Jump to ratings and reviews
Rate this book

জিন্দাবাহার

Rate this book

152 pages, Hardcover

Published January 1, 2019

16 people are currently reading
306 people want to read

About the author

Paritosh Sen

11 books4 followers
Paritosh Sen (Bengali: পরিতোষ সেন) was a leading Indian artist. He was born in Dhaka (then known as Dacca), the present-day capital of Bangladesh. He was a founder member of the Calcutta Group, an art movement established in 1942 that did much to introduce modernism into Indian art.

Sen pursued his artistic training at the Academie Andre Lhote, the Academie la Grande Chaumiere, the Ecole des Beaux Arts, and the Ecole des Louvre in Paris. Upon his return to India, he taught first in Bihar and then at Jadavpur University. He also taught art at The Daly College at Indore during the late 1940s.

In 1969 he was the recipient of the French Fellowship for Designing and Typeface and in 1970 he was awarded a Rockefeller Fellowship. Sen has exhibited widely both in India and abroad, including the Calcutta Group exhibition (1944), London (1962), São Paulo Biennale (1965), New Delhi Triennale (1968, 1971, 1975), Sweden (1984), and the Havana Biennale (1986).

In 1959/60, Sen published Zindabahar, a book of autobiographical sketches in which he memorialized the Dacca city of his childhood.

He died in Kolkata.

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
62 (44%)
4 stars
60 (43%)
3 stars
16 (11%)
2 stars
0 (0%)
1 star
0 (0%)
Displaying 1 - 30 of 43 reviews
Profile Image for রিফাত সানজিদা.
174 reviews1,357 followers
April 23, 2020
পরিতোষ সেনের লেখা প্রথম পাঠ রং তুলির বাইরে। বছর তিনেক আগে বিবাহে উপহার পেয়েছিলাম। বহুজনের কাছে প্রশংসা শুনেছি জিন্দাবাহারের। আজিজ এবং বাতিঘর চষে, হাল ছেড়ে শেষমেশ পিডিএফ পাঠ, বায়োমেডিক্যাল পালবাবুর বরাতে পাওয়া। একইসঙ্গে অন্তত গোটা পঁচিশেক বান্দাকেও গায়ে পড়ে মেসেঞ্জারে ই-বইখানা গছিয়েছিলাম।
ইহলৌকিক জীবন তো আগাগোড়া বিফলতার ভারে ক্লান্তদশাতেই কাটলো, পরোপকারের সওয়াবের বরাতে যদি পরকালে গরিবের একটা গতি হয়। :)
অবশেষে তক্ষশীলা ঢুঁড়ে শক্ত কপি মিললো। ভাগ্যিস!

পরিতোষ সেন পেশায় চিত্রকর, লেখক নন। এক্ষণ, কৃত্তিবাস এবং অমৃত পত্রিকায় নানাসময়ে প্রকাশিত নয়টি লেখা নিয়ে আত্মজীবনীমূলক রচনার জিন্দাবাহার নাম নেওয়া শৈশবের স্মৃতিমাখা জিন্দাবাহার লেনকে মনে করে। ঢাকার নবাববাড়ির গা ঘেঁষে কাটানো বাল্য এবং কৈশোরের ষোল বছরের রোমন্থন।

মুসলিমপ্রধান পাড়ার নিকটতম প্রতিবেশীদের গল্প এসেছে পরিতোষের স্মৃতিচারণে, সবিস্তারে৷ খিটখিটে মেজাজের দর্জি হাফিজ মিঞা,পনির আখরোট- পেস্তাবাদামের বেসাতি সাজিয়ে বসা জব্বার মিঞা, হাতুড়ে ডেন্টিস্ট আখতার মিঞা, তামাক বিক্রেতা কালু মিঞা, রেস্টুরেন্ট মালিক করিম মিঞা অথবা ওস্তাদ বাজিগর ঝুল্লুর মিঞা। কেউ অবয়বে, কারো স্বভাবে কিংবা কারো খাদ্যভ্যাসের বয়ানে চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠা একেকটা চরিত্র!

কী অবলীলায় ভেসে ওঠে সিন পেন্টার জিতেন গোঁসাই।
বাবুবাজার-ইসলামপুরের এক রাস্তার পাশের এক কালিমন্দিরের ধারের অপরিসর এক দোকানের আঁকিয়ে জিতেন্দ্র গোস্বামীর মূল পেশা যদিও ছিল থিয়েটারের সিনারি তথা ব্যাকগ্রাউন্ডের ছবি আঁকা। কিন্তু শুধু পেশার খাতিরে ফরমায়েশি আঁকিবুকি নয়, জিতেন বাবুর নেশাও ছিল তুলিতে আঁচড় কাটা, চোখের পলকে ক্যানভাসকে রাঙিয়ে তোলা। স্কুল কিংবা খেলাধুলায় অবসরের ফাঁকে অস্থির কিশোর সুস্থির হয়ে তাকিয়ে থাকতো অস্থির বিস্ময়, কী অদ্ভুত ভাবে রাতারাতি ক্যানভাসে আঁকা হয়ে যাচ্ছে বিশালতম দাবার ছক!
কৈশোরের সেই নিখাদ মুগ্ধতাই কি পরিণত বয়সে পরিতোষকে নিয়ে গিয়েছিল চিত্রশিল্পী হবার পথে?

পরিতোষ সেন স্নাতক ডিগ্রী লাভ নেন মাদ্রাজের সরকারি আর্ট কলেজ থেকে। এরপর উনিশশ ঊনপঞ্চাশ সালে চলে যান ইউরোপে। পরে দেশে ফিরে কলকাতার রিজিওনাল ইনস্টিট্যুট অব প্রিন্টিং টেকনলজিতে ডিজাইন অ্যান্ড লে-আউটের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। দেশ-বিদেশে তাঁর পঁয়ত্রিশের মত একক এবং যৌথ চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছে।
চুয়ান্ন সালে প্যারিসে হয়েছিল একক চিত্রপ্রদর্শনী।

অথচ পুরানো ঢাকার বনেদি কবিরাজ প্রসন্নকুমার সেনের বিশালতম পরিবারের সপ্তদশ সন্তানের তো পারিবারিক প্রথামতো ঠিক এই পথে হাঁটার কথা ছিলো না। পুরুষানুক্রমে যেটি ছিল তাঁদের প্রায় আড়াইশো বছরের বৃত্তি।
সেনদের একান্নবর্তী পরিবারের অন্দর আর সদরে পাত রোজ তিনবেলায় পড়তো সারে সারে। মায়ের সাথে দেখা হতোই না পরিতোষের, যার দিন কাটত কঠিন ব্যস্ততায়, সংসারের কামকাজের অনিঃশেষ জাঁতাকলে...

হঠাৎ করেই বিশটি সন্তানের (যাদের মধ্যে সর্বকণিষ্ঠজনের বয়স মাত্র দশমাস )পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর বৈমাত্রেয় বড় ভাইদের ছায়া কিংবা উষ্ণ ছায়া দু’য়ের কোনটাই পরিতোষ এবং তার কনিষ্ঠদের ভাগ্যে ছিল না। পারিবারিক স্বচ্ছলতাটুকু হারাতে শুরু করে বারাঙ্গনাগমন, সুরা, জুয়া এবং ঘোড়দৌড়ের সুত্রে। নিষ্ঠা এবং শৃংখলার সুতোয় বাঁধা পরিবারের আকাশে নিত্য জমতে থাকে ধার, কাবলিওতালার সুদের তাড়া, গালাগালি, মদ্যপানজনিত হ্যাংওভার এবং বদহজমি তিক্ত গরল উদগীরণের মেঘ।
সেন পরিবারের বধিষ্ণু বাতি এমনভাবে নিভতে শুরু করেছিল যে, ইন্দ্রিয়তৃপ্তির নেশায় মাতাল ন'দা এবং সেজদারা পরিতোষ, তস্য মাতা এবং বাকি পৃথিবীর জন্য হয়ে উঠেছিল জীবন্মৃত!
কী বিষণ্ণ স্বরে এই অংশটুকুতে সমাপ্তি টানেন সেন--
আমার ভায়েরা অন্ধকার পাতালের অতলে এতোটাই নেমে গিয়েছিল যে আকাশের দিকে আর কোনদিন মুখ তুলতে পারেনি।

বিস্ময়কর ভাবে এরকম অসংবৃত পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবন বেছে নেন পরিতোষ। প্রসন্নকুমারের আদি বাড়ি আর গোঁড়া হিন্দুধর্মের অনুসারীদের জীবনপটের সাথে অবশ্য আরেক ব্যতিক্রমী উদাহরণ ছিল আগে থেকেই।
জামিলার মা।
জাতে মুসলমান হয়েও প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে সেন পরিবারের আয়ুর্বেদিক জড়িবুটি তৈরীতে পেষণের কাজ ছিল জামিলার মার। পূজার ঘরে ঢোকার অনুমতি না থাকলেও কস্তুরি, ত্রিফলা বা হরিতকীর গন্ধ ছড়ানো জামিলার মায়ের মশলা পেষার ঘরে বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যদের আনাগোনা ছিল হরহামেশাই। কখনো ঘুড়ির লেত্তি, কখনো কদবেলের চাটনি, সীমাহীন আবদারের সুনিশ্চিত মঞ্জুরি।
পরিবার -সন্তান আর সম্বলহীন বৃদ্ধা হয়তো রিদয়ের সমস্ত স্নেহাশিস উজাড় করে দিয়েছিলেন কত্তার পরিবারেই।
আমৃত্যু!

ভূমিকায় অমলেন্দু বসু লিখেছেন-
''ওবিন ঠাকুর ছবি লেখে, ছবি লিখেছেন পরিতোষ সেন-ও।''
যদিও একমত নই। অবন ঠাকুরের মতো মায়ার তুলি নেই সেনের কলমে। তার চাইতে বরং মনে হয়েছে নিখুঁত বর্ণনার মুন্সিয়ানা বেশি পরিতোষের লেখার ধাঁচে।

তাই মুন্সিগঞ্জের বেলতলী গ্রাম, ধলেশ্বরীর ঢেউ, কোতোয়ালির মোড়ের জন্মাষ্টমী মিছিল কিংবা নবাবপুরের ‘বড়ো চৌকি’ মিছিল, ফিটন গাড়ি আর হাফিজ মিঞার গেরোবাজ পায়রার ডানা ঝটপটানির আওয়াজ আর‘রসিয়া তোরি আখিয়ারে, জিয়া লাল চায়’ ঠুংরী ঠাঁটের গানের সুরে ভরে ওঠা জিন্দাবাহার গলি ছবির মতো সামনে ভেসে ওঠে একেকটা অধ্যায় পড়তে পড়তে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমার চোখে বারবার ভেসে ওঠেন জামিলার মা৷ ১৫২ পাতার দিনলিপির শেষটায় পাতা মুড়ে রাখতে রাখতেই ধূসর তামাটে, নীল সবুজ আর ছাই রঙে আঁকা আবছায়া পটভূমিতে এক শীর্ণকায় বোরকা পরিহিতা হতদরিদ্র বৃদ্ধা বুড়িগঙ্গার তীর ধরে বড় নিঃশব্দে হেঁটে চলে যান...
Profile Image for Harun Ahmed.
1,651 reviews418 followers
July 21, 2022
৪.৫/৫

শতবর্ষের পুরনো ঢাকা। এ স্মৃতিকথায় আছেন দর্জি হাফেজ মিয়া, প্রসন্নকুমার, সিন-পেন্টার জিতেন গোঁসাই, ডেন্টিস্ট আখতার মিয়া, আছেন ন'বাবু আর সেজোবাবু, নবাব,বাঈজী, ডাক্তারসহ একগুচ্ছ বিচিত্র মানুষ। আর আছেন গল্পকথক পরিতোষ সেন, যার আছে photographic memory। তিনি শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে যে রূপ, রস, গন্ধময় পৃথিবী গড়ে তোলেন তাকে বলা যায় "বাকচিত্রশালা।"লেখকের বর্ণনা থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনোকিছুই বাদ যায় না। কি যে সুন্দর, সাবলীল, জীবন্ত বর্ণনা সব!! তিনি খাবারের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,

"সারি সারি মুসলমানী খাবারের দোকান।ঘি,গরম মসলা,পেঁয়াজ -রসুন এবং হিং এর গন্ধে সন্ধেবেলার হাওয়াটা মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। বড়ো বড়ো লোহার পরাতে কালেজা-কা সালন,শামি আর শিক কাবাব,মাটন কাটলেট আর রোস্ট, পরোটা, রুমালী রোটি, ফুরকা, ভাত, আরো কত কী।.....এই থালার শেষটিতে,জাফরানী রঙের রগরগে ঝোলে মাখা বড়ো-বড়ো চাঁপ।......একটা লোহার ডেগচিতে, হলদে আর গাঢ় গোলাপী, চিকন ভাতের বিরিয়ানি। তার থেকে গরম ভাপ হাল্কা ধোঁয়ার মতো কুণ্ডুলি পাকিয়ে উঠে আমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল। এই জাঁকালো দৃশ্যটি আমার চক্ষু এবং ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে অস্বাভাবিক-রকম সজাগ করে তুলল। রসনেন্দ্রিয়ও ক্ষেপে উঠল ততোধিক।"

পুরো বই-ই এমন সব চিত্ররূপময় কথনে ঠাসা।সে কথনে লেখকের ���শেপাশের বিভিন্ন পেশার ধ্যানমগ্ন শিল্পীরা যেমন আছেন, তেমনি আছে তার পরিবার, প্রিয় অর্জুন গাছ ও গৃহকর্মী জামিলার মা।বাবার মৃত্যুর পর শবদাহ নিয়ে লিখিত "আগুন" অধ্যায়ের বিবরণ পড়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।অমলেন্দু বসুর ভাষায়,
"লেলিহান অগ্নির লক্ষ কোটি বর্ণসমাবেশ,তার লক্ষ কোটি প্রতিকৃতি,....,তার অভ্যন্তরে অর্জুনের বিশ্বরূপ-দর্শন-সম্ভাবনা,এ সমস্তই সম্ভব হয়েছে এই অতুলনীয় রচনায়।"
শুধু "ন'বাবু,সেজোবাবু" অধ্যায় নিয়েই আস্ত একটা বই লেখা সম্ভব(সে বই "সাহেব বিবি গোলাম" এর চাইতে কম আকর্ষণীয় হবে না।)
নিজের পারিবারিক ভাঙন, অশান্তি, কলহ থেকে শুরু করে প্রথম নারীদেহ দর্শনের জান্তব অনুভূতি -সব জায়গাতেই পরিতোষ সেন আশ্চর্য রকমের অকপট।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিমুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে "জিন্দাবাহার" পড়া ছাড়া উপায় নেই। এ স্মৃতিকথা সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য।

(৩১ জুলাই, ২০২১)
Profile Image for সালমান হক.
Author 66 books1,959 followers
April 16, 2020
“যে-লোক কর্মের মধ্যে তাঁর জীবনাদর্শ খুঁজে পেয়েছেন, তাঁর সঙ্গী কিংবা আড্ডার প্রয়োজন কিসের!”

পুরনো ঢাকার বাবুবাজার অঞ্চলের কালীবাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে 'জিন্দাবাহার লেন'। নামটা সুন্দর না? জিন্দাবাহার। উর্দু "জিন্দেগী"(জীবন) থেকে "জিন্দা" (জীবন্ত, তাজা)। তার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে "বাহার"(বসন্ত)। অর্থাৎ দুইয়ে মিলে দাঁড়ায় "তাজা বসন্ত"। একটা গলির নাম হিসেবে বেশ রসিক কিন্তু।

কিছু লেখা থেকে পরিতৃপ্ত স্মৃতির ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এমন নয় যে সেখানটায় বর্ণিত সবকিছুই অতি আনন্দের, অতি সুখের। বরং পাহাড়ের চড়াইয়ের মতন, উতরাইয়েরও দেখা মিলবে। তবুও দেখবেন পড়তে ভালো লাগছে, এটাই লেখকের স্বার্থকতা। পরিতোষ সেন উপমহাদেশের বিখ্যাত চিত্রকরদের একজন। তার জন্ম ১৯১৮ সালে পুরনো ঢাকায়। বাবুবাজারের জিন্দাবাহার লেনে ছিল তার পৈতৃক নিবাস। পরিতোষ সেন যে আপাদমস্তক একজন শিল্পী তা বইটা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিলাম। বলা যেতে পারে বইটি তিনি লেখেননি, বরং এঁকেছেন। সেজন্যেই সবগুলো দৃশ্যপট ছিল একদম জীবন্ত, চোখের সামনে ভেসে উঠছিল(একটু ক্লিশে শোনাবে কথাটা, কিন্তু এখানে ব্যবহার না করে পারলাম না।)

মোট ন'টি লেখার সমাহারে 'জিন্দাবাহার'। প্রত্যেকটি লেখাই নাম দিয়ে আলাদা করা। আবার প্রত্যেক অংশের সাথে বোনাস হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়েছে পরিতোষ সাহেবের নিজস্ব চিত্রকর্ম, যা পাঠকের কল্পনাকে আরো চাঙ্গা করতে বাধ্য।

শুরুতেই আমরা দেখতে পাই দর্জি হাফেজ মিয়াকে। লেখকের বাড়ির পাশেই ছিল তার দোকান/বাড়ি। স্বয়ং নবাবপুত্র কাপড় বানাতে আসতেন তার কাছে। অথচ একবার দেখে চোখের আন্দাজেই ঠিকঠাক জুড়ে দিতেন কাপড়গুলো। কোন ভয়ডর নেই, গুণী মানুষ মাত্রই বোধহয় একটু ঔদ্ধত্য এসে পড়ে। তবে এখানেই শেষ নয় তার অদ্ভুত চরিত্রের বর্ণন। ভীষণ রগচটা ও স্বল্পভাষী এই লোকটাই আবার স্নেহশীল ও বাচাল হয়ে ওঠে পায়রা নিয়ে আলাপের সময়। পেশায় দর্জি হলেও, মনপ্রাণ তার পড়ে থাকতো ছাদের গেরোবাজ পায়রাগুলোর খাঁচায়। এরপর পাঠকদের পরিচয় হয় সিন পেন্টার জিতেন গোঁসাইয়ের সাথে। তার স্বভাব চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়েই পরিতোষ বাবু শুরুর উক্তিখানার অবতারণা করেছেন। “যে-লোক কর্মের মধ্যে তাঁর জীবনাদর্শ খুঁজে পেয়েছেন, তাঁর সঙ্গী কিংবা আড্ডার প্রয়োজন কিসের!”- আসলেই তো, কাজ যদি শখের সাথে মিলে যায়, এর চেয়ে আনন্দের আর কি-ই বা হতে পারে? ভীষণ প্রতিভাধর এই আঁকিয়ে সাদা থানকাপড়ের ওপরে রাত দিন এঁকে যেতেন। লেখকের উদ্দেশ্যে তার বলা "তোর হবে" কথাটাই বোধকরি অবচেতন মনে "গুরুর আদেশ শিরোধার্য" বলে মেনে নিয়েছিলেন পরিতোষ সেন। সবচেয়ে প্রাণবন্ত লেগেছে "ওয়ার্ল্ড রিনাউন্ড ডেন্টিস্ট" ওরফে প্রথম মহাযুদ্ধের যোদ্ধা ওরফে বাঘ শিকারী 'আখতার মিয়া" চরিত্রটি। একই শরীরে কত গুণের সমাহার! গাজীপুরের বনে তখব বাঘের দেখা মিলতো(!), এটা জেনে বিস্মিত হয়েছি। মানুষ যে তার অসীম চারিত্রিক বৈচিত্রে ও বৈশিষ্ট্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে, এই তিনটি লেখা দ্বারা তা স্পষ্ট বুঝিয়েছেন লেখক।

'প্রসন্নকুমার' লেখাটির মাঝামাঝি গিয়ে অবাক হয়েছিলাম ভীষণ। নিজের পিতার চরিত্র বর্ণনা এতটা নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে দেয়া যায়, তা আসলেও মেনে নিতে কিছুটা কষ্ট হয়েছিল। পুরো লেখাটা জুড়েই প্রচ্ছন্ন শ্রদ্ধাবোধ পাঠকমনে ছাপ ফেলবে। তবে বিশ সন্তানের জনক, বিখ্যাত কবিরাজ বাবার প্রতি চাপা অভিমান কিছুটা হলেও যে কাজ করতো লেখকের মনে, তা স্পষ্ট।

প্রথমদিকের লেখাগুলো পড়ে মনে হতে পারে, পুরনো ঢাকার শৈশব কৈশোর কাটানো কারো সুখস্মৃতির বর্ণনা পড়ছেন। চারদিকে কেবল আনন্দ। কিন্তু বাস্তব জীবন তো এমন নয়। বাস্তবে মুদ্রার একপাশে আনন্দ থাকলে অন্য পাশে বেদনা থাকতে বাধ্য। 'আগুন' লেখাটির মাধ্যমে সেটাই বুঝতে পারি আমরা। বাবার চিতার আগুনের বর্ণনা দিতে গিয়েই চিত্রকর পরিতোষ সেন এবং লেখক পরিতোষ সেন একাকার হয়ে গেছেন। তখন মনে হচ্ছিল সম্পূর্ণ অন্য কোন লেখা পড়ছি। একই কথা প্রযোজ্য 'হে অর্জুন' লেখাটির ক্ষেত্রেও।

বৈমাত্রেয় ভাইবোনেরা বাবার মৃত্যুর পর যখন আলাদা করে দিল তাদের, তখন জীবনের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রূপ আবিষ্কারের চিত্র দেখা যায়। মধ্যবিত্ততার বর্মের আড়ালে যে লোভ আর স্বার্থপরতা লুকিয়ে থাকে, তার নগ্ন প্রদর্শনী বেশ অস্বস্তির উদ্রেক ঘটাচ্ছিল। এরকম মহাদুর্যোগের সময় রিয়েলিটি থেকে "এস্কেপ" করতে সাহিত্যে মনোনিবেশের পরেও রিয়েলিটি যখন সেখানে মৃদু হেসে তার উপস্থিতি জানান দেয়, তখন বোধহয় এরকম অস্বস্তি লাগতে বাধ্য। বড় ভাইদের মদ, জুয়া, মেয়েমানুষের নেশার রঙে আঁকা এই গৃহদাহের চিত্রটি দেখতে(বা পড়তে) খুব একটা ভালো লাগেনি।

বাড়তি হিসেবে ছিল পুরনো ঢাকার বিচিত্র জীবনধারা, খাবার-দাবার এসবের সাবলীল বর্ণনা। পুরো বই শেষ করার পর কিছুটা অতৃপ্তি সঙ্গী হয়েছিল, আসলে আরো পড়তে চাচ্ছিলাম বোধহয়। হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু পড়া শেষে নবাবজাদার মতন মনে মনে আমিও বলে উঠেছিলাম, "কামাল, কামাল! গজব, গজব!"

যারা স্মৃতিকথা পড়তে ভালোবাসেন কিংবা সে আমলের পুরনো ঢাকার অসাম্প্রদায়িক রূপ জানতে আগ্রহী তাদের জন্যে অবশ্যই রেকমেন্ড করলাম।
Profile Image for বিমুক্তি(Vimukti).
156 reviews89 followers
December 20, 2020
এরকম একটা সংস্কৃত প্রবাদ আছে যে, কোনো সভায় যদি অনেক জ্ঞানী- গুণী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনায় মশগুল থাকেন, তবে সেই সভাটা ভেঙে দেয়ার জন্য একজন কবিই যথেষ্ট। আর সেখানে যখন কেউ সংগীত নিয়ে আবির্ভূত হয়, তখন কবিও ঠিক বুঝতে পারেন তাঁর সৃষ্টিতে সুরের অভাব। কিন্তু এই সভার পাশ দিয়ে যখন একজন সুন্দরি হেঁটে যায় তখন সবাই এটাই বুঝতে পারে যে যার জন্য এই কাব্য আর সংগীত, সেই সংগীতময় এসে গেছেন। এখন বাকি সব কিছুর মলীন হবার পালা।

'জিন্দাবাহার' বইটার সফট কপির লিনক সহ উপরের কথা গুলো টেক্সট করে পাঠিয়েছিল আমার এক সুহৃদ বন্ধু। আর সঙ্গে এটাও বলে দিয়েছিল এই বইটা হচ্ছে সেই সুন্দরির মতো। একবার পড়তে শুরু করলে বাকি সবকিছুই ম্লান হয়ে যাবে। কথাটা যে খুব একটা ভুল বলে নি তা পড়তে শুরু করেই বুঝেছি।


আমি স্মৃতিকথার বিরাট বড় ভক্ত। আর এই মুগ্ধতার শুরু হয়েছিল বিখ্যাত বই 'দেশে বিদেশে' পড়ার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে শংকরের 'এপ��র বাংলা, ওপার বাংলা', রবি ঠাকুরের 'আমার ছেলেবেলা', হুআ এর 'উঠোন পেরিয়ে দু পা' এবং আর অনেক প্রখ্যাত সাহিত্যিকের স্মৃতিচারণ মূলক লেখা পড়ার পর এইধরণের লেখার প্রতি মায়ার মাত্রা বেড়েছে বই কমেনি। আর এই সারিতে সাম্প্রতিক সংযোজন হচ্ছে 'জিন্দাবাহার'।


এই বই নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই যেটা বলতে হয় সেটা হচ্ছে লেখকের অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গি। একজন শিল্পীর দৃষ্টিতেই লেখক তাঁর আশপাশের বিষয়বস্তু দেখেছেন। আর সেটা ফুটিয়ে তুলতেই যেন কলমের আশ্রয়। বইটার শুরু সিন পেইন্টার জিতেন বাবু এবং গলির দর্জি হাফিজ মিয়ার মতো পাকা শিল্পীর বর্ণনায়। এদের শৈল্পিক সৃষ্টি লেখক কে পরবর্তীতে একজন বড় মাপের আর্টিস্ট হতে ঠিক কতোটা প্রভাবিত করেছিল, তা বইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় যেনো ছড়িয়ে রয়েছে।

লেখকের স্বপ্নের মতো সুন্দর কৈশোরে প্রথম বড় ধাক্কাটি ছিল তাঁর বাবার মৃত্যু। বইটা পড়ার সময় য��রা মনে করবেন লেখক তাঁর বাবার মৃত্যুর বর্ণনা একদমই দিতে পারেন নি, তারা পরমুহুর্তেই চমকে উঠবেন। বিশ্বাস করেন! চিতার আগুনের এরকম বর্ণনা আমি কাস্মিনকালেও পড়িনি।

বইটি পড়ার সময় কিন্তু মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এমন অনেক জিনিসের কথা লেখক উল্লেখ করেছেন যা চোখে দেখা তো দূরে থাক, নামটাই কখনো শুনিনি (যেভাবে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে সবকিছু উধাও হয়ে যাচ্ছে, সেটাই স্বাভাবিক)।
Profile Image for Amit Das.
179 reviews117 followers
November 28, 2022
'ওবিন ঠাকুর ছবি লেখে। ছবি লিখেছেন পরিতোষ সেন-ও। লিখেছেন এমন অকস্মাৎ, কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে এবং সে-লেখায় এমন নিখুঁত মুন্সিয়ানা যে বিশ্বাস হতে চায় না এই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এই প্রথম আপন অনবদ্য শিল্পীসত্তা প্রকাশ করলেন লেখনীর মাধ্যমে।'

বইয়ের শুরুতে অমলেন্দু বসু'র লেখা ভূমিকার প্রথম দিককার এই ক'টা লাইনে চোখ আটকে যায়। আগ্রহ বাড়ে পরিতোষ সেনকে নিয়ে, তাঁর স্মৃতিকথা নিয়ে। সেই আগ্রহ মুগ্ধতার সাথে বিলীনতার পথে যাত্রা করে একরাশ বিস্ময় নিয়ে।
জিন্দাবাহার (তাজা বসন্ত) তার নামের মতোই অতি চমৎকার বয়ানে ঠাসা দারুণ সব স্মৃতিকথার সমাহার, যার ঝুলিতে শুরুতেই আছেন দর্জি হাফিজ মিঞা, আছেন সিন্-পেন্টার জিতেন গোঁসাইয়ের মতো বিচিত্র মানুষও। ডেন্টিস্ট আখতার মিঞা, প্রসন্নকুমার, ন'বাবু, সেজোবাবু থেকে গৃহকর্মী জামিলার মা- কে স্থান পায়নি এই বইয়ে!

জিন্দাবাহার

কথিত আছে, এই স্মৃতিকথার প্রথম দুয়েকটি লেখা শেষ করার পর সত্যজিৎ রায়, নিখিল সরকার (শ্রীপান্থ), সুরজিৎ দাশগুপ্তের মতো গুণী মানুষদের নিকট থেকে সমাদর ও বাহবা পেয়ে বাকি লেখাটুকু উৎসাহের সাথে লিখেছিলেন আমাদের এই স্মৃতিকথার কথক পরিতোষ সেন। ভাগ্যিস লিখেছিলেন! এমন অসামান্য সব বয়ান অলিখিতই রয়ে যেত যে অন্যথায়!

জিন্দাবাহার আমি একবার পড়লাম, প্রথমবারের মতো। আর জানি এখানেই শেষ নয়। এই বই আরো পড়া হবে, বারবার।
স্মৃতিকথার দর্জি হাফিজ মিঞার অবাক করা সব কান্ডকারখানা দেখে গল্পকথকের মুগ্ধতা প্রকাশের মতোই পুরো বই পাঠশেষে আমিও আপনমনেই বলে চলি, 'কামাল, কামাল! গজব্, গজব্!'


(১০ অক্টোবর, ২০২২)
Profile Image for Farzana Raisa.
530 reviews238 followers
August 11, 2021
বইটা নিয়ে ভালো ভালো কথা সবাই বলে ফেলসে। এই বই কেবল মাত্র চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেনের শৈশবকালের স্মৃতিচারণাই নয়, আরও অনেক কিছু। ভদ্রলোকের আঁকা ছবি আমি দেখিনি কিন্তু বই পড়ে আক্ষরিক অর্থেই মুগ্ধ হয়ে গেছি। প্রচন্ড রকমের জীবন্ত একটা বই। সাবলীল, প্রাঞ্জল বর্ণনার সাথে বাড়তি উপহার হিসেবে আছে প্রতি চ্যাপ্টারের সাথে পরিতোষ সেনের আঁকা সুন্দর কিছু স্কেচ।

অন্যান্য আত্মজীবনীর মতো কেবল হাসি আর আনন্দই নয়, কৈশোরের দ্বারপ্রান্তে থাকা ছোট শিশুর চোখ দিয়ে দেখা দু:খের ঘটনাও আছে নানান রকম। হাসি-কান্না-দু:খের সাথে সাথে বিভিন্ন চিত্র-বিচিত্র চরিত্রের সমাহারে একটু একটু করে বড় হয়েছে 'জিন্দাবাহার'।


বি.দ্র. হারুন ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। নইলে জামিলার মা পর্বের শেষ দেড় পেজের দু:খ থেকে যেতো আজীবন।
Profile Image for Farhan.
725 reviews12 followers
July 29, 2021
কিছুদিন আগে মার্টিন স্করসিস মার্ভেলের সুপারহিরো ম্যুভিগুলোকে "নট সিনেমা" বলে বেশ একটা হইচই ফেলেছেন। পক্ষে-বিপক্ষে দু'দিকেই অনেক কথা হচ্ছে; এর মাঝে কারীম আব্দুল জব্বার--আমেরিকার বাস্কেটবল লিজেন্ড হিসেবে যিনি পরিচিত হলেও অনেকেই জানি না যে তিনি একসময় মারভেল এর বেশ কিছু কমিক্সও লিখছেন--এর মন্তব্যটা বেশ ভাল লেগেছে। তাঁর মতে--
"স্করসিস সিনেমা ব্যাপারটাকেই ডিফাইন করেন। কাজেই তিনি 'সিনেমা না' বলে মারভেল এর ম্যুভিগুলোকে একদম ফেলে দিয়েছেন বলে আমি মনে করি না। বরং একটু জেনারালাইজড ভিউ থেকে স্করসিসের বক্তব্যকে দেখলে, আমার মনে হয় 'হাই আর্ট' আর 'পপুলার আর্ট'-এর মাঝে যে পার্থক্য, সেটাই স্করসিস এখানে বুঝিয়েছেন। পিটার কুলিজের 'ডগস প্লেয়িং পোকার' দেখে আমাদের মুখে যতই হাসি ফুটুক, দিনশেষে তা রেমব্রাঁ'র 'দ্য ওয়েভস এট দ্য সী অভ গ্যালিলি'-এর সমকক্ষ নয়। পিটার বেঞ্চলির 'জ' যত বেশি মিলিয়ন কপিই বিক্রি হোক, সাহিত্য বুঝাতে চাইলে মেলভিলের 'মবি ডিক'-ই পড়াতে হবে। অবশ্যই আমি মারভেলের ম্যুভি ভালবাসি। যখন আমি মারভেলের ম্যুভি দেখে হল থেকে বের হই, আই ফিল 'লাইটার'। আর যখন স্করসিসের ম্যুভি দেখে হল থেকে বের হই, আই ফিল 'ওয়াইজার'।"

পরিতোষ সেন-এর স্মৃতিকথা 'জিন্দাবাহার' পড়তে পড়তে বারবার এই 'হাই আর্ট'- এর কথাই মনে হচ্ছিল। ভদ্রলোক সর্ব অর্থেই 'শিল্পী'। যখন লেখেন, তখনো যেন কলম দিয়ে এক ডিটেইল্ড ছবিই আঁকছেন। জিন্দাবাহার লেনে তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে, সেখানকার ক'জন বাসিন্দাকে নিয়েই এই লেখা। দর্জি হাফিজ মিয়া, ডেন্টিস্ট আখতার মিয়া, সীন পেন্টার জীতেন গোঁসাই, জামিলার মা, তার বাবা আর দাদারা, প্রত্যেকের চরিত্র আর জীবনধারার মাঝ দিয়ে উঁকি দিয়ে গেছে তখনকার সময়েরও খানিকটা। কিন্তু সেই সময় বা সেই ঢাকার চেয়ে মানুষগুলোকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বেশি, সেজন্য জিন্দাবাহার হয়ে উঠেছে সর্ব সময়ের, সর্ব মানুষের। মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ না করেও কিভাবে ঘটনার আর পটভূমির বর্ণনায় প্রতিটি মানুষকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল করে তোলা যায়, সেটা বুঝতে হলে পড়তে হবে জিন্দাবাহার। আর কী আশ্চর্য মমতা তাঁর মানুষের প্রতি! শত দোষ-ত্রুটি নিয়েও প্রতিটি চরিত্র আমাদেরকে টানে, ভালবাসতে শেখায়। এপার থেকে ওপারে চলে যাওয়া অনেকের লেখায় একটা সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতার ছাপ এবং এপারের দিকে যে ক্ষোভের একটা ছায়া দেখেছি, পরিতোষ সেনের লেখায় তার ছিটেফোঁটাও নেই। সত্যিকার অর্থেই জিন্দাবাহার, এক রংধনুর মত রঙিন লেখা। জীবনকে বোঝার জন্য যেসব বই পড়তেই হবে, এ বই তার মাঝেই একটা। কারীম আব্দুল জব্বার এর মত এ বই পড়ার পর আমিও বলতে চাই--"আই ফিল ওয়াইজার"।
Profile Image for Daina Chakma.
440 reviews772 followers
March 24, 2020
ভূমিকায় অমলেন্দু বসু লিখেছেন-

“‘ওবিন ঠাকুর ছবি লেখে।’ ছবি লিখেছেন পরিতোষ সেন-ও। লিখেছেন এমন অকস্মাৎ, কোনো পূর্বাভাস না-দিয়ে এবং সে-লেখায় এমন নিখুঁত মুন্সিয়ানা যে বিশ্বাস হতে চায় না যে এই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এই প্রথম অনবদ্য শিল্পীসত্তা প্রকাশ করলেন লেখনীর মাধ্যমে।”

কই, আমার আছে তো তেমন লাগলো না। ওবিন ঠাকুরের গদ্য ধাঁধার মতো সুন্দর আর মায়াময়। পরিতোষ সেনের বর্ণনা বরং কিছুটা ফোর্সফুল লেগেছে। তবে পিতার মুখাগ্নির আগুন নিয়ে ঝিমঝিমে নেশা ধরানো বর্ণনা এঁকেছেন বটে। স্যুরিয়েলিজম ধাচের খানিকটা।

ন্যারেশনটুকু উপেক্ষা করতে পারলে "জিন্দাবাহার" চমৎকার একখানি গ্রন্থ। ঢাকা শহরের বাবুর বাজার নামক জনবহুল অঞ্চলে কালীবাড়ির পাশ দিয়ে চ’লে গেছে জিন্দাবাহার লেন, সে-রাস্তার প্রায় শুরুতেই ছিল পরিতোষ সেনের পৈতৃক বাড়ি। দৃশ্যপটের আড়ালে থাকা মানুষ - যাদের জন্মভূমি এই লেন - তাদেরকে কলমের কালিতে জীবন দিয়েছে�� পরিতোষ সেন। কী অদ্ভুত একেকটা চরিত্র! সিন-পেণ্টার জিতেন গোঁসাই এর ক্ষুদ্র জীবনী পড়তে গিয়ে ঘোর লেগে যাচ্ছিল বারবার। সৃষ্টির জন্য এভাবে কাউকে বাঁচতে দেখিনি! কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত! খিটখিটে মেজাজের দর্জি হাফিজ মিঞা চোখের মাপে প্রায় নিখুঁত সাইজের কোট বানিয়ে নবাবজাদার সাথে সাথে পাঠককেও আনন্দ আর বিস্ময়ে অভিভূত করে ফেলে। পরক্ষণেই শিল্পীর একান্নবর্তী পরিবারের টানাপোড়েনের চিত্র পড়ে হতবাক হতে হয়। ভাইদের স্বার্থপরতা, হীনতা, বিদ্বেষ, মদ আর জুয়ার নেশা যখন সংসারের ধ্রুব সত্য, মাতৃপীড়ন যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা- সেই পরিবারে পরিতোষ সেনের মতো শিল্পীরও জন্ম হয়! এ যেন গোবরে পদ্মফুল! এই যে আমরা প্রায়শই বলি, "ফ্যামিলি কী শিক্ষা দিয়েছে" কখনও কি ভেবেছি কত পলকা এই কথাটা! যে ঘরের ছেলে জুয়া খেলে আর মা পিটায় সে ঘরেই আবার চিত্রশিল্পী গড়ে উঠে!

প্রতি অধ্যায়ের শুরুতে শিল্পীর আঁকা ইলাস্ট্রেশন যোগ আছে। যারা আঁকিবুঁকি করে তাদের ভালো লাগবে।

পরিশেষে একটা কষ্টের কথা বলি। আমার হার্ডকপির মাঝখান থেকে হঠাৎ করে ১২৬-১৩৬ পৃষ্ঠা গায়ের। পিডিএফ নামিয়ে মাঝের এই দশপাতা পড়তে হলো। শখ করে কেনা বই। অহেতুক এই বিড়ম্বনা পোহাতে কার ভালো লাগে! আমাদের প্রকাশনা শিল্প কবে বই প্রকাশে আরেকটু যত্নশীল হবে?
Profile Image for Mahiya Tabassum.
24 reviews72 followers
March 7, 2024
অনেকদিন পর কোনো বই রীতিমতো টানা পড়ে শেষ করলাম। কয়েকটা বই শাফল করে করে পড়ার যে অভ্যাস, জিন্দাবাহার বইটা শুরু করার পর সেকথা বেমালুম ভুলে গেলাম।

পরিতোষ সেন পেশায় একজন চিত্রশিল্পী, যাঁর জন্ম ঢাকার ইসলামপুরের জিন্দাবাহার লেনে। লেখকের জীবনের একটানা ষোলো বছর কেটেছে যেই এলাকায়, সেখানকার বিভিন্ন বাসিন্দা ও তাদের যাপিত জীবনের গল্পের সংকলন- "জিন্দাবাহার"। এটিকে আত্মজীবনীমূলক বইও বলা চলে- যেখানে পরিতোষ সেন তাঁর শৈশবের ঢাকা শহরের স্মৃতিচারণ করেছেন।


দর্জি হাফিজ মিঞা, সিন্-পেণ্টার জিতেন গোঁসাই, ডেণ্টিস্ট আখ্তার মিঞা, প্রসন্নকুমার...বইয়ে জায়গা পেয়েছে জিন্দাবাহার লেনের অনেকের গল্প, তাদের জীবনাচরণ আর সাবলীল বর্ণনার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে পুরান ঢাকার সংস্কৃতি। আছে 'পায়রার রেস'- এর মতন বহুবছর পুরনো পুরান ঢাকার নানারকম ট্রেডিশান এর বর্ণনা। আর আছে প্রতি চ্যাপ্টারের শুরুতে পরিতোষ সেনের আঁকা রেলেভেন্ট, চমৎকার স্কেচ।

পুরো বই জুড়ে অসাধারণ লেখনী, আর তার চেয়েও মনোমুগ্ধকর গল্পকথকের বর্ণনাভঙ্গি- যেন কোনো এক মৃদু ছন্দে লেখক গল্প বলে যাচ্ছেন। কোথাও এক মুহূর্তের জন্য তাল কাটে নি। উপমার ব্যবহারে উনি না করেছেন কার্পণ্যতা, না অতিরঞ্জনতা।

বইয়ে পরিতোষ সেনের ব্যক্তিগত পারিবারিক  জীবনের চিত্র কিছুটা উঠে এসেছে। উনি বেড়ে উঠেছিলেন ঊনিশজন ভাই-বোনের মাঝে। ক্রমানুসারে, তিনি ছিলেন সপ্তাদশ (১৭)। পরিতোষ সেনের পিতা প্রসন্নকুমার সেনের সাথে তাঁর ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক ছিলো না। এদিকে পুরোদস্তুর সংসার সামাল দিয়ে, প্রসন্নকুমারের দ্বিতীয় স্ত্রী- হেমাঙ্গিনী দেবীর - মায়ের ভূমিকা পালনের খুব একটা সুযোগ ছিলো না। অদৃশ্য দেয়াল আর দূরত্বের উপস্থিতিতে, লেখকের বেড়ে ওঠার মাঝে প্যারেন্টাল অ্যাফেকশানের বেশরকম ঘাটতি ছিল- যার ইঙ্গিত প্রসন্নকুমার, আমি, আগুন- শিরোনামের তিনটি গল্পেই পাওয়া যায়।

লেখক 'আগুন' নামক গল্পে তাঁর পিতার চিতার আগুনের বর্ণনা দেন। সে এমন এক বর্ণনা যা পড়ে যেমন অবাক হয়েছি, তেমন খুব অস্বস্তিও লেগেছে।

বইমেলায় হাঁটতে হাঁটতে কোণার একটা ছোটখাটো স্টলে (বোধি প্রকাশালয়) হঠাৎ বইটা চোখে পড়ে। মূলত স্কেচগুলো দেখেই কেনার আগ্রহ জন্মায়। এই বই পিডিএফ আকারে পড়লে নির্ঘাত এখন হন্যে হয়ে ছুটতাম বইটা কালেকশানে রাখবার জন্য!
Profile Image for musarboijatra  .
283 reviews354 followers
November 5, 2020
জিন্দাবাহার, ম্যাজিকাল একটা বই। অন্যান্য রিভিউ পড়ে হয়তো প্রেক্ষাপট আর 'জিন্দাবাহার' নামের মোজেজা জেনে গিয়েছেন। ভারতের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেনের বেড়ে ওঠা হয়েছে পুরান ঢাকায়। ছোটবেলায় দেখা নিজের পাড়ার কিছু চমৎকার চরিত্রের অবাক-করা জীবনযাপন এসেছে দর্জি হাফিজ মিয়া, সিন-পেইন্টার জিতেন গোঁসাই, ডেন্টিস্ট আখতার মিয়া-দের গল্পে; যাদের অভিনব জীবনের গল্প আদৌ তাদের পেশাগত পরিচয়ের মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
'প্রসন্নকুমার', 'আমি', 'ন'বাবু, সেজবাবু' পরিচ্ছদগুলোয় নিজের একান্ত কাছের মানুষদের বিষন্ন-রঙিন স্মৃতিচারণ করেছেন লেখক। 'হে অর্জুন', 'জামিলার মা' পরিচ্ছদগুলো চিত্রশিল্পীসুলভ দেখার চোখের সাথে লেখকের কলমের মিশেল ঘটেছে যা কিনা পূর্ণতা পেয়ে 'আগুন' গল্পটাকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। পিতার মুখাগ্নির অভিজ্ঞতা যেভাবে তাঁর চিত্রশিল্পী সত্ত্বা চিরে বেরিয়েছে, তা পড়তে গেলেও নড়ে বসতে হবে, তাঁর তুলনাও দিতে মন চাইবে না।

সব কথার শেষ কথা, ন্যারেটিভ ভালো হলে বই পড়ার আনন্দে পূর্ণতা আসতো। (ন্যারেটিভ ভালো, বাংলাদেশের বর্তমানের আর-দশটা বই পড়া পাঠকের কাছে এই বইয়ের লেখনশৈলীকে বেশ ভালো না বললে অবিচার হবে)। তবে ভূমিকায়ই যেমন 'ওবিন ঠাকুরের ছবি লেখা'র কথা বলা হলো, সে তুলনা না দেওয়াই ভালো।

যারা ছবি আঁকেন, স্কেচবুকিং করে থাকেন, এই বই আপনাদের জন্য।

প্রকাশক : প্যাপিরাস (১৯৫৯ সাল)।
দীর্ঘকাল আউট-অব-প্রিন্ট থাকার পর বোধি প্রকাশালয় ২০১৯ সালে ঢাকা থেকে পুনর্মুদ্রণ করেছেন।
মুদ্রিত মূল্য : ৩২৫ টাকা
প্রাপ্তিস্থান : তক্ষশিলা। এছাড়াও বাতিঘর ইত্যাদি বড় দোকানে পাওয়া যেতে পারে।
Profile Image for Titu Acharjee.
258 reviews33 followers
August 21, 2024
পরিতোষ সেন মূলত একজন চিত্রশিল্পী হবার কারণেই কিনা কে জানে, এই বইতেও নিজের সহজাত প্রবৃত্তি থেকে বের হতে পারেননি। শব্দ দিয়ে একের পর ছবি এঁকেছেন পাতার পর পাতা জুড়ে। সেসব শব্দ ছবি এতোই নিঁখুত, এতোই সুন্দর, এতোই মনোরম যে এক ছবি থেকে পরের ছবিতে চোখ ফেরাতে সময় লাগে। চোখ সরতে চায় না। অথচ পরের ছবিতে যখন যাই, তখন আগেরটার চেয়েও বেশি সময় ধরে সেটিকে দেখতে থাকি। শব্দ নির্মিত ছবিগুলো যেন মাথার ভেতর,মনের ভেতর পাক খেতে থাকে।

পরিতোষ সেন এই বইখানায় শব্দ নিয়ে যা করেছেন তাকে এক শব্দে ‘অবিশ্বাস্য’ বলে। একেকটা বাক্য যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। শেষ হতে সময় লাগেনা তবে রেশ রয়ে যায় বহুক্ষণ। জিভে লেগে থাকে মিষ্টি একটা স্বাদ। পড়ার সময় এমনও হয়েছে একেকটা পৃষ্ঠা, একেকটা বাক্য বারবার পড়তে বাধ্য হয়েছি। প্রত্যেকটা দৃশ্য যেন চোখে,মনে গেঁথে গেঁথে যাচ্ছিল এমনই তার মহিমা।

আত্মজীবনী ধাঁচের এই বইখানার কথা আমি মনে রাখবো সবসময়। বলাইবাহুল্য, ইতিমধ্যেই ‘জিন্দাবাহার’ আমার “All time favourite” তালিকায় যুক্ত হয়ে গিয়েছে।
Profile Image for Camelia kongkon.
29 reviews11 followers
August 11, 2021
একশো বছর আগে আপনি যেখানে বর্তমানে থাকেন সেই জায়গাটা কেমন ছিলো জানতে ইচ্ছা করে? একটা স্থান যেটা টিকে আছে বহুবছর ধরে তার গল্প থাকতে পারেনা?
ইচ্ছা করলে নতুন মুখদে�� সে ডেকে ডেকে নিজের গল্প শুনাবে। এইভাবে একটা স্থানের গল্প,একটা মহল্লার গল্প, একটা লেনের গল্প,একটা শহরের গল্প থাকবে। শহরের বুকে হেটে চলা প্রতিটা ব্যস্ত মানুষের জীবন একেকটা গল্প থাকবে। কিংবা পৌঢ় মানুষগুলোর মুখে মাছি বসছে তাদের অবাধ্য ব্যস্ত দিনগুলোর গল্প থাকতে পারেনা?
প্রতিদিন সকালে কে সবার আগে ওঠে,কোন লোকটা বেশি বদরাগী, কোন লোকটা রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে,কোন লোকটা সবচে সাহসী। কিংবা কোন মহিলাটা স্নান শেষে আতর দিলো কোমল ঘাড়ে,কোন মহিলা পাড়ায় সবচে সুন্দর আচার দেয়....এইসব কিছুই তো গল্প। একটা মহল্লার গল্প।
জিন্দাবাহার বইটাও একটি লেনের মানুষদের গল্প। লেনে বসবাসরত ৪০ দশকের পুরান ঢাকার মানুষগুলোর জীবন কেমন ছিলো তার বর্ননা দেন পরিতোষ সেন এই বইয়ে।
বাবুবাজার অঞ্চলের কালীবাড়ির পাশের জিন্দাবাহার লেন বা বাংলায় বলা যায় "তাজা বসন্ত" লেন।
চিত্রকর পরিতোষ সেনের পৈতৃক নিবাস ছিলো এই জিন্দাবাহার লেন। বলে রাখি, পরিতোষ সেন লেখক নন,চিত্রকর।
একটা কথা আমার মাথায় সবসময় ঘোরে,যে মানুষ যে কাজে পটু সে মানুষ দুনিয়াটাকে সেভাবেই দেখে। দেখবেন, একজন শিক্ষক সবসময় সবাইকে ছাত্রের চোখে দেখে,দার্শনিক সবকিছুতেই দর্শন খোঁজে। তাই আপনি এই বইয়ে সাহিত্য খুঁজতে বসলে পরিতোষ সেন স্বয়ং আপনার মাথায় একটা গাট্টা বসিয়ে দেবেন সজোরে।
বরং লেখাগুলোকে আপনি চিত্রকরের চোখে দেখুন। ভাবুন সেগুলো লেখার বুননে আঁকা সুন্দর একেকটি ছবি। বিশ্বাস করুন আপনার একটুও অসুবিধে হবেনা ভাবতে। বইটি লেখাই সেভাবে। জিন্দাবাহার লেনের মানুষদের নিয়ে নয়টি গল্পের সমাহারে আঁকা বই।
বইয়ের শুরুতে দর্জি হাফিজ মিয়া"র গল্প। সুক্ষ্ম হাতের কাজের জন্য যিনি বিখ্যাত। সাংঘাতিক নিজের হাতের কাজ দিয়ে দূর দুরান্তের মানুষকে তিনি অবাক করতেন, তেমনি তার ছিলো পায়রা ওড়ানোর সখ। পায়রার ঘরের পালা খুলে দিয়ে তাদের উড়তে দেখে উদ্দাম স্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠত "কামাল,কামাল,গজব, গজব"
এরপর জিতেন গোসাঁইর গল্প,যিনি ছিলেন অসম্ভব গুনি আঁকিয়ে। সাদা সাধারণ কাপড়ে তুলির আচঁড়ে তুলে আনতেন দুর্বোধ্য সব চিত্র।
ডেন্টিস্ট আখতার মিয়া পেশা তার ডেন্টিস্ট হলেও শিকার করেছেন বাঘ। ঢাকা থেকে ভাওয়ালের রাস্তায় তখন ঘন জঙ্গলে শিকারও হত।
লেনের গুনী মানুষদের থেকে উঠেই তিনি পাঠকদেরকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন নিজের পরিবারের দিকে। ছবির মত সুন্দর শৈশবের বিবরণ পড়তে বলে নিয়ে যাবেন আপনাকে প্রসন্নকুমার গল্পে। সেখানে পরিচয় হবে পরিতোষ সেনের ছোটবেলার সাথে। তার বাড়ির অন্দরমহলে।
প্রসন্নকুমার গল্পটা পরিতোষ সেনের বাবাকে নিয়ে। বাবার মৃত্যুতে কিশোর পরিতোষ সেনের জীবনে আসা ধাক্কাটা যেন তিনি লিখতে বসেননি। আঁকিয়ে দেখিয়েছেন কতটা খোদিত হয়েছিলো তার কিশোর হৃদয়।
পরক্ষনেই বইয়ের ভেতর সবচে বড় ধাক্কাটা খাবেন।
আগুন গল্পটা কেনো জানি শেষ হতেই সব ছাড়খাড় করে দিয়ে গেলো। সব গল্পকে ছাড়িয়ে গেলো। চিতার আগুনের এক ভয়াবহ বর্ননা নিয়ে আগুন গল্পটা। একটুখানি চিতার আগুন নিয়ে গল্প হয়?
বাবার মৃত দগ্ধরত লাশের সামনে ছেলের অভিব্যক্তি কেমন হতে পারে? সেই অভিব্যক্তি কাগজে কিভাবে তব্দা লাগিয়ে দেয়?
"আগুনও কুম্ভকর্ণের মত ঘুমিয়ে পড়ে না কি!তাকেও কি বর্শার ফলকের খোঁচা মেরে জাগিয়ে দিতে হয়?"
.
লিখেছেন "ন'বাবু,সেজোবাবু,হে অর্জুন,জমিলার মা"য়ের মত গল্পগুলো। যেখানে মমতা,ও শৈশবের সুখ, দুঃখের স্মৃতি মিশে যায় একসাথে।
সুপ্রাচীন ইতিহাসকে পরিতোষ সেন বেশ সুন্দরকরে স্মৃতির পাতা থেকে কাগজের পাতায় স্থান দিয়েছেন।
প্রতিটা গল্পে খালি স্মৃতিচারণই নয়,বরং তৎকালীন সমাজের নিয়মকানুন, মানুষের মধ্যকার প্রেম এবং প্রকৃতির চমৎকার বর্ণনা রয়েছেই।
তাছাড়া বইয়ের সাথে জুড়ে দেওয়া ইলাস্ট্রেটগুলোও ভাবণাকে আরো জীবন্ত করে দেয়। ছবি ও লেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বইয়ের পাতায়।
প্রথম পাতা উল্টিয়েই যখন দেখতে পান সুন্দরী এক মেয়ের ছবির নিচে লেখা" অন্দরমহলের চিক সরিয়ে অল্পবয়সী একটি ফুটফুটে মেয়ে রঙ বেরঙের প্রজাপতির চালে ঘরে ঢুকল" ধক করে মনেহয় বইটি খুলেছি এটা কেউ নিজহাতে লেখককে জানান দিলো এবং লেখক পাঠককে স্বাগত করল।
এবার সে তার অনন্য হাতের লেখনীতে আবিষ্ট করে রাখবে সকল পাঠকদের।
হ্যাপি রিডিং।
Profile Image for DEHAN.
275 reviews86 followers
May 7, 2020
পরিতোষ সেন এর আত্মকথা পড়লাম । সেই সময়ে পুরাতন ঢাকার চমৎকার বর্ণনা করেছেন ভদ্রলোক । শুধু বর্ণনা নয় মাঝেমধ্যে চিত্র এঁকে পাঠকের কল্পনার জিন্দাবাহারের অলিগলি আরো পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন ।
তাছাড়া আমি এর মধ্যে পেয়েছি এ পর্যন্ত আমার পড়া মৃত পোড়ানোর দৃশ্যগুলোর সবচাইতে বিশ্বাসযোগ্য এবং অনবদ্য বর্ণনা।
দশ এগারো বছরের এক শিশু তার পিতার দাহকর্মে উপস্থিত থেকে পিতার শরীর একটু একটু করে দগ্ধ হতে দেখে ।
লেখক ব্যাপারটা এমন ভাবে ব্যখ্যা করেছেন যেন মনে হয় শুধু পিতার দেহ পুড়ছে না , পুড়ে যাচ্ছে দূরে দাঁড়ানো সন্তানের শৈশবের একটা গুরত্বপূর্ণ অংশ । আহারে !
Profile Image for Momin আহমেদ .
112 reviews49 followers
August 16, 2023
পরিতোষ সেনের শৈশব কৈশোরের কিছু সময় কাটে পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার গলিতে। এরপর বাড়িছাড়া। জীবনের লম্বা সময় পার করে অর্ধশতাব্দী পরে সেই শৈশবের স্মৃতিচারণ করছেন এই বইতে। আমি বইটা পড়তে পড়তেই উপলব্ধি করলাম আমার নিজের বাড়ি গ্রাম গ্রামের মানুষ এরা আমার কতো আপন। আবার কতো মুখচেনা মানুষ আমার স্মৃতিতে কতো গভীর ভাবে আমার মনের মধ্যে জায়গা করে আছে।
সেই ছোট্টবেলায় এক দোস্ত ছিল। রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে যখনই দেখা হতো হাত তুলে জিজ্ঞাসা করতো "দোস্ত ভালো?"। এরপর আমরা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলতাম ধাদা বলতে। দোস্তর লম্বা পাকা দাড়ি মেহেদি দিয়ে রাঙানো। সেই হাস্যজ্জ্বর চেহারা এখনো স্পষ্ট মনে আছে।
আর একজন ছিলেন দাতবীহিন বিশিষ্ট গায়ক। দাত না থাকায় তার ঠোট মুখের ভিতরে ঢুকে থাকতো। হয়তো স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় দেখা হলে সবাই মিলে ধরতাম একটা চাইনিজ জার্মান বা স্প্যানিশ গান শোনার জন্য।
এছাড়া করতোয়া নদীর পারে বসে নির্নিমেষ তাকিয়ে কেটে যায় কতো সময় ভাবছি চারশো কিলো দূরে হলের রুমে বসে।
এভাবেই উপলব্ধি করি একটা বই কিভাবে আমাদের পুরনো জিনিস গুলোই নতুন ভাবে দেখার চোখ খুলে দেয়।
Profile Image for Asikul Islam  Himel.
39 reviews5 followers
March 9, 2025
বাবুবাজার ব্রীজ দিয়ে ঢাকায় ঢোকার সময় হাতের ডানে খেয়াল করলে দেখা যায় ইসলামপুর, সদরঘাটের রমরমা রাস্তার সাথে জিন্দাবাহার নামক চুপচাপ গলি মিশে আছে৷ এখানেই শৈশব কৈশোরের ১৬ বছর পার করেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী পরিতোষ সেন৷ তার ছবি আঁকার হাতেখড়ি এই জিন্দাবাহার লেনেই হয়েছিলো এরপর ঘুড়ে বেড়িয়েছেন দেশে-বিদেশে কিন্তু ঢাকাকে ভুলতে পারেন নি৷ ভুলে-ভালে একবার ভালোবেসে ফেললে ঢাকা কে কি ভোলা যায়? সেজন্যই হতচ্ছাড়া শহর ঢাকা ছাড়ার পঞ্চাশ বছর পর রঙ তুলি ফেলে আর্টিস্ট যখন কলম তুলে নিলেন, জিন্দাবাহার লেনেরই কিছু ক্যারেক্টারের গল্প বললেন, বলা ভালো অক্ষরের মাধ্যমে ছবি লিখলেন।
ত��র স্মৃতিচারণের নায়ক গলির তুখোড় দর্জি হাফিজ মিঞা, হাতুড়ে ডেন্টিস্ট আখতার মিঞা, সিন-পেইন্টার জিতেন গোঁসাই, এমনকি একখান লম্বা-চওড়া অর্জুন গাছ পর্যন্ত।
মাঞ্জা দেয়া ঘুড়ি কাটাকাটি, গেরোবাজ পায়রাবাজী কিংবা গ্রামের অর্জুন গাছকে ভালোবাসতে বাসতে পিছনে পড়ে যায় সোনালি দিন আর এসবের মাঝেই বেঁচে থাকে ঢাকা, আলগা হাওয়ায় পায়রা ভাসায় পালক বুক, হুডতোলা রিকশায় প্রেম করে ময়ূরী আর মারজুক৷
Profile Image for Kripasindhu  Joy.
543 reviews
February 25, 2025
এমন কিছু পড়ে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কিই বা হওয়া যায়!
এখানে আমরা শুধু স্মৃতিকথাই পড়ি না বরং ঘুরে আসি শতবছর আগের ঢাকা থেকে। যেখানে বাল্যে বাবাকে হারায় সপ্তদশতম সন্তান। নবাব বাড়ির অপরূপ মেয়েরা তাকে উপহার দেয় ঘুড়ি। আগুন দেয় জীবনের শিক্ষা।
Profile Image for Ahmed Aziz.
381 reviews69 followers
November 29, 2024
একজন চিত্রশিল্পীর অনন্যসাধারণ দেখার চোখের নেশা ধরানো লিখিত বহিঃপ্রকাশ। গত শতকের বিশ ত্রিশ দশকের ঢাকার জিন্দাবাহার গলির জীবন্ত বর্ণনা, সাথে লেখকের আঁকা দুর্দান্ত সব স্কেচ। শিল্পীর মত দর্জি আর কবুতর বিশেষজ্ঞ হাফিজ মিঞা, যাত্রা থিয়েটারের সিন পেইন্টার জিতেন গোঁসাই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক, শিকারি, হাতুড়ে ডেন্টিস আখতার মিঞা; লেখকের জাঁদরেল বাবা বিখ্যাত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক প্রসন্নকুমার, বিশাল একাম্নবর্তী পরিবার, নবাব বাড়ি, পুরান ঢাকার বিখ্যাত খানাপিনা, সবুজ গ্রামের প্রকৃতি, পুজা, রথযাত্রা, পিতার চিতার আগুনের ভয়ানক রূপ, ভেঙে পড়া একান্নবর্তী পরিবার, দুশ্চরিত্র ভাইয়েরা, রূপবতী বারবণিতা, মহীরুহ অর্জুন বৃক্ষ আর মায়ের মত স্নেহশীল আত্মীয়ের বেশি জমিলার মা সব মিলিয়ে মনে হয় ফেলে আসা দূর অতীতের রূপকথা যেন।
Profile Image for Ashik.
220 reviews40 followers
July 11, 2024
এ ধরনের স্মৃতিকথা পড়তে একটা আলাদা ভালো লাগা কাজ করে। শুধুমাত্র হাফিজ মিঞা এবং জামিলার মা'র অংশের জন্যেই ৫ তারকা দেওয়া যায়।
Profile Image for হাঁটুপানির জলদস্যু.
299 reviews228 followers
June 18, 2020
দেশ মানে আসলে ঘুরেফিরে অল্প কিছু মানুষ। একেকজনের দেশও তাই একেক রকম। পরিতোষ সেনের টুকরো স্মৃতিকথার সংকলনে এমন এক দেশের ছবি উঠে এসেছে, যেখানে যাওয়ার একমাত্র যান এই বইটিই। চিত্রীর তুলি যখন কলম বনে, হয়তো রং-জল-তেল কোথাও দু'বিন্দু বেশি পড়ে; সে দোষ ঢেকে গেছে অকাপট্যের গুণে।
Profile Image for Onu Tareq.
29 reviews209 followers
July 6, 2022
অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর পরিতোষ সেনের ঢাকায় কাটানো শৈশব স্মৃতিকথা ‘জিন্দাবাহার’-এর বহু সুনাম শুনেছি নিজস্ব শৈশব থেকেই, কিন্তু বইটি সুল্ভ ছিল না, বিধায় কোন ভাবেই সংগ্রহ সম্ভব হয়ে উঠে নি। সম্প্রতি বইটি পুনঃমুদ্রিত হয়েছে, ঢাকাতেও এবং কলকাতাতেও। গতকাল রাতে পড়ার পর থেকেই এক অবসন্ন করা মুগ্ধতা তাড়া করে ফিরছে, যেন শুধু নিজে পড়ে আত্মস্থ করলেই এই অসামান্য শব্দমালার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায় না, সেই সাথে অন্যদেরও জানাতে হয় এই বইটি নিয়ে, সেই কথামালাগুলো নিয়ে। মানুষটাকে নিয়ে।

পরিতোষ সেন মূলত একজন চিত্রকর, জগৎজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন ছবি এঁকেই, পাবলো পিকাসো স্বয়ং তাঁর হাতের আঁকার বেশ প্রশংসা করেছিলেন সামনাসামনি সাক্ষাতে। এই বইতেও তিনি এঁকেই গেলেন, একের পর এক শব্দতুলির আঁচড়ে আমাদের সামনে মনের ফাঁকা ক্যানভাসে নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুললেন তাঁর শৈশবের দিনগুলি, যা মূলত কয়েকজন মানুষকে ঘিরে আবরতিত,এই ভাবেই চিরচেনা হয়ে যায় আমাদের কাছে, দর্জি হাফিজ মিঞা, থিয়েটারের চিত্রকর জিতেন গোঁসাই, হাতুড়ে ডেন্টিস্ট আখতার মিয়াঁ যিনি টেনিদা-ঘনাদাকে হার মানিয়ে খালি হাতে বেঙ্গল টাইগারের ভবলীলা সাঙ্গ করেন,মায়াময়ী কাজের মানুষ জমিলার মা, তাঁর বাবা বৈদ্যরাজ প্রসন্নকুমার, দুই বিটকেল বড় দাদা, শৈশবের অন্যান্য গল্প ও একটি অর্জুন গাছ।

কী নিপুণ ভাবে একটার পর একটা চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তোলেন আমাদের সামনে অবলীলায়, যেমন দর্জি হাফিজ মিঞাকে নিয়ে লিখেছেন,

‘আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে, দশ হাতের মধ্যেই, হাফিজ মিঞার দর্জির দোকান। আসন ক’রে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে মিঞা কাঁচি হাতে যখন কোটের ছাট দিতে বসত তখন দেখে মনে হ’ত ঠিক যেন গান্ধার শৈলীর অবিকল বুদ্ধমূর্তি। বুকের পাঁজরের খাঁচাটা যেন তার তিন জ’ পেরেকের মতো সরু শরীরটা থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। খাঁচার তলার পেটের গর্তটি যেন অবিকল একটি আড়াই-সেরি দই-এর খালি ভাঁড়।‘

এইভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন সকলকেই, আবার স্কেচও করেছেন, সেই গুলোই দিলাম উনার পাতার পর পাতার লেখা অমৃতশব্দমালা আর টাইপ না করে।

আর দিনের শেষে তিনি একজন শিল্পী, রঙ নিয়েই তাঁর কারবার, সেই রঙ তি
নি খুঁজে নিয়েছেন সবখানেই, এমনকি শৈশবে জ্বলতে দেখা বাবার চিতার আগুনেও পেলেন লাল রঙের ফুলঝুরি-
“তার হাঁ-করা মুখের গহ্বর থেকে এবার-একটা নয়, সাত-সাতটা-আনাভিলম্বিত লকলকে জিভ যেন রক্তের সাতটা পাহাড়ী প্রস্রবণ। তার ভয়ংকর মুখমণ্ডল-চুল থেকে নিয়ে জিভের ডগা পর্যন্ত সবটাই যেন পৃথিবীর তাবৎ লাল রঙের মিলনক্ষেত্র। রক্তজবার লাল, রক্তকরবীর লাল, পলাশের লাল, শিমুল ফুলের লাল, কৃষ্ণচুড়ার লাল, রঙ্গনের লাল, রডোডেনড্রনের লাল, বকুল-বটফল-লিচুর লাল, শীতের বাদাম পাতার লাল, তরমুজের লাল, আবির-আলতার লাল, স্বর্ণসিন্দুর মকরধ্বজের লাল, মোরগের ঝুঁটির লাল, টিয়েপাখির ঠোঁটের লাল-আরো যে কত রকমের লাল, তার হিসেব কে করে! পৃথিবীর সব ইস্পাত কারখানার ফার্নেসের পুঞ্জিত উত্তাপে যেন লালের নির্যাস তৈরি হচ্ছে। আমার পলক পড়ছে না। আমি স্বপ্নাবিষ্ট, অর্ধ-অচৈতন্য।”

আবার গ্রামের স্মৃতি ভরে আছে সবজেটে রঙের মহাবিশ্বে,

"ঢাকা জেলার আমাদের গ্রামের কথা মনে এলেই চোখের সামনে একটা অ্যাবস্ট্রাকট ছবি ফুটে ওঠে। আগাগোড়া সবুজ রঙ দিয়ে আঁকা। নানারকমের সবুজ থাকে-থাকে সাজানো। অনেকটা নামকরা মার্কিনী আর্টিস্ট মার্ক রথকো-র আঁকা ছবির মতো। এক কথায় বলা যায় একটা সবুজের সমুদ্র। ভরা বর্ষা আর বসন্তে মনে হ’ত যেন সারা গ্রামটা এইমাত্র সবুজ আলোর পুকুরে ডুব দিয়ে উঠেছে। সব-কিছু যেন একটা সবুজ কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখছি, যেন সব-কিছু সবুজ সেলোফিনে মোড়া। কোনো-কোনো অচেতন মুহূর্তে মনে হয় যেন সূর্যটিও সবুজ। রোদের রঙটাও সবুজ। চারিদিকে এমনই সবুজের ছটা। আকাশের নীলের তলায় গাছপালার সবুজ, তার তলার জলের নীল-সবুজ, পলিমাটির ছাই রঙের ওপর ঘাসের সবুজ, শ্যাওলার সবুজ, কুচুরিপানার সবুজ, কচুপাতার সবুজ- কালো –সবুজ, নীল-সবুজ, গাঢ়-সবুজ, হলদে–সবুজ, এমারেল্ড—সবুজ, ওনিক্সি—সবুজ, টার্কোয়াজি–সবুজ, চীনাজোড়ি–সবুজ, সবুজ–সবুজ, আরো–সবুজ- এক সবুজের সিমফনি। আঃ! সব ইন্দ্রিয়গুলো যেন সবুজের সংগীতে ঘুমিয়ে পড়ে। “

কী যে সব দৃশ্য একের পর এক তৈরি করে রংতুলির জাদুকর তাঁর কলম নামের তুলি দিয়ে।

“আমাদের পাড়ার বারবনিতারা প্রতিদিন সকালে দল বেঁধে বুড়িগঙ্গায় স্নান করতে যায়। তাদের স্নানে যাবার পথটি আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই। ভেজা কাপড়ে ফেরবার পথে কালীমন্দিরের দরজায় প্রণাম ক’রে আমাদের গলির মুখে আবার দেখা দেয়। সকালবেলার এই মনোরম দৃশ্যটি আমাদের পাড়ার পুরুষদের চোখকে তৃপ্তি দেয়। তাদের মন-মেজাজ খোশ রাখে। দিনটি ভালো রাখে।”

এভাবে নিজের দুই বড় দাদার জীবনের মোচ্ছবের বর্ণনা আসে, এবং তিনি যে বালক অবস্থায় সেই গৃহে ফুলবাবু দাদার সাথে যেয়ে দাদার প্রেমিকার সাথে দেখা হয়েছিল সেই কথা জানান দেন আমাদের, সেই সাথে নর্তকীর উদ্দাম নাচের সুচারু বর্ণনা। কিন্তু তারও আগে আসে বাবা ও তার বৈদ্য চিকিৎসার নানা গল্প,

"সেন-পরিবারের সরষে পরিমাণ আফিম খাওয়ার রেওয়াজ নাকি অনেক কালের। আমার ঠাকুমা কে খেতে দেখেছি। কি শক্ত বুড়ি। দীর্ঘ পচানব্বই বছর অব্দি বেঁচে ছিলেন। আমার দিদিমাও খেতেন, তিনিও প্রায় ঐ-রকম বয়সেই দেহত্যাগ করেছিলেন। সম্পূর্ণ মজবুত দু-পাটি দাঁত এবং লাঠির মতাে শক্ত শরীর নিয়ে শেষদিন পর্যন্ত স্বপাক রান্না ভােগ করে গেছেন। এমন সৌভাগ্য কজনের হয়।"

আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে টনিক হিসেবে এটুকু আফিম প্রচুর দুধের অনুপানে খেলে নাকি মানুষ সবল ও দীর্ঘায়ু হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে আমার কনিষ্ঠভ্রাতার যখন জন্ম হল, বাবার বয়স তখন পঁচাত্তর বছর।

উল্লেখ্য বাবার প্রথমা স্ত্রী প্রয়াত হওয়ায় ২য় স্ত্রী অর্থাৎ লেখকের মাকের বিবাহ করেছিলেন, এবং দুই ঘর মিলিয়ে জনা-বিশেক ভাইবোন ছিলেন তারা! বাবার চিকিৎসার বেশ সুনাম ছিল, এবং তার চিকিৎসার সেরা ওঠা একাধিক রোগী ও তাদের রোগের মনোগ্রাহী বর্ণনা দিয়ে ফের উনি আমাদের নিয়ে যান ঢাকার নবাবদের বাড়িতে, যে নবাব কাঁচের গ্লাসে শরবত দিয়েছে বলে বকাবকি করে রূপোর গ্লাসে তাদের শরবত পরিবেশন করেন-

“অর্ধশায়িত অবস্থায় নবাব মখমলে-মোড়া, বিশাল তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আছেন। নবাব-বাদশাহদেরই এমন চেহারা হয় বটে। বেদানার মতো গোলাপী গায়ের রঙ। নীল টানা চোখ আর কটা চুল। হাতে আতরে-ভেজা রেশমী রুমাল! সেটি মাঝে-মাঝে নাকের ডগায় তুলে ধরছেন। তার সুবাস ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর শরীরটি একটি দামী কাশ্মীরী শালে ঢাকা। জ্বর হয়ছে কি? ঐ অবস্থায় ডান হাতটি ইষৎ তুলে তিনি বাবাকে সশ্রদ্ধ আদাব জানালেন! চোখ বুজে বাবা নবাবসাহেবের নাড়ী পরীক্ষায় মনোনিবেশ করলেন।”

অপূর্ব বইখানা, সেই কবে ধোঁয়াটে শৈশবে নাম শুনেছিলাম আলী ইমামের এক স্মৃতিচারণায়, আজ এতদিনে পড়া হলো। কিন্তু পড়েও তুরীয় আনন্দ পেলাম, মনে হলো এত দিনে পড়াটাই হয়তো ভালো হয়েছে । কিন্তু সবচেয়ে মনে দাগ কেটে গেলে এক অর্জুন গাছকে নিয়ে তাঁর উৎসর্গ করা আস্ত একটি অধ্যায়, ‘হে অর্জুন’, সমগ্র বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ গাছকে নিয়ে কী এত অসামান্য শব্দনৈবদ্য আর আছে, যেটা চিত্রকর পরিতোষ সেন তাঁর মাষ্টারপিস শৈশব স্মৃতিকথা 'জিন্দাবাহার'এ 'হে অর্জুন' অধ্যায়ে পুরোটা জুড়ে এঁকেছেন শব্দতুলিতে? বড়ই পরিতাপের বিষয় যে তাঁর প্রিয় ঢাকা শহরের অধিকাংশ মানুষই অর্জুন গাছ চেনে না, সর্বোচ্চ তার ছালের নাম জানে।

১৯১৮ সালে জন্ম পরিতোষ সেনের, মানে এই জীবনগল্পগুলো সবই প্রায় শতবর্ষ আগের, যদিও বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৯/৬০ সালে। ব্যক্তিগত জীবনেরও গল্প হলেও এখানে তৎকালীন ঢাকার জনজীবন ও সমাজের অমূল্য সব তথ্য লুকিয়ে রাখা আছে নানা বেশে প্রতি পাতার পরতে পরতে। সত্যজিৎ রায় এ গ্রন্থে খুবই আলোড়িত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'পরিতোষবাবুর চিত্রশিল্পের সঙ্গে আমাদের পরিচয় অনেক দিনের। সম্প্রতি তিনি মাঝে মাঝে তুলির পরিবর্তে লেখনীর সাহায্যে ছবি আঁকতে শুরু করেছেন। এ কাজে তার যে নতুন পরিচয়টা পাওয়া গেল সেটা যুগপৎ বিস্ময় ও পুলকের উদ্রেক করে। তীক্ষষ্ট স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে তিনি তার জীবনের নানান ধরনের যেসব অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন এবং লিখছেন, তাতে শিল্পীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির নজির তো আছেই, তা ছাড়া আছে বহু বিচিত্র ঘটনা আর চরিত্রের সমাবেশ, যার সুসংবদ্ধ ও সরল বিবরণ তাকে সাহিত্যের আসরে স্থান করে দেবে বলে আমার বিশ্বাস।'

এটাই বলতে পারি যে এটা একটা অবশ্যপাঠ্য বই, এবং বাংলাদেশে নতুন করে ছাপানোর জন্য তক্ষশীলার প্রকাশনা বিভাগ ‘বোধি প্রকাশালয়’ এবং কলকাতার প্যাপিরাসকে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
Profile Image for Wazedur Rahman Wazed.
Author 2 books22 followers
May 29, 2021
"যে লোক কর্মের মধ্যে তার জীবনদর্শন খুঁজে পেয়েছেন, তার সঙ্গী কিংবা আড্ডার প্রয়োজন কীসের! একাকিত্বের নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ও প্রকৃত আনন্দের স্বাদও পেয়েছেন তিনি এরই ভেতর দিয়ে। সময়ের অপচয় তার কাছে পাপতুল্য অপরাধ।" - পরিতোষ সেন

বুড়িগঙ্গার পাড় ঘিরে যে জনপদ গড়ে উঠেছিল, তা-ই মূলত আজকের পুরান ঢাকা নামে খ্যাত। আহসান মঞ্জিল এবং লালবাগ কেল্লা ছাড়াও এ অঞ্চলের অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্য আর ইতিহাস। আধুনিক আর নতুন ঢাকার পাশাপাশি সেসব ঐতিহ্যকেই আঁকড়ে ধরেই বিচ্ছিন্ন এক জনপদের মতোই এখনো টিকে আছে পুরান ঢাকা এবং সেখানকার অধিবাসী ঢাকাইয়ারা। বিচিত্র স্বভাবের মানুষগুলোর বসবাস এই জনপদে। গলি-ঘুপচিতে পূর্ণ এই জনপদ ঘিঞ্জি এলাকা বলেও খ্যাত। তবে এখানকার বিচিত্র বাসিন্দাদের মতোই শত শত গলি-ঘুপচির নামেও রয়েছে বৈচিত্র্য। আর নতুন ঢাকার দিকে মুখ উঁচিয়ে এসব স্থান যেন তার হারানো ঐতিহ্য আর অতীত জৌলুসের কথাই প্রচার করে। আছে গলির বহর, বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর এই পুরান ঢাকা। তেমনই এক গলির নাম জিন্দাবাহার লেন।

উর্দু শব্দ জিন্দেগী (জীবন) থেকে জিন্দা (তাজা, জীবন্ত)। আর তার সঙ্গে এসে জুড়ে গেছে বাহার (বসন্ত)। একসঙ্গে জুড়ে দিলে হয় 'জিন্দাবাহার', যার অর্থ দাঁড়ায় 'তাজা বসন্ত'। এমন অভূতপূর্ব আর অপূর্ব এক সড়ক নিয়ে গোটা কয়েক গ্রন্থ রচিত হলেও অবাক হবার কোনো কারণ নেই। কারণ যে গলির নামটাই এমন বৈচিত্র্যময়, সেখানকার বাসিন্দারা কতটা বিচিত্র হতে পারে, তা ভেবে আনন্দ অনুভূত হয়।

এমনই এক বৈচিত্র্যময় গলিতে জন্মেছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী শিল্পী পরিতোষ সেন। শৈশব কেটেছিল তার এই ঢাকাতেই। ইউরোপ থেকে আর্টের শিক্ষা গ্রহণ করা সত্ত্বেও নাড়ির টানে ফিরে এসেছিলেন পরিতোষ সেন। তিনি ছিলেন কলকাতা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। কলকাতা গ্রুপ ছিল মূলত আর্ট মুভমেন্ট, যা ১৯৪২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠা পায়। পরবর্তী সময়ে এই কলকাতা গ্রুপ থেকেই ভারতীয় শিল্পকলায় মডার্ন আর্ট ব্যাপক হারে প্রচার বৃদ্ধি লাভ করেছিল।

১৯৫৯/৬০ সালের দিকে পরিতোষ সেন 'জিন্দাবাহার নামে' একটি গল্পসংকলন প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি তার শৈশব জীবনের নিত্যদিনের জীবনীকে পুঞ্জি করে গল্প বলেন পাঠকদের উদ্দেশে। একজন চিত্রকরের বয়ানে ঢাকার এক অচেনা আর অজানা রূপ সম্পর্কে জানতে পায় পাঠককূল। তাই জিন্দাবাহারকে কেবলই গল্পগ্রন্থ না বলে পরিতোষ সেনের আত্মজীবনী বা স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থও বলা চলে।

পরিতোষ সেনের উত্তরসূরীর অনুমতি নিয়ে বইটি পুনরায় বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ করে বোধি প্রকাশনালয়। যা মূলত আজিজ সুপার মার্কেটের বুকশপ তক্ষশীলার প্রকাশনা বিভাগ। বইটির প্রচ্ছদ এবং ভেতরে থাকা গল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আঁকা ১৩টি চিত্রকর্মও স্বয়ং লেখকেরই সৃষ্টি। 'দর্জি হাফিজ মিঞা', 'সিন্‌-পেন্টার জিতেন গোঁসাই', 'ডেন্টিস্ট আখ্‌তার মিঞা', 'প্রসন্নকুমার', 'আমি', 'আগুন', 'ন’বাবু, সেজোবাবু', 'হে অর্জুন' এবং 'জামিলার মা নামে সর্বমোট নয়টি গল্প স্থান পেয়েছে বইটিতে। বইটির প্রচ্ছদ, কাগজ, বাঁধাই, চিত্রিত পাতা, সর্বোপরি বইটির আউটলুক এবং গেটআপ দারুণ।

গল্পগ্রন্থের শুরুতেই তিনি পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন 'হাফিজ মিঞা'র। কেবল চোখের দেখাতেই একজন মানুষের পোশাক তৈরির অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল এই দর্জির। তাইতো, স্বয়ং নবাবপুত্রও আসতেন তার কাছে কাপড় বানাতে। তবে পেশার বাইরে মানুষ হিসেবে ভীষণ একরোখা আর রগচটা হাফিজ মিঞা। নেশার মধ্যে ছিল কালেজা-কা সালন্‌ (কলিজার তরকারি) আর কবুতর। একদিকে সালন্‌-এর জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কারো গায়ে হাত তুলতে যেমন দ্বিধাবোধ করতেন না, ঠিক তেমনি আবার পায়রাগুলোর সঙ্গে কাটানো সময়ে নরম মনের হাফিজ মিঞার দেখা মিলত।

এর পরই পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় হয় জিন্দাবাহার লেনের আরেক গুণীর সঙ্গে। নাম তার জিতেন গোঁসাই। পেশায় তিনি একজন আঁকিয়ে। থিয়েটারের জন্য বিশাল থান কাপড়ে বিভিন্ন দৃশ্য আঁকাই ছিল তার নেশা ও পেশা। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে গোঁসাইবাবু নিজের সুখটাকে খুঁজতেন বিশাল ক্যানভাসের বিভিন্ন দৃশ্যে। তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রায় প্রায়ই সেখানে উপস্থিত হতেন শৈশবের পরিতোষ সেন। অন্যদের তাড়িয়ে দিলেও তাকে বসিয়ে কাজ দেখাতেন। মাঝেমধ্যে জিতেন গোঁসাই বলতেনও বটে, "তোর হবে"। সেটাই কি তবে ছিল পরিতোষ সেনের চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার শুরু? আর জিতেন গোঁসাই-ই ছিলেন তার গুরু?

এর পরই আসে ডেন্টিস্ট আখ্‌তার মিঞার গল্প। জিন্দাবাহার লেনের এই ডাক্তার ওয়ার্ল্ড রিনাউন্ড, মানে বিশ্ববিখ্যাত। তার কারণও রয়েছে বটে। কেননা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা এই ডেন্টিস্টের ঝুলিতে রয়েছে বাঘ শিকারের মতো বড় রকমের অর্জন। একদিন আচমকা সেই গল্প পরিতোষ সেনকে শুনিয়ে দেন আখ্‌তার মিঞা। পাঠক হারিয়ে যায় উনিশ শতকের সেই দুর্ধর্ষ অভিযানের জগতে।

পরের গল্পে এসে পাঠক শুরুতে ভিড়মি না খেলেও গল্পের মধ্যভাগে খানিকটা অবাক হবে লেখকের নির্মোহতা আর সত্যতার কাছে। নিজের পিতাকে নিয়ে রচিত এই গল্পের নাম 'প্রসন্নকুমার'। পেশায় ভেষজ ডাক্তার। সেন পরিবারের মতো বিশাল এক পরিবারের কর্তাবাবু তিনি। পুরো গল্প জুড়েই পাঠকের কাছে এক প্রচ্ছন্ন শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হন লেখকের জনক। বিশ সন্তানের জনক, কবিরাজ এই মানুষটাকে এতটা সম্মান আর শ্রদ্ধার পাত্র বানানো সত্ত্বেও চাপা অভিমানও যেন পাঠকের কাছে স্পষ্টই প্রকাশ করেছেন লেখক।

'আমি' নামক গল্পের নিজেদের পারিবারিক টানাপোড়েনের সংসারের কথা বাদেও তখনকার সময়ে নবাববাড়ির কথাও তুলে ধরেছেন লেখক। এমনকি অসচ্ছল এক পরিবারের সন্তান হলেও যে মাঝেমধ্যে বিলাসিতার ইচ্ছা জাগে; সেটাও প্রকাশ পায় গল্পে। এমনকি রূপসী বাংলার যে অপরূপ দৃশ্য লেখকের চোখকে আজীবন প্রশান্তি দিয়ে গেছে, তার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এভাবে,

রূপসী বাংলার এ বিশিষ্ট ছবিটি মনে এলে, আজও আমাকে উদ্‌ভ্রান্ত ক’রে তোলে। আমাকে নিয়ে যায় অনেক দূরে, অনাবিল এক সৌন্দর্যের জগতে, যেখানে জীবন খুলে দেয় এক খুশির দুয়ার।

'জিন্দাবাহার' এতটুকু অবধি পড়ে যে কারোরই মনে হবে, লেখক হয়তো তার শৈশবের সুখস্মৃতির বর্ণনা দিয়ে গ্রন্থটি রচনা করেছেন। কিন্তু বাস্তব জীবনও তো এমন নয়। সুখ ক্ষণস্থায়ী, আর দুঃখ যে মানুষকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে– এই ব্যাপারটাই যেন পরিতোষ সেন বর্ণনা করেছেন তার পরবর্তী গল্পগুলোতে।

অর্জুন গাছের মতোই বিশাল পরিসর আর ছায়া হয়ে থাকা বিশ সন্তানের পিতার মৃত্যু দিয়ে পরিতোষ সেন 'আগুন' নামক এক গল্প লেখেন। নিজের পিতার মৃত্যুতে ব্যক্তি পরিতোষ, লেখক পরিতোষ এবং চিত্রকর পরিতোষ– তিনটি সত্ত্বা যেন মিলেমেশ একাকার হয়ে যায় এ গল্পে। পিতার চিতার আগুন তাকে যতটা যন্ত্রণা আর বেদনা দিয়েছে, ঠিক ততটাই যেন শক্তিশালী হবার মন্ত্রও ফুঁকে দিয়েছে। ঠিক একই রূপ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার 'হে অর্জুন' নামক গল্পে। দুটো গল্পের পটভূমির চাইতে বর্ণনার উপর বেশি নির্ভরশীল। তবে সে বর্ণনা পাঠককে শুধু মুগ্ধই নয়, বরং বাকরুদ্ধ করে দিতে সক্ষম।

পিতার মৃত্যুর পর এত বড় সংসারে বিমাতার গর্ভজাত ভাই-বোনদের স্বভাবচরিত্র কী নির্মোহ আর স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন লেখক 'ন’বাবু, সেজোবাবু' গল্পে। বটবৃক্ষের ছায়া হয়েই নয়, বরং শেকড় হয়ে যেভাবে বিশ সন্তানকে আগলে পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছিলেন প্রসন্নকুমার, তা যেন এক নিমেষেই গুঁড়িয়ে যায় তার মৃত্যুতে। মধ্যবিত্ত সংসারের পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দেয় লোভ আর স্বার্থপরতা। তাই তো, সংসার হয়ে যায় বিভক্ত আর পরিতোষ সেন শোনান আমাদের সেই ভাঙ্গনের গল্পই। ভাইয়ের কীর্তিকলাপ এবং সেন পরিবারের ধ্বংসে লেখক তাই বলেন,

"আমার ভায়েরা অন্ধকার পাতালের অতলে এতটাই নেমে গিয়েছিল যে আকাশের দিকে আর কোনোদিন মুখ তুলতে পারেনি।"

আর সবশেষে এই সনাতনী ধর্মের বিশাল পরিবারে 'জামিলার মা' নামে বিধর্মী এক গৃহকর্মীর গল্প লেখক আমাদের শোনান। পিতার কবিরাজি কাজের জন্য জড়িবুটি পেষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন এই হাড্ডিসার নারী। বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। পরিবার, সন্তান আর সম্বলহীন এই নারী ভালোবেসে ফেলেছিলেন সেন পরিবারের বাচ্চাদের। হৃদয়ের সমস্তটা উজাড় করে ভালোবেসেছিলেন তিনি। আর তাইতো, নিত্যদিন চার মাইল পথ হেঁটে আসতেন তীব্র প্রখর রোদ উপেক্ষা করে, কালো রঙের এক বোরখা পরে। এমনকি প্রসন্নকুমারের মৃত্যুতে তার চাকরির অবসান হলেও তার ভালোবাসা ফুরোয়নি বিন্দুমাত্রও। অসাম্প্রদায়িক বোধসম্পন্ন এমন গল্প পাঠকদেরকে ভাবিয়ে তুলবে।

একজন চিত্রকর আঁকেন, আর লেখক বর্ণনা দেন। কিন্তু যখন এই দুয়ে মিলে যায়, তখন আসলে গল্প লেখার বদলে গল্প আঁকা হয়। ছবি আঁকার বদলে ছবি লেখা হয়। পরিতোষ সেনের 'জিন্দাবাহার' সেরকমই এক গ্রন্থ। লেখক তার চিত্রশিল্পীর সত্ত্বা থেকে বেরিয়ে আপন অনবদ্য আরেক শিল্পীসত্ত্বার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার লেখনীর মাধ্যমে। তার বর্ণনা এতটাই নিখুঁত আর স্পষ্ট, যে পাঠকের মানসপটে মুহূর্তেই ফুটে উঠবে ত্রিশ-চল্লিশ দশকের ঢাকা। সকল গল্পেই তার লেখনশৈলীর মাধুর্যতা পাঠককে মুগ্ধ করে রাখবে।

তবে সবকিছু ছাড়িয়ে, এমনকি লেখক পরিতোষ সেন নিজেকেও ছাড়িয়ে গেছেন তার 'আগুন' এবং 'হে অর্জুন' নামক দুটি গল্পে। এই গল্পগুলোর বর্ণনা পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে, লেখক যেন ছবি দুটো আঁকার সময়কার সম্পূর্ণ তার মানসিক চিন্তা-চেতনাকে লেখায় রূপ দিয়েছেন। তাই, পুরো গ্রন্থ জুড়েই এমন ভাবটা বজায় থাকে, হয়তো তিনি গল্প লেখেননি, বরং এঁকেছেন। পরিতোষ সেনের সার্থকতা এটাই যে, পাঠক এ গ্রন্থ পড়া শেষে পরিতৃপ্তির ঘ্রাণ পায় নিজেরই অজান্তে।

বই: জিন্দাবাহার
লেখক: পরিতোষ সেন
প্রকাশনী: বোধি প্রকাশনালয়
মলাট মূল্য: ৩২৫/- টাকা

বিস্তারিত আলোচনার লিংক - https://roar.media/bangla/main/book-m...
Profile Image for পটের দুধের কমরেড.
209 reviews25 followers
March 18, 2020
ঢাকা শহরের বাবুর বাজার নামক জনবহুল অঞ্চলে কালীবাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে জিন্দাবাহার লেন৷ জিন্দাব��হার অর্থাৎ 'জীবন্ত বসন্ত'৷ সে রাস্তার প্রায় শুরুতেই ছিল প্রখ্যাত ভারতীয় চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেনের পৈতৃক নিবাস৷ সেই লেনে জীবনের ষোলটি বসন্তে মনে গভীরে দাগ দেওয়া কিছু 'অলৌকিক' মানুষের গল্প আর বিমর্ষতাপূর্ণ ঘটনার স্মৃতিকথা নিয়েই লিখেছেন— 'জিন্দাবাহার'৷
_
স্মৃতিকথা সবসময়ই বেদনামধুর৷ চিত্রকর পরিতোষ সেন শিল্পীসত্তার সমান্তরালে অনবদ্য লেখক ব্যক্তিত্বের রঙের ভাষায় 'খিটখিটে মেজাজ আর নবাবী চালের দর্জি হাফিজ মিঞা', 'ক্যানভাসে বিক্ষিপ্ত রেখা সন্তপর্ণে জুড়ে দিয়ে অসাধারণ চিত্রশিল্পী সিন-পেণ্টার জিতেন গোঁসাই', 'প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সিপাহি/গল্পকথাক/শিকারী ডেণ্টিস্ট আখতার মিঞা'— প্রতিটা চরিত্রই ছিল প্রাণবন্ত—স্পষ্ট—জীবন্ত৷ যাদের সরল জীবনযাত্রার বৈচিত্র্যময় চারিত্রিক স্বভাব ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছোটবেলায় পরিতোষ সেনকে মুগ্ধ করেছিল৷ অতপর 'প্রসন্নকুমার', 'আমি', ' ন'বাবু, সেজোবাবু ' রচনায় নিজের পরিবারকেন্দ্রিক কিছু সরস এবং বিষাদ বাস্তবতার উপস্থাপন করেছেন৷ পিতৃবিয়োগে পর ভাইদের স্বার্থপরতা, হীনতা, বিদ্বেষ আর মদ, জুয়া আর নারী নেশায় একান্নবর্তী মধ্যবিত্ত সংসারের দুর্দশার করুণ বর্ণানা মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলে৷ আর 'আগুন' রচনা পরিতোষ সেনের চিত্রশিল্পী এবং লেখকসত্তার এক অভূতপূর্ব মিশ্রণ৷ " তার হাঁ-করা মুখের গহ্বর থেকে সাত-সাতটি আনাভিলম্ভিত লকলকে জিভ যেন রক্তের সাতটা পাহাড়ী প্রসবণ৷ তার ভয়ংকর মুখমণ্ডল- চুল থেকে নিয়ে জিভের ডগা পর্যন্ত- সবটাই যেন পৃথিবীর তাবৎ লাল রঙের মিলনক্ষেত্র৷ রক্তজবার লাল, কৃষ্ণচূড়ার লাল, পলাশের লাল, শীতের বাদাম পাতার লাল, আবির আলতার লাল, স্বর্ণবিন্দুর মকরধ্বজেত লাল, মোরগের ঝুঁটির লাল, টিয়েপাখির ঠোঁটের লাল- আরো যে কত রকমের লাল, তার হিসেব কে করে! পৃথিবীর সব ইস্পাত কারখানার ফার্নেসের পুঞ্জিত উত্তাপে যেন লালের নির্যাস তৈরি হচ্ছে৷ আমার পলক পড়ছে না৷ আমি স্বপ্নাবিষ্ট, অর্ধ-অচৈতন্য"৷ 'হে অর্জুন', 'জালিমার মা' লেখকের সৃজনশীল চমৎকার গদ্যভাষার বৈশিষ্ট্য গুনান্বিত৷
Profile Image for Nakibur Rahman.
5 reviews5 followers
December 7, 2020
বইটিতে শিল্পের ছড়াছড়ি। সেই শিল্প তৈরি হয়েছে কখনও ছবি হয়ে, কখনো লেখকের কালিতে অক্ষর-শব্দ-বাক্যে রুপ নিয়ে। আপাত দৃষ্টিতে অতি সাধারণ ব্যাক্তি, ঘটনা, বস্তু ও যে একজন শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি তে অসাধারণ হয়ে ধরা পড়তে পারে, তা এই বই পড়লে আঁচ করা যায়। পরিতোষ সেনের ছোটবেলেটা কেটেছে পুরান ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে। এই লেনেরই কতিপয় চরিত্র তার বাল্য মনে রেখে গিয়েছে এক গভীর ছাঁপ। তাইতো ৫০ বৎসর কেটে গেলেও তাঁদের তিনি এঁকেছেন অতি যত্ন সহকারে,এক মায়াবী ভালোবাসায় আচ্ছন্ন থেকে। তাঁদের বিচিত্র চলাচলের সাক্ষী হয়ে তাদের জীবনকে দিয়েছেন বাস্তবতা ছাপিয়ে শিল্পের আকৃতি। তাই দর্জি হাফিজ মিঞা, সিন-পেন্টার জিতেন গোঁসাই, ডেন্টিস্ট আখতার মিঞা অতি সাধারণ পেশার লোক হয়েও তাদের মাঝে জন্ম নেয় জীবনের বহু রঙ। তাদের অদ্ভুত জীবনধারা ও কাজকর্ম আর লেখকের শৈল্পিক পর্যবেক্ষণ এবং চমকপ্রদ বর্ণনা পাঠককে হারিয়ে যেতে বাধ্য করবে পরিতোষের বাল্যবেলার সেই জিন্দাবাহার লেনে।

বইটিতে আছে লেখকের নিজ পরিবারের বর্ণনা। আছে তার কবিরাজ বাবা প্রসন্নকুমার সেন, ' ন'বাবু, সেজোবাবুর ' কথা। পরিবারের গল্পগুলোতে ফুটে উঠে তার বাড়ির হরেক দিক। অতি সূক্ষ তুলির আচড়ে তিনি তুলে ধরেছেন পরিবারের নিত্তনৈমিত্তিক আচার-আচারাদি, এক-অপরের সাথে বন্ধনের যোগসূত্র। পারিবারিক কলহ ক্রুটির কিছু ধূসর ছায়া লেপে দিতেও কুন্ঠাবোধ করেননি তিনি।

তবে আমি মনে করি(লেখক নিজেও কিছুটা একমত হবেন) যে তাঁর এই বই চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছে 'আগুন' আর 'হে অর্জুন' নামক রচনা দুটিতে। এ দুটি রচনা নিয়ে কিছু বলার বা মন্তব্য করার ভাষা বা অভিব্যাক্তি আমার জানা নেই। শুধু বিস্ময় নিয়ে অনুভব করেছি আগুনের ভেতরই যেনো জন্ম নেয়া আরেক ভয়ানক সৃষ্টির কথা যা রঙ পালটিয়ে মুহূর্তে হয়ে উঠে আরো পরাক্রান্ত। আশ্চর্য হয়ে জেনেছি একটি অর্জুন গাছের সাথে জড়িয়ে থাকা অভাবনীয় সৃষ্টির কারুকার্য, রহস্যজাগানো কিছু অলীক কেচ্ছা।
আর শেষমেষ জমিলার মা। যেই অসাধারণ মানবিকতা,সহানুভূতি আর ভালবাসা নিয়ে তিনি স্মরণ করেছেন তাঁর পিতার কবিরাজী কার্যে সহায়তা করা এই বৃদ্ধাকে, তাতে খুব সহজেই পরিস্ফুট হয় লেখকের সূক্ষ মানবিক মূল্যবোধ আর উচ্চাশয়তা। শুধু একটি অনুযোগই করবো এই বলে যে মাত্র ১৫২ পৃষ্ঠাতেই এই বইটির পরিসমাপ্তি।
Profile Image for Masud Khan.
87 reviews17 followers
May 31, 2021
৭০ এর দশকে দেশে আমার খুব ছোটবেলা কেটেছে জিন্দাবাহার প্রথম লেনে। আবছা মনে পড়ে আমাদের বাসাটা ছিল দুইতলায়, তিনতলা বাড়িতে। রেলিং ঘেরা কমন বারান্দা, ইউ শেপের বিল্ডিং, নিচতলায় কলতলা, শান বাঁধানো উঠোন ... রেলিং বিহীন ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো, কাঁচের গুড়ো এবং আঠা দিয়ে ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেয়া, আমার বন্ধু চঞ্চলের ছাদ থেকে পড়ে অকালমৃত্যু, ... বাসা থেকে বেরুলেই পুলিশ ফাঁড়ি, একটু সামনে এগুলে খলিফার দোকান "পাটনা টেইলার্স", আব্বুর কাছে খলিফার অভিযোগ আপনার ছেলে তো বাড়ছেই না, বছরের পড় বছর একই সাইজের জামা বানিয়ে দিচ্ছি ... উল্টো দিকে গেলে ইসলামপুর রোড, উপর তলা থেকে নিচের পান দোকানে দড়িতে ঝুড়ি বেঁধে টাকা পাঠিয়ে দেয়া এবং দোকানী ঝুড়িতে সদাই তুলে দেয়া ... ইসলামপুর রোডে নবাববাড়ির গেইট, সামনে এগুলে গোল তালব ... হাঁটা পথে চার চারটি সিনেমা হল ... শাবিস্তান, লায়ন, মুন আর স্টার ..., মহাররমের তাজিয়া মিছিল, পুজোর আগে অতিকায় প্রতিমার সজ্জা ... সে কি জৌলুশ আমার পুরানো ঢাকার।

এই বই জিন্দাবাহারের, আবার এ বই জিন্দাবাহার ছাড়িয়ে আরও অনেক দুরের। ভালো লাগলো।
Profile Image for Arif  Raihan Opu.
212 reviews7 followers
January 31, 2022
জীবনের স্মৃতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে বড় হওয়া পরিতোষ সেন তার স্মৃতি কথা তুলে ধরেছেন। যদিও লেনের স্মৃতির চেয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্মৃতি অনেক বেশি।
.
বইটিতে ৯টি লেখা রয়েছে। লেখা গুলোতে লেখক তার দেখা কিছু মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। বিশেষ ভাবে তার পরিবার ও তার আসে পাশে থাকা মানুষ কে নিয়ে এই লেখা গুলো লেখা হয়েছে।
.
তবে স্মৃতি গুলো অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছে লেখকের লেখার মুন্সিয়ানাতে৷
.
বইটি শুরুর দিকে বেশ ভাল ভাবে হলেও মাঝে ও শেষের দিকে কিছুটা মন্থর। তবুও বইটি বেশ ভাল। সবাই পড়তে পারেন।
Profile Image for Amartya.
4 reviews
February 8, 2022
পুরান ঢাকার বাবুবাজার অংশের কালীবাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটা লেন “জিন্দাবাহার” লেন। “জিন্দাবাহার” একটা উর্দু শব্দ। "জিন্দা" অর্থ জীবিত, আর "বাহার" অর্থ বসন্তকাল। শব্দ দুটো একসাথে করলে যা পাই সেটা হচ্ছে “জীবিত বা জীবন্ত বসন্ত”। এই জিন্দাবাহার লেনে এখনো বসন্ত আসে, জীবনের আনাগোনা চলে, ঠিক যেমন চলতো আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে। কিন্তু সময়ের এই বিশাল ব্যবধানে একই যায়গায় অন্যরকম অনেক গল্প হারিয়ে যায় সেকথা কজন জানে? সেই গল্পেগুলোর একেকটি চরিত্র হতে পারে দর্জি হাফিজ মিঞা, সিন পেন্টার জিতেন গোঁসাই, ওয়ার্ল্ড রিনাউন্ড ডেন্টিস্ট আখতার মিঞা'র মত বিভিন্ন পেশার কিছু মানুষ। একলা এবং নিঃসঙ্গ এই মানুষগুলোকে এখন জিন্দাবাহার লেনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারা এমন কোনো কাজও করে নি যে যুগের পর যুগ ধরে মানুষ তাদের মনে রাখবে। সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোকেই যখন তুলির আঁচর ফেলে দিয়ে কলমের দাগে একজন শিল্পী তুলে ধরেন , উপলব্ধি করা যায় মানুষগুলো কতটা জীবন্ত। যেন এখনো জিন্দাবাহার লেন দিয়ে হেঁটে গেলে দেখতে পারবো দর্জি হাফিজ মিঞা খ্যাকর খ্যাকর কাশি দিয়ে নিজের মত করে কেটে যাচ্ছেন কাপড়, তার কবুতরগুলো খাচার ভিতর থেকে শব্দ করছে। হটাৎ কান খাড়া করলে হয়তো শুনবো আখতার মিঞার চেম্বার থেকে ভেসে আসছে কোনো রোগীর চিৎকার।

খিটখিটে মেজাজের একজন দক্ষ দর্জি হাফিজ মিঞা। যার দিনের শুরু হয় “কালেজা কা সালন” খাবার দিয়ে। সামান্য একজন দর্জি হয়েও তিনি নবাবি চাল ছাড়তে পারেন না । তৈরী করেন নবাবেরই আত্মীয়দের কাপড়। তারই মহল্লার একটি শিশু আড়াল থেকে প্রতিদিন তাকে দেখে। মাপ না নিয়ে শুধু চোখ দিয়ে পরখ করেই কিভাবে একজন নবাবজাদার কোট হাফিজ মিঞা বানিয়ে ফেলেন শিশুটিকে অবাক করে। কাটা কাপড়,রুলার, মাপার ফিতা ছাড়াও হাফিজ মিয়ার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিভিন্ন জাতের খানদানি পায়রা। এই রুগ্ন জরাজীর্ণ দেহধারী দর্জি হাফিজ মিঞার কাজে মুন্সিয়ানা দর্জিগীরিতে থাকলেও পায়রা ওড়ানো তার কাছে আফিমের নেশার মত । পায়রা হাতের কাছে পেলে তিনি হয়ে ওঠেন কখনো জাদুকর কখনো সার্জেন্ট কমান্ডার । পায়রা ওড়ানো এবং তাদের সামরিক প্রশিক্ষন দিয়ে দর্জি হাফিজ মিঞা গড়ে তোলেন এক আশ্চর্য জগৎ যেখানে তার পায়রাগুলো তার কথায় উঠে-বসে, কখনো আকাশে ডিগবাজি খায় । বাছাই করে সেরা পায়রাগুলোকে নিজের কাছে রেখে দিয়ে তিনি একাই প্রভাব বিস্তার করেন পুরো এলাকায়। পায়রা বিষয়ে কেউ তাকে টক্কর দিতে পারে না। টক্কর দিতে পারে না তার কাপড় সেলাই করার মুন্সিয়ানায়।

অন্যদিকে সিন পেন্টার জিতেন গোঁসাই যখন মগ্ন হয়ে থিয়েটারের সিন এঁকে চলেন সেই শিশুটিকেই দেখা যায় আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে তার আঁকা চিত্রকর্ম দেখতে। জিতেন গোঁসাই নিজের অজান্তেই হয়তো শিশুটির মধ্যে রেখে জান তার শিল্পীসত্তা। বছরের প্রত্যেকটা দিন জিতেন গোঁসাইয়ের কাটে একটা সাদা বড় পর্দার সামনে যেটি তিনি ভরিয়ে তোলেন সুনিপুণ ছবি আঁকার দক্ষতার মধ্য দিয়ে । প্রতিটা নাটকের সিন এঁকে তিনি একা একা সেগুলো অভিনয় করেন, কখনো সন্ধাবেলায় গান গান। এভাবে গান গাইতে গাইতে একসময় তার দেহ অবসাদে একটা লতার মত গুটিয়ে পরে।
একজন দর্জি, একজন নিঃস্ঙ্গ শিল্পীর পাশাপাশি গল্পে এবারে চলে আসে একজন ডেন্টিস্ট। লোকটি হাতুড়ে দাঁতের ডাক্তার আখতার মিঞা । আখতার মিঞার কাজে শিল্পের অবদান নেই বলতে গেলে। আগের পেশাগুলো থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম পেশার আখতার মিঞা আকারে এতই বিশাল , তার আগমনে জিন্দাবাহার গলিটাই অন্ধকারে ঢেকে যায় , সূর্যগ্রহন হচ্ছে মনে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিলেও ক্ষিদার কাছে পরাজিত নিরুপায় আখতার মিয়াকে বাধ্য হয়ে মৃত সৈন্যের মাংস খেতে হয়। সবাই জেনে যায় মৃত সৈনিকের মাংস খাওয়ার মধ্য দিয়েই তিনি লাগামহীন ভাবে বাড়তে থাকেন দৈর্ঘ্যে প্রস্থে । আখতার মিয়ার পরিবার বলতে কিছু নেই। হাফিজ মিয়া আর জিতেন গোঁসাই দুজনের মত আখতার মিয়ার জীবনেও একটা সময় নেমে আসে একাকীত্ব। একাকীত্ব কমাতে আখতার মিঞার প্রিয় শখ পাখি শিকার। শিকারই তার জীবনে একমাত্র বিনোদন। সময় পেলেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বন্দুক দিয়ে তিনি পাখি শিকারে নেমে যান। বিভিন্ন জাতের পাখি শিকার করে বাড়ি ফেরা তার নৈমিত্তিক স্বভাব। এত জেদী ও দক্ষ শিকারি হয়েও যখন আখতার মিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজে বন বাদাড়ে কোনো পাখি খুঁজে পান না, তখন বনে রাত কাটিয়ে নিজের অজান্তেই শিকার করে ফেলেন আস্ত বাঘ । একজন ডেন্টিস্ট থেকে পাকা শিকারী হয়ে ওঠেন আখতার মিঞা । আখতার মিঞার কাছে গল্প শুনতে গিয়ে শিশুটি তার খুব কাছাকাছি পৌঁছে যায়। শিশুটির কল্পনার জগতের সিংহদুয়ার শিকারী এই দন্তচিকিৎসকের হাতত দিয়ে খুলে দূর দূরান্তে চলে যায়...

এতক্ষণ ধরে , হাফিজ মিঞা, জিতেন গোসাই এবং অখতার মিঞাকে আড়ালে প্রত্যক্ষ করা শিশুটির নাম পরিতোষ সেন। পরিতোষ সেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী পাশাপাশি এই বইটির লেখক। জীবনের অনেকটা সময় পশ্চিমবঙ্গ থাকা আর পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে কাজ করলেও তার শৈশব জীবন শুরু হয় পুরান ঢাকার এই জিন্দাবাহার গলিতেই। জিন্দাবাহার গলির আনাচ কানাচ থেকেই তিনি পৃথিবীর রূপরস গন্ধ নেওয়া শুরু করেন, তাঁকে শিল্পী হয়ে উঠতে সাহায্য করে উপরে উল্লেখিত প্রত্যেকটি চরিত্র।
এই চরিত্রগুলো প্রত্যেকেই একা। কোনো পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ না থেকে নিজের জগৎ নিয়ে পড়ে থাকা তিনজন মানুষ।

আগের চরিত্রগুলো যেমন ছিলো একদম পরিবারহীন, পরবর্তীতে চরিত্রটির রয়েছে বিশ সন্তানের এক বিশাল পরিবার। এর মধ্যে সতেরো নম্বর সন্তান লেখক নিজে। এবারে লেখার বিষয়বস্তু খোদ লেখকের পিতা শ্রীপ্রসন্নকুমার সেন। প্রসন্নকুমার সেনও বংশানুক্রমে একজন চিকিৎসক কিন্তু আয়ুর্বেদিক উপায়ে তিনি রোগীদের চিকিৎসা করেন। পুরান ঢাকার একজন বিখ্যাত কবিরাজ, তাঁর হাতের ছোয়ায় প্রায়ই মৃত মানুষকে জীবিত হয়ে উঠতে দেখা যায়। প্রায়ই রোগীদের উপঢৌকন এসে পৌঁছে যায় তাঁর দ্বারপ্রান্তে । বিশাল পরিবারটির কর্তার দায়িত্ব পালন তাঁর কাছে নিতান্তই নস্যি। একদিক দিয়ে শৌখিন অন্যদিকে রূঢ এই ধরনের মিশ্র বৈশিষ্ঠ্যের লোক প্রসন্নকুমারকে অনেকটাই শক্তিশালী ভাবে দেখনোর চেষ্টা করেন ছেলে পরিতোষ সেন। বর্ণনা করেন তাঁর জীবনের সব সূক্ষাতিসূক্ষ ঘটনা।
এতগুলো চরিত্র পার করে এবারে লেখক নিজের সাথে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বলতে থাকেন । কিভাবে অকষ্মাৎ নবাবের বাসায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যান, রাস্তায় যেতে যেতে বর্ণনা করেন তখনকার পুরানঢাকার অলিগলি বাজার পথঘাটের অবস্থা। নবাবের বাসাতে ঢুকেও কি কি দেখেন তার বিস্তর বর্ণনা আছে বইয়ে । নবাব বাড়ির ভিতরের জগৎ বাইরের বাস্তব জগৎ এর সাথে খাপ খায় না, নবাব বাড়িতে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনাই যেন রূপকথার মোড়কে ঢাকা। এই অংশে জানা যায় নবাববাড়িতে আদব কায়দাকে ঠিক কিভাবে সেসময় গুরুত্ব দেওয়া হতো। গল্প এগোতে থাকে, নবাব বাড়ি, পুরান ঢাকার অলিগলি রাস্তাঘাটে। চলে আসে বিভিন্ন খাবারের বর্ণনা। যেগুলো ছোট্ট বয়সেও লুকিয়ে একা খাবার খাওয়ার লোভ সামলাতে পারেননি তিনি । নিজের চোখে শাঁখ কাটা দেখা , পিঁপড়া দিয়ে কেউটে সাপ মারতে দেখা জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে। ডিঙি নৌকায় চড়ে প্রকৃতির এমন দৃশ্য বর্ণনা করেন যেই বর্ণনা পড়লে ছাপার অক্ষর পেরিয়ে মন চলে যাবে সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের জগতে যেটি লেখক খোদ উপভোগ করেছিলেন কোনো কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে আধডোবা ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে।

সব কিছু ঠিকমতই চলছিলো, কিন্তু বাধ সাধলো "আগুন"। নয়টি গল্পের এই বইটিতে "আগুন" অংশটি একদম ব্যাতিক্রম। এই ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত লেখকের পিতা প্রসন্নকুমারের চিতা। এই চিতার আগুনের ভয়াবহতা ধীরে ধীরে তাঁকে চারিদিক গ্রাস করতে শুরু করলে এতদিনের সুখের স্মৃতি হটাৎ করে বদলাতে থাকে। লেখককে ধাওয়া করতে থাকে সেই আগুন,যেটি তাঁকে শক্তিশালী করে তোলে পরবর্তী জীবনের জন্য। অথচ আগুন নিয়ে কোনো দৃশ্য আঁকতে গেলেই তিনি শক্তি পান না, বিপর্যয়ে হারিয়ে ফেলেন নিজ���কে। আগুন অংশটার বর্ণনা লেখক যেভাবে দিয়েছেন , পৃথিবীর কোনো বইয়ে হয়তো আগুনের এমন বর্ণনা নেই, আগুন তাকে স্পর্শ করছে না অথচ তিনি এই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন, চোখের সামনে এই আগুন থামাতে পারছেন না। দৈত্যের মত এসে আগুনটা খেয়েই চলছে তাঁকে, শুকিয়ে যাচ্ছে তাঁর অন্তরাত্মা।
পিতা প্রসন্নকুমারের মৃত্যুর পর বিশাল পরিবারের ভাঙচুর অবস্থা চলে আসে । দুই ভাইয়ের চূড়ান্ত অবনতি চোখের সামনে দেখতে হয় তাঁকে। এইগুলোই পড়তে পড়তে হটাৎ দেখা যায় কোত্থেকে একটা অর্জুন গাছ উঠে আসছে বইয়ের পাতা ভেদ করে। প্রথম থেকেই যেই চরিত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এর মধ্যে সবগুলোই মানুষ ছিলো। এই অর্জুন গাছটি বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অথচ এটি মানুষ না হয়ে একটি গাছ । গাছটিকে শিল্পী মানসিকতা দিয়ে বিশ্লেষন করার চেষ্টা করেছেন, বলেছেন গাছটিকে ঘিরে অনেক ঘটনা। অর্জুন গাছটির তুলনা করেছেন মহাভারতের অর্জুনের সাথে।

জিন্দাবাহারের সর্বশেষ চরিত্র, জামিলার মা। একজন গৃহভৃত্য যে প্রায় চল্লিশ বছর সময় ধরে সেন পরিবারে কাজ করে আসছে। মূলত প্রসন্নকুমার সেনের চিকিৎসার গাছগাছালি পিষে ঔষুধ তৈরী করা তার কাজ। কিন্তু জগৎসংসারের এমন কোনো ছোট কাজ নেই যেটা জামিলার মায়ের অসাধ্য। অন্য ধর্ম , পাশাপাশি একদম ব্যাতিক্রম নিয়ম নীতি পালন করা একটি পরিবারে কিভাবে জামিলার মা স্থান করে নিয়েছেন সেটা বিষ্ময়কর। ছোট বড় সকলের এমন কোনো কাজ নেই যেটি জামিলার মা করেন না। বয়সের ভারে নুইঁইয়ে তার অবস্থা রদ্যার "she who was once the helmet-maker's beautiful wife " ভাস্কর্যটির মত। অথচ প্রতিদিন তিন চার মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে নারিন্দা থেকে জিন্দাবাহার লেনে এসে আমৃত্যু নিবিঢ়ভাবে সেন পরিবারের সাথে ছায়ার মত থেকে নিজের জীবন উৎসর্গ করে যান জামিলার মা। কখনো কোনো অভিযোগ বা টু শব্দটি করেন না, আড়ালে থেকে হয়ে উঠেন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। কিজন্যই বা সাম্প্রদায়িকতা, কষ্ট উপেক্ষা করে জামিলার মা বার বার ফিরে আসতেন সে বাসায়?

শেষ করলাম জিন্দাবাহার ওরফে "জীবিত বসন্ত"। বুড়িগঙ্গা নদীর কাছেই জিন্দাবাহার ঘিরে যেই চরিত্রগুলো একসময় গড়ে উঠেছিলো তাদের কাউকে এখন সেখানে পাওয়া যাবে না। কে জানতো, এই জিন্দাবাহারে জন্মানো শিশুটি প্যারিস গিয়ে পাবলো পিকাসোর কাছ থেকে কুড়িয়ে আনবে প্রশংসা? লিখে ফেলবে ঢাকার এই লুকিয়ে থাকা অংশটির ইতিহাস?
অসংখ্য বসন্ত পার করে একে একে দর্জি হাফিজ মিয়া, জিতেন গোঁসাই, আখতার মিঞা, জামিলার মা চলে যায়। একদিন চলে যান পরিতোষ সেনও। পঞ্চাশ বছরের অক্ষত স্মৃতির জিন্দাবাহার লেখকের কলমে আটকে থাকে। যে জিন্দাবাহারের আকাশে হাফিজ মিঞার পায়রাগুলো উড়ে বেড়াতো সেটা আমাদের থেকে নব্বই বছর পিছিয়ে আছে। আজকের জিন্দাবাহার ক্যামন আমি জানি না। কেউ কি লিখবে এগুলো নিয়ে ?
লিখা দরকার, কারন ইতিহাস বেঁচে থাকে গল্পে, বইয়ের পাতায়।
Profile Image for Abu Syed sajib.
147 reviews15 followers
July 29, 2021
বইটা অনেক আগেই শেষ করেছিলাম।এর মাঝে আরও কয়েকবার পড়াও হয়েছে।আজকে হঠাৎ খেয়াল হল যে এই বইয়ের রিভিউ লেখা হয় নাই।

ইতিহাস রসহীন কেননা ইতিহাস মানুষের কথা বলে না। তাই আমার কাছে কোন সময়কালকে জানার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল ঐ সময়ের মানুষকে জানা। পুরান ঢাকার ইতিহাস জানার ক্ষেত্রেও আমি ঠিক একই পদ্ধতি অবলম্বন করি। তবে সমস্যা হল যে এইরকম সাহিত্যের খোজ পাওয়া দুষ্কর। আত্মজীবনী একটা উপায় হতে পারে তবে সেখানে লেখকের নিজের জীবনই বড় হয়ে দেখা দেয়।
'পুরান ঢাকার গন্ধ পাওয়া যায়'-কথাটি পুরান ঢাকা সম্বন্ধে রচিত হওয়া খুব কম বই সম্বন্ধেই বলা যায়।'জিন্দাবাহার' ঠিক ঐরকম একটি দুর্লভ বই।বইটি এই কারণেই বইটি আমার এত প্রিয়।
পুরান ঢাকার এক বিখ্যাত গলি হল জিন্দাবাহার। এখানেই লেখকের ছেলেবেলা কেটেছে।তিনি লিখেছেন তার শৈশবের কথা,শৈশবে তার আশেপাশে দেখা মানুষদের কথা। তিনি গল্প বলেছেন দর্জি হাফিজ মিয়ার, ডেন্টিস্ট আখতার মিয়ার, সীন পেন্টার জীতেন গোঁসাইয়ের, জামিলার মা সহ আরও অনেকের। তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকরা প্রবেশ করতে পারে বিশের দশকের সেই শান্ত-স্নিগ্ধ ঢাকায়, ভাগাভাগি করে নিতে পারে ঐ মানুষগুলোর সুখ-দুঃখ,প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারে গঙ্গা বুড়ির তীরে। লেখকের মুনশিয়ানায় ঠিক এভাবেই প্রত্যেকটা চরিত্রই হয়ে উঠে পাঠকদের আপন,পূর্ব-পরিচিত।
Profile Image for Tanzila Jahan.
3 reviews1 follower
December 2, 2024
এত চমৎকার বই না পড়া থাকলে নিজেকে পাঠক দাবী করা বেমানান ।
Displaying 1 - 30 of 43 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.