শব্দরা থেমে যায়... থেমে যেতে হয়, বহুদূর হেঁটে যাবার পরও।
ঝিরিপথে একরাশ ভেজা বালির মতো জমে থাকা সেই শব্দ পেরিয়ে কিছু পথ হাঁটলে খুঁজে পাওয়া যায় অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য। আর গাছের ছায়ায় পথভোলা হয়ে বসে থাকা যায় একটা জীবন। সেখানে চাঁদের আলোয় বাতাসের শব্দে ঝরে পড়ে চুপচাপ পাতারা। দ্বিমাত্রিক সেই পৃথিবীতে কেউ সূর্য খোঁজে না। মানুষের অনুভূতির চড়া সুরে পুড়ে গেছে অসংখ্য চোখের আলো, তৈরি হয়েছে নৈর্ব্যক্তিক কাচের দেয়াল। এক আকাশ ভরা জ্বলজলে তারার কোনো অর্থ নেই সেখানে, বরং একমাত্র ভাষা হলো শব্দ।
অষ্টপ্রহর ফিরে ফিরে হয় শুধু কোলাহল, আর কখনোবা নীরবতা। তারপরও, যেদিন বিষণœ জ্যোৎস্না এসে সেই শহরের রোদভেজা পথে নতুন করে আলপনা তৈরি করে, সেদিন সেই ছায়া ছায়া শব্দগুলো কেমন একটা নির্যাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে শহরময়।
বন্ধ জানালায় বাধা পেয়ে দেয়ালের আড়ালে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কাছে ছুটে যেতে চায় অসংখ্য গল্প, কখনো না তৈরি হওয়া কোনো সিম্ফনির মতো... কাচবন্দি সিম্ফনি.. =
Mahrin Ferdous is the author of eleven books across adult and children’s literature. Her fiction inhabits the border of surrealism and magic realism, where social upheaval collides with psychological dislocation and the hidden architectures of memory. Her stories blur reality and the uncanny, drawing readers into worlds that are unsettling yet deeply human.
In 2019, she was named one of Bangladesh’s five most promising young writers by Banglalink Telecom. She received the BRAC Bank–Samakal Literary Award in 2022 for her contributions to Bangla literature. Beyond her books, she serves as Vice President of the Pencil Foundation, a nonprofit dedicated to youth creativity and social engagement.
She now lives in New York, where she continues to write and work.
বইয়ের কাভার দেখে সবার আগে মনে হয়, বাহ! কি চমৎকার ঝকঝকে প্রচ্ছদ! ঠিক যেন ড্রয়িং রুমের সোফার পাশের দেয়ালের উপর ঝুলিয়ে রাখা গ্লাস পেইন্টিং। হাতে নিয়ে নতুন বইয়ের মিষ্টি ঘ্রাণে নাক মুখ ডুবিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে দেখি মাত্র ৮৮ পাতায় শেষ গল্পের সমাপ্তি টানা হয়েছে। খানিকটা মন খারাপ করে রেখে দিলাম বইটা। পড়লেই তো শেষ হয়ে গেলো!
তবু শব্দের হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে পড়ে ফেললাম দশটি গল্প। মাথায় ঘুরছে ছোট গল্পের সেই চিরন্তন সংজ্ঞা, শেষ হইয়াও হইল না শেষ। অর্থাৎ পড়া শেষ হলেও বুকের ভেতর গল্পের যে রেশ থেকে যায় তাই বা কম লোভনীয় নয় কি!
"গল্পগুলো বাড়ি গেছে" বইয়ে সূচী সাজানোর যে নতুন ধারা পেয়েছিলাম এই বইয়েও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। "হারাও", "ডুব" আর "বিদায়বেলা" শিরোনামে লেখক বন্ধী করেছেন দশটি ছোটগল্পকে।
মাহরীন ফেরদৌসের লেখনীর একটা বিশেষত্ব হলো তিনি সাধারণত তার গল্পের উপাদান চারপাশের চেনা জগৎ থেকেই নিয়ে থাকেন। আর শব্দের গাঁথুনিতে সেই চিরচেনা গল্প পায় অন্য এক মাত্রা। তবে কিনা এই বইয়ে লেখক সেই সুর থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ধারার অনেকগুলো গল্প সাজিয়েছেন। প্রথম গল্পের কথায় ধরা যাক, নিঝুম বিদায়বেলায় গল্পে প্রোটাগনিস্ট চরিত্রের নিখাঁদ অনুভূতির পাশাপাশি উঠে এসেছে প্রিকগনিটিভ ড্রীম নামক প্যারানরমাল একটা বিষয়। মজার ব্যাপার হলো, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির মাঝেও স্বপ্নের মাঝে ভবিষ্যৎ দেখে ফেলার এই অ্যাবিলিটি ছিলো। আব্রাহাম লিংকন নিজের মৃত্যুদৃশ্য এই প্রিকগনিটিভ ড্রীমের মাধ্যমেই জানতে পেরেছিলেন! নিঝুম বিদায়বেলায় গল্পের কথক অবশ্য জেগে জেগেই ভবিষ্যৎ দেখে ফেলতো! এরপরের গল্পটা খানিকটা বিষাদ আর নস্টালজিয়ার। এক ঝটকায় ঘুরিয়ে আনে বইয়ের পাতার ভাঁজে চিরকুট চালাচালি করার দিনগুলোতে। গল্পটা পড়তে গিয়ে বেশ কবার হেসেও ফেলেছি! হয়তো নয়নতারা জানে গল্পটা বেশ শক্তিশালী। আপাত দৃষ্টিতে ভালো মানুষ মনে হওয়া বাবা-ছেলে চরিত্রের কদাকার রূপ তুলে ধরেছেন অবলীলায়, টুইস্টের মাধ্যমে। হেমন্ত গল্পটাও প্রচন্ড নাড়া দিয়ে যায়। আমাদের জীবন আর সম্পর্কগুলো কতটা অভ্যাসে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এই গল্পে সেটার আভাস মিলেছে। মোমেনা আখতারের যন্ত্রমানব হারানোর শোকে ফেলা দুফোঁটা অশ্রু সেটারই সাক্ষর বহন করছে! মেরিনার মেঘমালা গল্পটিও প্যারানরমাল ঘরানার। এই জনরাভুক্ত আরও একটি গল্প আছে বইয়ে, চৈতালী সন্ধ্যায় সামরিন ও আমি। সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে পাওয়া এই গল্পগুলো পড়তে গিয়ে বারবার ভ্রম হচ্ছিল, সত্যি একুয়া রেজিয়ার গল্প পড়ছি তো! কমবেশি সব লেখকেরই নিজস্ব একটা ধারা থাকে। সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে লেখক এবার সত্যি চমকে দিয়েছেন! মহুয়ার গুঞ্জরনে গল্প পড়ে সবাই হয়তো বৈশাখীকে জাজ করতে বসবে। অথচ তার ট্রমাটিক চাইল্ডহুড কিভাবে এডাল্ড লাইফে এসেও সবকিছুর গতি নির্ধারণ করে দিচ্ছে সেটা কেউ তলিয়ে ভাবতে চাইবে না। ফেলে আসা সুগন্ধি গল্পে লেখকের সেই পুরানো সুর খুঁজে পাওয়া যায়। সম্পর্কের টানাপোড়েনের পাশাপাশি এখানে আছে বিষাদ আর ভুলে ভরা অতীত।
বোনাস হিসেবে রয়েছে ফাইজা ইসলামের মনোমুগ্ধকর অলংকরণ। প্রতিটি থিমকে আঁকিবুঁকির মাধ্যমে গল্পের সাথে যোগ চোখকে নরম আরাম দেয়! সবশেষে যে ব্যাপারটি না উল্লেখ করলেই নয়, বাংলা মৌলিক নামকরণের ব্যাপারে মাহরীন ফেরদৌসের প্রতিভা। নান্দনিক নাম সৃষ্টির মাধ্যমে লেখক বই আর গল্পগুলোকে চমৎকার এক মাত্রা দান করেছেন!
লেখিকার একটা বই ই পড়েছিলাম, "কিছু বিষাদ হোক পাখি"; তাও বছর পাঁচেক আগে! তখন ওই বই টাকে ভালোবাসতে চেয়েও ভালোবাসতে পারিনি, তার কারন লেখাতে ইমোশোনের বাড়াবাড়ি ছিলো, অন্তত আমার তাই মনে হয়েছিলো। তারপর আর একুয়া রেজিয়ার বই পড়িনি। ভাবছেন সে আবার কে? মাহরীন ফেরদৌস ই একুয়া রেজিয়া নামে লিখতেন। তার এই বেনামে লেখার ব্যাপারটাই আমাকে উনার বই পড়তে উৎসাহী করেছিলো।
এই বই এর কথাই বলি। দশটি ছোটগল্প আছে এই বই এ। দশটাই আমার ভালো লেগেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই বই এর লেখাগুলো "কিছু বিষাদ হোক পাখি"র লেখার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাধারন ভাষায় কিছু অসাধারন গল্প। ছোটগল্পে পেট ভরে না, এটা আমি জানি। তবে পেট না ভরলেও ভালো লাগবে, গ্যারান্টি দিচ্ছি। আর যারা ব্যাস্ততার কারনে বই পড়তে পারছেন না, অথবা রিডার্স ব্লকে ভুগছেন তাদের জন্য এটা একটা পারফেক্ট বই। আমি বইটা এক বসায় শেষ করতে পারতাম। কিন্তু মনে হলো লেখিকা হয়তো দুই মাস ধরে এই বই লিখেছেন, সেটা দুই ঘন্টায় শেষ করতে একদমই ইচ্ছে হলো না। তাই সময় নিয়েই শেষ করলাম।
মেলোম্যানিয়াকদের শহরে সাড়া পড়ে গেছে। কারণটা একটু অদ্ভুত। নতুন একটা সুরে বাঁধা পড়ছে শহরবাসী। নাগরিক জীবন উঁচুতলার কাঁচঘেরা দেয়ালে মোড়ানো হয়। সেই কাঁচের দেয়ালে আটকে থাকা মানুষগুলোর থাকে একটা করে গল্প। সবার গল্পগুলো মিলেমিশে একটা গান হতে পারতো। আর সেই গানগল্পের যদি নাম দিতে হয়, নামটা হবে ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’। কেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা দেয়ার একটা ছোট্ট চেষ্টা করছি।
কোএভাল (coeval) ঘরানার লেখক মাহরীন ফেরদৌসের নতুন বই ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’। বই হাতে নিলে প্রথমে একটু থমকে যেতে হয় প্রচ্ছদ দেখে। সাদা রঙের দেয়াল ভেদ করে লাল-কমলা জারবারা আর নীল জারুলের মতো রঙগুলোর পাশে স্তব্ধ কিছু মানব মুখাবয়ব দেখা যায়। একটানা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তাদের আকুতি দেখা যেতে পারে, সেই আকুতি সাথে নিয়েই যেন বইটির সাম্রাজ্যে আমরা প্রবেশ করি। বইয়ের প্রথমটায় মখমলের মতো সবুজ রং বইটিতে এক রাজসিক সৌন্দর্য নিয়ে এসেছে। যেন বইটি একটি সবুজ দীঘি আর তার অতলান্তিতে হারিয়ে শ্রান্ত মনকে শান্ত করবার জন্যই এই চেষ্টা। শুরুতেই উইলিয়াম বার্কলের বিখ্যাত উক্তিটি পড়ার পর মনে 'আহারে আহারে' ডাক ডেকে যায়। আর সেই হাহাকার নিয়ে আমরা গল্পের ক্রমতে চলে যাই। ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’ একটি গল্প সংকলন। গল্পগুলোকে লেখক তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। হারাও, ডুব এবং বিদায়বেলা।
জীবনের এই বন্ধুর চলার পথে অসংখ্যবার আমাদের মনে হয় যেন হারিয়ে যাই, আর কেউ বিষাদমনে আমাদের খুঁজে ফিরুক, তাই না ? ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’র ‘হারাও’ অংশটি আমার কাছে ঠিক তেমনই মনে হয়েছে । ‘নিঝুম বিদায়বেলা’ গল্পটির প্রজ্ঞা মেয়েটিকে মনে হয় আমাদের পাশের বাসার, যার জীবনের গল্পটি খুব পরিচিত, যার স্বপ্ন আকাশ ছুঁতে চাওয়ার আর তারপর আমরা দেখতে পাই তার ডানা ভাঙ্গার কষ্ট। উচ্চতাভীতিতে ভোগা গল্পের প্রোটাগনিস্ট ছেলেটির কল্পনা আর বাস্তবতার মিশেলে প্রজ্ঞার পরিণতি আমাদের চোখে ধরা দেয়। প্রজ্ঞার জন্য আমাদের বুকের ভেতর একটা শূন্যতা তৈরি হয়। তার জন্য আমাদের প্রার্থনা করতে ইচ্ছে হয়। এই ইচ্ছে তৈরি করে দেয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। ‘চিরকুট’ গল্পটি আমার বেশ হালকা মনে হয়েছে, যেমন গল্প পড়লে যে কোন মিলেনিয়ালের মনে হতে পারে আরে! এতো আমার ছেলেবেলার কথা। গল্পটি পড়ার পর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে মনের অজান্তেই। ‘হয়তো নয়নতারা জানে’ গল্পটি আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে ক্ষণে ক্ষণে। গল্পে বাবা চরিত্রটি নয়নতারা নামক গৃহকর্মীর শরীর থেকে মাছের গন্ধ পান আর তার বখে যাওয়া ছেলে সেই শরীরে নাক ডুবিয়ে বুঁদ হবার প্রবল আকাঙ্খায় পুড়তে থাকে। গল্পের প্রতি পাতায় একেকবার রেগে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম দোষ কাকে দেবো? শরীরী ঘ্রাণে অভিজ্ঞ বাবা নাকি তার বখে যাওয়া ছেলে কে? ছটফট করছিলাম নয়নতারার পরিণতি কী হবে তাই ভেবে। এইটুক বলতে পারি, শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার আশ্চর্য এক ক্ষমতা লেখকের আছে ।
বই এর দ্বিতীয়ার্ধের নাম ‘ডুব’। মোট চারটি গল্প আছে এই অংশে। প্রথম গল্পের নাম ‘হেমন্ত’ । হেমন্ত ঋতুটি বছরের প্রায় সায়াহ্ণে আসে। বিদায় বেলার আগে শেষ ঝলক আলোর মতো। কোমল কিন্তু উজ্জ্বল। মোমেনা আখতার অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। তার প্রবাসী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে একটা রোবটের প্রোটোটাইপকে পরীক্ষামূলকভাবে মায়ের একাকীত্বের সঙ্গী হিসেবে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। সাহিত্যমনা মোমেনা নিজের পড়ন্ত সময়ের কথা ভেবেই হয়তো মিলিয়ে রোবটের নাম রাখেন ‘হেমন্ত’। এই পর্যায়ে গল্পটিকে সায়েন্স ফিকশন মনে হতে পারে কিন্তু গল্প শেষে একজন মাঝবয়সী নারীর বোধ, একাকীত্ব, কষ্টের সাথে মিলিয়ে গল্পটি অনেক বেশি মানবিক হয়ে ওঠে। আরেকবার মন হয় বাষ্পময়। ‘মেরিনার মেঘমালা’ মূলত একটি দুঃস্বপ্নের গল্প। কেমন লাগবে যদি অন্য কারোও দুঃস্বপ্নে আমরা আটকে পড়ি? গল্পটি পড়তে পড়তে তাই ভাবনা জাগে, আহ জীবন! ‘মহুয়ার গুঞ্জরণে’ গল্পটি পড়ার পর কিছুক্ষণ স্তব্ধতায় চারপাশ থেমে থাকে। জীবন সুন্দর আর তা মনে না রেখে পারিপার্শ্বিক জটিলতায় হারিয়ে যাওয়ার যে কদর্য রূপ তা আমাদের ভাবায়। গল্পটিতে চমৎকার কিছু উক্তি ব্যবহার করা হয়েছে আর লেখকের কাব্যিক অলংকরণে হয়েছি মুগ্ধ। ‘বিষাদের ডাকনাম’ কলেবরে ছোট বলেই হয়তো মনে হয়েছে ঠিক মন ভরে ওঠেনি। এ একান্তই আমার অভিমত।
বলতে বলতে গল্পের শেষার্ধে চলে এসেছি। শেষ ব্যাপারটার সাথে মিল রেখেই যেন এর নামকরণ করা হয়েছে ‘বিদায়বেলা’। ‘চৈতালি সন্ধ্যায় সামরিন ও আমি’ গল্পটির সাথে একজন খুব জনপ্রিয় লেখকের ‘দ্বিতীয়জন’ গল্পটির কিছুটা মিল রয়েছে। তবে আশার কথা হলো, এই মিলটুকু ছাপিয়ে অচিরেই গল্পটি নিজস্ব ভঙ্গিতে চলে গিয়েছে বহুদূর। গল্পের গাঁথুনি ছিল খুবই সুন্দর। এই ফাঁকে বলে রাখি, কল্পনা থেকে স্বত্তার সৃষ্টি নিয়ে ‘রুবি স্পার্কস’ নামের চমৎকার একটি ইংরেজি চলচ্চিত্রও আছে। চাইলে প্রিয় পাঠক দেখে নিতে পারেন। ‘ফেলে আসা সুগন্ধি’ আরেকটি কন্টেম্পোরারি ঘরানার গল্প। ব্যস্ত নাগরিক জীবন, স্মৃতির টানা-পোড়েন, দায়িত্ববোধ আর মনের গলি-ঘুপচিতে আটকে পড়া এই নিয়েই কাহিনি এগোয়। এমন গল্পগুলো আমাদের কাতর করে। মনে হতে থাকে জীবন আরেকটু সহজ, সরলরেখার মতো হলে খুব কি ক্ষতি হতো? গল্পের একদম শেষ সংযোজনের নাম ‘উপহার’। উপহারে কী আছে তা পাঠককুলের জন্য বরং ভিন্ন রকমের উপহার বা চমক হিসেবে থাকুক! তবে তা পড়ে শেষ করার পর পাঠক যে অকস্মাৎ ঝটকার শিকার হতে পারে তার দায়ভার সম্পূর্ণই লেখকের।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের ঝকঝকে প্রচ্ছদ বরাবরের মতোই নান্দনিক হয়েছে। তবে অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করেছে প্রতি গল্পের আগে থাকা ফাইজা ইসলামের করা চমৎকার অলংকরণ দেখে। যা বইটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বইটির পাতাগুলো সুন্দর, বাইন্ডিং দারুণ! জানা মতে ‘পেন্সিল পাবলিকেশনস’ এবারের মেলা দিয়েই তাদের প্রকাশনা যাত্রা শুরু করেছে। তবে বইয়ের মানা, উপস্থাপন দেখলে তা কেউ বলবে না। বরং প্রথম শ্রেণীর প্রকাশনীর কাজের মতো মান সম্মত হয়েছে। বইটির আরেকটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লেগেছে তা হলো ছোট্ট গল্প সংকলন হলেও বইটিতে একটি বুকমার্ক সংযোজন করা হয়েছে। সাধারণত খুব ভারী উপন্যাস না হলে বই্য়ে বুকমার্ক থাকে না। পেন্সিল পাবলিকেশন্স থেকে আসা ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’ বইটি পাওয়া যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলায়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এছাড়াও বইটি অনলাইনে রকমারি, বইবাজার ও অথবাসহ নানা জায়গায় আছে। মুদ্রিত মূল্য ২০০ টাকা।
বই - কাচবন্দী সিম্ফনি লেখক- মাহরীন ফেরদৌস ৪/৫ স্টার প্রথমেই বলে নেই আমি কেন মুগ্ধ। বইটা অথবা ডট কমের মাধ্যমে ছোটবোন অর্ডার করেছিল এবং আমি জানিনা সবার বইয়ের সাথে তারা চিঠি পেয়েছে কিনা আমি একটা স্ক্যান করা লেখিকার হাতে লিখা দুই লাইনের চিঠি পেয়েছি। এই যে সামান্য একটু নতুনত্ব, সামান্য একটু বেশি কিছু করার ইচ্ছা এটাই আসলে আমরা পাঠকরা চাই, আমরা এতটুকু বুঝতে চাই বইটা লেখকের কতখানি কাছের, আমরা তার কত কাছের। ধন্যবাদ পেন্সিল প্রকাশনী এবং লেখিকাকে। বইটাতে মোট ১০টা ছোটগল্প আছে এবং শুরুতেই বলি ছোটগল্প আর আমি দুইটা জগতের জিনিস। আমি সম্ভবত নিম্নশ্রেনির কোনো পাঠক কিন্তু ছোটগল্প আমার ভালো লাগেনা, ভবিষ্যতেও লাগার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ তবুও এই বইটা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। ১০ টা অতৃপ্ত গল্প, ১০ টা অসমাপ্ত মানুষের গল্প। প্রতিটা গল্পের ভাষা, সুর একদম আলাদা, প্রতিটা গল্পের যে সুর, সেটা তার ভাষার মধ্যে ফুটে উঠেছে। প্রথম গল্প পড়ে ভাবছিলাম এরকম ভাবে কেন লিখল, প্রতিটা বাক্য যেন অন্যটা থেকে আলাদা, কেমন অন্যরকম, বাক্যগুলোর মধ্য তাল সুরে যেন মিল নেই, কিন্তু যত অন্যগল্প পড়েছি বুঝেছি তিনি ইচ্ছা করেই সেই অস্বস্তিটা অনুভব যেন করি, কোনো গল্পের অস্থিরতা যেন বুঝি, আবার কোনো গল্পের অতৃপ্তি যেন বুঝি , নিজের ভেতর অনুভব করি এভাবেই লিখেছেন, তিনি একরকম জোর করেই সেটা ভাবতে, অনুভব করতে বাধ্য করেছেন,যেটা গল্পের চরিত্ররা অনুভব করছে। আর আমার কাছে একজন গুণী লেখক তিনিই যে এই কাজটা সাবলীল্ভাবে করে ফেলতে পারেন। এতকিছুর পরও যদি বইটা কিনতে না চান, এই সুন্দর প্রচ্ছদের জন্য কিনে ফেলুন! আর ১ নম্বর কাটলাম কেন? কারণ ঐ যে ছোটগল্পে আঁশ মেটে না!
সিম্ফনি কখনো কাচের মধ্যে বন্দী থাকতে পারে, কখনো শব্দের মধ্যে। এই বইটার নাম আমার বেশ পছন্দ হইছিল। মূলত জলতরঙ্গের জন্য হয়ত। কাচের সাথে সুরের একটা ব্যপার আছে। কাচ ভাঙলেও সুর ওঠে। এই বইয়ের কয়েকটা গল্প ভাঙনের। কয়েকটা গল্প ভাঙা আর গড়ার মাঝামাঝি। যাপিত জীবনের। ব্যক্তির মন, তার টানাপোড়েন বইয়ের গল্পগুলোর মূল বিষয়। সেখানে এই সমাজের চলতি কিছু অবস্থা, মানুষের যাপন, রীতি নীতি আর সম্পর্কের স্প্রেডশিটও পাওয়া যায়। এতোসব কারণে গল্পগুলো হয়ে ওঠে বিচিত্র। এ সময়ের গল্প, গল্পের ধাঁচ ও মাহরীন ফেরদৌসের লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য বেশ ভালো বই।
অফিস ছুটির বিকেলগুলো খুবই নিরস ও বৈচিত্রহীন। সারাদিনের ক্লান্তি জেঁকে ধরলে শরীর ও মনে বুঝতে পারি ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে নড়ে চড়ে বসবার জন্য সামান্য উতসাহটুকুও। হয়তোবা দৈনন্দিন জীবন-যাত্রার কাছে এতোটাই বাধা পড়ে গেছি যে ইচ্ছে হলেই ভাঙ্গতে পারি না এই একঘেয়ে-পৌন:পুনিক চক্র। মানুষ জন্মমাত্রই মুক্তিপ্রবণ বলেই বোধহয় এতোসব অপ্রাপ্তিবোধ, শূন্যতাবোধ থেকেই মাথার ভেতর-কল্পনায় একের পর এক বা���ারী দৃশ্যনির্মাণ করে চলে। এইসব একঘেয়ে আলোকিত কাচঘরে বন্দিদশাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও মাথার ভেতর দৃশ্য নির্মাণের প্রক্রিয়া কিন্তু ঠিকই চালু থাকে। এইসব ছোট-বড় দৃশ্যগুলোই যেনো এক একটা সিম্ফোনি কিংবা কখনো সখনো ঘাড় গুঁজে বেঁচে থাকবার একমাত্র অনুষঙ্গ। বাট্রান্ড রাসেলের একটা কথা আছে সেটা হলো “সংসারে জ্বালা-যন্ত্রনা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভেতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে বিপদকালে তার ভেতরই ডুব দেওয়া।” আমার কাছে সেই জগত সৃষ্টির অন্যতম অনুষঙ্গ বই। মাহরীন ফেরদৌসের গল্পগ্রন্থ “কাচবন্দি সিম্ফোনি” হাতে পাবার পর অভ্যাসব��ত নিজের ভেতরের জমে যাওয়া গল্পগুলোকে নেড়েচেড়ে দেখার মতো করেই ভাবি অন্যের চোখের ভেতর দিয়ে নিজের চেনাজগতে বরং একটু ঘুরে আসা যাক। ব্যক্তি মাহরীনের সাথে আমার পরিচয় ও সম্পর্কের রকমারী বৃত্তান্ত না হয় আজকের মতো তোলা থাক। প্রায় ৭-৮ বছর ধরে স্মৃতির রেকাবে ইচ্ছে-অনিচ্ছে, আচমকা-পরিকল্পিত সব মিলিয়ে জমার পরিমানও কিন্তু অনেক। তবে এখানে আমার ভূমিকা একজন পরিব্রাজক বা মোটাদাগে সিরিয়াস পাঠক। এই ভূমিকা অবশ্য আমি আপনা আপনিই কাঁধে নিয়েছি কেননা আমাদের পারষ্পরিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে কার্যকরী অনুষঙ্গই ছিলো তার ভেতরের মহত লেখকসত্ত্বা। ওর লেখক সত্ত্বাকে আমি শ্রদ্ধা করি। মাহরীনের গল্পের ভেতরকার বিষাদ আমাকে বরাবরই আক্রান্ত করে। ওর গল্পের চরিত্রগুলোকে আমার দূরের মনে হয় না। এর একটা বড় কারণ হতে পারে আমাদের পরষ্পরের অন্তর্লোকের জগতের সাদৃশ্য। সেই ব্লগের স্বর্ণযুগে একদিন আনমনে ঢু মারতে মারতেই তার কোন একটি লেখায় চোখ পড়েছিলো। তখনো ওর লেখার সাথে আমার পরিচয় হয় নি। লেখার নিচে অসংখ্য পাঠক প্রতিক্রিয়া দেখে অনেকটা কৌতূহলবশতই পড়তে বসেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে গল্পটা পড়ে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়েছিলো, অদ্ভুত এক শূন্যতা ও বিষাদবোধে আক্রান্ত হয়েছিলাম। পাঠক ও গল্পের চরিত্রগুলোর মাঝখানের পর্দাটা সরে গেলেই এমনটা হয়। কোথায় যেনো শুনেছিলাম একটা গল্প তখনই প্রকৃত গল্প হয়ে ওঠে যখন গল্পটা হয় পাঠকের কাছে আয়নাস্বরুপ যে আয়নায় সে অহর্নিশ নিজেকেই দেখতে পায়।
আমার ভুল না হলে ওর প্রথম উপন্যাস “কিছু বিষাদ হোক পাখি” প্রকাশের পর সর্বোপ্রথম পাঠক আমিই ছিলাম। বি আর টি সি’র ডাবল ডেকার বাসে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকতে থাকতেই বইটা এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেলেছিলাম এবং ঠিক আগের মতোই এক অদ্ভুত বিষণ্ণতাবোধে আক্রান্ত হয়েছিলাম। এরপর এসেছে “এ শহরে মেঘেরা একা, মনোসরণি কিংবা কাকতাড়ুয়ার আকাশের মতো বেশ কয়েকটা ভালো বই। এর প্রায় সবগুলোই পড়ে ফেলেছি একে একে। এতে করে একসময় মুগ্ধতা ও তার লেখক সত্ত্বার প্রতি শ্রদ্ধার সাথে সাথে পাঠক হিসেবে বেশ কিছু দাবীও তৈরি হয়েছিলো। বিভিন্ন সময়ে ওকে জানিয়েও ছিলাম কিছু কিছু । একটা ছিলো এরকম যে তার গল্পের ভেতর ব্যক্তি মাহরীনের উপস্থিতিটা বেশ প্রকটা যা কি না অনেক সময়ই আমরা যারা ওকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি তাদের কল্পনার ক্ষেত্রে এক প্রকার প্রচ্ছন্ন সিমাবদ্ধতা তৈরি করে দ্যায়। সময় ও অভিজ্ঞতা মানুষকে প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ করে তোলে। একটা বড়োসড়ো বিরতি কিংবা জীবনযাত্রায় অবস্থানগত পরিবর্তন যেমন মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নানারকম প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ জুড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যহত করতে পারে তেমনি পারে স্বাতন্ত্রে ও বৈশিষ্টে পূর্বের তুলনায় অধিক পরিপক্ক ও যথাযথ করে গড়ে তুলতে। দেশ ছেড়ে প্রবাসে জীবন যাপন শুরু করার পর ওকে তাই নিতে হয়েছে অনেক বড়ো ঝুঁকি। কিছুটা দ্বিধা-দন্দ সাথে করেই বইটি পড়তে বসেছিলাম কেননা পরিবর্তনটা ঠিক কেমন হবে সেটা নিয়ে দু:শ্চিন্তাও ছিলো খানিকটা। গল্পক্রমে ‘হারাও’, ‘ডুব’ ও ‘বিদায়বেলা’ শিরোনামের ভেতর বিভিন্ননামে সর্বোমোট দশটি গল্প সাজানোর আইডিয়াটা নি:সন্দেহে অভিনব এবং পড়তে পড়তে খুব সহজেই তার চিন্তা-সূত্রের সরল সঞ্চরণটা স্পষ্ট চোখে পড়ে। রচনাকৌশল ও ব্যকরনগত ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়া কোন গল্পেরই ভালো মন্দ বিচারের সুনির্দিষ্ট কোন মানদন্ড নেই। গল্পের ভালো-মন্দ নির্ভর করে গল্পের প্লট ও চরিত্রের সাথে পাঠকের যোগাযোগের উপর। আর এই যোগাযোগ করিয়ে দেবার গুরু দায়িত্ব একজন লেখককেই করতে হয়। মাহরীনের গল্পের সবচেয়ে বড় শক্তি তার বর্ণনা কৌশল ও গদ্যের স্বতস্ফূর্ততা যা যেকোন পাঠককেই খুব সহজেই গল্পের ভেতর টেনে নিয়ে যেতে পারে। আমার ভেতরের দ্বিধা-দন্দ তখনই কেটে যেতে থাকে যখন দেখি সময় ও অবস্থানগত পরিবর্তন মাহরীনের কলমকে একটুও শ্লথ করতে পারে নি বরং করেছে আগের চেয়ে অনেক বেশী ধারালো, পরিপক্ক ও স্বতস্ফূর্ত। পড়তে পড়তে তাই আমি দৃশ্য থেকে দৃশ্যের ভেতর অবচেতনভাবেই ডুবে যেতে থাকি। গল্পকার হিসেবে এই বইয়ের অনেকগুলো গল্পেই সে নিয়েছে লেখার বিভিন্ন কৌশল নিয়ে পরিক্ষা-নিরিক্ষা করার ঝুঁকি যেটি মানদন্ডে কতটুকু উতরেছে সেটা আপেক্ষিক হলেও নিশ্চিতভাবে বলা যায় তাতে সম্ভাবনার আঁচটা স্পষ্ট ও প্রকট। বইয়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্প হলো “নয়নতারা কি জানে? মহুয়ার গুঞ্জরণে, মেরিনার মেঘমালা ও হেমন্ত। আমি নিশ্চিত এখানে পাঠক সম্পূর্ণ নতুন এক মাহরীনকে খুঁজে পাবেন এবং নিশ্চিত হবেন তার দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা ও প্রশ্বস্ততার ব্যপারে।
প্রতিটি শিল্পিরই একটা নিজস্ব জগত থাকে যেটি তার প্রতিটি শিল্পকর্মের মধ্যদিয়েই নানারুপ-বৈচিত্রে আবির্ভূত হয়। শিল্পির সেই জগত সদা নির্মীয়মান। মাহরীনের কল্পনার জগতের সাথে তার যে সমস্ত পাঠক অল্পবিস্তর পরিচিত আমি নিশ্চিত তারা “কাচবন্দি সিম্ফোনি” বইয়ের গল্পগুলোর মধ্যদিয়ে সম্পূর্ণ অভিনব সব দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হবেন।
বইটি শুরু করতে করতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ১০ টি ছোটগল্পে সাজানো এই বইটি। খুব সুন্দর করে প্রতিটি গল্পের নিজস্ব ভাব বা স্বকীয়তা ফুটিয়ে তুলেছেন। পড়তে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম বইটির মাঝে। দু'একটা যদিও অস্পষ্ট ছিল আমার কাছে কিন্তু তবুও মনে হলো নতুন কিছু। সবচেয়ে বেশি যে গল্পটি ভালো লেগেছে সেটি হলো "ফেলে আসা সুগন্ধি"। মনে হচ্ছিল আনিকা আর দ্যুতি আমার চোখের সামনেই স্কুলে আসা যাওয়া করছে, একসাথে বেড়ে উঠছে। কিন্তু কলেজে পা রাখতেই দুজনের মধ্যে দূরত্ব এসে যায়। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। বেশ অনেক দিন পর তাদের আবার দেখা হয়। সব মিলিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন লেখিকা। আমি ভীষণ উপভোগ করেছি বইটি পড়তে গিয়ে।
সাল ২০১৪ থেকে বছর ঘুরে আসার আগেই মুখিয়ে থাকতাম একুয়া রেজিয়া আপুর লেখার জন্য। উনার গল্প পড়ে কখনোই একটা "particular" ভাবনার জগতে আমি থাকতে পারিনি। বরাবরের মত এইবারও হাজারটা অনুভূতি খেলা করেছে।
"নিঝুম বিদায়বেলা" তেমনই একটা গল্প যেখানে কিছু লাইন পড়ে মনে মনে বলে উঠেছি 'বাহ্'। আর কিছু লাইন পড়ে মনে হল যেন "আমি হা করে আছি আর কেউ চামুচ ভরে ভরে বিষাদ ঢেলে দিচ্ছে আমার মধ্যে।" ঠিক যেন জীবনান্দ দাশের লেখা গ্লাসে করে ঘাসের ঘ্রান খাওয়ার মতন।
"চিরকুট" গল্পটা পড়ার সম্পূর্ণ মুহূর্ত আমি টাইম মেশিনে করে ১২-১৩ বছর আগে চলে গিয়েছিলাম! অবিকল আমার ছোটবেলার দিনের মতো! আম্মুর সন্দেহ, চোখ কটমট করে তাকানো, আমাকে ভুল বোঝা, আবার নিজের ভুল বুঝে আদর করতে আসা। জীবনের সেই সময়টা একটা রোলার কোস্টার রাইডে চড়ার মতোই, যেখানে কিশোরীবেলার ভয়, উত্তেজনা, আনন্দ সব একই সাথে কাজ করে। তবে গল্পের শেষটা যে এমনও হবে তা একবারও ভাবিনি! শেষটুকু আসলেই সারপ্রাইজিং ছিল!
"হয়তো নয়নতারা জানে"- গল্প নিয়ে ���টাই বলবো যে পৃথিবীতে কাউকে ভালো লাগা দোষের কিছু না। কাউকে দেখে লাস্টফুল চিন্তা ভাবনা আসাটাও হয়তো মানুষের বৈশিষ্টের মাঝেই পড়ে। কিন্তু এমন ভাবনা যদি নয়নতারাদের মতো মানুষকে শুধু দেখামাত্রই আসে, তাহলে তা হয়ত অসুস্থ মানুষিকতার পরিচয়। নয়নতারা কী? কিংবা কে? তা নিয়ে আসলেই আমি ভেবেছি খুব। এখানে নয়নতারা হয়ত হাসতে হাসতে গুলি করে দেওয়ার মতো অপূর্ব একটা সত্য। কিংবা হয়ত সে একটা শিক্ষা, একটা মেসেজ। যা অনেকের জানা উচিৎ।
"হেমন্ত" গল্পটা পড়ে আমার এই ব্যস্ত পৃথিবীর সব ছেলেমেয়ে আর তাদের মায়েদের কথা মনে হয়, এমন কি আমার মাও এই দলেরই মানুষ। আসলে একাকীত্ব শব্দটা ভারী এবং হাহাকার জাগানোর মত একটি শব্দ। আর ব্যস্ততার এই যুগে কার আছে একটু সময় প্রিয় মানুষটার খোঁজ নেবার! আর তাই এই শব্দের অনুভূতির কাছে হেরে যায় অনেক মানুষই, বিশেষ করে মায়েরা! এমন দিনগুলোতে সময় কাটানোর মতো বা কথা বলার মত আশেপাশে যাই থাক তাই যেন একটা সঙ্গী! মনের খুব কাছের একটা গল্প "হেমন্ত"।
"মেরিনার মেঘমালা" গল্পটি মেঘ নিয়ে আমার যাবতীয় সব ভাবনা সব কল্পনাকে কেমন যেন ধোঁয়াটে করে দিল। মনে পড়ে কলেজে পড়ার সময় কলেজ ম্যাগাজিনের জন্য একবার একটা ছোট গল্প লিখেছিলাম, নাম- "মেঘবালিকা"। আমার সেই মেঘবালিকারা তাদের জীবনের স্বপ্ন দেখতো আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের দিকে তাকিয়ে সবুজ ঘাসে বসে। গল্পটা আনমনে লেখা। আমি নিজেও জানতাম না এমন কিছু লিখব। কিন্তু তার পর থেকেই আকাশের মেঘের প্রতি অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো। যেন মেঘ এক টুকরো স্বপ্নবন্দী করার বাক্স! সিক্রেট বক্স!যেখানে সুন্দর সুন্দর সব স্বপ্ন লুকিয়ে রাখা যায় কেউ যেগুলো দেখতে পায় না, ছুঁতে পায় না। দুঃস্বপ্ন যেখানে দানা বাঁধে না। অথচ মেরিনার মেঘমালায় মেঘেরা কতো অন্যরকম!
"মহুয়ার গুঞ্জরনে" গল্পটি একটা ইংলিশ quotation এর কথা মনে করিয়ে দেয়, "Found the right one but at the wrong time, Why I had to find the right one at the wrong time" -আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে বৈশালী কি তাহলে সব আশা ছেড়ে দিলে কোন এক ভুল দিনে পাবে তার মিঃ রাইটকে?
"বিষাদের ডাকনাম" গল্পটি তাদের জন্য যাদের কাছে ভালবাসা আর অপেক্ষার সংজ্ঞা, গতানুগতিক সংজ্ঞার বাইরে। জীবনের সব অনুভুতিকে ছাপিয়ে যারা অনুভব করতে পারে, গল্পটি তাদের না ছুঁইয়ে পারে না। জাপানী্জ কুকুর Hachikō- এর গল্পের পর এইবার "বিষাদের ডাকনাম" গল্পটি আমাকে এতটা আবেগপ্রবণ করে ফেলেছিল যে আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা আর ভালবাসার সেই সংজ্ঞার জগতে তলিয়ে গিয়েছিলাম। যদি কেউ আমাকে এই একটা গল্পে তারকা দিতে বলত আমি গুনে গুনে ১২ টা তারকা দিতাম পাঁচ তারকার মাঝে!!
"ফেলে আসা সুগন্ধি" গল্পটি পড়ার আগে পর্যন্ত "হেমন্ত" গল্পটি ছিল মনের খুব কাছের গল্প। কিন্তু এখন আর তা বলা যাচ্ছে না, কারন আমার ভার্সিটি জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার সাথে অনেকটাই মিলে যায়। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে আমার জানা নেই মিলে যাওয়া চরিত্রটি আর ফিরে আসবে কিনা! কেউ ওকে বলবে কিনা ," তুমি ঘরটা পিছনে ফেলে চলে গিয়েছ"। আসলেই আত্নমগ্নতা একটি অসুখ। যে অসুখ চারপাশের মানুষের অনুভূতিগুলো টুকে টুকে ছিনিয়ে নেয়। "চৈতালি সন্ধ্যায় সারমিন ও আমি" গল্পটা মন খারাপ করার পাশাপাশি প্রচণ্ড উত্তেজনা সৃষ্টি করে শেষটুকু জানার। তাই কাল বৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ার মতো পাগলা হয়ে পড়ে ফেলি এক নিঃশ্বাসে। যদিও মন খারাপ এতটুকু কমেনা বরং বাড়েই। আর উত্তেজনা? সেটাও শেষ অবধি রয়েই যায়।
"উপহার" গল্পটি পড়ে আমার মনে হয়েছে এর থেকে সুন্দর ভাবে এই গল্প লেখাই সম্ভব না। এই বইয়ের সবচেয়ে ছোট অথচ বড় গল্প এটি। এইটাই জগতের সবচেয়ে বড় সত্য, সবচেয়ে বড় অনুভূতি। আমি গল্পটি শেষ করে মিনিট দশেক স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। "উপহার" যা বলে গেল, তা আমার মাঝে কোথাও যেন একটা শুন্যতা সৃষ্টি করে। খুবই সুন্দর, সত্য আর অসাধারন লেখা।
(শেষের কিছু কথা)- বরাবরের মতো চমৎকার লেখা। তবে লেখকের লেখা আর চিন্তার চেয়েও সাংঘাতিক তার সব কয়টি উপমা। কিভাবে মানুষ পারে এতো গুছিয়ে লিখতে, ভাবতে আর উপমা খুঁজে বের করতে আমার সত্যিই জানা নেই। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরানো কিছু গল্পের নতুন নতুন চিন্তা ধারা, আবার একেবারেই নতুন করে গড়া কিছু গল্প নিয়ে বইটা মন্দ তো নাই বরং বেশ ভালো।
এক সমুদ্র পরিমাণ এই জীবনের গল্পে আবেগ, উচ্ছলতা, আনন্দ আর বিষণ্ণতার ঢেউরা নানাভাবে সমুদ্রতটের মতো ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের কাছে একবার আসে, একবার চলে যায়। তারপর আবার আসে, আবার চলে যায়। মাঝে মাঝে আমরা বালিকণা হয়ে ভেসে গিয়ে হারাতে চাই, কিন্তু পারি না। অতঃপর কোন এক নিঝুম বিদায়বেলায়, আমাদেরকে বুকপকেটে একটি চিরকুট নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়; যেখানে লেখা থাকে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে আর ঠিক তার পরের দিন থেকে আমরা আবার বাঁচবো! এই গোপন চিরকুট এর খবর কেউ জানে না। শুধু কোন এক চৈতালি সন্ধ্যায় আমি ও আমরা যখন ব্যালকনির গ্রিলে মাথা লাগিয়ে দীর্ঘশ্বাস লুকোতে চাই, তখন হয়তো পাশের ছোট টবে বেখেয়ালে ফুটে থাকা নয়নতারাটা জেনে যায় আমাদের চিরকুটের কথা, আমাদের লুকোতে চাওয়া গোপন কথা! অতীতের যে গাছটা শেকড় গেড়ে বসে থাকে আমাদের মনে কিংবা মাথায়, আমরা চাই হেমন্ত এর শেষ সময়ের পাতা ঝড়ার মতো করে টপাটপ পড়ে যাক বিষাদের ডাকনাম নিয়ে গজিয়ে থাকা সে গাছের সব হলুদ পাতারা। অথবা, সমাজের তথাকথিত ভাল একটি ভবিষ্যতের জন্য পাহাড়ের ভালবাসা অগ্রাহ্য করা সেই মেরিনের মেঘমালারা ঠিক গাছটার সামনে এসেই, একদম ভেঙ্গে পড়ুক! সেখানে একটি ঝুম বৃষ্টি নামুক! ধুয়ে মুছে দিয়ে যাক সবটুকু, চিরতরে! কোন কোন দিনের শেষে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আমরা ভেবে ব্যাকুল হই, সবকিছু ঠিকঠাক করে দেওয়ার নাম করে শীতকে উপেক্ষা করে মহুয়ার গুঞ্জরনে কেন বসন্ত আসে না! অন্যদিকে আমার মতো অনেকেই যখন পালাতে চায়, সমুদ্র জীবন তখন আমাদেরকে কোন ঢেউ উপহার দিয়ে আবার একটি অনিশ্চিত জায়াগায় পৌঁছে দেয়। শহরের কোন এক সাধারণ রাস্তাকে অসাধারণ বানিয়ে আবার সেই রাস্তায় শেষ দেখা করা এই আমাদের হারিয়ে যাওয়ার গল্পটুকুও একসময় হারিয়ে যায়! আমরা কেউ কেউ নতুন গল্প খুঁজে ফিরি, আর নতুন পেলে পুরানো গল্পগুলো ভুলে যাই। কখনো কখনো বোকা মন ফেলে আসা সুগন্ধীর মতো পুরানো গল্পের চিরপরিচিত গন্ধ খুঁজে বেড়ায় নতুন গল্পগুলোতে! আপেক্ষিকতার কাঠকোট্টা সুত্রে মোড়ানো এই কাচবন্দী জীবনের ছোট ছোট অনুভুতিগুলোই এক একটি সুরের মতো করে গড়ে তোলে গল্পের সিম্ফনি। কাচবন্দী এমন অসংখ্য সিম্ফনির গল্প নিয়েই এবারের বইমেলায় প্রিয় মাহরীন ফেরদৌস নিয়ে এসেছেন তার গল্পগ্রন্থ “কাচবন্দী সিম্ফনি”।
“প্রথম হিসেবে যা হয়েছে ভালই হয়েছে” এমন একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু প্রথম প্রকাশনী হিসেবে ‘পেন্সিল’ বইয়ের প্রচ্ছদ ও বইয়ের পাতার মান নিশ্চিতকরণ এবং বুকমার্ক ফিতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের সুন্দর রুচী, মননশীলতা এবং বই এর প্রতি আন্তরিকতার যে ছাপ রেখেছে তা সত্যিকার অর্থেই অতুলনীয় এবং খুব প্রশংসার যোগ্য। প্রচ্ছদের স্রষ্টা হিসেবে নির্ঝর নৈঃশব্দ্য সবসময়ই দারুণ। তবে এই বইয়ের প্রচ্ছদ এর কথা একটু আলাদাভাবে বলতে হয়, কেননা বইয়ের নামের সাথে প্রচ্ছদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মনে হবে নানা রং এর ভিতর স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা প্রতিটি মুখাবয়ব একটি করে গল্প বলতে চাইছে আপনাকে! প্রতিটি গল্পের আগে অলংকর�� হিসেবে একটি করে আঁকা ছবি দেওয়ার মাধ্যমে লেখিকা তার বই এ আলাদা একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ব্যাক্তিগতভাবে বইয়ের এই অংশটুকু আমার খুব ভাল এবং ব্যাতিক্রম লেগেছে। এজন্য ফাইজা ইসলামকে ধন্যবাদ। বইয়ের গল্পগুলোকে তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। হারাও, ডুব এবং বিদায়বেলা। গল্পকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করার ব্যাতিক্রম এই উপস্থাপনার কৌশল, লেখিকা তার গত বছরের গল্প গ্রন্থ “গল্পগুলো বাড়ি গেছে” থেকে শুরু করেছেন। একজন পাঠক এবং শুভানুধ্যায়ী হিসেবে আমার অনুরোধ থাকবে, লেখিকা উপস্থাপনের এই ভিন্নতাটুকু তার পরবর্তী সব বইয়ে বজায় রাখবেন এবং এটাকে আলাদা একটি নতুন মাত্রা দিবেন।
নিঝুম বিদায়বেলা গল্পটি দিয়ে বইয়ের শুরু। খুব পরিচিত একটি থিম নিয়েই লেখা এই গল্প। তবে সে থিম উপস্থাপন বা বর্ণনার ধরণ একদম অপরিচিত। আর এখানেই এই গল্পের বিশেষত্ব! বিশেষত্ব এই কারণেই বলা, যখনই পাঠকের মনে ��বে ‘ও আচ্ছা গল্পটা তাহলে এই!’ ঠিক তখনই লেখিকা অল্প কিছু বর্ণনায় পাঠককে আবার নতুন করে ভাবার অবকাশ করে দিবেন এবং শেষ অব্দি পাঠকের আকর্ষন ধরে রাখবেন। আব্রাহাম লিংকন এর জীবনী পড়ে থাকলে অথবা “স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন” মুভিটা দেখে থাকলে, পাঠক প্রিকগনিটিভ ড্রীমের যে ধারণা আছে তার সাথে এই গল্পের সহজেই একটি রিলেশন তৈরি করতে পারবেন।
চিরকুট গল্পটি খুব সাধারণ গোছের। কাহিনী হালকা হলেও শেষে এসে টুইস্ট দিতে লেখিকা ভুলেননি! তবে যে দিকটি লেখিকার বিবেচনায় আনা দরকার ছিল বলে মনে হয়েছে তা হলো, বাকী সব গল্প পড়ার পর পাঠকের মনে হতে পারে এই গল্পটি কোনভাবেই বাকী গল্পগুলোর কন্টেন্ট এর সাথে ম্যাচ করে না।
সমসাময়িক ঘটনা কিংবা চিরাচরিত কিছু বিষয়, শুধুমাত্র বাক্যবুননের দক্ষতায় কিংবা উপস্থাপনের আলাদা ভঙ্গিতে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারা লেখিকা মাহরীন ফেরদৌস এর শক্তিশালী একটি দিক কিংবা কমফোর্ট জোন (Comfort Zone)। আর এজন্যই ছোট গল্পের লেখিকা হিসেবে তিনি বেশি জনপ্রিয়! তার এই দক্ষতা ফুটে উঠেছে হারাও পর্বের শেষ গল্প ‘হয়তো নয়নতারা জানে’ গল্পটির মধ্যে দিয়ে। পাঠকের মনে উপসংহার জানার কৌতুহল জাগিয়ে শেষ পর্যন্ত এক টানে পড়তে বাধ্য করবে গল্পটির ঝড়ঝড়ে বর্ণনা। ঘৃণা নাকি করুণা? কোন অনুভুতির রেশ নিয়ে পাঠক ভাববে সেটি লেখিকা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন গল্পের শেষ দু’লাইনের মধ্য দিয়ে।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে চলতে আমরা কখন আর কিভাবে একা হয়ে যাই তা আমরা বুঝতে পারি ঠিকই। তবে নিজের সাথে সাথে আশেপাশের কাছের মানুষগুলোকেও একা বানিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটুকু আমাদের অগোচরে থেকে যায়। ডুব পর্বের প্রথম গল্প হেমন্ত পড়ে পাঠক একাকিত্বের নৌকায় চড়ে ভাসতে থাকবেন বিষণ্ণতার নদীতে। মোমেনা আখতার চরিত্রের কোন না কোন এক পর্যায় এর সাথে পাঠক নিজের মিল খুঁজে পাবেন স্বাচ্ছন্দ্যে। আর এখানেই এই গল্পের কিংবা লেখিকার স্বার্থকতা।
পরের গল্পটির নাম মেরিনার মেঘমালা। মুগ্ধতা নাকি ভালবাসা? অভিমান নাকি অভিশাপ? স্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্ন? এমন দোটানা অনুভুতির রেশ থেকে পাঠক কোনটা বেঁছে নিয়ে কল্পনার রাজ্যে ডুব দেবে তা পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন লেখিকা। গল্পটির বিশেষত্ব বর্ণনায় এবং লেখিকার দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে। গল্পের মধ্যাবস্থায় এসে পাঠকের মন, গল্পের একটি পরিসমাপ্তি ধারণা করে নিতে চাইবে নিজে নিজেই। আর তখনই লেখিকা নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যত্ন সহকারে পাঠককে অন্য কল্পনায় নিয়ে যাবেন।
মহুয়ার গুঞ্জরণে গল্পটির তেমন কোন বিশেষত্ব নেই আমার কাছে। এ আমার ব্যাক্তিগত অভিমত। খুব সাদাসিধে বাস্তবিক এই গল্পটি নিজের মতো করে এগিয়েছে এবং শেষ হয়েছে। অনেক ধরণের বা অনেকজনের গল্প মিলে একজন মানুষের জীবনের গল্প কিভাবে তৈরী হতে পারে তার একটি উদাহরণ হতে পারে এই গল্পটি।
প্রাণহীন কংক্রিট এর যে দেয়ালজুড়ে আমাদের শৈশব বেড়ে উঠে, যে বাড়ির ছাদ জানে আমাদের প্রথম বৃষ্টিবিলাস, যে জানালা জানে আমাদের কাগজের দলায় ফেলে দেওয়া গল্পগুলো, সে সব নীরব দর্শকদের প্রতি আমাদের মায়া জমে যায় ধীরে ধীরে। এরপর সময়ের তারণায় আমরা নতুন দর্শক বানিয়ে নেই ঠিকই কিন্তু মায়া পড়ে থাকে পুরনোদের কাছে! বিষাদের ডাকনাম গল্পটি এমন মায়ার ই প্রতিচ্ছবি! ব্যাক্তিগতভাবে আমার আক্ষেপ, এই গল্পটি একটু তাড়াহুড়া করে শেষ করেছেন লেখিকা। আরও একটু সময় এই গল্পটার প্রাপ্য ছিল!
আগের গল্পের আক্ষেপ এক নিমিষেই ভ্যানিস করে দিয়েছে শেষ পর্ব বিদায়বেলা’র প্রথম গল্প ‘চৈতালি সন্ধ্যায় সামরিন ও আমি’ গল্পটি। কি হতে পারে এই গল্পের শেষ? এমন একটি কৌতুহল শুরু থেকেই তৈরী করে দিয়ে লেখিকা পাঠককে বাধ্য করেছেন একদম গল্পের শেষ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে পড়ে যেতে! এই গল্পটি পড়া শেষ করে “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ” টাইপের একটি অনুভুতি নিয়ে আমি কিছু সময় বসে ছিলাম। পাঠককে নিজের মতো করে ভাবনা তৈরি করে নেওয়ার জায়গাটুকু খুব সযত্নে লেখিকা বানিয়ে দিয়েছেন শেষ বাক্যগুলো দিয়ে, “পাশ থেকে সামরিন কিছু একটি বলে, কিন্তু আমি কিছু শুনতে পারি না। ভাবতে পারি না। শুধু রাতের আকাশের পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি একটি হলুদ পাতার জীবন মিলিয়ে যাচ্ছে সুদূর আকাশে।“ ব্যাক্তিগতভাবে এই গল্পটি আমার কাছে এই বইয়ের সবচেয়ে ভাললাগার গল্প।
সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং মায়ার বাঁধন মিলিয়ে জীবনের যে হিসেবী গল্প আমাদের কমবেশি জানা, তার একটি প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে ‘ফেলে আসা সুগন্ধী’ গল্পে। লেখকের নিজস্ব ধারার বা শক্তিশালী দিকের গল্প এটি। তাই এর ভাল দিক নিয়ে আর বিশেষকিছু বলার নেই।
বিদায়বেলা পর্বের এবং বই এর শেষ গল্প উপহার! গল্প না বলে বরং চমক বলা যায়। কথায় আছে “শেষ ভাল যার, সব ভাল তার”। এই বিশেষ গল্পটির মধ্য দিয়ে লেখিকা চমৎকারভাবে বই এর ইতি টেনেছেন। খুব স্বল্প বাক্যে, খুব সহজ একটি গল্প। তবে আমি বাজি ধরে বলতে পারি, যেকোন পাঠক একবারের বেশি অবশ্যই গল্পটি পড়বেন এর মুগ্ধতার রেশ কাটানোর জন্য অথবা মুগ্ধতার রেশ ধরে রাখার জন্য! প্রতিটি বইয়ে এক বা একাধিক বাক্য থাকে যা পাঠকের মনে গেঁথে যায়। আমি এর নাম দিয়েছি প্যান্ডোরা’স বাক্য। কাচবন্দী সিম্ফনি বইয়ের প্যান্ডোরা’স বাক্য এই গল্পের শেষ লাইন, “পৃথিবী একটি তৃষ্ণার্ত গ্রহ...... এখানে মা বাদে সবাই শুধু চায়, আর চায়।“
লেখিকা মাহরীন ফেরদৌস এর জন্য কাচবন্দী সিম্ফনি গল্পগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো তিনি নিজস্ব লেখার ধারা থেকে কিংবা কমফোর্ট জোন থেকে বেড়িয়ে এসে নতুন ধারার কিছু গল্প লেখার সাহস দেখিয়েছেন এবং আমার মতে উনার এই সাহসী পদক্ষেপ সফল হয়েছে। উনার সাহিত্য পড়া এবং লেখার প্রতি যে আন্তরিকতা এবং ভালবাসা আছে, তা বজায় থাকুক সবসময়। তাহলে আরও অনেক অনেক ভাল বই উনি পাঠকদের উপহার দিতে পারবেন ভবিষ্যতে। লেখিকার জন্য অনেক শুভকামনা রইলো।
পেন্সিল পাবলিকেশন্স থেকে আসা ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’ বইটি পাওয়া যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলায়। ঢাকা #৫৭৩ ও চট্টগ্রামে #৮১, #১১০। এছাড়াও বইটি অনলাইনে রকমারি, বইবাজার ও অথবা তে পাওয়া যাচ্ছে। মুদ্রিত মূল্য ২০০ টাকা।
আমি যদি ছোটগল্পের মোহে পড়ে থাকি তাহলে সেই মোহাচ্ছন্নতার অনেকাংশে জুড়ে থাকবে মাহরীন আপু লেখা। মানুষের লেখা স্নিগ্ধ হয় কিন্তু তা এতটা অসম্ভব স্নিগ্ধও যে তা জানা ছিল না!
মোট ন'টা গল্প আছে কাচবন্দি সিম্ফনির ফ্রেমে। চিরকুট গল্পটা নাইন্টিজের কিংবা আর্লি টুয়েন্টিজের নস্টালজিয়ায় মোড়ানো।চিরকুট যে শুধু প্রেমপত্র না হয়ে বন্ধুপত্রও হতে পারে তা আগে কেন ভাবিনি?
❝হয়তো নয়নতারারা জানে❞ গল্পটা নিতান্তই যৌনতায় ভরপুর। কিন্তু তবুও সেই যৌনতার বিষাদ সেই অদ্ভুত তাচ্ছিল্যভরা হাসিটার জন্যই ভাবিয়েছে।
❝হেমন্ত❞ আর ❝মেরিনার মেঘমালা❞ আমায় ভাবিয়েছে মানুষের সম্পর্ক গুলো কতটা বিচিত্র হয়।শরীরের সম্পর্কের চাইতে আত্মার কিংবা মনের সাথে গেঁথে যাওয়া সম্পর্ক গুলো বিষণ্ন সুন্দর।গল্প দুটো অদ্ভুত ঠেকলেও ভালো লেগেছে।
❝মহুয়ার গুঞ্জরনে❞ বৈশালীর ২১ টা শরীরী বোঝাপড়া হওয়ার পরও যখন সে মন কিংবা আত্মার প্রশান্তি দিতে পারে কাউকে পেল না তখন মনে হয়েছে মানুষের একটা জীবন কতটা অসহায় ভাবে কেটে যায়।পারিবারিক অশান্তি বাচ্চাদের গ্রোথ সিস্টেমে কতটা বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় লেখিকার এই গল্পে তা উপলব্ধি করা যায়।
বইয়ের সবচেয়ে ভালো লেগেছে শেষের দিকে দ্বিতীয় আর তৃতীয় হওয়া গল্প দুটো। “চৈতালি সন্ধ্যায় সামরিন আর আমি” গল্পটা পুরোদস্তুর মনস্তাত্ত্বিক। কি হচ্ছে তা নিয়ে প্রোটাগনিস্টের মতো পুরো গল্পজুড়ে আমিও ভেবেছি কিন্তু লেখিকা শেষের দিকে আর খোলাসা করেননি দেখে রাগ হয়েছে কিন্তু এই গল্পটাও মন ছুঁয়েছে। আর ❝ফেলে আসা সুগন্ধি❞ গল্পটার অপুর সাথে নিজেকে সবচেয়ে বেশি রিলেট করতে পেরেছি।গল্পের অপু এ দেশের মধ্যবিত্ত গড়পড়তা প্রতিটা ছেলের প্রতিনিধিত্ব করে যার চওড়া কাঁধ কিংবা সদা হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী হয়তো নেই কিন্তু কাউকে লুকিয়ে ভালোবাসার বাস্তব ইচ্ছে টুকু আছে আর অপরদিকে আনিকার চরিত্র টুকু আমার একটি ছোট্ট বোন না থাকার আক্ষেপটুকু আবারও বাড়িয়ে দিয়েছে।আর দ্যুতির জীবনটা আমাদের সবারই বড্ড চেনা।
বইয়ের শেষ ❝উপহার❞ নামের গল্প দিয়ে।শেষ দেখেই কি তাড়াহুড়ো হলো কিনা বুঝতে পারলাম না।
দশটি ছোট গল্পের সমন্বয়ে বইটি লেখা।একটা গল্প শেষ হলে সমস্যা নেই আরেকটা গল্প আছে পরে। গল্পের পর গল্প পড়তে ভাল লাগে। কিন্তু এই বইয়ের এক একটা গল্প মন্ত্রমুগদ্ধকর। এক গল্পের রেশ কাটিয়ে আরেক গল্পে যেতে কিছুটা সময় লাগে। কেমন জানি দুঃখ সুখ মিশ্রিত অনুভূতি লাগে। গল্পগুলো ভাবিয়ে তুলে কল্পনা আর বাস্তবতাকে। চিরকুট আর উপহার গল্প দুইটি বেশি ভাল লেগেছে আমার। হেমন্ত গল্পটি আবেগপ্রবণ ছিল। হয়তো নয়নতারা জানে আর মহুয়ার গুঞ্জরনে গল্প দুইটিতে বর্তমানকালের কঠিন ও কদাকার রূপ ফুটে উঠেছে। অন্যান্য গল্পগুলো আপন মহিমায় মহিমান্বিত।
লেখিকা ফেসবুকে একুয়া রিজিয়া নামে বেশ বিখ্যাত ছিলেন। বইয়ের দুটো ছোটগল্প এই সুবাদে আগেই পড়া ছিলো। বইয়ের 'মেরিনার মেঘমালা' গল্পের মেরিনা নামের ইন্সপিরেশন সম্ভবত আমার চাচী।
আমি ছোটগল্প পড়ি না বহুদিন...কেন জানি মনোযোগ রাখতে পারি না, দুটো গল্প পড়ার পর হয়তো বইটা পড়েই থাকে....
এজন্যই এই বইটার কথা বারবার শোনার পরও বাদ দিয়ে গেছি, যদি জানতাম কী বোকার কাজ করলাম!
বই না বলে যদি এটাকে "অনুভূতির বাক্স " বলি ভুল কিছু হবে না, প্রতিটি গল্পের আলাদা একটা স্বকীয়তা, মায়া আছে....চরিত্রগুলি চোখের সামনে ভাসে, চিন্তাগুলি আপন আপন লাগে - এটা তো আমিই ভাবতাম বা নিজেই দেখেছি, এমনকিছু...
আবার ধোঁয়াশা কিছুও আছে, যাতে শুরুতে মনে হয় অজানা কিছু একটা দেখতে যাচ্ছি কিন্তু শেষপর্যন্ত জানা জিনিসটাই চোখের সামনে উপস্থিতি জানিয়ে চলে যায়...
অনেকদিন পর এবার কিছু ছোটগল্প পড়লাম যেইগুলি আমি শেষপর্যন্ত সমান আগ্রহ নিয়ে পড়েছি, কী হবে সেইটা নিয়ে মাথাও ঘামাইনি...