১১ জানুয়ারি ২০০৭। বিকেলে বঙ্গভবনে মঞ্চস্থ হলো রুদ্ধশ্বাস নাটক। হঠাৎই বদলে গেল দেশের হালচাল। ক্ষমতায় এলো সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। লাইনচ্যুত গাড়ি ফের লাইনে তুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে সরকার হাত দিলো অনেকগুলো কাজে, যা প্রশংসা ও নিন্দা দুটোই কুড়িয়েছে। উথাল-পাথাল এই দুই বছর ছিলো ঘটনাবহুল। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো এ অধ্যায়। ১১ জানুয়ারির পালাবদলের ক্ষণটির নাম হলো ওয়ান-ইলাভেন বা এক-এগারো। প্রশ্ন হল - এই সেনা হস্তক্ষেপ কি বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের অনিবার্য পরিণতি, নাকি এর পেছনে ছিলো অনেক দিনের পরিকল্পনা? কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়া, নাকি ষড়যন্ত্র? লেখকের অনুসন্ধানী গবেষণায় ঐ সময়ের একটি সুরতহালের চেষ্টা করা হয়েছে এই বইয়ে।
জন্ম ১৯৫২, ঢাকায়। পড়াশোনা গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। ১৯৭০ সালের ডাকসু নির্বাচনে মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বিএলএফের সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দৈনিক গণকণ্ঠ-এ কাজ করেছেন প্রতিবেদক ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে। দক্ষিণ কোরিয়ার সুংকোংহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাস্টার্স ইন এনজিও স্টাডিজ’ কোর্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক। তাঁর লেখা ও সম্পাদনায় দেশ ও বিদেশ থেকে বেরিয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা অনেক বই।
এক এগারো বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ব্যাতিক্রমী অধ্যায়। ঠিক কোন কোন ঘটনাবলী এই পরিস্থিতির জন্ম দিল তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা দিয়েই শুরু হয়েছে বই। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকান্ডগুলো এবং ওদের তথাকথিত জনবান্ধব কর্মসূচীগুলোর বর্ণনা ও প্রভাবের কথা পাওয়া যায় এই অংশে। এরপরই এসেছে এক-এগারো অর্থাৎ ১১ই জানুয়ারি ২০০৭ এর সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের কথা। একদমই আচমকা ঘটে যাওয়ার পেছনে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিলো কিনা, কারা কারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং কারা প্রচ্ছন্ন ইন্ধন জুগিয়েছিল তার আভাসও ভালোভাবেই দিয়েছেন বইতে। ১১ এবং ১২ই জানুয়ারি রাজনীতির ইতিহাসে বেশ লম্বা দিন ছিলো। অনেক সমীকরণই বদলে গিয়েছিল এই দুদিনে। তাই এই সময়ের বহু প্রসঙ্গের বহু ঘটনা বলার চেষ্টা করেছেন যাতে করে এর মাত্রা এবং তৎকালীন কার কী প্রভাব ছিল তা পাঠকদের অনুধাবন করতে সুবিধে হয়। বইয়ের সবচেয়ে ভালো অংশও এগুলো।
একইসাথে এসেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথা। এই কাজে পুরোপুরি আধিপত্য বিস্তার করেছিল তৎকালীন সেনা কর্মকর্তারা। তারা নিজেদের নামে ক্ষমতা না নিয়ে একটা ছায়া সরকার তৈরি করে মূল ক্ষমতা কীভাবে নিজেদের কাছেই কুক্ষিগত করেছিল তার আলোচনা আছে। শুরুতে ড. ইউনূসকে দেয়া হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব। উনি তা ফিরিয়ে দিলে ফখরুদ্দীনকে এ পদে বসানো হয়। পরবর্তীতে আবার দেখা যায় ড.ইউনূসই রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছেন। এই দল গঠনের কাজে মাত্র তিনমাসেই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। ওদিকে তীব্রভাবে শুরু হয় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের উপর নির্যাতন। আটক হন দুই দলের প্রধান দুই নেত্রী। সংস্কারের নামে এই দুই দলকেই ক্ষমতার বলয় থেকে সরিয়ে ফেলার প্রক্রিয়াটাই "মাইনাস টু" নামে পরিচিতি পেয়ে যায়। যদিও মাইনাস টু এর পদক্ষেপ ব্যর্থ হয় কিন্তু এর প্রভাবটা পরবর্তী রাজনীতিতে রয়ে যায়। এই মাইনাস টু নিয়েও ভালো আলোচনা রয়েছে বইতে।
এই বইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বারী এবং মঈনের সাক্ষাৎকার। লেখক তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত নিয়েছেন। এই দুজন ছিলেন এক এগারোর অন্যতম কুশীলব। একজন তৎকালীন সেনাপ্রধান এবং অন্যজন ডিজিএফআই এর হর্তাকর্তা। তাদের মন্তব্যগুলো পরস্পরবিরোধী এবং অনেকটাই নিজের প্রতি বায়াসড। তবু এসব মন্তব্য অনেকগুলো পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করে।
এক এগারোর মেয়াদ খাতা কলমে হিসেব করলে দুবছরের মতো হবে। কিন্তু এই সময়টাই অনেক রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে যাওয়ার পেছনে একে মূখ্য কারণ হিসেবে দেখা হয়। তাছাড়া মাইনাস টু, বহিঃশক্তির প্রবল প্রভাবের ব্যাপারটা প্রকটহারে দেখা দেয় এর ফলে। সেনাবাহিনীকে আরো দলীয়করণ করে ফেলা এমনকি বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গেও অনেকে এর সংযোগ খুজে পান।
মহিউদ্দীন আহমদের বইগুলোর সুবিধা হচ্ছে এগুলো পড়ার জন্য তেমন কোনো প্রস্তুতি কিংবা আলাদা করে পড়াশোনা করা লাগেনা। তার বর্ণনাভঙ্গি সরল, ইতিহাসের ক্রান্তিকালীন সময়গুলোকে তিনি একটা সময়রেখায় ধারাবাহিক বিবরণ দিয়ে যেতে পারেন। এক এগারো নিয়ে লেখা বইয়ের সংখ্যা বেশি নয়। তার উপর মোটামুটি নিরপেক্ষ এবং পাঠযোগ্য বই আরো কম। এ কারণে এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করার জন্য মহিউদ্দিন আহমদ ধন্যবাদ পেতে পারেন। বইটা এক এগারো সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা দিতে সক্ষম।
(বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে অনেক বিষয়েই মিল দেখা যায় নানান প্রসঙ্গে। ড. ইউনূস সেবারে নাকচ করে দিলেও ভাগ্য তাকে শেষমেশ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়েই আসল এবং রাজনীতি যে তার বিষয় না তা তিনি বরাবরের মতোই এবারেও প্রমাণ করেছেন।)
বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছদ্মবেশে সেনাশাসন, শান্তিরক্ষা মিশন বন্ধের চিঠি ও সেনাপ্রধান পদে 'নোয়াখালী কানেকশন' - সবকিছু মিলেই মহিউদ্দিন আহমদের প্রায় ছয় শ পাতার বই ' এক-এগারো: বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮'।
জ্যােষ্ঠতা লঙ্ঘন করে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জুনিয়রকে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান বানানোর শুভারম্ভ জিয়াকে ডিঙিয়ে শফিউল্লাহকে চিফ অফ স্টাফ ঘোষণার মাধ্যমে। এই লঙ্ঘনকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসকে বদলে দেয়। আরও একটি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ সুখকর ফল বয়ে আনেনি। যার মাসুল এখন সারা বাংলাদেশকে রক্ত দিয়ে শোধ করতে হচ্ছে।
হাসান মশহুদ চৌধুরীর পর সেনাপ্রধান হওয়ার কথা লে.জে. (অব.) এ টি এম জহিরুল আলমের। কিন্তু তাকে সেনাপ্রধান করা হয়নি। সেনাবাহিনীর পদ-পদবি বন্টনে বড়ো ভূমিকা রাখতেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোটো ভাই সাবেক মেজর সাঈদ এস্কান্দার। তিনি মইন ইউ আহমেদের নাম সুপারিশ করেন। দুইটি বিশেষ যোগ্যতায় জহিরুল হককে পেছনে ফেলে সেনাপ্রধান হন মইন। এক. তিনি সাঈদ এস্কান্দারের ভায়রা অর্থাৎ পিএম বেগম জিয়ার আত্মীয় এবং দুই. জেনারেল মইনও বৃহত্তর নোয়াখালীর সন্তান। সেনাবাহিনীতে মইনের চাইতে বিশ্বস্ত বেগম জিয়ার কেউ ছিল না। এই মইন কখনো বিএনপি ও বেগম জিয়ার সাথে প্রতারণা করতে পারে তা তিনি হিসাবে আনেননি।
'নোয়াখালী কানেকশন' ব্যবহার করে আরও একজন সেনাবাহিনীতে প্রবল প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন। তিনি হলেন লে. জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি সেনাবাহিনীর নন। মূলত, রক্ষীবাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া একমাত্র কর্মকর্তা মাসুদ, যিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেলের মতো বড়ো পদে এবং সাভারের নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। এই ডিভিশনকে ঢাকার সদর দপ্তরের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে অলিখিতভাবে বিবেচনা করা হয়৷ লে. জে. মাসুদ দুইটি কারণে রক্ষীবাহিনী নিয়ে বিএনপির এত অভিযোগ, ক্ষোভ ও অবিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি পেয়ে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন।
এক. তিনি বেগম জিয়ার ভাই সাঈদ ইস্কান্দার অত্যন্ত অনুগত ও ঘনিষ্ঠ এবং
দুই. তার জন্মস্থান ফেনীতে। যা বেগম জিয়ার নির্বাচনি এলাকা
জেনারেল মইন ও লে. জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী - এই দুইজন ব্যক্তি এদেশে ২০০৭ সালে পরোক্ষ সেনাশাসন ও পরবর্তী নির্বাচনে একটি দলকে জয়ী করতে এক ধরনের ভূমিকা রাখেন। মহিউদ্দিন আহমদ সরাসরি এই কথা লিখতে পারেননি। কিন্তু যা বলেছেন তার মানে এটাই দাঁড়ায়। অথচ এই দুজনকে এক ধরনের স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল এবং তারাই সময়মতো তাদের পদোন্নতিদাতার সঙ্গে বেইমানি করে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে এত ভয়-ভীতির সূচনা ২০০৭ সালে। একটি চিঠির মাধ্যমে। তখন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক ছিলেন রেনাটা লক। সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ দাবি করেন, রেনাটা লক একটি জরুরি চিঠি সেনাপ্রধানকে পাঠান। সেই চিঠিতে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত রুখতে ব্যর্থ হলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশকে আর অংশগ্রহণ করতে দেবে না - এমন হুমকি ছিল।
এই ভয়াবহ সংবাদ পেয়ে অস্থির সেনাপ্রধান, নৌপ্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধান, পুলিশ, বিজিবি, Rab ও সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেলদের নিয়ে একটি জরুরি সভা আহ্বান করেন। এই সভায় আবেগভরা কণ্ঠে সেনাপ্রধান মইন বলেন,
আমরা যদি এখন হস্তক্ষেপ না করি তাহলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের বাহিনীগুলো সুযোগ হারাবে। তিনি যুক্তি দেন, আজীবন চাকরি করে যা পাই তার চাইতে ��নেক বেশি পাই শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়ে। যদি আমাদের মিশনে যাওয়া বন্ধ হয় তাহলে বাহিনীগুলোতে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ দেশের বাইরে সুনাম নষ্ট হতে পারে। তাই আমাদের উচিত হস্তক্ষেপ করা।
প্রমাণ হিসেবে রেনাটা লকের চিঠি নিয়ে আসেন সেনাপ্রধান। যদিও সেই চিঠি সভায় উপস্থিত কেউ খুলে দেখেননি। এই চিঠির পর মোটামুটি সবাই ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে জোর করে সরিয়ে দিতে সম্মত হয়। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তাদেরকে সব ধরনের সমর্থন দেন স্বয়ং 'নোয়াখালী কানেকশন'-এর মাধ্যমে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ও নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী।
বিএনপির অদূরদর্শিতা, ইয়াজউদ্দিনকে 'ইয়েসউদ্দিনে' পরিণত করা - তাদেরকে ক্ষমতার গদি থেকে দূরে ছিটকে ফেলে। তাদের 'মাই ম্যান' সেনাপ্রধান মইন পরোক্ষভাবে ক্ষমতা দখলের পর দলটির মনোবল ভেঙে পড়ে। ইউনূস সাহেব হঠাৎ রাজনীতি নিয়ে সরব হলেন। বিবৃতি দিতে থাকলেন। দল গঠনের প্রস্তুতির কথা জানালেন এবং অনেকটাই যেন তা সেনাবাহিনীর আরশতলে। তাকেই পহেলা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার আমন্ত্রণ জানায় সেনাবাহিনী। তখনকার ডিজিএফআইয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার আমিন ঘন্টার পর ঘন্টা ইউনূস সাহেবকে 'ম্যানেজ' করার চেষ্টা করেন। কিন্তু 'সময় কম' পাবেন - এই ভেবে তিনি রাজি হয়নি। অবশ্য দুই বছর ক্ষমতা থাকা যাবে তা তখন সেনাবাহিনী জানতো না। এরশাদের মতো 'হোমওয়ার্ক' করে তারা গদি দখল করেনি। তাই ফখরুদ্দীনকে প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং তিনি খুশিমনে রাজি হয়ে যান।
ইয়াজউদ্দিনের নিস্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সেনা-নির্দেশিত নতুন সরকারের সাথে এক ধরনের ভাব-ভালোবাসার নিয়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু বিএনপি গোস্বা করে বসে থাকে৷ তারা ফখরুদ্দীনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বর্জনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সাথে শীতল লড়াইয়ে নামে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে মাত্র ৩৩ টি আসন পেয়ে ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েই থামে।
মইন ইউ আহমেদসহ সেনাবাহিনীর বড়ো কর্তারা বিএনপি নিয়ে স্বস্তিতে ছিলেন না। তারা মনে করতেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে এলে ওয়ান-ইলেভেনের জন্য বেগম জিয়া তাদেরকে দেখে নেবেন। সেই বিবেচনায় আওয়ামী লীগ তাদের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ আশ্রয় ছিল। যদিও দুইটি দলের প্রধানকেই তারা সরিয়ে দিতে চেয়েছেন। দলগুলোর নেতাকর্মীদের গণহারে মামলা ও বড়ো নেতাদের মারধর করা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি। সেই সব স্বীকারোক্তি এখনো ইউটিউবে পাওয়া যাবে। উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া একটি তারবার্তার উদ্ধৃতি দিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদ ইউএসে যান একটি সফরে। সেখানে তার সাথে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি দীর্ঘ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন, গওহর রিজভী। এই রিজভী সাহেব ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার পদ অলঙ্কৃত করেন।
সেনাপ্রধানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আরও একটি 'মিসিং লিঙ্ক' পাই ভারতের প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীতে। তিনি সেখানে স্পষ্ট লিখেছেন, সেনাপ্রধান মইন ভারতে যাওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণববাবুর সঙ্গে তার কথা হয়। তিনি দুই নেত্রীকে ছেড়ে দিতে বলেন এবং নিশ্চয়তা দেন, শেখ হাসিনা মইন ইউ আহমেদকে মাফ করে দেবেন।
শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে চিঠিটি ছিল ভুয়া। রেনাটা লক পরবর্তীতে দাবি করেন, ভয় দেখিয়ে এমন কোনো চিঠি কস্মিনকালেও তিনি দেননি এবং এই বিষয়ে কিছু জানেন না। অন্যদিকে, মহিউদ্দিন আহমদকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অনেক কিছুই বলেছেন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ। তার কথা হলো, শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ দেওয়ার ভয় দেখিয়ে চিঠি রেনাটা লক পাঠিয়েছিলেন। তার কাছে চিঠির অনুলিপি আছে। যদিও তা মহিউদ্দিন আহমদকে তিনি দেখাননি।
এক-এগারো নিয়ে বইটির তথ্যের প্রধান উৎস সাক্ষাৎকার ও সেই সময়ে প্রকাশিত পত্রিকার সংবাদ। ডিজিএফআইয়ের বিগ্রেডিয়ার বারী, সেনাকর্মকর্তা জহিরুল আলম ইত্যাদি ব্যক্তির সাক্ষাৎকার থেকে অনেক কিছুই জানা গেছে। রাজনীতি কোন পরিস্থিতিতে গেলে সেনাশাসন ফরজ হয়ে ওঠে তা বুঝতেই বইটি পড়ি। পটভূমি বোঝা গেছে। সব সত্য ও তথ্য জানা যায়নি। লে. জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী সেনাবাহিনী-নির্দেশিত সরকারের অন্যতম ভিত ছিলেন। ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দীন, বারীসহ এক-এগারোর অনেক কুশীলব দেশের বাইরে নিরাপদ জীবনযাপন করছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি ২০১৮ সাল থেকে টানা দুইবার জাপার মনোনয়নে ফেনী-৩ থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন। অর্থাৎ, ক্ষমতারসঙ্গী তিনি তখনো ছিলেন, এখনো আছেন। তার বয়ান ছাড়া এক-এগারো আধুরা। ফখরুদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎকার দরকার ছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংস্কারপন্থি ও নেত্রীপন্থি সিনিয়র নেতাদের সাক্ষাৎকার থাকলে আরও কিছু জানতে পারতাম।
সামরিক আমলাদের পাশাপাশি সেই সময়ে উচ্চপদে থাকা বেসামরিক আমলাদের সাক্ষ্য থাকতে পারতো।
এক-এগারোর সময় মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনাম অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। প্রথমা বইটির প্রকাশক। মহিউদ্দিন আহমদ কেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বয়ান জানতে চাননি তা আমাকে অবাক করেছে৷
'এক-এগারো' বইটি এখন পড়া প্রয়োজন। কোন পটভূমিতে দেশে সেনাশাসন আসে তা বোঝা জরুরি। কাদের কর্মকাণ্ড দেশ থেকে বেসামরিক সরকারকে নির্বাসিত করে তা-ও অনুধাবন করতে চাইলে বইটা পড়তে পারেন।
ছয় শ পাতার বইটিকে মহিউদ্দিন আহমদ চাইলেই সর্বোচ্চ চার শ পৃষ্ঠায় মলাটবন্দি করতে পারতেন। সাক্ষাৎকারগুলোর কিছু কথা একাধিকবার এসেছে ; পাতার পর পাতা ভরিয়েছেন পত্রিকার সংবাদ ও ছবি দিয়ে। নিজস্ব বিশ্লেষণের চাইতে কে, কী বললো - তা সংগ্রহ করে রাখতেই মহিউদ্দিন আহমদের ঝোঁক বেশি লক্ষ করেছি।
২০০৭ সালের সেনাশাসন নিয়ে ভালো বই নেই। মওদুদ আহমদের বইটা মন্দের ভালো৷ মহিউদ্দিন আহমদের এই ঢাউস কিতাব তবুও পড়তে পারেন৷
লেখক এক-এগারোর একটা সিনারি আঁকার চেষ্টা করেছেন। ওই সময়ে কী হয়েছে, মূল ভূমিকা কারা প্লে করেছে, রাজনৈতিক সংস্কার কীভাবে হয়েছে বা করার চেষ্টা হয়েছে - এসবই।
সার্বিক ভাবে যারা ওই সময়ের ঘটনাবলির সাথে ওয়াকিবহাল নয় তারা একটা ধারণা পাবে। এক-এগারোর প্রেক্ষাপট, মোহাম্মদ ইউনূসের প্রধান উপদেষ্টার পদ না নেওয়া এবং পরবর্তীতে নিজের দল তৈরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া, রাজনৈতিক ধরপাকড়, উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তাদের মনস্তত্ত্ব, প্রধান দুই নেত্রীকে বাদ দেওয়ার সেই 'মাইনাস টু' ফরমুলা এবং সবশেষে আপাত দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর - সবই আছে বইতে।
মোটা দাগে ওই সময়ের, ভেতরে কী চলছিলো সবকিছুর একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব - কিন্তু ভেতরের খবর গুলোর আসলেও কতটা সত্য তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায় - এর কারণ লেখক ঘটনা গুলোর অনেকটাই তুলে ধরেছেন ওই সময়ে মূল চরিত্রদের অনেকের ইন্টারভিউ নিয়ে। এসব ইন্টারভিউ গুলোর বক্তব্য গুলো কতোটা সত্য তা নিশ্চিত ভাবে বলার উপায় নেই আসলে। যেমন জেনারেল মইন ইউ আহমেদ এর কিছু বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পাওয়া যায় অন্য কারো বক্তব্যের।
মহিউদ্দিন আহমেদ তাঁর অন্য বই গুলোর মতোই নিজে কোনো মতামত দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। পেপার, ইন্টারভিউ, রাষ্ট্রদূতদের পাঠানো বিভিন্ন ফ্যাক্সের দলিল প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে ঘটনা গুলোর একটা চিত্র এঁকেছেন।
The writing is really good. The writer planned the chapters in such a way that helps the flow of the writing while not disrupting the integrity of the events. There are some questions about the neutrality of some parts of the book but at the end of the day the almost none can bring the huge scale of events in his book. So, the readers will see the history through the lenses of the writer and the writer's own perception effects his writing whether he likes it or not. Taking into all of these things into account i must say it's a must read for anyone who wants to know about the 1/11 and the people who played a part in it.
DNF...... What an utterly boring book! Came up to 260 pages and gave up. Series of interviews and newspaper reports and stating of dates and events do not make for enthralling reading especially when the book is trying to describe events of a very turbulent episode. One expected more comments from the writer on who had said what to him. Maybe people who were too young in 2007 will get a chance to brush on the famous/infamous one-eleven.
এক-এগারোর এবং তৎপরবর্তী ইতিহাস নিয়ে রচিত একটি সুখপাঠ্য বই। একই লেখকের ‘বিএনপি সময়-অসময়’ বইয়ে এ সংক্রান্ত আলোচনা সংক্ষেপে গেলেও এ বইটিতে বিস্তারিত এসেছে। লেখক তুলনামূলক নিরপেক্ষ যেটা পাঠকমাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন। সাক্ষাৎকারের উপর বেশি নির্ভর করায় অনেক সময় বিরক্তি আসতে পারে। তবে সে সময়ের অনেক অজানা ইতিহাস বইয়ের পাতায় পাতায় উঠে এসেছে। উদ্দীনদের (ইয়াজউদ্দীন, ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দীন) শাসনামল সম্পর্কে জানতে নির্ভরযোগ্য একটা বই বলা চলে।
সেই সময়কার কুশীলব দের সাক্ষাৎকার গুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বইটা কি বিশ্লেষণের দিকে যেতে পারছে? তরতর করে পড়ে যাওয়া যায়, সাক্ষাৎকার গুলো ইন্টারেস্টিং। কিন্তু অনেক জায়গায় মনে হলো অকারণে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পত্রিকা থেকে তুলে দেওয়া গোলটেবিল বৈঠকের ধারা বিবরণী। লেখকের মূল্যায়ন নাই, লেখক বরং বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু কী অবস্থা, ওই সময়টা নিয়ে সেরকম বইপত্র আর কোথায়?
বইটি খুবই অসাধারণ। লেখক অনেক পরিশ্রম করে লিখেছেন। অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যারা ভবিষ্যতে ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করতে চায় তাদের জন্য এই বইটি একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হতে পারে।
তবে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার অত্যন্ত দীর্ঘ ছিল যা অনেকটা ক্লান্তিকর মনে হয়েছে।