ভাস্কর চক্রবর্তী (Bhaskar Chakraborty, কোথাও কোথাও Bhaskar Chakrabarti) (১৯৪৫-২০০৫) একজন বাঙালী কবি, এবং গদ্যকার।
জন্ম দেশভাগের দুই বছর আগে, কোলকাতার বরানগরে। পড়েছেন ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র কলেজে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০, প্রথম কাব্যগ্রন্থ বহুল আলোচিত শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা (১৯৭১)। লেখালেখির শুরু ষাটের দশকের মাঝখানে, লিখেছেন টানা চল্লিশ বছর, মৃত্যুর আগ অব্দি। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষক।
তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে এসো , সুসংবাদ এসো (১৯৮১), রাস্তায় আবার (১৯৮৩), দেবতার সঙ্গে (১৯৮৬), আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে (১৯৮৯), স্বপ্ন দেখার মহড়া (১৯৯৩), তুমি আমার ঘুম (১৯৯৮), নীল রঙের গ্রহ (১৯৯৯), কীরকম আছো মানুষেরা (২০০৫), জিরাফের ভাষা (২০০৫)। গদ্যগ্রন্থের মাঝে প্রিয় সুব্রত, শয়নযান উল্লেখযোগ্য।
এদ্দিন ধরে ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা পড়ার পর যা বুঝলাম, আমাকে ভাস্করের কবিতার কাছে বারংবার ফিরতে হবে। ভাস্কর চক্রবর্তীর পদ্যে অকপট চালচিত্তির, ভাষার সারল্য আর যাপিত জীবনের প্রত্যাহিকতার খুটিনাটি যেভাবে এনেছেন। তা ভীষণ মুগ্ধ করার মতো। কবিতা সমগ্রের বেশিরভাগ কবিতাই আমার বারবার পড়া। যখনই পড়তে যাই, কবিতাগুলো নূতন রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে আমার কাছে হাজির হয়। আর তার মাধুরী আমাকে মোহিত করে।
পোস্ট-মাস্টারের মেয়ে শুধুমাত্র জুতোজোড়া নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে তার সঙ্গে গোলাপি যুবক - তারা স্বর্গে যাবে
আমাদের স্বর্গ নেই স্যারিডন আছে —চৌ-রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা চারজন
শোক এলেই মা-র কথা মনে পড়ে —দিগ্ভ্ৰান্তি
তোমার হাসি ভালো লাগে আমার পথের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে তুমি যখন হেসে ওঠো হঠাৎ— পুলিসও মুখ ফিরিয়ে দেখে নেয় আমাদের
সিগারেট ধরায় —শুধুমাত্র তোমাকে
একবার এই জন্ম— ছুটে যাই, তুমি জানো ছুটবোই আমি যেখানে তোমার ছায়া বসবোই হাঁটু ভাঁজ করে আমি ইঁট, আমি কাঠ – চুণ বালি অথবা খড়কে-কাঠি আমি তুমি জানো, আমি শালা ভিখারির চেয়েও ভিখারি —ভিখারি
এই যে হঠাৎ সব শব্দ থেমে যায়— কর্কশ দুপুরবেলা ভরে যায় পাপে— টবের মাটিতে আজও দুই পা ডুবিয়ে, হাত ছড়িয়ে দাঁড়ালে শরীরে কি ফুল হবে? —দুপুরে
ভালোবাসবার আগেই কতো মানুষের ভালোবাসা ফুরিয়ে যায় হঠাৎ— সশব্দে ঘুমোতে ঘুমোতে, কতো মানুষ চশমা পরেই হঠাৎ চলে যায় কবরে- —চব্বিশ বছর, আমি
আমার ভালোবাসার কোনো জানলা দরজা নেই। আমার ভালোবাসায় কোনো হাওয়া-বাতাস নেই। যে, যেরকম— পৃথিবীতে – সে, সেইরকমই থেকে যায়। —কলকাতায় আবার
ভুলে যেতে গিয়ে আমি বারবার তোমাকে ভোলার কথা ভুলে যাই। —মৃত্যু সম্পর্কে আরেকটি
মনে পড়ে আলিঙ্গন — মনে পড়ে শান্ত হাসিমুখ। —রেস্তোরাঁয়
আমার বন্ধুরা, বন্ধুত্বের বাইরে- —তিরিশ বছরের শেষে
স্মৃতি হচ্ছে সাপের কামড় যা দিনে দিনে বিষিয়ে ওঠে। জীবনের যেখানটায় ফাঁকা সেখানে তুমি যত্নে বেড়ে উঠছো প্রতিদিন। —নিষিদ্ধ প্রেমের কবিতা
আমার ভ্রমণ শুধু তোমার দু-চোখে থেমে যায়। —আলো
স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের মধ্যে সরু পথ দিয়ে আমরা এগোই। মোহ আর মোহহীনতার মধ্যে আমাদের বাড়ি। দু-পয়সার কাস্টমার আমরা সব, কিছু কেরামতি দেখিয়ে উধাও হই একদিন;
তারপর পড়ে থাকে বৃষ্টির ভাষা আর কাঁটাতার, মুদ্রিত পৃথিবী। —আমাদের কথা
এক একটা গানের সঙ্গে, কী আশ্চর্যজনকভাবে, ‘কিছু সময়’ অথবা ‘কোন মুখ' মিশে আছে।
কাছের লোকজন সব হারিয়ে গেছে তাই আজ দূরের মানুষকে কাছে পেতে হেঁটে চলেছি।
জানলার নিচে বকুলফুলের মত সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। —শহরনামা
লোভ যেন আমাকে লোভ না দেখাতে পারে। সতর্ক থাকতে হবে।
ভাস্কর চক্রবর্তী অত্যন্ত সমাজ সচেতন। সমাজের নানা পাপ, বিশৃঙ্খলা, মানুষের বিপন্নতা, মৃতবৎ বেঁচে থাকা, স্বপ্ন প্রভৃতি লেখকের কবিতায় এক ক্ল্যাসটিক অ্যারেঞ্জমেন্টের মধ্য দিয়ে লালিত এবং নির্মিত হয়েছে।
বইয়ে পাতা যত এগিয়েছে এক অদ্ভুত বিষন্নতাও আমায় ঘিরে ধরেছে। এমন এক অবসাদের গোলকধাঁধায় এসে পড়েছি যা থেকে পালাবার পথ নেই। এটাও বলা যেতে পারে যে হয়তো অনেক বেঁচে থাকার রসদও নিয়েছি সাথে।