মানবসভ্যতার ইতিহাসের ধারায় এই জগতে আমাদের টিকে থাকা, আমাদের সাফল্য, এসব কিছুর পিছনেই আছে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের অবদান। বিজ্ঞানের আলোকিত জয়যাত্রার মাধ্যমেই আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রতিকূলতাকে জয় করতে পেরেছি, উদঘাটন করেছি প্রকৃতির অমোঘ রহস্যকে। বিশ্বমানচিত্রে অবস্থান করে নিতে হলে এই বিজ্ঞানকে জানতে হবে, বুঝতে হবে, এবং জীবনের অংশ হিসাবে গ্রহন করতে হবে।
বিজ্ঞানীদের গল্পটা বলা তাই জরুরি। বিজ্ঞানীরা আমাদের মতোই মানুষ -- তাঁরা নিজেদের জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত জয় করে জনকল্যাণে বিজ্ঞানের বড় বড় আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করেছেন। এই বিজ্ঞানীদের গল্প আমার সন্তান যায়ান আর যোয়ীকে প্রতিদিন ঘুম পাড়াবার সময়ে শোনাই -- কিন্তু এই গল্পগুলো আরো বহু শিশুর কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহ থেকেই এই সিরিজের বইগুলো লেখা। আগের দুই খণ্ড প্রকাশিত হবার পরে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে। তাই এবারে নিয়ে এসেছি আরো ১৫টি গল্প। এই গল্পগুলো আসলে বিশ্বের চেহারা পাল্টে দেয়া সব আবিষ্কার ও তার সাথে জড়িত বিজ্ঞানীদেরই গল্প।
এবারের খণ্ডে থাকছে নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেলের সৌভাগ্যময় দুর্ঘটনার মাধ্যমে ডাইনামাইট আবিষ্কারের কাহিনী। আরো থাকছে জীনতত্ত্ব ও বংশগতির জনক গ্রেগর মেন্ডেলের কথা, থাকছে খামখেয়ালি কিন্তু প্রখর মেধাবী গণিতবিদ পল আরডিশের উদ্ভট ও মজাদার গল্প, বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বিড়ালটির কথা, কিংবা রকেটের মাধ্যমে মহাকাশযুগের সূচনাকারী রবার্ট গডার্ডের অধ্যবসায়ের কাহিনী। আর আমাদের নিজেদের দেশের গর্ব ডঃ ফজলুর রহমান খানের সেই অভূতপূর্ব আবিষ্কারের গল্পটাও বলছি। বলেছি নোবেলজয়ী আবদুস সালাম, ভেলক্রোর স্রষ্টা দ্য মেস্ট্রাল ও তার কুকুরের কথা। মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ছেলেবেলার গল্প, তাঁর পিএইচডি থিসিসের মজার ঘটনা, তাও আছে এখানে। গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাস কিংবা বাঙালি গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার, কবুতর পোষা বিজ্ঞানী কাসিমির ফাংক, প্রথম মোটরগাড়ির সড়ক ভ্রমণ, আর অন্ধজনে আলো এনে দেয়া ব্রেইল লিপির ইতিহাস লিখেছি। আর বইটা শেষ করেছি হলিউডের বিশ্বসুন্দরী চিত্রনায়িকা হেডি লামারের যুগান্তকারী উদ্ভাবনের অসাধারণ কাহিনীটা দিয়ে।
গতবারের মতো এই বইটি লেখার পেছনেও যায়ান বাবা ও রিনীতা যোয়ী মামণির গল্প শোনার তীব্র নেশা কাজ করেছে, আর সেই সাথে তাদের অসাধারণ মা জারিয়াকেও জানাচ্ছি অনেক কৃতজ্ঞতা -- দুই কৌতুহলী শিশুর দুরন্তপনাকে বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত করাতে তাঁর অবদান সবার উপরে।
বইটি উৎসর্গ করেছি আমার সব শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য।
বিজ্ঞানের অপার সুন্দর আলো আসুক সব শিশুর জীবনে, আর বিজ্ঞানের জগতে সবার অভিয়াত্রা হোক শুভ।
শুভকামনায়,
ড. রাগিব হাসান কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ ইউনিভার্সিটি অফ আলাবামা অ্যাট বার্মিংহাম, বার্মিংহাম, আলাবামা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র fb.com/ragibhasan | ragibhasan.com
বিজ্ঞানীদের কান্ড কারখানা সিরিজের তৃতীয় বই এটি। আগেরগুলো পড়া না থাকলেও এটা পড়া যাবে, পাঠকরা এ বইটি পড়ার পর সিরিজের বাকি বই গুলো পড়ার ব্যাপারেও আগ্রহী হবেন বলে আমার ধারনা। রাগিব হাসান একজন শিক্ষক। লেখার স্টাইলে বোঝা যায় তিনি জানেন কিভাবে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে হয়। সাবলীল ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন আলফ্রেড নোবেল, আরভিন শ্রোডিঙ্গার, আলবার্ট আইনস্টাইন, প্রফেসার আব্দুস সালাম, পিথাগোরাস, আমাদের গর্ব এফ আর রহমান সহ আরও অনেক বিজ্ঞানীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া কিছু ঘটনা।
বিজ্ঞান কোন জাদুমন্ত্র না, রূপকথাও না। বিজ্ঞানীরা কিভাবে বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন তার কিছু ধারনা পাওয়া যাবে এই বইটি পড়লে। কোনকিছু রাতারাতি আবিষ্কার হয় নাই, বিজ্ঞানীদের প্রত্যেককেই যেতে হয়েছে প্রচুর বাঁধা বিঘ্ন পাড়ি দিয়ে। সর্বোপরি, প্রাকৃতিক কোন ঘটনা বা ল্যাবের হঠাৎ কোন দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে "এটা ওপরওয়ালার দান" ভেবে সন্তুষ্ট থাকেন নাই এনারা কেউ। প্রশ্ন করেছেন এই জিনিষগুলো কেন হচ্ছে, এবং সেই প্রশ্নের উত্তর বের করেই এক একজন জগত সেরা বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন। এই মেসেজটা সুস্পষ্ট গল্প গুলোতে।
বইটি পড়ার জন্য বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া জরুরী না। কোন গাণিতিক বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয় নাই বইটিতে। সব বয়সী পাঠকের পড়ার উপযোগী সুখপাঠ্য বই।
এটি এই বইয়ের তৃতীয় পর্ব। কিন্তু প্রতিটি খন্ডই আলাদা ভাবে পাঠক পড়তে পারবেন। লেখক আমার স্কুলের বড় ভাই। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ। এবং আমি চাই লেখক এই বইয়ের চতুর্থ খন্ড বের করবেন।
যারা বিজ্ঞান পছন্দ করেন এবং যারা সত্যি ইতিহাস জানতে চান তাদের জন্য অবশ্যই পাঠ্য একটি বই। হয়তো লেখক নিজেই জানেন না উনার রচিত এই তিনটি খন্ড কতটা প্রয়োজনীয় নতুন ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের উৎসাহ দেবার জন্য। আমার আফসোস হয় আমরা যখন ছোট ছিলাম কেন এই ধরনের একটি বই আমাদের হাতে ছিল না।
পূর্বের দুটি খন্ডের তুলনায় এই খন্ডটি আমার জন্য অনেক বেশি চমকদার ছিল। কারণ আগের দুটি পর্বের অনেক কিছুই আমার পূর্বে জানা ছিল। কিন্তু এইখানে অনেক কাহিনী আছে যা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন।
বিজ্ঞানী সালাম এর আবিষ্কার সম্পর্কে জানতাম। কিন্তু ধর্মান্ধতার কারণে তার আপন দেশ তাকে পর করে রেখেছে এটা জানতাম না। পিথাগোরাস এর কাহিনী টি খুব মজার ছিল। এভারেস্ট এর উচ্চতা আবিষ্কারক একজন বাঙালি বইটি না পড়লে জানা হতো না। বিজ্ঞানী ফজলুর এর আবিষ্কারের পিছনে সিগারেট এর ভূমিকা টি খুব মজার। মোটর গাড়ির কাহিনী টি অনেক বেশি রোমাঞ্চকর। সবসময় সব টেকনোলজি এই ছোট্ট জীবনে জানা হয়ে উঠে না। কিন্তু আপনার লেখা আমাকে কম সময়ে কিছু জিনিস জানতে সাহায্য করে। ঠিক যেমন ব্রেইলের লিপি। ইচ্ছে ছিলো খুব জানার এটি কিভাবে কাজ করে। আপনি কয়েক পৃষ্ঠায় শিখিয়ে দিলেন।
অনুরোধ করবো লেখককে যদি পারেন বিখ্যাত বাংলাদেশীদের মজার কান্ড কারখানা নিয়ে যদি একটি বই লিখেন।
বিজ্ঞানীদের কান্ড কারখানা-৩;রাগিব হাসান মিভিউ করোনার এই সময়ে যখন বিজ্ঞানীদের নিয়ে টানাটানি, তখন হাতের সামনে পেয়ে পড়ে ফেললাম এই বইটি। পড়তে পড়তে কিছু জিনিস একদম শেয়ার না করে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই একটু শেয়ার আরকি। গনিত এক ভীতিকর বিষয়। সেই গনিতে আবার গবেষনাপত্র। বলছি পল আরডিশ এর কথা। একটি দুটি নয়, পল আরডিশ জীবনে লিখেছিলেন ১ হাজার ৫০০ টির ও বেশি গবেষনাপত্র। আরা বিশ্বের গনিতের ইতিহাসে যা আজ পর্যন্ত ভাংগতে পারেনি কেউ। কোনো কোনো বছর এমনও হয়েছে, আরডিশ মোট ৫০-৬০টি গবেষনাপত্র প্রকাশ করেছেন। অধিকাংশ গনিতবিদ হয়তো সারাজীবনে এতটা গবেষনার কাজ করেন, যা বছরের পর বছর আরডিশ করে গেছেন ১২ মাসেই। আর আরডিশ কাজ করেছেন ৫০০ এর ও বেশি গনিতবিদের সাথে। তার সাথে কাজ করতে পারাকে এত সৌভাগ্যর ব্যাপার মনে করতেন গনিতবিদরা যে আরডিশ সংখ্যা নামে এক ধরনের সম্মানসূচক সংখ্যার প্রবর্তন হয়েছে গনিতের জগতে। আরডিশের সাথে সরাসরি যারা কাজ করেছেন তাদের আরডিশ সংখ্যা হল ১. সারা বিশ্বে এরকম আরডিশ সংখ্যার অধিকারি আছেন ৫১১ জন ভাগ্যবান গনিতবিদ। তাদের সাথে যারা তারা ২। তাদের সাথে যারা কাজ করেছেন তারা ৩। যার আরডিশ সংখ্যা যত ছোট, গনিতের জগতে তার মর্যাদাও তত বেশি ধরা হয়। আরেকজন হলেন পিথাগোরাস। আর তার মজার সব বিশ্বাস। মানুষ অঙ্ক করে। ঠিকাছে। কিন্তু তাই বলে এরকম। লেখকের ভাষাতেই বলিঃ পিথাগোরাস ছিলেন গনিতের পূজারী। তার মতে গনিতই হল একমাত্র বিশুদ্ধ দর্শন, আর গনিত দিয়েই সবকিছুর ব্যাখ্যা করা সম্ভব। পিথাগোরাসের এই ধর্মের অনুসারীরা নানা অদ্ভুদ বিশ্বাস মেনে চলতেন। ডাল খাওয়া ছিল নিষিদ্ধ, কারন ডাল আর মানুষের আত্মা একই উতস থেকে আসা। সাদা মুরগির মাংস খাওয়া মানা। নানা রকম সংখ্যাকে পুজা করতে হত অনুসারীদের। একেক সংখ্যায় একেক গুন, এটা বিশ্বাস করতেন পিথাগোরাস ও তার অনুসারিরা। ১ হল সবকিছুর মুল উৎস। ২ হল বস্তুর প্রতীক। ৩ একটি নিখুত সংখ্যা, কারন এর মাঝে অতীত, বর্তমান, আর ভবিষ্যত এই তিন ধারনা নিহিত আছে। ৪ হল চারটি ঋতুর প্রতীক। আবার ৮ হল ন্যায়ের সংখ্যা। ৭ হল জ্ঞানের প্রতীক। আর সবচেয়ে পবিত্র সংখ্যা হল ১০। পিথাগোরাসের শিষ্য হতে হল ১০ সংখ্যার উপাসনা করে একটি শপথ নিতে হত। পিথাগোরাসকে দেবতা হিসেবে পুজা করতেন অনুসারীরা। তারা ভাবতেন, পিথাগোরাসের অলৌকিক ক্ষমতা আছে অনেক। আরও ভাবতেন তারা, পিথাগোরাসের উরু সোনার তৈরি। আর পিথাগোরাসের শিষ্য হওয়াটাও এত সহজ ছিল না। এই দলে যোগ দিতে হলে পাচ বছর মৌনব্রত পালন করতে হত।, মানে পাচ বছর ধরে কোনো কথা বলা যেত না। আর শিষ্যদের দুই দলে ভাগ করা হত, -মৌনব্রত পালনরত শিষ্যরা শুরুর পাচ বছর পিথাগোরাসের চেহারা দেখার অনুমতি পেত না। এদের পিথাগোরাস কখনো নিজের চেহারা দেখাতেন না-তারা পিথাগোরাসকে দেখত পর্দার আড়াল থেকে। মাংস ও ডাল খাওয়া ছিল সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। আর পিথাগোরাস বা তার শিষ্যদের সম্পর্কের সবকিছু রাখতে হত গোপন। এরকম আর অনেক বিজ্ঞানী নিয়ে মজার গল্প বলেছেন লেখক। নোবেলের স্বপ্ন, মেন্ডেলের মটরশুটি, শ্রোডিংগারের বিড়াল, হেডি লামার গল্প গুলো ভালো লেগেছে। কার্ল বেঞ্জ যে জার্মানীর, আর জার্মানির মার্সিডিজ বেঞ্জ সম্ভবত এখান থেকেই এসেছে। সেই কার্ল বেঞ্জের গাড়ি তৈরির গল্প ও কম মজার নয়।
This entire review has been hidden because of spoilers.
বিজ্ঞানীদের কান্ডকারখানা ৩ পড়ে আবারও নিশ্চিত হলাম কেবল কবি জীবনানন্দই নন; রাধানাথ শিকদার, অস্ট্রিয়ার মেন্ডেল, ফ্রান্সের বেইল কিংবা আমেরিকান অভিনেত্রী হেডি ল্যামার সহ বিখ্যাতরা বেঁচে থাকতে স্বীকৃতি পায় খুব কম জনই। মরে গেলে কদর বাড়ে, বেঁচে থাকতে পায় বিদ্রুপ!
বইঃ বিজ্ঞানীদের কাণ্ডকারখানা-৩ লেখকঃ রাগিব হাসান বইয়ের ঘরানাঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, জীবনী প্রকাশনাঃ আদর্শ প্রকাশকালঃ ২০২০ পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১২৮
পাঠ-প্রতিক্রিয়াঃ
নতুন করে বিজ্ঞানের চাঞ্চল্যকর ও মজার সব আবিষ্কার ও উদ্ভাবন, সেগুলোর পেছনের কাহিনী ও সেসবের নেপথ্যে থাকা মানুষগুলোর প্রচেষ্টার কথা জানা হল। কিছু ঘটনা পড়ে রীতিমত চমকে গিয়েছি। মানুষ চেষ্টা করলে কী-ই না পারে! সবথেকে ভালো লেগেছে যাদের সত্যিকারের গল্প---
অজৈব রসায়নবিদ্যায় (খননে ডাইনামাইটের ব্যবহারে) আলফ্রেড নোবেল (Alfred Bernhard Nobel) গণিতে পল আরডিশ (Paul Erdős) রকেট বিজ্ঞানে প্রফেসর গডার্ড (Robert H. Goddard) পুরকৌশল প্রযুক্তিতে ফজলুর রহমান খান (F.R. Khan) তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় সালাম (Muhammad Abdus Salam) প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে মেস্ট্রাল (George de Mestral) ত্রিকোণমিতি ও পরিমাপবিদ্যায় রাধানাথ শিকদার (Radhanath) পুষ্টিবিজ্ঞানে কাসিমির ফাঙ্ক (Kazimierz Funk) স্বয়ংচালিত গাড়ির প্রযুক্তিতে বার্থা বেঞ্জ (Bertha Benz) দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা-সহায়ক প্রযুক্তিতে ব্রেইল (Louis Braille) বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক পরিবর্তন করে বার্তা আদান-প্রদান, CDMA, GSM ভিত্তিক যোগাযোগ ও ব্লুটুথ প্রযুক্তিতে হেডি লামার (Hedy Lamarr)
এ বইটা শেষ করে এমন বই আরও পড়তে, গল্পের আড়ালে এরকম প্রতিভাধর আর উদ্যমী ব্যক্তিদের কথা আরও জানতে ইচ্ছে করছে!