আশি দশকের শুরুতে মফস্বল শহরের গল্প। একটি বৃহৎ পরিবারের বড় সন্তান কামরুল আকন্দ হঠাৎ আক্রান্ত হলো - সাতসকালে দোকান খুলতেই কেউ একজন গুলি করে বসল তাকে। স্থানীয় থানার ওসি আমিনউদ্দিন লেগে পড়ল তদন্তে। কিন্তু কে আছে এর পেছনে? আকন্দ পরিবারের কেউ, নাকি বাইরের কোন মানুষ? পরিবারের প্রধান করিম আকন্দও বসে নেই।
গল্পে আরো আছে অনন্যা, কাউকে ভালবাসে সে। আছে অর্ণব। উদাসীন এক যুবক। সে-ও ভালবাসে কাউকে। আছে শেঁকড়ের টানে বারবার ফিরে আসা তপন।
ইউসুফ জালাল আকন্দ পরিবারের মেয়ে জামাই। ক্ষমতা আর টাকার জন্য সে কতোদূর যাবে?
আমাদের ফেলে আসা অদ্ভুত আর আশ্চর্য সেই ছায়া সময়ের গল্প নিয়ে শরীফুল হাসানের উপন্যাস 'ছায়া সময়'।
Shariful Hasan hails from Mymensingh, Bangladesh. He has spent his childhood by the banks of Brahmaputra river. He completed his Masters in Sociology from University of Dhaka and is currently working in a renowned private organization.
Shariful's first novel was published on 2012 titled Sambhala. With two other books, this captivating fantasy trilogy has received widespread acclimation both within and beyond the borders of Bangladesh. The Sambhala Trilogy was translated in English and published from India.
Although his inception consisted of fantasy and thriller, he has later worked on a variety of other genres. These works have been received fondly by the Bangladeshi reader community. Lot of his works have also been published from different publications in West Bengal.
Award- Kali O Kalam Puroshkar 2016 for 'অদ্ভুতুড়ে বইঘর'
যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ, আশির দশকের ময়মনসিংহ শহর। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল, চলছে ক্রমাগত ক্ষমতার পালাবদল। প্রভাবশালী আকন্দ বাড়ির বড় সন্তান কামরুল আকন্দকে সাতসকালে দোকান খুলতেই কেউ একজন গুলি করে বসল হঠাৎ। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই শুরু হলো গল্প। স্থানীয় থানার ওসি আমিনউদ্দিন লেগে পড়ল তদন্তে। কিন্তু কে আছে এর পেছনে? আকন্দ পরিবারের কেউ, নাকি বাইরের কোন মানুষ? পরিবারের প্রধান করিম আকন্দও বসে নেই।
ক্ষমতা আর অর্থের লোভ, মানুষকে কোন পর্যায়ে নামিয়ে দেয়, পুরো বই জুড়ে আমরা একের পর এক দৃষ্টান্ত দেখি। চোখের সামনে বদলে যেতে থাকে চিরচেনা নিরীহ ইউসুফ জালাল, আকন্দ পরিবারের মেয়ে জামাই। টাকার জোর মানুষকে কথা বলতে শেখায়, তা সে যেই উৎস থেকেই আসুক না কেন! সেই পরিবর্তন আমাদের বিস্মিত করে; অবক্ষয়ের স্পষ্ট চিত্র দেখে ছটফট করতে করতে ভাবি, এ তো সমাজের চিরন্তন বাস্তব।
এক মফস্বল শহরের ক্ষমতাশীল পরিবার চোখের সামনে একটু একটু করে ধ্বসে যেতে থাকে। সমান্তরাল গতিতে আমরা খুঁজে পাই একটি প্রেমের গল্প, এক ভবিষ্যৎ লেখকের ধাপে ধাপে নিজেকে আবিষ্কার করাকেও উপলব্ধি করি। পুরো উপন্যাসে নির্জীব থেকে, কোন বাক্যব্যয় না করেও কামরুল প্রতি মুহূর্তে জানান দিয়ে যায় নিজের উপস্থিতি; দীর্ঘশ্বাস ফেলতে বাধ্য করে পাঠককে।
ফেলে আসা অদ্ভুত আর আশ্চর্য ছায়া সময়ের গল্প নিয়ে এই উপন্যাস আমাদের স্থবির করে দেয়, উত্তাল বিষণ্ণতায় ভোগায় প্রবলভাবে। চরিত্রগুলো যেন চোখের সামনে হাঁটছে-ফিরছে; সময় আর প্রেক্ষাপটের সাথে মিশে যাচ্ছে পাঠকের নিজের অস্তিত্ব- কী অদ্ভুত!
শরীফুল হাসান এর সাম্ভালা পড়ার পর ছায়া সময় ওনার লেখা সম্পর্কে একেবারে অন্যরকম একটা ধারনা তৈরি করল। এতটা বিন্যস্ত পরিপাটি লেখা সত্যি বলতে আশাও করিনি। গোটা সময়টাই বলা যায় একরকম মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে ছিলাম।
একটা ছিমছাম মফশ্বল শহর এবং তার ভেতরের সবথেকে প্রতাপশালী আকন্দ বাড়ীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অনেকগুলো ঘটনা। একদিকে মফশ্বল এর মিষ্টি প্রেমের স্পর্শ আর অন্যদিকে রাজনীতি, ক্ষমতা, প্রতিপত্তির জন্য চরম স্বার্থপরতা ও নিষ্ঠুরতা। ভিটে মাটির টানে মানুষ কি করতে পারে, ক্ষমতার লোভে মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে আবার অন্যদিকে ভালবাসা আর বিশ্বাস থেকেও মানুষ কতটা করতে পারে তার দৃষ্টান্তগুলো সত্যিই অবাক করে।
তবে কামরুল এর চরিত্রটাকে সুস্থ অবস্থায় একটু যদি দেখাতেন লেখক তাহলে বোধহয় ভাল হত। যার প্রতি সবার এত মায়া এত দরদ তাকে ঠিক বুঝেই ওঠা গেল না। আর একটা জিনিস খুব বিরক্ত করেছে পড়ার সময়। সেটা হচ্ছে চরিত্রগুলোর নাম। এত কাছাকাছি নামগুলো যে কোনটা কে বারবার গুলিয়ে যাচ্ছিল। আলাল, দুলাল, খলিল, জলিল, জালাল, জয়নাল উফফফ😑😑 আমি মনে হয় ইতিমধ্যে ভুলেও গেছি কোনটা কে।
আমি মুগ্ধ, অভিভূত। শরীফ ভাইয়ের লেখনীর ভক্ত আমি দীর্ঘদিন, কিন্তু এখানে যেন উনি নিজেকেই ছাড়িয়ে গেলেন। করিম আকন্দ, অর্ণব, ইউসুফ, কামরুল, ওসি আমিন উদ্দিন, অনন্যা, গলাকাটা কোহিনূর, সর্বোপরি যে বাড়িটা নিয়ে কাহিনী আবর্তিত- আকন্দ বাড়ি কিংবা শ্রীলেখা ভবন- অনেক দিন আমার স্মৃতিতে থাকবে। অনেক দিন পর একটা বই শেষ করে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম কিছুক্ষণ।
সাম্ভালা শরীফুল হাসানকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। আমার মনে হয়, ছায়া সময় তাকে অমরত্ব এনে দিবে।
জীবনে যতগুলা ভালো কাজ করেছি সম্ভবত তার মধ্যে একটা হলো এই বই এর কোনো রকম রিভিউ ফ্ল্যাপ না পড়েই প্রথমে কেনা তারপর সেল্ফ থেকে বের করে পড়া! এই বই এর একটা শব্দ যেন আগে থেকে জানা থাকলে স্পয়লার হয়ে যেত।
কিছু না বলা, আলোচনা না করা মাস্টারপিস হিসাবে থাক বইটা আমার কাছে। লেখক কে ধন্যবাদ অসাধারণ আরেকটা সৃষ্টির জন্য।
শরীফুল হাসানের প্রায় সব বই-ই পড়ে ফেলেছি। বলতে দ্বিধা নেই, 'ছায়া সময়' তার সবচেয়ে সুলিখিত উপন্যাস। আর এখনো পর্যন্ত এটাকেই তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বললেও ভুল বলা হবে না হয়তো।
লেখককে প্রথমে ধন্যবাদ দূর পরবাসে ত্রহাকা পাঠককে মনে করে বিনা কোন শর্তে বইটির পি ডি এফ পাঠাবার জন্য। এরপরে ধন্যবাদ আশির দশকের মফস্বলের সময়কে এত সুন্দর করে তুলে ধরবার জন্য।
গল্প বলার ধরণ বা চরিত্রের ভাবনা চিন্তা , কথা বলায় একটু অন্য কারো লেখনীর খুবই হালকা ছায়া থাকলেও পড়তে গেলে দেখা যায় একটা মৌলিকতা হুট করে বের হয়ে আসছে। সেটা পুরোটা জুড়ে থাকলেই বেশি ভাল লাগতো। এটার জন্য আমি না লেখকের দোষ দেই না পাঠকের। কারণ বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে আমরা সেই কথাশিল্পীর লেখা এত বেশি পড়েছি যে না চাইলেও মিল খুঁজে পাই বা চলে আসে প্রভাব লিখবার সময়। এটা আমার বুঝবার ভুলও হতে পারে।
করিম আকন্দ কে যতটা প্রভাবশালী বলে দেখান হয়েছে কেন জানি ঠিক সেরকম প্রভাবশালী মনে হয়নি। তার সম্পত্তি আছে , সম্মান আছে কিন্তু মনটা যথেষ্ট নরম মনে হল। অন্যদিকে সবথেকে আকর্ষণীয় চরিত্র আমার কাছে লেগেছে ওসি আমিনুদ্দিন। সে বাজারে মেয়ে মানুষের কাছে যায় কিন্ত কারো ধার ধারে না। তার উপর কারো প্রভাব নেই।
টিনেজ বয়সের প্রেম টা খুব উপভোগ্য। কারণ আশি নব্বই দশকের কৈশোরের প্রেম এর সবকিছু এখানে ছিল।
বইটা কি আমি আবার পড়বো? হ্যাঁ। তবে খুব শক্ত কোন অনুভূতি পাবার জন্য নয় বরং সেই পুরনো সময়টাকে ধরব্র জন্য বারবার পড়বো।
দু ঘন্টা রেষ্ট নিয়ে পর পর দুটি বই শেষ করেছি শরীফুল হাসানের। তার লেখার ষ্টাইলে তা করাই যায়। এবারে আসল কথাই আসি , বইটা নিয়ে যে এক্সপ্টেশান ছিল তার কয়েকশ গুন বেশি পেয়েছি। প্রথমে যারা এই বই পড়বেন খুব মনযোগ দিয়ে পড়বেন না হলে এত এত ক্যারেক্টার যে গুলিয়ে ফেলবেন। মাথা ঘুরাবে, আকন্দ ফ্যামিলি তিন ভাইয়ের দুই জেনারেশন, জামাই তার ফ্যামিলি, পুলিশ অফিসার, কৈহিনূর ডাকাত, চক্রবর্তো পরিবার, সাহা পরিবার, অন্যন্যা , অর্নব, তপন এত এত ক্যারেক্টর এত এত কাহিনী যে পড়তে গিয়ে হিমশীম খেতে হয়েছে। তবে লেখার স্বাভাবিকতা গুনে প্লট চলেছে অসাধারণ ভাবে। একবারের জন্যে বিরক্তি আসেনি। অতিরিক্ত মানুষের আনাগোনা হলেও পড়তে খুব অসুবিধা হয়নি। মূল গল্প যে কামরুলকে ঘিরে থাকে একেবারে কোমাই রেখেছেন তিনি , কোথাও না জাগালেন বাট কিছু ইনফো দেওয়া হলে ভাল লাগত আর বেশি ।
বেশি কিছু বলব না , বইয়ের নামকরণ কে করেছে জানি না যিনি করেছেন তাকে আলাদা ভাবে ধন্যবাদ,অত্যন্ত সার্থক নাম করণ হয়েছে।
#রিভিউ ছায়া সময় শরীফুল হাসান বাতিঘর প্রকাশনী জনরা: সমকালীন উপন্যাস পৃষ্টা: ২৮৬ প্রচ্ছদ: জিয়াউদ্দিন বাবু
একান্নবর্তী আকন্দ পরিবারের পালিত বড় ছেলে কামরুল। পালিত হলে কি হবে, পুরো পরিবার আবর্তিত হয় কামরুলকে ঘিরে। পারিবারিক সবকিছু সামলায় সে। একদিন কে যেন ভরা বাজারের মধ্যে কামরুলকে গুলি করে পালিয়ে গেল। কে গুলি করলো কামরুলকে? পরিবারের কেউ নাকি বাইরের? অনন্যা চক্রবর্তী ভালোবাসে একজনকে অন্যদিকে অর্ণব সাহাও ভালোবাসে আরেকজন মেয়েকে। তাদের প্রেম কি পূর্ণতা পাবে? আকন্দ পরিবারের নিরীহ ঘর জামাই ইউসুফ কি কামরুলের অনুপস্থিতির সুযোগ নেবে? কামরুলের এ অবস্থার পর পরিবার প্রধান করিম আকন্দ কি এ ঐতিহ্যবাহী পরিবার সামলাতে পারবে নাকি ঘরের ও বাইরের মানুষদের চক্রান্তে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে আকন্দ পরিবার? এসব কিছু নিয়েই গড়ে উঠেছে ছায়া সময়।
পর্যালোচনা ও অন্যান্য: মুক্তিযুদ্ধের পরের বা মধ্য সত্তুর দশকের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে প্রখ্যাত লেখক শরীফুল হাসানের উপন্যাস ছায়া সময়। এর আগে লেখকের আলোচিত কাজ ছিল সাম্ভালা ট্রিলজি, মেঘ বিষাদের গল্প, রাত্রি শেষের গান ইত্যাদি। প্রত্যেকটা উপন্যাস পাঠকপ্রিয়। ছায়া সময় একটি হারানো জেনারেশনের আখ্যান। বহমানকাল ধরে চলে আসা সামাজিক টানাপোড়নের দৃশ্য দেখানো হয়েছে এ উপন্যাসে। ময়মনসিংহ শহরকে বেশ নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। মফস্বলের রাজনীতি, পারিবারিক বন্ধন, প্রেম,ধর্মীয় টানাপোড়ন, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ক্রাইসিস উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। সবথেকে চোখে পড়ার মত বিষয় হল, লেখক শরীফুল হাসান সাহেবের লেখায় রয়েছে এক অদ্ভুত ধরনের বিষণ্নতা। পড়তে গিয়ে চরিত্রগুলোর টানাপোড়নে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। আমি নিশ্চিত যেকোনো মানুষেরই মন খারাপ করে দিতে সক্ষম ছায়া সময়। গল্পের অন্যতম নায়ক কামরুল দুষ্কৃতীদের গুলিতে আহত হয়ে কোমায় থাকার পরেও পুরো উপন্যাসে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রভাবশালী করিম আকন্দ যেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, জীবনের লড়াইয়ে ক্লান্ত এক সৈনিকের প্রতীক। এ চরিত্রটা সবথেকে বেশি বৈচিত্র্যময়। বিষণ্নতার এক মূর্ত প্রতীক। অনন্যা ও অর্ণব দুই দিক থেকে টিনএজ বয়সের উথালপাতাল প্রেমের প্রতিনিধিত্ব করেছে। সবথেকে বড় কথা এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোট শহরের রাজনীতি ও দেশভাগের পরবর্তী প্রভাব। লেখক শরীফুল হাসান সাহেবের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল উনার সামাজিক বা সমকালীন উপন্যাস এ জনরার অন্যান্য উপন্যাসের মত শুধু কাহিনী দিয়েই শেষ করেন না। উনার এ সমস্ত উপন্যাসের শেষেও থাকে একটা মাথা ঘুরানো টুইস্ট। যথারীতি ছায়া সময়ের শেষের টুইস্টটাও একইসাথে বিস্ময়কর ও বিমর্ষ। বইয়ের অসাধারণ প্রচ্ছদটি করেছেন জিয়াউদ্দিন বাবু। সকল ধরনের পাঠকদের জন্যেই অসাধারণ এক উপন্যাস ছায়া সময়। বিষণ্নতা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতি ও টানাপোড়নে ডুব দিতে চাইলে উঠিয়ে নিন এ বইটি ☺️।
উনিশশো সাতাত্তর সালের ছয়ই মে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাল চলছে এক অন্তর্বর্তী সময় দিয়ে যেন। মানুষজনের চাহিদা পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে খিদে। যা নিচ্ছে এক সর্বগ্রাসী রূপ।
বিশাল আকন্দ পরিবারের রত্ন কামরুল। অন্যান্যরা যেখানে তাঁর বাবা করিমের ধনসম্পদের উপর বসে বসে খাচ্ছে সেখানে কামরুল তৎপরতায় পূর্ণ এক যুবক। দোকান-ব্যবসা, লেনদেন, প্রায় সবকিছু শক্ত হাতে সামলাচ্ছিলো কামরুল। ঐদিনই কে বা কারা গুলি করে দিল করিম আকন্দের পালক পূত্রকে।
বেশিরভাগ মানুষের মন যেন এক অন্ধকার গুহা। লোভ এবং ভয় তাকে দিয়ে কি-না করিয়ে নেয়। তদন্ত কর্মকর্তা আমিনউদ্দিন কাজে নেমে পড়েন। কিন্তু এই কাজ করেছে কে? করিম আকন্দের শত্রু থাকলেও তাকে সবাই সমীহ করে। করে ভয়। এই ভয়ের পিছনে অবশ্য সঙ্গত কারণ রয়েছে। কামরুলের মৃত্যুর পর করিমের ভাই, ভাইয়ের ছেলেরা, মেয়ের জামাই গোবেচারা দেখতে ইউসুফ এবং আরো অনেকের মধ্যে একধরণের শীতল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অর্থ এবং ক্ষমতার লড়াই প্রায় সবসময় বিভীষণ তৈরি করে।
এই আখ্যানে আরো আছেন অনীমেষ চক্রবর্তী। তাঁর দু'ভাই সব বেচা-বিক্রি সেরে চলে গেছেন ইন্ডিয়া সেই কবে। অনীমেষ রয়ে গেছেন, এক হতাশার দৃষ্টি দিয়ে "আকন্দ বাড়ি" এর দিকে তাকিয়ে থাকেন যা একসময় ছিল "শ্রীলেখা ভবন"। অনন্যা অনীমেষের মেয়ে। যার প্রতি হয়তো অর্ণবের দূর্বলতা আছে। আবার মাটির টানে বারবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন তপন। তপন অবশ্য একটু রহস্যময় চরিত্র। নকশাল করছে নাকি এখন সে।
ছয়ই মের ঘটনার পর এই উপন্যাসের প্রায় সকল চরিত্রের মাঝে যেন একধরণের পরিবর্তনের সূচনা হয়। করিম আকন্দের বড় মেয়ে আমিনার স্বামী ইউসুফ জালাল। নিজ ঘর থেকে সৎ মার কারণে বিতারিত এবং স্বশুড় বাড়ি এবং খোদ আমিনার কাছে ছোট হয়ে চলা ইউসুফের চরিত্রের ধীরে ধীরে যে বদল তা চোখে পড়ার মত। আমিনাও আকন্দ বাড়িতে দৌরাত্ম্য চায়। আরো অনেকে চান। এর মধ্যে ঘটতে থাকে একের পর এক ভায়োলেন্স। আধিপত্যের খেলার সাথে সমান্তরালে চলতে থাকে না বলা প্রেমের গল্প।
শরীফুল হাসানের এত প্রশংসা এতদিন কেন শুনেছি তা এই বই পাঠের পর বুঝতে পারলাম। প্রতিটি চরিত্রের রুপায়ন, সময়ের সাথে পরিবর্তন, একই মানুষের অবস্থা এবং সময় ভেদে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি আচরণ, ময়মনসিংহের মফস্বলের মানুষজনে��� তৎকালীন মনস্তত্ত্ব এবং একইসাথে রাজনৈতিক একধরণের নতুন দুয়ারের আভাস, সবকিছুই প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন লেখক। আখ্যানটিকে থ্রিলার বলা যায়, আবার বলা যায় সামাজিক উপন্যাসও। শরীফুলের লেখনী চমক, টুইস্ট এবং গিমিক সর্বস্ব নয়। অনেক কিছু পাঠক আগের থেকেই জেনে যাবেন কিন্তু তারপরও আগ্রহের সাথে পড়ে যেতে থাকবেন। এর পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ হল লেখকের গল্পকথনের সুচারুতা। আমি তাঁর অন্যান্য বই এখনো পড়িনি তবে কেন জানি মনে হয় এই গ্রন্থটি এখন পর্যন্ত লেখকের অন্যতম সেরা কাজ।
এক অদ্ভুত সময়ের গল্প আছে এই বইয়ের দুই মোড়কের মাঝটায়। সময় আমাদের একসময় শেষ করে দেয়। ছায়ার সাথে সময়ের একটি মিল আছে। সময়ের মত ছায়ার সাথেও পেরে ওঠা যায় না।
সময় এবং ছায়ার মাঝে বিলীন হওয়া যায়। সেই বিলীন হওয়ার গল্প-ই মনে হয় "ছায়া সময়"।
সাম্ভালা ট্রিলজি দিয়ে শরীফুল হাসানের লেখার ভুবনে প্রথম প্রবেশ করি। এবার পড়লাম 'ছায়া সময়'। দারুণ গল্পের বুনন। অজ্ঞাত কারোর গুলিতে আহত হয়ে কোমায় চলে যাওয়া কামরুল থেকে শুরু। করিম আকন্দের পালক পুত্র হলেও কামরুলের অসারত্ব বদলে দিল আকন্দ পরিবারের সব সমীকরণ। কাহিনী এরপর ডালপাল ছড়িয়েছে। যেদিকেই গিয়েছে একটা না যোগসূত্র আকন্দ পরিবারের সাথে লেগেই থেকেছে। অনন্যা-কামরুল-অর্ণবের জীবনের যোগসূত্র কাহিনীতে একটা করুণ রোমান্টিকতার আবেশ ছড়িয়ে রেখেছে। কোনো অতিনাটকীয়তা ছাড়াই শেষমেষ এসে কাহিনীটা বিরাট আকার নিয়েছে। যা অন্তরে বড়সড় দাগ কেটে গেল। করিম আকন্দের কুকর্মের ইতিহাস জানার পরও অনন্যার মতো আমারও লোকটার জন্য মায়া লাগছিল।
"যাক অবহেলে সে যখন চায় যাক নিরাবেগ নিষ্ঠুর আমি সমর্পণ করলাম আমার প্রেম, কাম আর দ্রোহ আমি এখন আর কিছু নই হাওয়ার সাথে মিশে যাওয়া রোদ্দুর।" অর্ণবের এই কবিতাটা খুব ভালো লেগেছে। (লিখেছেন নিশ্চয় শরীফুল হাসান।)
“ডিসেম্বর এর শহরে চেনা বন্ধু চেনা নিকোটিন, ডিসেম্বরের শহরে ভালোবাসা যেন পোর্সেলিন।” এই রকম ডিসেম্বরের এক অলস বিকেলে, গরম পিঠা আর কম্বলের ও'মে, হাতে নিলাম শরীফুল হাসানের 'ছায়া সময়' উপন্যাসটি। খুব বেশি এক্সপেকটেশন ছিল না বইটি নিয়ে। শুরুতে মনে হয়েছিল, গতানুগতিক প্লটের সহজ ও সাবলীল উপন্যাস।
গল্পটি একটি শহরের, আমাদের অনেকের পরিচিত, অনেকের প্রিয় ময়মনসিংহ শহরের গল্প।আশির দশকের গল্প, যখন সামরিক শাসন জাকিয়ে বসেছে বাংলাদেশের বুকে, এ রকম মন খারাপ করা সময়ের গল্প। শহরের একটি প্রতাপশালী পরিবারের অভ্যন্তরীণ পলিটিক্সের গল্প, দেশত্যাগের গল্প, অনেকগুলো পাওয়া না-পাওয়ার গল্প। এক আলো আধারী সময়ের গল্প।
গল্পের শুরুটি ছিল অনেকটা সাধারণ উপন্যাসের মত, এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী পরিবারের বড় ছেলে কামরুলের গুলি খাওয়ার মাধ্যমে। যদিও কাম্রুল ছিল করিম আকন্দের পালকপুত্র , কিন্তু সেই আকন্দ পরিবারের সব ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করত। ধীরে ধীরে শুরু হয় , ষড়যন্ত্র- পাল্টা ষড়যন্ত্র যার মাধ্যমে কাহিনি ডালপালা বিস্তার করতে থাকে, যার সাথে জড়িয়ে থাকে অনেকগুলো মানুষের জীবন।
কথায় বলে “পুরানো পাপ পিছু ছাড়ে না”। করিম আকন্দের ক্ষেত্রে কথাটি আরও সত্য। কি করেছিলেন তিনি, অনেক বছর আগে? আবার আপতদৃষ্টিতে নিরীহ মানুষ অনিমেষ , যার পুরো পরিবারকে করিম আকন্দ নিঃশেষ করে দিয়েছিল, সে কি সব সহ্য করে যাবে সবসময়? এই দুই পরিবারের দ্বন্দের যাতাকলে পড়ে কামরুল আর অনন্যার প্রেম, যা ছিল তখনকার যুগে অস্পৃহ্য , তার পরিণতিই বা কি হবে? হাবাগোবা ইউসূফ কি চাল চালছে? জানতে হলে এক নিঃশ্বাসে শেষ করতে হবে ২৮৫ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি।
লেখক শরীফুল হাসানের লেখনী নিয়ে কিছু না বললেই না। এত সাবলীল লেখা খুব কম লেখকের কলম দিয়েই বের হয়। লেখকের বাকি কাজগুলোও পড়েছি, এর মধ্যে’ ছায়া সময়’ সবচেয়ে পরিণত মনে হয়েছে। প্লট , গল্পের গতি, টুইস্ট সবই অসাধারন। সত্যি বলতে লেখক “ ছায়া সময়” উপন্যাসে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন।
সামাজিক ঘরানার থ্রিলারধর্মী উপন্যাসটি আশা করি সকলের ভালো লাগবে। লেখকের জন্য শুভকামনা।
বইয়ের নামঃ ছায়া সময় লেখকঃ শরীফুল হাসান প্রকাশনীঃ বাতিঘর রেটিং ঃ ৯/১০
একটি নয়, দুইটি নয় অনেকগুলো মানুষের জীবনের ছায়া সময় দেখা যায় গল্পে। সময়ও যে কখনো কখনো ছায়া হয়ে ভবিষ্যতে আবার নতুন স্মৃতির ছায়া হয়ে ফিরে আসে তা বোঝা যায় উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে। অর্নব-অনন্যার চোখের সামনে স্মৃতির ছায়া সময়ে অঙ্কিত হয় গল্পের শেষ অঙ্ক। বইটি নিঃসন্দেহে সক্ষম হবে পাঠকের মনে মন খারাপ করে দেয়ার এক ছায়ার স্পর্শ রেখে...
বইয়ের নাম : ছায়া সময় লেখক: শরীফুল হাসান প্রকাশনী : বাতিঘর প্রকাশনী। জনরা: সমকালীন সামাজিক উপন্যাস। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০১৯। প্রচ্ছদ : জিয়াউদ্দিন বাবু পৃষ্টা সংখ্যা : ২৮৫ পেজ মূল্য : তিনশত টাকা। (গায়ের দাম)।
অল্প করে ছায়া সময় এর গল্প :
মানুষের জীবনটা খুব সহজ সরল।জন্ম বেড়ে উঠা, বড় হওয়া, কর্মক্ষেত্র, সংসারের দায়িত্ব নেয়া এইতো। কিন্তু এই জীবন চলার পথে নিজের অজান্তেই হয়ে উঠে কঠিন থেকে কঠিনতর। আর এই রকমই কিছু জীবনের গল্প নিয়ে শরীফুল হাসান এর ছায়া সময় উপন্যাসটি।
গল্পটি সুদূর ময়মনসিংহ জেলায় আশির দশকের। বড়বাজার এ ইট বালু সিমেন্ট এর ব্যবসাহী করিম আকন্দ। আকন্দ পরিবার এর প্রধান। দুই ছেলে কামরুল ও রহমান এবং দুই মেয়ে আমিনা ও আয়েশা, বড় মেয়ের ঘরজামাই ইউসুফ, করিম আকন্দ এর স্ত্রী , ও ভাইদের নিয়ে একান্নবর্তী পরিবার। ব্যবসাহ এর সিংহ ভাগই দেখা দেখাশুনা করে বড়ছেলে কামরুল। শুধু দেখাশুনাই নয় এমন ভাবে ব্যবসাহকে বড় করেছে যে কারো চোখ পরার মতো। আর ঘরজামাই ইউসুফ জালালও সে ব্যবসায়। বাপ বেটা জামাই তিনজন মিলে ব্যবসাহ যেমন করছে সমাজে নাম প্রতিপত্তও তেমন আকন্দ পরিবার এর। কিন্তু শকুনের চোখ পরতে তো আর সময় লাগেনা। একদিন দোকান খুলতে গিয়েই হঠাৎ মোটরসাইকেল আরোহী একজন আততায়ী এর হাতে গুলি খেলো কামরুল। ঐসময় দোকানে উপস্থিত ছিল দুলাভাই ইউসুফ। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য সে দেখেনি কে গুলি করলো কামরুলকে। তারপর আরকি। হাসপাতালে নেয়া চিকিৎসা শুরু। আর এদিকে মা বোন এর কান্নাকাটি। গুলি আঘাতে প্রান না গেলেও সুস্থ হতে পারেনি কামরুল। চলে গেছেন কোমায়। জীবন যেমন সহজ সরল আবার সময়ে তেমনি জটিল হয়ে উঠে। কামরুল এর কোমায় পরে যাওয়ার পরে করিম আকন্দ এর জীবন তেমন কঠিন হয়ে পরে। ব্যবসাহ এর দেখভাল শুরু করে ইউসুফ। কিন্তু ঘোর শত্রু এর তো আর অভাব হয় না কথায় বলে হাতি গর্তে পরলে পিপঁড়েও লাঠি মারে। জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে করিম আকন্দ এর জীবন। একেক করে বদলে যাচ্ছে ঘরে সবাই। প্রিয় পুত্র কামরুল আবার সুস্থ হবে এই আশায় প্রহর গোনে। আর ধীরে ধীরে পরিবার নেমে আসে ছায়া। আর এ গল্প সেই ছায়া সময় এরই।
পাঠ প্রতিক্রিয়া :: শরীফুল হাসান, মূলত সাম্ভালা টৃলজি ফ্যান্টাসি দিয়ে পরিচিত হলেও গত কয়েক বছরে তিনি লিখেছেন কিছু সামাজিক উপন্যাস। মেঘ বিষাদের গল্প, রাত্রি শেষ���র গান, ইত্যাদি এর পর ২০১৯ সালে বই মেলায় প্রকাশিত হয় তার নতুন বই ছায়া সময়। মূলত সামাজিক জনরায় হলেও বইটিতে লেখক চেষ্টা করেছেন রহস্যকে ধরে গল্পটা আগে বারাতে এবং লেখক সার্থক। এবার আসি গল্প প্রসঙ্গে। গল্পের প্লট ছিল অসাধারন। গল্পটা সত্যি অনেক ভালো লেগেছে। সামাজিক উপন্যাসে ক্যারেক্টার ডেভল্পম্যান্ট অতীব জরুরি। শরীফুল হাসান এখানে চরিত্র গুলো খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন। করিম আকন্দ, ইউসুফ,কামরুল, আমিনা, অনন্যা, অর্নব, তপন সহ ইত্যাদি প্রতিটা ছোট বড় চরিত্র গুলো চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছেন। ইউসুফ ঘরজামাই তার কর্মকান্ড, এবং ব্যাবসা দেখভাল ইত্যাদি ছিল চোখে পরার মতো। করিম আকন্দ এর কষ্ট টাই পাঠককে ভাবাবে। বাবা হয়ে ছেলের প্রতি দরদ ও শাসন দুই তার চরিত্রে এসেছে চমৎকার ভালো। শুধু বাবা হিসাবে না পরিবার এর প্রধান কর্তা হিসাবে তার কর্মকান্ড গুলোও চোখে পরার মতো । ছিল কামরুল আকন্দ যে কোমায়, কিন্তু গল্পের উত্থান ও এগিয়ে চলা তাকে নিয়েই। পার্শ্বচরিত্রে ছিল অনন্যা চক্রবতি। যে একজনকে ভালোবাসতো, আর অর্নব সাহা যে ভালোবাসতো অনন্যা চক্রবতিকে। করিম আকন্দ এর গল্পের পাশেই ফুটে উঠেছে অনন্যা আর তার পরিবার চক্রবতি পরিবার এর গল্প। এর সব মিলিয়ে এগিয়ে চলা ছায়া সময় এর। তো চরিত্র আর গল্পের পটভূমি দুই ছিল নান্দনিক। বর্ননা বিষয়বস্তু উপাস্থান সব দিক থেকে লেখক সার্থক।
আরেকটা জিনিশ হলো ময়মনসিংহ শহর, লেখক তার নিজ ময়মনসিংহ শহর এর একটি চমৎকার বর্ননা দিয়ে গেছেন যেটা অনেক ভ্রমন প্রিয় পাঠকদের ভালো লাগবে। সবচে বড় কথা লেখক বইটা এই শহরকেই উৎসর্গ করেছেন।
কিছু কিছু বই আছে যার গল্প পাঠকের মনে গভীর দাগ ফেলে যায়, অনেকদিন পরেও যেন সে দাগের ঘোর কাটেনা। ছায়া সময় এমন একটি বই। এই ঘোর এতো সহজে হয়ত কাটবেনা।
বাতিঘরের বই বানান ভুল থাকবে এটা এখন আর অস্বাভাবিক মনে হয় না। এবার একটি মেজর বানান ভুল পেয়েছি তা হলো বঙ্গবন্ধু বানাকে লেখা বংগবন্ধু, রাষ্ট্রপতি বানাকে লেখা রাস্ট্রপতি সহ ইত্যাদি আরো অনেক। তাছারা স্পেস এবং লাইনের মাঝে অযথা প্যারা তৈরি করা চোখে পরেছে এবার। পেজ এর মান আর বাধাঁই ছিল মোটামুটি ভালোই। ছাপাও সন্তুষ্ট। শুধু বানান ভুল এর দিকে একটু নজর দিলেই হবে।
সুন্দর গল্প আর চরিত্র এবং উপস্থাপনার জন্য ছায়া সময় বইটি আমার কাছে পাঁচে পাঁচ পাওয়ার দাবি রাখে।
সর্বাপরি বলবো আশির দশকের এক একান্নবর্তী পরিবারকে নিয়ে সামাজিক উপন্যাস ছায়া সময়। এই উপন্যাস নিয়ে আপনার সময় খারাপ কাঁটবে না। তাই প্রিয় পাঠক আপনাকে ছায়া সময় এর ভুবনে স্বাগতম। সেই সাথে বইয়ের আলোয় আলোকিত হোন।
কি অসাধারণ একটা বই!!! লেখকের টানা ৩টা বই পড়লাম।অতিভোজনের কারণেই কিনা,আগের বইটি শেষ করে মনে হচ্ছিল,শরীফুল হাসান থ্রিলারে যত পটুই হোন,অন্যদিকে এখনো অনেক পিছিয়ে আছেন।এরকম সব চিন্তাভাবনা যেন এক ঝংকারে উড়িয়ে দিল এই বইটি।এত পরিণত,দ্রুত গতির লেখা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে কমই পেয়েছি।
অসাধারণ একটি বই। এই বইটি জানে কিভাবে পাঠককে ধরে রাখতে হয়। এই বইটি পড়তে পড়তে আমি এক সময় আবিষ্কার করলাম, আমি চরিত্রগুলোর মধ্যে ঢুকে গেছি। ধন্যবাদ লেখককে (শরিফুল ভাইকে) এত সুন্দর একটা উপন্যাস উপহার দেয়ার জন্য।
'ছায়া সময়' একটি সমাজের চিত্র, একটি বিশাল পরিবারের চিত্র, মানুষের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ চিত্র। ভালোবাসা, অবহেলা, প্রতারণা, ক্ষমতার লিপ্সা, অর্থের লোভ, অতীত সবকিছুই চিত্রিত হয়ে আছে ছায়া সময়ের প্রতিটি পাতায় পাতায়, প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি অক্ষরে। যদি বলি ছায়া সময় কয়েকটি জীবনের চিত্র খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে?
ছায়া সময় চলেছে সময়ের তালে তালে। সময় গড়িয়েছে সেই সাথে উন্মোচিত হয়েছে নতুন দিকের। নতুন সম্ভাবনার। নতুন নতুন টুকরো ঘটনার। যা সহজেই হৃদয়ে দাগ কেটে গিয়েছে।
কামরুল আকন্দ বাড়ির বড় ছেলে। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কেউ একজন গুলি করে। কে কোন উদ্দেশ্যে, কোন স্বার্থে আক্রমণ করেছে তার কোন কূল কিনারা করা যায়নি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে নানান ঘটনা। সামনে এসেছে কাছের, দূরের মানুষদের মুখোশের আড়ালের আসল চেহারা।
বইয়ের পাতায় পাতায় আছে ভালোবাসা না পাওয়ার এক আকাশ পরিমাণ আফসোস। আমাদের যারা চায় তাদের আমরা চাই না। আবার আমরা যাদের চাই তারা আমাদের চায় না। এ জীবনের এক নিষ্ঠুর ধ্রুব সত্য। যেখানে মানুষ অসহায় হয়ে ছটফট করে। অথচ কিছু করার থাকে না।
বোকাসোকা একজন মানুষ অবহেলায়, ক্ষমতার জন্য হতে পারে নিষ্ঠুর ঘৃণ্য। চরিত্রের স্খলন ঘটিয়ে নিচে নামতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। এক্ষেত্রে শুধুই কি ব্যক্তিকে দোষ দেয়া যায়? নিজের পরিবার, সমাজ একটুও কি দায়ী নয় মানুষটার এমন ঘৃণ্য পরিণতির জন্য?
সন্তান বখে গেলে স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকরা শাসন করবে। কিন্তু তার মাত্রা যদি ছাড়িয়ে যায় তখন ঘটতে পারে হীতে বিপরীত। ভুল বুঝার আগেই যা ঘটার ঘটে যায়। এর মাশুলও দিতে হয় অবশ্য।
পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এই কথা হরহামেশাই শুনে আসছি। করিম আকন্দের ক্ষেত্রেও কি তাই হয়েছে? অতীতের করা ভুলের কারণে কি ভেঙে গেছে একটি পরিবার। সাথে আরো কিছু মানুষের স্বপ্ন। করিম আকন্দের উপর প্রতিশোধ নিতে কেউ কি দাঁড়াবে তার সামনে?
ছায়া সময় শুরু থেকেই টানটান উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। বইয়ের শেষ পাতা পর্যন্ত সেই ফ্লো অব্যাহত থেকেছে। লেখক চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বইয়ের প্রতিটি চরিত্রকে। সেই চরিত্রদের কারো জন্য মন খারাপ হয়েছে। কারো জন্য দীর্ঘশ্বাস বা কারো জন্য আফসোস, ঘৃণা। একটি সমাজে যেই ধরনের মনোভাবের মানুষ থাকে তার প্রায় সবই লেখক তুলে ধরেছেন শব্দের মাধ্যমে। সেই শব্দগুলো পাঠক হিসাবে ধারণ করার চেষ্টা করেছি। বইয়ের অক্ষরগুলো থেকে কিছু শিখতে পেরেছি কিনা তা হয়তো সময়ই বলে দিবে।
রহস্য ধরে রেখে আমাদের চেনা জীবনের কথা এমন সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে, এমন চমৎকারভাবে চিত্রিত করতে কয়জনই বা পারে। লেখক এই কাজটি সার্থকভাবে করতে পেরেছেন বলেই মনে হয়েছে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে একরাশ বিষন্নতা নিয়ে শেষ করেছি ছায়া সময়। যে গল্প জীবনের কথা বলে। মানুষের উভয় দিকের কথা বলে।
সময়ের সাথে সাথে বয়ে চলে জীবন। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। আজ যা বর্তমান তা কালই হয়ে যায় অতীত। সেই অতীত হয়তো মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে উঠে স্মৃতির মানসপটে। 'এই তো হওয়ার ছিল' এই উপলব্ধি খুব তাড়াতাড়ি অতীতকে দূর করে দেয়। হয়তো হৃদয়ের কোন এক কোণায় তা চিরকালই অম্লান হয়ে থাকে।
পাঠক চাইলেই ছায়া সময়ের মধ্য দিয়ে একবার হেঁটে আসতে পারেন। এর আকর্ষণ আপনাকে আঁটকে রাখতে সক্ষম হবে তা আশা করাই যায়!
বইয়ের নাম: ছায়া সময় লেখক শরীফুল হাসান প্রকাশক: বাতিঘর জনরা: সমকালীন উপন্যাস প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯ প্রচ্ছদ: জিয়াউদ্দিন বাবু পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২৮৬। মূল্য: ৩০০টাকা
কাহিনী সংক্ষেপ:: গল্পটা আশির দশকের। ময়মনসিংহের মফস্বলের একটি বৃহৎ পরিবারের বড় ছেলে কামরুল আকন্দ। পালিত সন্তান হয়েও কামরুল হয়ে উঠেছিল আকন্দ পরিবারের সব। তাকে ঘিরেই গল্প ফুটে উঠেছে। পরিবারের বিরাট ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন সবকিছু সামলে গোটা পরিবারকে যেন এক করে রেখেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালে দোকান খুলতে গিয়ে কেউ একজন গুলি করে বসে তাকে। থানার ওসি আমিনউদ্দিন তদন্তের কাজে লেগে পড়ে। পুলিশ তদন্ত কাজ চালালেও আকন্দ পরিবারের প্রধান করিম আকন্দ বসে নেই। চোখ কান খোলা রেখে সব সামলে নিচ্ছেন। করিম আকন্দের শত্রুর অভাব নেই এই শহরে। তার অতীত জীবনের কারণে সবাই তাকে সমীহ করা চলে।
কিন্তু কে করেছে কামরুল এই অবস্থা? বাইরের কেউ নাকি পরিবারের লোক? এদিকে কামরুলের এই অবস্থার পর ভাঙ্গন শুরু হয় আকন্দ পরিবারের। ইউসুফ জালাল আকন্দ পরিবারের বড় মেয়ের জামাই। পারবে কি আকন্দ পরিবারকে সামলে রাখতে নাকি সে কামরুলের অনুপস্থিতির সুযোগ নিবে? ক্ষমতা আর টাকার লোভে কত দূর যায় সে?
গল্পে আরো আছে অনন্যা যে কাউকে ভালোবাসে। আছে অর্ণব, সেও কাউকে ভালোবাসে। উদাসীন এক যুবক। সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যা করার। আছে শেঁকড়ের টানে বার বার ফিরে আসা তপন। আমাদের ফেলে আসা অতীতের ছায়া সময়ের গল্প নিয়েই গড়ে উঠেছে শরীফুল হাসান ভাইয়ার ‘ছায়া সময়‘।
পাঠ পর্যালোচনা:: যুদ্ধপরবর্তী সময়ের গল্প ফুটেছে উঠেছে ‘ছায়া সময়‘-এ। কামরুল আকন্দের গুলি খাওয়া থেকেই ঘটনার শুরু হয়। তারপর ফুটে উঠেছে আকন্দ পরিবারের ভরাডুবির কথা। আলাদাভাবে বলতে গেলে গল্পে সবচেয়ে ভালো লেগেছে লেখকের বর্ণনা। নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আমাদের আবহমান সামাজিক জীবনের একটি চিত্র। যুদ্ধ পরবর্তী দেশের অবস্থা, রাজনীতি, দেশভাগ, প্রেম, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক টানাপোড়ন, সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষমতার লোভ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই গল্প। যেন চিরায়ত বাংলা সামাজিক জীবনেরই একটি ছবি। প্রতিটা চরিত্রের জীবনের গল্পগুলো এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে পড়তে গিয়ে বার বার এক অদ্ভূত বিষন্নতায় মন ভার হয়ে উঠে। আকন্দ পরিবারের প্রধান করিম আকন্দ যেমন একাধারে বদরাগী, হিংস্র এবং কঠিন মনের মানুষ তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফুটে উঠেছে বাবা হিসেবে সন্তানদের জন্য পরম ভালোবাসা। অনন্যা চরিত্রটি সবচেয়ে পছন্দের। ভালোবাসা একজনকে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই যেন জড়িয়ে আছে ভালোবাসার মানুষটি। গল্পের প্লট বিস্তৃত এবং চরিত্র অনেক। তবে কোন চরিত্রকে বাহুল্য মনে হয়নি, শেষ দিকে সব চরিত্রেরই সার্থকতা ফুটে উঠেছে। গল্পের স্বার্থে জালিল, খলিল, আলাল, আমিনা, দুলাল, সেলিম, জালাল, নিরুপমা, অনিমেষ ও সহদেব চরিত্রগুলো উঠে এসেছে। আছে কোহিনূরের মতো ডাকাত। এদের কেউ ভালো, কেউ মন্দ। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশের অবস্থা, রাজনীতি, দেশভাগ ও দেশে ত্যাগের বর্ণনাগুলো মনকে বিষণ্ণ করে তোলে। নিজের জন্মভূমি যেখানে ছোট থেকে বড় হয়েছে, যার প্রতিটি রাস্তায় রয়েছে নিজের পদচিহ্ন, নিজের শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছেযে জায়গায়, যে বাড়ির প্রত্যেকটা কোণে রয়েছে নিজের হাতের স্পর্শ এমন বাড়ি এবং দেশকে ছেড়ে যাওয়ার মতো কষ্টের ঘটনা নেই। গল্পের শেষে রয়েছে একটি মাথা ঘোরানো টুইস্ট। সকল ধরনের পাঠকই উপভোগ করবেন বইটি। এক কথায় দারুন একটি বই। যারা দারুন একটি গল্পের সাথে সাথে মাথা ঘোরানো টুইষ্ট এবং বিষণ্নতার সাগরে ডুব দিতে চান তারা পড়ে ফেলতে পারেন শরীফুল হাসান ভাইয়ের ‘ছায়া সময়‘। যারা সাম্ভালা পড়েছেন তারা শরীফুল হাসান ভাইয়ের লেখার সাথে পরিচিত আছেন। সাম্ভালা পড়েই ওনার লেখার প্রেমে পড়েছিলাম। পড়ে ফেলুন, কথা দিচ্ছি ঠকবেন না।
লেখক শরীফুল হাসান যে শুধুমাত্র থ্রিলার না, সাথে অন্যান্য ধরাণার বই ও বেশ ভালো লেখেন, তার প্রমাণ এই বই। থৃলার বই হিসেবেই বইটা ধরলাম, কিন্তু এটা ঠিক গতানুগতিক থ্রিলার বই না। এতে তেমন ক্লাইম্যাক্স বা টুইস্ট নেই। বাট এককথায় খুব অসাধারণ একটা বই। চরিত্র গুলো খুবই দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলা। বর্ণণার কারণে প্রতিটা চরিত্রের মাঝে ঢোকা গেছে। থ্রিলার থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে এটি বেশ উন্নতমানের একটি উপন্যাস। সুপাঠ্য।
দারুণ! দারুণ! দারুণ 😍 শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার মত একটি উপন্যাস। প্রায় ৩০০ পেজের বইটি যেন না ধরতেই ফুরায় গেলো। থ্রিলার রাইটার শরীফুল হাসান যে উপন্যাসিক হিসেবেও প্রথম শ্রেণীর তা কে জানতো! ♥
সামাজিক থ্রিলার বললে একটুও ভুল বলা হবে না। তবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ ধরে রাখতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হবে না। প্লটটা সাধারণ মনে হলেও চরিত্রগুলো অসাধারণ। শরীফুল হাসানের নতুন বইয়ের অপেক্ষায় থাকা ভুল হবে বলে মনে হয় না।
উঁচু পাঁচিল আর লোহার গেট দিয়ে ঘেরা দোতালা দালানটা সাক্ষ্য দিচ্ছে অনেক বঞ্চনা আর পাপের। 'আকন্দ বাড়ি' নাম ধারণ থেকে 'শ্রীলেখা ভবন' পরিচয় মুছে ফেলতে পারেনি। শ্রীমতী শ্রীলেখা চক্রবর্তীর ছেলেরা এই বাড়ি পানির দরে করিম আকন্দের কাছে বিক্রি করে ওপারে চলে গিয়েছিলেন। শুধু ছোট ছেলে অনিমেষ চক্রবর্তী দেশমাতৃকাকে ছেড়ে গেলেন না, বাড়ির পেছনের অংশে এখনো তার বসবাস।
আকন্দ বাড়ির প্রধান করিম আকন্দকে নিয়ে শহরে অনেক গুজব, পুরোনো কুখ্যাতি। প্রৌঢ়বয়সী মানুষটাকে দেখলে লোকজন সালাম দেয় ঠিকই, কিন্তু তা যতটা না শ্রদ্ধায়, তারচাইতে বেশী ভয়ে। তার দুই ভাই এবং পুত্র-কন্যা নিয়ে গঠিত বিশাল যৌথ পরিবারটি শহরের রাজনীতি থেকে ব্যবসা - অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে।
বৃদ্ধবয়সে করিম আকন্দের স্নেহ সব এসে জড়ো হয়েছে তার পালক-পুত্র কামরুলের জন্য। বেলবটম প্যান্ট, বুকখোলা শার্ট, ঝাঁকড়া চুল আর ঢুলুঢুলু চোখের তরুন কামরুল পারিবারিক ব্যবসা সামলায় দক্ষতার সাথে। দুলাভাই ইউসুফ কামরুলের অধীনে দোকানে বসতে তেমন পছন্দ করে না, তবে প্রায় ঘর-জামাই হওয়ায় নিরুপায় সে। ইউসুফের পিতা জালাল উদ্দিন গ্রামে বদমেজাজি বলে পরিচিত, দ্বিতীয় বিয়ে করার পর প্রথম পক্ষের পুত্র ইউসুফকে প্রায় ত্যাগ করেছে।
অনিমেষ চক্রবর্তীর একমাত্র কন্যা অনন্যা চক্রবর্তী। করিম আকন্দের এতো কিছু জেনেও কেন যে মেয়েটা কামরুলকে ভালোবাসে! আর ছোটবেলা থেকে তাকে চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখা অর্ণব ভেবেছিল, অনন্যা তো আছেই সবসময়! তার উদাসীনতার কারণে কবে যে অনন্যা কামরুলের হয়ে গেল, টের পায়নি।
গল্পের শুরু সেদিন, যেদিন দিনেদুপুরে দোকানে এসে কামরুলকে এক মোটরসাইকেল আরোহী গুলি করে গেল। জীবন্মৃত হয়ে টিকে থাকা ছেলেটিকে ঘিরে থমকে গেল কতগুলো জীবন। কামরুলের অনুপস্থিতি অনেকের জন্যই লাভজনক, মাথা চাড়া দিল সেই সব সুযোগসন্ধানী সাপেরা।
তবে এই গল্পটা খুনের নয়, প্রেমেরও না। এ এক শহরের গল্প, যে শহর লালন করছে কামরুল - অনন্যা - ইউসুফ - অর্ণবের কথা। অথবা গল্পটা সেই ছায়াসময়ের, যে সময় অস্থির কিন্তু অদ্ভুত বিষন্ন।
একটা গল্পকে প্রাণবন্ত করে তুলতে হলে, লেখকের নিজের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। 'ছায়াসময়' উপন্যাসের লেখক গল্প সাজিয়েছেন তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ শহরকে কেন্দ্র করে, বইটি উৎসর্গও করেছেন প্রিয় শহরকে। লেখকের বর্ণনায় শহরটি হয়ে উঠেছিল মায়াময়। 'আকন্দ বাড়ি'র দোতালার জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা অন্তঃপুরবাসিনীরা, আর উঠোনে সকলে মাঝখানে আসীন কর্তা করিম আকন্দের বর্ণনা ভীষণরকম জীবন্ত। অর্ণব আর তপন - দুই ভাইয়ের ফেলে যাওয়া শহরের জন্য টান পাঠকের মনেও মায়ার সঞ্চার করার মতো।
পটভূমিতে এসেছে আশির দশকের অস্থির সময়, যখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে মানুষগুলোও, দ্রুত বাড়ছে পরস্পর অবিশ্বাস, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। সেই পরিচিত সুর কেটে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে চরিত্রগুলোতেও। শুরু থেকেই কামরুল কোমায়, কিন্তু সবকিছু তাকে ঘিরেই আবর্তিত। অনন্যার ভালোবাসা, করিম - জেবুন্নেসার পুত্রস্নেহ, অর্ণবের বিতৃষ্ণা আর ইউসুফের টপকে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কামরুলকে বাঁচিয়ে রেখেছে পুরো গল্পে। করিম আকন্দের চরিত্রটি পাঠক ঘৃণা করতে গিয়েও ভালোবাসতে বাধ্য হবেন। ইউসুফকে নিয়েও দোলাচলে থাকতে হয়।
মূল চরিত্রগুলোর পাশাপাশি আততায়ীর খোঁজে ঘুরতে থাকা ওসি আমিনউদ্দিন, বখে যাওয়া ছেলে রহমান, ডাকাত কোহিনূর, রাতেরবেলা ঘোর লাগা বাঁশি বাজানো রাজনীতিবিদ কাশেম আলী, শেকড়ের টানে ফেরা তপন, ইউসুফের স্ত্রী আমিনা - একেকটি চরিত্রকে খুব বাস্তব মনে হয়। কোনো মানুষকেই একেবারে বাঁধাধরা ছকে ফেলে দেওয়া যায় না, বরং ভালোমন্দ মিলিয়ে প্রচন্ড অনিশ্চিত প্রতিটি মানুষ - এটা লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন সুচারুভাবে।
বইয়ের প্রচ্ছদটি মানানসই। মুদ্রনজনিত ভুল অবশ্য খুব বেশি ছিল। তবুও, অনেক দিন পর একটি বই পড়ে অন্তরে হাহাকার ছেয়ে গেল। ছায়াসময়ের বিষন্নতায় সার্থকতার সাথে ডুবিয়ে দিলেন লেখক।
বর্তমান বাংলা সাহিত্যে জনরাভিত্তিক সাহিত্য একটি শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে। এক্ষেত্রে যাদের অবদান সবথেকে বেশি তাদের মধ্যে অন্যতম শরীফুল হাসান। সাম্ভালা ট্রিলজি তাকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। ফ্যান্টাসি-অ্যাডভেঞ্চার দিয়ে শুরু করে এরপর তিনি থ্রিলার, কিশোর উপন্যাস, সমকালীন জনরাতেও দারুণ অবদান রেখেছেন। ছায়া সময় সমকালীন উপন্যাস। যদিও বেশ ভালো রকমের থ্রিলিং এলিমেন্টও আছে, তবে তা গল্পের ড্রাইভিং ফোর্স না। গল্পের টাইমলাইন যুদ্ধ পরবর্তী সেনা শাসনের সময়। সেসময়ের ময়মনসিংহ শহর এবং আর্থসামাজিক পলিটিক্সকে অনিন্দ্য সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। এমনিতেই আমি 'পুরনো সময়' পছন্দ করা মানুষ। তাই পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিলো ঐ সময়ের ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একটি সন্ধ্যা কাটিয়ে আসতে পারলে কি দারুণ ব্যাপারই না হত! এই উপন্যাসের সবথেকে শক্তিশালী দিক স্টোরিটেলিং এবং চরিত্রায়ন। লেখনশৈলী তো আরামদায়ক বটেই, তার উপর তিনি গল্প বলেছেন সবগুলো চরিত্রের পার্সপেক্টিভ থেকে। এই ব্যাপারটা এর আগে পেয়েছিলাম আরেকজন প্রিয় লেখক মাশুদুল হকের 'মিনিমালিস্ট' বইটিতে। ছায়া সময়ে এই ব্যাপারটি আরো সুন্দর ভাবে এক্সিকিউট করা হয়েছে। কোমায় থাকা কামরুল এবং অনন্যাকে বাদ দিলে কোন চরিত্রকেই শুধুমাত্র ভালো-খারাপের গণ্ডিতে ফেলা যায় না। লেখক তাদের নিজেদের ভাবনা দেখিয়েছেন, পাশাপাশি অন্যেরা তাদের প্রতি কিরূপ ধারণা নিয়ে চলে তাও দেখিয়েছেন। একারণে স্টোরিটেলিং আরো বেশি ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছে। চরিত্রগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে আমার করিম আকন্দ, ওসি আমিন উদ্দিন, অনন্যা এবং কামরুলকে বেশ ভালো লেগেছে। এই উপন্যাসের সবথেকে শক্তিশালী চরিত্র করিম আকন্দ এবং ওসি আমিন উদ্দিন। কখনো সিনেমা অ্যাডাপ্টেশন হলে এই দুটো চরিত্রের কাস্টিং শক্তিশালী হওয়া অত্যন্ত জরুরি। গল্পের শেষদিকে দারুণ একটি টুইস্ট আছে। যদিও গল্প বলার টোন চিরাচরিত থ্রিলার ধারার না হওয়ায় ব্যাপারটা হয়তো অতটা ধাক্কা দেবে না পাঠককে। - গল্পের টোনের সাথে মানানসই প্রচ্ছদটি করেছেন জিয়াউদ্দিন বাবু। বাতিঘরের প্রোডাকশনও বেশ ভালোই লেগেছে আমার কাছে। সবমিলিয়ে অসাধারণ একটি উপন্যাস 'ছায়া সময়'। যে কোন জনরার পাঠকরাই নির্দ্বিধায় হাতে তুলে নিতে পারেন বইটি। 😊 রেটিংঃ ৪.৫/৫
❝জেবুন্নেসার কান্না থেমে গেলেও পুরো আকন্দ বাড়ি যেন কাঁদছে। এক এক করে সব চেনা সুর কেটে যাওয়ার যন্ত্রণায়।❞
বই বেশ কিছু দিন আগেই পড়ে শেষ করেছি কিন্তু রিভিউ লিখবো লিখবো করেও লেখা হচ্ছিল না। অলসতা একটা কারণ। আরও একটা কারণ হলো বই পড়ে যে অনুভূতি হয়েছে শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে পারবো না ভয় হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের পরবর্তী প্রেক্ষাপটে এক পরিবারকে ঘিরে অনেকগুলো চরিত্রের গল্প। ষড়যন্ত্র, অন্যায়, ঘৃণা, প্রতিশোধ, ভালোবাসা, খুন, রাজনীতি নিয়ে এক মলাটে বিষন্ন অদ্ভুত সুন্দর একটা বই। বইয়ের শুরু থেকেই তিনটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল। কয়েকবার তো মনে হয়েছিল শেষটা পড়ে উত্তরগুলো খুঁজি কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছি। ১. কামরুলকে কে গুলি করেছে? ২. কখনও কি সে কোমা থেকে উঠবে? ৩. আকন্দ পরিবারের সদস্যদের কার পরিণতি কী হবে? (সবচেয়ে বেশি যেটার জবাব পেতে চাচ্ছিলাম)
চরিত্রের সংখ্যা অনেক আবার কিছু নাম প্রায়ই কাছাকাছি এইজন্য প্রথমে কনফিউজড হয়ে যাচ্ছিলাম। চরিত্রগুলোর গল্প এতো সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছে যেন মনে হচ্ছিল তাদের অনুভূতিগুলো আমিও অনুভব করছি। কখনও অনেক রাগ হয়েছে, কখনও বিরক্ত হয়েছি, কখনও হেসেছি, তো কখনও দীর্ঘশ্বাসও ফেলেছি। যে চরিত্র নিরব থেকেও সবার মধ্যে সরব ছিল তার নিজের আরও কিছু ঘটনা থাকলে ভালো হতো। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে এই নিরব চরিত্র ও আয়শার জন্য। কিন্তু এদের আলোচনা বাকিগুলোর তুলনায় কম। যে যার কর্মফল পেয়েছে কিন্তু কিছু চরিত্রের জন্য প্রকৃতি একটু বেশিই নিষ্ঠুর ছিল না? প্রথম প্রশ্নের জবাব অবাক করেছে। একদমই আশা করিনি। বইটা পড়ে মনে এতোটাই চাপ পড়েছিল যে ঘুমের মধ্যে বেশ কয়েকবার চরিত্রগুলো আমার মাথার ভিতরেই কথা বলেছে।
বইয়ের শুরুতেই বোঝা যায় ময়মনসিংহ শহর লেখকের স্মৃতি বিজড়িত প্রিয় শহর।আর সেই শহরে পাকাপোক্ত ভাবেই গড়ে উঠেছে কয়েকজন মানুষের জীবন আখ্যানের প্লট। উপন্যাসের প্রত্যেকটা চরিত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ। জালাল ইউসুফ কিংবা করিম আকন্দের মতো চরিত্রকে নিয়ে গল্পের প্রধান বিস্তার তা বলার উপায় নেই। অনন্যা,অর্ণব আর তপনের মতো চরিত্র গল্পে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রেম,পাপ,প্রাকৃতিক প্রায়শ্চিত্ত চরিত্রগুলোতে প্রাণ দিয়েছে। গল্পে আছে মায়ের মতো মাটিকে অনেকটা বাধ্য হয়ে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট। কামরুলের ভূমিকা গল্পে অনেকটা নীরব অথচ গভীর।অনন্যার ভালোবাসা মৃত্যুর সাথে লড়াই করা কামরুলকে জাগিয়ে তুলবে এমন নাটকীয়তা হতে পারতো কিন্তু তা হয়নি যা একটা ভালো গল্পের লক্ষণ। অপূর্ণতাই জীবন,অসমাপ্ত গল্পগুলোই শ্রেষ্ঠ গল্প ;অন্তত আমার কাছে।উপন্যাসে ছোট ছোট কিছু চরিত্র যেমন- রহমান,খাজু মিয়া কিংবা আলালের চরিত্র থেকে অদ্ভুত সত্য কিছু গল্প পাওয়া যায়।গল্পে প্রভাব আছে কোহিনূর ডাকাত আর ওসি আমিন উদ্দিনের মতো চরিত্রের। সব মিলিয়ে উপন্যাসটা আমার কাছে প্রচন্ড ভালো লেগেছে।শরীফুল ভাই কখনো হতাশ করেন না বরং আশার চেয়ে বেশি কিছু উপহার দেন। গল্পে কিছু বানান (বিশেষ করে "শ্বশুড়") ভুলের পুনরাবৃত্তি আর বৈষয়িক অসংগতি বিরক্ত করেছে যা লেখকের দোষ বলে মনে হয় না। আর অবশ্যই এড়িয়ে যাওয়ার মতো। অবশেষে,সবাইকে বলবো উপন্যাসটা পড়ার মতো একটা উপন্যাস। এই উপন্যাস পড়লেই বুঝবেন প্রকৃত ভালো বইয়ের বেস্টসেলার তকমা লাগে না।
This entire review has been hidden because of spoilers.
অনেকদিন পর এরকম একটা বই পড়ে সত্যিই ভালো লাগলো। লেখক শরীফুল হাসান যেভাবে বইটা লিখেছেন তা বলতে গেলে অনেকদিন ধরে এরকম গল্প খুঁজছিলাম। একটা সময়ে মনে হয়েছিলো গল্পটা আমার নিজের জীবনের গল্প। গল্পের চরিত্রগুলো অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক যা এককথায় পাঠকদের সেসময় নিয়ে যেতে বাধ্য।