কিংবদন্তী কী? কিংবদন্তী হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে বহুকাল ধরে চলে আসছে এমন সব গল্প বা জনশ্রুতি। কিন্তু, কিংবদন্তী কি কেবলমাত্র গল্প বা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত জনশ্রুতি? এক্ষেত্রে একটা প্রশ্নবোধক থেকেই যায়... কারণ অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাসের উৎস হিসাবে রসদ যোগায় এই কিংবদন্তী। আবার একে অবহিত করা যায় প্রাচীন সমাজের সম্পদ বলেও। তবে কিংবদন্তীকে পুরোপুরি ইতিহাসও বলা চলে না। সত্য ও কল্পনা—এ দুইয়ের মিশ্রণে সৃষ্টি হয় কিংবদন্তীর।
আচ্ছা কখনো কি মনে হয় আপনি ঠিক এই মুহূর্তে যে জায়গাটিতে থাকছেন, যে পথ দিয়ে প্রতিদিন যাতায়ত করেন সেই জায়গাটি কিন্তু কোটি কোটি বছর পুরাতন? আজ যেমন জায়গাটি আছে দুই কোটি বছর আগেও ছিল।
কিন্তু আমরা আমাদের আবাসস্থলের মাটি কিংবা পরিবেশ সম্পর্কে অত পুরাতন তথ্য সঠিকভাবে জানতে পারি না তবে সামান্য আগ্রহ যদি থাকে তাহলে আজ থেকে মাত্র ২০০/৩০০ বছর পূর্বে আমাদের অবস্থানরত এই জায়গাটায় কি ছিল সেটা কিন্তু সহজেই জানতে পারি।
আর কয়েক শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া ইতিহাস জানা আরও আনন্দদায়ক আর মজার হয়ে ওঠে যখন সেটা আমরা জানি কিংবদন্তীর মাধ্যমে। এখন কিংবদন্তী ব্যাপারটা কি?
কিংবদন্তী (ল্যাটিন, legenda, "things to be read") সহজ করে বলতে গেলে কোন একটি নিদির্ষ্ট অঞ্চলে অতীতকালে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা মৌখিক বর্ণণা । সংক্ষেপে প্রচলিত গল্প। তবে গল্পটি তখন কিংবদন্তী হবে তখন সেটিতে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে।
আচ্ছা আপনারা যারা ঢাকা থাকেন কখনো জানতে ইচ্ছে হয়েছে এই যে কাকরাইল নামের জায়গাটা এমন একটা উদ্ভট নাম এলো কি করে? এই একটা আমি বই থেকে বলে দেই।
উনিশ শতকের শেষ দশকে ঢাকার কমিশনার ছিল মি. ককরেল নামের এক ইংরেজ। সেই সময় ইংরেজ বড় কর্মকর্তাদের নাম অনুসারের রাস্তার নামকরণ করা হত। যেমন ছিল "জনসন রোড" কিংবা "ইংলিশ রোড"। মি. ককরেলের নামেও একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়। যা কালের বিবর্তনে এখন কাকরাইল।
এলিফ্যান্ট রোড, সূত্রাপুর, পিলখানা কিংবা টিকাটুলি এই যে বাহারি নামের পসরা বুকে নিয়ে ঢাকা বেঁচে আছে এগুলো এলো কোথা থেকে? আচ্ছা ঢাকাই বা ঢাকা এলো কোথা থেকে? কখনো কি মনে এসেছে প্রশ্নগুলো। এই নামগুলোর পিছনে আছে ইতিহাস, আছে গল্প। যে গল্পগুলোকে লেখক খুব যত্ন আর সুন্দর করে উপস্থাপন করেছে বাংলা কিংবদন্তী নামের এই বইটিতে।
তবে শুধু ঢাকা নয় বইটিতে আছে সারাদেশ ব্যাপী কিংবদন্তীর গল্প। সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, দিনাজপুর, বান্দরবন, টেকনাফসহ সারা বাংলাদেশ থেকে মুক্তর দানার মত ইতিহাসের বুকে জমা গল্পগুলো সংগ্রহ করেছে লেখক আর গেঁথেছে একটা দামী হার, “বাংলা কিংবদন্তী”।
অনুজ জুয়েল যখন প্রথম যখন ওর এই প্রেক্ষাপট নিয়ে বই প্রকাশ করবে বলে পোষ্ট দেয় আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। মনে মনে বললাম যাক পরিচিত একজন হলেও আমার পছন্দের বিষয় নিয়ে লিখছে। স্বাভাবিকভাবেই বইটি আমার সংগ্রহের এক নাম্বার চলে আসে।
যেহেতু বইটি জুয়েলের এটি প্রাথমিক কাজ আমি একটু আশংকিত ছিলাম হয়তো বইটি ততটা প্রত্যাশাকে পূরণ করতে পারবেনা। কিন্তু নিজেকে ভুল প্রমাণিত হতে দেখে ভাল লাগছে। প্রচণ্ড মুন্সীয়ানা দেখিয়েছে লেখক। আমি মুগ্ধ। প্রতিটা পরিচ্ছদে সংক্ষিপ্ত রাখার পরেও গল্পের স্বাদ নষ্ট হয়নি। শুধু তথ্যের ভিড়ে বই পড়ার মজা একটুও নষ্ট হয়নি। মাত্র ৯২ পৃষ্ঠার বইটি যেন কিংবদন্তী ইতিহাসে পুরো বাংলাদেশ।
আর শেষের তথ্যসূত্রগুলোর সংযুক্তি ছিল বাড়তি পাওয়া।
লেজেন্ড যাকে কি না বাংলায় বলে কিংবদন্তী হলো লোকমুখে চলে আসা বিভিন্নধরনের জনশ্রুতি। একটু খুঁজেপেতে দেখলে আপনি যে জায়গায় আছেন তাকে কেন্দ্র করেও নানা গল্প জানতে পারবেন। এই ধরুন না ঢাকা শহরের নামকরণের কথা। "তখন বাংলায় সেন শাসন চলছে। রাজা বল্লাল সেন স্বপ্নে দেখলেন গহীন জঙ্গলে ঢাকা এক দেবীমূর্তি। স্বপ্নে দিকনির্দেশ পেয়ে সেই মূর্তি উদ্ধার করলেন অরণ্য থেকে। মন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন দেবীকে। মূর্তিটি জঙ্গলে ঢাকা ছিল, তাই মন্দিরের নাম হলো ঢাকেশ্বরী বা ঢাকার ঈশ্বরী। সেই অঞ্চলের নামও হয়ে গেল ঢাকা।" কি মজার গল্প না?
কিংবদন্তী কম- বেশি আমরা সবাই-ই ভালোবাসি। সত্য ও কল্পনার মিশ্রণে সৃষ্ট এই গল্পগুলো যুক্তি দিয়ে বিচার করার কোনো স্বার্থকতা নেই। জানা- অজানা মোট পঁচিশটি কিংবদন্তীর সংকলন এই বইটি। এইখানে যেমন আছে অতি পরিচিত বেহুলা- লখিন্দর, রামসাগর দিঘী, গানস অব বরিশালের কথা তেমনি স্থান পেয়েছে ভাওয়ালগড়ের সন্ন্যাসী রাজার অদ্ভুত গল্প ( এক যে ছিল রাজা ছবিটা কিন্তু এই কিংবদন্তীকেই কেন্দ্র করে), রানী রাসমনির শেষ পরিণতি এবং কবি চন্দ্রাবতীর প্রেমকথা ( এইটা আমাকে বেশি নাড়া দিয়েছে)। প্রথম বই হিসেবে লেখক চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি কিন্তু বাঁধ সাধলো ঐ যে সাবলীলতা। লেখার ভাষা মাঝে মাঝেই খুব আড়ষ্ট আর এলোমেলো মনে হয়েছে। আরেকটু প্রাঞ্জল হলে অনায়াসে ৪ তারা দিয়ে দেওয়া যেতো।
কিংবদন্তী হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে বহুকাল ধরে চলে আসছে এমন সব গল্প বা জনশ্রুতি। বইটিতে উঠে এসেছে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২৫ টি কিংবদন্তী। কিংবদন্তীর সাথে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন প্রাচীন নির্দেশনা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য। পাঠকদের মনে একটা ধারনা সৃষ্টির জন্যে প্রতিটি গল্পের শুরুতে ছবি দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ পেয়েছে ঢাকার বিভিন্ন স্থানের নামকরণের পিছনের কাহিনী। আপনার অনেক ধারনা ভুল প্রমানিত হবে বইটি পড়ার পর। বইটি পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্য সংকলক অনেক বই,দলিল,স্থান নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হয়েছে সেটা বইটা পড়লেই বুঝা যায়। আরেকটি ব্যাপার প্রশংসনীয়, সেটা হলো বইটিতে বানান ভুল বা প্রিন্টিং মিস্টেক চোখে পড়ে নি। তাই প্রকাশনীকে ধন্যবাদ। বইটি পড়ুন অন্ততপক্ষে ছড়িয়ে ছিটেয়ে থাকা কিংবদন্তী সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন।
ছোট একটা বই, কিন্তু বেশ তথ্যবহুল। বাংলাদেশের কোন জায়গার নামকরণ কী করে হলো, সেসব জায়গার পেছনের ইতিহাস কী- সবকিছুই বেশ সুন্দর করে বর্ণনা করা হয়েছে এখানে। ঠিক গল্পচ্ছলে লেখা হয়নি দেখে কেউ গল্প পড়ে শোনাচ্ছে- তেমন মনে হবে না, তবে পড়তে খারাপও লাগবে না।
তখন বাংলায় সেন শাসন চলছে। রাজা বল্লাল সেন স্বপ্নে দেখলেন গহীন জঙ্গলে ঢাকা এক দেবীমূর্তি। স্বপ্নে দিকনির্দেশ পেয়ে সেই মূর্তি উদ্ধার করলেন অরণ্য থেকে। মন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন দেবীকে।
মূর্তিটি জঙ্গলে ঢাকা ছিল, তাই মন্দিরের নাম হলো ঢাকেশ্বরী বা ঢাকার ঈশ্বরী। সেই অঞ্চলের নামও হয়ে গেল ঢাকা।
আরেকটি গল্প বলি।
পর্বতঘেরা এলাকায় আরব দেশ থেকে ইসলাম প্রচারে এলেন সাধক হজরত বদর শাহ আউলিয়া। সেখানে বন-জঙ্গলে জ্বী��-পরীর বাসস্থান, ভয়ে মানুষ থাকে না। পাহাড় চূড়ায় মাটির চাটি (প্রদীপ) জ্বালালেন বদর শাহ। অলৌকিক প্রদীপের আলো ছড়িয়ে পড়লো দিকে দিকে। পুড়ে গেলো পরীদের ডানা, পালিয়ে গেলো সব জ্বীন। আলৌকিক রশ্মি ঘিরে জনপদ গড়ে উঠলো।
বদর শাহ পীরের প্রদীপ বা চাটি ঘিরে গড়ে ওঠা অঞ্চলের নাম হয়ে গেলো 'চাটিগ্রাম' বা চট্টগ্রাম।
যে ঢাকা শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ান তার নামগুলোরও কিন্তু অনেক গল্প বলার আছে। ঢাকা শহরে ইংরেজরা যেখানে বন্য হাতি পোষ মানানোর জন্য রাখতো সে জায়গাকে পিলখানা বলা হত। ইংরেজ কমিশনার মি. ককরেলের নামে ককরেল রোড, সেই থেকে গোটা এলাকাটাই হয়ে যায় কাকরাইল। ইন্দিরা রোড কিন্তু আবার ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানার্থে নয়, এই এলাকার বিত্তশালী ব্যক্তি দ্বিজদাস বাবুর কন্যা ইন্দিরার নামেই এই নাম।
নানা অঞ্চলের কত গল্প এভাবে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। লোক মুখে মুখে তৈরী হয়ে আসছে কতসব কিংবদন্তী। কখনো তা প্রসিদ্ধ লখিন্দর-বেহুলার গল্প, বা ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া কমল বাওয়ালির উপাখ্যান। সত্য আর কল্পনার মিশেলে গল্পগুলোতে থাকে মানুষের বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার, রাজা বা রাজনীতি।
এইসব গল্প আর জনশ্রুতিকে সারা দেশ থেকে মণিমাণিক্যের কুড়িয়ে দুই মলাটে আবদ্ধ করেছেন আসাদুজ্জামান জুয়েল 'বাংলা কিংবদন্তী' বইটিতে।
পাঠপ্রতিক্রিয়া: লোককথা পড়তে কে না ভালোবাসে। বইটি পড়লে ঠাকুরমার ঝুলি বা ছোটবেলায় ঘুমিয়ে পড়ার সময় শোনা গল্পের একটা স্বাদ পাওয়া যায়। লেখক সংক্ষিপ্ত আকারে মধ্যে অধ্যায়গুলো রাখলেও, গল্পের স্বাদ নষ্ট হয়নি একটুও। পুরো বইয়ে ছিল লেখকের যত্নের ছাপ।
মজার অনেক কিছু লক্ষ্য করা যায় বাংলার কিংবদন্তীগুলো পড়লে। বেশিরভাগ অঞ্চলের লোকশ্রুতিতে রাক্ষস বা জ্বীনের আবির্ভাব, কিন্তু বান্দরবানের উপজাতিদের গল্পে পাওয়া যায় ড্রাগনের খোঁজ! বিভিন্ন এলাকার একটা প্রতিচ্ছবিও ভেসে উঠে। দরবেশ-ব্রাহ্মণ, মাজার-মন্দির মিলেমিশে কতরকম মানুষের দেশ বাংলাদেশ।
ধন্যবাদ লেখককে আমাদের কাছে 'বাংলা কিংবদন্তী' পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
বর্ণনাগুলো কিছুটা সংক্ষিপ্ত মনে হয়েছে। বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন ঘটনার পিছনের কিংবদন্তী আমার কাছে অজানা ছিলো। আমার মত নতুনদের জন্যে শুরু হিসেবে বইটা ভালো, এইজন্যই ব্যাক্তিগত রেটিং ৪ দেয়া।
অনেকদিন পর একটা বাংলাদেশি ঐতিহ্যের পরিচায়ক মিথ সম্পর্কিত একটা বই পড়লাম৷ ছোট্ট একটা বই৷ কিন্তু কন্টেন্ট অনেক সুন্দর৷ প্রথম "রামসাগর ও কমলা রানীর দিঘি" পড়েই মন ভরে যাবে, তারপর একে একে নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা, কোশাকান্দার কিংবদন্তি, কুড়িটিলার কালো পাথর, সুন্দরবনের বাওয়ালি যাদুকর ---- কি নেই! পুরো বাংলাদেশের সবচেয়ে অদ্ভূত ও অজানা সব কিছু এ বই পড়লে জানা যাবে৷ গানস অফ বরিশাল এর এত বিস্মৃত ব্যাখা আমি আগে কোনো বইয়ে দেখিনি৷ ভাওয়াল গড়ের সন্ন্যাসী রাজা পড়ে "এক যে ছিল রাজা" এর কথা মনে পড়ল! আর রানী রাসমনির শ্যামসুন্দর মঠ এর কাহিনি পড়ে গা শিউরে উঠল৷ যদি ওটা সত্যি হয় --- তাহলে আসলেই অনেক অবাক হব! জানতে হবে তার ব্যাপারে৷
লেখক আসাদুজ্জামান জুয়েল কে ধন্যবাদ এত পরিপাটি ও সুনিপুনভাবে বইটা লেখার জন্য৷ কাহিনি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে বর্তমানের উপযোগি করে লিখেছেন। আশা করি, এরকম বই সামনে আরো পাব--- তবে প্রত্যেক বিভাগের আলাদা আলাদা বই সেগুলো হবে ( অবশ্যই মিথ, উপকথা এইসব নিয়ে) আপনাকে। ধন্যবাদ সুনদ্র একটি বই উপহার দেবার জন্য!
জেলায় জেলায় নানান দীঘি-মঠ-মন্দির-ঐতিহাসিক স্থান নিয়ে ছড়িয়ে আছে কত কিংবদন্তী। কোথাও বেড়াতে গেলে এমন স্থানের দেখা পেলে স্বভাবতই মন কৌতুহলী হয়ে উঠে পেছনের ঘটনা জানার জন্য। সেই কৌতুহল অনেকাংশে নিবারিত হয় এই বইটি পড়লে। ছোট ছোট অধ্যায়ে সরল গদ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থানের কিংবদন্তী আলোচিত হয়েছে বইটিতে যা ইতিহাস জানতে সাহায্য করে, করে দেশকে চিনতে। লেখকের প্রথম বই এটি। ভাষা বেশ সাবলীল। সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তাঁর প্রথম বই রচনার ক্ষেত্রে এমন গবেষণাধর্মী একটা বিষয় বেছে নিতে। এতেই আলাদা করে প্রকাশিত হয় তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন এবং মননশীলতা। ভবিষ্যতে আরো বিরাট কলেবরে ভালো কিছু পাওয়ার আশা লেখকের কাছে থাকলো।
Worst thing about this book: It did what has been already done by numerous others, but poorly. বাংলাদেশের কিংবদন্তীর ওপর আরো বই আগে না পড়া থাকলে এই বইটার প্রশংসা করতে পারতাম। বইটা একটা poor execution. কেন? যে স্থানের মিথ, সে স্থান কোন জেলায়, বা কিভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব তার উল্লেখ নেই অধিকাংশ মিথের ক্ষেত্রেই - অথচ পাঠক হিসেবে আমারই জানা ছিল অনেকগুলো স্থানের অবস্থান। কয়েকটা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলো সংশ্লিষ্ট না। দিনাজপুর বড়কুঠির জায়গায় রাজবাটীর ছবি। লেখক নিজে ঘুরে মিথ সংগ্রহ যদি করে থাকেন, এহেন ভুল কিভাবে হতে পারে? চোর চক্রবর্তীর ঢিবির ছবি তোলা যায়নি, তার জন্য বিড়ি-ফুঁকনরত-কার্টুনের ছবি দেওয়ার দরকার ছিল না। ঘুরেফিরে এইসব মিথ উঠে আসে বাংলাদেশ ঘিরে। রাজীব চৌধুরীর 'বঙ্গদেশী মাইথোলজি' বাজারে পাওয়া যায়। পাওয়া যায়না যেটা, শহীদুল ইসলামের 'বাংলাদেশের কিংবদন্তী', ওটা একটা মাস্টারপিস। 'বাংলা কিংবদন্তী'র লেখক (কিংবা সংকলক) আসাদুজ্জামান জুয়েল তথ্যসূত্র ঘেঁটেই লিখুন আর ফিল্ডওয়ার্ক করে, এই ক্ষেত্রটায় নতুন কিছু যোগ করতে পারেননি।
প্রথম লেখা হিসেবে অনেক ভুল চোখে পড়লেও উপভোগ্য ছিল কারন কিংবদন্তী একাই খুব আকর্ষনীয় একটা বিষয় তার উপর বাংলা কিংবদন্তী বলে একটা আলাদা আগ্রহ কাজ করে। তারপরেও কিছু ক্ষোভ থেকে যায় বইয়ের যাচ্ছে তাই বাঁধাই আর প্রুফ রিডিংয়ের ভুল দেখে। পরবর্তী মুদ্রণে ভুলের সংশোধন হবে বলে আশা করি।
সন্ধ্যায় মুড়ি মাখা খেতে খেতে পরার মত বই। মিথগুলো প্রায় অনেকগুলোই বেশ কাছাকাছি/একই ধরনের। সংগ্রহে রেখে দেব।মাঝে মাঝে বের করে পড়ব। বাংলাদেশের আনাচে কানাচের মিথ বলে কথা! প্রচ্ছদ বেশ ভাল লেগেছে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এ দেশ,আমাদের বাংলাদেশ। এ দেশজুড়ে প্রচলিত রয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তী বা উপকথার। লোকমুখে প্রচলিত এসব কিংবদন্তী কতটা সত্যি বা মূল কিংবদন্তী লোকের মুখে মুখে কতটা পরিবর্তিত হয়ে নতুনত্ব লাভ করেছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিংবদন্তীগুলোকে অত্যন্ত যত্নসহকারে দুই মলাটের মধ্যে সহজ সরল ভাষায় তুলে ধরেছেন সংকলক আসাদুজ্জামান জুয়েল। তার এ প্রচেষ্টার জন্য তিনি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বইটা পড়ে অনেককিছু জানতে পারলাম।যেমন—ঢাকার নামকরণ,রানী রাসমনির নৃশংসতা,চট্টগ্রামের দরবেশ বদর শাহের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা কিংবা কমলা রানীর দিঘির মতো হৃদয়স্পর্শী ঘটনা। সব মিলিয়ে, বলতে চাই কিংবদন্তী নিয়ে আগ্রহ থাকলে বইটা বেশ ভালো লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস!
বাংলাদেশের কিংবদন্তী নিয়ে আগে 'কিংবদন্তী কথা কয়' আর 'বংগদেশী মাইথোলজি' পড়া ছিল। তবুও এখন পর্যন্ত প্রকাশিত দুই খন্ডের এই সিরিজটি একসাথে কিনে ফেললাম দেশী মিথলজি নিয়ে আগ্রহের কারণে। পড়া শেষে বলতেই হবে, কেনা বৃথা যায় নাই। লেখক অনেক পরিশ্রম করেছেন সহজেই বোঝা যায়। প্রতিটি কিংবদন্তীর গল্প শেষে সংশ্লিষ্ট ইতিহাসও বর্ণনা করেছেন, সেই সাথে যোগ করেছেন আলোকচিত্র - যাতে পাঠক ইতিহাস এবং কিংবদন্তীকে এক সূত্রে গেঁথে নিতে পারেন। বইটি খুবই উপভোগ্য ছিল, তাই এক বসায় শেষ করে উঠেছি। কলেবর বেশ ছোট, মাত্র ৯২ পৃষ্ঠা, একটু বড় হলে বোধহয় ভালো হত। তবে আনন্দের বিষয়, আজই আবার দ্বিতীয় কিস্তি নিয়ে বসবো, আশা করি সেই বইটাও মনোমুগ্ধকর হবে।
পৃথিবীতে মানুষ এসেছে, সামনেও আসবে। আমরা অতীত হবো। আমাদের স্মৃতি ফিকে হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা যে এখন একটা সমষ্টি, এই সমষ্টিটুকুই একটা জাতির স্মৃতি। সময় বদলায়, বদলায় নথির কাগজ। তারপর আসে কিছু মানুষ ইতিহাসকে ভালোবাসে। তারপর? আসলে ইতিহাস একটা ভালো লাগার জায়গা। ইতিহাসের কানাগলি ঘুরলে জানা যায় নিজের দেশকে, এই জানাটুকুই আসলে লাভ। ইতিহাসের উৎসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অংশ সবসময় সাহিত্য, লোকগাঁথা, ছড়া, কবিতা, বচন। মানুষের কাছে ইতিহাসের সবচেয়ে অবহেলিত অংশও লোকসাহিত্য, কিংবদন্তী। আমরা গ্রীক মিথোলজি পড়ি, রোমান মিথলজি আরো অনেক মিথের সাথে পরিচিত। আস্তে আস্তে পরিচিত হই বিভিন্ন লোককথার সাথে। লোককথার খুবই জনপ্রিয় অংশ রুপকথা। এই রুপকথা লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে একটা সার্বজনীন রুপ লাভ করে। . কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা যেগুলো লোকগাঁথা বা কিংবদন্তী বলে পরিচিতি লাভ করে। এরা রুপকথা হয়ে উঠেনা শুধুমাত্র এদের বাস্তব অস্তিত্ব আছে বলে। প্রায় প্রতিটা গ্রামেই আমরা একটা পুকুর পাই। যে পুকুরে প্রায়ই নাকি সিন্দুক থাকে। একটা পুকুর প্রতিবছরই একটা করে মানুষ নেয়। এই লোকগাঁথা ত একদম কমনই। কিন্তু আমাদের চারপাশের রয়েছে অসংখ্য স্থান। অসংখ্য প্রাচীন নিদর্শন। . প্রাচীন নিদর্শনগুলোর রয়েছে এলাকার মানুষদের পুর্বসূরীদের প্রত্যক্ষ করা গল্প। এই গল্পগুলো বা কথাগুলো মানুষ এমনভাবে বিশ্বাস করে যা আসলে নিজ চোখে দেখা। এমনকি বর্তমানেও এসকল রহস্যময় বিষয়গুলো মানুষ লক্ষ্য করে। তাদের অভিজ্ঞতা হয়। তাই কিংবদন্তীগুলোকে হাস্যকর বা বানোয়াট বললেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। মানুষ রহস্য পছন্দ করে। অসংখ্য রহস্যময়তা একটি নিদর্শনকে আরো আবেদনময়ী করে দিতে পারে। . সুনীলের কাকাবাবুর গল্পগুলো পড়লে খুব সহজে ব্যাপারটা অনুমান করা যেতে পারে। ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহটা বেশি দিনের না। একটা সময় সাহিত্যপাঠের প্রয়োজনে ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ প্রায় সবাইকে দেখাতে হয়। বর্তমান সময়ে পাঠকদের মাঝে ইতিহাস খুবই আগ্রহের বস্তু। প্রথমত ইতিহাসভিত্তিক এত উপন্যাস সৃষ্টি হচ্ছে যে পাঠক আর চোখবুজে বিশ্বাস করতে চায় না। চালাক ত একেই বলে। . যাহোক, জুয়েলদা এইবারের বইমেলায় একটি বই প্রকাশ করে ফেলেছেন। বইটির নাম, "বাঙলা কিংবদন্তী"। তবে পড়ে মনে হয়েছে " বাংলাদেশি কিংবদন্তী"। যাহোক, পুরো বইটিতে বাংলাদেশের পরিচিত নিদর্শনগুলো নিয়ে লোকমুখে প্রচলিত গল্পগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার যে প্রচেষ্টা এটাকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। আমাদের বাংলাদেশে "ফোকলোর" বা "লোকসাহিত্য" বেশ বড় একটা ভাগ জুড়ে আছে। এমনকি মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য, মুসলিম কাব্য, গীতিকা, ছড়া, গান এগুলোর মধ্যে সমাজ, গল্প এগুলোর ঠাই হয়েছে। ইতিহাস তার রসদ জোগানোর একটা বিশাল ক্ষেত্র হিসেবে সবসময় লোকসাহিত্যের ওপর নির্ভর করেছে। এর আগেও বাংলা একাডেমী বাংলাদেশের লোকগল্প, লোককাহিনীগুলোকে প্রকাশ করেছে। সমসাময়িককালে "বঙ্গদেশী মাইথোলজি" বইটা বেশ দৃষ্টি আকর্ষন করেছে অনেকের। বাংলাদেশে ইতিহাসপ্রেমী বাড়তে শুরু করেছে। তার মধ্যে এতক্ষন কেন ইতিহাস ইতিহাস করলাম তার কারন মোটাদাগে স্পষ্ট অনেকের কাছে নাও হতে পারে। তাই আবার বলি, লোককাহিনী থেকে একটা সমাজের পুঙখানুপুঙখ ইতিহাস জানা সম্ভব হয়ত না, কিন্তু ওই সময়ের সমাজের একটা সমষ্টি সম্পর্কে ধারনা করা যায়। মানুষের মুখ থেকে মুখে একেকটা ঘটনা ভিন্ন একটা রুপ লাভ করে। মানুষ একটু রঙ চড়িয়ে গল্পগুলো বলতে চায়। মূলত অন্যের প্রতি নিজ জানার প্রভাবটা চাপিয়ে দিতেই এই প্রচেষ্টা। . এভাবেই আস্তে আস্তে কিংবদন্তীর সৃষ্টি হয়। আমরা আস্তে আস্তে এগুলো জানতে পারি কোনো পরিবারের বৃদ্ধ হতে। এহেন আধুনিক অবস্থাতেও আমরা নিজেদের জানা কিংবদন্তীর গল্প মাঝেমধ্যে বন্ধুমহলে বলার লোভ সামলাতে পারিনা। আবার কোনো প্রাচীন নিদর্শনে ঘুরতে যাওয়ার আগে যদি ওটার সম্পর্কে প্রচলিত কিংবদন্তী জানতে পারি আমাদের আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। যতই বিশ্রী হোক দেখতে, যদি এর সম্পর্কে আবর্তিত ঘটনাটাও জানা যায়, স্থানটার প্রতি অন্যরকম অনুভূতি কাজ করবেই। . এতক্ষন অনেক কথাই বললাম মূল কথাটাই বলা হলোনা। জুয়েলদা মুলত দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বহুল পরিচিত স্থানগুলো সম্পর্কে প্রচলিত কিংবদন্তীগুলোকে লিপিবদ্ধ করেছেন। কাজটা খুব দক্ষভাবেই করেছেন এটুকু বলা যায়। লেখকের বলার ধরন বৈঠকী, আলসে। যেন মুখোমুখি বসে লোককাহিনী শোনাচ্ছেন। পাঠক হয় শুরুর দিকের কয়েকটা অধ্যায় পড়তে শুরু করলে ভাববেন, গল্পগুলো খুব দ্রুতই বলে যাচ্ছেন। আমারো তাই মনে হয়েছে। কিন্তু বৈঠকী আবেশে এত ডিটেইল দিয়ে বলা যায়না। অথবা আরেকটু বড় করে লিখলে পাপ হতোনা। বেহুলা লখীন্দর, কবি চন্দ্রাবতীর প্রেম, মাথিনের কূপ, অতীশ দিপঙ্করের ভিটা, শ্যামসুন্দরের মাঠ, বগালেকের কিংবদন্তী এসবকিছুই আছে বইটিতে। সর্বমোট ২৫ টি সুপরিচিত স্থানের কিংবদন্তীর ঠাই হয়েছে বইটিতে। সবগুলোই যে অলৌকিক বা রঙ চড়ানো গল্প তা কিন্তু না। কোনো কোনো গল্পে সত্যতার সুর ও রয়েছে। প্রতিটি গল্পই একেকটি নিদর্শনের রহস্যময়তা, সৌন্দর্য্য, ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছে। . এবার আসি নিজের কথায়। বহুদিন পর বই পড়ায় ফিরেছি। আয়েশি ভঙ্গীতে এক নতুন ধরনের লেখা পড়ে দারুন লাগছিলো। সবচেয়ে বড় কথা বইটার প্রতি একটা আলাদা ভালোলাগা ছিলো। কিন্তু পাঠক হিসেবে আমি সবসময় নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়। প্রথম ২ টি ও মাঝের ৪ টি কিংবদন্তীর গল্প বর্ননায় লেখক বেশ তাড়াহুড়া করে ফেলেছেন বলে মনে হয়েছে। তবে বর্ননাভঙ্গী বৈঠকী হওয়ায় সেটা খুব বেশি দৃষ্টিতে পরবে বলে মনে হয়না। যাহোক, পুরো বইটা পড়ে পরিচিত এই নিদর্শনগুলো দেখার আগ্রহ আরো বেড়ে যাচ্ছে দ��রুত। হ্যা জানি এগুলো ওই এলাকায় গেলেই অনেকের মুখে গল্প জানা যেতো। কিন্তু কেউ সাগ্রহে এসে ত আর শোনাবে না। আর ঘুরাঘুরি করলে এতকিছু জানাটাও মুশকিল। তাই আগে থেকে জেনে গেলে আগ্রহটা বেশি থাকে। আরেকটি বিষয় হলো, লেখক দিনাজপুরের হওয়ায় দিনাজপুরের কিংবদন্তীগুলোই বেশি এসেছে। আর কথাগুলো এত সুন্দর যে আমারো দিনাজপুরে যেতে ইচ্ছে করছে। ওভার অল প্রথম বইয়ের হিসেবে টপিকটা সুন্দর। একজন পাঠক হুট করে লেখক হলে।প্রত্যাশা থাকে অনেক। সেটা জুয়েলদা দারুনভাবে পূরন করেছে। তবে বইটা আরেকটু বড় করলে খুশি হতাম। এরকম বই আমাদের বেশি বেশি দরকার। এটা হয়ত ক্ষুদ্র কিছু প্রচেষ্টার একটি। ভবিষ্যতে ইতিহাসকে আরো সুন্দরভাবে গুছিয়ে লিখতে শুরু করবে অনেকে। ততদিনে এই লেখাগুলোকে জিইয়ে রাখতে হবে। আশা করি এবার জুয়েলদা নিয়মিত বই প্রকাশ করতে থাকবেন। অপেক্ষায় রইলাম।
৩৬০ আউলিয়ার দেশের কিংবদন্তী গুলোও যে বুজরুকিতে ভরপুর হবে সে আর বলতে!! আউলিয়ারা এই বঙ্গদেশে নাজিল হওয়ার আগে পরে যেহেতু সনাতন ধর্মের বিরাট সংখ্যক রাজা জমিদার ছিল আমাদের শাসন করার অতএব বাকি অর্ধেক কেচ্ছা কাহিনি এসেছে দেব দেবী প্রদত্ত।
কেউ পাথরের উপর দাড়িয়ে সমুদ্র পার হয়ে দেশের পর দেশ ছাপিয়ে এই বাংলায় এসে উপস্থিত আমাদের নসিহত করতে। কেউ আবার একরের পর একর জমি জ্বীন দিয়ে কাটিয়ে দীঘি করে ফেলে আমাদের মুসকিল আসানের জন্য।
আওলিয়ারা এমন কান্ডকারখানা করলে মা কালী পিছিয়ে থাকবে কেন? দেবীদের তরফ থেকেও আসতে থাকে অলৌকিক মোজেজা। কখনো সখনো স্বপ্নদৃশ্যে হাজির হয়ে বিভিন্ন ফর্দের অর্ডার দিচ্ছেন তো কখনো আবার মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করার ফর্মুলা বাতলে দিচ্ছেন।
কিংবদন্তী হয়তো যুক্তির কষ্টিপাথরে মাপা ঠিক হবে না। বছরের পর বছর ধরে গ্রামের সহজ সরল মানুষজন এই গল্পগুলোর ভেতরই সুখ খুঁজে এসেছে। আর ধর্মীয় আবেগে মোড়া এসব কিংবদন্তী যে আরও যুগ যুগ ধরে গ্রাম্য নানি দাদীদের ভরা জ্যোৎস্নায় গল্পের আবদার মেটাতে ভূমিকা রাখবে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে এইসব কে পাশ কাটিয়ে কিছু কিংবদন্তী উঠে এসেছে আমাদের জীবন সংশ্লিষ্ট। যে গুলো পূর্বপুরুষদের বীরত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমাদের গর্বিত করে। দস্যু মহর খাঁ, কমল বাওয়ালি, সন্ন্যাসী রাজা,চন্দ্রাবতীর প্রেম এইসব গুলোই মনকে আনন্দ দেয়।
লেখককে ধন্যবাদ আয়েসি গল্পের ঢংএ সমস্ত দেশ থেকে কিংবদন্তী গুলো বইবন্দী করার জন্য। তবে একটা আফসোসের জায়গা রয়ে গেছে। সেটা হলো বইটি বড্ড ছোট। এমন বই এতো অল্পতে যে মন ভরে না।
এক যে ছিল নাস্তিক পন্ডিত। সে কেমন করে তার বিশ্বাস পরিবর্তন করলেন এরপর আবার বৌদ্ধ শ্রমণের জীবন ধারন করলেন সে এক অদ্ভুত কাহিনি। সময় পেরিয়ে সেই নাকি অতীশ দীপঙ্কর নামে পরিচিত হলেন!
ঈশা খাঁ প্রেমে পড়েছিলেন স্বর্ণময়ীর। তাদের বিবাহের সময় এমন কোন স্বপ্ন দেখেছিলেন ঈশা খাঁ যার জন্য কোশাকান্দির কিংবদন্তীর সৃষ্টি?
ধীরাজ আর মাথিনের সেই করুণ প্রেমগাঁথা জানে না কে? ধীরাজের প্রেমে রাখাইন জমিদার কন্যা মাথিন যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল সে করুন কাহিনি আজও মানুষকে আবেগঘন করে দেয়। ধীরাজ আর মাথিনের প্রেম কথা বয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছে সেই কূপ।
চম্পক নগরীর শিব ভক্ত চাঁদ সওদাগরের কথা অজানা নেই কারো। মনসাকে পূজো দিবেনা বলে একে একে ছয় পুত্রকে হারানোর পরেও দমে যাননি। কালের ক্রমে আর দেবলোকের লীলায় সপ্তম পুত্র হয়ে জন্ম নিলো লখিন্দর আর আরেক বণিকের ঘরে বেহুলা। তারা যে স্বর্গের নর্তকী যুগল। মর্তে তাদের লক্ষ্য মনসাকে দেবীর সম্মান পাইয়ে দেয়া। এরপর বেহুলা লখিন্দরের বাসরে নাগের ছোবল, প্রাণহীন পতিকে নিয়ে সতীসাধ্বী বেহুলার দেবলোক গমনের কাহিনি এক অদ্ভুত কিংবদন্তী বটে!
আচ্ছা বলুন তো, ঢাকার নাম ঢাকা কেন? স্বপ্নে দেবীর আদেশ পেয়ে জঙ্গলের মধ্যে মন্দির স্থাপন করলেন বল্লাল সেন। নাম দিলেন ঢাকেশ্বরী। সেই থেকেই কি ঢাকার নাম ঢাকা হলো?
তবে বলুন তো, গেন্ডারিয়ার নাম কেন গেন্ডারিয়া হলো? ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার নামেই কি এদেশের ইন্দিরা রোডের নামকরণ? একটা সময় তাই জানতাম। তবে একসময় জানলাম দ্বিজদাস বাবুর বড়ো কন্যা ইন্দিরার নামেই ধীরে ধীরে এলাকাটির নামকরণ হয়ে যায়। জানেন তো, মি. ককরেল সাহেবের নাম থেকেই কাকরাইলের নামকর হয়েছে?
হজরত বদর আউলিয়ার কথা কে জানেন? তার অলৌকিক চাটি থেকেই নামকরণ হয়েছে চাটিগ্রাম তথা চট্টগ্রামের। পাহাড়ে মধ্যে চাটির আলো ছড়িয়ে জিন পরীদের তাড়ানোর সে কী এক অবাক করা ঘটনা! আজও চাটগাঁ বাসীর মুখে মুখে শোনা যায়।
বগালেকের ইতিহাস আর রহস্য যেন কেমন এক বিস্ময়। এত উঁচুতে কী করে এমন মিঠাপানির আর একেক সময় রং বদলে যাওয়া পানির উদ্ভব তাই নিয়ে আছে গল্প। বগা লেকের সেই ড্রাগনের কারণেই এসব নাকি কে বা বলতে পারে!
গভীর রাতে যদি কামান দাগর শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় তো কেমনটা লাগে? হেনরি সাহেবেরও একই দশা। পর্তুগিজ সেনাদের আক্র মণ নাকি! বরিশালে ডিউটির আগের দিনই এমন হলে কার আরাম লাগে? দেখা গেলো রাতে কয়দিন পরপরই এমন কামান দাগার শব্দ। নতুন নতুন সবাই একটু কাঁচুমাচু হলেও ধীরে ধীরে মানিয়ে নিলো ❛গা নস অব বরিশাল❜ এর সাথে। এমন শব্দ নাকি শুধু বরিশাল নয় আরো অনেক জায়গাতেই শোনা গেছে। এ এক রহস্যই।
❛গরিবের বন্ধু ধনীদের জম, রবিনহুড❜
রবিনহুডের দেশী ভার্সন কি বলতে পারি মহর খাঁ কে? ডাকাত মহরও যে গরিবদের সেবা সাহায্য করতেন আর ধনীদের থেকে লুট করতেন।
বেহুলা-লখিন্দর, শিরি-ফরহাদ এদের প্রেমের ঘটনা তো লোকে জানে। তবে কবি চন্দ্রাবতীর প্রেমকথা কে জানে? যার কাব্যের রসে দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারাম, মলুয়া পদ্মপুরাণের মতো কাব্যোগীতি পেয়েছে মানুষ। তার আর জয়নন্দের পরিণয় আর জয়নন্দের দ্বিচারিতার গপ্পো তো কষ্ট দেয়ার মতো। রাজা থেকে সন্ন্যাসী হওয়া ভাওয়াল গড়ের রাজা রমেন্দ্র জীবনের অলৌকিক খেলা শেষ করে কি ফিরে এসেছিল আপন ভূমিতে? ইতিহাস আর প্রমাণ তো তাই বলে।
রাণী রাসমণির কাহিনি তো লোকমুখে প্রচারিত। তিনি আসলে কেমন ছিলেন? প্রতাপময়ী নাকি অত্যাচারী?
......
স্ত্রীর কথায় মায়ের একমাত্র সন্তান নদের চাঁদ কুমিরের রূপ ধারণ করেছিল। জানেন সে কথা? কিন্তু কীভাবে সে নিজেকে কুমিরে পরিণত করতে পারলো কিন্তু আগের বেশে আর ফিরতে পারলে না এই আখ্যান শুনলে নিশ্চয়ই বেদনা বিধুর হয়ে যাবেন আপনি।
শাশুড়ি কিংবা কথিত আছে স্বামীর অত্যা চারে থেকেও সব মুখবুজে সহ্য করছিল এক অপরুপা সুন্দরী বধূ। তাকে নাকি ভালোমতো খেতেই দিত না। সেই ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে বণিকের বউ জঙ্গলের ফল খেতে খেতে আর্জি জানালো তাকে ���েন পাখি করে দেয়া হয়। সেই থেকেই নাকি কালো মাথা বেনে বউ পাখিটির প্রচলন। অপূর্ব সুন্দর কন্ঠের গান দিয়ে পাখিটি কিংবদন্তী হয়ে আছে। যাকে অনেকে ইষ্টিকুটুম, বউ কথা কও বলেও থাকেন।
পরশুরামের কাঠের কুঠারের কথা তো জানি নাকি? মাতৃ হ ত্যার পাপ নিয়ে যে কতো পরীক্ষা দিলো। তার ভিটের খোঁজ কি পাওয়া গেছে? আবার পাপমোচন করতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের দেখা পায় সে। এত অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন নদীকে লোকালয়ে পৌঁছে দিতে সে লাঙ্গল দিয়ে কর্ষণ শুরু করেছিল। এরপর সৃষ্টি হলো লাঙ্গলবন্ধের আর দুইটি নদীর অপরুপ গল্প।
এলাকার নামকরণের ইতিহাস গুলো বেশ মজার। এইতো মগেরা যেখানে থাকতো সেই থেকে মগবাজার, চার ফকিরের পুল থেকে ফকিরাপুল, ঢাকার দুটি গ্রাম হলো খিলগাঁও আর তেজগাঁও, নীলচাষ হতো যে ক্ষেতে সেখান থেকেই নীলক্ষেত, জিন্দবায়োর গালি থেকে জিন্দাবাহার, বেঙ্গলাবাজার থেকেই যে আসলো বাংলাবাজার, চাঁদ খাঁর পুল থেকেই চানখাঁরপুল। আবার আছে অপভ্রংশ। আজকের জিগাতলা যে ঝিগাটোলার অপভ্রংশ জানতেন কি?
পীর নিয়ে তো গপ্পের শেষ নেই। পীর মাদার, মাদানী, পীর বলুন দেওয়ান সহ কত পীরের যে অদ্ভুত সব কিংবদন্তী আছে! আদিনাথের মন্দির আর তা মহেশখালীতে অবস্থান নিয়ে লোককথা খুবই দারুণ। শিবের আরেক নাম আদিনাথ, আবার শিবকে মহিষাসুর কিংবা মহেশ নামেও ডাকা হয়! কানেকশন সমঝে?
এলাকার নামের যেমন ইতিহাস আছে তেমনই ইতিহাস আছে জেলার নামেও। ঢাকা যে ঢাকেশ্বরী থেকে এসেছে বা ঢাকা কোনো কিছু থেকে এ নিয়ে অনেক তর্ক মতভেদ আছে। কালক্রমে এই ইতিহাস তো অজানাই রয়ে গেলো।
ব্রাহ্মবাড়িয়া নিয়েও আছে মজার কিংবদন্তী। ❛ব্রাহ্মণ বেরিয়ে যাও❜ থেকে নাকি এসেছে এই নাম। আছে অন্য মতও। ফিরোজপুর থেকে নাকি এসেছে পিরোজপুর, আবার চাঁদ রায় কিংবা চাঁদ ফকিরের নাম থেকে এসেছে চাঁদপুর। আসল ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। রয়ে গেছে কিংবদন্তী।
গাজী, কালু আর চম্পাবতীর আখ্যান আর অদ্ভুত। গাজী, কালু ইতিহাসে কীভাবে এসেছে তার থেকেও অদ্ভুত হলো লোককোথায় তাদের অবস্থান। তাদের সাথে আরেকটি নাম জড়িত সে হলো দক্ষিণ রায়। কেউ বলে গাজীর সাথে দক্ষিণ রায়ের বিবাদে কথা, কেউ বলে গাজীর অনুসারী দক্ষিণ রায়, আবার দক্ষিণ যায় নিজেই একজন প্রথম সারির লৌকিক দেবতা। যে কিনা বাঘের বেশে থাকে। সুন্দরবনের অধিবাসীদের কাছে যিনি পূজিত।
দক্ষিণ রায়ের কথা আসলেই সামনে আছে দ্য ওমেন, দ্য মিথ বনবিবির কথা। লৌকিক কথায় বনবিবি একজন উঁচু মাপের দেবী। তার ঘটনাও বেশ চমকপ্রদ। হিন্দুরা তাকে দেবী বললেও বনের অধিবাসী অনেক মুসলিমের কাছে নাকি তিনি পীরানি নামে পরিচিত!
হিন্দুদের মাঝে দেব-দেবী নিয়ে হাজারো মিথ থাকলেও মুসলিমদের কাছে কিংবদন্তী অন্যভাবে ধরা দেয়। সেগুলো আসে পীর, ফকির, মাজার আর মসজিদ দিয়ে। এই জনপদে মুসলিম ধর্ম প্রচারের পথিকৃৎ হজরত শাহজালাল (রাঃ) এর কথা প্রসিদ্ধ। তিনি কীভাবে এলেন, এরপর কীভাবে ইতিহাস এবং কিংবদন্তীতে জায়গা করে নিলেন এসব ঘটনা বেশ দারুণ। সিলেটের বিস্তৃতিও তেমন মজাদার।
মসজিদ নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তী। কেউ বলে কিছু কিছু মসজিদ নাকি আউট অফ নোহোয়ার এক রাতেই উঠে এসেছে। কেউ বলে কিছু মসজিদের আছে অলৌকিক শক্তি। তারা নাকি মানত পূরণ করে দেয়! আবার কেউ বলে কোনো মসজিদের ভেতর কেউ ভয়ে ঢুকে না কারণ সেখানে সাদা বসন পরিহিত অনেককে নামাজরত দেখা যায়। এমনকি কিছু মসজিদ হলো পাতরাইল মসজিদ, সাতরা মসজিদ, খাঁ মসজিদ, নিদাড়িয়া মসজিদ।
রবীন্দ্রনাথের ❛বৌ ঠাকুরাণীর হাট❜ তো পড়েছেন। এই নামেই আছে করুণ এক কিংবদন্তী। আচ্ছা কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানের নাম যে সোয়া লাখিয়ার অপভ্রংশ জানেন? তেমনি আছে এই অঞ্চলের অনেক কিংবদন্তী। কিংবদন্তীর আরেকটি আখড়া হলো জমিদার বাড়ি গুলো। তাদের আজকের ভগ্নমান দশা এই ধ্বংসস্তূপ কি এককালে তাদের অ ত্যাচার, অহমিকা আর স্বেচ্ছাচারিতার ফলকেই বহন করে? লকমা জমিদার বাড়ি, কাইতলা জমিদার বাড়ি, শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ি, বামনডাঙা জমিদার বাড়ি সহ অনেক জমিদার বাড়ির ইতিহাসই এমন করুণ। প্রজাদের অত্যা চারের শিরোমণি ছিল সিংহভাগ জমিদার। তাদের ঘিরে আছে অদ্ভুত সব কিংবদন্তী। আছে তাদের পাপের ঘড়া পূর্ণ হওয়ার গপ্পো।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
❝বাংলা কিংবদন্তী❞ বইটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা কিংবদন্তীগুলো সংকলন করেছেন আসাদুজ্জামান জুয়েল। ❝বাংলা কিংবদন্তী- দ্বিতীয় কিস্তি❞ সংকলন করেছেন আসাদুজ্জামান জুয়েল এবং রুদ্র কায়সার।
পুরাণ, উপকথা, লোককথা কিংবা কিংবদন্তী এগুলো একটি দেশের ইতিহাসের আরেকটি অংশ। ইতিহাস যেমন সত্য প্রকাশ করে কিংবদন্তীর কাজ একটু আলাদা। কিংবদন্তী সত্য আর কল্পনার এক মধুর মিশ্রণ। বলা যায় ইতিহাস যেখানে থেমে যায় সেখানে কিংবদন্তী ডানা মেলে। মানুষের মুখে প্রচলিত কথা, গুরুজনের বুলি আর অভিজ্ঞতা মিলে কিংবদন্তী তৈরি হয়। যা কেউ কাহিনিরূপেই শুনে কেউবা করে বিশ্বাস।
এই বইটিতে সংকলক ঢাকা সহ আশেপাশের অনেকগুলো অঞ্চলের লোকমুখে প্রচলিত কিসসা, কাহিনিকে সংগ্রহ করেছেন। কিছু একদম শোনা কাহিনিকে তুলে ধরেছেন, কিছু শোনা এবং আপন লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
সংক্ষেপিত আকারে অনেকগুলো ঘটনা উঠে এসেছে। আমার বেশ লেগেছে পড়তে। কিছু ঘটনা পড়তে গিয়ে একটু অবাকই লেগেছে। জানা ঘটনার সাথে পড়া ঘটনার আকাশ পাতাল ফারাক দেখে। এরমধ্যে অন্যতম রাণী রাসমণির ঘটনা। এটা আমার জানা হয়েছে জীবন মানে জি বাংলায় দেখা নাটকের মাধ্যমে। সেখানে রাসমণি বেশ শক্ত এবং পজিটিভ একজন চরিত্র। মূল চরিত্র ছিলেন। সেখানে তাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেটার সাথে এই বইতে পড়া ঘটনা একেবারেই ১৮০° উল্টো।
লেখার ধরন ভালো। কিন্তু কিছু বাক্যের ক্ষেত্রে শব্দের প্রয়োগ কেমন যেন গুলিয়ে গিয়েছিল। পড়তে ভালো লাগছিল না। বাক্যগঠনের ভুলের কারণে হবে হয়তো কিংবা সম্পাদনার মেশিনে ঠিকমতো কাটছাঁট না হওয়ার কারণও হতে পারে।
.....
দ্বিতীয় বইটি প্রথম বই থেকে বিস্তারিত তবে গল্পের সংখ্যায় একটু কম। এই কিস্তিতে সংকলকদ্বয় চেষ্টা করেছেন কিংবদন্তীগুলোর ইতিহাস বা লোকমুখে ছড়ানো কথাগুলোকে আরো বিস্তারিতভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে।
এই অংশে আগের অংশের কিছু গল্প পুনরায় এসেছে। ঢাকার কিংবদন্তী, শাঁখারীবাজারের কিংবদন্তী এগুলো রিপিট ছিল। তবে কিছুটা বিস্তারিত ছিল। এই খন্ডে আসা অনেক কিংবদন্তী নিয়ে জানা ছিল। তবে আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে বনবিবির ঘটনা। পীরের কাহিনিগুলো, আর দেবতাদের বিশ্বাস এগুলো এগিয়েছে ধর্মকে পুঁজি করেই। তবুও কিছু কিছু বেশ অবাক করা ছিল। বিশেষ করে মা ফাতিমা ও ইমাম হাসান, হুসাইনের সাথে জড়িত কিংবদন্তী অবিশ্বাস্য বটেই। তবে কিংবদন্তী তো কিংবদন্তীই!
দুটো বইতে প্রায় ৪৫-৪৬ টি কিংবদন্তী স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের অনেকগুলো জেলা, অঞ্চলের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোককথাগুলোকে এক মলাটে দেয়ার কঠিন কাজটি সংকলকদ্বয় সম্পন্ন করেছেন। কিছু কাহিনি বেশ অতিরঞ্জিত লাগছিল। যদিও নির্দিষ্ট বিশ্বাসের সীমায় থেকে রঞ্জনের মাত্রা কমবেশি মনে হয়েছে। তবে এই কাহিনিগুলো ইতিহাস ছাপিয়ে বা কখনো ইতিহাসকে ঢেকে দিয়েছে। আজ এত বছর বাদে এসে সেই আদ্দিকালের সত্য খুঁজে বের করা কঠিন। তাই লোকমুখে শুনে আসা বুলিই ভরসা। বাংলা পুরাণ সমৃদ্ধ। তবে রক্ষণাবেক্ষণের যথেষ্ঠ লোকবলের অভাবে হয়তো এই কথাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। মিছে যাচ্ছে কল্পনা। এরকম আরো বই আসা উচিত।
প্রচ্ছদ, প্রোডাকশন:
প্রচ্ছদ প্রথম বইটির বেশি সুন্দর। আমার কাছে সম্পাদনার ঘাটতি মনে হয়েছে দুটো বইতেই। শব্দ পূর্ণ হয়নি। কোথাও যেন মনে হলো র ফাইলের লেখা এডিট না করেই মূল ফাইল ছেপে দিয়েছে। অন্য বাক্যের শব্দ আগের বাক্যে রয়ে গেছিল যেটা আগের বাক্যের সাথে মানানসই ছিল না। তেমনি করে যেখানে হবে সেখানে কর দেয়া, আবার যেখানে না দিয়ে বাক্যের শেষ সেখানে হ্যাঁ বোধক হয়ে গেছে। এর উল্টোটাও হয়েছে অনেকক্ষেত্রে। এগুলোতে নজর দেয়া জরুরি ছিল।
❛ঢাক বাজে টাগডুম টাগডুম ঢোলসমুদ্রের তলে; কিংবদন্তী লুকিয়ে আছে সবাই তো তা বলে।❜
বইঃ বাংলা কিংবদন্তী সংকলকঃ আসাদুজ্জামান জুয়েল প্রকাশনীঃ ভূমি প্রকাশ প্রচ্ছদঃ সজল চৌধুরী পৃষ্ঠাঃ ৯৬ মূল্যঃ ১৬০ টাকা।
লেখক আসাদুজ্জামান জুয়েল এর জন্ম দিনাজপুর শহরে। পড়ালেখা করেন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। ভৌতিক গল্প এবং ছোটদের জন��য লিখতে পছন্দ করলেও আমাদের চারপাশের প্রচলিত কিংবদন্তী নিয়ে লিখেছেন "বাংলার কিংবদন্তী "। এটি লেখকের একক প্রথম বই।
বহুদিন পূর্বে থেকে জনশ্রুত হয়ে আসছে বা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত কথা বা গল্পই কিংবদন্তী। এটাকে রুপকথা বলা যায় না আবার পুরোপুরি ইতিহাস ও নয়। ইতিহাসের কঠিন বিষয়ের সরস গল্প।
এই সব কিংবদন্তী আমাদের সম্পদ। কোন বিশেষ স্থান, সেই স্থানে থাকা বিশেষ একজন বা কয়েক জন ব্যক্তিকে ঘিরেই কিংবদন্তীর সৃষ্টি। কিছু হয়তো হারিয়ে গেছে কালের গহব্বরে আর কিছু স্থান কিংবদন্তী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও তা হারিয়ে যাবার পথে। এমনই সব কিংবদন্তী কাহিনি নিয়ে লেখক আসাদুজ্জামান জুয়েল এর " বাংলা কিংবদন্তী "।
দিনাজপুর অঞ্চলের রাজা প্রাণনাথ, তার পুত্রের প্রাণত্যাগের ফলেই দিঘি পানিতে পূর্ণ হয়। দিনাজপুর শহর থেকে ৮ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত সেই দিঘি রামসাগর ।
বাসর ঘরেই লখিন্দর কে সাপে কাটে। প্রথা অনুযায়ী তাকে কলাগাছের ভেলায় করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সাথে যায় বেহুলা। ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যায় স্বর্গে। তার সংকল্প দেবতাদের কাছ থেকে প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন লখিন্দরের।
বগুড়া শহর থেকে নয় কিলোমিটার উত্তরে, বগুড়া রংপুর সড়ক থেকে এক কিলোমিটার দূরে বেহুলার বাসরঘর।
এমনই সব ছোট বড় নানা কিংবদন্তী নিয়েই বইটা। এর কিছু আগে জানা থাকলেও অনেক কিছুই অজানা। তাছাড়া কিছু কাহিনি আগে জানা থাকলেও এই কাহিনির উৎপত্তি স্থান আদেও আছে কিনা তা জানা ছিলো না। চমৎকার সব কিংবদন্তী আমাদের চারপাশে আছে অথচ এটা আমরা অনেকেই জানি না। আর জানলেও পুরোটা জানা হয়নি। ছোট বড় করে মোট ২৫ টি কিংবদন্তী কাহিনি বইটাতে আছে। এর কিছু কাহিনি শুরু মুখে মুখেই আছে আর বেশীরভাগ কাহিনির সাথে জড়িয়ে আছে নিদিষ্ট একটা স্থান যা এখন দর্শনীয় স্থান হয়ে আছে। কাহিনির সাথে দেওয়া আছে ছবি। কিংবদন্তীর কাহিনির কিছু আগে পড়েছিলাম, এই বইটাতে বেশ কিছু নতুন স্থানের নতুন নতুন কাহিনি জানা হলো। তথ্য গুলো সংগ্রহ করে এমন সুন্দর করে সাজাতে বেশ কষ্ট সাধ্যই।
গুছানো এই সুন্দর কাহিনি এক মলাটে পেয়ে ভালোই লাগলো। শুভকামনা রইলো লেখকের জন্য আগামীতে এমন সুন্দর সুন্দর লেখা আমরা পাই।
ধরুন, আপনি বগালেকের শান্ত পরিবেশে লেকের জলে পা ডুবিয়ে বসে আছেন। উপভোগ করছেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। হঠাৎ পেছন থেকে একটি লোক এগিয়ে এসে আপনাকে বলে উঠলেন, "সাবধান, লেকের জলে কিন্তু দানো আছে।" আপনি প্রথমে লোকটির কথায় তেমন পাত্তা দিলেন না। কিন্তু পরেই মনে পড়ল, কিছু বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনার কথা আপনি শুনেছেন। লেকের জলে এখন আর কাউকে নামতে দেয়া হয় না, সেটাও জানেন। মনটা একটু খচখচ করে উঠল। জিজ্ঞেস করলেন, "দানো মানে?" লোকটি তখন আপনার পাশে আয়েশ করে বসলেন। বলতে শুরু করলেন, "একদিন আকাশ থেকে হুট করে নেমে আসলো এক আজব জন্তু। অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে লাগল। গ্রামবাসী ওটার নাম দিল 'বগা'।পাহাড়ের গুহায় আস্তানা গেড়ে বাস করতে শুরু করল গ্রামের পাশেই। তার কিছুদিন পর থেকেই গ্রাম থেকে ছোট ছোট বাচ্চা হারিয়ে যেতে শুরু করে। গ্রামবাসী একসময় ক্ষিপ্ত হয়, বুঝতে পারে কাজটা বগার। তারা দল বেধে আক্রমণ করল বগাকে। তারপর... " 'বগালেকের ড্রাগন' শিরোনামের কিংবদন্তীর গল্পসহ এরকম 'পঁচিশ'টি কিংবদন্তীর সমন্বয়ে সংকলক আসাদুজ্জামান জুয়েলের 'বাংলা কিংবদন্তী' বইটি। কিংবদন্তী মানে হলো জনশ্রুতি, মুখে মুখে প্রচলিত গল্প। যা পুরোপুরি ইতিহাসও নয়, আবার রূপকথাও নয়। সত্য ও কল্পনার মিশ্রণে সৃষ্টি হয়। বইটিতে আরও আছে — রামসাগর, কমলারাণীর দিঘি, কোশাকান্দার কিংবদন্তী, বেহুলা - লখিন্দরের বাসরঘর, ঢাকার ঈশ্বরী ঢাকেশ্বরী, কিংবদন্তীর বান্দরবান, গানস অব বরিশাল, চলনবিলের রবিনহুড, ভাওয়ালগড়ের সন্ন্যাসী রাজা প্রভৃতি।
ইতিহাস রচনা মোটেও সহজ কিছু নয়। আর পুরাণের বা লৌকিক গল্পের ক্ষেত্রে তো মোটেও না। সেইদিক বিচারে আসাদুজ্জামান জুয়েল বেশ ভালোই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তবে মাঝে মাঝে সেই মুন্সিয়ানায় ভাটা পড়েছে। কিছু কিছু বাক্য গঠন পড়ে মনে হয় লেখকের নিজস্বতা আর মৌলিকত্ব হারিয়েছে ঐটুকু জায়গায়। ব্যাপারটা যদিও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব তবুও। এছাড়া বাদবাকি শব্দচয়ন আর বাক্যগঠন প্রশংসার যোগ্য।
আমার মতে সবকিছু ছাপিয়ে হলেও এই বইটা অন্তত সবার পড়া উচিত। সবার আগে সবকিছুর আগে নিজের দেশ, নিজের কৃষ্টি আর নিজের নৃতাত্ত্বিক গঠন জানাটা সবচাইতে বেশি জরুরী। যেহেতু লেখক ভালো একটা উদ্যোগ নিয়েছে নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে পাঠকদের বিস্তারিত জানার সুযোগ করে দিয়ে; সেহেতু বলবো লেখককে এই সিরিজটা ধারাবাহিকভাবে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে।
প্রয়োজনে হাড়ি থালা আসতো, এমন দিঘি মনে হয় কম বেশি সব জেলাতেই ছিলো । আপনার জেলাতে কি ছিলো?? আমাদের ছিলো। ফুফাতো বোনদের কাছে মুন্সীগঞ্জের ঐ দিঘির গল্প অ-নে-ক বার শোনা হয়েছে এবং প্রত্যেকবার শুনতে মজা লাগতো। ☺️ দুঃখজনক হলেও সত্য, অতীশ দীপঙ্কর এর জন্মস্থান যে বিক্রমপুরে তা আমি এই বই পড়ে জানলাম ☹️ যেখানে আমার বাসা থেকে দুই কদম দূরে মূল সড়কের নামকরণ করা তার নামে ( এর কারন হয়তো তার চিতাভস্ম , ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারে সংরক্ষিত আছে) । বেহুলা- লখিন্দরের কাহিনী মুখে শুনে জানলেও এই প্রথম লিখিত আকারে পুরোটা পড়া হলো। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নামকরণের কাহিনী ছিল বইটিতে। সর্বপ্রথম নীলকরদের বিরুদ্ধে যে বাওয়ালি মেয়েটি বিদ্রোহ করেছিল তার কথা ইতিহাসে লেখা নাই জেনে খারাপ লাগলেও খুলনার মানুষের মুখে মুখে সে স্মরনীয় হয়ে আছে এটাও একটা ভরসা। এরকম মুখে মুখে বলে আসা গল্প যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে বইটি পড়ে দেখতে পারেন। বইটির দ্বিতীয় খণ্ড ও আছে। একটু বিরতি দিয়ে তা পড়বো ইনশাআল্লাহ।
সত্যিই দারুণ একটা বই বাংলা কিংবদন্তি। বইটি পড়ে গ্রাম বাংলার অনেক লোকগাথা কিংবা মিথ যাই বলি না কেন সব জানতে পারলাম। একটা সময়ে মনে হয়েছিলো এগুলো বাস্তব জীবনের কোন ইতিহাস যা একটা সময় ঘটেছিলো বিভিন্ন জনপদে। তাছাড়া বইটিতে প্রতিটি অধ্যায় খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। তবে সুন্দর প্রচ্ছদের প্রশংসা না কর���েই নয়।
আহারে পুরো বইটাই কপি আর পেষ্ট!কি আশ্চর্য একটা পুরো বই শুধু এই বই থেকে একটু ওই বই থেকে একটু কপি করে লিখে ফেললেন!যারা এই বইয়ের প্রশংসায় ভেসে যাচ্ছে তাদের শীলা বসাকের বাংলার কিংবদন্তি বইটা পড়ার অনুরোধ রইলো।কিংবা এই বইয়ের শেষে যে সহায়ক গ্রন্থসমূহ দেয়া রয়েছে সেগুলো পড়ে দেখবেন।
বাংলা কিংবদন্তির মতো এতো জটিল একটা বিষয়ে নিয়ে নিশ্চয়ই আসাদুজ্জামান জুয়েলের অনেক খাটুনি করতে হয়েছে, সেজন্যে ৫ ★। খুবই তথ্যবহুল বই। দ্বিতীয় কিস্তি সংগ্রহে আছে। আশা করি সেটিও প্রথমটির মতোই ভালো হবে।