ভারতীয় সাংবাদিক Asoka Raina ( অশোকা রায়না, নাকী অশোক রায়না?অনুবাদক অশোকা রায়না লিখেছেন) "ইনসাইড 'র' " নামে বইটির বাংলায় অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন আবু রূশদ। নামকরণের মাধ্যমেই বোঝা যাচ্ছে লেখক ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-য়ের ভেতরের তথ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইটি মূলত, ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় ইংরেজিতে। আর বাংলাতে ১৯৯৪ সালে। বর্তমান হিসাবে বেশ আগের বই। কিন্তু অশোকা রায়নার বইটির আবেদন প্রকাশকালের গন্ডিতে বাঁধা দুষ্কর। রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং তথা 'র'- একটি গুপ্তচর সংস্থা- তা মোটামুটি সবাই জানেন। অশোকা রায়না বই লিখেছেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কীর্তিকলাপ নিয়ে। তিনিনি আগে পাঠককে ধারণা দিতে চেয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থা বলতে আসলে কী বোঝায়। এজন্য তিনি দারস্থ হয়েছেন বিষ্ণুশর্মা,যিনি কৌটিল্য তথা চাণক্য নামে সমাধিক খ্যাত তার কাছে। চাণক্য রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে গুপ্তচরবৃত্তির ওপর জোর দিয়েছিলেন এবং গুপ্তচরকে চারশ্রেণীতে ভাগ করেছিলেন। চীনের সান জু তাঁর "Art Of War" বইতে গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে লিখেছেন। অবশ্য অশোকা রায়না সান জু'র বইটির নাম "Practice Of War" বলে উল্লেখ করেছেন।মোজেস নিজেও গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলেছেন বলে দাবি লেখকের।এসব লিখে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন গোয়েন্দা সংস্থা আধুনিক কালের সৃষ্টি নয়। ইন্টেলিজেন্স আর গুপ্তচরবৃত্তি কে এক ভাবতাম আমি। সে ভুল ভাঙালেন লেখক।সেই সাথে জানিয়েছেন,প্রাচীন এবং বর্তমান ভারতের সকল রাষ্ট্রদূত হলেন সম্মানিত গুপ্তচর। ব্রিটিশ সরকার দেশভাগের প্রাক্কালে সিমলায় হাজার হাজার নথি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। কারণ সেগুলোতে দেশীয় রাজা-মহারাজাসহ গণ্যমান্যদের নানা কীর্তির প্রমাণ ছিল। এসব প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ইংরেজ সরকার এদেশীয় এলিটক্লাসকে একপ্রকার হাতের মুঠোয় রাখত।সেসব নথির সাথে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ইংরেজ সরকারের সোর্সদের নথিও।যাতে স্বাধীন দেশে ইংরেজদের দোসরদের কোনপ্রকার হেনস্তা হতে না হয়।কিংবা এও হতে পারে, প্রশাসনে থেকে যেন তারা সাবেক প্রভুদের আগের মতোই তথ্যসেবা দিতে পারে। ঠিক কীভাবে শূন্য থেকে ভারতীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হয়েছে তার ইঙ্গিত দিতে 'র'- গঠনের পটভূমি নিয়ে খানিকটা লিখেছেন অশোকা রায়না। তা অবশ্যই একজন ভারতীয়র দৃষ্টিকোণ থেকে। '৪৭ এ ব্রিটিশ সরকারের আইবি(Intelligence Bureau)-র সবচেয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা গোলাম মোহাম্মদ পাকিস্তানে চলে যান।ভারতে আইবির দায়িত্ব নেন সঞ্জীব পিল্লাই। জনাব পিল্লাই দায়িত্ব নেয়ার পরই একেরপর এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন বললে ভুল হবে না।সত্যি বলতে কি, ১৯৬৮ সালের 'র' প্রতিষ্ঠার আগপর্যন্ত ভারতকে বেশ বড় কিছু ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে দ্বন্দ্ব, হিন্দি-চীনি ভাই ভাই হতে '৬২ সালে শালা শালা বনে গিয়ে চীনের হাতে মার খাওয়া আর '৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ ভারতকে আইবি বিভাগকে আরো সমৃদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দেয়- বলেই সাক্ষ্য দিচ্ছে "ইনসাইড 'র' "। তবে তাই বলে সঞ্জীব পিল্লাই হাত গুটিয়ে বসেছিলেন না।প্রমাণ- ' গুপ্তচরবৃত্তির জাল ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আরো অনেক নতুন লোককে নিয়োগ করেন।.১৯৫২ ও ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে ( করাচী,লাহোর,ঢাকা) ও বার্মা ও সিলোনে (বর্তমান শ্রীলংকা) আরো নতুন 'আউটপোস্ট' খোলা হয়। ' জওহরলাল নেহেরু একটি গোয়েন্দা সংস্থা গড়ে তুলতে চাইলেও তা পারেননি। সাফল্য আসে ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে।সাথে ছিলেন তার মুখ্যসচিব পি এন হাকসার। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে এই সংস্থার অনুমোদন দেন। তখন নাম নির্ধারণ করা হয় Research And Analysis Wing তথা R&AW। যা সাংবাদিকদের কলমের বদৌলতে দাঁড়ায় RAW 'র'। প্রথমদিকে খোদ ইন্দিরার সরকারেই 'র' নিয়ে কানাঘুষা ছিল।অনেকেই এই বাহিনীকে গান্ধীর 'ব্যক্তিগত বাহিনী' ভাবত।অবাক করার মতো তথ্য জানিয়েছেন লেখক। তাঁর মতে, তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চ্যাবনও খুশি ছিলেন না 'র' নিয়ে। এরপর শুধুই একটি গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে 'র'-য়ের এগিয়ে যাবার খবর।এসপিওনাজের, ইন্টেলিজেন্সের জাল বিস্তারের ঘটনা। রামেশ্বর নাথ কাও ও শংকর নায়ার এই নাম দু'টি 'র'-য়ের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। ১৯৬০ সালে ঘানা স্বাধীন হলে (উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে ১৯৫৭ সালে ঘানা স্বাধীন হয়) ঘানার প্রেসিডেন্ট নক্রমা নেহেরুর কাছে নিজ দেশে গোয়েন্দা সংস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য চান।নেহেরু আইবির দুই ঝানু কর্মকর্তা আর এন কাউ ও নায়ারকে ঘানায় পাঠায়। বলতে গেলে, এই দুইজন মিলেই ঘানার গোয়েন্দা সংস্থা গড়ে দেন। ইন্দিরা গান্ধী এবার নিজ দেশের গোয়েন্দা সংস্থা গড়ে তোলার ভার দেন কাওয়ের ওপর, সাথী নায়ার। 'র'-য়ের প্রতিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার মতো এটিও কীভাবে নিজের জাল বিস্তার করেছে, এই সংস্থার সদস্যদের প্রশিক্ষণকালীন সময়ে কী রকম রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা নিয়ে বেশ আগ্রহজাগানিয়া তথ্য দিয়েছেন অশোকা রায়না। কথাপ্রসঙ্গে 'র' এর কিছু সফল অভিযানের কথা উঠে এসেছে যা পড়তে গিয়ে বেশ নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছি। গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে যখন সাবেক সোভিয়েটের কে জি বি, যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, যুক্তরাজ্যের এমআই-১৬,শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের আইএসআই সহ অন্যান্য দুর্ধর্ষ সংস্থা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তখন 'বাংলাদেশ অপারেশন'-এর মাধ্যমে নিজেদের জানান দিয়েছে 'র'। বাংলাদেশ নিয়ে দুইধাপে কাজ করেছে সংস্থাটি। স্বাধীন হবার আগে ও মুক্তিযুদ্ধসহ তার পরে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে তৎপর 'র'। প্রমাণ - ' কিন্তু ততোদিনে ভারতীয় এজেন্টরা পূর্ব পাকিস্তানের 'মুজিবপন্থি' (Pro Mujib) একটি অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে।আগরতলায় ১৯৬২-৬৩ সালে ভারতীয় এজেন্ট ও 'মুজিবপন্থীদের' মধ্য অনুষ্ঠিত বৈঠকে পরবর্তী গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ' অশোকা রায়না দাবি করেছেন, মেনন (শংকর নায়ারের ছদ্মনাম) মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ফ্রন্টে ঘুরে ঘুরে কেন্দ্র খুলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছেন।'র'- এর এই চিন্তানায়কের সাথে ওসমানী, খালেদ মোশাররফ, কাদের সিদ্দিকী,শফিউল্লাহর সাথে ভালো যোগাযোগ ছিল বলেও দাবি লেখকের। 'র'-এর নেটওয়ার্ক কতটা বিস্তৃত ছিল তার প্রমাণ - ' একজন নেতৃস্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ পাকিস্তানী কর্মকর্তা যিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন: তিনি 'র' এর অপারেটরদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপাচার করেন।' 'র'- জানত ২৫ শে মার্চ পাকবাহিনী কী করতে যাচ্ছে। অশোকা রায়নার লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে 'র' জানিয়েছিল ভয়ানক কিছু ঘটবার কথা। 'র' তাঁকে পালিয়ে যাবার অনুরোধ করেছিল বারবার। কিন্তু তিনি আত্মগোপন করতে রাজি হয়নি।রায়না লিখেছেন, ' তারা দীর্ঘ বারো ঘন্টা ধরে শেখ মুজিবকে ঢাকা ত্যাগ করার অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু মুজিব জেদের সাথে ঢাকা ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নেন। ' লেখকের স্বরে বোঝা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তে খুশি হয়নি 'র'। সংস্থাটি নাকী মুক্তিসেনাদের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল বলে দাবি করে লিখেছেন- ' 'র'- এর পূর্বপাকিস্তান সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গোপনীয় আশ্রয়স্থান 'মুক্তিফৌজ'কে পর্যাপ্ত আশ্রয় প্রদান নিশ্চিত করে।' এমন কি নিজেদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা নিয়ে সংস্থাটি এতই গৌরব অনুভব করে যে, মুক্তিবাহিনীকে 'যোদ্ধাবাহিনীতে' পরিণতকরণে 'র'-এর ভূমিকা নিয়ে পরিপূর্ণভাবে লেখা হয়নি বলে তাদের বড়ই আফসোস হয়!!! স���বাধীন বাংলাদেশে এই সংস্থার কার্যকলাপ অনেক বৃদ্ধি পায়। তৎকালীন সরকার বেকায়দায় পড়তে যাচ্ছে এই খবর তাদের হাতে ছিল। এমনকি মেজর জিয়ার বাসায় ফারুক,রশিদ আর ওসমানী সেনা অভ্যুত্থান ঘটনো নিয়ে আলোচনা করেছে বলেও তারা তথ্য উদ্ধার করে। এদিকে 'র' প্রধান কাও ব্যবসায়ী সেজে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তাঁকে অভ্যুত্থানের কথা জানালো তিনি তা উড়িয়ে দেন বলে দাবি রায়নার।বাংলাদেশে 'র'- এর প্রভাব কতটা তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া যখন ভারতে যান,তখন ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ নিয়ে জানলে চাইলে জিয়া কাওকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ' যতটুকু আমি না জানি, তার চেয়েবেশি জানেন এই ভদ্রলোক- আমার দেশ কীভাবে চলছে।" এরপর সিকিম কীভাবে ভারতের ২২ তম রাজ্য হিসেবে ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে হাতে আসে সেই ঘটনা লিখেছেন রায়না। চীন আর যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালিয় সিকিমবাসীকে যেভাবে ঠকাতে সাহায্য করেছে 'র'- তা অনেকটাই গোয়েন্দা কাহিনীকে হার মানাবে। নেতাদের টাকা দিয়ে কিনে নেবার সরল স্বীকারোক্তি বেশ অবাক করে। সেই ইংরেজআমল থেকে নিপীড়িত এক জনপদ সিকিমে বিভেদ সৃষ্টি করে 'র'-ভারতের প্রদেশ একটি বাড়িয়ে দেয় এবং নিজেদের ঝুলিতে আরেকটি সাফল্য যোগ করে। যেমনটি ভারত বোকা বানিয়েছিল ১৯৭৪ সালে। পারমাণবিক পরীক্ষার সময়। সারা পৃথিবীকে অন্ধকারে রেখে পারমাণবিক বোমার অর্জন সম্পন্ন করে। কেউ নিশ্চিত হতে পারেনি। এসবই সম্ভব হয়েছে 'র'- এর কারণে। সবসময় 'র'-এর সুসময় যায়নি। ১৯৭৭ সালের জনতা সরকার ক্ষমতায় এসে 'র' এর টুঁটি চেপে ধরে।প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই 'র'-এর জয়রথ থামিয়ে দেন।পদত্যাগ করেন কাও ও নায়ার।বেশকিছু ভুল অপারেশনও করে 'র'।আবার গান্ধী সরকার এসে 'র'-কে তার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করে- ভুলে যাবেন না বইটা ১৯৮১ সালে লেখা। আবু রূশদের অনুবাদ খুববেশি সুখপাঠ্য নয়। মাঝেমাঝে খাপছাড়া লাগছিল। আর তথ্যঘাটতি না, বরং বলবো অশোকা রায়না 'র'-কে একটি আলাদা উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন বইটির মাধ্যমে। কিন্তু একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে তিনি তা পারেননি। আরো হালকা বিষয়গুলো স্পর্শ করতে করতে বই শেষ হয়ে গেল। হয়তবা 'র'- কে নিয়ে,সংস্থারটির কার্যকলাপ নিয়ে লোকে বেশিবেশি ভাবুক তার সুযোগ তিনি দিতে চাননি। হতে পারে, গোয়েন্দা সংস্থা স্পর্শকাতর ইস্যু তাই তিনি লিখতে গিয়েও লিখেন নি। কেননা বইটা কয়েকবার কথাটা আছে যার যতটুকুজানা দরকার,তার ততটুকু জানলেই হবে। তবুও বলবো এটি একটি ভালো বই। পড়ার মতো বই।
একটা তথ্যবহুল এবং বোরিং বই। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পাওয়া যায়। Not Highly Recommend. কিন্তু হাতে প্রচুর সময় থাকলে একটু পড়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। একেবারেই মন্দ হবে না বিষয়টি