মানুষের নুতন দেশ দেখার বাশনা কতকটা নেশার মতো। কেউ সে সুযোগ পান, কেউ পান না। কিন্তু সখ সবারই সমান। যারা ভ্রমণ করেন, তাদের একটা সঙ্গীর দরকার, যে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর জন্য ভ্রমণ-কাহিনীই সবচেয়ে ভাল সঙ্গী। আর যারা বাড়িতে বসে ভ্রমণের আনন্দ পেতে চান, তাঁদের কাছেও ভ্রমণ-কাহিনী অপরিহার্য। এঁদের সবার জন্য লেখা হয়েছে রম্যাণি বীক্ষ্য। পর্বে পর্বে এই গ্রন্থ রচনা করে লেখক শ্রীসুবোধকুমার চক্রবর্তী শুধু রবীন্দ্রপুরস্কারেই সম্মানিত হন নি, গত কয়েক বৎসরে বাংলার ভ্রমণ সাহিত্যকে অভাবনীয় রূপে জনপ্রিয় করে তুলেছেন।
"রম্যাণি বীক্ষ্য" নামটি কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তলমের একটা শ্লোকের প্রথমাংশ। রবীন্দ্রনাথ এর অনুবাদ করেছেন 'সুন্দর নেহারি'। তার মানে, নানা রম্য স্থান প্রত্যক্ষ্য করে মনে যে ভাব এল, তারই অভিব্যাক্তি এই রচনায়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেখানে যা কিছু মনোরম দ্রষ্টব্য স্থান আছে, সাবলীল ভাষায় ও মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গ্রন্থকার এক ধারাবাহিক ভারত দর্শনের কাহিনী পাথকের সামনে উপস্থিত করেছেন। এই গ্রন্থে ভারতের পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ই শুধু নয়, বর্তমানের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আলোচনাও আছে। তীর্থ-মাহাত্ম্যের পৌরাণিক বিবরণ দিতে গিয়ে বিদগ্ধ গ্রন্থাকার মন্দির-স্থাপত্য ও তার কিংবদন্তি জনশ্রুতিকেও আলোচনার বলয়ের মধ্যে টেনে এনেছেন। এতে নুতন ও পুরাতন কাল মিলিয়ে ভারতের একটি সামগ্রিক রূপ পাঠকের দৃষ্টির সমক্ষে উদ্ঘাটিত হয়েছে।
কিন্তু শুধুমাত্র ভ্রমণ-বিবরণই এই গ্রন্থের বিশিষ্ট নয়। ভ্রমণ-কাহিনীর সঙ্গে একটি জীবন-ঘনিষ্ট কাহিনীও বইগুলির ভিতর এক অপুর্ব স্বাদের সঞ্চার করেছে। ভ্রমণে যারা উৎসাহী নন, জীবনে যারা শুধুই প্রাণরসেরই সন্ধানী, উপন্যাসের রসের আকর্ষণে তারাও এই গ্রন্থের প্রতিটি পর্ব সাগ্রহে পাঠ করবেন। ভ্রমণ-রসসিক্ত উপন্যাস অথবা উপন্যাস-রসসিক্ত ভ্রমণ- এই দুই নামেই বইগুলিকে অভিহিত করা চলে।
ধনী মামা অঘোর গোস্বামী, তাঁর স্ত্রী, ও অনুঢ়া কন্যা স্বাতিকে নিয়ে দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের জন্য হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে এসেছেন। এই সময় প্লাটফরমে অপ্রত্যাশিত ভাবে এক পাতানো ভাগ্নে গোপালের সঙ্গে দেখা। গোপাল লোকাল ট্রেনের যাত্রী, কেরানীর কাজ করে কলকাতায়। মার্জিত রুচি ও শিক্ষায় তার আত্মপ্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত। মামা মামী তাকে সঙ্গী হবার অনুরোধ জানালেন, আর স্বাতির দৃষ্টিতে গোপাল আবিষ্কার করল এক আন্তরিক আবেদন। চলতি ট্রেনে তাকে উঠে পড়তে হল।
প্রথম গ্রন্থ "অন্ধ্র পর্বে" ভ্রমণের অবকাশে স্বাতি ও গোপাল এল দুজনের কাছাকাছি। গোপালের চারিত্রিক বলিষ্ঠটা ও বিদ্দ্যাবত্তায় স্বাতি প্রথম থেকেই মুগ্ধ হয়েছিল, কিন্তু সমাজ ও মনের দুরকম প্রয়োজনে স্বাতির চরিত্র হয়ে উঠেছে বিশিষ্ট। ওয়াল্টেয়ার ও সীমাচলমে, বিজয়ওয়াড়া ও মঙ্গলগিরিতে, অমরাবতী নাগার্জুনসাগর ও তিরুপতিতে আমরা দুজনকে দেখি পাশাপাশি।
"তামিল পর্বেও" তারা একত্র আছে- মাদ্রাজ মহাবলীপুরম ও পক্ষীতীর্থে, কাঞ্চীপুর ও তাঞ্জোরে, ত্রিচিনিপল্লী ও মাদুরায়, ধনুষ্কোন্ডি রামেশ্বর ও তিরুচেন্দুরে। তারপর কন্যাকুমারীতে এসে দেখি যে অপুর্ব জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের সম্মোহনের মধ্যে স্বাতি ও গোপাল বিবেকানন্দশিলাকে সাক্ষী রেখে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছে নীরবে।