ক্রাইমিয়ার যুদ্ধে ওয়াল্টার, কলকাতায় বোমা পড়ার সময়কার রসিক, নকশালের সময়ের রেয়াংশ বা এখনকার সিয়ােনা আর বিরাজ, এরা সবাই কোথায় যেন এক। কোথায় যেন একে অপরের সঙ্গে বিনি সুতোয় গাঁথা। গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এমন নানান গল্পকে তুলে ধরে 'সেফটিপিন'। গল্প শুরু হয় একশাে চৌষট্টি বছর আগে ক্রাইমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে। এক বড় অফিসারকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল ওয়াল্টার আর তার পুরস্কারস্বরূপ সে পেয়েছিল সােনার ওপর দামি পাথর বসানাে এক সেফটিপিন। তারপর দশক শতক ধরে সেই সেফটিপিন ছুইঁয়ে গিয়েছে কখনও মেরি আর রসিককে, কখনও সাহিমা আর রেয়াংশকে। আবার তা কখনও দেখিয়েছে হুলো, স্যাম টুকাইকে। আর সবশেষে তা আবার জেগে উঠেছে সিয়ােনা-বিরাজের গল্পে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার প্রাক্-স্বাধীনতার কলকাতা, নকশালের কলকাতা থেকে এখনকার কলকাতায় ঘুরেছে গল্প। বলেছে বিশ্বাসের কথা, বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কে কথা বলেছে, রাজনীতির আবহে টালমাটাল যুবক যুবতীদের কথা। আর সর্বোপরি সে বলেছে ভালবাসার কথা। মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের মন গেঁথে রাখার কথা। এমন করেই বিরাট এক সময়কালকে ভালবাসায় বেদনায় গেথে রেখেছে 'সেফটিপিন'।
স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯ জুন ১৯৭৬, কলকাতায়। বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। পৈতৃক ব্যবসায় যুক্ত। প্রথম ছোটগল্প ‘উনিশ কুড়ি’-র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত। প্রথম ধারাবাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত। শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার ২০১৪, এবিপি এবেলা অজেয় সম্মান ২০১৭, বর্ষালিপি সম্মান ২০১৮, এবিপি আনন্দ সেরা বাঙালি (সাহিত্য) ২০১৯, সানডে টাইমস লিটেরারি অ্যাওয়ার্ড ২০২২, সেন্ট জেভিয়ার্স দশভুজা বাঙালি ২০২৩, কবি কৃত্তিবাস সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩, উৎসব পুরস্কার ২০২৪, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড ২০২৪, আনন্দ পুরস্কার (উপন্যাস: '‘শূন্য পথের মল্লিকা') ২০২৫ ইত্যাদি পুরস্কারে সম্মানিত ।
শুরু দিয়ে অতটা ভালো লাগছিল না। কিন্তু শেষ হতে হতে স্মরণজিৎ বাবুর ম্যাজিক কাজ করে গেল। পরম মমতায় যেন ভালোবাসা হাত বুলিয়ে গেল। আর লেখকের ভাষার কারুকার্যতা এত সুন্দর যে পড়তে অনেক ভাল লাগে।
সমান্তরালে চলছে , তিনটে গল্পঃ যার সমাপ্তি ভিন্ন একে অপরের থেকে। কোথাও ধরা পড়েছে এক পার্শ্ব প্রেমের বিলাপ আবার কোথাও সমাজের খাতিরে হারিয়ে যাওয়া প্রেমের গল্প । মানুষের শেষের কথা ভাবে , ভাবে না বর্তমানের কথা যার জন্য কত কিছু হারিয়ে যায় , কিন্তু কিছু ঘটনা আটকে থেকে যায় সেফিটিপিনের মতো জামার এক কোনাই। বাস্তবে চারটি গল্প রয়েছে এর মধ্যে ।
একশো ছেষট্টি বছর আগের একটা ঘটনা , সেইসময় এর একটা ছোট্ট উপহার কিভাবে চার জোড়া জীবনের গল্পকে একে অপরের সাথে জুড়ে রেখেছে তা নিয়েই এই অসাধারণ উপন্যাস।মন থেকে কাউকে ভালোবাসলে তা প্রকাশ করার প্রয়োজন হয়না, দূরে থেকেও অসম্ভব ভালোবাসা যায়, এই দুটো বিশ্বাসটাই কেমন যেন পুরো উপন্যাসে ছড়িয়ে আছে। এক সেফটিপিন কীভাবে এক অদৃশ্য সুতোয় একে অপরকে গেঁথে রেখেছে তা এই উপন্যাস না পড়লে উপলব্ধি করা যাবে না। কুটু, বিরাজ, ওয়াল্টার , পুটু, লক্কা,হুলো , রসিক , মেরি, সাইমা , অপা , রোয়াংসুর গল্প থেকে এখনও যেন বেরিয়ে আসতে পারিনি । এক অদ্ভুত মায়ায় যেন বাঁধা পড়েছি আমি । ঠিক যে মায়ায় সবার সাথে সবাইকে জুড়ে রেখেছিল সোনার সেই সেফটিপিন।
এই উপন্যাসের হাত ধরেই স্মরণজিৎ চক্রবর্তী'র লেখার সাথে পরিচয়। উচ্চমাধ্যমিকের পর প্রথমবার পড়েছিলাম এতোটাই ভালো লেগেছিল যে দু'সপ্তাহের মধ্যে বোতামঘর, দোয়েল সাঁকো , ছাতিম, পাতাঝরার মরশুমে, কম্পাস, ফানুশ, বৃত্ত.. পড়ে ফেলেছিলাম। মনের মধ্যে একটা অন্যরকম জায়গা করে নিয়েছেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী।
✍️ রোমান্টিক গল্প, উপন্যাস থেকে আমি সাধারণত শতহস্ত দূরত্ব রেখে চলি, কিন্তু যার এত নাম শুনেছি সেই স্মরণজিতের একটাও বই না পড়ে যুগচ্যূতও হতে চায়নি। তাই বইমেলাতে বেশ পাতলা মতন দেখে এই বইটি কিনে ফেলি। আমার ধারণা কি বলার আগে এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া ভালো। . ✍️ । তিনটি প্রজন্মের ভালোবাসা না পাওয়ার দুঃখ ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ওয়াল্টার, কলকাতায় বোমা পড়ার সময় রসিক, নকশালের সময়কার রেয়াংশ বা এখনকার সিয়োনা আর বিরাজ, এরা সবাই গ্রথিত হয়েছে একই সুতোয়। গল্প শুরু হয় একশো চৌষট্টি বছর আগে ক্রিমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে । হিরে খচিত সেফটিপিন পায় ওয়াল্টার, তার উর্দ্ধতন অফিসারের প্রাণ বাঁচানোর পুরস্কার হিসেবে। যা সে উপহার দেয় তার ভালোবাসার মানুষ ভার্জিনিয়াকে , কিন্তু সে দেরি করে ফেলেছে অনেকটা। তার পরে দশক শতক ধরে সেই সেফটিপিন ছুঁয়ে গেছে কখনো মেরি আর রসিককে, কখনো সাহিমা আর রেয়াংশকে। আর সবশেষে তা আবার জেগে উঠেছে সিয়োনা - বিরাজের গল্পে। . ✍️ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার প্রাকস্বাধীনতার কলকাতা, নকশালের কলকাতা থেকে এখনকার কলকাতায় ঘুরেছে গল্প, বলেছে বিশ্বাসের কথা, বাবা মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কের কথা, বলেছে রাজনীতির আবহে টালমাটাল যুবক-যুবতীর কথা, আর সর্বোপরি সে বলেছে ভালোবাসার কথা। . ✍️ । গল্পের পরিবেশ বড়ই মনোরম, বসন্ত-হেমন্ত, প্রেম - বিরহ এমন করে এগিয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ব্যাপারটা একটু আধটু অবাস্তব লাগলেও গল্পের সাবলীল ভাষা আর ফুরফুরে মন ভালো করে দেয়া কিছু লেখা তা ভুলিয়ে দেবে। নব্বইয়ের দশকের বাংলা সিনেমায় যেমন গোটা পরিবার শেষে একত্র হয়ে হাসি-তামাশার মাধ্যমে হ্যাপি এন্ডিং হয়, ' সমাপ্ত 'লেখাটা ছোট থেকে বড় হয়ে রং বদলাতে থাকে, একদম এমনই অনুভূতি হয় এই গল্প পড়ে। পড়তে একেবারেই মন্দ লাগে না , কিন্তু অতিনাটকীয়তা আর ন্যাকামিতে ভরপুর । তাই এই বইটির জন্য স্মরণজিতকে 'গ' বই কিছু দেয়া যায় না।
"........আমাদের এ জীবন শুধু জীবৎকালে সীমিত থাকবে না।অনেক ভালোবাসায় আর বেদনায় আমাদের আয়ু অতিক্রম করেও অন্য অনেকের মধ্যে আমরা বেঁচে থাকবো ঠিক।বেঁচে থাকবো সমস্ত যুদ্ধ ও মহামারী পার করে। মৃত্যু ও বিচ্ছেদ পার করে।বেঁচে থাকবো জীবনের এক আশ্চর্য আনন্দে।"
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ওয়াল্টার-ভার্জিনিয়া,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার রসিক-মেরি,নকশালের সময়কার রেয়াংশ-সাহিমা, এখনকার বিরাজ-সিয়েনা......এমন একেকটা সময়ের এক একজন মানুষকে, একেকটা জীবনকে আরেকজন মানুষ,আরেকটা জীবনের সাথে জুড়ে রেখেছে "সেফটিপিন"
✨আমাদের বর্তমান জীবন, আমাদের পূর্বপুরুষ কিংবা তাদের পূর্বপুরুষদের যদি বংশের বা রক্তের সম্পর্ক ব্যতীত এক সূত্রে বাঁধতে বলেই আপনারা বাঁধবেন কি দিয়ে? উত্তর একটি "সেফটিপিন"।ব্যাপারটা খোলসা হলো না তাই না? আসলে এই উপন্যাসের পটভূমি যাই থাকুক, সবার কেন্দ্রে রয়েছে একটি "সেফটিপিন"।
🔸উপন���যাসে যা ভালো লাগলো» ১.আমার এই উপন্যাসের সবটুকুই যেন পছন্দ হয়েছে। ২.উপন্যাসে রয়েছে অনেকগুলি চরিত্র, অনেকগুলি দৃশ্যপট,অনেক আলাদা ভাবনা।এগুলো পরপর চলতে থাকে, প্রথমদিকে বুঝতে অসুবিধা হতে পারে।কিন্তু পরে যেন মনে হবে,আরো কয়েকটা চরিত্রে আগমন ঘটলেও মন্দ হতো না। ৩.স্মরণজিৎ কে এমনি এমনি ম্যাজিশিয়ান বলা হয় না। তাঁকে ভালো লাগে তাঁর চেহারায় নয়,তাঁর লেখার ব্যক্তিত্বে, সৃজনশৈলীতে। ৪.ক্রাইমিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতা,নকশাল আন্দোলন,দাম্পত্য জীবনের শোক,বিরাগভাজন, ভালোবাসার ফুলের প্রস্ফুটন সব মিলিয়ে ককটেলের উপস্থাপনা করে এই উপন্যাস।
🍃 আমার তো পড়ে খুবই ভালো লাগলো। যারা এখনো ❝সেফটিপিন❞পড়েননি, তারা ঝটপট পড়ে ফেলুন।
উনবিংশ শতাব্দির ইউরোপের ক্রাইমিয়ান যুদ্ধের ওয়াল্টার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালের সময়ের রসিক, নকশাল আন্দোলনের উত্তাল কলকাতার রেয়াংশু ও এই যুগের সিয়োনা- সকলকে গেঁথে রাখে হিরে বসানো সোনার এক সেফটিপিন। এই গল্পে সোনার সেফটিপিন ছাড়াও আরেকটি অভিনব জিনিস হচ্ছে এই যে তিনটি যুদ্ধ বা আন্দোলনের সময়ে মানুষের মনের ভয় ভীতি, উৎকণ্ঠা, তাদের লড়াই এসব কিছুটা হলেও ছুঁয়ে গেছে কাহিনীর চরিত্রদের। একটি ছোট উপন্যাসে আমরা মোটামুটি তিনটি সময়ের একটা ছবি দেখতে পারি।
স্মরণজিৎ বাবুর গল্পে কিছু চরিত্র থাকে যারা খুব বোকা বোকা কিছু কাজ করে ফেলে। এখানেই তেমন ছিল। কিন্তু এরকম কাজ করা যে কোন কাজের কথা নয় এটাও গল্পে অন্য চরিত্রদের মুখে বলা হয়েছে।
তবে কিছু ব্যাপার ইমম্যাচিওরড লাগলেও এই ‘গল্পের ভেতর গল্প, তার ভেতরেও গল্প’ কন্সেপ্টটা দারুণ। আবার আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম যে এভাবে কয়েকটা প্রজন্ম একসাথে দেখাতে গিয়েও গল্পটা পড়ার সময় কিন্তু কোথাও কোন কনফিউশন হয়নি। পুরো গল্পটা খুব পরিষ্কার ভাবে লেখা হয়েছে।
প্রথমেই বলে রাখি আমি স্মরণজিৎ চক্রবর্তী লেখার ভীষণ বড়ো ভক্ত, তাই আপনাদের কারোর কারোর কাছে এই review অনেকটাই biased বলে মনে হতে পারে তাই সেরম মনে হলে আপনারা এড়িয়ে যেতে পারেন।
গল্পের কথায় আশা যাক, এত্ত সুন্দর চলিত অথচ কাব্যের কথায় মনের ভাষা উনি যেভাবে প্রকাশ করতে পারেন খুব কম লেখক লেখিকার মধ্যে সেই প্রতিভাটি দেখতে পাওয়া যায়। আর গল্পের প্রত্যেকটি চরিত্র যেন প্রচন্ড রকম ভাবে জীবন্ত, আর তাদের প্রেম আর কাহিনী জুগজুগান্তর ধরে, ধরে রেখেছে একখানি সেফটিপিন। Teenage love story হিসেবে আপনাদের এই বইটি পড়তে ভালই লাগবে।
কিছু কিছু উপন্যাস থাকে সেগুলিকে পড়ার পরে সেগুলির সম্পর্কে বলার মতন কোন ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না এটি তেমনি একটু উপন্যাস। উপন্যাসটির সঙ্গে পরিচয় আমার বহুবছর আগে তখন আমি ইনস্টাগ্রামে সেভাবে একটিভ থাকতাম না, কাল হঠাৎ করেই বইটি চোখে পড়ে আমার, তাই আজকে বইটির রিভিউ দেওয়ার চেষ্টা করলাম, আমার একান্তভাবে মনে হয় স্মরণজিৎবাবুর এই বইটি খুবই আন্ডার রেটেড, এমন অনেক মানুষ আছেন যার বইটি সম্পর্কে জানেনি না, তবে আমার রিভিউ যদি ভালো লেগে থাকে একবার বইটা পড়ে দেখবেন।
সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকে ভালবাসা, তার আখ্যান বোনার এক প্রচেষ্টা। লেখক কোথাও গিয়ে বারেবারে গুরুত্ব দিয়েছেন বহিরাঙ্গের সৌন্দর্যকে, যা কিনা অন্তরের সৌন্দর্যকেও ছাপিয়ে গেছে কখনোসখনো, যা দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। উপভোগ্য ভাষায় লেখা, একটানা পড়ে ফেলার পক্ষে উপযুক্ত বই।