কলেজ টলেজ সব বাদ দিয়ে সুমিরে একজন উপন্যাসিক হওয়ার চেষ্টায় আছে। নাওয়া খাওয়ার খেয়াল নেই। সারাদিন বই পড়ে আর লেখালেখি করে। দুনিয়ার সাথে ওর একমাত্র যোগাযোগ হল শুধু মাত্র মাঝ রাতে একমাত্র বন্ধুকে ফোন দিয়ে উঠিয়ে অসংখ্য কথা বলা। এমন সময় সে প্রেমে পড়ল তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় একজন বিবাহিতা নারীর। অমনি তার জীবনটা বদলে গেল। প্রেমিকাকে চাইলে লেখালেখি হয় না, লেখালেখি চাইলে প্রেম বাদ দিতে হবে। সুমিরে শেষ পর্যন্ত কোনটা বেছে নিল? ওর সিদ্ধান্ত কি শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াল? বলাবাহুল্য বরাবরের মত এটিও মুরাকামিয় পরাবাস্তবতা ও অসীম বিষণ্ণতায় ভরপুর।
কৌশিক জামান একজন অপদার্থ। ইংরেজিতে যাকে বলে- গুড ফর নাথিং। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে পরাজিত হতে হতে হাল ছেড়ে দেয়া একজন ব্যক্তি। কিছু মানুষ আছে না এক ভুল বার বার করে? তিনিও ঐ কিসিমের।
তাই নিজেকে বন্দী করে রেখেছেন একশ স্কয়ার ফিটের একটা রুমে। রুম ভর্তি শুধু বই আর বই। বই পড়তে পড়তে তার মনে হয়েছে কিছু একটা লিখে ফেলা দরকার। এবং অখাদ্য ছাইপাঁশ কিছু আবর্জনা লিখেছেন যেগুলো প্রকাশক একরকম চাপে পড়ে ছাপিয়ে এখন আফসোস করছেন।
"কেন মানুষকে এতোটা নিঃসঙ্গ হতে হয়? এর কারণটা কী? পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ,সবাই আকাঙ্ক্ষায় আকুল,আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে যে অন্যরা তাদের পরিতৃপ্ত করবে,পূর্ণ করবে,অথচ তারপরও তারা এক হয় না।কেন?পৃথিবীর কাজ কি এখানে মানুষের নিঃসঙ্গতাকে পরিপুষ্ট করা?" -স্পুটনিক সুইটহার্ট, হারুকি মুরাকামি
এককথায় বলতে বলতে গেলে,পুরো বইটা খুবই অদ্ভূত! নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব,বিষণ্ণতা,শূন্যতাকে যেভাবে বিভিন্ন ঘটনা, গল্প, চরিত্রের মাঝ দিয়ে আনা হয়েছে সেটাকে বলা যেতে পারে- Pure piece of art.. তবে বইটা পড়ার সময় এটা মাথায় রাখা আবশ্যক যে, কোনোকিছুই আগে থেকে প্রেডিক্ট করা যাবে না,ধরে নেয়া যাবে না। কারণ,যেভাবে আপনি আমি সাধারণ মানুষ চিন্তা করি, এই বইটাকে সেই গতেবাঁধা কালো-সাদা বাস্তবতার ছকে বাঁধা পড়বে না। সুপারন্যাচারাল সব ঘটনা, নস্টালজিয়া, ম্যাজিক-রিয়েলজিম আর সুররিয়েলিজমের ছড়াছড়ি পুরো বই জুড়ে। আপনি যদি কথোপকথনের গভীরতা,ভাবাবেগ, ইমোশনকে প্রাধান্য দিতে পছন্দ না করেন,ধুমধাড়াক্কা আর ফাস্ট রোলার কোস্টার রাইড ছাড়া আপনার চলেই না, তবে বইটা আপনার জন্য নয়।কারণ,তখন এটাকে মনে হবে মারাত্মক স্লো আর বোরিং। এটুকু ছাড় দিতে পারলে সিটবেল্ট বেঁধে,গা-হাত-পা ছেড়ে রিল্যাক্সড হয়ে বসুন। আর কিছুক্ষণ পরেই মহাকাশের অন্ধকারে ভেসে যাওয়া মনুষ্যনির্মিত স্যাটেলাইটের ছোট্ট জানালাতে বাইরের অসীম শূন্যতার দিকে চেয়ে থাকা পৃথিবীর প্রথম প্রাণী লাইকার মতোই, বিপন্ন বিস্ময় আর নিঃসীম শূন্যতা আপনাকে গ্রাস করতে চলেছে।
#কাহিনী_সংক্ষেপ: গল্পটা লেখক হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ সুমিরের। লেখালিখির জন্য কলেজ অবধি বাদ দিয়েছে সে।নাওয়া-খাওয়ার খেয়াল নেই, না আছে পরনের পোশাক বা নিজের যত্ন, নেই পথ হারানোর ভয়ও। লক্ষ্য শুধু একটাই, এমন একটা উপন্যাস লিখতে হবে যা প্রকাশিত হলেই তুমুল করতালিতে ভেসে যাবে চারদিক। সারাদিন বই পড়া আর লেখালিখি। দুনিয়ার সাথে যোগাযোগের একমাত্র সুতোটা বাঁধা বন্ধু "কে" এর সাথে। মাঝরাতে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে অসংখ্য কথা বলে সে কে'র সাথে। সে হাড়হিম করা শীতই হোক কিংবা চেরিফুলে ভরা বসন্তে। সবই ঠিকঠাক চলছিলো কিন্তু এমন সময় এলো টর্নেডোর ধাক্কা, নিজের থেকে অনেক বড় বিবাহিতা মিউ নামের এক নারীর প্রেমে পড়লো সুমিরে। আর এই ধাক্কাই ওলটপালট করে দিলো সুমিরের পুরো জীবন। ফর্মার পিয়ানিস্ট মিউ উত্তরাধিকার সূত্রে এখন বিশাল বিজনেসের মালকিন, যা কিনা হ্যান্ডেল করে তার স্বামী। মিউয়ের পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে চাকরিতে জয়েন করার পরই অগোছালো সুমিরে কেমন যেন বদলে যায়। এক বিজনেস ট্রিপের শেষে তারা দুজন হাজির হলো গ্রিসের সীমন্তঘেঁষা এক দ্বীপে। আর তারপর পাল্টে গেল তিন,তিনটা মানুষের জীবনের গতিপথ। ভাবছেন, এ আর কী এমন ঘটনা? উঁহু..এতোটাও সহজে দুইয়ে দুইয়ে চার হবে না। লেখকের স্টোরিটেলিংয়ের কারণে, থার্ড পার্টি অ্যাডে উইন্ডোর মতো পপ-আপ করবে প্রশ্নের দল। দোলাচলে ভুগে সুমিরে উপন্যাস আর মিউয়ের মাঝে কোনটাকে বেছে নিলো? কী হলো তার কাল? মরে না গিয়েও কীভাবে একজন জলজ্যান্ত মানুষ উধাও হয়ে যেতে পারে, যেখানে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার কোনো রাস্তায়ই নেই? গুলি খেয়েছে কিন্তু রক্ত ঝরে নি এরকম কাউকে কি কখনো আপনি দেখেছেন?
জানতে চান? শেষবারের মতো সাবধান করে দিই.. এটাকে নিছক কোনো প্রেমের উপন্যাস ভেবে ভুল করবেন না। ম্যাটারিয়েলস্টিক চরম বাস্তবতা থেকে আর কয়েক মিনিটের মাঝেই অতলান্ত শূন্যতায় ডুবতে যাচ্ছেন আপনি।
#পাঠপ্রতিক্রিয়া: স্পুটনিক সুইটহার্টের যে বিষয়টা সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে তা হলো এর চরিত্রায়ন আর চরিত্রগুলোর জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। কে,সুমিরে আর মিউ এই তিনটা ক্যারেকটারের ডেভেলপমেন্ট হাতের রেখার মতোই সূক্ষ্ম আর একইসাথে ইন্টারেস্টিং । মনে হয় যেন জলজ্যান্ত মানুষটা আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে,আপনার প্রতিদিনের ওঠাবসা তার সাথে। কোন কাপে চা খায়, চায়ে পাঁচ চামচ চিনি খায় কেন সব আপনার জানা।
তারপর আসা যাক,স্টোরিটেলিং আর ন্যারেটিভের বিষয়ে। কখনো ফার্স্ট পার্সন পার্সপেক্টিভ,আবার কখনো থার্ড পার্সন থেকে এগিয়েছে ২০৪ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস। এমবেডেড ন্যারেটিভে বেশ স্মার্টলি ছোট ছোট গল্পকে টেনে এনেছেন বিষণ্ণতার জাদুকর। জীবনবোধ, অনুভূতিকে এমন এমন ভার্সেটাইল ফিলোসফি আর গল্পের মধ্য দিয়ে টেনে আনা হয়েছে যা মনে স্পষ্ট ছাপ ফেলতে বাধ্য করে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আর ওয়েদার ক্রিয়েটিংয়ে মুরাকামিকে মায়েস্ত্রো বলা যায়। কারণ, স্টোরিটেলিং আর ডিটেলিংয়ে মুন্সিয়ানা না থাকলে, আমার মনে হয় না বইটা আমি আদৌ শেষ করতে পারতাম। গ্রিসের সেই ঘটনাবহুল দ্বীপ থেকে শুরু করে কফিশপের ডিটেলিং পর্যন্ত অনেক বেশি জীবন্ত।
১৬ টা চ্যাপ্টারের ২০৪ পৃষ্ঠার এই বইটাতে আমি কমসে কম ৫০ টা নতুন গানের খোঁজ পেয়েছি, বেশিরভাগই ক্লাসিক্যাল আর জ্যাজ মিউজিক। মুরাকামি প্রথম জীবনে জ্যাজ বারে কাজ করতেন অনেকটা লা লা ল্যান্ডের সেবাস্টিয়ানের মতো। আর লিটারেচারের রেফারেন্সের কথাও বলতে হয়। কখনো তলস্তয়, কখনো জোসেফ কনরাড,আবার কখনো জ্যাক কেরুয়াকের লেখার নানাকথা পাওয়া যায় বইয়ের আনাচে কানাচে। ব্যক্তিগতভাবে, আমার ভালো লেগেছে বইয়ের ৫,১১ আর ১২ নাম্বার চ্যাপ্টার। বইয়ের নামকরণের সার্থকতাও পাওয়া যাবে,বইয়ের কালো অক্ষরে সাজানো পাতাগুলোর ভেতরেই।
নেগেটিভ দিক বলতে হলে বলবো, বইয়ে যে সাহসী একটা গল্প বলা হয়েছে,সেটা হয়তো আমাদের পক্ষে নেয়া বেশ কঠিনই। তা বাদেও আপনার হাতে যদি সময় কম থাকে,হালকা কিছু পড়ার মুডে থাকেন তবে বইটা রিকমেন্ড করবো না একেবারেই। কারণ,যেসব ভারী ভারী ফিলোসফি আর চলার পথে অবস্ট্যাকলসগুলো নিয়ে ক্যারেকটারগুলোর অনুভূতি,ভাবাবেগ বিভিন্ন প্রসঙ্গে ঘুরেঘুরে এসেছে সেগুলো মাথার কয়েক মাইল উপর দিয়ে যেতে পারে। খুব বেশি ইমোশনাল না হয়ে যদি ম্যাটারেয়িলিস্টিক বাস্তবতার সমুদ্রে পোড়খাওয়া নাবিক হোন, তবে ক্যারেকটারগুলোর অস্তিত্বের সংকট, পরাবাস্তব অনুভূতিগুলো ঠিকমতো অনুভব করাটা কঠিন।
বইটা পড়তে গিয়ে কেন জানি না,ইমতিয়াজ মাহমুদের একটা কবিতার কথা মনে পড়ছিল বারবার।
নিঃসঙ্গতা ❑ আন্দামান সাগরের এক একলা দ্বীপে এক সাধু যখন একটা পাখির কিচির মিচিরে অতিষ্ঠ হয়ে ভাবছিলো কিভাবে আরো একা হওয়া যায় তখন জাকার্তার জনাকীর্ণ সড়কে হাজার হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে একটা লোক একা একা হেঁটে যাচ্ছিলো . #অনুবাদ_প্রসঙ্গে: কৌশিক জামানের এই অনুবাদটা আমি মোটামুটি ভালো বলবো। তবে খুব বেশি সাবলীল নয়,জড়তা-সঙ্গতির অভাব দেখা গেছে অনেক জায়গায়। অনেক চ্যাপ্টার খুব ভালো অনুবাদ করেছেন,আবার কিছু কিছুতে দেখা গেছে শব্দচয়ন, বাক্য গঠনে অসঙ্গতি। এমন না যে, উনার কোনো অনুবাদ আমি আগে পড়ি নি। এটা উনার অনুবাদে পড়া পাঁচ নাম্বার বই (কনফেশন্স,গথ,জু, ডার্ক ওয়াটার) আর মুরাকামির অনুবাদ হিসেবে তিন নাম্বার। বাকি বইগুলোর তুলনায় এটাতে বেশ কিছু শব্দের ব্যবহার চোখে লেগেছে। যেমন : দানিউবকে লিখেছেন দানুবে, ডপলগ্যাঙ্গারকে ডপেলগ্যাঞ্জার,তাছাড়া পড়া আর পরা বিভ্রাট। চিরায়ত বা সমকালীন সাহিত্যের বইয়ের অনুবাদে একটু কাঠকাঠ ভাব থাকাটা অস্বাভাবিক না,তবে এইটা পড়তে গিয়ে আমার বেশ অসুবিধা হয়েছে। একই প্যারা, একই চ্যাপ্টার কয়েকবার পড়তে হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে মূল বই পড়ে বুঝতে হয়েছে। স্পেশালি বইয়ের কমপ্লেক্স সেন্টেন্সগুলোর অনুবাদে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। ভেঙে ভেঙে করলে বা খানিকটা সঙ্গতি বজায় রাখলেই সেগুলোর অর্থ বা সৌন্দর্যের কোনো কমতি হতো না বলেই মনে করি।
#প্রোডাকশন_নিয়ে_দু'চার_কথা: অবসর থেকে প্রকাশিত বইটার প্রোডাকশন বেশ ভালো। মানানসই প্রচ্ছদটা করছেন অনুবাদক নিজে। ফ্ল্যাপে সিনোপসিস যদিও নেই,তবে সেটা খুব বেশি সমস্যা হবার কথা না। মুদ্রণ প্রমাদ সেভাবে চোখে পড়ে নি বললেই চলে।
মানুষজনের কতো রকম শখ-ই না থাকে.. ইচ্ছা থাকে কতো কী হবার। কিন্তু সুমিরে সব সময় ঔপন্যাসিক হতে চাইতো৷ জাগতিক সব প্যাচমুক্ত, সহজ সরল আত্মভোলাটাইপ সুমিরে প্রাণপণ চেষ্টা ছিল সত্যিকারের একজন লেখক হবার। টুকিটাকি লেখালেখি দিয়ে সত্যিকারের সাহিত্যিক হবার পথে ঠিক কতোটা এগিয়ে যাচ্ছিল-সে প্রশ্ন না হয় আপাতত তোলা থাকুক। আসলে জীবনকে আমরা যতোটা সহজভাবে দেখি, জীবন অতোটা সহজও নয়। নিজের সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন সুমিরের জীবন হুট করে পালটে গেল একদিন... জীবনের বাইশতম বসন্তে এসে সত্যিকার অর্থে প্রেমে পড়ল এই তরুনী লেখিকাটি। প্রেমে ভেসে গেল সে, ভেসে যেতে লাগল তার বোহেমিয়ান জীবন যাপনও। সুমিরে কোন পুরুষের প্রেমে পড়েনি, তার থেকে প্রায় সতেরো বছরের বড়, রীতিমতো মধ্যবয়সী এক বিবাহিতা নারী, মিউ'র, প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল সে। কঠিন ধূমপায়ী, আউলা ঝাউলা চরিত্রের সুমিরে এই ঘটনায় গেল তুমুল বদলে। হাতে নেইল পালিশ, ঝাঁ চকচকে স্যুট, আর পায়ে হাই হিল দিয়ে খটখট করে হেঁটে বেড়াতে দেখা গেল তাকে। শুধু তাই না.. লেখালেখিতে সম্পূর্ন মনযোগ দেয়ার জন্য যে মেয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল সেই মেয়েকে ফাইল হাতে দশটা-পাঁচটা অফিসে জব করতে দেখা যেতে লাগল। সে সব তো দৃশ্যমান পরিবর্তন সবাই দেখতে পাচ্ছিল... কিন্তু সুমিরের মনোজগতের যে পরিবর্তন হয়ে গেছে সেটা তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউ টের পেল না। আর পাবেই বা কি করে, মুখচোরা সুমিরে মনের আগল খুলে তো আর সবার সাথে কথা বলতো না। মিউ আসার আগ পর্যন্ত তার জীবনে কেবল একজনের অস্তিত্বই ছিল। গল্পের কথক, তার একমাত্র বন্ধু। স্কুল শিক্ষক এই বন্ধুটি আবার মনে মনে পছন্দ করতো সুমিরেকে। সম্পর্কটা কেবলই বন্ধুত্বের হলেও সবকিছু মিলিয়ে সম্পর্কটি যেন বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কিছু৷
ওই যে বললাম.. জীবন আমরা যেমন সহজ ভাবি আসলে তা না... ছন্দপতন এলো আবারও। পাগলাটে সুমিরে তার বস মিউ'র সাথে অফিসিয়াল ট্যুরে চলে গেল দেশের বাইরে.. আমাদের গল্পের কথকের শুরু হলো নির্লিপ্ত জীবন৷ যে সুমিরে হুটহাট রাত তিনটা চারটায় ফোন দিয়ে অক্ষর আর প্রতীকের পার্থক্য জানতে চেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিতো অর্থহীন আলাপে সেই সুমিরে এখন অতি ব্যস্ত। মাঝে মাঝে দীর্ঘ অপেক্ষার পর তার কাছ থেকে পাওয়া যায় খুব সংক্ষিপ্ত টেলিগ্রাম কিংবা পোস্টকার্ডের।
একদিন এলো টেলিফোন...
না, গল্প কথকের সেই প্রতীক্ষার টেলিফোন নয়। অন্য একজন, মিউ। একটা দুঃসংবাদ। গ্রীসের একটা দ্বীপ থেকে হারিয়ে গেছে সুমিরে। হারিয়ে গেছে মানে একেবারেই উধাও.. খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। বন্ধু (নাকি প্রেম?) এর টানে সেই দ্বীপে হাজির হয় সে। মুখোমুখি হয় মিউর... আর অনুসন্ধান করতে থাকে সুমিরের। কি হয়েছে এই উদীয়মান লেখিকাটির? জ্বলজ্যান্ত একটি মেয়ে কিভাবে সবার চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে যেতে পারে? একটা ফ্লপি ডিস্ক থেকে উদ্ধার হয় রাইটার্স ব্লকে ভুগতে থাকা সুমিরের সর্বশেষ লেখা। এগিয়ে যেতে থাকে গল্প.. সুমিরে কি আদৌ বেঁচে আছে? শুরু হয় অন্য রকম এক প্রতীক্ষা।
দিন বদলেছে, বছর ঘুরেছে, প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে। এমনকি মানব সভ্যতা চাঁদেও পা রেখেছে। কিন্তু এতকিছু অর্জন করা সত্ত্বেও মানুষ একটা জিনিসকে কখনোই জয় করতে পারেনি। আর তা হচ্ছে, নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব কিংবা শূন্যতাকে। এখনো এই বিশাল বিশাল ইমারতের শহরগুলোতে মানুষকে নিঃসঙ্গতার বৃত্তে বন্দি হয়ে চক্রাকার জীবনযাপন করতে হয়। ঠিক তেমনি টোকিওর মতো বিশাল এক মহানগরীতে হারিয়ে যাওয়া তিনজন মানুষ নিজেদেরকে খোঁজার চেষ্টা করেন; ভাঙার চেষ্টা করেন নিঃসঙ্গতার চিরন্তন বলয়। ঠিক যেন রাশিয়ান স্যাটেলাইট স্পুটনিক ২ এর যাত্রার অনুরূপে; যেখানে কুকুর লাইকা পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে এবং অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অসীম এক শূন্যতার দিকে।
উপন্যাস শেষে হয়তো মুরাকামির মতো আপনিও ভাববেন সেই অসীম মহাশূন্যের ভেতর লাইকার কেমন অনুভূতি হয়েছিল? শূন্যতার আরো গভীরে কি শূন্যতাই থাকে? নাকি নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্ব মিলে শূন্যতাকে রূপ দেয়? লাইকা কী ভেবেছিল তা কেবল লাইকাই জানে! যেমনটা মুরাকামি জানে তিনি কী ভেবেছেন!! আর উপন্যাস পড়া শেষে আপনিও জানতে পারবেন আপনি কী ভাবছেন।
"মনুষ্য সৃষ্ট স্যাটেলাইটটা নিঃশব্দে মহাকাশের অন্ধকারে ভেসে যাচ্ছে আর ছোট্ট জানালা দিয়ে চকচকে চোখ মেলে লাইকা নামের কুকুরটা বাইরে তাকিয়ে আছে। বাইরের অসীম শূণ্যতায় চেয়ে থেকে লাইকা কী দেখছিলো!"
অতুলনীয় এক নিঃসঙ্গতাবোধ সেই নিঃসঙ্গতা বোধে আক্রান্ত মানুষদের গল্প বলে যান হারুকি মুরাকামি। নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত মানুষের অনুভুতির বর্ণনা তিনি এভাবে দিয়েছেন " আমরা দুজন চমৎকার ভ্রমণসঙ্গী ছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা আসলে স্রেফ নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন কক্ষপথে চলতে থাকা একাকী একতাল ধাতব বস্তুর চেয়ে বেশি কিছু ছিলাম না। দূর থেকে দেখে ওগুলোকে সুন্দর খসে পড়া তারার মতো দেখালেও, বাস্তবে ওগুলো বন্দীশালার বাইরে আর কিছু ছিলো না। আমরা দুজনেই যার যার মতো একাকী বন্দি ছিলাম, কোথাও যেতে পারছিলাম না। যখন এই দুই স্যাটেলাইটের কক্ষপথ একটা আরেকটাকে অতিক্রম করে তখন আমরা একত্র হতে পারি। এমনকি আমরা হয়তো একজন আরেকজনের কাছে নিজের মন খুলে ধরতে পারি। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র অল্প সময়ের জন্য। পরের মুহুর্তেই আমরা আবার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। যতক্ষণ না আমরা পুড়ে গিয়ে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাই। "
আমার কাছে হারুকি মুরাকামি শুধুমাত্র একজন লেখক নন। মানুষের হতাশা, একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতাবোধের সার্বজনীন অনুভূতি গুলোকে একজন পর্যবেক্ষকের মতো একজন মনস্তত্ববিদের মতো পর্যবেক্ষণ করে গেছেন এবং তার লেখায় উপস্থাপন করেছেন নিজস্ব অভিনব ভঙ্গিমায়। মানুষের জটিল মনস্তাত্ত্বিক দুঃখবোধ যা মানুষের মধ্যে সার্বজনীন কিন্তু এই সার্বজনীন দিকটির গভীরতা সম্পর্কে এবং এর স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা খুব কম মানুষেরই আছে। সেই গোলকধাধাঁর সাথে তিনি আমাদেরকে অভিনব বর্ণনায় বহুমাত্রিক আঙ্গিকে পরিচয় করিয়ে দেন।
হারুকি মুরাকামির একাধিক লেখায় দেখা গেছে এমন কিছু চরিত্র যারা তাদের সম্পূর্ণ সত্তার কিছু অংশ হারিয়ে ফেলেছে অতীতের কিছু ঘটনাপ্রবাহে। সেই চরিত্র গুলো সম্পূর্ণ আগের মানুষটা নন যেমনটি তারা ছিলেন। এই নিজের সত্তার কিছু অংশ হারিয়ে ফেলার যে সুক্ষ্ম দিকটি। ভাষাতীত সেই অনুভুতির চিত্রকর হারুকি মুরাকামি। প্রশ্ন তুলেছেন কেনো মানুষকে এতোটা নিঃসঙ্গ হতে হয়? এর কারণটা কী? পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ, সবাই আকাঙ্খায় আকুল, তাকিয়ে আছে অন্যরা এসে তাদেরকে পরিতৃপ্ত করবে, অথচ তারপরেও তাদের আলাদা করে রাখছে। কেনো? পৃথিবীর কাজ কি এখানে শুধু মানুষের নিঃসঙ্গতাকে পরিপুষ্ট করা?
বার বার হারুকি মুরাকামির লেখার কাছে ফিরে যেতে ���ালো লাগে। আত্মকেন্দ্রিক দুঃখবোধের অনন্য অনুভূতিগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন ভিন্ন বিবর্ণ দৃশ্যপটে মানস চোখে কল্পনায় ফুটিয়ে তুলতে।
এক বই ভরা নিঃসঙ্গতা, বিষণ্নতা, পরবাস্তবতা। গল্প নয়, ছোট ছোট দৃশ্যগুলোর জীবন্ত ব্যাখ্যা ভাসিয়ে নিয়ে যায় নাম না জানা পরবাস্তব কোনো জগতে, মুখোমুখি করিয়ে দেয় অজানা কোনো জগতের নিজের-ই সত্ত্বার সাথে, যেখানে রয়েছে শুধুই একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতা, সবশেষে দীর্ঘনিশ্বাস।
কে, সুমিরে আর মিউ - এই তিনে উপন্যাস। কে হচ্ছে এই উপন্যাসের গল্পকথক। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন পরিচয় হয়েছিল সুমিরের সাথে। খুব অদ্ভুত ধরনের এই মেয়েটার প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু কেন জানি কখনোই মনের কথাটা মন খুলে বলতে পারে না। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে সুমিরের পরিচয় হয় মধ্যবয়সী সুন্দরী নারী মিউয়ের সাথে। আচমকাই সুমিরের অনুভূত হয় যে এই নারীর প্রেমে পড়েছে সে। একটা সময় লেখালেখির জন্য সবকিছু ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করলেও এখন মিউয়ের সাথে এক মুহূর্ত কাটানোর জন্যে সবকিছু ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে সুমিরের। কে কি শেষমেশ সুমিরেকে জানাতে পারে নিজের মনের কথা? সুমিরে ঠিক কোনটাকে বেছে নেয় লেখালেখি নাকি মিউয়ের সঙ্গ? মিউয়ের অন্ধকার অতীতে আসলে কি হয়েছিল?
কিছু কিছু যায়গায় সুমিরে আর কে এর কথোপকথন অর্থহীন মনে হয়েছে৷ অনুবাদের মান আরেকটু ভালো হলে ভালো লাগত৷
বই থেকে কিছু লাইন- একা থাকার ব্যাপারটা আসলে ভয়াবহ একটা একাকী ব্যাপার।
সব গল্প বলার একটা সময় আছে। নাহলে আপনি আপনার ভেতরের গোপনীয়তার কাছে চিরবন্দী হয়ে থেকে যাবেন।
আমি অতীতে জীবিত ছিলাম, আর এখনও জীবিত আছি, এখানে বসে তোমার সাথে কথা বলছি। কিন্তু যাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ সে আসল আমি নই। আমি যা ছিলাম তার একটা ছায়া মাত্র। তুমি সত্যি সত্যি জীবিত, কিন্তু আমি নই। এমনকি এখন আমি যেসব কথা বলছি সেগুলোও খালি শোনাচ্ছে, যেন প্রতিধ্বনির মতো।
আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বিশেষ কিছু একটা থাকে যা আমরা শুধুমাত্র জীবনের একটা বিশেষ সময়ে পেতে পারি। ছোট একটা অগ্নিশিখার মতো। একজন সাবধানী লোক, ভাগ্যবান কেউ কেউ ঐ শিখাটাকে যত্ন করে বাড়িয়ে তুলতে পারে। চলার পথে একটা মশাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু একবার শিখাটা নিভে গেলে, সারাজীবনের জন্য তা শেষ।
তো এইভাবে আমরা আমাদের জীবন চালিয়ে যাই। ক্ষত যত গভীর আর যত ভয়াবহ হোক না কেন, আমাদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি করে নেয়া হোক না কেন-আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া হোক না কেন-এমনকি আমাদেরকে যদি পুরোপুরি অন্য মানুষে বদলে ফেলা হয় যার বাইরে আগের চামড়াটাই আছে, তারপরও আমরা আমাদের জীবন এভাবে নীরবে চালিয়ে যাই। আমরা আমাদের জন্য বরাদ্দ সময়ের বিস্তৃতি আগের চেয়েও কাছে টেনে আনি, পেছনে পড়ে গেলে বিদায় জানাই। বারবার, কখনো কখনো নিপুণভাবে, করে যাই প্রতিদিনের অসীম পরিমাণ কাজ। পেছনে ফেলে যাই অপরিসীম শূন্যতার অনুভূতি।
I am a fan of Murakami's writing style, but this book really disappointed me. It was literally being so difficult for me to finish this book. Flat and meaningless storyline...I felt there were so many unnecessary and boring parts,metaphors.
Moreover, Murakami's character detailing is always so deep that readers can literally feel those characters, their philosophy,their pain,joy,lonliness. In simple words, they easily get connected with the characters. But in this novel, i just couldn't understand any of these 3 characters.There was no character depth.Their perspective,way of living,loneliness,relationship among characters...nothing touched me at all.