর্তমান।
উপন্যাস ‘পদতলে চমকায় মাটি ’ ধরতে চেয়েছে এই চতুষ্কোণ।''

আর যার ফলে উঁকি দিয়েছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত কিছু যুবক- হুট করে যাদের রক্ত অন্যায় দেখে হঠাৎই ছলকে ওঠে; দেখা গেছে চবির সমর চাকমাকে- ফুটবলের স্বপ্নে বিভোর থাকা যুবক যাকে কিছু তীক্ষ্ণ কাঁটাওয়ালা বুট আহত করে বেড়ায় প্রতি মুহূর্তে; একই সাথে দেখা দেয় দুর্নীতি আর মুচড়ে যাওয়া স্বপ্ন আর বইয়ের পুরোটা জুড়ে চট্টগ্রাম-পাহাড় হাতছানি দিয়ে গল্প শুনতে ডাকে...


পদতলে চমকায় মাটি বাংলাদেশের মানুষের জীবনের পরিশীলিত গদ্যের চিত্রকথন। অতীত কিংবা বর্তমান যাই বলি না কেন! যার কারণেই পাঠকের সফরসঙ্গী শান্তিপ্রিয়ার আর কারও প্রিয়া হয়ে ওঠা হয় না, সে হারিয়ে যায় তথাকথিত শান্তির আড়ালে; কিছু স্বপ্ন পথেই পড়ে থাকে, তার ব্যাপারে আর কিছু জানা যায় না; যুবকের ছলকে ওঠা রক্তও হঠাৎই ভয়ে ভয়ে স্থির হয়ে যায়, অতীত কৃষ্ণ গহবরের রূপ নেয়। আর এসবের সংস্পর্শ পেয়ে পায়ের তলায় একটু পরপরই এদেশের মাটি চমকে চমকে ওঠে!

বইটা কিনেছিলাম প্রায় দু'বছর হয়। অনেক দেরি করে পড়লাম, শুরুর সময় মনে হয়েছিল একটি বিগ প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। স্লো লাগলেও বইটা পড়া শেষ করে একটা অন্যরকম ভাল লাগা কাজ করলো! বইয়ের এমন সুন্দর নামের জন্য এমনিই কেনা যায় (লেখককে ধন্যবাদ এই নামের জন্য) বইটা সম্পর্কে জানি গুডরিডসেই থেকেই, তখন হুট করে নাম আর প্রচ্ছদটা দেখে ফ্ল্যাশ ব্যাকে চলে গিয়েছিলাম- একটি বাচ্চা মেয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে খালি পায়ে দৌড়াচ্ছে, শীত আসি আসি করছে, পায়ে তার হালকা শিশির ভেজা মাটি চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে...

(আহা অনুভূতি!
Lord, I'm one, Lord, I'm two
Lord, I'm three, Lord, I'm four
Lord, I'm five hundred miles away from home!)

~২৫ আগস্ট,২০২২
Profile Image for Farzana Raisa.
530 reviews237 followers
February 28, 2023
ডিয়ার সুহান রিজওয়ান.. হ্যাটস অফ! এতো সুন্দর এবং পারফেক্ট এন্ডিং বোধহয় আর হয় না। বিভ্রান্ত আরিফ, নিজেকে খুঁজে ফিরতে থাকা সমর কুমার চাকমা, হতাশায় ডুবে যেতে যেতে খড়কুটোর মতো দুবলা পাতলা একটা দলকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাওয়া কোচ শামীম আজাদ কিংবা রাজনীতিসচেতন একই সাথে পলায়নপর মানসিকতার হিমেল-এরা সবাই যেন এসে মিশেছে একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে। এরকম 'স্টপ মোমেন্ট' সাধারণত সিনেমাগুলোতে দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু বইয়ে? এভাবে! জাস্ট ওয়াও।
পুরো বইটা একটা বিশাল জার্নি। বাংলাদেশের কোন সমস্যাটা উঠে আসে নাই এখানে! ২০২০ সালে বইটা কিনলেও পড়তে পড়তে বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেল। বইটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুগ্ধতা। প্রচ্ছদ থেকে শুরু.. এরপর মুগ্ধতা কেবল বেড়েই চলে। লেখক গল্পচ্ছলে বিবরণীর মাধ্যমে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন আমাদেরকে। গ্যালারিতে বসে থাকা আরিফ কিংবা সমর কুমার চাকমার মত বলের বদলে বইটাকে সামনে রেখে আমিও এখন দ্বিধাবিভক্ত।
Profile Image for Samira Saba.
2 reviews1 follower
February 26, 2019
#rant
#notabookreview
#ijustneedtogetitout

শান্তি চুক্তি যখন সাক্ষরিত হয়, আমার সাত বছর বয়স। অবাক হয়েছিলাম, একটা স্বাধীন দেশে নিজেদের লোকের মধ্যে কেন এমন চুক্তি লাগবে। মা অল্প কথায় বোঝানর চেষ্টা করেছিল main issue গুলো কি। খুব যে বুঝলাম তা না।

ক্লাস আইটে পড়ি তখন, এক বন্ধু বলেছিল, ওর বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশা করা ওর দাদার একদম পছন্দ না। উনি বাঙালিদের একদম বিশ্বাস করেন না। খুব অবাক হয়েছিলাম শুনে। I wondered if he was holding a grudge, এখনতো সব ঠিক হয়ে গেছে।

আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি? চিন্তা না করেই বলেছিলাম, আমরা বাঙালি, বাংলাদেশি বলে কেন মানুষ। পাশ থেকে বন্ধুটি নিচু গলায় বলেছিল আমি বাঙালি না। খুব বোকা মনে হয়েছিল নিজেকে তখন।

আরও বছর খানেক বাদে জানতে পারলাম কাপ্তাই বাঁধ বানানোর সময় আদিবাসীরা কি পরিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। That's when I realised if my friend's grandpa doesn’t believe us it makes absolute sense.

পত্রিকায় প্রকাশিত পাহাড়ের খবর পড়েছি শুধুমাত্র যখন headline হয়েছে। এর বাইরে কখনও খবর নাওয়ার চেষ্টাও করিনি। অথচ এই পাহাড়ে কতবার বেড়াতে গিয়েছি।

I couldn’t read পদতলে চমকায় মাটি at one go. It was traumatic. I felt small. I felt ashamed. I felt fury. I felt helpless. I also understood the roots of the problem run deep. পাহাড়ে শান্তি আসতে এখনও অনেক দেরী।

On a different note, writing a novel about two completely different issues (football and peace in hill tracts) and threading them together so effortlessly isn’t something any writer can do. Shuhan Rizwan keeps his emotions at bay. He illustrates the perspective of different stakeholders and let the readers decide what is just. Rather than telling the readers what to think, he ignites their thoughts, fuels a healthy debate.

On a lighter note, it felt good to see one of my favourite writers, Shahriar Kabir being mentioned in the book. রাজধানী ইউনাইটেড, was that a salutation to Manchester United? And I laughed each time the names গম পার্টি and বৈঠা দল came up.

This ended up being a half baked book review.
Profile Image for Kamruzzaman Kamrul.
16 reviews22 followers
February 21, 2019
"খেলে যায় পদাতিক" পড়া হয়েছিলো বেশ আগে, চার পাঁচ হয়ে গেছে বোধ করি। সুহান ভাইয়ের কল্যাণে পিডিএফটা আগেই পেয়ে গিয়েছিলাম, ঠিক টানা পড়ে শেষ করা হয় নি, মধ্যে সপ্তাহ দুয়েকের একটা বিরতি ছিলো।

কিছু সংস্কার এবং পরিমার্জনার পরে বইটি "পদতলে চমকায় মাটি" হিসেবে বইমেলায় এসেছে। নতুন নামটি আগের নামের চাইতে ভালো লেগেছে।

গল্পের প্রধান চরিত্র সমর চাকমা, শুরুতেই একটু ধাক্কা খেতে হয় বৈ কি। এতো মানুষ থাকতে, সমর চাকমাই কেনো? সমর চাকমার কি গুণ আছে মূল চরিত্র হবার? সে ভালো ফুটবল খেলে, আর কিছু কি? বোধহয় নায়কোচিত ব্যাক্তিত্ব বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা তার নেই। তবে সমরের আছে ইতিহাস, যেখানে সে অনন্য। তার ছোটবেলা, কৈশোর কিংবা তরুণ বয়সের সম্পূর্ণ সময়টাই তাকে আলাদা করেছে তার পেছনের গল্পগুলোর জন্য, ফুটবলটা নিতান্তই তার চরিত্র বিকাশের একটা আশ্রয় ছাড়া কিছু নয়। তবে তাতে ফুটবলের গুরুত্বটা কিছুমাত্র কমে নি, বরং সময়ে সময়ে মোচড় নিয়ে এসেছে, কাহিনীকে টেনে নিয়ে গেছে তরতরিয়ে।

এ উপন্যাসে লেখক খুব শক্তিশালী স্পষ্ট কোনো বার্তা দিতে চান নি। বরং আমাদের দৈনিক জীবনেই আমরা যে দ্বৈততার মুখোমুখি হই, ভালো-খারাপের মধ্যে যে টানাপোড়ন চলে, তার মধ্যেও আবার যে আমরা কখনো কখনো সাহসী হয়ে উঠি, আবার পলায়নপ্রবৃত্ত হয়ে মুখ লুকাই, সবই আছে। নিজের অতীতকে ভুলে যাবার জন্য অনুশোচনা তাড়া করে, আবার বর্তমানকে সম্পূর্ণ আঁকড়ে ধরতে না পারার জন্য আফসোস কাজ করে। পুরো উপন্যাসটায় এ বিষয়টি ভারী স্পষ্ট, আমজনতার মানসিকতার দোদুল্যমান অবস্থা। আমরা একই সাথে সংগ্রামী আবার ভীতু, বিপ্লবী কিন্তু স্বার্থপর, তারুণ্যের দীক্ষামন্ত্রে উজ্জীবিত, কিন্তু একই সাথে গা জোয়ারি। সর্বত্রই আমরা যে দীনতা আর উদারতার এক অদ্ভুত ভারসাম্য মেনে চলি, সেটা ফুটে উঠেছে বারবার।

উপন্যাসটি পড়লে হয়তো আপনি পাহাড়ে আদিবাসীদের কিছু গল্প জানবেন। সমসাময়িক সময়ের মানুষের চিন্তাভাবনা সাথে নিজের সামঞ্জস্য আবিষ্কার করবেন, শহুরে হতে চাওয়া, কিংবা মাটি আঁকড়ে ধরে রাখা কিছু মানুষের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া সম্পর��কে অবগত হবেন। তবে এ সবই সম্ভবত আমাদের চিন্তার জায়গাটা একটু ধরিয়ে দেবার জন্য, নাড়া দেবার জন্য, কিংবা একটু এগিয়ে দেবার জন্য। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম, আমি আমার মত করে তোমাকে দু'চার কথা বলেছি। তুমি বাবা এবার কি করবে, পড়বে, চিন্তা করবে, সেটা তোমার নিজের ওপর নির্ভর করে, তোমার উপরেই ছেড়ে দিলুম!

উপন্যাসটি সুখপাঠ্য। তবে উপন্যাসভঙ্গির কারণে মাঝখানে বিরতি পড়লে ধারাবাহিকতা হারিয়ে যাবার শংকা কাজ করে না। বেশ কিছু স্থানের ভাষা, অনুচ্ছেদ দীর্ঘ মনে হয়েছে, প্রথম দু'লাইন আর শেষ দু'লাইন পড়ে ইস্তফা দেবার মত, কাহিনীর ধারাবাহিকতা কিছু স্থানে এলোমেলো মনে হয়েছে। লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস দ্বারা ভয়াবহ প্রভাবিত, এটা সম্ভবত ব্যাক্তিগত পরিচয় না থাকলেও অনেকেই ধরে ফেলতে পারবেন।

সবচাইতে চমৎকৃত হয়েছি সমসাময়িক সময় থেকে ভিন্ন সময়রেখার স্মৃতি ভ্রমণে, ঠিক রাস্তাতে হাটতে গেলে আমরা যেভাবে সময়ের মধ্যে ভ্রমণ করি, উপন্যাস পড়তে গিয়ে নিজের সেই অনুভূতিটা তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করেছি, চিন্তাচ্যুত হইনি একবারও। এই দিক দিয়ে ভারী চমৎকার হয়েছে বিষয়টি!

উপন্যাসের সমাপনী ভারী সুন্দর। ছোট বড় অনেকগুলো চরিত্রের আরেকটু ডেভেলপমেন্ট আশা করেছিলাম, শান্তিপ্রিয়ার মত শান্তি প্রিয় মানুষদের চাইতে অন্যদের বিস্তারে একটু দুঃখ পেয়েছি বৈ কি।

সুহান ভাইয়ের প্রথম উপন্যাসের সাথে এই উপন্যাস আসলে তুলনা করা যায় না। প্রথমটি এক রকমের, এক ধাঁচের, এটি পুরোই আরেক ধাঁচের, প্রথমটি সম্পর্কে তাও বেশ কিছু জায়গাকে টেক্সটবুক স্পিচ ডেলিভার করা যেত, এটার সম্পর্কে কিছুই বলতে পারা যাচ্ছে নি। বৈচিত্র্যের প্রত্যাশা থাকলে পাঠক হতাশ হবেন না।
Profile Image for Titu Acharjee.
258 reviews34 followers
August 30, 2020
এই বইয়ে লেখক এমন এক সময়ের গল্প, সুদূর পাহাড়ের এমন এক চেপে রাখা ইতিহাসের গল্প শুনিয়েছেন যেটা শুনতে শুনতে এতোদিনের অনেক ধারণাই ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছিল।

Highly Recommend
Profile Image for Fahim.
35 reviews47 followers
March 9, 2019


Football, it hurts and humbles. For every winner, a loser. For every triumph a defeat. But on the horizon awaits a new season, a new opportunity, a redemption for glory, for immortality. The brave will take to the pitch as warriors to battle, shoulder to shoulder, face to face. The hunger, the determination to push limits, to fight, to run, tackle, defend, attack, score and celebrate.



বইয়ের প্রচ্ছদ বেশ চমকপ্রদ। পাতাজুড়ে স্টেডিয়াম। যেকোন স্টেডিয়ামই হতে পারে, তবে মাঝে সেন্টার লাইন দেখে বোঝা যায় - ফুটবল স্টেডিয়ামই হবে। লাইনের দুপাশে একজোড়া করে পা, একদিকে খালি পায়ের ছাপ, অন্যদিকে বুটের। চমকায় এর "য়" এর ফুটকি আঁকা ফুটবলে। মাটির "ট" এর উপরে "এটাকে-কী-বলে-ভুলে-গেছি" যেন শটগানের মত তাক করা। আন্দাজ করি বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য নিশ্চয়ই ফুটবল। তবে খটকা লাগে এক পাশে বুটের অনুপস্থিতিতে। তবে কি অসম এই প্রতিযোগিতা? সুবিধাবঞ্চিতের সাথে সুবিধাভোগীর লড়াই? বুট বনাম নগ্ন পায়ের যুদ্ধ? ফুটবল মাঠ থেকে চলে যাই বইয়ের ফ্ল্যাপে।
 … ঘুণে ধরা কিছু যুবক। তরুণ এক ফুটবলার। ক্ষ্যাপাটে কোচ। পাহাড়ঘেরা জনপদ। পদতলে চমকায় মাটি ধরতে চেয়েছে এই চতুষ্কোণ।
খুব বেশি কিছু স্পষ্ট হয় না। আবার একটা আবছা আদলও ধরা পড়ে। ঢুকে পড়ি মূল গল্পে।

প্রথম কয়েকপাতা পড়েই আবিষ্কার করি লেখার আদল বেশ চেনা চেনা ঠেকছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেক লেখকদের সহজ সরল ভাষায় কাহিনী বলে যাওয়ার প্রবণতা থেকে এ একটু আলাদা। সবাই যখন অনুকরণ করতে চায় হুমায়ূন আহমেদের সাবলীলতাকে, সুহান রিজওয়ান তখন বেছে নিলেন আরেক শ্রেষ্ঠকে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আদলে দীর্ঘ বাক্যগঠন, অ্যাটেনশন টু ডিটেলস আর শব্দের জাদুতে পরাবাস্তব এক জগতে পাঠককে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। সচেতনে কিংবা অবচেতনে। সৈয়দ শামসুল হক 'মার্জিনে মন্তব্য'তে দেখিয়েছিলেন ক্রিয়াপদের কালরূপ সৃষ্টি করতে পারে যাদু। একই গল্প একই লেখা ভিন্ন ক্রিয়াপদের কালরূপে লিখলে বদলে যায় এর ধরন, এর স্বাদ, এর গতি। বহুল ব্যবহৃত সাধারণ অতীত যেমন: সে করল, সে গেল, সে দেখল - এর পরিবর্তে সুহান রিজওয়ান লিখলেন নিত্যবৃত্য বর্তমানকে সঙ্গী করে - সে করে, সে যায়, সে দেখে।
উপন্যাসের নামটিও তেমন - পদতলে চমকায় মাটি। সৈয়দ হক বলছেন, নিত্যবৃত্য বর্তমান যেন অনেকদূর পর্যন্ত ধাবিত হচ্ছে, একটা দীর্ঘশ্বাস যেন এর ভেতরে হাহা করছে, ধাবিত হচ্ছে অনেকদূর পর্যন্ত। ঘটনাগুলো যেন মাত্র ঘটলো তা নয়, আগেও ঘটেছে, এখন ঘটছে এবং আগামীতেও ঘটতে পারে কিংবা ঘটবে। পুরো উপন্যাসের মূল কাঠামোকে নিত্যবৃত্য বর্তমানে রাখতে লেখককে তাই যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে হয়। এর মধ্য থেকেই বের করে আনতে হয় সংলাপ, সাধারণ অতীত কিংবা ঘটমান বর্তমানের নানা কার্যকলাপ। এর সাথে উপমার মেলবন্ধন তো আছেই। তাই ল্যাম্পপোস্টের স্লিভলেস আলো মূর্ত হয়ে ওঠে পাঠকের কল্পনায়, কিংবা কনডেন্স মিল্কের টিনের কৌটা থেকে ঝনঝন শব্দের পাশাপাশি একগুচ্ছ অনুভূতি বেরিয়ে আসলেও খাপছাড়া লাগেনা মোটেই। গদ্যের জাদু বোধহয় এখানেই। বাক্যের আকাঙ্ক্ষা, আসত্তি আর যোগ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঠিকই জায়গা করে নেয় পাঠকের হৃদয়ে।

উপন্যাসের শুরু সমর চাকমা আর শামীম আজাদের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। ফ্ল্যাপে বর্ণিত চরিত্রদের মধ্যে দুজন প্রথম পাতাতেই উপস্থিত। পুরো উপন্যাস জুড়েই শামীম আর সমরের ভূমিকা গুরু শিষ্য হিসেবেই। সমর কি নায়ক এই উপন্যাসের? যারই পদতলে চমকায় মাটি? হয়তো বা। তবে শুধু সমরের কাঁধে এই নায়কত্বের ভার তুলে দিলে ভুল হবে। রাঙামাটির রানি দয়াময়ী স্কুলের মাঠে মনের আনন্দে ফুটবল খেলে বড় হওয়া সমর চাকমার জন্য ঢাকার ফুটবলে এসে - এলাম, দেখলাম, জয় করলাম - ব্যাপারটা মোটেই এমনটা ছিল না। সবসময় তাকে তাড়া করে ফেরে বাবা রতন চাকমার ওপর নির্যাতনের স্মৃতি, তার ফেলে আসা অতীতের কথা। আবার সময়ে সময়ে শান্তিপ্রিয়া "চোরাগোপ্তা ফাউল" করে যায়। গল্পের বয়ান সমরের মুখে হতে পারত। কিন্তু তার বদলে আমরা দেখি শহুরে দুই যুবকের চোখে পার্বত্য চট্টগ্রামকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনার উচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে তারা আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় তেতো সত্যের মুখোমুখি - পার্বত্য চট্টগ্রাম ভাল নেই। হুমায়ূন আজাদ তাঁর বইয়ের শিরোনামেই বলে গিয়েছিলেন সে কথাটি - পার্বত্য চট্টগ্রাম, সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা। সেই হিংসা জন্ম দিয়েছে কলমপতি, লোগাং গণহত্যাসহ আরও অনেক রক্তপাতের, সামরিক বাহিনী বনাম শান্তিবাহিনীর সংঘর্ষে হতাহত হয়েছে অসংখ্য প্রাণ। লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, অপহরণ - বাদ যায়নি কিছুই। আরিফ আর হিমেলের সত্যান্বেষণের সঙ্গী হয়ে আমরাও যেতে থাকি পাহাড়ের অনেক গভীরে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ গুজে থাকা আমাদের এই প্রজন্মের প্রতিনিধি আরিফের যেন পুনর্জন্ম হয় পাহাড়ে এসে। বিজয়ের জন্য কিছু করতে না পারার অক্ষমতা কিংবা পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভের উদগিরণ স্পর্শ করে যায় আমাদেরও। গা-বাঁচিয়ে-চলা মধ্যবিত্তের খোলস ঝেড়ে ফেলে আরিফ নিজেকে খুঁজে পায় বটে কিন্তু হিমেল রয়ে যায় সেই গন্ডিতেই। অন্যান্য চরিত্রদের মধ্যে শান্তিপ্রিয়া, মুনা এরা সামনে আসে নি কখনোই, কিন্তু অস্তিত্বের জানান দিয়ে গেছে ঠিকই। সমর খুঁজেছে শান্তিকে, কিন্তু সে শান্তি এত সহজে দেখা দেবার নয়।

উপন্যাসের মাঝে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উঠে আসা জন্ম দিয়েছে অন্যরক�� ভালোলাগার। তবে নির্ঘণ্টতে ইলিয়াস আর মিহির সেনগুপ্তের এই কথোপকথনের একটা রেফারেন্স উল্লেখ করে দিলে মন্দ হত না।
নূর হোসেনের উল্লেখ পার্বত্য চট্টগ্রামের কনটেক্সটে না হলেও মনে করিয়ে দেয় শাসক শ্রেণীর পেটুয়া বাহিনীর কথা যা কিনা এখনো ভয়ংকর প্রাসঙ্গিক। নিরাপদ সড়ক কিংবা কোটাবিরোধী আন্দ‌োলনে পুলিশের যে ভূমিকা আমরা দেখেছি, সুহান স্মরণ করিয়ে দেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই, বদলায়নি কিছুই, বদলাবেও না হয়তো। একই ক্যানভাসে অতীত এবং বর্তমানকে ধরতে চাওয়ার প্রচেষ্টায় লেখক সফল। শাহবাগের উত্তাল সময়, গণজাগরণ মঞ্চ, অভিজিৎ রায়সহ ব্লগারদের হত্যা - এসবের স্মৃতি তো এখনো টাটকা। নিজেকে সংযুক্ত করতে পারি খুব সহজেই, চোখের সামনেই যেন দেখতে পাই।


উপন্যাসের সমাপ্তিটা আশা করছিলাম নাটকীয় কিছু হবে। কিন্তু এখানেও লেখকের ক্যারিশমা, টিকিটাকার স্লো বিল্ডাপে একে একে আরিফ, শামীম আজাদ, মহানগর ক্রীড়াচক্র সবাইকে মাঝমাঠের ওপরে তুলে বল ঠেলে দিলেন সমর কুমার চাকমার পায়ে। সমরের পেছনে অদৃশ্য সমর্থনে পাহাড়ের নির্যাতিত জনগোষ্ঠী আর সামনে গোলকিপারকে পেরোতে পারলেই ভবিষ্যতের হাতছানি। কী ঘটবে, সেই কল্পনা পাঠকের হাতেই।

অনবদ্য, হ্যাটস অফ! "পদতলে চমকায় মাটি" তৈরি করে এক ঘোরের, যা থেকে যায় অনেকটা সময়, দিন, সপ্তাহ।
কর্মময় ব্যস্ত জীবনের একটু অবসরে এই ঘোর নিয়ে যায় অন্য জগতে, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে হয় যার স্বাদ।
সুহান রিজওয়ান আরো লিখুন, আরো ভাল লিখুন, "সবকিছু নষ্টদের অধিকারে" যাবার আগেই এমন লেখা আমাদের বড্ড দরকার।

পুনশ্চ: লেখার শুরুতে দেয়া কোটেশনটা FIFA 14 গেমের ট্রেলার থেকে নেয়া। আলোচ্য উপন্যাসের সাথে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় সংযুক্ত করে দিলাম।
Profile Image for Shotabdi.
818 reviews194 followers
June 4, 2022
বেশ বড় ক্যানভাসের উপন্যাস। লেখক ছুঁয়ে যেতে চেয়েছেন অনেক দিক। মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ভাবনার সাথে সাথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করেছে আদিবাসী জনগণের কথা এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সম্ভাবনাময় ফুটবলার সমর চাকমার কথা।
আছে আমাদের মতো করে জেনেশুনে কিছু করতে যাওয়া, পারা না পারার দ্বন্দ্বে কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়া হিমেল বা আরিফদের কথা। যারা সচকিত, কিন্তু অসহায়।
ভাষার ধরণটা সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ থেকে একটু আলাদা। সাক্ষীরটাই বেশি ভালো লেগেছিল।
শেষটা বেশ অভিনব, ভালো লেগেছে।

ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৩.৫/৫
Profile Image for Arifur Rahman Nayeem.
205 reviews107 followers
September 30, 2024
পাঁচে সাড়ে তিন।


বইয়ে যখন উত্তপ্ত দীঘিনালার কথা পড়ছিলাম তখন ১৮ সেপ্টেম্বর সত্যিই দীঘিনালা সহিংসতার আগুনে জ্বলে ওঠে। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের সংঘাতের সময়টায় সবখানে এ বিষয়ে যুক্তি-কুযুক্তি, তর্ক-বিতর্ক চলে। এসব লক্ষ করে দেখলাম অনেকেই মনে করেন পাহাড়ে বাঙালিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, তারা সেখানে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যালঘু বলে নির্যাতিতও। কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া স্মরণকালের সবচেয়ে বড় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের ক্ষয়ক্ষতি আরও একবার সাফ সাফ অন্য কিছু বলে গেল। দৈনিক প্রথম আলোর ২১ তারিখের খবর অনুসারে সংঘর্ষে মোট ১০২টি দোকানপাটে আগুন দেওয়া হয়, যার ৭৮টি পাহাড়িদের। মারা যান চারজন। যাদের তিনজনই পাহাড়ি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে যে কয়জন আহত হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই পাহাড়ি আদিবাসী। হতাহতের ঘটনায় মামলা হলেও ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর আমরা এতদিনে নিশ্চিত হয়ে গেছি যে এসবের বিচার কোনোদিনই হয় না। ‘‘বাংলাদেশের মাটিতে বাঙালিদের সেটেলার বলার সাহস হয় কীভাবে?’’—এই প্রশ্ন তোলা এক লেখক (?) বা এমন মনোভাব পোষণ করা অসংখ্য মানুষেরা (!) নিশ্চয়ই এই সংঘাতের ফলাফলে খুব খুশি হয়েছেন! নিজেদের দল বিজয়ী হওয়ার আনন্দ নিশ্চয়ই তারা পুরোদস্তুর উপভোগ করছেন!

শ্রীহট্ট অঞ্চলের মানুষ আমি। পাহাড়ঘেরা এ অঞ্চলে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস। ফলে তাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ আমার আকসার হচ্ছে। মিশতে গেলে প্রথমদিকে আপনার মনে হবে মানুষগুলো মোটেও বন্ধুসুলভ নয়। বাঙালিদের প্রতি ওদের বিশ্বাসহীনতা ও ঘৃণা ধরতে পারা যায় অল্প চেষ্টাতেই। কারণ বুঝতে অবশ্য মাথা বেশি খাটানোর প্রয়োজন হয় না; কারও ভিটেমাটি বা জমি দখল করে নিলে, বিভিন্ন ছুতানাতায় হুটহাট বাড়িঘর পুড়িয়ে দিলে, রাষ্ট্র কর্তৃক জলপাই বাহিনী দ্বারা ঘেরাও করে রাখলে, নির্বিচারে খুন-গুম করা হলে, ন্যায়বিচার না পেলে, সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছ থেকে কোনোদিন দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না মিললে—এই অবিশ্বাস ও ঘৃণা আমার কওমের মানুষদের প্রাপ্য নয় কি?

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমার আগ্রহ ‘পদতলে চমকায় মাটি’ পড়ার প্রধান কারণ। এ অঞ্চল সম্পর্কে কিছুই না-জানা কারও মনে যে যে ধরনের জিজ্ঞাসা আছে, সে সব কিছুর উত্তর খুঁজে নেওয়া যাবে উপন্যাস থেকে। লেখার জন্য লেখক যে বিস্তর খেটেছেন তার প্রমাণ উপন্যাসের পরতে পরতে। সুহান রিজওয়ান পাহাড়ে সর্বদা বিরাজমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণ আদিবাসী, বাঙালি, শান্তিবাহিনী, সেনাবাহিনী—সবার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন। বিষয়বস্তু, বস্তুনিষ্ঠতা এবং লেখকের সৎ ও নিরপেক্ষ থাকার জন্য উপন্যাসটি পাঁচে পাঁচ পাওয়ার হকদার।

কিন্তু...

অনলাইনে পড়া সুহান রিজওয়ানের লেখাজোখা থেকে তাঁর গদ্যভাষা নিয়ে আমার যে উঁচু ধারণা তৈরি হয়েছিল সেদিক থেকে ‘পদতলে চমকায় মাটি’র গদ্যশৈলী খুবই সাদামাটা লাগল। তারপর ধরো, লেখক চরিত্রের মনোজগৎ বর্ণনায়, ভাষায় (কিছুটা), বয়ান ও বিন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত বলে মনে হলো। ইলিয়াসের লেখায় প্রচুর স্ল্যাং থাকত। সুহানের এ ইচ্ছা থাকলেও তিনি কেবল হারামজাদা, শালা, শুয়োরের বাচ্চা ও বাল পর্যন্তই যেতে পেরেছেন। মানে বলতে চাচ্ছি, ইলিয়াসের মতো ‘কড়া’ হয়নি জিনিসটা। পূর্বসূরি লেখকের প্রভাব উত্তরসূরী কারও লেখার মধ্যে থাকাটা মন্দ কিছু নয়। তবু আমার কেমন যেন একটু ‘ইয়ে’ লাগল আরকি! ৩৭৫ পৃষ্ঠার বইটাকে অনায়াসে ৩০০-৩২০ পৃষ্ঠায় নামিয়ে আনা যেত গল্পের কিছুমাত্র ক্ষতি না করেই, আর তাতে বরং বইটা গতিশীল হতো আরও বেশি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও মিহির সেনগুপ্তের ক্যামিও ব্যক্তিগতভাবে যতই ভালো লাগুক না কেন এটা অস্বীকার করা যাবে না যে ব্যাপারটা ভীষণ খাপছাড়া হয়েছে। এ ছাড়া হঠাৎ করে সাড়ে ছয় পৃষ্ঠা বর্ণনার এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন কই থেকে টপকাল বোঝা দায়!

শেষ কথা এটাই যে কিছু খামতি থাকা সত্ত্বেও ‘পদতলে চমকায় মাটি’ গুরুত্বপূর্ণ বই।
Profile Image for Muhammad Kamruzzaman.
33 reviews9 followers
March 24, 2019
প্রথমে লেখককে নিয়ে কিছু কথা বলি। লেখক সুহান রিজওয়ান এর দ্বিতীয় বই "পদতলে চমকায় মাটি"। প্রথম বই "সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ" এর জন্যই প্রত্যাশার পারদ ছিল আকাশচুম্বী। প্রথম বই জনপ্রিয়তা পেলেও দ্বিতীয় বই প্রকাশের জন্য বেশ খানিকটা সময় নিয়েছেন লেখক, যেখানে সামান্য জ���প্রিয়তা পেলেই গন্ডায় গন্ডায় বই লেখার রেওয়াজ এই দেশে।লেখার ধরণও লেখক সুহানকে সমসাময়িক লেখকদের থেকে আলাদা করেছে।

এবার বইয়ে চলে যাই, বইয়ের বিষয়বস্তু নানান সময়ে বিস্তৃত, সূক্ষ্ম এবং জটিল। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের আদিবাসীদের বঞ্চনা, দুঃখ, আন্দোলন আর অবহেলার ছবি নিয়ে পদতলে চমকায় মাটি। প্রথমে মনে হচ্ছিল, উপন্যাসের নায়ক সময় কুমার চাকমা, নিয়তি যাকে রাঙ্গামাটি থেকে নিয়ে এসেছে ঢাকার ফুটবল লীগে। পরে মনে হল নাহ, নায়ক আরিফ, হিল ট্র্যাক্টসে গবেষণা করতে গিয়ে যে নিজেই নিজেকে বিবেকের কাঠগড়ায় তুলে দেয়। পরক্ষনে মনে হয়, সমরের ফুটবল গুরু, আরিফের মামা শামিম আজাদ, কিংবা আরিফের গবেষণার লোকাল এজেন্ট বিজয় দেওয়ান ও নায়ক হওয়ার দাবিদার। ঢাকা লীগের শেষ ম্যাচের এক উত্তেজনাকর মুহূর্তে যখন বইটি শেষ হল, তখন মনে হল এই উপন্যাসের নায়ক আসলে কোন মানুষ না, নায়ক হচ্ছে সময়। সময়ের কাছে সবাইকে পরাজিত হতে হয়।

লেখকের লেখনি অসাধারণ লেগেছে, ফুটবলের কৌশলের মেটাফোর এর ব্যবহার অসাধারণ লেগেছে।
লোকটাকে ঠেকাতে আজাদ এবার তাই বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নামিয়ে দেয় একরাশ অভিমান

বইয়ের বিষয়বস্তুর কারণে রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তি চলে এসেছে, তাদের প্রসঙ্গ অবতারণায় লেখক ছিল বেশ কৌশলী। আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লিখলে কে কখন নাখোশ হয়, তা বলা বেশ মুস্কিল। কিন্তু গম দল আর বৈঠা দল বলতে লেখক কাদেরকে বুঝিয়েছেন, পাঠকের তা বুঝতে বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি বলেই আমার বিশ্বাস।

শান্তিবাহিনী বা কাপ্তাই লেক এর কাহিনী কথোপকথনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আরেকটু বড় পরিসরে উপন্যাসের মধ্যে আসলে পড়ে আরও আনন্দ পেতাম। অর্ধেকের পর অনেক জায়গাতেই উপন্যাসের তাল কেটে গেছে, মনে হচ্ছিল বড্ড তাড়াহুড়া করে লেখা। নুর হোসেন হুট করে উপন্যাসে কেন এলেন বুঝতে পারিনি।

উপন্যাস হিসেবে "পদতলে চমকায় মাটি" সফল না ব্যর্থ, তা মন্তব্য করার মত সাহিত্যের সমঝদার আমি নই। বইটি পড়ে আনন্দ পেয়েছি ঠিক, তবে লেখক চাইলেই সম্ভবত আরও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারতেন বইটিকে। লেখকের পরবর্তী বইয়ের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
Profile Image for Musharrat Zahin.
404 reviews490 followers
June 23, 2023
এই বই নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে একটু পেছনে, ১৯৯৭ এর ২রা ডিসেম্বরে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির এই সালটা ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য এত পড়েছি যে মাথার মধ্যে এক্কেবারে গেঁথে গেছে। কিন্তু আমার দৌড় এতটুকুই। কী কারণে চুক্তিটা হয়েছিল, একই দেশের একটা অংশের সাথে কী জন্য আরেক অংশের মধ্যে শান্তি চুক্তি হচ্ছে– এইটা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগলেও কখনো তার উত্তর খোঁজা হয়নি।

১৯৬০ সালে কাপ্তাই হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তিবাহিনী। এর প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদার দাবি জানান। কিন্তু নতুন সংবিধান পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মর্যাদা দেয়নি। তাই নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেন। আর এরই প্রেক্ষিতে তৈরি হয় শান্তিবাহিনী। তাদের প্রায় দুই দশকের সশস্ত্র লড়াইয়ের ইতি হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২রা জুলাই এক শান্তি চুক্তির মাধ্যমে। সে চুক্তির দুই মাস পরে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছিল শান্তি বাহিনীর সদস্যরা।
.
.
যেই মেঘ ধরতে যেয়ে আমরা পাহাড়-পর্বতে উঠি, সেসবের আড়ালে পড়ে যায় পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘশ্বাস ও আর্তনাদ। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া তার কতটুকুই বা প্রচার করে? চুক্তির মূল কথা ছিল পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং সেজন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এবং আইন প্রণয়ন করা হবে। এর মধ্যে কতটুকু আসলেই বাস্তবিত হয়েছে?

উল্টো তাদের ভিটেমাটি থেকে তাদেরই উচ্ছেদ করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের আমলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লাখখানেক বাঙালিকে পার্বত্য এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়েছিল। যাদেরকে বলা হয় 'সেটেলার'। এই সেটলাররাই একটা সময় আদিবাসীদের অত্যাচার শুরু করে। যেন তাদেরকে উসকানোর জন্যই এখানে আনা হয়েছে। শান্তিবাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীর সংঘাত চলার সময় বহু পাহাড়ি ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। নিজের এলাকাতে নিজেরাই উদ্বাস্তু হয়েছিল। চুক্তির পরে যেন শান্তির চেয়ে অশান্তিই বেশি হচ্ছে।

এই যে আমরা সাজেকে যাই, আশেপাশে একটু তাকালেই বোঝা যায় সেখানকার আদিবাসীরা কেমন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল রিসোর্ট এবং অপরিকল্পিত সব দোকানপাট। অবাধে তাদের থেকে জোর করেই নামমাত্র মূল্যে সেসব জমি কিনে নিচ্ছে ক্ষমতাবানেরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুমতি ছাড়া নিজেদের এলাকাতে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। পিঁপড়ার মতো মানুষজন তাদের এখানে পাড়ি জমায়।
.
.
.
এবার আসি বইয়ের আলোচনায়। যেহেতু এতক্ষণ পার্বত্য অঞ্চলের কথা বলছিলাম, তাই বুঝতেই পারছেন প্লটটা কী।

প্রথমে মনে হবে একটা আদিবাসী ছেলের ঢাকা শহরে মানিয়ে নেওয়ার গল্প বোধহয়। কিন্তু এই উপন্যাস তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু৷
লেখক সমান্তরালভাবে দুটো জায়গার কাহিনী একইসাথে বর্ণনা করে গেছেন। এক জায়গায় আমরা দেখতে পাই ক্ষ্যাপাটে কোচ আজাদ এবং তার আবিষ্কার তরুণ ফুটবলার সমর চাকমা। ফুটবল খেলেই সে তার ফেলে আসা দুর্বিষহ স্মৃতি নব্বই মিনিটের জন্য ভুলতে চায়।

আরেকদিকে সাবেক প্রতিভাবান ফুটবলার আজাদ এখন ফুটবলের নোংরা রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে ঢাকার ইউনাইটেড ক্লাবের কোচ৷

আরেকদিকে একবিংশ শতাব্দীর দুই যুবক আরিফ-হিমেল, যারা কিনা রিসার্চের কাজে চট্টগ্রামে যায়৷ সেখানে যেয়ে তারা দেখে কীভাবে আদিবাসীদের কোনো কারণ ছাড়াই নিপীড়ন করা হচ্ছে। তাদের দোষ তারা কেন নিজেদের দাবি আদায় করতে চাইছে। এগুলো দেখে ঢাকায় বড় হওয়া এই দুই যুবক অবাক হয়। আদিবাসীদের সাথে ঘটে যাওয়া বাঙালিদের অরাজকতা দেখে যাদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। বিশেষ করে আরিফ বুঝতেই পারে না চট্টগ্রামের বাইরের মানুষ কেন এসব বিষয় নিয়ে সচেতন না। সমকালীন রাজনীতির থাবা দেখে সে অবাক হয়।

শান্তিচুক্তির পূর্ববর্তী থেকে শুরু করে পরবর্তী ইতিহাস– সবকিছুই লেখক পাতায় পাতায় বর্ণনা করে যান। গল্পের বুনন থেকে শুরু করে কাহিনী পরিবর্তন, ভাষার ব্যবহার, সবই প্রশংসনীয়। কোনোরকম জড়তা নেই, খুব সাবলীলভাবেই লেখক লিখে গেছেন।

এই বইয়ের সবচেয়ে সুন্দর অংশ শেষের অধ্যায়। এত চমৎকার ও বাস্তবভাবে লেখক বইটার ইতি ঘটিয়েছেন! ফুটবল খেলার বর্ণনা লেখক অসম্ভব জীবন্তভাবে দিয়েছেন। মনে হবে যেন আপনি লাইভ খেলাই দেখছেন। একদম ক্লাইমেক্সে যেয়ে বাকিটুকু পাঠকের চিন্তার জন্য রেখে দিয়েছেন।
.
.
সুহান রিজওয়ানের লেখা এই প্রথম পড়লাম। লেখক যেভাবে সমসাময়িক একটা সংবেদনশীল বিষয় বইয়ে তুলে ধরেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। বইটা সুখপাঠ্য, কিন্তু একইসাথে অস্বস্তিকর। এই বই এমন বিষয় নিয়ে কথা বলে, যেটা নিয়ে আপনি-আমি খুব কম আলোচনা করি। কারণ এসব রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই আগ্���হ বেশ কম৷ সবাই যেন একটু গা বাঁচিয়ে চলতে চাই।

যেই আমরা এসব উচ্ছেদের কাহিনী পড়ে দুই মিনিট চুক চুক করি, সেই আমরাই ছুটি পেলে পাহাড়েই দৌড় দিই। কিন্তু কয়জন সেখানকার আসল খবর সম্পর্কে খোঁজ রাখি? দেখেও গা বাঁচানোর জন্য না দেখার ভান করে চলে আসি। সবাই হিপোক্রিট, আমিও ব্যতিক্রম নই৷ মনে পড়ে, সাজেকে আমি যেই রিসোর্টে ছিলাম, সেখানে সন্ধার পর ইলেক্ট্রিসিটি থাকতো না। তখন ফোনে চার্জ না দিতে পারায় শুধুই হাপিত্যেশ করতাম। অথচ সেখানকার আসল বাসিন্দারাই কোনো ধরনের বিদ্যুৎ পান না। এত বড় ইউনিয়ন, অথচ শিক্ষার হার সর্বনিম্ন। সুপেয় পানির খরা, কাজকারবার কারো নেই বললেই চলে।

লেখক অতীত-বর্তমানের সব বিষয় একইসাথে তুলে ধরেছেন৷ আর দেখিয়েছেন যতই কালের পরিবর্তন হোক না কেন, কিছু কিছু জিনিস সবসময়ই অপরিবর্তিত থাকে। এই যেমন আদিবাসীদের গড়ন নিয়ে বিদ্রুপ করা, তাদের বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় না দেওয়া, চ্যাং চুং বলা, অহেতুক ক্ষমতা দেখানো ইত্যাদি।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে মনে হয় এই বই শুধু শান্তিচুক্তিতেই আটকে নেই। বরং বোঝানো হয়েছে ঢাকা শহর হোক কী পার্বত্য চট্টগ্রাম, সব জায়গাতেই শুধু স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাবানদেরই রাজত্ব। আমরা কেবল তাদের দাস, তাদের সিস্টেমের দাস। সংখ্যালঘুরা বরাবরের মতোই মার খেয়ে আসে

আরিফের বন্ধুদের মতোই আমরা সবাই নির্লিপ্ত। দেশের ভেতরে কোথায় কী হচ্ছে আমরা কিছুই জানি না। ওই যে যা বললাম, সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার কিন্তু অ্যাকশন নেওয়ার বেলায় কেউ নেই। যে যেভাবে পারে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ায় ব্যস্ত। এই আমি যেমন এত বড় একটা পোস্ট দিলাম, এই আমিই হয়তো দুদিন পড়ে এটার কথা বেমালুম ভুলে যাব। এই দোষ কি সিস্টেমের?

এই যে বইটা পড়ার পর যে এত চিন্তার খোরাক আসছে, এইটাই লেখকের সার্থকতা। সুহান রিজওয়ান চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই জিনিসটাই দেখাতে চেয়েছেন।
Profile Image for Sanowar Hossain.
281 reviews25 followers
July 26, 2023
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র সমর কুমার চাকমা। দারুণ ফুটবল খেলে সে। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় তার খেলা দেখে মুগ্ধ হন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের দল মহানগর ক্রীড়াচক্রের কোচ শামীম আজাদ। তাই তিনি সমরকে ঢাকা নিয়ে আসেন এবং নিজের কাছে রেখে গাইড করা শুরু করেন। জাতিগতভাবে বাঙালি না হওয়ার ব্যথা সবসময় ভুগিয়েছে সমরকে। রাঙামাটি শহরে বসবাস করলেও পাহাড়ে বাঙালি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব সে ভালোভাবেই টের পেয়েছে। সমরের বাবা রতন কুমার চাকমার পিঠে সেনাবাহিনীর বুটের ছাপ সমরকে যেন তাড়া করে ফেরে। তাই ফুটবল খেলার সময় বুট পায়ে দিতে তার বরাবর অস্বস্তি। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকায় আসার পর ক্লাবজীবনে বরাবরই জাতিগত বিদ্বেষের স্বীকার সে। এটাকিং মিডের খেলোয়াড় সমর মাঠে কিংবা তার নিজের জীবনেও ক্রমাগত ট্যাকল কাটিয়ে খেলে যাচ্ছে। মাঠের খেলা কিংবা নিজের জীবন দুইই তাকে হতাশায় ভোগায়।

শামীম আজাদ একসময়ের নামকরা ডিফেন্ডার ছিলেন প্রিমিয়ার লীগে।দেশের হয়ে ছাব্বিশটি ম্যাচও খেলেছিলেন । ঢাকা ইউনাইটেডের গোলকিপারকে সুরক্ষা দিয়ে আসছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু উপরমহলের দুর্নীতির কারণে জুবায়ের আলম তাকে দুই ম্যাচ ইচ্ছাকৃতভাবে হেরে যেতে বলেন, যাতে বিপক্ষ দলের রেলিগেশন আটকে যায়।কিন্তু শামীম আজাদের নৈতিকতা সেটাকে সায় দেয়নি।তিনি খেলেছিলেন নিজের সেরাটা দিয়ে, তার ফলে সেই মৌসুমে আর খেলা হয়নি তার, এমনকি সাফ চ্যাম্পিনশিপে তার খেলার কথা থাকলেও পরে দেখা যায় তার নাম নেই তালিকায়। পরের বছর ঢাকা ইউনাইটেড তাকে কিনলেও একটি ম্যাচও নামায়নি, সেজন্য চলে আসেন মহানগর ক্রীড়াচক্রে। একসময় ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেলেও তিনি দায়িত্ব নেন ফুটবলার তৈরির। তারই সূত্র ধরে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ান পাগলাটে অবিবাহিত ফুটবল কোচ শামীম আজাদ এবং পেয়ে যান সমরকে।

শামীম আজাদের বড় ভাগ্নে আরিফ ও তার বন্ধু হিমেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন এর শিক্ষার্থী। সামনেই তাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার পরপরই হিমেলের ফার্মে পার্টটাইম কাজ নেয় আরিফ। তাদের কাজ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রিসার্চ করা। এবং একটি প্রজেক্টও পেয়ে যায় তারা। রিসার্সের বিষয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। আমাদের মূল গল্পটা এই শান্তিচুক্তির অতীত ও বর্তমান নিয়েই, যা লেখক দেখিয়েছেন আরিফ ও হিমেলের পার্বত্য অঞ্চলে দেড়মাস তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে।

ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই হ্রদ ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ তৈরি করা শুরু করলে লক্ষাধিক আদিবাসী তাদের ভিটেমাটি ছাড়া হয়। অনেকে পাশের দেশ ভারতে চলে যায়, কিন্তু সেখানে গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় আবার ফেরত চলে আসে। বসবাস করার জন্য তারা পাহাড়ের আরো ভেতরে চলে যায়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তারা আগে থেকেই দাবি তুলে আসছিল। মুক্তিযুদ্ধে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষ নিলে পাহাড়িদের মধ্যে বিভক্তি শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) নেতৃত্ব জাতীয় জনসংহতি সমিতি গঠিত হয় স্বায়ত্তশাসন আদায়ের লক্ষ্যে। '৭৩ এর নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হন।কিন্তু ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান এবং কিছুকাল পরে জেএসএস (জাতীয় জনসংহতি সমিতি) এর সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। পাহাড়ে বিশৃঙ্খলা দিনদিন বাড়ার কারণে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে অপরাগ ছিল পুলিশ ও সামরিক বাহিনী। তাছাড়া ঢাকা হতে পাহাড়ের মধ্যে কি হচ্ছে এসব নিয়ে মাথায় ঘামানোর পরিস্থিতি ছিল না, কারণ তখন দেশের রাজনীতি ছিল দোদুল্যমান।

১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান পাহাড়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জমি এবং টাকা দিয়ে বাঙালিদের বসবাস শুরু করান। এরপর পুরোদমে শুরু হয় বাঙালি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব। যারই ফলস্বরূপ ১৯৮৪ সালে ভূষণছড়ায় শান্তিবাহিনীর হাতে চার শতাধিক বাঙালি নিহত হয়, যা পাহাড়ে সবচেয়ে বড় গণহত্যা। এছাড়া বাঙালি সেটেলাররা বহুবার পাহাড়িদের উচ্ছেদ কিংবা বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, এদিক দিয়ে পাহাড়িরাও শান্তিবাহিনীকে সমর্থন দিয়ে বাঙালিদের হত্যায় সহায়তা করেছে। জেএসএস দলের মধ্যে লারমা ও প্রীতি গ্রুপের দ্বন্দ্বে একসময় এম এন লারমা নিহত হন এবং দলের দায়িত্ব নেন তার ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। বাঙালি - পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, শান্তিবাহিনী-সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ ইত্যাদি নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে ১৯৯৭ সালে আওয়ামিলীগ সরকার এবং শান্তিবাহিনীর মধ্যে শান্তিচুক্তি হয় এবং শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে। এই শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করা গ্রুপটি পরে ইউপিডিএফ নামে আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস থেকে কিছু নেতা বেরিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠা করেন জেএসএস (সংস্কার/এম এন লারমা) দল। পাহাড়ি তিনটি দলেরই দাবি তাদের শান্তিচুক্তির বিভিন্ন শর্ত বাস্তবায়িত হয়নি।অন্যদিকে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের বিভক্তি আদিবাসী জনগণের অধিকার আদায়ের অন্তরায় বলে মনে করা হয়।তবে সরকারের দাবি চুক্তির শর্তগুলো অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বাকি শর্তগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
আমরা ফিলিস্তিন, ইরাক,সিরিয়া, মায়ানমারের জাতিগত নিপীড়নের বিরোধিতা করলেও আমাদের দেশেরই পাহাড়ে কি হচ্ছে সেই বিষয়ে ধারণা নেই। কখনো ভাবিনা যে সাজেক বেড়াতে গিয়ে যে হোটেলে রাত থাকছি সেই হোটেল বানাতে গিয়ে শতাধিক আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। মেজরিটি-মাইনরিটি সমস্যা সৃষ্টির আদিকাল হতে চলে আসছে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা কারো হাতেই যদি ক্ষমতা দেয়া হয় তখন হয়তো দেখা যাবে তারাই আবার অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘুদের সাথে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।

সুহান রিজওয়ান এর সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রান বইটি পড়েছিলাম। সেই ভালো লাগার সুবাদে এই বইটি পড়া। এই বইটিও যথেষ্ট ভালো বই। গল্পের মাধ্যমে নিয়ে গিয়েছেন পাহাড়ঘেরা জনপদে। পাহাড়ের অতীত এবং বর্তমানকে তিনি দেখিয়েছেন স্বচ্ছ আয়নার মতো। গল্পের সাথে সাথে যারা ইতিহাস জানতে চান তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। হ্যাপি রিডিং।
Profile Image for Jahid Hasan.
135 reviews160 followers
March 30, 2020
Dictatorship and authentic literature are incompatible... The writer is the natural enemy of dictatorship.
― Ismail Kadare


পাহাড়তলি থেকে যে বাস ছাড়ে তারই নাম পাহাড়িকা-- এতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
কিন্তু পাঠক আশ্চর্যিত হয় তখনই যখন সে দেখে, ঐ বাসে চেপেই প্রধান চরিত্র সমর, যার মানে যুদ্ধ, আর তারই একটু একটু পছন্দের পাত্রী শান্তিপ্রিয়া, রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামের দিকে আসছে।
অর্থাৎ টলস্টয়ের যুদ্ধ আর শান্তি পাশাপাশি বসে আলোচ্য উপন্যাসে প্রবেশ করে।


এই তথ্য যতক্ষণে পাঠক বুঝতে পারছে, ততক্ষণে তার কাছে এও পরিষ্কার হচ্ছে যে, চোখের সামনেই কিছু কিছু বানানের বদল ঘটছে। এতো হয়ে উঠছে অ্যাতো, আর কেমন হয়ে উঠছে ক্যামন। যা তাকে পূর্বের কোন লেখককে স্মরণ করাচ্ছে।
কিন্তু কেন?
সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ বইটিতেও কি লেখক এই বানান ব্যবহার করেছিলেন? মোটেই নয়। তাহলে কেন এই নতুন বানানের উদ্ভব?
এই প্রশ্নের সদুত্তর মেলে তিরিশ নম্বর অধ্যায়ে।
যেখানে বিনা নোটিশে খোদ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এসে হাজির হচ্ছেন, এবং জানাচ্ছেন তাঁর ইচ্ছের কথা, পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জন্যে তিনি এক উপন্যাস রচনা করতে চাইছেন, যা রচিত হবে তাদেরই ইতিহাসে, তাদেরই ভাষায় ও ভাবনায়।
তাহলে কি বলা যায়, এই উপন্যাস আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অধরা স্বপ্নকেই ধরতে চাইছে?
হতে পারে। আর হতে পারে একারণেই উপন্যাসের ভাষা ইলিয়াস সাহেবকে স্মরণ করাচ্ছে।


যাই হোক, পাঠক নিজে লক্ষ্য করে, যেসকল বই নিয়ে সে সাগ্রহে কিছু বলতে চায়, তাই নিয়ে সে বলতে পারে কম। তাই পড়বার পরও দীর্ঘদিন সে কিছু লিখতে পারে না।
তার কাছে মনে হয়, সারবাঁধা পিঁপড়ের মতো এই অসংখ্য অক্ষর একবিংশ শতাব্দীর নিরেট চিত্র তৈরি করে চলেছে। তাই পাঠক ধীরে ধীরে সতর্ক হয়ে ওঠে। ভাবতে চেষ্টা করে, লেখকের বর্ণিত সমস্ত ঘটনার সঙ্গে তার পরিচয় আছে-কি-নেই।
পাঠকের মনে পড়ে, আইরিশ লেখক James Joyce তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস Ulysses -এ এরকম সময়কে বোতলবন্দি করেছিলেন। বলেছিলেন, ১৯০৪ সালের ডাবলিনকে পূনরায় গঢ়া যাবে এই বইয়ের মাধ্যমে। ঠিক তেমন একটা ঢাকা শহরের আজকালকার চিত্রই কি তৈরি করছেন লেখক?


ওদিকে লেখক আবার তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড় সমরের ভাবনার মাধ্যমে আমাদের নিয়ে চলেন রাঙামাটি। লাল পাহাড়ের যে ইতিহাস আমরা কখনো স্পর্শ করতে চাইনি, যা নিয়ে আমাদের ভাবনার তেমন কোন অবকাশ ছিল না, সেই গহীন অরণ্যের ইতিহাস সম্বলিত নানা প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন লেখক।
এই প্রশ্নশরের সমাধান খুঁজতে গেলে ইতিহাসের পাতা থেকে বিভিন্ন চরিত্র আমাদের সামনে এসে আত্মপ্রকাশ করেন। আমরা কপ্তাই বাঁধের পরিণাম উপলব্ধি করি। যেখানে মঞ্জু এক টুকরো মাটি কাগজে মুড়িয়ে তাঁর দিদির হাতে দিয়ে অনুরোধ করে, 'দি, গমে থোচ! এ মাদিয়ানর ভালত্তমান দাম আগে সি।'
তাঁর দিদি অবাক হয়, এই মাটির দলার আবার কী দাম আছে!
অথচ দুদিন পর দেখা যায়, কপ্তাই বাঁধের পানিতে তাদের ঘরদোর, জমিজমা সমস্ত ডুবে গেছে। কিন্তু যত্নে রাখা ঐ একটুকরো মাটির দলা ডোবেনি।
আমরা এখানে একদিকে দেখি টাকা ছড়ানো ফুটবল, ম্যাচ ফিক্সিং আর পলিটিক্স। ঠিক তেমনি অন্যদিকে দেখি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ইতিহাস।
এভাবেই সন্তর্পণে লেখার ভেতর শব্দের অধিক রেখে যাচ্ছেন লেখক।


পুরো বইতেই কোন শিরোনামের আশ্রয় নেননি লেখক। তবে বইয়ের পনের নম্বর অধ্যায়ে সামান্য বিচ্ছিন্ন লাগে। কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়া মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার উপস্থিতির পর অপেক্ষায় থাকতে হয়, কখন অন্য কোন ব্যক্তির প্রসঙ্গ চলে আসে।
তবে এও বুঝতে সময় লাগে না যে, "পার্বত্য শান্তিচুক্তি বর্তমান প্রেক্ষিত" প্রজেক্টে কর্মরত আরিফকে নয়, এ অধ্যায়টি মূলত পাঠককেই অবগত করছেন লেখক।


পাঠক ভাবে, আমাদের সময় এবং তরুণ সমাজের মানসিকতা কী দারুণ জেনে নিয়েছেন লেখক! সমাজের প্রায় প্রতিটা ঘুণে ধরা প্রসঙ্গকে তিনি স্পর্শ করে গেছেন। কখনো কখনো চরিত্রের মুখে চলে এসেছে সমাজের নিপাট চিত্র। তারা বলছে, 'বাংলাদেশ হইল ইস্যুর দেশ, ফলোআপ এইখানে চলে না।'
আবার বলছে, 'জ্ঞান নয়, মেধা নয়, গলা যার যত বড়-- সে'ই আজকের তারকা।'
পাঠকের ধারণা, আগামী প্রজন্ম এ বইয়ের মাধ্যমে আমাদের সময়কে জানবে। জানবে কী দারুণ দুর্দিন আমরা পাড় করেছি।


লেখক সুহান রিজওয়ানের একটানা গদ্য বলে দেয় যে, তিনি সচেতন পাঠক চান। আর ঐ পাঠক যে তাঁর হবেই তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা দুটোমাত্র বই তাঁর, অথচ সময়ের ব্যবধান বেশ দীর্ঘ। হয়ত তিনি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চান না।
তবে বেশ গভীরে তিনি গিয়েছেন। এমন সব প্রশ্ন তুলেছেন যার সদুত্তর খুঁজতে গিয়ে ক্রমে আমাদের পদতলে চমকে ওঠে মাটি।
Profile Image for Sazedul Waheed Nitol.
87 reviews33 followers
November 19, 2019
পড়া শুরু করার পর 'পদতলে চমকায় মাটি'র যে দিকটা শুরুতেই মনযোগ কাড়ে তা হলো: লেখকের প্রথম উপন্যাস 'সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ'-এর চাইতে ভাষা ও ভাবাবেগে চলমান উপন্যাস কতোটা ভিন্ন। প্রথম উপন্যাস ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর ভর করে আছে, যার পরিণতি কিংবা মীমাংসার গল্প বহু আগে আকার পেয়েছে। কিন্তু 'পদতলে চমকায় মাটি'র গল্প সমসাময়িক, কিছুটা স্পর্শকাতরও বটে; উপন্যাসের ঘটনার নায়কেরা অনেকেই জীবিত এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েক দশক ধরে চলমান রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব আজও প্রকাশ্য। সে কারণে লেখকের বর্ণনাভঙ্গীতে নির্মোহতা খুঁজে পেয়ে অবাক হই না।

উপন্যাসে দু'টো গল্প সমান্তরালে চললেও গণিতের সূত্র মেনে পরস্পরকে এড়িয়ে যায়নি, বরং বহুবারই একে অপরকে ছেদ করেছে, কখনো কখনো পথ দেখিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার, যাকে বলে কমপ্লিমেন্ট করা। একদিকে, অতীত ও বর্তমানের ক্ষত বুকে বয়ে নিয়ে চলা সমর কিংবা শামীম আজাদের ফুটবল বুট ছক কাটা চেনা মাটির ওপর নিজের ছাপ রাখতে চায়; অন্যদিকে রাষ্ট্রের বুটের নিচে পাহাড়ের মাটি কী করে রাঙা হলো তার সুলুকসন্ধানে গিয়ে আরিফ ও হিমেল বিহ্বল হয়ে নিজভূমে পরদেশ আবিষ্কার করে।

ফুটবলের প্রতি তীব্র আগ্রহ ও চট্টগ্রামের ভাষাবাসী হওয়ায় উপন্যাসের অনেকটা এলাকা আমার ব্যক্তিগত ভেনচিত্রে উপরিপাতিত হয়েছে, যার ফলে পড়ার সময় তরতর করে এগিয়ে গেছি। পড়তে পড়তে আবিষ্কার করি, একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি সময়ের এই উথালপাথাল সময়টিকে সাহিত্যের স্থিরচিত্রে ধরার এবং চেনা নগরের কোণায় কোণায় জড়িয়ে থাকা অনুভূতির একটা জবানবন্দী রেখে যাবার প্রয়াস লেখকের মধ্যে ছিল। লেখক তাতে সফল। একইসাথে দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ে অদৃশ্য মানচিত্র এঁকে রাষ্ট্র নিজ নাগরিকদের মাঝে একটি কাঁটাতারের দু'পাশে অবস্থান করার একটি বোধ যে জাগ্রত করেছে তার চিত্র পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা এবং সেই কাঁটাতারে আটকে থাকা অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদেও লেখক সফল।
Profile Image for Shuk Pakhi.
512 reviews305 followers
May 5, 2019
এবইয়ের পাঠপ্রক্রিয়া কীভাবে দিবো বুঝতে পারছি না ....
বই শেষ করার পরপর মাথা কিছুটা এলোমেলো হয়ে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে, তার সমস্যাগুলো নিয়ে এরকম বই আগে পড়িনি।
এই বিষয়গুলো কিছুটা জানা থাকলেও এইভাবে ফিল করিনি আগে।
সুহান ভাইয়ের ১ম বইটা থেকে এই বইটা একেবারেই ভিন্ন।
ভিন্নতা কাহিনীতে, ভিন্নতা বাক্য গঠনে, ভিন্নতা রয়েছে শব্দের ব্যবহারেও।
বইয়ে যে চাকমা ভাষা বা চাটগাইয়া ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে ব্র্যাকেটে প্রমিত ভাষায় দেয়া থাকলে বুঝতে সুবিধা হতো।
এগুলো অনেকটাই আন্দাজ করে নিতে হয়েছে।

বইয়ের কাহিনী কিছুটা স্লো হলেও পড়ে মজা পেয়েছি।
৩য় বইয়ের অপেক্ষায় থাকলাম....

Profile Image for Saima  Taher  Shovon.
521 reviews190 followers
April 17, 2024
এই বইয়ের নতুন প্রচ্ছদের বই আসছে দেখলাম। আহা!সেটাও নিতে ইচ্ছে করছে। আবার লেখকের ফিডে দেখে পড়তেও ইচ্ছে হচ্ছে। খোয়ারনামা নিয়েছিলাম। কিন্তু ধুম করে এই বইয়ের কথা মনে পড়ে গেলো।

গতবার পড়ার পর অনুভূতি :
এই বইয়ে লেখক এক গল্প থেকে যেভাবে অন্য একটি জায়গায় নিয়ে যান এবং সম্পূর্ণ আলাদা ইতিহাস নিয়ে আমাদের অবগত করেন এটিই সবচেয়ে চমৎকার।শত অনিয়ম,ক্ষমতার দৌরাত্ম্য এবং এর চারদিকে বিস্তৃত শেকড়ের সাক্ষী করে রাখেন এই বইয়ের মাধ্যমে। সাক্ষী না আসলে, দৈনন্দিন যে বাস্তবতাগুলো ভুলে গিয়ে আমরা জীবন সুন্দর দাবি করি, লেখক তারই বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন এই বইয়ের মাধ্যমে।
বইটি শুরু ঢাকা থেকে। ঢাকা শহরের প্রতি অভিযোগ দিয়ে শুরু হয় এই বই। অথচ শুধু ঢাকা ছাড়া আমাদের দেশের আরও অনেক বিষয় উঠে আসবে তা কয়েক পাতা এগোলেই বোঝা যায়। কী নেই এই বইতে? সদ্য তরুণদের জীবনের পথ খুঁজে বেড়ানো, একজন খ্যাপাটে মানুষের স্বপ্ন ধরার চেষ্টা, ঢাকা শহরের নুইয়ে পড়ার গল্প, ক্ষমতার বাস্তব চিত্র বা শান্তিবাহিনী, সেনাবাহিনী, শান্তিচুক্তি সংক্রান্ত ইতিহাস। লেখক এসব বিষয়ের অতীত-বর্তমান দুই-ই একসাথে তুলে ধরেছে। আবার এও দেখিয়ে দিয়েছেন যে যতই যুগ বদলাক- নতুনের আগমন হোক কিন্তু পুরনো রীতিনীতি বদলায় না। সংখ্যালঘুরা বরাবরের মতোই মার খেয়ে আসে।ক্ষমতা এক আজব জিনিস। যার কাছে থাকে নীতি তাদের কাছে তুচ্ছ।ক্ষমতা মানেই "আমি কী হনু রে" তা প্রমাণ করার সময়।

আমাদের আদিবাসীদের নিয়ে যে কথাগুলো উঠে এসেছে সেগুলো একশ একটা ভাবনার খোরাক জোগাবে না তা নয়। আমরা দেশে সংখ্যালঘুদের উপর যে নিপীড়ন হয় বা পর্যটনশিল্পের নামে তাদেরকে যে বেঘর করা হয় সেসবে আমরা রীতিমতোন বাহবা দিই।বাহবাই বলবো না কেনো?অতীত ইতিহাস বাদ দিই,সাজেক এর ইতিহাস আমরা কয়জনে না জানি? এখনকার পরিচ্ছন্ন, নতুন রং করা ঘর গুলো আমরা কিসের বিনিময়ে পেয়েছি? অথচ এসব পড়ে,মিনিট দুয়েক মানুষগুলোর জন্য আফসোস করে,এরই নাম জীবন বলে ওই জায়গাতেই পরবর্তী গেটএওয়ে পরিকল্পনা করি। আমিও এই হিপোক্রেটগুলোরই দলে পড়ি।ঈশপের ব্যাঙ আর বালকের গল্পের "তোমার জন্য খেলা, আমার জন্য জ্বালা"মতোনই আমাদের এই সামান্য বাহবা হাজার হাজার ঘর উজাড় করে।

বই পড়ার পর বৈষম্য, নিপীড়ন, ক্ষমতা খেলা এসব নিয়ে গভীর ভাবনা চেপে বসবে।এই-ই লেখকের সার্থকতা। গল্পের মাধ্যমে ইতিহাস জানতে চাইলে, নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইলে,এটি অবশ্য পাঠ্য। লেখক আমার ভীষণ প্রিয় বলে ওনার বই পড়ার পরের অনুভূতিগুলোই লিখে দিলাম। যদিও বইয়ের গভীরতার ১০% ও আমি প্রকাশ করতে পারছিনা,কেননা সেসকল শব্দ আমার জানা নেই।
সুহান রিজওয়ান
Profile Image for Hibatun Nur.
159 reviews
March 18, 2021
বইটা রাতেই শেষ করেছি কিন্তু কি লেখা যায় তা ভাবতে ভাবতেই দিন এসে গেল।

হঠাৎ করেই রাঙামাটি যাওয়ার প্ল্যান করা হলে বন্ধুর কাছ থেকে রাঙামাটির ইতিহাস সম্বলিত অথবা সেখানকার পটভূমিতে লেখা কোন উপন্যাস তার কাছে আছে কিনা জানতে চাইলে সে এই বইটার কথা বলে। লেখকের 'সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ' বইটার ব্যাপারে অবগত ছিলাম। সেই বইটা পড়ব বলে বহু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি। এই বইটাও কয়েকবার চোখের সামনে যে আসে নি তা না তবে নামটার কারণে বইটার নিয়ে তখন কোনরূপ কৌতুহল জাগে নি। এমনকি যে বন্ধুর কাছ থেকে বইটা ধার নেয়া সে যখন বইটার পড়ছিল তখনও না।

কিন্তু এখন নামটার প্রকৃত মর্ম আন্দাজ করতে পারছি।

বইটা নিয়েছিলাম রাঙামাটি যাওয়ার কয়েকদিন আগে কিন্তু বন্ধু বার বার বলার পরও রাঙামাটি যাওয়ার আগে বইটা নিয়ে বসলাম না তো বসলামই না। একটা ভুল যে করছি সে আভাস দিলেও গা করিনি। রাঙামাটি গিয়ে যখন বইটা নিয়ে বসলাম তখন আমরা ইঞ্জিন চালিত বোটে করে কোমল হাওয়ায় সিক্ত হতে হতে ঝুলন্ত ব্রীজের দিকে যাচ্ছি। মাঝপথে থাকতেই অন্যতম মূলচরিত্রের একটু একটু ভাল লাগার মানুষটার সম্ভ্রম হানির ঘটনা তাও আমার ঘুরতে আসা রাঙামাটিতেই, ব্যাপারটা পড়েই মুষড়ে পড়লাম। এতেই বোঝা হয়ে গেছিল যে সামনে কি আসতে যাচ্ছে। তাই ট্যুরে আর সাহস করে পড়া হয় নি। ঘুরতে এসে যদি স্থানীয় বাস্তবতার এমন চিত্র পড়তে হয় তখন ট্যুরই উপভোগ করা হবে না। তবে বই এ যা আছে তার সামান্য হলেও সেখানে অবলোকন করেছি বললে ভুল করব না।

শান্তিবাহিনী, শান্তিচুক্তি বিষয়ক একটা ভাসা-ভাসা ধারণা ছিল এবং মনে ইছা ছিল যে এ নিয়ে বিশদভাবে লেখা-পড়া করবার। বইটা সেই সুযোগ করে দিল। শান্তিবাহিনীর সাথে জড়িত বহু বিশিষ্ট চরিত্রের সাথে পরিচয় হল। যে-ই পড়বে তারই এসব চরিত্রদের নিয়ে আরও জানার ইচ্ছা করবে। শান্তিচুক্তির বর্তমান অবস্থার উপরেও একটা ওভারঅল আইডিয়া হয়েছে বইটি পড়ে। ক্ষেত্র বিশেষে নিজেদের জাতিগত অস্তিত্ব নিয়েও এক ধরণের অস্বস্তিকর অনুভূতির সঞ্চার হয়েছে বইটি পড়ে। যে আমরা নিজেদের বাঙালি ঐতিহ্য আকড়ে ধরে থাকার জন্য এক সময় লড়েছিলাম সে আমরাই আমাদের দেশের মাইনরিটির স্বকীয়তাকে তুচ্ছজ্ঞান করছি। এর চেয়ে বড় হতাশার ব্যাপার আর কি হতে পারে? আমাদের তো উচিত ছিল এদের জাতিগত বিষয়ে অন্য সকলের চেয়ে আরও বেশি খেয়ালি হওয়া।

তা আমরা করিনি।

গল্পের আরেক অংশ ছিল বর্তমান বাংলাদেশ ফুটবল। শুরুটাও মূলত ফুটবল দিয়েই। বাংলাদেশ ফুটবলের মধ্যাকার নানান সমস্যা উঠে আসলেও এক পর্যায়ে গিয়ে ফুটবল বইয়ে আর লাইম-লাইট পায় নি। তবে অবশ্য শেষে ফুটবলেই সব কিছু আটকে গেল। তবে মনে হয়েছে ফুটবল নিয়ে আরও কিছু আলোচনা থাকলে ভাল হত। হয়ত আলোচনা করার আর কিছু নেইও।

বইটি বাস্তববাদী। ফুটবল আর পাহাড়ে বাঙালি এবং আদিবাসীদের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা গল্পের মেইন প্লট পয়েন্ট হলেও একাধিক সমসাময়িক বিষয়ে কমেন্টারি মিলেছে বইটিতে। আর এটাই বইয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের সামগ্রিক দশা কি ছিল তা এই বইয়ে দলিল হয়ে রইল।

লেখকের লেখনি অত্যন্ত ভাল। এক ধরণের অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি পাঠকদের। সমর্থও হয়েছেন। চরিত্রগুলোও আমাদের মতন সাধারণ। আমাদের মতই তাদের আচরণ। ক্ষেত্রবিশেষে স্টেরিওটাইপগুলো ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে কিছু ব্যাপার অস্বাভাবিক ঠেকেছে তবে তা খুবই কম। কিন্তু সুন্দর লেখনির একটা সমস্যা হল। ক্ষেত্রবিশেষে ছন্দ কেটে গেলে পড়তে একটু কষ্ট হয়। সেই সমস্যাটা ফেস করেছি। তাছাড়া বইয়ে বানান ভুলসহ আরও ছোট-খাটো কিছু ভুল রয়েছে যা পড়ার স্রোতকে বাধাগ্রস্থ করেছে একটু হলেও।
Profile Image for Kripasindhu  Joy.
542 reviews
April 22, 2025
ফুটবল এই উপন্যাসের একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকলেও একে স্পোর্টস ফিকশন জনরায় ফেলা যায় না। বরং, সুহান রিজওয়ানের এই উপন্যাস আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় এক বিস্তৃত ইতিহাসের সাথে।

সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নির্যাতিত, অসহায় মানুষের জন্য আমাদের দুঃখের যেন সীমা নেই৷ কিন্তু, নিজের দেশেই, পাহাড়ে, আদিবাসীদের সাথে বহু বছর ধরে যা ঘটে আসছে তা নিয়ে মাথা ব্যথা দেখা যায় না কারো। এই সমস্যাটিকে নিজের উপন্যাসে সুন্দর করে তুলে ধরেছেন লেখক।

আকারে মোটামুটি বড় হলেও পুরো সময় জুড়ে, দক্ষ লেখার হাতের কারণে, উপভোগ করতে বাধা হয় না।
Profile Image for Heisenberg.
151 reviews8 followers
September 14, 2021
বইয়ের মাঝের দিকে এসে একটা ভয় কাজ করছিলো আসলেই কি এন্ডিং টা সুন্দর করে দেয়া সম্ভব হবে?...
.
.
.
.
..
.
.
.
একদম পার্ফেক্ট এন্ডিং...
Profile Image for Edward Rony.
90 reviews9 followers
November 7, 2023
" কর্পোরেট কালচারে একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসবমুখর হয়ে ওঠার মতোই বৈসাবির লাইভ সম্প্রচারে চাপা পড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গণহত্যার ইতিহাস। পানছড়ি জেনোসাইড বা লংগদু গণহত্যা আজকাল কে মনে রাখে? ভূষণছড়ায় যে শান্তিবাহিনীর আক্রমণে নিহত হয়েছিল বহু বাঙালি এবং তার প্রতিক্রিয়ায় পালটা আক্রমণে যে বহু আদিবাসীকেও ম��রা হয়েছিল, এ বিষয়গুলো আজকাল উপেক্ষিত।
হায় রে প্রজন্ম, তোরা প্যালেস্টাইন চিনলি, সিরিয়া চিনলি - কিন্তু লোগাং চিনলি না! "

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমার বরাবরই অনেক আগ্রহ আছে। বিশেষ করে আমাদের আদিবাসীর সাথে যে অন্যায় হয়ে আসছে, সেটা বারবারই আমাকে পাকিস্তানি শাসন আর শোষনের চিত্র দেখায়।

আবার এর পাশাপাশি, ফুটবল-ক্রিকেট বা অন্য যে কোন খেলাধুলা বিষয়ক যে কোন কিছুই আমার প্রচন্ড অপছন্দের বিষয়।
এই প্রচন্ড পছন্দ আর অপছন্দেন দুইটি বিষয়কে মূখ্য করে রচিত সুহান রিজওয়ানের "পদতলে চমকায় মাটি"।

উপন্যাসের একদিকে রয়েছে একজন খ্যাপাটে ফুটবলার কোচ। যে ঘরোয়া ফুটবলে অবহেলার শিকার হয়েছে ম্যাচ ফিক্সিং এর মত বিষয়ের সাথে আপোস না করায়। এরপর নিজেকে উৎসর্গ করেছে ফুটবলের জন্য। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খুঁজে এনেছে তুখোড় ফুটবলার কে। আর শুধু মেধার জোর দিয়েই এগিয়ে গেছে অনেক দূর।

অন্যদিকে তরুন যুবক, রিসার্চ ফার্মের এক প্রজেক্টে পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে ঘুরতে আবিষ্কার করে পাহাড়িদের উপর করা নানা অন্যায়, অত্যাচার আর শোষণের কাহিনী। স্বাধীনতার পরে আশির দশকেও যে এদেশে গণহত্যার মত ঘটনা ঘটেছে, অথচ আমরা সমতলের মানুষ যে সেটা জানি না তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে সেই সব রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কথা যার কারণে হাজার হাজার গরীব বাঙালিকে সেটেলার হিসেবে পাহাড়ে এনে আদিবাসীদের মুখোমুখি দাঁড়করিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের কথা।

সংবাদ পত্র, টেলিভিশনের পর্দা আর আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের গাল গল্পের বাইরে এসে পাহাড়ের বাস্তবতার এক চিত্র খুবই স্পষ্টভাবে প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে।

আগেই বলেছি, ফুটবল আর এ সম্পর্কিত কিছু বিষয় বেশ বিস্তর ভাবে ফুঁটে উঠেছে এই উপন্যাসে। যেহেতু আমি খেলার তেমন ভক্ত না, তাই ঐ চ্যাপ্টার গুলো কিছুটা একঘেঁয়ে লেগেছে।
অন্যদিকে, পার্বত্য এলাকার চ্যাপ্টার গুলো অনেক ভাল লেগেছে। পাহাড়ের কিছু চ্যাপ্টার আরেকটু গুছিয়ে লেখা যেত, তবে যতটুকু বলা হয়েছে সেটাও বেশ ভাল।

তবে আমার যেটা খারাপ লেগেছে সেটা হচ্ছে হঠাৎ করে উপন্যাসের শেষ হয়ে যাওয়া। প্রথমদিকে বেশ ধিমে তালে, স্লোলি এগিয়েছে কাহিনি। মাঝের দিকে কাহিনি স্বাভাবিক গতি নিলেও শেষটা হুট করে এসে গেল বলে মনে হয়েছে। শেষ করার গতিটা প্রথমদিকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়নি আরকি।

সব মিলিয়ে ভাল লেগেছে। সবচে বড় কথা উপভোগ্য ছিল লেখাটা।
Profile Image for Zahidul.
450 reviews93 followers
March 10, 2019
"Son, we live in a world that has wall, and those walls have to be guarded by men with guns. Who's gonna do it, you ?"

অনেকদিন পরে কোন সমকালীন উপন্যাস একটানে পড়ে শেষ করলাম। কাহিনীর একেবারে প্রথম থেকেই সমর কুমার চাকমার সাথে একবারে ডুবে গিয়েছি যে মুগ্ধতার রেশ ছিল একেবারে শেষ পর্যন্ত। শেষ কবে বাংলা চিরায়ত সাহিত্যের কোন চরিত্র হৃদয়কে এতটা ছুঁয়ে গিয়েছে তা আসলেই ভাববার বিষয় আমার জন্য।

" পদতলে চমকায় মাটি " নামক এই উপন্যাসে বর্তমান ক্লাব ফুটবলের নানা দিকের সাথে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের সমসাময়িক নানা দিক গুলো দারুন ভাবে উঠে এসেছে, সেই সাথে ছিল বর্তমান সময়ের নানা আলোচিত কিছু ঘটনাও। উপন্যাসের চরিত্রায়ন এবং ঘটনাগুলো পড়ে মনে হচ্ছিল সেগুলো একেবারে বাস্তব থেকেই তুলে আনা যা প্রতিনিয়তই ঘটছে আমাদের আশেপাশে, অথচ এক অদ্ভুত কারণে এ ব্যাপারে আমাদের খুব একটা বিকার নেই। ঋজু এবং সুখপাঠ্য এই উপন্যাস শেষ করার পরে এক অদ্ভুত অনুভূতি ছুঁয়ে গেছে তা বলতেই হয়, যার রেশ থাকবে আরো অনেকদিন। বইয়ের প্রচ্ছদ এবং নামকরণ পুরো উপন্যাসকে দারুন রিফ্লেক্ট করেছে, এদিক থেকেও এই উপন্যাসটি সফল।

লেখকের কাছে এক প্রকার আবেদনই থাকবে যে এ ধরনের উপন্যাস আরো লিখুন যাতে আমার মতো পাঠকদের মন কিছুটা সময়ের জন্য হলেও এ ধরণের ধোঁয়াশা বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো জানার আগ্রহ হয়। আমি মনে করি বাংলা ভাষায় " কালজয়ী " বা ক্লাসিক উপন্যাস হবার সব ধরণের গুনাগুন এতে আছে, সে সকল কথাবার্তা বাদ দিলেও বাংলা সাহিত্যের একালে এ ধরণের বাস্তবধর্মী উপন্যাস দরকার, খুব দরকার।

আশা করছি সামনে এ ধরনের আরো কিছু উপন্যাস পড়তে পাবো যা আমাদের ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থার দিকে কিছুটা হলেও চোখে আঙ্গুল তুলে দেখাবে, যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নানা কারণে এড়িয়ে যাওয়া এমনি সব বিষয়ের উপর দেবে কিছু সময়ের জন্য একটু হলেও চিন্তার খোরাক !
Profile Image for Sharif Mohammad.
20 reviews4 followers
May 23, 2019
লেখক সুহান রিজওয়ানের দ্বিতীয় বইটি আমার পড়া তার প্রথম বই। যদিও তার প্রথম উপন্যাস 'সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ' প্রথম প্রকাশের পরই বইমেলায় শুদ্ধস্বরের স্টল থেকে কেনা হয়েছিল, তবুও সে বইটি এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি। তাই লেখকের লেখনীর সাথে ভালভাবে পরিচয় 'পদতলে চমকায় মাটি'-তে। পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক ইতিহাস ও সংগ্রামকে উপজীব্য করে বাংলায় লেখা উপন্যাস হয়ত এটাই প্রথম। আর সেই গন্ধমাদন পর্বত মাথায় নিতে লেখক তার তথ্য ও গবেষণার মধ্যে এতটুকু ত্রুটি রাখেননি। বঙ্গীয় বদ্বীপের মানুষ মূলত হোমোজেনাস জনগোষ্ঠী, যারা অঞ্চলভেদে ভাষা ও সংস্কৃতিগত সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্যসত্ত্বেও মূলত একই এথনিসিটিভুক্ত। পার্বত্য জেলার মানুষেরা হল এর ব্যতিক্রম। দেশের এই দুর্গম ও ক্ষুদ্র একটি অংশের মানুষ হিসেবে তাদের কৃষ্টি, ধর্ম, লোকাচার সবই ভিন্ন। আর যেকোন হোমোজেনাইজড সমাজের যে সুপ্ত বিপদ তা হল, ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মের প্রতি এক ধরনের তাচ্ছিল্য ও তাকে বেদখলিকরণের বাসনা। এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির এক অনন্য ও অদ্ভুত জগাখিচুড়িতে পাহাড়ি মানুষের বঞ্চনা ও বৈষম্যের সূত্রপাত। লেখক এধরনের বহু জটিল বিষয় উপন্যাসে বিভিন্ন প্লটের ফাকে ফাকে আমাদের জানিয়ে দিতে ভুল করেন না। পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাধের নির্মাণ থেকে শুরু করে পাহাড়ি মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অবদান ও বীরত্ব, এম এন লারমার বেড়ে ওঠা, তার রাজনৈতিক দর্শনের বিবর্তন, জনসংহতি সমিতি ও তার কার্যক্রম, তার অপঘাতে মৃত্যুর পরে বহুধাবিভক্ত পাহাড়ি রাজনীতি ও যোগ্য নেতৃত্বের সংকট, শান্তিচুক্তি নামের প্রবঞ্চনা- অনেক অজানা তথ্যসমৃদ্ধ বইটিতে লেখকের শ্রম ও মেধার পরিচয় স্পষ্ট। সাবপ্লট হিসেবে সমকালীন ঢাকাই তথা দেশীয় রাজনীতি, আশাহীনতা, বেকারত্ব, বাংলাদেশের ফুটবলের অনেকটা কাল্পনিক অথচ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তব অবস্থার বর্ণনা আশ্চর্যজনক। আদিবাসী জীবন ও ইতিহাস নিয়ে লেখা হলেও আমার কাছে উপন্যাসের মূল চরিত্র দুই বন্ধু হিমেল এবং আরিফ। এই দুই মধ্য বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত ঢাবি পড়ুয়া তরুণ যেন একই স্পেকট্রামের দুই মেরুর বাসিন্দা। একদিকে আতেল, রাজনীতি সচেতন পাহাড় বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য জানা গবেষক হিমেল- যে পাহাড়িদের বিভিন্ন সমস্যা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করে, তাদের অভিযোগ ও অধিকার আদায়ে একাত্ম বোধ করে, তবুও কোথায় যেন একটা ফাক, একটা দূরত্ব যেন সবসময় বজায় রেখে চলে। তাই ত সহকর্মী বিজয়কে পুলিশ আটক করলে তাকে ছাড়াতে গিয়ে তার ভয় হয় গ্লাসগোতে হয়ে যাওয়া স্কলারশিপ হারাবার। বহু পড়ার সুবাদে খানিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা ছেলেটি বিপ্লবের সামনে দাঁড়িয়ে হারাবার পিছুটানে যেন ��িমূঢ় হয়ে পড়ে। তখন তার যেন পালিয়ে বাচাই একমাত্র নিয়তি। হিমেল আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের সমগ্র শিক্ষিত তরুণসমাজ (আমি সহ)। যারা স্যুডো-ইন্টেলেকচুয়াল এক ভণিতা ধরে শুধুই উপরে উঠে যাবার সিড়ির সন্ধানে ব্যস্ত। অপরদিকে মধ্যবিত্ত ঘরের অতি সাধারণ আরিফ তার গড়পড়তা মেধা আর অতি সামান্য ইতিহাসজ্ঞান নিয়ে চাকরির লোভে পাহাড়ে গিয়ে যেন অনেকটাই সচেতন আর জাগ্রত হয়ে ওঠে। পাহাড়ের মানুষের আকুতি তাকে স্পর্শ করে, তার প্রতিবাদের ভাষা জোগায়। তাই ত পুলিশের ক্ষমতাধর ওসিকে দুকথা শুনিয়ে দিতে তার বাধে না। ক্ষমতার আস্ফালন, পেশীপ্রদর্শন তার ক্ষোভের কাছে পাত্তা পায় না। সহকর্মীর ন্যায়বিচারের দাবির পরিণামের কথা তার মনে থাকে না। কোনকিছু হারাবার নেই বলেই হয়ত নিজের কথা তার মনে হয় না।

এবার আসি লেখকের যৎকিঞ্চিত সমালোচনায়। আমার দৃষ্টিতে বইটির ত্রুটিগুলো এক. দৃষ্টিকটু রকমের বানান বিভ্রাট। অত্যধিক মুদ্রণপ্রমাদের কথা বাদ দিলেও একই শব্দ বারবার ভুল বানানে লেখা হলে লেখকের বানানজ্ঞান নিয়ে সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়। 'উদ্যম' শব্দটিকে বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় 'উদ্যাম' হিসেবে লেখা হয়েছে। এরকম আরো ভুলের উদাহরণ দেয়া যাবে। দুঃখজনক হল লেখক সমকালীন রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে অভিজিৎ রায়ের নামোল্লেখ করেছেন। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেছি, 'অভিজিৎ' না লিখে লেখা হয়েছে অভিজিত। এরকম একটি শ্রমসাধ্য বই লেখার ব্যস্ততায় লেখক বোধহয় অভিজিৎ রায়ের সঠিক বানানটি খুজে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। দুই. উপমার ব্যবহারে বাড়াবাড়ি। যেহেতু আমার পড়া এটা লেখকের প্রথম বই তাই তার লেখনীর সাথে সবিশেষ পরিচয় আমার নেই, তবে ধরে নিতে পারি বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনায় অনাবশ্যক উপমার ব্যবহারের প্রতি তার দুর্বলতা পাঠক হিসেবে আমার জন্য বিরক্তি উদ্রেককারী। তিন. "রোদে পুড়ে মুখ একটু কালোর দিকে গেলেও ব্যাটার মাঝে একটা বেশ আলাপী ভাব আছে"- এই বাক্যের আকাঙ্ক্ষা, আসত্তি ও যোগ্যতা কী? ৩৫তম পরিচ্ছেদের দ্বিতীয় পৃষ্ঠার প্রথম লাইনটিতে গায়ের পোড় খাওয়া চামড়ার সাথে চরিত্রের আলাপী ভাবের সংযোগ স্থাপন আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এরকম কিছু খাপছাড়া বাক্য মাঝে মধ্যেই খুজে পেয়েছি। আরো ছোটখাট কিছু ব্যাপারে আপত্তি থাকলেও সেগুলো প্রণিধানযোগ্য নয়।

সর্বোপরি, আমার ছিদ্রান্বেষণ সম্পূর্ণই পাঠক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। " পদতলে চমকায় মাটি" আমার মত আরো অনেককে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ইতিহাস সন্ধানে আগ্রহী করে তুলবে এই আশা রাখি, এবং শুধুমাত্র এই একটি কারণে হলেও লেখকের ধন্যবাদ প্রাপ্য।
Profile Image for Soumik.
83 reviews17 followers
June 30, 2020
রাত তিনটা তেরো-তে আমি যখন বইটা শেষ করছি, তখন মাথার মধ্যে অনেকগুলো বিক্ষিপ্ত ভাবনা মেলানোর চেষ্টা করে চলেছি। সমর কুমার চাকমা কি রাণী দয়ময়ী স্কুলের মাঠ, অসুস্থ বাবা, পাহাড় এবং তার প্রিয় শান্তিপ্রিয়ার বিস্তৃত চিন্তাগুলো মাথায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সাত হাজার মানুষের উৎসুক চোখের সামনে ইউনাইটেডের গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে বল জালে জড়াতে পেরেছিলো? লেখক সুহান রিজওয়ান এর উত্তর দিলেন না। তিনি আরো অনেক চিন্তার আগুন চোখের সামনে জ্বালিয়ে রেখে দিলেন - বিজয় ও তার পরিবার কি এই জনপদের ঘৃণ্য রাজনীতির রোশানল থেকে মুক্তি পেয়েছিলো? আরিফ কি পাহাড়ে ফিরে যেতে পেরেছিলো? আর হিমেল? আজাদ স্যার এর এতো ত্যাগের পর কি তাঁর স্বপ্নপূরণ হয়েছিল?

রাণী দয়ময়ী স্কুলের মাঠ একসময় দাপিয়ে বেড়ানো সমর কুমার চাকমা পাহাড় আর হাজারো স্মৃতি পেছনে ফেলে এসে দাঁড়ায় দুই কোটি মানুষের শহর এই ঢাকায়। অপরদিকে রিসার্চের কাজে আরিফ আর হিমেল ঢাকা ছেড়ে এসে মুখোমুখি হয় বোধহয় দেশের সবচেয়ে প্রত্যন্ত ও বিতর্কিত অঞ্চল পাহাড় আর তার প্রাচীন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির। আর তারপর একে একে সুহানের লেখায় উঠে আসে করুণ সব ইতিহাস যার অধিকাংশই বিকৃত, পরিবর্ধিত নয়তো ধামাচাঁপা দেওয়া। এই আদিবাসী অধ্যুসিত অঞ্চলে যেনো বেঁচে থাকাটাও একটা সম্মুখ যুদ্ধ। একদিকে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীরা আরেকদিকে বাঙালী স্যাটেলার, একদিকে ঘুঁনে ধরা একটা সিস্টেম আরেকদিকে পাহাড়ের ইতিহাস, যেনো বারবার বলে যেতে চাইছে এই সমস্যার শেষ কোথায়?

সমস্যার শেষ আসলে নেই। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ডিসক্রিমিনেশন, বাঙালী স্যাটেলারদের সংখ্যাগুরুসুলভ আচরণ, নিরীহ আদিবাসী ও বাঙালী মানুষের উপর পারস্পরিক ক্ষোভ, রোশানল ও নির্যাতন যেনো সাক্ষী দিয়ে চলেছে এক করুণ অমিমাংসিত এই রাজনীতিঘেরা জনপদের। রিসার্চের কাজে স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে আরিফ আর হিমেল বুঝতে শুরু করে সমস্যার মূল আসলে অনেক গভীর, যার সমাধান একদিনে সম্ভব হবে না। আর এই সমাধানহীন সমস্যার ট্যাকল দিতে গিয়ে আরিফ নিজেকে আবিষ্কার করে একজন সদ্য আঠারো পেরোনো ফেসবুক কাঁপানো তরুণের মতো বিপ্লবী রুপে। আরিফ যেনো আমাদেরই উপস্থাপন করে, আমরা যেমন রাজনৈতিক দানবদের জন্ম দেয়া দৈনন্দিন ঘটনাগুলো দেখে নিজেকে আবিষ্কার করে ফেলি ত্রাতা রুপে, যেনো আমরাই একটা নষ্ট সিস্টেমকে আবার লাইনে নিয়ে আসবো। যেটা মূলত কখনো করা হয়া না।

উপন্যাসটি ফুটবলের মতোই পালাবদল করতে থাকে কখনো ঢাকায় তো কখনো পাহাড়ে। মাঝেমাঝে হিমেল-আরিফ-সমরের স্মৃতিকাতরতায় কিংবা অতীত ঘটনাবলীতে। যেখানে সমর জিইয়ে রেখেছে শান্তিপ্রিয়ার মুখ, বাবা রতন চাকমার বার্ধক্য, ফুটবল আর বিশাল, অব্যক্ত পাহাড়। আচ্ছা শান্তিপ্রিয়াকে যারা ধর্ষণ করেছিলো তাদের কেনো শাস্তি হলো না? অন্যায় কিংবা প্রতিশোধ যেটাই হোক না কেনো, একজন মেয়ের গায়ে হাত দেয়ার অধিকার তারা কোথায় পেলো? নাকি এটা পাহাড়ের মেয়েগুলোর একমাত্র পরিণতি তাদের নিজেদের অধিকার চাইবার বিপরীতে?

লেখক সুহান যে ঢাকা শহরকে কি ভয়ঙ্করভাবে চিনেন সেটা তার লেখনিতে স্পষ্ট। আমি ২০ বছর সিলেটে থেকেও হয়তো সিলেটের অলিগলি সম্পর্কে এতো স্পষ্ট বর্ণনা দিতে পারতাম না। ঝরঝরে লেখা, অনেক সহজাত শব্দের ব্যবহার আর যেকোনো ঐতিহাসিক ঘটনার দারুণ বর্ণনা উপন্যাসকে করে তুলেছে বইমেলার হিড়িকে বর্জ্যপদার্থের মতো নিয়মিত বের হওয়া বইগুলোর থেকে আলাদা। এমনকি বইয়ে ব্যবহৃত প্রতিটি গালিও অনায়াসে মিশে গেছে চরত্রের প্রয়োজনীয়তায়।

ভালো বই পড়ার একটা বড় সমস্যা হলো, একটা বই অনেক বেশি ভাবিয়ে তোলে। একটা ভালো বই শেষ হলে হঠাৎ করে আমার একা লাগে, মাথায় বেশ কয়েকদিন ঘুরপাক খায় আর থেকে যায় চরিত্রগুলো। পদতলে চমকায় মাটি আমার পায়ের নিচের মাটিও কিছুটা কাঁপিয়ে দিয়েছে বৈকি। সুহানের এই ৩৭৫ পেজের প্রচেষ্টাটি অনেক অনেক বেশি জরুরী আমাদের অনেকের মতোই যারা জানেনা বা খোঁজও নিতে চায় না দেশের বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর, পাহাড়ের, বিশ্বজিৎ এর, অভিজিত রায়ের, নূর হোসেনের এবং নাম না জানা অনেক শান্তিপ্রিয়া ও বিজয়ের। সুহান রিজওয়ান তার দুর্দন্ত উপন্যাস পদতলে চমকায় মাটি-তে একই সুঁতায় গাথার চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কয়েকটি আক্ষেপকে। পাহাড়। ফুটবল। রাজনীতি। গণতন্ত্র।।
Profile Image for Mahmudur Rahman.
Author 13 books356 followers
April 18, 2019
ছোট্ট একটা দেশ আমাদের। কিন্তু উত্তরের মানুষ জানে না দক্ষিণে কি হয়। পূবের মানুষ জানে না পশ্চিমে কি হয়। আর রাজধানীর মানুষেরা কোন কারনে অতি ���্বার্থপর। দেশের কোন কোণায় কি হলো তা নিয়ে দুটো মামুলি লেকচার দেওয়ার বাইরে তাদের কিছু করার ইচ্ছে নেই।

শব্দটা 'উপজাতি' হবে, নাকি 'আদিবাসী' তা নিয়ে যে পরিমাণ তর্ক হয় তার সিকিভাগও আসলে এই শব্দ দিয়ে অভিহিত করা মানুষদের সম্পর্কে ভাবা হলে দেশের চিত্রটা অন্যরকম হওয়া সম্ভব ছিল। ইদানীং অনেকেই রাঙামাটি, বান্দরবান 'ট্যুর দেয়', কিন্তু সেখানকার ইতিহাস, সেখানকার মানুষদের নিয়ে কারও কোন ভাবনা আদৌ আছে কি?

পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ওই এলাকা নিয়ে একটা ছোট্ট কাঁটা বিঁধে আছে স্বাধীনতার সময় থেকেই। এরপর নানা সময়ে নানা ভাবে সে কাঁটা বিঁধেছে বাংলাদেশের শরীরকে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের জন্য যেমন তা হয়েছে মাথাব্যথার কারন, তেমনি ওই অঞ্চলের মানুষকে দিতে হয়েছে দাম।

ব্যক্তির হাত ধরে যে যে গল্প ব্যপ্ত হয়ে ছুঁয়ে যায় দেশ কাল ইতিহাসকে, আমার কাছে তা-ই 'আখ্যান'। ফুটবলার সমর কুমার চাকমাকে দিয়ে শুরু হওয়া 'পদতলে চমকায় মাটি' আমাদের একে একে নিয়ে যায় পাহাড়ের বুকে। সেখানে ঝর্ণার গানের পাশাপাশি লেখক আমাদের ‘গান ফায়ার’ শোনান। সমরের দাদীর মুখে কিছু পাহাড়ি পুরাণ হয়ত শোনা যায়, কিন্তু লেখক আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেন পাহাড়ের ইতিহাস। সন্তু লারমা থেকে সমর কুমার চাকমা। কল্পনার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া থেকে শান্তিপ্রিয়ার গল্প।

একই সঙ্গে সমরের পায়ে ফুটবল এগিয়ে চলে। শামিম আজাদের স্বপ্ন সমরের শক্তিতে এগিয়ে যায় একটু একটু করে। একদিকে মাঠে সমরের কুশলতা, অন্যদিকে আমরা দেখি বর্তমান সময়ের অর্থাৎ প্রযুক্তির যুগে বড় হওয়া কিছু ছেলেপেলের জানার পরিধি আর মতের অগভীরতা। অথচ সুযোগ পেলে তারাও বদলে যেতে পারে।

ফুটবল আর পাহাড়কে সমান্তরালে রেখে সুহান ভাইয়ের দ্বিতীয় বই, দ্বিতীয় উপন্যাস। আমার এই লেখাটা তার বইয়ের ‘পাঠ প্রতিক্রিয়া’, ‘পাঠ অনুভূতি’, কিংবা ‘রিভিউ’ না; ‘ব্যবচ্ছেদ’ তো কস্মিনকালেও না। আমি বলতে চাইছি বইটায় কী আছে। কেন বইটা আমরা পড়বো?

পড়বো কেন না পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে আমাদের মূলধারার সাহিত্যে লেখালেখি হয়েছে খুবই কম। সেলিনা হোসেনের কিছু লেখা, হরিপদ দত্তের ‘চিম্বুক পাহাড়ের জাতক’ কিংবা এর তার কিছু গল্প ছাড়া ‘কংক্রিট’ কিছু নেই বললে বোধয় ভুল হবে না। সেখানে সুহান রিজওয়ান একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখেছেন অনেক লম্বা একটা সময়, সেই সময়ের ঘটনা এবং মানুষদের। বর্তমান বাংলাদেশী সাহিত্যের ক্ষেত্রে যা বিরল এবং সাহসী পদক্ষেপ।

যদিও বলেছি বই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এটা নয়, তবু বলে রাখি ‘সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ’-এর অব্যবহিত পরে এই বই পড়ার কারনে কিংবা অন্য কোন কারনে কিছু জিনিসে অতৃপ্তি রয়ে গেছে। যদিও নিজে লেখার সুবাদে বুঝি যে লেখক যা নিয়ে লেখেননি, তা নিয়ে আলোচনা বাতুলতা তবু মনে হয়েছে আরও কিছু চরিত্র আসতে পারতো। না এলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু সর্বদ্রষ্টা হিসেবে লেখকের নিজস্ব বর্ণনার মাঝে কিছু চলতি কথা বা ‘স্ল্যাং’ (স্ল্যাং মানেই গালি নয়) চলে আসায় পড়ার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকবার ছন্দপতন অনুভূত হয়।

এরকম একটা বই হয়ত দরকার ছিল আরও আগে। কিংবা এরকম একটা বইয়ের প্রয়োজন ছিল ঠিক এই সময়েই। আমার নিজস্ব ধারণা বই হিসেবে ‘পদতলে চমকায় মাটি’ সার্থক। লেখকও সার্থক। কিন্তু দায় এখানেই শেষ হয় না। দায় থাকে পাঠকের, দায় থাকে যারা নিজেদের এই দেশের সচেতন নাগরিক বলে দাবী করেন। দায় হলো এই বইকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। দায় হলো বইয়ে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আরও বিস্তারে জানা এবং জানানো। সেটি যেদিন হবে, সেদিন আসলে আমরা সার্থক হবো।
Profile Image for অপরিচিত আবির.
19 reviews5 followers
February 27, 2019
সমর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।। সমর মানে যুদ্ধ, আমাদের সমরও যুদ্ধ করতে এসেছে। তবে সে পাহাড়ে যেমন যুদ্ধ দেখে এসেছে সমর তেমন যুদ্ধ করতে চায় না। এজন্যই হয়ত সমর নামের শান্তিপ্রিয় ছেলেটি এ মেয়েটিকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে তার নাম শান্তিপ্রিয়া। এজন্যই হয়ত লাশের, বুটের আর অস্ত্রের যুদ্ধ৷ শান্তিপ্রিয়ার পরিণতি সব স্মৃতিতে জমা করে রেখে সে ঢাকায় আসে ফুটবল মাঠে যুদ্ধ করতে। এজন্যই হয়ত তার অবচেতন মন আপন করে নিতে পারে না ফুটবলের বুটজোড়াকে অথবা ঢাকা শহরের সেই সব মানুষকে যাদের দুঃখ, ভালবাসা, দুশ্চিন্তাগুলো সমরের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখে ফেলে আসা যুদ্ধ আর ফেলে আসা স্মৃতি আর সামনে থেকে টানে আজাদ নামের এক মাঝবয়সী ক্ষ্যাপাটে ফুটবল কোচ।

ওদিকে আরেক মূল চরিত্র আরিফ বাস করে সমরের তরঙ্গের বিপরীত স্পেকট্রামে। নগরীর আরো হাজারো বিষন্ন যুবকের মত আরিফের দিন কাটে অ্যাপাথি আর তার ক্ষুদ্র জগতকে সঙ্গী করে। পাহাড়ের যুদ্ধ, আমেরিকার ইলেকশান, রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচ বা নত্নন কোন চলচ্চিত্র - সবটাই তার কাছে একইরকম, ফেসবুকের স্ট্যাটাস বা চায়ের দোকানের আড্ডার বিষয়। পাকে চক্রে রিসার্চের ছুতোয় আরিফকে যেতে হয় পাহাড়ে। এখান থেকেই সমরের পাহাড়ের কথা ভুলে যাওয়া আর আরিফ এবং পাঠকের পাহাড়ের কথা জানার যাত্রা শুরু।

নিতান্তই নবিশ পাঠক যেহেতু, কাজেই সুহানের লেখা উপন্যাসের যকল গুণাগুণ, সুর-তাল-লয় মেনে চলতে পেরেছে কিনা সেটা বলার মত যোগ্যতা বা জ্ঞান কোনটাই নেই। চরিত্রদুটোর ডুয়ালিটি নিয়ে হয়ত আরো কাজ করার জায়গা ছিল, তাদের প্যাসিভনেসের স্থায়িত্ব কি একটু বেশি হয়ে গিয়েছে কিনা, এক্সপোজিশনের স্টাইলটা কিছুটা বদলানো যেত কিনা - ইত্যাদি খুঁটিনাটি আলোচনা পড়তে পড়তেই সুহানের সাথে করা হয়ে গেছে। কিছু অভিযোগ তো আছে বটেই। আরিফের চোখে পাহাড়ের ইতিহাস এবং পাহাড়ের বর্তমান যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে বিভিন্ন জাতি আর পেশার লোকেদের বর্ণনায়, সেখানে কী সুহান আরেকটু সাহসী, আরেকটু পাহাড়ঘেঁষা ন্যারেটিভের দিকে যেতে পারত না? দেশের ফুটবল ইতিহাসের একেকটা ছবি উঠে এসেছে কোচ আজাদের স্মৃতিচারণায়, সমরের চোখে বর্তমানটাও হয়ত উঠে আসতে পারত। পাঠকের বুদ্ধির আর পঠনের অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা করে সুহান আর অনেক নাম, চরিত্র, ইতিহাস আর বর্তমান লিখে রেখেছে শূন্যস্থানে, জলছাপের মত, পাঠকের প্রজ্ঞার ওপর এত ভরসা থাকাটা ভুল হয়ত। এসব আলোচনায় খুব বেশি কিছু আসে যায় না, কারণ পাঠক হিসেবে সুহান কী লিখতে চেয়েছে, কী জানাতে চেয়েছে সেটা আমার মত পাঠকের মাথাতেও যেহেতু ঢুকেছে তবে সম্ভবত ভয় নেই। ন্যারেশনের ভঙ্গিমাও পরিবর্তন হয়েছে সুহানের, পরিবর্তন হয়েছে উপন্যাসের স্ট্রাকচার। সিগনেচার “মনোরম মনোটনাস” বর্ণনাও আছে প্রায়ই। ফুটবল প্রেমীদের জন্য আছে টানটান ফুটবলের ধারাবিবরণী, ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য রেফারেন্স আর চিন্তার খোরাক, ফেসবুক স্ট্যাটাসপ্রেমীদের জন্য কোটেবল লাইন।

সব মিলিয়ে সুহানের আগের উপন্যাস “সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ” থেকে সাহিত্যগুণে এগিয়েই রাখব এবারের “পদতলে চমকায় মাটি” কে। গুরুত্ববিচারে এগিয়ে থাকবে কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে।
Displaying 1 - 30 of 81 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.