স্বাধীনতা চার দেয়ালের কল্পিত স্বর্গে নয়, স্বর্গের দিকে কি দেয়াল থাকে? দিগন্তের ওপারে যে বিশাল আকাশ- স্বাধীনতা ঐ আকাশেও নেই। মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলো যান্ত্রিক আটপৌরে এই জীবনের গ্লানি টানতে টানতে ক্লান্ত, বিষন্ন। সবচেয়ে বড় বন্দিত্ব হলো অন্তরের বন্দিত্ব, আর সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা হলো হৃদয়ের স্বাধীনতা। চোখ বন্ধ করলে যে যোগাযোগটা হয়- সেটাই তোমার স্বাধীনতা। একদিন নিশ্চই আল্লাহ চোখের পানিগুলো মুছে দেবেন, অন্তরগুলো প্রশান্ত করবেন। তুমি শক্ত হয়ে জমে থেকো, কখনও ঝরে যেও না...
. দমকা হাওয়া তোমাকে সমূলে ফেলে দিতে চাইবে। তুমি হয়তো চারিদিকে তাকিয়ে অন্য কিছু গাছকে সহজেই পড়ে যেতে দেখবে। কেউ হয়তো বাতাসের ধাক্কায় সমূলে উৎপাটিত হয়ে যাবে। তুমি ভয় পেও না। দাঁতে দাঁত চেপে টিকে থাকার এই সংগ্রামে তুমি সিনা টান করে দাঁড়িয়ে যাও- কখনও ঝরে যেও না...
. রুটিন মাফিক এই যাপতি জীবনে ইসলামটা আজ আমাদের কাছে বিশ্বাস কিংবা আদর্শ নয় - অভ্যাস। ঠিক যেন নয়টা থেকে পাঁচটা গৎবাঁধা জীবনের পান্ডুলিপি। ঝিমুনি আসা জুমার খুতবা, এ প্লাস পাওয়ার সহজ সাবজেক্ট 'ইসলাম শিক্ষা', চায়ের কাপে-ফেইসবুকে-সুরেলা ওয়াজ মাহফিলে-বুকশেলফে সাজিয়ে রাখা কুরআনে ইসলামটা বাক্সবন্দী অভ্যাস হয়ে আমাদের সাথেই কাটিয়ে দিচ্ছে দিনের পর দিন। সেই বাক্সটা খুলে কেউ যখন দেখিয়ে দেয় আমাদের এই নির্লিপ্ত জীবনের অসারতা, মেরুদন্ডহীন এই বেঁচে থাকা, কিংবা যখন বুঝিয়ে দেয় যেটাকে আমরা ইসলাম বলে যত্ন করে বাক্সবন্দী করে রেখেছি, সেটা আসলে ইসলাম নয়- তখন যেন প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে জেগে উঠার মতো অনুভূতি হয় আমাদের। এই বইয়ের প্রতি পাতায় পাতায় তেমনই অনেকগুলো ঝাঁকুনি অপেক্ষা করছে পাঠকদের জন্য।
কিছু কিছু বই আছে যেগুলোর রিভিউ লিখতে অন্তরে সাহসের প্রয়োজন হয়। তারিক মেহান্নার (আল্লাহ তা'আলা তার মুক্তি ত্বরান্বিত করুন) "কখনও ঝরে যেও না" ঠিক তেমনই একটি বই। এ বই সম্পর্কে কি লিখবো ঠিক বুঝতে পারছি না। বুকের ভেতর বিশাল শূন্যতা অনুভব করছি। আমার মতো অধম ও পাপীর কিই বা যোগ্যতা আছে তারিক মেহান্নার মতো ঈমান ও প্রজ্ঞার অধিকারী একজন মু'মিনের লেখা সম্পর্কে আলোচনা করার?
. ভাই তারিক মেহান্নার লেখা পড়ে আমার প্রথম যে উপলব্ধি হলো তা অল্প কথায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হয়- কাফির আমেরিকার কারাগারে থাকার পরও তারিক মেহান্নার মতো মুক্ত মানুষ আমাদের বাইরের পৃথিবীতে খুব কমই আছে। তিনি কারাগারের চার দেয়ালের ভেতর বন্দী। কিন্তু যে ব্যক্তি তার রবকে চিনতে পেরেছে, তার দ্বীনকে বুঝতে পেরেছে, তার জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও মাহাত্ম উপলব্ধি করতে পেরেছে, আপন রবের প্রতি সততার স্বরূপ যে অনুধাবন করতে পেরেছে, তাকে বন্দী করে রাখে এ জগতের কোন ফেরাউনের সে সাধ্য নেই।
. নিজেকে একবার প্রশ্ন করুন, বন্দীত্ব বলতে আপনি আসলে কি বুঝেন? দৈহিক বন্দীত্বই কি প্রকৃত বন্দীত্ব? নাকি অন্তরের উপলব্ধিও এখনে সমান গুরুত্বপূর্ন?
. হযরত বিলালের (রাদ্বিআল্লাহু আনহু) কথা মনে করুন। কাফির উমাইয়া বিন খালফ তাঁকে শারিরিক ভাবে কতই না অত্যাচার করেছে। পাথর চাপা দিয়েছে। কিন্তু "আহাদুন আহাদ" ব্যতীত তাঁর কন্ঠ থেকে দ্বিতীয় কোন শব্দ বের হয়নি। কাফির উমাইয়া বিলালের শরিরকে নির্যাতন করলেও, তার অন্তরকে বিন্দুমাত্র স্পর্ষ করতে পারেনি।
. যে বান্দা তার অন্তর আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) নিকট সমর্পন করেছে, পৃথিবীর এমন কোন জালিম নেই যে তাকে অত্যাচার করে, পৃথিবীর এমন কোন কারাগার নেই যে তাকে বন্দী করে রাখে।
. আপনি আমি আমরা যারা নিজেদের মুক্ত মানুষ ভেবে খুব গর্ববোধ করছি, তারা আদতেই প্রকৃত অর্থে মুক্ত হতে পেরেছি কি না, বইটি পড়ার পর সে ভাবনা মনের ভেতর ক্ষনে ক্ষনে উদয় হচ্ছে। প্রকৃত দাসত্ব তো হচ্ছে সেই দাসত্ব, যাতে একজন মুখলিস বান্দা একনিষ্ঠভাবে নিজেকে তার রবের নিকট সমর্পন করে দেয়। প্রকৃত দাসত্বের ইতিহাস তো হচ্ছে মূলত রবের নিকট আত্মসমর্পনের ইতিহাস।
. কাফিরদের হাতে বন্দী একজন ভাইয়ের লেখায় কতখানি জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লুকিয়ে থাকতে পারে, তা তারিক মেহান্না আমাদের প্রমান দিয়েছেন। বইটি পড়ার সময় আমার শুধুই মনে হচ্ছিলো ইবনে তাইমিয়্যা (রাহিমাহুল্লাহ) ও শহীদ কুতুবের (রাহিমাহিল্লাহ) কথা। আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম, ইবনে তাইমিয়্যা (রাহিমাহুল্লাহ) কারাগারে বসেই লিখে চলেছেন খন্ডের পর খন্ড মাজমুআল ফাতওয়া। কিংবা শহীদ কুতুব (রাহিমাহুল্লাহ) কারাগারের চার দেয়ালের ভেতর বসে লিখছেন তাফসীর ফি-যিলালিল কুরআন।
. যাই হোক, এবার আসি বইয়ের কথায়। বইটি মূলত ৪৬ টি আর্টিকেলে সমৃদ্ধ। তার মধ্যে ২১ টি রয়েছে একক প্রবন্ধ। বাকি ২৫ টি হচ্ছে "কুরআন এবং আপনি" সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এ সিরিজটি সেই প্রাচীরে পড়ার পর থেকেই আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি সিরিজ।
. "কুরআন এবং আপনি" সিরিজে তারিক মেহেন্না কুআনের ভিন্ন ভিন্ন সূরার ভিন্ন ২৫ টি আয়াত নিয়ে সেগুলোর খুব প্রজ্ঞাসম্পন্ন তাফসীর করেছেন। কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি এখনকার বিশ্ব পরিস্হিতির যে আলোচনা করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তার জীবনের কাহিনীই বর্ণনা করা হচ্ছে। কুরআন যে আমাদের জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলতে সমর্থ, সিরিজটি পড়লে তা সম্যক।উপলব্ধি করা যায়।
. যে কোন পাঠকের ঘুনে ধরা ঈমানকে জাগিয়ে তোলার জন্য এ বইটি টনিকের মতো কাজ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। "কখনও ঝরে যেও না" নামটিই প্রবল এক উদ্দীপনা ও উৎসাহ জাগায় মনের ভেতর। আর ভেতরের লেখাগুলো পড়লে অন্তর কতখানি কোমল হয় তা পাঠক মাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন। আমার কিছু বলাই বাহুল্য।
. বইটির বাঁধাই, প্রিন্ট, প্রচ্ছদ সবই আমার খুব ভালো লেগেছে। পড়ার জন্য হলদেটে রং এর কাগজ আমার এমনিতেই পছন্দ। প্রচ্ছদে বোন আনিকা তুবা বেশ মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
. আমার এ দীর্ঘ বিরক্তিকর পাঠ প্রতিক্রিয়া শেষ করছি বইয়ের ব্যাক কাভারে লেখা কিছু কথা দিয়ে-
. "স্বাধীনতা চার দেয়ালের কল্পিত স্বর্গে নয়, স্বর্গের দিকে কি দেয়াল থাকে? দিগন্তের ওপারে যে বিশাল আকাশ- স্বাধীনতা ঐ আকাশেও নেই। মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলো যান্ত্রিক আটপৌরে এই জীবনের গ্লানি টানতে টানতে ক্লান্ত, বিষন্ন। সবচেয়ে বড় বন্দিত্ব হলো অন্তরের বন্দিত্ব, আর সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা হলো হৃদয়ের স্বাধীনতা। চোখ বন্ধ করলে যে যোগাযোগটা হয়- সেটাই তোমার স্বাধীনতা। একদিন নিশ্চই আল্লাহ চোখের পানিগুলো মুছে দেবেন, অন্তরগুলো প্রশান্ত করবেন। তুমি শক্ত হয়ে জমে থেকো, কখনও ঝরে যেও না..."
. আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে ইসলামের সরল পথে দৃঢ়পদ রাখুন। হাজারো ঝড় ঝাপটায় আমরা যেন শুকনো পাতার মতো এক নিমিষে উড়ে না যাই। বট গাছ যেমন মাটি কামড়ে দাড়িয়ে থাকে, আমরাও যেন তাওহীদের পতাকাটি হাতে নিয়ে হাজারো দুঃখ-কষ্ট-নির্যাতনে তেমনি ইসলামকে আঁকড়ে দাড়িয়ে থাকি।
এই বইয়ের লেখককে আল্লাহ কি অসামান্য জ্ঞান আর প্রজ্ঞা দান করেছেন তা এই বইয়ের প্রতি পরতে পরতে প্রতিভাত হয়। এই বইটি পড়ে আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে, পশ্চিমা ছাঁচে আবদ্ধ ঈমানের কুঠুরিতে ঝাঁকুনি তৈরি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। এই ঝাঁকুনি যেন কেবলই ক্ষণিকের না হয়ে, আপনার আমার চিন্তা জগতে আলোড়ন তোলে সেটা মাথায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ন। বইটির রিভিউ লেখার যোগ্যতা আমার নাই, তাই সেই দুঃসাহস করছি না। প্রকাশকের লেখা থেকে কেবল একটুখানি উদ্ধৃত করি- "... তারিক মেহান্না। যে একবার তাঁর লেখা পড়েছে, মোহাচ্ছন্ন হয়েছে নিঃসন্দেহে। তাঁর লেখা পড়া যেন মনের জানালা খুলে নীল আকাশ দেখার মত।..." মনের জানালা খুলে নীল আকাশ দেখার আমন্ত্রণ আপনাকে।
তারিক মেহেন্না আমেরিকার এক কারাগারে বন্দি দা'ঈ । মাষ্টরিড টাইপের কোনো বই ভেবেছিলাম ;অন্য কিছু আশা করেছিলাম ।ভেবেছিলাম মোটিভেশন টাইপের বই । কিন্তু , সেরকম কিছু না ।
বর্তমানের আলোকে ইসলামের মূল কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি । ( এবং এই বিষয়গুলো জানার জন্য এরকম বই থেকে তাফসির বইগুলো বেশি ভালো )
প্রাচীর এমন একটি বই যেই বইটি পড়ে আমার টনক নড়েছে, বিক্ষিপ্ততায় বিষন্ন জীবন সংবরন করতে শিখেছি, যত বার প্রাচীর বইটি পড়েছি ততবার হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করেছি, যে প্রশান্তির অনুভূতি বিক্ষিপ্ত শব্দে ভাষায় সংকোচে প্রকাশ করা অসম্ভব। বলা চলে এতদিন বিষন্নতা নিয়ে হিমু হয়ে রূপা’তে বিভোর থাকতাম। ঠিক তখনি রূপার পরিবর্তে পেলাম “প্রাচীর” যে “প্রাচীর” ভেঙ্গে দিয়েছে হৃদয়ের সকল প্রার্থিব জীবনের প্রতি ভালোবাসা। একজন মুসলিমের হিদায়তের জন্য কুরআন’ই যথেষ্ট কিন্তু আমরা অনেকেই আছি কুরআন পড়ি কিন্তু আয়াতের অর্থ জানি না, আমিও সে-রকম একজন। প্রাচীর বইয়ের ভাষা আমি বুঝেছি তাই প্রাচীর বইয়ের প্রতি একটা অন্য রকম ভালোলাগা। আমাকে যদি বলা হয় আমার প্রিয় বই কোনটি আমি নিরদ্বিধায় প্রাচীর বইটির নাম বলবো। কেননা, আমি এই বইটি পরে রিভার্টস করেছি ফিরে এসেছি ইসলামে যদিও আমি একজন মুসলিম ছিলাম। এখন প্র্যাক্টিসিং মুসলিম হওয়ার চেষ্টা করছি। (দোয়ার দরখাস্ত)
৪৬ পরিচ্ছেদের একটি বই যেখানে ২৫ টা পর্বই হল "কুরআন এবং আপনি" নামে। সবগুলোই তিনি লিখেছেন কারাগারে বসে, চিঠি হিসেবে। সেই চিঠিই বই আকারে পড়লাম। এই বই সম্পর্কে আমার একটাই প্রতিক্রিয়া, তা হল এটা বারবার পড়ার মতন বই। আপনি এখানে যদি আক্ষরিক অর্থে মোটিভেশন খোঁজার চেষ্টা করেন, তাহলে হতাশ হতে হবে। এটা অমন বই নয়। কুরআন-হাদীস, পশ্চিমা সমাজ, পশ্চিমা দাঈ, হিপোক্রেসি দিয়ে তৈরি আধুনিকতা, আরাম আয়েশের মাত্রাতিরিক্ততায় মানুষের বশ্যতা স্বীকার করে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া -সব কিছু নিয়েই এই বইটা ভাবাবে আপনাকে। Highly recommended!
এটা একটা ইসলামিক বই যেখানে বিভিন্ন প্রকার বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যেমন আফিয়া সিদ্দিকী কে নিয়ে তাছাড়া ইসলামের যে বিষয়গুলো সচারাচর আলোচনা করা হয় না তা উল্লেখযোগ্য। এর বাইরে কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে 25 টি পর্ব রয়েছে। বইটি একটু কঠিন ভাবে লেখা যেটা দু'একবার পড়লে ভালো করে বোঝা যায়। আমি মনে করি এটা সবার পড়া উচিত একবার হলেও। 😊
অসাধারণ একটি বই। চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের সব অসারতাকে তুলে ধরেছে, আবার হারানো মর্যাদা ফিরে পেতে কীভাবে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরতে হবে তাও বলে দিয়েছে এ বইটি। আল্লাহ্ এর লেখকের, অনুবাদকের ও প্রকাশকের সাদাকায়ে জারিয়াহ চালু রাখুক, এই দু'আ করি।