পরিমল ভট্টাচার্য বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখেন। স্মৃতিকথা, ভ্রমণ আখ্যান, ইতিহাস ও অন্যান্য রচনাশৈলী থেকে উপাদান নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক নতুন বিশিষ্ট গদ্যধারা, নিয়মগিরির সংগ্রামী জনজাতি থেকে তারকোভস্কির স্বপ্ন পর্যন্ত যার বিষয়-বিস্তার। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। কলকাতায় থাকেন।
“কী তোমার আছে তার টেরই পাও না যতক্ষণ না সেটি হারিয়ে যায়।”
এ বছরের একেবারে শুরুতে নাহুমের গ্রাম পড়ে বলেছিলাম, এই বছর মনে হয় না ঠিক এমন আরও কোনও বই পড়া হবে। কিন্তু বছরের অর্ধেক যেতে না যেতেই আমার সেই শঙ্কাকে ভুল প্রমান করে ফেললেন স্বয়ং পরিমল ভট্টাচার্যই, তাঁর ডোডোপাখিদের গান দিয়ে। এভাবেও লেখা যায় গবেষণাধর্মী অনুবাদগ্রন্থ! ননফিকশন তো নয়, এ যেন সত্যিকারের রূপকথা! বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কুড়িয়ে নিয়ে গল্পের মত ঘটনাগুলো তুলে ধরা- এমন সুমধুর ভাষায় যা খুলে দিয়েছে পরিবেশ, সমাজ সভ্যতার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার সুদূর দিগন্ত । মানুষের তৈরি সভ্যতার চাকায় পিষ্ট প্রাণপ্রকৃতি কী টিকে থাকবে, নাকি বিলুপ্ত হবে নিশ্চল নাস্তিতে?
বইটি যখন পড়তে শুরু করি তার কিছুদিন আগেই তীব্র তাপদাহে পুড়ছিল পুরো বাংলাদেশ, আতঙ্কে পিটিয়ে মারা হচ্ছিল রাসেল’স ভাইপার নামের সাপকে, চন্দ্রবোড়া সাপ নামে যারা শত-সহস্র বছর ধরে আমাদের বাস্তুসংস্থানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। যশোর রোডের গাছগুলো যেন লাশের সারি, পড়ে আছে পথের কিনারায়; কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জে বন্যায় বিপযর্স্ত মানুষ। বাংলাদেশের হাজারো নদী থেকে শিরোনাম হয়ে এলো কয়েকশো নদীর নাম, যাদের অস্তিত্ব এখন শুধু স্মৃতিতে নয়তো জীর্ণ, অতীত নকশায়।
আর পার্বত্য অঞ্চল?
একজন সুনীল লিখেছিলেন-
"অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ। কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না। যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না।"
বেচারা সুনীল সম্ভবত ভুল সময়ে জন্মেছিলেন, এখন জন্মালে তিনি ঠিকই পাহাড় বিক্রেতার সন্ধান পেয়ে যেতেন। তবে দামে হয়তো তিনি আটকে যেতেন, এখনকার ক্রেতাদের মতো আর্থিক সঙ্গতি তাঁর ছিল কিনা, সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ থেকে যায়।
এদেশে অনেকেই পাহাড় কিনে ফেলছেন ইদানিং- চেনাজানা অনেক মানুষ। শখে। সেই পাহাড়ের ছবি ছবি তুলে গর্ব ছড়িয়ে দিচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে- এই পাহাড়ে তারা ঘর তুলবেন, শখের বাগান করবেন, পরিবার পরিজন বন্ধুবান্ধব মিলে হৈ-হুল্লোর করবেন, বার-বি-কিউ পার্টি করবেন, অন্ধকার আর রাতের স্বর্গীয় স্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে শুনবেন উচ্চ-নিনাদী প্রলয় সংগীত। এটা শুরু হয়ে গেছে; এরই মধ্যে কেউ রিসোর্ট করছেন, কেউ বা করেছেন ইঁটভাটা নয়তো কারখানা।
একটা দেশের পাহাড় কীভাবে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়? হয়তো হতে পারে, তবে সেটা তার আদি বাসিন্দাদের যাঁরা শত প্রজন্ম ধরে পাহাড়কে ধরে আছে বুকের মাঝে। কিন্তু দূর শহর থেকে যাওয়া আগুন্তুক কেন কিংবা কিভাবে পাহাড়ের মালিক হবেন? জ্ঞানীরা বলেন, একশো বছরের জন্য নাকি একে লীজ নেয়া যায় । ব্যক্তিমালিকানায় একশো বছর থাকলে অস্তিত্ব থাকবে এই সবুজ পাহাড়ের?
বান্দরবান কিংবা সিলেটের সবুজ পাহাড়ে কিংবা টিলায় কোনও বয়সী গাছ নেই, রাতারাতি সব হাওয়া; সব সাবার করেছে বনখেকোরা, অবশ্য রোপনও করেছে কিছু। তাই দূর বা ওপর থেকে সবুজ দেখালেও ছোট, অল্পবয়সী গাছে ছাওয়া এই সবুজ পাহাড় আর বন। রাতের অন্ধকারে এসব পাহাড় খুঁড়ে সরিয়ে ফেলা হয় পাথরও। সামান্য বৃষ্টিতেই ভূমিধ্বসে তার প্রতিদান মেলে হাতে হাতেই।
আর বাংলার সবুজ গ্রাম? কেমন আছে তারা? আধুনিক সভ্যতার কড়াল গ্রাসে নিস্তেজ, কড়া কীটনাশক আর উচ্চফলনশীল বীজের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে নিঃশব্দে, নীরবে অভ্রুভেদী ক্রন্দনে দশদিক বিদীর্ণ করে ফসলের মাঠ; দূষিত নদ-নদী, পুকুরে চাষ হয় নদীর মাছ। আজ থেকে ৪০/৫০ বছর আগেও বাংলার রূপ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রাণ-প্রকৃতি উজার হয়েছে। যার কারণে মারণব্যাধি বাসা বাঁধছে। এ সঙ্কট আজ শুধু আমাদের নয়, সারা বিশ্বেরই।
ডোডোপাখিদের গানে এই সবুজ পৃথিবীর এই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কার গল্পগুলো বলেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লেখক, গবেষক, সাংবাদিক আর পরিবেশবাদীরা। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যিকারের রূপকথার সাথে মিশিয়ে ভারতবর্ষের পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের বর্তমান ছবিটি এঁকেছেন পরিমল ভট্টাচার্য, শুনিয়েছেন সবুজ নিধনের অন্ধকার আর সবুজ সৃজনের আশার গল্প।
জলবায়ু পরিবর্তন আর বিশ্বউষ্ণায়নের কারণে এক ঘনায়মান বিপর্যয়ের মুখোমুখি বিশ্ব। উন্নত দেশ থেকে একবারের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো, সবখানে বাসা বাঁধছে মারণব্যাধি। আবিষ্কারের পর থেকেই গত দেড়শো বছরে পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম হুমকি হয়ে উঠেছে প্লাস্টিক আবর্জনা। এই প্লাস্টিক এখন মিশে গেছে শিশুর খাদ্যে, এমনকি মায়ের বুকের দুধেও সেই প্লাস্টিকের কণা। সেইসাথে চলছে বিশ্বনি:শেষণ - অর্থাৎ পানীয় জল, বিশুদ্ধ বাতাস, সারবান জমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ- যা এতকাল আমরা অঢেল অফুরান বলে ধরে এসেছি- তার অপরিমেয় ব্যবহার; এবং জীববৈচিত্রের নি:শেষণ। যার কারণে একুশ শতক শেষ হবার আগেই পৃথিবী থেকে প্রায় অর্ধেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
গবেষকরা বলেন, এ হলো ষষ্ঠ বিলুপ্তির কাল, যা সম্পূর্ণভাবে মানুষের সৃষ্টি। এসব ধারণা থেকেই আর্থ ওভারশুট ডে-র উদ্ভব। সারা বছরে পৃথিবী যে পরিমান পরিবেশগত সম্পদ (ecological resources) সৃষ্টি করতে পারে, মানুষের চাহিদা যদি তার থেকে বেশি হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে বছর শেষ হবার আগেই মানুষ সমপরিমান সম্পদ নি:শেষ করে ফেলে। যে দিনটিতে এই ঘটনাটি ঘটে তাকে বলা হয় আর্থ ওভারশুট ডে। ১৯৭১ সালে শুরু হওয়া এই গণনায় সে বছর আর্থ ওভারশুট ডে ছিল ২৭ ডিসেম্বর। পরেরবছর ছিল এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন- ২৯ ডিসেম্বর। এ বছরে সেটি আগস্টের ১। অর্থাৎ এবছরে পৃথিবী যে পরিমান পরিবেশগত সম্পদ পূন:সৃষ্টি করতে পারবে সে পরিমাণ সম্পদ আগস্টের ১ তারিখের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। মানুষ তখন পৃথিবীর জমানো সম্পদ , যা আসলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়ার কথা, সেখান থেকে আগামী ৫ মাস ভোগ করতে থাকবে। এভাবে চিন্তা করা যায় যে, এবছর প্রথম ৭ মাস মানুষ নিজের আয়ে চলবে, আর বাকি ৫ মাস ভোগ করবে সন্তান-সন্ততির সম্পদ থেকে। বর্তমান হারে মানুষের এই চাহিদা যোগাতে ১.৭ টি পৃথিবীর প্রয়োজন। অথচ কথা ছিল, আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, তার জন্য একটি সাজানো বাগান রেখে যাওয়ার।
অথচ একসময়- খুব বেশী আগেও নয়- মানুষের চাহিদার তুলনায় পৃথিবীর যোগান বেশি বৈ কম ছিল না। মানুষ মিশে ছিল মাটির সাথে, নদীর সাথে, ফসলের মাঠের সাথে। দুশ্চিন্তাহীন শান্তি ছিল, সুস্বাস্থ্য ছিল। ইউটোপিয়ার মতো সেই কৃষিভিত্তিক সমাজই তো আমাদের ছিল। অথচ এখনকার নাগরিক সমাজের কোনো সংযোগ নেই এসবের সাথে। তাইতো একটা পাখির পেছনে ছুটে ছুটে দুপুরগুলোকে সন্ধ্যা বানিয়ে ফেলা কিশোরের আর দেখা পাওয়া যায় না। কারণ, এখন- “নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃতি যতটা বিমূর্ত, ততটা বাস্তব নয়। ক্রমশই প্রকৃতি হয়ে উঠেছে দেখার জিনিস, ভোগ করার জিনিস, পরার জিনিস এবং উপেক্ষা করার জিনিস।”
অথচ অর্ধযুগ আগেও চিত্র কতটা ভিন্ন ছিল! প্রাণপ্রকৃতির সাথে থাকায় এসব নিয়ে ভাবার প্রশ্নও ওঠেনি তখন। "১৯৫০ এর দশকেও অম্ল বৃষ্টি, ওজনস্তরে ছ্যাঁদা কিংবা বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে কেউ কথা বলত না। কিন্তু আমি আমার বনকে, আমার মাঠগুলোতে চিনতাম; আমি আমার খাঁড়ির প্রতিটি বাঁক, পায়ে-চলা সুঁড়িপথের প্রতিটি খাদ চিনতাম। আমি এমনকি স্বপ্নের ভিতরেও সেইসব বনে ঘুরে বেড়াতাম। আজকের কোনো বাচ্চা হয়তো তোমাকে অ্যামাজনের বৃষ্টিস্নাত অরণ্য সম্পর্কে বলতে পারবে, কিন্তু শেষ কবে সে একা একা কোন বনের ভে���র চষে বেড়িয়েছে, সেটা বলতে পারবে না।”
এইসব সংকট মোকাবিলায় পরিবেশবিদরা রিওয়াইল্ডিং বা পূনর্বন্যকরণের কথা বলছেন। বলছেন, দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর। কিন্তু অরন্য ফিরিয়ে দেবে কে? এই বইয়ে আমরা এলজার্ড বুফিওর মতো কিছু গাছমানুষের সন্ধান পাই, যারা তিলে তিলে জীবন দিয়ে ধরে রাখছে সবুজকে, ধু ধু মাঠে জাগিয়ে তুলেছে সবুজ অরণ্য। লাতিন আমেরিকার গাভিওতাস বা পাশ্ববর্তী শাংগ্রিলা এখনও স্বপ্ন দেখায় সবুজ সৃজনের। এই বইয়ে আমরা পাই আরোভিল নামের এক সত্যিকারের কল্পনার শহর, পাই কলম্বিয়ার প্রত্যন্ত উপনিবেশ গ্যাভিওতাসের চিত্র। লা ভায়োলেন্সিয়া বা হিংসার যুগের অবসানের পর সৃষ্টি হয় এই গ্যাভিওতাস, যা ছিল পূর্ব কলম্বিয়ার প্রায় বৃক্ষহীন প্রান্তরের মাঝে একটি বিস্ময়কর স্থান যাকে ঘিরে রেখেছে বন এবং যা সৃজন করে চলেছে সঙ্গীত। নিজের চোখে দেখতে ১৯৯৫ সালে গবেষক জোপেস একদল সাংবাদিকের সাথে গেলেন গ্যাভিওতাসে। পৃথিবীর বুকে ইউটোপিয়া নির্মাণ যে সম্ভব তার বাস্তব প্রমাণ গ্যাভিওতাস- ওরোনিকোর এক উপনদীর ধারে বনানীর ছায়ায় ঘেরা, ফুলে ফলে আর পাখির কলতানে জমজমাট হয়ে আছে সেটি।
“গ্যাভিওতাসের বাসিন্দাদের মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন এমন এক সজীবতার স্পর্শ , যা তিনি আগে কখনও পেয়েছেন বলে মনে হল না। একবার সেই স্পর্শ পেলে চিনে নিতে ভুল হয় না। এখানে মানুষ সুখী। এরা ভোরের আগে ঘুম থেকে ওঠে। কঠিন ও ফলপ্রসুূ পরিশ্রম করে। সহজ পুষ্টিকর খাবার খায়। এবং শান্তিতে থাকে। যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তা তাদের বা চারপাশের নিসর্গকে শাসন করে না। বেশীরভাগই তাদের নিজেদের তৈরী এবং প্রায় শব্দহীন।”
ইউটোপিয়ার মত এই শান্ত গ্রামের কথা ফিরে এসে লিখেছেন কলম্বিয়ার সাংবাদিকরা; মাকোন্দোকে যেভাবে উপস্থাপন করেছিলেন গাবো, ঠিক যেন সেভাবেই।
গ্যাভিওতাসের সুখী মানুষ আর তাদের জীবনের ছবি দেখে মনে পড়ে যায় আমার নিজেরই অতীতের কথা, বইপত্রে পড়া আমার বাংলার মানুষ, তাদের জীবনযাপন আর পরিবেশের কথা। বহু বছর আগে বাংলার গ্রামীণ জনপদও তো এমনই ছিল! শান্তিতে বাস করার জন্য এমন জনপদের স্বপ্নই তো যুগ যুগ ধরে একেঁছেন আমাদের কালজয়ী সৃষ্টিশীল মহান মানুষেরা:
“গাছটির স্নিগ্ধ ছায়া, নদীটির ধারা ঘরে আনা গোধুলীতে সন্ধ্যাটির তারা চামেলির গন্ধটুকু জানালার ধারে ভোরের প্রথম আলো জলের ওপারে। তাহারে জড়ায়ে ঘিরে, ভরিয়া তুলিব ধীরে জীবনের কদিনের কাঁদা আর হাসা ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা করেছিনু আশা।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
গ্যাভিওতাসই তো আমার হারিয়ে ফেলা গ্রামবাংলা! ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীটের বাইরেও তো আমাদের ছিল শান্ত শ্যামল গ্রাম আর সুখী শক্তিমান মানুষ। আর সাহসী শিশু। কিন্তু, পার্থক্য শিক্ষা আর সৃজনে। আমাদের হারিয়ে ফেলা গ্রামবাংলাও এখন আমাদের জন্য ইউটোপিয়ার মত কিন্তু গাভিওতাস তো সত্যিকারের ইউটোপিয়া। আমরা হাতে ধরে সভ্যতার কড়াল গ্রাসে ধ্বংস করেছি আমাদের গাভিওতাস। তাই গ্যাভিওতাসের পাইন আর পর্ণমোচি গাছের বর্ণনায় স্মৃতিভারাতুর হয়ে যাই আমি: “ওদের চারদিকে ঘিরে ছিল চল্লিশ ফুট উঁচু ক্যারিবীয় পাইন আর পর্ণমোচি গাছের বন। আর ঝোপেঝাড়ে ঘন পাতার স্তুপ। চড়া দুপুরেও বনের বাতাস ছিল মিঠে ঠান্ডা”- এই প্রশান্তিময় বর্ণনায় পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে এক টুকরো স্বর্গীয় সমিরণ; ক্রমশ তা শীতল, স্নেহময়ী, পরান জুড়ানো স্পর্শের মতো ছড়িয়ে পরে বাংলার অশ্বথ গাছের ছায়া আর পাতার ছন্দমধুর সঙ্গীতে। কিন্তু হায়! আমাদের কোনো অশ্বত্থের বন নেই, কারণ কোনো গাছমানুষ তো নেই আমাদের।
আমরা আমাদের হারিয়ে ফেলা গ্রামবাংলার ছবি দেখি বইয়ের পাতায়, শিল্পীদের চিত্রকর্মে। অথচ হারিয়ে ফেলা সেই সত্যিকারের ইউটোপিয়ার মত জায়গা-ই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। গ্যাভিওতাস ঘুরে এসে মার্কেস বলেছিলেন, এমন একটি জায়গা কলম্বিয়ার প্রয়োজন। স্পেনের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, এমন একটি জায়গা লাতিন আমেরিকার প্রয়োজন। আর রোমের প্রতিনিধিদল বলেছিল, এমন একটি জায়গা সারা পৃথিবীরই প্রয়োজন। তাই এ কথাই অনিবার্য হয়ে ওঠে যে, "কী তোমার আছে তার টেরই পাওনা যতক্ষণ না সেটি হারিয়ে যায়।”
আর শুধুই কী গ্যাভিওতাস! ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-প্যারাগুয়ে সীমান্তের সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলটিকেই বা ভুলি কী করে, যেখানকার জনগোষ্ঠীর প্রত্যেককে গান গাইতে বা বাজনা বাজাতে শেখানো হয়েছিল! গোটা জনগোষ্ঠীই যেন বোনা হয়েছিল সঙ্গীতের তাঁতে- স্কুলে, খাবার সময়ে এমনকি কাজের সময়েও সঙ্গীত। বাজনাদারেরা চাষীদের সঙ্গে ভুট্টার খেতে চলে যেত, পালা করে বাজনা বাজাতো আর ফসল কাটত। যেন পুরো সমাজ ডুবে আছে নিরবচ্ছিন্ন এক ঐকতানে।
এমন ঐকতান কি বাংলায় ছিল না? এখানকার লোকসঙ্গীত সবই তো গ্রামবাংলার মানুষের থেকে সৃষ্টি- ভাটিয়ালি, জারি সারি। এখানকার চাষীরা তো ক্ষেতে ফসল বুনতো গান গেয়ে, ফসল তুলতো গান গেয়ে, মাঝি দাঁড় বাইতো গান গেয়ে। জারি সারি গম্ভীরা ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি সবই তো বাংলার সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষার কণ্ঠ থেকে এসেছে:
“কী যাদু বাংলা গানে গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে গেয়ে গান নাচে বাউল গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।” (অতুল প্রসাদ সেন)
এই যে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সঙ্কট, বিপর্যয়, তার মাঝেও গ্যাভিওতাসের মত জনপদ যেমন আছে, আছে শাংগ্রিলাও। এই বইটি আমাদের নিয়ে যায় বরফে মোড়া দেশ থেকে অভয়ারণ্য, চেরনোবিলের প্রান্তর থেকে একেবারে সেই দেশে, যে দেশে সম্পদের পরিমান নয়, মাপা হয় সুখ। সেই দেশে ১৯৭০ এর দশকেই তাদের চতুর্থ রাজা ঘোষণা করেছিলেন, “মোট জাতীয় উৎপাদনের থেকেও মোট জাতীয় সুখ গুরুত্বপূর্ণ, এবং সুশাসনের মাধ্যমেই সেই সুখ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।” তা হয়েছেও। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্নের সংকটকালে যে দেশটি একটি কার্বন নিরপেক্ষ আর কার্বন নেগেটিভ দেশও। সেই দেশটির নাম ভুটান।
জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে কথা কিন্তু কম হচ্ছে না! লেখা হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে, জলবায়ু সম্মেলন হচ্ছে; ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে সেই ছবি মানুষের চোখের সামনে ধরা দিচ্ছে। কিন্তু পরিবেশের বিপর্যয় রোধ হচ্ছে না। কেউ একজন সত্যিকার অর্থেই গাছমানুষ হয়ে উঠছে না। ক্ষমতার কেন্দ্রে গেলে এসব যেন ভুলে যাচ্ছেন খোদ পরিবেশবাদীরাও। কিন্তু কী হবে পরিবেশ, জলবায়ু কিংবা প্রাণীজগৎ-এর? কীভাবে মুক্তি মিলবে এই সংকট থেকে?
এই সংকট থেকে উত্তরনের জন্য আশার আলো হয়ে আছে শাংগ্রিলা, গ্যাভিওতাস আর গাছমানুষেরা। এর জন্য দরকার সুশাসন। শুধু একটা দুটো দেশে নয়, সুশাসন ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীব্যাপী- সবুজে, বনে, নদীতে, জনপদে, লোকালয়ে; প্রতিষ্ঠিত হোক সুশাসন, প্রাণ-প্রকৃতির সমঅধিকারের সুশাসন। গভীর বিশ্বাসের উচ্চারিত হোক:
"আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন" (আল মাহমুদ)
আমাদের ধর্ম হোক সুশাসন আর সম্পদের পরিমিত ব্যবহার।
চলুন একজন গাছমানুষকে অনুকরণ করি। গেয়ে উঠি-
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। অবশেষে সব কাজ সেরে আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হব ইতিহাস।। (সুকান্ত ভট্টাচার্য)
"এতোদিনে ঘুম ভাঙলো বাছা?" পৃথিবী আমাকে ও আমাদের এই প্রশ্নটা করতেই পারে।আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তো আগামীকাল ৪০, এরপরের দিন ৪১। অসহনীয়, অসহনীয়, অসহনীয়। এ গরম আমার পূর্বনারী পূর্বপুরুষেরা কে সয়েছে কবে? বসে শান্তি নেই, ঘুমিয়ে শান্তি নেই। টনক নড়েছে সকলের। "আসলে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে তো..." সবাই বলা শুরু করেছে। অথচ কিছুদিন আগেও এই পরিবর্তনের প্রলয়ঙ্কর প্রভাব শুধুই ছিলো কাগজে কলমে।অন্যদের কথা জানি না, আমি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য "দুঃখ" পেতাম। ভাবতাম,এদের কপালে কতোই না দুর্ভোগ আছে। এই "এদের" একজন যে আমি নিজেও, তার চাক্ষুষ প্��মাণ পেয়ে এখন কেঁদেকেটে কুল পাচ্ছি না। এ বই যখন পড়ছি তখন বিশ্বের প্রথম দুর্ভাগা দেশ হিসেবে নাম লিখিয়েছে ভেনেজুয়েলা; যেখানে কমতে কমতে বরফের স্তূপ এখন শূন্যের কোঠায়। "ডোডোপাখিদের গান" এ পরিমল ভট্টাচার্য নিজস্ব পর্যবেক্ষণের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন জ্যারেড ডায়মন্ড, এলান ওয়েইজম্যান, সভেৎলানা আলেক্সিয়েভিচ, অমিতাভ ঘোষ, র্যাচেল কার্সন, শেরিং তোবগে, সুমনা রায়-সহ প্রায় ৪০ জন পরিবেশবাদী তাত্ত্বিক ও স্বাপ্নিকের লেখা। চেরনোবিলের পারমাণবিক বিস্ফোরণবিধ্বস্ত প্রান্তর থেকে শুরু করে আমাজন, নিউইয়র্ক, ভুটান তথা শাংগ্রিলা, বিশ্বগ্রাম অরোভিল, ইনুইটদের বরফ মোড়া দেশ, গাছমানুষ যাদব পায়েং পর্যন্ত পৌঁছে যায় গল্প। আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে হলে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, "আমি"র বদলে ভাবতে হবে "আমাদের কথা।" সবই বুঝলাম,কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
কী দাবদাহই না চলছে কদিন ধরে! গরমে প্রাণ অতিষ্ঠ সবার। আবার বৃষ্টি নামলে থামতে চায়না। দেখা দেয় বন্যার আশঙ্কা। শীতকালেও এমন হাড়কাঁপানো শীত আগে পড়তে দেখা যায়নি। এলাকাটা ছিল নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার, হয়ে পড়েছে চরমভাবাপন্ন। আবহাওয়া আর জলবায়ু নিয়ে একটা চ্যাপ্টার সকল ক্লাসেই বোধহয় আছে একটা করে। সচেতনতা এবং জ্ঞান বাড়ানোর এই প্রয়াস তেমন কাজে লাগছে কই?
এক্সট্রিম ওয়েদার দেখছি আমরাই। অপেক্ষা করছি, প্রায় হাত পা গুটিয়ে, চরমতম রূপটি অবলোকন করার জন্য। যারা অরণ্যের আশেপাশে থাকে, বনাঞ্চল গড়ে তুলে বা গ্রামেরই সাধারণ লোকজন, গাছপালা চেনে, এরা তো জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বব্যাপী এত যে হইচই হচ্ছে জানে না। অথচ তাদের সাথে প্রকৃতির সংযোগটা কত নিবিড়! আর আমরা শহুরে নাকউঁচুরা ইট-কাঠ-পাথরের মধ্যে থেকেই যারা অভ্যস্ত, বছরে সম্মেলন আর গুচ্ছের টাকার শ্রাদ্ধ করে অনেক জানি, মানি না কিছুই, তাদেরই পরিবেশের সাথে নিবিড়তাটা বড্ড কমে গেছে।
ডোডোপাখিদের গান-পরিমল ভট্টাচার্যের আরেকটা অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। অবাক হয়ে ভাবি, কেমন করে গবেষণা আর সাহিত্যকে এত সুন্দর শব্দের বুননে এক করতে পারেন তিনি!
অভিনব এই বইটিতে তিনি এক করেছেন পরিবেশ বিষয়ক বিশ্বের ৪৪টি লেখা, আর সাথে তাঁর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী মন্তব্য আর সরস অনুবাদ। ইস্টার দ্বীপের রহস্যময় স্থাপত্য আর এর সাথে দ্বীপের মরে যাওয়া-এই দুইয়ের সংযোগটা যে গা শিউরে ওঠার মতো! চেরনোবিলের বিষভূমি আর ছেড়ে আসা মানুষের কথা জানার জন্য না, অনুভবের জন্যই লেখা। মানুষ যে কেবল ধ্বংসই করতে পারে এমন তো নয়। সৃষ্টিতেও তো সে সেরা। তা কি প্রমাণ করেননি ইন্ডিয়ার ফরেস্টম্যান পদ্মশ্রী খেতাবজয়ী যাদব পায়েং?
ডোডোপাখি-এক বিলুপ্ত প্রাণী। আমরা যেন পরিবেশকেও ডোডোপাখি না বানিয়ে দেই। সৃষ্টির ক্ষমতা তো মানুষেরই। পাতের খাবারগুলো আসছে কোথা থেকে-না মুদি দোকান বা সবজি বাজার নয়, সেগুলো উৎপন্ন হচ্ছে কীভাবে, আমরা কি তা শেখাই পরিবারের ছোটদের? কীভাবে জানবে তবে তারা এর পেছনে মাটি থেকে মানুষ কতকিছুর অক্লান্ত শ্রম?
শাংগ্রিলার খোঁজে-আলাদা বই আছে। আবার এই বইয়েও একই নামে একটি আলাদা প্রবন্ধ আছে। ভুটান নিয়ে। সবুজেঘেরা ভুটান, এশিয়ার ছোট্ট দেশ ভুটান যেখানে অরণ্যের কোন অভাব নেই। সেখানকার বাতাস নির্মল, কার্বন এর উৎপাত নেই অন্যান্য পৃথিবীর মতো। আমরা কি একটা ভুটান চেষ্টা করলেও গড়তে পারি না?
নন-ফিকশনের জগতে পরিমল ভট্টাচার্য এর মতো কেউ এখন আছেন কিনা আমি জানিনা। আমার ক্ষুদ্র পাঠ অভিজ্ঞতা বলে তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। বিষয়বস্তু, ভাষার অনবদ্য ব্যবহার এবং গবেষণায় তিনি অনন্য। তাঁর লেখা নিজেদের মননশীল পাঠক মনে করেন, এমন প্রত্যেকের পড়া উচিত। অন্তত এই ডোডোপাখিদের গান!
মানুষ পৃথিবীতে রাজত্ব করে চলেছে অনেকদিন হলো। কিন্তু, নিজের রাজ্যের প্রতি এমন খারাপ আচরণ কোনো রাজা ইচ্ছা করে না করলেও মানুষ করেছে এবং দিনে দিনে তাই পৃথিবী খারাপ অবস্থার দিকে পতিত হতে থাকছে।
শীতকালেও ঠান্ডা নেই, গ্রীষ্ম-বর্ষা-হেমন্তে তো ভয়ংকর গরম। তাপমাত্রা আছে শুধু বৃদ্ধির পথে।
পরিবেশের বর্তমানে যতটুকু অবশিষ্ট আছে তাকে ঠিকমতো টিকিয়ে রাখতে পারলেও আমরা বেঁচে থাকতে পারবো, কিন্তু, সেই ইচ্ছাও তো সামগ্রিকভাবে লক্ষ্য করা যায় না।
ডোডো পাখিদের গান পরিমল ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিকতম লেখা। তাঁর লেখা প্রতিটা বই অনবদ্য, সত্যি কথা বলতে বাংলা, হিন্দি অথবা ইংরেজির কোন নন ফিকশন লেখকের বইয়ে আমি এরকম আন্তরিকতার স্পর্শ পাইনি। তাঁর লেখনীতে এক মায়া জড়িয়ে থাকে, যা সবসময় স্মৃতিচারণমূলক না হলেও ছুঁয়ে যায় মনকে। এমন নেশা ধরে যায় যে অন্য সব লেখাই তখন পানসে বলে মনে হতে থাকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ অথবা স্থানীয় সমস্যা, তিবেট হোক অথবা নিয়মাগিরি, দার্জিলিং হোক অথবা পুরুলিয়া, গবেষণামূলক তথ্য হোক অথবা অভিজ্ঞতার বর্ণনা -- পরিমল ভট্টাচার্য সাবলীল, অনন্য এবং অসাধারণ। একটুও না বাড়িয়ে বলি, নন ফিকশনের ক্ষেত্রে এই কলম আন্তর্জাতিক স্তরে ঝড় তুলতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস। বিষয়বস্তু এবং লেখনী, দুই ক্ষেত্রেই লেখকের আশেপাশে কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না।
শাংগ্রিলার খোঁজে প্রায় কাল্ট এ পরিণত হয়েছে, দার্জিলিং হয়ে উঠেছে বহু পাঠকের প্রিয়তম বই। ড্যাঞ্চিনামা আর অপুর দেশ পড়ে স্তম্ভিত হয়েছি। এমন সময় হাতে এল ডোডো পাখিদের গান। পরিবেশ বদল আর বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে লেখা এই ভাষ্য তৈরি হয়েছে দেশ বিদেশের চল্লিশটা লেখকের লেখনীর সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত ভাবনার সূত্রের সন্ধিতে, এবং সম্ভবত এইধরনের লেখা বাংলায় আর একটাও নেই। আশার কথা, পরিমল বাবু ইংরেজিতেও ততটাই ভাল লেখেন, এবং নিকট ভবিষ্যতে হয়তো ডোডো পাখিদের গান ইংরেজিতেও প্রকাশিত হবে। বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছবে এই লেখা। এই মুহূর্তে বলতে পারি, গত পনেরো কুড়ি বছরে যদি একটা বাংলা নন ফিকশন বইয়ের নাম বলতে হয়, আমি এই বইটার কথাই বলব। ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে যদি পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে আপনার স্পষ্ট ধারণা না থাকে, বইটা পড়ুন। 🙏
"সে যাইহোক, মোদ্দা কথা হল প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানুষের ভূমিকা নিয়ে সরাসরি কিংবা অপ্রত্যক্ষভাবে অসাধারণ ভাষায় ভঙ্গিতে লিখে চলেছেন এক ঝাঁক লেখক। ... এঁদের লেখায় ফুটে উঠেছে এই বিশ্বের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে তীক্ষ্ম আসক্তি, প্রেম, এবং আমাদের এই সভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠা। এঁরা যেন সেই হারিয়ে-যাওয়া ডোডো পাখি, ���ান গাইছেন বিভিন্ন ভাষায়, কিন্তু সেই গান হারিয়ে যাচ্ছে কর্কশ ধাতব মিছে কোলাহলে। বিলুপ্তির কিনারে দাঁড়িয়ে আমরা শুনতে পাচ্ছি না, শুনতে চাইছি না।"
এমন একটা সময়ে আমরা বেঁচে আছি যখন আত্মসত্তার বাইরে ফিরে থাকাবার ফুসরত মেলে না। আত্মাকে বিযুক্ত করে রাখি মাটি-জল-অরণ্য-বৃক্ষ-বাতাস-মানুষ সমস্তকিছু থেকে। একরকম কৃত্রিম সুখ মগজে পুরে দিয়ে ভাবি, ভালো আছি। সেই সুখ ভোগের সুখ, অনুভবের নয়; আত্মার সুখ নয়। যে সুখ আসে মগ্নতায়, সেই সুখ নয়। কারণ প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে যাচ্ছে। একটা প্রজন্ম পর্যন্ত আমরা বড়োজোর 'হিরাইথ' এ ('হিরাইথ হল এক স্মৃতিমেদুর অনুভূতি, ঘরে ফেরার টান, এমন এক ঘরে ফেরার টান যে ঘরের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই।' পৃ.৯১) আক্রান্ত হই। কিন্তু ভোগসর্বস্ব জীবন ফেলে এক কদম পা বাড়াই না প্রকৃতির দিকে। যদিও বা শারীরিকভাবে পাহাড়-অরণ্যে যাই আমরা সেখানে লীন হতে পারি না, প্রকৃতিকে লুট করে নিতে চাই। সাহিত্যেও 'ব্যক্তি' যতটা রাজত্ব করে 'প্রকৃতি' ততটা নয়। প্রকৃতির বিপর্যয়, বিপণ্নতার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি পাই না সাহিত্যে। কিন্তু এমন লেখার উপস্থিতি শূন্য নয়। প্রকৃতি, পরিবেশ, সভ্যতার ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রিক এক গুচ্ছ লেখাকে দুই মলাটে বন্দি করে পাঠককে উপহার দিয়েছেন পরিমল ভট্টাচার্য। নানান ভাষার এইসব রচনার রচয়িতাকে তিনি তুলনা করেছেন ডোডো পাখিদের সঙ্গে। সংকলিত রচনাগুলো নিয়ে এবং প্রকৃতি নিয়ে তাঁর নিজস্ব বিশ্লেষণ, অনুভূতিও যুক্ত হয়েছে সঙ্গে। সবমিলিয়ে প্রকৃত অর্থেই বইটি হয়ে উঠেছে 'চমকপ্রদ ভাবনার আকর'!
পৃথিবী নামের গ্রহটা নিয়ে, তার প্রকৃতি নিয়ে ভীষণ চমৎকার বই। প্রকৃতি বাঁচলে বাঁচবে সকল প্রাণ। প্রকৃতিকে আঘাত করলে সে আঘাত ফিরে এসে মানুষের গায়েই লাগবে। হিসাবটা বড্ড সোজা। কিন্তু মানুষের কোন হুশই নাই।
সত্যি কোনোরকম পাঠ-প্রতিক্রিয়াই যথেষ্ট নয় এই বইয়ের আলোচনাতে। কিন্তু পুরো বই শেষ করবার পর মনে হলো যে, পৃথিবীর সবাই যদি নাও জানতে পারে, অন্ততঃপক্ষে Goodreads সমস্ত বাংলাভাষী সদস্যের উচিত এই বইটির সম্বন্ধে জানা এবং বইটি পড়বার। সেই অনুভব থেকেই আজকের এই লেখার উপস্থাপনা। কি আছে এই বইতে ? ১৯৯ পাতার বই, লেখকপরিমল ভট্টাচার্য, প্রকাশক অবভাস, মুদ্রিত মূল্য ২৭৫ টাকা (দ্বিতীয় সংস্করণ)। হে উৎসাহী কিংবা অনুৎসাহী পাঠক/পাঠিকা, উপরের এই এক লাইন পুস্তক পরিচিতি দেখে মোটেও কোনো ধারণা করে বসবেন না বইটির সম্পর্কে ! এই বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে আরো অনেক বইয়ের খোঁজ, আর তারা যে সে বই নন, কোনোটির বিষয়বস্তু পারমাণবিক দুর্ঘটনার পরবর্তী সময়ে চেরনোবিলের প্রাকৃতিক বিস্তার (এক ভূমিকন্যার বয়ানে), কোনোটিতে রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে ইস্টার আইল্যান্ডের বিশালকায় মূর্তির, কোনোটিতে বা জানতে পারি ব্রেস্ট ক্যান্সারাক্রান্ত নারীদের এক অদ্ভুত রূপকথা, আবার কোনোটিতে জানতে পারি প্রতিবেশী দেশ ভুটানের 'জাতীয় সুখ' মাপবার কাহিনী (পড়ে ভুটান ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করবেই)। এছাড়াও রয়েছে শিকার-কুরানিদের কথা, ব্রাজিলের ইয়ানোমামি জনজাতির লড়াই, মানবোত্তর বিশ্বে ধ্বংস ও ক্ষয়ের প্রক্রিয়া (পড়তে পড়তে গা শিউরে উঠতে পারে), গাছমানুষ নিয়ে বিশ্বের মন জয় করা গল্প কাহিনী আবার আমাদেরই দেশের এক প্রান্তিক মানুষের একার হাতে একটি বন সৃষ্টির সত্যিকারের অবাক কান্ড। আরো পাবেন জলবায়ু পরিবর্তন আর তার ভবিষ্যতের আভাস, আমাদের খাদ্যাভ্যাসে বীজের গুরুত্ব, যশোর রোডের বৃক্ষ-ইতিহাস, লাইকেনের অন্তর্জীবনের জটিলতা, কলম্বিয়ার গাভিওতাস কিংবা ভারতের অরোভিলের ইউটোপিয়া। বইটির প্রতিটি অধ্যায়ে, প্রায় প্রতিটি পাতায় নতুন করে ধরা দিচ্ছে আমাদের এই পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষ, পশু-পাখি, গাছপালা, প্রাকৃতিক সম্পদ, এদের সবার মধ্যে চিরকালীন দ্বন্দ্ব অথবা সমন্বয় আর তার পরিণতির। লেখাগুলির সূত্র হিসেবে শ্রী ভট্টাচার্য চুয়াল্লিশটি বই/রিপোর্টের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন, লেখক ও প্রকাশকের নাম এবং প্রকাশ সালসহ। শুধু এই তালিকাটির জন্যই ওনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে পারি, প্রতিটি বিষয়ের ওপর ওনার অনন্যসাধারণ বিশ্লেষণ তো উপরি পাওনা। অভিনব বিষয়ের উপর নতুন বই যারা খোঁজ করেন তারা এই বই পড়বেন, প্রকৃতিপ্রেমিকরা এই বই পড়বেন, আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবনে পৃথিবীকে আরো ভালো করে চিনতে ইচ্ছুকরা এই বই পড়বেন, আমাদের এই পৃথিবীকে "নবজাতকের বাসযোগ্য" রেখে যেতে যারা অঙ্গীকারবদ্ধ, তারা অবশ্যই এই বই পড়বেন।। পাঠ শুভ হোক !
“থামো। এক পা পিছিয়ে যাও। নিজেকে জিজ্ঞেস কর – যে খাবারটা আমি এখন খেতে চলেছি সেটি কোথা থেকে এল? ক বিন্দু থেকে খ বিন্দুতে আসার জন্য এটি কত পরিমাণ জল, জমি ও অন্যান্য সম্পদ নিঃশেষ করেছে? আমি কেন এটা খাচ্ছি? নিজেকে কখনো এ প্রশ্ন করেছ কি? না, করনি। আর কেনই বা করবে? তোমার খাবার কোথা থেকে আসে সেটা থাকতে হবে তোমার ‘দৃষ্টির বাইরে, অতএব মনের বাইরে’। এটাই আমাদের সংস্কৃতি এখন; সবকিছু চাপা পড়ে গিয়েছে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাগত অসত্য আর বিভ্রান্তির আড়ালে। অথচ এই একটি বিষয়, আমাদের খাবার কোথা থেকে আসে, এর জন্যে প্রতি বছর স্বাস্থ্যপরিষেবা আর উৎপাদন ক্ষমতার ক্ষতি সামলাতে কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, বিশ্বনিঃশেষের এ হল এক প্রধান কারণ। (রিচার্ড ওপেনল্যান্ডার) . "বিশ্বনিঃশেষণ— অর্থাৎ পানীয় জল, বিশুদ্ধ বাতাস, সারবান জমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ যা এতকাল আমরা অঢেল অফুরান বলে ভেবে এসেছি, তার নিঃশেষ। পরিবেশ লেখক এলিজাবেথ কোলবার্টের মতে এ হল ষষ্ঠ বিলুপ্তির কাল, যা সম্পূর্ণভাবে মানুষের সৃষ্টি করা। একুশ শতক শেষ হবার আগেই পৃথিবী থেকে প্রায় অর্ধেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তার মানে হল— আজ যে শিশুটি জন্মালো সে যদি মানুষের স্বাভাবিক বয়সকাল, অর্থাৎ ৮০-৮৫ বছর বাঁচে (যদি আশা করা যায় আগামী দিনে চিকিৎসাশাস্ত্রের অগ্রগতি ভয়ংকর দুষিত পরশ সত্ত্বেও তাকে তার প্রাপ্য আয়ু দেবে) তাহলে জীবনের সায়াহ্নে এসে সে এমন এক রিক্ত দীন পৃথিবী দেখবে, যা আমরা সহজে কল্পনা করতে পারি না। আমাদের চারপাশে যেটুকু যা জীবজন্তু গাছপালা রয়েছে তার অনেক কিছুই ততদিনে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই পৃথিবীটা আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাইনি, আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে ধার নিয়েছি— এই প্রবাদটি এক করুণ নিষ্ঠুর ব্যঞ্জনায় দেখা দেবে তখন।" . “ডোডোপাখিদের গান” পরিবেশ ও সভ্যতা নিয়ে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে গ্রন্থিত এক বই। বইটিতে পরিমল ভট্টাচার্যের দারুণ অনুবাদে উঠে এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন কাল ও দেশের প্রায় চল্ল���শ জন প্রকৃতিপ্রেমীর প্রকৃতি নিয়ে অভিজ্ঞতা ও গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনা। সেই সাথে লেখকের নিজস্ব বক্তব্য তো আছেই। পরিবেশ ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন এই মানুষগুলোর অভিজ্ঞতা আর চিন্তা আমাদের ঘুরিয়ে আনবে আমাজনের জঙ্গল, ইনুইটদের বরফরাজ্য, মধ্য ভারতের গহীন অরণ্য, চেরনোবিল, ইউটোপিয়ান শহর অরোভিল, সবুজ দেশ ভুটান এবং নিউইয়র্কের সাবওয়েসহ আরো অনেক জায়গা থেকে। এবং সেই সাথে আমাদের ভাবিয়ে তুলবে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।
“ আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়, দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার কবেকার পাড়াগার মেয়েদের মতো যেন হায় তারা সব আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভরে, গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ — কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে ” —জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দের পউষ–সন্ধ্যার খড়ের মাঠে হেঁটে যাওয়া মানুষ আমরা—কিন্তু সেই মাঠ কি আর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে? নরম নদীর নারী কিংবা কুয়াশার কবেকার মেয়েদের মতো গ্রাম্য সৌন্দর্য আজ যেন ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে সভ্যতার অদৃষ্টে।
লেখক পরিমল সেই মিলিয়ে যাওয়ার সুরটিকেই অনুসরণ করেছেন—চৌদ্দটি সর্গে সাজানো প্রকৃতির এক বেদনাময় ইতিহাস, এক নিকট ভবিষ্যতের সতর্কবার্তা।
“এবার বুঝি প্রকৃতি কথা বলছে, এতদিন মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করার পর: নদী পাহাড় কথা বলছে। পাখির কলতানে, ঝর্ণার নূপুর কিংবা নদীর মিঠে কল কল ধ্বনিতে নয়— মজ্জায় শীতল স্রোত বইয়ে দেওয়া জলের গর্জন আর গাছপালা বাড়িঘর সমেত সবকিছু হুড়মুড় করে ধ্বংস পড়ার শব্দে। মানুষের যুদ্ধং দেহি ডাকে সাড়া দিয়েছে অবশেষে।”
যদি প্রকৃতি মানব আচরণ অনুকরণ করে!
পরিমল এই গ্রন্থে শুধু নিজের ভাবনাই রাখেননি; পরিবেশবিজ্ঞান, মানবসভ্যতা, জলবায়ু–সংকট এবং প্রকৃতিবিষয়ক সাহিত্য থেকে বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থ ও গবেষনা তিনি সুচারুভাবে অনুবাদ ও সংকলন করেছেন। আমাজনের অরণ্য থেকে ইনুইটদের বরফঘেরা জনপদ, চেন্নাইয়ের জলকষ্ট থেকে চের্নোবিলের পরিত্যক্ত প্রান্তর—মানুষ ও প্রকৃতির ভাঙা সম্পর্কের এক বিশ্বব্যাপী মানচিত্র। গত দুই দশকের বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ যে ভবিষ্যতের ভয়াবহ রূপরেখা দেখাচ্ছে—উষ্ণায়নের লাগামহীন বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক বিলুপ্তি, খাদ্যব্যবস্থার দূষায়ণ, এবং পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল মানুষের জন্য অযোগ্য হয়ে ওঠা, সেসবই এখানে পুনরায় ও জোরালোভাবে স্পষ্ট হয়েছে।
পরিমল ভট্টাচার্য ছোট ছোট অনেক কিছুর সাথ পরিচয় করিয়ে দেন, যেটা হয়তো আদতে আমাদের চোখেই পড়েনা। আবার এই ছোট ছোট বিষয়গুলো কীভাবে একটা বিশাল বড় কিংবা সমগ্র পৃথিবী হয়ে উঠে সেটাও তিনি দেখিয়ে দেন। একারণে পৃথক একটি গাছ, গাছের গায়ে লেগে থাকা লাইকেন, বালুতে পড়ে থাকা পাথর সবকিছুই তার লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠে। সব থেকে বড় কথা তার লেখা পৃথিবীর সজীব প্রানের কথা বলে। ডোডোপাখিদের গান প্রকৃতি, সভ্যতা, পরিবেশ এবং জলবায়ু নিয়ে খুব দরকারি একটি বই। বিভিন্ন জনের বইয়ের খণ্ডিত অনুবাদ তুলে দিয়ে পরিমল ভট্টাচার্য প্রকৃতি এবং পরিবেশের জরুরি প্রয়োজনটুকু বোঝাতে চেয়েছেন। প্রকৃতি, পরিবেশ জলবায়ু এওবং সভ্যতা নিয়ে অনেক তত্ত্বকথার বই আছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু ডোডোপাখিদের গান মূলত প্রকৃতির হারিয়ে যাওয়া গানকে অনুভব করতে শেখায়। এখানে ইস্টার আইল্যান্ড, চেরনোবিল, ভোপাল কিংবা নেভাডার মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যের কথা যেমন আছে তেমনি গেভিতাস আর ভূটানের মতো সম্ভাবনার কথাও আছে। মানুষ যেমন ধ্বংস করে ফেলছে, চাইলে মানুষ সৃষ্টিও করতে পারে- হয়তো একথাই লেখক বলতে চেয়েছেন। এই বইয়ের মূলসুর যদি পাঠক অনুভব করতে পারে, হয়তো সেও তাহলে প্রকৃতি এবং পরিবেশ নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা ভাবতে পারবে।