বাংলার রাজনীতিতে এক অনবদ্য চরিত্র আবুল কাশেম ফজলুল হক। শেরে বাংলা কিংবা হক সাহেবের জীবদ্দশায় তাঁর একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন বি.ডি. হাবীবুল্লাহ। হক সাহেবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন বি.ডি. হাবীবুল্লাহ। তাই এই জীবনীগ্রন্থে হক সাহেবের গুণমুগ্ধ হাবীবুল্লাহর মাধ্যমে সন্ধান পাওয়া যাবে বহুমাত্রিক ফজলুল হককে।
উদার একটি পরিবারে জন্মেছিলেন এ কে ফজলুল হক। বিপন্নকে সহায়তাদান করতে বিপুল অর্থ ঋণ করেছিলেন হক সাহেবের দাদা। তাই তা্কে দেনায় দায়ে জেলে যেতে হয়েছিল। এমনকি হক সাহেবের পিতা ওয়াজেদ আলীও এই স্বভাবের বাইরে যেতে পারেননি। পূর্বজদের মুক্তহস্তে দানের রীতিটিকে আমৃত্যু চর্চা করেছেন হক সাহেব।
হক সাহেবের বীরত্ব ও শক্তিমত্তা নিয়ে যত কথা ও কাহিনি প্রচলিত আছে তা বাংলার কোনো নেতা সম্পর্কে খাটে না। এদিকে তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। বি.ডি হাবীবুল্লাহও এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যেখানে তরুণ হক সাহেব নারকলে খান এক বসায় বিশ-বাইশটি, আস্ত সুপারি দাঁত দিয়ে চিবিয়ে গুঁড়ো করেন কিংবা শক্তিদর্পী কাবুলিকে পাঞ্জা লড়াইয়ে অনায়সে পরাজিত করেন।
শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি অসাধারণ মেধাবী ছিলেন তা আমরা সকলেই জানি। একবার পড়লেই যে কোনো কিছু মনে রাখা, বন্ধুর টিটকারি শুনে মাত্র ছয়মাসের প্রস্তুতিতে গণিতে স্নাতকোত্তর হওয়া কিংবদন্তির ফজলুল হকের পক্ষেই সম্ভব।
১৮৯৭ সালে ওকালতি পাস করেন। স্যার আশুতোষের শিক্ষানবিশি করার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র তিনজন: স্যার এন এন সরকার, স্যার বি এল মিত্র এবং ফজলুল হক নিজে। আশুতোষের সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগকে তিনি পরম সৌভাগ্য মনে করতেন এবং পরবর্তীতে আশুতোষের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। কেননা হক সাহেবের উত্থানে আশুতোষের অবদান কোনোঅংশেই কম ছিল না। এমনকি আশুতোষের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ৷ শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তিনি বলেছিলেন,
‘ দুনিয়াতে আমার একমাত্র ভাই ছিল শ্যামাপ্রসাদ। আজ আমি তাকেও হারালাম। ‘
রাজনৈতিক মতাদর্শে শ্যামাপ্রসাদ হক সাহেবের ঠিক উল্টো। তবু শ্যামাপ্রসাদ হন হক সাহেবের ভাই। এমন ‘ব্যতিক্রমী’ ঘটনায় হক সাহেবপট রাজনৈতিক জীবন ভরপুর।
আইনজীবী হিসেবে ফজলুল হকের বুদ্ধিমত্তার তুলনা মেলা ভার৷ তরুণ আইনজীবী ফজলুল হক একবার নিজেকে মক্কেলকে বেকসুর খালাস প্রমাণ করতে আদালতে খেজুরগাছ কাটার দা, দড়ি এবং দা রাখার ঝাপি নিয়ে হাজির হন। আদালতে রীতিমতো অভিনয় করিয়ে নিজের মক্কেলকে নির্দোষ প্রমাণ করেন। আশুতোষের মতো আরও একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ফজলুল হককে পুত্রতুল্য স্নেহ করতেন। তিনি হলেন নবাব সলিমুল্লাহ। নবাব তাকে আদর করে বলতেন,
সলিমুল্লাহর আগ্রহেই তিনি ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন৷ ফজলুল হক কিছুকাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটগিরিও করেছেন। জামালপুরে এসডিও থাকাকালীন একটা ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না –
‘ ফজলুল হক লুঙ্গি, পাঞ্জাবী, কিস্তি টুপি পরে চটিজুতা পায়ে দিয়ে ছদ্মবেশ ঘোরাফেরা করতেন। একদিন শুকনো এক পুলের নিচে আছরের নামাজঅন্তে ফজলুল হক অমনি ছদ্মবেশে দোয়া দুরুদ পাঠ করছিলেন৷ তখন পুলের ওপরে বসে কিছু লোক একটি মোকাদ্দমায় সাক্ষ্যপ্রদান নিয়ে আলোচনা করছিল। পরেরদিন তার আদালতে লোকগুলো হাজির হয় এবং ভিন্নরকম সাক্ষ্য দিতে শুরু করলে তিনি তাদেরকে ধমক দিয়ে বলেন, “তোমরা পুলের উপরে বসে বলেছিলে একরূপ, আর এখন অন্যরূপ বলছো কেন?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সাক্ষী সত্য বলতে শুরু করে। ‘
অন্যায্যভাবে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হলে হক সাহেব পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তখন তাকে উৎসাহ দিয়ে আশুতোষ মুখার্জি বলেন,
১৯১৩ সালের নির্বাচনি রাজনীতিতে হক সাহেবের হাতেখড়ি। ঢাকার একটি বর্ণহিন্দুপ্রবণ আসনে রায় বাহাদুর মহেন্দ্র মিত্রকে কুপোকাত করে তার রাজনীতিতে প্রবেশ। এরপর নিজের উপস্থিতি জানান দিতে আইনসভার প্রথম অধিবেশনে তার বক্তৃতা শুনে লর্ড কারমাইকেল স্পিকারের আসন থেকে উঠে এসে তাকে অভিনন্দন জানান।
নবাব সলিমুল্লাহর পুত্র নবাব হাবিবুল্লাহসহ অনেক জমিদারের সাথে হক সাহেবের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রাখতেন বর্ণহিন্দু ভূস্বামীদের সাথেও। তবু জমিদারিপ্রথাকে খতম করার চিন্তা তিনি কোনোদিন বাদ দিতে পারেননি। কারণ এই জমিদারি ও মহাজনি প্রথার শিকার বাংলার লাখ লাখ গরিবের কৃষকের দুঃখ-দুর্দ্দশার সাক্ষী তিনি নিজে।
রাজনীতিকে ধর্মের সাথে মেলানো আজকে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক হক সাহেব রাজনীতির দাবা খেলায় আজীবন ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন নিজের প্রয়োজনে৷ যেমন লর্ড কারমাইকেলের আমলে ‘এপিফেনি’ পত্রিকায় একজন খ্রিষ্টান পাদরি নবি মুহাম্মদকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক রচনা লিখলে মুসলমানগণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে কারমাইকেল বাধ্য হয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে ফজলুল হককে স্মরণ করেন। হক সাহেব মুহূর্তেই লুঙ্গি, পাঞ্জাবী, চটিজুতা ও রুমি টুপি পরে হাজির হলেন লাট ভবনে। আর, গুলির ঘটনা শুনেই দৌঁড়ে গেলেন মুসল্লিদের ভিড়ে। সরাসরি দাঁড়ালেন পুলিশের রাইফেলের সামনে। মোটকথা, এই ঘটনা হক সাহেবকে মুসলমানদের কাছে আরও জনপ্রিয় করে তুলল।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ – একইসাথে দুইটি দলের কর্তাব্যক্তি ছিলেন হক সাহেব৷ কিন্তু খেলাফত আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ ত্যাগের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন,
‘ যদি সমস্ত হিন্দু ছেলে স্কুল-কলেজ ত্যাগ করে, তাতে তাদের যায় আসে না৷ কারণ তাদের পরিবারের সবাই শিক্ষিত। তারা বাড়ি বসে মা-বাপের কাছে লেখাপড়া লিখতে পারবে এবং সময় হলে স্কুলেও ফিরে আসবে। কিন্তু মুসলমান ছেলে স্কুল-কলেজ ছাড়লে সর্বনাশ। তাদের পরিবারের সবাই অশিক্ষিত। তারা এমনভাবে গোল্লায় যাবে যে আর স্কুল-কলেজে ফিরে আসবে না। মুসলমান শিক্ষাক্ষেত্রে আরও অর্ধশতাব্দী পিছিয়ে যাবে। ‘
অর্থাৎ রাজনৈতিক হুজুগে কোনো বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। বরং সার্বিক স্বার্থ বিবেচনা করে মতামত ও কর্মপন্থা ঠিক করতেন। এই ‘সার্বিক স্বার্থ’ দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা হক সাহেবের একটি অকৃত্রিম বৈশিষ্ট্য। তা সেই সিদ্ধান্ত যতই অজনপ্রিয় কিংবা সমালোচিত হোক না কেন।
১৯২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী হয়ে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য যা করেছেন তা অন্যকোনো নেতার পক্ষে কতটা সম্ভব ছিল বলা কঠিন। তবু তার মন্ত্রিত্ব টেকিনি। কেননা বাঙালি মুসলমান ফজলুল হককে টেনে নিচে নামানোর কাজটি আনন্দ নিয়েই করেছিলেন অন্যান্য মুসলমান আইনসভার সভ্যবৃন্দ। সেই সময়ে তাকে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চিত্তরঞ্জন দাস।
’৩৭ সালের নির্বাচনে খাজা নাজিমুদ্দীনকে তার জমিদারি পটুয়াখালীতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন হক সাহেব। ফজলুল হকের মতো প্রচার-প্রচারণা আর কোনো নেতা করতে পারতেন না এবং পারবেন না। তার নিজস্ব স্টাইল অননুকরণীয়। যেমন পটুয়াখালীতে প্রচারণা চালাতে গিয়ে জনসভায় পৌঁছানোর আগেই নৌকার মাঝি-মাল্লাদের সাথে তাদের মতো পোশাক পরে বসে পড়লেন, খেলেন তাদেরই খাবার এঁটো কলা ও পান্তা ভাত এবং খাওয়ার পর দাঁড় বাইতে বাইতে হাজির হলেন জনসভায়! এমন নির্বাচনি কৌশল হক সাহেব ছাড়া কার মাথায় আসবে?
নির্বাচনে জয়ী হলেন কৃষক প্রজা পার্টির ওপর ভর করে। কিন্তু মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন করে প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের পর নিজ দলকে উপেক্ষা করেন, নিজের মনোনয়ন দেওয়া কৃষক প্রজা দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজে গিয়ে বক্তৃতা করে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে জয়ী করে আনার মতো ঘটনাও একাধিকবার হক সাহেব ঘটিয়েছেন।
উপমহাদেশের রাজনীতিতে হক সাহেব এক অনন্য নাম৷ বহুমাত্রিক হক সাহেবকে এই জীবনীগ্রন্থে পাই। তবে তাকে নিয়ে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন পাইনে। বি.ডি. হাবীবুল্লাহ ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। তাই ফজলুল হকের সীমাবদ্ধতাগুলো তিনি দেখতে পাননি, আসেনি কোনো পর্যবেক্ষণ। এই বিবেচনায় বইটি হক সাহেবের গুণমুগ্ধের মুগ্ধতা প্রকাশের পয়লা স্বীকৃতি হয়ে রইল।
জীবনি হলেও লেখকের লেখনির মাধুর্য্যে এক প্রকার সাহিত্যিক গড়িমাও আছে বইটির। সাহিত্যিক গূণ বিচারে একশ তে একশ। শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক সম্পর্কে একটুও হলেও জানতে পেরেছি ভেবে ভাল লাগছে। ’৪৭ পূর্ব এবং ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পরবর্তী সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ত্ব ছিলেন তিনি। ধর্মীয় আইডেন্টির অপব্যবহারের রাজনীতি এ উপমহাদেশে মজ্জাগত সমস্যা। শের-এ-বাংলা মানুষকে মানুষ হিসেবে আপন করে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং সাধারণ মানুষও তাকে ভালবেসেছিল। এই বাংলার মাটিও তাকে ভালবেসেছিল।
বইয়ের আশি ভাগই বিশেষণ এ ভরা। রাজনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেমন, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পরে কংগ্রেস এর সাথে সমঝোতায় ব্যর্থতা এবং লীগ এর সাথে সরকার গঠন, শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার পতনের কারণ, ১৯৫৪-৫৭ এর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, এসব রয়ে গিয়েছে একরকম উপেক্ষিত। শেরেবাংলা এর একজন কাছের ব্যক্তি হিসেবে পর্দার অন্তরালের রাজনৈতিক ঘটনাগুলো লেখকের অবলোকন করার কথা, সেসব বর্ণনা করে লেখক তাঁকে আরো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন।