এমন এক দেশ, মানচিত্রে কোথাও যার উল্লেখ নেই, চরাচরব্যপী এক ষড়যন্ত্র দেশটির অস্তিত্ব মুছে দিয়েছে, কিন্তু দেশটি যে আছে, মাঝে-মধ্যে তার পরোক্ষ আভাস পাওয়া যায়; এমন এক জনপ্রিয় লেখক, যার বসবাস অন্য আরেক লেখকের মগজের ভেতরে; এমন এক আপেল, যা আসলে আপেল নয় - শেক্সপিয়রের সনেট; এমন এক তৈলচিত্র, যা যৌথভাবে আঁকছেন দুই সমান্তরাল মহাবিশ্বে বসবাসকারী দুজন শিল্পী; এমন এক কবিতা যা লেখার আগেই চুরি হয়ে গেছে; এমন এক খুনি যাকে ধরতে গেলে প্রমাণ করতে হবে লোকটা রোবটের ওপর নির্যাতন চালাত।
বানিয়ালুলু গল্পগ্রন্থে শিবব্রত বর্মন বিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসির এমন এক কল্পলোক তৈরী করেছেন যা পাঠককে একই সঙ্গে আবিষ্ট করে রাখে অনুসন্ধিৎসায় ও সন্তরণমগ্নতায়।
জন্ম ১৯৭৩, ডােমার, নীলফামারী। বিচিত্র বিষয়ে লেখালেখি করলেও প্রধান ঝোঁক গল্প-উপন্যাসে। বিজ্ঞান-কল্পকাহিনি ও রহস্যকাহিনি লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেন। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত।
সেবা প্রকাশনীর রহস্যপত্রিকার কৈশোর আমাদের উপহার দিয়েছিলো বিদেশি গল্পের দারুণ সব অনুবাদ। একটা গল্প এখনো মনে পড়ে আমার। মেট্রোর টিকিট কাটতে গিয়ে গল্পের নায়ক হারিয়ে যায় পাতাল রেলের এমন এক স্টেশনে, সেখানে তখনো বিরাজ করছে তিরিশের দশকের নিউইয়র্ক। গল্পটার নাম আজ ভুলে গেছি আরো অনেক কিছুর মতোই, কিন্তু মুগ্ধতা থেকে গেছে। আজও কোনো ভালো সাইফাই কি ফ্যান্টাসি ঘরানার গল্প পড়লে, লেখকের কল্পনার দৌড়কে অবচেতনেই মিলিয়ে নেই রহস্যপত্রিকার সাথে।
বাতিঘর প্রকাশনীর ‘বানিয়ালুলু’ নামের ছোটগল্প সংকলনটা ভালো লাগলো ঠিক ওই কারণেই। ভাষা, গঠনের করিগরি নিয়ে বকা যায় অনেক কিছুই; কিন্তু গল্প, কল্পনার দৌড় আর বিজ্ঞানকে দৃষ্টিভঙ্গির অংশ করে পাঠককে টানা বসে থাকতে হয় বইয়ের সামনে। শেক্সপিয়ারের সনেট হয়ে যায় আপেল, লেখার আগেই চুরি হয়ে যায় কবিতা; একই মানুষ ঘোরাফেরা মানচিত্রের দুই স্থানে।
ভোরের ঢাকা শহর থেকে সুদূর কৈশোরের দুপুর ঘুরিয়ে এনেছেন বলে, শিবব্রত বর্মনের কাছে একটা ভালো লাগায় আচ্ছন্ন কৃতজ্ঞতার চিঠি পাঠিয়ে দিলাম। আর আধেক তারা দেয়ার উপায় নেই বলে গুডরিডসে বরাদ্দ করলাম পূর্ণ পাঁচতারা।
এই একশো আটাশ পৃষ্ঠার বইটার পাতা উল্টালাম ঠিক দেড় বছর ধরে। গল্পগুলো পড়লাম খুব বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে, একমুঠো একমুঠো করে। কিছু গল্প আগেই পত্রিকায় পড়া, প্রিয় পুরনো বন্ধুর মতো হাত নেড়ে গিয়েছে। কিছু গল্প নতুন, নিজের তীব্র ভাবনা নিয়ে ষাঁড়ের মতো ছুটে এসেছে পাঠরত মস্তিষ্কে। কিছু গল্প বৃহৎ, যত না দৈর্ঘে, তার চেয়ে অনেক বেশি গল্পের বিস্তারে। কিছু গল্প শুকনো আর খটখটে শব্দে যান্ত্রিক অভিনয়ে সিদ্ধহস্ত। কিছু গল্প কান দিয়ে ঢুকে মস্তিষ্কের গলি-ঘুঁপচি বেয়ে আততায়ীর মতো মিলিয়ে যায়। আসলে, গল্পগুলো যত না গল্প, তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবনা। অনেক বেশি ভাবনার খোরাক। প্রায় প্রতিটা চমৎকার ভাবনাই এক পশলা বৃষ্টির মতো ঝরঝরে শব্দতুলে বেজে ওঠে পাঠকের মাথায়। ভাবনার খোরাকের এই আকালযুগে এমন একটা বই যে খুব লুকিয়ে-বাঁচিয়ে পড়তে হবে, সেটাই স্বাভাবিক। ৪.৩/৫
প্রথমবার শিবব্রত বর্মন পড়তে যেয়ে যে শব্দটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো তা হলো, "বিস্ময়।" বিস্ময় গল্পের বিষয়বস্তুর জন্য, বিস্ময় অভিনবত্বের জন্য, বিস্ময় গল্পের ফর্ম নিয়ে অদ্ভুতভাবে খেলা করার জন্য।আমার বারবার রে ব্র্যাডবেরির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। হ্যাঁ, শিবব্রত বর্মনকে আমার রে ব্র্যাডবেরি মাপের একজন গল্পকার মনে হয়। তার গল্প কোথা থেকে শুরু হবে, কোথায় যেয়ে থামবে, লেবেল আটা থাকলেও গল্পের প্রকৃত জনরা কী তা আগেভাগে ঠাহর করা মুশকিল।সব মিলিয়ে তার গল্পপাঠ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। দুইবার পড়ার বছরতিনেক বাদে "বানিয়ালুলু" আবার পড়তে যেয়ে আগের মতোই নিখাদ বিহবলতা ও অপার আনন্দের মুখোমুখি হলাম। অন্য সবকিছু বাদ, মানুষের কল্পনার দৈত্যাকার বিস্তৃতির অনুপম উদাহরণ হিসেবে অন্তত একবার "বানিয়ালুলু" পড়া উচিত সবার।
বাস রে! বাংলায় এইরকম গল্প-সংকলন তাহলে প্রকাশিত হয়? সত্যি? কেন আমার এহেন বিচলিত দশা, সে-কথায় পরে আসছি। আগে লিখি এই শীর্ণকায় সংকলনে কী-কী গল্প আছে। ভূমিকা-টুমিকার বালাই নেই। সোজা এসেছে এই ক'টি গল্প~ ১) বানিয়ালুলু ২) জাগার বেলা হল ৩) দুই শিল্পী ৪) ভেতরে আসতে পারি? ৫) প্রতিদ্বন্দ্বী ৬) দ্বিখণ্ডিত ৭) ড. মারদ্রুসের বাগান ৮) বহুযুগের ওপার হতে ৯) সার্কাডিয়ান ছন্দ ১০) বুলগাশেম প্যারাডক্স ১১) মইদুল ইসলামের শেষ তিন উপন্যাস এই গল্পগুলোতে কল্পবিজ্ঞান, পরাবাস্তবতা, কল্পনার অবাধ উড়ান, নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা, আর মানব-সম্পর্কের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন এমনভাবে মিশে আছে যে কোথায় একটা জঁর শেষ হয়ে অন্যটা শুরু হয়, তা বোঝা যায় না। সত্যি বলতে কি, তার খুব একটা প্রয়োজনও হয় না। ওপন-এন্ডেড গল্পের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন আমরা এই গল্পগুলোর শেষে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া অগণন সম্ভাব্যতার মধ্যে স্রেফ হারিয়ে যাই। ফলে খেয়ালই থাকে না, ঠিক কোথা থেকে শুরু হয়েছিল এই যাত্রা। মবিয়াস স্ট্রিপের মতো ন্যারেটিভে লেখক আমাদের ফিরিয়ে আনেন শুরুর বিন্দুতেই— কিন্তু তারই মধ্যে ডান হয়ে যায় বাঁ, মাথা হয়ে যায় পা! আমার এইসব আজাইরা প্যাচাল না পড়ে বরং বইটা পড়ুন। ভালো লাগবে। লেখকের উদ্দেশে একখানা আভূমি সেলাম পেশ করলাম।
‘যথার্থ সময়ে’ পড়ব বলে অনেকদিন ফেলে রেখেছিলাম বইটা। যথার্থ সময় এসেছে কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু পড়ে ফেলেছি। সত্যিকারের মাইন্ডবেন্ডিং গল্প বোধহয় এগুলোই। একেবারে অতুলনীয়, দুর্দান্ত, আমাদের চিন্তা যেখানে শেষ গল্পগুলো সেখানেই শুরু। শিবব্রত বর্মন ভাবেন এভাবেই। একইসাথে গল্পগুলোতে উঠে এসেছে ফ্যান্টাসি, কিছুটা বিজ্ঞান, সাইকোলজিকাল ব্যাপার ও হালকা জাদুবাস্তবতা। অধিকাংশ গল্পই মনে রাখার মত। তবে সবথেকে ভালো লেগেছে জাগার হল বেলা, প্রতিদ্বন্দ্বী, দ্বিখন্ডিত, বহুযুগের ওপার থেকে। সবমিলিয়ে ৪.৫ তারকা। লেখকের পরবর্তী বইয়ের জন্য আবারও কত যুগ অপেক্ষা করতে হয় কে জানে।
শিবব্রত বর্মনের লেখা আগে পড়েছি হাতে গোনা দুয়েকটা, এখানে-ওখানে ম্যাগাজিন-পত্রিকার পাতায়। সেগুলোর নাম-ধামও ভুলে গেছি। মনে রাখবার মত তেমন কিছু না তাই মনে রাখি নি। তবে এই বইয়ের কয়েকটা গল্প বিশেষ করে ‘‘ড. মারদ্রুসের বাগান”, “বুলগাশেম প্যারাডক্স”, “সার্কাডিয়ান ছন্দ” গল্পগুলোর কথা বেশ কয়েকদিন আমার মনে ঘুরঘুর করবে।
কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অধিকাংশ লেখক লেখার ক্ষেত্রে একটা যান্ত্রিক ন্যারেটিভ অ্যাপ্রোচ করেন। শিবব্রত বর্মন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। লেখার ধাঁচ যান্ত্রিক না। যাতে যান্ত্রিক না লাগে তাই লেখক একটা ভালো বুদ্ধি বের করে করেছেন। সেটা হল উত্তম পুরুষ ব্যবহার করা। যদিও সব গল্পগুলো হার্ডকোর সায়েন্স ফিকশন না, তবুও উত্তম পুরুষের ব্যবহার লেখনীর যান্ত্রিকতা কমায়। “বহুযুগের ওপার হতে” এর কিছু অংশ বাদে সব গল্পই উত্তম পুরুষে লেখা।
আবার কিছু গল্প যেমন “বানিয়ালুলু”, “দ্বিখণ্ডিত”, “মইদুল ইসলামের শেষ তিন উপন্যাস” এই গল্পগুলোর ক্ষেত্রে লেখক প্রবন্ধের টোন ইউজ করেছেন। এই টোনের ভালো দিক হল গল্পগুলো গল্প মনে হয় না, মনে হয় একজন প্রাবন্ধিক সত্যি কথা বলছেন। ব্যাপারটা ভালো লেগেছে আমার। যদি খামতির কথা বলি তাহলে বলব, গল্পগুলিতে বর্ণনা নেই বললেই চল���, আমি আবার সারাউন্ডিংস এর বর্ণনা পছন্দ করি। তবুও বর্ণনা না থাকা গল্পকে অ্যাফেক্ট করে না, বরং পড়ার গতিকে একটু বাড়ায়। আর সব গল্পই যে সমান��াবে দুর্দান্ত হবে এমন আশা নিয়েও বই হাতে নিই নি। “ভেতরে আসতে পারি?” গল্পটাই সামান্য টিপিক্যাল লেগেছে।
সবমিলিয়ে দারুণ! লেখনী যেমন ঝকঝকা, বিষয়বস্তুও তেমন চমকপ্রদ। সামনে আরো ভালো কিছু পাবার আশা রাখতে পারি।
পড়েছি বেশ কিছু মাস আগে। তবে যতটুকু মনে পড়ে, গল্পগুলো পড়ে বেশ অবাক হয়েছিলাম! ভেবেছিলাম "এমনও গল্প হতে পারে!!" প্রতিটি গল্প চিন্তার উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলে।। বেশ কিছু গল্প এমন যে, আপনাকে চিন্তা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সরাসরি সব সমাধান করে দেওয়া হয়নি।।
গল্পগুলোকে বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী বা ফ্যান্টাসি বলা হলেও গল্পগুলো আমাদের আশপাশের চিরচেনা পৃথিবী নিয়ে, গল্পগুলো সাধারণ মানুষকে নিয়ে ।। এখানে কোনো এলিয়েন বা স্পেসশিপ নেই, অবাস্তব জাদু নেই।।
লেখক বেশ সুনিপুণ হাতে গল্পগুলো বুনেছেন।। উনি প্রতিটা গল্পে অন্যরকম কিছু সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, এবং আমার মতে তিনি সফল হয়েছেন।। এবং তিনি হয়তো আরো চেয়েছেন "পাঠককে চিন্তায় ফেলে দেখা যাক। তারা কিছু গল্প নিয়ে একটু ভাবুক, কতটুকুতে কি সমাধান করে দেখা যাক" কিছু গল্পে পাঠককে তিনি ভিন্নরকম এক জগতের হাতছানি দিতে চেয়েছেন।।
উনি জানার মতো অনেককিছু বলেছেন, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করে গল্পের স্বাদ নষ্ট করেছেন এমনটা না। পাঠককে গল্পের শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেছেন। আসলে এমন সব গল্প পাঠকের মনে অন্যরকম এক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, অন্যরকম কিছুর কাছে নিয়ে যায়।
আমি মনে হয় একজন সত্যজিতের খোঁজ পেলাম। অবাক হয়েছি শব্দচয়ন এবং গল্পের অভিনবত্বে। কিছু বই আছে যাকে ৫ তারকা দিয়েও তৃপ্তি মেটে না।
সকাল থেকে বইটা নিয়ে প্রিয় মানুষটার সাথে ফোনে অনেকক্ষণ কথা বললাম। আমার অভ্যাস হলো একটা বই পড়ে শেষ করার পর সেই বই নিয়ে কারো সাথে ফোনে দীর্ঘক্ষণ বই-আলাপ করা।
আমি যখন ওর সাথে ফোনে বইটা নিয়ে কথা বলছিলাম তখন আমি ওরে বলি, 'তুমি কি জানো! আমি একজন সত্যজিতের খোঁজ পেয়েছি।'
নতুন লেখকদের বই একদম পড়তে পছন্দ না করা লোক আমি। তবে শিবব্রত বর্মনের পরবর্তী বইয়ের জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি।
আমার পড়া লেখকের প্রথম বই 'সুরাইয়া' পড়েছিলাম বাতিঘরে বসে। তারপর হারুন ভাইয়া এই বইটা পড়ার কথা বললে বইটা কিনে ফেলি।
"বানিয়ালুলু, ড. মারদ্রুসের বাগান, বুলগাশেম প্যারাডক্স" গল্প ৩টি অসহ্য ভয়ানক সুন্দর। বাকি ৮টি গল্পও আশ্চর্য রকম সুন্দর। এই বইটা আমি এবারের বইমেলায় আমার প্রিয় ৫ জন মানুষকে গিফট করব।
তবে 'সুরাইয়া' থেকে 'বানিয়ালুলু' বইটা হাজারগুণ মুগ্ধ করেছে। 'সুরাইয়া' বইটাও আমার পছন্দের।
শিবব্রত বর্মনের পরবর্তী বইয়ের অপেক্ষায় থাকছি। অপেক্ষা অসহ্যকর। অন্তত আমার মতো পাঠকের কথা বিবেচনা করে লেখকের উচিত অতি শীঘ্রই সূর্য ডোবার পূর্বে তার আশ্চর্য গল্পের মতো পরবর্তী বইয়ের জন্ম দিতে।
হয়তো শিবব্রত বর্মন-এর পরবর্তী বই লেখার আগেই আমি পড়ে ফেলব! হাহাহা। কৃতজ্ঞতা লেখক এবং প্রিয় হারুণ ভাইয়ার প্রতি।
"জীবনসায়াহ্নে নিজেদের ফেলে আসা ভূমির ছবির দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকেন শরণার্থীরা।"
বইটিতে অনেকগুলো গল্পই একটু "ঘন"; আরেকটু হাত খুলে লেখা হলে ভালো হতো। শেষ গল্পটি, "মইদুল ইসলামের শেষ তিন উপন্যাস", পড়ে সেটার লয়ে স্বস্তি পেয়েছি। নামগল্প "বানিয়ালুলু"র সার ধারণাটি চমৎকার, কিন্তু পড়তে গিয়ে সবিকল্প ইংরেজি শব্দের কাঁটা বারবার পায়ে-গলায় বিঁধেছে। আরো কয়েকটা গল্প পড়ে মনে হয়েছে লেখক গল্পে ব্যবহৃত নানা ধারণা ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ থেকে পেয়েছেন, এমনকি এখানে-ওখানে ইংরেজিতে গল্প ভেবেছেন, শেষে বাংলা গদ্যে সেগুলো ঠিকমতো ফুটে ওঠেনি। অথচ বাংলা গদ্যে লেখকের দখলও চমৎকার। কল্পবিজ্ঞান গল্পে একটু খটোমটো বা অপরিচিত ধারণাকে ইংরেজিতে রেখে না দিয়ে বাংলায় লিখলেও চলে; এ ব্যাপারে তাঁর সাধ্য থাকার পরও হয়তো সাধের অভাব আছে।
বেশ ভালো লেগেছে "বুলগাশেম প্যারাডক্স" আর "সার্কাডিয়ান ছন্দ"। লেখকের পরবর্তী কল্পবিজ্ঞান বই সাগ্রহে পড়বো।
সংযোজন: "বহুযুগের ওপার হতে" গল্পটিতে উত্তর গোলার্ধ আর দক্ষিণ গোলার্ধে ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের ঘূর্ণনাভিমুখ ভুল বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উত্তর গোলার্ধে বাতাস বামাবর্তে (কাউন্টারক্লকওয়াইয) ঘোরে, আর দক্ষিণ গোলার্ধে ঘোরে দক্ষিণাবর্তে। ইতোমধ্যে এ ত্রুটি শুধরে কোনো সংস্করণ বেরিয়েছে কি না জানি না; না হয়ে থাকলে পরবর্তী সংস্করণে প্রকাশক শুধরে নিতে পারেন।
শিবব্রতের গল্পের জগৎ অদ্ভুত রহস্যময় ; যেখানে যে কোন অবিশ্বাস্য কিছু অবলীলায় ঘটে যেতে পারে। পরাবাস্তবতা আর কুহকজালে একেকটি গল্প আবৃত হয়ে মনে আশ্চর্য দ্যোতনার সৃষ্টি করে। শিবব্রতের গল্পের জগতে পাঠকের বিস্মিত হয়ে চোখ বড় করে তাকানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। বানিয়ালুলু থেকে প্রকাশিত সার্কাডিয়ান ছন্দে মইদুল ইসলামের শেষ উপন্যাস ত্রয়ী পড়তে পড়তে পাঠক বুলগাশেম প্যারাডক্সে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবেন!
অনেএএক বছর আগে কিশোর আলোতে শিবব্রত বর্মনের 'চৌধুরী এহতেশামের জীবনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাসমূহ' পড়ে একেবারে হা হয়ে গিয়েছিলাম। তখন, ওই সময়ে, উপন্যাসটা আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এর আগে সেরকম কিছু পড়িনি বলেই উপন্যাসটার ভিন্নরকম উপস্থাপনা আর লেখা অনেকদিন মনে ছিল।
তারপর দীর্ঘদিন এই লেখকের আর কোনো বই পড়িনি। হঠাৎ 'বানিয়ালুলু' চোখে পড়ায় নামটা কেমন আদর আদর লাগল! এক বসাতেই পড়া শেষ… কিন্তু মাথা এখনও বইয়ে আটকে আছে। কী লিখব তাও বুঝছি না। আপাতত গল্পগুলোর সমাধান নিজের মনে আরেকবার কষে দেখি! মাথায় জং ধরে থাকলে আপনারাও ঘুরে আসুন বিচিত্র সব জটিলতার দুনিয়ায়!
বইপ্রেমীর সাথে যারা ওয়েব-কনটেন্টপ্রেমী, তাদের জন্য উল্লেখ্য– এই বইয়ের দুটো গল্প চরকিতে মুক্তি পাওয়া 'ঊনলৌকিক' সিরিজে নেওয়া হয়েছে।
শিবব্রত বর্মন এই প্রথম পড়লাম। কারো থেকে তার নামগন্ধ বা কোনো প্রচার ছাড়া শুধুমাত্র প্রচ্ছদ আর বইয়ের নাম দেখে বইটি হাতে নিয়েছিলাম। উন��র লেখার প্রশংসা করতেই হচ্ছে। লেখায় কাঠখোট্টা ব্যাপারটা একেবারেই নেই। গল্পগুলোও ছোট। টুক টুক করে সবগুলো গল্প একদমে পড়ে ফেলা যায়। আর ফ্যান্টাসির এক অন্যরকম স্বাদ তো সাথে আছেই। তরকারির লবণ হিসেবে লেখকের গল্প বলার ধরণ যোগ করা যায়। গল্প পড়তে পড়তে কখন যে আপনার ইচ্ছে করবে "ড. মারদ্রুসের বাগান" এর শেক্সপিয়ার সনেটের আপেলখানি খেতে তা আপনিও টের পাবেন না। "বানিয়ালুলু" গল্পটা পড়েই ক��ষানিকক্ষন তব্দা খেয়ে গেলাম। এতো দারুণভাবে একটা নিছক গল্প বললেন মানতে কেনো জানো আমার মন নারাজ। আমার বারবার মনে হতে লাগলো বানিয়ালুলু একটা অজানা দেশ হোক, আমি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসি। "দুই শিল্পী" তে যেভাবে দুজন শিল্পী আলাদা ডায়মেনশন থেকে একই ক্যানভাসে আঁকছে, আবার অন্যদিকে চুরি হয়ে যাচ্ছে "প্রতিদ্বন্দ্বী" গল্পে কবির কবিতা।
ফ্যান্টাসির সাথে বিজ্ঞানের এই আপস অ্যান্ড ডাউনস' বেশ উপভোগ্যই বলা যায়। মাথার ভেতর ঘোরপাক খাওয়ার মতো গল্প প্রতিটাই। পছন্দের গল্প হিসেবে বলতে গেলে বলবো "বানিয়ালুলু, দুই শিল্পী, ড. মারদ্রুসের বাগান,সার্কাডিয়ান ছন্দ,বুলগাশেম প্যারাডক্স" এরা শীর্ষে স্থান নিয়ে নিয়েছে। বেশ পছন্দের তালিকার একটি গল্পসংকলন হিসেবে আমার সেল্ফে জায়গা করে নিলো এই ছোট্ট ১২৭ পেজের বইটি। হ্যাপি রিডিং❤️
বাতিঘর গেছিলাম রাইফেল-রোটি-অরাত পড়তে। ওটা কিনে নিয়ে আসলাম আর এটা পড়ে আসলাম। খুবই বিষণ্ণ দিন। বাতিঘরের কফি খেয়ে মাথা ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় আরও শূন্য শূন্য লাগছে। সেই শূন্যতায় কিছু দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করলো গল্প গুলো
রে ব্রাডবেরির "দ্য মার্শিয়ান ক্রনিকেলস" কিংবা আইজ্যাক আসিমভের "আই, রোবট", কল্প বিজ্ঞানের নানা ধরনের ছোট গল্প নিয়ে সংকলন আকারে বই প্রকাশ করা এই ঘরানার জগতে খুবই কমন এক থিম। বাংলা ভাষায় অনেক দিন আগে মুহম্মদ জাফর ইকবালের "কপোট্রনিক সুখ দুঃখ" এবং "জলজ" পড়া থাকলেও অনেক দিন পরে " বানিয়ালুলু " নামে এই ধারার দুর্দান্ত একটি বই পড়লাম। - "বানিয়ালুলু" মূলত ১১ টি কল্পবিজ্ঞান ছোটগল্পের সংকলন। বইটির শুরুই "বানিয়ালুলু" নামক গল্পের মাধ্যমে। গল্পে দেখানো হয় বানিয়ালুলু এমন এক দেশ, যার অস্তিত্ব পৃথিবীর বাকি মানুষের কাছে একেবারেই অজানা। কিন্তু এক অভূতপূর্ব ঘটনার মাধ্যমে এর অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এক সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা সায়েন্স ফ্যান্টাসি ঘরানার এ গল্পে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার নানা ধরণের অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে। - "জাগার বেলা হলো" গল্পটি মূলত দুই জন লোকের কথোপকথন দিয়ে শুরু হয় এবং স্বপ্ন বিষয়ক এ কথোপকথন ধীরে ধীরে ইন্টারেস্টিং মোড়ে রূপ নেয়। "দুই শিল্পী" প্যারালাল ইউনিভার্স ভিত্তিক বেশ পেচানো কিন্তু উপভোগ্য গল্প। "ভেতরে আসতে পারি ?" রোবট ভিত্তিক সাইবারপাংক টাইপের গল্প হলেও বেশ ইউনিক বলা যায়। - এর পরের গল্প "প্রতিদ্বন্দ্বী" নিঃসন্দেহে বইয়ের অন্যতম সেরা গল্প। টাইম ট্রাভেল ভিত্তিক এত দুর্দান্ত গল্প বাংলা ভাষায় অনেক দিন পড়ে পড়লাম।উইয়ার্ড সাই ফাই হিসেবে "দ্বিখণ্ডিত" বেশ লাগলো। "ড. মারদ্রুসের বাগান" বর্তমান সময়ের বেশ কিছু জিনিষের উপর আলোকপাত করেছে যার কারণে এটিকে টুইলাইট জোন বা ব্ল্যাক মিরর - ইশ টাইপের গল্প বলা যায়। - "বুলগাশেম প্যারাডক্স" এই সংকলন এর আরেক দুর্দান্ত গল্প যেখানে ড.বুলগাশেম নামক এক বিজ্ঞানীকে হঠাৎ এক প্রাচীন মানমন্দির যা বর্তমানে সামরিক ঘাঁটি, সেখানে নিয়ে আসা হয় এক অদ্ভুত কারণে। এই গল্পের ফিনিশিং বেশ চমকপ্রদ লেগেছে। "মইদুল ইসলামের শেষ তিন উপন্যাস" গল্পটি প্রথমদিকে মইদুল ইসলাম নামক এক রহস্যময় লেখকের শেষ তিনটি উপন্যাসকে (গিরগিটি, বেহুলার বাসর এবং তারাশঙ্করের ডায়েরি) ঘিরে নিছক সাহিত্য সমালোচনা টাইপ লেখা মনে হলেও কাহিনী যত এগিয়েছে, গল্প ততই নতুন নতুন বাঁকে মোড় নিয়েছে, এক্সপেরিমেন্টাল লেখা হিসেবে ভালোই লাগলো। " বহুযুগের ওপার হতে " গল্পটিকে অনেকগুলো ভালো গল্পের ভিতরে এভারেজ লাগলো। - এবার আসি আমার দৃষ্টিতে এই বইয়ের সেরা গল্প "সার্কাডিয়ান ছন্দ" তে। যেমন দুর্দান্ত প্লট তেমনি দুর্দান্ত এক্সিকিউশন এই গল্পকে সংকলনের অন্যন্য গল্প থেকে একেবারেই আলাদা করে দিয়েছে। এই গল্প সম্পর্কে বিস্তারিত স্পয়লার ছাড়া বলা কঠিন আর এতে গল্পের পূর্ণ স্বাদ নষ্ট হতে পারে বিধায় প্লট সম্পর্কে আর কিছু বললাম না। - "বানিয়ালুলু" এর আরেক ভালো লাগার দিক এর দারুন প্রচ্ছদ যা আমার দৃষ্টিতে এবারের মেলার সেরা প্রচ্ছদ গুলোর ভিতরে একটা। এ কারণে প্রচ্ছদ শিল্পী সব্যসাচী মিস্ত্রিকে বিশেষ ধন্যবাদ। - এক কথায় "বানিয়ালুলু" বাংলা সাহিত্যের চেনা পরিচিত কল্পবিজ্ঞানের গন্ডি থেকে বের হওয়া এক অনবদ্য সংকলন। সব ধরনের কল্প বিজ্ঞান পড়ুয়া পাঠকদের জন্য হাইলি রিকমেন্ডেড !
স্পেকুলেটিভ ফিকশন নামক জনরায় আটকে না থেকে, জনরাভিত্তিক সাহিত্যের রাজনীতির বাইরে গিয়েও কোনো কিছু যে লেখা যায় তার প্রমাণ হলো শিবব্রত বর্মনের বানিয়ালুলু। ফিনাইলের গন্ধমাখা হাসপাতালের পরিবেশ থেকে বিপদাপন্ন অবরুদ্ধ ক্রোনোবায়োলজিস্টের দমবন্ধ করা পরিবেশে দিন গুণতে থাকা কিংবা কন্সপিরেসি থিওরির আড়ালে কেমন করে হারিয়ে যায় একটি দেশ,কীভাবে যন্ত্র অর্জন করতে পারে মানুষের মতো ভাবনাশক্তি,প্রগ্রেসিভ ওভারলোডের মোড়কে বাড়তে থাকে যন্ত্রের চিন্তাশক্তি, নিজের স্বপ্ন বা অন্যের সম্মিলিত স্বপ্নে কীভাবে নিজেকে আবিষ্কার করা যায়---বহু যুগের ওপার হতে এইসব বিচিত্র বিষয়বস্তুর গল্পের কল্পজগতের ঝলমলে রাংতায় মোড়া মোড়কের মাঝে লুকিয়ে আছে গভীর চিন্তার খোরাক। কাহিনী নির্মাণ, অ্যাটমোস্ফিয়ার আর এনভায়রনমেন্ট সাজানোর পাশাপাশি গল্পের সাসপেন্স বজায় রাখতেও শিবব্রত বর্মন যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত। অজানা কোনো বিষয়কে অব্যাখ্যাত রেখে পাঠকের উপর পুরোপুরি ছেড়ে দেন না।তবে গল্পটা বলতে গিয়ে উনি পাঠকের হাতে ধীরে ধীরে লাটাইয়ের সুতো ছেড়ে দিতে থাকেন,অথচ লাটাইয়ের নিয়ন্ত্রণটা থাকে তার হাতেই। আর তারপর সমাপ্তিতে গিয়ে পাঠক দেন প্রবল ধাক্কা! এই ধরনের লেখার মূল্যায়ন করতে গিয়ে হয়তো ভবিষ্যতে "দ্য বানিয়ালুলু ইফেক্ট" নামের নতুন শব্দবন্ধের প্রচল ঘটবে।
লক্ষ করবার মতো বিষয়, বানিয়ালুলুর গল্পগুলো এমন কোনো প্যারালাল ইউনিভার্সের ঘটনা যেখানে চরিত্রেরা শুধুই পুরুষ। ক্রিস্টোফার নোলান যেমন তার সিনেমার নারী চরিত্রগুলোকে মেরে ফেলে নিজের সিগনেচার রাখেন,শিবব্রত বর্মনের বানিয়ালুলু বইতে সেরকম কোনো নারী চরিত্রের দেখা আমরা পাই না।
যারা স্পেকুলেটিভ ফিকশনের আড়ালে সিরিয়াস কিছু বলতে চায় তারা হয়তো অজস্র এলিমেন্টারি বই পড়বার পর এই বইয়ের কাছে ফিরে ফিরে আসবে ও নিজের মনকে প্রশ্ন করবে, "Are we on track now?" আড়মোড়া ভেঙে কুহকী মন দিবে উত্তর, "Yep,buddy. All four wheels."
শিবব্রত বর্মনের লেখা ভালো লাগে প্লট এবং উপস্থানের অভিনবত্বের জন্য। গল্পগুলো সায়েন্স ফ্যান্টাসি ঘরানার, কিন্তু সায়েন্সের কচকচানি একেবারেই, নেই কোনো কঠিন শব্দ বা উদ্ভট কোনো যন্ত্রের কারসাজি। খাটি বাংলা শব্দে গেঁথে গেছেন গল্পগুলো।
শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ার মতো রহস্য আর মুখ হাঁ করা বিস্ময়ের মেলবন্ধন ঘটাতে শিবব্রত বর্মন আশ্রয় নিয়েছেন সায়েন্সের কিন্তু বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন ফিকশন থেকে ফ্যান্টাসি অবধি, কিছু জায়গায় ঢুকিয়েছেন সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার স্যাপার আর কিছু জায়গায় এসেছে ম্যাজিক রিয়েলিজম। সবকিছু মিলিয়ে ভাবনার খোরাক পেয়ে শেষ অবধি গোগ্রাসে গেলে বইটা, পড়া শেষ করেও হয়তো ভাবতে বসে "এ কী হলো মাইর��!"
গল্পের প্লটগুলো কেমন যেন!! ঠিক সাধারণ সায়েন্স ফিকশন/ফ্যান্টাসি নয়। তবে সায়েন্সের মূল বিষয়গুলো নিয়েই। এই বইতে ১১ টা গল্প আছে। এরমধ্যে দু' তিনটে গল্প আমি আগেই পড়েছি। বিজ্ঞানচিন্তা, কিশোরআলো বা প্রথমআলোয়। প্লটগুলো অভিনব আগেই বলেছি, এখন বলতে চাই প্লটগুলো কেমন যেন! পড়তে গিয়ে থ্রিল পেয়েছি প্রতিবারই।
"দ্বিখণ্ডিত" গল্পটার কথাই ধরি। হিমালয়ের হিলারী স্টেপ নামের যেই বিশাল বাঁধা রয়েছে এভারেস্টে উঠবার ঠিক ডজনখানেক মিটার আগেই ; সেটাকেই একজন বলছেন আছে, আরেকজন বলছেন নেই। উভয়ই প্রমাণসহ দাবি করছেন যে হিলারী স্টেপ আছে অথবা নেই। আবার একই মানুষ একই সময়ে দুই জায়গায়! এই প্লটটা উদ্ভট কল্পনা মনে হতে পারে!
আজ্ঞে না! উদ্ভট না। সায়েন্সের থিওরি ফলো করেই লেখা। যেন শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল, জীবিত অথবা মৃত। অথবা কোনো ইলেকট্রন, এই হয়তো দ্বিতীয় কক্ষপথে আছে, পরমুহূর্তেই তৃতীয় কক্ষপথে চলে গেলো। অথবা ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব!
অথবা এই সংকলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প, "সার্কাডিয়ান ছন্দ"র কথা যদি বলি, এরকম এন্ডিং আর টুইস্ট শিয়ার ব্রিলিয়ান্স!! এক পৃথিবীতে বসে আরেক পৃথিবীর দেহঘরির খোঁজ পাওয়ার কল্পনা করা চাট্টিখানি কথা নয়। এরচে বিস্তারিত লিখলে স্পয়লার হয়ে যায়। বাকিটা গল্প পড়েই জেনে নেবেন।
যান্ত্রিকার ছোঁয়া এড়িয়ে খানিকটা মানবিক দিক টেনে গল্পগুলোর মসলিন বুনেছেন লেখক। তবে দুয়েক জায়গায় মনে হয়েছে বর্ণনা আরেকটু থাকলে ভালো হতো।
এগারোটা গল্প নিয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা করার ধৈর্য নেই। বইটার গল্পগুলো ভালো, এন্ডিং ভালো, পড়তে আরাম লাগে, একটা বই সম্পর্কে এইটুকু কমপ্লিমেন্ট মনে হয় যথেষ্ট।
বাকি দশটি গল্পেও প্লটের অভিনবত্ব বিদ্যমান। এন্ডিং টুইস্ট মিলিয়ে কমপ্লিট এক সুখাদ্য প্লেটার এই বইটা। শিবব্রত বর্মনকে অভিবাদন।
শেষ কবে বই পড়ে এতটা উচ্ছ্বসিত হয়েছি মনে নেই। এত দারুণ! আমি ভাবতেও পারিনি প্রত্যেকটা গল্প আমাকে মুগ্ধ করবে সমানতালে। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে কোনটা সেটাও বোধহয় বলতে পারবো না। লেখকের "সুরাইয়া" বইটা আগে পড়েছিলাম, সেখান থেকে বানিয়ালুলু পড়ার প্রতি আগ্রহ পাই। দিজ ওয়ান ইজ মোর ব্রিলিয়ান্ট! গল্পের দৈর্ঘ্য বাড়লে বোধহয় শেষে গল্পেরব্যাপারে যুক্তিমূলক বর্ণনা পাওয়া যেত এই ওপেন এন্ডেড সমাপ্তির বদলে।
রেটিং ৪.৫ মুন্সিগিরি দেখার পর আগ্রহ জাগে লেখকের বই পড়ার। মৃতেরাও কথা বলে কোথাও পাইনি দেখে বানিয়ালুলু পড়তে হলো। প্রায় প্রত্যেকটা গল্পই সুন্দর। গল্পের শেষে এসে একটা ধাক্কা দেয়া যেন লেখকের একটা অভ্যাস। তবে কিছু কিছু গল্প একটু জটিল মনে হয়েছে, গল্পগুলোর পরিধি হয়ত আরো বড় হলে উপভোগ করতাম আরেকটু। তবে বইটা সংগ্রহে রাখার মত একটা বই।
ব্যাক কাভারে লেখা বইটা পাঠককে একই সাথে 'মুগ্ধ' ও 'স্তম্ভিত' করে দিবে। কথাগুলো স্রেফ বিক্রি বাড়ানোর সস্তা কৌশল না। বানিয়ালুলু পড়লে আপনি আসলেই মুগ্ধ হবেন, গল্পের অভিনবত্বে হবেন স্তম্ভিত। বইয়ের প্রতিটি গল্পই অনন্য, তবু আলাদাভাবে 'সার্কাডিয়ান ছন্দ' নামক গল্পটির কথা উল্লেখ করবো। গল্প শেষ করে খানিকক্ষণ থ মেরে বসেছিলাম।
অদ্ভুত সুন্দর ঘোরলাগানো কিছু ছোট কল্পকাহিনী, যা অনেকখানি চিন্তার খোরাক জাগায়। সবগুলো গল্প সেভাবে অনুভব করতে না পারলেও প্রতিদ্বন্দ্বী, দ্বিখন্ডিত, ডা. মারদ্রুসের বাগান, সার্কাডিয়ান রিদম, বুলগামেশ প্যারাডক্স খুবই ভালো ছিলো। লেখকের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেলো!
বাংলা ভাষায় এমন আধুনিক বৈজ্ঞানিক কল্পগল্প পড়তে পেরে বিশেষ আনন্দ হচ্ছে। এতদিন শুধু ইংরেজি ফিল্ম আর টিভি শোতেই এমন বিষয়বস্তু নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখেছি। শিবব্রত বর্মনের এই বইয়ের গল্পগুলোতেও বৈচিত্র্য আছে। বোর হওয়ার কোন সুযোগ নেই। গল্পগুলো সংক্ষিপ্ত, একটু তাড়াহুড়া ছিল মনে হয় কোন কোন গল্প লেখার সময়। যেমন "ভেতরে আসতে পারি" গল্পে একজন মানুষকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে কিছু সূত্র ব্যবহার হয়। সেখানে সবগুলো সূত্র কোহেরেন্ট মনে হয় না। তবে "ভেতরে আসতে পারি" গল্পে দেখানো ডিসটোপিয়ান রিয়ালিটি আমাকে Black mirror সিরিজটার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত উৎকর্ষে মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে- এইটাই বিষয়বস্তু।
"ডক্টর মারদ্রুসের বাগান" গল্পটা সেরা। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সৃষ্ট অসীম তথ্যভাণ্ডার, সভ্যতার বিলুপ্তি, জেনেটিক্স, মিউটেশনের মত বিষয়বস্তুকে একটা গল্প এক সূত্রে গেঁথে এমন সাইন্স ফিকশন বানিয়েছেন, অসাধারণ! একটা প্রজন্মের আপেল থেকে আরেক প্রজন্মের আপেলে শেক্সপিয়রের সনেটসমগ্রের মিউটেশন ঘটছে, সৃষ্টি হচ্ছে সনেটের ভ্যারিয়েন্ট। ব্যাপারটা ভাবলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় (মিউটেশনের ব্যাপারটা, Mass extinction না কিন্তু)।
"মইদুল ইসলামের শেষ তিন উপন্যাস" গল্পটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উৎকর্ষ ছুঁয়েছে। প্রযুক্তির যা উন্নতি হচ্ছে দিনকে দিন, কোনটা সম্ভব আর কোনটা অসম্ভব, বুঝ পাওয়া কঠিন।
"প্রতিদ্বন্দ্বী" গল্পটাও প্রিয়। সামনে পিছনে টাইম ট্রাভেল করা নিয়ে একটা জমজমাট ক্রাইম থ্রিলার। আর গল্পটা দুই কবিকে নিয়ে। কাব্যপ্রেমীদের একটু স্পেশাল ভালোলাগার সুযোগ আছে।
Alternate reality ব্যাপারটা আমার ভালোলাগে। একই সাথে অনেকগুলো সত্য বিরাজ করে ধাঁধা সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে একটা আধ্যাত্বিক ব্যাপার আছে, কাহিনীতে ক্রাইম যুক্ত থাকলে guilty pleasure-ও পাওয়া যায়। তাই "দ্বিখণ্ডিত" গল্পটাও প্রিয়।
আরও বিভিন্ন মজার বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প আছে "বানিয়ালুলু"-তে। মানুষ যে ডাইমেনশন কল্পনা করতে পারে না তেমন ডাইমেনশনে চিত্রকলার গল্প। স্বপ্ন নাকি বাস্তব- এমন ধোঁকায় ফেলে দেয় এমন গল্প। Alien invasion নিয়ে কাহিনী। রাষ্ট্রের তথ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কড়াকড়ির গল্প। বঙ্গোপসাগরে প্রায় পাঁচশত বছর আগের বিশালাকৃতির পালতোলা ইউরোপিয়ান জাহাজ দর্শনের শিহরণজাগা অভিজ্ঞতার কথা।
মৌলিক বই তার উপর গল্প সংকলন।আমাদের দেশের বেশিরভাগ মৌলিক বইই আশানুরূপ হয় না।কোন না কোন জায়গায় সমস্যা থাকেই প্লাস প্লটহোল তো কমন বিষয়। কিন্তু এই গল্প সংকলন ট�� পড়ার পর অভিভূত করল। কি জনরায় ফেলানো যায় গল্প সংকলনটিকে??
আমাদের চিন্তা যেখানে শেষ সেখানেই যেন শুরু লেখক শিবব্রত বর্মনের লিখা।কি বৈচিত্রময় এবং অদ্ভুদ রকমের গল্প দিয়ে পুরা বইটা সাজিয়েছেন তিনি।সাই ফাই বলবেন বইটার জনরাকে?সাই ফাই ফ্যান্টাসি বলবেন?আরবান ফ্যান্টাসি জনরায় ফেলাবেন?ক্রাইম থ্রিলার?আসলে পুরা বইটার জনরাকে কোন ভাবেই একটা নির্দিষ্ট নাম দেয়া যাবে না।কি অসাধারণ,কি বৈচিত্রমত তাঁর গল্পের প্লট।আমি স্রেফ তব্দা খেয়ে ছিলাম পড়া শেষে।
একেকটা গল্প পড়েছি আর মুগ্ধতার রেশ কাটাতে অনেক সময় লেগেছে। "দ্বিখন্ডিত" গল্প টা এই বইয়ের সেরা গল্প লেগেছে আমার কাছে।জানি না এই লেখক এত কম লিখে কেন বা আবার কতদিন অপেক্ষা করা লাগে উনার বইয়ের জন্য
'বানিয়ালুলু' গল্পগ্রন্থে বিজ্ঞান আর ফ্যান্টাসির অপূর্ব এক মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন শিবব্রত বর্মন। সবগুলো গল্পই দারুণ লেগেছে, তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করব 'সার্কাডিয়ান ছন্দ', 'জাগার বেলা হলো', 'দ্বিখন্ডিত', 'প্রতিদ্বন্দ্বী', 'দুই শিল্পী' শিরোনামের এই গল্পগুলোর নাম। ভদ্রলোকের পরবর্তী লেখা (উপন্যাস/গল্পগ্রন্থ যা-ই হোক না কেন) পড়ার জন্য মুখিয়ে রইলাম।
প্রচ্ছদটা এতো সুন্দর! বইমেলায় বাতিঘরের স্টলে গিয়েই চোখ আটকে গিয়েছিল। ডিজাইন আর রঙের ব্যবহার খুব ভালো করেছেন প্রচ্ছদশিল্পী।
বইয়ের নামটাও মাথায় ঢুকে যায়। 'বানিয়ালুলু' - বলতেই মজা লাগে। দু-তিন বার বলতে ইচ্ছে করে।
এবার আসি মূল বিষয়ে। লেখনী খুব ভালো। সহজে পড়ার মতো। গল্পগুলোও ছোট ছোট। মনোযোগ ধরে রাখে।
গল্পের বিষয়বস্তু বিচিত্র। মানচিত্রে নেই এমন দেশ, স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝের দুরত্ব ও নৈকট্য, মহাজগতে ভিন্ন প্রাণ থাকার সম্ভাবনা, জেনেটিক্স, মোর্স কোড।
সময়ের থিম নিয়ে লেখক কয়েক জায়গায় এনেছেন - প্রতিবারই খুব মজা পেয়েছি। অনলাইনে তথ্য সংরক্ষণ আর সব তথ্য বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা নিয়ে লেখাটা সাংঘাতিক।
একটা ব্যাপারে খুব মনমেজাজ খারাপ হয়েছে। কয়েকটা গল্পের শেষ নাই। ওপেন এন্ডিং নাহয় মেনে নিতে পারি, তাই বলে গল্পের মাঝখানে গিয়ে দেখব নতুন গল্পের নাম - এটা কেমন কথা!?
আর দু-একটা গল্প তো শুরুই হয় নাই! মাত্র এক্সপোজিশন পড়লাম আর দেখি গল্প শেষ! কিন্তু আমি তো আরো জানতে চাই! এই আইডিয়াগুলো এক্সপ্যান্ড করে আড়াইশো পাতার উপন্যাস লিখলে খুশি হয়েই পড়ব।
কয়েকটা গল্প বেশ ভালো ছিল, কয়েকটা আবার ভাল্লাগে নাই। মাঝামাঝি। তবে আমাদের দেশে সাই-ফাই নিয়ে খুব বেশি কাজ করতে দেখা যায় না (সবাই খালি থ্রিলার থ্রিলার করে) :3 সেই তুলনায় ভালো ছিলো প্রচেষ্টাটা।