বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের অনুরাগী মাত্রেই এই ঘরানার মহাজনদের লেখা আর সহজলভ্য না থাকা নিয়ে হা-হুতাশ করে থাকেন। সেইসব লেখকদের পুরোধা বলা চলে সিদ্ধার্থ ঘোষকে। কল্পবিশ্ব পাবলিকেশন তাঁর ফিকশনের প্রথম সংকলনটি প্রকাশ করে আমাদের সবার কৃতজ্ঞতাভাজন হলেন। গবেষক ও প্রাবন্ধিক সিদ্ধার্থ ঘোষকে নিয়ে অনেক বিদ্বজ্জন মোহিত হয়ে থাকেন। কিন্তু গল্পকার সিদ্ধার্থ ঘোষকে নিয়ে আমরা এত মাতামাতি করি কেন, তার সবচেয়ে ভালো উত্তর তথা স্যাম্পলার হিসেবে এই বইটিকে নেওয়া যেতে পারে। কী-কী লেখা আছে এতে?
সূচিপত্র তুলে না দিয়ে বরং অন্যভাবে গল্পগুলোকে সাজানো যাক। সেটা করতে গিয়ে সবচেয়ে আগে দুটো কথা বলি। (১) আজ থেকে সাড়ে তিন দশক বা তারও বেশি আগে এই মানুষটি তাঁর ফিকশনে, এমনকি 'কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান' পত্রিকায় প্রকাশিত ইয়ং অ্যাডাল্ট পাঠকদের জন্য লেখা গল্পে পরিবেশ নিয়ে টানাপোড়েন থেকে লোভের রাজনীতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে অন্য গ্রহের চোখে মানবতা - এমন সব বিষয় নিয়ে লিখে গেছেন। এই সংকলনে এমন বেশ কিছু গল্প আছে যাতে বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন চরিত্ররা নিজেদের মতো করে সেগুলোর সমাধান করেছে। তাদের অনেকগুলোতেই রহস্যভেদী তথা ইনফোটেইনমেন্ট সরবরাহকারী হলেন ফোটোগ্রাফার ঝন্টুমামা। মামা-দের স্বর্ণিম ঐতিহ্যময় বাংলা সাহিত্যে ঝন্টূমামা নিজস্ব ছাপ ফেলেছেন এই গল্পগুলোর মাধ্যমে। ঝন্টুমামা'র নানা আখ্যান ছাড়াও এই বইয়ের অধিকাংশ কাহিনিই এ-রকম। এদের মধ্যে যে গল্পটি পড়ে কিঞ্চিৎ হাহাকার করেছিলাম, সেটি হল 'মন্ত্র মাহাত্ম্য'। এই গল্পটা লেখক অসম্পূর্ণ করেই শেষ করে দিয়েছেন। হয়তো চল্লিশ বছর পর শারদীয় 'দেশ'-এ কী হতে পারে তা ভেবেই তাঁর এই কাজ। আমাদের সৌভাগ্য, এই থিম পরে 'ই.টি রহস্য'-তে নিবিড়ভাবে নাড়াচাড়া করা হয়। এই ধারায় 'তড়িৎ রহস্য' একটি অনন্য কাহিনি। পরিবেশ তথা পৃথিবীর লুণ্ঠন, সাসপেন্স এবং গতির জোরে এই গল্পটিকে বিদেশি কাহিনির সঙ্গে তুলনা করলে তা অসঙ্গত হবে না।
(২) ডিস্টোপিয়ান ফিকশন নামক বস্তুটি বাংলায় এখনও বিশেষ আদৃত নয়। সেখানে আটের দশকেই সিদ্ধার্থ ঘোষ একের-পর-এক কাহিনি পেশ করেছেন যাদের পড়লে চোখের সামনে আলো কমে আসে। সেইসব গল্প আমাদের ব্ল্যাক মিররের দুনিয়ায় ঢুকিয়ে দেয় ত্রিশ বছর পুরোনো হয়েও! এই বইয়ে এমন লেখার নিদর্শন হল: - লাখ টাকার আবর্জনা; - অ্যাস্ট্রো-স্কুলের ছাত্র; - মহাশূন্যের মণিমুক্তো। এই শেষোক্ত গল্পটি আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের এক 'দেশ'-এ বেরোলেও~ প্রথমত, এত পরিণত ও প্রাপ্তবয়স্ক থিম নিয়ে এখনও বাংলায় লেখালেখি হয় না। দ্বিতীয়ত, গল্পটা অসম্ভব আধুনিক, এবং আমার ধারণা এই বইয়ের কোহিনূর এই গল্পটিই।
শক্ত মলাটের বইটির ছাপা অত্যন্ত স্পষ্ট। মুদ্রণের ও বানানের ভুল খুব একটা নজরে পড়েনি। তাই বইটা পড়তে আপনাদের ভালোই লাগবে বলে মনে হয়। পড়ে ফেলুন!
রচনাসংগ্রহের প্রথম খণ্ডে মোট ২২টি লেখা রয়েছে (তার মধ্যে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস)। এই ২২টি লেখায় ঝন্টুমামা আবির্ভূত হয়েছেন দশবার, ঠিক কালবৈশাখী ঝড়ের মত।
আধ-পাগলা ঝন্টুমামা একদিকে আলোগ্রাফার (একদম ফটোগ্রাফার বলে ডাকবেন না, নইলে আদিদাস কামড়ে দেবে আপনাকে), অন্যদিকে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যিনি মাঝেমধ্যে টিকটিকিপনা করে থাকেন। বেশির ভাগ গল্পেই বিজ্ঞানের কোনও তত্ত্বানুসারে মূল সমস্যার সমাধান হয়। চক্রবেড়িয়ার (৩২+৭২)-(৩×৭) স্ট্রিট নম্বরে ওনার বাড়ি। হামবড়াই মানুষ, গল্পের কথক সুগত আর তার বন্ধু নিলয়ের ঘাড়ে চেপে অনেকসময় পেটপুজো করেন আবার অসংখ্য তুচ্ছতাচ্ছিল্যের আড়ালে এই দুইজনকে প্রচণ্ড স্নেহও করেন--
"অ্যাই, অ্যাই, ফুল স্টপ," কেউ কেউ এখানে বলতেই পারেন। "ইনি তো প্রফেসর শঙ্কু আর ঘনাদার সংমিশ্রণ মনে হচ্ছেন? এতে নতুন কী?"
আমি বলব, "যাও আদিদাস, ওনাকে একটু তালিম দিয়ে এসো।"
শঙ্কুর প্রসঙ্গে এলে, প্রথমে বলতে হবে ঝন্টুমামা বিজ্ঞানী নন, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ (যদিও তিনি নিজেকে বিজ্ঞানীই ধরে থাকেন, থুড়ি ইনভেন্টর)। উনি বিজ্ঞানকে ভালবাসেন, এবং প্রায়ই সুগত আর নিলয়ের ব্রেইনস্টর্মিং-কে নিজের কাজে ব্যবহার করেন। মুদ্রণশিল্প আর ফটোগ্রাফি শিল্পের অদ্ভুত মিশেলের মাধ্যমে তিনি মাঝেমধ্যে রহস্যের সমাধান করে থাকেন। শঙ্কুর মত আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে, তবে ফটোগ্রাফার হিসাবে, উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্যে নয় (তার মানে ধরে নেবেন না যে ঝন্টুমামা কিছুই উদ্ভাবন করেন নি)। কিন্তু এইরকম উপরি পার্থক্য বাদ দিলেও একটা গভীরতর বিভেদ রয়েছে দুই চরিত্রের মধ্যে।
প্রফেসর শঙ্কু আর যতই হোক অনেকটাই স্ট্যাটাস ক্যো রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে থাকেন। দেশ বিদেশের সরকারের হয়ে কাজ করা শঙ্কুর নৈতিক জ্ঞান প্রখর হলেও তিনি সামাজিক আর রাজনৈতিক স্ট্যাটাস ক্যো-কে অবমাননা খুব একটা করেন নি, অন্তত করার সম্ভাবনা থাকলেও সত্যজিৎ রায় সেইসব স্পর্শকাতর বিষয় গল্পে ঢোকান নি। অন্ততঃ স্বর্ণপর্ণীর আগে কোনও গল্পে শঙ্কুকে সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে অতিরিক্ত উতলা হতে দেখি নি। ঝন্টুমামা সেইদিক থেকে উলটো। পাড়ার বড়লোক পরিবার সবার সাথে অসভ্যতা করে? দাও নষ্ট করে ওদের ইলেক্ট্রিক ফিউজ (গভীর রাতে চুপিচুপি ঢুকে)। বাংলাদেশ থাকা আসা রিফিউজির আস্তানাতে লোকাল গুন্ডা উৎপাত শুরু করেছে? সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও তৎক্ষনাৎ। দূর্নীতিগ্রস্থ সরকারি চাকুরে অফিসের সবাইকে জ্বালিয়ে মারছে? ক্যামেরার কারসাজি দিয়ে তাকে বাঁশ দেওয়ার সুব্যবস্থা করে দাও। ঝন্টুমামা জাস্ট ডাজ নট গিভ আ ড্যাম। পুলিশ, সরকার- সবাইকে তিনি অবমাননা করতে প্রস্তুত নিজের নৈতিক মূল্যবোধকে অটুট রাখার জন্যে।
ঘনাদার সাথে তুলনাটা এত গভীর নয়। টংঘরের ঘনাদা আর্মচেয়ার অভিযাত্রী, মূলত টল-টেলসের (গুলতাপ্পি) জনক। তাঁকে ঘিরে ম্যিথের সৃষ্টি হয়েছে, কারণ ঘনাদা নিজে হস্তক্ষেপ করেছেন বারংবার (মৌ-কা-সা-বি-স এবং অন্যান্য)। ঝন্টুমামা ঘনাদার অ্যান্টিথেসিস। তাঁর ম্যিথ তৈরি হয়েছে অতিনাটকীয় কার্যকলাপের জন্যে, বিজ্ঞানের সুচারু ব্যবহারের মাধ্যমে। তবে দুইজনের মধ্যে মিল রয়েছে লেখনীর উদ্দেশ্যের উপর। ঘনাদা আর ঝন্টুমামা দুজনের গল্পই আসলে কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। যেখানে ঘনাদার গল্পে ভুগোল আর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেখানে ঝন্টুমামা বিজ্ঞান, সমাজ আর রাজনীতির আখ্যান বলেছেন।
ঝন্টুমামার হাসির গল্পগুলোকে ঝাঁঝরা করে রেখেছে কয়েকটা গম্ভীর সাইফি গল্প। এগুলোর মধ্যে "লাখ টাকার আবর্জনা", "তড়িৎ রহস্য", " অধিক শহরের তামাসা" আর "মহাশূন্যের মণিমুক্ত"- এই চারটে গল্প আমি জীবনে ভুলবো না।
"লাখ টাকার আবর্জনা" স্পেস অ্যাডভেঞ্চার। এই গল্পটা পড়ে জন স্কালজির Old Man's War এর কথা মনে পড়ছিল, যদিও দুটো লেখার মাঝে দুই দশকের বিভেদ। কয়েকজন বুড়োহাবড়া মহাকাশযাত্রীর শেষ হুরাহ।
"তড়িৎ রহস্য" বিজ্ঞানধর্মী থ্রিলার। জিয়োথার্মাল এনার্জিকে ব্যবহার করার যে পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে তা বিজ্ঞানসম্মত, যদিও সেটাকে বাস্তবে প্রয়োগ এখনও করা হয় না। এখনও অনলাইনে শুধু থট-এক্সপেরিমেন্ট রয়েছে, আলোচনার পর আলোচনা, বিজ্ঞানীরা প্রো আর কনের লিস্টি দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এইরকম অভিনব চিন্তা আশির দশকে একটা বাংলা গল্পে ইনজেক্ট করে সেটাকে রোমহষর্ক থ্রিলারের পরিবর্তন করতে পারাটা এক কথায় অসম্ভব মনে হতেই পারে।
"অধিক শহরের তামাশা"- একবার পড়বেন না। বারবার পড়ুন। প্রতিবার এই অদ্ভুত কর্পোরেটোক্রেটিক দুনিয়ায় নতুন কিছু খুঁজে পাবেন, নতুন ধরণের অমানুষিকতা, নতুন কোনও চিন্তা, নতুন কোনও ইমেজ যা সাতরঙা সরের মত আপনার মনে ভাসবে। এই গল্পের বিবরণ দেওয়া বেশ কঠিন, বাক্যগুলোয় মরচেধরা পেরেকের মত ধার রয়েছে। শেষ পর্যন্ত খোঁচা খেতে হবে। মোবিয়াসের এস্থেটিক সেন্স যেন গল্পের প্রযুক্তির বিবরণে মিশে গেছে।
"মহাশূন্যের মণিমুক্ত" সাইফি থ্রিলার। ছোট, স্মার্ট, গল্পটা ১৯৮০-৯০ দশকের (এবং কিছুটা হলেও বর্তমানের) তথাকথিত রোবট আর এলিয়েনদের নিয়ে লেখা বাংলা গল্পের থেকে অনেক আলোকবর্ষ এগিয়ে। গল্পটা পড়ে মনে হচ্ছিল SyFy প্রযোজিত কোনও সিরিজ দেখছি, যেখানে সরকার থেকে কর্পোরেট সকলে সাধারণ মানুষকে পিষে ফেলে রেখেছে।
চারটে গল্পেই কিন্তু ডিসটোপিয়ান এলিমেন্ট রয়েছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের ছায়া আঠালো আলকাতরার মত ছড়িয়ে রয়েছে। "লাখ টাকার আবর্জনা"-তে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম মেরামতি করা বেআইনি, কারণ বিনামূল্যে মেরামতি করতে পারলে সরকারের মুনাফা হবে না। "তড়িৎ রহস্য" গল্পে ভারত সরকার একজন অনৈতিক খুনীকে শাস্তি দিতে দোনোমোনো করছিল কারণ, ওই যে, খুনী মুনাফা আনছিল। "অধিক শহর" আর "মণিমুক্ত"- দুটো গল্পেই কর্পোরেটোক্রেসি রয়েছে, অর্থাৎ কর্পোরেট এনটিটিরাই দেশ, দুনিয়া চালায়৷ "অধিক শহরে" ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে ব্যাপারটা বর্ণিত রয়েছে, হাইপাররিয়ালিজমের মাধ্যমে। অন্যদিকে "মণিমুক্ত" অনেকটাই সংযমী, অনেকটাই বাস্তব, যেখানে প্লট এগিয়েছে ধীরে ধীরে, ভয়ঙ্কর এক পরিণতির দিকে।
প্রথম খণ্ডটা পড়ে মাথায় ঘূর্ণির উদ্রেক হয়েছে। ভাবছি বাংলার স্পেকুলেটিভ ফিকশনের গতি ঊর্ধ্বগামী হতে পারতো। হয় নি। সিদ্ধার্থ ঘোষের অসময়ে পরলোকগমন হয়তো একটা ছোট কারণ। কিন্তু প্রধান কারণ, পাঠককুল৷ তারা নিজেদের গণ্ডির বাইরে পা রাখতে পারে নি, এখনও ভয় পায়।
তবু যুগ বদলাচ্ছে। নতুন প্রকাশক, অডিও স্টোরি, ইত্যাদি সাধারণ মানুষের স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম হয়েছে। এখন পাবলিক লাভক্রাফটকে চেনে (কতটা গভীরভাবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে, কিন্তু অন্তত চিনতে পেরেছে তো!)। তাই বলি, চলুন, ভোরের আলোয় পুরনো বইগুলো বুকে ধরে রেখে আমরা এগিয়ে চলি। যা হবে, দেখা যাবে।
বাংলা সাহিত্যে নাকি কল্পবিজ্ঞান অপাংক্তেয় জঁর! এটা বহুদিন শুনে আসছি। ইনি নাকি বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের পোস্টার বয়। এর বইপত্র নিয়ে প্রকাশকে সম্পাদকে বাওয়াল চলে। তা পোস্টার বয়ের লেখার লেভেলে যদি এতো consistency র অভাব থাকে তাহলে সেই সাহিত্য জঁর হিসেবে কতোটাই বা পাতে দেওয়ার যোগ্য হবে? 'মহাকাশের মণিমুক্তো' আগে অন্য সঙ্কলনে পড়েছি। ওটা বাদ দিয়ে একটা লেখাও মনে থেকে যাওয়ার মতো লাগেনি। হাইলি disappointed.