রহস্য সিরিজ পড়ার নেশা রহিয়াছে? বহুদিন কোন উৎকৃষ্ট শ্রেণীর মগজের পুষ্টিকারক ডিটেকটিভ বইয়ের অভাব বোধ করিতেছিলেন? সেই অভাব অভাবনীয় উপায়ে পূর্ণ করিতে চলিয়াছে বুক ফার্ম প্রকাশন। তাঁহাদের অন্যতম লেখক কৌশিক মজুমদারের লেখা যিনি একবার পড়িতে শুরু করিয়াছেন, বই শেষ না হওয়া অবধি দুনিয়ার সমস্ত কিছু তিনি ভুলিতে বাধ্য। কৌশিকবাবুর 'সূর্যতামসী' উপন্যাসখানি অতীব চিত্তাকর্ষক। ইহার প্রতি অধ্যায় দুর্দান্ত চমক, প্রতি পাতা চরম উত্তেজনা, আনন্দ ও বিষ্ময়ের সৃষ্টি করিবেই। এই ধরণের বই বাজারে প্রথম। কাহিনীর এক বড় অংশ জুড়িয়া রহিয়াছে উনিশ শতকের কলিকাতা, যাদুবিদ্যা, ভয়ংকর ষড়যন্ত্র, একদল উন্মাদ, ফ্রিম্যাসনের গুপ্ত সমিতি আর বেশ কিছু নৃশংস হত্যাকান্ড। রহিয়াছে বর্তমান কালের চন্দননগরে অনূরুপ হত্যা, গুপ্তধনের আভাস আর এক তরুণ ডিটেকটিভ। বইয়ের অন্তিমে এমন চমক উপস্থিত যাহাতে আপনাকে দ্বিতীয়বার বইটি পড়িতেই হইবে। খুব কম ডিটেকটিভ বইয়ের ক্ষেত্রে এমনটি বলা যায়।
জন্ম ১০ এপ্রিল, ১৯৮১, কলকাতা। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পি. এইচ. ডি. তে সেরা ছাত্রের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া Bacillus sp. KM5 এর আবিষ্কারক। বর্তমানে ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত এবং হাবড়া মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক। জার্মানী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর কমিকস ইতিবৃত্ত (২০১৫), হোমসনামা' (২০১৮),মগজাস্ত্র (২০১৮), জেমস বন্ড জমজমাট (২০১৯), তোপসের নোটবুক (২০১৯), কুড়িয়ে বাড়িয়ে (২০১৯),নোলা (২০২০), সূর্যতামসী (২০২০), আঁধার আখ্যান (২০২০) ও নীবারসপ্তক (২০২১) এই সব দিনরাত্রি (২০২২), ধন্য কলকেতা সহর (২০২২), আবার আঁধার (২০২২), অগ্নিনিরয় (২০২২), হারানো দিনের গল্প (২০২৪), সিংহদমন (২০২৪), ডিটেকটিভ তারিণীচরণ (২০২৪), আরও একটি প্রবন্ধ সংকলন (২০২৫) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সরাসরি জার্মান থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ঝাঁকড়া চুলো পিটার (২০২১)। বাংলাদেশের আফসার ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে ম্যাসন সিরিজের বাংলাদেশ সংস্করণ (২০২২, ২৩), মৃত্যুস্বপ্ন (২০২৪), ডিটেকটিভ তারিণীচরণ (২০২৪) । সম্পাদিত গ্রন্থ সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ (২০১৭, ২০১৮) ফুড কাহিনি (২০১৯), কলকাতার রাত্রি রহস্য (২০২০) সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবর্ষে একাই একশো (২০২২), কলিকাতার ইতিবৃত্ত(২০২৩), বিদেশিদের চোখে বাংলা (২০২৪) এবং কলিকাতার নুকোচুরি (২০২৫)
ট্রাপিজের খেলা দেখেছেন? তাতে এক দিক থেকে অন্যদিকে উড়ে যায় খেলোয়াড়— মাঝখানে অপেক্ষা করে থাকে অসংখ্য মানুষের উৎকণ্ঠা, চোখ-ধাঁধানো আলো, অপার শূন্যতা, আর তারও নীচে মৃত্যু! এই বইও এক ট্রাপিজ। এতে এক প্রান্তে আছে ২০১৮ সালের ঘটমান বর্তমান। মূলত নজরদারি করেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ তুর্বসু রায়ের পেট চলে। তার প্রথম ক্লায়েন্ট ছিলেন চন্দননগরের বাসিন্দা দেবাশিস গুহ। ইতিহাস নিয়ে গভীর পড়াশোনায় আসক্ত দেবাশিসের সঙ্গে তুর্বসু'র সম্পর্কটা বন্ধুত্বর স্তরে পৌঁছে গেছিল। সেই দেবাশিস তুর্বসুকে একটা অস্পষ্ট ছবি হোয়াটসঅ্যাপ করেছিলেন। তারপরেই বীভৎসভাবে হত্যা করা হয় দেবাশিস-কে। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশি তদন্তে জড়িয়ে পড়ে তুর্বসু। আর তখনই বোঝা যায়, এক বিশেষ কারণে তুর্বসু'র কাছে পৌঁছোতে চাইছিলেন দেবাশিস। কাহিনির অন্য প্রান্তে আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের কলকাতা। সেখানে চিনেপাড়ায় একটি মৃতদেহের বুকে এক আপাত-দুর্বোধ্য চিহ্ন দেখে চিন্তিতভাবে পুলিশকে খবর দেন তরুণ গণপতি চক্রবর্তী। পুলিশের তরফে তদন্তে নামেন আরেক তরুণ— ডিটেকটিভ প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। শব-ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে প্রিয়নাথের সঙ্গে আলাপ হয় লন্ডন থেকে আসা এক রহস্যময় তরুণের, যার নাম সাইগারসন মোহেলস— কনসাল্টিং ডিটেকটিভ! এদিকে গণপতি'র কাছ থেকে এই মৃত্যুর কথা শুনে চঞ্চল হয়ে ওঠেন তাঁর বন্ধু তথা কলকাতার প্রথম প্রাইভেট ডিটেকটিভ তারিণীচরণ রায়। ক'দিন পরেই, এঁদের সবার সামনে, করিন্থিয়ান থিয়েটারে মৃত্যু হয় দুই যাদুকরের! ঘনিয়ে ওঠে সেই যাদুর খেলা, যার শেষে সাফল্যের পাশাপাশি অপেক্ষায় থাকে মৃত্যু। তারই নাম সূর্যতামসী! ভালো কথা, পুরোনো কলকাতার বুকে ওই চরিত্রদের চিনলেন তো? তাঁদের মধ্যে তারিণীচরণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ তিনি তুর্বসু'র পূর্বপুরুষ... এবং এই কাহিনিতে তুর্বসুর প্রবেশের প্রধান কারণ। তারপর কী হয়? সোনাগাজির গলি থেকে বড়োলাটের প্রাসাদ, সেদিনের লন্ডনের ইস্ট এন্ড থেকে আজকের চন্দননগর গ্রন্থাগার— এই সর্পিল ও পিচ্ছিল পথ বেয়ে কি পৌঁছোনো যায় সত্যের কাছাকাছি?
এই বইয়ের ভালো দিক কী-কী? প্রথমত, বাস্তব ও কল্পনার চরিত্রদের একসঙ্গে আনার 'ক্রস-ওভার' নামক পদ্ধতিটি ইংরেজি সাহিত্যে বহুলপ্রচলিত হলেও বাংলায় তা অতি-বিরল। লেখক এর আগে তাঁর "তোপসের নোটবুক" নামক বইয়েও এই পদ্ধতিটি প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু এই বইয়ে তিনি সেই প্রক্রিয়াটিকে আরও দক্ষ, নিপুণ ও পরিণতভাবে ব্যবহার করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। দ্বিতীয়ত, 'পিরিয়ড পিস'-এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী? অনেকেই মানবেন যে তথ্যনিষ্ঠার পাশাপাশি সেই বিশেষ আবহটিকে ফুটিয়ে তোলার গুরুত্ব এক্ষেত্রে অপরিসীম। 'সূর্যতামসী'-তে লেখক সেই কাজে ষোলো আনা সফল হয়েছেন। স্পষ্টই মনে হয়েছে, যেন হেমেন রায়ের গল্পে পড়া ব্ল্যাক-আউটের কলকাতার মতোই এই বইয়ের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে গেছি সেই বিশেষ স্থান ও কালে। তৃতীয়ত, লেখকের গদ্য নির্ভার, স্বচ্ছন্দ এবং অত্যন্ত গতিময়। ফলে গল্পে যত মোচড়ই আসুক না কেন, তাদের মোকাবিলা করতে অসুবিধে হয়নি। পরিবেশিত রহস্যটিও তেমনই আকর্ষণীয় এবং ঘোরালো ছিল। সবমিলিয়ে বইটা প্রায় আনপুটডাউনেবল গোত্রের। চতুর্থত, পুরোনো কলকাতার ইতিহাস এবং যাদুবিদ্যা নিয়ে পাঠকদের মনে আগ্রহের সঞ্চার করতে পুরোমাত্রায় সফল হবে এই লেখাটি। তারই সঙ্গে মিশে থাকবে আরও অনেক কিছু নিয়ে জন্মানো কৌতূহল।
এই বইয়ের খারাপ দিক কী-কী? ১) যে কাজগুলো টীকা/অ্যানোটেশনের মাধ্যমে করা উচিত ছিল, সেগুলো এখানে মূল টেক্সটের মধ্যে ঢোকানোর ফলে ভয়ানক ইনফো-ডাম্পিং ঘটেছে। এতে পাঠক বিভ্রান্ত হন এবং রসচ্যুতি ঘটে। এক্ষেত্রে লেখকের দ্বারা সম্পাদিত 'কলকাতার রাত্রি রহস্য'-কে মডেল হিসেবে বিবেচনা করা উচিত ছিল। আশা রাখি যে পরবর্তী পর্বে আমরা এই ধরনের তথ্যভারে ভারাক্রান্ত হব না। ২) কাহিনিটি দুই সময়কালে দু'টি হত্যারহস্য-র সমাধান করতে চেয়েছে। এদের মধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর রহস্যটির সমাধান রীতিমতো অ্যান্টি-ক্লাইমেটিক। কিন্তু লেখক এক্ষেত্রে লিন্ডসে ফে'র 'দ্য গডস অফ গথাম'-এর মডেলকে অনুসরণ করেছেন বলা চলে— যেখানে প্রদীপের নীচে জমে থাকা অন্ধকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাই মুখ্য। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর হত্যারহস্যের সমাধানই হয়নি। কাহিনির অনিবার্য দ্বিতীয় পর্বের জন্য আমাদের প্রস্তুত করার জন্যই লেখক এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন— এটা বুঝতে পারছি। কিন্তু এমন রুদ্ধশ্বাস আখ্যানের শেষে চাতকের মতো অপেক্ষায় থাকতে ভালো লাগে কারও?! ৩) গৌতম কর্মকারের কিছু অলংকরণ দুর্ধর্ষ, কিন্তু কিছু অলংকরণ একেবারেই ছেলেমানুষি গোছের। একটি চরিত্রকে বারবার এমনভাবে আঁকা হয়েছে যা গল্পের অন্যতম প্লট-ডিভাইসকে প্রকাশ করে দিয়ে সাসপেন্স নষ্ট করে দেয়।
বইটির প্রচ্ছদ অসাধারণ, সামগ্রিক মুদ্রণও অত্যন্ত চমৎকার। সব মিলিয়ে বলব, এই বই পড়া মানে শুধু হুড়মুড়িয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্যত্র ধেয়ে যাওয়া নয়। বরং মঞ্চের সামনে অন্ধকারে বসে যাদু দেখার মতোই এ-এক অভিজ্ঞতা। একে উপভোগ করুন। আর পরের শো-র টিকিটের জন্য এখন থেকেই বলে রাখুন। নইলে এ-খেলার শেষে কী আছে, তা যদি আর দেখা না হয়?
লেখকের গতিশীল ও প্রাণময় গদ্যের গুণে একটানা বইটা পড়ে ফেললাম। গল্প এগিয়েছে দুই সময়রেখা ধরে। উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের কলকাতা লেখকের কলমে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।( এতোই জীবন্ত যে আমার মনে হচ্ছে টাইম মেশিনে চড়ে ওখান থেকে একবার ঘুরে আসি।) উপন্যাসের চরিত্রগুলোও খুব পছন্দ হয়েছে। প্রিয়নাথ, তারিণী, গণপতি, তুর্বসু, সাইগারসনদের সাথে পরের দুই উপন্যাসেও দারুণ সময় কাটবে বোঝা যাচ্ছে। টুইস্টগুলোতে তেমন অবাক হইনি। "যদি" ও "কিন্তু"র পরিমাণ বেশি। লেখকের দেওয়া প্রচুর তথ্যের সমাবেশে অনেকে বিরক্ত হলেও আমার কাছে মন্দ লাগেনি। সব মিলিয়ে, পুরো সিরিজ নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী।
মূলত ৩.৫ স্টার। বেশ আশাবাদী ছিলাম বইটা নিয়ে। বাট আশানুরূপ হয়নি। দুটো টাইমলাইনে কাহিনী এগিয়েছে। অতীত ও বর্তমান। অতীতের টাইমলাইন উনিশ শতকের ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতে। বাংলার প্রথম গোয়েন্দা কাহিনীর লেখক প্রিয়নাথের ডায়েরি থেকে উঠে এসেছে এই অংশটা। স্টেজ ম্যাজিক, মানসিক বিকারগ্রস্তদের ওপর বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট, গুপ্তসঙ্ঘ, সেসময়কার কলকাতার পুলিশি প্রক্রিয়া ভালোমতই উঠে এসেছে। বর্তমান সময়েও একটা কেস নিয়েই বর্ণিত যা অবধারিতভাবেই অতীতের কেসটার সাথে সংযুক্ত। বইয়ের পজিটিভ দিক হল একটা ভালো ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখার চেষ্টা করা হয়েছে, অযথা ইনফো ডাম্পিং হয়নি। যতটুকু ইনফো আছে সেটুকু উপভোগ্য। ওয়েল রিসার্চড রহস্যের জালও দুই টাইমলাইনেই ভালোভাবে বুনা হয়েছে। লেখনশৈলী দারুণ।
নেগেটিভ দিক হল টুইস্টগুলো সামান্য দুর্বল ও প্রেডিক্টেবল লেগেছে। মনে হয়েছে তাড়াহুড়ো করে ইতি টানা হয়েছে কাহিনীর। আর বর্তমানের কেসটা অসমাপ্ত। হয়তো পরবর্তী বইয়ে সমাধান টানা হবে।
সবমিলিয়ে য���রা মিস্ট্রি/ক্রাইম জনরার বই পছন্দ করেন তারা বইটা পড়ে আশা করা যায় হতাশ হবেন না।
বইটার ফ্ল্যাপ উলটে দেখলে আপনি জানতে পারবেন এই মেনুতে আছে উনিশ শতকের কলিকাতা, গোপন ষড়যন্ত্র, সিম্বোলজি, দুর্ধর্ষ চাইনিজ গুপ্তসঙ্ঘ, ফ্রি ম্যাসন, একের পর এক নৃশংস হত্যাকান্ড এবং জাদুবিদ্যা। এতোগুলো দারুণ মশলায় মাখানো এক সুস্বাদু রহস্যোপন্যাস আপনার হাতে, তাতে আপনার থ্রিলারগ্রাসী পাঠকমনের জিভে জল আসাটা স্বাভাবিক, কিন্তু তার উপর অনলাইনে ধুন্ধুমার ব্র্যান্ডিং আর পাবলিসিটি দেখলে আশার পারদ বেড়ে যায় আরও। কিন্তু কতোটুকু দিতে পারলো সূর্যতামসী? এক শতাব্দী আগেকার বিজ্ঞাপনের ঢঙ্গে ব্যাক কভারে লেখা ‘অতীব রহস্যময় উপাদেয় ডিটেকটিভ উপন্যাস’ এর বিশেষণ কতটা সার্থক হলো, নাকি বদহজম হওয়ায় ভোজন শেষে উলটে দিতে হলো এই পাঁচমেশালি প্লট?
একবাক্যে সে উত্তর খোঁজা সহজ হবে না, তাই সে চেষ্টা করছি না।
সূর্যতামসীকে পুরদস্তুর গথিক মিস্ট্রি বলা চলে। তবে ভিক্টোরিয়ান এরা’র লন্ডনের প্রশস্ত রাস্তা, সুউচ্চ প্রাসাদ, আর ধোঁয়াটে পাবের বদলে সূর্যতামসীর প্লট এসে ঠেকেছে ১৮৯৩ সালের ভারতবর্ষে,, আরও ঠিকভাবে বললে - কলকাতা আর চুঁচুড়ার গলিঘুঁপচি, চীনাপাড়া আর নিষিদ্ধ পল্লিতে। বইয়ের একটা অংশ অবশ্য বর্তমান ২০১৮’র টাইমলাইনে চলছে, তবে উনিশ শতকের কলিকাতা বর্তমান কলকাতাকে কাহিনীর ঘনঘটনায়, বর্ণনার খুঁটিনাটিতে আর রহস্যময়তায় ছাপিয়ে গেছে বহুগুণে।
বইটার ফ্ল্যাপে কিছুটা ড্যান ব্রাউনিয় কায়দায় লেখা আছে মূল কাহিনীটা বাদে বইয়ে ব্যবহৃত সকল স্থান, স্থানিক ইতিহাস, গুপ্তবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান/জাদুবিদ্যার খুঁটিনাটিসহ বেশ কিছু ঘটনা সত্য। মজার ব্যাপার হলো, শুধু কাহিনী বা ঘটনা বাদেও বইয়ের কয়েকজন প্রধান চরিত্র রক্তমাংসের ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্ব। যেমন গথিক কলকাতার দুই (নাকি তিন?) প্রোটাগনিস্টের মধ্যে একজন হলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, যাকে অভিজ্ঞ পাঠক চিনবেন প্রিয়নাথ দারোগা হিসেবে। উপমহাদেশের প্রথম প্রকাশিত বাংলা গোয়েন্দা কাহিনীগুলোর মাঝে অন্যতম ‘দারোগার দপ্তর’ এর ট্রু ক্রাইম লেখাগুলো প্রিয়নাথ দারোগার পুলিশ জীবনেরই কেস ফাইলস। আবার আরেক প্রোটাগনিস্ট হলেন ছন্নছাড়া গণপতি, যার জীবনের ঝোঁক ম্যাজিকের প্রতি। এই গণপতিই যে বাংলার অগ্রণী ম্যাজিশিয়ান গণপতি দ্য গ্রেট, জাদুকর পি.সি. সরকারের গুরু, সেটা আমার মতো অনেক পাঠকই খেয়াল করবেন না ধরিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত। এরকম বেশ কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রকে খুব সুচারু ভাবে তাদেরও বইয়ের ঘটনার জালে জড়িয়ে ফেলার জন্য লেখকের একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য থাকবে। তবে লেখক এই পর্যন্ত এসে ক্ষান্ত দেন নি, এইসব ইতিহাসের বেড়া ডিঙিয়ে ইতিহাসের ফিকশনাল চরিত্রকেও টেনে এনেছেন গল্পে। সে ব্যাপারে বেশি বললে স্পয়লার হয়ে যাবে, তাই না বলি।
জনরা/সাবজনরায় আটকে ফেলা কতোটুকু ঠিক জানিনা, কিন্তু সূর্যতামসী আগাগোড়া একটা রহস্যোপন্যাস হিসেবেই মর্যাদা পাবে আমার কাছে। বর্তমানের হরেক রকম থ্রিলারের/হররের মাঝে একটা নিখাঁদ ডিটেকটিভ মিস্ট্রি বেশ রিফ্রেশিং ছিলো। এখানে গোয়েন্দারা তদন্তে নেমে কিছুক্ষণ পরপরই রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে যায়নি, আবার হিরোয়িক ফাইট সিকোয়েন্সও জুড়ে বসেনি পদে পদে, বরং একদম খাটি হুডানিট মিস্ট্রির মতো রহস্যের পেছনের রহস্য খুলে এসেছে পরতে পরতে। বেশ খাটনি করে দাঁড় করানো একটা প্লটকে গল্পের বুননে মোটামুটি ভালোই গাঁথতে পেরেছেন লেখক। তবে গল্পটা বহুলাংশেই প্লট ড্রিভেন থেকে গেছে, ক্যারেক্টার ড্রিভেন হতে পারেনা। চরিত্রগুলো কিছুটা একমাত্রিক মনে হয়েছে। গথিক পার্টের তারিণী, প্রিয়নাথ আর সাইগারসন - সবাইকেই কমবেশি সদা সত্যসন্ধানী কান্ডারির মতোই উপস্থাপন করা হয়েছে,, তাই তাদের প্রতি আকর্ষণটা যতটুকু হওয়া উচিত ছিলো ততটুকু হয়নি। সেই আকর্ষণ কেড়ে নিয়ে গেছে গঙ্গার ঘাট আর করিন্থিয়ান থিয়েটারের স্টেজের গণপতি দ্য গ্রেট। চরিত্রগুলো সাদামাটা ভালো-খারাপ না করে আরেকটু ভার্সেটাইল করলে বাকিদের প্রতি আকর্ষণটা যথাযত হতো। আর বর্তমান সময়ের প্রোটাগনিস্ট তুর্বসুর ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট আর্কটা সুন্দর, ওয়েল হ্যান্ডেলড। বর্তমানের এক দেশি প্রাইভেট ডিটেকটিভের কাজ যে কমবেশি ডিভোর্স কেস নিয়েই হবে, সেটাও বিশ্বাসযোগ্য।
তবে প্রোটাগনিস্টের বিষয়ে একটা কথা বলা প্রয়োজন, একই কাহিনীতে একাধিক গল্প একই সাথে চলতে থাকলে, দুই ক্ষেত্রেই প্রোটাগনিস্টের বিষয়টা পরিষ্কার থাকলে ভালো হয়। যেমন বর্তমান সময়ের প্রোটাগনিস্ট তুর্বসুর সাথে পাঠকের বোঝাপড়া হতে কোনো সমস্যাই হয়না, কিন্তু অতীতে একবার তারিণী, আরেকবার প্রিয়নাথ, আবার মাঝদিয়ে গণপতি, এবং এই তিনের উপর দিয়ে আবার সাইগারসন - এতোগুলো পজিটিভ প্রটাগনিস্ট চরিত্র এলে পাঠক খেই হারিয়ে ফেলতে পারে। সেই ব্যপারে আরও একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে ভালো লাগতো।
ইতিহাস নিয়ে লিখতে গেলে, তাও আবার এরকম পুরদস্তুর গথিক সেটিং এ ঐতিহাসিক চরিত্রদের নিয়ে লেখা বইয়ের জন্য কম পড়াশোনা করার সুযোগ নেই, বইয়ের শেষে লেখকের সহায়ক গ্রন্থের ফিরিস্তি দেখলে বোঝা যায় লেখক একদম ফাঁকি দেন নি। লেখক নিজে বেশ ভালো নন-ফিকশন রাইটার, তাই তার রিসার্চ আর পাঠকের কাছে তথ্যের উপস্থাপনটাও বেশ স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু কতটুকু বিদ্যে লেখক তার লেখা দিয়ে পাঠককে জানাবেন, তা নিয়ে হয়তো ভাবার বেশ কিছু জায়গা আছে।
সে বিষয়ে বলার আগে লেখকের গদ্য নিয়ে বলা উচিত। সূর্যতামসী বইয়ের গদ্যভাষা ঝরঝরে, মেদহীন। যতটুকু ভিজ্যুয়াল বর্ণনা প্রয়োজন লেখক ঠিক ততটুকুই দিয়েছেন, লেখার সাথে গল্পের গাঁথুনি খুব ভালোভাবে এগিয়েছে। অন্যান্য বইয়ের তুলনায় চাপ্টারগুলো ছোটছোট, তাই পাঠকে তরতরিয়ে পড়ে ফেলতে পারেন। প্রিয়নাথ দারোগার ডায়েরী, সেকালের গোয়েন্দা তারিণীচরণের ডায়রী, লেখকের দৃষ্টি থেকে তৃতীয় পুরুষে বর্ণনা আর বর্তমান সময়ের প্রোটাগনিস্ট তুর্বসু নিজ বর্ণনা- বইটা চারটা ভিউপয়েন্ট থেকে লেখা, যা প্রায় প্রতি চাপ্টারে পরিবর্তিত হয়েছে। দৃষ্টিকোণ বদলের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তনটা প্রশংসনীয়, যেমন প্রিয়নাথ দারোগার ডায়েরী সাধুভাষায় সেকেলে বর্ণনা, সেকেলে যতিচিহ্নের ব্যবহার দেখা যায়, আবার তারিণীর ডায়রীতে বা লেখকের অতীত বর্ণনায় ব্যাবহারিক ইংরেজি শব্দের আধিক্য কম - যা আবার পরিপূর্ণ ভাবে আছে বর্তমানে তুর্বসুর বর্ণনায়।
এই পরিবর্তনগুলো একদম যথাসই হলেও, একটা জিনিস সবগুলো চাপ্টারেই স্বমহিমায় বিদ্যমান, সেটা হলো এক্সপোজিশন, সোজা বাংলায় ব্যাখ্যা প্রদর্শন। এবং এই এক্সপোজিশনই হচ্ছে এই বইয়ের দুমুখো ছুড়ি। কিছুক্ষণ আগে লেখকের বিস্তর পড়াশোনার প্রশংসা হচ্ছিলো, একটা হিস্টোরিকাল ফিকশনে সবার আগে দরকার পর্যাপ্ত রিসার্চ এবং দ্বিতীয়তে প্রয়োজন সঠিক এক্সিকিউশন। হিস্টোরিকাল ফিকশন অথবা মিথোলজি বেজড ফিকশনে পাঠককে পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য-ইতিহাস-পাতিহাস জানানোটা আবশ্যিক, সেটা না জানিয়ে উপায়ও নেই। সে কারণেই রবার্ট ল্যাংডন সিম্বোলজির ফিরিস্তি শোনাতে গল্পের মাঝে ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যান তার ক্লাসরুমে, বা অন্যান্য বইয়ে সিধু জ্যাঠাগোত্রীয় জ্ঞানের জাহাজীরা এসে পর্যাপ্ত তথ্য শিখিয়ে পড়িয়ে যান পাঠককে।
এটা এই এক্সপোজিশন তখনই গল্পকে আরও তুখ���ড় করে তোলে যখন তা সঠিক জায়গায় কোন বিশ্বাসযোগ্য সংলাপে বিশ্বাসযোগ্য লোকের কাছ থেকে জানছে পাঠক। এই বইয়েও তথ্য আর গল্পের পার্টনারশিপ বেশ কিছু জায়গায় দারুণ কাজ করেছে, পাগলাগারদের সিকোয়েন্সটা অথবা করিন্থিয়ান হলের কাহিনী উল্লেখ্য। কিন্তু যখন গল্পের প্রতিটা চরিত্রই কমবেশি জ্ঞান ঝেড়ে তার এক্সপোজিশন সিকোয়েন্স ঝাড়তে থাকে, কিংবা লেখককেই বারবার তার তৃতীয় পুরুষ বর্ণনার মাঝে দশাসই তথ্যের এক্সপোজিশন করতে দেখা যায়, তখন পাঠকের কাছে গল্পের গাড়ি বারবার ব্রেক কষছে এমনটা লাগতে পারে বইকি। পর্যাপ্ত তথ্য জানানো ছাড়াও এরকম এক্সপোজিশনের আরেক ধরনের ব্যবহার হচ্ছে খুব দারুণ কোন তথ্য পাঠককে জানিয়ে চমকে দেওয়া, চরিত্রের জ্ঞান-গরিমা বোঝাতে । যেটা পড়তে ভালোই লাগে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু শুধু চটকার তথ্যের সাইজ যদি দেড় পৃষ্ঠা পেরিয়ে যায় তখন পাঠকের বিভ্রান্ত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আরও একটা বিষয় এখানে উল্লেখ্য, আমি বাংলাদেশি না হয়ে পশ্চিমবঙ্গের কেউ হলে হয়তো স্থানগুলোর সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কানেক্ট করতে পারতাম। সেক্ষেত্রে হয়তো ভ্রুকুটি কিছুটা কম হতে পারতো। ঢাকা নিয়ে এমন বিশদ রিসার্চ করা একটা ফিকশন পড়তে যে বেশ দারুণ লাগতো, এই বই পড়তে গিয়ে বুঝেছি। ( ঢাকা নিয়ে এমন কিছু দেখেছিলাম মাশুদুল হকের কাল্ট থ্রিলার ‘মিনিমালিস্ট’ এর একটা অধ্যায়ে, ঢাকার আহসান মঞ্জিল থেকে ঐতিহাসিক হট এয়ার বেলুন ওড়ানো নিয়ে দারুণ একটা সিকোয়েন্স ছিলো। )
আর নামকরণের বেলায়, জীবনানন্দের কবিতার নামে নামকৃত এই বই আদতেই যে শুধু কবিতার নামকরণেই সীমাবদ্ধ না, কাহিনীর মাঝপথেই। তারপরও বইয়ের শুরুতে এবং শেষে জীবনানন্দের পংক্তি, আর অধ্যায়ের নামকরণে কবিতার নাম ব্যবহার করাটা দারুণ মানিয়ে গেছে।
সূর্যতামসীর বইটার পেছনের কথাও একটু বলা উচিত। বইটার বাঁধাই, প্রচ্ছদ, ছাপা বেশ ভালো, প্রকাশনা বুকফার্ম এক্ষেত্রে প্রশংসা পাবে। তারা এসব বাদেও আরও একধাপ বেশি করেছেন, বইয়ের শুরুর আর শেষের ব্লার্ব অংশটাতেও রঙিন আর্ট পেপার ব্যবহার করে ইলাস্ট্রেশন জুড়ে দিয়েছেন, বইয়ের প্রোডাকশনকে অন্য একটা মাত্রা দিয়েছে এটা। আর বইয়ের লেখার ফাঁকে ফাঁকে গৌতম কর্মকারের কালিতুলিতে আঁকা ডার্ক এবং গ্রিটি আর্টওয়ার্ক গুলো উপরি পাওনা ছিলো, উপন্যাসের লেখার ফাঁকে হঠাৎ দুই পৃষ্ঠা জুড়ে কোনো টেক্সটবিহীন স্প্রেড আর্টওয়ার্ক দেওয়াটাও একটা সাহসী পদক্ষেপ।
তবে এইখানে একটা বিষয় একটু বলতে চাইছি, শিল্পীর আঁকা নিঃসন্দেহ মুগ্ধ করেছে কিন্তু কাহিনীর সাথে তার অসামঞ্জস্যতা দেখে কিছুটা হতাশও হয়েছি। শুরুর ছবির বর্ণনায় ১৮৯৩ এর গভীর রাতে পালকি করে চায়নাটাউনে যাওয়ার দৃশ্যের বর্ণনায় আমরা জানতে পারি চারিদিক ভয়ানক সুনশান, রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু ইলাস্ট্রেশনে দেখা যাচ্ছে রাস্তার দুই ধার ভর্তি লোকসমাগম। আবার তুর্বসুর দেবাশীষদার প্রথম দেখার দিন বর্ণনায় আছে যে তুর্বসু বৃষ্টিতে কাপড় ভিজিয়ে ফেলায় ধুতি শার্ট পরে নিয়েছে, কিন্তু ইলাস্ট্রেশনে তাকে দিব্যি শার্ট প্যান্ট পরাই দেখা যায়। এই ভিজ্যুয়াল ভুলগুলো আঁকিয়ের অনেস্ট মিস্টেক কিনা, নাকি তাকে দেওয়া নির্দেশনার অপর্যাপ্ততা তা জানিনা।
সবমিলিয়ে সূর্যতামসী একটা পড়ার মতো বই, অবশ্যপাঠ্য কিনা সে বিচার করা সহজ নয়। হয়তো এই বই না পড়লে আপনার পাঠকজীবনের অর্থ বৃথা হয়ে যাবেনা, কিন্তু পুরোনো দিনের নানান ঘটনায় ঠাসা একটা রহস্যোপন্যাস মিস করবেন। বাংলায় গথিক মিস্ট্রি উপন্যাস খুব বেশি নেই, তার মধ্যে এটা একটা অন্যতম উদাহরণ হয়ে থাকবে নিশ্চিত । একটা ভালো শক্ত প্লটের রহস্যোপন্যাস পড়তে চাইলে পড়তে পারেন, কিংবা আমার মতো কোনো ফিকশনের সাথে ননফিকশনের একগাদা ফিরিস্তি শুনতে ভালো লাগলে পড়তে পারেন।
অতি অতি অতি মৃদু স্পয়লার- বইটার সিকুয়েল আসবে এরকম কোন আভাস ছিলোনা, কিন্তু বইয়ের শেষে খুব ভালোমতই আগামী বইয়ের ইঙ্গিত দেওয়া আছে। সিরিজ হবে আগে থেকে জানতাম না, তাই সেটা একটা চমকই ছিলো।
অনেক দিন রিভিউ না লেখার ফল, এটা নিয়ে লিখতে গিয়ে দেখি কিছুই মাথায় আসছেনা।
তবে এইটুকু বলবো অনেকদিন পর কোন থ্রিলার পড়ে খুব মজা পেয়েছি। বই শেষ না করে উঠা যায়না এমন একটা বই সূর্যতামসী। তবে লেখক অনেক ইনফো ডাম্পিং করেছেন, যেগুলো অযথা লেগেছে।
মাথার বারোটা বাজাতে আর রাইটারকে গালি দিতে যেমন বই দরকার হয় এটা ঠিক তেমন বই। তবে বেশিদুর অবদি না। প্রথম দুই চার অধ্যায় অবদি। তারপর আবার রাইটারের লেখার প্রতি মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নাই। লেখক যে খুবই পড়াশুনা করেন/করেছেন আর খুবই যত্নসহকারে সবকিছুর যোগসাজশ করেছেন এই ব্যাপারটা চিন্তা না করতে চাইলেও এমনিতেও চিন্তার ভেতর চলে আসে। আর এসেই লজ্জা দিয়ে যায় এইটা বলে যে তোমার দ্বারা হবেনা, তুমি পারবা এত খুটিনাটি বিষয় মনে রাখতে? পারবা এরকম করে পড়তে? এত ধৈর্য্য নাই তোমার, হবেওনা কখোনো, শুধু ভাবতেই পারবা মনে মনে কিন্তু বাস্তবে পারবানা।
কৌশিক মজুমদারের "সূর্যতামসী" শুরু হয় আর আট দশটা ডিটেকটিভ থ্রিলারের মতোই। গল্পের শুরুতেই খুন। তবে যে সময়ে লেখক গল্প লিখছেন সেসময়ের খুন না। এই বীভৎস খুনের ঘটনা ঘটে প্রায় ১২০-২৫ বছর পূর্বের কলিকাতা শহরে। ১৮৯২ আর ২০১৮ টাইমলাইনেই গল্প এগোতে থাকে।সেসময়ের হত্যাকাণ্ড তদন্তের দায়িত্ব পান দারোগা প্রিয়োনাথ মুখোপাধ্যায়। এই খুনের রেশ কাটতে না কাটতেই আরো দুইটা মৃত্যু করিস্থিয়ান হলে কার্টার সাহেবের জাদুর প্রদর্শনের সময়। অনেক সময় পরে ২০১৮ সালে চন্দননগরে প্রায় একই পদ্ধতিতে আবার খুনের ঘটনা ঘটে। আর এখানে জড়িয়ে পড়েন তরুণ ডিটেকটিভ তর্বসু রায়। এই খুনের রহস্য জানতে অবশ্যই সেই ১২০ বছর আগের কাহিনী জানতে হবে। আর সেই কাহিনী আর এই কাহিনী নিয়েই গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন কৌশিক মজুমদার।
গল্পে যেভাবে ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে সেটা প্রশংসার দাবিদার। শুধু ইতিহাসই না, বাস্তব চরিত্রদের যেভাবে ফিকশনালাইজড করে উপস্থাপন করা হয়েছে সেটা এক কথায় অসাধারণ। দারোগা প্রিয়নাথ, গণপতি বা সাইগারসনের কথাই বলা যায়। সাথে খুনের পদ্ধতি, সিম্বল সবকিছু নিয়েছেন হিস্ট্রি থেকে।
গল্প এক টাইমলাইন থেকে অন্য টাইমলাইনে দৌড়াদৌড়ি করার কারনে প্রথমে কিছুটা অসুবিধা হলেও, চরিত্রগুলো পরিচিত হয়ে যাবার পর আর এই সমস্যাটা থাকেনা। কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। চিনাদের সাথে সম্পর্ক খুনের বা তারা খুন করতে চায় শুধু, কিন্তু সেই বক্স সমন্ধে তারা জানল কিভাবে বা তারা সেটা চাইছেই বা কেন সে কথা লেখক স্পষ্ট করে বলেননি। যদিও বাক্স রহস্য উন্মোচন হয়নি, হয়তো পরবর্তী বই গুলোতে করা হবে। কিন্তু কোনো হিন্টও পাওয়া গেলোনা এখানে। রহস্য উন্মোচন আমার কাছে এভারেজ লেগেছে। দুই টাইমলাইনেরই। পাশ কেটে বের হয়ে যাবার মতো। রহস্যটাও খুব যে মর্মান্তিক বা আহামরি এমনটাও না। তবে খারাপও না। পরে রিফ্লেক্ট করতে বসলে মনে হবে আহ এইটাই!!
তবে পড়ার সময় খুবই সুখপাঠ্য লেগেছে। প্রতিমুহূর্তে ক্লু পাওয়া, উত্তেজনাপূর্ন পরিবেশ, গথিক গথিক ভাব, এসব কিছু সাথে নিয়ে পড়ার মজাটাই অন্যরকম। ১৯ শতকের কলকাতার বর্ণনা, অলিগলি, আর্থসামাজিক অবস্থা, ব্যবসা বানিজ্য, এসব সহ Pale Blue Eyes এর মতো সিনেম্যাটিক অভিজ্ঞতাটাও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যেটা আসলে ফিল করার বিষয়, কথায় বুঝানো যাবেনা বলে মুভির উদাহরণ দিলাম। সাথে ভাষার প্রাঞ্জলতা, শব্দের শ্রুতিমধুরতা, বাক্যগুলোকে ছোট ছোট করে লেখা, আর লেখার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে পাঠকের মাথা আউলায়া না দেওয়া এই বইয়ের অন্যমত ভালো দিকগুলির একটি।
এই বইয়ের মতো পরের বইগুলার সাথেও সময় ভালোই কাটবে বলে মনে হচ্ছে। আর রহস্যের যেহেতু শেষ হলোনা তাই পড়তেই হবে। পড়তে ভালো লেগেছে খুবই।
বইঃ সূর্যতামসী লেখকঃ কৌশিক মজুমদার জনরঃ ডিটেকটিভ উপন্যাস পেইজঃ ২৩০
“ভাবছিলাম আপনার গল্প যতই গাঁজাখুরি হোক না কেন, স্রেফ মশলা আর পরিপাকের গুণে শুধু যে উতরে যায় তা নয়, রীতিমতো উপাদেয় হয়।” - লালমোহন গাঙ্গুলীর উদ্দেশ্যে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র [এবার কাণ্ড কেদারনাথে]
কৌশিক মজুমদারেরটা উতরে গেছে, উপাদেয় হয়নি। তবে ভালো লাগলো ভদ্রলোকের পরিশ্রম দেখে। তার অকল্পসাহিত্য (নন ফিকশন) –এর প্রচুর সুনাম শুনেছি, পড়বার আগ্রহ বাড়লো।
ভাল লেগেছে, দুইটা ব্যাপার বাদে। এক, নন-লিনিয়ার স্টোরিলাইনের নামে দ্রুত এক ডাল থেকে আরেক ডালে বাঁদরের মত লাফিয়ে লাফিয়ে অধ্যায় পরিবর্তন; বারবারই মনোযোগ ছুটে যায়। আর ইতিহাসাশ্রয়ী কাহিনী লিখতে গিয়ে লেখকরা মাঝে মাঝেই ভুলে যান যে, তিনি গল্প লিখছেন, ইতিহাস নিমিত্ত মাত্র। কাজেই লেকচার দেয়া বারণ। লেখক প্রায়ই সেই লেকচার দিতে গিয়ে পাঠকের মনোযোগ সরিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু গল্পটা ভাল লেগেছে। আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্রটার চিত্রায়ণ (কে, সেটা বললাম না, স্পয়লার হবে) অবশ্য ঠিকভাবে হয়নি, সেটা হলে একতারা বেশি দিতাম।
গতানুগতিক থ্রিলার থেকে একটু ভিন্ন লেগেছে, যেটা অবশ্যই একটা পজেটিভ দিক। তবে শুরু থেকে দারুন লাগলেও উপন্যাসের মাঝামাঝি থেকে সব কিছু অনেকটা প্রেডিক্টেবল হয়ে গিয়েছিল।
লেখনী ছিল সাবলিল আর মোটামুটি বড় কলবরের লেখা, সেখানে আগ্রহ ধরে রাখতেও সক্ষম হয়েছেন লেখক। থ্রিলার মিস্ট্রি পাঠকদের জন্য অবশ্যই রিকমেন্ডেড।
আর প্রেডিক্টেবল প্লট? সবে মাত্র ত্রিলোজির প্রথম বই পড়লাম৷ দেখা যাক না, সামনে কি আছে!
কৌশিক মজুমদার যেভাবে পুরনো কলকাতাকে জ্যান্ত করে তোলেন, অন্তত তার স্বাদ নিতেই তাঁর বইগুলো পড়তে আগ্রহ হয়। এর আগে তোপসের নোটবুক বইতে সামান্য আঁচ পেয়েছিলাম, এবার সূর্যতামসী পড়ে মাত হয়ে গেলাম।
সূর্যতামসী, দুটো সময়ের সমান্তরাল গল্প। এক, গ্যাসবাতি আমলের ভিক্টোরিয়ান কলকাতা, আরেক বর্তমান। সূর্যতামসী-নীবারসপ্তক-অগ্নিনিরয় ত্রয়ী যদিও নামে ম্যাসন ট্রিলজি, এবং গুপ্তসংঘের উপস্থিতি আছে, কিন্তু গতানুগতিক থ্রিলার লেখকদের মতো গুপ্তসংঘ দেখিয়ে চটক লাগানোর প্রবণতা ছিল না সূর্যতামসী-তে।
গল্পের অবতারণা ঊনিশ শতকের কলকাতায়। যখন গ্যাসবাতির আলো রাস্তাকে আলোকিত করতো কম, বরং তার রহস্যময়তা বাড়াতো বেশি। ঐতিহাসিক চরিত্র, দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, ডাক পেয়েছেন এক খুনের তদন্তের। নৃশংস খুন হয়েছে চীনা পাড়ায়, ছিন্নভিন্ন দেহের বুকের ওপর ই-চিং প্রক্রিয়ায় লেখা, মৃত্যু। এবং আরো মৃত্যু সমাগত, এই বার্তা। তদন্তের সুতোর টানে জড়িয়ে পড়েন আরো দুই ঐতিহাসিক চরিত্র, জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী, আর গোয়েন্দা তারিণীচরণ। এঁদের নাম গুগল করলেই দেড়শ' বছর আগের কীর্তি দেখা যায়, এমন বিখ্যাত মানুষদের অরিজিন স্টোরি সাজানো হয়েছে উপন্যাসে, সাথে তাঁদের সময়টাকে, সে সময়ের কলকাতা-কে ফুটিয়ে তুলে, সব মিলিয়ে জম্পেশ একটা ব্যাপার।
এদিকে বর্তমানের গল্প। তরুণ গোয়েন্দা তুর্বসু রায়, নামে প্রাইভেট ডিটেক্টিভ হলেও গল্পের গোয়েন্দাদের মতো দক্ষ মোটেই নন। দৈনন্দিন লেজেগোবরে অবস্থার মাঝে এক হত্যারহস্যের অভিযুক্ত তালিকায় ফেঁসে যান। হত্যাপদ্ধতি? সেই শত বছর আগেকার! জানতে পারি, তুর্বসু রায়, গোয়েন্দা তারিণীচরণ রায়ের বংশধর। তাহলে পূর্বপুরুষের সম্পৃক্ততা, এত বছর পর তুর্বসু-কে ধরে বসলো কি?
সূর্যতামসীর গল্প অনেকাংশেই টেনে নিয়ে গেছে অতীতের সময়টুকু, এবং আপাতত রহস্যটুকু ওই সময়েরই। আর সে সময়কার পথঘাট, সংস্কৃতি, এইসব যেমন চোখে দেখার মতো ফুটে উঠেছে, তার পাশাপাশি উপভোগ করা গেছে উল্লেখিত একেকটা জায়গার পূর্ব ইতিহাস, উল্লেখিত ব্যাক্তি বা সাহিত্যের বর্ণনা।
এদিকে, গল্প যেহেতু মূলত ডিটেক্টিভ থ্রিলার, তাই ডিটেক্টিভের চোখেই রহস্যভেদ করবেন পাঠক- ঠিক করে বললে, ডিটেক্টিভদের। মূল দায়িত্বে থাকা প্রিয়নাথ আর তুর্বসু ছাড়াও, যেসব চরিত্ররা নিজেদের জীবনের পাকে গল্পে জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁরাও নিজ নিজ তাগিদেই রহস্যের ইতিউতি সমাধান করায় হাত লাগিয়েছেন। জাদুকর গণপতি আর গোয়েন্দা তারিণীচরণ ছিলেন, মায় শার্লক হোমস-ও বেনামে হাজির হয়েছেন কৌশিক মজুমদারের বয়ানে। আর, একেকটা চরিত্রের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি, আর তদন্ত কৌশল দেখার মতো ছিল এখানে।
বই যদি কোনো একটা সিরিজের অংশ হয়, তার কাছে চাওয়া থাকে, যেন বইজুড়ে যে সাময়িক কনফ্লিক্ট, সেটার সমাধান হয়, আর সিরিজজুড়ে যে ওভার-আর্চিং কনফ্লিক্ট, ওটাও ভালোমতো পরিচিত হয়। এই দাবিটুকু পুরোপুরি ঘুচেছে ম্যাসন ট্রিলজির পয়লা বই 'সূর্যতামসী'-তে। অবশ্য সিরিজটা কোন রহস্য নিয়ে এগোবে, তার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া না গেলেও, ক্রীড়নক কারা হবেন, তা বুঝা গেছে।
সবকিছু মিলিয়ে সূর্যতামসী পড়ে শেষ করার অভিজ্ঞতা এতটা জমজমাট ছিল, যে, পরের বইদুটো হাতে পাবার তর সইছে না।
পড়েছিলাম আফসার ব্রাদার্স প্রকাশিত বাংলাদেশী সংস্করণে। ভারতীয় সংস্করণের সাথে পাল্লা দিয়ে দেখার মতো প্রচ্ছদ হয়েছে এটার। ভারতীয় সংস্করণের চিত্রাঙ্কণই রাখা হয়েছে। আফসার থেকেই আসতে যাচ্ছে পরের দুটাও, নীবারসপ্তক, আর অগ্নিনিরয়।
সূর্যতামসী এবং বাদবাকি সিরিজটা সম্বন্ধে স্পয়লার-ফ্রি আলোচনা দেখে নিতে পারেন এখানে : https://youtu.be/RSz9hE4JZss
'দারোগার দপ্তর'-এর প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ঘাড়ে পড়লো চীনে পাড়ায় রহস্যময় পদ্ধতিতে এক ইংরেজ তরুণ খুনের ঘটনা। এই খুনের সাথে জড়িত আছে জাদু, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মান-সম্মান ও একটি অপ্রিয় সত্য।
কাহিনির বর্তমান প্রক্ষাপটে এক তরুণ গোয়েন্দা জড়িয়ে গেল খুনের ঘটনা। দুইটি ভিন্ন পরম্পরায় ঘটতে থাকা ঘটনার মিল পাওয়া যাবে আশ্চর্য এক লুকানো সত্যে।
কাহিনি এগোচ্ছিল ভালোই। কিন্তু মাঝখানে সবকিছু বিশ্রীভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে। কী থেকে কী হলো তা বুঝবার আগেই বই শেষ!
হাইপ ওঠা বইগুলো বে��ির ভাগ গড়পড়তা মানের হয়। এই বইটিও তেমন। নিতান্তই সাদামাটা। পড়ার মতো বই না পেলে এটি পড়তে পারেন। সময় মোটামুটি কেটে যাবে।
কয়েকটি জিনিস আমার ভালো লেগেছে, সেগুলোই শুধু উল্লেখ করছি। ১. সূর্যতামসী নামকরণ ও তার সঙ্গে যোগসূত্র ২. তুর্বসু নামটি, ৩. সাইগারসন টুইস্ট ৪. আর পুরোনো কলকাতার সাথে পাগলদের ওপর লেখা প্লট। ব্যস, এইটুকুই। নাহলে টাইমলাইন এদিক ওদিক করে, সাধুভাষা-চলিতভাষায় গুলিয়ে, ইতিহাস আর থ্রিলারের চচ্চড়ি করে শেষমেশ যে খিচুড়িটা তৈরী হয়েছে তা শেষ করতে আমায় বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কষ্ট হচ্ছে এইভেবে যে এই প্রেডিকটেবল বইটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেটা আবার একটা সিরিজের জন্ম দিয়েছে। :')
"কোথাও পাখির শব্দ শুনি; কোনো দিকে সমুদ্রের সুর; কোথাও ভোরের বেলা র’য়ে গেছে— তবে। অগণন মানুষের মৃত্যু হ’লে— অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয় বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে; এ কোন্ সিন্ধুর স্বর: মরণের— জীবনের?"
জীবনানন্দের 'সাতটি তারার তিমির' কাব্যগ্রন্থভুক্ত সূর্যতামসী কবিতার এই চরণগুলো দিয়েই কৌশিক মজুমদারের অতীব রহস্যময় উপাদেয় ডিটেকটিভ উপন্যাস 'সূর্যতামসী'র সূচনা। সূচনাংশ পাঠের পর অপর পৃষ্ঠায় চোখ বুলালেই দেখতে পাওয়া যাবে লেখক সমগ্র উপন্যাসটিকে তিন খণ্ডে বিভক্ত করেছেন। অর্থাৎ, পূর্বখণ্ড-সংকট,মধ্যখণ্ড-সন্ধান এবং উত্তরখণ্ড-সমাধান।
উল্লেখ্য যে, কয়েকখানা খুন, প্রাচীন কলকাতা থেকে আধুনিক কলকাতার সৃষ্টির ইতিহাস - এই উপন্যাসের প্লটের মূল বিষয়বস্তু। উনিশশতকের শেষাংশ অর্থাৎ ১৮৯২ সালে কলকাতায় ঘটে যাওয়া চাঞ্চল্যকর তিন-তিনটে রহস্যময় খুনের অমিমাংসিত একটি কেসের রহস্য কালের বিবর্তনে ২০১৮ সালে পুনরায় ঘনীভূত হবার মাধ্যমেই 'সূর্যতামসী' উপন্যাসের চমক শুরু। কোন যোগসূত্রের কারণে এত বছর পর কলকাতার অন্ধকার ইতিহাসের ধূলোজমা খাতা আবার সর্বসম্মুখে আসলো? -সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে উপন্যাসটিতে মুখ ডুবিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই পাঠকের। রহস্যের সমাধান খুঁজতে গিয়ে উনিশ শতকের প্রাচীন কলকাতার বিবরণ, তার অন্ধকারের ইতিহাস, গোপন ষড়যন্ত্র, সিম্বোলজি, দুর্ধর্ষ চাইনিজ গুপ্তসঙ্ঘ, ফ্রি ম্যাসন,কতিপয় নৃশংস হত্যাকাণ্ড,মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা বিষয়ক চিকিৎসা ও চিকিৎসালয়, জাদুবিদ্যা,'সূর্যতামসী' নামক ভয়ংকর কালোজাদুর সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।
শুধু তাই নয়,ফিকশনের মাঝেও খোঁজ মিলবে নন-ফিকশনের অর্থাৎ,বেশ ক'জন জ্বলজ্যান্ত মানুষের। যাঁদের অস্তিত্ব লেখকের কল্পনায় নয় বরং এই ধুলির ধরায় ছিলো।এই প্রোটাগনিস্টদের একজন বইয়ের ভাষ্যমতে, উনিশ শতকের চাঞ্চল্যকর কেসের তদন্তকারী কর্মকর্তা - প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। যিনি বাস্তবজীবনে উপমহাদেশের প্রথম প্রকাশিত বাংলা গোয়েন্দা কাহিনী 'দারোগার দপ্তর' এর রচয়িতা।অভিজ্ঞ পাঠকমহলে 'প্রিয়নাথ দারোগা' খ্যাতিপ্রাপ্ত প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর পেশাগত জীবনের সত্যিকারের কেসগুলোকেই 'দারোগার দপ্তর' - এ লিপিবদ্ধ করতেন।অন্যজন,উপমহাদেশের প্রখ্যাত জাদুকর 'গণপতি রায়' ওরফে 'গণপতি দ্য গ্রেট';জাদুকর পিসি সরকারের গুরু হিসেবে যাঁর রয়েছে অগাধ জনপ্রিয়তা। তাঁকে এই উপন্যাসের প্রথম দিকে নিতান্ত ছন্নছাড়া এক ম্যাজিকপ্রেমী যুবক হিসেবে দেখতে পাওয়া যাবে। এমনকি, ছদ্মনামধারী শার্লক হোমসের দেখাও মিলবে বইটির পাতায়।এতসব ঐতিহাসিক চরিত্রের সম্মিলনেও প্লটটা যে একদমই খেই হারিয়ে ফেলেনি বরং ঐতিহাসিক ও কাল্পনিক চরিত্রসমূহ নিখুঁতভাবে প্লটের মাঝে একাকার হয়ে গেছে তার জন্যে লেখককে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।শুধু কি তাই?দারোগা প্রিয়নাথের ডায়রি,তৎকালীন নামজাদা গোয়েন্দা তারিণীচরণের অমূল্য ডায়রি,প্রাচীন নথিপত্র, গণপতির রহস্যময় ভূতের বাক্স কি নেই এই উপন্যাসে?! উপন্যাসের অন্যতম প্রশংসনীয় একটি দিক হচ্ছে প্রাচীনসময়ের নথি-পুস্তক-প্রিয়নাথ কিংবা তারিণীর ডায়রি এবং বর্তমান সময়ের গল্পকথকের লেখা মাঝের ফারাকগুলো অবলীলায় ধরতে পারা গেছে।যার একমাত্র কারণ- দৃশ্যপট বদলানোর সাথে সাথে লেখক বারবার নিজের দৃষ্টিকোণ এবং ভাষার ব্যবহারের-ও পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। দেড়শো বছরের পুরনো কাগজাদিতে যেমনিভাবে সাধুভাষায় লেখা সেকেলে বর্ণনা,সেকেলে যতিচিহ্নের ব্যবহার ,ইংরেজি শব্দের প্রয়োগহীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে বর্তমান সময়ের কাগজ-পত্রে আধুনিক যতিচিহ্নে চলিত ভাষার প্রয়োগ এবং কথায় কথায় ইংরেজি শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এখানে লেখক তাঁর শব্দশৈলী-জ্ঞান এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন।
বলাই বাহুল্য, লেখক যথেষ্ট কাঠ-খড় পুড়িয়েই এই দুর্দান্ত প্লটটাকে দাঁড় করিয়েছেন।নতুবা,ফিকশনের মাঝে নন-ফিকশনের এমন চমৎকার সংমিশ্রণ ঘটানো সম্ভব নয়।তথ্যের বাহুল্য কিংবা ঘটনার অতিরঞ্জন কোনোটাই চোখে পড়েনি এই উপন্যাসে।বলা ভালো, গোটা উপন্যাসজুড়ে ঝরঝরে, মেদহীন গদ্যভাষায় সুচারুরূপে বাস্তব এবং কল্পনার মেলবন্ধন ঘটেছে। ঠিক যতটুকু ভিজ্যুয়াল বর্ণনা প্রয়োজন লেখক ঠিক ততটুকুই দিয়েছেন, লেখার সাথে তালমিলিয়ে গল্পের গাঁথুনি-ও সমগতিতে এগিয়েছে।এর সাথে অনন্য সংযোজন হিসেবে যুক্ত হয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায় গৌতম কর্মকারের দারুণ অলংকরণ।পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো, বর্ণনার সঙ্গে এঁটে দেওয়া এই চিত্রগুলো যেন চোখের সামমে গোটা উপন্যাসটাকেই তুলে এনেছে।
গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে সৃষ্টি উত্তেজনায় ভরপুর-শক্তিশালী প্লট নির্ভর রহস্যময় এই উপন্যাসটি পাঠ না করলে বোধহয় সুসাহিত্যের স্বাদ থেকে কিছুটা বঞ্চিত-ই হবেন।এই উপন্যাসটির শেষাংশে রয়েছে বিশাল চমক।শেষ হয়েও যেন হবে না শেষ ;রয়ে যাবে এর রেশ। হয়তো, এ-কারণেই আবারও গোটা উপন্যাসটা পড়তে বসে যেতে হতে পারে!
বেশ লাগলো। সব বিষয়ের ইতিহাস বলাটা জরুরী ছিল না হয়তো, কিন্তু, লেখক আসলেই শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাঠক ধরে রাখার মতো সর্বজনগ্রাহ্য এক গোয়েন্দা উপন্যাস লিখতে চেয়েছেন। তাই, তথ্যদানে কার্পন্য করেন নি। একে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবেও অনায়াসে চালানো যায়। কারন, অনেক বাস্তব চরিত্রও কাল্পনিক চরিত্রের পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে। একবারও মনে হয় নি যে কোন একটা জায়গায় ফাঁকি দিয়ে পার পেতে চাইছেন। এবারে ‘নীবারসপ্তক’ পড়া ফরয হয়ে গেল।
বইটা নিয়ে গত ২-৩ বছর ধরে ব্যাপক রিভিউ দেখেছি, এতো রিভিউ দেখে মনে হচ্ছিলো হয়তো পাঠ করলে বদহজমও হতে পারে। সচরাচর আমি হাইপে থাকা সকলকিছুই পড়া/দেখা এড়িয়ে চলি, যখন হাইপটা কমে যায়, তখন পড়ি/দেখি। সূর্যতামসী নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো বিশেষ কারনে। বইয়ের কিছু রিভিউ পড়ে বারবার ড্যান ব্রাউনের কথা মনে হচ্ছিলো, সচরাচর বাংলাতে এতো তথ্য সমৃদ্ধ উপন্যাস খুঁজে পাওয়া যায়না। দুই-তিন বছরে প্রায় যখন সকল রিভিউ ভুলে গেছি, তখন বইটা পড়া শুরু করলাম। বইটির কাহিনি মূলত দুইটি টাইমলাইনে, একটি ১৮৯২ সালে, অন্যটি ২০১৮ সালে। দুটি লাইমলাইনেই দুটি খুন হয়েছে। দুটি খুনের ধরণই একই রকম। ১৮৯২ সালের খুনের সাথে জড়িয়ে পড়ে পুলিশ প্রিয়নাথ এবং জাদুকর গণপতি, মজার বিষয় এই দুইজন সত্যিকারের চরিত্র। এই প্রিয়নাথই বাংলা সাহিত্যে তার পুলিশ জীবনের সকল রহস্য কাহিনি নিয়ে লিখেছেন 'দারোগার দপ্তর', অন্যদিকে গণপতিকে আমি চিনতাম না, একটু ঘাটাঘাটি করে জানতে পারি শৈশবে আমি যেই পি.সি সরকারের জাদুর বই ঢাকা শহরের হকারের দোকান খুঁজে খুঁজে এনে যাদু শিখতাম ইনি সেই পি.সি সরকারের ওস্তাদ। এছাড়াও আরও দুইজন প্রধান চরিত্র রয়েছেন গোয়েন্দা তারিণী এবং বিলাতী সাহেব সাইগারসন। মূলত এই চারজন মানুষ ১৮৯২ সালের ঘটনর মূল চরিত্র। তাদের উপরই বর্তায় ১৮৯২ সালের খুনের তদন্ত। কাহিনিতে উঠে আসে চীনা গুপ্ত সংঘ, গুপ্ত সংকেত, যাদুবিদ্যা, কলকাতার ইতিহাস, ঐতিহাসিক চরিত্র সহ নানা কিছু। নানাবিধ তথ্য দেখে বইটির শেষের দিকে খুঁজে দেখি নানা বইয়ের রেফারেন্স, লেখক যে ব্যাপক লেখাপড়া করেই বইখানা লিখেছে তা বুঝতে পারলাম। অন্যদিকে একইভাবে খুন হয় ২০১৮ সালেও, এখানে মূল চরিত্র ডিটেকটিভ তুর্বসু, যে কিনা আবার ১৮৯২ সালের কাহিনির গোয়েন্দা তারিণীর উত্তরপুরুষ। ধীরে ধীরে প্রায় ১২৫ বছর আগের-পরের দুটি কাহিনি একে অপরের সাথে জড়িয়ে যেতে থাকে, কাহিনি ঘোলাটে হতে থাকে। শৈশব থেকেই গোয়েন্দা কাহিনি পড়ে বড় হয়েছি। তিন গোয়ন্দা, অয়ন-জিমি, মাসুদ রানা, শার্লক, ব্যোমকেশ, ফেলুদা, এরকুল, কাকাবাবু সহ নানা গোয়েন্দার সাথে ছোট্টবেলা থেকেই পরিচয়। বইটি পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো সেই শৈশব-কৈশোরের স্বাদ পাচ্ছি, তবে এই বইটি বেশি তথ্যসমৃদ্ধ হওয়াতেই উপভোগ্য ছিলো, তথ্যের সাথে কাহিনি ফুটিয়ে তুলেছে লেখক দারুণভাবে। কিন্তু বইটির শেষে কিছু জট যখন খুলতে থাকে, তখন তেমন বেশি অভিভূত হইনি, যেনো মনে হচ্ছিলো এমনটাই হবে তা আগে থেকেই ধারণা করা যায়, প্রেডিক্টেভল লাগলো কিছুটা। তবে যতোটুকু জানি পরবর্তী খন্ডে রহস্য আরও বেশি জট পাকাবে। . অনলাইনে পরিচিত হওয়া এক ছোট বন্ধু এই সিরিজের তিনটি বই গিফট করেছে, প্রথম বই 'সূর্যতামসী' পড়ে শেষ করলাম, শেষ করেও নানাবিধ প্রশ্ন মনে থেকে গেলো, সিরিজের দ্বিতীয় বইটি পড়া শুরু করবো কিছুদিনেই।
রীতিমতো ঈর্ষনীয় প্লট। যে প্লট নিয়ে কাহিনি অবতারণা করেছেন কৌশিক বাবু তা যদি অহেতুক ইনফো ডাম্পিংয়ের দোষে ভারাক্রান্ত না হতো তাহলে বইটাকে নির্দ্বিধায় ৫ এ ৫ দেয়া যেত। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। একটা লা-জওয়াব ডিটেকটিভ স্টোরি লেখার সমস্ত উপকরণ ছিল তার কাছে। কিন্তু কৌশিক বাবু হাঁটলেন জ্ঞান বিতরণের মহান ব্রত নিয়ে। যাই দেখলেন তাই ব্যাখ্যা করলেন। যা ব্যাখ্যা করার দরকার নেই, তাও ব্যাখ্যা করলেন। শুধু ব্যাখ্যা নয়, এ একেবারে কেরাণী স্টাইলে লিপিবদ্ধকরণ। মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এত এত তথ্য দেয়ার আদৌ কি কোন দরকার ছিল? তাও একেবারে সন তারিখ সহ।
বেজে উঠলো ড্রাম। হাততালির আওয়াজে কাঁপছে গোটা করিন্থিয়ান হল। মঞ্চে জাদু দেখাচ্ছেন উনিশ শতকের বিখ্যাত বাজিকর রবার্ট কার্টার। ব্রিটিশ বড়লাটও আজকে শো দেখতে হাজির।
কার্টার সাহেব দেখাবেন 'ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক' - হিমালয় থেকে শিখে আসা সেই খেলা যা সহজে কেউ দেখানোর সাহস করে না। শূন্যে ছুঁড়ে দেওয়া দড়ি বেয়ে উঠে গেলেন কার্টারের সহযোগী চিন-সু-লিন। সাহেব মন্ত্র পড়ছেন... 'ওম-ম-ম...'। গোটা হলে পিনপতন নীরবতা। মঞ্চের পাটাতন ভেঙে উপর থেকে পড়লো একটি দেহ - চিন-সু-লিন! নগ্ন, ঘাড় মটকানো, নিঃসাড়!
চীনেপাড়ায় আরেকটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। লোকটা ভিনদেশি, বুক থেকে তলপেট পর্যন্ত গভীর করে ফেঁড়ে ফেলা হয়েছে। পুরুষাঙ্গটি নেই, সমস্ত শরীর রক্তশূন্য, বুকের চামড়া কেটে অদ্ভুত কিছু এক চিহ্ন আঁকা হয়েছে। গোয়েন্দা পরিদর্শক প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় জানতে পারলেন এই চিহ্নটি ব্যবহার করে চৈনিক গুপ্তসমিতি, যার অর্থ বজ্র!
এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও, গোয়েন্দাগিরি পেশা হিসেবে ফ্যান্সি হলেও পসার তেমন নয়। তুর্বসুর রক্তে মিশে আছে কাজটা, পরদাদা তারিণীচরণ রায় ছিলেন কলকাতার প্রথম বাঙ্গালী প্রাইভেট ডিটেকটিভ। রক্তের টানেই বড়দাদুর পুরোনো অফিসটা ঝেড়েমুছে বসে পড়েছে তুর্বসু। দু বছরে ফেলুদা হবার স্বপ্ন এসে ঠেকেছে পরকীয়ার কেসে।
বোরিং জীবন পুরোপুরি বদলে গেল, যেদিন খুন হলেন প্রথম এবং প্রাক্তন ক্লায়েন্ট দেবাশীষদা। চন্দননগরে নিজের লাইব্রেরিতে খুন করা হয়েছে তাকে, বুকের চামড়া ছাড়িয়ে আঁকা হয়েছে চীনা সংকেত, অণ্ডকোষ কেটে নিয়েছে কেউ। খুন হওয়ার আগে দেবাশীষবাবু হোয়াটসঅ্যাপে তুর্বসুকেই শেষ মেসেজটা পাঠিয়েছিলেন:
কী জানে তুর্বসু? সেটা সে নিজেই জানে না! তবে এটুকু বুঝতে পারছে, উত্তর খুঁজতে হলে ডুব দিতে হবে উনিশ শতকের কলকাতায়, জাদুবিদ্যা, পাগলাগারদ, ভয়ংকর ষড়যন্ত্র আর গুপ্তসমিতির ইতিহাসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দেবাশীষদার খুনের রহস্যের সমাধান।
লেখক শুরুতেই বলে নিয়েছেন, এই উপন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন বাস্তব তথ্য ও চরিত্র। সেই সূত্রেই গল্পে চলে এসেছেন উনিশ শতকের গোয়েন্দা ও 'দারোগার দপ্তর'র লেখক প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, বাংলার আধুনিক জাদুবিদ্যার পথকৃৎ গণপতি চক্রবর্তী, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের মতো বাস্তব চরিত্ররা।
দু'টি টাইমলাইনে রহস্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ধারাটায় এখন নতুনত্ব নেই তেমন। তবে বইটির প্রধান আকর্ষণ পুরোনো কলকাতা আর জমজমাট রহস্য। তিন খন্ডে সাজানো গল্পে উনিশ শতকের জাদুর মঞ্চ থেকে বেশ্যাপাড়ায় সমাধানের খোঁজে ছুটে বেড়িয়েছে প্রিয়নাথ ও তারিণী। আর সেই সুতো এই সময়ে ধরে এগিয়ে গিয়েছে তুর্বসু। বিভিন্ন সময়ে ও ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প বলার সময় লেখক খেয়াল করার মতো ভাষাগত পরিবর্তন এনেছেন।
বইটির ফ্ল্যাপের কথা এবং পরিবেশনাও ছিল পুরোনো লিফলেটের বিজ্ঞাপনের আদলে। ইলাস্ট্রেশনগুলো বইটিকে আরো উপভোগ্য করেছে। কৌশিক মজুমদারের ঝরঝরে লেখনশৈলী পড়তে ভালো লাগে, তার গল্প বলার ঢঙে অনেকটাই সত্যজিৎ রায় বা সেই সময়ের লেখকদের একটা ধাঁচ আছে। সংক্ষিপ্ত অধ্যায় আর টানা গল্পের গাঁথুনি তো আছেই। কিছু কিছু দৃশ্যায়ন দারুণ রোমাঞ্চকর ছিল। বইটি লিখতে লেখককে পুরোনো কলকাতা নিয়ে প্রচুর পড়তে হয়েছে সন্দেহ নেই। যদিও কখনো মনে হয়েছে তথ্য ও ইতিহাসের আধিক্য একটু কম হলেই ভালো হতো।
'সূর্যতামসী'র ফ্ল্যাপের আর বাইরের চেহারা দেখে যেকোনো পাঠকের জিভে জল আসতে বাধ্য। তবে ইতিহাস, বহু চরিত্র, ঘটনার ঘনঘটা আর কাহিনীর জটিলতা সব ধরনের পাঠকের জন্য সুস্বাদু হবে কি না নিশ্চিত নই।
বই: সূর্যতামসী লেখক: কৌশিক মজুমদার প্রকাশনায়: বুকফার্ম প্রথম প্রকাশ: জুন ২০২০ প্রচ্ছদ: কামিল দাস অলংকরণ: গৌতম কর্মকার ভারতীয় মূল্য: ২৬৯ টাকা
....বেজে উঠলাে ড্রাম। হাততালির আওয়াজে কাপছে গােটা করিন্থিয়ান হল। মঞ্চে জাদু দেখাচ্ছেন উনিশ শতকের বিখ্যাত বাজিকর রবার্ট কার্টার। ব্রিটিশ বড়লাটও আজকে শো দেখতে হাজির ।
কার্টার সাহেব দেখাবেন 'ইন্ডিয়ান রােপ ট্রিক' - হিমালয় থেকে শিখে আসা সেই খেলা যা সহজে কেউ দেখানোর সাহস করে না । শূন্যে ছুঁড়ে দেওয়া দড়ি বেয়ে উঠে গেলেন কার্টারের সহযােগী চিন-সু-লিন । সাহেব মন্ত্র পড়ছেন... 'ওম-ম-ম...'। গােটা হলে পিনপতন নীরবতা । হঠাৎ.. মঞ্চের পাটাতন ভেঙে উপর থেকে পড়লাে একটি দেহ - চীন-সু-লিন ! নগ্ন, ঘাড় মটকানাে, নিঃসাড় !
📝 প্রতিক্রিয়া : এই বইয়ের ফ্ল্যাপে দেখতে পাবেন এতে আছে - উনিশ শতকের কলকাতা, গোপন ষড়যন্ত্র, সিম্বোলজি, দুদ্ধর্ষ চাইনিজ গুপ্তসঙ্ঘ, একের পর এক নৃশংস হত্যাকান্ড এবং জাদুবিদ্যা । তা সত্বেও এটি একটি নিখাদ ‘ডিটেকটিভ মিস্ট্রি’ উপন্যাস ।
▪️এই উপন্যাসের দুটি প্লট । একটি ১৮৯৩ সালের ভারতবর্ষ, আরও বিশদে বললে - কলকাতা আর চুঁচুড়ার গলিঘুপচি, চীনাপাড়া এবং নিষিদ্ধ পল্লী । বইয়ের অপর অংশ ২০১৮ অর্থাৎ বর্তমান সময়ের । তবে উনিশ শতকের কলিকাতা বর্তমান কলকাতাকে কাহিনীর ঘনঘটনায়, বর্ণনার খুঁটিনাটিতে এবং রহস্যময়তায় ছাপিয়ে গেছে বহুগুণে । ইতিহাস এবং রহস্যের সঠিক মিশ্রণ ঘটলে তা ঠিক কতটা আকর্ষণীয় হতে পারে, তার অন্যতম উদাহরণ এই বই । এই বইতে মূল একটি চরিত্রের মধ্যে দিয়েই গল্পের ছলে ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে, যা কখনই মূল গল্পের একমুখী স্রোত থেকে পাঠককে বিচ্ছিন্ন করেনি ।
▪️লেখক কৌশিক মজুমদারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল - যে কোনো বিষয়ে দুর্দান্ত রিসার্চ করা এবং টানটান নির্মেদ লেখনী । তবে লেখকের সিগনেচার স্টাইল হচ্ছে রক্তমাংসের ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্বদেরকে নিজের কাহিনীর চরিত্র হিসেবে সুনিপুণভাবে প্রতিস্থাপন করা (যা এর আগেও লক্ষ্য করেছি ‘তোপসের নোটবুক’ বইটিতে) । এই উপন্যাসের প্রোটাগনিস্টদের মধ্যে একজন হলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, যাকে পাঠক চেনেন ‘দারোগার দপ্তর’ এর লেখক হিসেবে । এছাড়াও আর একটি মূল চরিত্র ‘গণপতি’। এই গণপতিই যে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাদুকর ‘গণপতি দ্য গ্রেট’, তা নিশ্চয়ই পাঠকরা বুঝতে পারবেন । তবে লেখক শুধু এই পর্যন্ত এসে ক্ষান্ত দেননি, তিনি সাহিত্যের ইতিহাসের বিশিষ্ট একটি ফিকশনাল চরিত্রকেও টেনে এনেছেন নিজের গল্পে, যা গল্পে অন্য মাত্রা যোগ করেছে ।
📜 উপন্যাসটির গদ্য ঝরঝরে, উপস্থাপনাও ভীষণ সুন্দর এবং দৃশ্যপট বর্ণনা একদম যথাযথ । প্রোটাগনিস্টদের চরিত্রায়ন যথাযথ, বিশেষ ভাবে বলতে হয় তুর্বসু চরিত্রটির কথা । পাঠক খুব সুন্দরভাবে ঐ চরিত্রটির সাথে একাত্মতা খুঁজে পাবেন । তবে এইসময়ের একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ যে ক্রাইম মিস্ট্রির থেকেও ডিভোর্সের কেস বেশি পাবে তা বলাই বাহুল্য ।
▪️উপন্যাসের অতীতের প্লট ‘গথিক’ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পুরোপুরি ভাবে সক্ষম । কিন্তু, ঐ কাহিনীতে প্রোটাগনিস্ট চরিত্রের ভীড় একটু বেশিই... কে যে সত্যিকারের মূল চরিত্র সেই ব্যাপারে একটু যেন খটকাই থেকে যায় ।
▪️এছাড়া, কাহিনীতে বর্তমান সময়ের যে মিস্ট্রি তৈরি করা হয়েছে তার সমাধান হয়ে ওঠেনি । লেখক ক্লিফহ্যাঙ্গার দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন পরবর্তী বইয়ের জন্য, যা রহস্য উপন্যাসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিরক্তিকর একটি বিষয় ।
🔹তবে সবমিলিয়ে বলতে পারি... প্রচুর তথ্য এবং পাঁচটি প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টার সামলে যদি গল্পের মধ্যে ঢুকে যেতে পারেন, তাহলে ২৩০ পাতার বই একটানে শেষ করতে বাধ্য হবেন ।
প্রথমেই বলে রাখি, আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। ফেসবুকে কিছু রিভিউ পড়ে আর অ্যাড দেখে কিনে ফেলেছি। সূর্যতামসী একটি ডিটেকটিভ উপন্যাস। এক সাথে দুটো সময়ের ঘটনা বলেছেন। এক, ১৮৯২ এর কলকাতা আর দুই ২০১৮র কলকাতা আর চন্দননগর। লেখক পুরনো ঘটনা বলতে গিয়ে খুব সুন্দর সাধু ভাষা ব্যবহার করেছেন। সত্যিই চমৎকার লেগেছে, অনেক দিন পর সাধু ভাষায় ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়লাম। কিছুটা সত্য ঘটনা মিলিয়ে, খুব চমৎকার একটা গল্প উপস্থাপন করেছেন। "দারোগার দপ্তর" বইয়ের স্রষ্টা প্রিয়নাথ বাবুর ঘটনা গুলো খুব সুন্দর লিখেছেন।
কেন খারাপ লেগেছে বলি - ১. বইটার প্লাস পয়েন্ট যেমন প্রচুর তথ্য ভান্ডার তেমনি ওটাই সবচেয়ে বড় দুর্বল পয়েন্ট। একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস, যেখানে থ্রিল আছে। সেখানে হঠাৎ করে চুঁচুড়ার নাম চুঁচুড়া কেন হলো , ব্যান্ডেল এর নাম ব্যান্ডেল কেনো , চন্দননগরের নাম চন্দননগর কেনো, চন্দননগরের পাঠাগারের ইতিহাস নিয়ে পাতার পর পাতা খরচ করেছেন যার সাথে মূল উপন্যাসের কোনো যোগ নেই।
২. ভালো ডিটেকটিভ উপন্যাস আর থিসিস পেপার এক বস্তু নয়। লেখকের অগাধ জ্ঞান আছে জানি, উনি উপন্যাস লিখার জন্য প্রচুর বই পড়েছেন জানি - তাই বলেন একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস সেই সব জাহির করার কোনো মানে হয় না। গল্পের ফ্লো নষ্ট হয়ে যায়।
৩. প্রচুর চরিত্র। মানলাম বড় উপন্যাসে অনেক চরিত্র হবে, তাই বলে এত হবে না যে ১০ পাতা আগে কি পড়েছিলাম গুলিয়ে যাই। মাঝেই মাঝেই পেছনে গিয়ে দেখতে হচ্ছে - এটা আবার কোন রবার্ট, নীল চোখ আবার কার ছিল, এর বাবা কে ছিল, ম্যাজিক কার কাছে শিখেছিল, চরিত্রের আগে নাম এটা ছিল এখন নাম এটা।
পরিশেষে বলি, এইসব বাদ দিলে খুব একটা খারাপ নয় উপন্যাসটা। তাই বলে বিশাল উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করার মত ডিটেকটিভ উপন্যাস নয়।
রহস্য টা আকর্ষিক হলেও লেখনীতে দূর্বলতা চোখে পড়ার মতন ছিল ||
যে কটা জিনিস একেবারেই ভাল্লাগেনি :
- অতিরিক্ত ক্যারেক্টার (বিদেশী নাম বলে প্রায়শ ই খেয় হারাচ্ছিলাম) - সাধু ভাষার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি
আর ব্যক্তিগত ভাবে আমি গল্পের মধ্যে গল্প এমন লেখনী তে কেন যেন মন বসাতে পারিনা,ম্যাগপাই,মুনফাই মার্ডার্সেও সেইম অবস্থা হয়েছিল :| কিন্তু ওইগুলো তাও সয়ে গিয়েছিলো :( এইটা সইলোনা :(
দারুণ। তবে ইতিহাসের কচকচানি একটু বেশিই হয়ে গেছে। আর বিশেষ সেই চরিত্রটিকে কাহিনিতে না টানলেও চলত। এ-দুটো ব্যাপার উপেক্ষা করলে বইটা সত্যিই ভাল। নীবারসপ্তক পড়তে তর সইছে না।
নামে গুপ্তসংঘ হলেও, বিষয়টা মোটেও গুপ্ত কি না এ নিয়ে একটা সন্দেহ আছে। যে সংঘের নাম কারো অজানা নয়, তাকে কি গুপ্ত বলা যায়?
গুপ্তসংঘ নিয়ে কচকচানি এখন থাক। এখন তুর্বসুর কথা বলি। জীবনে অনেক কিছু করতে চাওয়া ছেলেটার যখন কিছুই করা হ���ো না, তখন সে পুরনোকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। বড়ো দাদার পুরনো ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে ডিটেকটিভ হওয়ার চেষ্টা চলে। টুকটাক রহস্য সমাধানে ডাক আসে। প্রথম কেসেই পরিচয় হয় এমন এক মানুষের সাথে, যার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে খুব দ্রুতই।
দুই বছর পর আরেকটি কেসে ছুটে চলতে গিয়ে থমকে যেতে হয়। সেই মানুষটি আজ আর নেই। গতকাল হোয়াটস অ্যাপে এক মেসেজ দিয়েছিলেন। এরপর? পুলিশ জানায় নৃশংসভাবে খুন করা হয় দেবাশিসদাকে। মৃত্যুর পর যৌনাঙ্গ ও অণ্ডকোষ কেটে নেওয়া হয়। আর খুনের পদ্ধতি? পুরনো এক চীনা পদ্ধতি। কেন এভাবে খুন? খুনি কি কিছু বলতে চায়? দেবাশিসদা তুর্বসুকে ফাঁসিয়ে গেছে। এর মর্ম উদ্ধার না করে নিস্তার নেই।
জানা যায়, প্রায় একশ বছরেরও আগের এক কেসের সাথে যোগসাজস এই রহস্যের। যোগসাজস তুর্বসুর সাথেও। কেননা সেই কেসের সমাধান করতে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া তারিণী যে তুর্বসুর বড়ো দাদু। সেই সময়ও খুন হয়। তিনটি খুনের রহস্য সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাইভেট ডিটেকটিভ তারিণী, পুলিশ অফিসার প্রিয়নাথ ও একজন সাহেব সাইগারসন। অনেক জল ঘোলা করে সেই রহস্যের সমাধান হয়।
কিন্তু বর্তমান রহস্যের সমাধান করবে কে? তুর্বসু যা জানতে পেরেছে, এরপর জীবন নিয়ে না টানাটানি লাগে!
কৌশিক মজুমদারের "সূর্যতামসী" দুই সময়ে এগিয়ে যাওয়া একটি উপাখ্যান। বর্তমান সময়ের পাশাপাশি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের গল্প এগিয়ে যায়। বর্তমানের সাথে অতীতের গল্পের যোগসাজস থাকলেও তার পরিমাণ ছিল খুবই কম। এমনকি শেষভাগে এসেই দুটি টাইমলাইন একসাথে মেলেনি। বিষয়টা বোধগম্য হয়নি। হয়তো সিরিজের পরবর্তী বইয়ের জন্য জমা রেখে দিয়েছেন।
উপন্যাসটির একটি সময় ছিল বর্তমান। আরেক টাইমলাইন ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ। স্বভাবতই সেই সময় ব্রিটিশদের শাসন চলছিল। সেই সময়ের কোম্পানির শাসনের একাংশ উঠে এসেছে এখানে। একই সাথে উপমহাদেশের সেই প্রাচীন ইতিহাসের কলকাতার জীবনযাত্রার এক খণ্ডচিত্র লেখক তুলে ধরেছেন যেন। ইংরেজদের কাছে এই বাংলার মানুষ ছিল নেটিভ। চাকর শ্রেণীর। তাই বড়ো কোনো উৎসবে প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করা হতো। দেশীয় কেউ সেখানে প্রবেশের অনুমতি পেত না। অবজ্ঞা যেন ছিল সবসময়ের সঙ্গী।
শুধু তাই নয়, সাদা চামড়ার মানুষ দেখলেই যেন বিনয়ে গদগদ হয়ে উঠত এদেশের সর্বসাধারণ। সেই বিষয়টি এখনো আছে। আমরা বিদেশি কিছু দেখলেই নিজেদের মূল্যের চেয়েও তা দামি মনে করি। নিজেদের মূল্যায়ন না করে বিদেশিদের মূল্যায়ন করি। ফলাফল খুব বেশি ভালো হয় না। নিজেদের প্রতি এই অবজ্ঞা সেই সময়ের ইংরেজরা ভালো মতো ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল বলে আজও নিজেদের নিয়ে আমাদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
লেখক বই লিখতে গিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছেন বলেই মনে হয়েছে। সেই ছাপ তিনি রাখতে চেষ্টা করেছেন পুরো বই জুড়ে। ফলাফল, প্রয়োজনের অতিরিক্ত তথ্য তিনি দিতে চেয়েছেন। যার খুব একটা প্রয়োজন ছিল না। গুপ্তসংঘের একটা সূক্ষ্ম বিষয় উপন্যাসে থাকলেও ফ্রি ম্যাসন নিয়ে লেখকের অতিরিক্ত কথাবার্তা উপন্যাসের মেদ বাড়িয়েছে শুধু। প্রয়োজনের তাগিদে যে সকল তথ্য আসা প্রয়োজন, তা মেনে নেওয়া গেলেও; অতিরিক্ত তথ্যের ভার বারবার পড়ার গতিকে মন্থর করে দিয়েছে।
উপন্যাসে একবার প্রিয়নাথের কথা, কখনো তারিণীর ডায়েরি, আবার তুর্বসুর কথা, বর্তমান সময়, অতীতে ফিরে যাওয়া, সাধু/চলিতর মিশ্রণ; এক উপন্যাসে এতকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছিল। আমার মনে হয়েছে লেখকের মাথায়ও তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। কেননা শুরুর দিকে টাইমলাইন আলাদা করতে সময়ের উল্লেখ থাকলেও শেষের দিকে তা ছিল না। এছাড়া অন্তিম পর্বে লেখক প্রিয়নাথের বয়ানে সাধু রীতিতে কথা শুরু করে হুট করে চলিত ভাষার আশ্রয় নেন। আবার গুগলের বর্ণনা ছিল, যা প্রিয়নাথকে বাদ দিয়ে তুর্বসুর কথা বোঝায়। এগুলো আলাদা করা প্রয়োজন ছিল। যার অভাবে পড়তে গিয়ে বারবার হোচট খেয়েছি।
আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে চরিত্রায়ন। একেকটি চরিত্রের মাধ্যমে গল্প এগিয়ে গিয়েছে। সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দারুণভাবে আলোকিত ছিল। তবে একটা বিষয় ভালো লাগেনি। তারিণী তুর্বসুর প্রয়াত বড়ো দাদু। তাকে তুর্বসু নাম ধরে উল্লেখ করছিল কেন? যতই প্রাচীন সময়ের হোক, সম্মান দেখানো এই উপমহাদেশের ধর্ম। বিষয়টি পছন্দ হলো না।
পাগলদের চিকিৎসা নিয়ে যেভাবে আলোকপাত করা হয়েছে এক কথায় অসাধারণ। প্রাচীনকাল থেকেই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষ সব করতে পারে। গবেষণার নামে গিনিপিগ বানিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাতে কার কী যায় আসে? যেখানে বৃহৎ স্বার্থ, সেখানে ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না।
গোয়েন্দাগিরি, তদন্ত প্রক্রিয়া ভালো মতোই এগিয়ে চলেছে। আমি আরেকটু প্রত্যাশা করেছিলাম। একটা জিনিস প্রায়শই লক্ষ্য করি, নতুন কোনো গোয়েন্দা কাহিনি লিখতে গেলেই লেখক ফেলুদা, ব্যোমকেশ, শার্লক হোমসদের রেফারেন্স টেনে আনেন। আমার কেন জানি ভালো লাগে না। লেখকের তৈরি যেকোনো চরিত্র স্বতন্ত্র্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। কালজয়ী সেসব চরিত্র কল্পনায় আনার কারণেই হয়তো বর্তমানে কোনো কালজয়ী গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি হয় না। একটা বাঁধা থেকেই যায়!
শেষটা নিয়ে আগেই বলেছি, কেমন যেন মিলল না সবকিছু। হয়তো পরের বইয়ে খোলসা হবে বাকি জিনিস। পড়ার অপেক্ষায় রয়েছি। এই ধরনের বইয়ে লেখক চাইলে আরও ভালো করে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। আমরা সাধারণ পাঠকও একটু তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারতাম।
বইয়ের বাঁধাই নিয়ে অভিযোগ আছে। বই কিছুক্ষণ পড়ার পরই এক ফর্মা খুলে হাতে চলে এসেছে। আফসার ব্রাদার্স-এর মতো বড়ো প্রকাশনীর কাছ থেকে এমনটি কাম্য নয়। না-কি শুধু আমার বইয়ে এ সমস্যা, কে জানে?
খুব বেশী প্রত্যাশা নিয়েই বইটা পড়তে বসেছিলাম। নামটাও কিযে সুন্দর। অসম্ভব ভালো বাইন্ডিং আর কাভার। কি সুন্দর চিত্র। আর বইয়ের শেষে রেফারেন্স। বেশ ভালো প্রচেষ্টা, কিন্তু কেন যেন ভাল লাগল নাহ। বাকীগুলা পড়ব, দেখি কেমন লাগে। লেখার থেকে মার্কেটিং এ বেশী প্রচেষ্টা মনে হল।
কৌশিক মজুমদারের সূর্যতামসী পড়া মানে একধরনের তন্দ্রাচ্ছন্ন সফরে বেরিয়ে পড়া, যেখানে একদিকে ইতিহাসের চোরা অলিগলি আর অন্যদিকে বর্তমান সময়ের ধোঁয়াশা মিশে গিয়ে তৈরি করেছে এক দুর্বোধ্য কিন্তু চুম্বকের মতো টান বজায় রাখা গল্প। অনেকটা যেন দুই শতকের মাঝখানে টানটান করে টাঙানো একটা লুকানো দড়ির ওপর হাঁটছি আমরা—পাশে ভিক্টোরিয়ান গ্যাসবাতির রহস্যময় আলো, আর অন্যদিকে চন্দননগরের আধুনিক লাইব্রেরির নীরবতা। এই দু'প্রান্তেই একটাই শব্দ বারবার প্রতিধ্বনিত হয়—“মৃত্যু”।
উপন্যাসের দুটি মূল সময়রেখা—১৮৯২ ও ২০১৮—শুরুতে সমান্তরাল মনে হলেও, ক্রমশ তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, গণপতি চক্রবর্তী, তারিণীচরণ রায়—তাঁদের নাম শুধু গল্পের উপাদান নয়, বাংলার বাস্তব ইতিহাসের অংশ। আর এই চরিত্রগুলোকে কৌশিক মজুমদার যেভাবে flesh and blood মানুষ করে তোলেন, যেন তাঁদের ইতিহাসের ছায়া নয়, ইতিহাসের আলোতেই দাঁড় করিয়ে দেন। চীনেপাড়ার খুন, বুকের ওপর উৎকীর্ণ সংকেত, গণপতির চোখে দেখা এক মৃত্যুর পূর্বাভাস—সবই যেন বাস্তব আর কল্পনার এক অদ্ভুত সিম্বায়োসিস, এক জৈব শৈলী।
অন্যদিকে আছে বর্তমান। এবং বর্তমান মানেই গোয়েন্দা তুর্বসু রায়। বলা বাহুল্য, তিনি সেই গোঁড়ামির গোয়েন্দা নন, বরং চিরন্তন বাঙালি ছেলের মতোই জীবনযুদ্ধে জর্জরিত, অথচ নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে ঢুকে পড়েছেন এক শতাব্দী-পুরনো রহস্যের কেন্দ্রে। আশ্চর্যজনকভাবে আবিষ্কার করেন, তিনি তারিণীচরণের উত্তরসূরী। অথচ লেখক কখনও এই উত্তরসূরিত্ব নিয়ে অহেতুক নাটকীয়তা তৈরি করেন না, বরং সম্পর্কের সূত্রপাত যেন ধোঁয়া-ধরা বারান্দার মতো, জ্বলছে, কিন্তু নিঃশব্দে।
সবচেয়ে চমকপ্রদ যেটি, তা হলো গল্পে থ্রিলার স্টাইল বা গুপ্ত সংগঠন নিয়ে কোনো অতিরঞ্জিত চমক বা সস্তা উত্তেজনার চক্রব্যূহ নেই। বরং এখানে গুপ্ত সংঘের অস্তিত্ব একধরনের কালচারাল লেয়ার, যা ইতিহাসের গহীন থেকে মাথা তুলে আসে, আবার ডুবে যায়। ম্যাসন ট্রিলজির সূচনাপর্ব হিসেবে সূর্যতামসী যেভাবে শুরু করে, তাতে একেবারে চেনা কোনো ‘স্যাটারডে নাইট থ্রিলার’ পড়ার মেজাজ থাকে না—এটা পড়া মানে এক নাগাড়ে পড়ে যাওয়া নয়, পড়তে পড়তে থেমে যাওয়া, ভাবা, আবার ফিরে যাওয়া।
গল্পটি যদিও রহস্যের, অথচ পাঠক শুধু প্রিয়নাথ বা তুর্বসুর চোখ দিয়েই রহস্য ভেদ করেন না। অন্যান্য চরিত্ররাও, প্রত্যেকে তাঁদের নিজস্ব পদ্ধতিতে, এই রহস্যের টুকরোগুলোকে খুঁজে নিয়ে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেন। গণপতি, যার পৃথিবীটা জাদুর আলো-আঁধারিতে তৈরি, তারিণীচরণ, যার হাতে জন্ম নেয় আধুনিক গোয়েন্দাবিদ্যা, এমনকি বেনামে প্রবেশ করা শার্লক হোমসের ছায়া—সব মিলিয়ে গল্পটা কখনও রহস্যের, কখনও কল্পনার, আবার কখনও ইতিহাসের একাধিক স্তরের ওপরে গড়ে ওঠা একটা রূপকথার মতো লাগতে থাকে।
উপন্যাসটির শক্তি কেবল তার কাহিনির মোচড়ে নয়—লেখকের ভাষার দখলে। গদ্য অনবদ্য, কোথাও সহজ, কোথাও হঠাৎ করে পঙ্ক্তিময়। স্থান ও কালের মিশ্রণে ভাষা কখনও ক্লাসিক, কখনও সমকালীন। ১৮৯২ সালের ভাষা আর ২০১৮-র বাঙালির মুখের ভাষা যে একসঙ্গে এত সাবলীলভাবে বইতে পারে, তা কৌশিক মজুমদার না লিখলে বিশ্বাস হতো না।
অবশ্য কিছু খুঁতও ছিল। যেমন, ১৮৯২ সালের রহস্যের সমাধানটি একটু বেশিই ঠাণ্ডা ঠেকেছে। আর কিছু তথ্যের উপস্থাপনায় মাঝে মাঝে গল্পের ছন্দে সামান্য ছেদ পড়েছে। তথ্যে ভরপুর উপন্যাসে ইনফোডাম্পিং একটা চিরন্তন ফাঁদ, যা এখানে কখনও কখনও এড়ানো যেত। কিন্তু লেখকের সাহসী কাঠামো ও গদ্যের শক্তি সে ছন্দপতনকে বহু গুণে পুষিয়ে দিয়েছে।
সব মিলিয়ে সূর্যতামসী হল এক আশ্চর্য পাঠ্য অভিজ্ঞতা। যেটি পড়া মানে শুধু ইতিহাস জানার চেষ্টা নয়, বরং ইতিহাসের বুকে হাত বুলিয়ে দেখা—আলো, আঁধারি, রক্ত আর রহস্যে মোড়া অতীতকে। যিনি ভেবেছিলেন এটা একটি সাধারণ গোয়েন্দা উপন্যাস, তাঁর জন্য এটা একটা সাহিত্যমূল্য সম্পন্ন, বহুস্তরীয় যাত্রা হয়ে উঠবে। আর এই যাত্রার শেষ কোথায়, তার জন্যই হয়তো আমরা অধীর অপেক্ষায় থাকব ট্রিলজির দ্বিতীয় পর্বের।
বইটি শেষ করার পর তাৎক্ষণিক অনুভূতি হচ্ছে 'চুড়ান্ত হতাশা'। এর অসম্ভব সুন্দর স্টোরি বিল্ডিং আমাকে যেমন হিলিয়াম বেলুনের মতো উড়িয়ে নিয়ে গেছে, এর এন্ডিং আবার তারচেয়েও বীভৎস ভাবে সেই বেলুনে আলপিন ফুটিয়ে দিয়েছে। আপাতত হতাশার তিক্ত স্বাদ নিয়ে বসে আছি। এর থেকে বেরোতে সময় লাগবে।
প্রচুর তথ্যে ঠাসা এবং কৌতুহলোদ্দীপক। কিন্তু গনপতি ও তারিণীদের সাথে তুর্বসু ও দেবাশিসদের যোগসূত্রতার দূরত্ব ঠেকছিল। শেষে মিলিয়ে দিয়ে লেখক অবশ্য উতরে গেছেন তবুও সুখপাঠ্য হওয়ার পরীক্ষায় কতটুক উত্তীর্ণ হয়েছেন তা প্রশ্ন রাখে(!)। যাই হোক প্রচুর আগ্রহ নিয়ে কেনা হয়েছিল, ততটা অবশ্য পূরণ করতে পারেনি। হতে পারে আমার ব্যর্থতা যে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতেছিলাম না এবং একটা ঘটনার সাথে আরেকটা ঘটনা সিনক্রোনাইজ করতে পারছিলাম না। সময় পেলে আরো একবার পড়ার ইচ্ছে আছে। ততদিনে না হয় নীবারসপ্তক পড়ার কথা চিন্তা করতে হয়। হ্যাপি রিডিং💙
'সূর্যতামসী', রিসেন্ট টাইমের দুই বাংলার সবচেয়ে বেশী হাইপড থ্রিলার বইগুলোর একটা আর জনপ্রিয় ম্যাসন ট্রিলজির প্রথম বই। বইটা জনরায় মূলত ডিটেকটিভ মিস্ট্রি থ্রিলার, তবে বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা পড়লে বর্তমান সময়ের ড্যান ব্রাউনীয় মশলা মাখানো গতানুগতিক হিস্টোরিক্যাল কন্সপিরেসি থ্রিলারই বেশী মনে হয়। একারণে বাজারি স্টাইলে লেখা ফ্ল্যাপটা পড়ে বইটা কেনার তেমন ইচ্ছে ছিল না, তবে একবার বাতিঘরে বইটার বাংলাদেশী সংস্করণের প্রচ্ছদ দেখে ভালো লাগায় কিনেছিলাম।
সেইসাথে এই ট্রিলজির অতীতের অংশে লেখক কিছু জনপ্রিয় আর ক্লাসিক, বাস্তব আর ফিকশনের চরিত্রদের ক্রসওভার রেখেছেন শুনে কিছুটা আগ্রহ ছিল, বেশ ভালো ভালো রিভিউ দেখে তাই পুরো ট্রিলজিটাই সংগ্রহে নিই। যাইহোক, সিরিজের প্রথম বই 'সূর্যতামসী', যা শুরু থেকেই একটা জমজমাট মিস্ট্রি থ্রিলার হবার সম্ভাবনা দেখায়।
সিরিজের গল্প নিয়ে বলতে গেলে, এটা একটা ভিক্টোরিয়ান আমলের ডিটেকটিভ গল্প বর্তমান সময়ের কন্সপিরেসি এডভেঞ্চার থ্রিলার হিসেবে মোটামুটি মানের। অতীতের গল্পে যদিও লেখক অনেকরকমেরই উপাদান রেখেছেন, তবে তা কতটুকু কার্যকরী? এই বইয়ে লেখকের লেখনী ভালোই বলতে হবে। সাবলীল গল্পকথন, পড়তে ভালো লাগে আর তা গল্পের সাথে মানানসইও। অতীতের অংশে ইংরেজ শাসিত কলকাতার সিস্টেমটাকে লেখক বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। সেইসাথে সোনাগাছির বেশ্যাপল্লি, জাদুকরদের কার্যক্রম, উনিশ শতকের চিকিৎসাক্ষেত্রের অবস্থা সবকিছুর উপস্থাপনা মোটামুটি ভালো হয়েছে।
তবে সবকিছুর শেষ কথা, গল্পের রহস্য আর তার সমাধানটা কেমন? আমার মতে খুব একটা সুবিধার না। প্রথমত, বর্তমান সময়ের মূল রহস্যের কথা বললে বলব, সেটা খুব কমই বিকশিত হয়েছে। অল্প স্থানে কোনোমতে লেখক মূল রহস্যটাকে শুরু করেছেন বলা চলে। সামনের পর্বগুলোতে তা আরও ভালো করে প্রকাশ করবেন আশা করি। তবে যা এসেছে, তা খুবই গতানুগতিক, তেমন ইন্টারেস্টিং কিছু পেলাম না।
আর অতীত অংশটার ব্যাপারে বলতে গেলে, যেই কাহিনীটা লেখক এই বইয়ে শেষ করেছেন, তা খুব একটা খারাপ ছিল না। কিন্তু লেখক অজস্র চরিত্র, পরবর্তী পর্বের রহস্যের সেটাপ, যেটার সাথেই মূলত বর্তমান সময়ের গল্পটা কানেক্টেড, রাখতে গিয়ে সেটাকে খুব একটা ভালোমতো গড়ে তুলতে পারেন নি। আমার মতে তা হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ তিনখানা আলাদা আলাদা গোয়েন্দাদের দিয়ে তদন্ত করানো। হুটহাট অতীত বর্তমান টাইমলাইন বদলানোর মাঝখানে কিভাবে গোয়েন্দারা তদন্ত করলো, সূত্র পেলো আর সবশেষে সমাধান হলো তা খুব একটা বোধগম্য হবে না। সবশেষের রহস্যের সমাধানটা মোটামুটি।
চরিত্রায়নেও কিছুটা সমস্যা ��ছে। অতীতের গল্পে এতোবেশী চরিত্র আর কি বলব। সেইসাথে তিন গোয়েন্দা প্রোটাগনিস্ট প্রিয়নাথ, তারিণী আর সাইগারসন কাউকেই তেমন সুগঠিত চরিত্র বলা যায় না। বিশেষ করে সাইগারসনের চরিত্রটা বেশ হতাশ করেছে (যারা জানেন তারা জানেন)। শুধু একটু ভালো লেগেছে পরের পর্বের গুরুত্বপূর্ণ গুটি হতে যাওয়া গণপতিকেই, যাকে কিছুটা জোড় করে এই বইয়ে আনা হয়েছে বলা চলে, তবুও এই জনপ্রিয় বাঙালি ম্যাজিশিয়ানকে ফিকশনরুপে মোটামুটি দারুণভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে।
এবাদে বর্তমান সময়ের কাহিনীটা তো তেমন একটা প্রকাশ পাই নি, দুয়েকটা হাতেগোনাদের বাদে তেমন কোনো চরিত্র আসে নি। ফলে ছোটখাটো টুইস্টখানা অনুমান করা কঠিন হবে না। বাদবাকি চরিত্রগুলো খুব আহামরি কিছুও নয়। হুটহাট অতীত বর্তমান জাম্পকাট, কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জ্ঞান দেওয়া বিরক্তি সৃষ্টি করেছে। সবমিলিয়ে আমি 'সূর্যতামসী' বইটা নিয়ে বেশ হতাশ। হয়তো লেখক পরের পর্বে ভালো করবেন, তাই প্রথম পর্বে সেটাপ করেছেন বেশী। তবুও এতো জনপ্রিয় এই বইটা, যার হাইপেই এই সম্পূর্ণ ট্রিলজিটা জনপ্রিয় হয়েছে বলা চলে, তা থেকে আরও বেশী কিছু এক্সপেক্ট করেছিলাম।