উত্তম সারাদিন ছবির হাটে গাছের নীচে শুয়ে থাকে। দিনের পর দিন বাসায় ফেরে না। ছন্নছাড়া বেখেয়ালি উত্তমের গভীর প্রেমে হাবুডুবু খায় রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে কাকলী। কিন্তু উত্তম ভালোবাসে মানসীকে। মানসী বলে কেউ কি আসলেই আছে নাকি সবই উত্তমের শিল্পী মনের কল্পনা?
দেড় ঘন্টারও বেশি সময় ধরে বাংলামোটরের বিশ্রি জ্যামে আটকা। সন্ধ্যার আকাশ ভেঙে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে, ঝুম বৃষ্টি। গাড়ির ভেতর অন্ধকার; রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট, নিয়ন সাইন আর আশেপাশের গাড়ির হেডলাইটের যেটুকু আলো আসে, তাতে বইয়ের পাতা উলটে আরাম পাওয়া যায় না। তবুও বইটা একটানে পড়া হয়ে গেলো, গল্পের গুণে।
'উত্তম ও মানসীর রহস্যময় প্রেম' একটা রহস্যময় প্রেমের উপন্যাস। উত্তম ভালোবাসে মানসীকে- যেই মানসীকে কেউ কখনও দেখতে পায়নি। অথচ ঘটা করে প্রতিবছর মানসীর জন্মদিন পালন করা হয়, বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডায় বারবার উঠে আসে অদৃশ্য নারীর স্মৃতি রোমন্থন। এদিকে রক্ষণশীল কাকলী একসময় উত্তমকে ভালোবেসে ফেলে। কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে ঘরও বাধে ওর সাথে। কাহিনী এগিয়ে যায়: কখনও বাস্তবতায়, কখনও ভ্রমে, আবার কখনও কাকতালীয় বিস্ময়ে।
পারমিতা হিমের চরিত্রগুলো বেশ স্বতঃস্ফূর্ত, কাহিনীর প্রয়োজনে ঢেলে সাজানো মেলো-ড্রামাটিক ক্যারেক্টার নয়; বরং আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো সহজ-স্বাভাবিক তরুণ। বর্ণণাভঙ্গিতে কি যেন একটা ব্যাপার আছে, স্বাচ্ছন্দ্যে পড়া যায়। গল্প উপন্যাসের বর্ণণায় সরাসরি কথ্যরীতি/ফেসবুকীয় ভাষা ব্যবহারে আমার কিছুটা আপত্তি আছে। এই বইয়ের ভাষারীতি ব্যতিক্রমধর্মী: প্রচলিত শুদ্ধ ভাষার পাশাপাশি সংলাপ এবং কিছু ক্ষেত্রে বর্ণণায় কথ্য ভাষার প্রয়োগ ঘটেছে। শুরুতে একটু গোলমেলে মনে হলেও গল্পের টানে এই ব্যাপারটা উপভোগ্য হয়ে যায়। মনে হয়, চোখের সামনে সবকিছু দেখছি, উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সাথে আড্ডা দিচ্ছি ঘুরেফিরে।
প্রেমটা কেন রহস্যময় সে বৃত্তান্ত এই উপন্যাস। উত্তমের কল্পনায় উপস্থিত, বন্ধুমহলের আলোচনায় অথবা হঠাৎ উত্তমের মনে মনে যেন কোন টেলিপ্যাথি কিংবা অলৌকিকভাবে মানসীর বার্তা এসে ভর করে আর উত্তম তা বন্ধুদের বয়ান করে; এতটুকুই মানসীর বাস্তবিক উপস্হিতি । আদতে মানসী যেন একটা পৌরাণিক চরিত্র হয়ে ঘুরে ফিরে আসে আলোচনায়। উত্তম মানসীর জন্মদিনে প্রতি বছর বন্ধুদের নিয়ে উৎযাপন করে । অনাহারে, উদাসীনতায় গাছতলায় দিন যাপন করে অসুস্হ হয়ে হাসপাতালস্হ হলে কাকলীর সাথে পরিচয় হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে উত্তম ও মানসীর প্রেম কোন পরিণতির চেয়ে মানুষের ভাবাবেগকে প্রাধান্য দিয়ে বাস্তবে না থেকেও সমস্ত জুড়ে থাকার মানবিক চিত্রায়ন। একজন উদাসিন মানুষ, একজন খামখেয়ালি আর্টিস্ট তার প্রথম প্রেম মানসীকে ভুলতে গিয়ে অথবা প্রথম প্রেমের স্মৃতিকে অবচেতনে মনে করতে গিয়ে বাস্তবতাকে যেভাবে হুমকির মুখে ফেলে চলে তার বর্ণনা। এক পর্যায়ে কাকলী নামের এক প্রণয়িনী বা স্ত্রীর সাথে উত্তমের সম্পর্ক হয়। মানসীকে পুরো গল্পে অনুপস্হিত আলোচনাতেই পাওয়া যায় তবে একদম শেষে এসে দেখা যায় অনেক বছর পর গল্পের ন্যারেটর আফসানা বিদেশে পড়তে গেলে একটা পাতাল ট্রেনে একদিন এক বাঙালী নারীর সাথে পরিচিত হন যার নাম মানসী এবং তার কিশোর বাচ্চা ছেলেটির নাম উত্তম। কঠিনকে সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। মনস্তত্ত্বে লেখকের বিচরণ আর লেখার ভাষায় সাবলীলতা উল্লেখযোগ্য। পড়ে আরাম পাওয়া গেল।
একটানে পড়ার মত বই । বা বরং বলা চলে উপন্যাসটার স্বাদ ভালোমত পেতে হলে একটানেই পড়া উচিত ।
শিরোনামের মতই লেখার মুল বিষয় প্রেম, উত্তম-মানসীর প্রেম। তাদের প্রেম লাইলী-মজনুর প্রেমের মত না, আবার ঠিক লাভ-লোকসানের হিসেব কষা সম্পর্কের মতও না । পুরো উপন্যাস জুড়েই এই প্রেমের উপস্থিতি নিয়ে সংশয় আর নিশ্চয়তার দোটানায় ভুগতে হয়েছে । গল্পের শেষে টুইস্ট ছুড়ে দেওয়ার চেষ্টা আছে কিন্তু আমার কাছে গল্পের চেয়ে গল্পের ভেতরের অণুগল্পগুলোকেই বেশি ভালো লেগেছে । পাঠককে গল্পের আবহের মাঝে ঢুকিয়ে ফেলার ক্ষমতা আছে লেখিকার । একটা চুম্বক অংশ তুলে ধরা যায় -
" আমি জানালার ওপাশে তাকালাম । ওপাশে জানালার সমান ছোট দেয়াল ঘেরা এক টুকরা জমি। সেখানে মাটি, ঘাস আর কয়েকটা গাছ । কী আশ্চর্য ! একটা সুন্দর কলাপাতা গাছ একপাশে, রোদ পড়ে ওটার রঙ যেন পৃথিবীর আর সব রঙকে তুচ্ছ করে দিচ্ছে । ঘাসের উপরে বড় বড় পা ফেলে হাটতেছে কয়েকটা রাজহাঁস । ওগুলা গাঁক গাঁক করে ডেকে উঠল । । দুইটা বেড়াল, একটা সাদা আর একটা কালো, সমানে ঝগড়া করে যাচ্ছে । আমি মন দিয়ে বিড়ালের ঝগড়া দেখতে থাকলাম । সাদা বিড়াল মেও মেও করেই যাচ্ছে। কালো বিড়াল চুপ। খানিক বাদে বাদে সে চাপা গররর শব্দ ছাড়া কিছুই বলে না । এদিকে সাদা বিড়ালের যেন আরও কিছু শোনা(নো) চাই । সে আরও জোরে মেও মেও মেও করেই গেল । কালো বিড়ালটা যেন আর বউয়ের ঘ্যান ঘ্যান সহ্য করতে পারল না । ঘ্যায়াও শব্দ করে ঝাঁপায়ে পড়ল সাদা বিড়ালটার উপর । রাজহাঁসগুলো গাক গাক করে আবার ডেকে উঠল । টুকরা জমির চারপাশে দালান । ভুতের গলি খুবই ঘিঞ্জি এলাকা । সারি সারি উঁচু দালান একটা আরেকটার গাঁ ঘেঁষে দাঁড়ানো । কোন ফাঁকফোকর নাই ।"
উপন্যাস জুড়ে বৈচিত্র্য আছে । লেখিকার নিজের জীবনদর্শন কিংবা জনপ্রিয় কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার চেষ্টা আছে -
"হাসপাতাল একটা অদ্ভুত জায়গা । ... যারা হাসপাতালে যায় না আর যারা যায় নিয়মিত হাসপাতালে যায়, তাদের মধ্যে অনেক ফারাক । "
"ফ্রান্স, ইটালি হলে হয়তো শিল্পীদের এমন জীবন চলে যায় কিন্তু আমাদের দেশে ? এই দেশে এই রকম জীবন যে চরম গ্লানিকর আর সেটা নিয়ে বেঁচে থাকার যে কোন মানে নাই এই ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নাই । শিল্পীদের জীবন আর আমাদের জীবনে আকশা-পাতাল ফারাক আছে । ওদের জীবন মনে হয় দুঃখভরাই হতে হয় । গ্লানিময়, অবসাদগ্রস্ত, গরীব না হলে কি আর আসল শিল্পী হওয়া যায় ? বড়লোক হবে ব্যবসায়ীরা, শিল্পীরা মরবে না খেয়ে। ..."
প্রচলিত খাইছি, গেছি এসব শব্দের ব্যবহার দেখে আমার প্রথমে কিছুটা বিরক্ত লেগেছিল কিন্তু পরে বিরক্তিটা থাকে নি । উপন্যাসটা যার বর্ণনায় আমরা শুনছি সেতো এই সময়েরই মানুষ, যত তার চিন্তার গভীরে ঢোকা হয় (মানে উপন্যাস এগিয়ে যায়) তত বিরক্তি কমে আসে, সবকিছু চোখের সামনে ঘটতে থাকে ।
উপন্যাসটা আরেকটু দীর্ঘ হতে পারত, কিছু চরিত্রকে আরেকটু যত্ন নিয়ে গড়ে তোলা যেত । তবে এক কথায় উপভোগ্য লেখা ।
গল্পের নায়ক উত্তম এক জাতে মাতাল তালে ঠিক ভবঘুরে পাগলা বাবা। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে যথারীতি ছোট চুল, বড় চুল, সোজা দাঁত, বাঁকা দাঁতের মেয়েরা সিরিয়াল দিয়ে দাঁত না মাজা, গোসল না করা উত্তমের প্রেমে পড়ে। চাল্লু উত্তম সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা নিতে নিতে সবাইকে মানসীর ভাও দেয়। কিন্তু মানসী আসলেই আছে কিনা ঠিক বোঝা যায় না, নাই নাই করেও আছে মনে হয়, আবার আছে আছে বইলা শিওর হইয়া গেলে মনে হয় নাই। এইসব নিয়েই টানটান উত্তেজনা। এর মধ্যে সবাই মাঝেমধ্যে দার্শনিক কথাবার্তা বলে, উড়ে উড়ে সময় চলে যায়। উপন্যাসের ভাষা সুন্দর, গতি দুর্দান্ত, কাহিনিতে নতুনত্ব, চরিত্রগুলোর বেড়ে ওঠা দ��র্বল, পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা অবাস্তব আর শেষে টুইস্ট সবমিলিয়ে সুখপাঠ্য এক উপন্যাস।
লেখকের প্রথম বই 'নারগিস'- লেখায় একটা পরিচ্ছন্ন আর ঝরঝরে ভাব সাথে নতুন জেনারেশনের বা হয়ত আমাদের জেনারেশনের চিন্তাধারার সঙ্গে অনেকাংশে মিল রেখে চরিত্র চিত্রণেই গল্পে তাড়াহুড়া আর অসঙ্গতি থাকার পরও ভাল লেগেছিল। প্রথম বই বলেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম, পরে লেখক সেটা শুধরে নিবেন। কিন্তু বইমেলায় আসা তার দ্বিতীয় বই একই দোষে দুষ্ট প্রমাণ হল। গল্পের শুরুটা যদি হয় ঝকঝকে অ্যাশটন মার্টিন, তবে শেষটা একেবারেই টাটা ন্যানোতে পর্যবসিত। শেষ পৃষ্ঠায় লেখক যে টুইস্টটা দিতে চেয়েছেন তা যেকোন সাধারণ পাঠক আগেই টের পাবেন। সেটা নিজে থেকে খুব একটা সমস্যার ব্যাপারও না, যদিনা তার উপস্থাপনাটা এতটা তড়িঘড়ি আর অ্যামেচারিশভাবে করা না হত। আর লেখক বোধকরি তার হোমওয়ার্ক ঠিকভাবে করেন নি। গল্পের কথক যখন ভর্তি হন ঢাবির সাইকোলজি বিভাগে তখন তাকে বলতে শুনি সাইকিয়াট্রিস্ট হবার বাসনার কথা। সাইকিয়াট্রিস্ট আর ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের তফাতটা তিনি সম্ভবত ঘেটে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন নি, ফলত এই বিভ্রাট। সাইকিয়াট্রিস্ট হচ্ছেন মানসিক রোগের ডাক্তার যিনি মেডিক্যাল ডিগ্রিপ্রাপ্ত, অপরদিকে সাইকোলজিস্ট বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজিতে ডিগ্রিপ্রাপ্ত- যিনি বিভিন্ন ছোটখাট মানসিক ভারসাম্যহীনতা যার ওষুধ দেবার দরকার নেই সেধরনের রুগি দেখে থাকেন। এদের কাজ মূলত কাউন্সেলিং বা অন্যান্য আরো কিছু চিকিৎসা প্রদান। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরনের বিভ্রান্তি অবশ্য খুবই সাধারণ এবং সেজন্য মেনে নেয়ার মত।
সমস্যার কথা বলার পর ভাল দিকগুলোর কথাও বলি- লেখকের গদ্য অত্যন্ত নির্মেদ এবং ঝরঝরে। অনেকটা বৈঠকী ঢং আছে লেখার মধ্যে, যার জন্য একটানে পুরা বইটি পড়ে উঠতে কোন বেগ পেতে হয় না। দিনশেষে বই পড়ে ভালই লাগবে, কিন্তু লেখক যদি চান তার রচনা শুধু নিমেষের ভাললাগার ব্যাপ্তি থেকে আরো বেশিকিছু হয়ে উঠুক, তবে ক্যারেকটার ডেভলপমেন্টে আরো সময় ব্যয় করা জরুরি মনে করি।
পুনশ্চঃ বইটি ছাপানোর আগে একজন সম্পাদক এটি দেখলে এর চূড়ান্ত ভার্সনটি আরো ভাল হত বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু আমাদের দেশজ প্রকাশনার ত সেই মুরোদ নেই, লেখকদেরই টাকা দিতে যে অনীহা, সম্পাদনার কথা উঠলে ব্যবসা বন্ধ করে কারওয়ানবাজারে আলু আর মাছের পাইকারি বিক্রেতা বনে যাবেন