ভ্রমণ কাহিনী পড়ার অভিজ্ঞতা আমার খুবই কম। কিন্তু উপভোগ করি বেশ। একটানা পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না। ভালো লাগে, ধীরে ধীরে এর রসাচ্ছাদন করতে। হারিয়ে যাই লেখকের সাথে, বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা আর মানুষের ভীড়ে।
তবে সমরেশ বসু বা কালকূটের লেখার সাথে আগেই থেকেই পরিচয় হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তার লেখনী মুগ্ধ করে রাখত আমায়। 'নির্জন সৈকত' তার ব্যতিক্রম নয়।
'তারপর সেই ঘেরাটোপ কখন আরো ছোট হয়ে এসেছে। সহসা নিশ্বাস আটকে গিয়েছে বুকের মধ্যে। রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠেছি। দু'হাত দিয়ে সরাতে চেয়েছি...' লেখক এই ঘেরাটোপ থেকে মুক্তির আশায় বেরিয়ে পড়েছেন! '... ফেনিলোচ্ছল অট্টহাসে কেঁপেছে সেই ঘেরাটোপ।' নির্জনে সুমদ্রের বিশালতার কাছে নিজেকে করতে চেয়েছেন সমর্পণ।
কিন্তু চাইলেই কি মুক্তি পওয়া সম্ভব? ট্রেনে পরিচয় হয় অবুদি, শিবিদি, সেজদি, ছোট বৌদি আর রেণর সঙ্গে। এছাড়া রয়েছে নানা ইন্টারেস্টিং চরিত্র, আর তাদের বিচিত্র সব ইতিহাস। যেমন- সঞ্জয়, প্রণববাবু, মহিমবাবু, সিদ্ধকামবাবু, খেঁকিয়ানন্দ। তাদের সংস্পর্শ যেন নতুন দুয়ার উন্মোচন করে দেয়!
নির্জন সৈকতকে সার্থক ভ্রমণকাহিনী বলা যায় কিনা সে বিষয়ে আমার ধারণা নেই। তবে কালকূটের এ সুখপাঠ্য উপন্যাস পড়ে যদি আপনার সমুদ্রে যেয়ে গা ভিজিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে, সমুদ্র আর আকাশের বিশালতা যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, সেদিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে! আপনি একটুখানি নির্জনতার খোঁজ করবেন কিন্তু পাবেন কি?
কালকূটে মুগ্ধ হয়েছি শাম্ব পড়ার পর, তারপর অমৃত কুম্ভের সন্ধানে পড়ে। এবার পড়লাম নির্জন সৈকতে। ভালো লাগার কেবলই উত্তরণ হয়েছে একটার পর একটা বই পড়ে। অথচ এই আমি সেই কবে কালকূটের আরেক বিখ্যাত বই কোথায় পাবো তারে শুরু করে শেষ করতে পারিনি। সে বই তোলা আছে কখনো পড়বো বলে। কেন পারিনি? কারণ শুরুতে কালকূট তার লেখায় একটা জটিল ভাষার আস্তরন তৈরি করেন। মনে হয় যেন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কথার জটিলতায় বইয়ের সামনে এগোনোটা কঠিন মনে হয় (অন্তত আমার)। তবে কালকূটের ভাষায়ই বলি এহো বাহ্য। ভেতরটা সরল, সহজ, অনাড়ম্বর কিন্তু অসাধারণ। নির্জন সৈকতেও একদম তাই। এ হলো লেখকের পুরী ভ্রমণের বৃত্তান্ত। তবে কালকূট তো আর আমাদের মতো ব্যস্ত সাধারণ টুরিস্ট নন যে ঝটপট দুচারদিনের জন্য ঝটিকা সফরে গিয়ে শখানেক ছবি তুলে মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রসাদ খেয়ে আর সমুদ্র স্নান করে ফিরে এসে ভ্রমণকাহিনী ফাঁদবেন। গিয়েছিলেন তো স্রেফ একটা কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে ট্রেনের থার্ড ক্লাসে কোনমতে জায়গা করে নিয়ে। কতদিনের জন্য যাচ্ছেন, কোথায় গিয়ে উঠবেন, কোথায় কোথায় বা ঘুরবেন কোন প্ল্যান করা নেই। ভবিতব্য যেদিকে টেনে নিয়ে যায় সেখানেই যাওয়া হবে, তবে নির্জন সৈকতে ছিল তার একলা হবার সাধ। একলা কি হতে পেরেছিলেন? তা পারেন নি। মানুষ আসলে একা বলেই অবচেতন মনে সে সঙ্গ খুঁজে বেড়ায়, সঙ্গও তাকে খুঁজে বেড়ায় বোধ করি।লেখক ই বা তার ব্যতিক্রম হন কিভাবে, বনবাসী সন্ন্যাসী তো আর নন। তবু নির্জনতা পেয়েছিলেন, নিজেকে ও অন্যকেও বোঝার মতো নির্জনতা।
বর্ষার অফ সিজনের পুরী। যাবার পথেই পরিচয় হয়েছিল একদল বিধবা প্রৌঢ়া আর এক বিষণ্ণ তরুণীর সাথে। অবুদি, শিবিদি, ছোট বৌদি আর রেণু। এদের সাথে পরিচয় তো সেই ট্রেনে যাবার সময় থেকেই ট্রেনের বসার জায়গার দখল নিয়ে। শুরুতে ওদিক থেকে ছিল সন্দেহ, পরে তা পরিবর্তিত হয়েছিল ঘনিষ্ঠ ভালোবাসা আর স্নেহে। শুরুতে উঠতে হয়েছিন এক অন্ধকার অস্বাস্থ্যকর ধর্মশালায়। সেখান থেকে মহিম বাবুর হোটেল নোঙর-ঘর এ ঠাই মিলেছিল। সিংহের মতো রাশভারী এককালের স্বাধীনতা সংগ্রামী মহিম রায়কে দেখে বাইরে থেকে কঠোর-কঠিন বলেই মনে হয় তবে ভেতরে তার রয়েছে একটি কোমল স্নেহশীল মন। নোঙর-ঘরের বয় কাম বেয়ারা কাম হ্যাল্পিং হ্যান্ড সঞ্জয় নায়ক। নায়ক তার পদবী মাত্র, তবে তার জীবনে আছে এক রহস্যময়ী নারী বিম্বাধরী। দেখা হয়েছিল খেঁকিয়ানন্দ ব্রহ্মচারীর সাথে। আদি রসাত্মক বৈষ্ণব পদাবলী বলে যিনি আশ্রমের জন্য চাঁদা তোলেন আবার অন্যদিকে অসম্ভব সুন্দর কীর্তন গান। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যিনি বলেছিলেন ঈশ্বরকে পাবার আশায় পঁচিশ বছর হলো ঘর ছেড়েছিলেন, তবু ঈশ্বরকে পান নি। ছিলেন মানব মনের অন্ধকার দিকের কারবারী বিলিতি কোম্পানীর এজেন্ট প্রণববাবু আর মহিম রায়ের বন্ধু একদা স্বাধীনতা সংগ্রামী পরবর্তীতে বিজনেস ম্যাগনেট সিদ্ধকাম বাবু, রম্ভায় যিনি কাটাচ্ছিলেন ভোগের জীবন, তবু সে জীবন কালকূটের দৃষ্টিতে মহাশশ্মান। আরও দু’চারটে গৌণ চরিত্র যে ছিল না তা নয়। মানুষের কথাই বলেছেন কালকূট। প্রকৃতির মতোই বিচিত্র মানুষ। ছোট বৌদিদের সাথে গরুর গাড়িতে চেপে কোনারকও গিয়েছিলেন, গিয়েছিলেন চিল্কা হ্রদের পাশে প্রকৃতির আপন আলয় রম্ভাতেও। তবু সেসব বর্ণনা সামান্য।পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দির নিয়েও খুব বেশি লেখেন নি, তেমনভাবে লেখেন নি সমুদ্র সৈকতের কথাও। পুরীর নির্জন সৈকতে গিয়েও লেখক প্রকৃতির বর্ণনা কমই দিয়েছেন, বলেছেন মানুষের কথাই। এই কাহিনী নিয়ে তপন সিংহ সিনেমা বানিয়েছিলেন। জানিনা সেটা কেমন হয়েছে, তবে বইটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। যেমন মুগ্ধ করে চলেছেন কালকূট।
কালকুটের রচনা সবসময় মন ভালো করে দেয় । এই গল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন চরিত্রের ওঠা নামার সাথে সাথে সামান্য ইতিহাস আর বিতর্কিত বিষয় ও ছুঁয়ে গেছেন সুন্দর ভাবে। এক নাগারে শেষ করার মতো বই । কেবল শেষ ৬-৭ পাতা কেমন দ্রুত এগিয়ে গেল - গল্প কেমন দুম করে শেষ হয়ে গেল !!