বকুলের গন্ধ মনকে মুহূর্তেই মোহনীয় করে তুলে; আবার টেনে নেয় অজানা বিপদের দিকে।
মেয়েটির সাথে তৃতীয়বারের মতাে দেখা, আশ্চর্য! এতগুলো বছরেও তার চেহারার কোনাে পরিবর্তন হয়নি, এ হতেই পারে না।
প্রথমবার দেখা হয়েছিল কৃষ্ণনগর রেলস্টেশনের পথে - খুব বৃষ্টির রাত, ঘুটঘুটে অন্ধকার চরাচরে; বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শােনা যায় না। হুট করে কেউ এসে ছাতা ধরে মাথার উপরে, কিন্তু তাকে দেখতে পাই না, একটা গন্ধ পাই শুধু। গন্ধটা বকুল ফুলের। রিনরিনে নূপুরের শব্দ শুনে বুঝি, মেয়ে মানুষ। জিজ্ঞেস করি, 'এত রাতে!' সে বলল, “ভিজে যাচ্ছিলেন, এগিয়ে দিয়ে গেলাম; কিন্তু কুড়ি মিনিটের মধ্যেই ফিরে যাবেন।' চমকে উঠি, কুড়ি মিনিটেই কেন ফিরতে হবে। মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করতেই সে অদূরে দাঁড়ানাে কদম গছি লাগোয়া বাড়িটা দেখিয়ে বলল, ‘মশাই, ঐ বাড়ির নামেই আমার নাম।'
দ্বিতীয়বার মেয়েটিকে দেখি কৃষ্ণনগর জমিদারমহলের ছাদে, ভর সন্ধ্যায় মোমবাতি নিয়ে হাঁটছে, শরীরে ভারী গহনা। জমিদারমহলের সাথে দাঁড়িয়ে বিশাল কদম গাছ, মহলের নাম ফলকে লেখা - "স্মিতা মহল, ১২১৭ বঙ্গাব্দ"।
বকুল ফুলের গন্ধে ট্রেনের কামরা মােহিত, আশপাশে কেউ নেই। খুট করে শব্দ হলাে। আঁতকে উঠে বলি, 'কে?' 'আমি মশাই, আমি। স্মিতা চৌধুরানি। ভয় পাবেন না, ট্রেনের বগি মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে গেছে।'
নীলাসাগর গ্রাম। এখানে তিনটি কবর - লম্বা ভিটা, ময়লা ভিটা আর নতুন ভিটা; এ গ্রামের মেয়েরা অদ্ভূত কারণে হারিয়ে যায়। গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে লাহুর নদী। লাহুর নদীর পানিতে মিশে আছে কৃষ্ণনগর জমিদারের ইতিহাস, সেই ইতিহাসের খোঁজ চলে নীলাসাগর, হিরমুখী আর কৃষ্ণনগরের মাঠে-ঘাটে, শ্মশানে, কবরে।
রাতের অন্ধকারে নদীর ঘাটে নৌকা থামে, নৌকোয় নিঃশব্দে উঠে যায় এক রমণী - যার শরীরভর্তি গুটি টিওমার... স্মিতা পলকেই নিজেকে আড়াল করে।
রাতের ট্রেনে করে গ্রাম থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে এক যুবক। লক্ষ্য একটি জিনিস পৌঁছে দেয়া। ট্রেনে দেখা হয়ে গেল রহস্যময়ী এক নারীর সাথে। ঠিক তখনই দুর্ঘটনা ঘটলো ট্রেনে। সবকিছু ফেলে মেয়েটির সাথে ট্রেন থেকে মাঝরাতেই অজানা গ্রামে নেমে পড়ল যুবক। ঘটতে থাকল একের পর এক বীভৎস, ভয়ঙ্কর ঘটনা। কে এই মেয়ে? সত্যি কি তার অস্তিত্ব আছে নাকি শুধুই মায়া? কি তার উদ্দেশ্য? যুবকটি বা কি এমন মূল্যবান সম্পদ বহন করছে যার জন্য তাকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে অতিপ্রাকৃত অস্তিত্বের?
বকুল ফুল মনোয়ারুল ইসলাম রচিত অতিপ্রাকৃত নভেলা। ফিকশনে সম্ভবত উনার প্রথম বই এটি। মফস্বল আবহে গড়ে উঠেছে গল্পের কাহিনী, এক পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িকে কেন্দ্র করে। অতৃপ্ত আত্মা, জমিদার বাড়ির রহস্য এগুলো আমাদের সাহিত্যে পুরাতন। এগুলোকেই নতুন রূপে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে বকুল ফুল বইটাতে। শুরুর দিকে কাহিনীর ব্যাখ্যা খুবই এলোমেলো লেগেছে। কয়েক জায়গায় মনে হয়েছে জোর করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। গা শিউরে ওঠার মত দৃশ্য বর্ণনা করে লেখক এক্ষেত্রে খুব একটা সফল হননি। তবে চুয়ান্ন পৃষ্টার পর একটা বড় অধ্যায় কাহিনীর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে গল্পের উন্নতি হয়েছে, ছন্নছাড়া ভাবটা ছিল না। বিড়াল হত্যার একটা দৃশ্য মোটামোটি অস্বস্তিকর ছিল। শুরুর দিককার এলোমেলো রহস্যের জট তখন থেকেই খুলতে আরম্ভ করেছিল তবে শেষে গিয়ে তাড়াহুড়োর ছাপ দেখা গেছে। ভিলেনের ব্যাকস্টোরির অতিস্বল্প ব্যাখ্যায় কিছুই স্পষ্ট হয়নি। কিছু রহস্য সমাধান না করলেও মোটামোটি এন্ডিং দিয়েছেন লেখক। মোটামোটি ছিল গল্পটা। হরর/ অতিপ্রাকৃত প্রেমীদের ভালো লাগার কথা। বইটার এডভান্টেজ হল লেখনী ভালো হওয়ার কারণে দ্রুত পড়ে ফেলা যায়। তবে বানান ভুল লক্ষ করেছি বহু জায়গায়। র্য সবজায়গায়-ই র্য হয়ে গেছে। বইয়ের সিক্যুয়েল আছে বিড়ালাক্ষী নামের। পড়ার ইচ্ছা আছে সামনে।
(ছোট্ট একটি বইয়ের এত উচ্চমূল্য সত্যিই বিব্রত করেছে আমাকে। প্রকাশনার এই দিকটা একটু খেয়াল রাখা উচিত 🙂। রিভিউয়ের সাথে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও কথাটা সত্যি)
মাত্রই পড়ে শেষ করলাম বইখানা। জাত লেখকের লেখা কয়েক লাইন পড়লেই কিন্তু চেনা যায়। মনোয়ারুল ইসলাম জাত লেখক! অদূর ভবিষ্যতে ভালো করবেন। বইটা কলেবরে বড় না, ছোট বই। কাহিনীও তেমন ভালো লাগেনি আমার। এলোমেলো সব। কি হচ্ছে না হচ্ছে মনোযোগ দিয়েও বুঝতে কষ্ট হচ্ছিলো। তবে লেখার জন্য বইটা নামানো কঠিন! সুন্দর লেখেন। আমার ধারণা তিনি কন্টেম্পরারি জনরায় বেশ ভালো করবেন। বকুলফুল একটা ট্রিলজি বর্তমানে। আরও দুটি বই বেড়িয়েছে।'বিড়ালাক্ষী' আর এবছর বের হওয়া 'বাঁশি'। মূল প্রোটাগনিস্ট/এন্টাগোনিস্ট এর বিশদ বিবরণ না পেলেও এই বইতে, সামনের বইগুলোতে পাওয়া যাবে আমার ধারণা। বইটা অতিপ্রাকৃত ধরণের। আমি কিনেছিলাম সামাজিক উপন্যাস ভেবেই যদিও, লেখা কয়েকলাইন পড়েছিলাম মেলায়। ভালো লেগেছিলো। পরে জানলাম এটা এই জনরার। কেনার অনেকদিন পর পড়া হলো। পরের দুটো বই পড়বো কিনা জানিনা, তবে লেখককে আমি সাধুবাদ জানাতে চাই!
২০১৯ বইমেলায় কিনলেও পড়তে অনেক দেরি হয়ে গেল। সাধারণত আমি নতুন বই কিনলে ফেলে রাখি, ফিরেও তাকাই না। পুরনোগুলোই শেষ হয় না! মাঝে মাঝে চোখে পরলে মনে হয়, 'এটা এখনও পড়া হয়নি কেন?' 'পড়তে হবে' এই টাইপ অবস্থা। যাই হোক শেষ করলাম। কেমন লাগলো?
প্রথমেই আসি লেখকের কাছে, তিনি ঠিক কি চেয়েছেন পাঠকের কাছে-
১. কৌতূহলঃ বক্তার সম্পূর্ণ পরিচয়ের প্রতি কৌতূহল, স্মিতা চৌধুরানীর প্রতি কৌতূহল, কি হচ্ছে, সামনে কি হবে! ফলাফল: কৌতূহল সৃষ্টি তিনি করতে পেরেছেন। একটা আকর্ষণীয় আবহও তৈরি করতে পেরেছেন 'বকুল ফুলের সুবাসিনী' কে ঘিরে। যার কারণে বইটা শেষ না করা পর্যন্ত কিছুটা খুঁতখুঁত রয়েই যায়।
২. ভয়ঃ রাতে হুট করে নির্জন স্থানে ট্রেন থেমে যাওয়া, ট্রেনের সব যাত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, অপরিচিতার সাথে 'ভয়ংকর' সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া, একের পর এক নৃশংস সব বর্ণনা। ফলাফল: সত্যি বলতে ভয় একেবারেই পায়নি। কেমন যেন সব সাজানো নাটক। স্মিতার সাথে ট্রেন থেকে নামার পরের সব অভিজ্ঞতা আমার কাছে ছোটবেলায় খেলা 'জম্বি কিলিং' গেমগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। একরাতের এত লম্বা চওড়া বর্ণনা পড়তে যেয়ে বারবার রেখে দিতে ইচ্ছে করছিল।
৩. চিরাচরিত প্লটের সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপায়ণঃ অভিশপ্ত জমিদারবাড়ির গল্প নতুন রূপে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা। ফলাফল: এই ক্যাটাগরির কিছু পড়েনি, শুনেনি বা টিভি সিরিয়াল, মুভিতে দেখেনি এমন কাউকে পাওয়া খুব কঠিন। তবুও লেখক চেষ্টা করেছেন চিত্র এক রেখে ফ্লেভারটা আলাদা করতে। শুরুর ১০০ পৃষ্ঠার মতো এরকম কিছুই খুঁজে পাইনি। কেমন একটা পানসে পানসে ভাব। তবে শেষাংশে লেখক বাজিমাত করেছেন এটা বলতেই হয়।
৪. পাঠকদের মনে প্রশ্ন (যেহেতু এটার সিক্যুয়েল বের হয়েছে) জাগিয়ে তোলাঃ কিছু প্রশ্ন আসলেই থেকে যায়। যেমন রুক্মিণী চৌধুরীর ব্যাপারটা পুরোটাই চোখের আড়ালে থেকে গেছে। তার এতো শক্তির উৎস কোথায়? স্মিতার মুক্তির পর তার কি হলো? সবচেয়ে বড় কথা বক্তার ক্ষমতা সম্পর্কে হালকা ইঙ্গিত করলেও লেখক খোলাসা করে কিছু বলেননি। ফলাফল: এসব প্রশ্নের উত্তর কি আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে? এমনটা না। তবে দ্বিতীয়টা আমি এটা পড়ার আগেই কিনে রেখেছি। কোন একসময় পড়ে ফেলব!
+এবার আসি সামগ্রিকভাবে লেখক কতটুকু সার্থক? ভূমিকায় বইটা নিয়ে তার পরিশ্রমের কথা তিনি বলেছেন। তার মেয়ে লেখা বারবার নষ্ট করে ফেলছিল। ঠিকই করছিল হয়তো! আমারো তাই মনে হয়। গল্পটা যদি আরো ছোট হতো। শেষাংশে তাহলে তাড়াহুড়োর ছাপ চোখে পরতো না। বইটাও এক নিঃশ্বাসে শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারতাম। এখন ব্যাপারটা হয়ে গেছে সালাদের 'কিছু' সবজি পঁচা- এর মতোন!
তিন তারা দেয়ার মতো না। সবমিলিয়ে ২.৫ দেয়া যেতে পারে। যাই হোক, আশা করি বিড়ালাক্ষী- থেকে আরো ভালো কিছু পাব।
মেয়েটির সাথে তৃতীয়বারের মতো দেখা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে চেহারার কোন পরিবর্তন নেই। কীভাবে সম্ভব?
প্রথমবার যখন দেখি তা দশ বছর আগের ঘটনা। বৃষ্টির জল চোখেমুখে মেখে হাঁটছি হঠাৎ কোত্থেকে এসে মাথায় ছাতা ধরে এক আগন্তুক। মুখাবয়ব দেখি না, শুধু বকুলের গন্ধ পাই।নূপুরের শব্দ শুনে বুঝি, মেয়েমানুষ। এত রা���ে একলা একটা মেয়ে কীভাবে ঘর থেকে বের হলো জানতে চাইলে সে বলে, 'আপনি যেভাবে বের হলেন' তা বলে এত রাতে! সে উত্তর দিল, 'ভিজে যাচ্ছিলেন,এগিয়ে দিয়ে গেলাম।কিন্তু বিশ মিনিটের মধ্যেই ফিরে যাবেন' বিশ মিনিট! চমকে উঠি। সে কি আমাকে ভয় দেখাতে চায়?
মেয়েটির নাম জানতে চাইলে কাছেই দাঁড়ানো কদম গাছ লাগোয়া বাড়িটা দেখিয়ে বলল, 'মশাই, ঐ বাড়ির নামেই আমার নাম'
রহিম চাচা কৃষ্ণনগর জমিদার বাড়ি নিয়ে গল্প বললেন।গল্পটি এরকম, " স্মিতামহলের ছাদে রাতের বেলায় এক তরুণী হাঁটে মোটা মোমবাতি হাতে নিয়ে,তার গায়ের রঙ খুব ফরসা নয়। জমিদারের মেয়েরা যতটা সুন্দরী হয় ততটা নয়। মেয়েটা হঠাৎ হাসে।আবার হুহু করে কাঁদে,তখন গ্রামের কুকুর-বিড়ালেরাও কুঁইকুঁই করে খুব করুণভাবে কাঁদে।যে রাতে মেয়েটার কান্নার শব্দ শোনা যায় সে রাতে গ্রামের কেউ জরুরি প্রয়েজনেও ঘর থেকে বের হয় না।এমন এক কান্নার রোল উঠেছিল অনেক আগে এক অনাবশ্যার রাতে।তখন শীতকালও না আবার বর্ষাও না; তবুও টিনের চালা বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে জমানো কুয়াশার মতো। ওই রাতে তিনজন মারা যায়,রহস্যময়ভাবে তিনজনই পুরুষ এবং তিনজনই বাসর রাতে মারা গেছে।"
সতর্ক করে দিলেন যেন জমিদারবাড়ির এলাকায় চলাকালীন কখনো পিছনে ফিরে না তাকাই।কিন্তু কান্নার শব্দে আমি কৌতূহলপরবশ হয়ে পিছনে তাকালাম।দ্বিতীয়বার মেয়েটিকে দেখলাম।ভর সন্ধ্যায় মোমবাতি নিয়ে হাঁটছে,শরীরভর্তি গহনা। মহলের নামফলকে লেখা ''স্মিতা মহল,১২১৭ বঙ্গাব্দ"। মহলের ছাদে দাঁড়ানো মেয়েটি হাত নাড়িয়ে আমাকে ডাকছে।
ট্রেনের কামরায় বকুলফুলের গন্ধে ভুরভুর করছে। পাশের ছিটে এক অপরিচিত তরুণী।তরুণী কিছু জিজ্ঞেস করলে বলি, 'অপরিচিত কারো সাথে কথা বলি না' -এখানে অপরিচিত কে মশাই? চমকে উঠি মশাই সম্বোধনে। স্মিতা চৌধুরাণী!!
মেয়েটা আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।এই আছে এই নেই হয়ে যায়।চোখের পলকে কোথায় হারিয়ে যায়। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হলো।ট্রেন ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে স্পিড কমিয়ে নিল।ভাবলাম ট্রেন থামবে।কিন্তু তরুণী আমাকে চমকে দিয়ে সাবলীলভাবে বলে, ট্টেন থামেনি।দুই ভাগ হয়ে ছিঁড়ে গেছে। কী আশ্চর্য!!
স্মিতা চৌধুরাণী আমার মনের কথা আগে থেকে টের পেয়ে যায়।আমার ব্যাগে কী আছে সব জানে সে।রহিম চাচা আমাকে একটা পোটলা দিয়েছেন।যা আমার ব্যাগে রাখা। কী আছে তাতে আমি জানি না।কিন্তু স্মিতা বলে, পোটলার জিনিস পেলেই নাকি সে মুক্ত! কী আছে পোটলাতে!
নীলসাগর গ্রামে তিনটি কবর আছে। লম্বা ভিটা,ময়লা ভিটা আর নতুন ভিটা।এ গ্রামের মেয়েরা অদ্ভুতভাবে হারিয়ে যায়।তাদের খবর কেউ জানে না।গ্রামের মধ্যদিয়ে লাহুর নদী বয়ে গেছে। নদীর পানিতে নাকি মিশে আছে কৃষ্ণনগরের জমিদারের রক্তরঞ্জিত ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পেছনে ছুটে চলি নদ-নদী,মাঠ-ঘাট, শ্মশান পেরিয়ে কবরে।
রাতের অন্ধকারে ঘাটে নৌকা এসে থামে। নৌকায় নিঃশব্দে এক মহিলা উঠে যায়।যার শরীরভর্তি গুটি টিউমার।স্মিতা নিজেকে সন্তর্পণে আড়াল করে রাখে। কেন?
বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত ঘটনাতে আমি হকচকিয়ে যাই।ফিরে যেতে চাই।কিন্তু স্মিতা বাধা দেয়।
'আমাকে রেখে আপনি যেতে পারেন না।আমি ছাড়ব না আপনাকে।প্লিজ আপনি যাবেন না'
স্মিতার কাজল চোখের কোণে শিশিরের মতো অশ্রুকণা।অজানা অপরিচিত যুবকের জন্য এই তরুণীর কীসের মোহ! কীসের মায়া! নাকি অন্যকিছু মায়ার আড়ালে!
রুক্মিণী চৌধুরী আমেরিকাফেরত ডাক্তার।কৃষ্ণনগর এর সাথে তার কী সম্পর্ক? সে ও চায় পোটলার মধ্যকার বস্তু যা রহিম চাচা আমাকে দিয়েছিল। কী আছে এতে? জমিদার বাড়ির সাথে কী সম্পর্ক জিনিসটার?
সবকিছুর উত্তর আছে 'কৃষ্ণনগর জমিদার বাড়ি'
পাঠ প্রতিক্রিয়া: অতিপ্রাকৃত জনরার উপর বরাবরি আমার একটু বেশি ভাললাগা কাজ করে।এ বইটাও ব্যতিক্রম না। আনাচেকানাচে টুইস্ট লুকিয়ে আছে। পড়তে নিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে বইটা আকৃষ্ট করে রাখবে। শেষ করে নিজের অজান্তেই বলে উঠবেন, এটা লেখকের প্রথম উপন্যাস? সিরিয়াসলি?
প্রথম উপন্যাস হিসেবে বইটা অসাধারণ।বর্ণনাভঙ্গি এবং বাক্যালাপ চমৎকার। বর্ণনা শৈলী দেখে খুব সহজেই আন্দাজ করা যায় লেখক শুধু ভালো লেখক নন ভালো পাঠক ও বটে!
বইয়ের বাঁধাই সুন্দর। বানান ভুল খুব কম চোখে পড়েছে। তবে কিছু স্থানে দুটি শব্দের মধ্যকার স্পেস ব্যবহৃত হয়নি।যেমন, গন্ধবাজেভাবে (গন্ধ বাজেভাবে), মাজানলে (মা জানলে) ইত্যাদি। প্রিন্টিং মিস্টেক আরকি!
বইয়ের নাম বকুল ফুল ঠিক আছে।কিন্তু বকুল ফুলের গন্ধটা খুব বেশি করে,বেশিবার হাইলাইট করা হয়েছে।যা এতবেশি ব্যবহার না করলেও হতো বলে মনে হয়েছে। রুক্মিণী চৌধুরীর পরিচয়টা খোলসা করা হয়নি।করলে ভালো হতো।
লাশ বা বীভৎস খুনের বর্ণনা অনেক বেশি। অতিপ্রাকৃত করতে গিয়ে লেখক হয়তো এগুলো ব্যবহার করেছেন।মাঝখানে একটু বিরক্ত বোধ হয়েছিল।কিন্তু রহস্য আমাকে থামতে দেয়নি। সর্বোপরি বইটা ভালো।
মনে করুন এক বৃষ্টির রাত। খেয়ালের বশে ছাতা ছাড়াই বাইরে বেড়িয়েছেন। ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি পড়ছে, গ্রামের মেঠো পথ অন্ধকার। পাশ থেকে মাথায় ছাতা ধরলো কে জানি! শাড়ি পরা শ্যামবর্ণ মেয়েটি, অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না। শুধু শুনতে পাবেন তার নুপুরের টুংটাং আর বকুলের ঘ্রাণ।
'ভয় পাচ্ছেন?' মনের কথাটাও যেন টের পায় সে। তার কাছ থেকে আর মুক্তি নেই, অশরীরী হলেও সে বকুল ফুলের মতই মায়াময়, তীব্র নেশা তার উপস্থিতিতে। তার প্রেমে পড়বেন না সে সাধ্যি আপনার নেই!
আসুন, ঘুরে আসি কৃষ্ণনগর গ্রাম থেকে। পুরনো জমিদারবাড়ির ছাদে ঘুরে বেড়ায় মেয়েটি, স্মিতা মহলের স্মিতা চৌধুরানী। গল্পকথকের সাথে তার দেখা হয়ে যায় বারেবার। গভীর রাতে ট্রেনের কামরায় পাশে এসে বসে স্মিতা। চায়ের কথা বলে একরকম জোর করেই ট্রেন থেকে নামিয়ে আনে কথককে। ভুতুড়ে এক গ্রাম নীলাসাগর, বুক চিরে বয়ে যায় লাহুর নদী।
সে গ্রামে কবরস্থানে গোর দেওয়া হয় বেওয়ারিশ লাশ, কেউ জানে না কোথায় হারিয়ে যায় গ্রামের তরুণীরা। সারা শরীরে টিউমার এক নারীমূর্তির, কবরে কি যেন খুঁড়ে চলে যায় দ্রুত। প্রচন্ড ভয় গ্রাস করে, স্মিতার মায়াময় চলনের ফাঁকে ফাঁকেও অশুভ কিসের আভাস!
নীলাসাগর এর ভয়াবহ রাত থেকে স্মিতা কথককে বুক আগলে রক্ষা করে। কিন্তু অতিপ্রাকৃত কিছুর অস্তিত্ব পিছু ছাড়লো না। আবার ফিরে যেতে হবে কৃষ্ণনগরে, সেখানেই সব প্রশ্নের উত্তর। কি চায় রহস্যময় রুক্সিনী চৌধুরী? স্মিতার মুক্তির চাবিকাঠি কি? এতোগুলো বীভৎস মৃত্যু কেন ঘটে যাচ্ছে?
'বকুলফুল' যত্নে লেখা অতিপ্রাকৃত উপন্যাস। গল্প বলা হয়েছে বর্ণনামূলক উত্তম পুরুষে, কোথাও মূল চরিত্রের নাম উল্লেখ করা হয় নি। অতিপ্রাকৃত অংশগুলো গা শিউরানোর মত, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। স্মিতার অশরীরী ভয়ংকর ভাবটা আভাসিত রেখেও মায়াবীনি দিকটা কথকের সামনে তুলে ধরার ঢং-টা ভালো লেগেছে।
বইয়ের প্রচ্ছদ আর বাঁধাই এর মান খুবই ভালো। গল্পের শেষের দিকটা গতানুগতিক লেগেছে। কিছু প্রশ্নের উত্তরও খাপছাড়া। প্রাচীন জমিদার বাড়ির মেয়ে হিসেবে স্মিতার নামটা কি অন্যরকম হতে পারতো? আমি ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলাম না!
ভৌতিক উপন্যাস যারা ভালোবাসেন, তারা কোন এক বৃষ্টির রাতে বইটা নিয়ে বসে পড়তে পারেন।
উপন্যাস : বকুলফুল লেখক: মনোয়ারুল ইসলাম প্রকাশকাল : #বইমেলা ২০১৯ প্রকাশনী: নালন্দা প্রকাশনী
গল্পকথকের সাথেে শ্যামবর্ণের মায়াবী মেয়েটির দেখা হয়েছিল মূলকাহিনীর দশ বছর আগে। সে সময়ে তিনি থাকতেন কৃষ্ণনগর গ্রামে। তাদের বাড়ির কাছেই এক জমিদার বাড়ি। জমিদারের নামে গ্রামের নাম। গল্পকথকের অভ্যেস ছিল রাতে-বিরাতে ঘুরে বেড়াবার। তখনই তার ���্রথম দেখা মেয়েটির সাথে। রাতের নির্জন রেলস্টেশনের পথে। প্রথমে মেয়েটিকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেও মেয়েটি কিন্তু নিতান্ত আপনজনের মতো ব্যবহার করে তার সাথে। কে এই মেয়ে? কিছুদিন বাদে তারা সপরিবারে চলে আসেন কৃষ্ণনগর থেকে।
দশ বছর পরের কথা। হিরণমুখী জংশন থেকে রাতের মেইল ট্রেনে যাত্রী হলেন গল্পকথক। ততোদিনে মেয়েটির কথা ভুলেও গিয়েছেন তিনি। পুরানো মায়া গিয়ে জমেছে মনের কোণায় কোনো ভুলে যাওয়া কুঠুরীতে। কিন্তু স্মৃতি আবার ফিরে এলো জীবন্ত হয়ে। ট্রেনের কামরায় তার সাথে একজন মেয়ে এসে উঠলো। সেই দশ বছর আগের মুখটি। স্মিতা চৌধুরানি। আশ্চর্য! এত বছরেও তার চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় নি!
ট্রেন ছাড়ার চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট পার হবার আগেই সেটি পড়লো দুর্ঘটনায়। ট্রেন ছিন্ন হয়ে দু'ভাগে ভাগ হয়ে অচল পড়ে রইলো রাতের আঁধারে। স্মিতার উৎসাহে ট্রেনের কামরা ছেড়ে চায়ের খোঁজে হাড়কাঁপানো শীতের রাতে বাইরে বেরিয়ে এলেন গল্পকথক। কোথায় চা, কোথায় কি?
কামরা ছেড়ে রাস্তায় বের হবার পরই ঘটতে লাগলো উদ্ভট সব ঘটনা। নীলাসাগর গ্রামের পথে জমাট অন্ধকারের রাত্রিতে একের পর এক রহস্য আবির্ভূত হতে থাকলো। গল্পকথকের অবস্থা হলো অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাবার মতো। যে পরিস্থিতির কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। স্মিতা কেন তাকে বের করে নিয়ে এলো বাইরে?
কিছুক্ষণ বাদে টের পায় তারা কবরখানার মধ্যে দিয়ে হাঁটছে। এখানে কি কাজ তাদের? এই গ্রামের কাহিনীটাই বা কি? মানুষগুলো হারিয়ে কোথায় যায় এখানে? চলতে চলতে যে বীভৎস লাশগুলো চোখে পড়লো, সেগুলোই বা কার কাজ? স্মিতা কেন ভয় পায় না কোনো কিছুতেই? এতোকিছুর মধ্যে রুক্সিণী চৌধুরীর ভূমিকা কি? স্মিতা ছুটছে কিসের আশায়?
পাঠ-প্রতিক্রিয়াঃ
"IT ENDS WITH US" বইটা পড়ার পর থেকেই ভাবছিলাম রিডার্স ব্লকে পড়ে গিয়েছি। শেষমেশ চিন্তা করলাম পড়বো পড়বো করে রেখে দেওয়া "বকুল ফুল"-টাই পড়া হোক তবে।
বাংলায় অতিপ্রাকৃত জন্রার বই খুব বেশি সংখ্যক বের হয় তা না। পারসোনালি আমার অসম্ভব পছন্দের একটা জন্রা। সেজন্যই এতো আগ্রহ নিয়ে শুরু করা।
উত্তম পুরুষে লেখা হয়েছে পুরো উপন্যাস। একবসায় শেষ করতে পারবেন। যেই তালে শুরু হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই শেষ হয়েছে। কোথাও বোরড হবার সুযোগ নেই। জমিদারবাড়ির পটভূমিকায় যে কাহিনীটা বর্ণনা করা হয়েছে - আমার অনেক ভালো লেগেছে।
কাহিনী যতটুকু বর্ণনার দরকার ঠিক ততোটুকু করা হয়েছে। এই জিনিসটাই বেশি দারুণ লাগল যে অতিরঞ্জন নেই কোথাও। চরিত্র বর্ণনার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
বইয়ে বেশকিছু বানান ভুল ছিল যেটা খানিকটা দৃষ্টিকটু লেগেছে। আশা করি পরবর্তী মুদ্রণে এসবে নজর রাখা হবে। ওভার-অল, নতুন বই হিসেবে সকলের পড়া উচিত বলে মনে করি☺️
গল্প পড়লাম না এক খানা বেশ ভালো স্বপ্ন দেখলাম? এই প্রশ্নই বই শেষ করার পর মনে জাঁকিয়ে বসেছে। ♥️ 💞 স্বপ্ন যেমন হয়, এলোপাথাড়ি মাথামুন্ডু হীন কিন্তু তাও আপনার মন কিছু কিছু করে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে, তেমনি এই গল্প। 💞 একটা সম্পূর্ন ভৌতিক গল্প তার মধ্যে মিশে আছে সেই প্রেমের মন কেমন করা একটা ভাব। আর তাতে গড়িয়ে যেতে যেতেই বইয়ের আদ্দেক শেষ। ওই শুরুতে প্রেমে যেমন হয় "বেশ তো চলছে, চলুক না।" সময় কেটে যায়, ভালো লাগার অবশ অনুভূতিতে আটকে থাকেন। এই গল্পও ঠিক সেই অনুভূতিতে ডুবিয়ে রাখবে।🫂💗 শেষের দিকে গল্পের বেগ একদম সপ্তমে উঠে সুন্দর পরিণতিতে। 172 পাতার বই, খুব জোর দুদিনের সময় দিতে হতে পারে। একদম হালকা মেজাজে একটা ভৌতিক কাম রোমান্টিক থ্রিলার সেরে ফেলুন দেখি।
যদিও কিছু প্রশ্ন থেকে যাবে, যা পরের বইয়ে হয়ত উত্তর মিলবে, দেখা যাক। 🌝
আমি খুব একটা রিভিও লিখি না কেননা আমি এই ব্যপারে পারদর্শি না। আপনি জানেন যে আপনার পাশের জন মানুষ নয় কিন্তু তবু আপনি তাকে উপেক্ষা করতে পারছেন না .. কি একটা আকর্ষনে আপনি মোহিত হয়ে আছেন .. রহস্যগল্প হিসেবে কিন্তু বেশ সুন্দর একটা বই। লেখক খুবই সাবলীল ভাবে লিখেছেন । যদিও এখনো বেশ কিছু প্রশ্নের উওর জানা বাকি..পুরো বইয়ে বকুলের সৌরভ নিয়ে এতোবার বলা হয়েছে যে কিছুটা বিরক্তি এসে গিয়েছিল ।😒 এছাড়া বাকি সব কিছুই ভালো লেগেছে .. লেখক মনোয়ারুল ইসলামকে শুভ কামনা ।
গল্পটা ভাল। সহজ সরল বলা যাবে না, লেখনশৈলির কারণে একটা উচ্চ মার্গিক ব্যাপার আছে বইটাতে। লেখনি উন্নতমানের হওয়ার ব্যাপারটা একই সাথে ভাল, আবার খারাপ।
ভালঃ প্রতিটা বাক্যে এক ধরণের কাব্যিক রসবোধ অনুভূত হয়, যেন গল্প নয় কাব্য। সাধারণ গল্পকেও অসাধারণ বানিয়ে তোলে।
খারাপঃ লেখনশৈলির কাব্যিক ছন্দে যখনই কোন লাইন মিলে না তখনই ছন্দ কেটে যায়। কাব্যিক অনুভূতিটা নষ্ট হয়। কাব্যিক যে নেশা জাগে বইটা পড়লে সেটা মরে যায়। এমন জায়গায় বিরুক্তি লাগে।
গল্প অতটা কৌতুহল তৈরি করতে পারেনি যতটা না লেখনিটা পড়ে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছে। বই এর বল যে লেখনি তাই যখন কিছু কিছু বাক্যে এসে নিজের মার্গ মিস করে যায় তখন আর জমজমাট ভাবটা থাকে না। তাছাড়া বানান ভুলও এক্সপেরিয়েন্সে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
ভৌতিক মানে হরর জনরার সাথে আমি পরিচয় খুব বেশি নয় তবে ভৌতিক প্লটে এমন কাব্যিক ধাচটা কেমন জানি লাগে। পিছনে মরণ লেগেছে আর এদিকে ভীত লেখকের মাথায় কাব্যিক চিন্তা-ধারা পেন্ডুলামের মত দোদুল্যমান।
মেইন ক্যারেক্টারকে আসলই ভাল লাগে নাই। একাধিক প্রশ্ন মনে জাগিয়েছে বইটা। যেগুলোর উত্তর মিলেছে কিন্তু মনকে তৃপ্ত করে নাই। আর কিছু প্রশ্নের উত্তর দ্বিতীয় বইয়ের জন্য হয়ত তোলা আছে।
ক্রিপি সীনগুলো ক্রিপি ফিল করিয়েছে তবে এগুলোর ঘনত্বটা জমে নাই। যার সাথেই দেখা হয় সেই খতম।
বিঃদ্রঃ স্মিতা নামটা উল্লিখিত টাইম পিরিয়ডের সাথে যায় না। তৎকালীন হিন্দু হাউজ হোল্ডে এমন নামের প্রচলন ছিল বলে জানা নেই।
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ আমি অতিপ্রাকৃত বিষয়ক বইগুলো এড়িয়ে চলি। তবে এবার অনেক দিন ধরে ই চিন্তা করছিলাম যে শুরু করেই দেই সেই থেকে বকুল ফুল নিয়ে বসে পড়া৷ বেশ ভালো লেগেছে বইটা। সেক্ষেত্রে লেখকের গল্প বলার ধরণ সবার আগে প্রশংসের দাবীদার, এক টানা পড়ে ফেললাম কোনো ধরনের বিরক্তি কাজ করে নি, যথাযথ স্টোরিটেলিং। সবগুলো মুহুর্ত এমনভাবে তুলে ধরেছেন প্রত্যেকটা মুহুর্ত ফিল করা যাচ্ছিলো। বেশ সাসপেন্স ছিল, টুইস্ট ও ছিল অনেক। তবে হরর বা অতিপ্রাকৃতিক বই পড়ার যে ভয় টা পেয়েছিলাম তেমন একটা ভয় কাজ করেনি। স্মিতা চরিত্রে স্টোরি টাইম���র সময় বকুল ফুল এর ঘ্রাণের আবহের দিক টা বেশ ভালো লেগেছে৷ গ্রামীণ চরিত্রগুলোর আচরণ ও ভাষাগত দিক টা সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন, ঘটনাস্থল গুলোর অনেক বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তবে ক্যারেক্টার বিল্ড আপ এ আরো কাজ করার সুযোগ ছিল। চরিত্রগুলো সাথের যোগসূত্র নিয়েও আরো বিস্তারিত আলোচনা করা যেত সম্ভবত। যেহেতু নভেলা সেক্ষেত্রে এবিষয়ে খুব একটা অভিযোগ করাও যায় না। বই এ একটা লাইন বেশী ভালো লেগেছে "প্রকৃতি মানুষ কে দুঃখ কষ্ট দেয়। আবার তা সারিয়ে তুলতেও সাহায্য করে"। জলের গানের "বকুল ফুল" গানটার ছোট্ট অংশ তুলে দেয়া হয়েছে৷ সেখানে একটা ছোট্ট ভুল আছে লিরিকে। বই এ কিছু জায়গায় ধোঁয়াশা রয়ে গেছে, বই এর শেষে বিড়ালাক্ষী নামক সিকুয়েল এর কথা উল্লেখ আছে আশাকরি সেখানে উত্তর খুঁজে পাবো।
"বকুলের মালা শুকাবে, রেখে দেব তার সুরভী!" বকুল ফুল নাম শুনলেই আমার এই গানটি মনে পড়ে। তবে বকুল ফুল পড়ার পর থেকে মনে পড়ে রহস্যময়ী "স্মিতা চৌধুরানী" ও "স্মিতা মহল, ১২১৭ বঙ্গাব্দ" এই উক্তিটি! বৃষ্টিস্নাত রাতে দেখা হওয়া রমণীর দশ বছর পরেও অপরিবর্তিত থাকা, হঠাৎ করে পেছন থেকে এসে তার "মশাই" সম্বোধন ও উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্য বকুল ফুলের মোহনীয় গন্ধ আভাষ দেয় একটি অতিপ্রাকৃত ঘটনার। কৃষ্ণনগর জমিদারবাড়ীর জমিদারিত্ব নিয়ে কোন্দল ও পরবর্তীতে রুক্সিনী চৌধুরীর আগমন ও তার কর্মকান্ড খুবই সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। নামহীন গল্প কথক, তার জন্মের বিস্ময়কর ঘটনা, তাকে ঘিরে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা, ট্রেনের বগি ছিড়ে যাওয়া এবং মৃত্যুর ভয়ানক যে বর্নণা দিয়েছেন তা আসলেই গা ছমছম করা অনুভূতি এনে দিয়েছিল মনে। সব মিলিয়ে অতিপ্রাকৃত ঘরনার এই বইটি পড়লে সময় নষ্ট হবেনা একদম ই! বই শেষ করেই এর সিক্যুয়াল পড়তে আপনি বাধ্য হবেন! বিঃদ্রঃ গল্প কথকে আমি বারবার লেখককেই কল্পনা করছিলাম।
পাঠ - প্রতিক্রিয়া: মনে করুন একদিন জোছনা রাতে বের হয়েছেন নিজের গ্রামে হাটার জন্য। হাটতে হাটতে মনোমুগ্ধকর জোছনা দেখার ঘোরে পড়ে গেছেন আর ভুলক্রমে চলে এসেছেন পরিত্যাক্ত একটি কবরস্থানে।সংবিৎ ফিরে পাবার পর আপনি যখন বাড়িতে ফেরত যাবার চেষ্টা করলেন তখনই দেখলেন পরিত্যাক্ত সেই কবর স্থানে এক রুগন ব্যক্তি হারিকেনের সাহায্য নতুন কবর খোড়ছে।পাশে রাখা লাশটা থেকে রক্ত চুইয়ে পড়েছে যেটা কবর দেওয়া হবে। কেমন হবে আপনার অবস্থা? যখন মনোয়ারুল ইসলামের বইগুলোর নাম দেখি তখন সমকালীন বইই মনে করেছিলাম। কিন্ত এর কয়েকদিন পর জানতে পারি এগুলো হরর। তাই কয়েকদিন আগে বকুল ফুল শেষ করলাম। বইটাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ রোড ট্রিপ হরর। গল্প কথক চরিত্র ট্রেনে ভ্রমণে অনেক অতিপ্রাকৃত ঘটনার মুখোমুখি হয়। দেখা হয় দশ বছর আগে স্মিতা মহলের রহস্যময়ী চরিত্র স্মিতা চৌধুরানীর সাথে। অনেক রহস্য এই চরিত্র নিয়ে। নীলসাগর গ্রামে পদে পদে গল্পকথক অনেক ভয়ংকর ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে। আর স্মিতার সাহায্য তা থেকে পার হবার উপায় খুজছে। দ্বিতীয় ভাগ বলতে গেলে রহস্য উন্মোচনের ভাগ। কেনো গল্পকথকের সাথে এসব অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে চলছে এর উদ্দেশ্য কি তা জানতে গল্প কথক চলে যায় কৃষ্ণনগরে তা অনুসন্ধানে। সেখানে পদে পদে ওত পেতে থাকে ভয়ংকর সব বিপদ। এই প্রথম মনোয়ারুল ইসলামের লেখা পড়লাম। চমৎকার লেখনী উনার। সেজন্য বইটা পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো আমার চোখের সামনে সব ঘটে চলছে। এটা হবার আরেক কারণ হচ্ছে গল্পটা বলা হয়েছে উত্তম পুরুষে, কোথাও মূল চরিত্রের নাম উল্লেখ করা হয়নি। সেজন্য পাঠক নিজেকে সে জায়গায় বসিয়ে নিতে পারবেন অনায়াসে। কয়েকটা অতিপ্রাকৃত ঘটনা গুলো গা শিউরানো। কবরের আর ধানের আইলের দিকের বর্ণনা গুলো গেঁথে গিয়েছে মাথায়। এর পরের গুলো আবার ভয় অনুভব করাতে পারে নি।স্মিতার চরিত্রটাকে রহস্যজনক রেখেও একটা রোমান্টিক দিক তুলে ধরতে পেরেছেন লেখক সফল ভাবে। কিছু জায়গায় মনে হয়েছিলো জোর করে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে আসল ঘটনা থেকে অন্য দিকে। এটা একটুউ ফ্লো নষ্ট করেছে। মানে একটা অতিপ্রাকৃত ঘটনা হচ্ছে কিন্তু হুট করে প্রধান চরিত্র স্মৃতিচারণে আরেক ছোট অতিপ্রাকৃত ঘটনা বলছে। প্রথম দিকে কিছু খাপছাড়া মনে হয়েছিলো গল্প এরপর ৬০ পেজে এসে সুন্দর এগিয়েছে। বইয়ের নামটাও যুতসই লেগেছে। কোনো বইই আমি এক্সপেকটেশন নিয়ে পড়ি না এজন্য আমি উপভোগ করতে পারি বই। হরর বই সম্পর্কে কম জানা আছে। খুব কমই পড়েছি। তাই এটা ভালো লেগছে দুই একটি বিষয় ছাড়া।
সত্যিই দারুণ লেগেছে বকুল ফুল সিরিজের এই বইটি। গৎবাঁধা ভৌতিক কোন উপন্যাস নয় তা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তবে লেখক যেরকম সহজ আর সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন পাঠকের কাছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। লেখককে ধন্যবাদ এরকম একটি উপন্যাস পাঠকদের উপহার দেয়ার জন্যে।
স্মিতা চৌধুরানির সাথে কথকের ( নাম বলা নাই) দশ বছর আগে দুইবার দেখা হলেও এবারের দেখা হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথম দুই দেখায় মেয়েটাকে যেরকম অদ্ভূত আর রহস্যময় মনে হয়েছিল, এবারও তার ব্যতিক্রম না, উপরন্তু সারা দেহে বকুলের গন্ধ বয়ে বেড়ানো মেয়েটি যেন আরো রহস্যময় হয়েছে। এবার তার সাথে দেখা হল চট্টগ্রাম অভিমুখী ট্রেনের কামরায় যখন অজ্ঞাত কারণে ট্রেনের অর্ধেক ছিড়ে পড়েছে পানিতে!
এরপর শুরু হলো এক দীর্ঘ রাত। চা খেতে বেড়োনো দুজন প্রত্যক্ষ করল অনেক কিছুই। কাটা মস্তক, সারা দেহে টিউমার ভর্তি মহিলা, অনেক গুলো বিভৎস মৃত্যু, লম্বা ভিটা, ময়লা ভিটা আর নতুন ভিটা কবরস্থান, বেশ কিছু শ্মশান। তার শুধু একটাই চাওয়া ব্যাগের ভেতরের জিনিসটা যা তার মুক্তি ঘটাবে!
এদিকে যে রহিম চাচা তাকে জিনিসটা চট্টগ্রাম পাঠাতে দিয়েছিল সে এসে হাজির হয় কথকের সামনে, কেননা সে তো তা পাঠাতে পারে নি। বঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয় এক নতুন নায়িকা রুক্সিনী চৌধুরানি সেও চাই সেই জিনিসটা অর্থাৎ সিংহের থাবাযুক্ত আংটিটা। কেন? কি এর বিশেষত্ব? এই দুই চৌধুরানির কেন এই একই আংটির উপর দাবি?
তখন আবিষ্কৃত হয় এক নতুন কাহিনী। আংটিটা কৃষ্ণনগরের জমিদারের প্রতীক! আর সেই জমিদারির জন্যই যুদ্ধ চলছে এক অশরীরী আর এক মৃত্যুর কারবারির! কে পাবে আংটিটা? কথকের তাতে ভূমিকাই বা কি?
রহস্য, রোমাঞ্চ আর অতিপ্রাকৃত ঘটনাবলীর বই বকুল ফুল। একদিকে যেমন আপনি মুগ্ধ হবেন, মায়ায় পড়বেন, ভালবেসে ফেলবেন স্মিতা চৌধুরানিকে অন্যদিকে ঠিক তেমনি ভীত হবেন, রোমাঞ্চিত হবেন আবার কখনো বা অবাক হবেন তার কাজকর্মে। একদিকে কাটা মস্তক, বিভৎস লাশ, লাশ চুরির ঘটনাগুলো যেমন আপনাকে ভয় পাইয়ে দেবে অন্যদিকে আংটির রহস্য আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করবে। স্মিতার আগমণের সাথে সাথে পাওয়া ৬২ বার ( সত্যি আমি গুনেছি!) বকুল ফুলের গন্ধের বর্ণনা শুনে কখন যে আপনি ইট, সিমেন্টের রুমে বসেও বকুলের গন্ধ পেতে শুরু করবেন তা আপনি টেরও পাবেন না!
এসব বইয়ে যা হয়, সব ধরনের ঘটনা ঘটে রাতে আর নায়কের গাড়ি বা অন্যকিছুরও কেমন করে যেন দেরি হয়ে যায় তা এই বইয়েও হয়েছে! এছাড়া বেশকিছু বানানও ভুল রয়েছে। তবে চমৎকার প্রচ্ছদ আর অসাধারণ সব চরিত্রগুলো এসব খুব বেশি ভাবতেও দেয় নি।
তবে বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাকি বইটার যার উত্তর আসবে হয়তো সামনের ফেব্রুয়ারিতেই। সে পর্যন্ত অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে বইটার দ্বিতীয় পার্টটার জন্য।
বই : বকুল ফুল লেখক : মনোয়ারুল ইসলাম জনরা : অতিপ্রাকৃত, আধিভৌতিক প্রকাশনাী : নালন্দা প্রকাশনী প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর পৃষ্টা সংখ্যা : ১৫২ মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০১৯
◾▪️কাহিনী সংক্ষেপঃ-
মেয়েটির সাথে এই নিয়ে তিন তিন বার দেখা। আশ্চর্য! এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তার চেহারায় কোন পরিবর্তন হয়নি!
★ বৃষ্টিস্নাত কোনো এক মধ্য রাতে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে হাঁটার সময় আমি প্রথম আবিষ্কার করি বকুল ফুলের ন্যায় এক অপার্থিব সুঘ্রাণ। কিন্তু এই মধ্যে রাতে কোথায় থেকে এত সুন্দর এক অপার্থিব সুঘ্রাণ আসছে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। চারপাশ নিস্তব্ধ! পায়ের নিচে বৃষ্টির পানির ছপাৎ ছপাৎ শব্দ ছাড়া কোন শব্দই শোনা যায় না। কোন এক আচমকা ঝড়ো হাওয়ার মতোই আমি হঠাৎ'ই উপলব্ধি করি ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা থেকে আমাকে রহ্মা করার জন্য কে যেন আমার মাথার উপর একটি ছাতা ধরিয়ে আছে। আর পরিচিত কন্ঠের মতো বলছে, এই যে মশাই ভয় পাওয়ার কিছুই নেই; আপনি যে কারনে বের হয়েছেন আমিও ঠিক সে কারনেই বের হয়েছি! আমি অবাক! এই মধ্যে রাতে অচেনা এক মেয়ে কিভাবে আমাকে পড়ে ফেলছে?? আমি বিস্ময়ের চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে,কিন্তু চারপাশ এতোই অন্ধকার মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছোনা। শুধু এতটুকু উপলব্ধি করতে পারছি, মেয়েটির শরীরে পরা নীল শাড়ি থেকেই সেই এক অপার্থিব সুঘ্রান চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে!
★ দ্বিতীয় বার মেয়েটির সাথে আমার দেখা হয়ছিলো কৃষ্ণনগর জমিদার বাড়ির মহলের ছাঁদে। সাঁঝ সন্ধ্যায় শরীরে ভারী গহনা জড়িয়ে মোমবাতি হাতে নিয়ে মেয়েটি হাঁটছে। যখন তার চোখের সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময় হলো, তখন মনে হয়েছিলো কোন এক অপার্থিব টানে সে যেন আমাকে তার কাছে ডাকছে! আর বলছে, প্লিজ কাছে এসো..... জমিদার মহলের সাথে দাড়িয়ে আছে বিশাল এক কদম গাছ। সেই সাথে মহলের নাম ফলকে সুন্দর করে লেখা "স্মিতা মহল, ১২১৭ বঙ্গাব্দ"।
★ গল্পটি শুরু হয় তৃতীয় বার মেয়েটির সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই। আমি যাচ্ছি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে রাতের ট্রেনে করে। সময়টা শীতকাল এবং সেই সাথে বেশ রাত হওয়াতে খুব একটা যাত্রী নেই ট্রেনের কামরায়। ট্রেনের কামরায় উঠেই দুটো ফাঁকা ছিট দেখতে পেলাম। ব্যাগটা উপরে রেখেই আমারছে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা। জানিনা কতহ্মন ঘুমালাম, মুহুর্তেই উপলব্ধি করলাম বকুল ফুলের সুগন্ধ ট্রেনের কমরা মোহিত। তাকিয়ে দেখলাম আশেপাশে কেউ নেই। খুট করে শব্দ হলো। আৎকে উঠে বলি,‘কে’? আমি মশাই, আমি। স্মিতা চৌধুরানী! অবাক হলাম, এই মেয়ে এত রাতে আমার পাশে কি করছে? নিজের অজান্তেই ভয় পেয়ে গেলাম, স্মিতা আশ্বস্ত করে বললো, ভয় পাবেন না মশাই ট্রেনের বগি মাঝ খান থেকে ছিঁড়ে গেছে!
ট্রেনটা যেখানে নষ্ট হলো সেই গ্রামটার নাম নীলাসাগর। বুঝতে পারলাম সময়টা মধ্যরাত। হঠাৎ স্মিতা বলে উঠলো এই যে মশাই, এভাবে ট্রেনে বসে থাকবেন! ট্রেনতো আজ ঠিক হবে না চলেননা বাহির থেকে একটু ঘুরে আসি। ভয়ে ভয়ে ট্রেন থেকে নামলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেক দূর চলে আসলাম। হঠাৎ'ই আমি ফোনের ফ্লাশ অন করাতে স্মিতাকে দেখতে পেলাম। এই কনকনে শীতে স্মিতার শরীরে একটি পাতলা নীল শাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। তার চোখ জোড়া শীতল দৃষ্টিতে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম তাকে পূর্ণ আলোতে দেখতে পেলাম। তার নীলাভ পীতজোড়া ডাগর ডাগর চোখ যে করোরই প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো। এ যেন রাতের পরী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এর কিছুহ্মন পরেই তার হাতের সাথে আমার হাত স্পর্শ হয়। সাথে সাথে মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা শীতল স্রোত বয়ে গেছে। খুব ভয় পেয়ে গেলাম, এত ঠান্ডা হাত মানুষের নাকি??
স্মিতার সাথে সাহ্মাৎটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হলোনা। কিন্তু এর পরবর্তীতে যা ঘটবে তার জন্যে আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। চারপাশ নিস্তব্ধ, যে দিকে তাকাই দুচোখ জুড়ে শুধুই সরিষা হ্মেত। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যায়না। আস্তে আস্তে কুয়াশার প্রলেপ ভারী হয়ে আসছে। আমরা হাঁটছি দুজনে। কোন এক কারনে হঠাৎ'ই স্মিতা উদাও হয়ে যায় আমার পাশ থেকে। আমি ভয় পেয়ে যাই। সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর নিজেকে আবিষ্কার করি একটি চায়ের দোকানে। জ্ঞান ফিরে পাবার পরই তাদের জিজ্ঞেস করি তাদের, আমার সাথে যে মেয়েটি ছিলো আপনারা কি তাকে দেখেছেন?? তারা সবাই অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছে আর তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁসছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা....
হাঠাৎ'ই আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। চারপাশ থেকে সেই চিরচেনা বকুল ফুলের ঘ্রান ভেঁসে আসছে নাকে। আমি স্মিতা বলে ডাক দিয়েই তার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। দুজনেই আবার হাঁটতে থাকলাম ঘন জঙ্গলের দিকে। এতোই ক্লান্ত লাগছিলো আমার শরীর তাই একটু মাঝপথে দাঁড়ালাম। বুঝতেই পারিনী এই ঘন অন্ধকারে কোন যায়গায় দাড়িয়ে আছি। পাশ থেকে স্মিতা বলে উঠলো, এখানে তিনটি কবর আছে, লম্বা ভিটা,ময়লা ভিটা আর নতুন ভিটা। এই গ্রামের মেয়েরা অদ্ভুত কারনে হারিয়ে যায়। যারা হারিয়ে যায় তাদেরকে আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়না। এই গ্রামের মাঝখান দিয়েই চলছে লাহুর নদী। লাহুর নদীর পানিতে মিশে আছে কৃষ্ণনগর জমিদারের ইতিহাস, সেই ইতিহাসের খোঁজ চলে এই নীলাসাগর, হিরনমুখী আর কৃষ্ণনগর মাঠো-ঘাঠে, শ্মশানে,কবরে। তারপর আমরা আবার চলতে থাকি। চলতে চলতে দেখি স্মিতা আবার আমার পাশে নেই, উদাও হয়ে গেসে সে। আমি দাঁড়িয়ে আছি একা এক গোরস্থানের সামনে। আচমকা এক গোড় খোদক আপন মনে কবর খুড়ছেন যাচ্ছেন একটা পোস্টমর্টেম করা লাশকে কবর দিতে। আমি ভয় পেয়ে যাই। তারো কিছুহ্মন পর সেই গোড় খোদক লাশটি কবর না দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আমি তার নাম ধরে ডাকতে থাকি। কোথাও তার কোন সাড়া শব্দ নেই। এক পর্যায়ে তার ছিন্ন ভিন্ন মৃত লাশ দেখতে পাই। আমি ভয় পেয়ে যাই, কেনো আমার সাথে এইসব হচ্ছে! আচমকা বকুল ফুলের গন্ধ উপলব্ধি করছি, আমি স্মিতাকে দেখতে পাচ্ছি। সে আমার পাশেই। সে জোরে জোরে হাঁসছে, আর বলছে এই গোড় খোদক তার পাপের শাস্তি পেয়েছে হা হা হা হা...। আমি তার ভারী কন্ঠ শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
আমরা আবারো হাঁটতে লাগলাম। এবার ঘন জঙ্ঘল পেরিয়ে আমি আর স্মিতা হাঁটতে হাঁটতে আমরা লাহোর নদীর পাড়ে চলে এলাম। আচমকা নদীর ওপাশে একটা নৌকা থামে,নৌকার নিঃশব্দে উঠে যায় এক রমনী-- যার শ���ীর ভর্তি গুটি গুটি টিউমার... স্মিতা পলকেই নিজেকে আড়াল করো নেয়। কেনো এই মেয়েটিকে দেখে স্মিতা আড়াল করে নেয় নিজেকে??,কেনোইবা সে আমাকে চুপ করে থাকতে বললো?? আমার ভেতরে প্রশ্নগুলো কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে....
নীলাসাগর থেকে ফিরে কয়েকদিন শরীর বেশ খারাপ গিয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনী জ্বরের তাপে। রহিম চাচা আমার সাথে দেখা করার জন্যে এসেই বসে আছেন দুপুর থেকে। একটু পর রহিম চাচা আমার পাশে এসে বসলেন। মনে মনে কি যেন আউড়ালেম। ‘’তাইলে কামডা তুমি করতে পারলানা!’’ কী কাজ চাচা?। তিনি চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময় ফুটিয়ে তুলেন, পরোহ্মনেই হো হো করে হেসে দিলেন। তোমারে যে জিনিসটা দিছিলাম, ভুইলা গেলা মিয়া! এই জিনিসের লাইগা রুক্সিনী চৌধুরী আমারে জ্বালাইতেছে বহু দিন থেইকা। রুক্সিনী রানি! তুমি কি আমাকে তার সাথে দেখা করার জন্যেই চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলে? রহিম চাচা ভ্রু কুচকালেন.....
এখন সব কিছু আস্তে আস্তে আমার মনে পড়ছে। রহিম চাচা আমাকে একটা গোপন একটি জিনিস দিয়েছিলেন চট্টগ্রামে রুক্সিনী চৌধুরীর নিকট পৌছে দেওয়ার জন্য। তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেনন এই জিনিসটি মহা মুল্যবান। কারো হাতে যেন না পড়ে! কিন্তু আমি সে কাজটা করতে পারিনী। চাচা সেই জিনিসটি নেওয়া জন্য তিনি আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি ইতিমধ্যে মিথ্যে বলেছি সেটা আমি ট্রেন এক্সিডেন্টে হারিয়ে ফেলেছ���। চাচা রাগে গড়গড় করে তিনি আমার রুম থেকে বের হয়ে গেলেন........
হঠাৎ মনে হলো সেদিন যখন নীলাসাগর গ্রাম থেকে ট্রেনে বাসায় ফিরবো ঠিক তখনি স্মিতা আমাকে বলেছিলো তোমার ব্যাগে যে গোপন জিনিসটা রহিম চাচা দিয়েছে সেটা আমাকে দিয়ে এর থেকে মুক্ত করো প্লিজ! আমি সাথে চমকে উঠি, এই মেয়েটি এই কথা কিভাবে জানলো, তারতো এই কথা জানার কথা না..............
ওদিকে রুক্সিনী চৌধুরী একেরর পর এক আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে ওই জিনিসটি তাকে দিয়ে দেওয়ার জন্য। এটা নাকি তার পারিবারিক সম্পত্তি। অপর দিকে স্মিতাও বলেছে সে মুক্তি চায়। এখন বুঝতে পেরেছি এসব কিছুরই একটা মুল আমার কাছে থাকা "বস্তুটাকে" ঘিরে! কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে এর মাঝে?? পাঠক জানতে হলে পড়তেই হবে।
ওদিকে গ্রামে একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছে। মৃত লাশগুলোর দেহ ছিন্ন ভিন্ন অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে। রহিম চাচা নিখোঁজ। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে যেটা আমি ধরতে পারছিনা?? কেনোইবা একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছে?? কেনো স্মিতা বার বার আমার কাছে থাকা বস্তুটাকে চাচ্ছে?? কেনো???
পাঠক এ এক গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে, যেটা আপনাকে জানতে হলে অবশ্যই পড়তেই হবে!
◾▪️পাঠ বিশ্লেষণঃ-
অবশেষে টান টান উত্তেজনায় আমার পছন্দের জনরার বইটি শেষ হলো। এই অতিপ্রাকৃত হরর উপন্যাসে লেখক খুবই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। আসলে এই ধরনের বই লিখতে হলে প্রচুর কল্পনা শক্তির দরকার হয়। লেখক সেটা দারুন ভাবেই দেখিয়েছেন। প্রথম বই হিসেবে ভালোই কাজ দেখিয়েছেন ভাইয়া। তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি সিরিজের প্রথম বইয়ের তুলনায় দ্বিতীয় বইতে লেখার স্টাইলটা আরো বেশি দারুন এবং আকর্ষনীয়। পড়লেই বুঝতে পারবেন আপনারা। গল্পটি লেখক উত্তম পুরুষে লিখে গিয়েছেন। আমিও উত্তম পুরুষে রিভিউটা লিখে গিয়েছি।😍 আমি আদৌ জানিনা এটা আসলে রিভিউ কিনা! রিভিউ লিখতে গিয়ে কি লিখলাম আল্লাহ ভালো জানেন। মনে হচ্ছে সব কিছুই স্পলার করে দিচ্ছি!😎 পাঠক, বকুল ফুল এবং বিড়ালাক্ষী এ দুটো মিলেই একটি সিরিজ। বিড়ালাক্ষী না পড়লে বকুল ফুলের অনেক প্রশ্নের উত্তর আপনার অজানাই থেকে যাবে......
বকুল ফুল অতিপ্রাকৃত ঘরানার উপন্যাস। মনোয়ারুল ইসলামের বকুল ফুল ট্রিলজির প্রথম বই। বইটা পড়তে গিয়ে 'ঘোর লাগা' অনুভূতি প্রকটভাবে প্রতীয়মান হয়। লেখক ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন বকুল ফুলের পৃথিবীতে। সেই মায়ায় কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য।
এটা যেন রহস্যময় সে দুনিয়ায় অতৃপ্ত প্রেতাত্মা স্মিতার সাথে অজ্ঞাতনামা নায়কের ভ্রমণ কাহিনীর গল্প। এক অসম প্রেমের গল্পও বলা যায় এটাকে।
অতিপ্রাকৃত ন্যারেটিভে অতৃপ্ত আত্মার মোটিভ মোটামুটি সংজ্ঞায়িত। দুনিয়াবি বিশেষ কোনো কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেই কাজের সমাধান না হচ্ছে, আত্মা আফটারলাইফে যেতে পারছে না। তেমনই স্মিতার সেই বিশেষ কাজটি বুঝতে হলে, কিছুটা পরাবাস্তব এই জগতে আমাদের নায়ককে ভ্রমণ করতেই হবে। স্মিতার এই নায়ক 'মশাই' কিছুটা গ্রুমিং পিরিয়ডের মধ্যে দিয়ে যায় এই উপন্যাসে।
অতৃপ্ত আত্মার ম্যানিফেস্টেশন চাক্ষুষ করতে হলে সেই ব্যক্তিকে স্পেশাল হতে হয়। সাইকিক হোক বা প্ল্যানচেটের মিডিয়াম কোনো এক বিশেষত্ব অবশ্যই প্রয়োজন। মশাইয়ের স্পেশ্যালিটি কিছু যে আছে তা হিন্ট দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত সিকুয়েলগুলোতে আরও পরিষ্কার হবে বিষয়টা।
সীমিত কিছু চরিত্র ঘুরে ফিরে এসেছে। তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভাসা ভাসা একটা ধারণা পাওয়া গেলেও, তাদের ড্রাইভটা কী সেটা সম্ভবত ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গিয়েছেন লেখক।
লেখকের গল্প বলার ভঙ্গিমা আকর্ষণীয়। পাতার পর পাতা উপমা, অলংকার দিয়ে রহস্যময় এই পৃথিবীটা সৃষ্টি করতেই বেশি মনযোগী ছিলেন সম্ভবত। মূল গল্পে ঢুকতে অনেক দেরী করেছেন। বই শেষে যতোটা না উত্তর পাওয়া গেছে তার থেকে ঢের বেশি প্রশ্ন তৈরী হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে, আংটির কথাই ধরা যাক। এ জিনিসের গুরুত্ব বুঝা গেলেও সেটা কুয়োতে ফেলে দিলে কীভাবে স্মিতার স্থায়ী মুক্তি হতে পারে সেটা অপরিষ্কার। এবং যেহেতু সিকুয়েলও আছে একই চরিত্র নিয়ে, মুক্তি যে আদপেও মিলছেনা সেটাও অনুমেয়।
আমি আশা করছি ১ম বইয়ের বিশদ সেটআপ কাজে লাগিয়ে সিকুয়েলগুলো আরও পরিপক্ব হয়েছে। কারণ সামগ্রিকভাবে আমার মনে হয়েছে, এই বইটা সিরিজের এস্টাব্লিশমেন্ট পারপাজ সার্ভ করেছে। মূল গল্পের চড়াই-উৎরাই সামনে দেখার বাকি আছে।
বইয়ের প্রচ্ছদ রঙ ঝলমলে উজ্জ্বল। স্মিতার অবয়ব নজরকাড়া। প্রথম দেখায় অনিন্দ্যসুন্দরী শাঁকচুন্নির মতো লাগে! মনে গেঁথে থাকবে অনেকদিন।
হার্ডকোর অতিপ্রাকৃত-প্রেমীদের বেশ ভালো লাগবে পড়তে। রেগুলার থ্রিলার পাঠকদের সম্ভবত একটু কষ্ট করতে হবে।
বই : বকুল ফুল লেখক : মনোয়ারুল ইসলাম প্রকাশনা : নালন্দা প্রকাশকাল : ২০১৯ প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর পৃষ্ঠাসংখ্যা : ১৩৬ মলাট মূল্য : ৩০০
মনোয়ারুল ইসলাম এর বকুল ফুল লেখক মনোয়ারুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত বই 'ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষা অভিধান'। বইটি পড়া হয়নি, তবে নিশ্চতভাবে এটি ছিলো খুবই কঠিন এবং সাহসিকতার কাজ। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু পাঠক বন্ধুদের আড্ডায় উঠে এসেছিলো মনোয়ারুল ইসলামের এই বইটি। ঠিক তখনি আমি লেখক সম্পর্কে জানতে পারি। যা লেখক সম্পর্ক এক উচ্চবর্গীয় ইম্প্রেশন তৈরি করেছিলো।
বকুল ফুল ২০১৯ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নালন্দা থেকে প্রকাশিত বকুলফুল বইটি ২০২১ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় লেখকের অটোগ্রাফসহ সংগ্রহ করি। সম্প্রতি "বকুল ফুল" উপন্যাসটির ভারতীয় সংস্করণ এনেছে Bookecart Publishing India। যার প্রচ্���দ করেছিলেন কৃষ্ণেন্দু মন্ডল। বাংলাদেশের মত ভারতীয় পাঠকদেরও বইটি বকুল ফুলের গন্ধ, স্মিতার রূপ এবং রুক্সিনীর কূটচালে মুগ্ধ করেছে। বলে রাখা আবশ্যক, এটি মনোয়ারুল ইসলাম এর প্রথম উপন্যাস। কিন্তু বইটি পড়ে আমার মত সকালে কাছে একবারের জন্যও তা মনে হবার সুযোগ নেই। বরং বারবার মনে হয়েছে- এত পরে কেন বইটি পড়লাম! আরও অনেক আগেই পড়া উচিত ছিলো। নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি কেউ যদি না জেনে পড়ে তবে কোন ভাবেই বলা সম্ভব নয়- এটি লেখকের প্রথম উপন্যাস। প্রতিটি লাইন, প্রতিটি প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ, সামঞ্জস্যপূর্ন ঘটনা প্রবাহ থেকে মনে হয় যেন লেখক এর পূর্বে অসংখ্য গল্প উপন্যাস লিখে হাত পাকিয়েছেন।
কিছু উপন্যাস বা লেখা থাকে যা পড়তে বসলে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে উঠে আসা যায় না। উপন্যাসের চরিত্র, ভাষাশৈলী, গল্প বলার ঢঙ, গল্পের ঘটনা প্রবাহের উত্তেজনা আমাদের সামনে এগোতে বাধ্য করে। আমি, আপনি বা অন্য কোন পাঠক এমন লেখা ছেড়ে উঠে আসতে পারেন না। এমন সাহস নেই, এমনই একটি উপন্যাস ‘বকুল ফুল’।
বইটির দুর্দান্ত এক প্রচ্ছদ করেছে প্রচ্ছদ-শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর। বরাবরের মতই মোস্তাফিজ কারিগরের করা বকুল ফুলের প্রচ্ছদ ছিলো ভাবাবিষ্ট ও মনকাড়া । বইটির প্রচ্ছদ, প্রিন্টিং, বাঁধাই, সব মিলে অসাধারন কাজ করেছে লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী, প্রিন্টিং-প্রেস এবং বাঁধাইখানা। হার্ডকভারের "বকুল ফুল" হাতে নিলেই যা স্পষ্টাকারে ফুটে উঠে।
লেখক তার বহু কষ্টের 'বকুল ফুল' উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন তার আদরের ভাগ্নি 'সাবীহা'কে। অসাধারন উৎসর্গপত্রটি পড়ে অনুমান করা যায়- লেখক তার ভাগ্নি সাবিহাকে কতটা ভালোবাসেন। স্বভাবতই লেখকরা প্রথম বই গুলো মা বা বাবাকে উৎসর্গ করে থাকেন। সেখানে তিনি তার ভাগ্নি সাবিহাকে মায়ের মর্যাদা দিয়ে উৎসর্গ করেছেন। হৃদয়ের কতটা জায়গা জুড়ে একজন মানুষ থাকলে তাকে এতো মর্যাদায় উৎসর্গ করা যায় সেটি উৎসর্গপত্রে চিত্রায়িত হয়েছে।
আমার আরেকজন ভীষণ পছন্দের লেখক হুমায়ুন আজাদের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন এই উপন্যাসটির লেখক মনোয়ারুল ইসলাম। ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো। -হুমায়ুন আজাদ।
যাই হোক, ফিরে যাই উপন্যাসে, গল্প কথক শুরুতেই দশ বছর আগের এক ঘটনাপ্রবাহের গল্প বলতে শুরু করেন। খুব বৃষ্টির রাত, ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশ। চারদিকে একটাই শব্দ- বৃষ্টির। বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যায় না। বৃষ্টির আভাস দেখেও কথক প্রতিদিনের মত ঘর ছেড়ে গভীর রাতে রাস্তায় নেমে এসেছেন তবে খুব সতর্কতার সাথে, যাতে বাবা বুঝতে না পারে। যদিও তাদের খুব বেশি একটা ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে। হুট করেই পাশ থেকে একজন এসে কথকের মাথায় ছাতা ধরে বসলেন।ভয়ে থ’হয়ে যায় কথক, গল্প কথক। বৃষ্টিতে ভিজে জেসমিন ফুলের গন্ধ ভারী হয়ে বাতাসে মিলে যাচ্ছে চারদিক। আগন্তুক মেয়েটি কথকের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটছে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির জোর বাড়তেই বৃষ্টি আর আগন্তুক এক তরুণীর পায়ে থাকা নুপুরের আওয়াজ মিলে অনবদ্য সেই সৃষ্টি- ঝুম শব্দ! কিন্ত এই পরিবেশে কথক অত্যন্ত বিচলিত। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেও কপালে ঘামবিন্দু জমাট বেঁধেছে। সে আগন্তুক রূপকথার সেই মেয়েটিকে আবিষ্কার করতে ব্যর্থ চেষ্টা ব্যর্থ করলো। নিগূঢ় অন্ধকারে মেয়েটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। গাঢ় অন্ধকার। একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে তার শরীর থেকে। গন্ধটা কিসের? কর্পূর নাকি বকুল ফুলের! বুঝতে পারে না কথক! বাবার চাকরির সুবাদে কথক বেড়ে উঠেন কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগরের জমিদার বাড়ির কাছেই তাদের বাড়ি। এই জমিদার বাড়ির জমিদারের নাম ছিল 'কৃষ্ণচন্দ্র'। তার নামেই অঞ্চলটির নাম হয়েছে কৃষ্ণনগর। কথক আগে কখনোই জমিদার বাড়ি দেখেনি। বইপত্রে যা দু'একবার পড়াশুনা হয়েছিল, ঐ অব্দি, এর বেশি দূর নয়। খুব কাছাকাছি থাকা জমিদার বাড়ি দেখা কৌতূহল সে সংবরণ করতে পারলো না। কৌতূহলের তাড়নায় সেই বুক ভরা উচ্ছ্বাস নিয়ে একদিন ছুটে গেলো, একপ্রকার থমকে দাড়াঁলো জমিদার মহলের সামনে। দেখার সময়ে তার নাকে ফুলের গন্ধ আসতে লাগত। এত সুন্দর গন্ধ তাকে বকুল ফুলের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো বারবার, কিন্তু চারপাশে কোনো বকুল ফুল গাছ তো নেই! তাহলে? বৃদ্ধ নারকেল গাছ আর তরুণ জাম গাছ ছাড়া আর কিই-বা আছে! অথচ ঘ্রাণের তীব্রতা এতো গাঢ় ছিলো যে, মনে হয় যেনো পাশেই বকুল ফুলের গাছটি দাঁড়িয়ে। জমিদার মহলের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে দেখছিল সে। শ্বেতপাথরের খোদাঁই করা নাম- স্মিতা মহল, ১২১৭ বঙ্গাব্দ। হঠাৎ তার কানে ভেসে এল এক পরিচিত কণ্ঠ। রহিম চাচার কণ্ঠ। সে কণ্ঠে একটা গাম্ভীর্য ছিলো, এটা কোনো ঘুরবার মতো জায়গা নয়। এখনি ফিরে যাও। আর বলেন- ফিরবার সময় যেনো পেছনে না তাকায়। কিন্তু কথকের কৌতূহলী মন!ফিরবার সময় ফিরে তাকালো সে। একি! স্মিতা মহলের ছাদে সে কাকে দেখছে? সেই মিশমিশ কালো অন্ধকার রাতের আলোকিত মেয়েটি-ই তো! দ্বিতীয় বারের মত মেয়েটিকে দেখেছে সে। বিষয়টা রহিম চাচা বুঝতে পেরে হকচকিয়ে যায় । ভয়ার্ত চোখে, বিরক্তিমাখা কণ্ঠে কথককে কতগুলো ভারী কথা শুনিয়ে ফিরিয়ে দিল। কথক কিছু আচ করতে না পেরে চলে এলেন। ঘটনার কিছুদিন পর কৃষ্ণনগর ছেড়ে চলে যায় কথক ও তার পরিবার। কারণ কথকের বাবার বদলি হয়েছে। উনার নাকি গ্রাম ভালো লাগে না। তাছাড়া সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারেও তিনি চিন্তিত ছিলেন। এদিকে মনের উপর বিশাল পাথর জমেছে কথকের। আর কৃষ্ণনগরের জমিদার বাড়ি দেখা হবে না তার। স্মিতামহলের ছাঁদে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে যে মেয়েটি ডেকেছিল, সে কে? কি তার পরিচয়? সে কী করে? কখনোই আর জানা হবে না। নিকষ অন্ধকারে মেইল ট্রেনে কথকের পাশে কোন এক যুবতী আছে। সে শুয়ে নাকি বসে আছে তা বুঝবার অবকাশ নেই। শুনশান নীরবতায় কথক কেবল নিজের নিশ্বাস উপলব্ধি করতে পারছে। আর নাকে ভেসে আসছে বকুল ফুলের গন্ধ। মেয়েটি কথকের সাথে কথোপকথনে জড়াতে চায়। কথক চায় না। জানায়, সে অপরিচিত কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। প্রত্যুত্তরে মেয়েটি মৃদুস্বরে বলল, 'এখানে অপরিচিত কে মশাই!' মশাই শব্দটি খুব ভালো ভাবেই কথকের কানে গিয়ে ভিড়লো। তাকে একজন ছাড়া কেউ কখনো 'মশাই' বলেনি। সেই কতো আগে কৃষ্ণনগরের সেই সুন্দরী মেয়েটিই তাকে 'মশাই' বলেছে! তাহলে কি এই সেই মেয়ে! ভেবেই কথক বিচলিত হয়। প্রচণ্ড ভয় আছড়ে পড়ে মস্তিষ্কে। তারপর ভয়ের মিছিল ছড়িয়ে পড়ে সাড়া শরীরে। বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে সাদা একটা আলো নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। কিছু মুহূর্ত পর মানুষের অবয়বের উপস্থিতি। বিড়ির আগুন স্পষ্ট। ভাবান্তরের দীর্ঘটান যেনো প্রতি টানে। লোকটা রিক্সাচালক। রিক্সা নিয়েই এসেছে। কিন্তু এই রাতে রিক্সা নিয়ে যাবার জায়গা কই! ভাবলো কথক। রিক্সাওয়ালা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, 'রাইতের বাসে আইছেন মনে হয়! কই যাইবেন?' 'কৃষ্ণনগর'...
আমি গতকাল (২২ এপ্রিল ২০২১) বিকালে বইটি পড়তে শুরু করি। রাতের মধ্যেই পড়ে শেষ করি। না শেষ করে কিছুতেই যেনো উঠতে পারলাম না। পড়ার সময় ছাত্রজীবনের ছোট বড় বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনা মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে কেমন যেন গা শিরশির করে উঠছিলো। লেখক উপন্যাসটিকে সর্বোচ্চ মাত্রা দিয়েছেন। এই লেখার জন্য লেখকের প্রাপ্য সম্মান লেখক পেয়েছেন কিনা জানা নেই। তবে এমন অসাধারন সৃষ্টির জন্য এই সমাজ এবং যথাযথ পক্ষ থেকে আরো অনেক প্রাপ্য অবশিষ্ট রয়েছে। প্রথম উপন্যাসে সে তার সেরাটা দিয়েই অসান্য করে তুলেছেন৷ বকুল ফুল এর মাধ্যমে লেখক নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছে। আমি মনে করি, একটি রোমান্টিক উপন্যাস পড়ে যখন পাঠক প্রেমানুভব করবে, রহস্যোপন্যাস পড়ে রোমাঞ্চিত হবে, অতিপ্রাকৃত উপন্যাস পড়ে ভয়ানুভব করবে, সেখানেই লেখকের সার্থকতা। সেই অর্থে লেখক শতভাগ সার্থক। শুভকামনা সতত।
সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখন জমিদারি রাজ্যে ভরপুর ছিল গোটা বঙ্গদেশ। তখনকার কোনো এক সময়ে, কোনো এক জায়গায় — এক জমিদারের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। স্বভাবতই বড়ো কন্যার ভাগ্যে জোটে সকল জমিদারি। গন্ধ শুঁকে ছুটে আসা হায়েনাদের তো অভাব হয় না। তারাও ছুটে আসে নিজেদের লোভ নিবারণের জন্য। সকল জমিদারির মালিক হতে হলে বড়ো কন্যার সাথে বিবাহ করতে হবে। তবেই সব পাওয়া সহজ হয়। শুরু হয়, রাজতন্ত্রের নামে ষড়যন্ত্র। নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে হয়। হিংস্রতার ছাপ রেখে দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। যেন ভয়েও কেউ কাছে ঘেঁষতে না পারে। যুদ্ধ, বিগ্রহ, রক্তাক্ত সংঘাতের পর দখলদারি…. সব কি পাওয়া হয়ে যায়? একসময় জীবনের শেষ সময় এসে উপস্থিত হয়। নিঃশেষ হয়ে যায় সবকিছু। রেখে যায় ইতিহাস-ঐতিহ্য। স্মৃতিগুলো জ্বলে ওঠে। সব কিছু ছাপিয়ে থেকে যায় না পাওয়া কিছু আক্ষেপ…..
▪️কাহিনি সংক্ষেপ :
মেয়েটির সাথে এর আগে দেখা হয়েছিল দুইবার। এর আগে এক বৃষ্টির রাতে। ছাতা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল মায়াবী মেয়েটা। আজ আবার! এই চলন্ত ট্রেনে মেয়েটা কী করে এলো? কী যেন নাম তার? হ্যাঁ, স্মিতা চৌধুরানী। তার মুখে মশাই ডাক যেন কানে মধু বর্ষণ করে। তার আগমনে বকুল ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে চারিদিক। আজকের এই আগমনের হেতু কী?
রহিম চাচার একটা কাজ করতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আমাদের গল্পকথক। রহিম চাচা সতর্ক করে দেয়, খুব সাবধানতার সাথে কাজ করতে হবে। কোনোভাবেই দেখা চলবে না জিনিসটা কী? কৌতুহল বড়ো খারাপ জিনিস। তবুও আমাদের গল্পকথকের সেই কৌতূহল নেই। তাই নিশ্চিন্ত মনে সিলগালা সেই বস্তুটি নিয়ে রওনা দেয়। পথিমধ্যে কত বিপদের আনাগোনা। মৃত্যু যেখানে পরোয়ানা জারি করেছে। নিতান্তই কপালগুণে বেঁচে যাওয়া! তারপরও চোখের সামনে কত রহস্য! এক মায়াবিনীর সাথে পথ চলতে গিয়ে মনে হয়, মেয়েটি ঠিক যেন মানুষ নয়। ঘোর লাগে। সেই ঘোরে হারিয়ে যেতে হয়।
এই সমাজে যত অপরাধ সংগঠিত হয়, তার অধিকাংশই গভীর রাতে। এই রাতের অন্ধকারে কবরস্থানে ঠিক কোন রহস্য খেলা করছে? ময়লা ভিটায় সেই মেয়েটি কে? কীসের পুঁটলি তার হাতে। এর সাথে রহিম চাচার সম্পর্ক কী? খুব অদ্ভুতভাবে রহিম চাচার ভাগ্যের বদল ঘটেছে। কোনো অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে? না-কি লটারি লেগেছে ভাগ্যে? কেন সে এতটা দিশেহারা সেই বস্তুটির হারিয়ে যাওয়ার খবরে? এত গুরুত্বপূর্ণ কেন সেটা?
রুক্সিনী চৌধুরী পেশায় ডাক্তার হলেও ডাক্তারির ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে নেই। নানান কাজে নিজেকে জড়িয়ে আজ সে বাংলাদেশের অন্যতম ধনী, প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। পত্র পত্রিকায় যার নাম উঠে হরহামেশাই। বিদেশে মানুষ হওয়া মহিলা এবার থিতু গেড়েছে দেশে। ফিরে এসেছে পূর্বপুরুষদের ভিটায়। এখানেই লেখা হবে নতুন ইতিহাস। তার অপকর্মের একটা দিক যেন এখানেই উন্মোচন হয়ে উঠবে। আরও যে অনেক দিক আছে। ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিক। যেখানে হোচট খেয়ে আটকে যেতে হয়। রুক্সিনী চৌধুরীর মতো মানুষেরা যা চায়, তা-ই নিজের করে নেয়! এতে কয়েকটা প্রাণ ঝরে যায় তো যাক!
একটি আংটির খোঁজে হন্যে হয়ে আছে সবাই। স্মিতা চৌধুরানী, রুক্সিনী চৌধুরী…. আরও অনেকে! কী আছে এই আংটিতে? কেন এত গুরুত্বপূর্ণ। সেই রহস্য যেন আবারও নিয়ে এসেছে তাকে, এই কৃষ্ণনগর জমিদারবাড়িতে। এখানেই সব রহস্যের উন্মোচন হবে….
▪️পাঠ প্রতিক্রিয়া :
লেখক মনোয়ারুল ইসলামের লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে “বকুল ফুল” বইটির মাধ্যমে। লেখকের প্রথম বইও এটিই। প্রথম বইয়ের লেখক তার লেখনীর মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। কোনো আড়ষ্ট ভাব নেই, জড়তা নেই। সহজ ও সাবলীল ভঙ্গিতে রচনা করেছেন বকুল ফুলের কাব্য।
“বকুল ফুল” অতিপ্রাকৃত ঘরানার বই। যেই বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখক রহস্য স্থাপন করতে পেরেছেন। শুরু থেকেই যা পাঠককে বইয়ের সাথে জড়িয়ে নেবে। লেখক বইয়ে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি রাখতে পেরেছেন, সেটা হলো ভয়। একই সাথে কৌতূহল। ভয়ের বর্ণনাগুলো একদম খাপে খাপ। কোনো বাড়তি কিছু মনে হয়নি। মনে হয়নি জোর করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। গল্পের স্রোতে আপনাআপনি গা শিউরে ওঠার অনুভূতি হবে।
আরেকটি বিষয় বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তা হলো কৌতূহল। পরবর্তী অংশে কী ঘটবে, কেন ঘটবে, কীভাবে ঘটবে— তা জানার আগ্রহ লেখক পুরোটা বই জুড়ে রাখতে পেরেছেন। আর সে কারণেই হয়তো খুব দ্রুত বইটি শেষ হয়ে যায়। আর যেহেতু লেখকের বর্ণনা সাবলীল, সেহেতু পড়তে গিয়ে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় না। বর্ণনাগুলো ভালো লেগেছে। রাতের অন্ধকারে বর্ণনা, প্রকৃতির বর্ণনা— সব যেন একটা আবহ তৈরি করতে পেরেছিল। রাতের অন্ধকার মানুষের মনের উপর চাপ তৈরি করে। সবচেয়ে সাহসী মানুষটিও হয়তো সাহস হারিয়ে ফেলে তখন। এই ভয়ের যে মানসিক চাপ, সেই চাপ ভালোমতোই লেখক উপস্থাপন করতে পেরেছেন।
অতিপ্রাকৃত ঘরানার বই হলেও এর সাথে খুব দারুণভাবে জমিদারি ইতিহাসের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। একই সাথে এক শক্তিশালী খল চরিত্রে আবির্ভাব হয়েছে। ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র, রাজত্ব— সবকিছু যেন বইটিকে বাস্তবতার ছোঁয়া দিয়েছে। বাস্তব আর অতিপ্রাকৃতের এই মেলবন্ধন পছন্দ হয়েছে।
লেখক পুরোটা বই জুড়ে গল্পটা দুইভাবে পরিচালনা করেছেন— বর্ণনার মাধ্যমে আর সংলাপের মাধ্যমে। দুটি অংশেই লেখক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বর্ণনার বিষয়ে তো আগেই বলেছি, সংলাপেও কোনো অংশে কম না। অনেক বইয়ে সংলাপ পরিণত না হলে পড়তে বিরক্ত লাগে। এই বইয়ে সেটা ছিল না। বরং সংলাপে যে প্রাণ ছিল, তাতে বইটা আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।
আক্ষেপটা বোধহয় শেষটা নিয়ে। খুব তাড়াহুড়ো করে শেষ হয়ে গিয়েছে। আরেকটু গল্পের বিস্তৃতি প্রয়োজন ছিল। তাহলে শেষ বেলায় এসে পরিতৃপ্তির পরিমাণ আরেকটি বেশি হতো। বই পড়তে গিয়ে কিছু প্রশ্নের উদয় হয়েছিল। যার উত্তর লেখক তার বর্ণনার মধ্য দিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টা ভালো লেগেছে। কিছু উত্তর সরাসরি। কিছু হয়তো ভেবে নিতে হয়।
▪️চরিত্রায়ন :
উপন্যাসের সবচেয়ে দুর্বল অংশ মনে হয় চরিত্রের ভালো মতো ফুটে না ওঠা। ছোটোখাট চরিত্রগুলোর অবশ্য সমস্যা নেই। তাদের যতটুকু প্রয়োজন ছিল তা-ই, ততটুকুই তাদের গণ্ডি। এর বেশিকিছু প্রয়োজন ছিল না।
তবে মূল তিন চরিত্র— গল্পকথক, স্মিতা চৌধুরানী ও রুক্সিনী চৌধুরীদের সবটা ফুটে ওঠেনি। স্মিতা চৌধুরানী পুরোটাই আলো কেড়ে নিতে সক্ষম এখানে। তার চরিত্র বিন্যাসের অভিযোগ না থাকলেও গল্পকথকের ক্ষেত্রে আমার কাছে পুরোপুরি ফুটে উঠতে পারেনি। হয়তো আরো ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা যেত। গল্প স্রোতে যতটুকু ফুটে উঠেছে ঠিক ততটুকুই। তবে এই মশাইয়ের একটু পরপর আঘাত পাওয়া আর দুর্বল চিত্তে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।
সবচেয়ে আড়ালে থেকে গিয়েছেন রুক্সিনী চৌধুরী। তার অতীত, এত শক্তিমত্তার উৎস কিছুই ফুটে উঠেনি। হয়তো লেখক পরের বইয়ের যিনি জমিয়ে রেখেছেন। তবে আরও কিছু আভাস দিলে পূর্ণতা পেত বলে মনে হয়।
▪️বানান, সম্পাদনা ও প্রচ্ছদ :
লেখকের শব্দচয়ন দুর্দান্ত কিন্তু তারপরও কিছু অভিযোগ থাকে। পুরোনো সে�� আফসোস। এর দারুণ শব্দচয়নের মাঝে কিছু ইংরেজি শব্দ বিরিয়ানির এলাচির মতো অনুভূতি দেয়। একটি এলাচি যেমন মুখের স্বাদ নষ্ট করে দেয়, এখানেও তা-ই। দুয়েকটা হলেই কেমন যেন বিস্বাদ লাগে। কথা প্রসঙ্গে আমরা ইংরেজি বলি, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু সাহিত্যে শব্দচয়নে ক্ষেত্রে আরেকটু সচেতন হতে হয়। বর্ণনার ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দ যত পরিহার করা যায় তত মঙ্গল। সংলাপে দেওয়া যায় অবশ্য। কিন্তু যেখানে সংলাপেও শব্দচয়ন দারুণ, সেখানে দুয়েকটা ইংরিয়ে পরিহার করলে ক্ষতি তো কিছু নেই।
বইয়ে একটা বিষয় লক্ষণীয় ছিল— কী/কি এর ভুল ব্যবহার। এছাড়া একটা বানান লেখকের প্রায়শই ভুল করতে দেখি। বীভৎস বানানকে ভীবৎস লিখেন। এছাড়া টুকটাক ছাপার ভুল, বানান ভুল ছিল।
প্রচ্ছদটা আমার ভীষন পছন্দের। দারুণভাবে বইয়ের মূলভাব তুলে রাখে। সেই সাথে ভয়ের আবহ…
▪️স্মিতা চৌধুরানী, রুক্সিনী চৌধুরী, না-কি গল্পের মশাই? এই গল্পটা কার? বকুল ফুলের সুবাসে রহস্য আরও ঘনীভূত। শেষে কী আছে?
১২১৭ বঙ্গাব্দে গড়ে উঠা কৃষ্ণনগরের প্রাচীন রহস্যঘেরা জমিদার বাড়ি স্মিতামহলের রহস্যময়ী এক নারীকে কেন্দ্র করেই গল্পের সূচনা। এক বৃষ্টিস্নাত মধ্য রাতে লেখক প্রথম আবিষ্কার করেন এই রহস্যময়ী নারী স্মিতা চৌধুরানিকে। বকুল ফুলের সৌরভ মাখা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির রাতে এই রহস্যময়ী নারীর ছাতা হাতে উপস্থিতি শুরু থেকে লেখককে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়।
লেখকের বাবার চাকুরীর সুবাদে কৃষ্ণনগরে তার প্রথমবার আগমন। স্মিতামহলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বকুল ফুলের গন্ধ অনুভব হলে চকিত দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই লেখক দ্বিতীয়বারের মতো মেয়েটিকে দেখেন স্মিতামহলের ছাদে। মোমবাতির হালকা আলোয় এক মোহ জাগানীয়া ইঙ্গিতে লেখককে ডাকছে স্মিতা চৌধুরানি।
"আমার আর কখনো কৃষ্ণনগরের জমিদারের তৈরি স্মিতা মহলে যাওয়া হবে না। জমিদারমহলের ছাদে দাঁড়িয়ে হাতছানি দেওয়া মেয়েটা কে? তার পরিচয় কী? জানা হবে না। প্রথম প্রথম এসব ভেবে মন খারাপ হতো। সময়ের পরিবর্তনে স্মৃতি অনেক কিছুই সাবধানে মুছে ফেলে। দশ বছর অনেক সময়! অনেক। একসময় ভুলেই গিয়েছিলাম জমিদারমহলের কথা, সুন্দরী মেয়েটার কথা, কিন্তু প্রকৃতি অনেক কিছুই ফিরিয়ে দেয় মাঝে মাঝে। প্রকৃতি চায় মানুষের মন যা খোঁজে তা কিছুটা হলেও পাইয়ে দিতে।"
বাবার বদলিজনিত কারণে কৃষ্ণনগর থেকে চলে যাওয়ার পর এভাবেই লেখক তাঁর অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করেন। অজানা অচেনা সেই রহস্যময়ী নারীর জন্য লেখকের বুকের গভীরে যেন তৈরি হয় আরেক স্মিতামহল।
হঠাৎ এক রাতে জরুরী প্রয়োজনে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে হিরনমুখী স্টেশন থেকে লেখক একটি লোকাল ট্রেনের কামরায় উঠে পড়েন। নিকষ কালো আঁধারের বুক ছিঁড়ে ট্রেন যখন এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই খুব পরিচিত একটা স্মেল অনুভূত হলে লেখক চমকে উঠেন। ঘুম ঘুম চোখে বুঝতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল, এটি কি কল্পনারই বহিঃপ্রকাশ, নাকি অন্য কিছু? নাহ্, কল্পনায় ভেসে বেড়ানো স্মেলের আবেশগুলো এতো গাঢ় হওয়ার কথা না। পরক্ষণেই ট্রেনের সামনের আসনে লেখক তৃতীয় বারের মতো আবিষ্কার করেন কৃষ্ণনগরের জমিদার বাড়ির ছাদে দশ বছর পূর্বে মোমবাতির হালকা আলোয় ঘুরে বেড়ানো সেই রহস্যময়ী নারী স্মিতা চৌধুরানিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা শীতল অনুভূতি বজ্রপাতের মতোই আছড়ে পড়ে। অন্ধকার কামরায় দশ বছর পূর্বের সৌরভ আর অতি পরিচিত মোলায়েম কণ্ঠস্বর লেখককে যখন অন্তহীন ভাবনার রাজ্যে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে, ঠিক তখনই ঘটে যায় আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা। তরমুজের ফালির মতোই ট্রেনটা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। রহস্যজনকভাবে স্মিতা চৌধুরানির অবরুদ্ধ কারাগারে অজানা এক মায়াজালের আবেশে বন্দি হয়ে যান লেখক। অপরিচিত এই নারীর লেবু চা পানের আমন্ত্রণকে অগ্রাহ্য করার মতো শক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি।
বকুল ফুলের মায়াবী ঘ্রাণে জড়িয়ে, আঁধারের বুক ছিঁড়ে একটা শীতল হাতে হাত রেখে রহস্যের আরেক তীর্থভূমি নীলাসাগর গ্রামে লেখক পা রাখতেই ঘটতে থাকে একটার পর একটা অপার্থিব ঘটনা। প্রত্যেকটি ঘটনার সাথেই পরিচিত সেই বকুল ফুলের সৌরভ আর মাঝে মধ্যেই রহস্যজনকভাবে স্মিতা চৌধুরানির গায়েব হয়ে যাওয়া তাকে ভীষণ রকম ভাবিয়ে তোলে।
নীলাসাগর গ্রামের লাহুর নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ময়লা ভিটা, লম্বা ভিটা ও নতুন ভিটায় কান পাতলে এখনো স্পষ্ট শোনা যায় শত সহস্র বেওয়ারিশ লাশের আত্মচিৎকার আর প্রহরে প্রহরে ডেকে উঠা শিয়ালের ভয়ঙ্কর ডাক। দূর্বাঘাসে পতিত হওয়া রাতের শিশির মারিয়ে রজস্যময়ী এই নারীর সাথে চলতে থাকা লেখক এখানে মুখোমুখি হতে থাকেন একটার পর একটা অতিপ্রাকৃত সব ঘটনার।
ওঁৎ পেতে থাকা পদে পদে বিপদ, বেওয়ারিশ লাশের গোরখুদকের নৃশংস মৃত্যু, নীলাসাগর গ্রামের তরুণীদের রহস্যজনক লাপাত্তা, বিভৎস সব লাশ, বুনো শিয়ালের ভয়ার্ত হাঁকডাক, নবজাতক শিশুর ছিন্নভিন্ন মুন্ডু, অদ্ভূত টিউমারে ভরপুর খাটো নারীর আবির্ভাব সবই যেন নীলাসাগরের নিত্য ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক সব ঘটনা। সব ঘটনার সাথেই স্মিতা চৌধুরানির দেবীরূপে অাবির্ভাব আর বকুল ফুলের গন্ধ রহস্যের জটলাকে ক্রমেই ঘনীভূত করেছে।
অতিপ্রাকৃত জনরার বই এই প্রথম পড়লাম। একজন থ্রিলারপ্রেমী হিসেবে অন্য জনরার বইয়ের রাজ্যে খুব একটা ঢুঁ মারা হয় না। কিন্তু অনলাইনে বইটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা আর সমালোচনাই মূলত আমাকে বকুল ফুলের বাগানে বিচরণ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। বইটি পড়তে যেয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী কবিতার কয়েকটি চরণ বার বার মনের মধ্যে হানা দিচ্ছিলো।
"বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।"
সত্যিই আমি অভিভূত! বাংলা সাহিত্যে শত সহস্র বইয়ের অন্তরালে যে এতো সুন্দর একটি বই শিশিরবিন্দুর মতো হাতের নাগালেই পড়ে ছিল, বইটি না পড়লে হয়তোবা আক্ষেপই রয়ে যেতো।
শুরু থেকেই বকুলফুলের এই রহস্যময়তা আমাকে টেনে নিয়ে গেছে গভীর থেকে আরো গভীরে। মাঝে মধ্যেই বকুলফুলের অপার্থিব গন্ধ অনুভব করেছি। গল্পকথনে লেখকের মুন্সিয়ানার তারিফ না করে পারছি না। পুরো বইটি লেখকের নিজ জবানীতে ব্যক্ত করে আলাদা সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বকুল ফুলের স্মেলের সাথে স্মিতা চৌধুরানির উপস্থিতি যে ভঙ্গিমায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, পড়তে যেয়ে কখন যে আমি এই রহস্যময়ী নারীর উপর ক্রাশ খেয়েছি বুঝতেই পারিনি।
প্রায় দুইশত বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া লোভ, লালসা আর পারিবারিক কলহকে কেন্দ্র করে লিখা 'বকুল ফুল' নামের এই অতিপ্রাকৃত উপাখ্যানটি পড়ে সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমার বিশ্বাস, লেখার এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে লেখক এগিয়ে যাবেন অনেকদূর। বাংলা সাহিত্যে রেখে যেতে পারবেন অসামান্য অবদান।
বইটির আরেকটি বিশেষত্ব হলো- যতক্ষণ পড়েছি, পুরো সময়টাতেই বকুল ফুলের অপার্থিব গন্ধে মাতোয়ারা ছিলাম। গল্প কথককে স্মিতা চৌধুরানির 'মশাই' সম্বোধনটাও আমার কাছে অন্যরকম লেগেছে।
বইটির বেশিরভাগ অধ্যায়ে লেখক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিছু আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা পড়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে আমি তেমন কোনো জটিলতার সম্মুখীন হইনি। কেননা, আমার শ্বশুড়বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া হওয়ার সুবাদে ওখানকার আঞ্চলিকতা আমার ভালোই রপ্ত করা ছিলো।
একটি অতিপ্রাকৃত জনরার বই হিসেবে বইটি পড়ার সময় আমি খুবই ধীরগতিতে পড়েছি। চেষ্টা করেছি প্রতিটি বাক্য বুঝে পড়ার। এক্ষেত্রে কিছু প্রিন্টিং মিসটেক আমাকে ভালই পীড়া দিয়েছে। একটা অসঙ্গতির কথা না বললেই নয়। নীলাসাগর গ্রামে রহস্যময়ী নারী স্মিতা চৌধুরানির সাথে লেখক যখন একের পর এক অতিপ্রাকৃত সব রহস্যজনক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছিলেন, তখন লেখক নিকষ কালো আঁধারের বর্ণনার পরমুহুর্তেই আবার জোৎস্নার উপস্থিতি নিয়ে এসেছেন। এটিও অতিপ্রাকৃত কোনো বিষয় কিনা আমার বোধগম্য নয়। নাকি ঘটে যাওয়া অতিপ্রাকৃত সব ঘটনার আবেশে জড়িয়ে নিজেও ভুল পড়লাম কিনা তাও ক্লিয়ার হতে পারছি না।
বাস্তবে আমরা যা দেখে আসছি, লোকাল ট্রেনগুলোতে সাধারণতঃ যাত্রীদের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গাটুকুও অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু হিরনমুখী স্টেশন থেকে লেখক একটি লোকাল ট্রেনে চড়ে ফাঁকা আসনে একেবারে ঘুমানোর মতো জায়গা পেয়ে গেলেন! আবার সামনের আসনটিও খালি ছিল! এটিও অতিপ্রাকৃত কোনো ঘটনা কিনা ঠাহর করতে পারছি না।
অনেকগুলো প্রশ্ন ছিল, যার সমাধান খোঁজে পাইনি। তবে বুঝতে বাকি রইলো না, বকুল ফুলের সিরিজ হিসেবে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরো একটি বই। প্রত্যাশা থাকবে, পরবর্তী বইয়ে লেখক এগুলোর সুন্দর সমাধান দিবেন।
তাছাড়া গল্পের প্রত্যেকটি প্লটই ছিলো ব্যাপক রহস্যে ভরপুর। প্রচ্ছদটিও ছিল মন ভরে যাওয়ার মতো। নালন্দা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটির কাগজের মান ভালো থাকলেও বাঁধাই ছিল চালিয়ে নেয়ার মতো। সবশেষে কি আর বলবো, 'উত্তম পুরুষে খুবই ভালো লিখেছেন মশাই।'
বই : বকুল ফুল লেখক : মনোয়ারুল ইসলাম প্রকাশনায় : নালন্দা প্রকাশনী প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর পৃষ্টা সংখ্যা : ১৩৫ মুদ্রিত মূল্য : ২৭৫ টাকা
"স্মিতামহলের ছাদে রাতের বেলায় এক তরুণী হাঁটে মোটা মোমবাতি হাতে নিয়ে, তার গায়ের রঙ খুব ফরসা নয়। জমিদারের মেয়েরা যতটা সুন্দরী হয় ততটা নয়। মেয়েটা হঠাৎ হাসে। আবার হুহু করে কাঁদে, তখন গ্রামের কুকুরবিড়ালেরাও কুইকুই করে সুর তুলে কান্না করে। সেই কান্না খুব করুণ হয়। যে রাতে মেয়েটার কান্নার শব্দ শোনা যায় সে রাতে গ্রামের কেউ জরুরি প্রয়োজন হলেও ঘর থেকে বের হয় না।"
ভয় খুব একটা পাই না তারপরও হরর তো ছেড়ে দেয়া যায় না। অবশ্য শুধু হরর না, কিছুটা ঐতিহাসিক কিছুটা প্রচলিত গ্রামবাংলার মিথ - সবকিছুই ছিল। স্মিতা চৌধুরানীর চরিত্র ছিল মনে দাগ কেটে যাওয়ার মত।
অন্যদিকে রুক্সিনীর চরিত্র কেন জানি বেখাপ্পা লেগেছে আমার কাছে। এইগল্পে একটা শক্ত ভিলেনের খুব অভাববোধ করেছি কিন্তু তাকে প্রায় কার্টুন টাইপ লাগে জিনিষটা খুবই বিরক্তিকর।
কিন্তু (প্রায়) সব মাফ কারণ, পক্ষ নেয়া হোক আর যাই হোক পুরো কাহিনী, আবেশটাই কেমন মায়ামায়া। হোক সেইটা গ্রামের মানুষ, প্রকৃতির বর্ণনা অথবা স্মিতার *মশাই* ডাক...!
যতদূর মনে পড়ে বর্ণনাকারী *মশাই* এর কোন নাম কোথাও নেই। হয়ত এটা লেখকের রহস্য ধরে রাখার একটা কায়দা। সম্ভবত তিনি আগ্রহ ধরে রাখায় অনেকটুকুই সফল, গল্পের কোথাও এতটুকুও একঘেয়েমি ছিল না বা বর্ণনা অতিরিক্ত লাগেনি। একেবারে শেষপৃষ্ঠা পর্যন্ত মনোযোগ খুব সহজেই ধরে রাখা যায়।
আমার প্রিয় বই গুলো আমি সযত্নে রেখে দিই,বার বার দেখি, বার ছুই কিন্তু পড়ি না।পড়লে বইটা শেষ হবে তাই মাথার কাছেই রেখে দিই। অবশেষে,,,,এইমাত্র আপনার লেখা বকুল ফুল বইটি পড়ে ফেরলাম।এই করোনায় বন্ধি অবস্থায়।
আমি খুব রহস্যের ভিতরে ছিলাম,ভয় ভয় লাগছিল আবার উত্তেজনা কাজ করছিল। অবশেষে আমার প্রথম রহস্যময় অপ্রাকৃতিক ঘটনা নিয়ে অসাধারণ বইটি পড়ে ফেরলাম। আর স্মিতার প্রেমেই পড়ে গেলাম।থাকুক আপনার বকুল ফুল , আমার বইয়ের তাকে। ভাই অনেক ধন্যবাদ এই রকম একটা বই লেখার জন্য
বকুল ফুল নাম দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম এটা বুঝি কবিতার বই। ফেসবুকের বইয়ের গ্রুপগুলোতে প্রচুর সুনাম দেখে হাতে নিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছি এই বইটা। একটানে শেষ করে মুগ্ধ হয়েছি। লেখকের লেখার হাত বেশ ভালো।বিড়ালাক্ষীও প্রায় শেষ। স্মিতাকে খুব ভালো লেগেছে। রুক্সিনীকে নিয়ে আরো কাজ করা যেতো।
সিরিজটা একসাথে পড়ব বলে রেখে দিয়েছিলাম। এখন আফসোস হয় এতদিন কেন আমি রেখেছিলাম। বকুল ফুল, স্মিতা, মশাই। মশাই চরিত্রটাকে খুব ভালো লেগেছে। লেখকের লেখায় একটা আলাদা টান আছে। এই টান ধরে রাখতে পারলে ভালো হবে।
২০১৯ এ বইটা পড়েছিলাম, এখন আবার পড়লাম পুরো সিরিজটা শেষ করবো তাই। লেখক সুন্দর লেখেন, লেখার ধরন সুন্দর। আবার প্লট ও খারাপ না। তবুও মনে হলো একটু এলোমেলো। ~৩.৫/৫
অপ্রাকৃত বা ভৌতিক রহস্যময় ঘটনার আদলে লেখা হয়েছে উপন্যাসটি। অপ্রাকৃত ঘরানার বই আমার তেমন ভালো লাগে না। তবে লেখক অপ্রাকৃত ঘটনার সাথে থ্রিলারের মিশ্রণ ঘটিয়ে লিখেছেন বলেই বইটি বেশ ভালো লেগেছে।