হার্বার্ট জর্জ ওয়েলসের সম্বন্ধে কিছু, অন্তত এই আলোচনায়, লেখা নিতান্তই অনাবশ্যক। তাঁর তিনটি অবিস্মরণীয় উপন্যাস এবং উনিশটি ছোটোগল্প অদ্রীশ বর্ধনের রোমহর্ষক অথচ সরস অনুবাদে স্থান পেয়েছে এই বইয়ে। সেগুলো নিয়েও নতুন করে কিছু লেখা বৃথা, কারণ লেখাগুলো ইতোমধ্যেই পাঠকমহলে প্রশংসা, এমনকি মুগ্ধতা অর্জন করেছিল। যা নিয়ে লেখা উচিত তা হল এই বইয়ের বুক-মেকিং। সম্পাদনা যে একটি বইকে কতখানি সমৃদ্ধ করতে পারে, আর মুদ্রণ-পারিপাট্য যে সেই উদ্যোগের সঙ্গে কতখানি সঙ্গত করতে পারে, তার একটি মডেল বলা চলে এই বইকে। শতাব্দীপ্রাচীন পত্র-পত্রিকা থেকে উদ্ধার করা অলংকরণ, প্রকাশকালীন নানা তথ্য, ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট কাজটি নিয়ে অনুবাদকের ভাবনা— এ-সবই পরম যত্নে ও শুদ্ধভাবে পরিবেশন করা হয়েছে এই রয়্যাল সাইজের হার্ডকভারে। ফলে আমার মতো পাবলিক— যে বহু আগেই ওয়েলসের এই লেখাগুলো মূলে পড়েছে এবং কাছে রেখেছে— বইটার এই অসাধারণ পরিবেশনের টানেই সেটিকে সংগ্রহ করতে, নতুন করে লেখাগুলো পড়তে, আর এখন এই রিভিউ করতে একরকম বাধ্য হচ্ছে। দারুণ সব কাহিনি, তার দুর্দান্ত অনুবাদ, আর একেবারে অতুলনীয় পরিবেশন— এমন ত্র্যহস্পর্শ-যোগের পরেও যদি বইটাকে ঝটপট জোগাড় না করেন, তাহলে কী আর বলব!
এইচ জি ওয়েলস কে কেন কল্পগল্প জনরার কিংবদন্তিতুল্য ধরা হয় তা বুঝা গেল। এই সংকলনে বড় ও ছোট গল্প উভয়ই স্থান পেয়েছে। বড়গল্পগুলো বেশ আকর্ষণীয়। সেই তুলনায় ছোটগল্পগুলো আবার কিছুটা ম্লান। তবে ছোট করে দেখা যাবেনা কোনোটাকেই। অদ্রীশ বর্ধন অনুবাদেও মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। সব মিলিয়ে উপভোগ্য একটা বই। কল্পগল্পে আগ্রহ থাকলে এই বই রিকমান্ডেড।
তিনটি সায়েন্স ফিকশন /ফ্যান্টাসী উপন্যাস নিয়ে এই সমগ্রটি। নামকরণটি তবু একটিু ধন্দে ফেলে দেয়। কল্পগল্প সমগ্রে উপন্যাস কেন? আর সমগ্রই যদি বলা হচ্ছে তাহলে এই ধরনের সবগুলো লেখা এই বইয়ে স্থান পায় নি। এইচ. জি. ওয়েলস লেখালেখি শুরু করেছিলেন উনিশ শতকের শেষ ভাগে। তীব্র কল্পনাশক্তি আর মৌলিকতা ছিল বলে তার লেখাগুলো উঠে গিয়েছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। পরবর্তীতে সামাজিক কর্মকান্ড, রাজনীতি ও সামাজিক জীবন নিয়ে লেখালেখিও করেছেন। তবে তার শুরুর দিকের সায়েন্স ফিকশনগুলোই বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল, পরবর্তীতে নিজে নিজেকে আর ছাড়িয়ে যেতে পারেন নি। এই বইয়ের বেশিরভাগ লেখাই তার শুরুর দিকের সাহিত্যকর্ম। টাইম মেশিন উপন্যাসটি তো চিরকালের ক্লাসিক একটি উপন্যাস। ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হতে পারে তা ই নিজের কল্পনায় একেছেন এই উপন্যাসে এইচ.জি.ওয়েলস। দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস উপন্যাসে তিনি লিখেছেন মঙ্গল গ্রহীদের সাথে পৃথিবীবাসীর লড়াই। সেই লড়াইয়ে মঙ্গল গ্রহবাসীরা ব্যবহার করেছিল ধাতব বিশালাকৃতি রোবট, লেসার গান সদৃশ অস্ত্র আর বিষাক্ত গ্যাস। এতো আগে এতো আধুনিক অস্ত্রের কথা ভেবেছিলেন এইচ.জি. ওয়েলস। এতো শক্তিশালী মঙ্গলগ্রহবাসীরা কিন্তু জিততে পারে নি লড়াইয়ে। মানুষ তাদের হারায় নি, তারা হেরে গিয়েছিল পৃথিবীর জীবাণুর কাছে। তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রুখতে পারে নি আপাত অদৃশ্য জীবাণুদের। এই কাহিনীর সাথে বর্তমান সময়ের ঘটনার সাথে মিল আছে অনেক। অস্ত্র নির্মাণে তো অনেক এগিয়েছে পৃথিবী তবু করোনা সংক্রমণ রুখতে তো আর এসব কাজে লাগে না। ভাবীকালের একটি গল্প উপন্যাসটি দ্বাবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীকে নিয়ে। সেই কল্পনা হয়তো বাস্তবে মিলবে না, তবু উড়োজাহাজ, চলন্ত সিড়ি এমন সব কল্পনা করেছিলেন তিনি এই উপন্যাসে।
আত্মার ব্রহ্মান্ড পর্যটনে তিনি বর্ণনা করেছেন নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স, সবুজ গুরো গল্পে প্যারালাল ইউনিভার্সকে, ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ, ক্রিস্টাল ডিম, জীবন্ত স্বপ্নগল্পগুলোতেও লেখকের আশ্চর্য কল্পনাশক্তির পরিচয় মেলে। লোহার কচ্ছপ গল্পে তিনি কল্পনা করেছেন যুদ্ধ-ট্যাঙ্ক এর যা আরও কয়েকদশক পরে বাস্তবে ব্যবহার হয়েছিল। কল্প বিজ্ঞান যাদের ভালো লাগে তাদের এই বইটি ভালো লাগবে। অনুবাদের মানও খারাপ নয়। সবমিলিয়ে দারুণ লেগেছে এই বইটি।
(বই পরিচিতি দেবার আগে কিছু প্রাক-কথন করতে চাই। পরবর্তী প্যারায় একটি গল্পের স্পয়লার আছে।) অনেক বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা নাটকের সিরিজ দেখতাম 'মনের মুকুরে' নামে। এতে মূলত বিদেশি কাহিনী অবলম্বনে দেশি নির্মাতাদের তৈরি নাটক প্রদর্শন করা হত। সেই অনুষ্ঠানের একটা নাটকের কথা আমার এখনও মনে আছে। নাটকের ঘটনাটা এরকম- এক বৃদ্ধ ব্যক্তির সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় একজন তরুন যুবকের। বৃদ্ধ জীবন সায়াহ্নে উপস্থিত, হাতে অঢেল অর্থ। আর তরুনের চোখে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ন, তবে প্রায় কপর্দকহীন। বৃদ্ধের কোন উত্তরাধিকারী নেই। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার সকল সম্পদ যুবকের মালিকানায় দিয়ে যাবেন। আকস্মিক এই বিপুল সম্পদের হাতছানি এড়ানো মুশকিল, বলাই বাহুল্য। তবে বৃদ্ধের এক শর্ত- যুবককে বৃদ্ধের নামটি গ্রহন করতে হবে, নিজের আসল নামে আর পরিচয় দেওয়া যাবে না। যুবক শর্তে রাজি হলেন। দুজন তাদের চুক্তি পালনের পর উদযাপন করলেন। এরপর সদ্য-ধনাঢ্য যুবক ধীরে ধীরে আবিস্কার করলেন যে তিনি আর যুবক নেই, কোন এক আশ্চর্য প্রক্রিয়ায় তিনি রাতারাতি এক হতশ্রী এক বৃদ্ধে পরিনত হয়েছেন। যুবক বুঝতে পারলেন, ধনী এই বন্ধুটি মোটেও তার কোন শুভাকাঙ্ক্ষী নন, বরং অঢেল টাকাকড়ির লোভ দেখিয়ে তিনি বিনিময়ে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ- তার যৌবন। অর্থাৎ পূর্বের সেই বৃদ্ধ এখন যুবকের দেহে প্রবেশ করেছেন, তার সামনে এখন জীবনকে পুনরায় উপভোগ করার অবারিত সুযোগ। (একটা গল্পের স্পয়লার দিয়ে ফেললাম, ক্ষমাপ্রার্থী। এই গল্পটা পড়ে খুব বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। এতটা নাড়া দিয়ে না গেলে এই পোস্টই লিখতাম না।)
দুই দশক পেরিয়ে এসে মূল গল্পটির সন্ধান পেলাম অদ্রীশ বর্ধন অনূদিত এইচ জি ওয়েলস কল্পগল্প সমগ্র বইটিতে। ওয়েলসের ৩টি উপন্যাস আর ২০টি গল্প এতে রয়েছে। একটা সমগ্র শ্রেণীর সংকলনে পেছনের যত তথ্য দরকার বলে মনে হয় তার প্রায় সবই পাওয়া যাবে। বাংলা ভাষায় ওয়েলস অনুবাদের ইতিহাস থেকে শুরু করে আজতক কারা কারা এই নিয়ে মানসম্পন্ন কাজ করেছেন তার খুঁটিনাটি বিবরন আছে। আছে ওয়েলসের প্রত্যেকটি গল্পের সময় ও প্রকাশের ইতিহাস। এমনকি, সেই এক শতাব্দীরও আগে কোন ম্যাগাজিনে বা পত্রিকায় ওয়েলসের কোন গল্প প্রকাশিত হয়েছে, সেই ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ পর্যন্ত সংগ্রহ করে ছবি সংযোজন করা হয়েছে বইএর শেষে।
অতি আবশ্যিকভাবে রয়েছে ওয়েলসের জীবনী। ওয়েলস সায়েন্স ফিকশনের বাইরেও ইতিহাস, সমাজ, গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র নিয়ে লিখেছেন। মূল ধারায় সাহিত্যও রচনা করেছেন। তার এসব সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের আলোচনা ও সমালোচনা আছে প্রকাশকের কথায়।
অদ্রীশ বর্ধন প্রয়াত হয়েছেন ২০১৯ সালে। ১৯৬৩ সাল থেকেই তিনি বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের প্রসারে কাজ শুরু করেন। তার প্রকাশিত 'আশ্চর্য!' নামের পত্রিকাটি ভারতের ইতিহাসে প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা। খুব অল্প সময়ের স্থায়িত্বে এই পত্রিকা পাঠক সমাজে এক গভীর ছাপ রেখে গিয়েছিল। অদ্রীশ বর্ধন ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মত এইচ জি ওয়েলসের কল্পগল্প সমগ্র প্রকাশ করেন। এর দীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছরের ব্যবধানে আবারো যৌথভাবে বইটি প্রকাশ করেছে কলকাতার ফ্যানটাসটিক ও কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস। অদ্রীশ বর্ধনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে।