Jump to ratings and reviews
Rate this book

বঙ্গে স্বূফী - প্রভাব

Rate this book
ধর্ম্মাধর্ম্মের কোন্দল যত একখানে নিয়ে যায়
স্বপন সে এক, নানামুখে তব বিবিধ ব্যাখ্যা পায়।

155 pages, Hardcover

Published February 1, 2011

10 people want to read

About the author

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
1 (25%)
4 stars
2 (50%)
3 stars
1 (25%)
2 stars
0 (0%)
1 star
0 (0%)
Displaying 1 of 1 review
Profile Image for লোচন.
207 reviews56 followers
February 18, 2021
বইটার মানানসই নাম হতো— বঙ্গে সুফিবাদের বিস্তার ও বিবর্তন। গবেষক মোটাদাগে চারটে ভাগে ভাগ করেছেন প্রায় হাজার বছরের ইতিহাসকে, সেখানে হোঁচট যে খাইনি তা বলব না, কিন্তু ইতিহাস-ভ্রমণটা অবিস্মরণীয় ছিল। বইটা ছোট্ট, মাত্র ১৬০ পৃষ্ঠা, তারপরেও এইটুকুন পরিসরে এতকিছু আঁটানোর দুঃসাহসী চেষ্টা সফলই হয়েছে বলা যায়। সংক্ষিপ্ত একটা আলোচনা করা যাক।


—প্রথম ভাগ: ইসলামে সুফিবাদের জন্ম ও প্রসার (ষষ্ঠ—নবম শতাব্দী)—

সুফিবাদ সবসময়ই ছিল ব্যক্তিগত আন্দোলন। সুফির ভেতরে ইলমুল মারফত কিংবা হিকমাহ— গুপ্তজ্ঞানের জন্য যে চিরতৃষ্ণা, সেই তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে তাদের মাঝে দুনিয়া ও বিষয়াবলীর প্রতি অনাসক্তি চলে আসত, বৈরাগ্য ও ভাবের প্রাবল্য দেখা দিত। নবীজীর জীবদ্দশা হতে বিবিধ সাহাবী ও পাঁচ খলিফার সময় পার করে, শাস্ত্রীয় ইসলামের একটা অন্যতম অংশ হিসেবে সুফিবাদ ছড়াতে থাকে। অষ্টম শতাব্দীর নব্য মুসলিমদের মাধ্যমে আরো তা জনপ্রিয় হয়; পরবর্তীতে পারস্য, বোখারা, সমরখন্দে প্রচারিত হতে থাকে সমান তালে। বায়েজিদ বোস্তামি, মনসুর হাল্লাজ, জুনাইদ বাগদাদীর মতো মনীষীরা এই ইজমে নতুন প্রাণ সঞ্চার করলেন, আর ধীরে ধীরে মূল ইসলাম হতে আলাদা কিছু তত্ত্বের দেখা পাওয়া যেতে লাগল। তিনটি প্রধান তত্ত্ব এরকম:

১. মুসলমান হতে হলে যেমন পাঁচ জিনিসে বিশ্বাস করতে হয়— কালেমা নামায রোজা হজ্ব যাকাত— সুফিদের তেমন বিশ্বাস আনতে হয় তিনটিতে:
—জিকির করা,
—রাবিতা (আল্লাহর সাথে সংযোগ-সূত্র স্থাপন),
—মুরাক্বাবাহ করা (ধ্যান)।

২. মুসলমান যেমন দুইটি ধাপ পালন করলে প্রকৃত মু’মিন হতে পারে— ঈমান আনা ও তদানুসারে আমল করা— সুফিবাদে সেই ধাপ চারটি, মতান্তরে পাঁচটি:
—ঈমান আনা
—ত্বলব করা (অনুসন্ধান)
—ইরফান (জ্ঞানলাভ)
—ফানা ফিল্লাহ (আল্লাহর স্বরূপ অবলোকন করা)
—বাক্বা বিল্লাহ (আল্লাহর মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া)

৩. শাস্ত্রীয় বিশ্বাসে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস বা তাওহীদ যেমন এক কালেমা তাইয়্যিবাতেই নির্দিষ্ট ছিল, সুফিদের ক্ষেত্রে তা বিভাজিত হয়ে গেল দুই ভাগে:
—তাওহীদে ওজুদী— সকল সৃষ্টিতেই স্রষ্টা আছেন। সৃষ্টির সেবাতেই স্রষ্টার সেবা।
—তাওহীদে শহুদী— সৃষ্টির কথা ভুলে গিয়ে স্রষ্টায় বিলীন হবার চেষ্টা করতে হয়।

তখনকার অধিকাংশ সুফি সাধক এই মৌলিক ব্যাপারগুলোয় একমত ছিলেন।

—দ্বিতীয় ভাগ: বাংলায় সুফিদের প্রবেশ ও ধর্মপ্রচার (দশম—যোড়শ শতাব্দী)—
সুফিদের আগমনের পূর্বে বাংলায় তন্ত্রমন্ত্র সাধনার চল ছিল। কামরূপ রাজ্যের কামাখ্যা মন্দির হতে মন্ত্রলাভ করা বিভিন্ন সুরাচারী বামাচারী তান্ত্রিক এবং তাদের মারণ-উচাটন-বশীকরণ বিদ্যার চাহিদা ধীরে ধীরে সুফিদের প্রভাবে নিস্ক্রিয় হতে শুরু করে। বঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্র ও চট্টলা— এই চার জায়গা তখন সুফিদের প্রধান বিচরণক্ষেত্র। সুফি দরবেশগণ মাত্রই ছিলেন ভ্রাম্যমাণ। মায়ার বন্ধনকে ভাবতেন আল্লাহর তরফ থেকে দেওয়া কোন পরীক্ষা, সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতেন, স্বজন—স্বগৃহ—স্বদেশত্যাগী হয়ে বেদুইন-স্বভাব নিয়ে চষে বেড়াতেন বাংলার মাঠঘাটপ্রান্তর।

তবে ধীরে ধীরে বেদুইন-স্বভাব সরে গিয়ে স্থায়ীত্ব চলে আসে। তারা খানক্বাহ তৈরি করেন, ভক্ত ও অনুসারী বাড়তে থাকে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সেখানে প্রবেশাধিকার থাকত। মুসলিম রাজশক্তি থেকেও এই দরবেশদের অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হতো, সুলতান থেকে শুরু করে মুসলিম শাসক সকলেই উপদেশ নিতে যেতেন সেখানে। লেখক বলছেন: বাঙালিকে ‘বাঙালি মুসলিম’ করার ক্ষেত্রে, মানে ইসলাম প্রচারে চট্টলার একেকটি খানক্বাহ যে ভূমিকা রেখেছে; সুলতান মাহমুদ গজনবী, মুহম্মদ বিন কাসিম, আওরঙ্গজেব, আকবর— এরা সবাই মিলে নাকি তার অর্ধেকও পারেননি!

যোড়শ শতাব্দীতে আকবরের আইন—ই—আকবরীতে সুফীদের চৌদ্দটি দল বা ফিরকার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে বাংলায় সফল প্রচার হয়েছে চারটির।
—(শায়খ বাহাউদ্দিন মুলতানির) সোহরাওয়ার্দিয়া ফিরকা
—(খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর) চিশতীয়া ফিরকা
—(সৈয়দ মুহাম্মদ জিলানীর) ক্বাদিরিয়া ফিরকা
—(খাজা মুহম্মদ বাকি বিল্লাহর) নকশবন্দীয়া ফিরকা

এদের মাঝে চিশতীয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া ফিরকায় গান-বাজনার প্রতি দুর্বলতা দেখা যায়। এই ফিরকার সুফীগণ সুরেলা জিকিরের তালে তালে ঘুরে ঘুরে নড়তেন, নাচতেন, এবং আল্লাহর নিকটাবর্তী অবস্থায় পৌঁছে গেলে (হলক্বহ), সহ্য না করতে পেরে অচেতন হয়ে যেতেন।

দশম শতাব্দীতে উপমহাদেশে ইসলামের প্রবেশের পর থেকে ভারতীয় সাধনা ও ভাবধারার সাথে এর মিশ্রণ ঘটতে শুরু করেছিল। একই সাথে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে বিবর্তিত হতে থাকলো সুফিবাদের মূল তত্ত্বগুলো। জিকির ছিল শুরুতে নিজের মনে কিংবা নিম্নস্বরে করার জিনিস, সেখানে সেটা হতে লাগল উচ্চস্বরে, তালে তালে, ভারতীয় দমে দমে প্রাণায়াম-সাধনার মতন। রাবিতা মানে ছিল কোন বিদ্বান শিক্ষকের সহায়তায় আল্লাহর সাথে প্রত্যক্ষ সূত্র-সংযোগ। সেটা হয়ে গেল শিক্ষকের সাধনা, গুরু/মুর্শিদ/পীরই মুখ্য। বান্দা তো তুচ্ছ, আল্লাহর নূরে সামান্য বান্দার বিলীন হবার চেষ্টা দুঃসাহস ছাড়া কিছু নয়। বরং বান্দাকে হতে হবে গুরুতে বিলীন; ফানা ফিল্লাহ নয়, ফানা-ফিশ-শায়েখ। মুরাক্বাবাহ মানে ছিল সিজদায়, ধ্যানে পড়ে থাকা। সেটাতে যুক্ত হলো যোগশাস্ত্রের কুণ্ডলিনী সাধনার কাছাকাছি আরো জটিল তত্ত্ব— শরীরের ভেতরে নূরের ছয়টি আলোক-কেন্দ্র (লত্বিফাহ) আছে, নির্দিষ্ট নিয়মে ধ্যান করলে এদের মাধ্যমে আল্লাহর আরো নিকটাবর্তী হওয়া যায়।

এভাবে আরো কিছু বছর কেটে যাওয়ার পর উত্থান ঘটল কবির-নানক-চৈতন্যদেবের মতন কয়েকজন প্রেমবাদী মনীষীর। এরা বৈষ্ণব সুফি বৌদ্ধ অবিশ্বাসীর ভিন্ন মতামতগুলোর মধ্যে মিল খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতেন, সাম্য—মৈত্রী—উদারতার চর্চা করতেন। তাদের প্রচেষ্টায় ধারণার সংমিশ্রণ হতে থাকে আরো প্রাকৃতিকভাবে, সেই ধারণায় ঋদ্ধ হতে শুরু করল সাধারণ মানুষ।

এভাবেই কয়েকশ বছর ধরে জন্ম নেয় cultural বা লৌকিক ইসলামে। শাস্ত্রীয় ইসলাম দুনিয়ার সব জায়গায় অপরিবর্তনীয়, কিন্তু লৌকিক ইসলাম স্থানভেদে আলাদা— পারস্যে এক, আরব্যে আরেক; বাংলায় আবার হিন্দু, বৌদ্ধ, আর্য, অনার্য, বৈষ্ণব সবার কাছেই সে সমান ঋণী। লেখক বলছেন, ‘সাধারণ বঙ্গীয় মুসলমানদের মধ্যে এখনো তাহাদের ভারতীয় পিতৃপুরুষ হইতে লব্ধ বা পরবত্তীকালে গৃহীত যত হিন্দু ও বৌদ্ধ আচার-ব্যবহার প্রচলিত আছে, এবং চিন্তা ও বিশ্বাস ক্রিয়া করিতেছে তাহা হিসাব-নিকাশ করিতে গেলে অতি চমৎকার পৃথক পুস্তক রচিত হইতে পারে।’

—বাউল (সপ্তদশ—অষ্টাদশ শতাব্দী)—
বৈষ্ণব ও সুফীর সম্মিলিত প্রভাবে এবারে নিরক্ষর শ্রেণীর ভেতরে মর্মচিন্তার প্রকাশ ঘটতে শুরু করলো। হরিগুরু, বনচারী, সেবাকমলিনী, অখিলচাঁদ— এই বাউল চতুষ্টয়কে ঘিরে নদীয়ায় গড়ে উঠল বাউলের আখড়া। তারা বাউল, তার বাতুল, তারা সন্ধানে পাগল। কার সন্ধান? অনামক, সাঁই, মনের মানুষ, অচিন পাখি, মন-মনুরা, দরদিয়া— অসংখ্য নাম, কিন্তু জিনিস একই। চিশতীয়া আর সোহরাওয়ার্দিয়া ফিরকার মাঝে যে সঙ্গীত-প্রেম ছিল, বাউলের হৃদয়ে এসে তা প্রস্ফুটিত হলো। মারফতি, মুর্শেদি, দেহতত্ত্ব— বাউলের গানই তার শাস্ত্র, তার মত, তার ইতিহাস। এই দর্শনে ‘রাবিতা’র প্রয়োজন কমে গেল, বাউল বিশ্বাস করে মনের মানুষকে পেতে হলে খুঁজতে হবে নিজে গিয়ে; গুরু এখানে সাহায্য করতে পারেন, কিন্তু সাধনা করে তো আর দিতে পারেন না। প্রেমধর্মের কাছে পান্ডিত্য নি��্প্রয়োজন, জ্ঞান তুচ্ছ।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে হাজি কিরামত আলি ও হাজি শরীয়তুল্লাহ ধর্মসংস্কারে নামেন, তাদের জনপ্রিয়তার কারণে বাউলদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। হাজি শরীয়তুল্লাহের ছেলে দুদু মিয়া এই সংস্কার আরো জোরদার করলে একটা সময় বাউল দর্শন গুটিয়ে আসে। শাস্ত্রীয় ইসলামের চর্চা শুরু হয় আবার।

—পীরতত্ত্ব (অষ্টাদশ—উনবিংশ শতাব্দী)—
ধর্ম সংস্কার করে দেশীয় সংস্করণকে তাড়ানো হল ঠিকই, কিন্তু সেই ফাঁকা জায়গা পূর্ণ করা হলো পারস্য, তুর্কিস্তান, আফগানিস্তান, সমরখন্দ— এসব এলাকার লৌকিক ইসলাম থেকে আসা ‘পীর’ কনসেপ্ট দিয়ে। এই দেশগুলি কণিষ্কের সময় (৭৮ খ্রিষ্টাব্দ) হতে কয়েক শতাব্দী আগ পর্যন্তও বৌদ্ধধর্মী ছিল, মুসলমান হবার পরেও সেই প্রভাব মিশে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। বৌদ্ধ ‘থের’ (স্থবির) শব্দ থেকেই তাই ফারসি ‘পীর’ শব্দ আসে, ‘থের’ মৃত্যুবরণ করলে তার সমাধিতে ধূপ—ধুনা জ্বালিয়ে, চন্দন ছিটিয়ে, মাথা ঠেকিয়ে দেবতার মত সম্মান দিয়ে করা ‘চৈত্য—পূজা’ হয়ে যায় পীরের কবরে লোবান জ্বালিয়ে, আতর—গোলাপজল ছিটিয়ে, সিজদা দিয়ে করা মাজারপূজা। বিবর্তন।

দ্বিতীয়তঃ, রাবিতার ধারণাও এই সমান্তরালে এসে আরেকটু পালটে গেল। গুরু রাস্তা দেখাবেন, আমি সেই পথে চলব— এ ধারণা তখন খারিজ। পীর দীর্ঘকাল সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্যলাভ করেছেন, বিভিন্ন ক্বারামত, আল্লাহপ্রদত্ত ক্ষমতা পেয়েছেন। আমার পক্ষে তো সেসব সম্ভব নয়। আবার পীরের মাঝে বিলীন হওয়াও আরেক সাধনার কাজ। তার চেয়ে আমি তার ভৃত্য হয়ে যাই। মুরিদ। নাজাত পেতে চাইলে তাকে উত্তরোত্তর সেবা-পরিচর্যার মাধ্যমে সন্তুষ্ট রাখতে হবে, তার আদেশ মানতে হবে, বিনিময়ে আল্লাহর কাছে পীর আমার জন্য ওকালতি করবেন।

বাংলা খুব দ্রুত ছেয়ে গেল এই মতবাদে, এমনকি হিন্দুদের ধর্মগুরু ও গ্রাম্য দেব-দেবীরাও পীরতত্ত্বের ভেতরে সংস্থাপিত হতে লাগলেন। সত্যনারায়ণ হয়ে গেলেন সত্যপীর। মাঝিমাল্লারা প্রমত্ত নদী পার করার সময় যে আল্লাহ, নবীজী কিংবা দেবদেবীকে ডাকত, সেখানে সব এক করে পীরের নাম ঢুকে গেল— ‘আল্লা, নবী, পাঁচপীর, বদর বদর!’ এই কারণে মাজারে এখনো দেখা যায় দুই ধর্মের মানুষই ভিড় করে শিরনি দিচ্ছে, মানত করছে।


এভাবে সুফিবাদের গোড়া হতে একেবারে ডগা পর্যন্ত পুরো ইতিহাস তথ্যবহুল, সহজ বর্ণনায় লিখে গেছেন এনামুল হক। সুনীতিকুমারের যোগ্য উত্তরসূরী লোকটা, কোন সন্দেহ নেই! নামের উচ্চারণগুলো অনেক কষ্ট দিয়েছে, আউলে যাচ্ছিলাম জায়গায় জায়গায়। কিন্তু নোট করে পড়ায় সামলে নেওয়া গেছে। সময় নিয়ে পড়া সার্থক!
Displaying 1 of 1 review

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.