What do you think?
Rate this book


214 pages, Paperback
First published May 22, 1936
শশী নিজের সাথেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া পরাজিত এক সত্তা।হৃদয়,আবেগের বশবর্তী হয়েও সে চায় যুক্তি দ্বারা জীবন চালনা করতে।তাই সে বারবার নিজের কাছে নিজেই পরাজিত হয়।কুসুম শশীকে ভালোবাসে।সামাজিক বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করেও শশীকে প্রেম নিবেদন করে নানা উপায়ে।কিন্তু শশীর বিক্ষিপ্ত মনের অস্থিরতা তার অনুভূভুতিগুলোকে অবহেলা করে।মৃত্যু ঘটে কুসুমের হৃদয়ের।প্রকৃতপক্ষে মানবসৃষ্ট এই সঙ্কীর্ণ সমাজে আমরা অনেকেই শশীর মতই বেঁচে থাকি।নিজের আবেগকে জোর করে অবদমিত করি সামজিকতা নামক এক দুর্ভেদ্য যুক্তির জালে জড়িয়ে।
গাওদিয়া গ্রামের বধূ কুসুম, শশী ডাক্তার, শশীর বাবা গোপাল, সেনদিদি,পাগলদিদি, যামিনী কবিরাজ, যাদব, মতি, কুমুদ, কলকাতার জয়াসহ খুঁটিনাটি আরও বেশকিছু চরিত্রের মাধ্যমে কি খেলাটাই দেখিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়!
শশীর নিজের সত্ত্বার সাথে নিজের দ্বিমুখীতা, কুসুমের মন হঠাৎ করে মরুভূমির মতো শুকিয়ে যাওয়া, নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা পরান, গোপালের এমন অদ্ভুত স্বার্থপরতা, গ্রামের কিশোরী মেয়ে মতির হঠাৎ সংসারী হয়ে ওঠা, কুমুদের এমন ভবঘুরে জীবন কিংবা জয়ার সেই ভালোবাসা কি(!) তা আবিষ্কার করার কাহিনী সবকিছুকেই কেন জানি আমার কাছে অনেকটা চেনা-পরিচিত বারবার দেখা ফটো/ছবি জুম করে দেখার মতো মনে হচ্ছিল। এমনি একটা ছবি দেখলে ফোকাসড অবজেক্ট ব্যতীত তেমন কিছু নজরে আসে না, খুব কাছে থেকে কিংবা জুম করে দেখলে আরও কত কি দেখা যায়!
সহজ-সরল গ্রাম্য জীবনভিত্তিক প্লট দেখে অতি সহজ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। পিঁপড়ের দল সারি বেঁধে হেঁটে যায়; দূর থেকে মনে হয় স্বাভাবিক বিষয়, কোনো জটিলতা নেই। কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় ফেরোমন হরমোন নিয়ে কিসব কাহিনী। জীবনানন্দের বাংলার রূপকে বিশেষভাবে দেখার চোখ যেমন আর পাঁচজন মানুষের তেমনটা নেই! তেমনই মানিক বাবুর মতো মনকে কাটাকুটি করার ক্ষমতাও খুব কম মানু্ষের আছে।
“শশী একটু হাসিল, কিছু বলিল না। কুসুমের এরকম সরল মিথ্যাভাষণ সে মাঝে মাঝে লক্ষ করিয়াছে। ধরা পড়িবে জানিয়া শুনিয়াই সে যেন এই মিথ্যাকথাগুলি বলে। এ যেন তাহার একধরনের পরিহাস। কালোকে সাদা বলিয়া আড়ালে সে হাসে”
“বইটা নয়—বইয়ের নামটা বিভ্রান্ত করে দিয়েছে সমালোচক থেকে বইটা যাতে বেশি বিক্রি হয় সেই উদ্দেশ্যে বইয়ের পিছনের বিজ্ঞাপনটির লেখককে পর্য্যন্ত।
পুতুলনাচের ইতিকথা? তবে আর কথা কী, মানিকবাবু মানুষকে পুতুল বানিয়েছেন, ভাগ্যের দাস বানিয়েছেন।
এটা হল বিচারকদের রায়।
যারা বিচার করে না, যারা আজ বিশ বছর ধরে বইটাকে জীবন্ত রেখেছে, তারা টের পায় এ বইখানা মানুষকে যারা পুতুলের মত নাচায় তাদের বিরুদ্ধে দরদী প্রতিবাদ।
প্রচণ্ড বিক্ষোভ নয়, স্থায়ী দরদী প্রতিবাদ।
… … …
সামন্ততান্ত্রিক অবস্থায় হাবুডুবু খেতে খেতেও এতগুলি মানুষ চেষ্টা করছে সে অবস্থাকে অতিক্রম করতে—কুড়ি বছর আগের বাংলা দেশে যখন সামন্ততন্ত্র প্রধান সমস্যা বলেই গণ্য হত না, তখন মানুষের সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, কিছু মানুষের হাতে পুতুল হবার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ, স্লোগানের বদলে সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যমে রূপ নিয়েছে।
আমি ভাবছি, হায়! যদি বইটার একটা ভূমিকা দিয়ে লিখে দিতাম মানুষকে কীভাবে পুতুল করা হয়েছে এটা তারই উপন্যাস—আমার বইখানার পিছনে হয়তো প্রচারক আমাকে ভাগ্যবাদী ঘোষণা করতেন না।
কত বোকামিই করেছি!”
তারপর বাজারের সন্ন্যাসী, বাজার দর, একাল-সেকালের পার্থক্য, নারী হরণ, পূর্ণ তালুকদারের মেয়ের কলঙ্ক, বিদেশবাসী গাঁয়ের বড় চাকুরে সুজন দাস, এইসব আলোচনা। শশী কি এত উঁচুতে উঠিয়ে গিয়াছে যে এইসব গ্রাম্য প্রসঙ্গে তাহার মন বসিল না, শান্ত অবহেলার সঙ্গে নীরবে শুনিয়া গেল? তা তো নয়। শুধু আধখানা মন দিয়া সে ভাবিতেছিল, এতগুলি মানুষের মনে মনে কি আশ্চর্য মিল। কারো স্বাতন্ত্র্য নাই, মৌলিকতা নাই, মনের তারগুলি এক সুরে বাঁধা।

