এক মিথোলজিক্যাল মিস্ট্রি থ্রিলার, যার কাহিনি দানা বেঁধেছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে। প্রাচীন এক গুপ্তপুঁথির সূত্র ধরে দুই বন্ধু জড়িয়ে পড়ে হাজার হাজার বছরের লুকিয়ে থাকা এক অবিশ্বাস্য সত্যের সন্ধানে। ঐতিহাসিক সূত্র আর পৌরাণিক সংকেতের হাত ধরে এ গল্প আমাদের এনে দাঁড় করায় এক নতুন দিগন্তের সামনে। বর্তমানের এই আধুনিক কালে ফিরে আসে প্রাচীন সময়, ইতিহাস ও পুরাণের যুগ। এ কাহিনির ভূগোল বদলে গেছে বার বার - কখনও দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতার কলেজস্ট্রিট, রিষড়া, হেদুয়া, কসবা, র্মুর্শিদাবাদ কিংবা শিলিগুড়িতে। আর স্থান বদলের সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠেছে গল্পের রহস্য। কাহিনির প্রত্যেক মোড়ে এক নতুন চমক অপেক্ষা করে আছে পাঠকের জন্য। চরিত্রগুলো এখানে পরিচিত মহলের কাছাকাছি থেকেও যেন মুখোশের আড়ালে। পাঠক এর প্রতিটি পাতায় খুঁজে পাবেন রহস্য-রোমাঞ্চ।
Anirban Mukherjee, 34, a mechanical engineer and statistician, works for one of the big four organizations as the head of Quality Management.
Anirban is fascinated with globetrotting, reading, writing poetry, composing music and passionate about playing cricket. He takes keen interest in exploring human psyche and searches for the true meanings of relationships. Romance, history, mythology, adventure and travelogue are his areas of literary interest. Love-Bites! is his debut novel, where he tries to sketch a complete portrait of love using the colours of attraction; disconcert; isolation and union. Anirban resides in Kolkata, India, along with his wife Amrita and kids Aryan and Aayush.
2.5 five stars. Intriguing plot line, but the writing is very weak. The execution..... Meh. The climax was frustrating to read. Readers will guess the ending from miles away.
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে আছড়ে পড়ে ইতিহাস। জনতার ভিড় ছাপিয়ে গর্জে ওঠে হাজারও কিংবদন্তি। ফেনার মতো অনন্ত প্রশ্নমালা ছিটিয়ে দেয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। তবু কেন আমাদের নিজস্ব থ্রিলার হয় না? এমন থ্রিলার যার পা থাকবে এদেশের এই গল্পময় মাটিতে, কিন্তু মাথা থাকবে ড্যান ব্রাউনীয় ভুবনে? হয়। ইংরেজিতে হয়। বাংলাতেও হয়, তবে এযাবৎ তাদের প্রায় সবটুকুই সীমাবদ্ধ ছিল ওপারে। এই ধারার সাম্প্রতিকতম নিদর্শন হিসেবে সিদ্দিক আহমেদ রচিত 'দশগ্রীব' আমরা পেয়েছি প্রথমে বাতিঘর এবং এখন অভিযান পাবলিশার্স থেকে। এই বছর জানুয়ারিতেই এপারে প্রকাশিত হয়েছিল আলোচ্য বইটি। এটি এমনই এক কাহিনি যেখানে টানটান রোমাঞ্চ, খুন, ষড়যন্ত্র, অপহরণ, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি ঘটেছে প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু সে-সব গৌন করে এতে মুখ্য হয়ে উঠেছে পুরাণ, ইতিহাস, সিম্বলজি, স্পেকুলেশন, এবং আরও অনেক-অনেক প্রশ্ন। তাই জোর গলায় বলা চলে, অন্তত এপার বাংলায় রচিত মিথলজিক্যাল থ্রিলার হিসেবে এই বইটি প্রথম বা অগ্রপথিকদের একজন।
কিন্তু বইটা ঠিক কী নিয়ে? 'বাংলা আমার বাংলা' চ্যানেলের দুই রিপোর্টার বিক্রমজিৎ ও অভিনন্দন আলিপুর চিড়িয়াখানায় একটি রেকর্ডিং করতে গিয়ে ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়ে এক বিচিত্র রহস্যজালে। সেই রহস্যের কেন্দ্রে আছে একটি পুঁথি - যাকে দীর্ঘদিন ধরে রক্ষা করে এসেছে এক গুপ্তদল। কী আছে সেই পুঁথিতে? কারা এই গুপ্তদল? এরা কি ভালো, না মন্দ? সত্যিই কি এদেশের, এমনকি গোটা দুনিয়ার ইতিহাস নতুন করে লেখার মতো জিনিস লুকিয়ে আছে ওই পুঁথিতে? মুখ আর মুখোশের ভিড়ে বিক্রমজিৎ আর অভিনন্দন কাদের বিশ্বাস করতে পারবে?
বইটা কি উতরেছে? আজ্ঞে হ্যাঁ, বইটা আনপুটডাউনেবল হিসেবে থ্রিলারের প্রথম শর্ত ভালোভাবেই পূর্ণ করেছে। শুধু একটিই আক্ষেপ রয়ে গেল। ঘাগু রহস্যপ্রেমীরা অপরাধীদের আন্দাজ করতে মোটেই সময় নেবেন না। কাহিনির ক্লাইম্যাক্সও রীতিমতো হতাশাজনক। তবে... বইটা পাঁচে পাঁচ পাবে পুরাণের বিনির্মাণ ও সিম্বলজির জন্য। সত্যি বলতে কি, বইয়ের এই অংশটা এতই কৌতূহলোদ্দীপক, যে কাল অফিস যাওয়ার হ্যাপা না থাকলে আমি এই রাত দুটোতেই হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মহাগ্রন্থটি নিয়ে পড়তে বসতাম, যাতে ইতিহাস আর পুরাণকে আরও একবার ম্যাপিং করে নিতে পারি নিজের মতো করে। অর্থাৎ, দিনগত পাপক্ষয়ের চক্করে পিণ্ডবৎ মস্তিষ্ককে একটি হাই ভোল্টেজ স্পার্ক দেওয়ার ব্যাপারে এই বইয়ের দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
বইটা সম্পূর্ণ অকারণে আর্টপেপারে ছেপে হাত ও চোখ - দুয়ের ওপরেই চাপ বাড়ানো হয়েছে। বানানরীতি প্রাগৈতিহাসিক (নাকি পৌরাণিক?), তবে ছবি ও ম্যাপের দরাজ প্রবিষ্টি বইটাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
যদি আপনি পুরাণ, ইতিহাস, রহস্য, রূপক-সংকেত - এদের মধ্যে একটি জিনিসও ভালোবাসেন, তাহলে এই বইটি আপনার ভালো লাগবে। আর যদি এদের মধ্যে একাধিক বিষয় আপনার কাছে আকর্ষণীয় হয়, তাহলে এই বই আপনার জন্য অবশ্যপাঠ্য।
ইদানীং কিছু 'লেখক' থ্রিলার লেখার নাম করে নষ্টামি করছে। কথাটা শুনতে বিচ্ছিরি শোনালেও অসত্য নয়।
সুলেখক মুহাম্মদ আলমগীর তৈমূর এই লেখকের প্রশংসা করেছিলেন। তাই অনির্বাণ মুখার্জির 'তিন বাহু দশ মুখ' পড়তে শুরু করি এবং প্রচণ্ডরকম হতাশ হই। কাহিনিকে জমাতে হলে যে মেহনত করতে হয়, তা করেননি লেখক। মুখার্জিবাবু পড়াশোনা করেছেন। এই ছাপ রাখার যথেষ্ট চেষ্টাও লক্ষ করলাম। সব-ই জমল। শুধু কাহিনি জমাতে ব্যর্থ লেখক।
রোববারের অলস দুপুর। বিছানায় শুয়ে বসে ভাবছেন, এতদিন হল, তাও ড্যান ব্রাউনিয় ঘরানার বেশ জম্পেশ একখান বাংলা থ্রিলার হাতে এলনা কেন? শ্রী দেবতোষ দাশের বিন্দুবিসর্গর পরও তো গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেল। এখন বাংলাদেশে পর্যন্ত মিথোলজিক্যাল থ্রিলারের ছড়াছড়ি। সেখানে আমরা কি ওদের থেকে চিন্তাভাবনায় এতটাই পিছিয়ে? তবে আর চিন্তা নেই, এবছর কলকাতা বইমেলায় "সৃজন" এর সাড়াজাগানো উপন্যাস "তিন বাহু দশ মুখ" আপনার পাঠকমনের তৃষ্ণা মেটাতে হাজির।
আসুন, বইয়ের বিষয়বস্তুর ওপর হালকা করে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক:- সাড়ে তিনহাজার বছরের পুরোনো এক গুপ্তসংঘ রক্ষা করে চলেছে এমন এক গোপন সূত্র, যা প্রকাশ পেলে বদলে যাবে মানবসভ্যতার ইতিহাস। একটি পুঁথির তিনটি অংশের মধ্যে লুকোনো সেই সূত্র। এদিকে, সংঘকে ঘিরে হয়ে চলেছে একের পর এক খুন। সন্দেহ, সংঘের সদস্যদের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক বিশ্বাসঘাতক। কী চায় সে? সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে ঘটনাবলীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে দুই তরুণ সাংবাদিক অভিনন্দন ও বিক্রমজিৎ। তারা কি পারল বিপদকে তুচ্ছ করে সংঘের মন্ত্রগুপ্তি রক্ষা করতে নাকি চোরাটানে এগিয়ে চলল অমোঘ নিয়তির দিকে?
বিজ্ঞাপন চোখে পড়ার পর থেকেই মিথোলজিক্যাল থ্রিলারটি নিয়ে উৎসাহ ছিল তুঙ্গে। আনকোরা নতুন লেখক, তাই কেনার সময় সামান্য সংশয়ও কাজ করছিল, অস্বীকার করবনা। কিন্তু বইটি হাতে তুলে কয়েক পাতা পড়তেই সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হয়ে গেল। বলা ভাল, রুদ্ধশ্বাস লেখনীর জোরে একটানা এতবড় উপন্যাসটি পড়িয়ে নিয়েছেন লেখক। পোক্ত লিখনভঙ্গী, উপযুক্ত চরিত্রচিত্রণ, কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়নির্মাণ, রহস্যজাল বিস্তার এবং উন্মোচনের ক্ষেত্রে আগাগোড়া মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। হিন্দুধর্মের অতিপরিচিত সিম্বলিজম সমন্বিত একটি পুঁথির তিনটি অংশকে কেন্দ্র করে যে মারণজাল ঘনিয়ে উঠেছে তার সুতোগুলির বুনন অত্যন্ত জমাট। হু ডান ইট গোত্রের থ্রিলার এটি, সুতরাং সুতোর জট ছাড়াতে ছাড়াতে আপনিও পৌঁছতে পারেন অপরাধীর কাছে, আর তা লেখকের আগে হলেও ক্ষতি কিছু নেই। উপন্যাসের প্রস্তুতির দিনগুলির গভীর পড়াশোনার ছাপ রয়েছে লেখার ছত্রে ছত্রে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। শিল্পী শতদ্রু গুপ্তের বিষয়োপযুক্ত প্রচ্ছদ ও অলংকরণ বইটির সম্পদ। তাছাড়া, এই মাগ্যিগন্ডার বাজারেও বইয়ের দাম যথাযথ বলেই মনে হয়েছে।
সব ভালোর মাঝেও কিছু কথা না বললেই নয়,যেমন:- ১)বিশ্বাসঘাতকের মোটিভ আরো জোরালো হওয়া উচিত ছিল। যে উদ্দেশ্য দেখানো হয়েছে তার পিছনের কারণটি স্পষ্টভাবে ব্যাখা করলে আরো সূক্ষ্ম হত। ২)যতটা দেখানো হয়েছে, বাবাঠাকুর চরিত্রটির ব্যাপ্তি কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি। তবে, এর সিকোয়েল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে হয়তো লেখক হাতের তাস পুরোটা খুলে দেখাননি, এমনটাও হতে পারে। ৩)অযথা, গ্লসি আর্ট পেপারের ব্যবহারে বইয়ের ওজন অস্বাভাবিক বেশি। কলকাতা থেকে বাঁকুড়া বয়ে আনতে কাঁধের ব্যাথায় এর সিংহভাগ অবদান রয়েছে।সাধারণ পেপারব্যাক করলেও এর আবেদন কমত না বলেই মনে হয়।
প্রথম উপন্যাসেই বাজিমাত তো করেছেনই, সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে এই বিশেষ জঁরে লম্বা রেসের ঘোড়া সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন লেখক। গল্পের শেষে সাম্ভালার উল্লেখ আরেকটি অসাধারণ মিথোলজি��্যাল থ্রিলার পড়তে পাবার ইঙ্গিত কিনা, তা জানা এখন সময়ের অপেক্ষা। অতএব, যাঁরা এই ধরনের থ্রিলারের রসাস্বাদনে আগ্রহী তাঁরা অবশ্যই বই সংগ্রহ করে পাঠে মনোনিবেশ করুন। এ অনন্য অভিজ্ঞতার সুযোগ ছাড়া একদম উচিত হবেনা।
কাহিনি সংক্ষেপঃ কলকাতার 'বাংলা আমার বাংলা' নিউজ চ্যানেলের তরুণ দুই রিপোর্টার অভিনন্দন ও বিক্রমজিৎ এক সন্ধ্যায় আলিপুর চিড়িয়াখানার ওপর একটা স্টোরি কভার করতে গেছিলো। এই দুই তরুণ তখনো জানতো না, সেই সন্ধ্যাতেই তাদের জীবন কি অদ্ভুত ভাবে বদলে যাবে। ঘটনাক্রমে এই দুই বন্ধুর হাতে এসে পড়লো বহু প্রাচীন একটা পুঁথি। আর ঠিক এরপর থেকেই যেন ওদের নিরুপদ্রব জীবনে নেমে এলো একের পর এক উপদ্রব।
রাস্তায় গুরুতর আহত অবস্থায় একজন মানুষকে পেয়ে হসপিটালে ভর্তি করলো অভিনন্দন ও বিক্রম। রাতারাতি সেখান থেকে গায়েব হয়ে গেলো লোকটা। কে বা কারা এই দুই বন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাদের বাড়ি সার্চ করে গেলো। প্রতিনিয়ত কেউ যেন নজর রেখে চলেছে তাদের ওপর। কেন?
সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত দেড় হাজার বছর আগে তাঁর বিশ্বস্ত নয়জন অনুচরকে নিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন এক গুপ্তদল। যে দলের সদস্যদের কাজ ছিলো ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের প্রকৃত ইতিহাসের রক্ষণাবেক্ষণ ও সেটার গোপনীয়তা বজায় রাখা। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই গুপ্তদলের গোপন কর্মকাণ্ড। অথচ আজ, এই বর্তমান সময়ে গুপ্তদলের দলপতি বাবাঠাকুরের মনে দেখা দিয়েছে ঘোর সন্দেহ৷ দলের দশ জনের মধ্যে একজন পরিণত হয়েছে বিশ্বাসঘাতকে। যে রহস্য তাঁরা শত শত বছর ধরে লোকচক্ষুর সামনে থেকে সযত্নে রক্ষা করে চলেছেন, সেটাই আজ তাঁদেরই মধ্যে অজানা কোন একজন হস্তগত করতে চাইছে একক ভাবে। যে রহস্যকে তিনটা আলাদা আলাদা পুঁথি আকারে ভাগ করে রাখা হয়েছে গুপ্তদলের সৃষ্টিলগ্ন থেকে। যেগুলোর অবস্থান জানার জন্য খোদ গুপ্তদলও চালিয়ে যাচ্ছে চেষ্টা।
মাস্টারমাইন্ড আরেক ব্যক্তি, যে নিজেকে পরিচয় দেয় প্রধান হিসেবে; একদম মরিয়া হয়ে উঠলো পুঁথির বিচ্ছিন্ন অংশ গুলো হস্তগত করার জন্য। প্রধান আর তার বিশ্বস্ত সহচর চন্দ্রবাবু নিজেদের মিশন কমপ্লিট করার জন্য মেতে উঠলো ভয়ঙ্কর এক খেলায়। পড়তে লাগলো একের পর এক লাশ।
আলিপুর জেলের ২০ নাম্বার সেলের রহস্যটাও বেশ জমে উঠলো। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবের সাথে জড়িত বিপ্লবী বরেন ঘোষ কোন সূত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন ওই সেলে? সিপাহী বিদ্রোহের সময় এই উপমহাদেশে আসা ইংরেজ নাবিক রিচার্ড ব্যারনের ডায়েরিও যেন অনেক ধাঁধার জন্ম দেয়৷ কুখ্যাত জগৎ শেঠের সমস্ত ধনরত্নই বা গেলো কোথায়?
সাধারণ দুই তরুণ অভিনন্দন ও বিক্রম না চাইতেও জড়িয়ে পড়লো এসব ঘটনার সাথে। ভারতবর্ষের প্রচলিত প্রাচীন ধর্ম ও সভ্যতার ইতিহাসেরও ইতিহাস ঠিক যেন ওদের থেকে কয়েক কদম দূরে। আর এই কারণেই ওরা পণ করলো এসবের শেষ দেখে ছাড়ার। ঘটতে লাগলো একের পর এক অদ্ভুত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। প্রাচীন সভ্যতা, ধর্মবিশ্বাস, হারানো ইতিহাস, নানারকম থিওরি, প্রতিজ্ঞা, লোভ আর বিশ্বাসঘাতকার অপূর্ব এক আখ্যান আপনাআপনিই যেন এগিয়ে যেতে লাগলো সামনের দিকে।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ 'তিন বাহু দশ মুখ' বইটা কিনেছিলাম ২০২০-এর অমর একুশে বইমেলা শেষ হওয়ার পরপরই৷ বাংলাদেশে এই বইটা প্রকাশের আগে কলকাতায় বেশ ভালোই হাইপ ক্রিয়েট করেছিলো বইটা। আমি আসলে হাইপে গা ভাসাই না। যে কারণে বোধহয় এটা পড়া শুরু করতে দেরি হয়ে গেলো। অনির্বাণ মুখার্জীর প্রথম উপন্যাস 'তিন বাহু দশ মুখ'। বহু প্রাচীন এক সিক্রেট নিয়ে লেখক লিখে ফেলেছেন তাঁর এই সুবিশাল কলেবরের উপন্যাসটা৷ কন্সপিরেসি থিওরি, মিথোলজি, ইতিহাস, বিবর্তনবাদ, হিন্দুধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ সহ নানা বহুল-চর্চিত ব্যাপারে অনির্বান মুখার্জী খোলামেলা আলোচনা করেছেন তাঁর এই থ্রিলারে।
পড়া শুরু করার পর দেখলাম, একটা প্রাচীন পুঁথি আবিস্কারের মধ্য দিয়ে শুরু হলো কাহিনি। এরপর নানা রোমাঞ্চকর ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলো পুরো ব্যাপারটা৷ দুই তরুণ রিপোর্টার জড়িয়ে গেলো গুপ্তদল ও অজানা আরেক ভয়ঙ্কর দলের সাথে মুখোমুখি বিরোধে। হিস্টোরিক্যাল ও মিথোলজিক্যাল থ্রিলারের এসব উপাদানের পাশাপাশি উঠে এলো বেশ কিছু থিওরি। যেমন দশাবতারের দশ জন অবতারের আবির্ভাবের সাথে বিবর্তনের থিওরি, প্রাচীন ভারতবর্ষের তিন প্রান্ত থেকে উদ্ভব হওয়া প্রাচীন তিন সভ্যতার থিওরি, তিন সভ্যতার মিলনে সৃষ্ট সম্পূর্ণ নতুন এক সভ্যতা ও একীভূত ধর্মবিশ্বাসের থিওরি আর সব শেষে ভারতবর্ষ থেকে সারা পৃথিবীতে সেই সভ্যতার ধারা ও ধর্মবিশ্বাসের ছড়িয়ে পড়ার থিওরি।
উপন্যাসের কাহিনির স্বার্থে লেখকের দেয়া এসব থিওরি বিশ্বাস করে বসে থাকার কোন কারণ নেই। তবে চমকৃত হয়েছি তাঁর চিন্তার ব্যপ্তি দেখে। একটা প্রাচীন গুপ্তসঙ্ঘের ধারণা থেকে একে একে এতোকিছুর উদ্ভব হওয়া সত্যিই অসাধারণ একটা ব্যাপার। আজকের এই আধুনিক হিন্দুধর্মের ধারণার পেছনের সুপ্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অনির্বাণ মুখার্জী তাঁর এই উপন্যাসে যে থিওরি গুলো দিয়েছেন, সেসব পড়ে চিন্তার খোরাক পেয়েছি, শিহরিতও হয়েছি। সর্বশেষ বোধহয় গতো বছর সিদ্দিক আহমেদের 'দশগ্রীব' পড়ে এতোটা শিহরিত হয়েছিলাম। ইতিহাস আর মিথের অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে কখন 'তিন বাহু দশ মুখ' শেষ হয়ে গেছে, টেরই পাইনি।
এই বইটার বেশ কিছু নেগেটিভ রিভিউ আছে। আমি পজিটিভ রিভিউ দেখেও বেশি লাফালাফি করি না। নেগেটিভ রিভিউ পড়েও কোন বই ছুঁড়ে ফেলি না। আমার পড়ার কথা, আমি পড়ি। ব্যক্তিগতভাবে 'তিন বাহু দশ মুখ' আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। লেখকের প্রথম উপন্যাস হিসেবে তিনি তাঁর সর্বোচ্চটা দিতে চেষ্টা করেছেন। এতো থিওরির অবতারণা করতে গিয়ে যে তাঁকে প্রচুর জানতে হয়েছে, তা সহজেই বোঝা যায়। 'তিন বাহু দশ মুখ' একটা পারফেক্ট ও উপভোগ্য থ্রিলার উপন্যাস, যেখানে থিওরি গুলোকে সরিয়ে রাখলেও ভেতরের বেশ কিছু ইনফরমেশন পাঠককে অবাক করবে। আমি বেশ আনন্দ নিয়ে পড়েছি৷ কার কেমন লাগবে বা লেগেছে, জানি না।
বানান ভুল বা টাইপিং মিসটেক বলতে গেলে একেবারেই ছিলো না। তবে কাহিনির ব্যাপারে একটা খটকা আছে। আর সেটা হলো, প্রধান কিভাবে এতোটা নিশ্চিত ছিলেন ২০ নাম্বার সেলের রহস্যের ব্যাপারে? এটার সদুত্তর আমি পাইনি।
উপন্যাসের কাহিনির স্বার্থে পুরো বই জুড়েই অনেকগুলো ছবি ব্যবহৃত হয়েছে, যেসব পড়ার ক্ষেত্রে বেশ সাহায্য করেছে৷ 'তিন বাহু দশ মুখ'-এর প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছেন শতদ্রু গুপ্ত। ভালো লেগেছে।
রিকমেন্ড করবো না। ইচ্ছা হলে পড়ে ফেলতে পারেন বইটা।
উপন্যাসের প্রেক্ষাপট এত বিশাল যে কাহিনী সংক্ষেপ আমি লিখতে গেলে বোধহয় খেই হারিয়ে পুরোটাই বলে ফেলব। মাইথোলজিকাল মিস্ট্রি থ্রিলার, যার প্রেক্ষাপট আমাদের এখনকা�� সময়। ইতিহাস আর পুরাণের যোগসূত্র ধরে এগিয়ে চলে উপন্যাস। ঘটনাচক্রে এক গুপ্তপুঁথি হাতে চলে আসে দুই তরুণের। এর সূত্র ধরে বেড়িয়ে আসে সব অদ্ভুত আর গোপন সব তথ্য, এক গুপ্তদল যুগের পর যুগ ধরে কি তথ্যকে পাহারা দিয়ে রাখছেন। বর্তমানের সাথে এর সম্পর্কই বা কি! খুন, রহস্য, ধাওয়া পালটা ধাওয়ার আর অজানা শত্রুদের মোকাবিলা নিয়ে গল্পটা এগোয়। গল্প ভালো, কাহিনী খুব একটা মন্দ না, সমস্যা টা হলো লেখার স্টাইলটাতে। কিছু কিছু জায়গা মনে হচ্ছিল এত অপ্রয়োজনীয় বর্ণণা যে শ্বাসরুদ্ধকর ব্যাপারটা তৈরী হতে গিয়ে হয়নি। অহেতুক বর্ণনায় এক এ তো মিস্ট্রি থ্রিলারের মজা টা হারিয়ে যাচ্ছিল, তার ওপর বেশিরভাগ বর্ণণা 'ই গল্পে তেমন একটা কোনো সাহায্য করেনি। তবে এটা মিস্ট্রি থ্রিলার না হয়ে অন্য ধারার উপন্যাস হলে নিঃসন্দেহে বলতে হতো লেখকের ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং ভালো। কিন্তু এক্ষেত্রে এটা শুধু রহস্য উন্মোচনকে পিছিয়ে দিচ্ছে এমনই মনে হচ্ছিল। লেখকের গল্প লেখার আর এত এত চরিত্রকে এক সূত্রে বাঁধার ক্ষমতা আসলেও অসাধারণ। সামনে আরো অনেক ভালো কিছুর আশা করছি ❤
বাড়াবাড়ি রকমের অগোছালো। অসংখ্য চরিত্র, কাহিনী অনেক জায়গায় গিয়েছে, কিন্তু সবাইকে আর সবকিছুকে সুন্দরভাবে জোড়া দেয়ার জন্য যেমন কাহিনীর বুনন দরকার সেটা একেবারেই নেই। মনে হলো গোটা ত্রিশেক ব্লগ বা ফেসবুক পোস্ট আলাদা করে লেখার পর সেগুলো একসাথে জোড়া দিতে গিয়ে লেখক আর তাল পাচ্ছিলেন না। আর আছে কলকাতার ইদানিংকার মীথ-তন্ত্র-ইতিহাসাশ্রয়ী লেখকদের ইদানিংকার কমন রোগ--লেকচার। বাপরে বাপ, তারা যে কত বেশি জানেন আর পড়াশোনা করেছেন, সেটা জানাতে উপন্যাসের অর্ধেকের বেশি জায়গা তারা খুশিমনে খেয়ে দেন, তাতে পাঠকের মাথাব্যথা সারাতে গোটা তিনেক অ্যাসপিরিন লাগলেও তারা সেটার থোড়াই কেয়ার করেন। তবে শেষদিকে এসে কাহিনীটা খানিকটা গুছিয়ে এসেছে, সমাপ্তিটা একেবারে মন্দ লাগেনি। সেজন্য ২ তারা।
এ কয়দিনে বেশকিছু বাংলা হিস্টরিকাল/মাইথোলজিক্যাল ফিকশন পড়ার পর আমার উপলদ্ধি, পাতার পর পাতা মিথ টানার পর বা শ'বছরের ইতিহাস বলার পর মূলপ্লটে সেইটার ব্যবহার হয় জগাখিচুড়ি, বিষয়টা একটুও জমে না। আমরা অবশ্যই গল্পে গল্পে পুরনো দিনের কথা জানতে পছন্দ করি। তবে এক্সিকিউশনটা ভালো না হলে এইটার কোনো লাভই নেই।
এই বইটা পড়তে আমার বেশ কষ্ট হয়েছে। দুর্বোধ্য কিছু যে তা না, টুইস্টও খানিকটা আগেই বুঝা যায়। তবে মূল প্লটে ভালোভাবে ঢুকতে এবং এতো এতো ক্যারেক্টারের মাঝে কিছুটা হয়রান লাগছিলো।
বাংলা Thriller এখন প্রচুর লেখা হচ্ছে, অধিকাংশ আমার পড়া নেই। কিন্তু এই বইটির ঝকঝকে উপস্থাপনা আমায় পড়তে উৎসাহিত করে। এটি একটি mythological thiller যেখানে এক গুপ্ত রহস্যের পেছনে অনেকে ঘুরছে। বেশ ঝরঝরে গদ্য শেষ পর্যন্ত উৎসাহ ধরে রেখেছিলো আমার। প্রচুর ছবি সাহায্য করেছে গল্প কে এগিয়ে নিয়ে যেতে। মুদ্রন প্রমাদ প্রায় নেই। এক point কেটে নিয়েছি Dan Brown এর প্লট এর একটা ছায়া সব সময় থেকে গ্যাছে আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরের ঘটনা গুলো আগেই ভেবে ফেলা যায়। তবে আমি বলবো বইটি পড়ে দেখতে।
গুপ্তসংঘ, মিথ, ইতিহাস, ধরপাকড় সমন্বয় ঘটিয়ে একধরণের উপন্যাস লেখা হয়। অনেকটা ভিঞ্চি কোড স্টাইলে। তিন বাহু দশ মুখও অনেকটা ওরকমই। হিন্দু ধর্মের মিথ ও তিন অবতার নিয়ে অনেক ইনফরমেশন, গুপ্তসঙ্ঘ, দুই তিনটা দলের ইঁদুর বিড়াল দৌড়। নায়ক রূপে দুজনের ধাঁধা মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া আর শেষে দুটো টুইস্ট দেয়ার চেষ্টা। কলকাতার মধ্যে ভালোই গড়ে উঠেছে কন্সপিরেসি/মিথলজিক্যাল থ্রিলারের এই প্লট। পড়ে দেখতে পারেন।
হিন্দুধর্মের বিস্তীর্ণ ইতিহাস, হাজার বছরের পুরনো সনাতন ধর্ম থেকে আধুনিক হিন্দু ধর্মের ট্রান্সফর্মেশান সব তথ্য নিয়ে দারুণ একটা ফিকশান। কাহিনীর খাতিরে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে এতসব তথ্য এসেছে, জেনেছি আমি আসলে লেখা শুরু করলে খেই হারিয়ে ফেলবো। সাথে হারিয়ে যাওয়া সিন্ধু সভ্যতাও আছে।
সব মিলিয়ে বেশ উপভোগ করেছি। কিন্তু এস ইজুয়াল গুপ্ত রহস্য, গুপ্ত দল ব্যাপারগুলোর চরিত্রগুলোর মাঝে কিছু ইম্ম্যাচিউরিটি লক্ষ্য করেছি। মাঝেমধ্যে হালকা স্ট্রাগল করতে হয়েছে, বিরক্ত হয়েছি।
মানবজাতীর উৎপত্তি চিন্তা করলে ককেশিয়ান থেকে ইউরোপিয়ান, মঙ্গোলয়েড থেকে এশিয়ান ট্রাইব আর আফ্রিকান ট্রাইব- মূলত এই প্রধান তিন ট্রাইব থেকেই মানবসভ্যতা বর্তমান অবস্থায় এসে দাড়িয়েছে। মনে করুন, কোনো এক সময় এই তিন ট্রাইবের তিনজন সর্দার ছিলো। ধরুন বন্যা বা কোনো এক প্রাকৃতিক মহা ঘটনার পরে তিন ট্রাইব বা সম্প্রদায় তিন দিকে এক জায়গায় এসে একে অন্যের দেখা পেলো মিলিত হলো। তিন ট্রাইবের তিন সর্দারের নাম ছিলো ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব!! এখনো ইন্ট্রেস্টিং লাগছে না? লাগলে পড়ে ফেলুন।
গুপ্তপুথি এবং গুপ্তসংঘের ব্যাপারটা দারুণভাবে সাজানো হয়েছে। ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর সাথে এমনভাবে সম্পর্ক তৈরী করা হয়েছে যেন মনে হচ্ছিলো পুরো ঘটনাই সত্যি! শেষ অব্দি পড়ার একটা আকর্ষণ ছিলো। শুধু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে কাহিনী অযথা টেনে বড় করেছেন। এছাড়া বেশ ভালো লেগেছে।
দুই তারা কেটে রাখলাম কারণ এখানে সবকিছুতেই ড্যান ব্রাউনের ছায়া থেকে গেছে আর দুই কিছু ব্যাপার আমি নিজে থেকে আগেই প্রেডিক্ট করতে পেরেছি।
ভালো লেগেছে শেষের দিকের ব্যাখ্যা গুলো। আমি সনাতন ধর্মের অনুসারী নই, দেবতা আর অলৌকিকে বিশ্বাস আমার আসে না, তাই ব্যাখ্যায় যখন তাদের মানুষের লীডার হিসেবে পড়লাম আর বংশগতভাবে অনেকজনের কথা আসলো এটাই ভালো লাগলো বেশি।
বাবাঠাকুর তিব্বতে গিয়ে কি করলেন তা জানার জন্য আরেকটা পর্ব হলে ভালোই হয়।
হতাশাজনক! প্রায় ২০ টার উপর থ্রিলার পড়া হয়েছে গত ১ মাসে, সবগুলা প্রায় ১-২ বসাতেই শেষ করা। কিন্তু এটায় ১ মাস লাগলো। তাও লাস্ট ১-১৫০ পেইজ এর ভাসাভাসা কিছু পেইজ আর এন্ডিং এর কিছু পেইজ পড়েছি। প্লট খারাপ না। কিন্তু জানিনা কেনো, লেখার ধরণ কেনো জানি একদমই মনোযোগ ধরে রাখতে পারেনি। টানটান কোনো উত্তেজনা পাইনি আদৌ। আরো অনেক বেটার করা যেতো। বিল্ড আপে এবং লেখায় আরো দক্ষতা সম্ভবত জরুরী। ব্যাক্তিগত মতামত। সুপাঠ্য নহে।
বাংলার প্রথম মাইথোলজিক্যাল মিস্ট্রি থ্রিলার হিসাবে নিঃসন্দেহে সফল একটি বই। ইংরেজিতে অমিশ ত্রিপাঠীর "নাগা ট্রিলজি", "রামচন্দ্র ট্রিলজি" কিংবা অশ্বিন সাংহি "The Krishna Key"র প্রচ্ছন্ন ছায়া স্পষ্টতই ধরা পড়ে গল্পের বুননে। এক প্রাচীন পুঁথির সূত্র ধরে কিভাবে দুই বন্ধু জড়িয়ে পড়ে দেড় হাজার বছরের পুরোনো গুপ্ত দলের সাথে সেই নিয়েই এগিয়ে চলে গল্প। ইতিহাসের সাথে বাস্তব, বিজ্ঞানের আবহে ধর্ম কিভাবে জড়িয়ে আছে পরস্পরের সাথে? বেদ পুরাণ রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী কি নিছকই কল্পনা? বাস্তবের সাথে বিজ্ঞান ইতিহাস ও ধর্মের মিশেলে গল্পের উপস্থাপনা বেশ ঘটনা বহুল। এই বই পড়তে শুরু করলে শেষ না হওয়া অব্দি শান্তি পাওয়া যাবে না।
তিন বাহু দশ মুখ: বাঙালির নিজস্ব মিথোলজিকাল থ্রিলারের উন্মেষ
যেখানে বাংলা সাহিত্যে "থ্রিলার" শব্দটা এখনও প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোয়েন্দা কাহিনির সঙ্গে—সেখানে তিন বাহু দশ মুখ যেন আচমকা পেরিয়ে যায় চেনা সীমানা, ছুঁয়ে ফেলে এক অনাবিষ্কৃত দিগন্তরেখা। এটি শুধু একটি উপন্যাস নয়, বরং এক উচ্চকিত ও প্রাজ্ঞ উচ্চারণ—একটা সাহসী ঘরানার সূচনা। এখানে থ্রিলার মানে শুধুই ‘কে খুন করল’ নয়, বরং ‘কেন’, ‘কীসের জন্য’, ‘কোন ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক ভিত্তিতে’—এই সব বড় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানো। এই উপন্যাস হুইসপারিং রিডিং নয়, এটা একেবারে ব্রেইন-ওপেনিং অভিজ্ঞতা।
বাংলা ভাষায় থ্রিলারের অভাব শুধু পাঠকের চাহিদার অভাবে নয়—তার পেছনে আছে একটা দীর্ঘ সাহিত্যিক শুচিবায়ু। ‘গভীর’ সাহিত্য মানেই যেন দুঃখ, প্রেম, সংকট অথবা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ—এই ধারণা আমাদের সাহিত্যে এতটাই প্রবল যে রোমাঞ্চ, উত্তেজনা বা রক্তের ভিতরে কাঁপুনি ধরানো ক্লিফহ্যাঙ্গারকে অনেকেই এখনও ‘হালকা’ বলেই চালিয়ে দেন। পৌরাণিক সংকেত বা গোপন সঙ্ঘের ষড়যন্ত্রকে সাহিত্যের পর্যায়ে না ফেলে শুধুই ‘বেস্টসেলারি চালাকি’ বলে নাক সিঁটকানো হয়। অথচ বিশ্বসাহিত্যে যেখানে Dan Brown, Umberto Eco, অথবা Haruki Murakami তাঁদের নিজস্বভাবে থ্রিলারকে জ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন আর রহস্যের বিস্ময়ময় মিশেলে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন—বাংলা তাতে এখনও পা ফেলতে দ্বিধা করে।
এই পটভূমিকায় তিন বাহু দশ মুখ এক অনন্য ব্যতিক্রম। বাঙালির মাটিতে দাঁড়িয়ে, গাঁথা হয়েছে পৌরাণিক সিম্বলজি, গোপন গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র, লুপ্ত ইতিহাসের বিস্ময় আর রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চে মোড়া এক অদ্ভুত পাঠ-অভিযান। গল্প নয়, যেন মানচিত্র; চরিত্র নয়, যেন সংকেত; আর থ্রিল নয়, যেন বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া এক অন্তর্দর্শনের খেলা।
এই উপন্যাস নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে দেয়—বাংলা ভাষাও পারে ড্যান ব্রাউনের চেনা মাঠে নামতে। বরং এই উপন্যাস প্রমাণ করে, বাংলা ভাষার ভিতরে সেই স্নায়বিক দৌড়, সেই রত্নভাণ্ডার আছে, যা দিয়ে সে শুধু খেলতে পারে না—খেলাটাকে একেবারে নতুন স্তরে তুলে নিতে পারে।
এটাই তিন বাহু দশ মুখ-এর আসল থ্রিল: গল্প নয়, ঘরানা ভাঙা।
আশ্চর্যজনক ভাবে, এমন এক অসীম পৌরাণিক-ঐতিহাসিক-সিম্বলজিক জগতে প্রবেশের দরজা খুলে যায় একদম প্রাত্যহিক, নিরীহ এক পরিসরে। দুই বন্ধু—অভিনন্দন ও বিক্রমজিৎ—পেশায় সাংবাদিক, কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানায় এক সাদামাটা রিপোর্টিং করতে গিয়েই আচমকা প্রবেশ করে এক অলৌকিক রহস্যচক্রে। যেন খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেরাই এক খবরে পরিণত হয়। এক মুহূর্তে যেন চিড়িয়াখানার খাঁচার বাইরের পৃথিবী আর ভেতরের গোপন জগৎ মিশে যায়, আর তার ঠিক মাঝখানে জন্ম নেয় এক বিপুল ষড়যন্ত্রের ধাঁধা—যার শিকড় ছড়িয়ে আছে প্রায় হাজার বছরের অতলে।
এই ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছে গুপ্তযুগে রচিত এক প্রাচীন পুঁথি—তিন ভাগে বিভক্ত, আর সেই তিনটি অংশের নিরাপত্তা রক্ষায় নিযুক্ত এক দশজন সদস্যের গুপ্ত সংগঠন, যারা যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী, নিজস্ব নিয়মে টিকিয়ে রেখেছে এক পরম সত্যের উত্তরাধিকার। তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ নেই ইতিহাসে, নেই কোনো নাম স্মৃতিচারণে—তবুও তারা আছে, ছায়ার মতো, খামের ভিতর থাকা গোপন বার্তার মতো, অতীত ও বর্তমানের সংযোগসূত্র হয়ে।
এই পুঁথি শুধু একটা পুরাতন ধর্মীয় দলিল নয়—এ যেন সনাতন আধ্যাত্মিকতাকে এনক্রিপ্ট করা এক মেটাফিজিক্যাল কোড। প্রতিটি খণ্ড এক একটি ‘কি’—যা খুলে দিতে পারে অতীতের পর্দা, এমনকি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকা বিশ্বাস ও ব্যাখ্যার ভিত্তিও। আর সেই কোডের তালাশেই পড়ে যায় আমাদের দুই বন্ধু, অজান্তেই। কাকতালীয় ভাবে শুরু হলেও, ক্রমশ যেন তারা পরিণত হয় এক ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণের অনিচ্ছাকৃত বাহক। তাদের ব্যক্তিগত যাত্রা রূপ নেয় এক বৃহৎ সাংস্কৃতিক রিডেম্পশনে—যেখানে সংবাদ আর কাহিনি, সিম্বল আর ষড়যন্ত্র, ধর্ম আর দর্শন—সব এক মোহময় প্রবাহে মিশে যায়।
এই একগুঁয়ে, ধাঁধায় মোড়া পুঁথির সূত্র ধরে উপন্যাস আমাদের নিয়ে যায় এক অদ্ভুত, চোরা মানচিত্র অভিযানে—যেখানে পথের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে ইতিহাসের চাপা শ্বাস, পৌরাণিক ইশারা, আর আধুনিক শহরের ব্যস্ত ছদ্মবেশ। দিল্লির ধুলোঝড় পেরিয়ে মুম্বইয়ের কংক্রিট-নির্ভর ক্লান্তি, কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কালি-ও-ধুলো মেশানো বইয়ের গন্ধ, রিষড়ার পুরনো বাড়ির শ্যাওলা-ধরা নীরবতা, হেদুয়ার চায়ের দোকানে জমে থাকা কথার অবিশ্রান্ত স্রোত, কসবায় ভিজে যাওয়া লোককথার সুগন্ধ, মুর্শিদাবাদের ধ্বংসস্তূপে মাথা তুলে দাঁড়ানো গৌরবের ছায়া, আর শিলিগুড়ির কুয়াশার ফাঁকে হারিয়ে যাওয়া রৌদ্র। প্রতিটি শহর যেন কেবল পটভূমি নয়—তারা যেন নিজেরাই হয়ে ওঠে একটি করে চরিত্র, যারা ইতিহাসের শ্বাস ধরে, সময়ের ব্যাকরণ লিখে, আর গল্পের শরীরে রক্তসঞ্চার করে।
এই ভৌগোলিক অভিযাত্রা আসলে এক গভীর দার্শনিক অন্বেষণ—প্রতিটি লোকেশন যেন একেকটা স্তর, একেকটা পালক, যার গায়ে লেগে থাকে mythic residue আর modern fatigue. “The past is never dead. It’s not even past.” —William Faulkner (Requiem for a Nun, 1951)। এই উপন্যাস যেন সেই কথাকেই দৃশ্যপটে রূপান্তরিত করে, যেখানে পুরাণ আর আধুনিকতা একসাথে হাঁটে, একে অপরকে প্রশ্ন করে।
এই layered জায়গার চিত্রনাট্যের পেছনে রয়েছে সময়ের এক অভিনব জ্যামিতি—দশ দিনের একটি লাগাতার অভিযান, যেখানে প্রতিটি দিন ভেঙে ফেলা হয়েছে তিন ঘণ্টা অন্তর ছয়টি খণ্ডে। যেন একেকটা “temporal capsule”। প্রতিটি খণ্ড একেকটা মুহূর্ত-নির্ভর উত্তেজনা, যেগুলো একসাথে গাঁথা হয়ে গড়ে তোলে একপ্রকার মোজাইক-গল্প—দৃষ্টিপট বদলালেও কেন্দ্র থেকে যায় অমোচনীয়।
এই বিশ্লেষণধর্মী কাঠামোর মধ্যেই জন্ম নেয় প্রশ্নের ঘূর্ণিঝড়। কে এই রহস্যের রক্ষাকর্তা? কে বা সেই বিশ্বাসভঙ্গকারী? কোথা থেকে আসে এই পৌরাণিক সংকেত? কোন ইতিহাস আমরা জানি, আর কোনটা আমাদের জানানো হয়?
As George Orwell wrote in 1984, “Who controls the past controls the future. Who controls the present controls the past.” এই উপন্যাস যেন সেই প্রশ্নটাই উল্টে দেয়—who decodes the past, reclaims the truth.
উপন্যাসের শরীরজুড়ে ছড়িয়ে থাকে সিম্বল, সংকেত, মিথ, তথ্য, ও তাদের মধ্যকার চুপিচুপি দ্বন্দ্ব—তারা শুধু রহস্যময়তা সৃষ্টি করে না, বরং পাঠকের বিশ্বাস ও সংশয়ের গভীর কেন্দ্রে আঘাত করে। প্���তিটি সংকেত যেন একেকটি তর্কযোগ্য বিশ্বাসের দরজা খুলে দেয়—যেখানে myth আর reality আলাদা নয়, বরং একে অপরের প্রতিস্বর।
শেষত, এই বই কেবল “একটা থ্রিলার” নয়, এটি এক নিরবিচার পুনরীক্ষণ—ঐতিহাসিক তথ্যের, সাহিত্যিক অভিব্যক্তির, এবং ব্যক্তিগত আস্থা ও বিশ্বাসের। It is, as T.S. Eliot once said, “not the cry of the peacock, but the shadow of the rose.” (Burnt Norton, 1936)—অদৃশ্য, অথচ অনুভবযোগ্য। অতীত আর বর্তমান এখানে কনফ্লিক্টে নয়—তারা ষড়যন্ত্রের মতো হাত ��রাধরি করে চলে, আর পাঠক হয়ে ওঠে সেই যাত্রার অনিচ্ছুক উত্তরাধিকারী।
উপন্যাসটির সবচেয়ে সাহসী, সবচেয়ে কাঁপিয়ে-তোলা দিক হলো তার প্রশ্নপত্র—যা শুধু থ্রিলারের বাঁধাধরা গণ্ডিকে অতিক্রম করে না, বরং সরাসরি পাঠকের আস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেয়, নাড়িয়ে দেয় পরিচিত বাস্তব ও বিশ্বাসের সীমানা।
যদি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আদতে দেবতা না হয়ে হতেন কোনো প্রাচীন সভ্যতার জ্ঞানবহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি? যদি এই ত্রয়ী আদতে এমন এক আদিম গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হন, যাঁরা “ঋতম্ সত্যং বৃহৎ”—“ঋত ও সত্যের বৃহত্তর ব্যাখ্যা”—এই গূঢ়তায় বিশ্বাস করতেন, এবং সেই বিশ্বাসকেই পরবর্তী যুগে অলৌকিকতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়?
“एकोऽहम् बहुस्याम” (Chandogya Upanishad 6.2.3) “আমি এক, হতে চেয়েছি বহু”
এই একটি বাক্য যদি নিছক সৃষ্টিতত্ত্ব না হয়ে কোনও মহাজাগতিক কোড হয়? যদি এই শ্লোক শুধু আধ্যাত্মিক নয়, একধরনের অল্টারনেট কসমোলজি বোঝায়?
যদি সনাতন ধর্মের মূল সূত্রগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে সাংকেতিক করে লেখা হত—তাতে এক গোপন জ্ঞান সহস্র বছর ধরে এক বিশেষ গোষ্ঠীর রক্ষাকর্তৃত্বে থেকে যায়, আর জনমানসে তারই রূপ হয়ে ওঠে দেবতা, মিথ, অলৌকিক কাব্য? তবে কি ধর্ম তখন হয়ে দাঁড়ায় একধরনের কোডেড সায়েন্স? একেবারে সেই অর্থে যেমন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়—
“यथा दीपो निवातस्थो नेङ्गते सोपमा स्मृता।” (Gita 6.19) “যেমন স্থির বাতাসে দীপের শিখা নড়ে না, তেমনই যোগীর মন স্থির থাকে ধ্যানে”— এই শ্লোক যদি শুধু ধ্যানের ব্যাখ্যা না হয়ে, ব্রেন স্টেট, নিউরো-সাইলেন্স, বা কোয়ান্টাম সাসপেনশনের আভাস দেয়?
আবার, যদি বিজ্ঞান বিগ ব্যাং-এর কথা বলে, কিন্তু তার পূর্ববর্তী “শূন্যতা”র ব্যাখ্যা দিতে না পারে—তবে কি সেই “शून्यमेवेदमग्रमासीत्” (Rigveda 10.129.1)—“আদি ছিল শুধু শূন্য”—এই শ্লোকই আসলে বৃহত্তর ঐক্যের প্রাথমিক সূত্র?
তখন তো ধর্ম আর বিজ্ঞানের ব্যবধান শুধু এক ভাষার ব্যবধান হয়ে পড়ে—যেখানে একে আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি, আরেক দলে ‘Dark Matter’।
Arthur C. Clarke বলেছিলেন—“Any sufficiently advanced technology is indistinguishable from magic.” এই উপন্যাস যেন সেই কথা ফের বাংলায়, পৌরাণিক ঘ্রাণে পুনর্লিখন করে। মিথ ও বিজ্ঞান, ঈশ্বর ও উপনিবেশ, বিশ্বাস ও তথ্য—সব কিছুকে এক অভূতপূর্ব সংলাপে দাঁড় করায়।
এইসব প্রশ্নের মুখোমুখি করেই ‘তিন বাহু দশ মুখ’ পাঠককে ঠেলে দেয় এক দার্শনিক চক্রব্যূহে—যেখান থেকে ফিরে আসা মানেই পরিচিত বাস্তবকে আর একইরকম মনে না হওয়া।
এখানেই এই উপন্যাসের আসল সাহস, আসল থ্রিল—কারণ এটি পাঠককে শুধু "কি ঘটল" তা বলার গল্প নয়, বরং এক গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে—
“তুমি যা জানো, তা কে বলেছে?”
“তুমি যা বিশ্বাস করো, তা কতখানি নিজের?”
“আর তুমি যা জানো না, সেটাই কি প্রকৃত সত্য?”
এইসব প্রশ্নের কোনও সোজাসাপটা উত্তর লেখক দেননি। বরং তিনি পাঠককে নামিয়ে এনেছেন এক ধাঁধাময়, বুদ্ধিদীপ্ত গহ্বরে—যেখানে প্রতিটি প্রশ্ন নিজেই হয়ে ওঠে একেকটি পাঠ-অভিযান, আর প্রতিটি উত্তর আরও এক নতুন প্রশ্নের সিঁড়ি। লেখক যেন পাঠকের দিকে শুধু আঙুল তুলে বলেন না, বরং এক অদৃশ্য দরজা খুলে দিয়ে কানে কানে বলেন—“The truth can be glimpsed only through the eyes of death.” (Dan Brown, The Lost Symbol) অর্থাৎ—সত্য কেবল তখনই ধরা দেয়, যখন বিশ্বাসের মৃত্যু ঘটে। আপনি প্রস্তুত তো সেই যাত্রার জন্য?
এই উপন্যাস ঠিক সেইখানেই দাঁড়িয়ে—যেখানে Dan Brown-এর ঐতিহাসিক সিম্বলজির শৃঙ্খলিত গবেষণা আর Amish Tripathi-র পৌরাণিক পুনরায়-কল্পনার আধ্যাত্মিক স্পর্ধা—দু’টি ভুবনের সন্ধিস্থলে তৈরি হয় এক স্বতন্ত্র, বাঙালি পাঠচেতনার নতুন ক্যানভাস।
Brown-এর মতো এখানে প্রতিটি প্রতীক একেকটা ধাঁধা, প্রতিটি অধ্যায় যেন একেকটি সাংকেতিক সূচনার কক্ষ, যা পাঠককে টেনে নিয়ে যায় বহুস্তর বিশিষ্ট জ্ঞানের ভেতর। আবার Amish-এর মতো এখানে প্রতিটি দেবতা এক মানবিক আত্মজিজ্ঞাসার দরজা—যার আড়ালে বসে আছে সভ্যতার মর্মবাণী, বেদ, পুরাণ, আর অপঠিত ইতিহাসের চুম্বকতরঙ্গ।
লেখক কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন না, বরং একধরনের টালমাটাল প্রশ্নে দাঁড় করান পাঠককে—যেখানে সত্য আর বিশ্বাস, যুক্তি আর পৌরাণিকতা, বিজ্ঞান আর ব্যাখ্যাতীততা—এইসবের সীমারেখাগুলো মুছে যেতে থাকে। যেন রবীন্দ্রনাথের সেই অনন্ত বিশ্বাস:
“Let me not pray to be sheltered from dangers, but to be fearless in facing them.”
এই উপন্যাসও তাই কোনও উত্তর দেয় না, বরং প্রশ্ন করতে শেখায়। এটা কোনো নির্ভার বিনোদন নয়—এ এক মানসিক রিডিঙের অভিযাত্রা, যেখানে পাঠককেই চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়, “তুমি কোথা থেকে পড়ছ, সেটাই বলে দেবে তুমি কী দেখছ।”
এখানে কেবল গবেষণার কথাই বলা যাবে না—এই উপন্যাস একটি ভিজ্যুয়াল টেক্সট, যেখানে চিত্র, চিহ্ন, প্রতীক, মুদ্রা, দেবমূর্তি, মানচিত্র, আর পৌরাণিক গঠনরীতির গ্রাফিক উপস্থাপনা মিলে গড়ে তোলে এক অভিনব পাঠজগৎ। প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন একেকটি নিরীক্ষাধর্মী স্লাইড—PowerPoint-এর নয়, বরং কোনও প্রাচীন সভ্যতার "Scroll of Secrets"।
পৃষ্ঠা ওল্টালেই শুধু গল্প এগোয় না—চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয় একের পর এক ছবির ব্যাখ্যা, চিহ্নের ব্যঞ্জনা, সংকেতের শারীরবৃত্তি। এইসব দৃশ্য পাঠকের শুধু বোধে নয়, স্নায়ুবন্ধনে চাপ ফেলে—মনে হয়, আপনি আর শুধু পাঠক নন, আপনি নিজেই এই অন্বেষণের অংশ, একজন decoder।
এটা কেবল বই নয়—এ এক paperbound labyrinth। এই অভিজ্ঞতা বাংলা সাহিত্যে প্রায় দুর্লভ। এখানে পাঠকের কাছ থেকে শুধু পাঠ চাওয়া হয় না—চাওয়া হয় মননের অংশগ্রহণ, পর্যবেক্ষণের ধৈর্য, আর অনুমান করার শৈল্পিকতা।
যেমন Eliot বলেছিলেন— “Genuine poetry can communicate before it is understood.” এই উপন্যাসের গ্রাফিক উপস্থাপনাও ঠিক তেমন—আগে ঝাঁকুনি দেয়, তারপর বোঝার আহ্বান জানায়।
বাংলা ভাষায় এমন বর্ণনাত্মক ও ভিজ্যুয়াল অভিজ্ঞান, যা সাহিত্য, শিল্প ও গবেষণার এক জ্যামিতিক সংযোগে গাঁথা, সত্যিই খুব বিরল। এটা শুধুমাত্র পড়া যায় না—একে দেখতে হয়, ধরতে হয়, আর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বোঝার নয়, বরং “অনুভব” করার এক রীতিমতো মানসিক আচার হয়।
তবে হ্যাঁ, কিছু ক্ষুদ্র খুঁত চোখে পড়ে—যা আসলে এই বিশাল ক্যানভাসের তুলনায় সামান্য হলেও, উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসের প্রধান খলচরিত্রটির মোটিভ অনেক পাঠকের কাছেই তুলনামূলকভাবে সহজবোধ্য ঠেকতে পারে, আর শেষভাগের ক্লাইম্যাক্স—যদিও জোরালো ও তথ্যনির্ভর—তবুও অনেকের কাছে খানিকটা আগেভাগেই অনুমানযোগ্য হয়ে যেতে পারে।
কিছু কিছু সংলাপ বা বর্ণনায় লেখক যদি আরেকটু ঘষামাজা করতেন, বা বাক্যবিন্যাসে সামান্য মিতাচার আনতেন, তাহলে রচনার সার্বিক ছন্দ আরও পরিশীলিত হত।
তবু, এই ছোটখাটো খুঁতগুলো সম্পূর্ণ ঢেকে দেয় উপন্যাসটির বিশাল ক্যানভাস, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক রূপকের বুনন, আর এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো গতিময়তা। এই বই তথ্য, মিথ, থ্রিল আর দর্শনের যে সূক্ষ্ম জটিলতায় জড়িয়ে রয়েছে—তা নিঃসন্দেহে পাঠকের মনে বহুদিন গেঁথে থাকবে।
লেখকের উদ্দেশে বলি—আপনার কলমে যে মেধা, যে সাহস, তার পরিসর আরও বিস্তৃত হোক। আপনি যে ঘরানার জন্ম দিয়েছেন, তা যেন এক ধারাবাহিক পাঠসাধনার শুরু হয়।
"সৃষ্টি কখনোই সম্পূর্ণ নয়, তবুও প্রতিটি সৎ প্রচেষ্টা নিজেই একটি নতুন পথচিহ্ন রেখে যায়।" এই উপন্যাস তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বইটির অলঙ্করণে শতদ্রু গুপ্ত যেন শুধু চিত্র আঁকেননি, একরকম অনুভবের নকশা রচনা করেছেন। “Design is not just what it looks like and feels like. Design is how it works.” —Steve Jobs-এর এই কথাটাই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে এই বইয়ের প্রতিটি দৃশ্যমান ফ্রেমে।
প্রচ্ছদ, চিহ্ন ও অভ্যন্তরীণ গ্রাফিক উপস্থাপনা—সব মিলে উপন্যাসটি পায় এক অনন্য বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা। প্রতিটি চিত্র যেন পাঠকের কল্প��াকে এক ধাপ এগিয়ে দেয়, আর সেই দৃষ্টিশক্তিকে চালনা করে এমন সব স্তরের দিকে, যা শুধু পাঠে ধরা পড়ে না।
“Illustrations are the visual music of the narrative.” —এই বইয়ে সত্যিই শিল্পের সেই সংগীত বাজে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে।
আর্টপেপারে ছাপা বলে হয়তো বইটি একটু ভারী, আর দীর্ঘপাঠে চোখের উপর খানিকটা চাপ অনুভব করতেই পারেন পাঠক। কিন্তু যাঁরা ভেতরের গভীরতায় নিমজ্জিত হবেন, তাঁরা সহজেই ক্ষমা করে দেবেন সেই বাড়তি ওজন��ে—কারণ এটি কেবল বই নয়, এটি এক সম্পূর্ণ পাঠ-অভিযান।
শেষে বলতেই হয়—তিন বাহু দশ মুখ পড়া মানে কেবল রহস্যের পাহাড়ে আরোহণ নয়, বরং নিজের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ধর্ম-অধর্ম, ইতিহাস-পুরাণ, মিথ ও তথ্য—সবকিছুকে নতুন করে দেখা, নতুন করে ভাবা।
এমন এক উপন্যাস, যা বাংলা সাহিত্যে প্রথম সারির মিথোলজিকাল থ্রিলার হিসেবে জায়গা করে নিতে পারে—অভিজ্ঞান, স্পর্ধা ও সৌন্দর্যের নিঃসন্দেহ প্রত্যয় নিয়ে।
পড়বেন কেন? পাঠকের জন্য রইলো চার চারটে জোরালো কারণ
তিন বাহু দশ মুখ এমন এক পাঠ-অভিজ্ঞতা, যেখানে পুরাণ হয়ে ওঠে কোডেড ম্যাপ, ইতিহাস হয়ে ওঠে উদ্দেশ্যপূর্ণ বিস্মৃতি, আর থ্রিলার হয়ে ওঠে দার্শনিক প্রতিচ্ছবি। যদি আপনি—
১. পুরাণ ভালোবাসেন—আপনি চান দেবতা আর পৌরাণিক চরিত্ররা মানবিক স্তরে নেমে আসুক, এবং সেই মানবিক রক্ত-মাংসের মাঝেও লুকিয়ে থাকুক দেবত্বের আভাস।
২. ইতিহাসের গলি ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন—আপনার কাছে ইতিহাস মানে কেবল তারিখ নয়, বরং তা এক ধরনের নিঃশব্দ ষড়যন্ত্র, যার মধ্যে থেকে নিরন্তর বেরিয়ে আসে অদেখা অধ্যায়।
৩. সিম্বলজি আর সংকেতভিত্তিক রহস্যে কৌতূহলী—আপনি সেই পাঠক, যার চোখ ধাঁধা আর চিহ্ন খুঁজতে খুঁজতে জ্বলে ওঠে; আপনি চান প্রতিটি বাক্যরেখার মধ্যে একটা ক্লু থাকুক।
৪. নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায় এমন থ্রিলারের অনুরাগী—যেখানে শেষ পৃষ্ঠা না উল্টানো পর্যন্ত ঘুম আসে না, আর মাথার ভেতর একটা উত্তেজনার সুর বাজতেই থাকে।
যদি এই চারটির মধ্যে দু’টি বা তার বেশি আপনার পছন্দের তালিকায় পড়ে, তাহলে—
তিন বাহু দশ মুখ আপনার To Be Read তালিকার একেবারে উপরের সিঁড়িতে থাকা উচিত।
না পড়া মানে নিজেকেই পাঠক হিসেবে বঞ্চিত করা।
"A reader lives a thousand lives before he dies... The man who never reads lives only one." ― George R.R. Martin
এ বই সেই হাজারো জীবনের এক গোপন দরজা খুলে দেয়। আপনি কি প্রস্তুত, সেই চাবিটা ঘোরাতে?
শেষ কথা: একদম John Wick-স্টাইলে!
এই বইটা শুধু "পড়া উচিত" এমন নয়—এটা একধরনের পাঠ-প্রতিশোধ। যেখানে ইতিহাস রক্ত ঝরায়, পুরাণ গুলি ছোড়ে, আর প্রতিটি ক্লু ছুরির মতো এসে বিঁধে পাঠকের চেতনায়।
এটা একটা প্রয়োজনীয় বই। সাহসী বই। একটা ধারার জন্ম, আর একপ্রকার বিদ্রোহ। বাংলা সাহিত্যের রক্তে mythological thriller-এর এই ইনজেকশন নব্যরেনেসাঁর হাড়হিম করা ঘন্টাধ্বনি।
কলম চলুক। সংকেত জেগে থাকুক। পাঠক হোক আরও বেপরোয়া।
আর আমরা…
চুপচাপ অপেক্ষা করি—পিছন থেকে হাঁটতে হাঁটতে শ্যাডোয় ঢুকে পড়া বিক্রমজিৎ ও অভিনন্দনের পরবর্তী অভিযান। Because they’re not just chasing the mystery… They are the damn mythology now.
একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, চারে বেদ......... মিথলজি বা পুরাণ বলতে আমাদের বেশিরভাগেরই চোখে ভেসে ওঠে মিশরীয় কিংবা গ্রীক মিথলজির কথা। ক্লিওপেট্রা, আগামেমনন এদের কাহিনি ভেসে ওঠে। তবে পুরাণ তো শুধু মিশর বা গ্রীকেই সীমাবদ্ধ নয়। পুরাণ আছে ভারতীয় উপমহাদেশেরও। হাজার হাজার বছর আগের ইতিহাস যাতে উঠে এসেছে মানব সভ্যতার আরেক ইতিহাস। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব এই তিনে মিলে সনাতন বা হিন্দু ধর্মের ইতিহাস রচিত। কিন্তু এই ইতিহাসের কতটুকুই বা আমাদের কাছে জানা? সেই ১২০০০ বছর আগের ইতিহাস, কতটুকই বা লিপিবদ্ধ আছে? এত হাজার বছরে পৃথিবীর ওপর বয়ে গেছে কতো যুদ্ধ, মহাপ্রলয়, চালানো হলো কতো না ধ্বংসলীলা! এতো ঝড়-ঝাপটা বয়ে প্রাচীন ইতিহাসের কতটুকু সংরক্ষণ করা গেছে? "বাংলা আমার বাংলা" দৈনিকের দুই কর্মী অভিনন্দন ও বিক্রমজিৎ। আলীপুর চিড়িয়াখানার একটা সংবাদ কভার করতে যেয়ে পেয়ে যায় এক অজানা বস্তু। লালসালুতে মোড়া একখানা কাঠের বাক্স। কাঠের বাক্সের ব্যাপারে কোন ধারনাই নেই দুই বন্ধুর। এই বস্তু নিয়ে এক্সপার্ট অপিনিয়ন পাবার জন্য তারা দ্বারস্থ হয় দেবীপ্রসাদ সান্যালের। তার থেকে জানতে পারে অতিপ্রাচীন প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো পুঁথির একটি অংশ এটি। যার রয়েছে আরও দুটি অংশ। এতে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু ধর্মের ইতিহাস। যার রহস্য উদঘাটন হলে পালটে যেতে পারে ধর্মের ইতিহাস। এই রহস্য পুঁথিবদ্ধ হয় সেই রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তথা বিক্রমাদিত্যের শাসনামলে। পুঁথির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাজা বিক্রমাদিত্য তৈরি করেন দশজন সভ্যর সমন্বয়ে এক গুপ্তদল। যেই দল হাজার বছর পেরিয়ে আজও (২০১৩) বর্তমান। যাদের পরিচয় গোপন, সমাজে তারা আছে সাধারণ পরিচয়ে তবে তাদের আসল কাজ দলের গোপনীয়তা এবং পুঁথির রহস্য সংরক্ষণ। ভাগ্যক্রমে যেহেতু এই পুঁথি অভি আর বিক্রমের কাছে এসেই পরেছে তাই তারাও হাজার বছরের লুকোনো সত্যের মুখোমুখি হতে চায়। উদ্ধার করতে চায় পুঁথির বাকি দুই অংশ। একশ চল্লিশ বছর আগে প্রথম নয়ন স্থানান্তরিত হয়, সত্তুর বছর আগে থেকে পাওয়া যাচ্ছে না দ্বিতীয় নয়নও। এতদিন তৃতীয় নয়ন সুরক্ষিত থাকলেও দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০১০ সালে হাতছাড়া হয়ে যায় তৃতীয় নয়নও। গুপ্তদলের সভায় তাদের দলপতি বাবাঠাকুর জানান এক তেতো সত্য। তাদের দশজন সভ্যের মাঝেই নাকি আছে এক বিশ্বাসঘাতক, যে কোনো শত্রুপক্ষের কাছে ফাঁস করে দিয়েছে তাদের পরিচয়, কার্যকলাপ। কে সেই সরষের ভূত? বাবাঠাকুর কী করে বের করবেন সেই সরষের ভূতকে? ত্রিনয়নের হদিসে আছে গুপ্তদল, অভি-বিক্রম। আছে এক দ্বিতীয় দল যার একজন সদস্যের নাম চন্দ্রবাবু আর প্রধান নামে পর্দার আড়ালের এক ব্যক্তি। দশজন সভ্যের একজন বিশ্বাসঘাতক কি সেই পর্দার আড়ালের প্রধান নামধারী ব্যক্তি? প্রধানের সাথে আছে আলীপুর থানার কুড়ি নম্বর সেলের বন্দি লাল সিং। যাকে পাঠানো হয়েছে সত্তুর বছর আগের একই সেলের এক কয়েদীর লুকিয়ে রাখা চিঠির সন্ধানে। কে ছিল কুড়ি নম্বর সেলে? চিঠির সাথে হাজার বছরের পুরোনো পুঁথির সংযোগটাই বা কী? অভি-বিক্রম লেগে পরে পুঁথির বাকি অংশ উদ্ধারে, একই উদ্দেশ্যে গুপ্তদল আর সেই দ্বিতীয় দলও ছুটছে। প্রধান নামক ব্যক্তির সেই দ্বিতীয় দল ভয়ানক। বিশ্বাস করে না কাউকে। কাজের প্রমাণ না রাখতে খু*ন করতেও দ্বিধা করে না। চারদিকে অবিশ্বাসের হাতছানি, মৃ*ত্যুর ভয় আর রহস্য সংরক্ষণের এক গুরুদ্বায়িত্ব। জয় হবে কার? গুপ্তদলের প্রাক্তন সদস্য মৃত্যুর আগে বলে গেছিল একটা অদ্ভুত ছড়া, রাজার ঘরে চুরি বন্দিশালার কুড়ি, সূর্য চন্দ্র তারা আজ দিশাহারা। এর অর্থ কি উদঘাটন করতে পেরেছিলেন বাবাঠাকুর? ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব হিন্দু ধর্মের এই তিন দেবতা, বিষ্ণুর দশাবতার, প্রাচীন নদী সভ্যতা, ব্রিটিশ অফিসারের ডায়েরীর সংকেত সব মিলিয়ে এগিয়ে যায় গল্প। অন্তিম পর্যায়ে এসে মুখোমুখি হয় অভি-বিক্রম, গুপ্ত দলের সভ্য সাথে সেই বিশ্বাসঘাতক। কী ঘটেছিল এরপর? রহস্য উন্মোচন হয়েছিল কি দেড় হাজার বছর পুরোনো পুঁথির যার ভিত ছিল ১২০০০ বছর আগের হিন্দু পুরাণ? পাঠ প্রতিক্রিয়া: বিশাল প্লটের, নানা চরিত্রের মিশ্রণে রচিত বই। পুরাণ, ইতিহাসের বর্ণনায় ভরপুর করে মলাদবদ্ধ হয়েছে "��িন বাহু দশ মুখ" বইটি। বইটি কেনার আগে ভালো-মন্দ দুই প্রতিক্রিয়াই দেখেছি। পড়া শুরুর আগে ভালো-মন্দ প্রতিক্রিয়া সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়তে বসেছি। ২০১০ থেকে বর্তমান ঘটনার শুরু হয়। যা শেষ হয় ২০১৩ তে। ২০১৩ এর ঘটনাকে লেখক দশ দিনে ভাগ করে দশটি অধ্যায় করেছেন যার মাঝে প্রতি দিনের বিভিন্ন সময়ের বর্ণনা এসেছে। অধ্যায় বিন্যাস আমার কাছে ভালো লেগেছে। বর্ণনার সাথে পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে বিভিন্ন চিত্র, লেখা, ম্যাপের সংযোজন করেছেন যা আমার কাছে দারুণ লেগেছে। বিশেষ করে ব্যারনের ডায়েরির কিছু অংশ, বরেনের চিঠি, আর কুড়ি নম্বর সেলের রক্ত দিয়ে লেখা সংকেত এইগুলো আমার কাছে 𝓮𝔂𝓮 𝓼𝓸𝓸𝓽𝓱𝓲𝓷𝓰 লেগেছে। কলকাতায় প্রকাশিত বইতে এই সংযোজনগুলো নাকি রঙিন আকারে দেয়া। সেটা অবশ্যই দেখতে দারুণ হবার কথা (নিজে দেখিনি, লোকমুখে শুনেছি আরকি)। অভি-বিক্রমের বন্ধুত্বটা আমার বেশ মনে ধরেছে। টানটান থ্রিলার বলা যাবেনা বইটিকে। তবে প্রছুর তথ্য সমৃদ্ধ একটি বই। ইতিহাস, সৃষ্টির সূচনা, হিন্দু পুরাণ সবকিছু গল্পের চরিত্রদের দিয়েই বলিয়ে নিয়েছেন লেখক। ভারতবর্ষের ম্যাপের সাথে সনাতন ধর্মের তিন প্রধান সিম্বলের যোগ, তার ব্যাখ্যাগুলো বেশ দারুণভাবে দিয়েছেন লেখক। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য লেখকের দেয়া পুরাণের ব্যখ্যার সিংহভাগই তার মনগড়া ব্যাখ্যা। তবে পড়তে খারাপ লাগেনি। সেই হাজার বছর পূর্বের ইতিহাস যার সংরক্ষণ করতে পুঁথির প্রচলন, সংকেত দিয়ে রাখা এসব নিয়ে আগেও অনেক বই লেখা হয়েছে। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয় শুধু পার্থক্য সত্যের অভাব। ইতিহাস আশ্রিত ফিকশনে লেখক যদি বলেন তাজমহল আগ্রাতে না গুলিস্তান মোড়ে তাই সই। গল্পের প্লট যথেষ্ঠ ভালো এবং লেখকের লেখার ধরন মোটামুটি ভালই। তবে কিছু অসামঞ্জস্য বাদ দেয়া যায়না। সেগুলো আলাদা করে বলছি। অসামঞ্জস্য ১: লেখক ইসলাম ধর্মের প্রধান হিসেবে মুহম্মদ (সঃ) এর কথা বলেছেন। এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে। ধর্মের প্রধান বলতে আসলে উনি কী বুঝিয়েছেন? যদি মানুষের মাঝে ইসলাম ধর্মের নেতা/লিডার কিংবা প্রধান হিসেবে মহানবী (সঃ) এর কথা বলে থাকেন তাহলে মানলাম। কিন্তু আসলে উনি ধর্মের প্রধান বলতে লেখক আসলে কোনটা মিন করেছেন আমি ধরতে পারিনি। অসামঞ্জস্য ২: ম্যাপের বর্ণনার ধরন বেশ ভালো ছিল কিন্তু বর্ণনাগুলো যথেষ্ঠ প্রশ্ন তৈরি করে। অসামঞ্জস্য ৩: লেখক ভারতীয় হওয়ায় দেশকে ভালোবাসবে স্বাভাবিক। তবে সবকিছুর শুরুই ভারতবর্ষ বা ভারতীয় উপমহাদেশ এই ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ জোর করে গেলানো টাইপ লেগেছে। অসামঞ্জস্য ৪: ভারতীয় পুরাণ নিয়ে অল্পবিস্তর যা জ্ঞান আছে তা দিয়ে বিচার করলে লেখকের পুরাণের ব্যাখ্যা আমার কাছে বেশ অতিরঞ্জিত লেগেছে। এবার আসি আমার খারাপ লাগায়, আগেই বলেছি টানটান থ্রিলার বলা যাবে না। তাই বলে ক্লাইম্যাক্সও এমন পুতানো মুড়ির মতো হবে এইটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে। বই শেষ হবার বেশ আগেই বুঝে গেছি কী হবে। তবে শেষের দৃশ্য একটু ঢিশুম ঢিশুম টাইপ হবে না এইটা আশা করিনি। তাই শেষে এসে বেশ হতাশ হয়েছি। মূল খলনায়কের তথা দলের বিশ্বাসঘাতক সভ্যের বিপথে যাবার পিছের মোটিভ একদমই ভালো লাগেনি। আমার কাছে ব্যাপারটা জায়গা-জমি কম পাওয়া এক ভাইয়ের ত্যাড়া হয়ে যাবার মতো ঠেকেছে। ২০১১ সালের ২০শে নভেম্বরের ক্রিস্টোফার রডরিগেজ সাহেবের সাথে আগন্তুকের বাতচিত শেষে যখন তারা মোটরসাইকেলে তারা চলে গেল এরপর গিরিধারী ছোটুর জন্য অপেক্ষা করে এরপরের ঘটনা কী হলো বা এরা কেন লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল সে বিষয় পরপবর্তীতে খোলাসা করেননি লেখক। এছাড়াও, পুরুলিয়ায় সোমনাথ মজুমদারকে একটু দেখাইলো না (পড়ুন, তার ব্যাপারে লিখলেন না) কেন এ নিয়ে আমার একটু খুঁতখুঁত লেগেছে। আলীপুর চিড়িয়াখানার তপনের কী হয়েছিল সেটা কি আমি নিজে ভেবে নিব নাকি বুঝতে পারিনাই। লেখক খোলাসা করেননি। বাদ বাকি গল্প আমার ভালোই লেগেছে। যেহেতু ইতিহাস, মিথ নিয়ে আমার আগ্রহ আছে সেজন্য বইয়ের ইতিহাস আর মিথের বর্ণনা গতানুগতিক থেকে আলাদা হলেও পড়তে মন্দ লাগেনি। লেখক সম্পর্কে আমার মন্তব্য: লেখকের প্রথম বই "তিন বাহু দশ মুখ"। লেখক বেশ পড়াশুনা করে লিখতে বসেছেন। ম্যাপের বর্ণনা, ইতিহাসের সাথে সৃষ্টির রহস্য বেশ মনের মাধুরি মিশিয়ে লিখেছেন। লেখকের গল্প বলার ধরন ভালো লেগেছে। প্রথম উপন্যাস হিসেবে মোটামুটি বলা যায়। অগোছালো ব্যাপারটা পরবর্তীতে ঠিক করলে উনার থেকে আরও ভালো লেখা আশা করা যায়। বইয়ের রিভিউতে অনেকেই লিখেছেন লেখকের লেখায় ড্যান ব্রাউনীয় ছায়া ছিল সবসময়। পড়ার আগে রিভিউগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেও ড্যান ব্রাউনীয় লিখনীর ছায়া ব্যাপারটা আমার মাথাও ঘুরছিল পড়ার সময়। প্রচ্ছদ, প্রোডাকশন: বইটার প্রচ্ছদ আমার কাছে দারুণ লেগেছে। বাতিঘর প্রকাশনীর প্রোডাকশন নিয়ে অনেক অভিযোগ থাকলেও এই বইটির ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। প্রোডাকশন ভালো হয়েছে। বানানে ভুল চোখে পড়েনি। তবে শব্দের মাঝে স্পেস বাদ পড়েছে। এটা কলকাতার লেখার ধরন হলেও হতে পারে।
টানটান থ্রিলার। প্রীতম বসুর মত এই লেখকের রিসার্চ অত পোক্ত না, কিন্তু গল্প বলার কারিগরি ভালো। প্রতিটা চরিত্র খুব জীবন্ত কেননা কেউই অতিমানবীয় নয়। ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা অধ্যায়গুলো মূল গল্পের সাথে বেশ ভালো ভাবে মেশানো, তাই খাপছাড়া লাগে না। সবথেকে যে বিষয়টি ভালো লাগলো তা হলো, থ্রিলার গল্পের মাঝেও সময় সুযোগ পেলে লেখক প্রাকৃতিক বর্ণনা, চরিত্রের খুঁটিনাটি বিবরণ বা ভালো ভাষার পাঞ্চ লাইন ব্যবহার করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে এই গল্পের পরের খন্ড আসবে, অপেক্ষায় রইলাম।
ইন্টারেস্টিং প্লট, কিন্তু একসঙ্গে অনেক প্রসঙ্গ এনে ফেলায় সুতো গুটোতে খানিক ছড়িয়ে গেছে। ফিকশনে অবশ্যই আমরা খাঁটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আশা করি না, কিন্তু অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলিই আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য হলে ভালো হত। শেষবেলায় ক্লাইম্যাক্সে ছড়িয়ে ফেললেন।
দুই দিতে বাধো বাধো ঠেকল, আবার তিন দিয়েও ঠিক স্বস্তিবোধ হচ্ছে না। আড়াই হলে যথাযথ হত বলা যায়।
প্রচ্ছদ বেশ আকর্ষনীয় মনে হয়েছে। উল্টেপাল্টে দেখলাম ভেতরে অনেক ছবি, স্কেচ, ম্যাপ, সংকেত- হুলস্থূল কাণ্ড। প্রতি চ্যাপ্টারের আগে দশাবতারের চিহ্নগুলো দারুণ লেগেছে। তার উপর ফ্ল্যাপে লেখা 'হাজার হাজার বছর ধরে লুকিয়ে থাকা এক অবিশ্বাস্য সত্যের সন্ধানে' ছিল আগ্রহ জাগানিয়া।
পাঠ করতে গিয়ে খানিকটা হতাশ হয়েছি। প্রথমেই বলি, লেখক অনেক বড় পরিধির প্লট হাতে নিয়েছেন। প্রায় বারো হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন। পুরাণ, ইতিহাস, গুপ্তসংঘ - সব মিলে মিশে একাকার করেছেন। তবে প্লট যতটা প্রমিজিং, গল্প ততটা নয়।
বইয়ের দশভাগকে দশাবতারের চিহ্ন দিয়ে সূচিত করায় ভেবেছিলাম কোন চমৎকার থিওরি বোধহয় পাব। আদতে এটা বইয়ের খুবই ছোট্ট একটা অংশ। এতটুকুর জন্য পুরো বইটাকে এমন সাজ দেয়াটা একটু মিসলিডিং।
বইয়ের নাম কেন 'তিন বাহু দশ মুখ' তাই বুঝতে পারিনি আমি।
চরিত্ররা বইয়ের পাতাতেই ছিল। এত এত চরিত্রের ভিড়ে জীবন্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছে- এমন চরিত্র হাতে গোনা। কয়েকটা চরিত্রের কাজ তো উইকিপিডিয়াই করতে পারতো।
বেশ কিছু তথ্যে সাংঘাতিক ভুল আছে। কিছু বিষয় লেখক জোর করে মেলাতে চেয়েছেন। আর পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতায় কিছু কমন দেব-দেবী আছে; এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সেগুলো সব ভারতীয় পুরাণ থেকে উদ্ভুত- এমন দাবি করাটা হাস্যকর লেগেছে। সিন্ধু সভ্যতার সেই সীলে যে যোগীর তিনটা মুখ এটা তো কারো না জানার কথা না। এই তথ্যকে এমন আহামরি ভাবে প্রকাশের কি কারণ তা বুঝি নি।
অসংখ্য ইরেলেভেন্ট কথাবার্তা। ভেবেছিলাম সেগুলো হয়তো ক্যারেক্টারাইজেশনে বা কোন প্লট বিল্ডাপে করা হচ্ছে। কিন্তু না। পাঠকদের 'Fun facts' দেয়া ছাড়া সেগুলোর তেমন প্রয়োজন ছিল না। তবে রেলেভেন্ট কথাগুলো বেশ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। সেই বর্ননাগুলো কাঠখোট্টা লাগেনি।
লেখক যা রিসার্চ করেছেন, তার সম্পূর্ণটাই তুলে দিয়েছেন বইতে। এতে কি হয়েছে? আপাতদৃষ্টিতে ইন্টারেস্টিং, তবে লুজলি কানেক্টেড একগাদা তথ্যের খিচুড়ি হয়েছে। বইয়ের মধ্যে অন্তত ১০০ পাতা আছে যা প্লটে কোন কন্ট্রিবিউট করে না। শুধু কিছু মুখরোচক পৌরাণিক গল্প একের পর এক সাজানো আছে।
হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষীরা সবই এক অঞ্চলে! এমন বিশাল একটা সিক্রেট নিয়ে সবাই গল্পের নায়কদের আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছে। অন্তত তাদের ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিলেও কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য হত।
বইটি তথ্যবহুল, কিন্তু গতিশীল না। একদমই না। বইয়ের মাঝে এসে একটু গতি বেড়েছিল, তবে ২০-২৫ পৃষ্ঠার পর সেটা আবার হারিয়ে যায়। 'তিন বাহু দশ মুখে'র সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো এটা এত গ্র্যান্ড স্কেলের থ্রিলার হয়েও যথেষ্ট থ্রিল সৃষ্টি করতে পারে নি। একশন সিন-খুনের সিন-টুইস্টের সিনেও হাই তুলেছি। কিছু জায়গায় এত অপ্রয়োজনীয় ডিটেইল দেয়া হয়েছে যে বিরক্ত হয়ে দেড়-দুই পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে পড়া শুরু করেছি।
সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার লেগেছে যেই গুপ্তরহস্যের জন্য এত খোঁজ, সে রহস্যের ঝাঁঝ খুবই কম। 'হাজার হাজার বছর ধরে লুকিয়ে থাকা এক অবিশ্বাস্য সত্য'কে তেমন কোন বড় বিষয় মনে হয় নি।
কিছু ব্যাপার অবশ্য চমৎকার লেগেছে। বরোন ঘোষের চিঠিটায় কোড, চন্দ্র-সূর্য-তারার সাথে তিন ধর্মের যোগ, ত্রিদেবের এন্থ্রোপলজিকাল ব্যাখ্যা আর সবচেয়ে ভালো লেগেছে তিনটি প্রধান হিন্দু প্রতীক - শ্রীযন্ত্র, ওম আর স্বস্তিকার ব্যাখ্যা। আমার মনে হয় কেবল এই তিনটা জিনিস নিয়েই যদি ২০০ পৃষ্ঠার একটা থ্রিলার লেখা যেত, তবে বেশ মেদহীন ঝরঝরে এবং উপভোগ্য একটা বই হত।
মানচিত্রের ব্যবহারে লেখক অসাধারণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ম্যাপ নিয়ে তার কাজগুলো বেশ ভালো লেগেছে। এই বিষয়ে যে কেউ তার প্রশংসা করতে বাধ্য।
লেখকের রিসার্চের পরিধি ব্যপক। এ ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখেন। এতটা রিসার্চ আর এত প্রমিজিং একটা প্লটকে আরেকটু গতিশীল ও সুচিন্তিত একশনের মধ্যে দিয়ে নেয়া গেলে এটা বাংলা সাহিত্যের 'ভিঞ্চি কোড'ও হতে পারতো।
শেষে একটা শাউট-আউট দিয়ে যাই। আমার মনে হয় এই সাবজনরায় বাংলা ভাষায় লেখা সেরা কাজ হচ্ছে, মাশুদুল হকের ভেন্ট্রিলোকুইস্ট-মিনিমালিস্ট সিরিজ। সেখানে পুরাণ-ধর্মতত্ত্ব-ইতিহাস-বিজ্ঞান-গণিত সব একাকার করেও যথেষ্ট সাবলীলতা বজায় রেখেছিল। সাথে ছিল প্লটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রোলারকোস্টার গতি। আমার মনে হয় 'তিন বাহু দশ মুখ' যতটা হইচই ফেলেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হইচই ভেন্ট্রিলোকুইস্ট সিরিজের প্রাপ্য; যা সেটা পায় নি।
লেখককে অনুরোধ করবো, টুইস্ট-তথ্যের পাশাপাশি গল্পকথনের সাবলীলতার প্রতি মনোযোগ দিতে। তবে এত বড় পরিসরে এবং এত গবেষণা করে থ্রিলার লেখার উদ্যোগ নেয়ায় লেখককে সাধুবাদ জানাই। নেক্সট বইয়ের জন্য শুভকামনা।
ধরুন কোনো এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গিয়ে আপনার হাতে চলে এল অতি পুরোনো একটা পুঁথি। পুঁথি বলতে আমরা যেরকম মনে করি অনেক পুরোনো, অক্ষর ঝাপসা, পৃষ্ঠা ছেঁড়া ইত্যাদি থাকে সেরকম কোনো পুঁথি না। পুঁথিটি অমূল্য তথ্যে ভরা। সে তথ্য মানব সভ্যতার প্রাচীন এক নিদর্শনের তথ্য যা বহু বহু যুগ, বহু বহু কাল ধরে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। কী করবেন তখন? নিশ্চয়ই কোনো আর্কিওলজিস্ট অথবা সরকারি জাদুঘরে নিয়ে গিয়ে নিলামে তুলবেন। অথবা নিজেই কিছু কিছু পড়ার চেষ্টা করবেন কৌতূহলের কারণে। ধরুন আপনি পুঁথিটা পেলেন কিন্তু সেটা খোলার ক্ষেত্রে একটা শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে সেই পুঁথিটা খোলার একমাত্র উপায় হচ্ছে এরকম আরও দুটো পুঁথি রয়েছে এবং তাদেরকে একজায়গায় করলেই শুধু সেই পুঁথির তথ্য আবিষ্কার করা যাবে। কেমন একটা রোমাঞ্চ অনুভূতি হচ্ছে না? একটা অবিশ্বাস্য কৌতূহল তৈরী হচ্ছে না? প্রাচীন পুঁথিতে এমন আধুনিক নিরাপত্তা ভাবতে গেলে তো খেই হারিয়ে ফেলতে হয়। সেই রোমাঞ্চের উপর যদি আরেকটু রোমাঞ্চ ঢেলে দেওয়া হয় তবে কেমন হবে?
পাঠক বলছিলাম অনির্বাণ মুখার্জির লেখা 'তিন বাহু দশ মুখ' বইটি নিয়ে। বইয়ের নামের সাথেই রয়েছে এর ঘোর আলিঙ্গন। তিনটে বাহু দিয়ে হয় একটা ত্রিভুজ আর দশ মুখ কার থাকতে পারে একটু ভাবতে থাকুন সেই ফাঁকে ঘুরে আসা যাক আখ্যানে।
★আখ্যানঃ
দুজন সাংবাদিক বন্ধু চিড়িয়াখানায় সংবাদ করতে গিয়ে বিড়ালের খপ্পরে পড়ে দুর্ঘটনা বশত একটা জিনিস কুড়িয়ে পায়। একটা পুঁথি যাতে রয়েছে সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাসের কিছুই জানা যাবে না যতক্ষণ না একই রকম দেখতে আরও দুটো পুঁথি আবিষ্কার না হয়। নেমে পড়ে দুজন সেই রহস্য উদঘাটন করতে। তাদের সাথে নেমে পড়ে যাদের হাত থেকে সেই পুঁথি হারিয়ে গিয়েছিল তারাও। আরও একদল নেমে পড়ে মহামূল্যবান সেই সম্পদের লোভে যার মূল্য হয়তো আকাশচুম্বী। আবিষ্কার করে সেই সভ্যতার ইতিহাস। পরিচয় ঘটে কিছু অবতারের যাদের পেছনে ছিল মুখোশের হাতছানি।
★ মূল রিভিউঃ
প্রত্যেকটা সভ্যতার একটা ইতিহাস থাকে। থাকে তাদের নিজস্ব ধর্ম। কোনো ধর্মই পুরোপুরি অন্য কোনো ধর্মের সাথে মেলে না। তবে ব্যতিক্রম আছেও অনেক। অনেক ধর্মেরই সৃষ্টি হয়েছে অন্যান্য ধর্ম থেকে। উদাহরণ হিসেবে টানতে গেলে দেখা যায় খ্রিস্টান, ইহুদি, ইসলাম ধর্মের উৎস কিন্তু একসূত্রে গাঁথা যদিও পরবর্তীতে বিভিন্ন দিকে চলে গেছে তাদের নিজস্ব বিশ্বাস। আরো গাঢ় করে বলতে গেলে পৃথিবীতে বর্তমান প্রায় ধর্মেরই সৃষ্টি হয়েছে একেকটা সভ্যতা থেকে। আর সভ্যতা এসেছে নদী থেকে৷ রিভার সিভিলাইজেশ্যন বিষয়টা মূলত এখান থেকেই এসেছে। সেরকমই একটা সভ্যতার নাম সিন্ধু সভ্যতা। ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমে সিন্ধুনদের অববাহিকার পাশে যে সভ্যতা গড়ে ওঠে তাকেই মূলত সিন্ধু সভ্যতা বলে।খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৫০০ এর মধ্যে বৈদিক যুগের পরপর আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ বছরে একটা ধর্মের প্রচলন শুরু হয়। নাম সনাতন ধর্ম। সিন্ধুনদের পাশে যে সাধু-সন্ন্যাসীরা এই সনাতন ধর্ম পালন করতো এবং সেখানে থাকতো তাদেরকে হিন্দু বলে সম্মোধন করার ফলে প্রকাশ পায় হিন্দু নাম। এরপরই সনাতন ধর্ম নাম থেকে হিন্দু ধর্মে রূপান্তর হয়। যদিও অনেকে এখনও সনাতন ধর্ম বলেই মানেন। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে আর্যরা ইরান হয়ে ভারতে গিয়ে বেদ পড়া শুরু করার পরপরই হিন্দু ধর্ম ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতে। বৈদ্যও বলা হতো তাদের। মূলিত তারা ছিলেন বৈদ্য ব্রাহ্মণ। কারণ হিন্দুদের সংকর জাত বা ছোটো জাতের প্রথম সারির শূদ্র জাতদের বৈদ্য বলা হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে আসলেই কি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল? নিশ্চয়ই হুট করে ধর্মের সৃষ্টি হয়নি। তবে? এর আগের ইতিহাস কোথায়? এই আলোচনা নিয়েই এই বই।
এই ধর্মতাত্ত্বিক কথা বলার কারণ আছে। বইয়ে হিন্দু মিথলজি থেকে শুরু করে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা পর্যন্ত তারপর গ্রিক দেবতা থেকে মিশরের দেবতার সব তথ্য রয়েছে।
দারুণ একটা প্লট নির্বাচন করেছেন লেখক অনির্বাণ মুখার্জি। সেই পুরোনো ইতিহাসের তথ্য নিয়ে তিনি তৈরি করেছেন একটা পুঁথি এবং রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে বানিয়েছেন সেই পুঁথির আবিষ্কারক। রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা রাজা বিক্রমাদিত্যকে দিয়ে আরেকটা প্লট তৈরী করেন তিনি। রাজা বিক্রমাদিত্য তার নয়জন সভা সদস্যকে বা নবরত্নকে নিয়ে তিনি একটা দল তৈরি করেন যার নাম দেন গুপ্তদল। এবং সেই পুঁথির রক্ষক হিসেবে তৈরি করেন তাদের। যা পরবর্তীতে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সেই গুপ্তদলের সংরক্ষণ করান।
এরকম একটা প্লট ভাবা চাট্টিখানি কথা না। যার সাথে মিশে রয়েছে হিন্দুধর্মের অনেক কিছু। তবে তার বর্ণিত অনেক কিছুই মনগড়া ইতিহাস। যদিও তার সাথে কিছু সত্য মিশে ছিল। যেহেতু ইতিহাস আশ্রিত থ্রিলার সেহেতু ��ত্য খোঁজা এখানে বোকামি। তবে ধর্মের ব্যাপারে তিনি আগ বাড়িয়ে অনেক কিছুই বলেছেন।
উপন্যাসের মূল বিষয় যা ছিল তা হলো দশ মুখ। দশ মুখ দিয়ে আমরা সচারাচর বুঝি একজন মানুষের দশটা মুখ। কিন্তু হিন্দুধর্মে একটা বিষয় আছে। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী তাদের দেবতা বিষ্ণুর দশটি অবতারের বর্ণনা পাওয়া যায়। যাকে দশাবতারও বলা হয়। দেবতা বিষ্ণু পৃথিবীতে দশটি রূপ ধারণ করে আগমন করার ইতিহাসকেই দশাবতার বলা হয়। যার মধ্যে সর্ব শেষ যে অবতার আসবে তার নাম কল্কি। কলিযুগের আড়াই লক্ষ (মতান্তরে ২৭০,০০০) বছর পরে তার আবির্ভাব হওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায় পুরাণে। এই দশাবতার নিয়েই মূলত উপন্যাসের ভীত তৈরি হয়েছে। উপন্যাসটিতে দশ দিন দিয়ে দশটা অধ্যায়ও তৈরি করা হয় এই দশাবতারকে। উপন্যাসের নামকরণও করা হয় এটা দিয়ে। উপন্যাসের নাম তিন বাহু দশ মুখ। তিন বাহু দিয়ে ত্রিভুজের তিনটি বাহু এবং দশ মুখ দিয়ে বিষ্ণুর দশাবতারের কথাই বুঝিয়েছেন লেখক।
এছাড়াও হিন্দুধর্মের অন্যতম তিনটি প্রতীকের ইতিহাসের বিষয়টাও এখানে তুলে ধরা হয়েছে। যদিও এর ব্যাখ্যা লেখকের মনগড়া। তবে তার উদ্দেশ্য ছিল উপন্যাসে তুলে ধরা যে যাবতীয় সভ্যতা ভারত থেকেই শুরু হয়েছে। এমনকি ইনকা সভ্যতা থেকে শুরু করে নীলনদের মিশর সভ্যতা পর্যন্ত তিনি স্বস্তিকার প্রতীক ব্যবহার করে প্রমাণ করেছেন যে ভারত থেকেই মূলত সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রধান বাহক ছিল হিন্দুধর্মের তিন দেবতা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব।
★ পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
ইতিহাস আশ্রিত থ্রিলারে মূলত ইতিহাসের একটা কাল্পনিক রূপ পাওয়া যায়। ইতিহাসের সব মানুষগুলো যে আমাদের মতোই জীবন যাপন করেছিলেন সেটা দেখতে বা পড়তে বেশ দারুণ লাগে। এবং সেই ইতিহাসের সাথে যদি রহস্য, রোমাঞ্চ মিশিয়ে দেওয়া হয় তবে তো সুখপাঠ্য হবে নিঃসন্দেহে। বইটি পড়তে বেশ দারুণই লাগছিল। হিন্দুধর্মের অনেক কিছুই জানতে পেরেছি যদিও এর সত্যতা অনেক ক্ষেত্রেই বেমানান। লেখক তার বর্ণনা এমন ভাবে তুলে ধরেছিলেন মনে হচ্ছিল শুধু অভিনন্দন বা বিক্রম না আমিও নেমে গিয়েছিলাম গুপ্তপুঁথি উদ্ধারে। খ্রিস্টপূর্ব বারো হাজার বছর থেকে রাজা বিক্রমাদিত্য বা গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় পর্যন্ত ভারতবর্ষের তথা হিন্দুধর্মের ইতিহাস নিয়ে সেই পুঁথি।
উপন্যাসের মিথলজিকাল বর্ণনাগুলো বেশ গোছানো ছিল। যদিও ভুল। এছাড়াও টুইস্টের ক্ষেত্রেও বেশ ভালো অবদান ছিল৷ বিশেষ করে দেবার্চনার বিষয়টা প্রেডিক্ট করার মতো ছিল না।
আরেকটা বিষয় যেটা দারুণ লেগেছে তা হলো নবাব সিরাজ উদ্ দৌলা এবং জগৎ শেঠের রোল উপন্যাসে রাখার বিষয়টা। বিশেষ করে জগৎ শেঠই যে মূল হোতা ছিল তা বেশ জমে গিয়েছিল। এছাড়াও অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা বা চরিত্রের উপস্থিতি দেখে চমকে গিয়েছিলাম।
★ সমালোচনাঃ
বইতে সমালোচনা করার মতো যথেষ্ট বিষয় রয়েছে। প্রথমেই ধরা যাক এন্ডিং-এর কথা। এত সুন্দর একটা প্লটের এত বাজে একটা এন্ডিং যেন পুরো বইটারই মান ক্ষুন্ন করেছে। ধরতে গেলে এত সুন্দর একটা প্লটের এন্ডিং লেখক এক লাইনে শেষ করে দিয়েছেন। তার উপর মূল খলনায়কের মোটিভ পড়ে আমার পুরো বইটার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছিল। লেখক চাইলেই একটা নতুন খলনায়ক রাখতে পারতেন। তার গুপ্তপুঁথি খোঁজার উদ্দেশ্য আরও শক্ত করতে পারতেন। কেউ ক্ষমতার লোভে এমন করবে এটা ভাবা অত্যন্ত বোকামি।
আরেকটা জিনিস না বললেই নয়। একটা ধার্মিক বিষয় নিয়ে মনগড়া তথ্য দেওয়া ভালো কাজ বলে মনে করি না যদিও এটা ইতিহাস বা মিথলজি আশ্রিত থ্রিলার। ধর্ম বিষয়টা প্রত্যেকটা মানুষের একটা সেন্সেটিভ পয়েন্ট। অনেকগুলো তথ্যের মনগড়া ইতিহাস দেখে হেসে ফেলেছিলাম। সবচেয়ে বাজে লেগেছে ওঁ আর স্বস্তিকার ইতিহাসের বর্ণনা দেখে! আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম বেশ কয়েকটা মিথলজির বিষয় পড়ে। শ্রীযন্ত্রের বর্ণনাও লেখকের মনগড়া।
লেখনশৈলীও কয়েক জায়গায় বেশ বেমানান লেগেছে। বিশেষ করে দেবার্চনার পরিচয় প্রকাশের সময় লেখক যেন জোর করে বিক্রমের প্রেমে পড়াতে চেয়েছিলেন। সম্মোধনের বিষয়টাও কটু লেগেছে। 'তিনি' এর জায়গায় 'সে' সম্মোধন অত্যন্ত বাজে দেখায়।
★ উপসংহারঃ
স্পয়লার বিহীন রিভিউ দিতে গেলে নিঃসন্দেহে মনোযোগ বেশি দেওয়া লাগে এবং অনেক তথ্য এড়িয়ে যেতে হয়। এই বই স্পয়লারসহ দেওয়ার কোনো মানে হয় না। কারণ যে বিষয়ে স্পয়লার দেব সেই বিষয়টা যদি বেখাপ্পা হয় তবে স্পয়লার দিলে পুরো বইয়ের সবটুকু বলে দেওয়া হয়। একটা বইয়ের সবটুকু ভালো হলে সেটা একটা মাস্টরিড বইয়ের খেতাব পায়। এই বইটার এন্ডিংটা আরেকটু জম্পেশ হলে আমি পড়া যায় এমন বই বলতাম এটাকে। আসলে এই বইয়ের তথ্যে এতটা ডুবে গিয়েছিলাম যে প্রধান কে এবং তার উদ্দেশ্য কি শুধু বিক্রি করে দেওয়া কি না এটা নিয়ে অনেক আকাঙ্ক্ষা জমে গিয়েছিল যার দরুন আকস্মিক এন্ডিং এ হতাশা জমা পড়েছিল মনে। থ্রিল ছিল ভালো এটা বলা বাহুল্য। বইটা আরও ছোটো করতে পারতো অযথা বর্ণনা না দিয়ে।
যদি প্রশ্ন করা হয় এই বই পড়া উচিৎ কি না?
আমি বলবো হ্যাঁ পড়া উচিৎ। তবে পড়ার আগে/পরে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে একটু জ্ঞান রাখা ভালো। এন্ডিংটা বাদে ভালোই ছিল বলা যায়।
বই - তিন বাহু দশ মুখ প্রকাশক - বইচই পাবলিকেশন বিনিময়- ৩৩৩ ভারতীয় মুদ্রা পার্সোনাল রেটিং - ৩.৫/৫
বইটা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই, পাঠক মহলে বিপুল সাড়া জাগানো বই। অনেক দিন ধরে পড়বো পড়বো করে অবশেষে কাল শেষ করলাম প্রায় এক নিঃশ্বাসে। বইটা হাতে নিলেই প্রথমে নজর কাড়বে অদ্ভুত দর্শন এক দেবমূর্তি, যা কিনা আমাদের মতো বইপোকাদের আকৃষ্ট করতে বাধ্য। প্রচ্ছদ শিল্পী ও অলঙ্করণ শিল্পীকে সাধুবাদ জানাই।
এবার আসি বইটাই মূল বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে। ঘটনার মূল প্রেক্ষাপট ২০১৩ সালের, মোট তিনটি সময়কাল কে দেখানো হয়েছে। এই উপন্যাস ইতিহাস ও পুরাণের মেলবন্ধনে এগিয়ে চলে। দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু ঘটনাচক্রে খুঁজে পায় প্রাচীন গুপ্তযুগের পুঁথির একটি অংশ। যেই পুঁথিটি বদলে দিতে পারে প্রাচীন হিন্দু সনাতন ধর্মের ইতিহাস। পুঁথির তিন অংশ সন্ধানে মরিয়া হয়ে পরে গুপ্তসংঘ ও আর একটি দল। এভাবেই ঘটনা এগোতে থাকে। ধীরে ধীরে ওই দুই বন্ধু পুঁথির রহস্য উন্মোচনের নেশায় নিজেদেরকে সরাসরি জড়িয়ে ফেলে। বাকিটা বিস্তরে বলে আমি স্পয়লার দিতে চাইনা। বাংলা সাহিত্যে বর্তমানের লেখক লেখিকাদের হাত থেকে প্রশংসনীয় থ্রিলার উপন্যাস বেরিয়ে আসছে। কিন্তু এই ধরনের মিথোলজিক্যাল মিস্ট্রি থ্রিলার লেখার সাহস করতালির যোগ্য। প্রতিটা চরিত্রকে খুব স্বাভাবিক লেগেছে আর সেটাকে কখনোই অতিরঞ্জিত অতিমানবীয় করে তোলেননি লেখক। খুবই তথ্য নির্ভরশীল লেখা। এই গল্পটি পড়তে গিয়ে কলকাতা তথা প্রাচীন বাংলার অনেক ইতিহাস জানতে পারা গেছে। বইটার আর একটা দিক আমার ব্যক্তিগত ভাবে খুব ভালো লেগেছে। পড়তে গিয়ে বার বার ড্যান ব্রাউনীয় ঘরানার একটা আঁচ পেয়েছি যেটা আমার কাছে খুব গ্রহণযোগ্য লেগেছে। এবার আসি প্লটের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে, আমার মনে হয় এটাই একটা গল্পকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারে। লেখকের সৃষ্টি করা দশাবতার ও তার বিবর্তনের মতবাদ, প্রাচীন ভারতবর্ষের তিন দিক থেকে আসা সভ্যতা একত্র হ��়ে গিয়ে একটা নতুন ধর্মবিশ্বাসের মতবাদ, সেই ধর্ম পরবর্তী কালে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার মতবাদ এবং তিনটি প্রধান হিন্দু প্রতীক - ওম, শ্রীযন্ত্র ও স্বস্তিকার মতবাদ বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মানচিত্রের ব্যবহারে লেখক স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে উনি কতো লেখাপড়া করার পর মাঠে নেমেছেন। লেখকের যে চিন্তাভাবনার ছাপ বইটিতে রেখেছেন, উনি সত্যিই বিশেষ অভ্যর্থনার দাবী রাখেন।
পরিশেষে কিছু কথা বলা উচিত বলে মনে করি। আগেই বলেছি গল্পটি খুবই তথ্য সমৃদ্ধ কিন্তু কোথাও যেন সেই তথ্যের ভারে বেশ কিছু কিছু জায়গায় গতিহীন হয়ে পড়েছিল। লেখার বাঁধনটা যেন আরও একটু আঁটোসাঁটো হলেও হতে পারত। এতো বেশি চরিত্রের সমাগম বলেই সেটাকে একটু কায়দা করে গড়তে পারতেন। তবুও অনির্বাণ মুখার্জী স্যার ভূয়সী প্রশংসার দাবী রাখেন বাংলা সাহিত্যকে এই ধরনের লেখায় সমৃদ্ধ করার জন্য। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ পাঠককূলে এইরকম লেখা উপহার দেবার জন্য। আপনার কলমের দীর্ঘায়ু কামনা করে আমার এই পাঠ প্রতিক্রিয়াটি শেষ করলাম।
বই : তিন বাহু দশ মুখ জনরা: মাইথোলজিক্যাল থ্রিলার/মিস্ট্রি লেখক: অনির্বাণ মুখার্জী প্রকাশনী: বাতিঘর পৃষ্ঠা: ৩৫১ মুদ্রিত মূল্য: ৪০০ টাকা
ধরুন আপনাকে একজন লোক এসে বললো, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর - এরা কোনো দেবতা নয় । যদি প্রাচীন হিন্দু ধর্মের ত্রিদেবকে কোনো দেবতা না, সাধারণ আদিম জনগোষ্ঠীর নেতা হিসেবে তুলে ধরা হয়, মেনে নেবেন? ঠিক এই যুক্তি নিয়েই চিরাচরিত ধর্মবিশ্বাসকে সজোরে নাড়া দিয়ে যায় এই বই - 'তিন বাহু দশ মুখ' । এক মাইথোলজিক্যাল মিস্ট্রি থ্রিলার, যার কাহিনী দানা বেঁধেছে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে । প্রাচীন এক গুপ্তপুঁথির সূত্র ধরে দুই বন্ধু জড়িয়ে পড়ে হাজার হাজার বছরের লুকিয়ে থাকা এক অবিশ্বাস্য সত্যের সন্ধানে । ঐতিহাসিক সূত্র আর পৌরাণিক সংকেতের হাত ধরে এ গল্প আমাদের দাঁড় করায় এক নতুন দিগন্তের সামনে । এই গুপ্তপুঁথি থেকেই জানা যাবে প্রাচীন হিন্দু ধর্মের সৃষ্টিরহস্য । আর আছে সেই পুঁথি কে রক্ষা করার জন্য এক গুপ্তদল - যে দল কয়েকশ বছর ধরে রক্ষা করে আসছে এই প্রাচীন পুঁথির রহস্য । কিন্তু সময়ের ফেরে সেই গুপ্ত রহস্যের ওপর ঘনিয়ে আসে বিপদের কালো মেঘ । পুঁথিটা হস্তগত হয়ে যায় । এক বা একাধিক দল চাচ্ছে এই গুপ্তপুঁথির রহস্য উদঘাটন করতে । কিন্তু শেষমেষ কী হবে? হাজার বছর ধরে যেই দলটা গুপ্তপুঁথির সংরক্ষণ করে আসছে তারা কি বাঁচাতে পারবে এই পুঁথিকে? নাকি শত্রুর হাতে উন্মোচিত হবে হিন্দু ধর্মের সৃষ্টির নতুন দিগন্ত? এসবকিছু জানতে হলে পড়তে হবে বইটা ।
বইয়ের ভালোমন্দ -----------------------------------
● ভালো দিক বইয়ের ভালো দিকের কথা বলতে গেলে শুরুতেই বলতে হয় বইয়ের জনরা । দুর্ভাগ্যবশত প্রাচীন সনাতন ধর্মে এতজন এতভাবে নিজেদের লম্বা নাক গলিয়েছে যে হিন্দু ধর্মের বেশকিছু ব্যপার রয়ে গেছে অগোচরে । আবার কোনো কোনো ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিরঞ্জিত । তাই এরকম একটা টপিক নিঃসন্দেহে কৌতূহলউদ্দীপক । এরপর আসা যাক টাইমলাইনে । লেখক গল্পটা দশদিনের একটা মলাটে বলেছেন । যেখানে বেশ সাবলীল ভাবে গল্প এগিয়ে নিয়েছেন । ধন্যবাদ বাতিঘর প্রকাশনীকে ওপার বাংলার এত সুন্দর বইটা নান্দনিকভাবে বাংলাদেশের পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য । বইতে বেশকিছু চিত্র সংযোজিত হয়েছে যা খুবই ভালো লেগেছে আমার কাছে । বইয়ের বাইন্ডিং, ফন্ট এবং পৃষ্ঠা সবকিছু ঠিকঠাক ।
● মন্দ দিক কাহিনী একটু স্লো ছিল গল্পের মাঝখানের দিকে । আর অকারণে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জ্ঞানদান পছন্দ হয়নি আমার । এছাড়া চরিত্রগুলো আরো ভালোভাবে ডেভেলপ করার সুযোগ ছিল বলে মনে হয়েছে আমার । মোটকথা বইটা আরো বড় করা যেত । আর ফিনিশিং টা মোটামুটি বলা চলে ।
আমার কথা ------------ 'তিন বাহু দশ মুখ' - বইটা নিঃসন্দেহে অনির্বাণ মুখার্জী অসাধারণ এক সৃষ্টি । বিশেষ করে বিভিন্ন সিম্বলের ব্যবহার বেশ ভালো লেগেছে ।
বিশাল প্রেক্ষাপটের এক মিথোলজিক্যাল মিস্ট্রি থ্রিলার,যার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে রহস্য,রোমাঞ্চ, খুন,ষড়যন্ত্র আর পৌরাণিক কাহিনীর ব্যখ্যা বিশ্লেষণ।
সাড়ে তিনহাজার বছরের পুরোনো এই কাহিনী, এক প্রাচীন গুপ্তসংঘ বংশ-পরম্পরায় রক্ষা করে চলেছে এমন এক গোপন সূত্র, যা প্রকাশ পেলে বদলে যাবে পুরো ভারতের ইতিহাস। একটি প্রাচীন পুঁথির তিনটি অংশের মধ্যে লুকোনো সেই সূত্র। ঘটনাচক্রে এই গোপন পুঁথির একটি অংশ হঠাৎ করে দুই সাংবাদিক বন্ধুর হাতে এসে পড়ে,ওরা প্রথম প্রথম কিছু বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে এই পুঁথি খন্ডের গুরুত্ব ওরা বুঝতে শুরু করে ,এই পুঁথির সূত্র ধরে বেড়িয়ে আসতে শুরু করে অদ্ভুত আর গোপন সব তথ্য, বেরিয়ে আসে এক গুপ্তদলের কথা। এবং তখনই ওরা নিজেদের মত করে এই রহস্য সমাধানে এবং পুঁথির বাকি দুটো অংশ উদ্ধার করতে পুরোপুরি মাঠে নেমে পড়ে।
কাহিনীর শুরুর দিকেই অবশ্য লেখক দশজন সদস্যের এই গুপ্তদলের কথা পাঠকদের জানিয়ে দেয়,এবং সেখান থেকেই জানা যায় এই গুপ্তদল হলো সেই গোপন গুপ্তপুঁথির রক্ষক কিন্তু কাহিনীতে দেখা যায় যে গুপ্তদলের কাছে বর্তমানে সেই গুপ্তপুঁথি নেই অর্থাৎ গুপ্তদলও সেই গোপন পুঁথি খুঁজে বেড়াচ্ছে। আবার আরো একটা দলকে আমরা দেখতে পাই যে তারাও হন্যে হয়ে গুপ্তপুঁথি খুঁজছে এবং এই দলটিই হলো এই কাহিনীর ভিলেন দল। ঐতিহাসিক সূত্রের সমারোহ আর পৌরাণিক সংকেতের হাত ধরে এ গল্প আমাদের এনে দাঁড় করায় এক নতুন দিগন্তের সামনে। সময় চক্র ঘুরে যায় বারাবার -ব্রিটিশ আমল ,নবাবী আমল,রাজা শশাংক এবং বিক্রমাদিত্যের আমলে পাঠককে ঘুরিয়ে আনে লেখক। বারবার বদল হয় স্থানও কখনও পাঠক যাবে দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা আবার কখনো যাবে রিষড়া, হেদুয়া, কসবা, র্মুর্শিদাবাদ কিংবা শিলিগুড়িতে। স্থান বদলের সঙ্গে সঙ্গে জমে ওঠে গল্পের কাহিনীও।
কাহিনীর প্রধান প্রধান চরিত্রগুলো সমাজে সবার কাছে সুপরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এর মাঝেও এই চরিত্রগুলো এক অদৃশ্য ছদ্মবেশে সবার নিকট থেকে নিজেদেরকে আড়াল করে রাখে। মূল কাহিনী মুলত দশ দিনের,এই দশ দিনের ভিতরই উন্মোচিত হয় সেই গোপন রহস্যের।
ড্যান ব্রাউনের ধাঁচে লেখা এই মিথোলজিক্যাল মিস্ট্রি থ্রিলার ইতিহাস অনুসন্ধানী পাঠকদের যে ভালো লাগবে সে কথা আর বলতে হয়না। কিছু কিছু জায়গায় কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা হয়তো এসেছে কিন্তু তাতে মূল কাহিনীতে কোন প্রভাব পড়েনি। বইটি পড়ার সময় কোন ক্লান্তি অনুভূত হয়নি যতক্ষন পড়েছি পুরো বইয়ের ভিতরই ডুবে ছিলাম।বিশেষ করে বইয়ের শেষ চমকটা সত্যিই অবাক করে দিয়েছে। বইটি পড়ে মনে হলো এর হয়তো কোন সিক্যুয়েল আসতে পারে,সেই পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলাম।
কিছু বই থাকে পড়ার আগে রিভিউ দেখলে মনে হয় বাহ্ এত ভালো যেহেতু পড়ে দেখি।তারপর সে আশায় গুড়েবালি হয়।আবার মাঝে মাঝে উল্টোটা ঘটে।একদম শেষ অবধি না পড়া পর্যন্ত রাখা যাবে না এরকম বই নিয়ে দেখি কত মানুষের ভর্ৎসনা!! আমার কাছে তিন বাহু দশ মুখ বইটি পড়ার পরেও ঠিক এরকম লেগেছে। কিন্তু কেন? তা আসলে ব্যক্তিগত মতামতের গণ্ডিতেই থাক!
বইটি আসলে কি নিয়ে? নাম আর প্রচ্ছদ দেখেই হালকা ধারণা হবে সনাতন ধর্ম নিয়ে হয়তো! জ্বী বইয়ের মূল প্রেক্ষাপট এই ধর্ম কে ঘিরেই, কিন্তু ধর্মের চেয়ে এখানে প্রাধান্য পেয়েছে মিথলজি।যা সোজা বাংলায় আমরা পুরাণ বলে থাকি।আমার কাছে বরাবরের মতোই একটু অবাক লাগে যখন দেখি এদেশের মানুষজন এই ভারতবর্ষের পুরাণ কে অন্যান্য প্রাচীন মিথলজি থেকে খুব নিচু করে দেখে।দুঃখজনক হলেও ছোটবেলা থেকে অন্যান্য সব পুরাণের মতই এই পুরাণ নিয়েও আমার অনেক জল্পনাকল্পনা ছিল। ইন্টারেস্টিং অনেক ব্যাপার আছে তা হয়তো ধর্মের আতিশয্যে সাধারণ মানুষের কাছে আর পৌঁছায় না।তাই যখন এই বইটি হাতে পেলাম আর জানলাম এর ঘটনাবস্তু ভারতের কাহিনী নিয়ে, তখন বেশ আশা নিয়েই শুরু করলাম। কাহিনীর মূল স্রোত অনেকটাই ভিঞ্চি কোড এর সেই প্রাচীন এক অমূল্য বস্তু খুঁজে ফেরা দুই দলের ভেতর গল্পের নায়কদের জড়িয়ে পড়া। আস্তে আস্তে রহস্যের জট খুলতে থাকে, সেই সাথে আমাদের সামনে উন্মোচিত হয় লেখক এর জ্ঞান আর কল্পনার অপূর্ব সম্মিলনে এক পুরাণ গাঁথা।
গল্পে নায়ক দুজন। বিক্রমজিৎ আর অভিনন্দন দুই বন্ধু।কাজের বদৌলতে হঠাৎ করেই তাদের হাতে চলে আসে প্রাচীন এক গুপ্তপুথির একাংশ। এই পুঁথির পেছনে ঘুরছে আরেক প্রাচীন গুপ্তদল যাদের কাজ এই পুঁথির রক্ষণাবেক্ষণ করা।সেই সাথে এক ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ যারা পুঁথির জন্যে খুন করতেও রাজি।এভাবেই গল্প এগোয়, একের পর এক প্রচুর চরিত্র সামনে আসে। চরিত্রের মারপ্যাঁচ, আর কখন কি হচ্ছে এটা বুঝতে গিয়ে শুরুতে হয়তো একটু নাভিশ্বাস উঠতে পারে, কিন্তু একবার বুঝে ফেললে দ্রুত কাহিনীতে ঢুকে যাবেন। সনাতন ধর্মের প্রধান তিন সত্তা বিষ্ণু ব্রহ্মা আর শিব,তাদের মূল তিন সিম্বল, বিষ্ণুর দশাবতার, যুগে যুগে কিভাবে সনাতন ধর্মের পরিবর্তন হয়েছে এসবই উঠে আসবে একে একে।প্রাচীন এসব কাহিনীর সাথে আধুনিক বিবর্তনবাদ ও অন্যান্য সভ্যতার খুব সুন্দর সাদৃশ্য দেখিয়েছেন লেখক তার কল্পনার সাহায্যে।আমাদের মিথলজি কিংবা ইতিহাস পড়ার সময় কিছু হারিয়ে যাওয়া সময় বা মিসিং লিঙ্ক যেমন আমাদেরকে আকাশ পাতাল কল্পনার সুযোগ করে দেয়, সেই সুযোগেরই চমৎকার সদ্ব্যবহার করেছেন লেখক। বইটিতে বানান ভুল একেবারেই নেই যা আমার অন্যতম ভালোলাগার কারণ।ভাষা আর সংলাপেও অন্যান্য বইতে যেরকম অসংলগ্নতা চোখে পড়ে তা আমার চোখে পড়েনি। সব মিলিয়ে খুব ভালো লেগেছে বইটি।তবে হ্যাঁ, থ্রিলার হিসেবে এর ক্লাইম্যাক্সটা আরো ভালো করা যেত।গল্পের ভিলেইন কেও আরো ভালো ভাবে চোখের সামনেই লুকিয়ে রাখা যেত; কারণ শেষে এলিমিনেশন প্রসেস এর মাধ্যমে সহজেই তাকে ধরে ফেলা যায়। তবু আপনি যদি মিথলজির ভক্ত হন, ভারতবর্ষের পুরাণ নিয়ে আগ্রহ থাকে তবে এই বইটির সাথে দারুন সময় কাটবে আশা করি।
ভারতের প্রাচীন সভ্যতার বলতে গেলে আক্ষরিক বেদের তিন টুকরো নিয়ে মারামারি। তি প্রান্তে লুকানো তিন খন্ডের প্রথম খন্ড দিয়ে গল্প শুরু। এরপর রাজা চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্য আর তার গুপ্তদল, এন্টি পার্টি, দুই তরুন প্রোটাগনিস্ট সব মিলিয়ে এখানে সেখানে ছুটোছুটি, গুপ্তপুঁথির বাকী অংশের খোঁজ।
হিস্টোরিকাল থ্রিলারের অনেক ফরম্যাটের ভেতর এই এক ফরম্যাট দেখলেই মাথাটা যে ড্যান ব্রাউন ড্যান ব্রাউন করে, এই দায় যে কার তা ঠিক জানি না। তবে প্রথমত বইটা আরো ছোট হলেই আমার অন্তত পড়তে সুবিধা হত। কারণ বলার মত ঘটনা তো আসলে একটাই, তা নিয়ে শুধুশুধু এত টানাটানি করে কী লাভ হল! দ্বিতীয়ত, পড়া শেষে মনে হল, তার লেখায় আমি ফিকশনের চাইতে নন-ফিকশন পড়তে বেশি আগ্রহী হতাম হয়তো!
সনাতন ধর্মের সব সিম্বোলের ব্যাখ্যা, কীভাবে কোন চিহ্ন দ্বারা কী বোঝানো হল, কোন গল্পের তাৎপর্য টা কি, এসব বিস্তারিত আছে; তাও প্রয়োজনীয় ম্যাপ, ডায়াগ্রাম আর ছবিসহ। তথ্যগুলো বেশ গোছানো। সাথে গল্পের অংশ না জুড়ে দিলেই বরং মনোযোগ ধরে রাখতে সুবিধা হত। আর তাছাড়া, যখন ই ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপার এসেছে, বুঝতে পারছিলাম রহস্য টা শেষ পর্যন্ত রহস্যই থেকে যাবে।
একটি নন-ফিকশন হতে পারার প্রচন্ড সম্ভাবনাময় পান্ডুলিপির ফিকশন হওয়াতে বইটি পড়তে ভালো লাগেনি। আর একটা বই পড়তে ভাল লাগেনি এটা বলতেও ভাল লাগে না। লেখক আর তার পরবর্তী বইগুলির জন্য শুভাকাঙ্ক্ষা থাকলো।
গুপ্ত সম্রাট বিক্রমাদিত্যের সময়ের এক গোপন পুঁথি। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অজানা রহস্য উন্মোচনের একমাত্র চাবিকাঠি। যুগ যুগ ধরে যেটার রহস্য রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর একটি SECRET SOCIETY। কিন্তু কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সেই পুঁথি উদ্ধারের জন্য অধুনা বঙ্গে শুরু হয় দুই দলের মধ্যে এক দ্বৈরথ যাতে নিজেদের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ে কিছু নিরীহ মানুষ। কি এমন আছে সেই পুঁথিতে যা সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে? পুঁথির গোপনীয়তা রক্ষা করতে কতজন মানুষকে আহুতি দিতে হবে? পুঁথির রক্ষকরা কি পারবেন শেষ পর্যন্ত অশুভ শক্তির হাত থেকে পুঁথির গুপ্ত রহস্য রক্ষা করতে? পড়ুন বাংলায় সম্ভবত প্রথম MYTHOLOGICAL THRILLER, ANIRBAN MUKHERJEE র TIN BAHU DOSH MUKH এর পাঠপ্রতিক্রিয়া আমার BOOKS REVIEWS BLOG এ নিচের link এ click করে,
এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতে পারিনি। বেশ হিসেব নিকেশ করে বই কিনতে হয়। তিন বাহু দশ মুখ বইটা পড়ার ইচ্ছে ছিল বহুদিনের। কিন্তু কোলকাতা থেকে যে সংস্করণটি বেরিয়েছিল, তা কিনতে গেলে ফতুর হয়ে যেতাম। কিন্তু বাতিঘরের বই মানেই একদম হাতের নাগালে দাম। কষ্ট করে বাংলাবাজার চলে গেলে গায়ের মূল্যের অর্ধেকে বই কেনা যায়। তাই উত্তরা থেকে বাংলাবাজার অনেক দূর হলেও, চলে যাই মাঝে মাঝে।
আমার কাছে দুর্দান্ত লেগেছে বইটা। সিম্বোলজি, মিথ, রহস্য- সবকিছুর সংমিশ্রণ সবসময়ই ভালো লাগে। ড্যান ব্রাউনের ছোয়া আছে বলা যায়। তবে অনেক কিছুর সাথে রিলেট করতে পেরেছি বিধায় ভালো লাগার পরিমাণ বেড়ে গেছে।