নরনারীর পারস্পরিক সম্পর্ক চিরকালীন অথচ চিরজটিল একটি বিষয়। সেই বিষয়কে যাঁরা বহুকোণ হীরকের মতো নানাদিক থেকে বিশ্লেষণের তীব্র আলো ফেলে দেখতে ভালবাসেন, শক্তিমান কথা শিল্পী বুদ্ধদেব গুহ তাঁদেরই একজন। প্রকৃতি যেমন তাঁর লেখায় প্রবল এক পটভূমি, প্রেমও তেমনই প্রধান এবং জোরালো এক অবলম্বন। এই প্রেম কখনও শরীরী, কখনও শরীরের ঊর্ধ্বে এক স্বর্গীয় অথচ জীবন্ত অনুভূতি। আধুনিক মানুষের প্রেমের সমস্যা আরও অনেক সামাজিক সমস্যার মতোই যে ক্রমশ সূক্ষ্ম ও বহুধাখণ্ডিত হয়ে উঠেছে বুদ্ধদেব গুহ তা জানেন। জানেন বলেই প্রেমের এত বিচিত্র, গভীর ও বহু বর্ণরূপ ফুটে ওঠে তাঁর রচনায়। তাঁর এই নতুন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আধুনিক এক লেখক, যার মানসিকসত্তা খুঁজে বেড়াত সর্ব-অর্থে এক নারীকে, এক প্রকৃত ও সম্পূর্ণ মেয়েকে। ভালবেসে বিয়ে-করা স্ত্রী ক্রমশ সরে গিয়েছিল দূরে, তার সমস্ত অস্তিত্বকে পৌঁছে দিয়েছিল অনস্তিত্বে। এমনসময় জীবনে এল ছুটি। এক অনুরাগিণী পাঠিকা। ধু-ধু তৃষ্ণাতুর জীবনে ছায়া-ঘেরাও য়েসিসের মতো স্নিগ্ধ ভালবাসার নিমন্ত্রণ হয়ে, হিম-হয়ে-যাওয়া হৃদয়ে তাপ সঞ্চারিত করার প্রতিশ্রুতি হয়ে। কিন্তু সত্যি পারল কি? শেষ পর্যন্ত কি সত্যি সুখী হতে পারল সুকুমার? জীবন কি সরল এক অঙ্ক? না তা নয়। এই তীব্র গভীর আশ্চর্য প্রেমের উপন্যাসে জীবনের এক বড়ো সত্যকেই শেষাবধি আবিষ্কার করেছেন বুদ্ধদেব গুহ।
Buddhadeb Guha (Bengali: বুদ্ধদেব গুহ) is a popular Bengali fiction writer. He studied at the well-known St Xavier's College of the University of Calcutta.
His novels and short stories are characterized by their dreamy abstractness and romantic appeal. His essays reveal the soul of a true wanderer providing some of the most beautiful renditions of travel in Bengal. His love for forests and nature provide the background for many of his novels.
A highly successful chartered accountant by profession, and an accomplished musician, Guha is very urbane in his lifestyle. He was one of the first to create characters representing easy-going, upper middle-class modern Bengali families, whom readers could identify with, and that gave him instant popularity.
He is the recipient of many awards including Ananda Puraskar, 1976; Shiromani Puraskar; and Sharat Puraskar.
The Library of Congress has over fifty titles by him. His most famous novel, according to many, is Madhukori. It is considered a milestone in Bengali literature. He is also the creator of Rijuda, an imaginary character who moves about in jungles with his sidekick Rudra. The jungles that he wrote about were mainly in Eastern India.
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। ইন্টারনেট ঘাটলে ঝাড়খণ্ডের এই পুরোনো পাহাড়ি শহরটিকে নিয়ে টুকরো তথ্য ভেসে আসে বেশ। প্রায় ১৪০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত জায়গাটির জনসংখ্যা মেরেকেটে হাজার তিনেক। রাচি থেকে চৌষট্টি কিমি দুর। উপন্যাসের সময়কালের নিরিখে, বিহার প্রদেশের অঙ্গ। এহেন ম্যাকলাস্কিগঞ্জ-কে কেন্দ্রে রেখে সিনেমা-সাহিত্য তৈরি হয়েছে সামান্য। উইকিপিডিয়া হাতড়ালে, পাওয়া যায় বিকাশ কুমার ঝা-এর বিশাল বপু হিন্দি উপন্যাসের উল্লেখ।
এছাড়াও খোঁজ মেলে কঙ্কনা সেন শর্মার ডেবিউ ডিরেক্টোরিয়ালের নাম। 'ডেথ ইন দ্যা গঞ্জ' ছবিটি না দেখে থাকলে দেখে নেবেন পারলে। দিব্যি জিনিস। এরই মাঝে মন পড়ে থাকে বুদ্ধদেবের কাছে। ...শরণং গচ্ছামি, জপে যায় প্রাণ। পাহাড়ি শহরটির ছোট্ট অ্যাংলো হৃদয় কি আদতে জানে, যে বুদ্ধদেব গুহ নামক এক মেজাজি, খামখেয়ালী বাঙালি লেখক, এই এতো সুন্দর করে, ক্যানভাস রাঙিয়ে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের মিষ্টি একখানি ছবি এঁকে গিয়েছিলেন সেই কবে? জানলেও কি কেউ তা আর মনে রেখেছে আজ?
স্বস্তার রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত হয়েছি বোধহয়। কে জানে। তবে লেখকের বই, স্রেফ একখানি প্রেমের গল্প পড়ার তাগিদে পড়ি না কোনোদিনই। একটা গোয়েন্দাসুলভ মনোভাবে আক্রান্ত হয়ে খুঁজে বেড়াই, আরো কিছু। এই বইতেও সেই কাঙ্খিত 'আরো কিছু' পুরোদমে বিদ্যমান। বইটি একটি প্রেম সর্বস্ব উপন্যাস হয়েও, আদ্যোপান্ত মন-কেমনে সিক্ত। জঙ্গল, নদী, নালা। মিষ্টি পাহাড়ি সারল্য। শীতের রোদ, পাখিদের উন্মাদনা। নীলচে আকাশ, কুয়াশা আগল। হারিয়ে যাওয়ার (অপেশাদারী) লাইসেন্স।
পা ফেললে এখানে কোনো শব্দ হয় না। পাতার নরম আর্দ্র গালচেয় পা পড়ে। ভুরভুর করে আতরের মত বনজগন্ধ ওঠে। এখনও হু হু করে হাওয়া বইছে, ভেজা জঙ্গল — পাহাড়ের প্রভাতী গন্ধ বয়ে — সেই পরিষ্কার, নির্মল শীতল হাওয়া ফুসফুসের হয়ত হৃদয়েরও যা কিছু কালিমা সব সঙ্গে সঙ্গে মুছে নিচ্ছে।
সাহিত্যকীর্তির হাজারটি ভ্রান্তি এড়িয়ে, ঠিক এই কারণেই লেখকের কাছে বারংবার ফিরে আসা যায়। এই জিনিসের বিকল্প খোঁজা দায়। ব্যক্তিগতভাবে, লেখকের উপন্যাস আমি শব্দ খুঁটিয়ে পড়ি না। পাখিদের রকমফের কি ফুলগাছের রংমিলান্তি বর্ণনা করতে গিয়ে, তিনি যখন আঞ্চলিক কাব্য-প্রবাহে হারিয়ে যান, আমিও তখন কতকটা হাপিস হই যেন। মনে মনে, কোন সুদূরে। হয়ে উঠি পক্ষীরাজের ঘোড়া! হোয়াইট নয়েজের মতো লেখকের গদ্যশৈলী আমায় ঘুম পাড়াতে চায় প্রাণপণে। এই ঘুম, ক্লান্তির বহিঃপ্রকাশ নয়। এই ঘুম, শান্ত সাবেকি আমেজের দান। অদম্য আরামের সুমিষ্ট ঘ্রাণ।
'চৈত্রের কাফন'-এর চেনা সুর যেন। মহীনের ঘোড়াগুলি-র আশ্চর্য গানটি আবহে চালিয়ে, অলস কোনো দুপুরে ঠান্ডা মাঠে, বেবাক ভাতঘুম দেওয়ার সমান এই বই। আবেগী হয়েছি, বোঝাই যাচ্ছে। তবুও তাই সই। এতটা ভালো লেগে যাবে ভাবিনি যে। উপন্যাসের মূল চরিত্র, তিনজন। কথক, সুকুমার। হাই কোর্টের উকিল। নেশায় লেখক। রাজরোগে আক্রান্ত হয়ে হাওয়াবদলে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। এছাড়াও রয়েছে, সুকুমার পত্নী, রমা ও পাঠিকা-কাম-প্রেমিকা, ছুটি। যথার্থই, 'থ্রিজ আ ক্রাউড'!
আমি মানুষটা সাহিত্যে পরকীয়া হজম করতে পারি না কোনোকালেই। এই জিনিসও একই পথে এগোচ্ছে দেখে প্রমাদ গুনেছিলাম প্রথমে। তবে, মানিয়ে নিলাম শেষমেশ। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মানিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট হলো না এবারে। উপন্যাসের গতিপ্রকৃতির অমোঘ খেয়ালে তিন চরিত্রেই অজস্র ত্রুটি। সুকুমার, অস্থিরসঙ্কল্প। রমা, নিষ্ঠুর। ছুটি, বাস্তববাদী। তবুও এরা ঠিক সাদা-কালো নয়। একটু নাটুকে ঠিকই, তবুও ধূসর। এখানেই আমার গ্রহণযোগ্যতার আসল এন্ট্রি-পাস। এদের ভালোতেও কালো, এবং কালোতেও...
এসব ক্ষেত্রে লেখক কাউকে বিশেষ ভাবে মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন কিনা, সেই প্রসঙ্গ অবান্তর। যেকোনো উপন্যাসেই, ব্যক্তিগত প্রক্ষেপণ থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। তবে এই যে চরিত্রপিছু সমস্ত ভালো ও খারাপের জটিলতা, পাঠকের কাছে খোলা মনে উন্মুক্ত করেছেন তিনি, এখানেই ওনার আত্মবিশ্বাসের পরিচয়। তাই কোনো চরিত্রই উপন্যাস-শেষে আইডিয়াল নারী কি পুরুষ হয়ে রয়ে যায় না। অগ্নিদগ্ধ অ্যালবামে, চৌচির হয় দর্পণ। হারিয়ে যায় বাইনারি সমীকরনের সাধারণ হিসেব। পাঠক হিসেবে, হিউম্যান ড্রামার এই সুনামি-সম চিত্রায়ন আমি বরাবরই উপভোগ করে থাকি। এবারেও করলাম, বলাই বাহুল্য।
আমার এই ভরা-যৌবনে—আমার এই সমস্ত রকম আপাতপ্রাপ্তির মধ্যেও কেন মন আমার সর্ব সময় এমন অশান্ত থাকে? কেন এমন পাগলের মত ছটফট করে? না কি, আমি একাই নই, সবাই-ই এরকম, প্রত্যেক মানুষ ও মানুষীর মনের ভিতরেই বুঝি এমনি একটা মন থাকে, যে মনটা প্রতিটি মুহূর্তে বিদ্রোহীর মত মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, যা পেল, তাকে ধুলোয় ফেলে, অন্য কিছুর দিকে হাত বাড়ায়? মাঝে মাঝে আমার নিজেকে লাথি মারতে ইচ্ছা করে। কেন সুখী হতে পারলাম না সহজ পথে—সকলে যেমন করে সুখী হয়? কেন সর্বক্ষণ একটা কাঁকড়া-বিছে আমাকে এমন করে কামড়ায়? কেন?
তবে, মন বলে অন্য আরেক কথা। বেশ ষড়যন্ত্রমূলক স্বরে জিজ্ঞেস করে বসে, এই যে বাপু এত উচ্ছাস তোমার, এর আসল কারণটা বলো দেখি? পুরুষমানুষ হয়েছো বলেই কি লাভ ট্রাইয়েঙ্গলে এতো আসক্তি?
উত্তরে আমি অল্প হাসি। 'একটু উষ্ণতার জন্য'কে অনেক উপমায় ভূষিত করা যায়। তবে ঠিক প্রথাগত ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী এ জিনিস নয়। একে বরং, ভালোবাসা বনাম অভ্যাসের কোনো স্বাদু দ্বৈরথ হিসেবে ব্যক্ত করলে বেশি মানায়। তা সে, ছুটি বনাম রমাই হোক কি ম্যাকলাস্কিগঞ্জ বনাম কোলকাতা, সুকুমারের চরম অন্তর্দ্বন্দ্ব এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। সেই ক্ষেত্রে, উক্ত অভিযোগটি কিছুটা হলেও সত্যি। সত্যিই বুঝি আমি পুরুষ মানুষ বলেই উপন্যাসটি আমার বেশি ভালো লাগলো। তবে, লাভ ট্রাইয়েঙ্গল জাতীয় কোনো ঠুনকো শিশুতোষ হিসেবে নয়। এর ধরণ অনেকটাই ভিন্ন।
সুকুমার বোস, বুদ্ধদেব গুহ-র চেনাজানা নায়কদের মতো নয়। সে সুপুরুষ নয়। ছ-ফুট উচ্চতা, অগাধ ক্যারিশমা, শিকার দক্ষতা, কোনোটাই তার নেই। একজন চূড়ান্ত এসকেপিস্ট মানুষ। ক্লান্ত, হেরে যাওয়া মানসিকতার দোরগোড়ায় দাড়িয়ে, সুইসাইড নিয়ে ভাবতে আনন্দ পায় সে। ম্যাকলাস্কিগঞ্জকে আঁকড়ে ধরে, ভুলে থাকতে চায় জাগতিক দায়িত্বের ক্রুর নিষ্পেষণ। তার এই ভ্রান্ত রোমান্টিক মায়াজালে স্থান পায় না, চাকরি ও পরিবারের পরিচয়। একাকি, দ্বিধান্বিত মনে, নিদারুণ আক্রোশে হাতড়ে বেড়ায় সে আলোর সন্ধান। সেই আলোর নাম ভালোবাসা।
এখানেই লেখক আর আপোস করেন না। অশেষ রহমতে মেলে ধরেন সুকুমারের কাঙালপনা। সে ফেমিশড ফর লাভ। ভালোবেসে ভালো থাকার, তার এই আকুল প্রচেষ্টাকে প্রায় দাবার ঘুঁটি ন্যায় এগিয়ে দেন তিনি। এগিয়ে দেন কমনীয়তার ক্ষিদে। স্পর্শের হাহাকার। যা শরীর-সর্বস্ব নয় একেবারেই। এই সন্ধিক্ষণে, না চাইতেও, পাঠক আঁকড়ে ধরে সুকুমারের জীবনদর্শনকে। সে দিকভ্রান্ত, সে ত্রুটিশীল। তার অন্তরে অবস্থিত জোলো রোমান্টিসিজমের কীট। সবটা জেনেও কোথায় গিয়ে যেন রিলেট করে বসে মন। সত্যিই, প্রেমের অঙ্কে যুক্তি খোঁজা বৃথা। ব্যাপারটা অদ্ভুত। একজন পুরুষ চরিত্রের সমস্ত অসুয়া কাঁধে নিয়েও, নিজের প্রতিবিম্বখানি প্রতিফলিত হয়ে ওঠে সুকুমারের কলমে। অজান্তেই, মন গেয়ে ওঠে কোনো চেনা করুণ সুর। সেলফ-পিটির পঙ্কিল পাঁকে খুঁজে বেড়ায় ভাবনার খোরাক।
কোলকাতায় ফেরার কথা আমি ভাবতে চাই না। ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। অথচ এখানের ঘন নীল আকাশ, রোদ্দুরে স্নিগ্ধ-শান্তিতে শুয়ে-থাকা পাহাড়—বন, চর��� বেড়ানো গরু মোষের গলার ঘণ্টার ঢুঙ্গুর ঢুঙ্গুর মন্থর আওয়াজ, কোনো ছোট পাখির চিকন্ গলার ডাক, সব আমাকে মনে পড়িয়ে দেয় যে কোলকাতাটাই নির্ম�� সত্যি, এই জগৎটাই মিথ্যা।
অবশ্য, কেবল প্রেমের ক্ষেত্রেই নয়। এক পর্যায়ে, চাপা শঠতার পরিচয়ও মেলে যেন। লেখক সরাসরি না লিখলেও, ম্যাকলাস্কিগঞ্জের সাধারণ গরীব মানুষগুলোর কাছে মহান হতে চায় সুকুমার। লালন করে, হিরো ওয়ার্শীপড হওয়ার প্রচ্ছন্ন চাহিদা। বাইরে থেকে এন্তার ভ্রু-কুচকালেও, সুকুমারের জায়গায় আমি নিজে থাকলেও কি ঠিক একই পদক্ষেপ নিতাম না? ইট-কংক্রিটের জঙ্গলে প্রতিনিয়ত হেরে গিয়ে একবারটির জন্যে সব ছেড়ে, জঙ্গলের রাজা হতে চাইতাম না আমি?
তাই সবটাই কেমন...বিগ্রাজিংলি রিলেটেবল হয়ে দাঁড়ায়। কতকটা, উডি অ্যালেনের 'অ্যানি হল' দেখার অভিজ্ঞতা সম। মন জানে, ব্যাটা অ্যালভী সিঙ্গার মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধের নয়। তবুও...
দীর্ঘশ্বাস ফেলি তাই। এই বই সবার ভালো লাগবে না, জানি। লাগা উচিতও নয়। আপনিও চাইলে রদ্দি-ট্র্যাশ জাতীয় সম্বোধনে সম্মানিত করে এ জিনিস বানের জলে ভাসিয়ে দিতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে, একটু খারাপ লাগলেও আই উইল অনেস্টলী আন্ডারস্ট্যান্ড। কিন্তু তবুও বলবো, বইটা পড়ুন। 'বাবলি'-টাবলি ছেড়ে এই একটি উপন্যাস পড়ে দেখুন ভায়া। প্রেম-ভালবাসা ভালো না লাগলেও, স্রেফ ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ও তার রঙিন বাসিন্দাদের খাতিরেই একটিবারের জন্য পাতা ওল্টান। স্বেচ্ছায় হারিয়ে যান সবুজের সাহচর্যে। দেখে আসুন, উষ্ণতার এক কাঙালস্বরূপ আস্ফালন। যা ওল্ড-স্কুল, তবুও ভীষণ প্রাণবন্ত।
আপাতত, বইটি আমার পড়া শ্রেষ্ঠ বুদ্ধদেব গুহ হয়ে রাজার হালে শেলফে ফিরে যাক। ওরও তো ছুটি দরকার। সাথে, আমারও।
“এ জায়গাটায় সকাল হয় না, সকাল আসে । অনেক শিশিরঝরানো ঘাসে ভেজা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে, অনেক শখিনী নদী পেরিয়ে, সোনা গলানো পোশাক পরে সকাল আসে এখানে ।”
▫️আমার কথা : গ্রামে বিকেলের রেশ কাটতে না কাটতেই ঝুপ্ করে সন্ধ্যা নেমে আসে । মেঘ-জমা বর্ষার বিকেল হলে তো আর কথাই নেই... হঠাৎ বৃষ্টি আসে কালবৈশাখী ঝড়ের সাথী হয়ে । খেলতে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, কোথাও বেড়াতে যাওয়াও যায় না । ঠিক ঐ সময়ে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে নিজের পছন্দের বই হাতে নিয়ে পড়ার মত সুন্দর অনুভূতি আর কিছু আছে কি ?
📝 গল্প-সংক্ষেপ : গল্পের প্রধান চরিত্র সুকুমার বোস, পেশায় বেশ নামকরা একজন উকিল । ওকালতির পাশাপাশি তার অন্য পরিচয়... তিনি একজন লেখক । রাজরোগ (টিবি) থেকে মোটামুটি সেরে উঠে তিনি হাওয়াবদলের জন্য আসেন ম্যাকলাস্কিতে । দূর্গম সে জায়গায় আছে কিছু সাধারন এবং অসাধারন চরিত্র আর অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য । তার স্ত্রী রমা এবং এক ছেলে রুণ । তাদের নিয়েই সুখী জীবন হওয়ার কথা ছিল তার, কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি । রমা এবং সুকুমার বোসের প্রেমের বিয়ে । কিন্তু বিয়ের পর তাদের সম্পর্কের দারুণ অবনতি ঘটে । সুকুমার বোস ব্যস্ত হয়ে পড়েন তার ক্যারিয়ার নিয়ে, ফলে রমার সাথে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে । যতদিনে নিজের ভুল বুঝতে পারেন ততদিনে রমাও নিজেকে বদলে নিয়েছে । দুজনের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো অসম্ভব ।
▪️এই প্রতিকূলতার মাঝেই আসে ‘ছুটি’ চরিত্রটি । সুকুমার বোসের একজন একনিষ্ঠ পাঠিকা । তার তৃষ্ণার্ত জীবনে স্নিগ্ধ হিমশীতল ভালবাসার প্রতিশ্রুতি হয়ে ধরা দিলো ছুটি । ছুটি তার চাকরির সূত্রে রাঁচিতে একা থাকে । কাজের ফাঁকে রাঁচি থেকে বারবার চলে আসে ভালোবাসার লেখকের কাছে । অপবাদের তীক্ষ্ণ ফলা তীব্র থেকে তীব্রতর, ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতম করে তোলে সুকুমার এবং ছুটি’র প্রেম কে ।
▪️এদিকে রমা নতুন করে টান অনুভব করে স্বামীর প্রতি, সে ফিরে আসে সুকুমারের কাছে । কী করবে সুকুমার বোস ? একজন সুখী মানুষ হওয়াই যার প্রবল ইচ্ছা, সেই সুকুমার বোস কি পারলেন সুখী মানুষ হতে ?
📝 পাঠ-প্রতিক্রিয়া : আমার অন্যতম প্রিয় উপন্যাসিক বুদ্ধদেব গুহ । ‘লেখক’ পরিচয়ের চেয়েও তার আরও বিশেষ পরিচয় তিনি ‘জঙ্গলের প্রেমিক’ । প্রকৃতির সাথে কতটা আত্মিক সম্পর্ক থাকলে এইভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণণা লেখা যায় !! ওনার এই সব উপন্যাসগুলি বাংলা সাহিত্যের ‘ক্লাসিক’ । এইসব বইয়ের ‘পাঠ প্রতিক্রিয়া’ হয় না, এই আলোচনাকে ‘পাঠ অনুভূতি’ বললে যথার্থ বলা হয় । বহুবার পড়া হয়ে যাওয়ার পরেও এই বইগুলির কাছে বারবার ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী লেখণীর গুণে ।
📜 চরিত্রায়ন : ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা...’
একটি মানুষেরই কত ভিন্ন ভিন্ন রূপ । ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তাভাবনা করে সম্পর্ককে জটিল করে তোলা মানুষের চিরকালীন অভ্যাস, তারপর সেই জটিলতা সমাধানের প্রচেষ্টা । আসলে... প্রতিটি মানুষই সুখের বড় কাঙাল । সবাই তার ভালবাসার মানুষটিকে সাথে নিয়ে হয়ে উঠতে চায় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ । আর যখন সেই সুখের দেখা মেলে না, সুখ এসে ধরা দিয়েও দেয় না... তখনই মানুষ মুক্তি চায়, ছুটি চায় এই নির্মম পৃথিবী থেকে । ভালবাসার উষ্ণতা খুঁজতে গিয়ে মানুষ হয়ে যায় নিঃস্ব, একাকী ।
▪️গল্পের মূল চরিত্র সুকুমার বোসের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক । একদিকে অসম প্রেমের গল্প, অপরদিকে স্ত্রী-ছেলের প্রতি দায়িত্ববোধ, সংসার । মান, যশ, খ্যাতি, টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে ভালবাসার মানুষকে হারানোর যন্ত্রণা সবই উঠে এসেছে ওই চরিত্রের মাধ্যমে ।
▪️রমা চরিত্রটি আমাদের পরিচিত আর পাঁচটা সাধারণ নারীর মতোই । সে চেয়েছিল তার স্বামী সফল হোক এবং একইসাথে তাকে সময় দিক । রমা চাইতো ভালবাসা, যত্ন আর প্রায়োরিটি । তাই, রমার চোখে সুকুমার বোস ব্যর্থ একজন পুরুষ । রমার মতে, ’যে আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করল, তারই এখন আমার দিকে তাকানোর সময় হয় না । তবে আমি কেন তার দিকটা ভাবব ?’
▪️এই উপন্যাসে অন্যতম প্রিয় এই ‘ছুটি’ চরিত্রটি । ছুটি খুব সাহসী, স্বাধীনচেতা, আধুনিকা । সে যথার্থ প্রেমিকা । ভালোবাসার ক্ষেত্রে সে সমাজকে তোয়াক্কা করে না ।
▪️এই উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ গল্পের পার্শ্বচরিত্রগুলি । এই প্রতিটি চরিত্রকেই লেখক অনেক যত্ন নিয়ে তৈরি করেছেন । আছেন মিঃ বোয়েলস নামে এক নিঃসঙ্গ ভদ্রলোক, শৈলেন-নয়নতারা, লাবু, নুড়ানি, মিসেস কার্নি এবং প্যাট । প্রতিটি চরিত্রই ভীষণ স্বতন্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ । লাবুর জন্য আপনার মায়া হবে, শৈলেনের জন্য মন খারাপ করবে নিশ্চিত । প্যাটের মধ্যে আপনি পাবেন এক জীবনসৈনিকের লড়াকু মনোভাব, সংগ্রাম । পড়তে পড়তে বুঝবেন এই চরিত্রগুলি ছাড়া এই উপন্যাস এতো পরিপূর্ণ হতো না ।
📜 প্রাকৃতিক বর্ণনা : বুদ্ধদেব গুহ’র লেখায় প্রকৃতির চিত্র ফুটে উঠবে না তা কী হয় ! এই উপন্যাসে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের বর্ণনা পড়লে রোমাঞ্চিত হতে হয় ।
.... প্যাট আস্তে আস্তে বলল, “সেদিন রিডারস্ ডাইজেস্টে পড়ছিলাম একটা লেখা । ‘হাউ ইভনিং কামস্’। আমাদের সকলের সামনেই সন্ধ্যে হয় রোজ কিন্তু আমরা ক'জন সেদিকে চোখ তুলে তাকাই ? দিনের শেষ এবং রাতের শুরুর মধ্যে এই যে গোধূলি লগন, এই লগনকে আমরা ক'জন উপলব্ধি করি ?”
প্যাটের কথায় একটা চমক লাগল মনে । আর কেউ করুক আর না করুক, ভগবানের দিব্যি ; আমি করি । জঙ্গল-পাহাড়ের পরিবেশে সন্ধ্যালগ্নে দাঁড়িয়ে নাক ভরে আসন্ন হিমের রাতের গন্ধ নিতে নিতে, পশ্চিমাকাশের শেষ ফিকে গোলাপি রঙের আভার দিকে চোখ মেলে আমার বারে বারে মনে হয় যে আমি যেন এখানেই জন্মেছিলাম কোনো কালে । মনে হয় প্রকৃতিই আমার আসল মা.. আমার আসল, প্রথম এবং সর্বশেষ প্রেমিকা । হয়ত অনেক নারী এসেছে, চলে গেছে, অথবা আছে এখনো আমার জীবনে, তারা সকলেই জংলী হলুদ সানফ্লাওয়ারের মত, বেগনেরঙা প্রজাপতির মত, ঘুঘুর কবোষ্ণ বুকের মত, কিন্তু তারা এই প্রকৃতিরই টুকরো মাত্র । তারা খণ্ড এবং প্রকৃতি তাদের সমষ্টি ।
📜 জীবনদর্শন : “প্রেমের সমস্ত সার্থকতা প্রেমাস্পদকে পাওয়ার মধ্যেই সীমিত নয় । তাকে পাওয়া যেতে পারে, নাও যেতে পারে । প্রেমের সবচেয়ে বড় গৌরব প্রেমই । মানুষের জীবনে আর কোনো অনুভূতিই তাকে এমন এক আত্মিক উন্নতির চৌকাঠে এনে দাঁড় করায় না ।”
▪️এই উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু কিন্তু প্রেম অথবা প্রকৃতি নয়, বরং ‘সম্পর্কের জটিলতা’। নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক চিরকালীন এবং চির জটিল । সেই চির জটিল সম্পর্ককে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখছেন লেখক বুদ্ধদেব গুহ । তার লেখায় যেমনি প্রকৃতির সৌন্দর্যের বিবরণ উঠে আসে ঠিক তেমনি উঠে আসে একটা সম্পর্কের চুলচেরা বিশ্লেষণ । প্রেমের গভীর এবং বিচিত্র রূপ দারুণভাবে ফুটে উঠেছে এই উপন্যাস জুড়ে । একজন পুরুষ কতটা আদিম হতে পারে, কতটা প্রবল হতে পারে তার প্রবৃত্তি, কতটা ঝুঁকি সে নিতে পারে নিজের ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠিত করতে... তার সবটুকুই উপলব্ধি করা যায় এই উপন্যাসের সুকুমার চরিত্রটিকে বিশ্লেষণ করলে ।
“হৃদয়ের শূন্যতা যে দেহ-মনে অপার্থিব এক শীতলতার সৃষ্টি করে সে আমরা প্রায় অনেকেই অনুভব করি । অপার্থিব বলছি এ জন্য যে, প্রচণ্ড দাবদাহে যখন জ্বলছে প্রকৃতি তখন হয়ত আপনি শীতে কাঁপছেন । সে শীত আপনি কোন পার্থিব পোশাকে দূর করতে পারবেন না । সে শীত একাকীত্বতার শীত । সে শীত কেবলমাত্র তখন দূর হবে যখন আপনার আত্মা খুঁজে পাবে আত্মিক উষ্ণতা । আর সেই উষ্ণতাটুকুর নামই ভালবাসা ।”
📜 শেষটুকু : পৃথিবীতে বিভিন্ন লোক বিভিন্ন কারণে শীতার্ত, সকলেরই একটু উষ্ণতার প্রয়োজন । গল্পের মূল চরিত্র সুকুমার বোস তার স্ত্রীর কাছে উষ্ণতার ছোঁয়া না পেয়ে, দীর্ঘ শীতার্ত দিবসের পর ছুটি নামক এক উষ্ণতাকে আলিঙ্গন করে বাঁচতে চেয়েছিলেন । যেমনভাবে নয়নতারাকে আলিঙ্গন করে বাঁচতে চেয়েছিল শৈলেন । লাবুও একটু উষ্ণতার জন্য হাত ধরল নুরানীর, পিছনে ফেলে রাখলো তার শীতার্ত পরিবারকে ।
▫️লেখক বুদ্ধদেব গুহ’র এই উপন্যাস শেষ করে অদ্ভুত রকমের একটা ভালোলাগার অনুভূতিতে ডুবে ছিলাম বেশ কিছুদিন । এই উপন্যাস সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভীষণ আধুনিক একটি উপন্যাস । লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি যদি আপনার কাছে পরিষ্কার না হয়, তাহলে এই বইটি আপনার কাছে নিছকই একটি ‘পরকীয়া কাহিনী’ই মনে হতে পারে ।
এক লুতুপুতু দুর্বল পুরুষের লুতুপুতু গল্প। সে যক্ষ্মা থেকে সেরে উঠার জন্য চেঞ্জে যায় এক সুনিবিড় প্রকৃতিঘেরা পাহাড়ি বুনো এক এলাকায়, এবং সেখানকার 'ছোটলোক'দের মাঝে সে দেখতে পায় মনুষ্যত্ব, যেই মনুষ্যত্ব মাইন্ড ইট ভদ্রলোকদের মাঝে একমাত্র তারই আছে। ভদ্রসমাজের বাকি সবাই-ই হচ্ছে অমানুষ, স্থূল, রুচিহীন, শরীরসর্বস্ব বেহায়া। সে একা আলাদা, তাই তো তার এত কষ্ট। কষ্ট কি কষ্ট - পৃথিবীর সব কষ্ট একমাত্র তারই। শরৎচন্দ্রের বাল্যবিধবারাও নাকি তার চেয়ে সুখী। একমাত্র তার হাঁটুর বয়সী মিস্ট্রেসের সাথেই তার যা একটু মনের মিল ছিলো, সেও তাকে শরীর দেবার আগেই অন্য কাউকে দিয়ে দেয়, অন্যদিকে তার মহাসুন্দরী স্ত্রীও তাকে ফেলে তার বন্ধুর সাথে ঘর বাঁধতে চলে যায়। হাউ স্যাড। অনেক কষ্ট পেলাম।
বুদ্ধদেব গুহ'র উপন্যাস থেকে আসলে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করেছি সেটা বলাও মুশকিল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এত মেজাজ খারাপ করার পরও বইটা শেষ পর্যন্ত একটানা পড়ে গেছি। Peak guilty pleasure. প্রকৃতি তো আছেই, তার পাশাপাশি লুতুপুতু আবেগেরও কী অসাধারণ বর্ণনা। পড়ে মাঝে মাঝে আমিও একটু লুতুপুতু হচ্ছিলাম বৈকি। ভয়াবহ ব্যাপার।
মেয়েরা কত্ত সস্তা,না? হেয়ালি,ন্যাকামি করে না বলে, সমাজকে গ্রাহ্য করে না বলে ছুটি কে ভালো লাগলো অথচ যে বৌ শুধু সমাজে সম্মান পাওয়ার জন্য একটা পরিচয় ধরে রাখতে চেয়ে সেই জন্মজনমের ছুটি কে রাস্তার মেয়ে,শরীর বিলানো মেয়ে বল্লো তখন সুকুমার রায়ের "এসব আলাপ বন্ধ করো" বলার চেয়ে বেশি কিছু আর বলার ছিল না। না মানে তোমার বিয়ে করা বৌয়ের এত্ত অপমান সহ্য করে ওই মেয়ে যখন অন্যবাকি সব মেয়েদের মতো হয়ে গেলো তখন লেখকবাবুর দুনিয়া ঘুরে গেলো! How lame
বছর দুয়েক আগে পড়া শুরু করেছিলাম, শেষ আর করতে পারিনি। মনেও ছিলনা কেন করতে পারিনি। আজ বুঝলাম সেটা। বুদ্ধদেব বাবু আমার ভীষণ পছন্দের লেখক, কিন্তু এই বইটি এতোটা হতাশ করবে আমায় ভাবতেই পারিনি। সুকুমার বোসের মতো একটা মেরুদন্ডহীন পুরুষকে কেন যে এভাবে মহান করে দেখাতে গেলেন লেখক, সেটাই বুঝছি না। আসলে আমি বইটা লেখার কারণটাই বুঝছি না। শুধুমাত্র রমা, ছুটি ও লাবুর জন্য ২টি তারা রইলো।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, পরমুহূর্তেই আমি দৌড়চ্ছি–অন্য দিকে, বিপরীত দিকে–যে দিকে মৃত্যু নেই, মিস্টার বয়েলস-এর মত কোটরগত-চক্ষু–ভয়াবহ যমদূতের দাবা-খেলার সঙ্গীরা কেউ নেই–যেদিকে অন্ধকার নেই।
দৌড়তে দৌড়তে দেখতে পেলাম। দূ–রে আলো দেখা যাচ্ছে।
কোনো সাহেববাড়ির আলো। দেখলাম একটা আলোকিত বাড়ি—বুকের মধ্যে অনুভব করলাম, সেখানে ঘরের মধ্যে উষ্ণতা, ঘরের মধ্যে ভালোবাসা; একজন প্রেমিক পুরুষ, একজন প্রেমিকা নারী; সেখানে জীবন।
বাইরে শীত। বাইরে অন্ধকার।
আমি জোরে সেদিকে, উষ্ণতার দিকে দৌড়ে চললাম।
উপন্যাসে মূলত বোঝানো হয়েছে, দিন শেষে আমাদের একজন ভালোবাসার মানুষ প্রয়োজন, একান্তই প্রয়োজন। প্রধান চরিত্র সুকুমার বোস, একটি অথর্ব ধরণের চরিত্র ছিল, কনফিউশান-এ ভর্তি একটা চরিত্র। তার তার কনফিউশান এর কারণে রমা এবং ছুটি দু'জনকেই হারিয়েছেন! উপন্যাসের 'ছুটি' চরিত্রটি খুব ভালো লেগেছে, প্রেমে পিচ্ছিল খেয়ে যাওয়ার মতো চরিত্র!
যে পুরুষ চিরকাল কোন এক নরম হাতের উষ্ণতা খুঁজে ফিরেছে অথচ যে কারণেই হোক সে নির্ভরতা পাওয়া হয়ে উঠেনি । যে নারী ভালোবেসেছে, কাছে পেতে চেয়েছে, কিন্তু যথার্থ কিংবা অযথার্থ কারণেই সে পুরুষ থেকে দূরে চলে যেতে হয়েছে। এ উপন্যাস তাদের জন্য।
যারা কোথাও না কোথাও থিতু হয়েছে, সবকিছু শরীর আর টাকা সর্বস্ব বলে জেনে এসেছে- তাদের কাছে এটি উপভোগ্য না হবারই কথা। সূক্ষ অনুভুতি, পুরুষ��র ভেতরে চলা টানা পোড়ন, ভালোবাসা, নারীর দিকের আবাহন আর সাথে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রকৃতি আর মানুষেরা - সব মিলিয়ে অন্য একটা জগতে যেতে চাইলে, একটু অন্যরকম উষ্ণতার খোঁজ হিসেবে চমৎকার এক পাঠ্য এটি।
অসাধারণ। চরিত্র আর প্রকৃতির নিখুঁত বিশ্লেষণ আর বর্ণনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ম্যাকলাসকিগঞ্জের প্রাকৃতিক বর্ণনায় এমন বিমোহিত হয়েছি যে মনে হয়েছে মরবার আগে ওখানকার স্বর্গীয় সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে একটু ঘুরে না আসতে পারলে জীবনটাই অপূর্ণ। আর প্রায় প্রতিটি চরিত্রের অন্দরমহল তো বটেই, সব অলিগলিও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়েছেন বুদ্ধদেব গুহ।
মূল গল্পের প্লট আহামরি ভালো না লাগলেও পুরো বইতে বিশ্লেষণ ধর্মী যে দৃষ্টিতে লেখক জীবনের দিকে তাকিয়েছেন, তা বইটি ভালো লাগতে বাধ্য করেছে।
প্রথমত উপন্যাসের নামে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। মনে করেছিলাম খুবই adult একটি বই। ক্লাস ১১ এ তখন পড়ি,স্কুলের পাশে লাইব্রেরীতে দেখেছিলাম। খুব ইচ্ছা করতো যে বইটা পড়বো কিন্তু কেনো জানিনা হয়ত বইএর এরকম নামের জন্যই হয়ত একটু লজ্জা লজ্জা করতো নিতে। যাই হোক সে সময় পড়তে পারিনি। ২০১৮ এ এসে শেষপর্যন্ত সেই ইচ্ছা পূরণ করি।
কিন্তু এ মা এ কি !!! রোমান্স তো দূরের কথা রোমান্সের ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। এবং গল্প টাও ভালো লাগেনি।
ছোটবেলায় বড় কাজিনদের বইয়ের আলমারিতে দেখতাম বইটা। অনেক বই নিতাম চেয়ে পড়ার জন্য, কিন্তু এই বইটা নিতে পারতাম না। লজ্জা লাগত। কী যে লোভ করছি বইটা পড়ার জন্য। এখন পড়ে মনে হলো ভাগ্য ভালো তখন পড়ি নাই। এখনও না পড়লে আরও ভালো হতো। সময় নষ্ট।
বুদ্ধদেব গুহ'র প্রথম যে বইটা আমি পড়ি সেটা সম্ভবত 'কোজাগর'। কোজাগর পড়ার সময়েই আমি বুদ্ধদেবের চোখে পাহাড়, জঙ্গল আর পাহাড়ি জনপদ দেখি। প্রেমে পড়ি পাহাড়, জঙ্গল আর মহুয়া ফুলের... এর যত বার গুহ পড়েছি, আমি নতুন করে প্রেমে পড়েছি পাহাড়, জঙ্গল আর মহুয়া ফুলের...
বুদ্ধদেবের লেখা সবার জন্য হজম করা কঠিন। বিশেষ করে ওঁর লেখায় নারী-পুরুষের যে ভালোবাসার সম্পর্ক দেখানো হয়, আলোচনা করা হয় সেটা বাঙালি সমাজের প্রথাগত সম্পর্কের বাইরের জিনিস। কেবল 'ভালোবাসা'ই যে যথেষ্ট, সেটা মেনে নিয়ে ওঁর লেখা পড়তে হয়। সেখানে থাকেনা সামাজিক প্রথার অবকাশ, থাকেনা বিয়ের দায়বদ্ধতা। আবার বিবাহ বর্হিভূত ভালোবাসাও হয়ে উঠে একটি স্বাভাবিক বিষয়। কারণ, ওঁর মতে প্রতিটি ভালোবাসা প্রতিটি সম্পর্কই অনন্য। একটার সাথে আরেকটির তুলনা চলেনা আবার একটি সম্পর্ক আরেকটি সম্পর্ক কে সীমাবদ্ধ করতে পারেনা।
'একটু উষ্ণতার জন্য' উপন্যাসের নায়ক সুকুমার বোসও তেমনি সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন। রাজরোগ যক্ষার জীবাণু থেকে মুক্তির জন্য ম্যাকলাস্কিগঞ্জে আসেন সুকুমার। এখানেই উপন্যাসের শুরু। মূল উপন্যাসের দুইটি দিক দেখিয়েছেন গুহ বাবু। একদিকে সুকুমারের ব্যক্তি জীবন অন্যদিকে পাহাড়ের এই জনপদের একাধিক মানুষের জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাহিনী। যেখানে ফুটে উঠেছে ভালোবাসা, যৌনতা, দরিদ্রতা, একাকীত্ব আর আদিমতা। অপর দিকে সুকুমারের ব্যক্তিগত জীবনের পারিবারিক বিষয় এসেছে। যেখানে স্ত্রীর অন্য পুরুষকে ভালোবাসে আবার সুকুমার নিজেও ভালোবাসে অন্য নারীকে। সবাই সবকিছু জানে, তবুও কেউ কাউকে ছেড়ে যায় না। কারণ কি? এই জটিলতার উত্তর নেই কোন। অথবা আছে, সেটা হলো ভালোবাসা...
সুকুমার কে একদিক থেকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, সেটা হচ্ছে তার ব্যক্তিত্ব। না, কোন কঠিন বা তীব্র ব্যক্তিত্ববান কেউ না সুকুমার। তবুও তার ভালোবাসার ধরণ ভালো লেগেছে। ঐ যে বলেনা, যে ভালোবাসা আমার চেয়ে নিতে হবে সেই ভালোবাসা দিয়ে আমি করবো টা কি? এমনি এক ব্যক্তিত্ব সুকুমারের। সে দু'হাত বাড়িয়ে ছিল ভালোবাসার জন্য অথচ আহ্বান করেনি। শুধু দাঁড়িয়ে থেকেই গেল...
‘’ সুখের ত’ কোনো বিশেষ চেহারা নেই। প্রত্যেকের সুখ আলাদা-আলাদা রকম। আসলে আমাকে যদি শুধোও ত’ আমি বলব, সুখের নিজস্ব কোন চেহারাই নেই, সুখ যে কোনো তরল পদার্থের মত-যে মানুষের মনের যেমন আয়তন, যেমন পরিধি, যেমন ঘনতা, সুখ ঠিক সেই আকার ধারণ করে। কাজেই যারা এমোশনকে জীবন থেকে বাড়তি পোশাকের মত ফেলে দিয়েছে তারা তাদের মত সুখী, আবার তুমিও তোমার মত সুখী। মনে হয়, জীবনে সুখ বলতে কে কি মনে করে তার উপরই সব নির্ভর করে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমরা সকলেই সুখী এবং সকলেই দুঃখী।‘’
সৃষ্টির শুরু থেকেই নরনারীর সম্পর্ক একটি জটিলতায় ঘেরা সম্পর্ক। বহুকৌণিক এই সম্পর্কে কেউ কখনও খুঁজেছে শরীরী ভালোবাসা আবার কেউ খুঁজেছে স্বর্গীয় ভালোবাসা; যা ছুঁয়েও নিয়ন্ত্রিত, না পেয়েও বহমান। প্রকৃত ভালোবাসা দানকারী ও গ্রহণকারী যে গৎবাঁধা ভালোবাসার উর্ধ্বেও তাঁদের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে পারে তা সর্বসত্য! একদিকে নানা উপমাযুক্ত প্রকৃতিতে অবগাহন তার সাথে বুদ্ধদেবের এই জটিল সম্পর্কের ধারালো বিশ্লেষণ; সব মিলিয়ে শেষ পর্যায়ে পাঠক নিজেই বিবেচনা করবেন যে কোন ভালোবাসা আর কোন উষ্ণতা অনুভব করেই হয়ে ওঠা যায় সাধারণেও অসাধারণ! নাকি একাকীত্ব বরণ করে তাতেও খুঁজে ফেরা যায় নিজের সর্বস্���কে! "একটু উষ্ণতার জন্য" আপনাকে ভাবাবে, খুঁজতে বাধ্য করবে কখনও কখনও চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে আবার হৃদয়ের বিভিন্ন খাঁজে নাড়াও দেবে! সবশেষে নিজের ভিতর আবিষ্কার করবেন এক ফুরোনো প্রায় ভালোলাগার আবেশ!
দশ বছর পর পুনর্পঠন,দেখা গেল পুরো উপন্যাসে কেবল দুলাইন ছড়াই স্মৃতিতে রয়ে গেছিল, "সুখ নেই কো মনে/নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে"..আর কিচ্ছুটি মনে ছিলনা৷ এমন অদ্ভুত আবর্তে জীবন চলে,তারও বেশ কয়েক বছর পর যখন "গোসাঁই বাগান" ধারাবাহিক পড়ছি,তখনও মনে দাগ কেটে গেছে চারটে লাইন, "তোমার সুখ নেই কো মনে/তুমি হলুদ বনে বনে হারাবে নাকছাবি/এতো অবশ্যম্ভাবী"..কবির নাম,কলামের বিষয় বাকি সব বেমালুম ভুলে গেছি৷
কিছু কিছু উপন্যাস থাকে যেগুলোর পাঠ প্রতিক্রিয়ার বিবরণ দেওয়া যায় না। বুদ্ধদেব গুহর একটু উষ্ণতার জন্য বইটিও ঠিক তেমন। পড়ে শুধু অনুভব করার মত বই এটি। সম্পর্কের কত ধরণ, কত ধরনের ভাঙা - গড়া, কত ভাবের ব্যবচ্ছেদ! তবুও ভালোবাসা টিকে থাকে জনমভর। তবুও নিজেকে বুঝতে পারা কিংবা নিজেকে জেনে নিজেকে ভালোবাসার মত বড় আর কিছুই হতে পারে না।
"জীবনে কেউ কাউকে ঠকাতে পারে না, কেউ কাউকে কিছু দিতেও পারে না। যা পাবার, যা দেবার, তা একমাত্র নিজেকেই পেয়ে ও দিয়ে ধন্য বা অধন্য হতে হয়। সে আনন্দ বা দুঃখ শুধু তারই। তার একার। সেই ন্যায় বা অন্যায়ের পাওনা এবং প্রায়শ্চিত্ত শুধু তার নিজেরই।"
"তবুও যেতে হবে, চলে যেতে হবে, আজ কিংবা কাল, নিজের হাতে নিজেকে খেয়া পার করাতে হবে। ... পাখি ডাকবে, ফুল ঝরে পড়বে, শুকনো পাতা উড়বে চৈতী হাওয়ায়, মহুয়া আর করৌঞ্জের গন্ধে ভারী হয়ে থাকবে সমস্ত প্রকৃতি - আর এই দ্বন্দ্ব ও দ্বিধায় ক্লিষ্ট বঞ্চিত ও ব্যথিত হৃদয়ের একজন চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকবে।"
"আমাদের সকলের সামনেই সন্ধ্যে হয় রোজ কিন্তু আমরা ক'জন সেদিকে চোখ তুলে তাকাই? দিনের শেষ এবং রাতের শুরুর মধ্যে এই যে গোধূলি লগন, এই লগনকে আমরা ক'জন উপলব্ধি করি?"
"অধিকার আমাদের অনেকেরই অনেক ব্যাপারে থাকে হয়ত অনেকের কাছে, কিন্তু সে অধিকারের তাৎপর্য ও তার সীমা আমরা অনেকেই সঠিক বুঝতে পারি না।"
"ভালোবাসা বলতে কি বোঝায় আমি জানি না, উষ্ণতা কথাটার মানে কি আমি জানতে চাইনি, কিন্তু বহুদিন পরে একজনের হাতে হাত রাখতেই আমার সমস্ত শরীর কেন যে এমন করে ভালোলাগায় শিউরে উঠল তাও কি আমি জানি? এই উষ্ণতা, এই আশ্লেষ, এই ভরন্ত ভালোলাগা, এর কি কোনো নাম নেই।"
"মাঝে মাঝে আমাদের চোখ এত কথা বলে, চুপ করে কারো দিকে চেয়ে থাকলে চোখ অনর্গল এত বলে যে, সে সময়ে মুখে কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না। আমাদের কলমের বা মুখের ভাষা কোনোদিনও বোধহয় চোখের ভাষার সমকক্ষ হতে পারবে না।"
"বয়স হয়ে গেলে সব মানুষই বেশি কথা বলেন, তাঁদের বোধহয় মনে হয় তাঁদের এত কথা বলার ছিল, অথচ বলা হল না। বোধহয় মনে হয়, এখন না বলে ফেললে পরে আর বলা যাবে না।"
"আমার এই সমস্ত রকম আপাতপ্রাপ্তির মধ্যেও কেন মন আমার সর্ব সময় এমন অশান্ত থাকে? কেন এমন পাগলের মত ছটফট করে? না কি, আমি একাই নই, সবাই-ই এরকম, প্রত্যেক মানুষ ও মানুষীর মনের ভিতরেই বুঝি এমনি একটা মন থাকে, যে মনটা প্রতিটি মুহূর্তে বিদ্রোহীর মত মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, যা পেল, তাকে ধূলোয় ফেলে অন্য কিছুর দিকে হাত বাড়ায়?"
"আমি এখনও ওকে ভালোবাসি। একে ঠিক ভালোবাসা বলা উচিত কি না জানি না, হয়ত এটা কর্তব্যবোধ, হয়ত এটা অনেকদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে যে যুক্তিহীন মমতা জন্মায় অন্যের প্রতি, তাই। হয়ত এ আমাদের একমাত্র ছেলের প্রতি, তার ভবিষ্যতের প্রতি মমত্ববোধ।"
"জীবন কি সত্যিই এত অবহেলার জিনিস? জীবন তা একটাই- একবারই আসে। তবে সে জীবনও আমরা নিজেদের ইচ্ছা নিজেদের সাধ অনুযায়ী ভোগ করতে পারি না কেন?"
"অগ্নিসাক্ষী করে কাউকে কোনদিন বিয়ে করেছিলাম বলেই, কাউকে সমস্ত উষ্ণতায় ভরা হৃদয় দিয়ে একদিন ভালোবেসেছিলাম বলেই যে আমার সেই নিবে যাওয়া যজ্ঞের আগুনে সেই ডিপ ফ্রিজে রাখা কোঁকড়ানো ঠাণ্ডা হৃদয়ের কবরে বাকি জীবন হাহাকারে কাটাতে হবে একথা ঠিক নয়।"
"সব কথাই কি মুখে অথবা লিখেই জানাতে হয়, এক হৃদয়ের কথা শব্দতরঙ্গে ভেসে কি অন্য হৃদয়ে পৌঁছয় না? যদি নাই-ই পৌঁছয় ত' কিসের ভালোবাসায় বিশ্বাস করি আমরা, কিসের আন্তরিকতা আমাদের?"
"পরনির্ভরতার মত অর্বাচীনতা আর বুঝি নেই। নিজের হৃদয়ের উষ্ণতায়, নিজের মধ্যের জেনারেটরে তাপ সঞ্চারণ করে এই ঠাণ্ডা নির্দয় পৃথিবীতে যে বাঁচতে না পারে, তার বাঁচা হয় না। তার জন্য এই পৃথিবী একটি চলমান প্রাগৈতিহাসিক হিমবাহ।"
"কেউই অন্য কারো জন্যে, অন্য কারো কারণে বাঁচে না, অন্তত কারোরই সেরকমভাবে বাঁচা উচিত নয়। কেউই অন্য কারো দয়ায় নির্ভর করে বাঁচতে পারে না। বেঁচে থাকার এবং সুস্থ স্বাভাবিক ও সুখী মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের সকলের জন্মগত নয়, সে অধিকার আমাদের প্রত্যেককে তৈরি করে নিয়ে বাঁচতে হবে।"
"জীবন একটা চলমান অভিজ্ঞতা, এতে স্থাবর বা স্থবিরের কোনো স্থান নেই। আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই সত্যি। এই মুহূর্তটিই -যে মুহূর্তে আমি বেঁচে আছি। আর সব মিথ্যা। বর্তমানের জন্যে অতীত অথবা ভবিষ্যৎ দুইকেই হাসিমুখে বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে।"
"আমাদের মধ্যে নিরানব্বই ভাগ লোকই অতীতের স্মৃতি অথবা ভবিষ্যতের সুখ কল্পনা নিয়ে বাঁচি, মানে বাঁচতে চাই। আর এই বাসি ঠাণ্ডা অতীত ও জরায়ুর মধ্যের ঈষোদুষ্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে পড়ে, তাদের প্রত্যেকের বর্তমানটাই মারা যায়। বর্তমান মানে জাস্ট একটা মুহূর্ত নয়। শুধু এই মুহূর্তই নয়। বর্তমানের বিস্তৃতি অনেক। বর্তমান মানে সমস্ত জীবন, আপনার আমার, সকলের প্রতি মুহূর্তের অস্তিত্ব। আমরা যদি প্রতি মুহূর্তেই নিজেদের ফাঁকি দিই, একে অন্যকে ফাঁকিতে ফেলি, তাহলে সে জীবনের কি বাকি থাকে বলুন?"
"আসলে প্রত্যেকটা সম্পর্কই বিভিন্ন, তাদের প্রকৃতি, তাদের ডাইমেনশান সব বিভিন্ন। তাই এক সম্পর্কের সঙ্গে অন্য সম্পর্কের তুলনা বোধহয় কখনো করা উচিত নয়।"
"সংসারের জন্যে অনেক কিছু করলে মানুষ স্বাভাবিক কারণে সংসারের কাছে কিছু আশাও করে। এবং মনে হয় সে আশা করাটা কিছু অন্যায় ও নয়। শেষের দিনে যদি এই-ই ঘটে, যখন মানুষ একটু সঙ্গ চায়, একটু সহানুভূতি চায়, তখন যদি তার অশক্ত হাতে তাকে এমন করে বাঁচার জন্যে, নিছক বাঁচার জন্যেই লড়াই করতে হয়, তাহলে এই সংসার-সংসার মিথ্যে পুতুল খেলা খেলে লাভ কি বল?"
"আমাদের সকলেরই জীবনই একএকটা চলমান অভিজ্ঞতা - এতে কোনো জানাই, কোনো মতই স্থিতিশীল নয়। আজ যা নির্ভুল বলে জানছি, কাল সেটাকেই চরম ভুল বলে মনে হয়। আজ যেটাকে চমকপ্রদ বুদ্ধিমত্তা বলে ভাবছি, কালই জানব যে সেটা এক পরম নির্বুদ্ধিতা।"
"আমাদের জীবনে, এই সংসারে আপনার বলতে, নিজের বলতে শুধু একটি জিনিসই আছে। একটি মাত্র জড়পদার্থ। সে জিনিসটা হচ্ছে বাথরুমের আয়না এবং সে আয়নায় প্রতিফলিত তোমার সত্যিকারের ব্যথাতুর মুখ। এটুকুই।"
"কেউ কেউ আপনার হয়, আপনার হতে চায়, ক্ষণকালের জন্য, কিছুদিনের জন্য। তুমি যদি সমস্ত জীবনকে ছোট করে হাতের মধ্যে তুলে ধরে একটা বলের মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো ত' দেখবে যে, তুমি ছাড়া, তোমার আয়নায় মুখ ছাড়া, তোমার আপনার বলতে আর কেউই নেই, সত্যিই কেউ নেই।"
"এই সংসার একটা দারুণ অর্কেস্ট্রা। কোনো বুড়ো, মান্ধাতার আমল��র প্রস্তরীভূত সামাজিক প্রতিভূ একজন কনডাকতারের মতো তার হাতের ছড়ি ওঠায় নামায় এবং তুমি যে বাজনাই বাজাও না কেন, তোমাকে সকলের সঙ্গে একই সুরে, একই লয়ে, একই মাত্রায় বাজাতে হবে। তোমার ভালো লাগুক, কি নাই-ই লাগুক। তোমার তার ছিঁড়ে গেলে তাড়াতাড়ি তার বেঁধে নিতে হবে, হাত শ্লথ হয়ে এলে তবুও অন্যদের সঙ্গে একই সঙ্গে বাজাতে হবে। যদি তুমি থেমে যাও, না বাজাও, সমস্ত অর্কেস্ট্রা তখনই থেমে যাবে।"
"যতদিন এই গায়ের উইন্ড-চিটারের মত, আমার বুকের ভিতরের মনের উইন্ড-চিটারটা অক্ষত থাকবে, ততদিনই আমি বাঁচব। আমি কাউকে আমাকে করুণা করতে দেব না, কোন কিছুর জন্যেই নয়।...আমি সশব্দে সমস্ত অনুভূতির তীব্রতার মধ্যে বাঁচতে চাই, মরার সময়েও সচকিত শব্দতার মধ্যে মরতে চাই।"
"আমরা প্রত্যেকেই বোধহয় অনেক পরত ভঙ্গুর ভাবাবেগ নিয়ে জন্মাই, বড় হই, হয়ত সেটাই স্বাভাবিক। তারপর এই জীবনের ছায়াময় রুক্ষ পথে চলতে চলতে, বাড়তি পোশাকের মতো, এক এক পরতকে পথে ফেলে যেতে থাকি।"
"লক্ষ লক্ষ বিবাহিত দম্পতি এমনি করে দাম্পত্যের অভিনয় করে চলেছেন, ক্লাবে, পার্টিতে, সামাজিক উৎসবে। সকলের সামনে ভাব দেখাচ্ছেন। কত প্রেম। হাসছেন, একে অন্যকে ডার্লিং বলছেন, তারপর বাড়ি ফিরে এয়ার কন্ডিশনড বেডরুমে মোটা ডানলোপিলোর গদির উপর দুটি প্রাণহীন মোমের মূর্তির মতো দুজন দুদিকে শুয়ে থাকছেন। গায়ে গায়ে লেগে থেকেও হাজার মাইল ব্যবধানে আছেন।"
"তোমার আমার চারপাশের লোকদের যদি তেমন করে লক্ষ্য কর, ত' দেখবে যে, তাদের বেশির ভাগের মনই স্যানফোরাইজড্। তাদের মনে কোনো সংকোচন প্রসারণ নেই। তাদের মনের পাল যেমন ছিল তেমনিই থাকে, হাওয়া লাগলেও ফোলে না, দোলে না, হাওয়া না লাগলেও চুপসোয় না, কুঁকড়ে গুটোয় না। তারা তাদের মনকে জীবনের সঙ্গে কন্ডিশানড করে নিয়েছে। এয়ার কন্ডিশনড ঘরের মতো। সেখানে শীতে-গ্ৰীষ্মে একই তাপ।"
"প্রত্যেকের সুখ আলাদা আলাদা রকম। সুখের নিজস্ব কোনো চেহারাই নেই, সুখ যেমন তরল পদার্থের মত - যে মানুষের মনের যেমন আয়তন, যেমন পরিধি, যেমন ঘনতা, সুখ ঠিক সেই আকার ধারন করে। কাজেই যারা ইমোশনকে জীবন থেকে বাড়তি পোশাকের মতো ফেলে দিয়েছে তারা তাদের মত সুখী, আবার তুমিও তোমার মত সুখী। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমরা সকলেই সুখী এবং সকলেই দুঃখী।"
"এখনও বেলা আছে, এখনও সকালের আশাবাদী রোদ আছে, এখনও পথ আছে ফেরার।"
"জীবনে আনন্দ কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সুখও নয়, এই দুঃখ, এই একাকীত্ব, এই মনে মনে আত্মহননের অনুক্ষণ চিন্তা পেরিয়ে এলে কখনও হঠাৎ আনন্দের উষ্ণ হাতে হাত রাখা যায়। কিন্তু শুধু কিছুক্ষণের জন্যই।
"আমি বিশ্বাস করি না যে মিথ্যাকে বা ভানকে আশ্রয় করে জীবনে কিছু পাওয়া যায়। পাওয়া যে যায় না, তা নয়, কিন্তু তা নিতান্তই মেকী, স্বল্পস্থায়ী, তাতে আনন্দ নেই। যে কোনো গভীর আনন্দই গভীর দুঃখ থেকে জন্মায়। গভীরতা না থাকলে দুঃখ বা সুখ কোনোদিনই তেমন করে নিজেকে আচ্ছন্ন করে না বলেই মনে হয়।"
"অন্যকে দুঃখ দিয়ে কি কখনও সুখী হওয়া যায়? সত্যিকারের সুখী হওয়া যায়? সুখ কেউই কাউকে হাত বাড়িয়ে দেয় না। আজকের দিনে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হাতে নিজের সুখ নিজেকেই কেড়ে নিতে হয় অন্যের অনিচ্ছুক হাত থেকে। যে তা না করে, সে মরে।"
"জীবনটা এত ছোট, অবকাশের সময় এত কম যে, বেশী লোকের মধ্যে, বেশী লোকের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দিলে কোনো সম্পর্ককেই গভীর ভাবে উপভোগ বা উপলব্ধি করা যায় না বলেই সবসময় মনে হয়েছে।"
"আমাদের প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি সম্পর্কই যেন হীরের টুকরোর মতো। কোনদিক থেকে, কোন্ কোণ থেকে আলো পড়লে মনের সম্পর্কের কোন্ কোণে কোন্ রঙ ঝিলমিলিয়ে ওঠে তা বোঝা শক্ত।"
"এ জীবনে কখনও ভুলে ও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু কোরো না। যা মন থেকে, হৃদয় থেকে করতে না চাও তা কখনও কোরো না। কারো কথাই শুনো না, বিবেকের না, সমাজের না..."
"জীবনে যা নিজের বিদ্যা, বুদ্ধি এবং বোধ দ্বারা বিবেচনা করেছ, করে ফেলেছ, কখনও তা নিয়ে আফশোস কোরো না। যাই করো না কেন, যা করেছ, তার জন্যে কারো কাছে ক্ষমা চেও না, নিজেকে অভিশাপ দিও না। যা করেছ, তা ঠিকই করেছ বলে মনে কোরো। সব সময় মনে কোরো।"
"জীবন একটা সমুদ্রের মতো, বিশাল, দিগন্তবিস্তৃত, আবর্তময়। এ এক মত্ততায় ভরা ঢেউয়ের সমুদ্র ঢেউ, তারপর ঢেউ তারপর আরো ঢেউ। এখানে অনেক ফেনা, ডুবে যাওয়া, পাথরে আছরে পড়া আবার আশ্চর্য নীল - শান্তও কখনও কখনও। সত্যিই জীবন একটা দারুণ গোলমেলে নোনা স্বাদে ভরা দুরন্ত অভিজ্ঞতা। আর আমরা, আমরা এই টুকরো টুকরো ক্ষুদ্র মানুষ সেই সমুদ্রের বুকে ওড়া ছোট নরম সাদা সীগালেদের মতো।"
"যে কাউকে জীবনে তেমন করে ভালোবেসেছে এবং ভালোবেসে ভালোবাসার জনকে পায় নি, একমাত্র সেই-ই জানে সেই ব্যর্থতার গ্লানি ও কষ্ট কি এবং কতখানি।"
"ভালোবাসা হচ্ছে তীরের মত। তূণ থেকে বেরিয়ে চলে গেলে সে চলেই যায়, তার লক্ষকে বিঁধতে পারে কি না পারে তা সেই তীরন্দাজের কপাল।"
"জীবনে অনেককেই এমন কতগুলো সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হয় যে সব সঙ্কটে অন্য কেউই তোমাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারে না। তোমার কষ্ট দেখতে পারে, মনে মনে তোমার প্রতি সমবেদনা জানাতে পারে, কিন্তু সাহায্য করতে পারে না। এই সঙ্কট থেকে পেরুতে যা করবার তা তোমাকেই করতে হবে।"
"যারা ভালোবাসে ভালোবাসার জনকে পায় না, তাদের সবচেয়ে বড় জিত বুঝি এইখানে। এই না-পাওয়াও একটা দারুণ পাওয়া।"
“ব্যর্থ প্রেম বা ব্যর্থ প্রেমিক বলে কোনো কথা কখনও আছে বা ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি না। প্রেম, সে যার প্রেমই হোক, সে যদি সত্যিকারের প্রেম হয় তা কখনই ব্যর্থ হয় না। প্রেমের সমস্ত সার্থকতা প্রেমাস্পদকে পাওয়ার মধ্যেই সীমিত নয়। তাকে পাওয়া যেতে পারে, নাও যেতে পারে। প্রেমের সবচেয়ে বড় গৌরব প্রেমই। মানুষের জীবনে আর কোন অনুভূতিই তাকে এমন এক আত্মিক উন্নতির চৌকাঠে এনে দাঁড় করায় না। যে ভালোবাসে সে নিজের অজানিতে কখন যে নিজের মনের আঁটসাঁট গরীব কাঠামোর চেয়ে অনেক বড় হয়ে যায়, সে নিজেও তা বুঝতে পারে না। অন্য কোনো অনুভূতিই তাকে এমন করে মহৎ, উদার ও উন্নত করে না। ভালো যে বাসে, সে ভালোবেসেই কৃ্তার্থ হয়; যাকে ভালোবাসে তার কৃপণতা বা উদারতার উপর তার ভালোবাসার সার্থকতা কখনও নির্ভরশীল হয় না।"
"মৃত্যু বোধহয় আমাদের একে অন্যের কাছে টেনে আনে। সমস্ত জীবন নিজেদের আত্মম্ভরিতা, নিজেদের ঠুনকো মান, সম্মান, অভিমান নিয়ে আমরা সহজে অন্যের থেকে দূরে থাকতে পারি, কিন্তু মৃত্যু এসে এই সমস্ত মন গড়া ব্যবধান সরিয়ে দেয় - তখন প্রত্যেকেই মনে করি, কি হত কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করলে? কি হত নিজেকে অন্যের কাছে একটু ছোট করলে? দুঃখের কথা এই যে, অন্যজন তার বা তাদের জীবদ্দশায় আমাদের এই সহজ কান্না দেখে যেতে পারে না। মরবার সময়ও বুক ভরা ব্যথা নিয়ে মরতে হয়।"
"সমাজটা যেন একটা চাইনীজ চেকারের ছক। যার যার স্থান, যার যার রঙ সব ঠিক করে দেওয়া আছে। ছকে ছকে পা ফেলে ফেলে এক ছক থেকে আর এক ছকে যে রঙে সমাজ রাঙিয়ে দিয়েছে আমাদের সেই রঙের একটা বল হয়ে গিয়ে এগোতে হবে। তাও এগনো বা পিছনোতেও আমাদের নিজেদের কোনোই হাত নেই। সামাজিক পণ্ডিতরা আমাদের এক ছক থেকে উঠিয়ে নিয়ে অন্য ছকে বসাবে তবেই আমরা এগোতে পারব।"
"যে কোনো লোকের জীবনেই সমস্ত কিছু পয়মন্ততা আর অপয়মন্ততার যোগফল শূণ্য।"
"আমার কখন কি করি, কেন করি, তা কি আমরা জানি? জীবনের কোন্ ঘটনা কেমন করে, কখন যে আমাদের মনের গোপন তারে কিভাবে নাড়া দিয়ে যায়, তা সবসময় আমরা নিজেরাই কি জানতে পাই?"
"জীবনের কোনো সম্পর্কই চিরদিনের নয়। সব সম্পর্কই বাঁচিয়ে রাখতে হলে, ফুলের গাছের মতো তাতে জল দিতে হয়, যত্ন করতে হয়।"
"রাতের কোনো তারাই কি দিনের আলোর গভীরে থাকে? থাকেও যদি, তাহলে আমার লাভ কি যদি নাই-ই দেখতে পেলাম? নাই-ই চিনতে পেলাম? তাহলে থাকল কি না থাকল তাতে আমার কি আসে যায়?"
"কাজ আছে বলেই হয়ত আমার মত অনেক হতভাগ্য পুরুষ বাইরের জগতের কৃতিত্বের মেডেল বুকে ঝুলিয়ে, হাহাকার তোলা আন্তর্জগতে সস্তা জাদুকরের মতো এখনও বেঁচে আছে, বেঁচে থাকে, এই নির্দয় সহানুভূতিহীন পৃথিবীতে। যেদিন আমার কাজ থাকবে না, সেদিন আমাদের বাঁচাও আর হবে না। আমাদের মতো লোকের বাঁচার সেদিন কোনো মানে থাকবে না।"
"সব উষ্ণতাই একদিন নিভে যায়। সমস্ত উষ্ণতার স্বাদ উষ্ণতার সাধ, সব নিঃশেষে নিয়মিত এই আমোঘ পরিণতির দিকে গড়িয়ে যায়ই যায়।"
"আমার এতদিন মনে হয়েছিল এমন পুরুষও থাকে, আছে, যার কোনো নারীর হাতের উষ্ণতার জন্য কাঙালপনা না করলেও চলে। আজ নিশ্চিতভাবে জানলাম, আমি যা ভাবতাম, তা ঠিক নয়। কোনো পুরুষই বোধহয় কোনো ভালোবাসার নারীর সঙ্গ ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। সে সব পুরুষ, মানুষ হিসেবে কখনই সম্পূর্ণ নয়।"
"যার সম্বন্ধে মনে মনে একটা ধারণা গড়ে উঠেছে সে ধারণা নিজে থেকে না ভাঙলে অন্য কেউ এমন করে ভাঙতে পারে না।"
"বিয়ের এই সম্পর্কটা ত কোনো তেজারতি কারবারের মুচলেকা নয় যে যা কবুল করেছি, তা না দিতে পারলেই জেল হবে। আইন আদালতে যাবার অনেক আগেই এ সম্পর্কের ফয়সালা হয়ে যায়। দুজনের মনে সে মুহূর্তে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, সেই মুহূর্তেই সেই সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। তারপর যা বাকি ছিল, তা শুধু নিজেদের নিজেরা ঠকানো। অভিনয়, সংস্কার, লোকভয়, এসব ভেঙে বেরিয়ে আসার সাহসের অভাব।"
"জীবনে এমন অনেক থাকা থাকে যা থাকাকালীন তাদের অস্তিত্ব বা দাম আমরা বুঝতে পারি না। হয়তো কেউই পারে না। যখন তা আর আমাদের থাকে না, তখনই টুকরো টুকরো কথা, বাসি ফুলের গন্ধের মতো চাপা স্মৃতি ফিরে ফিরে মনে আসে।"
"স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে, যা কখনও ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলা যায় না। সেই সম্পর্কটা যখন হঠাৎ শেষ হয়ে যায়, তখন অত্যন্ত নির্দয় মানুষের মনও দারুণভাবে দ্রবীভূত হয়ে পড়ে। অথচ সম্পর্ক যখন শেষ হয় নিজেদের ইচ্ছায়, তখন তা নিয়ে কিছুমাত্র খেদ থাকার কথা নয় কারো মনেই, অথচ আশ্চর্য। তবুও খেদ থাকে। বড় খেদ থাকে।"
"নীরবতাও একরকমের জবাব। প্রত্যেক নীরবতার মধ্যেই অনেক সশব্দ সাহসী উত্তর চাপা থাকে।"
"সময় কেউ কাউকে দিতে পারে না। সময়ও হচ্ছে জলের মতো। সময়কে নিজে হাতে শূন্য না করলে জলের মতই সময় চতুর্দিকে গড়িয়ে যায়। সময় কারো জন্যেই বসে থাকে না।"
"সকল মানুষই জীবনে এমন কোনো-না-কোনো মুহূর্তের সম্মুখীন হয় যখন তার কিছুতেই আর কিছু মাত্র যায় আসে না।"
প্রথমেই বলে রাখি যে এই ধরনের উপন্যাস এর কোনো পাঠ প্রতিক্রিয়া হয় না, কিছু কিছু উপন্যাস থাকে যা একান্ত অনুভবের বিষয়, যারা অনুভব করতে পারে এমন লেখনী তারা তা প্রকাশ করতে পারে কম, অত্যন্ত আমার ক্ষেত্রে এমনি।আমি শুধু আমার অনুভব গুলো তুলে ধরবো এখানে, বাকি পাঠকরা নিজেরা উপন্যাস টি পড়ে উপলব্ধি করবে। 🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁
বুদ্ধদেব গুহ যে একজন প্রকৃতি প্রেমী তা এই উপন্যাসে সহজেই দেখতে পাওয়া যায়, তার প্রতিটি পারিপার্শ্বিক পরিবেশের বর্ননা এতোটাই নিপুণ যে পাঠক তা পড়তে পড়তে সহজেই সেই পরিবেশে নিজেকে কল্পনা করতে পারবে । উপন্যাসের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি লিখেছেন "এ জায়গাটায় সকাল হয় না, সকাল আসে। অনেক শিশির ঝরানো ঘাসে ভেজা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে অনেক শঙ্খিনী নদী পেরিয়ে সোনা- গলানো পোশাক পরে সকাল আসে এখানে।" এমন অভিব্যাক্তি শুধু নিবিড় অনুভব থেকেই আসে আমার বিশ্বাস। 🍂🌿☘️🍂🌿☘️🍂🌿☘️🍂🌿☘️🍂🌿☘️🍂
ঝাড়খণ্ডের ম্যাকলাস্কিগঞ্জ নামক জায়গায় এই গল্পের বুনন, জায়গাটা যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তা স্পষ্ট হয় লেখকের অভিব্যাক্তি তে, আর তাই এখানে নিজের সাস্থ্য পুনরায় ভালো করতে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সুকুমার বোস এসেছেন, ওকালতি পেশা আর নিজের লেখক সত্তাকে এতোটাই ভালোবেসেছেন যে তার অজান্তেই দূরত্ব বেড়েছে তার স্ত্রী রমা ও পুত্র রুনের সঙ্গে, আর যখন সেটা বুঝতে পেরেছেন তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে, ইতিমধ্যে তার জীবনের শুন্যতার মধ্যে আগমন ঘটেছে তার এক পাঠিকার "ছুটি", যে তার লেখার প্রেমে পরে তাকে ভালবেসেছে। উপন্যাসের শেষ মুহূর্তে সুকুমার বোসের পরিণতি বেদনার কিন্তু তার থেকেও এই গল্পের এমন এক চরিত্র আছে যে হটাৎ করেই কেন্দ্রীয় চরিত্রকে ক্ষনিকের জন্য ছায়ায় রেখে দেই, আর সে হলেন স্টেশন মাস্টার শৈলেন। এখানে এই চরিত্রের বিন্যাস স্বল্প হলেও প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আকস্মিক তার মৃত্যু যে কোনো পাঠকের মনে দুঃখের একটা আবরণ তৈরি করবে তা বলাই যায় তেমনি নয়নতারার পরিণতি।
সর্বপরি এই উপন্যাসের যেমন গভীরতা আছে, তেমনি আছে এর প্রতেকটি চরিত্রের সুনিপুন বুনন, লেখক প্রতিটি চরিত্র কে খুব সুন্দর ভাবে নিজের কলমে একেছেন। আশা করি উপন্যাসটি সবার ভালো লাগবে পরে।😊 🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂 "No matter where I roam May be on land, on sea or on foam. You will always hear me singing that song Show me the way to go home...." 🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿
বইটার নামকরণে উষ্ণতা কেন ব্যবহার করা হলো তার কারণ খুঁজতে বেগ পেতে হয়েছে আমাকে।
তবে বইটা পড়ার কিছুদূর যেতে না যেতেই বুঝতে পারি। এই উষ্ণতা মানে প্রিয়জনের ভালোবাসার স্পর্শ! এই স্পর্শ শুধু অনুভব করতে হয় মন দিয়ে, চোখ দিয়ে,অনুভূতি দিয়ে। এরসাথে ইহজাগতিক কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকটা হিম শীতল রাত, বাইরে তুষারপাত হচ্ছে,ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালতে হবে, কিন্তু ঘরে শুকনো কাঠ নেই, এমন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে প্রিয় মানুষের একজোড়া উষ্ণতার হাত........ এই যে সেই উষ্ণতা! একটু উষ্ণতা!
এই উষ্ণতা আমাদের প্রতিদিনের বিষন্নতা কাটিয়ে ভালোবাসার পরশ মাখানোর উষ্ণতা। এটা এমন এক উষ্ণতা যার জন্য এই পৃথিবীর প্রতিটি মানব মানবী তৃষিত, তৃষান্বিত, তৃষাতুর থাকে।এই উষ্ণতাকেই বোধহয় ভালোবাসা বলে ?
বইটা পড়ে প্রথমেই আমার যেই কথাটা মাথায় এসেছে তা হলো ভালোবাসা কী? ভালোবাসার সঠিক সংজ্ঞা কী? যশ, নাম,খ্যাতি,সমৃদ্ধি, প্রতিপত্তি, সুন্দরী সহধর্মিনী,ফুটফুটে সন্তান এসবের মধ্যে কী ভালেবাসা নিহিত? যদি তা—ই হয় তবে সুকুমার বোস কেন একজন সামান্য পাঠিকার মধ্যে উষ্ণতা খোঁজে, কেন নিজের বিষন্নতায় হাতছানি দিয়ে ডাকে প্রিয় পাঠিকাকে?
ভালোবাসা যদি এসবেই থাকে তাহলে শৈলেস কেন ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে, আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? কেন নিজের চিরপরিচিত জগৎ, পরিবার, নিজের ছেলেমানুষী,রাজত্ব ছেড়ে অজানা, অচেনা, অনিশ্চয়তার জগতে পাড়ি দেয়?মানুষের বেঁচে থাকা কেন আমাদের মধ্যে উষ্ণতা জাগায় না? মৃত মানুষের অভাব কেন আমরা অনুভব করি?
নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক চিরকালীন অথচ চিরজটিল একটি বিষয়। সেই বিষয়কে যাঁরা বহুকোণ হীরকের মতো নানা দিক থেকে বিশ্লেষণের তীব্র আলো ফেলে দেখতে ভালবাসেন, শক্তিমান কথাশিল্পী বুদ্ধদেব গুহ তাঁদেরই একজন। প্রকৃতি যেমন তাঁর লেখায় প্রবল এক পটভূমি, প্রেমও তেমনই প্রধান এবং জোরালো এক অবলম্বন। এই প্রেম কখনও শরীরী, কখনও শরীরের ঊর্ধ্বে এক স্বর্গীয় অথচ জীবন্ত অনুভূতি। আধুনিক মানুষের প্রেমের সমস্যা আরও অনেক সামাজিক সমস্যার মতোই যে ক্রমশ সূক্ষ্ম ও বহুধাখণ্ডিত হয়ে উঠেছে বুদ্ধদেব গুহ তা জানেন। জানেন বলেই প্রেমের এত বিচিত্র, গভীর ও বহুবর্ণ রূপ ফুটে ওঠে তাঁর রচনায় ।
তাঁর এই নতুন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আধুনিক এক লেখক, যার মানসিক সত্তা খুঁজে বেড়াত সর্ব-অর্থে এক নারীকে, এক প্রকৃত ও সম্পূর্ণ মেয়েকে। ভালবেসে বিয়ে করা স্ত্রী ক্রমশ সরে গিয়েছিল দূরে, তার সমস্ত অস্তিত্বকে পৌঁছে দিয়েছিল অনস্তিত্বে। এমন সময় জীবনে এল ছুটি। এক অনুরাগিণী পাঠিকা। ধু-ধু তৃষ্ণাতুর জীবনে ছায়া ঘেরা ওয়েসিসের মতো স্নিগ্ধ ভালবাসার নিমন্ত্রণ হয়ে, হিম-হয়ে-যাওয়া হৃদয়ে তাপ সঞ্চারিত করার প্রতিশ্রুতি হয়ে। কিন্তু সত্যি পারল কি ? শেষ পর্যন্ত কি সত্যি সুখী হতে পারল সুকুমার ? জীবন কি সরল এক অঙ্ক ? না তা নয়। এই তীব্র গভীর আশ্চর্য প্রেমের উপন্যাসে জীবনের এক বড়ো সত্যকেই শেষাবধি আবিষ্কার করেছেন বুদ্ধদেব গুহ।
উপন্য়াস - একটু উষ্ণতার জন্য লেখক - বুদ্ধদেব বসুুু পৃষ্ঠা সংখ্য়া - 321 মান - 8.8/10 আলোচনায় - রাহুল মন্তব্যঃ - প্রকৃতি, প্রেম, মানবজীবন, সম্পর্কের টানাপোড়েন - এসব নিয়েই এক সুখপাঠ্য উপন্যাস।
বুদ্ধদেব বসুর লেখা প্রথম পড়লাম। শুরুটাই করলাম একটু উষ্ণতার জন্য উপন্যাস দিয়ে। উপন্য়াসটা শেষ করেছি তিনদিনে। একটা টান অনুভব করেছি পড়ার সময়। আমি ভাবতাম গোয়ান্দা কাহিনী বা রহস্য ছাড়া বোধহয় একটানা পাঠককে ধরে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তা আমি ভুল ভাবতাম, সেরকম সেরকম লেখা হলে যে কোনও লেখাই পাঠককে বেঁধে রাখতে পারে।
বুদ্ধদেব বসুর লেখার ভাষা ও শব্দচয়ন অত্যন্ত মার্জিত। ভাষার যে সাবলীল গতি তা বিন্দুমাত্র রুদ্ধ হয়নি। এ ঠিক যেন সমতলে প্রবাহমান কোনও নদীর মতো। ওনার শালীনতাজ্ঞান আমাকে মুগ্ধ করেছে। শরীরের বর্ণনা দেওয়ার সময়ও কোথায় শালীনতা লঙ্খিত হয়নি। আর যা মুগ্ধ করেছে তা প্রকৃতির বর্ণনা। প্রকৃতির বর্ণনার সময় উনি কোনও কার্পন্য করেননি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় যে প্রকৃতিকে মায়ের মতো দেখেছি তা বুদ্ধদেববাবুর লেখায় যেন প্রেয়সীর মতো হয়ে উঠেছে। একটা জায়গায় লিখছেন - এখানে সকাল হয়না, এখানে সকাল আসে। এই একটি বাক্যেই যেন কত ভালোলাগে জড়িয়ে আছে। পাখিদের কোলাহলের মধ্যেও যে জঙ্গলের নিঃস্তবদ্ধতা ক্ষুণ্ণ হয়না , তা উনিই দেখালেন। সত্যিই প্রকৃতিক রূপ দেখতে জানতে হয়। আমরাও প্রতি নিয়ত কত কিই না দেখি, কিন্ত দেখার মতো দেখতে আর কজন পারি। উনি দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন আমাদের। ঝাড়খণ্ডের এই ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রকৃতিকে এক অনন্য রূপ দিয়েছেন। তাই সমস্ত চরিত্রের মধ্যেও প্রকৃতিও একটি জীবন্ত পৃথক চরিত্র রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।
আর আছে উপন্যাসের গল্প। গল্পটা এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় - একটি বিবাহিত পুরুষের পরকীয়ার গল্প। কিন্ত এই এক কথায় এটাকে যতটা সস্তায় বলা চলে ততটা সস্তার বিষয় এটা নয়। এ উপন্য়াস সম্পর্কের টানা পোড়েনের গল্প। ভালোবাসার গল্প। চিরন্তন গল্প। প্রতিটা মানুষের গল্প। আমার যারা ভালোবেসে ভালো থাকতে চাই, তার কতজনই বা প্রকৃত ভাবে ভালো থাকি তা কিন্তু ভাবার বিষয়। এই যে এতো মানুষ বিবাহ করে দিব্য সংসার করছেন তারা কি সবাই ভালো আছেন কিংবা তারা কি প্রকৃত সুখী । আর যদি সুখী নাই হন, তাহলে তারা আছেন কেন। এই সব প্রশ্ন এর নানান উত্তর এই সব নিয়েই এই উপন্যাস। এখানে কখনো মনে হয়ছে লেখক দ্বিচারিতা করছেন। মনে হয়েছে লেখক পরকীয়ার পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে চেয়েছেন। কখনো আবার সেই ঠিক ভুলের সংজ্ঞা বিচারে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। অনেক লেখক থাকে শুধুমাত্র নিজের বক্তব্য বলেই ক্ষান্ত হন, কিন্ত আমার মনে হয়েছে এখানে লেখক পাঠককে ভাবতে বাধ্য করবে, যে আপনি কি ভাবছেন। এখানেই তো লেখকের মুন্সিয়ানা।
গল্পের নায়ক সুকুমার বোস, তিনি একাধারে নবীন লেখক, যারা বেশ নাম যশের প্রতি মোহ আছে, আবার তিনিই হচ্ছেন দুঁদে ব্যারিষ্টার। আমাদেরও এক একটা সময় এক এক বিষয়ের ওপর নেশা হয়। সময় বলতে বয়সের কথা বলছি। একটা বয়স এমন আসে যেখানে মনে হয় প্রেমটাই সব। আবার কিছুটা বয়েস বাড়লে মনে হয় অর্থটাই সব। আরও একটু বয়স হলে মনে হয়, মানসম্মনা খ্যাতিটাই সব, তারপর একটা সময়ে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে এসবের ভিড়ে সে একটু শান্তি চায়। কিন্ত এরই মধ্যে তার ভালোবাসার মানুষটাকে যে সে কবেই হারিয়ে ফেলেছে বুঝে উঠতে পারেন, যখন বুুঝতে পারে তখন তার অনেক দেরী হয়ে গেছে। এই হলো মানুষের চরিত্র। কিন্ত একটা সাধারণ মানুষ সেখান থেকেও ফিরে যেতে পারে। কিন্ত যিনি নিজেকে বিশেষ বলে ভাবেন তিনি আর ফিরতে পারনেনা। তাই সামান্য মানুষ যারা, তাদের মধ্যে এই মানিয়ে নেওয়া গুণটা থাকে বলে সমাজে আজও ভালোবাসা বেঁচে আছে। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্য়াটা কম। এই উপন্যাস আমাদের দেখিয়ে দেয় মানুষের জীবনে ব্যালেন্সের কতটা দরকার। সুকুমার বোস এই ব্য়ালন্সটা ন করতে পেরেই হেলায় হারালেন তার স্ত্রীকে। তার স্ত্রী রমাদেবীর অন্তরে কতটা শুন্যতা তা বোঝা যায় যখন তিনি হিংসা করেন সুকুমারের পাঠিকাদের। এরই মধ্যে সুকুমারের একনিষ্ঠ পাঠিকা সুকুমারের প্রেমে পড়। সুকুমারও রমাদেবীকে ফেরানোর চেষ্টায় ব্যার্থ হয় একাকীত্বের উষ্ণতায় যখন কাতর তখনই সেই পাঠিকা শীতল স্পর্শ বাড়িয়ে দেয় লেখকের দিকে। তিনি সমাজের কথা ভেবে উপেক্ষা করেন কিন্ত একান্ত ভাবে অস্বীকারও করতে পারনেনা। সমাজিক ভাবে যাকে স্ত্রীর সম্মান দিয়েছেন তার প্রতি তার দায়বদ্ধতাও চোখে পড়ে, কিন্ত পাঠিকা ছুটির প্রতিও তার ভালোবাসা যে কতটা নিখাদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই যে দ্বিচারিতা তা কিন্ত অত্য়ন্ত রূঢ সত্য। সারাটা জীবন একজনকেই ভালোবেসে কাটিয়ে দেওয়া যায় কি যায়না তা আমি জানিনা, কিন্তু লেখক বোধহয় দুজনকেই ভালো বেসেছিলেন। ভালোবাসা একবার আসে এ কথা লেখক মানেন না। আমাদের জীবনেও তাই, ভালোবাসা বহুবার আসে। প্রতিদিন আসে প্রতি মুহুর্তে আসে, তাকে গ্রহণ করতে জানতে হয়। তিনি কিন্ত একই কালে দুজনকে ভালোবােসননি এ। তাই লেখকের এই দ্বিচারিতাকে আমি কাঠগড়ায় তুলতে রাজি নই। কিন্ত লেখক এখানে সুকুমার বোসের যে ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন তাতে তাকে অত্যন্ত দূর্বল অসহায় লেগেছে। জানিনা এই দূর্বলতা পাঠককূল কিভাবে নেবে, তবে ব্য়াক্তিগত ভাবে আমার ভালো লেগেছে। পুরুষ মানেই সে পেশী-ওয়ালা কঠোর মনের হতে হবে এ আমি মানি না। পুরুষেরও মন থাকে, ভিতর থেকে সেও একজন নরম মনের মানুষ হতেই পারে। তবে সমাজ বোধহয় ক্ষমাশীল নীরব পুরুষকে কাপুরুষের চোখেই দেখে। দামাল না হলে পুরুষ হওয়া যায়না এ শিক্ষাতেই আমাদের সমাজ শিক্ষিত হয়। তাই কারও চোখে সুকুমার বোস কাপুরুষ হলেও হতে পারে, কিন্ত আমার চোখে না। আর যে চরিত্রগুলো এসেছে তারা তাদের মতো করো অপূর্ব। রমাদেবী অর্থাৎ লেখকের স্ত্রীর চরিত্রটিও আশ্চর্য রকমের বর্ণে সেজে উঠেছে। কখনও সেখানে রোদ, কখনো মেঘ কখনও ছায়া। কখনও স্বামীকে অপমান করে নিজেকে জেতানোর ইচ্ছা, কখনও আবার স্বামীর কাছে ফিরতে চেয়ে আকুতি। তবে তার এই স্পষ্টবাকসত্তা আমাকে মোহিত করেছে। যা মনে হয়েছে বলেছে। কোনও রকম ভণিতা ছাড়াই। আর সব থেকে প্রিয় চরিত্রে ছিলো ছুটি। লেখকের লেখার একনিষ্ঠ পাঠিকা। তার লেখা চিঠি গুলো আরো প্রিয় । এতো সহজে এ কথাগুলো বলা যায় বলে আমার মনে হয়না। উপন্যাস বলেই সম্ভব। ছুটির চরিত্র নিয়ে আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। ছুটি যেন ভীষণই একান্ত একজন।
এসবের বাইরেও কিছু ছোটো গল্প আছে উপন্য়াসে যা বলার মাধ্যেমে আমাদের সমাজিক বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে। শৈলেন নয়নতারার অপূর্ণ প্রেম, লাবু ও নুড়ানীর মধ্যে পূর্ণতা প্রাপ্ত প্রেম, বয়েলসের একাকীত্বের যন্ত্রনা, কিংবা প্যাটের একাকীত্বের আনন্দ, এসবই এই উপন্য়াসের অংশবিশেষ।
সবশেষে বলবো পড়ুন, এই উপন্যাসটা পড়ুন, ভালো লাগবে না খারাপ লাগবে তা পরের বিষয়। কিন্ত এটা বলতে পারি এই উপন্যাস পড়া কালীন আপনি নিজেকে বাথরূমের আয়নায় দেখতে পাবেন। আমার ব্যাক্তিগত মতামত গুলো খুব একটা লিখলাম না। কারণ সেটার জন্য ডায়েরীর পাতা আছে, আর এ এক নিছকই আলোচনা মাত্র। তবে হ্যাঁ অনেক উপলব্ধি হয়েছে। প্রেম ভালোবাসা শরীর মন এই সমস্ত শব্দগুলোর ওপর একটা ধারণা তৈরী হচ্ছে। নিজস্ব ভাবনাদের শব্দে প্রকাশ করার মতো জায়গায় আসছি সেটা বুঝতে পারছি। পড়তে ভালো লাগছে এই ধরণের উপন্যাস।