সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, তাদের জীবনযাত্রা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদাগুলাে মিটাবার জন্য চীন সরকার বিপ্লবের পর কীভাবে উন্নতি করেছে এবং পরিবর্তন এনেছে মানুষের আচরণে তাও জানা যায়। তিনি শুধু সম্মেলনেই অংশগ্রহণ করেন নাই তিনি এই দেশকে খুব গভীরভাবে দেখেছেন। কৃষকের বাড়ি, শ্রমিকের বাড়ি, তাদের কর্মসংস্থান, জীবনমান সবই তিনি দেখেছেন। ছােট ছােট শিশু ও ছাত্রছাত্রীদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। শিশু বয়স থেকেই দেশপ্রেম ও কর্তব্যবােধ জাগ্রত করার যে প্রচেষ্টা ও কর্মপন্থা তাও অবলােকন করেছেন । তিনি মুক্তমন নিয়ে যেমন ভ্রমণ করেছেন আবার তীক্ষ দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রতিটি বিষয় গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন।
Sheikh Mujibur Rahman (Bengali: শেখ মুজিবুর রহমান Shekh Mujibur Rôhman), (March 17, 1920 – August 15, 1975) was a Bengali politician and statesman who was the founding leader of the People's Republic of Bangladesh. He headed the Awami League and served as the first President of Bangladesh, and later as Prime Minister. He is popularly referred to as Sheikh Mujib (shortened as Mujib or Mujibur, not Rahman), with the honorary title of Bangabandhu (বঙ্গবন্ধু Bôngobondhu, "Friend of Bengal"), and widely revered in Bangladesh as the founding father of the nation. He was assassinated by a group of junior army officers on August 15, 1975, along with most of his family, while acting as President of Bangladesh.
বই - আমার দেখা নয়াচীন লেখক - শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশনী - বাংলা একাডেমি প্রচ্ছদ মূল্য - ৪০০৳ পৃষ্ঠা সংখ্যা - ১৯৯ প্রথম প্রকাশ - ১লা ফেব্রুয়ারি ২০২০
১৯৫২ সালে চীনের পিকিং এ অনুষ্ঠিত এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে। তাঁর এই চীন ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য এই শান্তি সম্মেলন হলেও, এর পাশাপাশি তিনি সে দেশের মানুষের জীবনের সামগ্রিক অবস্থা উপলব্ধি করার জন্য আরও বাড়তি কিছুদিন চীনে থেকে গেছেন। সেই সর্বমোট ২৫ দিনের স্মৃতি নিয়ে রচনা করেছেন এই ভ্রমণকাহিনী।
বঙ্গবন্ধুকে সফর করতে হয়েছে রেঙ্গুন, হংকং, পিকিং, তিয়ানজিং, সাংহাই - প্রভৃতি শহরের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৯ এর ১লা অক্টোবর চীনে কম্যুনিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর, তাদের শাসন সম্পর্কে যে সব নেতিবাচক কথাবার্তা কানে এসেছিলো, সেগুলোই যাচাই করে দেখতে চেয়েছেন তিনি।
প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর শান্তি সম্মেলনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা যাক। মোট ৩৭ দেশের প্রতিনিধির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সম্মেলনটি একটি কম্যুনিস্ট দেশে হলেও, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নন-কম্যুনিস্ট ঘরনার মানুষই ছিলেন বেশি। তবুও শান্তি সম্মেলন শেষ হয়েছে শান্তিপূর্ণ ভাবেই, কারণ সবার মূল কথা এক - সবাই শান্তি চায়, কেউ যুদ্ধ চায় না।
বঙ্গবন্ধু দেখতে চেয়েছেন মানুষের জীবনযাত্রার মান কেমন, জিনিসপত্রের দাম কেমন, কৃষক-শ্রমিক - সাধারণ মানুষ কিভাবে থাকছে, শিক্ষা-কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য কেমন চালাচ্ছে দেশের নতুন প্রশাসন, ধর্মীয় ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক আরোপিত কোনো বিধিনিষেধ রয়েছে কিনা - ইত্যাদি। আর এজন্য তিনি চীনের স্থানীয় বাজার, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, মুদিদোকান, কলকারখানা, কৃষক-শ্রমিকের বাসস্থান - সবখানেই ঢু মেরেছেন এবং সাধারণ মানুষের সাথে মিশে সরকার সম্পর্কে তাদের মনোভাব জানার চেষ্টা করেছেন। চীনের তৎকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার বর্ণনার সাথে সাথে দিয়েছেন পাকিস্তানের তৎকালীন অবস্থার তুলনামূলক বর্ণনা।
তৎকালীন চীন এবং পাকিস্তানের সরকারি সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন বেতনের একটা তুলনামূলক বর্ণনা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। "৬০ কোটি লোকের বিরাট দেশের প্রধান কর্মকর্তা মাও সে তুং আমাদের টাকার ৫০০শত টাকা মাসে গ্রহণ করে থাকেন। নিচে ৫০ আর উপরে ৫০০ টাকার বেশি কেউ গ্রহণ করতে পারে না, আর যাতে ৫০ টাকায় সংসার চলে তার বন্দোবস্ত সরকার করে থাকেন।……………………………………আমাদের দেশের সকলের চেয়ে বড় রাষ্ট্রপতি বেতন পান মাসে ১২০০০টাকা। আর সকলের ছোট কর্মচারী বেতন পায় ২০/২৫টাকা।……………………এর মধ্যে আবার জিনিসপত্রের দামের স্থিরতা নাই।"
বঙ্গবন্ধু বার বার লক্ষ্য করেছেন চীনের সাধারণ জনগন থেকে সর্বোচ্চ নেতা পর্যন্ত - সবার মধ্যেকার দেশপ্রেমের তীব্রতা। অনেক ভালো ইংরেজি জানা সত্ত্বেও সেখানকার নেতারা কেউ বিদেশিদের সাথে কথা বলার সময় ইংরেজি বলেন না, নিজের মাতৃভাষায় কথা বলে দোভাষীর মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করেন।দোভাষী ভুল করলে বরং তাদের শুধরে দিতে দেখা গেছে কয়েকবার। আরেকটা বিষয় হচ্ছে চীনাদের জাতীয়তাবোধ; দেখা গেছে যেসব পণ্য তারা নিজের উৎপাদন করতে পারে না, সেসব তারা ব্যবহারও করে না।
কিভাবে চীনের কৃষকরা ৩বছরে সাবলম্বী হয়ে উঠলো, ঘুষ-দুর্নীতি, ডাকাতি কিভাবে দূর হলো, কিভাবে চীনাদের আফিমের নেশা কাটলো, ভিক্ষাবৃত্তি নির্মুল হলো কিভাবে, কিভাবে পতিতারা ফিরে এলো সমাজের মূল ধারায়, নারী-পুরুষে আসলো সমতা, হোয়াংহো কিভাবে হয়ে উঠলো চীনের দুঃখ থেকে আশীর্বাদ - সব উঠে এসেছে বিস্তারিতভাবে।
সবশেষে যেটা না বললেই না, পুরো লেখনীতে চীনের নতুন সরকার তথা কম্যুনিস্ট সরকারের প্রশংসা করলেও, কম্যুনিস্টরা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মত প্রকাশের রাস্তা রুদ্ধ করে দেয়ার বিষয়টা বঙ্গবন্ধু পছন্দ করেননি। তবে চীন যে খুব দ্রুতই বিশ্বের একটা পরাশক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে তিনি তা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, আজ আমরা তারই বাস্তব রূপ দেখতে পাচ্ছি।
মূল রচনা মোটামুটি ১০৭ পৃষ্ঠা। আমি খুবই অবাক হয়েছি এটা দেখে যে, ১৯৫২ সালের এই ভ্রমণের কাহিনী তিনি লিখেছেন ২বছর পর ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দী থাকা কালে, তাও মাত্র আড়াই পৃষ্ঠার খাতার নোটকে পুঁজি করে! কতটা প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী হলে একজন মানুষের পক্ষে ২বছর পরও সব ঘটনা এত বিস্তারিতভাবে মনে রাখা সম্ভব!
এই বইয়ের শেষে বঙ্গবন্ধুর জীবণী এবং চীন ভ্রমণের বিভিন্ন সময়ের ছবিগুলোর সংযোজন বইটিকে করেছে আরও বেশি সমৃদ্ধ। আর টীকার সংযোজনী পাঠকের জন্য খুবই উপকারী হবে।একজন পেশাদার লেখক না হয়েও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব কিছু এতটাই সবলীল এবং প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন যে, মনে হচ্ছে সব যেনো নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ রসিকতা করেছেন তাঁ্র সফরসঙ্গীদের সাথে। খুব সাধারণভাবে মিশেছেন চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী আর স্কুলের বাচ্চাদের সাথেও। ঘটনার বর্ণনায় দেখা গেছে, চীনের এক সেলুন থেকে চুল কেটেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেই নাপিত বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফ নিয়ে রেখেছে, তিনি বার বার নিজেকে কোনো বড় নেতা নন - বলা সত্ত্বেও! তাঁর অটোগ্রাফ রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর সেই দল, যাদের সাথে তিনি নিজের নৌকার বৈঠা বেয়ে ঘুরেছেন কিছুক্ষণ। আর তাঁর নিজের হাতের আংটি উপহার পেয়েছে, চীনের এক সদ্য বিবাহিত শ্রমিক দম্পতি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো - যে সাধারণ বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফ আর উপহার পেয়েছিলো এরা, সেই বঙ্গবন্ধু যখন সাধারণের উর্ধ্বে উঠে গেলেন, হয়ে গেলেন বাঙালি অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক! - এই খবর যখন সেই নাপিত/ছাত্র-ছাত্রী/শ্রমিক দম্পতি জানতে পেরেছিলো, তাদের ঠিক কি অনুভূতি হয়েছিলো? কারণ সেই নাপিত কে তিনি নিজের পরিচয় হিসেবে বলেছিলেন - "এমনি ঘুরে বেড়াই, দেশ বিদেশ দেখি।" আর মনে মনে ভাবছিলেন - "আমার আবার পরিচয়? পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বক্তৃতা করে বেড়াই। আর মাঝে মাঝে সরকারের দয়ায় জেলখানায় পড়ে খোদা ও রসুলের নাম নেবার সুযোগ পাই। এই তো আমার পরিচয়।"
বাহান্ন সালের অক্টোবরে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে বিপ্লবোত্তর গণচীনে পাকিস্তানের একটি প্রতিনিধিদল যায়। মানকির পির সাহেবের নেতৃত্বে তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবসহ আতাউর রহমান খান, মানিক মিয়া প্রমুখ অংশ নিয়েছিলেন। নতুন চীনকে যেমন দেখেছেন তা নিয়েই 'আমার দেখা নয়াচীন'। ২০২০ সালে মেলায় কেনা এবং তখনই বইটা পড়া হয়ে গিয়েছিল। এরপর দুনিয়ায় কামিয়াবি হাসিলের বাসনায় পরবর্তীতে একাধিকবার পড়া হলেও পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখা হয়ে ওঠেনি।
'ইসলামি রাষ্ট্র' পাকিস্তান কমিউনিস্ট জুজুর ভয়ে কাতর এবং দেশটির দক্ষিণপন্থি রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশ চীনকে তখন সন্দেহের চোখে দেখতো। কারণ সবার চোখে পরা পশ্চিমা লেন্সের চশমা। শান্তি সম্মেলনের প্রতিনিধিদলের সদস্য তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। তাই তিনি চীনকে প্রথমেই মুগ্ধ নয়নে দেখেননি। বরং কৌতূহ�� মনের সাথে যুক্ত হয়েছিল সত্যিকারের চীনের স্বরূপ সন্ধানের চেষ্টা।
শেখ মুজিবুর রহমান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখেছেন। পরিচয় দিয়েছেন প্রখর পর্যবেক্ষণ শক্তির। চীনে তখন জাতীয়তাবাদের সোনালি জমানা। বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতা গণচীনের জনগণের দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং বিদেশি পণ্যের বদলে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারে সচেতনতা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন৷
কমিউনিজম নিয়ে যেসব প্রচারণা চলে তার অসারতার প্রমাণ পেয়ে নিজেই অবাক হয়েছেন। পশ্চিমা প্রচারশক্তির মহিমা তখন প্রবল এবং এখন প্রবলতর।
আজকে আমরা স্বাধীন কাশ্মিরের পক্ষে নেই। অথচ শেখ মুজিবুর রহমান একাধিকবার কাশ্মির নিয়ে ভারতের নীতির সমালোচনা করেছেন। এই বই নিয়ে আলোচনা হলেও বঙ্গবন্ধুর কাশ্মির নীতি নিয়ে আলাপ স্থান পায় না।
দূতাবাস কর্মকর্তা হিসেবে তার সুপরিচিত 'বন্ধু' মাহবুবের কথা শতমুখে লিখেছেন। এককথায়, মাহবুবের আতিথিয়তায় তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। উল্লেখ্য, এই মাহবুব হলেন পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে খুনের অন্যতম পরিকল্পনাকারী মাহবুবুল আলম চাষী।
আইয়ুবের আমলে মহাচীনে গিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। তাঁকে সেখানে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দেওয়া হয়। চীনা সমাজতন্ত্রে মুগ্ধ মওলানা দেশে ফিরে 'মাও সে তুংয়ের দেশে' শিরোনামে একটি ছোট ভ্রমণকাহিনি লিখেছিলেন। শেখ মুজিবের বইয়ের তুলনায় মওলানার বইখানা নিতান্তই অপাঠ্য ও গভীর পর্যবেক্ষণী দৃষ্টির কোনো পরিচয় সেখানে পাওয়া যায় না৷ এই শান্তি সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে কথাসাহিত্যিক মনোজ বসু গিয়েছিলেন। তিনিও দেশে ফিরে প্রশংসার তুবড়ি ছুটিয়ে 'চীন দেখে এলাম' নামে একখানা কেতাব ছাড়েন। দুষ্টু লোকে বলে, '৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে চীনের হাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ধবলধোলাই হওয়ায় মনোজবাবু নাকি ক্ষোভে ও দুঃখে তার চীনা ভ্রমণকাহিনি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেন। কেউ কেউ বলেন, মনোজবাবু বইখানা প্রকাশ্যে পুড়িয়ে দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন।সত্যাসত্য যাচাই করা হয়নি। স্মরণযোগ্য, মনোজ বসু কিন্তু তার বইতে শেখ মুজিবের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর স্বাধীনতাকামী মানসিকতার কথা লিখেছেন।
পেশাদার লিখিয়ে নন শেখ মুজিব। তাই উচ্চমার্গীয় গদ্যবৈভব আশা করা অনুচিত। সম্ভবত অত্যন্ত দক্ষ হাতের সম্পাদনার ছোঁয়া পেয়েছে। তাই বইখানা এত সুপাঠ্য। ভ্রমনকাহিনি রচয়িতা হিসেবে শেখ মুজিবের প্রশংসা করতেই হবে। কারণ নতুন চীনকে তিনি লেখকের দৃষ্টিতে দেখেননি। লক্ষ করেননি বামপন্থি মুগ্ধ বালকের মতো। বরং প্রথমে ডানপন্থি রাজনীতিবিদের সন্দিগ্ধ মন, জাতীয়তাবাদীর হৃদয় এবং সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশক্তি নিয়ে দেখেছেন বলেই নানারূপে সাক্ষাৎ পেয়েছেন কমরেড মাওয়ের দেশের।
শেখ মুজিবর রহমান প্রচন্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক পুরুষ ছিলেন, কিন্তু এরপরও আমার মনে হয় উনার মধ্যে একটা অদ্ভুত সরলতা আছে।বিশেষ করে লেখক মুজিবর রহমান ভীষণ রকমের সারল্য নিয়ে আমাদের নিজ অভিজ্ঞতা শুনান। একজন স্বাধিকার সচেতন পৌরুষেয় নেতার পাশাপাশি একজন কৌতুহলী বীক্ষ্যমাণ কিশোর সমন্বয় ছিলো উনার সত্তায়। শেখ মুজিবর রহমানের লেখার ভাষা বেশ আন্তরিক এবং সংযত ও বটে।
নয়া চীনের প্রতি বারবার উনার বিস্ময়বোধ কিন্তু একই সাথে সেই বিস্ময়ের কারন সত্য কিনা তা খতিয়ে দেখার ব্যাপারটা বেশ ভালো লেগেছে। পাশাপাশি চীনের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট নিজ যুক্তি দিয়ে যে বিশ্লেষণ করেছেন তা মুগ্ধ করেছে আমাকে।নিজ দেশ নিয়ে উনি সত্যই আন্তরিকভাবে ভাবতেন। তবে একটা জায়গা আমার কাছে খুব ট্র্যাজিক আইরনি লেগেছে। সে কথা থাক! কারাগারের রোজনামচা পড়ার অপেক্ষা রাখি।
বই নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই,বঙ্গবন্ধুর লেখার স্টাইলের সাথে পূর্বপরিচিত।আগের মতই সাবলীল লেখা,তিনি আসলেই লেখক হলে ভালো করতেন!!বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিকোণ থেকে চীন-কমিউনিজম-মাও সে তুং কেমন সেটা জানা যাবে এটি পড়লে।
আমার দেখা নয়াচীন শেখ মুজিবুর রহমানের গণচীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা একটি ডায়েরির পুস্তকি রূপ। শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি বইটি প্রকাশ করেছে।
যদিও এটি একটি ভ্রমণকাহিনী তবে গভীরভাবে দেখলে, এটি ভ্রমণ কাহিনীর চেয়েও বড় একটি ক্যানভাস বলে মনে হবে। বইটিতে ১৯৫০ দশকে কমিউনিস্ট সরকারের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত চীন (যা ‘নয়া চীন’ নামে অভিহিত) ভ্রমণের বিভিন্ন স্থান দর্শন ও এর খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের পাশাপাশি নিজস্ব আদর্শিক ভাবনাগুলোও বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এই ভ্রমণে চীনের সমাজ ব্যবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষ করে তাঁর নিজের ধর্মীয় চিন্তাগুলো অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু ওই সময়ের চীন ভ্রমণে গিয়ে দেখতে পান, সেখানকার মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করছে। তাদের কারোর কোনো অভিযোগ নেই রাষ্ট্র বা শাসকদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ধর্মের ভিত্তিতে কেউ বিভাজন ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। তিনি মুসলিম চীনাদের সঙ্গে একান্তে আলাপ করেছেন এবং ধর্মচর্চা বা রাষ্ট্রীয় চাকরিতে কোনো বৈষম্য করা হয় কিনা, তা জেনেছেন। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন এবং আশ্বস্ত হয়েছেন যে নয়া চীনে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। আগের চিয়াং কাই সরকারের সময়ে এমনটির নজির থাকলেও তা পরে আর দেখা যায়নি। আগের সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এবং ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য নিজেরাই ধর্মীয় দাঙ্গাকে উসকে দিত। বঙ্গবন্ধু তাঁর বইতে নতুন চীনের এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহনশীলতার দিকটি তুলে ধরেছেন গুরুত্ব দিয়ে। পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেছেন, ভারতীয় উপমহাদেশেও চিয়াং কাই সরকারের মতো ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে জিইয়ে রাখার জন্য একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপকৌশল প্রয়োগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উসকে দিত। ফল হিসেবে উপমহাদেশে সংঘটিত অনেক হানাহানি ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিয়েছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রেশ কাটেনি এবং এজন্য কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলকে দায়ী করেন। বঙ্গবন্ধুর মনে হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোনো ধর্মীয় কারণে হয় না। এটি কোনো কোনো গোষ্ঠীর বা রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হয়। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ যদি সত্যিকারভাবে ধর্ম ভাব নিয়ে চলত, তাহলে আর মানুষে মানুষে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এভাবে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম হতো না। কিন্তু মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ধর্মের অর্থ যার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চালাতে চেষ্টা করেছে।
কিছু ব্যাপার আমাকে ভাবিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে বছর চীন ভ্রমনে যান তার আগের বছরও তিনি জেলে ছিলেন। এরপরেও জেল খেটেছেন। তিনি নিয়মিত সরকারের সমালোচনা করার পরেও সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হয়ে শান্তি-সম্মেনলে যোগ দিয়���ছেন। দেখা যাচ্ছে সে সময়ের সরকার বিরোধী নেতাকে সম্মন দিতো। বর্তমানের কথা নাই বা বললাম।
এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছেন। সংবাদপত্রে খবর ছাপানো নিয়ে সরকারের নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছেন। পরবর্তিতে আমরা দেখেছি বাকশাল গঠনের সময় তিনি নিজেই ৪ টি জাতীয় দৈনিক বাদে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেন। এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের কারণ খোজা দরকার।
পুরো বইটাতে লেখার ধরন চমৎকার। মনে হবে না কোনো রাজনীতিবিদের লেখা পড়ছেন। প্রাঞ্জল ভাষায় মনের কথা বলে গেছেন তিনি। বইয়ের শুরুতেই লিখতে গিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন যে তিনি লেখক না। লেখকদের মত কাব্যিকভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবেন না। এই হতাশার মধ্যেই আমি তার লেখক সত্তাকে দেখতে পেয়েছি।
Sheikh Mujibur Rahman's "New China 1952" is an extraordinary testament to a pivotal period in history when the People's Republic of China was undergoing radical transformation under Chairman Mao Zedong's leadership. Sheikh Mujibur Rahman, later recognized as the founding father of Bangladesh (Bangabandhu), takes readers on a captivating journey through this era, offering a unique and insightful perspective.
Bangabandhu's travelogue begins with his participation in the Asian and Pacific Regional Peace Conference in China as a member of the Pakistan delegation. However, his curiosity led him to extend his stay, allowing him to immerse himself in the everyday lives of the Chinese people. This experience served as the foundation for his engaging narrative.
What stands out in Bangabandhu's account is his keen ability to capture the essence of 1950s, China. His vivid prose paints a vivid picture of a society in the throes of dramatic change, where ancient traditions collided with the fervor of a new era. Beyond political events, Bangabandhu's personal interactions with ordinary Chinese citizens, their stories, and aspirations add depth and humanity to the narrative, showcasing the resilience and determination of a nation striving for progress.
"New China 1952" not only serves as a historical record but also delves into broader themes of revolution, nation-building, and the aspirations of the masses. Bangabandhu's writing invites readers to ponder the universal struggle for social justice and equality. This book is a compelling reflection of Bangabandhu's deep intellect and his ability to document a significant historical moment with both objectivity and empathy. Despite not being a professional writer, he presents his experiences fluently and vividly, allowing readers to witness China's transformation through his eyes.
In conclusion, "New China 1952" transcends its historical context to become a captivating narrative that resonates with readers today. Bangabandhu’s narrative, marked by its sincerity and depth, serves as a valuable reminder of the enduring human quest for progress and justice. His continuous and enjoyable writing style ensures that this book remains a compelling account of a nation's journey towards a new dawn, making it a must-read for those interested in history and the human spirit.
বঙ্গবন্ধুর সহজ সরল অনবদ্য লেখা পড়তে খুব ভালো লাগে।এই বইয়ের লেখার সময় প্রকৃতির বর্ণনা করতে নিজের অপারগতা প্রকাশ টা ভালো লেগেছে।বঙ্গবন্ধুর প্রথম চীন ভবনের সময় চীন সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন প্রায় সবই মিলে গেছে বর্তমান চীনের সাথে।কেনো আজ চীন এত সমৃদ্ধ হয়েছে, এই বইটা পরে জানতে পারলাম।বইটা এত সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে মনে হলো কোন সাহিত্যিক ব্যক্তি লিখেছেন, পড়া শেষে একটাই আফসোস আমরা সম্পদ টা আগলে রাখতে পারিনি😥
মাত্র ১০০ পেজের বই,তার মধ্যে ৪০ পেজ হলো নয়াচীন ও সংযুক্ত পাকিস্তানের তুলনা।আমি চেষ্টা করেছি প্রথম ৬০ পেইজ নিখাদ ভ্রমণকাহিনীর মতো উপভোগ করার কারণ সেই চীনও আর নেই,সেই পাকিস্তানও আর নেই,তাই রাজনৈতিক আলোচনা এখানে অমূলক।এবং সেটা করতে গিয়ে ২ ঘন্টার পড়া আমার ৪ ঘন্টায় শেষ হয়েছে কারণ প্রচুর পরিমাণে গুগল ও ম্যাপ ঘেটেছি।
১৯৫২ সালের ২-১২ অক্টোবর চীনে Asian and Pacific rim peace conference অনুষ্ঠিত হয়।সেখানে আওয়ামী মুসলীম লীগের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলা থেকে যায় ৫ জন-শেখ মুজিব,তফাজ্জল হোসেন মানিক(ইত্তেফাক সম্পাদক),আতাউর রহমান খান (পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি),খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ও ইউসুফ হাসান।প্রথমে চীন যাওয়ার পথে পড়ে বিদ্রোহে উত্তাল রেঙ্গুন।সেখান থেকে হংকং এর কুওলন হোটেলে।হংকং এবং চীনের মাঝখানের সেতু পার হয়ে ঢুকেন নয়াচীনে যা সবে ১৯৪৯ এ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চিয়াং কাই শেকের পতন ও মাও সে তুং এর উত্থানের মাধ্যমে।চীনে তাদের প্রথম গন্তব্য ক্যান্টন শহর।ক্যান্টনে উঠেন তাইচুং হোটেলে যার দু-পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঝুইজাং/পার্ল নদী।সেখান থেকে পরদিন গেলেন আসল গন্তব্যস্থল রাজধানী পিকিং (বর্তমানে বেইজিং) শহরে।সেখানে সম্মেলনে অংশ নেয়া ৩৭ টি দেশের অতিথিদের রাখা হয় "পিকিং হোটেলে।এই পিকিং এই শান্তি সম্মেলন।সম্মেলনে দেখা হয় ম্যাডাম সান ইয়াত সেন,মাও সেতুং,লেখক মনোজ বসু,তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের সাথে।সম্মেলনে দুজন বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন-বঙ্গবন্ধু ও মনোজ বসু।বইয়ের প্রচ্ছদে সম্মেলনের একটি ছবি আছে।আর আছে একটি পায়রা।এটি পিকাসোর আঁকা। পেকিং এ ঘুরে বেড়িয়েছেন পথে পথে,মানুষের সাথে মিশে কথা বলে তাদের জীবনবোধ বোঝার চেষ্টা করেছেন।এই দিক থেকে বলা যায় বঙ্গবন্ধুর পরিব্রাজকতার ধাঁচ অনেকটা ইবনে বতুতার মতো--স্থানের চেয়ে ব্যক্তি সম্পর্কে তাদের কৌতুহল বেশি।
পিকিং এর পর গেলেন তিয়ানজিং-চীনের নামকরা শিল্পনগরী।সেখানে বিভিন্ন কারখানা দেখে পরদিন গেলেন নানকিং।Nanking হলো Yangtze নদীর পারে।এখানে আছে সান ইয়াৎ সেনের কবর Zhongshan/Purple mountain এর উপরে।তাই শুধু শ্রদ্ধাজ্ঞাপন নয়,নয়নাভিরাম দৃশ্যের জন্যও লোকেলোকারন্য থাকে।ঘুরলেন কৃষিফার্ম,নানকিং বিশ্ববিদ্যালয়।
এর পরের গন্তব্য Huangpu নদীর তীরের সাংহাই।এখানে তারা উঠলেন সাইহাই এর শ্রেষ্ঠ হোটেল কিংকং এ।সাংহাই এর ভ্রমণটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে।দেখতে গিয়েছিলেন Wusheng road এ জাদুঘর আর তার ঠিক ৬ কিমি দূরে Huaihai road এ সাংহাই এর সবচেয়ে বড় পাব্লিক লাইব্রেরিতে।
সর্বশেষ স্থান হলো হ্যাংচো।হ্যাংচোতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো কো-অপারেটিভ ফার্মিং দেখা।তবে সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর স্থান হলো West lake (UNESCO world heritage site) যার তিনদিকে পাহাড় এবং একে ঘিরেই হ্যাংচো শহর।লেকের মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপে প্যাগোডা,আছে বোটিং এর ব্যবস্থা,পাহাড়ের উপরে দাঁড়ালে জ্যোৎস্নাশোভিত হ্যাংচো শহর দেখা যায়।বহু দূরে দেখা যায় প্রাচীন Lingyin মন্দির। এরপর ক্যান্টন,হংকং,রেঙ্গুন হয়ে সবাই দেশে ফিরে আসেন।
এই বইটিতে ভ্রমণপিপাসু কৌতুহলী বঙ্গবন্ধুর সাথে সেন্স অফ হিউমারসমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর দেখা মেলে।বইয়ের দুটি ঘটনা দাগ কাটার মতো- ১.এক কারখানার হাউজিং পরিদর্শন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এক নবদম্পতিকে উপহার দিয়ে আসেন।পরে তারা উনাকে খুঁজে বের করে হোটেলে পাল্টা উপহার হিসেবে "লিবারেশন পেন" দিয়ে যায়। ২.চিয়াং কাই শেক যখন ফরমোজা পাল্লাচ্ছে তখন তার সমর্থকরা পানির দামে সব সম্পত্তি বিক্রি করে ভাগছে।তখন পেকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক এক বইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন।দোকানের মালিকও ভাগার তালে আছে।প্রফেসরকে পেয়ে নামমাত্র মূল্যে পুরো লাইব্রেরি ছেড়ে দিলেন।এভাবে আকস্মিক প্রফেসরের আজন্মলালিত নিজস্ব লাইব্রেরির শখ পূরণ হয়ে গেলো।এরকম একটা সিনারিও যে নিজে কতবার জেগে জেগে স্বপ্ন দেখেছি😥এভাবে কেউ যদি একটা বইয়ের দোকান পানির দামে দিয়ে দিতো!
বঙ্গবন্ধুর একটা নিজস্ব স্টাইল আছে। একেবারে সহজ-স্বাভাবিক, কিন্তু পড়তে বেশ লাগে। তাঁর এই সহজ স্টাইলের জন্য বই পড়তে একটুও একঘেয়ে লাগে না, বরং আগ্রহই জন্মায়। বঙ্গবন্ধুর লেখা আমার পড়া এটি আমার তৃতীয় বই। বাকি দুইটা অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা। অন্য দ��টোও বেশ লেগেছিলো তবে সবচেয়ে ভালো লাগলো এই বইটি। খুব তীক্ষ্ণ চোখে বঙ্গবন্ধু নয়া চীনের প্রস্তুতি এবং গঠন খেয়াল করেছিলেন, খুব সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ এর মাধ্যমে নয়া চীন কীভাবে উন্নতি করছে এতো দ্রুত তা তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন৷ বঙ্গবন্ধুর চেতনায় রাজনীতি এবং দেশপ্রেম কেমন আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলো তা বেশ অনুধাবন করা যায় বইটি পড়ে। একই সাথে তাঁর চোখ দিয়ে দেখে নেয়া যায় নয়াচীনের তখনকার অবস্থান৷ অনেক তাড়াতাড়ি তারা কীভাবে বেশ্যাবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, আফিমের নেশা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলো, কীভাবে তারা ধর্মীয় চেতনাকে একটু অন্য খাতে প্রবাহিত করে ব্যবহার করছিলো, কীভাবে মেয়েদের শিক্ষিত করার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলো বঙ্গবন্ধু সবই বিশ্লেষণ করেছেন ভালোমতো। একই সাথে তাঁর নিজস্ব ভাবনা, নিজের দেশের সাথে পার্থক্য এবং সমস্যার মূল কোথায় তাঁর খোঁজ ছিলো সারা বই জুড়ে৷ চীনের নানান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সাথে দেখা হওয়া কিংবা ঐতিহাসিক নানান বিখ্যাত ব্যক্তির কথাও আলোচিত হয়েছে প্রসঙ্গক্রমে। আবার সরস ভাষায় বন্ধুপত্নীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে কে কীভাবে খেলেন তাও বেশ মজার ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো অনেক আধুনিক। অনেক গোঁড়া ব্যাপারস্যাপার থেকে তিনি বের হয়ে এসেছিলেন নিজস্ব প্রজ্ঞার মাধ্যমে। রাজনীতি-ইতিহাস-সাহিত্য প্রতিটা ক্ষেত্রেই এই বইটি হয়ে রইবে তাই এক অমূল্য দলিল। পার্সোনাল রেটিং- ৪.৫/৫
০৪ আমার দেখা নয়াচীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমি মো : রায়হান
“জেলে থাকতে ভাবতাম, আর মাঝে মাঝে মাওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও”। চীন দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা বঙ্গবন্ধুর আগে থেকেই ছিল।যা গ্রন্থের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর এই উক্তিটির মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে দুটি বই—অসমাপ্ত আত্মজীবনী(২০১২) ও কারাগারের রোজনামচা (২০১৭)। এই বই দুটির লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুই পুস্তক-ই বাংলাদেশের বই বিক্রির ইতিহাসে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে এবং বেরোনোর এক বছরের মধ্যে কারাগারের রোজনামচাও বিক্রি হয়েছে ৭০ হাজার কপি।বাংলাদেশে আর কোনো রচনা এমন বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। বইগুলোতে আছে বঙ্গবন্ধুর জীবন, রাজনৈতিক জীবনের নানা ঘটনা ও অনুষঙ্গ। লক্ষ করার বিষয় হলো, দুই বইয়েই তাঁর ভাষার গাঁথুনি বেশ আকর্ষণীয় ও প্রাঞ্জল।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বের হওয়ার পর সবার সামনে উন্মোচিত হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখক পরিচয়ের গোপন কুঠুরি। সেই কুঠুরির আরেকটি অংশ একটি ভ্রমণকাহিনি। বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের ওপর ভিত্তি করে তাঁর লেখা আমার দেখা নয়াচীন নামে বইটি ।
‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ নয়া চীনকে চেনানোর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু নিজেকেও চিনিয়েছেন ভিন্নভাবে। ভ্রমণ-কাহিনী পড়তে পড়তে পাঠকের যেন কোনরূপ বিরক্তি না আসে, সেজন্যে বঙ্গবন্ধু রসবোধের পরিচয় দিয়ে প্রধান অনুষঙ্গগুলোকে উপজীব্য করে তুলতে সঙ্গতিপূর্ণ ভ্রমণের মজার ঘটনাগুলোকে তুলে ধরেছেন।
৩২ বছর বয়সের টগবগে তরুণ নেতার নয়া চীন ভ্রমণ; অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, বাস্তবতা-সবকিছু-ই দারুণ দক্ষতা ও পরম মমতায় লিপিবদ্ধ করেন। বয়স তখন তাঁর ৩৪ বছর।
১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে নয়া চীনের পিকিং-এ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তদানীন্তন পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলা থেকে শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। পূর্ববাংলা থেকে তাঁর ভ্রমণ-সঙ্গী ছিলেন পূর্ববাংলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ও ইউসুফ হাসান। নয়া চীন ভ্রমণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মিয়ানমার, ব্যাংকক ও হংকংও গিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে রাজবন্দী থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধু সেই ভ্রমণের সরস বিশ্লেষণ করেছেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে। নয়াচীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও সেতুং এর প্রতি সেদেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা, নয়াচীনের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক অবস্থা ও বাস্তবতা বঙ্গবন্ধু এ ভ্রমণে প্রত্যক্ষ করেন। চীন ভ্রমণের এসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন; যেখানে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান ও চীনের রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক অবস্থার তুলনা, কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা প্রভৃতি বিষয়াদি প্রাঞ্জলভাবে আলোচনা করেন। এটিই বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’।
আমার দেখা নয়া চীন গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথাই শুধু বলতে চাননি; বরং এই ভ্রমণের আদ্যোপান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে মনের ভিতর লালন-পালন করেছিলেন। একটা বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন তাঁর ভিতরও নিহিত ছিল। সদ্য স্বাধীন সাধের পাকিস্তান জন্ম লগ্ন থেকেই তা পূরণে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান নামক সদ্য স্বাধীন দেশে ৫৬ ভাগের বেশি মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে নিগৃহীত হচ্ছে, বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, নিপীড়ণের শিকার হচ্ছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে নয়া চীনের ঘুরে দাঁড়ানো বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার দালাল চিয়াং কাইশেকের নির্যাতন-নিপীড়নকে পরাভূত করে চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা মাও সেতুং এর হাত ধরে নয়া চীনে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, ধনী-গরীবের ভিতর যে সমতা এসেছে, একটা শোষণমুক্ত সমাজ গঠিত হয়েছে; তা বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। একটা শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রেরণা হয়তো বঙ্গবন্ধু এখান থেকে পেয়েছিলেন, যার ইঙ্গিত এই গ্রন্থে রয়েছে। মাঝে মাঝে নয়াচীনের নয়া শাসকদের রাষ্ট্রপরিচালনার বিভিন্ন ইতিবাচক দিকের সাথে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণের তুলনা করে পাকিস্থানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার মানুষের উপর যে বিমাতাসুলভ আচরণ করেই চলেছে, তা তুলে ধরেছেন।
নয়া চীনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৬৬ পৃষ্ঠায় লেখেন: “আমি লেখক নই, অনুভব করতে পারি মাত্র, লেখার ভিতর দিয়া প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা খোদা আমাকে দেন নাই।” বঙ্গবন্ধু নিজেকে লেখক দাবি না করলেও তাঁর রচিত ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থটির প্রাঞ্জল বর্ণনা, জটিল বিষয়বস্তুকে সরলভাবে উপস্থাপন পাঠক-হৃদয়ে ছুঁয়ে গেছে। একজন তরুণ রাজনীতিকের উপলব্ধিতে এসেছে দারুণ সব অভিজ্ঞতার বয়ান এবং নয়া চীন রাষ্ট্রের সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের গল্প। বিপ্লবের পর সমাজে যে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়, বঙ্গবন্ধু নয়া চীন ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তা আত্মস্থ করেছিলেন এবং তার বাস্তব প্রয়োগের স্বপ্নও হয়তো তিনি অন্তরে বপন করেছিলেন, তার ইঙ্গিতও এ গ্রন্থে রয়েছে।
মহান নেতা মাও সেতুং এর নেতৃত্বে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল চিয়াং কাইশেকের পতন হয়। বিপ্লব পরবর্তী সময় নয়াচীনের মনোজগতে আসে এক বিরাট পরিবর্তন। ধনী-গরীব, মহাজন-কৃষক, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ব্যবধান কমে আসে। কৃষিজমি, কলকারখানা; মালিক-শ্রমিক, মহাজন-কৃষকের হয়ে ওঠে। নয়া চীন মাত্র তিন বছরে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে থাকে।
নয়াচীন সরকার কায়েম হবার পর তারা ‘লাঙল যার, জমি তার’ প্রথা প্রবর্তন করলো। বড় বড় জমিদারের জমি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকের মধ্যে বণ্টন করা হল। অনাবাদি খাস জমিও কৃষকের মাঝে চাষের জন্য বণ্টন করে দেয়া হল। যখন কৃষক বুঝতে পারলো, এ জমিতে চাষ করলে কেউ আর ফাঁকি দিতে পারবে না, তখন তারা পুরো উদ্যমে চাষাবাদ শুরু করলো। শুরু হলো নয়াচীনের নবতর যাত্রা। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের পৃষ্ঠা: ৮৯-৯০ তে লেখেন- “নয়া চিনে একখণ্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। রেললাইনের পাশে যে গর্তগুলি পড়ে থাকে সেগুলিতেও ফসল করা হয়েছে। যদি কোন জমি ইচ্ছাকৃতভাবে পড়ে থাকে তাহলে সরকার কঠোর শাস্তি দেয়”।
শুধু আইন করে নয়; জনমত গঠন, মানবীয় ব্যবহার, প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় কঠোর আচরণ, কর্মসংস্থান-বাসস্থান সৃষ্টির মধ্যদিয়ে নয়াচীন ভিক্ষাবৃত্তি, বেকার সমস্যা, ডাকাতি, আফিম নেশামুক্তি, বেশ্যাবৃত্তিকে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছিল। সেজন্য বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন: “আইন করে কোনো অন্যায় কাজই বন্ধ করা যায় না, অন্যায় বন্ধ করতে হলে চাই সুষ্ঠু সামাজিক কর্মপন্থা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও নৈতিক পরিবর্তন।”
মাত্র ৩ বছরের মধ্যে চীন সরকার ও তাদের জনগণ এক হয়ে কাজ করে দেশটিকে বদলে ফেলেছে; যা বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষ করে চীনের জনগণের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য, দেশের প্রতি ভালোবাসা দেশপ্রেম- বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছে। এ বিষয়গুলি বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের বিভি��্ন পৃষ্ঠায় তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের ৯১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: “সরকার ডাক দিলো- একশত মাইল একটা রাস্তা করতে হবে। তোমাদের যথেষ্ট অসুবিধা হতেছে; সরকারের অত টাকা নাই, তাই তোমাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরই করাই উচিত। প্রত্যেকের আসতে হবে, অন্তত দু’দিন কাজ করে দিতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক মাসের ভেতর সমস্ত রাস্তা করে দিল। এইভাবে নয়াচীনে হাজার হাজার গঠনমূলক কাজ জনসাধারণ করেছে, কারণ জনসাধারণের আস্থা আছে সরকারের ওপরে এবং মনে করে একাজ তাদের নিজেদের।”
চীনের জনগণের চরিত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৬৪ পৃষ্ঠায় লেখেন: “এদেশের লোকের মনে অহংকার নাই। সকলকেই আপন করতে চায়। সকলেই মনে করে ‘রাষ্ট্র আমাদের’-একে গড়ে তুলতে হবে। ” মাত্র তিন বছরের মধ্যে চীনের শিক্ষা ব্যবস্থায় আসে আমূল পরিবর্তন। সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ছিল। এজন্য বঙ্গবন্ধু চীন ভ্রমণে গিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে লিখেছেন: “আমাদের দেশের মতো কেরানী পয়দা করার শিক্ষাব্যবস্থা আর নাই। কৃষি শিক্ষা, শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনিক্যাল শিক্ষা দেয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু পৃষ্ঠা: ৬০-এ একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে নয়াচীনের ইতিবাচক ভবিষ্যতের কথা ব্যক্ত করেন: “এক এক দেশে এক এক প্রকারের ‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণি’ (প্রিভিলেজড ক্লাস) আছে- যেমন আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’, অন্যদেশে শিল্পপতিরা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’; কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাই ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’। এই ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’টা সরকারের নানা সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকে। নয়াচীন সরকারের হুকুম, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হবে, একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে, সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেইভাবে পোশাক দিতে হবে। যাদের দেবার ক্ষমতা নাই, তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য করবে। এভাবেই নতুন মানুষের একটা জাত গড়ে তুলছে নয়াচীন। ১৫-২০ বৎসর পরে এরা যখন লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে, তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে?”
চীনের শান্তি সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ শান্তির সপক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও বক্তব্য রাখেন। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা তাদের নিজ ভাষায় বক্তব্য প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। পশ্চিম বঙ্গ থেকে আসা লেখক মনোজ বসুও বাংলায় বক্তৃতা করেন। কিন্তু অনেকে মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন, যা বঙ্গবন্ধুর ভাল লাগে নাই। উল্লেখ্য করা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। তারও ২২ বছর আগে তরুণ শেখ মুজিব চীনের শান্তি সম্মেলনে বাংলায় বক্তব্য প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৪৩ পৃষ্ঠায় লেখেন: “ বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান ও ইলিয়াস বক্তৃতাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।”
নয়াচীন ভ্রমণকালে বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ করেছেন, নয়াচীনে নারী-পুরুষ প্রকৃত অর্থেই সমানাধিকার ভোগ করছে। নারী-পুরুষ সমানভাবে দেশের জন্য কাজ করছে, আয়-রোজগার করছে; কেউ কারও উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে না। সমাজ থেকে নারী-পুরুষ সমান সম্মান পাচ্ছে।
তরুণ বয়সেই বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতায় রূপান্তরিত হচ্ছিলেন; এ গ্রন্থ তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গ্রন্থের ৬৩ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: “যাক বাবা, আমেরিকার বিরুদ্ধে সত্যকথা লিখে বিপদে পড়তে চাই না, কারণ আজ আমেরিকা পাকিস্তানের ‘একমাত্র বন্ধু’। এক মুসলিমলীগের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলেই প্রত্যেক বৎসর জেল খাটি। আবার এদের বিরুদ্ধে বলে কি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলবো?”
১৯৫২ সালে চীন ভ্রমণকালে বঙ্গবন্ধু গভীর দৃষ্টি দিয়ে নয়াচীন পর্যবেক্ষণ করেন। চীন সম্পর্কে কিছু ভবিষ্যৎ বাণী তিনি এ গ্রন্থে দিয়েছিলেন। বিশ্বে বর্তমান চীন রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর সেই ভবিষৎবাণী আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। কিন্তু লেখক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বড় কীতিত্ব সম্ভবত এখানে যে নিজের অভিজ্ঞতাগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন সহজ ভাষায়, অতিরঞ্জনের অশ্রয় না নিয়ে। বোধ করি এটা বড় লেখকেরই গুণ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বই লেখার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা (রেণু)। শেখ ফজিলাতুন্নেছা তাঁর স্বামীকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, অনুপ্রেরণা জাগিয়েছেন লেখার জন্য। কারাগারে বন্দী জীবনে সময় কাটানোর জন্য হলেও কিছু করা দরকার। তখনি ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধুকে লিখার জন্য খাতা-কলম কারাগারে দিয়ে যেতেন, যেন বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের জীবনের কিছু অংশ লিখে যেতে পারেন যা পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশিত হতেও পারে-এই বিশ্বাস ছিল শেখ ফজিলাতুন্নেছার। যে বই পড়ে জনগণ জানবে কি ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মায়ের সেই আকাঙ্খা পূরণ করেছেন।
'আমার দেখা নয়াচীন' বইটি ভ্রমণকাহিনী। এই বইটি বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালে কারাগারে বসেই লিখেছিলেন। বইটিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর চীন সফর সম্পর্কে লিখেছেন। ১৯৫২ সালে ২-১২ অক্টোবর চীনের পিকিংয়ে (বর্তমান বেইজিং শহর) এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে এ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে নয়াচীন সফর করেন।বঙ্গবন্ধু এই সফর সম্পর্কে, সম্মেলন সময়ের কিছু মুহুর্ত, সফরের সময়ে সঙ্গীদের সাথে কাটানো কিছু ভালো মুহুর্ত, তখনকার সময়ে চীন এবং পাকিস্তানের অবস্থার তুলনা তুলে ধরেছেন এই বইটিতে।
'আমার দেখা নয়াচীন' গ্রন্থের লেখক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কীর্তি, আত্মত্যাগ ও গৌরবগাঁথা সম্পর্কে পুরো বিশ্বের বিদগ্ধজন বিদিত। তাঁর রচিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও 'কারাগারের রোজনামচা' গ্রন্থ দুটিতে তাঁর জীবনের সেইসব কঠোর সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। এ বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির একুশে বইমেলাতে মুজিব শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে লেখকের লেখা 'আমার দেখা নয়াচীন' বইটি। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার এই যে, এ বছর একুশে বইমেলাতে বঙ্গবন্ধুর লেখা এই বইটি ত্রিশ হাজারের অধিক বিক্রয় হয়ে সর্বোচ্চ বই বিক্রয়ের রেকর্ড গড়েছে।
১৯৪৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুকে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে বারবার কারাবরণ করতে হয়। এরপর ১৯৫২ সালে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে যোগদা�� করেন চীনের পিকিং শহরে অনুষ্ঠিত হওয়া পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান এন্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স-এ। সে সময় তিনি চীন নামে নতুন স্বাধীন হওয়া একটি দেশকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে আবারো তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। সে সময় জেলের অন্ধকারের নীরবে নিভৃতে তাঁর চীনের সেই স্মৃতিনির্ভর ভ্রমণ কাহিনী ও অভিজ্ঞতা বিবৃত করে তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেন।
দীর্ঘ চার বছর জেল খেটে আসার ���র ৩২ বছর বয়সী তরুণ মুজিবের কাছে চীন দর্শনের সুযোগ আসে। কিন্তু তাঁর কাছে তখন পাসপোর্ট ছিল না। আর সে সময় পাসপোর্ট তৈরি করা মোটেও সহজলভ্য ব্যাপার ছিল না। পাসপোর্টের জন্য সে সময় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে আবেদনপত্র পেশ করতে হত। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে লাভ করা যেত বহু আকাঙ্ক্ষিত পাসপোর্ট। কিন্তু এদিকে ১৯৫২ সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পাবার পর বঙ্গবন্ধু বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর একটু সুস্থ হয়ে একই বছরের অক্টোবর মাসে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর পাসপোর্ট হাতে পেয়ে তিনি সফরসঙ্গীদের সাথে পাড়ি দেন চীন নামে সে সময় গঠিত হওয়া ষাট কোটি মানুষের এক নতুন রাষ্ট্রে। চীনে পৌঁছানোর পূর্বে তাঁকে ভিনদেশের আরো তিনটি স্থানে যাত্রাবিরতি নিতে হয়। উক্ত তিনটি স্খান যথাক্রমে ব্রহ্মদেশের (মায়ানমার) রেঙ্গুন এবং থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ও হংকং। এসব স্থানে তিনি বেশি সময় অবস্থান না করলেও, এসব স্থানের বর্ণনা ও অভিজ্ঞতাও লেখক লিপিবদ্ধ করেছেন এই বইতে। ব্রহ্মদেশের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লেখক এই বইয়ের ২২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন:-
"যতদূর খবর নিয়ে জানলাম, ব্রহ্মদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। বিপ্লবীরা বহুস্থান দখল করে আছে, আর মাঝে মাঝেই রেঙ্গুন শহরের পানি বন্ধ করে দেয়।"
পরেরদিন সন্ধ্যায় তিনি চীনের ক্যান্টন পৌঁছান এবং সঙ্গী-সাথীদের সাথে সেখানের একটা হোটেলে ওঠেন। এরপর থেকে এই বইয়ে তিনি চীনের বর্ণনা শুরু করেছেন। শান্তি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর সেখানকার রাষ্ট্রনায়কদের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং তাঁদের বক্তৃতার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা উল্লিখিত করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি বাইরে বেরিয়ে সেখানকার স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছেন নতুন চীনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে এবং সেগুলো উল্লেখ করেছেন এই বইতে। চীন স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সেখানে খুন,ডাকাতি,বেশ্যাবৃত্তি ও বেকার সমস্যার মত বেশকিছু সমস্যা ছিল। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসবের বেশ কিছু সমস্যার সমাধান আশ্চর্যজনকভাবে করে ফেলে চীন। এছাড়া, চীন দর্শনের পূর্বে তিনি শুনেছিলেন, এই দেশটি নাকি মুসলমানের প্রতি এবং তাদের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে দেওয়ার প্রতি খুবই নির্দয়। এই কথাটি আসলে কতটুকু সত্য, সেটা উদঘাটনেও তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর এবং এ সম্পর্কেও তিনি অনেক কথা লিখেছেন এই বইতে।
লেখকের ভ্রমণকালে বিভিন্ন স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে খুব চমৎকারভাবে, যা পড়ার পর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো স্বচ্ছ জলের মত ভেসে উঠেছে আমার চোখের সামনে। কিন্তু তবুও লেখক এই বইয়ের ২৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন:-
"আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লেখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন।"
বঙ্গবন্ধুর এই উদারচেতা বাক্য থেকে সহজেই অনুমেয় যে, তাঁর দর্শনীয় সেসব প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো কত না সুন্দর ছিল!
তিনি যে শুধু এই বইতে চীন ভ্রমণের বিরস বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন, তা নয়। রয়েছে তাঁর সফরসঙ্গীদের সাথে ঘটা হাস্যরসাত্মক বর্ণনাও। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় বঙ্গবন্ধুর একজন সফরসঙ্গী আতাউর রহমান সাহেবের কোটে হঠাৎ এসে একজন তরুণী মেয়ে গোলাপ ফুল গুঁজে দেয়। এর অর্থ মেয়েটি তাঁকে প্রেম নিবেদন করল। এমন ঘটনা দেখে বঙ্গবন্ধু আতাউর রহমান সাহেবকে কৌতুক ছলে জিজ্ঞাসা করে বলেন, "আমাদের মত যুবকদের দিকে নজর না পড়ে আপনার ওপর পড়ার কারণ কি?" এছাড়া, বঙ্গবন্ধুর আরেকজন সফরসঙ্গী দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক ভাইয়ের ভোজনরসের বিবরণ, পাঠকের মুখে হাসির লহর বইয়ে দেবে।
এই বইটির ভূমিকা রচনা করেছেন, গ্রন্থের লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা, আমাদের দেশের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এই বইটি সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন:-
"এই ভ্রমণকাহিনি যতবার পড়েছি আমার ততবারই মনে হয়েছে যে তিনি গভীর পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। তার কারণ হলাে তাঁর ভিতরে যে সুপ্ত বাসনা ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন সেটাই বারবার ফুটে উঠেছে আমার মনে , এ-কথাটাও অনুভব করেছি।"
এছাড়া, বইয়ের শেষে বঙ্গবন্ধুর চীন ভ্রমণের বেশ কিছু ছবি সংযোজিত হয়েছে, যা বইটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
পরিশেষে বলব, পুরো পৃথিবী আজ করোনা ভাইরাসের মহামারী প্রাদুর্ভাবে জর্জরিত ও দিশেহারা। আমরা সকলেই অবগত যে, এই ভয়ংকর ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। এরপর থেকে চীন দেশ সম্পর্কে আমাদের সকলের জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাদের কৃষ্টি-কালচার ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে কমবেশি আমাদের প্রত্যেকের মনে একটা নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু চীনের গোড়ার দিকের ইতিহাস ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম, যা আমাদের চীনের প্রতি তৈরি হওয়া বর্তমান ধারণার পরিবর্তন ঘটাবে। তাই, চীন দেশ সম্পর্কে জানার এই কৌতূহলকে উদ্দীপ্ত করার জন্য এই বইটি পড়া আমাদের প্রয়োজন।
বই : আমার দেখা নয়াচীন লেখক : শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশনী : বাংলা একাডেমি মুদ্রিত মূল্য : ৪০০ ৳ মোট পৃষ্ঠা : ১৯৯ প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২০
Read a book written by a 'fascist' hoping to find some 'Mein Kempf'-esque shit.. Really! a big let down! However, the last few pages made me realize why some people is and was afraid of this 'fascist' so much..
শেখ মুজিবের চীন সফর নিয়ে লেখা এই বই, সদ্য বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে হয়েছে তখন কমিউনিস্ট চীনে। মাও সে তুং এর দেশকে তাই কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তরুণ শেখ মুজিব পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। পাকিস্তানের ডেলিগেট হয়ে শান্তি সম্মেলনে চীনের সমাজ ব্যবস্থা, দূর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল মুজিবের। আমার ধারণা সমাজতান্ত্রিক শাসন কাছাকাছি থেকে দেখার অভিজ্ঞতা তার জীবনে ছাপ ফেলেছে, একাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস তার বীজও বোনা ছিলো ঐ সফরেই।
১৯৫২ সাল। ভাষা আন্দোলনের বছর। জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আওয়ামিলীগ এর রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে অক্টোবরে চীনে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু সেখানে পাকিস���তানের প্রতিনিধিদলের সাথে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে কারাগারে বন্দি অবস্থায় স্মৃতিনির্ভর এই ভ্রমণকাহিনী রচনা করেন। মূল বইটি ১১৯ পৃষ্ঠার। বাকিটুকু বঙ্গবন্ধুর জীবনপঞ্জি ও ভ্রমণের আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন চীনে যান, তখন জাতীয়তা লিখতে হতো পাকিস্তানি ব্রিটিশ। ঢাকা থেকে বিমানে রেঙ্গুন, ব্যাংকক, হংকং হয়ে চীনে প্রবেশ করেন ট্রেনে চড়ে। মাঝে কয়েক জায়গায় যাত্রাবিরতি করেন। ২-১২ অক্টোবর অর্থাৎ এগারো দিন সম্মেলন চলে। সকলে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন যে কোনোমতেই সেখানে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবেনা। এই এগারো দিনের সম্মেলন এবং বাড়তি কিছুদিনের চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তৎকালীন চীনের সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
বর্তমান চীনকে তখন সবাই নয়াচীন বলতো। কারণ ১৯৪৯ সালে চিয়াং-কাই-শেকের সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করে মাও-সে-তুং নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংস্কার শুরু করে। সমাজতন্ত্রের আদর্শে বলীয়ান হয়ে সকলের মধ্যে সমতা নিশ্চিতে কাজ করে নতুন সরকার। 'লাঙল যার, জমি তার।' নীতিতে সকল কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন করে দেয়া হয়। দেশের মধ্যেই শিল্প কারখানা স্থাপন করে অন্য দেশের উপর নির্ভরশীলতা কমানো হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের মধ্যে আমূল পরিবর্তন চলে আসে। তবে তারা স্বীকার করে যে পরিপূর্ণভাবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হতে তাদের আরো সময়ের প্রয়োজন আছে। পশ্চিমাদের প্রোপাগান্ডা বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাত থাকায় তিনি চেষ্টা করেন প্রান্তিক মানুষের সাথে কথা বলে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানতে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখতে পান যে, যা শুনে এসেছেন তার সাথে প্রকৃত ঘটনার খুব কমই মিল আছে। শুধুমাত্র সরকার নয়, চীনের জনগণও দেশের উন্নতির জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের মধ্যে অ-কমিউনিস্ট সদস্য বেশি থাকা সত্ত্বেও চীনের যে পরিবর্তন দেখতে পান তাতে সকলেই নতুন সরকারের প্রশংসা করেন।
বইটিতে তৎকালীন চীনের অবস্থার পাশাপাশি পাকিস্তানের বিভিন্ন বিষয়াদিও ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশের ভেতরকার অবস্থাও সমান্তরালভাবে তুলে ধরেছেন। চীন ও পাকিস্তানের প্রশাসনিক কাঠামোর পার্থক্যই মূলত দুই দেশকে দুই মেরুর দেশে পরিণত করেছিল। পাকিস্তানের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যে হালে থাকেন সেই হালে কোনো কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীও থাকেন না বলে বঙ্গবন্ধুকে অভিযোগ করেছেন এক অস্ট্রেলিয়ান। একটি দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন অনিয়ম ঢুকে যায় তখন আর দেশটির উন্নতির কথা চিন্তা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু অবাক হয়েছেন চীনের এমন অভূতপূর্ব সাফল্য দেখে। তবে বঙ্গবন্ধু শুধু কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক অধিকার দেওয়ার নীতিটাকে সাধুবাদ দিতে পারেন নি।
বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন, তিনি কবি বা সাহিত্যিক নন। তাই তিনি যা দেখেছেন সেসব শুধু অনুভবই করেছেন, উপস্থাপন করে বোঝানো সম্ভব না। তবে যতটুকু উপস্থাপন করেছেন বেশ ভালোভাবেই। ভাষা বেশ সাবলীল। তৎকালীন চীন যে রাষ্ট্র হিসেবে ভবিষ্যতে সফল হবে তার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। যা আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি। পরিশেষে বলতে পারি নয়াচীনের জন্মের পর গ্রহণ করা বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজ ও সামাজিক-অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে বইটি আপনার চাহিদা মেটাবে। হ্যাপি রিডিং।
পড়ার পর মনে হচ্ছে, 'অনেকদিন ধরে একটা মরুতৃষ্ণা ছিল, যেটি বইটি পড়ার পর মিটে গেছে'।
"আমি কোন লেখক নই, অনুভব করতে পারি মাত্র, লেখার ভিতর দিয়ে প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা খোদা আমাকে দেন নাই"। এভাবেই কোন অনুভূতি প্রকাশ করার আগে পাঠকদের কাছ হতে ক্ষমা চেয়ে নেন। তাঁর লেখা গতানুগতিক লেখকদের মতো নই, অথচ, তাঁর লেখার মধ্যে নিজস্ব একটা ধরন(স্টাইল) আছে, সহজ-সাবলীল, পড়তে ভালো লাগে। এর আগে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইটি পড়েছিলাম, ভালোই লেগেছিল, তবে এটাই বেস্ট মনে হচ্ছে।
১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট সরকার 'মাও সে তুং' এর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয় চীন, যা 'নয়া চীন' নামে অভিহিত। ১৯৫২ সালে চীনের পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত, শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে যোগ দেন শেখ মুজিব। সদ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া চীনে, ভ্রমণ কাহিনী বলতে গিয়ে, সমাজকে কিভাবে দেখেছেন তা বলে গেছেন তাঁর সহজ সাবলীল ভাষায়। মহান নেতা মাও সে তুং এর নেতৃত্বে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল চিয়াং কাইশেকের পতন হয়। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে নয়াচীনে বিরাট পরিবর্তন আসে। ধনী-গরিব, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ব্যাবধনলান কমে আসে। নয়াচীন সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর, 'লাঙ্গল যার জমি তার' প্রথা প্রবতর্ন করে, বড় বড় জমিদারের জমি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের বণ্টন করা হল। শেখ মুজিব লেখেন,"নয়া চীনে এক খন্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদী অবস্থায় পড়ে আছে। রেললাইনের পাশে যে গর্ত গুলো পড়ে থাকে সেগুলোতেও ফসল করা হয়েছে। যদি কোন জমি ইচ্ছাকৃত পড়ে৷ থাকে, তাহলে সরকার কঠোর শাস্তি দেয়।" জনমত গঠন অথবা কঠোর আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে বেকার সমস্যা, ভিক্ষাবৃত্তি, ডাকাতি, আফিম নেশামুক্তি, বেশ্যাবৃত্তি সব নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটি দেশের জনগণেরর চিন্তাভাবনা, শিক্ষাব্যবস্থা, সরকারের প্রতি আনুগত্যতা, শিল্প কারখানাও বাজার ব্যাবস্থা, দুর্নীতি ইত্যাদি প্রতিটি বিষয় তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করে পাঠকদের কাছে তুলে ধরেন। হয়তো এরই মাঝে নিহিত ছিল নতুন দেশ ভাবনা।
১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে নয়া চীনের পিকিং-এ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তদানীন্তন পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলা থেকে শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। পূর্ববাংলা থেকে তাঁর ভ্রমণ-সঙ্গী ছিলেন পূর্ববাংলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ও ইউসুফ হাসান। নয়া চীন ভ্রমণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মিয়ানমার, ব্যাংকক ও হংকংও গিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে রাজবন্দী থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধু সেই ভ্রমণের সরস বিশ্লেষণ করেছেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে। ৩২ বছর বয়সের টগবগে তরুণ নেতার নয়া চীন ভ্রমণ; অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, বাস্তবতা-সবকিছু-ই দারুণ দক্ষতা ও পরম মমতায় লিপিবদ্ধ করেন। বয়স তখন তাঁর ৩৪ বছর।
১৯৫২ সালের অক্টোব��� মাস, বঙ্গবন্ধুর প্রথম চীন ভ্রমণ। নয়াচীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও সেতুং এর প্রতি সেদেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা, নয়াচীনের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক অবস্থা ও বাস্তবতা বঙ্গবন্ধু এ ভ্রমণে প্রত্যক্ষ করেন। চীন ভ্রমণের এসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন; যেখানে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান ও চীনের রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক অবস্থার তুলনা, কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা প্রভৃতি বিষয়াদি প্রাঞ্জলভাবে আলোচনা করেন। এটিই বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’।
উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দফতরের মন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তান সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি দ্বিতীয় বার চীন ভ্রমণ করেন।
চীন দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা বঙ্গবন্ধুর আগে থেকেই ছিল। গ্রন্থের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লেখেন:
“জেলে থাকতে ভাবতাম, আর মাঝে মাঝে মাওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও”।
আমার দেখা নয়া চীন গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথাই শুধু বলতে চাননি; বরং এই ভ্রমণের আদ্যোপান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে মনের ভিতর লালন-পালন করেছিলেন। একটা বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন তাঁর ভিতরও নিহিত ছিল। সদ্য স্বাধীন সাধের পাকিস্তান জন্ম লগ্ন থেকেই তা পূরণে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান নামক সদ্য স্বাধীন দেশে ৫৬ ভাগের বেশি মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে নিগৃহীত হচ্ছে, বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, নিপীড়ণের শিকার হচ্ছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে নয়া চীনের ঘুরে দাঁড়ানো বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার দালাল চিয়াং কাইশেকের নির্যাতন-নিপীড়নকে পরাভূত করে চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা মাও সেতুং এর হাত ধরে নয়া চীনে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, ধনী-গরীবের ভিতর যে সমতা এসেছে, একটা শোষণমুক্ত সমাজ গঠিত হয়েছে; তা বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। একটা শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রেরণা হয়তো বঙ্গবন্ধু এখান থেকে পেয়েছিলেন, যার ইঙ্গিত এই গ্রন্থে রয়েছে। মাঝে মাঝে নয়াচীনের নয়া শাসকদের রাষ্ট্রপরিচালনার বিভিন্ন ইতিবাচক দিকের সাথে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণের তুলনা করে পাকিস্থানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার মানুষের উপর যে বিমাতাসুলভ আচরণ করেই চলেছে, তা তুলে ধরেছেন।
নয়া চীনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৬৬ পৃষ্ঠায় লেখেন: “আমি লেখক নই, অনুভব করতে পারি মাত্র, লেখার ভিতর দিয়া প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা খোদা আমাকে দেন নাই।”
বঙ্গবন্ধু নিজেকে লেখক দাবি না করলেও তাঁর রচিত ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থটির প্রাঞ্জল বর্ণনা, জটিল বিষয়বস্তুকে সরলভাবে উপস্থাপন পাঠক-হৃদয়ে ছুঁয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছেন:
“এই ভ্রমণ কাহিনী অতি প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়ে তিনি পাঠকের জন্য উপভোগ্য করেছেন। প্রতিটি শব্দ, বাক্য রচনার যে পারদর্শিতা আমরা দেখি, তাতে মুগ্ধ হয়ে যাই।”
একজন তরুণ রাজনীতিকের উপলব্ধিতে এসেছে দারুণ সব অভিজ্ঞতার বয়ান এবং নয়া চীন রাষ্ট্রের সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের গল্প। বিপ্লবের পর সমাজে যে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়, বঙ্গবন্ধু নয়া চীন ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তা আত্মস্থ করেছিলেন এবং তার বাস্তব প্রয়োগের স্বপ্নও হয়তো তিনি অন্তরে বপন করেছিলেন, তার ইঙ্গিতও এ গ্রন্থে রয়েছে।
‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ নয়া চীনকে চেনানোর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু নিজেকেও চিনিয়েছেন ভিন্নভাবে। ভ্রমণ-কাহিনী পড়তে পড়তে পাঠকের যেন কোনরূপ বিরক্তি না আসে, সেজন্যে বঙ্গবন্ধু রসবোধের পরিচয় দিয়ে প্রধান অনুষঙ্গগুলোকে উপজীব্য করে তুলতে সঙ্গতিপূর্ণ ভ্রমণের মজার ঘটনাগুলোকে তুলে ধরেছেন। যেমন- গ্রন্থের ২৮ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লেখেন:
“আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই, ইলিয়াস ও আমি রাস্তায় বেড়াতে বেরিয়েছি। হঠাৎ ১৬/১৭ বৎসরের একটা মেয়ে আতাউর রহমান সাহেবের কোটে একটা গোলাপ ফুল লাগাইয়া দিতে অগ্রসর হয়। মেয়েটি কলারে হাতও দিয়াছে, খান সাহেব হঠাৎ যেন চমকাইয়া উঠলেন। পরে ধাক্কা দিয়া ফুল ছুঁড়ে ফেলে রাগে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে এগিয়ে চললেন। মেয়েটি আশ্চর্য হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের মতো যুবকদের দিকে নজর না পড়ে আপনার ওপর পড়ার কারণ কী? আতাউর রহমান সাহেব তো রাগে অস্থির, আর মানিক ভাই তো তাঁর ‘রাজনৈতিক মঞ্চের’ মতো ঘুরাইয়া ফিরাইয়া উনার পিছনে লাগলেন। আমরা খুব হাসাহাসি শুরু করলাম। বেচারা ভদ্রলোক রাগে শোকে দুঃখে কথা বলেই যেতে লাগলেন। উল্লেখ্য, হংকংয়ে ফুল দেওয়াটা হলো ‘প্রেম নিবেদন’।”
আবার গ্রন্থের ৩৮ পৃষ্ঠার ঘটনাটিও প্রণিধানযোগ্য: “মানিক ভাইয়ের কথা কিছু না বললে অন্যায় হবে। মানিক ভাই যে এত খেতে পারেন, সে ধারণা আগে আমার কোনোদিন ছিল না। হয়তো কোনোদিন একটা মুরগীই খেয়ে ফেলে, সাথে সাথে ডিম, মাছ, ফলফলাদি, বসে বসে শুধু খায় আর খায়। মানিক ভাই বলেন, “বেশি কথার কাম নাই। খাবার সময় গোলমাল করো না। চুপচাপ খাও, সময় পাওয়া গেছে। দেশে লীগ (মুসলিম লীগ) আমলে কী খেতে পাই মনে নাই।” রুমে ফিরে এসে আমি, আতাউর রহমান সাহেব ও মানিক ভাই খুব হাসাহাসি করতাম, মানিক ভাইয়ের খাওয়া নিয়ে। আমি আর আতাউর রহমান সাহেব মানিক ভাইয়ের পিছনে লেগেই থাকতাম।”
মহান নেতা মাও সেতুং এর নেতৃত্বে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল চিয়াং কাইশেকের পতন হয়। বিপ্লব পরবর্তী সময় নয়াচীনের মনোজগতে আসে এক বিরাট পরিবর্তন। ধনী-গরীব, মহাজন-কৃষক, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ব্যবধান কমে আসে। কৃষিজমি, কলকারখানা; মালিক-শ্রমিক, মহাজন-কৃষকের হয়ে ওঠে। নয়া চীন মাত্র তিন বছরে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে থাকে। গ্রন্থের ৫১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর বয়ানে-
“আমার একটা অভ্যাস আছে। নিজের দাড়ি নিজেই শেভ করি। কোনোদিন সেলুন বা কোথাও শেভ করি না। আমার যে ব্লেড ছিল তাহা হঠাৎ ফুরিয়ে গেল। আমি বাজারে গেলাম ব্লেড কিনতে। সমস্ত দোকান খুঁজলাম, ব্লেড পেলাম না। এক দোকানে তিন চার বৎসরের একটা পুরানো ব্লেড বের করলো তার উপরে জং পড়ে গেছে। দাড়ি তো দূরের কথা ‘চাড়িও’ (নখ) কাটবে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই সমস্ত পিকিং শহরে একটা ব্লেড পেলাম না, কারণ কী? দোকানদার ভাঙা ভাঙা ইংরেজি জানে। আমাকে বললো, বিদেশ থেকে এই সমস্ত জিনিস আমরা আনি না। আমাদের নিজেদের ঘরে যে ক্ষুর তৈরি হয় তা দিয়েই শেভ করি। যে পর্যন্ত আমরা ব্লেড ফ্যাক্টরি করে নিজেরা তৈয়ার করতে না পারবো, সে পর্যন্ত ব্লেড কেউই ব্যবহার করবো না। আমরা বিদেশকে কেন টাকা দিবো?”
বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চীনের নবযাত্রা শুরু হয়েছিল কম্যুনিস্টদের হাত ধরে। এই কম্যুনিস্টদের চীনের মানুষ ভালবাসতো না, ভয় পেত। কিন্তু অত্যাচারী চিয়াং কাইশেক এর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে চীনবাসী। তখন আইন বলে চীনে কিছু ছিল না। আইন ছিল চিয়াং কাইশেকের অনুসারী জমিদারদের হাতে। নারী-পুরুষ-শিশু কেউই এসব জমিদারদের হাত থেকে রেহাই পেত না। শ্রমিক-কৃষকরা মহাজন-মালিকদের দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। কৃষক জমির খাজনা না দিতে পারলে কৃষকের মেয়ে, বউকে তুলে নিয়ে কামনা চরিতার্থ করতো। চিয়াং কাইশেকের অনুসারীদের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করতে পারতো না। চিয়াং কাইশেকের নিষ্ঠুর নির্যাতন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘বেআইনী’ কম্যুনিস্টরাই চীনের জনগণকে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করলো। মানুষ কম্যুনিস্টদের অপছন্দ করলেও বাঁচার তাগিদে কম্যুনিস্টদের আহবানে সাড়া দিল।
নয়াচীন সরকার কায়েম হবার পর তারা ‘লাঙল যার, জমি তার’ প্রথা প্রবর্তন করলো। বড় বড় জমিদারের জমি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকের মধ্যে বণ্টন করা হল। অনাবাদি খাস জমিও কৃষকের মাঝে চাষের জন্য বণ্টন করে দেয়া হল। যখন কৃষক বুঝতে পারলো, এ জমিতে চাষ করলে কেউ আর ফাঁকি দিতে পারবে না, তখন তারা পুরো উদ্যমে চাষাবাদ শুরু করলো। শুরু হলো নয়াচীনের নবতর যাত্রা। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের পৃষ্ঠা: ৮৯-৯০ তে লেখেন-
“নয়া চিনে একখণ্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। রেললাইনের পাশে যে গর্তগুলি পড়ে থাকে সেগুলিতেও ফসল করা হয়েছে। যদি কোন জমি ইচ্ছাকৃতভাবে পড়ে থাকে তাহলে সরকার কঠোর শাস্তি দেয়।… কৃষক যে জিনিস উৎপাদন করে তার দাম আমাদের দেশের মতো কম হতে পারে না। আমাদের দেশে যখন ধান পাট চাষির ঘরে থাকে তখন দাম অল্প হয়। যখন মহাজনদের ঘরে থাকে তখন দাম বাড়তে থাকে। চাষি উৎপাদন খরচও পায়না। আর অন্যান্য জিনিস যা কৃষকের কিনতে হয়, যেমন নুন, তেল, কাপড়, এগুলির দাম এত বেশি থাকে আমাদের দেশে, যে কৃষক যা উৎপাদন করে তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না।
কিন্তু নয়াচীনে একটা সামঞ্জস্য বিধান করেছে, কৃষক যা বিক্রি করে তার দাম দিয়ে ভালোভাবে অল্প দামে তেল, নুন, কাপড় কিনতে পারে। এতে তাদের জমির ফসলের দাম দিয়েই সংসার চালানো সহজ হয়েছে। গরিবদের পাঁচ টাকায় এক মণ পাট বিক্রি করে ৪ টাকায় এক সের ডাল তেল কিনতে হয় না তাদের দেশে।
প্রত্যেক এলাকাতে সরকারি দোকান আছে সেখানে সস্তায় সমস্ত জিনিস পাওয়া যায়। কোন দোকানদার ইচ্ছা করলেই বেশি দাম নিতে পারে না। কারণ যদি লোকে জানতে পায় যে কোন দোকানদার বেশি দাম নিচ্ছে তখন তারা সরকারি কর্মচারীদের খবর দিয়ে নিজেরাই ধরাইয়া দেয় এবং মিটিং করে ঠিক করে ঐ দোকানদারের দোকানে কেউই জিনিসপত্র কিনতে পারবে না। এতে চাষিদের যথেষ্ট উপকার হয়েছে। দেশের ভিতর গণজাগরণ এসেছে বলে এটা সম্ভবপর হয়েছে।”
শুধু আইন করে নয়; জনমত গঠন, মানবীয় ব্যবহার, প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় কঠোর আচরণ, কর্মসংস্থান-বাসস্থান সৃষ্টির মধ্যদিয়ে নয়াচীন ভিক্ষাবৃত্তি, বেকার সমস্যা, ডাকাতি, আফিম নেশামুক্তি, বেশ্যাবৃত্তিকে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছিল। সেজন্য বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন:
“আইন করে কোনো অন্যায় কাজই বন্ধ করা যায় না, অন্যায় বন্ধ করতে হলে চাই সুষ্ঠু সামাজিক কর্মপন্থা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও নৈতিক পরিবর্তন।”
মাত্র ৩ বছরের মধ্যে চীন সরকার ও তাদের জনগণ এক হয়ে কাজ করে দেশটিকে বদলে ফেলেছে; যা বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষ করে চীনের জনগণের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য, দেশের প্রতি ভালোবাসা দেশপ্রেম- বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছে। এ বিষয়গুলি বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের ৯১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:
“সরকার ডাক দিলো- একশত মাইল একটা রাস্তা করতে হবে। তোমাদের যথেষ্ট অসুবিধা হতেছে; সরকারের অত টাকা নাই, তাই তোমাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরই করাই উচিত। প্রত্যেকের আসতে হবে, অন্তত দু’দিন কাজ করে দিতে হবে। সমস্ত লোক এসে কাজ শুরু করল, সরকার তাদের খাবার দিল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক মাসের ভেতর সমস্ত রাস্তা করে দিল। এইভাবে নয়াচীনে হাজার হাজার গঠনমূলক কাজ জনসাধারণ করেছে, কারণ জনসাধারণের আস্থা আছে সরকারের ওপরে এবং মনে করে একাজ তাদের নিজেদের।”
চীনের জনগণের চরিত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৬৪ পৃষ্ঠায় লেখেন: “এদেশের লোকের মনে অহংকার নাই। সকলকেই আপন করতে চায়। সকলেই মনে করে ‘রাষ্ট্র আমাদের’-একে গড়ে তুলতে হবে। ”
মাত্র তিন বছরের মধ্যে চীনের শিক্ষা ব্যবস্থায় আসে আমূল পরিবর্তন। সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ছিল। এজন্য বঙ্গবন্ধু চীন ভ্রমণে গিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে লিখেছেন:
“আমাদের দেশের মতো কেরানী পয়দা করার শিক্ষাব্যবস্থা আর নাই। কৃষি শিক্ষা, শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনিক্যাল শিক্ষা দেয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেখানে আমার সাথে আলাপ হল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মি. হালিমের। তাঁর একটা চীনা নামও আছে, সেটা আমার মনে নেই। তিনি আমাকে বললেন, বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছি। প্রত্যেক ছেলে মেয়েকে স্কুলে দিতে হয়। সরকার তাদের যাবতীয় খরচ বহন করে। কৃষকদের জন্য কৃষি স্কুল করা হয়েছে। আমাকে একটা স্কুল দেখানো হয়েছিল, সেখানে যুবকদের কিছুদিনের জন্য শিক্ষা দিয়ে খামার জমিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শ্রমিকদের জন্য স্কুল করা হয়েছে। প্রত্যেক শিল্প কেন্দ্রের কাছে স্কুল আছে। বড়দের শিক্ষা দেয়া হয় কাজের ফাঁকে, আর তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য আলাদা বন্দোবস্ত আছে। সকল দিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, মাত্র ৪ বৎসরে তারা শতকরা ৩০ জন লোককে লেখাপড়া শিখিয়ে ফেলেছে। গর্ব করে আমাকে আবার বললো, দশ বছর পরে যদি চীনে আসেন তবে দেখবেন একটা অশিক্ষিত লোকও নাই।”
এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু পৃষ্ঠা: ৬০-এ একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে নয়াচীনের ইতিবাচক ভবিষ্যতের কথা ব্যক্ত করেন: “এক এক দেশে এক এক প্রকারের ‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণি’ (প্রিভিলেজড ক্লাস) আছে- যেমন আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’, অন্যদেশে শিল্পপতিরা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’; কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাই ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’। এই ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’টা সরকারের নানা সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকে। নয়াচীন সরকারের হুকুম, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হবে, একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে, সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেইভাবে পোশাক দিতে হবে। যাদের দেবার ক্ষমতা নাই, তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য করবে। এভাবেই নতুন মানুষের একটা জাত গড়ে তুলছে নয়াচীন। ১৫-২০ বৎসর পরে এরা যখন লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে, তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে?”
চীনের শান্তি সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ শান্তির সপক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও বক্তব্য রাখেন। সফরসঙ্গী হিসেবে পাকিস্তান এবং পূর্ব বাংলা থেকে যে সকল প্রতিনিধিবৃন্দ শান্তি সম্মেলনে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যেও কয়েকজন বক্তব্য প্রদান করেন। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা তাদের নিজ ভাষায় বক্তব্য প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। পশ্চিম বঙ্গ থেকে আসা লেখক মনোজ বসুও বাংলায় বক্তৃতা করেন। কিন্তু অনেকে মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন, যা বঙ্গবন্ধুর ভাল লাগে নাই। উল্লেখ্য করা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। তারও ২২ বছর আগে তরুণ শেখ মুজিব চীনের শান্তি সম্মেলনে বাংলায় বক্তব্য প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৪৩ পৃষ্ঠায় লেখেন:
” বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান ও ইলিয়াস বক্তৃতাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।”
নয়াচীন ভ্রমণকালে বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ করেছেন, নয়াচীনে নারী-পুরুষ প্রকৃত অর্থেই সমানাধিকার ভোগ করছে। নারী-পুরুষ সমানভাবে দেশের জন্য কাজ করছে, আয়-রোজগার করছে; কেউ কারও উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে না। সমাজ থেকে নারী-পুরুষ সমান সম্মান পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের পৃষ্ঠায় খেদ কর��ই বলেছেন:
“আমাদের দেশের কথা চিন্তা করে দেখুন। যদিও আইনে আমাদের দেশে নারী পুরুষের সমান অধিকার, তথাপি আমাদের দেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত লোকের মনে এই ধারণা যে, পুরুষের পায়ের নিচে মেয়েদের বেহেশত। পুরুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। মেয়েদের নীরবে সব অন্যায় সহ্য করতে হবে বেহেশতের আশায়। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মেয়েদের নির্ভর করতে হয় পুরুষদের অর্থের ওপর। কারণ আমাদের দেশে অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত কিছু সংখ্যক মোল্লা পর্দা পর্দা করে জান পেরেশান করে দেয়। কোনো পরপুরুষ যেন মুখ না দেখে। দেখলে আর বেহেশতে যাওয়া হবে না।… ইসলামিক ইতিহাস পড়লে জানা যায় যে, মুসলমান মেয়েরা পুরুষদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যেত, অস্ত্র এগিয়ে দিতো। আহতদের সেবা শুশ্রূষা করতো। হজরত রসুলে করিমের (সা.) স্ত্রী হজরত আয়েশা সিদ্দিকা নিজে বক্তৃতা করতেন, ‘দুনিয়ায় ইসলামই নারীর অধিকার দিয়াছে’।”
তরুণ বয়সেই বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতায় রূপান্তরিত হচ্ছিলেন; এ গ্রন্থ তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গ্রন্থের ৬৩ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:
“যাক বাবা, আমেরিকার বিরুদ্ধে সত্যকথা লিখে বিপদে পড়তে চাই না, কারণ আজ আমেরিকা পাকিস্তানের ‘একমাত্র বন্ধু’। এক মুসলিমলীগের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলেই প্রত্যেক বৎসর জেল খাটি। আবার এদের বিরুদ্ধে বলে কি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলবো?”
১৯৫২ সালে চীন ভ্রমণকালে বঙ্গবন্ধু গভীর দৃষ্টি দিয়ে নয়াচীন পর্যবেক্ষণ করেন। চীন সম্পর্কে কিছু ভবিষ্যৎ বাণী তিনি এ গ্রন্থে দিয়েছিলেন। বিশ্বে বর্তমান চীন রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর সেই ভবিষৎবাণী আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে।
ঠিক এই মুহূর্তে অনেক গুলো কারণে চীনে যেতে ইচ্ছে করছে। চীনের কথা বললেই একটা বাঁশির সুর কানে ভাসে। সেই সুরটাকে আমি চীনা সুরই বলব। কেন জানি মনে হয় ওইখানে অনেক শান্তি শান্তি টাইপ আবহাওয়া আছে। মনের মধ্যে চীন মানেই গাছগাছালির পাহাড় আর পাহাড়ের মধ্যে লম্বা লম্বা বাঁশ আছে এইরকম একটা ছবি আছে। কেউ একজন কচি বাঁশের কোরল রান্না করছে আর ফ্রেশ শাকসবজি কালেক্ট করছে। হয়তো আমি অনেক বেশি ইউটিউব ভিডিও দেখি এইজন্য এমনটা মনে হচ্ছে। যাইহোক, প্ল্যান ছিল 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী ' বইটা পড়ে শেষ করব। সেই একাদশ শ্রেনিতে বাংলা বইয়ের প্রবন্ধ পড়ার পর থেকেই প্ল্যান। কিন্তু যবে থেকে ভাইয়া ভাবিকে 'কারাগারের রোজনামচা' গিফট করলেন মনে হয় তবে থেকে নাকি অন্য কোন কারণে হুট করেই মনে হলো শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা সবগুলো বই পড়তে হবে। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটা পড়া শেষ না করেই এই বইটা হাতে নেই আর একদিনেই পুরো বইটা পড়লাম। বইটায় খুব সহজ, সাবলীল ভাষায় মুজিবুর রহমান উনার চীন ভ্রমনের কথাগুলো তুলে ধরেছেন। লেখক মুজিবুর রহমানকে আমার ভালোই লাগে। উনার অবজারভেশন সুক্ষ্ম। উনি যদি এত বড় নেতা না হয়ে শুধু লেখক হতেন তাহলেও দেশ বিদেশে অনেক নাম করতেন। বাংলা সাহিত্য আরো সমৃদ্ধ হতো। সাইজের দিক দিয়ে বইটা খুব বেশি বড় না। কিন্তু মানের দিক দিয়ে সেরা। এইরকম বই আসলে সকল বাঙালিরই পড়া উচিত। উনার বইগুলো পড়লে পজিটিভ মাইন্ডসেট তৈরি হয়। চীনের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে নয়াচীন বইটার তুলনা করব না। কিন্তু এতগুলো বছর আগে নয়াচীন কেমন ছিল জানতে ভালোই লেগেছে। বইটা পলিটিক্যালি বায়াস্ড না তাই ছোট বড় যেকেউ পড়তে পারে।
১৪ বৎসরে রাজনীতিতে আমার শিখবার ও দেখবার যথেষ্ট সুযোগ হয়েছে। পূর্বে শুনতাম, দারোগা পুলিশের মতো ঘুষ কেউ খায়না। তারপর শুনতাম,সিভিল সাপ্লাইয়ের মতো ঘুষ কেউ খায়না,তারপর শুনতাম কাস্টমস অফিসারদের মতো ঘুষ কেউ খায়না। আমি কয়েক বৎসর রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি,তাতে জেলখানার ঘুষের মতো বৈজ্ঞানিকভাবে ঘুষ বোধ হয় কোনো ডিপার্টমেন্ট এর কর্মচারীরা নিতে জানেনা। কোনো দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মচারীর উপায় নাই সে ঘুষ ধরে! জেলখানা,পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট, কাস্টমস,কোর্ট-কাচারি,সাব রেজিস্ট্রার অফিস,ইনকাম ট্যাক্স,কারো চেয়ে কেউ কম নাহ,এই ধারণাই আমার শেষ পর্যন্ত হয়েছে। জাতির নৈতিক পরিবর্তন ছাড়া ও সুষ্ঠু কর্মপন্থা ছাড়া দেশ থেকে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এই দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করা দরকার। নিরাপত্তা আইন যদি ব্যবহার করতে হয় তবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে জনসাধারণের এই নিরাপত্তা আইনের কোন সমালোচনা করতো না। সকলের চেয়ে দুঃখের কথা হলো, এমন অনেক দুর্নীতিপরায়ণ নেতা দেশে আছে যারা শাসকগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলাইয়া চোরাকারবার করে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে। যখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো সৎ কর্মচারী মামলা দায়ের করতে চায় তখনই বড় বড় মন্ত্রীরা এই সমস্ত কর্মচারীদের বদলি করে মামলা ধামাচাপা দেয়।
নয়াচীন থেকে দুর্নীতি তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে এই কারণে যে, রাষ্ট্রের কর্ণধাররা ঘুষ দুর্নীতি তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। আমি নয়াচীনে একটা ঘটনা শুনছিলাম যে, মাও সে তুংয়ের একজন প্রধান বন্ধু এবং নয়াচীনের নেতা দুর্নীতি কে প্রশ্রয় দিয়েছিল বলে তাকে বিচার করে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। ইচ্ছা করলে মাও সে তুং তাকে রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু বিচারে যাকে ফাঁসির হুকুম দিয়েছে তাকে রক্ষা করা অন্যায়। ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফাদের সময় এইভাবে ভাইকেও অন্যায় করলে খলিফারা ক্ষমা করতেন না। দরকার হলে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করতেন। এরকম বহু ইতিহাস আছে।দুঃখের বিষয় কয়েকজন মুসলিম নামধারী নেতা পবিত্র ইসলামের নাম ব্যবহার করে দুর্নীতি,ঘুষ ও চোরাকারবারিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। নিজেরাও অনেক লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেছে। দেশের রাষ্ট্রনায়করা যদি দুর্নীতিপরায়ণ হয় তবে আর দেশের কর্মচারী ও জনগণ দুর্নীতিপরায়ণ কেন হবে না?
দুর্নীতি সমাজের ক্যানসার রোগের মতো। একবার সমাজে এই রোগ ঢুকলে সহজে এর থেকে মুক্তি পাওয়া কষ্টকর।আমাদের দেশের বিচারে একটা লোক আরেকজনকে হত্যা করলে বিচারে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। ডাকাতি করলে বা চুরি করলে কয়েক বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। একটা লোক হঠাৎ রাগের বশবর্তী হয়ে আরেকটা লোককে হত্যা করলো,যাকে হত্যা করা হয় তার সংসারটা খতম হয়ে যায়। কারণ,সেই লোকটার ওপর সমস্ত সংসার নির্ভর করে। কিন্তু চোরাকারবারিকে ফাঁসি দেওয়া হয়না,ফাঁসি যদি কাহাকেও দিতে হয়,তবে চোরাকারবারি ও দুর্নীতিপরায়ণ লোকদেরই দেয়া উচিত। একজন চাউলের চোরাকারবারি লক্ষ লক্ষ মন চাউল জমা রেখে লক্ষ লক্ষ লোককে না খাইয়ে মারে। আরেকজন কে হত্যা করলে যদি ফাঁসি হয়, তবে হাজার হাজার লোকের যারা মৃত্যুর কারণ তাদের কী বিচার হওয়া উচিত?ধরুন,একজন কাপড়ের চোরাকারবারির জন্যে অনেক মহিলা ইজ্জত রক্ষার সামান্য কাপড় জোগাড় করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। তবে তার বিচারে কী হবে? সে তো লক্ষ লক্ষ নারীর জীবন ও ইজ্জত নষ্ট করেছে। আমি জানি আমাদের দেশের এক স্বনামধন্য মুসলিমলীগ ওয়ালা একমাত্র কাপড়ের চোরাকারবার করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেছে। তবে ইলেকশনে দাঁড়াইয়া লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেও ভোট পান ন��ই।তার ���িরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্যে সরকারি কর্মচারীরা চেষ্টা করেছিল, তখন তাদের বদলি করে দিয়ে সেই চোরাকারবারি কে রক্ষা করা হয়েছিল। এমনকি শোনা যায় যে, ফাইলগুলি পূর্ব বাংলা থেকে উড়ে করাচি চলে গিয়েছিল এবং কোনো এক মন্ত্রীর বাক্সের মধ্যে ফাইলগুলি আটকাইয়া রাখা হয়েছিল। এতবড় যেখানে দুর্নীতি যেখানে সেখানে সরকারি কর্মচারীরা কোন সাহসে বড় বড় চোরাকারবারিদের গায়ে হাত দেবে? উল্লিখিত লিখাটিঃ বই এর পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫ হতে গৃহীত। সেই ১৯৫৪ সালে বসে জাতির মহান নেতা ২০২০ সালের প্রেক্ষাপট রচনা করে বসে থাকলেন, আর যার প্রকাশ কিনা তার জন্মশত বার্ষিকীতেই হলো। ব্যক্তিগতভাবে আমার বইটি ভালো লেগেছে, সে সময়কার নব্য কমিউনিস্টদেশ চীনের অবস্থা এবং সেই সরকারের দৃষ্টি ভঙ্গি আর তা নিয়ে শেখ মুজিবুরের নিজস্ব ভাবনা আর পাশাপাশি নয়াচীনের সরকারের প্রোপাগান্ডা নিজ গুণে যাচাই। আর তৎকালীন পূর্ব বাংলা আর পশ্চিম বাংলার কিছু সামাজিক সমস্যার কথাও তুলে ধরেন তিনি। বিশেষ যে দিকটি লক্ষণীয় তিনি নারীর অধিকার নিয়ে মৃদু সোচ্চার ছিলেন এই পুস্তকে। রাজনীতি সচেতন যে কেউই পড়ে নিতে পারেন বইখানা।
This entire review has been hidden because of spoilers.
বইটি মূলত ভ্রমণকাহিনি। তবে প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক নিদর্শনের চাইতে বেশি ফুটে ওঠেছে চীন দেশের জীবনচিত্র। এখানে প্রকাশ পেয়েছে লেখকের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব, চিন্তাধারা। লেখক চীনের তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনার সাথে তুলনা করেছেন পাকিস্তানের সাথে। বইটির ভাষা প্রাঞ্জল, রসবোধ সম্পন্ন। সহজ সাবলীল বর্ণনা জুড়ে দিয়েছে আরো খানিকটা মুগ্ধতা।
কিছু ভালো লাগার উক্তি: "জাতির আমূল পরিবর্তন না হলে দেশ থেকে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা কষ্টকর।"
"দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।"
"আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লেখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন।"
"যাক বাবা, আমেরিকার বিরুদ্ধে সত্যকথা লিখে বিপদে পড়তে চাই না, কারণ আজ আমেরিকা পাকিস্তানের 'একমাত্র বন্ধু'। এক মুসলিম লীগের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলেই প্রত্যেক বৎসর জেল খাটি। আবার এদের বিরুদ্ধে বলে কি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলবো?"
"আমার কাছে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। আমার আবার পরিচয় কী? কী বলতে পারি? বললাম, এমনি ঘুরে বেড়াই, দেশ বিদেশ দেখি। মনে মনে বলি, 'আমার আবার পরিচয়? পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বক্তৃতা করে বেড়াই। আর মাঝে মাঝে সরকারের দয়ায় জেলখানায় পড়ে খোদা ও রসুলের নাম নেবার সুযোগ পাই। এই তো আমার পরিচয়।"
His verbal IQ must have been very high. It comes across not only in his burning speeches but even in his writings as well. উনার লেখা তিনটা প্রকাশিত বইয়ের ক্ষেত্রেই, একবার ধরার পর আর থামতে পারিনি। চুম্বকের মত টেনে রাখে লেখনী। ব্যক্তিত্বের জোর তো আছেই, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও অবাক করার মত। চীনের লাল বিপ্লবের মাধ্যমে ১ অক্টোবর ১৯৪৯ এ নতুন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গঠনের মাত্র ৩ বছর পরের ঘটনাবলীর বিবরণ। অনেক কিছুই শিখলাম, জানলাম।
এই বইটি শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন শুরুর বই। বইতে তিনি চীনের পরিবেশ ও তার মানুষগুলোর বর্ণনা মোটামুটি করতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু তার নিজের রাজনৈতিক ধারণার সাথে কীভাবে সম্পর্কিত তা উল্লেখ করেননি। তার নিজের ধারণা ও চিন্তা বইতে অত্যন্ত অস্পষ্ট এবং বেশীরভাগ জায়গাতেই অনুপস্থিত। আমি নিজে লিখলে এর চেয়ে ভালো লিখতে পারতাম।
চীনে পাকিস্তানের হয়ে বঙ্গবন্ধু যান। আর ওখানকার অবস্থান বর্ণনা করেন। ভালোই লাগলো।
"আইন করে কোন অন্যায় কাজ বন্ধ করা যায় না, অন্যায় বন্ধ করতে হলে চাই সুষ্ঠু সামাজিক কর্মপন্থা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও নৈতিক পরিবর্তন " -শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর তীক্ষ্ণ নজরে নয়াচীনের উন্নতি এবং এর পিছনের কারণ দেখতে গিয়ে আমার মাথায় এসেছিলো এই সফরের স্মৃতিই কি উনাকে ৭৫ এ বাকশাল গঠন করার জন্য উস্কে দিয়েছিলো? যদি উনি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারতেন তাহলে কেমন হতো দেশের অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আত্মজীবনী বলতে আমরা সাধারণত লেখকের আত্মকথনকে বুঝে থাকি। কিন্তু কখনো কখনো লেখকের লেখনশৈলীর বদৌলতে বইটির গণ্ডি এই সাধারণ নীতিকে অতিক্রম করে; বিশেষত তা যদি হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো লেখা! তাঁর লেখনীতে জাতীয় ইতিহাসের বর্ণনা যে লেখকের নিজের জীবনের ইতিহাসকে ছাপিয়ে যাবে, তা অতি সহজেই অনুমেয়। বলছিলাম, বঙ্গবন্ধুর লেখা তৃতীয় আত্মজীবনী "আমার দেখা নয়াচীন" বইটির কথা। বঙ্গবন্ধুর লেখা অন্য দুইটি আত্মজীবনীর মতো এটার ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালে স্মৃতিনির্ভর এ ভ্রমণকাহিনি রচনা করেন।
১৯৫২ সালে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু গণচীন সফরে যান এবং সেখানে অনুষ্ঠিতব্য 'পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান এন্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স' (এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন)-এ যোগদান করেন। এ সফরকালে তিনি গণচীন ও হংকংয়ের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখেন। এ ভ্রমণের ইতিবৃত্ত তিনি এই বইটিতে তুলে ধরেছেন। এই ভ্রমণের বর্ণনা দিতে গিয়ে একদিকে স্বৈরতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে সদ্য মুক্তিলাভ করা চীনের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বর্ণনা যেমন উঠে এসেছে, ঠিক তেমনিভাবে তৎকালীন পাকিস্তানের (বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের) নানা বিষয়ের বর্ণনা একই সমান্তরালে তাঁর লেখনীতে ঠাঁই করে নিয়েছে। সে বিবেচনায় বইটিকে আত্মজীবনীর পাশাপাশি সুপাঠ্য ভ্রমণকাহিনী বললেও বোধহয় খুব একটা অত্যুক্তি হবে না!
নিজস্ব ঢঙে লেখা এই বইটিতে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন গণচীনের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বরাবরের মতো তাঁর প্রাঞ্জল ও সরল ভাষারীতিতে লেখার পরিচয় দিয়েছেন। শব্দচয়ন ও ভাষারীতিতে মুন্সিয়ানার ছাপও পাওয়া যায় এতে। পাশাপাশি তিনি শুরুর দিকে লেখক হিসেবে নিজের অপারগতার কথা বলেছেন, যা তাঁর বিনয়ের পরিচায়ক। তাঁর ভাষায়, "আমি লেখক নই; অনুভব করতে পারি মাত্র, লেখার ভিতর দিয়া প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা খোদা আমাকে দেন নাই।"
যাহোক, এই বইটিতে তিনি মূলত চীনাদের স্বদেশপ্রেম এবং জাতিগত দায়বদ্ধতার বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন। স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর অল্প সময়ের মধ্যেই তারা কীভাবে স্বদেশপ্রেমে বলিয়ান হয়ে উন্নত জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করেছে এবং কীভাবে তারা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, সে বিষয়টিই তাঁর লেখনীতে বারবার ঘুরে-ফিরে উঠে এসেছে। তাদের এমন আত্মনির্ভরশীলতার বিষয়টি নজির হিসেবে উল্লেখ করে তা থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে লেখক বারবার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যকার নানা অবিচার ও বৈষম্যের চিত্র তিনি অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। এছাড়াও প্রসঙ্গক্রমে লেখকের নানা ব্যক্তিগত দর্শন ও মতামত তাঁর স্বগতোক্তিতে বারবার উঠে এসেছে। যেমনঃ * জনগণের সমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না। * শ্রমিকের উপহার, দিনমজুরের উপহার, পরিশ্রম করে তা দিয়ে যে উপহার দেওয়া হয় সেটাই সকলের সেরা এবং মূল্যবান। অর্থমূল্য দেখে উপহারের বিচার করতে হয় না। * শুধু জুলুম ও আইন করে এই সমস্ত অন্যায় কাজ বন্ধ করা যায় না, এর সাথে সুষ্ঠু কর্মপন্থারও প্রয়োজন। * পেটে খাবার না থাকলে কোনো ধর্ম কথায়ই মানুষ ঈমান রাখতে পারে না। * আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা নাহলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।
একখানি সুপাঠ্য বইয়ের গুরুত্ব ঠিক কতখানি, সে ব্যাপারে আলাদা করে কিছু বলবার নেই। তেমনিভাবে, বঙ্গবন্ধুর লেখা ইতিহাসের এই অনবদ্য দলিল ঐতিহাসিক গুরুত্বের সীমানা ছাড়িয়ে এক অনন্যসাধারণ সাহিত্য মর্যাদা লাভ করেছে। দল-মত নির্বিশেষে বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি পাঠকের জন্য এমন অনবদ্য লেখা পড়া অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এ প্রসঙ্গে আর.ডি. কামিংয়ের উক্তি প্রণিধানযোগ্যঃ "একটি ভালো বইয়ের কখনোই শেষ বলতে কিছু থাকে না।"
এক নজরে বইটি সম্পর্কিত তথ্যঃ বইয়ের নামঃ আমার দেখা নয়াচীন লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান বইয়ের ধরনঃ আত্মজীবনী প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমি প্রথম প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ প্রচ্ছদঃ তারিক সুজাত পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৯৯ মুদ্রিত মূল্যঃ ৪০০ টাকা ISBN No: 978-984-07-6151-7
আমরা জানি, ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধু দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে: ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (২০১২) ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ (২০১৭)। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কারাগারে লেখা বঙ্গবন্ধুর দুটো দিনপঞ্জি জব্দ করে, যা ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সময়কালে রাজবন্দী হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকাকালে লেখা। সেই বিবেচনায় প্রকাশের দিক থেকে ‘আমার দেখা নয়াচীন’ তৃতীয় হলেও রচনার দিক থেকে এটিই বঙ্গবন্ধুর প্রথম লেখা। ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে এই স্মৃতিনির্ভর ভ্রমণকাহিনিটি তিনি লেখেন। ১৯৫২ সালের ২ অক্টোবর থেকে ১২ অক্টোবর চীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট চিনের আত্মপ্রকাশ ঘটে, ঠিক এরপরই বঙ্গবন্ধুর এই চীন সফরের ঘটনা। দ্বিতীয়বার তিনি চীনসফরে যান ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে। তখন তিনি শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দপ্তরের মন্ত্রী। তবে সে ভ্রমণের কোনো লেখা পাওয়া যায় নি। এই বইতে আমরা দেখি, বঙ্গবন্ধু পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকেই ভবিষ্যৎবাণী করেন, ‘চীন একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে।’ আজ তাঁর সেই দূরদৃষ্টি আমাদের বিস্মত করে। শুধু তাই নয়, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি এই ভ্রমণকাহিনিতে গণচীনের শাসনব্যবস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিবর্গের বক্তব্যের সারকথা তুলে ধরেন। এমনকী যাত্রাপথে যাওয়ার সময় যে দেশে যাত্রাবিরতি দিয়েছেন, সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থার সম্পর্কেও কিছু কথা তুলে ধরেছেন। পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে চলে আসে বাংলাদেশের কথাও। একেবারে শুরুতেই তিনি বলছেন, ‘অনেকে বলতে পারেন কম্যুনিস্টদের শান্তি সম্মেলনে আপনারা যোগদান করবেন কেন?...কথাটা সত্য যে আমরা কম্যুনিস্ট না। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি।...কারণ যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয় তা আমরা জানি...।’ এরপরেই তিনি স্বাধীন দেশ হিসেবে পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পরও আমাদের অতৃপ্তি এবং কষ্ট কোথায় সেটা বোঝাতে তিনি বলছেন, “কথা সত্য, ‘পাকিস্তান’ নামটা পেয়েছি কিন্তু; আর কতটুকু স্বাধীন হয়েছি আপনারা নিজের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন।” তবে এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু নিজেদের দুরবস্থার কথা বলেননি। তিনি বিশ্বের কাছে সেসব উপস্থাপন করে ছোট হতে চাননি। আত্মমর্যাদা বোধের পাশাপাশি তাঁর বিনয়ের দৃষ্টান্তও আমরা পাই। তিনি ভ্রমণপথের ভূদৃশ্যের চমৎকার বর্ণনা দেওয়া পাশাপাশি এও বলে নিচ্ছেন: ‘আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লেখতে পারছি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন।’ বঙ্গবন্ধু এই সম্মেলনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বইতে লেখেন: ‘...আমিও বক্তৃতা করলাম বাংলা ভাষায়। ভারতবর্ষ থেকে বক্তৃতা করলেন মনোজ বসু বাংলা ভাষায়। বাংলা আমার মাতৃভাষা, মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে।...দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।’ বঙ্গবন্ধুর সূক্ষ্ম রসবোধ আমাদের প্রায়ই চোখে পড়বে। তিনি সফরসঙ্গী তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) সম্পর্কে একটি জায়গায় বলছেন, ‘মানিক ভাই ভালো লিখতে পারেন, কিন্তু এত যে খেতে পারেন তা আগে জানতাম না।...জিজ্ঞাসা করলাম, মানিক ভাই পেটে কী হলো? বললেন দুর্ভিক্ষ হয়েছে।’ বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সম্পাদনা করেছেন প্রাবন্ধিক চিন্তক শামসুজ্জামান খান। বইয়ের বিশেষ সংযোজন হলো বঙ্গবন্ধুর লিখিত ডায়েরির কয়েকটি পাতা এবং সফরের ছবি।