ঊনবিংশ শতকের সত্যিকারের ক্রাইম কাহিনী পড়ার সুযোগ হয়েছিল সেকালের দারোগা কাহিনী, বাঁকাউল্লার দপ্তর কিংবা মিঁয়াজান দারোগার একরারনামা বইগুলোর মাধ্যমে। সেসময়ের পুলিশ কিংবা আইন ব্যবস্থা তথা সামাজিক দলিল বলা যায় এর প্রত্যেকটিকেই। দারোগার দপ্তর নামে একই ধাঁচের আরেকটি সাহিত্যকর্মের যে অস্তিত্ব আছে তাই জানতাম না দীর্ঘদিন। জানলাম কৌশিক মজুমদারের উপন্যাস সূর্যতামসী থেকে। সেই গোয়েন্দা উপন্যাসে বাস্তবের সরকারী গোয়েন্দা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র। তাই দারোগার দপ্তর বইটির সন্ধান পাওয়া মাত্র সংগ্রহ করতে এবং পড়তে তর সইছিল না।
দারোগার দপ্তর অবশ্য পূর্বোল্লিখিত বইগুলোর মতো একেবারে নিখাদ ননফিকশন নয়, যদিও এর অধিকাংশ কাহিনীই বাস্তব। ১৮৫৫ সালে চুয়াডাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় দীর্ঘদিন পুলিশ বিভাগে কাজ করেছেন। ডিটেকটিভ পুলিশ হিসেবে তার কর্মকালীন বিভিন্ন অপরাধের সূত্রানুসন্ধান নিয়েই মূলত তিনি দারোগার দপ্তর নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন জ্যৈষ্ঠ,১২৯৯ সাল হতে। তবে এতে নিজের অনুসন্ধান করা অপরাধ কাহিনী ছাড়াও অন্যদের কাছে শোনা অপরাধ অনুসন্ধান ও বিদেশী কাহিনী অবলম্বনে লেখা গল্পও সময়ে সময়ে তিনি লিখতেন। এই কারণে এই লেখাগুলোর সবগুলোকে ননফিকশন বলা যায় না। তবে পাঠক যখন সব লেখাকেই সত্যি ভাবা শুরু করেছিল তখন একটি সংখ্যায় প্রিয়নাথ ব্যাপারটি খোলাসা করার জন্য লিখেছিলেন যে এখন থেকে তার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কাহিনীগুলো তিনি কেবল উত্তম পুরুষে এবং অন্য কাহিনীগুলো সাধারণভাবে লিখবেন। এই খন্ডে সংকলিত অধিকাংশ কাহিনীই উত্তম পুরুষে লেখা তাই তার কথার সূত্রানুসারে বলা যায় এর অধিকাংশই সত্য। তবে গোপনীয়তার স্বার্থে মূল নাম, ধাম কাহিনীগুলোতে পরিবর্তন করেই লেখা হয়েছিল।
শোনা যায় প্রিয়নাথ মোট ২০৬টি দারোগার দপ্তর লিখেছিলেন। অবশ্য ২০৬টি দপ্তর মানে কিন্তু ২০৬ টি রহস্যকাহিনী নয়। কিছু কাহিনী একাধিক সংখ্যায়ও শেষ হয়েছে। এই খন্ডে মোট ৪৮টি কাহিনী সংকলিত হলেও মোট দপ্তর বা সংখ্যা ছিল ৫০ টি। দুটি কাহিনী একাধিক দপ্তরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। কাহিনীগুলো বিভিন্ন অপরাধের অনুসন্ধান নিয়ে হলেও মূলত চুরি, হত্যা, প্রতারণা ও ডাকাতি সংক্রান্ত অপরাধের কাহিনীর সংখ্যাই বেশি। কাহিনীগুলোর অধিকাংশের সূত্রপাত শহর কলকাতা হলেও তদন্তের স্বার্থে প্রিয়নাথকে যেতে হয়েছে শহরতলী, নিকট বা দূরের পল্লীগ্রামে, ভিন্ন প্রদেশেও। তখন রেল যোগাযোগ ছিল, টেলিগ্রাফও ছিল তবে টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। বৈদ্যুতিক বাতি ছিল বলেও মনে হয় না, বাস বা মোটরযান তো ছিলই না। খোদ কলকাতায় গরুর গাড়ি চলতো, ঘোড়ার গাড়িই ছিল শহরে চলার মূখ্য বাহন। পুলিস কর্মকর্তা হলেও আলাদা গাড়ির কোন সুবিধা তখন অন্তত প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার ছিল না। প্রযুক্তির সুবিধা না থাকায় তখন অপরাধ বা অপরাধী সনাক্ত করা যে দূরুহ এবং সময়সাপেক্ষ ছিল তা কাহিনীগুলো পড়লে বেশ বোঝা যায়। তদন্তের স্বার্থে প্রিয়নাথকে বিভিন্ন দূরবর্তী স্থানে যেতে হয়েছে। পথের এবং বাহনের বর্ণনা থেকেই বোঝা যায় তা কি পরিমাণ কষ্টসাধ্য ছিল। তাছাড়া তখন বাঙালিদের প্রতি বৃটিশ শাসকদের মনোভাব, সেসময়ের সামাজিক অবস্থা প্রিয়নাথের কাহিনীগুলোতে বারবার বিভিন্নভাবে চলে এসেছে। সে হিসেবে এই লেখাগুলো তখনকার ঐতিহাসিক এবং সামাজিক দলিল।
প্রিয়নাথ ছিলেন সাদা পোশাকের গোয়েন্দা তাই ধরাবাঁধা রুটিন কাজ তার ছিল না। তবে নিজের পরিবার সম্পর্কে তিনি কিছুই এই দপ্তরগুলোতে না লিখলেও ছুটিছাটা পাওয়া যে তার পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য ছিল তা বেশ বোঝা যায়। তার লেখার ভাষা সহজ ও সাবলীল। ঘটনাগুলোর বর্ণনাও তিনি যেভাবে করেছেন তা থেকে ঘটনাগুলো বেশ বোঝা যায় যদিও তা পাঠককে বিরক্ত করে না। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে সাহিত্যমানের দিক থেকেও লেখাগুলো উঁচু মানের। প্রিয়নাথের ভাষারীতি সাধু ভাষায় হলেও দুর্বোধ্য নয় মোটেও এবং দু’চারটে শব্দ ছাড়া প্রায় সব শব্দই বর্তমানেও সমানভাবে প্রচলিত। যদিও বানানরীতি অনেকক্ষেত্রে বর্তমানের সাথে মেলে না তবে তাতে লেখা পড়তে কোন সমস্যা হবার কথা না। তবে মুদ্রাস্ফীতির কারণে সে সময়ের অর্থমূল্যের বর্তমান সমমান মূল্য কতো হতে পারে তা এখন ঠিক বোঝা সম্ভব না। তখনকার পাঁচ টাকা বর্তমানে কতো হতে পারে বা দুই সহস্র মুদ্রা আসলে কতো টাকা সেই ভাবনায় বারবার পড়েছি। সাহসীকতার জন্য প্রিয়নাথ বেশ কয়েকবারই পুরস্কার পেয়েছেন। তার সফল রহস্য অনুসন্ধানের সংবাদ সেকালের ইংলিশম্যান বা সমাচারচন্দ্রিকার মতো পত্রিকাগুলোয় বিস্তারিতভাবেই ছাপা হয়েছে একাধিকবার। সেসব সংবাদ ও সংবাদসূত্রগুলোও দারোগার দপ্তরে সংযোজিত আছে। সবমিলিয়ে দারোগার দপ্তর এর প্রথম খন্ড আমার কাছে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু ছিল। গোয়েন্দা কাহিনী যারা ভালোবাসেন তাদের কাছে এই বই ভালো লাগবে আশা করি আর যারা সেই সময়ের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী এই বই তাদের জানার পক্ষে, ভাবনার পক্ষে বিরাট এক উৎস হতে পারে।
আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে , ব্যোমকেশ, সত্যান্বেষী, ফেলুদা, কিরিটীরও আগে প্রকাশিত হয় বাংলার প্রথম ক্রাইম ম্যাগাজিন। যে সময় শার্লোক হোমস প্রথম সবার সামনে আসে, সেই সমমায়িক সময়ে এই বাংলায় সৃষ্টি হয় ইতিহাস। ক্রাইমসাহিত্য। পার্থক্য এই – শার্লক থেকে ফেলুদা সবাই কল্পনার নায়ক আর প্রিয়নাথ হলেন রক্ত মাংসের ডিটেকটিভ।
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় কলকাতা পুলিশের সিআইডি হিসেবে কাজ করেন ৩৩ বছর। তার ৩৩ বছরের গোয়েন্দা অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ১৮৮৯ সালে প্রকাশ করেন বাংলার প্রথম ক্রাইম ম্যাগাজিন দারোগার দপ্তর। দারোগার দপ্তর সাধু ভাষায় লেখা হলেও বইটির প্রতি কোন বিরক্তি আসবে না। এক বসায় শেষ করার মত বই। বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া ক্রাইম আর সব ক্রাইম স্টোরিকেও হার মানাবে নিশ্চিত। বিশেষ করে ত্রৈলোক্য !! ত্রৈলোক্যর কাহিনী আমার জানামতে পৃথিবীর প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলারের সত্য কাহিনী।
সে যা-ই হোক। বাংলা সাহিত্যের কোন গলিতে যে কী অমূল্য রত্ন রয়েছে, সেসব ভেবেই অবাক হচ্ছি। পার্সোণাল রেটিং ৪.৫/৫
বাংলার প্রথম গোয়েন্দা গল্প দারোগার দপ্তর। সেই সময়ের লোমহর্ষক এবং বুদ্ধিদীপ্ত অপরাধ সমূহ ও তা কি চরম মেধাশ্রমে ও সুচারুভাবে সমাধান করেছেন প্রিয়নাথ তারই চমৎকার বর্ণনা রয়েছে বইটিতে।