কলকাতায় ছড়িয়ে থাকা আপাতভাবে সম্পর্কহীন চারজন মানুষের গল্প এই ‘অসম্পূর্ণ’। সাংবাদিকতা ছেড়ে নিজেকে পুরোপুরি রাজনীতিতে ডুবিয়ে রেখেছে আদিত। মানুষের জন্য কিছু করতে চায় সে। স্বার্থপর পৃথিবীতে কষ্টে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। নিজেকে রাজনীতিতে ডুবিয়ে দিলেও কোথাও পুরোনো জীবন ওকে ছেড়ে যায় না। যে ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিল সেই মেয়েটিকে মনে পড়ে ওর। ক্রমে জটিল হয়ে ওঠে ওর রাজনীতির জীবন। এবার একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হয় ওকে। স্মাহি সব ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছে। সংসারে কেউ আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। তবু চাকরি করে, একার চেষ্টায় বেঁচে আছে স্মাহি। একদিন আচমকা অতীত এসে অলক্ষ্যেই সামনে দাঁড়ায় ওর। স্মাহি বোঝে না এখান থেকে কোন দিকে যাবে সে। নিরমুক্তার ডিভোর্সের পরে ও আবার বিয়ে করতে চলেছে। চাকরিতেও উন্নতি করেছে খুব। তবু নিজের প্রাক্তন দেওরের কাছ থেকে একটা খবর পেয়ে কলকাতায় চলে আসে সে একজনকে খুঁজতে। আর এসে যেন খুঁজে পায় নিজেকেই। কিন্তু সেটা কি নিজে মেনে নিতে পারে? ঋত্বিজ কলকাতায় এসেছে নিজের জীবনের একটা রহস্য জানতে। নিজের ভেঙে যাওয়া বিবাহ, মায়ের মৃত্যু, নিজের জীবিকা, সব কিছু সরিয়ে সে খুঁজে পেতে চায় আত্মপরিচয়। কিন্তু সেটা কি শেষ পর্যন্ত পেল? আর এই চারজনের বেঁচে থাকার থেকে দূরে ঈশ্বর নামের এক পাগল নিস্পৃহ হয়ে লিখে যায় সবার গল্প। তবু শেষ হয়েও কি শেষ হয় সবকিছু? হারিয়ে গিয়েও কি সত্যি কিছু হারিয়ে যায়। ভালবাসা কি পারে জীবনকে পূর্ণ করতে? নিজেকেই নানান প্রশ্ন করতে করতে এগোয় এই গল্প। যে ভালবাসায় মানুষের জীবন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, সেই ভালবাসার কাছে পৌঁছবার কাহিনিই ‘অসম্পূর্ণ’।
স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯ জুন ১৯৭৬, কলকাতায়। বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। পৈতৃক ব্যবসায় যুক্ত। প্রথম ছোটগল্প ‘উনিশ কুড়ি’-র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত। প্রথম ধারাবাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত। শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার ২০১৪, এবিপি এবেলা অজেয় সম্মান ২০১৭, বর্ষালিপি সম্মান ২০১৮, এবিপি আনন্দ সেরা বাঙালি (সাহিত্য) ২০১৯, সানডে টাইমস লিটেরারি অ্যাওয়ার্ড ২০২২, সেন্ট জেভিয়ার্স দশভুজা বাঙালি ২০২৩, কবি কৃত্তিবাস সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩, উৎসব পুরস্কার ২০২৪, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড ২০২৪, আনন্দ পুরস্কার (উপন্যাস: '‘শূন্য পথের মল্লিকা') ২০২৫ ইত্যাদি পুরস্কারে সম্মানিত ।
স্মরণজিতের গল্পে প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, যৌনতা, রোমাঞ্চ সবই থাকে। কোথাও না কোথাও যেন গল্পটা আমাদের নিজেদের সাথে মিলে যায়, গল্পের মফস্বল শহরটা পরিচিত বলে মনে হয় অথবা অজান্তেই চরিত্রগুলোর পরিণতিতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অসম্পূর্ণ গল্পটাও এরকমই। অনেকগুলো চরিত্র ও তাদের জীবনের গল্প, একজায়গায় গিয়ে মিলে যায় সবাই। বাংলাদেশে বর্তমানে শরীফুল হাসান যেরকম লেখেন অথবা হুমায়ূন, জহির রায়হান যা করেছেন, কলকাতাতে এখন স্মরণজিৎ কনটেম্পরারী জনরাতে সেটাই করছেন।
“ I loved you like a man loves a woman he never touches, only writers to, keeps little photographs of. ”
নিজেকেই নানান প্রশ্ন করতে করতে এগোয় এই গল্প । যে ভালোবাসায় মানুষের জীবন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে , সেই ভালোবাসার কাছে পৌঁছবার কাহিনিই ‛অসম্পূর্ণ’ । শেষটা আরও সুন্দর , আরও অভিনব । লেখক পুরোটাই ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকদের ওপর, যে যার নিজের মনের মতো করে সম্পূর্ণ করে নিক ।
সব প্রশ্নের উত্তর মানুষ যদি নিজে জেনে যেত তাহলে জীবনে এমন বিপত্তি হত না! সে যে কেন প্রিয় মানুষের থেকে স্বেচ্ছায় দূরে থাকে সেটা সে নিজেও বোঝে না! নাকি বোঝে! তাহলে অভিমান, অহং পার করতে পারে না বলেই কি এভাবে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে প্রিয় মানুষের থেকে!"
"নিজের কাছে সত্যি হতে পারে না বলেই মানুষের এত কষ্ট! এত মন খারাপ!"
"বিশ্বাস, আমাদের একমাত্র albatross!...বিশ্বাস এমন একটা জিনিস যা সব কিছুর মধ্যে থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যায়, এগিয়ে নিয়ে যায়! আমাদের আবারও বাঁচার কথা বলে।"
হয়ত স্মাহি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে আদিতকে ফিরিয়ে নেবে জীবনে, তিজু আর মুকু মাঝের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে, তিজু খুঁজে পাবে ওর উত্তর আর লেখা হবে একটা নিটোল, সম্পূর্ণ গল্প কিন্তু ওই যে "অসম্পূর্ণতাই তো জীবনের প্রকৃত সত্য!" কে এই জগন,জগনের পরিচয়টা জানা হবে না আমাদের, যে খালি জিজ্ঞেস করলেই বলবে "আমি কেউ নই। জাস্ট আ শ্যাডো। রিটায়ার্ড!" অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে তার জীবনের গল্পটা আর শেষটুকু...
“ I loved you like a man loves a woman he never touches, only writers to, keeps little photographs of. ”
নিজেকেই নানান প্রশ্ন করতে করতে এগোয় এই গল্প । যে ভালোবাসায় মানুষের জীবন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে , সেই ভালোবাসার কাছে পৌঁছবার কাহিনিই ‛অসম্পূর্ণ’ । শেষটা আরও সুন্দর , আরও অভিনব । লেখক পুরোটাই ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকদের ওপর, যে যার নিজের মনের মতো করে সম্পূর্ণ করে নিক ।
স্মরঞ্জিত চক্রবর্তী মানেই প্রেমের উপন্যাস। আর এক্ষেত্রে এটি তার ব্যতিক্রম ও নয়। আদিত,মাহি,নিরমুক্তা, ঋত্বিজ, এই চারজনকে ঘিরে গল্পটি। রাজনীতি র মূলে থাকা নেতাদের যে ভালমানুসি আমরা দেখতে পাই, সেটার আড়ালে তারা যে কতবড় বিশ্বাসঘাতক সেটা প্রমান হয়ে গেছে রাজুদা নামক চরিত্র টি ঘিরে। যৌবনকালে মাহি তার থেকে প্রায় ২২ বছরের বড় একটি লোকের সাথে ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, এবং যথারীতি তার পরিণতি ও ভালো হয় না, তাই ছোটবেলায় মা, বাবা হারানো জেঠু র কাছে মানুষ হওয়া মাহি কে তার জেঠিমা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। সে কলকাতায় এসে নিজের জীবনটা মোটামুটি গুছিয়ে ও নেয়। তারপর ই তার দেখা হয় আদিত এর সাথে, যে আগে সবসময় তার পাশে ছিল ও মাহি কে প্রেম নিবেদন ও করেছিল,কিন্তু মাহি তখন ঝোঁকের বসে তাকে ফিরিয়ে দেয়। জীবনের এই চরম মুহূর্তে এসে সে তার ভুল বুঝতে পারে, বুঝতে পারে যে সে ঠিক মানুষ কে চিনতে পারেনি। আদিত ও নিজের পরিবারের আর্থিক অবনতি, রোজগার ঘিরে রাজনীতির এক জটিল অংকে জড়িয়ে পড়ে,তবুও সে ভুলতে পারে না মাহি কে। তারপর একসময় তাদের দেখা ও হয়ে যায়। নিরমুক্তা আর ঋত্বিজ এর বিয়ে হয়েছিল,খানিকটা মুকু অর্থাৎ নিরমুক্তা র বাড়ির অমতেই। কিন্তু বিয়ের পর নিজেদের সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জেরে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তবুও মন থেকে কেউ ই কাউকে মুছে ফেলতে পারে না। মাঝে তিজু অর্থাৎ ঋত্বিজ , মার মৃত্যুশয্যায় বলে যাওয়া কথা অনুসারে নিজের বাবা কে খুঁজতে কলকাতায় আসে একরকম কাউকে না জানিয়ে এই। তাই তার ভালই দীপন মুকুকে অনুরোধ করে সে যেন একটু কলকাতাতে খুঁজে দেখে তিজু কোথায়। কিন্তু অনেক খুঁজেও যখন সে ব্যর্থ, ঠিক তখন ই তিজুর কাছের লোক জগণ এর মাধ্যমে মুকু তার খোঁজ পায়। এখন জগণ র পারদর্শীতা দেখার মতো। সে ঠিক তিজু কেও নিজের আসল বাবার সন্ধান দেয় ও মুকুর সাথে দেখাও করিয়া দেয়। একটা happy ending দেখা যায়। এটিও স্মরঞ্জিত চক্রবর্তী র অন্য সব উপন্যাসের মতো মন ভালো করে দেওয়া আরো একটা উপন্যাস। রেটিং : 🌠🌠🌠🌠
গল্পটি সত্যি অসম্পূর্ণ। চিরাচরিত ভাবে সমাপ্ত হলো না। পাঠকের মনে আশা জাগিয়ে দিয়ে বলে হয়তো সব ঠিক হবে। প্রতিটি চরিত্রএর সাথে নিজেদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আদিতের মতো এরকম অনেকে যারা লোকের ভালো করার জন্য রাজনীতিতে যোগ দেয় কিন্তু রাজনীতির সেই চোরাবালি তাকে বা তাদেরকেও ক্রমাগত গ্রাস করার চেষ্টা করে যায়। যাই হোক পছন্দের একটি বই।