পারিবারিক নরবলি - এ দুটো শব্দেই নড়ে চড়ে বসতে হয়। খোদ কলকাতায় সেই নরবলির রীতি পালন করছে এক পরিবার। দেড়শো বছর ধরে এই রীতির খবর কেউ জানে না। মহারাজ প্রতাপ নারায়ণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এক রাতে করেছিলেন এরকম এক পাপ যার ফলে তার পরবর্তী বংশধরদের জীবনে নেমে আসে এক অমোঘ অন্ধকারের অভিশাপ--রক্ত গঙ্গা বইতে দিতে হয় প্রতি বছর।
ইতিহাসের প্রফেসর রাঘব নরবলির ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন বহু বছর ধরে। বহু গবেষণা তার করায়ত্ত, কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে কেউ কোনোদিন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। নতুন বছরের ব্যাচে রাঘব পেলেন প্রিয় ছাত্র রিশানকে যে কার্য কারণে সেই একই বিষয়ের শিকার। শুরু হল খোঁজ। কিন্তু কীসের খোঁজ এ রকম এক বিষয় যে কাহিনী কেউ মনেই রাখতে পারে না অভিশাপের কারণে! রাজকীয় পূজা, তন্ত্রাচার, লোভ, অপশাসন, যৌনাচার, সাধন-ভজন, কী নেই এই কাহিনীতে! একে একে পেঁয়াজের খোসার মতো কাহিনী উন্মোচিত হতে থাকে। ঠিক যতটা উন্মোচন ততটাই ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকে ‘চন্দ্রহাস’-এর চরিত্ররা। এর আদৌ কোনও তল পাওয়া যাবে কি?
সৌরভ চক্রবর্তী’র ‘চন্দ্রহাস’ উপন্যাসে উঠে এসেছে ইতিহাস, ধর্ম, অলৌকিকতা উর্ধ্বে উঠে গিয়ে এক অমানুষের রুদ্ধশ্বাস কাহিনী যা আমাদের ভিতটাকেই নাড়িয়ে দেবে।
ভালো-মন্দ সব মিলিয়েই বলি, বাংলা সাহিত্যে এমন বই আমি আগে পড়িনি। এ বই পড়া একটা নজিরবিহীন অভিজ্ঞতা ছিল। এই অনুভূতির বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিতে গেলে স্পয়লার আসবেই। তাই স্রেফ দুটো জিনিস বলি। প্রথমত, নরবলি নিয়ে বিশ্বাস ও অপবিশ্বাসের ফ্যাক্ট আর তন্ত্রসম্ভূত হররের ফিকশনকে এভাবে কেউ মেশাননি। এই বই সেই বিচারে একমেবাদ্বিতীয়ম। গবেষণা করে লেখার মাঝেও কয়েকটি অনভিপ্রেত ত্রুটি (আব্রাহামের নিজ সন্তানকে বলি দেওয়ার অংশ, সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার পতনের তথাকথিত ব্যাখ্যা) বড়ো বেশি করে চোখে লেগেছে। পরের সংস্করণে এগুলো ঠিক করে নিলে খুব ভালো হয়। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর পরিচয় গোপন রাখার ব্যাপারে লেখক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। সেজন্যই তিনি সচেতনভাবে এই কাহিনিতে রীতিমতো মোটা দাগের অলৌকিকত্ব আরোপ করেছেন। বাকি লেখায় এই জিনিস অদ্ভুতভাবে কার্যকরী হলেও শেষে এসে উপন্যাসটি অলৌকিকের গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। তার কারণটি সহজেই অনুমেয় - চন্দ্রহাস যাতে আবার ঝলসাতে পারে তার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন লেখক। স্রেফ ওই শেষটুকুর জন্যই গভীর অতৃপ্তি রয়ে গেল। তবে আশাও রইল। লেখক এমন এক রুদ্ধশ্বাস কাহিনির পরের পর্বে নিশ্চয় গুটিয়ে নেবেন আলগা থাকা সবক'টি সুতো। ইতিমধ্যে, এই বইটি অতি অবশ্যই পড়া উচিত বলে আমি মনে করি। কারণটা আগেই বলেছি, ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যে এমন বই একটিও হয়নি। স্রেফ এই অনন্যতার জন্যই বইটিকে পাঁচ তারা দেওয়া যায়।
মাঝেমধ্যে মনে হয় মোড়ক উন্মোচন না করাই ভালো । শুধু বিজ্ঞাপন দেখেই মোড়কের ভেতর ভালো কিছুই থাকবে সেই আশায় সারাজীবন কাটায় দেওয়া খারাপ না । চন্দ্রহাস উপন্যাস টা নিয়ে মানুষের যে কি লম্ফঝম্প ছিলো তা এই বইমেলায় ঘরে বইসা কিছুটা টের পাইছি । আর তাছাড়া বই এর প্রচারণা যেমনে করছে লেখক ( প্রথম ১৩ পৃষ্ঠা শুধু লেখকের কথা পড়ে মনে হইতেছিলো উপন্যাস না পড়েই ফাইভ স্টার দিয়া রিভিউ তে লেইখা দেই ‘’নরবলির কাহিনী না, বরং লেখকের নরবলি লেখার ইতিহাস পইড়া মোর জীবন সার্থক , দুই একদিনের মধ্যে মইরা গেলেও এই অধম কোন আফসোস নিয়ে মরবে না’’) এখন একটু নরবলি নিয়া কিচিরমিচির করা যাক । নরবলি কিভাবে শুরু হলো , কেন হলো , কিভাবেই বা নরবলি আস্তে আস্তে লুপ্ত হয়ে গেলো তার ব্যখ্যা পাইবেন গিয়া হইলো এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র দ্য নরবলি ইস্পিশালিস্ট প্রফেসর রাঘবের কাছ থেকে । নরবলির উপরে যে রিসার্চ করা যায় তাই বা কে জানতো ! যাই হোক সে নরবলির উপর লেকচার দিতে দিতে ছাত্র ছাত্রীদের ক্লাসরুমে অসুস্থ করে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকুক । আমরা একটু পেছনে চলে যাই । ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির আমলের এক রাজার নরবলি দেওয়ার বদ অভ্যাস ছিলো । তো সে একবার লোকজন রে ধরে ধরে বলি দেওয়ার সময় কোম্পানির সেপাহি পুলিশ রা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং ইউ আর আন্ডার এরেস্ট কইয়া চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয় । রাজা কোন উপায় না দেখে ,যেই অস্ত্র (চন্দ্রহাস!) দিয়া বলি দিতেছিলো সেই অস্ত্রসহ পলায়ন করেন । যাদের বলি দেওয়া হয়েছিলো তাদের মধ্যে একজনের পিতা ছিলো । সে তার চোখের সামনে পিতার মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে মনে মনে ঠিক করে রাজার উপর প্রতিশোধ নিবে । ভয়ংকর প্রতিশোধ ! এই প্রতিশোধ নিতে গিয়াই সে তন্ত্র মন্ত্রের মাধ্যমে স্যাবার টুথ সিংহ হয়ে যায় , বাইসন হয়ে যায় , এর রূপ ধরে তার রূপ ধরে মানুষজন রে বিভ্রান্ত করতে শুরু করে………… এই রে ! স্পয়লার দিয়ে ফেললাম নাকি ! আহা ! থাক এই লাইন টা ভুইলা যাইয়েন কষ্ট করে অ্যাঁ ! লেখক নরবলি নিয়ে যে পড়াশোনা করেছেন এবং পাঠকদের অনেক তথ্য জানাইতে চাইছেন এইটা অস্বীকার করছি না ( তার জন্য দুই তারকা, এবং ঐ দুই তারকাইইইইই ) কিন্তু গা ছমছমানো উপন্যাস সৃষ্টি করতে গেলে ন্যাকামি জিনিসটা না রাখাই উত্তম । আরে বলি দিবেন ভালো কথা , ডায়রেক্ট হাড়িকাঠে উঠায়ে খড়্গ নামায়া দেন , শেষ । এর মধ্যে এতো নাটকীয়তা করলে হয় ! দেখা গেলো অধিক বিলম্বজনিত কারণে হাড়িকাঠে মাথা রাইখা ভিক্টিম অপেক্ষা করতে করতে ঘুমায় পড়ছে তখন ? লোকজনের মন্তব্য শুনে ভাবছিলাম ভালো কিছু পড়তে যাচ্ছি । প্রথম প্রথম মনেও হচ্ছিলো । ঠিক করেছিলাম অনেক দিন ধরে একটু একটু করে পড়বো যাতে রেশটার স্থায়িত্ব বাড়ে । কিন্তু পড়তে পড়তে মনে পড়লো কবি বলেছেন , If you have to eat shit, best not to nibble. Bite, chew, swallow, repeat. It goes quicker that way. বিজ্ঞাপন দেইখা আশাবাদী হয়ে আর ঢেউটিন কিনা যাবে না ।
একমিনিট। হাতে একটা ঢিল নিন। এবার ওদিকে ডাঁই করে রাখা বইগুলোর দিকে ছুঁড়ুন। ছুঁড়ুন ছুঁড়ুন! অ্যাই তো, ‘অঘোরী’-র ওপর পড়েছে। আরেকবার নিন। ‘এবং ইনকুইজিশন’। আরেকবার। ও বাবা ডাইরেক্ট ‘অলাতচক্র’! আপনি হাঁপিয়ে যাবেন, কিন্তু ঢিলখানা অন্তত আরও বার পাঁচেক এমন বইয়ের ওপর পড়বে যা মূল উপজীব্য হচ্ছে তন্ত্র।
সেখানে “এবং ইনকুইজিশন” বা '‘কালসন্দর্ভা’'-র মত স্তম্ভও যেমন আছে, তেমনি ‘বালি গুণিন’ (বানানে কাঁচা, একটা 'ই' এক্সট্রা হল বোধহয়) মার্কা ট্যাঁশগরুও পাবেন বিস্তর। কিন্তু, ওই যে তারাদাসবাবু নেশাটি একবার ধরিয়ে গেছেন। তন্ত্র নিয়ে ভাল ফিকশন বইয়ের খোঁজ আপনার থামবে না।
তাই আপনার সার্চ লাইট যখন এমন কোন বইয়ের ওপর পড়ে, যার কিনা সাবটাইটলই হল, ‘পারিবারিক নরবলির ঐতিহাসিক কাহিনী’, তখন আপনার আদিম ডিএনএ তাতে এক্সট্রা ফোকাস ফেলতে বাধ্য। কারণ ততক্ষণে আপনার স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে দুটো চোখ। আগুনের মাঝে শুয়ে থাকা এক তলোয়ারে স্পষ্ট বলির আভাস। আপনি হয়তো ব্লার্বটা পড়বেন খানিক। (ইয়ে, টিজারটাও দেখতে পারেন) এবং বই আপনার ব্যাগে।
এর আগে বেশ কিছু ছোটগল্পে লেখক পাঠকের শ্বাসরোধ করেছেন। বার বার প্রমাণ করেছেন, তিনিও পারেন ভয়ের সরস্বতী নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে। তখন বুঝিনি। কিন্তু এখন জানলাম তুরুপের তাস উপযুক্ত জল-বাতাসের অপেক্ষায় লুকিয়েছিল বহুদিন ধরে। প্রচুর পড়াশুনো, ফিল্ডওয়ার্ক ও আলোচনার ফসল এই 'চন্দ্রহাস'।
যা ছিল রাবণের, আজ তা সৌরভের!
বেশ বড় (প্রায় ন পাতা) একটা ভূমিকা পেরিয়ে গল্প শুরু হয় ব্রিটিশ ভারতে। বাংলা থেকে অনেক দূরে মধ্যপ্রদেশের এক জায়গায় নরবলি সহ আরও অনেক গা ঘিনঘিন করা রীতিনীতি ছিল নিত্য ঘটনা। সেখানেই অভিনীত হয় কিছু পাপ দৃশ্য, এবং পারিবারিক গল্পের হিটপ্লটের মতই এক অভিশাপের স্রোত গড়িয়ে যায় বাকি গল্পের দিকে। মোটামুটি এই স্রোত এখানে ওখানে বাউন্স করেই উপন্যাসকে টেনে নিয়ে যায় পরিণতির দিকে।
এবং এই বয়ে চলা গল্প লেখক সামলেছেন অত্যন্ত মুনশিয়ানার সাথে। দুটো সময়কালকে যেন প্রায় দুই কলমে লিখেছেন লেখক। পুরোনো দিনের কথা বলতে গিয়ে তৎসম শব্দের ব্যবহার আলাদা মাত্রা দিয়েছে গোটা পরিবেশকে। ঠিক তেমনি বর্তমানের সিনে ভৃত্য, পুস্তক ইত্যাদি শব্দগুলো পড়ার সময় বড্ড চোখে লাগে। আর যেটা চোখে পড়ে, সেটা হল লেখকের পরিশ্রম! তাঁর প্লট বিন্যাস, নির্মেদ ভাষা দেখার মত। শেখার মত তাঁর গল্পের প্রতি নিষ্ঠা। গল্পের ন�� ফিকশন অংশের জন্য ঝরানো ঘাম সোনা হয়ে ফলেছে সারা বইয়ে। কিন্তু অতিরিক্ত সোনা চোখ একটু হলেও ধাঁধায়। তাই পরিমিতি বোধটাও দরকার ছিল সমানভাবে। তথ্য ভিত্তিক ফিকশন উপন্যাসের সব থেকে বেশি রিস্ক ফ্যাকটর হল, যেন অদরকারি মেদ না ঢুকে পড়ে। "চন্দ্রহাস"-এ তা ঢুকেছে প্রায় বন্যার মত।
বেশ চলছে, আপনিও সিটের হাতল খামচে ধরেছেন কী হয়, কী হয় ভেবে। তখনি দেখলেন দুম করে থ্রিলার সিনেমায় ভক্তিগীতি ঢুকে পড়েছে। পুরো দু পাতা জুড়ে শিব তাণ্ডব স্তোত্র পড়তে হবে বসে বসে। আর আমার মত সংস্কৃত পিরিয়ডে নিলডাউন দেওয়া পাবলিক হলে তো কথাই নেই। অথচ দৃশ্য একদম পালটে যেত, যদি এই স্তোত্রেরই কিছু সামঞ্জস্যপূর্ণ লাইন ছড়িয়ে দেওয়া যেত এখানে সেখানে। তার সাথে বৃষ্টির শব্দ, বিদ্যুতের নীলচে ঝলক... এমনকি বরফ কুচির ওপর নাইট ল্যাম্পের রঙ মিশিয়ে বেশ সুন্দর একটা পরিবেশ সাজানো যেত পাঠকের জন্য।
আসলে জ্ঞান জিনিসটাই এরকম। একজনের কাছে কিছুতেই থাকতে চায় না। জানলেই জানাতে ইচ্ছে করে, ভাবলেই বলতে ইচ্ছে করে। যেমন কাহিনীর প্রোটাগনিস্ট প্রফেসর রাঘবের ক্লাসগুলো। নরবলির ওপর পিএইচডি করতে আসা স্টুডেন্টদের রিসার্চ গাইড রাঘব। তাই স্বাভাবিকভাবেই নরবলির ইতিহাস তাঁর ক্লাসে বসলে মিলে যায় সহজেই। লেখকের সৌজন্যে আমাদের বসতেও হয় গোটা তিন-চার ক্লাসে। পাতার পর পাতা গল্পচ্ছলে দেশ-বিদেশের নরবলি, নারীবলি নিয়ে প্রচুর জানলাম। এবার দাদাগিরিতে ‘নরবলি স্পেশাল’ এপিসোড হলেই হল। কিন্তু ওদিকে থ্রিলের চেনাজানা সুতোটা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। আর সেটা খুঁজে বের করতে করতে আমার সাধের বুকমার্কখানা কীভাবে যে একটা থেকে দুটো হয়ে গেল! ঠিক ধরতে পারলাম না।
বর্ণনাও তাই। কোথায় কতটা দিতে হবে, সেটা চেখে দেখতে হয়। নইলে "চন্দ্রহাস"-এও পরিবেশ সৃষ্টিতে দুর্বলতা আসে, বর্ণনার ব্যাপারে র ্যান্ডম স্ট্রোক আমার পছন্দ নয়। তা বলে একদম আউটলাইন করে ছেড়ে দিলে ব্যাপারটা খানিক ক্লিশে হয়ে পড়ে। ভয়ের দৃশ্যগুলোয় মিনিমাম ইঙ্কিং বা শেডটুকু তো দরকার। যাতে শুধু বইয়ের কিছু অক্ষরে না থেকে, পাঠক গল্পে হেঁটে চলে বেড়াতে পারেন। ভয়ের দৃশ্য দেখে কুঁকড়ে যাওয়া আনন্দ নিয়ে পড়ে ফেলতে পারেন সমস্ত বইটা।
তবে হ্যাঁ, চন্দ্রহাসের মূল প্লট কিন্তু একদম টাইট করে বাঁধা। কোথাও এতটুকু টোল পড়তে দেননি লেখক। তাই তো মাঝে মাঝে ভাবি এত বিশাল প্লট, এত দৃশ্যকল্প কী ভাবে একটা মাত্র মাথায় রূপ পায়! ভাষা হয়ে খাতা ভরায়! অবশ্য এই বিশাল জার্নিটুকু কিছুটা হলেও ধরা আছে বইয়ের ভূমিকায়। সেখানে এও বলা আছে গোপনীয়তার খাতিরে সত্যির সঙ্গে সঙ্গে চড়া দাগের ফিকশন মেশানো হয়েছে এই উপন্যাসে। আন্ডার লাইন “চড়া দাগ”। একদম সঠিক স্বীকারোক্তি। আর ঠিক এখানে এসেই আমার মনে হয়েছে ‘চন্দ্রহাস’ একবার পড়ার জন্য বেশ ভাল বই।
সাউথ ইন্ডিয়ার লো বাজেটের CGI ওয়ালা সিনেমাগুলোতে এরকম স্ক্রিপ্ট দেখা যায় বটে। কিন্তু বাংলায় এই প্রথম দেখলাম। তাও উপন্যাসে। একটা নয়, দুটো নয়, তিন তিনটে জাতিস্মর তো তেলুগুরাও দেখাতে পারেনি। একজন মাঝবয়সী প্রফেসর তাঁর অনভ্যস্ত হাতে ছ ফুট লম্বা একটা অস্ত্র তুলে নিচ্ছেন! তাও কী অবলীলায়! তারপর পায়ের চাপে মাটি ফেটে যাওয়া টাইপ ব্যাপারগুলো তো আছেই। গল্পের গরুকে গাছে তোলার বদলে এভাবে শূলে চাপালে গোরক্ষা সমিতি কিন্তু ছেড়ে কথা বলবে না বস!
পরিষ্কার কথা, দিনের শেষে এটা গল্প। তাই মাছ ঢাকতে শাক লাগল না বাঘছাল আনতে হল সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল ঢাকতে গিয়ে আঁশটে গন্ধটা যেন ছড়িয়ে না যায়। এখানে পারিবারিক নরবলির ব্যাপারে নন-ফিকশন এলিমেন্ট যা আছে তা সাকুল্যে ৫ থেকে ৬ পাতা। তার অন্যপিঠে প্রায় ১৭৫ পাতার ফিকশন রাখলে সেটা খুব বুঝেশুনে রাখতে হয়, মেশাতে হয়। আজ "চন্দ্রমুখী", "অরুন্ধতী" মার্কা সিনেমাগুলো ইতিহাসে পুরে দিলে সেটা হারাতে খান পাঁচেক সিনই যথেষ্ট। তাই জোর করে সত্যি আর কল্পনার মাঝে কাঁটাতার তুলতে গেলে মাঝখান থেকে পাঠকই ক্ষতবিক্ষত হন। যেখানে মিশে যাওয়াই যেকোনো রকম শিল্পের একমাত্র ধর্ম।
আর তন্ত্রমতে ভয় দেখাতে অ্যাকশন কি খুব দরকার ছিল? "অলাতচক্র"-এ একটা গোটা জঙ্গল জুড়ে মরা পাখি দেখে আমরা কিন্তু অনেক বেশি ভয় পেয়েছিলাম মশাই। অনুপস্থিতি জিনিসটা বরাবরই ভয়াবহ।
দ্যাটস অল।
নিঃসন্দেহে অনেক খেটেখুটে , পরিশ্রম করে লেখা বই। শুধু ফিকশনটুকু একটু বুঝেশুনে দিলে, ভালভাবে মিলমিশ করে দিলে এ বই ‘চন্দ্রহাস’-র মত অবিনশ্বর হলেও হতে পারত। এই আর কী।
পুনশ্চ: প্রথমে আসে পাপ, তারপর মহাপাপ, আর শেষে আসে গোটা পাঠ পতিক্রিয়ায় শিল্পীদের নিয়ে একটাও কথা না বলা। অনিকেত মিত্র স্বভাব সুলভ ভাবেই ফাটিয়ে দিয়েছেন। কি কভার আর কি ইলাস্ট্রেশন! তবে খুব নিম্নমানের ছাপার কোয়ালিটির জন্য ভেতরের প্রায় সবকটা আঁকাই মাঠে মারা গেছে। আশা করি পরে সেগুলো ঠিক করে নেওয়া হবে। আরেকটা ভুল দেখলাম ব্যাক কভারে গণেশে। কারণ গল্পে ষড়ভুজ গণেশের কথা আছে। এখানে আঁকা হয়েছে চতুর্ভুজ, আর গণেশের শুঁড়ের পজিশন এখানে আর ভেতরের একটা ইলাস্ট্রেশনে ভুল আছে। অবশ্য ব্রিফিং-র প্রবলেম হয়ে থাকলে শিল্পীকে দোষ দেওয়া যায় না তেমন।
মোটামুটি হতাশ। লেখক ইতিহাসের সাথে ফিকশন মিশিয়ে লিখতে চেয়েছেন (ভূমিকাতে তার ভাষ্য), কিন্তু দুটোর কোনটাই ঠিকমত হয়নি। লেখনী আড়ষ্ট, বেশিরভাগটাই লেকচার, চরিত্রগুলো একটাও গড়ে ওঠেনি, আর শেষটা এতটাই অগোছালো আর তাড়াহুড়ো যে মনে হলো লেখকের ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছিল। একশন এনে আরো ক্ষতি হয়েছে ; যা-তা। আর গল্প খুঁজতে যতটা পরিশ্রম করেছেন, গল্পটা সাজাতে তার খানিকটা করলে, সাথে ভাল একজন এডিটর থাকলে হয়তো নতুন ধরণের এই প্লটটা দাঁড়িয়ে যেত। এখন যা হয়েছে, সেটার নাম পয়সা নষ্ট।
ঠিক ২ টা বছর আগে আশে পাশের বন্ধুমহলে বইটি নিয়ে যে পরিমাণ নেগেটিভ মন্তব্য চোখে পড়েছিল, সাহস হয়নি বইটি হাতে নেওয়ার। কিন্তু ব্যাপার হলো আমার একজন অত্যন্ত বইপ্রেমী বন্ধু যখন এই বইটির ২য় কিস্তির জন্য হন্যে হয়ে চষে বেড়াচ্ছে ইনবক্স তখন ফের চিন্তা করলাম, চেখেই দেখি না কেমন লাগে। তাই একসাথে দুটো কিস্তিই হাতে নিয়ে বসে পড়লাম খাওয়ার টেবিলে।
তারপর আর কি? একটানা দু বসাতেই সাবাড়। লেখকের লেখা অত্যন্ত সহজ, প্রাঞ্জল এবং মেদহীন। আর প্লটের কথা যদি বলি, যাচ্ছেতাই রকমের নতুন। তাছাড়া লেখক প্রচুর পরিমাণ গবেষণা করেছেন লিখতে গিয়ে।
এর আগে 'দেবীরাক্ষস ' পড়েছি । ভূমিকা পড়ে এস্পেকটেশন এতো বেড়ে গেছিল যে, প্রত্যেকটা গল্পই আমাকে হতাশ করে (২ তাঁরা দিয়েছিলাম) । তাই এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভূমিকা পড়ব না। কেননা, ওখানে লেখক একটু বেশিই নিজের ঢাক নিজে পেটায়।
তাই আমার মন্তব্য, রিভিউ রেটিংয়ের গ্যাড়াকলে না পড়ে অন্তত একবার হাতে নিয়ে দেখতে পারেন। ইউনিক প্লটের সহজবোধ্য এই থ্রিলারটি আপনার মনোরঞ্জন করলেও করতে পারে।
বুঝলাম না, ভূমিকায় লেখক নিজেই নিজের বইয়ের এতো প্রশংসা করলো কেন? 🐸 কোন সন্দেহ নাই, বইয়ের প্লটটা ইউনিক। ইতিহাস-মিথ আর অতিরিক্ত অলৌকিকতার সাথে নাটকীয়তা মিলে মোটামুটি।
তবে হ্যা, লেখক প্রথমেই বলে দিয়েছেন যে পরিবারগুলোর কাছ থেকে তথ্য পেয়েছেন তাদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন হুবহু কাহিনি দেয়া থেকে কিংবা তাদের নাম পরিচয় প্রকাশ থেকে বিরত থাকবেন। আর সেটা এড়াতেই এতো অলৌকিকতার সৃষ্টি। কিন্তু তারপরেও :/ বইয়টার ফিকশন আর ফ্যাক্টস থেকে ফ্যাক্টস অংশটাই বেশি ভালো লেগেছে। বিধি-নিষেধ না থাকলে বিষয়টা নিয়ে লেখক যদি নন-ফিকশন কোন বই লিখতেন, পাঠক হিসেবে বোধ করি আরেকটু ভালো লাগতো।
ভয় পাওয়ানো ভালো, তবে অকারণে সেই ভয়কে আরও আরও ভয়ঙ্কর করার চেষ্টায় কখন যে সেটা বিরক্তির পর্যায়ে চলে যায়, সেটা লেখকের বোঝা খুব খুব দরকার ছিল। একটি তারা লেখকের গবেষণা ও অন্যটি রইল অনিকেত মিত্রের অনবদ্য সব ছবিগুলির জন্যে।
এই বই নিয়ে সারাবছর প্রচুর রিভিউ চোখে পড়েছে। আর পড়ার সময়ও জ্যোতি আপু বলে দিয়েছিল যে চন্দ্রহাস পড়ার পর এক সপ্তাহ পাগল থাকবো। অবশ্য এক সপ্তাহ পাগল থাকা লাগেনি, একদিনেই রেশ কেটে গেছে। বইয়ের একদম শুরুতেই লেখা আছে, "এই গ্রন্থ কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনস্কদের জন্য।" বইয়ে যেভাবে কামাতুর রাজার বিকৃত যৌনাচার, রক্তের অভিশাপ, বীভৎস নরবলির বর্ণনা দেওয়া, সেগুলো সহ্য করার জন্য আসলেই প্রাপ্তমনস্ক হওয়া প্রয়োজন। বইয়ের মূল কথাই হচ্ছে পাপ কখনো মোছা যায় না। পাপের ফল একদিন পাপীকে ভোগ করতেই হবে। পাপী নিজে তো তার পাপের ফল পাবেই, এমনকি তার বংশধরেরাও তার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে না।
নরবলির প্রচলন কিন্তু অনেক আগে থেকেই। এমনকি বছর দশেক আগেও ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে মানুষ বলি দেওয়ার প্রচলন ছিল। সাধারণত দেবীর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অথবা ঐশ্বরিক শক্তি লাভের আশায় নরবলি দেওয়া হতো৷ এরমধ্যে পারিবারিক নরবলির ইতিহাস কিন্তু ভয়াবহ। বংশ পরম্পরায় এই বলিগুলো দেওয়া হতো, আর কোনোভাবে যদি বলি দেওয়ার মানুষ না পাওয়া যেত, তাহলে পুরো পরিবারই অভিশাপের আগুনে পুড়তো। এরকমই এক পারিবারিক নরবলির ইতিহাস নিয়েই 'চন্দ্রহাস'।
লেখকের লেখনী অত্যন্ত সাবলীল, সহজ ও প্রাঞ্জল। তার গল্প বলে যাওয়ার ভঙ্গিও অসাধারণ, পুরো উপন্যাসটাই একদম টানটান করে ধরে রেখেছিলেন। আর আমার কাছে এই প্লটটা নতুন। একদম মেদহীন লেখা, যার কারণে খুব সহজেই গল্পের সাথে তাল মেলানো যাচ্ছিল। ফিকশনের সাথে নন-ফিকশন এবং একইসাথে দুটো সময়কাল নিয়ে একসাথে লেখা কিন্তু চাট্টিখানি কথা না। আর এখানেই লেখক তার মুনশিয়ানা দেখিয়ে গিয়েছেন। এই বইয়ের পেছনে লেখকের পরিশ্রমটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। যদিও কিছু কিছু জায়গায় লেখকের অতিরঞ্জিত বর্ণনা বেশ চোখে লাগছিল। আর ক্যারেক্টারগুলোর স্ট্রাকচার খুব দুর্বল। মেইন প্রোটাগোনিস্ট রাঘবের চরিত্রটা আরেকটু ভালো হতে পারতো। আমার কাছে বইটা ভালোই লেগেছে, একদম একটানে শেষ করার মতন। ওহ, বইয়ের শেষ দেখে মনে হলো কাহিনীর ২য় পর্বও আসতে পারে, টুইস্টটা কমপ্লিট না।
বইয়ের শেষের দিক টা বেশি মেলোড্রামাটিক হয়ে গেলো না? যাইহোক, প্রথম দিক থেকে ভালো লাগলেও মাঝখান থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি, বেশি অলৌকিক হয়ে গেছে কাহিনী টা৷ হয়তো আমি যেরকম আশা করেছিলাম সেরকম না হওয়ায় হতাশ লেগেছে! তবে নরবলি টপিক টা ইন্টারেস্টিং আগে কখনো এতটা জানিনি এজন্য লেখককে ধন্যবাদ 🙂 উনি বেশ চেষ্টা আর পড়াশুনা করেছেন বোঝায় যায় বইটা পড়লে। আর বইয়ের ভিতরের "আর্ট" গুলা ভালো লেগেছে। ☺
চন্দ্রহাস সৌরভ চক্রবর্তী পাঠ প্রতিক্রিয়া এবারের পুজোয় ঘরে বসে কয়েকটা নতুন বই পড়বো ভেবে সৌরভ চক্রবর্তীর চন্দ্রহাস বইটি তুলে নিলাম ৷ কথায় বলে, নেভার জাজ আ বুক বাই ইটস কভার, কিন্তু প্রচ্ছদটি চমৎকার ৷ এই কাহিনী আবর্তিত হয়েছে রামায়ণে বর্ণিত রাবণের চন্দ্রহাস খড়্গ নিয়ে, মহাদেবের এই অমোঘ অস্ত্রটি কালের নিয়মে অত্যাচারী রাজা ভৈঁরো দেওর হাতে পড়ে ৷ তিনি একদা বর্তমান দন্তওয়াড়া অঞ্চলের রাজা ছিলেন, যিনি নিয়মিত নরবলি দিতেন, নারীবলীও ৷ ভৈঁরো দেওর পুত্ররা নরবলীর ট্রাডিশন মানতে না চাইলে বাঙলার জমিদার ও রাজার বন্ধুপুত্র প্রতাপনারয়ণকে ভৈঁরো দেও অর্ধেক রাজত্ব ও চন্দ্রহাস দেন ৷ প্রতাপনারায়ণ এক নবমীর রাতে যুদ্ধবন্দীদের দন্তেশ্বরী কালিমায়ের মন্দিরে বলি দিতে গেলে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সেনারা এসে পড়ে ও বলি অসমাপ্ত রেখে রাজা পালায়, চন্দ্রহাস হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে ৷ এই কাহিনী প্রোফেসর রাঘব চক্রবর্তী প্রতিবছর ‘পারিবারিক নরবলির ইতিহাস’ ক্লাসে দিনের পর দিন পড়ান, কিন্তু কেউ বাকি গল্প জানতে চায় না, শুধু তনুশ ছাড়া ৷ রাঘব স্যরের লেকচার শুনে তনুশ প্রতাপনারায়ণের বাড়ী খুঁজতে গিয়ে রহস্যময় ভাবে মারা যায়, যা আপাতদৃষ্টিতে দুর্ঘটনা মনে হলেও তা নয় ৷ তনুশের যমজ ভাই রিশান রাঘব স্যরের ক্লাসে যোগ দেয় ও প্রতাপনারায়ণকে খুঁজতে দান্তেয়াড়া যায় ৷ অবশ্য দান্তেয়াড়া গিয়েই বোঝে প্রতাপনারয়ণের রাজবাড়ী, চন্দ্রহাসমহল আসলে কলকাতার উপকন্ঠে ৷ চন্দ্রহাসমহলের মানুষরা মানে প্রতাপনারায়ণের বংশধররা এখনও অভিশপ্ত জীবন কাটাচ্ছে ৷ প্রতি বছর সন্ধিপুজোয় পশুবলি দিতে হয় আর উনপঞ্চাশতম বর্ষে মানুষের অস্থিমজ্জা এবং পঞ্চাশতম বর্ষে হয় পূর্ণ নরবলি, নইলে চন্দ্রহাসমহলে নেমে আসে বিপর্যয় ৷ দুতিন প্রজন্ম ধরে প্রতাাপনারায়ণের বংশধররা বাধ্য হচ্ছেন নিজের প্রিয় আত্মীয়দের বলি দিতে, কিন্তু কেন ? কেন গল্পটি বড়ই ভয়ানক, কেউ পুরোটা মনে রাখতে পারেনা ৷ শুধু বর্তমান রাজা অনুজ নারায়ণ আর তাঁর পুত্র আদিত্য জানেন যে একমাত্র চন্দ্রহাস পেলেই বন্ধ হবে নরবলির অভিশপ্ত পরম্পরা ৷ রাঘব আর রিশান যে বছর চন্দ্রহাসমহলে পৌঁছয় সে বছর পঞ্চাশতম বছর, অর্থাৎ নরবলী বছর ৷ বিভিন্ন সূত্র হতে কাহিনীটা উদ্ধার করে রাঘব বোঝে রাজা প্রতাপনারায়ণ দান্তেয়াড়া হতে ফিরেও বলি প্রথা চালু রাখেন ৷ তিনি প্রতিবছর শরতে দুর্গাপ্রতিমার বদলে রক্তদন্তিকাদেবীর আরাধনা করতেন ও সন্ধিপুজোয় নরবলি দিতেন ৷ বলিপ্রদত্ত মানুষটিকে বাসন্তীপুজোয় মনোনীত করে ছয়মাসের জন্য তাকে অপার স্বাধীনতা দেওয়া হত, সে যা খুশী করতে পারতো ৷ একদিন এক ভৈরব স্বেচ্ছাবলি হতে আসেন ও রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন, রাজা তাঁকে বলি দিতে অস্বীকার করেন ৷ ভৈরব অখুশী হয়, ভৈরব রাজাকে বাধ্য করে তাকে বলি দিতে, সঙ্গে রাজার পোষা সিংহকেও ৷ বলির পর ভৈরব আর সিংহের রক্ত মিশে তৈরী হয় একপ্রাগৈতিহাসিক কালো সিংহের ৷ ভয়ানক সেই জন্তু রাজবংশকে শেষ করতে চায়, রাজা সিংহকে গুপ্ত কারাগারে বন্ধ করলেও প্রতি পঞ্চাশতম বর্ষে তার নররক্ত চাইই চাই, একমাত্র চন্দ্রহাসই পারবে সেই পিশাচকে মারতে ৷ রাঘব আর রিশান কি করে, কোথা হতে চন্দ্রহাস উদ্ধার করবে তা নিয়ে এই গল্প ৷ গল্পের ভালো দিকগুলি হলো, অবশ্যই প্লট ও সাবপ্লট ৷ খুব টানটান উত্তেজনাপূর্ণ, রোমাঞ্চকর গল্প ৷ এটা যেকোনো গল্পেরই বড় প্লাস পয়েন্ট, পাঠককে টেনে রাখার ক্ষমতা সবই আছে ৷ মাইনাস পয়েন্ট গুলো ভালো করে না পড়লে চোখে পড়বে না ৷ প্রথম কথা, পশ্চিমবঙ্গের কোনো আণ্ডার গ্র্যাজুয়েট কলেজে ইতিহাস ডিপার্টমেন্টে পারিবারিক নরবলীর ইতিহাস বলে কোনো পেপার পড়ানো হয় কিনা জানি না, তায় আবার একজন ফুলটাইম প্রফেসর (অ্যাসিস্টেন্ট বা অ্যাসোসিয়েট প্রোফেসরই কলেজে হয় মূলত ) পনের-কুড়ি ঘন্টা বলির গল্প বলেন ও তাতে ছাত্রদের রিসার্চ পেপার জমা দিতে হয় ৷ এটা কোনো বিদেশী রিসার্চ অর্গানাইজেশন হলে মানাত, তবে আণ্ডার গ্রাজুয়েট লেভেলে নয় ৷ আমার পরিচিত একজন সতীদাহ নিয়ে গবেষণা করছেন, তবে সেটা অনেক হায়ার লেভেলে ৷
“জনা পঁচিশেক ছাত্রছাত্রী সবারই বয়স পঁচিশ হতে তিরিশের মধ্যে ৷” রিয়েলি ? আমি বা আমাদের পরিচিতরা তো ১৮তে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে ২১শের মধ্যে গ্র্যাজুয়েশন করেছি, (চার বছরের ডিগ্রী কোর্স চালু হয়নি এখনও) ২৩ এ মাষ্টার্স, পঁচিশে এমফিল ডেসার্টেশন দিয়ে পঁচিশ থেকে ত্রিশে পিএইচডি ৷ এরা এখনও কলেজে ? বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে কখন ? আর ধরে নিলাম ‘কলেজে’ পিএইচডি করছে ৷ প্রতিবছর পঁচিশজন করে নরবলিতে পিএইচডি করে ? পিএইচডির টপিক এত লোকের এরকম হয় না, কোর্সওয়ার্কও অন্যরূপ হয় ৷ “রিশানকে তনুশের জায়গায় ভর্তি করে দিন”- কলেজে এডমিশন পাওয়া কি ইজি না ? তাও ২৬-২৭ বছরের পর ৷
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে রুবিনা বলে একজন মুসলিম ছাত্রী আছে বলে রাঘব চমকৃত হল ৷ রাঘব বোধহয় জানে না, অনেক হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীও ইউরোপের উইচকাল্ট নিয়ে গবেষণা করে, রিসার্চ যে কেউ যে কোনো টপিকে করতে পারে ৷ রুবিনা যখন শস্যচুরির শাস্তি হিসেবে রোমে মৃত্যুদণ্ড বা বলিকে ঠিক সাজা বলে, রাঘব তাকে কন্ট্রাডিক্ট করে ৷ আরব দেশে এখনও চুরির শাস্তি মৃত্যু, রুবিনা বোধহয় সেটাকেই সমর্থন করলো ও রাঘব সেটা লঘু পাপে গুরুদণ্ড বলে জানালো ৷ রুবিনা ‘সরি’ বলল ও মতটা মেনে নিল ৷ এসব স্টিরিওটিপিকাল কথাবার্তা খুব প্রয়োজন ছিল কি ? অনেকেই মনে করে মৃত্যুদণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়, আবার ধর্ষণের সাজা হিসেবে আরবের মৃত্যুদণ্ড সাজাকে অনেকে সমর্থন করে, তা সেটা তাদের ব্যক্তিগত মত ৷ রুবিনা সরি বলবে কেন ? তার যা মনে হয়েছে বলেছে, রাঘব স্যর ছাত্রদের ওপর নিজের মত চাপাবেন কেন ? এছাড়াও রয়েছে আরও একটি উক্তি, রাঘব বলে, নরবলি অনেক প্রাচীন, থুড়ি নারীবলীও, ফেমিনিষ্টদের খুশী করতে ৷ একথায় ক্লাসে সবাই হাসলে রাঘব তাদের সেন্স অব হিউমারের প্রশংসা করে ৷ এতে হিউমারের কি হল রে, বাবা ? ফেমিনিষ্টরা সব কিছুতে ‘নারী’ কথা পছন্দ করে, তাই ? ফেমিনিজম হাসির বিষয় হয়তো, কিন্তু উনি কি এটা লক্ষ্য করেছেন কারা বলী হতো, সাধারণ প্রজা, বিশেষত অব্রাহ্মণরা (ভৈরব নিজেও অব্রাহ্মণ ছিল, যার পুরো পরিবারকে প্রতাপনারায়ণ হত্যা করে) ৷ এটা লেখকই উল্লেখ করেছেন ৷ তা উনি ফিউডালিজম ও কাষ্টইজম নিয়ে বলতে গিয়ে কিন্তু পরিহাস করেননি ৷ রাঘব কি জানে না, নারীবলি তো সতীদাহও ছিল, নয় কি ? তৃতীয় হলো নরবলির ওপর দীর্ঘ্য লেকচার, লেখককে অনেক কিছু পড়তে হয়, তা বলে সব কিছু পাঠককে জানানোর দরকার নেই ৷ রাবণকৃত তাণ্ডব স্তোত্র ও চণ্ডীর পুরো পুরো অংশ তুলে পাতা ভরানোর কি আছে ? সিরিয়ালের কল্যাণে সর্বদাই এদুটি স্তোত্রপাঠ চলে টিভিতে ৷ রিশান আর রাঘবের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, রিশান লেকচারের ফাঁকে ফাঁকে স্যরকে জল দিচ্ছে, এসব অনাবশ্যক বিষয় লেগেছে ৷ তা এত কিছুই যখন লিখলেন তো চিমু সভ্যতাটাই বা বাদ গেল কেন ? চতুর্থত, দন্তেওয়াড়া না গেলেও চন্দ্রহাস মহল পাওয়া যেত ৷ ভুতুড়ে ঘটিগরমওলা তো আগেই বলতে পারত ৷ শুধুমুধু রাঘবের টাকা নষ্ট ৷ পঞ্চমত, চন্দ্রহাস মহাদেবের অস্ত্র, ধারককে অপরাজেয় করে তোলে, কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ আর সেপাইদের দেখে তবে প্রতাপনারয়ণ পালালেন কেন ? রাবণ তো চন্দ্রহাস হাতে বিশ্ববিজেতা হয়েছিল, প্রতাপনারায়ণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে পারল না ? তবে কি ভারতীয় দৈবঅস্ত্র শুধুই নির্দোষের প্রাণ নেয় ? ইংরেজরাই অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল বলতে হবে ৷ ষষ্ঠত, রাঘব এত কিছু জানে, অথচ বোধনের ইতিহাস জানে না ? অনুজনারায়ণকে রাঘব বলল এ বিষয়ে তার জ্ঞান তলানিতে ৷ অথচ রাঘব সংষ্কৃত জানে, চণ্ডীপাঠ করতে পারে, ফসিল চেনে (জুতো সিলাই হতে চণ্ডীপাঠ যাকে বলে ) ৷ আর বুঝলাম না, রিশান কি করে ভৈরবের পুনর্জন্ম হয় ? আত্মা মুক্তি না পেলে কি পুনর্জন্ম হয় ? আমারও অবশ্য এসব বিষয়ে জ্ঞান তলানিতে ৷ সপ্তমত, বস্তার জেলার এমন ইতিহাস অশ্রুতপূর্ব , ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন শেষে ১৯৪৭ এ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে রাজি হয়েছিল বস্তার ৷’ (পৃষ্ঠা ৮৫, অধ্যায় ৭)- আমি জানতাম সিপাহী বিদ্রোহের (১৮৫৭) পর কুইন্স প্রোক্লেমেশন দ্বারা মহারাণী ভিক্টোরিয়া ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন খতম করেন, ভারত ডাইরেক্ট ব্রিটিশ ক্রাউনের আণ্ডারে যায় ৷ ব্রিটিশ রাজ মানে সবটা কিন্তু কোম্পানীর শাসন নয় ৷ এই জন্যই বোধহয় ১৮৭৬ এও কোম্পানির সিপাহীরা ‘দশটি জিপে’ এসেছিল ৷ ভারতে জিপ অনেক পরে আসে ৷ জিপ USA তে আসে ১৯৪০ এ আসে, প্রথম জিপ তৈরি করে উইলিস-ওভারল্যাণ্ড ৷ ১৯৫০-৫৩তে ভারতে আসে এবং ১৯৬০ থেকে ভারতে মাহিন্দ্রা এণ্ড মাহিন্দ্রা কোম্পানীর হাত ধরে তৈরী হতে থাকে ৷ অষ্টমত, ওয়েবসাইট চেক করে আরও একটি বিষয় জেনেছি- পৃষ্ঠা ৪১-৪২- ত্রিপুরার দুর্গাবাড়ীর কথা এসেছে, যেখানে মায়ের দুই হাত ও নবমীতে মোষবলি হয় ৷ সেই পুজো সম্বন্ধে তনুশ বলছে“মহিষের দেহ ছটফট করতে থাকে…..ব্যাণ্ড পার্টি সেই মুহুর্তে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত কেন বাজায়, আমি আজ অবধি বুঝে উঠতে পারিনি ৷শুধু দেখেছি দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সকলেই ছিটকে বেরোনো মহিষের রক্ত সংগ্রহ করতে উঠে-পড়ে লেগেছে ৷” এতো জাতীয় সঙ্গিতের অবমাননা ! সত্যি নাকি ? ওটা দশমীর বিসর্জনে বাজে ! স্বপক্ষে একটি আর্টিকল পেশ করলাম ৷ ২০১৯ সালে ত্রিপুরা হাইকোর্টের নির্দেশে মোষবলি বন্ধ হয়েছে ৷ তার আগে অষ্টমীতে পাঁঠা, পায়রা ও মোষবলি হতো ৷ জাতীয় সঙ্গিতের বিষয়টিও অন্যরূপ ৷ আরও একটি খবর এসেছিল ২০১৮ দ্য স্টেটসম্যানে, দুর্গাপুজোর বিসর্জনে পুলিশব্যাণ্ড জাতীয় সঙ্গীত বাজায় ৷ “The idols of Durgabari are the first to be immersed at Dashamighat with full state honours, with the police band playing the national song.” এখনকার পুরোহিত জয়ন্তকুমার ভট্টাচার্য্য সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ৷ চন্দ্রহাসমহলের পুরোহিতকে হ্যাটস অফ, উনি পিশাচ আর মানুষের লড়াইতেও অবিচলভাবে সব মন্ত্রপাঠ করলেন ৷ এমন অকুতোভয় পুরোহিত সত্যিই দুর্লভ ৷ আর একটা মজার বিষয় হলো রাঘবের হেল্দি ডায়েট- রাঘব সকালে দুটো ডিমসেদ্ধ আর ব্রেড খায়, কলেজে আবার বোনলেস চিকেন স্যুপ আর হাঁসের ডিম ৷ আবার চন্দ্রহাস মহলে রেবার হাতের রান্না খেয়ে মনে হলো না রাঘব ডায়েট করে ৷ এ কাহিনী স্বপনকুমার রচিত দীপককে মনে করিয়ে দেয়- পৃষ্ঠা ৮৩-৮৪- “ফ্ল্যাটের জানলা খোলা ছিল, বাইরে বৃষ্টি স্পষ্ট দেখা যায় ৷ শনশন করে হাওয়া ঢুকছে ঘরে ৷ দূরের কিছু গাছের মাথা দেখা যায়, দুলছে তারা ৷ আজ পূর্ণিমা ৷ বিশ্ব চরাচর আলোকিত হয়ে আছে চন্দ্র মহিমায় ৷ চাঁদের দিকে চাইলেন প্রফেসর রাঘব ৷”- এ কেমন আবহাওয়া ? বৃষ্টি আর চাঁদ একসাথে ? কাহিনীর শেষে একটা সিক্যুয়েলের ইশারা, তবে প্রাগৈতিহাসিক বাস্তুতন্ত্র, ম্যামথ, এত কিছুর এই গল্পে দরকার ছিল না ৷ তন্ত্র শক্তিতে জীবিত সিংহের বাস্তুতন্ত্রের যদি দরকার ছিল, তো বলির পশুর কি প্রয়োজন ৷ সূর্য্যালোক ছাড়া বাস্তুতন্ত্র চলে কি করে ? আরও একটি বিষয়, এই কাহিনীর স্থানে স্থানে বিবরণ বড় নির্মম, বড় নির্দয়, দুর্বল চিত্তদের জন্য নয় ৷ এবার বলবো চরিত্র ও ডায়ালগের বিষয়ে ৷ চরিত্রগুলি আর একটু মানুষের মনে জায়গা করতে পারত, তনুশকে আরও একটু স্পেস দেওয়া যেত ৷ তবে আমার মনে হয় বইটি সবার পড়া উচিত, আর সিক্যুয়েলও নিশ্চয় পড়বো ৷
২০২০ সালের সব থেকে হট সেলিং বই আমিই হাত এ পেলাম ২০২২। পড়া শুরু করেছি মহালয়া থেকে আর আজ মহাঅষ্টমীর দিন বইটি পরে কিছু অনুভূতি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি, নিতান্তই ব্যাপারটা কাকতালীয় কারণ যারা বইটা পড়েছেন বুঝতে পারবেন। পারিবারিক নরবলির উপর লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস এই চন্দ্রহাস। অকাল্ট হরার জেনার এর উপর আমার পড়া প্রথম কোনো উপন্যাস। বইটির ব্লার্ব এর লেখাটি পরেই দারুন ইন্টারেষ্টিং মনে হয়েছিল, ঐতিহাসিক উপন্যাস এর সাথে অলৌকিক ঘটনাবলী দিয়ে লেখক একটি উপাদেয় উপন্যাস সাজিয়েছেন, সেখানে হিংস্রতা আছে, আছে ভয়, আছে এমন কিছু যা আপনাকে শিহরিত করবেই।
পটভূমি -
বর্তমান পৃথিবীতে কিছু পরিবার আছে যেসব পরিবারে পূর্বের আভিজাত্য আর নেই। রাজপাট জমিদার সব চুকে গেছে - কিন্তু ইতিহাস এর কলঙ্ক এখনো বয়ে বেড়াতে হয় তাদেরকে। পিছু ছাড়েনি পূর্বপুরুষদের রচিত অভিশাপ এর মায়াজাল। পারিবারিক নরবলির মতো বীভৎস রীতি মেনে বছরের পর বছর রক্তগঙ্গা বইয়ে দেন তারা। গুপ্ত কুঠুরিতে চলে সাধন ভজন. কখনো ইচ্ছের বিরুদ্ধে অথবা কখনো ইচ্ছাকৃত ভাবেই অংশ নিতে হয় এই নরবলির ক্রিয়ায়। একবিংশ শতাব্দীতেও পা দিয়েও শত বছরের পুরোনো বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে চলছে। আর এইসব রীতি না মানলেই পরিবারের উপর নেমে আসে ঘনঘোর অন্ধকার, মৃত্যুর ছায়ায় ঢেকে যায় চারিদিক। এ সবে ঘটে চলেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। কেউ জানেন না সেই সব ইতিহাস। এমন কি সংশ্লিষ্ট পরিবার, নিজেদের পারিবারিক ইতিহাস এর তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ তেও সেগুলোর উল্লেখ রাখে না সে সব অন্ধকার এর কথা, খুবই গোপন সেসব ক্রিয়া। এই প্রথম বার সে সব ইতিহাস উন্মোচিত হয়েছে চন্দ্রাহাস এ। অন্ধকার থেকে প্রথমবার আলোতে এসেছে পারিবারিক নরবলির একাধিক তথ্য।
রাজা প্রতাপ নারায়ণ, রাজা ভৈঁরো দেওয়ের দেওয়া অর্ধেক সাম্রাজ্য দানে পেয়ে রাজা হয়েছিলেন। শর্ত ছিল, ভৈঁরো দেওয়ের জীবদ্দশায় অন্তত একবার রাজ্যে নরবলির আয়োজন করতে হবে। শর্ত মত প্রতাপ নারায়ণ দক্ষ মন্ত্রী সুভদ্রের সহযোগিতায় নরবলির ব্যবস্থা করেন। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘাতক অস্ত্র চন্দ্রহাস দিয়ে নরবলিও দেন, কিন্তু অতর্কিতে কোম্পানীর সৈন্যরা এসে তা মাঝপথেই থামিয়ে দেয়। উপস্থিত অনুগত তথা মন্ত্রী সুভদ্র কোম্পানীর সৈন্যদের হাতে প্রাণ দেয়। চন্দ্রহাস সমেত পালিয়ে বাঁচেন রাজা প্রতাপ নারায়ণ। সেই শুরু রক্তের নেশা। এই রক্তের নেশার কারণেই প্রতাপ নারায়ণের বংশ অভিশপ্ত হয় এক ভৈরব দ্বারা। যার ফল ওনার উত্তর পুরুষরা ভোগ করে আসছিল দেড়শ বছর ধরে। এই অভিশাপ থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে এই পরিবার তাই ফুটে উঠেছে লেখকের লেখনীতে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া -
পারিবারিক নরবলি সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যে এই ধরণ এর কাজ এই প্রথম, আর তার জন্য লেখকে প্রচুর পড়াশুনা করতে হয়েছে, ফিল্ড স্টাডি করতে হয়েছে আর সেই পরিশ্রম তার লেখায় সর্বৈব ভাবে ছাপ রেখেছে। উপন্যাস জুড়ে বিভিন্ন সময় কালে পূজা, নরবলি, গল্প কথনের বর্ণনা ভীষণই সুন্দর। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে চরিত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক দর্শক মনে হয়েছে। কল্পনা বাস্তব লৌকিক অলৌকিক আজগুবি সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে বলবো বীভৎস দৃশ্যপটে, নারকীয় ঘটনায় রোমাঞ্চিত হতে চাইলে এই উপন্যাস উপযুক্ত।
কিছু কিছু দৃশ্য লেখক বলেছেন, সেগুলো এতোটাই নৃশংস ও হিংসাত্মক তাই বইটি অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।
Please follow Facebook page - Journal of a bookworm for more reviews.
অনেকদিন পর এমন হরর কাম থ্রিলার কাম স্ল্যাশার কাম গোর জনরার একটা বই পড়লাম। কয়েকদিন আগে চণ্ডাল পড়েছিলাম খুব আশা নিয়ে। আশানুরুপ হয়নি। চন্দ্রহাসের ওপরও হাই এক্সপেকটেশন ছিল। খুব বেশি যে পূরণ হয়েছে, তা বলব না। তবে নতুন একটা স্টাইলের সাথে পরিচিত হলাম। এটার জন্য লেখককে ধন্যবাদ দিতেই হয়। ইতিহাসের প্রফেসর রাঘব আর তার ছাত্র রিশানের সাথে পারিবারিক নরবলির ইতিহাসের চৌকাঠে পা রাখলাম চন্দ্রহাসের মাধ্যমে। কেমন ছিল গল্পটা, সে প্রতিক্রিয়ায় আসছি এবারেঃ
১) প্রথমেই বলতে হয় লেখকের রিসার্চের কথায়। বেশ গভীরভাবে তিনি এই বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার সুদীর্ঘ ভূমিকায় স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন সে কথা। বইটির পাতায় পাতায় সেটারই প্রতিফলন দেখতে পাই। মলাটেই যখন মোটা দাগে লেখা থাকে পারিবারিক নরবলীর ইতিহাস, পাঠকের মন সেখানেই ধরে ফেলা হয় বইটি বগলদাবা করে ফেলার জন্য। এখানেও ঠিক তাই হয়েছে। তবে লেখক যে বিস্তর পড়াশোনা করে আটঘাট বেঁধে নেমেছেন, সেটার জন্য সাধুবাদ।
২) ফ্যাক্টস আর ফিকশনের মিশেল খুবই ভালো হয়েছে, তা বলব না। বরং ফ্যাক্টসের জন্য লেখক নাম্বারটা বেশিই পাবেন। তিনি কষ্ট করেছেন, এবং সেটা তুলেও ধরেছেন চমৎকার মুনশিয়ানায়। ভূমিকাতে বলেছেন তিনি যে পরিবারগুলোর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এই গল্পে হাত দিয়েছেন, তাদের কোনো কথা এই বইতে থাকবে না। লেখক সে কথা রেখেই চন্দ্রহাসের গল্প তৈরি করেছেন।
৩) বইতে ইতিহাসের বর্ণনা একটু বেশিই। বারবারই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গিয়েছেন লেখক। সনাতন ধর্মের মন্ত্র নিয়ে আমার ধারণা খুব বেশি একটা নেই। তাই বিশাল বিশাল মন্ত্রগুলো পড়তে গিয়ে কিছুটা হোঁচট খেতে হয়েছে বৈকি। ভাগ্যিস লেখক আমাদের মতো পাঠকদের জন্য অর্থও বলে দিয়েছিলেন। ফিকশনের চাইতে ফ্যাক্টসগুলো বেশি আকর্ষনীয় লেগেছে আমার কাছে। আর ফিকশনালাইজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে লেখক খানিকটা সমস্যা তৈরি করেছেন। কিছু প্লটহোল রয়েছে। তবে সেটা সামান্যই। রাঘব আর রিশানকে সাহায্য করতে আসা অশরীরীর উপস্থিতি কিছুটা বেখাপ্পা লেগেছে আমার কাছে। সেটাকে অবশ্য পারিবারিক সাহায্যকারী হিসেবে জাস্টিফাই করা হয়েছে, তবুও প্রফেসর রাঘবের চরিত্রায়ণটা আমার কাছে খুব বেশি শক্ত লাগেনি। চন্দ্রহাস উদ্ধারের ক্ষেত্রেই যা কেবল বুদ্ধির ঝিলিক দেখতে পেলাম।
৪) বইতে কিছু আর্টওয়ার্ক দেখানো হয়েছে কাহিনীর সাথে সামঞ্জস্য রাখবার জন্য। এটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। খুবই নজরকাড়া ছিল ছবিগুলো।
৫) রিশান ও তার ভাইয়ের স্বপ্নগুলো দেখার আসল কারণ কী ছিল, সেটা নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত লিখলে ভালো হতো। প্রফেসর রাঘবের ক্লাসগুলোর ব্যাপ্তি এতটাই যে শুরুতে একটু আকর্ষণ পেলেও শেষের দিকে বিরক্ত লেগেছে।
৬) প্রোটাগনিস্ট রাঘবের চরিত্রটা একটু কেমন যেন দুর্বল লেগেছে। আমি জানি না লেখক এটার দ্বিতীয় পর্ব আনবেন কিনা। রাঘবকে আরও শক্তিশালী রূপে দেখতে চাই। বইয়ের শেষটায় এত তাড়াহুড়ো করায় আমি যারপরনাই হতাশ। পূজা-অর্চনার বর্ণনা নিয়ে লেখক যতটুকু ঘাম ঝড়িয়েছেন, সমাপ্তির বর্ণনার দিকে ততটুকু হলে বেশ জমজমাট একটা কাহিনী হয়ে যেত।
৭) বাতিঘরের অন্যান্য বইয়ের তুলনায় এই বইতে বানান ভুলের মাত্রা কম। বেশ কম।
৮) প্রচ্ছদ শিল্পী অনিকেত মিত্র একটা আলাদা ধন্যবাদ পাবেন এমন জম্পেশ প্রচ্ছদের জন্য। ভেতরের আর্টওয়ার্কগুলোও দশে দশ।
শেষ কথা। চন্দ্রহাস পারিবারিক নরবলীর ইতিহাস নিয়ে লেখা একটা বই, যেখানে ফ্যাক্টসের সাথে তাল মিলিয়ে ফিকশন তৈরি করা হয়েছে। ফ্যাক্টসই এখানে মূখ্য, ফিকশনটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। শক্ত একটা চরিত্র কাঁধে ঠেস দিয়ে ফ্যাক্টসগুলোকে দাঁড় করাতে পারল না বলে কিঞ্চিত হতাশ।
Historical conspiracy বা religious conspiracy তে আপনার যদি বিষয়বস্তু সম্পর্কে সাম্যক ধারণা না থাকে তাহলে আপনার সেটা পড়তে পানসে লাগতে পারে।যেমন ব্রাউনের ডা ভিঞ্চিকোড, আপনার যদি ইউরোপের চিত্রকলার ইতিহাস, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি বা ক্রিশ্চিয়ানিটির ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান না থাকে তাহলে সেটা আপনার পড়তে তেমনই লাগবে যেমন লাগবে লবন ছাড়া পোলাও কোর্মা খেতে।
প্রশ্ন হল থ্রিলারের বিষয়বস্তু আপনার কিউরিসিটি কে উস্কে দিচ্ছে কিনা।যদি দেয় তাহলে সেটা স্বার্থক থ্রিলার।তবে সব কিউরিসিটি প্রশ্নের উত্তর যে আপনি এতে পেয়ে যাবেন তা নয়।এর জন্য পিছনে নির্ঘন্ট তো দেয়াই আছে।পড়ুন না আপনার যত খুশি।মনে রাখতে হবে এটি থ্রিলার আপনার পরবর্তী পেপার নয় যেটা রাত গেলেই আপনাকে পরীক্ষা দিতে হবে।
থ্রিলারের যে গুণাবলি প্রতিনিয়ত কাহিনী বাঁক নেয়া সেটা প্রথম অধ্যায়ের পর থেকেই শুরু হয়েছে।মাঝে এই ইতিহাসের ক্লাস,দারুণ উপাদেয় আর উপভোগ্য। কিছু জানা কিছু অজানা যেটা এই জঁরের গল্পগুলোর সত্যিকার আকর্ষণ হয়ে উঠে চরিত্রগুলোকে গতি সঞ্চার করে থাকে পিছন থেকে। গল্পের প্রয়োজনে যৌনতা এসেছে এবং সেটা একেবারেই মাপা মাত্রায় এবং অশ্লীলতা বিবর্জিত ভাবে।প্রাপ্ত বয়স্ক থ্রিলারে এরচেয়ে অনেক বেশি রগরগে যৌনতা থাকে সেই তুলনায় এগুলো বলা যায় কিছুই নয় ।
গল্পের আউটলাইন বলে নেই-প্রাচীন একটি ধর্মীয় স্মারক চন্দ্রহাস যে relic দিয়ে করদ রাজ্যের এক স্বেচ্ছাচারী নৃপতি ফিরিয়ে আনতে চায় নরবলির এক নৃশংস ঐতিহ্য।ইংরেজ শাসনের সেই সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই শাসক ইংরেজেদের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হলেও এর ধারাবাহিকতা রয়ে যায় সেই রাজবংশের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তরে।একটা অভিশাপ অলৌকিক অশরীরী কিছুর অশুভ উপস্থিতি বংশ পরম্পরায় পুনরাবৃত্তি ঘটায় সেই নৃশংস ঐতিহ্যের।ইতিহাসের প্রফেসর রাঘব যার সাবজেক্ট হল ঐতিহাসিক নরবলি।অনেক বছর একঘেয়ে ভাবে ক্লাসে এই বিষয় পড়িয়ে নতুন ক্লাসে সম্মুখীন হন এমন এক ছাত্রের যে তাকে তার উদ্বুদ্ধ করে তোলে তার এতদিনের পড়ানো নরবলির শিকড় চন্দ্রহাস খুঁজতে।কোথায় সে relic, কি তার ভূমিকা, নরবলির সাথে কি তার সম্পৃক্ততা? প্রথমেই বলতে চাই গল্পের বিষয়বস্তের অভিনবত্বের কথা।লেখক বিজাতীয় ইলুমিনিটি ফ্রিম্যাসন এইসবে না যেয়ে একেবারে খাঁটি ভারতীয় Occult নিয়ে কাজ করেছেন,এবং সেই সাথে যোগ করেছেন নরবলির মত চমকপ্রদ বিষয়বস্তু যা তাকে প্রথমেই পঞ্চাশভাগ উৎরে দিয়েছে। চন্দ্রহাসের যে ইতিহাস তা বেশ চমকপ্রদ এবং ভীতিপ্রদ অন্তত এই অস্ত্রের মিথটা যাকে নিয়ে সেই লঙ্কাধিপতি রাবণ ভারতীয় পুরাণের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং পরাক্রমশালী খলনায়ক সেটা অনস্বীকার্য।গল্পে এর সম্পৃক্ততা একধরণের চমক আগেই সৃষ্টি করেছে সেটা আগেই বলেছি।
ভাষা চমৎকার গল্প বলার ভঙ্গি ভালো,তবে কথপোকথনের জায়গা গুলোতে কিছুটা জড়তা, ঐতিহাসিক ক্লাসে ছাত্রদের ঘনঘন প্রশ্ন এবং বিস্ময় কিছুটা অযাচিত আর বিরক্তিকর লেগেছে। এবার আসি কিছু বিশ্লেষণে- সপ্তম অধ্যায়ে লেখক ১৮৪২শে দন্তেশ্বরী মন্দিরে কোম্পানি পুলিশ মোতায়েনের কথা বলেছেন যা ১৮৭৬ পর্যন্ত ছিলো। হিসাবে চৌত্রিশ বছর লেখক বলেছেন তেত্রিশ, বলেছেন কোম্পানি সাহেব পাহারা তুলে নেন যেটা সাল অনুযায়ী আসলে হবে ব্রিটিশ সরকার।যদিও এই সামান্য তথ্যবিভ্রাট গল্পের গতিময়তা ক্ষুণ্ণ করেনি খুব একটা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু আজ পূর্ণিমা রাঘব চাঁদ দেখছেন,চাঁদের দিকে চেয়ে আছেন এটা কিছুটা ধন্দে ফেলে। আব্রাহাম পুত্র ইসাক কে বলি দিয়ে কেটে টুকরো করেন।তাহলে তার ব্লাডলাইনে ডেভিড সলেমন মোসেস রা কি ভাবে আসে? নরবলি যেখানে গল্পের মূল উপজীব্য সেখানে প্রতিটি বেসিক তথ্য নির্ভূল থাকা অত্যন্ত জরুরী। গল্পের শেষটুকু অত্যান্ত টানটান হয়ে উঠছিলো জন্মান্তরের টুইস্ট টা দারুণ কিন্তু ফাইনাল সংঘর্ষ একেবারে এলোমেলো। সিংহ ম্যামথ বাইসন এগুলো ঠিক মেনে নেয়া গেলো না।এতগুলো অস্বাভাবিক মৃত্যু শহর কলকাতায় কিন্তু পুলিশ আসলো না বা পুলিশি ঝামেলা হল না এটা ভাবা যায় না। চন্দ্রহাস মহল কোনো রিমোট প্লেসে হলে ভালো হত। রাঘবের স্ত্রী কন্যা আছে পূজোর সময় তারা কোথায় গেলো?এ নিয়ে দুলাইন হলেও একটা ব্যাখ্যা দরকার ছিলো না কি? সুড়ঙ্গে মশাল নিয়ে নামবে কেনো? যখন অতি আধুনিক এই সময়ে শক্তিশালী টর্চ চার্জার সবকিছুই আছে। ঐতিহাসিক গল্পের গ্যাপ গুলো একে একে পুরোন হওয়া, ভৈরবের আগমনের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা,চন্দ্রহাস খুঁজে পাওয়া এবং অশুভের বিনাশ সবকিছু মিললেও শেষে ভৈরবের অদ্ভুত সব রূপান্তর সব উত্তেজনা ভয় অলৌকিকতায় এক বালতি জল ঢেলে দিয়েছে বলা যায়।
.. .পারিবারিক নরবলি—এই দুটো শব্দেই নড়ে চড়ে বসতে হয়। খোদ কলকাতায় সেই নরবলির রীতি পালন করছে এক পরিবার। দেড়শো বছর ধরে এই রীতির খবর কেউ জানে না। মহারাজ প্রতাপ নারায়ণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এক রাতে করেছিলেন এরকম এক পাপ যার ফলে তার পরবর্তী বংশধরদের জীবনে নেমে আসে এক অমোঘ অন্ধকারের অভিশাপ-রক্ত গঙ্গা বইতে দিতে হয় প্রতি বছর।
ইতিহাসের প্রফেসর রাঘব নরবলির ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন বহু বছর ধরে। বহু গবেষণা তার করায়ত্ত, কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে কেউ কোনোদিন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। নতুন বছরের ব্যাচে রাঘব পেলেন প্রিয় ছাত্র রিশানকে যে কার্য কারণে সেই একই বিষয়ের শিকার। শুরু হল খোঁজ। কিন্তু কীসের খোঁজ? এ রকম এক বিষয় যে কাহিনী কেউ মনেই রাখতে পারে না অভিশাপের কারণে! রাজকীয় পূজো, তন্ত্রাচার, লোভ, অপশাসন, সাধন-ভজন, কী নেই এই কাহিনীতে! একে একে পেঁয়াজের খোসার মতো কাহিনী উন্মোচিত হতে থাকে। ঠিক যতটা উন্মোচন ততটাই ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকে ‘চন্দ্রহাস’-এর চরিত্ররা। এর আদৌ কোনও তল পাওয়া যাবে কি? সৌরভ চক্রবর্তী'র 'চন্দ্রহাস' উপন্যাসে উঠে এসেছে ইতিহাস, ধর্ম, অলৌকিকতা উর্ধ্বে উঠে। . গিয়ে এক অমানুষের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি যা আমাদের ভিতটাকেই নাড়িয়ে দেবে। . . .প্রথমত এটি একটি ঐতিহাসিক কাহিনী! তাই একটু বেশি আকর্ষণবোধ করেছি! . .যা ভাল লেগেছে : ✨ লেখক খুব ভালভাবে নরবলির ইতিহাস বলেছেন! আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি: “আরও একটি অস্বাভাবিক প্রথার প্রমাণ ইতিহাসে আছে। প্রাচীন চৈনিকদের ধারণা ছিল মৃত্যুর পর মৃতের আত্মা আবার তার দেহে প্রবেশের চেষ্টা করে। তাই তার মৃত্যুর পর কিছুদিন সেই মৃতদেহ বাড়িতে রেখে দিত। কবর দিতো না কিংবা পুড়িয়েও ফেলতো না। তারপর বাড়ির ছাদ বা সেরকম উঁচু কোনো জায়গায় গিয়ে বুক চাপড়ে আর্তনাদ করে কান্নাকাটি করতো। এর মাঝের কিছুদিন তারা উপবাসে কাটাতো, ঘাসের বা খড়ের বিছানায় শুতো। কিন্তু যখন মৃত ব্যক্তি জেগে উঠতো না তখন শুরু হতো দ্বিতীয় পর্ব। বিশাল এক কবর খোঁড়া হতো। তাতে পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার সমস্ত কিছু রেখে দেওয়ার পর মৃতদেহকে শুইয়ে দেওয়া হতো সেই কবরে। মৃতের পাশে চিরাচরিত নিয়মে স্ত্রী, রক্ষিতা, ভৃত্য প্রভৃতিদের রাখা হতো। জীবন্ত কবর দেওয়া হতো তাদের। এও তো একপ্রকার বলি প্ৰথাই।�� ✨কিছু কিছু জায়গায় লেখক এমন থ্রিল দিয়েছেন যে গা সিউরে উঠার মতো! আর শেষ ২০ পৃষ্ঠা তো 😱😱😱!
যা ভাল লাগেনি : ✨লেখক এটাকে Historical thriller বললেও আদতে সেটা হয়নি। এখানে history 80% এবং thrill 20%. ✨ লেখক গল্পে টানটান অবস্থাটা ধরে রাখতে পারেননি! লেখক আরও ভালো করতে পারতেন! আরও উন্নত করতে পারতেন! আরও টুইস্ট বসাতে পারতেন। কিন্তু মনে হয়েছে তিনি কোনো তাড়াহুড়ায় ছিলেন! ২২০ পৃষ্ঠার বইটি সে তুলনায় বেশ ছোট হয়েছে!! আমার রেটিং ৩/৫।
"খোদা পাহাড়, নিকলা চুহা!"- হিন্দি ভাষার এই প্রবাদটি শুনেনি এমন মানুষ বোধ হয় খুব কমই আছে। আর হ্যা, চন্দ্রহাস বইটি পড়ে আমার অবস্থা ছিল অনেকটা অমনই। যতটা আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে বইটি কিনেছিলাম তার যেনো অর্ধেকের অর্ধেকও বইটি পূরণ করতে পারেনি।
নরবলি, ইতিহাস, পৌরাণিক তত্ত্ব, ফিকশন, কল্পনা ও বিজ্ঞান মিশিয়ে চমৎকার কিছু একটাই যে লেখক পাঠকদের উপহার দিতে চেয়েছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ঐযে , খাপে খাপ না মিললে যা হয় আরকি! হয়তোবা হতে পারত অসাধারণ কিছু, হয়ে গেলো এক জগাখিচুড়ী! লেখকের ইতিহাস ও হিন্দু পুরাণ ( বিশেষত নরবলি ) নিয়ে ব্যাপক পড়াশুনা আছে তা নিয়ে কেউই বোধ হয় আপত্তি করবে না , প্রমাণ অবশ্য লেখক বইটির আনাচে কানাচে নিজেই দিয়েছেন। প্রথম দিকে উপন্যাস টি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা , গা ছমছমে ভাব তৈরি করা - এসব বিষয়ে লেখক যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু চরিত্রের গঠন , লেখনী ছিল বেশ দুর্বল! আর উপন্যাসের শেষে এসে লেখক যেনো নিজেই তালগোল পাকিয়ে গেলেন। অতিরিক্ত অলৌকিকতা দেখাতে গিয়ে এমন একটি জিনিস তৈরি করলেন যাকে ঠিক ইতিহাস আশ্রিত থ্রিলার বা ফিকশন কোনোটাই বলা চলে না। শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু বলতেই হয় শেষটা অনেকটাই যেনো লো বাজেটের তামিল হরর মুভি হয়ে গেলো। বইটির কাহিনীর থেকে প্রচ্ছদটাই আমার বেশ লেগেছে। অনিকেত মিত্র কি দূর্দান্ত কাজটাই না করলেন! পয়সার অনেকটা এই প্রচ্ছদের জন্যই উসুল হয়ে যায় যেনো। আমার পক্ষ থেকে বইটিকে ২ টি তারা। একটি লেখকের ইতিহাস, পৌরাণিক তত্ত্ব ও নরবলি নিয়ে ব্যাপক জ্ঞানের জন্য। আর একটি তারা অনিকেত মিত্রের ইলাস্ট্রেশনের জন্য।
প্রকাশের সময় এত গর্জন তর্জন হয় পরে রিভিউ তে ভিন্ন মতামত মনে হলো বইটা পড়ে দেখা উচিত, শুরুটা ভালো, ভালো লাগলো বেশ কিছু পুরান ইতিহাস এর তথ্য সমৃদ্ধ গল্প গুলো , লেখক অনেক পড়াশুনা করেছেন তার প্রতিফলন পেলাম, এবং বলবো লেখক কাহিনী পরিবেশক হিসেবে সত্য ভালো কাজ করেছেন, কারন এই বই কিন্তু যে গতি টা আছে আর যা বর্ণনা তা কিন্তু সত্যি খুব চমকপ্রদ, কিন্তু বই এর মাঝে এবং পরের দিকে এসে কোনো অতীব অতিরঞ্জিত সিনেমার চিত্রনাট্য পড়ছি বলে মনে হলো, একে বারে বিচ্ছিরি শেষে যে কি হলো কোনো হলো না হলে ও হতো মনে হয় ।
চন্দ্রহাস | সৌরভ চক্রবর্তী | The Café Table | ২০২০র ৯৪তম বই . গল্পের গরু ও গাছ। নয় পাতার ভূমিকা শেষে, শুরুটা ভালই ছিল। কিন্তু কাহিনীর মাঝামাঝি এসে দক্ষিনি ছায়াছবিকেও টেক্কা দিয়ে ফেলেছেন লেখক। . পোষাল না। . পৃষ্ঠার মাঝে মাঝে পাবেন অনিকেত মিত্রর অমুল্য চিত্রিত ছবিগুলি, যা মারাত্মক ভাবে জীবন্ত, এবং এগুলি গল্পের বুলেট-ট্রেনের গতি – কিছুটা হলেও আপনার জন্যে কমিয়ে আনবে। প্রকাশকরা যদি আরেকটু যত্ন নিয়ে বইটি ছাপাতেন, তাহলে হয়ত এই ছবিগুলির জন্যেই বইটি কেনা যেত। কিন্তু আঁকা আর ছাপার তফাৎ দেখে, সবই জলে গেল বলে রব উঠছে ভেতর থেকে। . সময় ও পয়সা, দুটিই “মা দন্তেশ্বরীর” ভোগে দেবেন না, স্যার ও মাদাম-রা। . লেখকের লেখার হাত যথেষ্ট ভালো ৷ আবহ-পরিবেশ গড়নেই তা প্রমাণ্য ৷ কিন্তু পারিবারিক নরবলির টোপ দিয়ে পিচবোর্ড চরিত্র ও ঝড়ের গতিলব্ধ খিঁচুড়িকৃত কাহিনীর শাক ঢাকা যায় না। সিকুয়েলের “টুকি”টা অপেক্ষা করে কিনতে হবে। এবারের মত ঝুরি ঝুরি “হুজুগে ও paid reviews”এর বন্যা নেমে গেলে, তারপর আরকি।
এই বইয়ের টপিক নির্বাচন খুবই সুন্দর ও যথাযথ।বইটি পড়ে শেষ করার পর পাঠকের/পাঠিকার মনেও এরকম চাহিদা আসতেই পারে যে তাকেও যেন যূপকাষ্ঠে ঢুকিয়ে নরবলি দেওয়া হয়।ধন্যবাদ।
কাহিনি সংক্ষেপঃ প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন বস্তার রাজ্য। রাজ্যের মহারাজ প্রতাপ নারায়ণ চৌধুরী এক রাতে মা দন্তেশ্বরীর মন্দিরে মায়ের পূজার সময়ে রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠলেন। একের পর এক যুদ্ধবন্দিদের যূপকাষ্ঠে আটকে তাদের শিরোচ্ছেদ করে বলি দিলেন মহারাজ প্রতাপ নারায়ণ। মা দন্তেশ্বরীর বিগ্রহ ও মন্দির প্রাঙ্গণ হতভাগ্য মানুষদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলো। নরবলি দেয়ার এই পৈশাচিক রীতির লাগামছাড়া অনুশীলনই যে একটা সময় মহারাজ প্রতাপ নারায়ণের বংশের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে দেবে, তা হয়তো তিনি নিজেও কখনো ভেবে উঠতে পারেননি।
বর্তমান সময়। ইতিহাসের প্রোফেসর রাঘব চক্রবর্তী কলেজে নরবলির ইতিহাস পড়ান৷ তাঁর নতুন ব্যাচের স্টুডেন্টদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হলো অদ্ভুত এক অ্যাক্সিডেন্টে, যার সাথে কাকতালীয় ভাবে জড়িয়ে গেলেন তিনি। সত্যিই কি কাকতালীয়? এই ঘটনার পর রাঘব চক্রবর্তীর হাতে এসে পড়লো ঐতিহাসিক একটা বই, যেখানে মহারাজা প্রতাপ নারায়ণের বংশে শতবর্ষ ধরে চলে আসা নরবলি প্রথার আরো কিছু প্রামাণ্য দলিল আছে৷ রিশান নামে তাঁর আরেকজন স্টুডেন্টকে নিয়ে প্রোফেসর রাঘব চক্রবর্তীকে পাড়ি জমাতে হলো বস্তারের মা দন্তেশ্বরীর মন্দিরে। অজানা সব রহস্যময় লোকজন কেন যেন প্রোফেসর সাহেব ও রিশানকে সাহায্য করে চলেছে৷ কেন?
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের দৌরাত্ম্যে মহারাজা প্রতাপ নারায়ণ চৌধুরী পালিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁর সাথে ছিলো দেবাদিদেব মহাদেব প্রদত্ত লঙ্কাধিপতি রাবণের ব্রহ্মাস্ত্র চন্দ্রহাস, যার ফলায় লেগে রয়েছে বলি দেয়া শত শত মানুষের রক্ত। মহারাজা প্রতাপ নারায়ণ চন্দ্রহাসের নামেই নিজের মহলের নাম রাখলেন চন্দ্রহাস মহল আর সেখানেই চালু করলেন লম্বোদর গণেশের আরেক রূপ উচ্ছিষ্ট গণেশের পূজা৷ কিসের আশায়?
প্রোফেসর রাঘব চক্রবর্তী ও রিশান যখন সব সূত্র মিলিয়ে চন্দ্রহাস মহলে পা রাখলো, তখন সেখানে বিপদের ঘোর ঘনঘটা। মহারাজা প্রতাপ শেষ বংশধর আদিত্য নারায়ণ দিশেহারা। আবারো দিতে হবে নরবলি, নইলে ভৈরবের অভিশা���ে শেষ হয়ে যাবে পুরো বংশ। কে এই ভৈরব? কি ছিলো তার অভিশাপ? চন্দ্রহাস মহলের দুর্বিপাক থেকে এর অধিবাসীদের বাঁচাতে প্রোফেসর রাঘবকে খুঁজে বের করতে হবে ব্রহ্মাস্ত্র চন্দ্রহাস। সেই চন্দ্রহাস, যার ধারালো ফলায় এই দেড়শো বছরের রক্তের আখ্যান রচনা শুরু হয়েছিলো। পাতালের সুড়ঙ্গে কে বা কি দাপাদাপি করে, সেটাও জানতে হবে ছাত্র-শিক্ষককে।
পূর্বপুরুষের মহাপাপের ফল বছরের পর বছর ভোগ করে আসা পুরোনো এক রাজপরিবারের সদস্যদের পিঠ এবার ঠেকে গেছে দেয়ালে। ত্রাতা হিসেবে উপস্থিত হওয়া প্রোফেসর রাঘব ও রিশান কি পারবে তাঁদেরকে এই প্রাচীণ অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে?
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ কলকাতার দ্য কাফে টেবল ও বাংলাদেশের বাতিঘর প্রকাশনী থেকে প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হয়েছে ওপার বাংলার তরুণ লেখক সৌরভ চক্রবর্তীর 'চন্দ্রহাস' বইটা। পারিবারিক নরবলি সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যে এমন বিস্তারিত কাজ এর আগে হয়নি৷ সৌরভ চক্রবর্তীকে এই বইয়ের মালমশলা সংগ্রহের জন্য বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে, তা সহজেই বোধগম্য। 'চন্দ্রহাস'-এর ভূমিকা অংশটা বিশাল। এই বিশাল ভূমিকা অংশে লেখক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা 'চন্দ্রহাস' লেখার ইতিহাস তুলে ধরেছেন, যা বেশ ভালো লেগেছে আমার।
মহারাজা প্রতাপ নারায়ণ চৌধুরী ও তাঁর বংশধরদের মেনে চলা নরবলি প্রথা সম্পর্কে গা শিউড়ানো ঘটনাবলী উপভোগ করেছি। পারিবারিক নরবলি ও সেই সংক্রান্ত রিচুয়ালগুলোর বর্ণনা বেশ ডিটেইল ছিলো। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো কোন এক্সট্রিম হরর বা স্ল্যাশার উপন্যাস পড়ছি৷ বিশেষ করে 'চন্দ্রহাস'-এর শেষদিকে এসে এই ব্যাপারটা আরো বেশি করে মনে হচ্ছিলো। গণেশের আরেক রূপ উচ্ছিষ্ট গণেশ, মা দন্তেশ্বরী ও দেবী দুর্গার আরেক রূপ দেবী রক্তদন্তিকা সম্পর্কে আগে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলোনা। এই বইটা পড়ার পর এসব ব্যাপারে জানতে পেরেছি৷
'চন্দ্রহাস'-এ লেখক সৌরভ চক্রবর্তী দারুন এক ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করেছেন। পারিবারিক নরবলির ইতিহাসের সাথে অতিপ্রাকৃতের এই সংমিশ্রণ কাহিনিটাতে যোগ করেছে ভিন্ন এক মাত্রা৷ এই বইয়ের শেষটা একটা সিক্যুয়েলের দিকেও কিন্তু ইঙ্গিত দিয়েছে। জানিনা, সিক্যুয়েল নিয়ে সৌরভ চক্রবর্তীর চিন্তাভাবনা কি। তবে এমনটা হলে কিন্তু বেশ ভালো হয়৷ প্রোফেসর রাঘব চক্রবর্তীর সাথে আবারো নরবলির রক্তাক্ত ইতিহাসে হারিয়ে যেতে চাইবো আমি।
বেশ কিছু টাইপিং মিসটেক চোখে পড়েছে আমার৷ শেষের দিকে এর মাত্রা একটু বেড়ে গেছিলো। এক বসায় শেষ করার মতো এই বইটাতে বেশ কিছু ইলাস্ট্রেশন আছে যা শিল্পী অনিকেত মিত্র'র আঁকা। বইটার প্রচ্ছদও করেছেন তিনি। ইলাস্ট্রেশন ও প্রচ্ছদ অসাধারণ হয়েছে।
অস্থির এই সময়ে বাইরে ঘোরাঘুরি না করে বাড়িতে থাকুন। বই পড়ুন৷ স্টে হোম। স্টে সেইফ।
মাইনাস রেটিং দেয়ার সুযোগ থাকলে তা দিতাম। ৫০ পেইজেরও বই না। অতিরিক্ত ড্রামা আনতে প্রচুর অতিরিক্ত কথা বলা হইছে। মূলত সবই অপ্রয়োজনীয়। আমার পড়া এবছরের সবচেয়ে "ফালতু" বই।
তো আমি গিয়েছিলাম এক মফস্বল শহরে, বিশেষ কাজে। মোটামুটি ডিসেন্ট একটা হোটেলে একাকী সন্ধ্যা ও রাতটুকু কাটানোর জন্যে শহরের একমাত্র সাহিত্য-লাইব্রেরিতে গিয়ে বইটা কিনেছিলাম। সাধারণত মৌলিক বই পড়া পছন্দ করি, বিদেশী বই পড়ি অরিজিনাল কপি পেলে। আরও কিছু মৌলিক ছিল বটে সেখানে, কিন্তু বেশিরভাগই আমার পড়া অথবা লেখকের উপর ভরসা নেই। চন্দ্রহাস বইটা কিনলাম তখন। কারণ রকমারিতে বইটার প্রথম কয়েক পাতা পড়ে বেশ আগ্রহ জেগেছিল পড়ার। তাছাড়া এই বিষয়ের উপর, অর্থাৎ ‘নরবলি’-র আমার অন্য কোন বই পড়া নেই। লেখা হয়েছে, এমনটাও জানা নেই। গুডরিডসে রিভিউ ঘাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, বাংলাদেশী পাঠকরা ৩ এর আশেপাশে রেটিং দিয়েছে বইটির। কলকাতার বাঘা বাঘা লেখক-পাঠকেরা দিয়েছে ৫ এর কাছাকাছি। স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিলাম, একটা সাংস্কৃতিক বিভেদ রয়েছে বইতে। ওপার বাংলার লেখক নিজের দেশের পটভূমিতে যা লিখেছেন, তা এপার বাংলার পাঠকদের কাছে অচেনা লেগেছে। এছাড়া আরেকটা অভিযোগ শুনেছিলাম যে প্রচুর অপ্রাসঙ্গিক তথ্য রয়েছে বইটিতে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই বইটা শুরু করেছিলাম। সে রাতেই অর্ধেকটা শেষ করেছি। গল্প ইতিহাসের প্রফেসর রাঘবকে নিয়ে। যিনি নরবলির ইতিহাসই পড়ান মূলত। একটি গবেষণা শুরু করেন এক ছাত্রকে সাথে নিয়ে। সেই গবেষণার সূত্র ধরে গল্প এগোতে থাকে। সেই সাথে থাকে নরবলির ইতিহাসের এ টু জেড। যা যা লেখক জানেন, তা পাঠকও জেনে যাবে পড়তে পড়তে। অনেক তথ্য মজাদার, অনেক তথ্য একঘেয়ে। কিন্তু বর্ণনা একঘেয়ে নয়, এটা স্বীকার করব। গল্পে অ্যাকশন কম, কথোপকথন বেশি। ব্যক্তিগতভাবে বেশি ডায়ালগওয়ালা বইগুলোই আমার ভালো লাগে। পরিমিত অ্যাকশন ও বেশি বেশি ডায়ালগ থাকলে অনেক অবাঞ্ছিত বর্ণনা এড়ানো যায়। পাঠককে খুব দ্রুত গল্পের ভেতর নিয়ে আসা যায়। এদিক থেকে বইটা আমার ভালো লেগেছে। গল্প খুব অসাধারণ কিছু না হলেও চলনসই। যে বিষয়টি নিয়ে গল্প লেখা হয়েছে, তা দারুণ। লেখক খেটেছেনও বেশ। সব মিলিয়ে ভালই লেগেছে। রেটিং-৩। সলিড তিন একদম। ৫ থেকে কমিয়ে ৩ নয়, স্বল্প প্রত্যাশা থেকে তৃপ্তি নিয়ে ১ থেকে বাড়িয়ে আনা ৩। আমি জানি এ বইটি বাংলাদেশী সমালোচকদের মনে ধরেনি। কারণ ওপার বাংলার মানুষ আমাদের মতো কথা বলে না, ভাবে না। আমরা একটা বিষয়কে অনেক প্যাঁচাই, অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে মেনে নেই বা বর্জন করি। ওরা চট করেই মেনে নেয়। এটা অবাস্তব মনে হয় আমার কাছে। যেমন (যেভাবে মনে আছে সেভাবে লিখছি)- ‘আমার ছেলেকে আপনার কাছে রেখে গেলাম। আমি চাই বড়ভাইয়ের অসমাপ্ত গবেষণাটুকু ও শেষ করুক। আপনারা অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়ুন। খরচ যা লাগে আমি দেব।’ প্রফেসর রাঘব মেনে নিলেন। কারণ এ ছাড়া অন্য কোন পথ কারও সামনে খোলা নেই। কেন পথ খোলা থাকবে না? অবশ্যই হাজারটা পথ খোলা ছিল! এ যুক্তি খাটে না আসলে। কিন্তু লেখকের কিছু একটা বলা প্রয়োজন এখানে, তিনি বলেছেন। ওপার বাংলার পাঠক বাস্তবতা নিয়ে এতটা ঘাঁটেনি, পুরনো আমলের সিনেমার মতো মেনে নিয়েছে তারা যুক্তিটা। সত্যি বলতে ওপার বাংলার সাম্প্রতিক সময়ের লেখকদের মধ্যে এই ধরনের বিষয় দেখেছি খুব। চরিত্ররা অবাস্তব আচরণ করে। এটা খুব একটা নেতিবাচকভাবে দেখা হয় না ওখানে। হলে নিশ্চয়ই ওখানকার ৩-৪ হাজার বইয়ের রেটিং দেওয়া পাঠকেরা এটাকে ৫ স্টার দিত না। তবে সুনীল-সমরেশের আমলে ডায়ালগ ও আচরণ নিখুঁত হতো, বাস্তব সম্মত হতো, গভীর ফিলোসফি থাকত। সেটা এখন প্রত্যাশা করি না, পাইও না। সোনালী সময় পেরিয়ে এসেছি। বর্ণনায় বাহুল্য আছে কিনা? অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা জানতাম বলেই এবং বর্ণনা সাবলীল বলে ব্যাপারটা সয়ে গেছে। এছাড়া প্রসঙ্গ থাক বা না থাক, ইতিহাসের বিষয়গুলো এসেছিল এবং বেশ উপভোগও করেছি সে সব। বিশেষ করে, অনেক জায়গা থেকে লেখক নরবলির উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ব্যাপারটা ভালো লেগেছে। জানি না ইতিহাস অংশের কতটুকু বাস্তব, খতিয়ে না দেখলেও আশা ��রছি সি���হভাগ বাস্তবের কাছাকাছি। আরেকটা মজার বিষয়, ডায়ালগের অসামঞ্জস্য রয়েছে অনেক জায়গায়। হয়তো চট করে চোখে পড়ে না। তবে খুঁতখুঁতে বলে হয়তো আমার চোখে পড়েছে। যেমন (যেভাবে মনে আছে)- ছাত্র এসে বলল, ‘স্যার, একটা কথা ছিল।’ ‘কী? ছুটি টুটি হলে দিতে পারব না।’ ‘না স্যার, ছুটি নয়।’ ‘তবে কী?’ ‘আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। আমাদের বাড়িতে পশু বলি দেওয়া হতো। আমার স্বপ্নের সাথে এর কোন সম্পর্ক রয়েছে। আমি কাল বাড়িতে গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে চাই।’ ‘ঠিক আছে, বেশ। একদিনের ছুটি দেওয়া হলো। যেতে পারো।’ অর্থাৎ ছুটি নয়, কিন্তু ছুটিই আদতে। কেমন প্যারাডক্সিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার! আবার আরেক জায়গায় দেখা গেল, ছাত্রদের প্রশ্ন করলেন প্রফেসর। একজন উত্তর দিতেই- ‘বাহ, আজ প্রথমবার তোমাদের ক্লাসে কেউ প্রশ্নের উত্তর দিল।’ অথচ আধাপৃষ্ঠা আগেই প্রফেসর ছাত্রদের কাছ থেকে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে বলেছিলেন, ‘সাবাস, সঠিক উত্তর দিয়েছ!’ বড় ধরনের কোন ভুল নয়, তবুও আমার ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল এসব জায়গায়। সব মিলিয়ে, ওপার বাংলায় এমন একটা বই বেশ ভালো লাগারই কথা। কারণ, বলি-টলির ইতিহাস দেখা গেল ওখানেই বেশি আছে। পাঠক হয়তো সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে বাস্তব জীবনের সাথে। এছাড়াও জাদুমন্ত্র গোছের গল্প ওখানের পাঠকরা আজকাল বেশ পছন্দ করে, বোঝা যায়। এপার বাংলায় একটু অচেনা লাগতে পারে পটভূমি। নরবলি নিয়ে ফিকশন পড়ার আগ্রহ রয়েছে, এমন যে কেউ বইটা পড়তে পারে, নিরাশ হবে না আশা করি।
বর্তমান যুগে নরবলি একটি অত্যন্ত ঘৃণ্যতম প্রথা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও কলকাতার এক প্রাচীন রাজপরিবার বিগত প্রায় দেড়শ বছর ধরে কয়েক প্রজন্ম যাবৎ এই প্রথাকে অত্যন্ত গোপনে এবং লোকচক্ষুর আড়ালে পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু এই রাজপরিবারটি ইচ্ছাকৃতভাবে এই প্রথা পালন করছে না বরং, তাদের পূর্বপুরুষ রাজা প্রতাপ নারায়ণের অত্যন্ত ভয়াবহ ও জঘন্য অপরাধের শাস্তি স্বরূপ অভিশাপ ভোগ করতে এই প্রথা পালন করে যেতে হচ্ছে এই রাজপরিবারটির। এই অভিশাপটি এতটাই ভয়াবহ যে, যদি এই নরবলি প্রথা এই রাজবংশে চালিয়ে যাওয়া না হয় তাহলে, বংশটির ধ্বংস অনিবার্য।
ইতিহাসের অধ্যাপক রাঘব নরবলির ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি তার নতুন ব্যাচে এক নতুন ছাত্র তনুশের সাথে পরিচিত হন এবং তার ঠিক কয়েকদিন পরেই ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে তনুশের মৃত্যু ঘটে এবং তার মৃত্যু রাঘব নিজেকে দায়ী করেন। এরপর বিভিন্ন ঘটনার সূত্রে তনুশের যমজ ভাই রিশানের সাথে রাঘবের সাক্ষাৎ হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা গুরু-শিষ্যের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। তবে তাদের সম্পর্ক কিন্তু এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। রাজা প্রতাপ নারায়ণের বংশের অভিশাপ ঘোচানোর জন্যে ভাগ্য রাঘব ও রিশানকে এক করে। কিন্তু রাঘব ও রিশান জানতেও পারেনা যে এই অভিশাপের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে তারা নিজেরাই সেই ইতিহাসের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়বে, যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। রাঘব ও রিশান কি পারবে সেই ঐতিহাসিক রাজপরিবারটির অভিশাপ ঘোচাতে এবং এই ঘৃণ্য নরবলি প্রথা বন্ধ করতে? নাকি তারাও এই অভিশাপটির অন্ধকার নরকে তলিয়ে যাবে? সেটি জানতে পড়তে হবে "চন্দ্রহাস" উপন্যাসটি।
ব্যক্তিগত অভিমত: ভারতের জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক সৌরভ চক্রবর্তীর লেখা এই বইটির মাধ্যমে তার লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। বইটি আজ থেকে আরো ৫ বছর পূর্বে প্রকাশিত হলেও দুঃখজনকভাবে অনেক দেরিতে বইটি আমার হাতে এসেছে। বইটির শুরুতেই লেখক বেশ কয়েক পৃষ্ঠার দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন, যেটি অনেক পাঠকের কাছেই বইটি সম্পর্কে বেশ নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে বলে আমার কানে এসেছিল। কিন্তু এসব বিষয় উপেক্ষা করে আমি একদম শুরু থেকেই বইটি পড়া শুরু করেছিলাম। আর সত্যি বলতে এই কাজের জন্যে আমার কোনো আফসোস নেই বরং বইটি লিখতে লেখককে যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সেটি জানতে পারলাম। তাছাড়াও এই দীর্ঘ ভূমিকা পড়ে আমি ছোট ছোট কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানতে পেরেছি যেগুলো পরবর্তীতে মূল উপন্যাসে থাকা বিভিন্ন জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রেক্ষাপট সঠিকভাবে বুঝতে আমাকে সাহায্য করেছে।
"চন্দ্রহাস" উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তু নরবলি প্রথা হলেও বইটিতে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যান প্রাধান্য পেয়েছে। বইটিতে নরবলি ছাড়াও অত্যন্ত স্পর্শকাতর কিছু বিষয় যেমন প্রাচীনকাল থেকে চলে আসে জমিদার বা রাজা কর্তৃক অসহায় প্রজাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন, অবাধ যৌনাচার এবং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের নিরীহ মানুষের ওপর পাশবিক নির্যাতন প্রভৃতি বিষয়গুলো লেখক অত্যন্ত সুনিপুণতার সাথে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি প্রতিটি চরিত্র চিত্রায়নে লেখক যে দক্ষতা দেখিয়েছেন সেটি সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। এছাড়াও প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মধ্যে যে পাশবিক নরবলি/নারীবলি প্রচলিত ছিলো সেই সম্পর্কে হৃদয়স্পর্শী কিন্তু অত্যন্ত চমকপ্রদ তথ্য লেখক বইটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
বইটি পড়তে গিয়ে আমার মধ্যে ভয় ও ভালো লাগা দুটি অনুভূতিই কাজ করেছে। একদিকে প্রাচীনকালের বিভিন্ন ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারার মাধ্যমে মুগ্ধ হচ্ছিলাম, অন্যদিকে বিভৎস নরবলি/নারীবলির বর্ণনা পড়তে গিয়ে দেহ জুড়ে ভয়ের শীতল স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে উপন্যাসের কিছু কিছু জায়গায় লেখক অতিরিক্ত পরিমাণে অপ্রাকৃত দৃশ্য বর্ণনা করেছেন, যেগুলো মূল ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। তবে বানান বা শব্দের ভুলত্রুটি তেমন চোখে পড়েনি। লেখকের গল্প বলার গতি সামান্য কয়েকটা অংশ ছাড়া উপন্যাসটির বাকি অংশে স্বাভাবিকই ছিলো, লেখার ভাষাও ছিলো সহজ এবং সাবলীল।
লোভ! এই লোভই মানুষকে পরিনত করে নরপিশাচে। যুগে যুগে তাই হয়ে আসছে।
প্রফেসর রাঘব কলেজে নরবলির উপর একটি কোর্স করান। প্রতিবছরই এই সাবজেক্টে ছাত্র ছাত্রীদের আগ্রহ থাকে। তেমনই নতুন এক ব্যাচ নিয়ে তার এবছরের যাত্রা শুরু। শুরু করলেন ভারতবর্ষেরই একটি প্রাচীনতম পারিবারিক নরবলির সত্যি ঘটনা দিয়ে…!
ভারতের উপমহাদেশে বস্তার নামক এক অঞ্চলে ১৫০ বছর আগে ‘দন্তেশ্বরী’ নামক এক দেবী মূতির্র পূজা করা হতো৷ তখন সেখানে ছাগল বা অন্য পশু বলি দিয়ে পূজা করা হতো। সেই অঞ্চলের তখন রাজা ছিলেন মহারাজ প্রতাপ নারায়ণ চৌধুরী।
একদিন হঠাৎ মহারাজ প্রতাপ নারায়ণের নিকট মন্ত্র�� কুটিল বুদ্ধির অধিকারী সুভদ্র এসে জানান যে মা দন্তেশ্বরী ছাগ রক্তে আর সন্তুষ্ট নন। তাকে এবার নর রক্ত দিতে হবে। তখন মহারাজ জানান যে তিনি নরবলি দিবেন। আর তার জন্য ব্যবহার করবেন যুদ্ধবন্দিদের। সব আয়োজন সম্পন্ন করার পর মহারাজ বিশেষ ভাবে বিশেষায়িত তলোয়ার “চন্দ্রহাস” নিয়ে যূপকাষ্ঠে দেয়া একের পর এক যুদ্ধবন্দির মন্ডু আলাদা করার মাধ্যমে নরবলি দিতে লাগলেন। রক্ত বন্যা বয়ে দেন তিনি মন্দির প্রাঙ্গনে। কিন্তু হঠাৎ সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা এসে সব লন্ডভন্ড করে দেয়। এবং সেখানে খুন হন কুটিল মন্ত্রী সুভদ্র। কিন্তু পরে আর সেখানে মহারাজ বা তার তলোয়ার চন্দ্রহাস কিছুই পায়নি সৈন্যরা।
এদিকে রাঘবের ক্লাস শেষে তার সাথে দেখা করতে আসে তারই ক্লাসের এক ছাত্র। নরবলি নিয়ে বিচিত্র কিছু আলাপ হয় তার সাথে। এই ছাত্রই পরে অদ্ভুতভাবে মারা যায়। তাও রাঘবের গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে। রাঘব চেয়েছিলো সেই ছাত্রকে নিয়ে নরবলি কিছু ইতিহাস জানতে। তারজন্যই সেই ছাত্রটি আর্জেন্ট ভাবে বাড়িতে গিয়ে আবার ফিরে আসার পথে এই দূর্ঘটনায় পড়ে।
মনকষ্টে থাকা রাঘব পরে সেই ছাত্রেরই জমজ ভাইকে নিয়ে নেমে পড়ে নরবলির ইতিহাস উদঘাটনে। আর সেই কাজে নামার পর অদ্ভুতভাবে কিছু সহায়তা পান তারা।
অবশেষে তারা প্রতাপ নারায়ণের “চন্দ্রহাস মহল”এ উপস্থিত হন। সেখানেই সন্ধান করতে থাকেন চন্দ্রহাসের। তার রেষ ধরেই আরো বিদঘুটে সব তথ্য আবিষ্কার করেন তারা। জানা যায় আজ থেকে দেড়শ বছরের পুরনো এক অভিশাপের কথা। নিঃসন্তান প্রতাপ নারায়ণের সন্তান লাভের কথা৷ আর সে জন্যে কি করে মহারাজ জড়িয়ে পরেন তান্ত্রিক সাধাক ভৈরবের সাথে। জানা যায় প্রতাপ নারায়ণ আড়ালে ‘উচ্ছিষ্ঠ গণেশ’ পূজাও করতেন। কিন্তু কেন এই নোংরা উপাচার? আর সেথেকে কেনইবা দীর্ষ সময় ধরে চলে আসছে এই পারিবারিক নরবলি প্রথা!!! সব শেষ কেনইবা কলকাতার এক কলেজের প্রফেসর আর ত্রিপুরা অঞ্চলের এক ছাত্র এসবে জড়িয়ে পড়েন?
চন্দ্রহাস পড়তে পড়তে মনে হবে যেন আপনি পেঁয়াজের খোসার মতো করে একএকটা রহস্যজট খুলছেন।
★★★
শুরুতেই বলব অদ্ভুত চমৎকার একটি বই শেষ করলাম। বইটার রেষ রয়ে যাবে অনেকদিন। নরবলি নিয়ে এরকম চাঞ্চল্যকর উত্তেজনা মূলক বই আমি আগে পড়িনি। লোভ, অভিশাপ, তন্ত্রাচার, যৌনাচার, অপশাসন, সাধন-ভজনের এক জটিল সংমিশ্রণে গড়া কলকাতার লেখক ★**সৌরভ চক্রবর্তীর**★ এই “চন্দ্রহাস” বইটি।
কলকাতার ‘দ্য ক্যাফে টেবল’ থেকে প্রকাশের পর বইটি বাংলাদেশে ‘বাতিঘর প্রকাশনী’ থেকেই বের করা হয় ২০২০ বই মেলাতে৷ লেখকের অসাধারণ লেখনিতে উঠে আসে ভারতবর্ষের কলুষিত এক অধ্যায় ‘নরবলির’ খন্ডিত ইতিহাস।
(১০৩ নং পেজে লেখক একটি তথ্য দিয়েছেন, তা আদতে সঠিক নয়। হযরত ইব্রাহিম আঃ উনার পুত্র হযরত ইসমাইল আঃ কে তাঁর প্রভুর নামে বলি দেননি। আল্লাহ তালা তাঁর প্রিয় বান্দার সামায়িক পরিক্ষা নিয়েছিলেন। এবং সেখানে তিনি চমৎকার ভাবে উৎরে যান। তখন আল্লাহ তালা ইসমাইলের পরিবর্তে একটি বকরি রেখে দেন। তখন সেটাই কুরবানি হয়।)
মানুষের লোভ এবং সেই সাথে বিকৃতরূপ কোন পর্যায় যে যেতে পারে তার চমৎকার বর্ণনা আছে এই “চন্দ্রহাস” বইতে৷
লেখকের কাছে বিশেষ করে চাইবো বইটার সিকুয়েল বের করতে৷
# পাঠ_প্রতিক্রিয়া: চন্দ্রহাঁস বই লেখক: সৌরভ চক্রবর্তী কলমে: সারাহ্ তৌফিক
যুগে যুগে ইতিহাসের পরিবর্তন ঘটেছে, ঘটেছে সভ্যতারও। কিন্তু তবুও পরিবর্তন ঘটেনি কাম, ক্রোধ, ঈর্ষা কিংবা লোভের। আর এসবের বশবর্তী হয়ে যুগের পর যুগ শুধু ঘটে গেছে নানারকমের অনাচার, অত্যাচার। এসব অত্যাচার এতটাই বীভৎস এবং ভয়াবহ ছিল যে সেই পাপের কর্মফল আজও ভোগ করতে হয় পরবর্তী প্রজন্মকে। প্রচুর ঐতিহাসিক তথ্য সংবলীত বীভৎস ইতিহাস ও পারিবারিক নরবলীর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৈরী হয়েছে এই চন্দ্রহাঁস উপন্যাসটি।
#পাঠ_প্রতিক্রিয়া রাজা ভৈরো দেঁও, মহারাজ প্রতাপ নারায়ন এবং মন্ত্রী সুভদ্রাকে কেন্দ্র করেই কাহিনীর শুরু। রাজা ভৈরো দেঁও ছিলেন তৎকালীন ইংরেজ শাসনামলের আগের মধ্যপ্রদেশের বাঙ্গালী রাজা যিনি ছিলেন একইসাথে নৃশংস, অত্যাচারী এবং ম-কারের লোভী। তিনি নরবলী প্রথা চালু করেছিলেন তার রাজ্যে চন্দ্রহাঁস নামক ইতিহাসখ্যাত একটি খড়্গ দিয়ে। পরবর্তীকালে যখন ইংরেজরা নরবলীকে রদ করে তখন তিনি তার বন্ধুপুত্র প্রতাপ নারায়নের সাহায্য নিয়ে আবার সেই ঘৃনিত প্রথা চালুর চেষ্টা করেন। এবং এই নারকীয় ঘটনা ঘটাতে গিয়েই আত্মাহুতি দিতে হয় মন্ত্রী সুভদ্রাকে। তবে শুধু মন্ত্রী সুভদ্রার মৃত্যুতেই এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়না বরং সেদিন থেকেই যেন রাজা প্রতাপ নারায়নের জীবনে পাপের কর্মফল ভোগের নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায়। তবে এতেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়না। বরং এই প্রথার রেশ এবং এই পাপকার্যের ক্ষতিপূরণ দিয়ে আসতে হয় তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে পুরো দেড়শ বছর ধরে।
প্রফেসর রাঘব ছিলেন নরবলীর ইতিহাসের একজন বিশেষজ্ঞ যার প্রধান কাজ ছিল প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীদেরকে নরবলীর ইতিহাস পড়ানো এবং এর উপর রিসার্চ ওয়ার্ক করানো। কিন্তু তিনি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেননি সেই ইতিহাস তাকে একদিন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিবে। বিগত পনেরো বছর ধরে মহারাজ প্রতাপ নারায়নের সেই বীভৎস নরবলীর ইতিহাস পড়ানোর পর এবার প্রথম তিনি সেই অসমাপ্ত কাহিনীর যেন সত্যতা এবং সম্পৃক্ততা খুজে পাচ্ছিলেন তারই এক ছাত্র তনুশের মাধ্যমে। কিন্তু পূর্বজন্মের পাপের কারনেই বোধহয় পরিচয়ের পরপরই ছেলেটি একটি মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। প্রফেসর যখন ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তেই উনার সামনে এসে হাজির হয় তনুশের জমজ ভাই রিশান এবং তারপর তাদের দুজনের চলতে থাকে বইয়ের পাতা থেকে সত্যিকারের ইতিহাসকে খুঁজে বের করার ও এই ভয়াবহ অভিশপ্ত জীবন থেকে সেই অভিশাপকে পুরোপুরি অভিশাপমুক্ত করার আপ্রান চেষ্টা।
অভিশাপ খন্ডনের আশায় প্রথমে উনাদের যেতে হয়েছিল সেইখানে যেখান থেকে এবং যার হাত ধরেই এই অভিশাপের সূচনা হয়, মধ্যপ্রদেশের বস্তারে, রাজা ভৈরো দেঁওর এলাকায়। এরপর সেখানকার কাজ মিটিয়ে আবার যেতে হয় মহারাজ প্রতাপ নারায়নের এস্টেটে যেখানেই ঘটে অভিশাপ মুক্তির সেই প্রানপন লড়াই। এই অসম লড়াইয়ের সঙ্গী ছিল অনেকেই। কি ঘটেছিল সেই লড়াইয়ের ফলাফল? কে ছিল এই লড়াইয়ের নেপথ্যে? কাদের জয়লাভ ঘটেছিল? প্রফেসর রাঘব কি আদৌ পেরেছিলেন এই অভিশাপ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে? হর নারায়ন, ব্রজ নারায়ন, রাজমাতা শিবাঙ্গী, সৌদামিনী কিংবা তনুশের পরিবারের আত্মত্যাগের কোনো মূল্যই কি পরিশেষে সকলে পেয়েছিল নাকি পাপের সেই কলঙ্কের অবসান ঘটানো সম্ভব হয়নি? আর সেইযে চন্দ্রহাঁস, যাকে ঘিরে পাপের শুরু , তার শেষ পরিনতি কি হয়েছিল?
জানতে হলে পড়তে হবে পুরো বইটি। ভীষণ রকমের ইতিহাসের আলোচনা ও তার ভেতর দিয়েই কাহিনীর অবসান ঘটানো হয়েছে। আর বারবার করেই বোঝানো হয়েছে যে পাপের কোন ক্ষমা হয়না যতক্ষণ না যার সঙ্গে সেই পাপ করা হচ্ছে তারা ক্ষমা না করেন। পাপ বাপকেও ছাড়েনা বৈকি! সর্বপরি বইটি ভীষন সুন্দর এবং বেশ রোমাঞ্চকর। আমি অনলাইনে পিডিএফ থেকে পড়েছি তবে বইটি রকমারি.কম এও পাওয়া যাচ্ছে।
বুক রিভিউ চন্দ্রহাস ১ শুরুতেই বলতে হচ্ছে, শেষ হয়েও শেষ হল না। আমি জানি না বুক রিভিউ কি করে শুরু করতে হয়। কিংবা কি লিখতে হয়। কিন্তু আজ চন্দ্রহাস ১ পড়া শেষ করে এটা সম্পর্কে না লেখে পারলাম না। আমি খুবই অলস প্রকৃতির জীব। তা বলতে আমার কোন লজ্জা নেই। আর একটানা কোনো বই পড়া, না বাবা আমার পক্ষে সম্ভব না। চন্দ্রহাসের যেমন ইতিহাস, আমারও একটি ছোটো ইতিহাস আছে। আর আমার ইতিহাসে নতুন স্থান পেতে চলেছে, উপন্যাস চন্দ্রহাস। এমন খুব কম বই আছে, যা আমার মতো অলস মানুষের মনকে এক জায়গায় ধরে রাখতে পারে। পৃথিবীর বুকে অতীতে দুজন লেখক এই কাজ করতে পেরেছেন। আর বর্তমানে তাতে জুরে গেল আরও এক নতুন নাম। লেখক সৌরভ চক্রবর্তী দাদা। জানি না কোথা থেকে শুরু করব, আর কি দিয়ে শুরু করব। এতকিছু ‘চন্দ্রহাস’-এ আছে হয়তো আমি তা কোনোদিন লিখে শেষ করতে পারব না। লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের কথাই বলব, নাকি সে ইতিহাস ঘিরে তৈরি হওয়া কাহিনীর তারিফ করব। নাকি শেষ অংশে বুক কাঁপিয়ে দেওয়ার এন্ডিং নিয়ে কথা বলব। লেখক শুরু থেকেই যেভাবে নরবলির ইতিহাস সম্পর্কে তার পাঠকদের জানান দিয়ে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই; যে লেখক নিজ পাঠকদের খুব ভালোবাসেন, তাদের এক ঐতিহাসিক কাহিনীর জানান দিতে দিবা-রাত্রি এক করে কাজ করেছেন। পাঠকদের সাথে যেন কোনরূপ বেইমানি না হয় সেদিকে লেখক বিশেষ নজর রেখেছেন। লেখকের পরিশ্রম ফুঁটে উঠেছে ‘চন্দ্রহাস’ এর প্রতি পাতায় পাতায়। শুধু দেশ নয়, বিদেশের নরবলির ইতিহাস হইতে ঐশ্বরিক জ্ঞান, কি না আমাদের উপহার দিয়েছেন লেখক। আছে প্রতি পাতায় পাতায় নতুন রহস্যের গন্ধ। আছে মন্ত্র শাস্ত্রের বিশেষ বিশেষ ছোঁয়া। সাধারণ জীবন কি করে পাল্টে গেল এক অজানা ঐতিহাসিক কাহিনীর মায়া জালে; তা পড়তে গিয়ে বেশ কয়েকবার আমি গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলাম। মায়ের মহিমায় বারংবার হাড়িয়ে গিয়েছিলাম। সর্বোপরি বলতে গেলে; কাহিনীর শুরু থেকে শেষ; যাকে হয়তো শেষ বলা ঠিক হবে না, কিন্তু এটা বলা যেতেই পারে, দমদার স্টোরি, সাথে বুক কাঁপানো এন্ডিং। কাহিনী ব্যাখ্যা করে আমি অন্য পাঠকদের সাসপেন্স নষ্ট একেবারে করবো না শুধু এটাই বলব ॐ रं रक्तदंतिकाय नमः লেখককে অনেক ধন্যবাদ এইরূপ এক অসাধারণ গল্প আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। পড়া আমার কিছুদিন পূর্বেই শেষ হয়েছে, কিন্তু লেখার শুরুতে যা বললাম, আমি অলস। তাই কেমন লাগল জানান দিতে খানিক বিলম্ব হয়ে গেল। অনেক ভালোবাসা দাদা তোমায়।
এই গল্পটা আসলেই প্রাপ্তমনস্কদের জন্য এবং কঠোরভাবে দুর্বল হৃদয়ের মানুষদের জন্য নয়। রক্ত হিম করা গল্প সাথে সুদক্ষ লেখনী আপনাকে এক দুঃস্বপ্নে নিয়ে যাবে। প্রথম কিছু অধ্যায় পড়ে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে রেখে দিয়েছিলাম। পরদিন আবার শুরু করি। অবশ্য এমন না যে এ গল্পে শুধুই কাটা মুন্ডু দেখতে হবে। মনে হবে আপনি অতীতে বিচরণ করছেন।
নরবলির ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখক এই উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন। তিনি বইয়ের শুরুতে বলেছেন, কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রের উপস্থিতি এবং স্থানের উল্যেখ ব্যতীত সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। এবং সম্পূর্ণ কাহিনি সত্য ঘটনা এবং কল্পনার মিশেলে তৈরি। আমি ইতিহাস বিশেষজ্ঞ নই, হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র বা ঘটনা সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই কম। জানার আগ্রহ নিয়েই বইটা পড়া। হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র বা ভারত উপমহদেশের ঐতিহাসিক স্থান ছাড়াও সমগ্র পৃথিবীর নরবলির ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দিতে চেয়েছেন লেখক। সেখানেই এক জায়গায় মারাত্বক একটি ভুল চোখে পরে, শুধু আমার না, গুড রিডস এও অনেকেই এ নিয়ে অভিযোগ করেছেন। লেখক কি এখানে ইতিহাসকে কল্পনার সাথে বিকৃত করে ফেলেছেন জেনে নাকি ভুল কোথাও থেকে তথ্য নিয়েছেন জানিনা। যেহেতু আমার ইতিহাস নিয়ে জ্ঞান কম, হিন্দু পৌরাণিক গল্প সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানিনা, কিন্তু ধর্মে মুসলিম হওয়ায় সেমিটিক ধর্মগুলোর ইতিহাস নিয়ে মোটামুটি ভালই জানা আছে, সেখানে ওই একটি ভুল আমাকে বাধ্য করেছে এই বইয়ে উল্যেখিত কোনো ঐতিহাসিক কাহিনীকে সিরিয়াসলি না নিতে। এইজন্যেই রেটিং বেশি দিতে ইচ্ছে করেনি।
সেহেতু পরবর্তীতে আমি নিছক একটি ভৌতিক গল্পের মতোই পড়ে শেষ করেছি। এটি আসলে একটি কাল্পনিক গল্প, কিন্তু নরবলির ইতিহাস মিথ্যে নয়।
আবারো গল্পে ফিরি। (Spoiler alert)
শেষের দিকে ৪৫ বছর বয়সি প্রফেসর রাঘব কিভাবে চন্দ্রহাসের মত ভরি অস্ত্র এক হাত ভাঙ্গা অবস্থায় বাহুবলির মত ব্যাবহার করেছেন টা আমার কাছে যুক্তিতে মেলে না। করণ এই ভদ্রলোক গল্পের শুরুতে যখন ছাত্রদের নরবলির ইতিহাস পড়াচ্ছিলেন তখন বিভৎস গল্প বলতে বলতে তিনি দম হারিয়ে বসে যেতেন। সম্ভবত চন্দ্রহাসে কোনো অলৌকিক শক্তি ছিল। পুরো গল্পটাই অলৌকিক। আসলে এখানে লজিক দিয়ে কিছু বোঝা বৃথা। তবে লেখকের লেখনি অসাধারণ। ভৌতিক, অলৌকিক, লৌকিক সব ধরনের বিভৎস অনুভূতি আপনি টের পাবেন বইটা পড়ে।
This entire review has been hidden because of spoilers.
পড়ে শেষ করলাম চন্দ্রহাস বইটা। এক কথায় অসাধারন লেগেছে আমার। গল্পের প্লট, বিন্যাস আর বিষয় একে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে। প্লট দাড় করানোর জন্য লেখক খুব বেশি ফিল্ড ওয়ার্ক আর রিসার্চ করেছেন তা বইটি পড়লেই বোঝা যায়। আর সেক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই সফল বলা যায়। বইটির প্লাস পয়েন্টঃ ১/ অভিনব প্লট। এরকম বিষয় নিয়ে আগে বাংলা সাহিত্যে কোন কাজ করা হয়নি। নরবলি ও অভিশাপ নিয়ে তৈরী করা প্লটই এই বইয়ের মূল আকর্ষন। ২/ প্রচুর পরিমান তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে। যা প্রাচীন নরবলির ইতিহাস জানতে খুব সাহায্য করবে। ৩/ সহজ, সরল ও সাবলীল ভাষা বইটিকে আরও বেশি গ্রহনযোগ্য করে তুলেছে। যার জন্য পাতার পর পাতা পড়ে যেতে কোন অসুবিধা হবে না। ৪/ বইটির কাহিনীবিন্যাসও অসাধারন। মূল গল্পটি একবারে না বলে আস্তে আস্তে বলেছেন। যাতে গল্পের গভীরে প্রবেশ করতে কোন সমস্যায় না পড়তেও হয়। ৫/ হিন্দু কালচার, দেব- দেবী এবং নরবলির সমাহারে লেখক এক অদ্ভুত গল্প বলে গিয়েছেন। পড়তে পড়তে নরবলি প্রথার উপর কিছুটা হলেও পাঠকদের ঘৃনা জন্মাবে।
বইটির মাইনাস পয়েন্টঃ ১/ ক্যারেক্টার বিল্ডআপে কোন সময় দেওয়া হয়নি। যার জন্য কাহিনীটা অনেকাংশেই ফিকে হয়ে এসেছে। ২/ কাহিনীটা পুরোপুরি একমাত্রিক। তেমন সাবপ্লট না থাকায় ভালো করে জমেনি ব্যাপারটা। ৩/ মোটা দাগে ফিকশন লিখতে যেয়ে লেখক বইটাকে অতি বেশি অলৌকিক করে ফেলেছেন যা এই বইয়ের সবচেয়ে নেগেটিভ দিক। ৪/ ক্লাইম্যাক্সে কিছু একশনের বর্ননা কিছুটা চোখে লেগেছে। ৫/ পরিশেষে টুইস্ট রাখতে যেয়ে পুরো ব্যাপারটাকেই ঘোলাটে করে ফেলেছেন লেখক। অতি অলৌকিকতার জেরে ক্লাইম্যাক্সে কাহিনীর আবহ পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। ৬/কাহিনীর শেষাংশ অতি তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে। ফিনিশিং প্রচন্ড দুর্বল। ভালো করে কিছু বোঝাই যায় নি। ফিনিশিংটা আরও ভালো হতে পারতো বলে আমার বিশ্বাস। বইটার সিক্যুয়েল আসবে হয়ত। সেজন্য লেখক কাহিনীর সব সুতো আলগা করে দেখাননি। শুধুমাত্র সিক্যুয়েলের আভাস দেওয়ার জন্য এমন ফিনিশিং পুরো কাহিনীটাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পরিশেষে ��টাই বলব ভালো মন্দ মিলিয়েই এই বই। লেখকের পরিশ্রমের মূল্য দিতে হলেও বইটা পড়ুন।আশা করি ভালো লাগবে। তাহলে আর দেরি কেন, এখনই বসে যান.. প্রফেসর রাঘব আর রিশানের সাথে এক রোমাঞ্চকর যাত্রার অভিযাত্রী হন আপনিও। হ্যাপি রিডিং....!!!!
Book Review: চন্দ্রহাস Publisher: thecafetable Price: Rs300
চন্দ্রহাস বইটি এখুনি পড়া শেষ করলাম। কাল রাত ৮টা থেকে বইটা ছাড়া কিছুই দেখিনি চোখে।
প্রথমেই বলি বই টা পেলাম কি করে। আমি কলকাতা থেকে ২০০০ মাইল দূরে থাকি। এই লকডাউন এর মধ্যে যে বই টা পড়তে পারলাম, তার জন্য ধন্যবাদ জানাই Avishek Aich কে যিনি কষ্ট করে সুদূর ব্যান্ডেল থেকে বই পাড়ায় এসে বইটি Dey's হাতে তুলে দেন। এবং Dey's আমাকে খুব যত্ন করে প্যাক করে বইটি পাঠায়।
এবার বই টির কথায় আসি। ইংরিজি সাহিত্যে অনেকদিন ধরেই ফ্যান্টাসি এবং মাইথলজি মিশিয়ে গল্প লেখা হচ্ছিল। Lord of the Rings তার সর্বশ্রেষ্ট প্রমাণ। বাংলায় এরকম লেখা খুব মিস করতাম। সৌরভ চক্রবর্তী এরকমই একটি দুঃসাহসিক কাজ করলেন। তিনি ডার্ক ফ্যান্টাসি, মাইথলজির সঙ্গে মিশ্রণ করলেন পুনর্জন্ম, তান্ত্রিক কালচার আর shape shifting. Shape shifting নিয়ে কিছু কথা বলি। যারা Harry Potter পড়েছেন, তাদের আর নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু এই জিনিসটা কিন্তু আমাদের পূরণে অনেক আগে থেকেই আছে। পূতনা রাক্ষসীর চেহারা পরিবর্তন বা রাবণের সাধুর বেশ ধরা নিশ্চয় ভুলিনি আমরা। এবার সেটাকে মডার্ন প্রেক্ষাপটে ফেলে ডার্ক ফ্যান্টাসি মিশিয়ে তাতে তন্ত্রের ফোরণ দিয়ে তৈরি হলো চন্দ্র হাস। Ashwin Sangvi র মতন ব্যাকগ্রাউন্ড রিসার্চ বা Amish Tripathi র ম্যথলজি কালচার এখানে পুরো মাত্রায় আছে। বেশ কিছু জায়গায় চন্ডী পাঠের মন্ত্র বা শিব মত্রও পাই আমরা। সঙ্গে আছে thecafetable র অসাধারণ ফর্মা আর অনিকেত মিত্রর অঙ্কন। এক কথায় অনবদ্য একটি রচনা।
এবং শেষে একটি টুইস্ট ও আছে। অনেক টা ওই "শেষ হলেও হইলো শেষ" গোছের। লেখকের বোধ হয় দ্বিতীয় পার্ট লেখার ইচ্ছে আছে। অপেক্ষায় রইলাম।
আশানুরূপ ভাবে ঠিক জমলো না ব্যাপারটা! মেনে নিচ্ছি, লেখকের প্রথম প্রয়াস এবং নরবলি নিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম ফিকশান। সে হিসেবে লেখককে অভিবাদন। অসংখ্য ধন্যবাদ একটি কারনে। লেখক যে পরিমাণ রিসার্চ করেছেন তা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখছি। সেটা অনেক প্রশংসনীয়। নরবলির ইতিহাস সাহস করে কলমে তুলে আনার প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে দারুণ ছিলো। স্টোরিটেলিং ছিলো এভারজ। প্লট বিল্ডাপ এবং ক্যারেক্টার বিল্ডাপ- দুই ক্ষেত্রেই ক্লাসিকাল কোনো বিল্ডাপ নেই। পুরো গল্প বর্ণিত হলো ছোটো বেলায় যে শুনতাম, 'এক ছিলো রাজা, এক ছিলো রানী... অমুক তমুক ঘটলো, গল্প শেষ। অনেকটা এরকম। এক কথায় 'প্রাপ্ত বয়স্ক ঠাকুরমার ঝুলি।' নজরে পড়েছে বেশ অনেকগুলা প্লট-ল্যুপহোল।
আগেই বলেছি প্রশংসনীয় দিক হচ্ছে লেখকের রিসার্চ এবং বাস্তব থেকে তুলে নিয়ে আসা বিভিন্ন খন্ড খন্ড ঐতিহাসিক নরবলির বিবরণগুলো। এছাড়াও সাসপেন্স, অকাল্ট থ্রিলার হিসেবে আদিভৌতিক পরিবেশনা ভালো লাগলো। লেখক রিসার্চে যে হাই লেভেলের যত্ন এবং পরিশ্রম দিয়েছেন, সেটা যদি প্লট এবং ক্যারেক্টার বিল্ডাপে দিতেন তবে এটি 'প্রাপ্তবয়স্ক ঠাকুরমার ঝুলি' না হয়ে মাস্টারপীস ক্লাসিকাল অকাল্ট থ্রিলার হতে পারতো।
ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় এবং তথ্য জানতে পেরেছি। গল্পটা শেষ হয়েও হয়নি শেষ-,আমার এরকম ই মনে হলো। যে অভিষ্ট লক্ষ্যের জন্য দ্বি-পাক্ষিক যুদ্ধ হলো তা শেষমেষ কোনো সমাধান হয়নি (হয়েও হয়নি?!)। সম্ভবত সিকুয়াল আসছে। অকাল্ট থ্রিলার, নরবলি ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহ থাকায় অপেক্ষায় রইলাম। এও আশায় থাকলাম সিকুয়াল করলে লেখক এবার সেইসমস্ত বিষয়ে তাঁর সৃজনশীল মনোযোগ বিনিয়োক করবেন। লেখকের জন্য শুভ কামনা।