অনভিপ্রেত জটিল এক রহস্যের জালে জড়িয়ে গেল প্রত্নতাত্ত্বিক রাশাদ এবং জয়িতা। প্রাচীন পুঁথির সোঁদা ঘ্রাণে ভেজা অদ্ভুত এক ঐতিহাসিক স্মারকের পেছনে ছুটে চলেছে সমস্ত ঘটনা প্রবাহ। যেখানে শত-সহস্র শতাব্দি ধরে সত্যের মহীরূহ ঢেকে দিয়েছে ধীরে ধীরে জমতে থাকা অসত্যের আগাছা।
'দশগ্রীব' এক ঐতিহাসিক রহস্য-রোমাঞ্চ আখ্যান। প্রাচীন কথকতার তমসা ভেদ করে দ্ব্যর্থহীন গন্তব্যের পথে বিস্ময়কর, অবিশ্বাস্য এক যাত্রা। ক্ষমতা, রাজনীতি আর ধর্মের ঘোলা কাঁচের নিচে দম আটকে থাকা প্রকৃত ঐতিহাসিক উপাখ্যান উদ্ধারের প্রচেষ্টা।
পাঠক আপনাকে প্রহেলিকাময় অতীত এবং আপতিত বর্তমানের সত্য এবং অসত্যের মায়াজাল নিরূপণে স্বাগতম।
অনেকদিন পর একটা সলিড, হৃদয় ও মস্তিষ্ক— দু'টিকেই তৃপ্ত করে এমন মিথোলজিক্যাল থ্রিলার পড়লাম। গল্পের বিষয়বস্তু আপাতদৃষ্টিতে সরল ও রৈখিক। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের সময় এমন একটি একজিবিট ভারপ্রাপ্ত গবেষকের হাতে এসে পড়ে যা অমূল্য। তবে শুধু ইতিহাসের বা চোরাচালানের দিক দিয়ে নয়, সেই একজিবিটের এক ভিন্নতর গুরুত্বও আছে। তার সূত্র লুকিয়ে আছে কিংবদন্তি আর পুরাকথার কুয়াশায় আচ্ছন্ন এক সম্ভাবনার মধ্যে। একের পর এক মৃত্যু, ষড়যন্ত্র, দুঃসাহসিক অভিযানের মধ্য দিয়ে এগোল ঘটনাক্রম। চলতে লাগল রামায়ণের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা। রামের বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত লংকা থেকে অশোকের হাতে আক্রান্ত কলিঙ্গ— এমন নানা স্থান ও কাল পেরিয়ে, বিভিন্ন দলের সঙ্গে আমরা ছুটে চললাম এক রহস্যময় আয়ুধের দিকে— যার তুলনা, এমনকি পুরাকথাতেও, নেই। তারপর কী হল?
বইটা আনপুটডাউনেবল। লেখক শুদ্ধ অথচ ধারালো ভাষা ব্যবহার করে এমন এক আবহ তৈরি করেছেন, যেখানে ঢোকা সহজ, কিন্তু বেরোতে হয় কাহিনির (আপাতত) সমাপ্তিতেই।
আমার আপত্তি রয়ে গেল শুধু রামায়ণের লেখকীয় ব্যাখ্যা নিয়ে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে-সব আকরগ্রন্থ তিনি এই ব্যাখ্যা নির্মাণে ব্যবহার করেছেন, তাদের অধিকাংশই 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতির প্রয়োগ করে লেখা প্রোপাগাণ্ডা। রাবণ যে কী সাংঘাতিক নারীলোভী ও স্বার্থান্বেষী ছিলেন, বাল্মীকি রামায়ণে তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁকে মহৎ করে দেখানো এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য হলেও লেখক সেই ফাঁদে পা না দিলেও পারতেন।
তবু বলব, এ এক দুর্ধর্ষ থ্রিলার। মিথ, ইতিহাস এবং রোমাঞ্চে আগ্রহ থাকলে এ-বই অবশ্যই পড়া উচিত।
দশগ্রীব বইটার গরম গরম রিভিউ দেয়ার ইচ্ছা ছিল। ফোন সংক্রান্ত গ্যাঞ্জামে পড়ে গুডরিডসে আর লগ-ইন করতেই পারছিলাম না.. কি এক দুর্যোগ! অবশেষে.. :D
রিভিউ বলতে যদি বইটা সম্পর্কে পজেটিভ নেগেটিভ দুটোই বুঝানো হয় তাহলে আগে পজেটিভ দিকগুলো সম্পর্কেই বলি। অতি অবশ্যই কাহিনির দিক দিয়ে সেরা একটা লেখনী। ইতিহাসের ভিলেন চরিত্রগুলোরে আমার আসলেই মায়া লাগে। একটু একটু ভালও লাগে ক্ষেত্রবিশেষে। কারণ হচ্ছে, ইতিহাস মূলত লিখেই বিজয়ীরা। সেখানে পরাজিতের কোন স্থান নেই। কাজেই পরাজিত বা যে আমাদের চোখে ভিলেন হয়ে দেখা দিচ্ছে তার সম্পর্কে সম্পূর্ণ আইডিয়া যে পাব তা কিন্তু না। সেক্ষেত্রে বইটার মূল ক্যারেক্টার আমার পছন্দ হইসে।শুধু পছন্দই না.. ভয়ানক পছন্দ হইসে। মহাভারতটা মোটামুটি হালকার উপর ঝাপসা কাটাকুটি করে পড়া হইসে বাট রামায়ণ সম্পর্কে আমার জ্ঞান কমিক্স ওয়ার্ল্ডে প্রকাশিত হওয়া ওই অল্প কিছু অধ্যায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মেঘনাদ বধ বহুদিন ধরেই হাতে উঠায় উঠায় আবার পড়া হচ্ছে না (এইবারে যেমনেই হোক... শেষ আমাকে করতেই হবে) রামায়ণের ক্যারেক্টার বিশ্লেষণ, দৃষ্টিভঙ্গি দুইটাই ভাল্লাগসে। যাই হোক.. মূল ক্যারেক্টার মানে রাবণ ছাড়াও বর্তমানের প্রধান চরিত্র হিসেবে আমার রাশেদকে বেশ পছন্দ হইসে আর জহির অবশ্যই! (জহির শালা পুরাই কুল) কিন্তু ন্যাকা জয়িতা না :3 এখন প্রশ্ন হচ্ছে জয়িতাও তো স্ট্রংটাইপ এবং অবশ্যই বর্তমানের প্রোটাগনিস্টও। তাহলে ক্যান আমার রাশেদরে ভাল্লাগলো আর জয়িতাকে না? তাইলে এখন আবার নেগেটিভ আলোচনায় চলে আসতে হবে। এতো সুন্দর বইটারে টুট টুট করার জন্য অল্প অল্প কিছু জিনিসই যথেষ্ট। এইটা আমার ধারণা এবং আমার মতামত.. জয়িতা ওয়েল ডেভেলপড ক্যারেক্টার না। সে আর্কিওলজির স্টুডেন্ট,অনেক ভালো ছাত্রী, সিজি ভালো,কাজও করসে তাই বিখ্যাত মানুষের সাথে, চেনাজানা এবং কাজের পরিধিও বেশ ভালো ব্লা ব্লা ব্লা.. তারপরেও বইয়ের অনেক জায়গায় খেয়াল করলাম.. এজ এ্য আর্কিওলজিস্ট (মানে যে কি না খুব ভালভাবে কাজের সাথে সম্পৃক্ত সে এমন সব প্রশ্ন মাঝেমাঝে করছে যা তার করা উচিত না। আবার বলা যায়,মাঝে মাঝে সে এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে যা তার আগের ক্যারেক্টারের সাথেও মিলছে না.. জয়িতাকে সঙগায়িত করতে চাইলে ওয়েল ডেভেলপড না বলে, ওয়েলব্যালেন্সড না সেটাও বলা যেতে পারে। (যদিও রাশেদকেও অতি জ্ঞানী হিসেবে দেখায় ফেলসে কিছু জায়গায় কিন্তু রাশেদের কন্টিনিউয়িটি থাকায় অতোটা বেখাপ্পা লাগে নাই।) এরপর সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা... বইয়ে 'পচুর বানাম বুল' ছিল। এইটা বেশি প্যারা দিয়ে দিছে (কোথায় শব্দটা যখন কোথাই হয় কিংবা যায় শব্দটা যদি যাই হয়ে যায় বা চিরকাল পড়ে আসা সাপ বানান যখন অভিশাপের শাপ হয়ে যায় তখন যে কী করতে মন চায়... সেটা আর নাই-বা বললাম।) আরও কিছু বিষয় ছিল সেগুলা বললে আবার জনসাধারণ স্পয়লার খেয়ে যাবে। বাদ্দেই। সবচেয়ে পজেটিভ দিক, লেখকের টান টান উত্তেজনাকর কাহিনি (আমি সত্যিই ইম্প্রেসড সেটা নিয়ে আসলেই কোন কথা হবে না) দশগ্রীব অনেক দিন ধরেই শখ ছিল পড়ার, ধনুর্ধর বইটাও। এই বই কেনার সময় যে কোন একটা বই কেনার টাকা হাতে থাকায় ধনুর্ধর আর দশগ্রীবের মাঝে উপর দশ বিশ করে লটারি করতে হইসে... ধনুর্ধর বইটা ইনশাল্লাহ next to buy লিস্টে আছে। এখন দেখা যাক.. কী হয়...
বি.দ্র. আরও কী কী নিয়ে যেন লিখব বলে ভেবে রাখসিলাম, ভুলে গেছি এখন।
সিদ্দিক ভাই খুব বড় সাইজের ফ্যান হিসাবে তার বই এর প্রতি আমার বিবেচনা বায়াসড হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে খারাপ বলার সুযোগ নেই। অসাধারণ একজন স্টোরি টেলার লেখক। এতদারুন ভাবে ন্যারেশন এগিয়ে নিয়ে গেছেন, ৪০০ খানা পেজ যে পড়লেন তা মনেই হবে না। তারপরও বইতে আছে অনেক হিস্ট্রিকাল-মিথিক্যাল এনালাইসিস থিওরি সহ অনেক ইনফো। হিস্ট্রিকাল ফিকশন এ বিভাগে বাংলা মৌলিকে তার সমকক্ষ কাউকেই লাগে না।
দেশ বরেণ্য প্রত্নতাত্ত্বিক প্রফেসর কামরুল শরীফ, হঠাৎই খুন হয়ে গেলেন হাজার বছরের পুরোনো এক পুঁথি আবিষ্কারের সাথে সাথে। এর কারণ খুঁজতে শুরু করলো তার দুই স্টুডেন্ট বিখ্যাত আর্কিওলজিস্ট জয়িতা এবং রাশাদ আর ধীরে ধীরে জানতে পারলো ভয়ংকর কিছু তথ্য। এদিকে এই পুঁথির পিছনে লাগে অনেক বছরের পুরোনো আরেক সংগঠন যাদের রয়েছে নিজস্ব এক পরিকল্পনা । - তারপরেই নানা সময়ের নানা ঘটনার মধ্যে উন্মোচিত হতে থাকে এই পুঁথির আসল রহস্য যা বিস্তৃত হতে থাকে বাংলাদেশ থেকে শ্রীলংকা, মৌর্য আমল থেকে রামায়ণের সময়ের ভারত পর্যন্ত ! এখন এই পুঁথির আসল রহস্য কি ? যে ভয়াবহ মিথকে এই পুঁথি নির্দেশ করছে সেটি কি আসলেই আছে নাকি এটি শুধুই একটি মিথ ? যদি তা থেকেই থাকে তাহলে কে শেষ পর্যন্ত হাতে পাবে এই মিথিক্যাল বস্তু ? এ সব কিছু জানতে হলে হবে লেখক সিদ্দিক আহমেদের আর্কিওলজিক্যাল থ্রিলার " দশগ্রীব " . - " দশগ্রীব " - এই নাম শুনেই বুঝে গিয়েছিলাম কাহিনী রামায়ণ বিশেষ করে রাবণ এর জীবনের মিথিক্যাল কোন কিছুর উপর বেসড করে হবে। তবে মূল কাহিনী শুধু এই এক মিথের ভিতরে সমাপ্ত নয়। উপমহাদেশের বেশ কিছু মিথিক্যাল সংগঠনের ও দেখা পাওয়া যায় এতে। আলাদা আলাদা ভাবে এ সংগঠন গুলোর বিষয়ে বেশ কিছু বইতে পড়া থাকলেও এদের একসাথে নিয়ে আসা বেশ চমকপ্রদ লেগেছে। বইতে নানান ধরণের হিস্টোরিক্যাল এবং মিথিক্যাল স্থান এবং এ সম্পর্কিত তথ্যগুলোও সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। - " হাজার বছরের এক গুপ্তবিদ্যা, যা পাওয়ার জন্য চেষ্টায় রয়েছে বেশ কিছু গুপ্ত সংগঠন " - শুনে অনেক সময় ক্লিশে মনে হলেও একটু খানি ইতিহাস, একটু খানি বিজ্ঞান আর আরেকটুখানি নানা ধরনের ধর্মীয় রীতি - নীতি ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে লেখা উপন্যাস পড়তে আমার সাধারণত ভালোই লাগে। বাইরের দেশে এ ধরনের লেখা বেশ জনপ্রিয় হলেও আমাদের উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের লেখা বেশ কমই বলা যায়। সে ধরনের উপন্যাসের ভিতরে নতুন এক সংযোজন বলা যায় " দশগ্রীব " কে এবং এটি টিপিক্যাল ক্লিশে প্লট হবার থেকে বেশ ভালোভাবেই উৎরে গেছে । - দশগ্রীব এর যে ব্যাপারটি প্রথমেই চোখে পরে তা হচ্ছে এর বিভিন্ন মিথিক্যাল এবং হিস্টোরিক্যাল ঘটনার দারুন ডিটেলিং। লেখককে যে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে অনেক রিসার্চ করতে হয়েছে তা ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে ঘটনাগুলো পড়ে। তাই আগে থেকে না জানা থাকলেও পাঠকরা এ ঘটনাগুলো সম্পর্কে বইটি পড়ার পরে বেশ ভালো ধারণা পেয়ে যাবেন। তবে এ কারণে কখনো কখনো কাহিনীর গতি বেশ ধীর মনে হয়েছে, বিশেষ করে প্রথমদিকে। হয়তো এ সম্পর্কিত তথ্যগুলোর কিছুটা জানা ছিল বলেই এরকম মনে হয়েছে। মাঝপথের পরে কাহিনী বেশ গতি লাভ করে যা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। মাল্টি লেয়ার্ড স্টোরিলাইন একেক পর্বের কাহিনীগুলোকে বুঝাতে বেশ সাহায্য করেছে। বিভিন্ন ধর্ম এবং কালচারের বিখ্যাত কিছু চিহ্ন দিয়ে কাহিনীর বাঁকে বাঁকে নানা ধরণের রহস্য তৈরী এবং এ রহস্যগুলো সমাধানের প্রক্রিয়াগুলোও দারুন। - চরিত্রায়নের দিক থেকে বলতে গেলে প্রধান দুই চরিত্র রাশাদ এবং জয়িতা বেশ মানানসই গল্পের সাথে,তবে তাদের মধ্যকার ইমোশন আরো ভালোভাবে তুলে আনা যেতে পারতো বলে মনে হয়েছে। বাকি চরিত্রগুলোর ভিতরে জহির চরিত্রটি দারুন ছিল,বাকিগুলোও চলনসই। কয়েকটি চরিত্র বেশ ধোঁয়াশা লেগেছে, আশা করি এর পরের পর্ব বের হলে ব্যাপারগুলো ক্লিয়ার হবে। - " দশগ্রীব " এর আরেক ভালো লাগার জায়গা হলো এর প্রচ্ছদ এবং দুর্দান্ত এক লেটারিং যা কাহিনীর জন্য একেবারেই পারফেক্ট আমার মতে।বইয়ের বাধাই সহ অন্যন্য দিক গুলোও ভালো লাগলেও বইতে অনেকগুলো প্রিন্টিং মিস্টেক চোখে পড়েছে, বিশেষ করে ভাঙা যুক্তাক্ষরগুলো ছিল বেশ দৃষ্টিকটু। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে ব্যাপারগুলো ঠিক করা হবে। - এক কথায় বলা যায়, উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে কাল্ট বেজড দারুন এক আর্কিওলজিক্যাল থ্রিলার হচ্ছে " দশগ্রীব "। সামনে লেখকের কাছ থেকে এ ধরনের আরো লেখা পাবো, এই আশায় রইলাম।
বাংলাদেশি লেখকদের জন্য মৌলিক থ্রিলার-এডভেঞ্চার মোটামুটি নতুন জনরা, আমরা যারা ক্লাসিকাল বাংলাদেশি সাহিত্য পড়ে বড় হয়েছি তারা সহজে এই জনরায় পাঁচ তারা দিতে চাইনা, কেমন কেমন করে খুঁত ধরে ফেলি, লেখকের উৎসাহ মেরে ফেলার জন্য যেটা এক্কেবারে পারফেক্ট! কিন্তু এ উপন্যাসে পারলে পাঁচে আমি সাড়ে ছয় দিতাম। খুব চমৎকারভাবে লেখার রাশ ধরে রেখেছিলেন সব জায়গায়। মনেই হবে না বানানো গল্প পড়ছি!
তবে শুরু করে ভালো লাগছিল না। কারণ "তিন বাহু দশ মুখ" (পশ্চিম বঙ্গের উপন্যাস), এটার শুরুটার সাথে হুবুহু মিল। খুব বিরক্ত লাগছিলো। ওপার বাংলারই এক বন্ধু উৎসাহ দিয়ে বলেছিলো "দশগ্রীব, এ তো অসাধারণ লেখা!" ~ এ থেকেই আরো ভেতরে ঢোকা। এবং আমি মুগ্ধ। ভেতরের প্লটের সাথে "তিন বাহু দশ মুখ"-এর তেমন মিল নেই। কিন্তু গল্পের অবতারণার মূল জিনিসগুলো একদমই এক। এতে পাঠকের পড়ার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যায় বলে আমার মনে হয়।
লেখকের জন্য শুভকামনা।
বি.দ্র. বাতিঘরের আরো সতর্ক হওয়া উচিৎ প্রিন্টিংয়ের ব্যাপারে। ভেতরে প্রচুর বানান ভুল।
রাবণ, যার দশটা মাথা, কারণ সে ছিল জ্ঞানী ও বিচক্ষণ। চার বেদ আর ছয় শাস্ত্র রাখত মাথায়। এইজন্যই সে দশগ্রীব।
সীতাহরণের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে ইতিহাসের পাতায় বরাবরই রাবণ একজন খলচরিত্র। অবশ্য, ইতিহাস বরাবরই বিজয়ীদের কথাই বলে, বিজিতদেরও যে গল্প থাকে সে হিসেব ইতিহাসের রাখতে নেই।
"সত্য সব সময় বিজয়ীদের হাতে লেখা হয় বলে আসল সত্যটা জানা খুবই কষ্টকর হয়ে যায়। রাবণের মতোন মহৎ মানুষকেও ভিলেন হিসেবে থেকে যেতে হয়।"
বইটা ঠিক রাবণ সম্বন্ধিয় বই নয়। মিথলজিক্যাল থ্রিলার। ওয়ারি বটেশ্বর থেকে উদ্ধার হয় অতি প্রাচীন তিনটি বই। বই এর তথ্য উদঘাটন করতে গিয়ে মারা পড়েন একজন প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক। তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় সেই বইগুলো। তবে মারা যাবার পূর্বেই বেশ কিছু তথ্য তিনি ডায়রীতে লিখে রেখে যান, আর তার ভেতর রয়ে যায় একটা বই এর একটা পাতা। সেটাতেই রয়েছে দশগ্রীবের সমাধি ও ব্রক্ষ্মাস্ত্রের বিষয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই শ্রীলঙ্কা গিয়ে হাজির হয় সেই নিহত প্রফেসরের দুই ছাত্র ছাত্রী, রাশাদ আর জয়িতা। এই ব্রক্ষ্মাস্ত্রকে হাত করবার জন্য অনেক অনেক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে একটা গুপ্ত সংঘ। তারাও গিয়ে হাজির হয় রাবণের দেশে। আর সবশেষে আবির্ভূত হয় আরও একটা দল, তাদেরও লক্ষ্য ব্রক্ষ্মাস্ত্র। কিন্তু ব্রক্ষ্মাস্ত্র শেষমেষ কার কাছে যায় সেটাও একটা টুইস্ট।
বইটা পড়তে গিয়ে শুরুতে একটু তাল হারিয়ে ফেলছিলাম। এই লেখকের পড়া এটাই আমার প্রথম বই। লেখার সাথে পরিচিত হতে কিছুটা সময় লাগলেও পরবর্তী ভ্রমণ ছিল অসাধারণ। রামায়ণ আমার পড়া হয়নি। কিন্তু এই বই পড়তে গিয়ে মোটামোটি একটা ভালো ধারণা হয়ে গিয়েছে। গতানুগতিক বর্ননাতে না গিয়ে চরিত্রগুলোর কথোপকথনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ রামায়ণের চিত্রই এঁকে দিয়েছেন লেখক। তাতে করে পড়তে যেমন ভালো লেগেছে তেমনি তথ্যগুলো বেশ সুন্দরভাবে মাথায় সেট হয়ে গিয়েছে। নবসংঘের ইতিহাস, সম্রাট অশোকের সাথে সংঘর্ষ, মগধ আর কলিঙ্গের যুদ্ধের বর্ননা ছিলো এককথায় অসাধারণ। রামায়ণের বর্ননাতেও তার বিভিন্ন ভার্সনের তথ্য গুলোকে লজিক দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। আর রাবণের ব্যাপারে যা কিছু জানা যায় তার সবই আসলে পজিটিভ। শুধু এক সীতা অপহরণ করা ছাড়া, কিন্তু সেটাও ছিল নিজের বোনের সম্মান রক্ষার্থে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং তথ্য ছিল যে রাবণ দ্রাভিডিয়ান রেইসের লোক, উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মানুষ।
লেখক সুহান রিজওয়ান একবার একটা কথা বলেছিলেন যে নর্স আর গ্রীক মিথলজির গল্পও যদি আমরাই বলি তাহলে আমাদের উপমহাদেশীয় মিথের গল্প কারা বলবে? আমি ব্যক্তিগতভাবে এই কথাটা সমর্থন করি। সেই দৃষ্টিতে দেখলে এই উপমহাদেশীয় মিথ নিয়ে লেখা 'দশগ্রীব' একটি অত্যন্ত চমৎকার থ্রিলার গল্প। কিন্তু মনে হলো বইটা আন্ডাররেটেড, লেখকও।
লেখক সিদ্দিক আহমেদকে বাহবা দিয়ে গেলাম। আর বইটা রেকমেন্ড করলাম সমস্ত থ্রিলার প্রেমীদের।
ক্লাস ইলেভেনে "বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ" প্রথমবার যখন পড়ি তখন রামায়ণের তথাকথিত হিরো-ভিলেইন এর দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গিয়েছিল। ছোটবেলা থে���ে হিন্দি চ্যানেল গুলোতে রাবণ কে ভিলেইন হিসেবেই দেখেছি। তাই বাংলা স্যার যখন পেছনের কাহিনী টা ব্যাখা করছিলেন তখন আরোও জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল। সে অভিলাষ এত বছর পর যে একটি থ্রিলার বইয়ে পূরণ হবে সেরকম হয়ত ভাবি নি। লেখক বেশ পড়াশোনা করেই বইটি লিখেছেন। "ধনুর্ধর" বেশি ভাল লাগলেও এই বইটিও মন্দ লাগে নি। বরারবরের মতন ই মেদহীন ও গতিময় লেখা। ইতোমধ্যে তিনি আমার প্রিয় একজন মৌলিক লেখক হিসেবে স্��ান পেয়ে গেছেন। উনার বাকি সব লেখা পড়ব ভাবছি। এরকম লেখা আমাদের আধুনিক থ্রিলার সাহিত্য কে আরোও পরিপূর্ণ করুক সেই মনোকামনা রইল।
সত্যিই দুর্দান্ত এবং অসাধারণ। ধর্মীয় পুরাণ আর ইতিহাসের এক অনবদ্য মিশেলে সত্যিই অসাধারণ করে তুলেছেন লেখক। লেখকের প্রতিটি বিষয় বিশ্লেষণ করে যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা বইটিকে সুখপাঠ্য করে তুলেছে। এরকম থ্রিলার উপন্যাস এদেশে নতুন হলেও সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। অপেক্ষায় আছি পরের পর্বের জন্যে।
আমার মনে হয়েছে, দশগ্রীব বা রাবণকে নিয়ে বাংলাতে এই উপন্যাসের চেয়ে ভালো-বেটার ঐতিহাসিক উপন্যাস হতে পারে না। ইতিহাসকে আশ্রয় করে তথ্য-উপাত্ত সহ কল্পনার সহায়তায় হাজার বছরের যে ঐতিহাসিক যে চিত্র লেখক আকলেন তা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। কেনো হতে পারে না, তা ব্যাখ্যা করছি,
আমি আমার পড়া হিস্ট্রিকাল থ্রিলারগুলোকে নিজের মতো করে দুইটা ক্যাটাগরিতে রাখি। এক হলো ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত-আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক নির্ভর বা এগুলোর সমন্বয়ে। আরেকটি হচ্ছে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ ফিকশান আঙ্গিকে নতুন করে বর্ণিত হয় প্লটের প্রয়োজনে। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিভিন্ন চরিত্র কে দেখা যায়, তাদের নিত্ত নৈমত্তিক বা বিশেষ ঘটনা গল্প আকারে বর্ণিত হয়। এই উপন্যাস এই দুই ক্যাটাগরির কোনো একটা তে পড়ে না, বরঞ্চ দু-টো ক্যাটাগরি মিলিয়ে মিশ্র ক্যাটাগরি বলতে হবে এই উপন্যাস টিকে।
একটা উপন্যাস তুলে আনবার জন্য লেখক তিন বছর স্টাডি করেছেন- সেই উপন্যাস যে অসাধারণ হবে সেকথা কিছুটা পূর্ব অনুমেয় হয়। হয়েছেও তাই। হাজার বছরের পুরোনো এক পুঁথি আবিষ্কারের সাথে সাথে হঠাৎ খুন হলেন দেশ বরেণ্য প্রত্নতাত্ত্বিক প্রফেসর কামরুল শরীফ। এর কারণ খুঁজতে শুরু করলো তার দুই স্টুডেন্ট বিখ্যাত আর্কিওলজিস্ট জয়িতা এবং রাশাদ। ধীরে ধীরে জানতে পারলো ভয়ংকর কিছু তথ্য। এদিকে এই পুঁথির পিছনে লাগে অনেক বছরের পুরোনো আরেক সংগঠন যাদের রয়েছে নিজস্ব এক পরিকল্পনা। সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন সংঘটন বলা হয়ে থাকে ভারতীয় উপমহাদেশের এই সংঘটনকে। এসেছেন ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ কিছু মুনী। তাদের জীবনের ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে উপন্যাসের অংশ হিসেবে। আছেন পরাক্রমশালী একজন সম্রাট ও। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তর্ক-বিতর্ক-তথ্য-উপাত্ত আর আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে উঠে আসে এক বিস্তৃত ইতিহাস যা আসলে কালের গর্ভে হারিয়ে না গেলেও সংযোজিত-বিকৃত-এডিট হয়েছে বহুবার। ডিটেইলিং খুব ভালো লেগেছে। লেখনশৈলীতে মুগ্ধ হয়েছি। এন্ডিং অবধি তাড়াহুরো নেই। এন্ডিং টাও জোশ হয়েছে। শ্রীলংকাতে রাশাদ-জয়িতার জয়েন্ট এডভেঞ্চার খুব উপভগ করেছি। হিস্ট্রিক্যাল ফিকশান লাভারদের জন্য রিকমেন্ডেড ।
সতর্কীকরণ- এই উপন্যাস পড়ার পূর্বে অবশ্যই পূর্ববর্তী সিকুয়াল 'নটরাজ' পড়ে শুরু করা উচিত। নয়ত অনেক কিছুর স্বাদ ই কম পাওয়া যাবে, কিছু জিনিস বুঝলেও শতভাগ স্বাদ পাওয়া যাবেনা, কিছু ক্ষেত্রে স্পয়লার সমস্যা হবে। মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, প্রোটাগনিস্ট-এন্টাগোনিস্টের কনফ্লিক্ট গভীরভাবে বা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যাবে না, আগের বইটা পড়া না থাকলে। কিছু চরিত্র সহ অনেক কিছু টান দেওয়া হয়েছে আগের বই থেকে।
এক বইতে পুরা রামায়ণের সারাংশ পড়ে ফেললাম। সাথে আছে লেখকের কল্পনাশক্তি আর যৌক্তিক আলোচনা। পৌরাণিক কাহিনী সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই, আর লেখকও এটাকে ধর্মের সাথে মিলাতে নিষেধ করেছেন। শুধু থ্রিলার গল্প যদি চিন্তা করি, রাম - রাবণের গল্প ছাড়া অতটা থ্রিলিং কিছু নেই, আরকিওলজি, মার্ডার সব মিলিয়ে যা হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু বর্ণনাভঙ্গি অসাধারণ। একটা বইতে রামায়ণের সাথে পরিচয় করানো সাথে ইতিহাস, আরকিওলজি যোগ করা কম কথা না। হয়তো রাম আর রাবণের রহস্য নিয়েই গল্পটা ছিল বলে গল্পের নতুন চরিত্রগুলোর গভীর বর্ণনা নেই। কিন্তু কিছু ব্যাপার একেবারেই অসংগতিপূর্ণ লেগেছে। যেমন এত পুরনো গুহায় কেউ সাথে সাথে ঢুকতে পারেনা। আগে বাতাস বিশুদ্ধ করে নিতে হয়। বা উপর থেকে পাথর ধ্বসে পরার পর ঝুঁকি বুঝে কেউ বের হওয়ার রাস্তা না খুঁজে, আরো ভিতরে ঢুকে রহস্য উদঘাটন এর জন্য। পরে বের হওয়ার সময় সহজেই আবার রাস্তা পেয়ে যায়। ব্যাপার গুলো খাপছাড়া। কিন্তু গল্প যেহেতু দশগ্রীব কে নিয়ে বাকিদের বা বাকি দৃশ্যপট খাপছাড়া লাগলেও বইটা অনেক ভালো লেগেছে। তবে বানান ভুল/ প্রিন্টিং এ ভুল টা বিরক্তিকর পর্যায়ে ছিল।
This entire review has been hidden because of spoilers.
"পৃথিবীতে সত্য আর মিথ্যার ব্যবধান খুবই অল্প। কে কোন পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে সেটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে।"
-আর্কিওলজিস্ট প্রফেসর কামরুল শরীফ
প্রিয় শিক্ষকের দূর্ভাগ্যজনক পরিণতির পর রাশাদ এবং জয়িতা নেমে পড়েন এক অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চারে। একটি লম্বা হলদেটে কাগজ। প্রাচীন এক গ্রন্থের অংশ এই কাগজে লুকিয়ে আছে হাজার হাজার বছরের রহস্যের অংশবিশেষ। এমন এক মিস্ট্রি যার সমাধান করতে পারলে অন্যরকম এক সত্যের মুখোমুখি হবে মানবসভ্যতা। একই সাথে কোন না কোন শক্তি বা চক্র পেয়ে যাবে অপরিসীম ক্ষমতা।
দশগ্রীব। এই এক বইয়ের পিছে সুদূর অতীত থেকে এখন পর্যন্ত লেগে আছে বিভিন্ন সঙ্ঘ, কাল্ট এবং ভাড়াটে অপরাধীরা। কেন এত মূল্যবান এই গ্রন্থটি? এমন কি ইশারা আছে এই বইয়ে যা স্বয়ং সম্রাট অশোকের জীবন বারবার বিপন্ন করেছিলো? বর্তমান টাইমলাইনে এসে এর উপযোগিতা কি?
লেখক সিদ্দিক আহমেদের এক বই পড়েই আমি ফ্যান। বইটির নাম "ধনুর্ধর"। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য নিয়ে বিপুল পরিশ্রম করে সেসবের সাথে তাঁর জলতরঙ্গের মতো গল্পকথন মিশিয়ে তিনি দারুন সব লিখা পরিবেশন করেন। ঐতিহাসিক ফিকশন মানেই ইতিহাস নয়। ইতিহাসকে উপজীব্য করে লিখা আখ্যানকেও হিস্ট্রি বলা যায় না। তবে ধনুর্ধর থেকে দশগ্রীব, মাত্র দুটো বই পড়ে বুঝতে পেরেছি যে সিদ্দিক আহমেদ হাজার বছর আগের কাহিনী বর্তমান টাইমলাইনের চেয়ে ভালো লিখেন। তাঁর স্টোরিটেলিং বরাবরের মতই ভালো।
এই আখ্যানে অতীতের সুদূর ঘটনাগুলো পড়তে গিয়ে বেশি ভালো লেগেছে। এক বিখ্যাত মিথলজিক্যাল চরিত্রের কোন বিশেষ অস্ত্র বা সিম্বলের পিছনে একাধিক পক্ষ ছুটে বেড়াচ্ছে এটি তো মোটামোটি কমন প্লট। তবে স্টোরিটেলিং এর মাধ্যমে সফল প্রয়োগ করাটাই মূল বিষয়। সিদ্দিক আহমেদ পেরেছেন। তবে "ধনুর্ধর" এর মত মাস্টারপিস পড়ে ফেলার পর লেখক���র কাছ থেকে আশা একটু বেশিই ছিল। আমি মুদ্রণপ্রমাদ নিয়ে খুব একটা বিচলিত হই না তবে এই বইয়ের বাক্যগঠন এবং বানানের এডিটিং আশা করছি পরের মুদ্রণে ঠিকঠাক হবে। বেশ কয়েক জায়গায় অসঙ্গতি দেখতে পেয়েছি।
তৈরি করা সত্য, রাজনীতি, ক্ষমতা, জিওপলিটিক্সের কারণে অনেক সত্যই চিরতরে ঢাকা পরে থাকে। কখনো একদল ভাগ্যবানের সামনে হয়তো চন্দ্রহাঁসের মত আলোকচ্ছটা দিয়ে চলে যায়। প্রহেলিকাময় এই আ���্যানে অনেক রহস্য নিয়ে আড়াল হয়ে আছেন দশগ্রীব।
দশগ্রীব,, অর্থাৎ দশ মাথা যার। এই দশগ্রীব নামটা শুনলে প্রথমেই মাথায় আসে লঙ্কাধিপতি রাবনের নাম কারন রামায়নের মাধ্যমে আমরা সকলেই জানি রাবনের দশ মাথা ছিল। দশগ্রীব উপন্যাসটি মূলত রাবন আর চন্দ্রহাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি। চন্দ্রহাস হচ্ছে মহাদেবের তলোয়ার যা তিনি রাবনের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে প্রদান করেছিলেন।
আর্কিওলজির প্রফেসর কামরুল শরীফ একটি প্রাচীন গ্রন্থের সন্ধান পান যার নাম দশগ্রীব ।বলা হয় রাবনের মৃত দেহ এক গোপন জায়গায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল আর সেই সাথে লুকিয়ে রাখা হয়েছে রাবনের অস্ত্র চন্দ্রহাস।এই গ্রন্থ রাবনের সমাধি আর চন্দ্রহাসের রহস্যের চাবিকাঠি। এই গ্রন্থের সন্ধান পাশাপাশি কিছু গুপ্ত সংঘও করে যাচ্ছিল। তন্মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন সংঘটি হল নব সংঘ। সঙ্ঘটি নয় জন সদস্য নিয়ে তৈরি এবং প্রত্যেক সদস্য প্রতি বিশেষ গ্রন্থে পারদর্শী। তাদেরই এক সদস্য প্রফেসরকে খুন করে বইটা নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে আসে। কিন্তু দেখা যায় বইয়ের একটা পাতা মিসিং। সেই পাতা প্রফেসরের বাড়িতে খুঁজে পায় প্রফেসরের দুই প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী, রাশাদ আর জয়িতা যারা নিজেরাও স্বনামধন্য আর্কিওলজিস্ট।পাতার তথ্য অনুযায়ী রহস্য উন্মোচনে তারা পাড়ি দেয় শ্রীলঙ্কা। সেখানে তারা আর গুপ্তসংঘ একই সাথে সন্ধান করতে থাকে।রাজা অশোকের রাজত্বকালীন ইতিহাসের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া যায় এখানে। শেষ পর্যন্ত কী পাওয়া গিয়েছিলো রাবনের সমাধি আর বহু আকাঙ্খার চন্দ্রহাস?!
এখানে রামায়ণ কাহিনী নিয়ে অনেক তথ্যের সমালোচনা করা হয়েছে। রাবনকে দেখানো হয়েছে আদর্শ রুপে।
গল্পটা বেশ ভালো লেগেছে। বেশ থ্রিলিং কাজ করেছে আর লিখনীও তরতাজা। কিন্তু শেষ দিকে পড়তে একটু একঘেয়ে লেগেছে। কাহিনী বেশী টানা হয়ে যাচ্ছিল মনে হয়েছে। সেটা বাদে দশগ্রীব বেশ উপভোগ্য বই।
|| পিন্টুর পাঠ প্রতিক্রিয়া || বইঃ দশগ্রীব লেখকঃ সিদ্দিক আহমেদ প্রকাশকঃ বাতিঘর প্রকাশনী (বাংলাদেশ) প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ প্রকৃতিঃ আর্কিওলজি থ্রিলার/ সাসপেন্স প্রচ্ছদঃ অয়ন পৃষ্ঠাঃ ৩৯৯ মুদ্রিত মূল্যঃ ৪০০ (বাংলাদেশী মুদ্রাতে) ধরণঃ হার্ডকভার। _________________________________________________ প্রথমেই বলে রাখি এটা কোন সমালোচনা নয়। বই পড়ার পর যে অনুভূতি সেটাই এখানে ব্যক্ত করছি। এই বইটির ক্ষেত্রে বলতে পারি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে লেখকের দক্ষতাকে ও মেধাকে সমালোচিত করবার মত যোগ্যতা আমার নেই। গল্পের সারংক্ষেপে যাবার আগে কিছু কথা বলতে চাই। লেখকের নিজের কথায় প্রায় ৩ বছর লেগেছে বিষয়বস্তু সম্মন্ধীয় তথ্য জোগাড় করতে। তারপর ধর্ম, বিজ্ঞান, ইতিহাস আর পুরানের মিশেলের এই থৃলার বই। কি পরিমাণ অধ্যাবসায় করতে হয়েছে লেখককে যার সংক্ষিপ্ত আকারে ৪২ টা বইয়ের নাম বলেছেন সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী হিসাবে। যারা ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল বা অতি সহানুভূতিসম্পন্ন তাদের জন্য এই বই নয়। তার মানে এই নয় যে লেখক এখানে ধর্ম কে আঘাত করেছেন। তিনি কোণ ধর্ম কে আঘাত করেন নি, যুক্তি সহকারে খোলা চোখে সম্মানের সাথে বিষয়বস্তুগুলি উপস্থাপনা করেছেন, তার অকাট্য যুক্তির কোন প্রত্যুওর আমি পায়নি। যারা যুক্তি জায়গাতে গালমন্দ বা চাপাতির উপর ভরসা রাখেন তাদের জন্য বলি দয়া করে এই বই পড়বেন না। বিশেষতঃ আমি এমন অনেক কিছু জেনেছি যা আমার জানা ছিল না। রামায়ণ কে আমি অন্য চোখে পড়লাম আর উপলব্ধি করলাম। যা আমার কাছে থৃলার পার্ট টার থেকে ও বেশি আর্কষনীয় ছিল। “দশগ্রীব” বইটির বিষয়বস্তু অন্য যে কোণ থৃলারের থেকে এই বইটিকে আলাদা করে দেয়। ________________________________________________ মূল কাহিনী সংক্ষেপঃ
বিখ্যাত আর্কিওলজিস্ট কামরুল শরীফ খুন হয়ে যান নিজের বাড়ীতে। কারণ অনুসন্ধানে নেমে পড়েন তার দুই ছাত্র রাশাদ ও জয়িতা। কামরুল শরীফের বাড়ী থেকে উদ্ধার হয় পালি ভাষায় লিখিত দুই পাতা যা একটি বিশেষ বইয়ের অংশ বিশেষ। এই বইয়ের খোজে মরিয়া হয়ে উঠেছে গুপ্ত সঙ্ঘের লোকজন। রাশাদ ও জয়িতা আবিষ্কার করে ভয়ংকর তথ্য। যা পালটে দেবে পৃথিবীকে। যার সূত্রপাত সুদূর রামায়ণের সময়ে। এদিকে বইয়ের পাতা দুটিকে উদ্ধারের জন্য গুপ্তসংঘ ভাড়া করে স্থানীয় সুপারি কিলার জহির কে। বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে জহির নিজের কাজ হাসিল করে। গুপ্ত সঙ্ঘ এর বিভাসের কাছে পৌঁছে যায় পাতা দুটি। এদিকে বইটির সূত্র ধরে রাশাদ ও জয়িতা পৌঁছে যায় শ্রীলংকা। পিছু পিছু হাজির হয় বিভাসের লোকজন ও জহিরের লোকজন। উদ্দেশ্য “দশগ্রীব” বইয়ের হাত ধরে মহাদেবের ব্রম্ভাস্ত্র “চন্দ্রহাস” উদ্ধার করা। প্রসঙ্গত গল্পের সারাংশ বেশি বলা যাবে না, স্পয়লার হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত, টানটান প্লটের মধ্যে দিয়ে গল্প এগিয়ে যেতে থাকে। পাঠক রাশাদ, জয়িতা, ও আলীর মুখ দিয়ে পড়ে নিতে পারবেন পুরো রামায়ণ, সঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিশ্লেষণ। রাম, রাময়ন, রাবণ, ছাড়া ও রয়েছে বিভিন্ন পুরানের গল্প, মহাদেব আর উপরি পাওনা মহামতি সম্রাট অশোক আর গুপ্ত সঙ্ঘ। রাশাদ ও জয়িতা কি পারবে মহাদেবের ব্রম্ভাস্ত্র “চন্দ্রহাস” উদ্ধার করতে? নাকি তা শ্ত্রুদের হাতে হস্তগত হবে? নাকি মানবজাতি হুমকির সম্মুখীন হবে? নাকি পুরোটাই শুধুই গল্প? এটা জানতে গেলে পড়তে হবে “দশগ্রীব”। _________________________________________________ পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ ৩৯৯ পৃষ্টার বই আপনাকে শুধু বেধেই রাখবে না, মুগ্ধ করে দেবে। এই বই একবার নয় বারবার পড়া যায়। কখন ও ধর্মের বেড়াজাল, কখনো ইতিহাস, কখনো পুরান আবার কখন ও বা বিজ্ঞান আপনাকে সম্মোহিত করে রাখবে। গল্পের বিন্যাস লেখক অনেক টা সিনেমার মত করে করেছেন, হয়তো তিনি একজন টিভি সিরিজের স্ক্রিপ্ট রাইটার বলে, তার উপর উপরি পাওনা লেখকের ভাষা শৈলীর দক্ষতা, যা লেখকের কল্পনা কে ১০০ শতাংশ বইতে চিত্রিত করেছে। দ্য ভিঞ্চি কোড পড়ার পর ভাবতাম ভারতীয় উপমহাদেশে এরকম শত শত বিষয়বস্তু আছে যা দিয়ে কত সুন্দর লেখা হতে পারে অথচ তার অভাব। অশ্বিন সাংভির দ্য কৃষ্ণা কি আর এই দশগ্রীব পড়লাম। “দশগ্রীব” যা আমাকে কার্যত মুগ্ধ করে দিল। বইয়ের প্রচ্ছদ গল্পের সাথে মানান সই করে খুব সুন্দর হয়েছে। প্রচ্ছদ টি করেছে অয়ন। যা প্রশংসার দাবী রাখে।
বইটিতে বানান ভুল বেশ চোখে পড়ার মত। আশা করি দ্বিতীয় মুদ্রণে টা ঠিক করা হবে। কিন্তু তার জন্য পড়ায় কোন হের ফের হবে না।
যদি অন্যরকম বই পড়তে চান তাহলে অবশ্যই এই বই আপনার বুক সেলফে জায়গা পাওয়া উচিত। আর হ্যাঁ “দশগ্রীব” এখানেই শেষ না আগামী সময়ে এর সিক্যুয়েল পেতে চলেছি, তার আভাস গল্পের শেষে আছে। রেটিং দিয়ে আমি বইটিকে ছোট করতে চাই না, তবে এই টুকু বলতে পারি অনেক দিন পর অসাধারণ একটা বই পড়লাম। যা আমাকে বেশ কিছু দিন সম্মোহিত করে রাখবে।
দ্রষ্টব্যঃ- বেআইনি পি.ডি.এফ বানানো বা শেয়ার করা বা পড়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে লেখক, প্রকা��ক এবং এর সাথে জড়িত সব কিছু কে আর সাহিত্যকে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যা একদম গ্রহণযোগ্য নয়। বই কিনুন পড়ুন, আর শেয়ার করুন।
দশাননের আখ্যান!! এক অসাধারণ প্লট। প্রতি পাতায় পাতায় থ্রিল। রা���ণকে আমরা সব সময়ই ভিলেন হিসেবে জেনে এসেছি। আসলেই কি তাই? তা বই পড়ে বুঝা যাবে। লেখকের যে অনেক পরিশ্রম ও গবেষণা করতে হয়েছে তা স্পষ্ট বুঝা যায় এবং উনার পরিশ্রম সফল ও। অনেক ভালো লেগেছে পড়ে। তার পরেও উনার ধনুর্ধর আমার কাছে সেরা হিসেবে থাকবে। আফসোস একটাই লেখক আর বই লিখবেন না। নাহলে বইটাকে একটা চমৎকার সিরিজ আকারে আনা যেতো।
রাবন, রামায়ন, হিন্দু মিথ, সম্রাট অশোক, আর্কিওলজি, সেইসাথে সামান্য অ্যাডভেঞ্চার ও অ্যাকশন। বেশ ভালো কম্বিনেশন। রাবন ও রামায়ন সম্পর্কে অনেক ইন্টারেস্টিং তথ্য জানা যাবে এই বইয়ে।
নিজেদের প্রিয় এক শিক্ষকের মৃত্যুর কারন খুঁজে বের করতে গিয়ে রাশাদ এবং জয়িতা জড়িয়ে পড়লো মহাকালের এক রহস্যের জালে। অতীত থেকে বর্তমানের সূত্র ধরে ধরে তারা ঘুরে বেড়াতে লাগলো শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন জায়গায়। তারা কি পারবে কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া ব্রহ্মাস্ত্র "চন্দ্রহাস" উদ্ধার করতে??
#পর্যালোচনাঃ ইতিহাস, গুপ্ত সংগঠন, মিথ, ধর্ম আর রহস্যে মোড়া দশগ্রীব উপন্যাস। এখানে উঠে এসেছে রামায়ন, মহাভারত হয়ে সম্রাট অশোক এবং তার নয় রহস্য মানবের কথা। এসেছে রাম, লক্ষণ, সীতা, হনুমান, সুগ্রীব, বালি এবং রাবন এর কথা। সনাতন ধর্মের ব্যাপারে আমার খুব একটা জানা নেই। তবে মহাভারতের এই রাম এবং রাবনের যুদ্ধের কথা মোটামুটি গল্পের মতো করে অনেকভাবেই শুনেছি, দেখেছি কিংবা জেনেছি।
আর আমার সেই সব জানাশোনার উপর কষে একটা চপেটাঘাত করেছে দশগ্রীব। আজীবন জেনে আসা ভিলেনদেরও ভিলেন "রাবন" এর এই নতুন জানা তথ্যগুলো আমাকে বজ্রাহত করেছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। লেখক বইয়ের শুরুতে ৪২টা রেফারেন্স বইয়ের উল্লেখ করেছেন। এবং পুরো বইটা মূলত এই রেফারেন্সগুলো থেকে প্রাপ্য সুতা গুলোকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং যুক্তির মাধ্যমে জোড়া লাগিয়ে তুলে ধরা হয়েছে।
বইয়ের মূল যে কাহিনী তা খুবই সাদামাটা। একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের অবিশ্বাস্য আবিষ্কার, সেটার পিছনে যুগ যুগ ধরে লেগে থাকা একটা সংগঠনের হাতে উনার মৃত্যু, সেই মৃত্যুর রেশ ধরে উনারই প্রাক্তন দুই ছাত্র এবং ছাত্রীর রহস্যের পিছনে লেগে থেকে তা উদ্ধার করা। এই রহস্য উদ্ধার অভিজানের ফাঁকে ফাঁকেই মূলত ঘুরে আসা হয়েছে খৃষ্টপূর্ব ৫০০০ শতাব্দীরও পুরোনো রামায়ন, কিংবা আড়াইশো বছরের পুরোনো সম্রাট অশোকের সম্রাজ্যকালীন যুগ থেকে। এবং প্রপার রেফারেন্স সহকারে বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণ এবং যুক্তির উপর ভিত্তি করে যা বলা হয়েছে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য কিন্তু পুরোপুরি ফেলে দেয়ার মতোও নয়। কে না জানে ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীদের হাত ধরে। আর সেই বিজয়ীরা ইতিহাস সাজিয়ে নেন নিজেদের মতো করে। রাশাদ জয়িতার সাথে বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, আর সেই সাথে একই সময়ে রামায়ন আর অশোকের জীবনীর বর্ণনা বইটা আমাকে চুম্বকের মতো আটকে রেখেছিলো প্রতিটা মুহুর্তে। ভিন্ন ভিন্ন টাইমলাইনে আগালেও লেখকের বর্ণনাভঙ্গির কারনে তা কখনোই কনফিউজিং মনে হয়নি। চমৎকার বর্ণনায়ন আর এক্সিকিউশান সিদ্দিক ভাইকে আমার চোখে মৌলিক সাহিত্যের অন্যতম সেরা একজন লেখক হিসাবে পরিণত করেছে।
রাবনকে কেনো রাক্ষস ডাকা হয়, কেনোই বা বলা হয় তার দশটা মাথা আছে তার প্রপার এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে বইয়ে। এছাড়াও হনুমান, বালি, সুগ্রীবদের বানর রাজ্য কিংবা এরা আদৌ বানর কি না সেই ব্যাপারেও আলোকপাত করা হয়েছে বইয়ে। আর্য এবং অনার্য দের যুদ্ধ, সীতার পরীক্ষা, রাবনের সীতাকে অপহরণ করা, কিংবা ব্রহ্মাস্ত্রের ধ্বংসাত্মক শক্তির পিছনের কারন সবই টুকটাক ব্যাখ্যা করা হয়েছে বইয়ে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের জায়গা থেকেই যায় তবুও বলবো রেফারেন্সগুলোর দিকে তাকালে এই ব্যাখ্যা গুলোকে কোনোভাবেই অবহেলা করা সম্ভব না। তবে রাবনের "পুষ্পরথ" বা বিমানের ব্যাপারে কোনো এক্সপ্লেনেশন পেলাম না। পাঁচ হাজার বছর আগে এই "উড়ন্ত জাহাজ" কিভাবে সম্ভব হলো তার কোনো একটা ব্যাখ্যা পেলে ভালো লাগতো।
বইয়ের শেষাংশে এসে রজনিস ওশোর অংশটুকু আমার কাছে কিছুটা অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। নব সংঘ এবং রাশাদ জয়িতার চন্দ্রহাসের পিছনে ছুটে চলার প্রপার এক্সপ্লেনেশন থাকলেও, তাদের অন্তর্ভুক্তির অংশটুকু আমার কাছে তেমন জোড়ালো মনে হয়নি।
#চরিত্রায়নঃ পুরো বইটার এই একটা জায়গা নিয়ে বেশ আক্ষেপ আছে। রাশাদ জয়িতার মতো প্রোটাগনিস্টদের পাশাপাশি নব সংঘের এন্টাগনিস্টদেরও প্রপার কারেক্টারাইজেশন হয়নি বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। সেই তুলনায় জহির বাবুর চরিত্রায়ন ভালো লেগেছে। এছাড়া সম্রাট অশোককেও বেশ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পৌরাণিক চরিত্রগুলোর মধ্যে রাবনের পাশাপাশি সীতার যে চরিত্রায়ন দেখিয়েছেন লেখক তা বেশ শ্রদ্ধার জন্ম দেয় এই দুই চরিত্রের প্রতি। বিশেষ করে এই বই পড়লে এবং মনের ধর্মীয় বিবেচনাটুকু বাদ দিলে রাবনকে আপনি ভালোবাসতে বাধ্য। অসম্ভব জ্ঞ্যানী, সাহসী এবং বিচক্ষণ এক ব্যক্তিত্ব হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে রাবনকে।
#প্রোডাকশনঃ টিপিক্যাল বাতিঘরের প্রোডাকশন। ভালো বাইন্ডিংস এবং পেইজ কোয়ালিটির পাশাপাশি পেইনফুল লেভেলের বানান ভুল ছিলো বইয়ে। বাতিঘরের পড়া আমার বইগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ভুল পেয়েছি আমি এই বইয়ে৷ সম্পাদনা জাতীয় কিছু ছিলো বলেও মনে হয়নি। তবে সিম্পলের মধ্যে প্রচ্ছদটা চমৎকার লেগেছে। বিশেষ করে লেটারিংটা ছিলো আউটস্ট্যান্ডিং।
#পরিশিষ্টঃ ওভারঅল দশগ্রীব একটা অসাধারণ ঐতিহাসিক, মিথোলজিক্যাল, কন্সপিরেসি থ্রিলার মনে হয়েছে আমার কাছে। পৃথিবীতে কতো কিছু যে জানার বাকী রয়ে গেছে, আর যা জানি তার ভিতরেও যে কতো বেশী ইতিহাস বিকৃতি রয়ে গেছে তা ভাবলে অবাকই লাগে। তবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারো কারো বইটা খারাপ লাগতে পারে। জন্মলগ্ন থেকে বিশ্বাস করে আসা ইতিহাস ভিন্ন রূপে নিজেদের সামনে উপস্থাপিত হলে আসলে কারোই ভালো লাগা সম্ভব নয়। লেখকের পরবর্তী বইগুলো পড়ার জন্য অধীর আগ্রহ হচ্ছে।
সিদ্দিক আহমেদ কে আমি চিনেছি 'ধনুর্ধর' এর মাধ্যমে। প্রথম পরিচয়ে আমি লেখনীর প্রতি হেলে পড়েছিলাম বলা চলে। কি দূর্দান্ত লেখনী। তারপর ওই পরিচয়ের সুবাদে হস্তগত করলাম 'দ���গ্রীব' বইটি।
ইতিহাস, পুরাণ, রহস্য, গুপ্তধন আর গুপ্ত সংগঠন সবই বরাবরের মতো আমার আগ্রহের জায়গা। আর এই বই তো বলতে গেলে সবকিছুর মিশেল। কাহিনির শুরু এক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজে উদ্ধার হওয়া কিছু বইয়ের পাতা নিয়ে।
উদ্ধারকৃ পাতাগুলো গায়েব করে দেয় একদল লোক, পিছে ফেলে রেখে যায় কিছু লাশ। তার ভেতর একটি লাশ জয়িতা-রাশাদ' দের স্যারের। কাহিনির খাতিরে তারা একসময় জড়িয়ে পড়ে পাতাগুলোর উদ্ধার কার্যে। সেখান থেকে ই ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে পাতার ভেতরে থাকা তথ্যগুলো।
তথ্যগুলোতে দেখা যায় 'রামায়ণে' র ভিলেন রূপে আমরা যাকে চিনি সেই রাবণের কথা আছে। রাবণ কে দেওয়া শিবের অস্ত্র 'চন্দ্রহাস' নিয়ে একসময় জানতে পারি। কাহিনির স্তর বিন্যাস প্রতক্ষ ভাবে দু'টি হলেও, কাহিনি আবছায়া ভাবে চলে ৩টি স্তরে। প্রথমটি, বর্তমান কে নিয়ে। দ্বিতীয়টি, সম্রাট অশোকের সময়কার। আর পরোক্ষভাবে চলা তৃতীয়টি, রামায়ণে ঘটে চলা ঘটনাগুলো নিয়ে।
ইতিহাস কি সবসময় বিজয়ী কে নিয়ে কথা বলে? না ইতিহাসের একটি কোণে আশ্রয় হয় 'বিজিত'দের নিয়েও। না ইতিহাস, যারা হেরে যায় তাদের কোনো আশ্রয়ই দেয় না? এর আসল জবাব সম্ভবত ঐতিহাসিকদের ই দেওয়া উচিত।
রামায়ণে লঙ্কার রাজা আসলে ই কি ভিলেন ছিলেন? না তারও কিছু ব্যক্তিগত কারণ ছিল? 'রাম' কি সম্পূর্ণ রূপে নির্দোষ? না 'দশানন' বিশ্বাসঘাতকতার শিকার? আসলে কি হয়েছিল বাল্মিকীর লেখা রামায়ণে?
অনেক অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় বইটির শেষ পর্যন্ত পড়ি। যদিও তার আগেই আনি 'রাশাদ' এর সাথে একমত পোষণ করে ফেলেছিলাম 'রাবণ' এর বিষয়ে। তারপরও কাহিনির শেষ দেখার জন্য শেষ অবধি পড়া।
বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল আমার কাছে, বইয়ের শুরুতে দেওয়া ৪২টি বইয়ের রেফারেন্স। আর বইয়ের সবচেয়ে দূর্বল চরিত্র লেগেছে 'জয়িতা' কে। বেচারীর সিলি টাইপ প্রশ্নগুলো তার ব্যক্তিত্বের সাথে যায়না বলে ই আমার এ মূল্যায়ন।
আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় উক্তি আমার কাছে 'জহির' এর উক্তিটি।
❝মানুষ টাকার কাছে বিক্রি হয়না ঠিকাছে, কিন্তু তারও একটা সীমা আছে। তারে মুলত জিগাইতে হইবো - 'বিক্রি হওনা ঠিকাছে মাগার কয় টাকা পর্যন্ত হও না '। ❞
আজ এ পর্যন্ত, সময় থাকলে আরো অনেকদূর লেখা যেতো। তবে একটা কথা বলতে পারি, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহ থাকলে আর ফিকশন পড়ার ইচ্ছে থাকলে এ বইটি আপনি পড়তেই পারেন। বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমারমতো আপনিও পেয়ে যেতে পারেন।
আর হ্যা, পড়তে বসার সময় পেন্সিল নিয়ে বসতে ভুলবেন না যেন।
বইয়ের পাতায় হোক, মুভিতে হোক বা মানুষের মুখের ভাষায় দশ মাথা মানেই বিশাল আকারের রাবণ। যাকে নিয়ে রচিত হয়েছে শত নাটক,গল্প…। কিন্তু আসলে আমরা রাবণকে কতটুকু চিনি। আমরা জানি লঙ্কা রাজ্যের অধিপতি রাবণ রামের শত্রু। কিন্তু কখনো কি এই প্রশ্ন মনে জেগেছে রাবণ কেন রামের পিছু নিল। রাবণে তথা দশ মাথাওয়ালা মূর্তির নিজেরও একটা রাজ্য রয়েছে। হয়তো রাবণের আরও অনেক গুন ছিল যেটা সবারই অজানা…
কাহিনি সংক্ষেপ:
বিখ্যাত আর্কিওলজিস্ট প্রফেসর কামরুল হাসানকে রাতারাতি হাম*লা করল অজানা এক দল, পরে মৃত্যু হয়।প্রাথমিক তদন্তে জানা যায় বিখ্যাত এক পুস্তকের জন্য এই হ*ত্যা কান্ড। পুস্তকটি হাজার বছরের পুরনো, যেটি শত্রুদের হাতে পড়লে পুরো পৃথিবী এক অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি হবে।ভাগ্যক্রমে পুস্তকের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পাতা হাতে পড়ে যায় প্রফেসরের ছাত্র রাশাদ এবং জয়িতার কাছে। রাশাদ পাতাটা দেখেই বুঝতে পারে এটি কোনো সাধারণ বইয়ের পাতা নয়,এটির সাথে জুড়ে রামায়ণের বিখ্যাত চরিত্র রাবণের তথা দশগ্রীব এর। দুজনেই এর রহস্য উদ্ধারে নেমে পড়ে সেইসাথে সঙ্গী হয় কতোগুলো অজানা ইতিহাস।
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ
সিদ্দিক আহমেদ এর আগে ধনুর্ধর পড়েছি। যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন কি চমৎকার লেখনি ছিল। তবে এখানে লেখেক বর্তমানের সাথে অতীত জুড়ে দিয়েছেন, ধনুর্ধর ছিল পুরোটাই ইতিহাস।
এবার আসি গল্পে,
রাবণের নাম শুনে নিশ্চয়ই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই চরিত্র যে সীতাকে অপ*হ*রণ করেছিল এবং রামের সাথে যুদ্ধ করেছিল।এবং আপনি মানেন রাবণ একজন নিষ্ঠুর রাক্ষস, খারাপ চরিত্র। কিন্তু এই বইয়ে রাবণই আসল হিরো। আপনি রাশেদের বক্তব্যে দ্বিধায় পড়ে যাবেন রাবণ সম্পর্কে কি এতদিন আমরা ভুল জেনেছি। সত্যিই তো রাবণের একটায় দোষ ছিল, সে সীতাকে অপহরণ করে। কিন্তু রাবণ তার বোনের অ*পমা*নের বদলা নিতেই তো অপহরণ করে। আপনি রাবণের জায়গায় হলে কি করতেন? তাছাড়া রাবণ ছিল অসম্ভব জ্ঞানী, তার মৃত্যুশয্যাও রাম লক্ষ্মণ কে পাঠিয়েছিল তার থেকে জ্ঞান আহরণ করতে। তাহলে ভেবে দেখুন রাবণ কি পরিমাণ জ্ঞানী ছিল। রাম তার শত্রু জেনেও সে রামের জন্য যজ্ঞ করে।
রাবণ সম্পর্কে রাশাদের প্রতি যুক্তি তে আমি অবাক হয়েছি, আসলেই তো এরকমও হতে পারে। সেই রাবণের সাথে দশগ্রীব পুস্তকটার কি সম্পর্ক তার মর্ম উদ্ধারে নেমে পড়ে রাশাদ, জয়িতা সাথে আরও একদল শক্তিশালি ক্ষমতাধর দল,সেই দলটিও রহস্যময়।
লেখক এখানে দুভাবেই পাঠককে থ্রিল দিয়েছেন। রাশাদ আর জয়িতার এডভেঞ্চার জার্নি আর রাশাদের জবানিতে অজানা একটা কাল।
লেখকের সবচেয়ে যে জিনিসটা ভালো লেগেছে সেটা হলো লেখক পুরোটা সময়ই তার গল্পের উপর ফোকাস করেছেন, অন্য কোন বিষয় অযথা টেনে আনেন নি। যার কারণে আমি পুরোটা সময় গল্পের সাথে লেগে ছিলাম। এখানে লেখক সরাসরি টুইস্ট দেন নি, দিয়েছেন ইতিহাসের রামায়ণের কাহিনির মধ্যে। তাই বলব যারা ইতিহাস পছন্দ সেই সাথে মিথ এবং থ্রিল মিশ্র জরনা চায়, তাদের জন্য এটা মাস্টরিড।
চরিত্রঃ
রাশাদঃ রাশাদ চরিত্রটা সাহসী এবং জ্ঞানী একজন আর্কিওলজিস্ট এর। প্রথম পাতা থেকে সে অ্যাকশন শুরু করে দেয়। তার মুখ দিয়ে লেখক বেশির ভাগ রাবণকে তুলে ধরেছেন।
জয়িতাঃ রাশেদের মতো অত সাহসী না হলেও গল্পের সমান গতিতে জয়িতাকেও রাশাদের পাশে পাশে দেখা যায়।
এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে।
কিছু অসংগতিঃ
এখানে লেখক বর্তমান, অতীত দুটো টাইমলাইনে গল্প এগিয়েছেন। কিন্তু অতীত শুরু হওয়ার সময় কোন প্রতীক কিংবা স্থান সময় উল্লেখ করেন নি, যার কারণে বর্তমান সময় পড়তে পড়তে হুট করে অতীতে ঢুকে পড়াতে কয়েকবার বুঝতে একটু সমস্যা হয়েছে। আর প্রোডাকশনটা বাতিঘরের অন্যান্য বইয়ের মতোই। কয়েক জায়গায় বানান ভুল ছাড়া তেমন অসংগতি চোখপ পড়ে নি।
নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে বইয়ের মূল বিষয়বস্তু রাবণ। রাবণ একসময় শিবের হাত থেকে এক ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র পেয়েছিলেন: চন্দ্রহাস। রাবণের মৃত্যুর পর সেই অস্ত্র লুকিয়ে ফেলা হয় এবং সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় দশগ্রীব নামের এক পুঁথিতে। সেই পুঁথি সংগ্রহ নিয়ে এবং চন্দ্রহাস উদ্ধার নিয়ে এই প্রায় ৩০০ পাতার উপন্যাস: দশগ্রীব। গল্প শুরু হয়েছে খ���ব মন্থর গতিতে। প্রথম ১৫-২০ পাতা পড়ার পর আর এগোনোর নাও ইচ্ছে হতে পারে। কিন্তু কষ্ট করে যদি টেনে নিয়ে যেতে পারেন নিজেকে, এ বই আপনাকে টেনে ক্লাইম্যাক্স অবধি নিয়ে যেতে সক্ষম। একটা পারফেক্ট কোয়েস্ট হিসেবে বইটা ভাল। তবে ওয়ান টাইম রিড হিসেবেই ভাল। অ্যাডভেঞ্চারের থ্রিলটাও বেশ ভালোই অনুভব করতে পারবেন। তবে আমার মতে কিছু কিছু জায়গা আরও বেটার হতে পারত, সেগুলো বলছি: • রাবণ নিয়ে এতগুলো থিওরি এসে গেছে যে আল্টিমেটলি কোন থিওরিটা যে প্রতিষ্ঠা করা যায় এই গল্পের সঙ্গে সেটা বড় গুলিয়ে গেল। • রাবণ নিয়ে নানা তথ্যের উপস্থাপনা হয়েছে এই বইয়ে। কিন্তু ব্যাপারটা বড্ড ইনফরমেটিভ হয়ে গেছে। তথ্যগুলো আরও কম্প্যাক্ট করে দেওয়া যেত। উদাহরণস্বরূপ, আলীভাইয়ের রামায়ণের পুনর্কথনের কথা বলা যায়। • তথ্যের ভারে টালমাটাল হওয়ার পাশাপাশি ঘটনাগুলোকে এক্সটেন্ড করা হয়েছে। যেটা কোথাও কোথাও খুব চোখে লাগে। বহু জায়গায় মনে হয়েছে যে এই অংশটা না থাকলেও চলত। বিশেষতঃ লাল দল আর জহিরের অংশগুলো। একা রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর। • অশোকের নয় রহস্য মানব ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়নি। শেষের দিকে খুব দায়সারাভাবে ওদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। • ১৮০-১৯০ পাতার পর থেকে অনেকগুলো অধ্যায় লেখার সময় আরও যত্নশীল হওয়া যেত বলে মনে হয়েছে। অকারণ ঘটনাবলী কেটে পাঠককে বারবার ক্লিফহ্যাঙ্গারে ঝোলানোর প্রচেষ্টায় জিনিসটা তেতো হয়ে গেছে। • আর একটা প্রশ্ন রয়ে যায়। চন্দ্রহাসের অ্যাক্টিভেশন সিস্টেম যদি রাবণ নষ্ট করেই দিয়ে গিয়ে থাকে, তবে শেষে রাশাদ চন্দ্রহাস ওই সাহেবের হাতে দেখে ওরকম লাফ মারল কেন? কেনই বা বলা হল যে চন্দ্রহাস পর্ব এখনও শেষ হয়নি? এর কোনো সিকোয়েল এলে খুব বিরক্তিকর ব্যাপার হবে সেটা। এই সমস্ত পয়েন্টই আমার ব্যক্তিগত মতামত। কাজেই কেউ রুষ্ট হবেন না প্লিজ। সবশেষে একটাই কথা বলব: এই দেবতাদের বর্ণ নিয়ে তাঁদের অনুগামী ট্রাইবদের মধ্যে গন্ডগোল বিষয়টা ঠিক পরিষ্কার না। তিন বাহু দশ মুখেও সদুত্তর পাইনি, এতেও পেলাম না। ব্যাপারটা কেউ একটু ব্যাখ্যা করলে খুশি হতাম।
অলমিতি।
This entire review has been hidden because of spoilers.
দশগ্রীব। অর্থ দশ গ্রীবা বা দশ মাথার অধিকারী। বলা হয় যে রামায়ণ মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র, রাবণের আসল নাম দশগ্রীব। কিন্তু রাবণ কি শুধুই মহাকাব্যের এক চরিত্র? ইতিহাসের পাতায় কি তার কোনো পদচিহ্ন নেই? মহাকাব্য কি শুধুই কল্পনার ফসল? না কি সত্য আর গল্পের মিশ্রণ? প্রত্নতাত্বিক আর গবেষকদের হাতে উঠে আসা বিভিন্ন তথ্য আর প্রমাণ কিন্তু পরেরটার দিকেই ইঙ্গিত দেয়। রামায়ণের এর সংস্করণের সংখ্যা একাধিক। সেইগুলোতে উঠে আসা বর্ণনাতেও আছে বিস্তর ফারাক। তাহলে কে ছিলো রাবণ? কেমন ছিলো সে? কী ঘটেছিলো আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগের বেদিক যুগে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে আলোচনা লুকিয়ে আছে সিদ্দিক আহমেদ রচিত থ্রিলার জনরার উপন্যাস দশগ্রীব এ। গল্পের শুরু কিছুটা সহিংসতার দৃশ্যায়ন থেকে। ধীরে ধীরে রহস্যের জট পরিষ্কার ভাবে পাঠকের সামনে উঠে আসতে থাকে। রাশাদ আর জয়িতার খোজ তাদের নিয়ে যায় অনেক নতুন সব সত্য আর তথ্যের মধ্যে দিয়ে। রহস্যের জট যেমন একদিকে খুলতে নিয়েও খোলে না, সেই সাথে উঠে আসতে থাকে ভয়ানক সব চক্রান্ত আর বিস্ময়কর কিছু জিনিস।
পাঠক হিসেবে প্রায় মোহগ্রস্তের মতো বই শেষ করেছি। রহস্যের জট খুলতে গিয়ে লেখক কখনো রাশাদের মুখ দিয়ে, আবার কখনো বা অন্য কোনো চরিত্রের মুখ দিয়ে তুলে ধরেছেন খুব সুন্দর সব তথ্য, প্রশ্ন করেছেন হাজার বছর ধরে চলে আসা গল্পের সত্যতা কে। আর এরজন্য লেখক খুব মারাত্মক রকমের গবেষনার মধ্যে দিয়েই গেছেন। বইয়ের শুরুতেই তার গবেষনার ৪২ টি বইয়ের তালিকাও তিনি দিয়েছেন তথ্যসূত্র হিসেবে। গল্পের সম্প্রসারণের ধরন খুবই সুন্দর। শেষটা যদিও "শেষ হইয়াও হইলো না শেষ" এর একটা অনুভূতি জাগ্রত করেছে। পুরো উপন্যাস যেকোনো পাঠককে মোহগ্রস্ত করার ক্ষমতা রাখে বললে হয়তো খুব বেশি একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। আর যারা ইতিহাস-সভ্যতা-মহাকাব্য এর নাম শুনলে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তাদের জন্য এই বইকে চমৎকার না বলে কোনো উপায় থাকবে না।
ফেলুদার গল্প "গোলকধাম রহস্য" তে "Unputdownable Book" বলে একটা টার্ম পেয়েছিলাম। যার মানে হল যে বই একবার পড়ার জন্য পিক আপ করলে আর পুট ডাউন করা যায়না।
লেখক সিদ্দিক আহমেদ এর 'দশগ্রীব' এমনি একটি বই। একটানা বই পড়ার সময় আর নেই। তাই আমাকে পুট ডাউন করতে হয়েছে বেশ কবার। এর পরেও কাজের ফাঁকে অথবা ঘুমানোর আগে একটু একটু করে শেষ করে ফেললাম ৪০০ পৃষ্ঠার এই বইটি। বইটি পড়ে মনে হলো লেখক এই বই লেখার জন্য প্রচুর পরিমানে পড়াশুনা করেছেন। তা নাহলে এই বই লেখা সম্ভব না! দারুণ গল্প আর গল্পের বিষয়বস্তু 'রামায়ন'। ছোটবেলায় দাদুর মুখে রামায়ণ আর মহাভারতের গল্প শুনেছি অনেক। তাই আমার প্রিয় সাবজেক্ট পেয়ে গেলাম। ক্যারেক্টার বিল্ডিং দারুণ। অ্যাকশন, তথ্য, হালকা রোমান্সের আভাস সবই আছে। গল্পের কোন অংশেই বিরক্ত হইনি অথবা স্লো মনে হয়নি আমার কাছে। এক কথায় দারুণ বই।
বইয়ের নাম "দশগ্রীব" থেকে এটা আন্দাজ করা যায় যে বইয়ের কাহিনী দশানন রাবণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তবে রাম-রাবণ-রামায়ণকে যে নতুন দৃষ্টিতে লেখক বিশ্লেষণ করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এক নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন এক ধর্মগ্রন্থ, এক মহাকাব্য।
তবে "দশগ্রীব" নন-ফিকশন বই নয়! জয়ীতা-রাশাদ জুটির এক অনবদ্য থ্রিলারের মধ্য দিয়ে বইয়ের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে অনেকগুলো টাইমলাইনে, সম্রাট অশোক থেকে নব সঙ্ঘ, সনাতন ধর্ম থেকে বৌদ্ধ ধর্ম, বেদ থেকে বিজ্ঞান অনেকগুলো বিষয় ঘিরে। এক রুদ্ধশ্বাস, টানটান থ্রিলারের মাঝেও এনেছেন নৈতিকতার কথা।
সবশেষে, দশগ্রীবের মধ্য দিয়ে এই প্রথম লেখকের লেখা পড়ার সুযোগ হলো। এবং প্রত্যাশার পারদ অনেকখানিই বেড়ে গেলো পরবর্তী লেখাগুলো পড়ার প্রতি।
বই নিয়ে পাঠকের প্রতি প্রকাশকের দায়বদ্ধতার কথা জানি কারণ, নিজের পেশা। পাঠককে আনন্দ দেয়ার চেয়ে বেশী বিরক্তি তৈরি করে যখন বইয়ের প্রত্যেক পাতা তখন পাঠক হিসেবে লেখক মানুষটার জন্য কষ্ট হয়। ভাষার প্রতি এই অবজ্ঞা, অবহেলার কারণ জানতে ইচ্ছে করে বড্ড। আমি বানান ভুল উপেক্ষা করে যাওয়ার মতো মানুষ নই, আর এতো এতো ভাষাগত ভুল দেখেও না দেখার ভান করা কষ্টকর। অনায়াসে ৫★ দেয়ার মতো একটা বই, ৪★ তারা দেবো অর্ধেক পড়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু পড়তে গিয়ে বারবার হোঁচট খাবার কারণেই তিনতারা।
৩.৭৫/৫ দশগ্রীব একটি মাইথোলজিকাল থ্রিল���র। মাইথো��জি সম্পর্কিত নানান তথ্য সমৃদ্ধ হলেও বইটিতে থ্রিলার উপকরণের সামান্য কমতি উপলব্ধি করেছি, যা উপন্যাসের গতি কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে।
তাছাড়া উপন্যাসের চরিত্র গুলোর মাধ্যমে দশগ্রীব(রাবণ), চন্দ্রহাস এবং রামায়ণের বেশ খানিকটা অংশের সুন্দর বর্ণনা পেয়েছি।বিশেষত যাদের রামায়ণ পড়ার সুযোগ হয়নি, তারা একাধিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রামায়ণ সম্পর্কে তথ্য আহরণ করতে পারবেন।
সর্বোপরি, এটি একটি well researched, তথ্য সমৃদ্ধ উপন্যাস। যারা তথ্য সমৃদ্ধ বই পড়তে পছন্দ করেন না, শুধুমাত্র thriller element এর জন্য বইটিতে পড়তে চাইছেন, তারা হতাশ হবেন।
অসংখ্য ধন্যবাদ রাবণ ভাইয়াকে এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য। ভাইএর প্রতি রেসপেক্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। Jokes apart, বইটা বেশকিছু লজিকাল আইডিয়া দেয় যার জন্য ভালো লেগেছে। ধনুর্ধর পড়ে যেমন ভালো লেগেছিল, এবারও সেম।
রামায়ণ/মহাভারত কিংবা পুরাণে উল্লিখিত অনেক ক্লুলেস থিওরির লজিকাল কিছু ব্যাখ্যা এখানে এসেছে। যেমনটা বিভিন্ন অস্ত্রের বা দেবতাদের মোটামুটি সাইন্টিফিক ব্যাখ্যা।
রাশাদ জয়িতা কম্বিনেশন টা খুব ভালো। এন্ডিং দেখে মনে হইল পরে আরো কিছু আসবে। তার অপেক্ষায়।
বেশ ভাল লেগেছে। রামায়ণের লৌকিক ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়াস ভীষণ চিত্তাকর্ষক। গল্পের মূল রহস্য উদঘাটন সহজ ছিলনা এবং বুদ্ধিদীপ্ত ছিল বলে; বইয়ের সময়টা দারুণ উপভোগ্য ছিল।
কিছুদিন পূর্বে নিজ টাইমলাইনে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। যেখানে উল্লেখ করেছি মিশরীয় ও গ্রিকের মতো যেসব ধর্ম এখন প্রচলিত সেগুলো একটা সময় মিথে পরিণত হবে। ইতোমধ্যে সে-ই প্রসেস চালু হয়ে গিয়েছে। পুরাণ আর মিথ একই ক্যাটাগরির মনে হলেও পার্থক্য রয়েছে অনেককিছুতে। সেদিকে যাচ্ছি না। ধর্মীয় যতকিছু রয়েছে বা ঘটেছে সেগুলোকে আমরা মিথ হিসেবে জানা শুরু করেছি। রিসার্চও হয় অনেকটা সেইভাবে। মুখ ফুটে কেউ না বললেও অনেকে সেটাই ভেবে নিচ্ছি। যা-ই হোক, এইসব চিন্তাভাবনায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার অন্ততপক্ষে কারও নেই। বাধাহীন এই জীবনে অনেক কিছুই বলা যেমন যায় তেমন করাও যায়। যুক্তিতর্ক যে সবসময় খাটবে তাও না।
মিথ বা পুরাণের প্রসঙ্গ টানার কারণ ❛দশগ্রীব❜ উপন্যাসটি আর্কিওলজিক্যাল থ্রিলার হলেও পুরোপুরি ইতিহাস ও পুরাণ নির্ভর। ইতিহাস নির্ভরের কারণ সম্রাট আশোকের কলিঙ্গ জয়ের কাহিনি। একইসাথে ছোটো করে রয়েছে মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসের নেপথ্য। পুরাণ অংশে উঠে এসেছে ত্রেতা যুগের কাহিনি। যেখানে রাম-রাবণের দ্বন্দ্ব, কেন রাবণ ভিলেন আর রাম কেন হিরো এই নিয়ে। ❛দশগ্রীব❜ উপন্যাস পুরোপুরি রাবণ বেসড বলা যায়, কারণ লেখক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বারংবার বুঝিয়েছেন রাবণ অর্থাৎ দশগ্রীব বা দশাননকে যতটা আমরা খারাপ ভেবে থাকি ততটা খারাপ উনি নন। ওনার চোখে অর্থাৎ বইয়ের মূল চরিত্র রাশাদের চোখে রাবণ হচ্ছে হিরো। শুধু রাশাদ না অন্যান্য চরিত্রের চোখেও হিরো। এখন কেন হিরো আর কী কারণে হিরো সেটার জন্য লেখক রিসার্চ করতে ব্যয় করেছেন নূনাধিক ৩ বছর সাথে পড়তে হয়েছে ৪২টি গ্রন্থ। হয়তো আরও বেশি গ্রন্থ পড়েছেন তবে রেফারেন্স হিসেবে দেখিয়েছেন ৪২টি। ওখানে আবার মৌর্য বংশের কাহিনি ও সম্রাট আশোক নিয়ে অনেক গ্রন্থ রয়েছে।
লেখক ইতিহাসের ভিত শক্ত করতে তুলে এনেছেন সম্রাট আশোকের রহস্য নয় মানবের কাহিনি, গুপ্ত সংঘ ও রজনীশ ওশো’র মতো আলোচিত-সমালোচিত চরিত্রকেও। পুরাণ পার্টে রাবণকে হিরো হিসেবে জাহির করতে ও পার্থক্য দেখাতে বাল্মিকী মুনি’র রামায়ণের পাশাপাশি মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, বাল্মিকী-রামায়ণ উপাখ্যানের প্রথম অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝার বিভিন্ন যুক্তি ও ব্যাকস্টোরি। এছাড়া রামায়ণে হনুমান বানর নয়, রাম দেবতা নয়, শিব কালো বিষ্ণু সাদা, রাম ইন্দো-ইয়োরোপীয় কারণ তিনি আর্য অন্যদিকে রাবণ অনার্য, অনার্য বলে তিনি আমাদের আপন আর রাম আর্য বলে পর, সাদা-কালো নিয়ে মিষ্টি রেসিজম (খাঁটি ইংরেজিতে বললে), সীতা রামের বোন (গেম অব থ্রোন্স ট্যাগ), সীতার জন্ম রহস্য, রাবণ সীতার মেয়ে-সহ এইরকম অনেক থিউরি লেখক তুলে এনেছেন। তবে তিনি শুধু তুলে এনে ক্ষান্ত হননি, কারণ দেখিয়েছেন ব্যাখা দিয়েছেন। কিছু ব্যাখ্যা মনঃপূত হলেও কিছু লেগেছে খোঁড়া যুক্তি। যুক্তিতর্ক নিয়ে বলতে গেলে আমিও একটা নভেলা লেখে ফেলতে পারি। দিনশেষে বিশ্বাস হচ্ছে বড়ো জিনিস। অবশ্যই অন্ধ না, যাচাই-বাছাই অন্তত করা দরকার। মূল উপখ্যান, কাব্য, গ্রন্থ আমরা কয়জনে পড়ি? রেফারেন্সের জন্য দ্বারস্থ হওয়া লাগে অনুবাদ হওয়া গ্রন্থের ওপর তাও যে লেখেছে সে যে নিজের মনমতো কিছু ঢুকিয়ে দেয়নি এই প্রমাণ কে দিবে? ৩ বছর কেন ৩৩ বছর পার করে দিলেও আসল কাহিনি জানতে পারব কি-না সন্দেহ।
ত্রেতা যুগে রাবণ-শিব যুদ্ধে শিবকে রাবণ ভালোই টক্কর দিয়ে ‘চন্দ্রহাস’ জয় করে নেয়। আবার ধারণামতে ‘চন্দ্রহাস’ পেয়েছে রাবণ মহাদেবের স্তুতি করে। তাহলে কোনটা সত্য? এই ‘চন্দ্রহাস’ নিয়ে পুরো ❛দশগ্রীব❜ উপন্যাস প্রতিষ্ঠিত। কাহিনিও ঘোলা কম হয়নি। লেখকের মতে রাম-রাবণ আদতে দেব-রাক্ষস নয়, ওনারা মানুষ। আর শিব একজনক ভালো যোদ্ধা মাত্র। ওনাকে দেবতা বানানো হয়েছে অনেক পরে! প্রাচীন তিন বেদে শিবের নাম উল্লেখ নেই কিন্তু ‘রুদ্র’ তো উল্লেখ আছে? রুদ্র যে শিব সেটা আশা করি প্রাচীন বেদ খুঁজলে রেফারেন্স পাওয়া যাবে?
যা-ই হোক, ‘চন্দ্রহাস’ আর ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ নিয়ে বই শেষ করার পরেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে গেছে। লেখক যদি ‘ব্রহ্মাস্ত্র' নিয়ে ফোকাস করেন তাহলে সেখানে ব্রহ্মাকে টানার দরকার ছিল কিন্তু তিনি সবকিছুতে টেনেছেন শিবকে। শিবের অস্ত্র সরি শস্ত্র। অস্ত্র যেটা নিক্ষেপ করা যায় আর শস্ত্র যেটা হাতে নিয়ে যুদ্ধ করে। অস্ত্র হচ্ছে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ আর শস্ত্র হচ্ছে ‘চন্দ্রহাস’ যেটার গঠন খড়্গের মতোই। মতোই না এইটা খড়্গ-ই, কিন্তু পুরো কাহিনিতে চন্দ্রহাস নিয়ে হাইপ ক্রিয়েট হলেও উদ্ভাবন করেছে ব্রহ্মাস্ত্র! এই ব্রহ্মাস্ত্র না-কি রাবণের জ্ঞানের মাধ্যমে তৈরি! কারণ জ্যোতিঃশাস্ত্রে রাবণ ছিল সর্বাধিক জ্ঞানী। এখন কীভাবে সেটা হয়েছে জানতে হলে ❛দশগ্রীব❜ পড়তে হবে।
মূলত পুরাণের এই ধারা থেকে বর্তমানের কাহিনি শুরু। এরপর পেরুতে হয়েছে কত মাঠঘাট, বনবাদাড়। এক প্রাচীন পুঁথির লড়াইয়ে নেমেছে আর্কিওলজিস্ট-সন্ত্রাস-গুপ্ত সংঘের মতো আরও অনেক ভয়ংকর লোকজন। শেষ পর্যন্ত কে পেয়েছে এই পুঁথি? আর কীভাবে উদ্ধার হবে এই পুঁথির লুকায়িত রহস্য? কেন এত গুরুত্বপূর্ণ পুঁথির মাহাত্ম্য?
➲ আখ্যান—
অনভিপ্রে�� জটিল এক রহস্যের জালে জড়িয়ে গেল প্রত্নতাত্ত্বিক রাশাদ এবং জয়িতা। প্রাচীন পুঁথির সোঁদা ঘ্রাণে ভেজা অদ্ভুত এক ঐতিহাসিক স্মারকের পেছনে ছুটে চলেছে সমস্ত ঘটনা প্রবাহ। যেখানে শত-সহস্র শতাব্দি ধরে সত্যের মহীরূহ ঢেকে দিয়েছে ধীরে ধীরে জমতে থাকা অসত্যের আগাছা।
'দশগ্রীব' এক ঐতিহাসিক রহস্য-রোমাঞ্চ আখ্যান। প্রাচীন কথকতার তমসা ভেদ করে দ্ব্যর্থহীন গন্তব্যের পথে বিস্ময়কর, অবিশ্বাস্য এক যাত্রা। ক্ষমতা, রাজনীতি আর ধর্মের ঘোলা কাঁচের নিচে দম আটকে থাকা প্রকৃত ঐতিহাসিক উপাখ্যান উদ্ধারের প্রচেষ্টা।
পাঠক আপনাকে প্রহেলিকাময় অতীত এবং আপতিত বর্তমানের সত্য এবং অসত্যের মায়াজাল নিরূপণে স্বাগতম।
➤ পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা—
বইটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া আমার মিশ্র। একদিক থেকে ভালো মনে হলে, অন্যদিকে খারাপ। এই দোদুল্যমান অবস্থায় স্থির থাকাও বেশ কষ্ট। পুরাণের বিভিন্ন রেফারেন্স টেনে দেখানো হয়েছে। সবগুলোতে রাবণকেই সেরা বানানোর প্রচেষ্টা এমনকি কিষ্কিন্ধ্যা বালিকে যে রাম লুকিয়ে হত্যা করেছে সেটা নিয়ে ব্যাখা আছে। যথারীতি সেখানেও রাম কাপুরুষ! যাহোক, পুরো বইয়ের যে বিষয়টি পোক্ত লেগেছে সেটা হচ্ছে সম্রাট আশোকের কলিঙ্গ জয়ের আগে ও পরের কাহিনি। যদিও সেটা আজও রহস্য। মিথ হিসেবে এইসব বেশি প্রচলিত। ঠিক কী কারণে আর কীভাবে কলিঙ্গ জয় করেছে সম্রাট আশোক। এই কন্সপিরেসিও শেষ নেই। কোনো ইতিহাস বা পুরাণ কিছুটা জেনেও বইটি পড়লে আপনার হয়তো ভালো লাগবে। কেন সেটা বলি—
● প্রারম্ভ—
❛দশগ্রীব❜ বইয়ের শুরুতে কাহিনি গ্রিপ করে ফেলে। একজন আর্কিওলজিস্ট খুন! খুনটাও একেবারে একরোখা। এরপরে আবির্ভাব গল্পের প্রোটাগনিস্ট রাশাদ ও জয়িতা। ওই আর্কিওলজিস্ট আবার রাশাদ-জয়িতার শিক্ষক! প্রাচীন এক পুঁথির জন্য মারা হয়েছে ওনাকে। অন্যদিকে এই প্রাচীন পুঁথি দরকার নব সংঘের লোকদের! কারা এরা? কুখ্যাত সন্ত্রাসী জহিরও জড়িয়ে গেল এই কেসে। কেন, কীভাবে? উত্তেজনা বাড়িয়ে দিতে এই কয়েকটি কারণ-ই যথেষ্ট।
● গল্প বুনন—
গল্প বুননে লেখক ভালোই পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন। পুরাণ আর ইতিহাসের মেলবন্ধনে কোনো কাহিনি গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা না৷ তার ওপর তথ্য-উপাত্ত এত বেশি সাথে দিতে হয়েছে ব্যাখা। কত ধৈর্য থাকলে এইরকম একটি বই লেখা যায়? গল্পের সিকুয়েন্স সাজানো হয়েছে নিপুণতার সাথে। প্রাসঙ্গিকভাবে গল্পটা টেনেছেন লেখক তাই বলে বাড়তি মেদ নেই সেটাও ভুল। ৪০০ পেজের বই হলেও কাটছাঁট করে ২০-৩০ পৃষ্ঠা ইজিলি কমানো যেত। গল্পের প্রেক্ষিতে কিছু বর্ণনা দুই-তিনবার করে উঠে এসেছে।
রামায়ণের পুরো কাহিনি গল্পচ্ছলে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক৷ সাথে সম্রাট আশোকের কাহিনি। তবে ইতিহাস, পুরাণ ও বর্তমানের কাহিনি আলাদা করে বিচার করলে আমি ইতিহাসকে এগিয়ে রাখব। এই কাহিনির ডেপথ এত অসাধারণ যে বলাবাহুল্য। রীতিমতো মুগ্ধতা ছড়িয়েছে।
থ্রিলার হলেও কাহিনি যত এগিয়ে যাচ্ছিল তখন নন-ফিকশনের ফ্লেভারও পাওয়া যাচ্ছিল। কিছুক্ষেত্র সেটা বোরিং ফিল করাতে পারে তবে আমার ভালো লেগেছে কারণ ব্যাখা ছিল আর সেটা আমার মূল আকর্ষণ। বইয়ের মূল কাহিনি থেকে মনে হয় পুরাণ আর ইতিহাসে বেশি ফোকাসে ছিল।
● লেখনশৈলী—
লেখকের লেখনশৈলী ছিল একেবারে তরতাজা। ফ্লেভারে রয়েছে ভিন্নতা। একেকবার একেক স্বাদ। খুব বেশি চেঞ্জ হয়নি। সম্রাট আশোকের সময়কালের অধ্যায়গুলোর লেখনশৈলী বেশি টেনেছে। একেবারে হুকড করে রাখার মতো। সংলাপগুলো ছিল তথ্য দিয়ে ভর্তি। কয়েকটা চরিত্রের শুধু স্বাভাবিক সংলাপ। সেগুলো উপভোগ করার মতো, বিশেষ করে জহিরের। তাছাড়া বাক্যগঠন হয়েছে দুর্দমনীয়। কথার মধ্যে মারপ্যাঁচ, মোটিভেট, মাইন্ড চেঞ্জের মতো আলোচনা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ খুব তথ্যসমৃদ্ধ বলে ভাববেন না লেখনশৈলী দুরূহ, আপনি ইতিহাসপ্রেমী হলে এই বই গিলতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবে না। আমার হয়নি, আমাকে শুধু মাঝেমধ্যে ব্রেক দিতে হয়েছে বিভিন্ন তথ্যগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করার কারণে।
● বর্ণনাভঙ্গি—
দারুণ! এর থেকে বেটার সম্ভব না। গল্পের যে ফ্লো ছিল সেটা আরেকটি কারণ হচ্ছে বর্ণনাভঙ্গি। লেখনশৈলী উন্নত হলে যে শব্দ আর বাক্য দিয়ে কিস্তিমাত করে দিবে সেটা ভুল। বাক্য হোক মৌলিক বা যৌগিক সেটাকে সাজানো লাগে সহজভাবে। ভারী ভারী শব্দ ব্যবহার করলাম, লাইনে পর লাইন লেখে গেলাম হবে না। বর্ণনাভঙ্গি যদি সহজবোধ্য না হয় সব বৃথা। রেফারেন্স নিয়ে ঠাঁসাঠাসি করে বসিয়ে দিলাম, কোনো সাইজ করা লাগবে না। তাহলে সেটা বই না হয়ে হবে কোনো আর্টিকেল বা থিসিস পেপার।
❛দশগ্রীব❜ উপন্যাসে মূল আকর্ষণ এই বর্ণনাভঙ্গি। লেখক সুন্দরভাবে প্রতিটি সিকুয়েন্স অনুভব করিয়েছেন মানসপটে। ভিজুয়ালাইজ করতে কোনোরূপ সমস্যার উদ্রেক হয়নি। বিশেষ করে গল্পের শেষদিকে যখন মূল কাহিনি আবর্তিত হয়ে থাকে তখন এই বর্ণনার সাবলীলতা দরকার পড়ে। বই পড়ে থাকলে বা ভবিষ্যতে পড়লে বিষয়টি আন্দাজ করতে পারবেন৷
● চরিত্রায়ন—
❛দশগ্রীব❜ উপন্যাসের একেকটি চরিত্র ছিল গল্পের স্তম্ভ। প্রত্যকটি চরিত্রের ব্যবহার লেখক ভালোভাবে করেছেন। যার যে কাজ সেটা ব্যতীত বাহ্যিক কোনোকিছু তিনি টেনে আনেননি। তাদের দিয়ে কাজও করিয়েছেন সেইভাবে।
রাশাদ-জয়িতা নিয়ে লেখক একটি পজেটিভ থিংক বিল্ডাপ করতে পেরেছেন পাঠকদের মধ্যে। দুজন পুরো কাহিনিতে একসাথে থেকেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের যে বিশ্বাস সেটা ভালোভাবে টিকে ছিল। যদিও প্রণয় ঘটিত কারণ রয়েছে বলে মনে হয়েছে তাও তাদের আচার-আচরণে পাশ্চাত্যর ছাপ ছিল না। পজেটিভ দিক আসলে।
অন্যদিকে জহিরের মতো কুখ্যাত চরিত্রকে কতটা অর্থপূর্ণ বানিয়েছে সেটা বই না পড়লে পরখ করা যাবে না৷ আর আর্কিওলজিস্ট, বিজ্ঞানীদের মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোও গল্পে দারুণ প্রভাববিস্তার করেছে।
● সমাপ্তি—
যেহেতু সিরিজের দ্বিতীয় বই, তাই সমাপ্তি সম্পূর্ণভাবে হয়েও হয়নি৷ তবে কাহিনির দিকে তাকালে শেষটা ভালো বলা যায়। অর্থাৎ যেরকম হওয়ার কথা ছিল। তবে অসংগতি রয়েছে অনেক। নাটকীয়তা তো রয়েছে তার সাথে অনেক উত্তর মিসিং। অ্যান্টাগনিস্ট আর প্রোটাগনিস্ট ফোকাসে বেশি রাখতে গিয়ে কিছু চরিত্রের খেয় হারিয়ে গিয়েছে।
● খুচরা আলাপ—
❛দশগ্রীব❜ বইতে কাহিনির পাশাপাশি রয়েছে ফিলোসোফি, ভাষা পরিবর্তনের কারণ ইত্যাদি আপেক্ষিক বিষয়বস্তু।
❝যে উর্দু ভাষার জন্য এতবড়ো ভাষা আন্দোলন করলাম, সেটাই এখন চেপে বসেছে হিন্দির নাম করে।❞
আসলে আমরা ভাষা আন্দোলন করেছি বাংলার জন্য। উর্দু ছেঁটে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা করার জন্য। লেখক কেন ‘উর্দু’ ভাষা পরিহার বিষয়টি সংলাপে তোলেননি সেটার কারণ জানা নেই। যা-ই হোক, কারণ কিন্তু সত্য। এই আমরা ‘উর্দু’ কিন্তু ঠিকই জাবরকাটার মতো বলে যাচ্ছি। মানে কথায় কথায়। যেমনটা এখন ‘বাংলিশ’ ট্রেন্ড। লেখ্য আর কথ্য ভাষার নিয়ে কোনো তফাত এখন আর নেই। একটা সময় সৃজনশীলতা এত তুঙ্গে থাকবে যে বইয়ের ভাষা আর মুখের ভাষা একই হয়ে যাবে। আমরা বাঙালি তো, সবই পারি। স্মার্ট না সাজলে লোকে তো কুল ভাববে না। - এইবার আসা যাক বইয়ের কিছু ভুল নিয়ে। তথ্যগত না মুদ্রণপ্রমাদ না-কি সম্পাদনার অভাব সেটা একমাত্র লেখক ভালো বলতে পারবেন।
৬১ পৃ: ঋষি বিশ্রবার চারজন স্ত্রী ছিলেন, পুষ্পোৎকটা, রাকা, মালিনী এবং ইলাভিদা। ইলাভিদার গর্ভে কুবের, রাকার গর্ভে খর ও শূর্পণখা, মালিনীর গর্ভে বিভীষণ, পুষ্পোৎকটা বা কৈকেশির (কৈকসীর) গর্ভে কুম্ভকর্ণ ও রাবণ।
ওয়েল, এইখানে রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ ও শূর্পণখাকে আলাদা আলাদা মাতার সন্তান বলা হয়েছে। পারতপক্ষে সবাই হচ্ছে একজন মাতার সন্তান। আর ওনার নাম ‘নিকষা’ অথবা ‘কৈকসী’ বা ‘কেশিনী’ বলা যায়। পুষ্পোৎকটার সন্তান হচ্ছে মহোদর, প্রহস্ত, মহাপাংশু ও খর এরা সবাই ছেলে আর মেয়ে হচ্ছে কুম্ভিণাশী। তাহলে এখানে পুষ্পোৎকটা আর কৈকসীকে এক করে দেওয়ার কাহিনি কী? ধরলাম কোনো এক পুরাণে, গ্রন্থে এই বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে তাহলে সেটার রেফারেন্স কোথায়? অথচ পুরো গল্পের সূত্রের সমাধান এই ভিত্তির ওপর নির্ভর!
যেহেতু এরা সবাই পুলস্ত্য পৌত্র-পৌত্রী তাহলে সেই হিসেবে আসে সাতের অধিক! এখন সাতের সাথে সাত মিলিয়ে যে জিগ স পাজল ক্রিয়েট করেছে সেটা তো পুরোপুরি ভ্যালু লেস! যদি এই বিষয়ে পোক্ত রেফারেন্স থাকে তাহলে দুইয়ে দুইয়ে চার না হয় আরেকবার মিলিয়ে দেখব। অন্যদিকে মালিনী অর্থাৎ বিভীষণের মা কে এবং কোথায় থেকে এসেছে জানালে ভালো হতো। কনফিউজড হয়ে গেলাম।
১৮৯ পৃ: আবার খর ও দূষণকে শূর্পনখার আপন ভাই দেখিয়েছে। খর মানলাম কিন্তু দূষণ আপন ভাই কেমনে হয়? কিছু শাস্ত্রে লেখা শূর্পণখা রাবণের বোন তাহলে সেটা ভুল? রাবণ স্টেপ ব্রাদার না? - ৮১ পৃ: মহাদেব শিব আর দেবী পার্বতী হানিমুন করছেন।
কোন লজিকে কেউ নিজ বাসগৃহে হানিমুন করবে? নিজের আবাস্থলে কেউ হানিমুনের পরিকল্পনা করে বলে শুনেছেন?
মানে যা ইচ্ছা তাই? - ১৩১ পৃ: বোনের সম্মানের জন্য রাবণ নিজের রাজত্ব ও জীবনের পরোয়া না করে রামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আর রাম সবার কথা শুনে স্ত্রীর সতীত্বের পরীক্ষা নিয়েছে।
পুরো রামায়ণে যে লঙ্কাকাণ্ড বেধেছে সেটার কারণ কি শুধু এইটা? আর রাবণ যে তার বোনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সীতকে হরণ করেছে তার পূর্বে দেখা উচিত না শূর্পণখা কী করেছে। সে দেখেছে যে রামের স্ত্রী সীতা, লক্ষ্মণ অলরেডি বিবাহিত জেনেও তাদের বিয়ের প্রপোজ করলে তাকে কি আদর আপ্যায়ন করবে? রাবণের এমনিতে পূর্ব থেকে সীতার প্রতি লোভ এবং স্বয়ংবর সভায় হরধনু ভাঙতে না পেরে ক্রোধান্বিত ছিল। এইজন্য সে সুযোগে সৎ ব্যবহার করে সীতাকে অপহরণ করে৷ অন্যদিকে সীতার সতীত্ব প্রমাণ দিতে রাম নিজে মানা করেছে, কিন্তু সাধারণ জনগণ বলে কথা। এই আমাদের সমাজের মতো। কোনো মেয়ে এক রাত উধাও হলে বা খুঁজে পাওয়া না গেলে কলঙ্কের কালি মেরে তাকে কালো বানিয়ে দেয়। সত্যতা কী সেটা কেউ খুঁজে না। তখন পরিবার না চাইলেও তাকে প্রমাণ দিতে হয় যে সে সতীসাবিত্রী। এই টেস্ট করো, ওই টেস্ট করো ব্লা ব্লা ব্লা! সবকিছু কানেক্টেড, খালি মাথা দিয়ে ভাবলেও এইরকম অনেককিছু মিলকরণ করতে পারবেন। - ২১০ পৃ: “রাবণ যজ্ঞ করেছিল কারন (কারণ) সে ভয়ানক প্রফেশনাল ছিল। তাকে যজ্ঞে ডাকলে সে না করতে পারেনি।”
রাম যদি সেতু বানানোর জন্য মহাদেব থেকে পারমিশন নেওয়ার থাকে কেন রাবণের যজ্ঞ করতে হবে? আবার রাবণ কেন রামের জন্য নিজ থেকে যজ্ঞ দিবে? যদি সে যজ্ঞও করে, তার যজ্ঞে সে কেন সাড়া দিবে? গোঁজামিল লাগছে পুরো। - ২৩৮ পৃ: “লক্ষণ (লক্ষ্মণ) যে রাবণের হাতে একবার মারা গেছিল এটা নিশ্চয় জানেন?”
কোনকালে লক্ষ্মণ রাবণের হাতে মারা গিয়েছিল? আমি তো জানি মেঘনাদের হাতে মারা গিয়েছে! - ২৯১ পৃ: ব্রহ্মার চার মুণ্ডুর তিনটা দেখবার কারণ হলো শিব।
ব্রহ্মার ছিল পাঁচ মুণ্ডু। একটা কেটে হয়েছে চার। তাহলে তিনটা কখন, কীভাবে হয়েছে?
আবার কিছুটা নিচে বলা হয়েছে, ইন্দ্র না-কি কোনো দেবতা না। এটি একটি পদ বা পোস্ট। অর্থাৎ এই পদে যে বসবে তার নাম হয়ে যাবে ইন্দ্র? তাহলে অগ্নিদেব এই পদে বসলে তিনি ইন্দ্র হয়ে যাবে। আমি তো জানি ইন্দ্র বজ্রের দেবতা। সেখানে লেখক আবার গ্রিক দেবতা জিউসকেও টেনেছেন।
আরও কী কী যে করেছেন ভাবাও যায় না। - ৩০৬ পৃ: এখানে সীতা ও শূর্পণখার মধ্যে কিছু আলোচনা তুলে ধরেছেন লেখক। যেখানে সীতার দার্শনিকতার উদাহরণ পাওয়া যায়। সেখানে একটি লাইন ছিল—
❝মানুষ কোন (কোনো) বিচারেই কখনও সন্তুষ্ট হতে পারে না, অন্যদিকে বন্য প্রাণীরা কখনই বিচারের দাবি করে না।❞
শতভাগ সত্য। - ৩১৫ পৃ: মেঘনাদ লক্ষণকে (লক্ষ্মণকে) নিরস্ত্র মানুষের উপর (ওপর) হামলা করে ক্ষত্রিয় ধর্ম কলুষিত করতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু লক্ষণ (লক্ষ্মণ) শোনেনি। মেঘনাদকে ব্রুটালি হত্যা করে, কিসের (কীসের) কি (কী) ধর্ম আগে যুদ্ধে জিততে হবে না?
শুধু ছল করে হত্যা আর ব্রুটালি চোখে পড়েছে? অথচ লক্ষ্মণের সাথে মেঘের আড়ালে ছল করে যুদ্ধ করেছে বলেই সে মেঘনাদ। এটা তার স্টাইল? অন্য কেউ ছল করে মারলে পাপ! অথচ মেঘনাদ যে মায়া-সীতা ভ্রম সৃষ্টি করে সীতাকে মেরে ধোঁকা দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনতিদূরে নিকুম্ভিলায় গিয়ে যজ্ঞ করতে বসে আরও ক্ষমতাশালী হওয়ার জন্য তখন হনুমানের মুখে রাম জানতে পারে সীতাকে মেঘনাদ বধ করেছে! এই শুনে বিভীষণ লক্ষ্মনকে সেখানে নিয়ে যায়। কারণ মেঘনাদ সে যজ্ঞ করলে আরও দুর্ধর্ষ হয়ে যাবে। যে সুযোগে বাধাপ্রাপ্ত করার জন্য এই কাজটি করতে হয়।
আদতে সেই নিকুম্ভিলায় ন্যায়সংগত মহাযুদ্ধ ঘটেছিল। কিন্তু সেটাকে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-তে দেখানো হয়েছে অন্যভাবে। লক্ষ্মণকে ভিলেন আর মেঘনাদকে হিরো বানানোর প্রয়াস করিয়েছে। অথচ পুরো রামায়ণে স্থিতধী পুরুষ হচ্ছে লক্ষ্মণ। - এছাড়া আরও অনেক কিছু রয়েছে যেগুলো নিয়ে আলোকপাত করতে গেলে রিভিউ কাম আর্টিকেল বেশি হয়ে যাবে। অলরেডি সেইরকম হয়েছেও। বইটি পড়ে জানতে যেমন অনেককিছু পেরেছি আবার সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পেরেছি বলে ভালোও লাগছে। রামায়ণ ঘিরে কিছু বিতর্ক অবশ্যই রয়েছে। কারণ সনাতন ধর্মের বাইরে এই ধর্ম নিয়ে পরিচর্যা করা হয়। একেক ধর্মে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেখানে দেবতা, রাক্ষস সবাই মানুষ। আবার সবাই যদি মানুষ হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তা কে? আর সৃষ্টিকর্তা যদি না থাকে তাহলে বিজ্ঞানীদের মতবাদ আমাদের মেনে নিতে হবে। পৃথিবী থেকে ধর্ম উঠে যাবে, আক্ষরিক অর্থে প্রয়োজন হবে না। নাস্তিক বনে যাবো সবাই, ধর্ম দিয়ে যে নীতি ও ন্যায়ের পথ সেটাও বন্ধ হয় যাবে। ধর্ম মানে ধারণ করা সত্য-ন্যায়নীতি-কর্তব্য-মনুষ্যত্ব ইত্যাদি তো আছেই, খারাপের বিরুদ্ধে ভালোর লড়াই আরেকটি দিক। ধর্মের সবসময় জয় হয়, আর সে জয় করতে যদি অন্যায়ের আশ্রয় নিতে হয় অসুবিধে কোথায়? মহাভারত তো পুরোটা শ্রীকৃষ্ণের ছলাকলা দিয়ে পূর্ণ। যেখানে শকুনির মতো বিদ্বান ব্যক্তিও কূটনীতি আর রাজনীতি করে রক্ষা পায়নি। পৃথিবীতে ধার্মিক মানুষ আছে বলেই ‘সত্য’ নামে কিছু আছে। না হয় এই জোচ্চুরির আর রক্তপাতের দুনিয়ায় মনুষ্যত্ব বলে কিছু থাকত না। আগামীতে যে শতভাগ থাকবে না এইটা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। ছোটো থেকে যে পাঠ্যপুস্তকে ধর্ম এত কিছু শিখে ও জেনে আসলাম তাহলে সব মিথ্যা? পৃথিবীতে জ্ঞানী মানুষের অভাব নেই, আর অভাব নেই বলে থিউরি অগণিত। একেকজনের একেক মত। চলমান আছে আর চলতেই থাকবে। এমনিতে মানুষ হিরো থেকে ভিলেন আর অ্যান্টি হিরো বেশি পছন্দ করে। কারণ তারা কুল হয়। একরোখা, জেদি, প্যাশন নিয়ে দুনিয়ার কুকাজ করে থাকে বলেই হয়তো। - এছাড়া জটায়ুকে সম্পাতির আত্মীয় দেখানো হয়েছে। অথচ জানতাম জটায়ু সম্পাতির ছোটো ভাই!
জাতপাত নিয়ে বেশ ভালোই টপিক রয়েছে বইতে। আরও আছে ম্যাটার অ্যান্টিম্যাটার তত্ত্ব, পরমাণুর হাফ লাইফ তত্ত্ব। এছাড়া ইলেক্ট্রন, নিউট্রাল, পজিট্রনের ব্যাখা রয়েছে। এক জায়গায় পারমানবিক বোমা বিস্ফারণের সাথে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের ফলে কী হতে পারে সে তুলনা দিয়েছে। সামঞ্জস্যপূর্ণ লেগেছে। তবে ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ নিয়ে যুক্তি খোঁড়া লেগেছে।
সম্রাট আশোকের র���স্য নয় মানব নিয়ে মিথ অন্যান্য দিক থেকে ভালো লেগেছে কারণ অনেক লেখক এই নিয়ে লেখলেও মাত্রাতিরিক্ত ব্যাখা দাঁড় করাতে পারেননি। সেদিক থেকে গুড এনাফ।
➢ লেখক নিয়ে কিছু কথা—
সিদ্দিক আহমেদের পড়া প্রথম বই। তবে ভুল একটা হয়েছে। ❛দশগ্রীব❜ হচ্ছে সিরিজের দ্বিতীয় নম্বর বই। প্রথমটি ‘নটরাজ’ যেটা আমার আগে পড়ার দরকার ছিল। তবে চিন্তামুক্ত কারণ পূর্বের বইয়ের মেজর কোনো স্পয়লার ❛দশগ্রীব❜ বইতে নেই। স্ট্যান্ড অ্যালোন হিসেবে আয়েশ করে পড়া যায়। শুধু শেষে গিয়ে একটি চরিত্রকে দেখানো হয় যে ‘নটরাজ’ বইয়ে অ্যান্টাগনিস্ট ছিল।
লেখকের ধৈর্য আর শ্রমের মিলেমিশে গড়া বইটি সমালোচনার চোখে দেখা ছাড়া বেশ তথ্যবহুল। তবে এতকিছু করেও কিছু জায়গায় মিস্টেক উনি এড়াতে পারেননি। যুক্তিতর্কের খাতিরে সব বাদ দিলেও এইরকম বইয়ে এত বেশি বানান ভুল সাথে সম্পাদনার কমতি ভালোই ভুগিয়েছে। ভালো একটি বইয়ের মান কমিয়ে দেওয়ার জন্য এইটুকু কারণ যথেষ্ট বলে বিবেচিত।
আশা করি পরবর্তী বইগুলোতে এই বিষয়ে লেখক সতর্ক থাকবেন।
● সম্পাদনা ও বানান—
কোন/কোনো, হ্যা/হ্যাঁ, কি/কী, দেয়া/নেয়া এইরকম মেজর ভুলের সাথে যুক্ত হয়েছে খৃস্টপূর্ব, সঙ্ঘ, বের-কে বর, সারাদিন-কে সারদিন, প্রধান-কে প্রাধান, যান্ত্রিক-কে যন্ত্রিক, সাপ-কে শাপ, এগুলো-কে আগুলো ইত্যাদি বানান আর টাইপোর ভুলের ছড়াছড়ি।
এছাড়া চরিত্রদের নামের উলটপালট করার সাথে দুই ফরমেটে লেখা বানান তো আছেই। ইকবাল-কে ইকবালা, শূর্পণখা-কে শুর্পণখা। অর্থাৎ ভুলের সাগরে ডুবে যাওয়া এইরকম তথ্যসমৃদ্ধ বইটির ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেছে। সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিচ্ছু করার নাই।
● প্রচ্ছদ, লেটারিং—
❛দশগ্রীব❜ প্রচ্ছদ ভীষণ পছন্দ হয়েছে। বিশেষ করে লেটারিং। লেটারিং কাজটা আমার নিজের অনেক পছন্দের, সেদিক থেকে এই বইয়ের লেটারিং ছিল নজরকাড়া আর ইউনিক। সাথে পুরো বইতে নীলাভ একটা আভা বিরাজমান ছিল। যেটা বইয়ের কনটেন্টের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফ্রন্ট কাভারে সপ্তর্ষীমন্ডলের তারা এঁকে দেখানো সাথে কিছুটা নিচে প্রাচীন পালি এবং ব্যাক কাভারে ব্রহ্মাস্ত্রের মাঝে গোলাকার বৃত্তটি যেখানে বিশেষ অর্থ বহন করে। সবমিলিয়ে অসাধারণ।
● মলাট, বাঁধাই, পৃষ্ঠা—
২০১৮ সালের বই হিসেবে বাঁধাই বেশ টেকসই। নিউজ প্রিন্টের কাগজ হলেও মানে ভালো। ফন্ট স্পেস, লাইন গ্যাপ যথার্থ৷ দামের দিক থেকে এইরকম একটি বইটি সহজলভ্য। শুধু সম্পাদনা আর প্রুফের বিশ্রী কারণটা না থাকলে আরও ভালো হতো।
➠ বই : দশগ্রীব | সিদ্দিক আহমেদ ➠ জনরা : আর্কিওলজিক্যাল থ্রিলার ➠ প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ➠ প্রচ্ছদ : অয়ন ➠ প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকাশনী ➠ মুদ্রিত মূল্য : ৪০০ টাকা মাত্র ➠ পৃষ্ঠা : ৪০০ ➠ রেটিং : ৩.৫/৫